হুমায়ূন-উপন্যাস : মানুষের প্রতি ভালোবাসার দলিল – মজিদ মাহমুদ

হুমায়ূন-উপন্যাস : মানুষের প্রতি ভালোবাসার দলিল

মজিদ মাহমুদ

বাংলাভাষার পাঠক পাঠিকাদের বহুবিধ আনন্দ-বেদনা দিয়েছিলেন হুমায়ূন। বলা চলে প্রায় চার দশক ধরে একটা জাতির কথকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। হরবোলার মতো যে কোনো প্রাণির ভাষা তিনি অনুকরণ করতে পারতেন। সকল চরিত্রে তিনি ছিলেন মানানসই। মানবচরিত্রের সকল মনঃস্তত্ত্ব তার জানা ছিল এমন নয় । কিন্তু সকল চরিত্রের গভীরে যে বেদনা ও আনন্দের ফল্গুধারা– তা তিনি আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন। আপাত কঠিন ও রাশভারি চরিত্রের মধ্য থেকে তিনি বের করে আনতেন উইট ও স্যাটায়ার। তার কাছে সকল কিছু ছিল ভালো; তিনি মানুষকে কুটিল ও জটিল করে সৃষ্টি করতে পারতেন না। সকল মানুষের মধ্যে রয়েছে তার নিজস্ব বসবাসের আনন্দ ও তার নিজের মতো একটি নৈতিকতা বোধ। হুমায়ূন ব্যক্তি-মানুষের এই মহত্তম দিকটি উদ্ঘাটন করেছিলেন।

তাঁর যে কোনো রচনা মানেই মন ভালো হয়ে যাওয়া। কঠিন-কঠোর ও হতাশাময় জগতের চাপ থেকে কিছুটা মুক্তি পাওয়া। তাঁর পাঠকরা আরও বহুকাল ধরে ঈদ-পার্বন ও একুশের বইমেলায় তাঁর অনুপস্থিতি প্রবলভাবে টের পাবেন। তাঁর মৃত্যুর পরে এত অল্প সময়ের মধ্যে যথার্থ সাহিত্যিক মূল্যায়ন সম্ভব নয়। তবে এ কথা বলা যায়, সমকাল যাকে নিয়েছে মহাকাল তার প্রতি বিরূপ হবে বলে মনে হয় না। তবু বর্তমান আলোচনাটি তাঁর উপন্যাস নিয়ে একটি অনপেক্ষ সাহিত্যিক মূল্যায়ন প্রয়াস।

নন্দিত নরকে - হুমায়ূন আহমেদ | Buy Nondito ...

এক.
হুমায়ূন আহমেদের প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ (১৯৭২) প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে অগ্রজ সাহিত্যিকরা তাঁকে প্রবলভাবে সাহিত্যাঙ্গনে স্বাগত জানিয়েছিলেন। বাংলাগদ্য ও কথাসাহিত্যের দীর্ঘ-অচলায়তন তাঁর হাতে নড়ে উঠেছিল- এ সত্য অস্বীকার করার জো নেই। বাংলায় সাহিত্য রচনা করে একই সঙ্গে পার্বতী-পরমেশ্বরের মিলন শরৎ ভিন্ন ইতোপূর্বে আর কারো ভাগ্যে এভাবে জুটেছে বলে আমাদের জানা নেই। তবে অভিযোগ রয়েছে হুমায়ূন আহমেদ যা রচনা করেছেন তাতে বাংলা সাহিত্যের প্রবল উত্তরাধিকার অর্জিত হয়নি। মধ্যবিত্তের সস্তা সেন্টিমেন্টকে মূলধন করে কথকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন তিনি– যে কারণে তাঁর সাহিত্য একটি চরিত্রও প্রতিনিধিত্বশীল করে তুলতে পারেনি। কেবল মধ্যবিত্তের প্রত্যাশা ও স্বপ্নভঙ্গের খণ্ডচিত্র তিনি তুলে ধরেছেন। এই অভিযোগ সর্বৈব সত্য নয়।

আমরা যদি আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত করি তাহলে এই সত্য উপলব্ধি করতে পারব। যেমন বঙ্কিমের কুন্দনন্দিনী ও রোহিণীকে সময়ের অভিক্ষেপ না বলে অনিবার্য বলাই শ্রেয়। স্রষ্টা কেন আপন সৃষ্টির হন্তারক হলেন সেই প্রশ্নের উত্তর ঊনবিংশ শতাব্দির সমাজ কাঠামোর মধ্যেই নিহিত। কারণ বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহের আন্দোলন ঔপন্যাসিকের নৈয়ায়িক শৃঙ্খলাভুক্ত নয়। ঔপন্যাসিক সমাজের মধ্যে বিদ্যমান মৌল প্রবণতাগুলি চিহ্নিত এবং সংগঠিত করেন। একজন লেখকের পক্ষে কালকে নির্ণয় করা সম্ভব, নির্মাণ করা নয়। রবীন্দ্রনাথের পক্ষে কুমুদিনী ও মধুসূদনের মধ্যে যোগ ও অযোগের কাহিনী বর্ণনায় নিস্পৃহ কথকের ঊর্ধে ওঠা সম্ভব হয়নি। যদিও কুমু ও বিপ্রদাস তাঁর প্রাণের মানুষ; তবু ঔপনিবেশিক শাসনের ফলে সৃষ্ট নব-বণিকায়ন থেকে সামন্ততন্ত্রকে রক্ষা করতে পারেনি তিনি। যেমন শরচন্দ্রের পক্ষে একজন বিধবাকেও বিবাহযোগ্য করে তোলা সম্ভব হয়নি, তাই বলে তিনি বিধবার প্রেম কম মমতায় অঙ্কন করেননি। বিপ্রদাস এবং কমলকে তিনি সমান মমতায় অঙ্কন করেছেন, যা একজন লেখকের মানসিক দ্বন্দ্বের পরিচায়ক। সমগ্র জীবন শরৎচন্দ্র এই মানসিক দ্বন্দ্বভার বহন করেছেন। তাই চরিত্র গঠনে এই দুর্বলতা সমালোচকের বক্র কঠিন উক্তি এড়াতে পারেনি। তিনি নিরানব্বই ভাগ পাঠক জনতার কৌতূহল নিবৃত্ত করতে পেরেছেন। কিন্তু সে কি কেবলই কৌতূহল? গোলক চাটুয্যের অর্থনৈতিক শ্রেণি ও বৈশ্যরূপও তিনি নিখুঁত দক্ষতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন। এসব চরিত্রের উপযোগিতা ও শরৎ উপন্যাসের পাঠকপ্রিয়তা এখনো তলিয়ে যায়নি।

তিরিশোত্তর আধুনিক বাংলা কাব্য ও উপন্যাসের আঙ্গিক বিষয়ে যে আমূল পরিবর্তন হয়েছে তা রবীন্দ্রনাথ এবং শরৎচন্দ্রে উত্তরাধিকারের পথ ধরেই এসেছে। তবু তাঁরা বাংলা উপন্যাসকে বহুবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে এনে এর সম্ভাবনাকে বর্ধিত করেছেন। অসম্ভব দক্ষতায় শরৎচন্দ্রকে নতুন করে নির্মাণ করলেন তারাশঙ্কর। রবীন্দ্রনাথের নিষ্পৃহতা এবং মর্ত্যপ্রীতিকে ঘনীভূত অবয়ব দিলেন বিভূতিভূষণ। আর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় উত্তরাধিকারকে মিলিয়ে নিতে চাইলেন তাঁর মার্কসীয় বিশ্বাসের নিরিখে।

উনিশ শতকের সূচনাপর্ব থেকে বিশ শতকের শেষার্ধের সূচনাপর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশের আর্থসামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বহুমাত্রিক নির্মিতি পেয়েছে। গড়ে উঠেছে মানুষের বহুবর্ণিল অভ্যাস। ঔপনিবেশিক শাসন, দুই দু’টি মহাযুদ্ধ, ভারত বিভাজন- মানুষের বিশ্বাস এবং ধর্মের পটভূমি পাল্টে দিয়ে যুগপৎ নবীন প্রতিবেশের জন্ম দিয়েছে। মার্কসের পরিবর্তমান সামাজিক অর্থনীতি আর ফ্রয়েডের লিবিডোতত্ত্ব লেখকের মনোজগতে সৃষ্টির নব অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করে। বৈশ্বিক অনুভাবনা দৈশিক চেতনার সঙ্গে গ্রথিত করেছে। উল্লেখ্যযোগ্য পর্যায়ে ’৪৭-এর বাংলা সাহিত্য নতুন পথযাত্রার সূচনা করেছিল। সে যাত্রা ছিল দৃঢ় ও স্বাতন্ত্র্য নির্ণায়ক। ‘লালসালু’র মজিদ, ‘চাঁদের অমাবস্যা’র আরেফ আলী আর ‘কাঁদো নদী কাঁদো’র মুহম্মদ মুস্তফা এবং তবারক ভূইয়া পাকিস্তান-পর্বের সমগ্র জীবনচরিত্রের অস্তিত্বের সংকট ও উত্তরণের দলিল। ভীত দ্বিধান্বিত হয়ে এক একটি চরিত্র কখনো একক কখনো সামষ্টিকভাবে সংকট উত্তরণের সাহস সঞ্চার করেছে। এই পর্বের সাহিত্যে সৃষ্টির মধ্যেও আমরা দেখেছি উত্তরাধিকার নির্মাণ এবং একটি সম্পূর্ণ চরিত্র গড়ে তোলার সামগ্রিক প্রায়াস। কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের সঙ্গে একক-ব্যক্তির হয়ে ওঠার ধারণা ব্যাহত হতে শুরু করলো। তার কারণ বহুবিধ। প্রথমত স্বাধীন রাষ্ট্রে ব্যক্তিক নেতত্বের ধারণা অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ল। কারণ ভিন্নশক্তির বিরুদ্ধে সংগঠিত হবার প্রয়োজনীয়তা থাকলো না। দ্বিতীয়ত একক ব্যক্তির পক্ষে সমস্যার সমাধান দেয়া সম্ভব হলো না । তৃতীয়ত প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির অমিল স্বপ্নভঙ্গের বেদনা বহির্মুখিনতা ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি পর্যন্ত আলাদা হয়ে গেল। কোনো একটি চরিত্রকে আদর্শ বিবেচনা করে মানুষ নিজেকে নির্মাণ করতে পারলো না। সমাজের এই সামগ্রিক হতাশা হুমায়ূন উপন্যাসের সূতিকাগার। তাই পূর্বতনের পারসোনাল মরালিটি তাঁর উপন্যাসে অনুপস্থিত। কারণ তাঁর উপন্যাসের কোনো পারসন নেই। আর এই না থাকার বাস্তবতাই তাঁর সামাজিক ন্যায়। আর এই ন্যায়কে তিনি যথার্থ নৈয়ায়িক করে তুলেছেন। এই ক্ষমতা তার একান্ত নিজস্ব।

দুই.
হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসের প্রধান দুর্বলতা কেন্দ্রীয় চরিত্রের অভাব এবং চরিত্রপাতের বিকাশহীনতা; সেই সঙ্গে পুরুষকারের অনুপস্থিতি। এই দুর্বলতাকে ত্রুটি বলা সমীচীন হবে না। তার একটি কালগত বৈধতা উপর্যুক্ত আলোচনায় বিবৃত হয়েছে। যখন সমাজের মধ্য থেকে নেতৃত্বপদের উপযোগিতা অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে, ফিউডালিজমের নীল রক্ত আর কলোনিয়াল শাসনের উদ্দেশ্যবাদের বিরুদ্ধে পেশীশক্তি সংগঠনের তাড়না রহিত হয়ে পড়েছে, তখন মানুষ নিজের ভেতর সংগঠিত হবার বাসনা অনুভব করছেন এবং অস্তিত্ববাদের ধারণা প্রসারিত হচ্ছে। আর এই পরিবর্তন কেবল নগরজীবনের নয়। গ্রামীণ সমাজব্যবস্থার মধ্যেও শহর এবং আন্তর্জাতিকতা প্রবেশ করেছে। বহু আগেই প্যারীচাঁদ মিত্র তাঁর ‘আলালের ঘরের দুলালে’র মধ্যে নবোদ্ভূত বাবু শ্রেণীর চরিত্রলক্ষণ অঙ্কন করলেন। বিষবৃক্ষ এবং কৃষ্ণকান্তের উইলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বঙ্কিম তাঁর সমাজের একটি মৌল সমস্যাকে অস্বীকার করতে পারলেন না। কুমুদিনী এবং বিপ্রদাসের প্রতি রবীন্দ্রনাথের পক্ষপাত থাকলেও মধুসূদনের উত্থান ছিল অনিবার্য। যে উত্থানের মধ্য দিয়ে ঠাকুর পরিবার ফিউডালিজম অর্জন করেছিল। সুতরাং বঙ্কিমের কাছে আমরা যা পেয়েছি, রবীন্দ্রনাথে তা পাইনি, আবার শরৎচন্দ্রকে কেন রবীন্দ্রনাথের মতো করে পেলাম না তা নিয়ে অভিযোগ করছি না। আর তিরিশের সাহিত্যিকরা তো সব কিছুকেই ঢেলে নতুন করে সাজিয়ে ছিলেন। যদিও বাংলা সাহিত্যির সমালোচকদের গা-সহা হতে খানিক সময় লেগেছিল। তবে সমাজ পরিবর্তনের এই ক্রিটিক্যাল পর্যায়ে মানব চরিত্রের যে ভেরিয়েশান হুমায়ূন আহমেদ নিরন্তর অঙ্কন করে চলেছেন মহাকাল তার চরিত্রলক্ষণ কেন মুছে ফেলবে না এ-কথার জবাব আমার জানা নেই।

‘নন্দিত নরকে’ এবং ‘শঙ্খনীল কারাগারে’ হুমায়ূন আহমেদ প্রথম যে সময়কে ধারণ করলেন তা ছিল অনিবার্য। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ। কার বিরুদ্ধে তখন বাঙালির বিপ্লব? কেবল বঞ্চনা অপ্রাপ্তি হতাশা স্বপ্নভঙ্গের বেদনা। নবোত্থিত পেশীশক্তির বলাৎকার। যা আইডেন্টিফাই করা যাবে না। এই রিরংসা এই জিঘাংসা আমাদের ঘরের মধ্যে বেড়ে উঠছে। যার নাম ‘নন্দিত নরকে’, যার নাম ‘শঙ্খনীল কারাগার’। আমার কাছে মনে হয়েছে এই উপন্যাসদ্বয়ের নাম হতে পারতো ‘নীরব ক্রন্দন’। অবশ্য কেনযাবুরো ওয়ের ‘সাইলেন্ট ক্রাই’র তাকাশি ও মিতশুকে তার উপন্যাসে পাওয়া যাবে না। হুমায়ূন আহমেদ এই দুটি উপন্যাসে একটি পাবিবারিক কাহিনীর মধ্য দিয়ে সমগ্র নিম্ন আয়ের সমাজের চিত্রটি প্রতীকায়িত করলেন।

হুমায়ূন উপন্যাস বুঝে নিতে পাঠকের কোনো অসুবিধা না হলেও সমালোচককে বুঝিয়ে দিতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। কেননা তারা নৈয়ায়িক শৃঙ্খলার মধ্যে উপন্যাসের গঠন, নায়ক চরিত্রের উত্থান এবং অন্তর্নিহিত মহাবাণী আবিষ্কারে ব্যাপৃত থাকেন। সুতরাং এই উপন্যাসদ্বয়ের নায়ক কে? উত্তম পুরুষকে নায়ক বলার যথেষ্ট আপত্তি হয়তো আমারও রয়েছে। কিন্তু কাহিনি গ্রন্থনা করেছেন উপন্যাসস্থ হুমায়ূন। কেরানি বাবার সন্তান। স্বপ্নকে ভাগাভাগি করে খাওয়া ছাড়া যাদের অর কোনো উদ্বৃত্ত খাদ্য নেই। সুতরাং স্বপ্নভঙ্গ ছাড়া আর কোন ধরনের ট্রাজেডির নায়ক এই নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে প্রত্যাশিত হতে পারে? হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র পৌরুষহীন সময়ের মতো নিস্পৃহ থেকে কেবল ঘটনাকে অবলোকন করেন। নন্দিত নরকের উত্তম পুরুষ হুমায়ূনের চোখের সামনে এতগুলো খুন হয়ে গেল তার ভাবান্তর হলো অল্পই। কিন্তু শৈল্পিক ব্যাপার অন্যখানে। পলার (কুকুর) পলাতক হওয়া ছাড়াও এই উপন্যাসে চারটি হত্যার ঘটনা ঘটেছে। অথচ পরিবারের সর্বমোট লোকসংখ্যা আটজন। যার সমগ্র কাহিনি মেলোড্রামায় পরিণত হওয়ার কথা। কিন্তু কিছুতেই তা শৈল্পিক-সৌকর্য অতিক্রম করেনি। কোন সূক্ষ্ম দৃষ্টিসম্পন্ন পাঠক এই পরিসংখ্যান দেয়ার আগ পর্যন্ত মন্টুর ফাঁসি ছাড়া একটি হত্যাও সে অর্থে চিহ্নত করতে পারবেন না। মাছকাটা বঁটি দিয়ে মাস্টার কাকাকে মন্টু ফালি ফালি করে ফেললো। কিন্তু কেন? কিংশুক নামে যে অনাগত সন্তানটি রাবেয়ার বুকের সঙ্গে মিশে গেল তার জন্য কি মাস্টার কাকা দায়ী ছিলেন? এ প্রশ্নের জবাব হুমায়ূন দেননি। তাঁর উপন্যাসে এমন অসংখ্য কেন-র জবাব মিলবে না। কেননা তাঁর রচনার বৈশিষ্ট্যই হলো সমগ্র লাইফ-প্যাটার্নকে না ধরা। এটা শিল্পের জন্য অপরিহার্য নয়। পোস্টমাস্টার যাওয়ার পরে রতনের কী হয়েছিল? ‘নীলকান্তের পোষা কুকুরটি কতদিন নদীর ধারে ঘুরিয়া ঘুরিয়া কাঁদিয়া কাঁদিয়া ফিরিতে লাগিল?’ অতিথি গল্পের তারাপদের এভাবে প্রস্থান সমীচীন হয়নি। কমলতার কি হয়েছিল? এসব জানার আকাক্সক্ষা গল্প পাঠকের চিরদিন থাকে। কিন্তু নিবৃত্ত না করার মধ্যেই লেখকের শিল্প কৌশলটি রক্ষিত হয়। তাহলে নখলিউদভ, ফাদার সিয়ের্গি, ৬নং ওয়ার্ডের ডাক্তার কিংবা ইয়াং-এর সমগ্র লাইফ-স্টাইলকে আমরা কি বলব? এরা কেউই বিচ্ছিন্ন কোনো মানুষ নয়। মহৎ কোনো বিপ্লবের লক্ষ্যে মহান তলস্তয়, চেখভ এদের সৃষ্টি করেননি। তৎকালীন রুশ জীবনের অবক্ষয় অনিবার্য এবং সম্ভাবনাকে এই চরিত্রের মধ্যে মহান লেখকরা ধারণ করেছেন। কিন্তু এখন কী ধরনের চরিত্র সৃষ্টি করলে একটি জাতির সমগ্রতা স্পর্শ করতে পারে? সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র মুহম্মদ মুস্তফা বিপন্ন মানবিক বোধ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আত্মহত্যা করেছিল। যা ছিল পাকিস্তান পর্বের একক বিচ্ছিন্ন হয়ে ওঠা পলায়নপর জীবনের গ্লানি। কিন্তু আশাবাদী ওয়ালীউল্লাহ্ তবারক ভূইয়ার মধ্য দিয়ে একটি জাতির সামগ্রিক অস্তিত্ব নির্মাণের চেষ্টা করেছেন। অথচ হুমায়ূন আহমেদের ‘নন্দিত নরকে’র কিংবা ‘শঙ্খনীন কারাগার’-এর উত্তম পুরুষের কোনো উত্তরণ নেই আছে বুকভরা মমতা, উত্তরণের আকাক্সক্ষা। কিন্তু উত্তরণের জন্য বৈপ্লবিক কিংবা নাট্যিক কোনো পরিণতি নেই। তাই বলে মূক এবং বধির সমাজ ও সময়ের মধ্যে প্রতিশোধ-স্পৃহা নেই তা কিন্তু বলা যাবে না। ‘নন্দিত নরকে’ রাবেয়া যে বলৎকারের শিকার হয়েছিল তার জন্য দায়ী কে? আসলে কি মাস্টার কাকা? নাকি পাশের বাড়ির যে ছেলেটি রাবেয়ার প্রতি দুর্বলতা পোষন করেছিল? এ প্রশ্নের জবাব লেখক আমাদের দেননি। তা জানাও আমাদের জন্য অপরিহার্য নয়। কিন্তু এই বলাৎকারকে লেখক উপেক্ষা করেননি। অ্যাবর্শনের নষ্ট রক্তক্ষরণে রাবেয়ার মৃত্যু হলো আর মাছ কাটা বঁটি দিয়ে মন্টু মাস্টার কাকাকে ফালি ফালি করে ফেলল। এতে প্রমাণ হয় না মাস্টার কাকাই এর জন্য দায়ী। তবে তাকে এই চরম মূল্য দিতে হলো কেন? এ হলো লেখকের প্রতিবাদ, শুভ উদ্বোধনের সোপান নির্মাণের পদক্ষেপ। এই প্রতিবাদ হুমায়ূন উপন্যাসের প্রধান নিয়ামক, স্থায়িত্ব এবং চালকশক্তি। আমরা জ্বালানি এবং খনিজসম্পদ মন্ত্রী জামিল চৌধুরীর (তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে) কথা জানি। সুুবিবেচক বন্ধুবৎসল পিতা কিংবা স্বামী হিসেবে খারাপ তারও প্রমাণ মেলে না। কিন্তু লেখক তার জীবনের এ কোন অজাচার আমাদের জানালেন। গোলক চাটুয্যের বিরুদ্ধে শরৎচন্দ্রের পক্ষে যা করা সম্ভব হয়নি। সেই প্রতিবাদ করার সিদ্ধান্ত নিলেন হুমায়ূন আহমেদ। মন্ত্রী জামিল চৌধুরীর সামাজিক কাঠামো যে এই প্রতিবাদের পরে ভেঙে পড়ল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। হুমায়ূন আহমেদ তাঁর উপন্যাসে বিপ্লব এবং সংগ্রামশীলতা সংঘবদ্ধ করতে পারেননি- এই অভিযোগও যথার্থ নয়। ‘ফেরা’ উপন্যাসে মুখ ফেরালে সহজেই পাঠক তা আবিষ্কার করতে পারেন। এখন প্রশ্ন, তাহলে সংগ্রাম এবং চরিত্রকে এ উপন্যাসে কেন সংগঠিত করতে চাইলেন, সময় যদি চরিত্র গঠনের পক্ষে না-ই হয়ে থাকে? এ প্রশ্নের জবাব উপন্যাসের মধ্যেই রয়েছে। কেননা ‘ফেরা’ উপন্যাসের সময়কাল বাংলাদেশ জন্মের পূর্ববর্তী। সেই সময়ে ব্যক্তিকে মান্যগণ্য করার প্রবণতা সম্পূর্ণ ফুরিয়ে যায়নি । তাই ঔপন্যাসিক আমিন ডাক্তারকে এ উপন্যাসে উপস্থিত করেছেন। কোথা থেকে এই লোকটি ‘সোহাগী’ গ্রামে এসে বসবাস শুরু করেছে এ কথা জানার কৌতূহল গ্রামবাসীর মধ্যে জাগেনি। লেখক তো আমিন ডাক্তারকে একটি নির্দিষ্ট গ্রামের মধ্যে সমগ্র গ্রামের আমিন ডাক্তারকে সংগঠিত করে তুলতে চেয়েছিলেন। একদিন লালসালুর মজিদ এসে উপস্থিত হয়েছিল মহব্বত নগর গ্রামে। সম্মুখে ছিল তার শারীরিক অস্তিত্বের প্রশ্ন। আল্লাহর দুনিয়ায় বেঁচে থাকার মধ্যে সীমালংঘন করে ছিল ‘লালসালু’র মজিদ। আমিন ডাক্তারও সোহাগী গ্রামে এসেছিল মজিদের মতো অস্তিত্বের টানে। কিন্তু মজিদের মতো বেঁচে থাকার জন্য অন্ধকার পথকে আমিন ডাক্তার বেছে নেননি। বেঁচে থাকার জন্য সামান্য ডাক্তারি ‘ইছামতী’র রামকানাই কবিরাজের মতো জীবনের সমগ্র শক্তি তার সরলতায়। ‘ফেরা’ উপন্যাসের মধ্য দিয়ে হুমায়ূন আহমেদ ‘সোহাগী’ নামক পরিবর্তমান একটি গ্রামকে সংগঠিত করতে চেয়েছেন। কেবল ‘ফেরা’ নয় আরো অনেক উপন্যাস তিনি গ্রামীণ সমাজ (উপন্যাসের সূচনাতেই বুঝতে অসুবিধা হয়নি। কিন্তু আমিন ডাক্তার কেন এসেছিল সে-কথা বুঝে নিতে উপন্যাসের শেষ পর্যন্ত যেতে হয়েছে। এ উপন্যাসে ঔপন্যাসিক ভিলেজ কমিউনিটি নির্মাণ করতে চেয়েছেন। এ উপন্যাসের পাত্রপাত্রীর কথোপকথন সামাজিক আচর-আচরণে বাস্তব অভিজ্ঞতার অভাব পরিলক্ষিত হলেও ঔপন্যাসিকের qualitz of mind সে-সব দুর্বলতা অতিক্রম করেছে এবং এসব উপন্যাসের চরিত্র নির্মাণ তার মধ্যবিত্ত নগর জীবনের পাত্রপাত্রীর চেয়ে বেশি উজ্জ্বল। ‘লালসালু’র মজিদ কেন এসেছিল মহব্বতনগর গ্রামে সে-কথা কিন্তু উপন্যাসের সূচনাতেই বুঝতে অসুবিধা হয়নি। কিন্তু আমিন ডাক্তার কেন এসেছিল সে কথা বুঝে নিতে উপন্যাসের শেষ পর্যায় পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে। আমিন ডাক্তারের চরিত্র চিত্রণে বিভূতির ‘ইছামতী’ উপন্যাসের রামকানাই কবিরাজ আর সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র চাঁদের অমাবস্যা উপন্যাসের আরেফ আলী চরিত্রের সংমিশ্রণ ঘটেছে। রামকানাই কবিরাজের মতো সমগ্র জীবন অকৃতদার আমিন ডাক্তারের মধ্যেও লোভ বিরংসা ক্রোধের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় না। তবে রামকানাই ছিলেন মানবোত্তর চরিত্র। সরলতা যার শক্তি। প্রকৃতির বিশালত্ব যার ঈশ্বর। মানুষের সেবা করে লাউটা-শশাটা যে যা-ই দেয় তার বেশি পাওয়ার আকাক্সক্ষা কবিরাজের নেই। সেই রামকানাইকে দিয়ে বিভূতিভূষণ ‘ইছামতী’ উপন্যাসে একটি বিশাল কাজ করে নিয়েছেন। তা হলো নীলকুঠির দেওয়ান রাজারাম রায়ের নিষ্ঠুরতা আর দৌর্দ- প্রতাপশালী কুঠিয়াল সাহেবদের ক্ষমতা সম্বন্ধে রামকানাইয়ের কিছুই জানা ছিল না। রামকানাইকে তা বোঝানোও সম্ভব হয়নি। নীলকুঠির পক্ষে একটি মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়ার জন্য রামকানাইর উপর সবরকম প্রলোভন এবং অত্যাচার চালিয়েও তাকে রাজি করোনো সম্ভব হয়নি, মিথ্য কথা কীভাবে বলতে হয় রামকানাইকে সে-কথা বোঝানো যায়নি। একই পেশার জীবিকা নির্বাহ করেন ‘ফেরা’ উপন্যাসের আমিন ডাক্তার। কারো প্রতি হিংসা কিংবা অতিরিক্ত লোভ নেই কিন্তু মানবিক মর্যাদাবোধের আকাক্সক্ষা আছে। ততক্ষণ পর্যন্ত বোঝা সম্ভব হয়নি কেন একজন বহিরাগত মানুষ সোহাগী গ্রামের মূল স্রোতের সঙ্গে প্রবাহিত হয়েছে। আমিন ডাক্তার এ উপন্যাসে প্রতিবাদ প্রদর্শনের এক অদ্ভুত কৌশল প্রয়োগ করেছেন। সরকার বাড়ির সামনে ক্ষেতের মধ্যে বসে পড়লেন আমিন ডাক্তার। এই অন্যায়ের প্রতিবাদ জানতে একজন দুজন কৈবর্ত্য ডাক্তারকে কেন্দ্র করে জড়ো হতে শুরু করলো। ‘ওই দিন চৌধুরী বাড়ির জামাই আসবে। ওই দিন রাতে ঘাটে দু’জন খুন হলো, ওই দিন রাতে পুলিশ এসে আমিন ডাক্তারকে বেঁধে নিলে গেল।’

এগার বছর পরে জেলখানা থেকে ছাড়া পেয়ে আমিন ডাক্তার সোহাগী গ্রামে ফিরে এলো। কিন্তু কেন? এগার বছর আগে চৌধুরী বাড়ির পিছনে একজন সুন্দরী বধূর লাশ দেখে নুরুদ্দিন ভয় পেয়েছিল। তার দুদিন আগে সরকার বাড়ির নববধূ নিখোঁজ হয়েছিল। এগার বছর পরে এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানানোর জন্য আমিন ডাক্তার আবার চৌধুরী বাড়ির ক্ষেতের সামনে অবস্থান নেবার প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করলেন।

এই অংশে ‘চাঁদের অমাবস্যা’র স্কুল মাস্টার আরেফ আলীর মনোজাগতিক পীড়ন এবং ব্যক্তিক অস্তিত্বের উত্তরণে কাহিনির সঙ্গে একটি ঐক্য খুঁজে পাওয়া যায়। ‘এক অপরাহ্নে আমিন ডাক্তার তার ধূলিধূসরিত লালকোট’ গায়ে দিয়ে সরকার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। মানুষটি ছোটখাটো কিন্তু পড়ন্ত সূর্যের আলোয় তার দীর্ঘ ছায়া পড়ল। সন্ধ্যা এগিয়ে আসছে বলেই হয়তো সরকার বাড়ির সামনে প্রচীন জায়গা থেকে অসংখ্য কাক কা কা করে ডাকতে লাগল।

তিন.
বিভূতিভূষণের সঙ্গে হুমায়ূন-মানসের গভীর ঐক্য লক্ষ্য করা যায়। বিভূতিভূষণ যেমন জীবনের দ্বন্দ্বসংঘাতের ব্যাপারটি প্রশ্রয় দিতে চান নি, যেখানেই জীবনের নিষ্ঠুর নখর-দন্ত তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন, সেখানেই ডেকে এনেছেন অনন্ত রহস্যকে। বিশ্বপ্রকৃতির প্রতি অসম্ভব মমত্ববোধ, ঘন ঘন জোছনার ব্যবহার, বোমাইবুবুর জঙ্গল, মহিষের দেবতা টারবারো, মায়ার কুন্ডি, সরস্বতী কুন্ডির রহস্যঘন অতিপ্রাকৃতিক প্রতিবেশের আবাহন। বিভূতিভূষণ তার সৃষ্ট চরিত্রকে কঠোর কঠিন জীবন বাস্তবতা থেকে রক্ষার জন্য তৃতীয় কোনো বিষয়ের অতিরিক্ত আকৃষ্ট কিংবা দিব্যদৃষ্টি দান করেছেন। অপুকে প্রকৃতির সঙ্গে এমন জড়াজড়ি করে সৃষ্টি করেছেন যে জীবনের অন্য সব ব্যর্থতা তার লুকোচুরি বাঁশবনের ফাঁকে ফাঁকে আম বকুল সাঁইবাবলার ঘনছায়া ঘেঁটু ফল আর সোঁদালির সৌরভ আর বনস্থলীর সবুজ আত্মার নিচে চাপা পড়ে থাকে। তিনি ইছামতীর ভবানী বাড়–য্যেকে করেছেন দর্শনে স্থিত। হুমায়ূন আহমেদের বহু রচনায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিভূতিভূষণের দৃষ্টি প্রদীপ-এর সতু চরিত্র। অতিপ্রাকৃত বিজ্ঞানকে বাংলা সাহিত্যে বিভূতিভূষণই প্রথম ব্যবহার করেছিলেন। বিভূতিভূষণের অধিকাংশ চরিত্র বিচ্ছিন্নভাবে মূলঘটনার সঙ্গে সমন্বিত হয়েছে। তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে হুমায়ূন আহমেদের চরিত্রও খণ্ডিত অসম্পূর্ণ টুকরো টুকরো উপস্থিতির মধ্যে একটি সম্পূর্ণ ঘটনার জন্ম দিতে চেয়েছে। প্রতিটি উপন্যাসে বহুমাত্রিক জোছনার ব্যবহার প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কস্থাপনের প্রয়াস-চরিত্রের বিচ্ছিন্ন সংস্থাপন- এসবই হুমায়ূন উপন্যাসে বিভূতিভূষণে বৈশিষ্ট্য। দৃষ্টিপ্রদীপের সতু, হুমায়ূনের ছায়াসঙ্গী, হিমু সমগ্র আর মিসির আলির অনেক কাহিনির সূত্রপাত। সর্বোপরি বিভূতিভূষণ কোন একটি চরিত্রকেও অবিমিশ্র মন্দ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দিয়ে সৃষ্টি করেননি। মানুষ খারাপ এই বিবেচনাকে বিভূতিভূষণ পাপ মনে করেছেন। ইন্দির ঠাকরুনের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ আর অপুর স্নেহময়ী মা হিসেবে সর্বজয়া, নীলকুঠির প্রজাপীড়ক দেওয়ান রাজারাম রায় নীলু-বিলুর স্নেহময়ী ভাই হিসাবে পাঠকের মমত্ব হারায় না। তেমনি জামিল চৌধুরী, মাস্টার কাকা পাঠকের শ্রদ্ধা অতিক্রম করে না। হুমায়ূন উপন্যাসে ইংরেজ সাহেবের স্ত্রী মারিয়া স্টোনের কবর ‘ইছামতী’ উপন্যাসের শিপটন সাহেবের কবরের কথা মনে করিয়ে দেয়। বিভূতিভূষণের মেয়েরা সুন্দরী, হুমায়ূন আহমেদের মেয়েরাও সুন্দরী।

হুমায়ূনের অন্যতম দুর্বলতা তাঁর চরিত্রগুলো অধিকাংশই পরিণতিহীন। হয়ে ওঠার ধাত্রীত্ব তিনি দিতে পারেন নি। একটি চরিত্র সূচনা থেকে শেষ পর্যন্ত একই মুদ্রা ধারণ করে থাকে বা পরিণতির দিকে ধাবিত হয় না। আসলে হুমায়ূন আহমেদ বাংলা উপন্যাসের প্রচলিত ধারাটি ভেঙে দিয়েছেন। তা হলো চরিত্রের প্রতিষ্ঠা নয়, চরিত্রকে গল্পের অনুগামী করে তোলা। একই সঙ্গে জীবনের প্রতি গভীর মমতা ও নির্লিপ্তি, বাস্তবতার কঠিন ঘা এড়িয়ে যাবার কৌশল, আনন্দে চোখে পানি আসা, মানুষের প্রতি গ্রগাঢ় মমত্ব হুমায়ূন উপন্যাসে মাহাত্ম্য পেয়েছে। জীবনের কোনো গভীর কার্যকারণ সূত্র থেকে হুমায়ূন আহমেদের চরিত্র ব্যাখ্যা করা যায় না। সবাই আপাত বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। হুমায়ূন উপন্যাসে যা ত্রুটি বলে বিবেচিত হতে পারে তা-ই তাঁর উপন্যাসের পাঠকপ্রিয়তা এবং চালিকাশক্তি বলেও বিবেচিত হতে পারে। মধ্যবিত্ত-জীবনের স্বপ্নভঙ্গের গল্প, এক বোনের প্রেমিক অন্য বোনের সঙ্গে বিয়ে- অধিকাংশ চরিত্রের বৈসাদৃশ্য। বিভিন্ন উপন্যাসে একই নাম ঘুরে ফিরে ব্যবহার। লিবিডোকে এড়িয়ে যাবার অপূর্বকৌশল, পাঠককে আদ্র-ব্যথিত করে দেয়ার অসম্ভব ক্ষমতা যুগপৎ তাঁকে প্রতিষ্ঠিত ও সমালোচিত করেছে।

চার.
হুমায়ূন আহমেদ বাংলা উপন্যাসে স্মরণযোগ্য হয়ে থাকবেন। এর প্রধান দুটি কারণ হলো : ভাবনার পরিচ্ছন্নতা যা বর্তমানের নষ্ট চেতনার মধ্যে শুভ উদ্বোধনের গম্বুজ নির্মাণ করেছে। দ্বিতীয়ত, তাঁর ভাষার পরিচ্ছন্নতা, যা বাংলা উপন্যাসের প্রধান নির্মাতাদের বৈশিষ্ট্য। যা কল্যাণকর তা হুমায়ূন উপন্যাসে বাঞ্ছনীয়। এত অল্প সময়ের মধ্যেও হুমায়ূন আহমেদের একটি অনুসারী লেখক শ্রেণী তৈরি হয়ে গেছে, যা একজন লেখকের একটি যুগের প্রতিনিধি হয়ে ওঠার পরিচায়ক। সৈয়দ হক সম্বন্ধে হুমায়ূন এক রচনায় বলেছিলেন, বাংলা সাহিত্যের সমালোচকরা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র প্রতি একটু বেশি পক্ষপাতিত্ব করেছেন। তাঁর বিবেচনায় সৈয়দ শামসুল হক বাংলাদেশের সাহিত্যে সবচেয়ে শক্তিমান ঔপন্যাসিক। এই আলোচনা পড়ে তার সম্বন্ধে আমার একটি মিশ্র ধারণা জন্মেছিল। সৈয়দ হককে বড় করার জন্য সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ টেনে আনার দরকার পড়ে না। নাকি তিনি সচেতনভাবে এমনটি বলেছিলেন । যেমন বঙ্কিম বিদ্যাসাগর সন্বন্ধে এবং রবীন্দ্রনাথ একটি সময় পর্যন্ত মাইকেলকে এড়িয়ে চলতেন। সমকাল হুমায়ূন আহমেদকে অকৃপণ হাতে দান করছে; মহাকাল বিমুখ হবে বলে মনে হয় না।

হুমায়ূন আহমেদের স্কেচ : মাসুক হেলাল

This image has an empty alt attribute; its file name is MANGROVE.jpg

মজিদ মাহমুদ

জন্ম ১৬ এপ্রিল ১৯৬৬, পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার চরগড়গড়ি গ্রামে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতোকত্তোর।
কবিতা তাঁর নিজস্ব ভুবন হলেও মননশীল গবেষণাকর্মে খ্যাতি রয়েছে।

প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৪০ এর অধিক।

উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ
কবিতা
মাহফুজামঙ্গল (১৯৮৯), গোষ্ঠের দিকে (১৯৯৬), বল উপখ্যান (২০০০), আপেল কাহিনী (২০০১), ধাত্রী ক্লিনিকের জন্ম (২০০৫), সিংহ ও গর্দভের কবিতা (২০০৯), গ্রামকুট (২০১৫), কাটাপড়া মানুষ (২০১৭), লঙ্কাবি যাত্রা (২০১৯), শুঁড়িখানার গান (২০১৯)।

প্রবন্ধ ও গবেষণা
নজরুল, তৃতীয় বিশ্বের মুখপাত্র (১৯৯৭), কেন কবি কেন কবি নয় (২০০১), ভাষার আধিপত্য ও বিবিধ প্রবন্ধ (২০০৫), নজরুলের মানুষধর্ম (২০০৫), উত্তর-উপনিবেশ সাহিত্য ও অন্যান্য (২০০৯), সাহিত্যচিন্তা ও বিকল্পভাবনা (২০১১), রবীন্দ্রনাথ ও ভারতবর্ষ (২০১৩), নির্বাচিত প্রবন্ধ (২০১৪), সন্তকবীর শতদোঁহা ও রবীন্দ্রনাথ (২০১৫), ক্ষণচিন্তা (২০১৬)।

গল্প-উপন্যাস
মাকড়সা ও রজনীগন্ধা (১৯৮৬), সম্পর্ক (২০২০)।

শিশু সাহিত্য
বৌটুবানী ফুলের দেশে (১৯৮৫), বাংলাদেশের মুখ (২০০৭)।

About S M Tuhin

দেখে আসুন

আমিনুল ইসলামের প্রেমের কবিতা : বহুমাত্রিক ও অনন্য । জোয়ানা জেসমিন

আমিনুল ইসলামের প্রেমের কবিতা : বহুমাত্রিক ও অনন্য জোয়ানা জেসমিন   একটি মানব মন একটি …

3,553 কমেন্টস

  1. where to buy generic cialis online safely tadalafil goodrx

  2. cialis at canadian pharmacy where to buy generic cialis online safely

  3. I’m still learning from you, but I’m trying to achieve my goals. I definitely love reading everything that is written on your blog.Keep the aarticles coming. I liked it!

  4. modafinil brand order modafinil 100mg without prescription

  5. why Does Cialis Not Work For Me?

  6. how Often Can You Take 20mg Cialis?

  7. Second, the hydroxybenzeneazobenzoic aci dye binding test of Porter and Waters was performed using the sera of eight jaundiced newborn infants tamoxifen endometrial cancer

  8. New York’s post mortem right-of-publicity statute recently came into effect.  Its previous right-of-publicity laws were an extension of its statutory right of privacy which provided that “any person whose name is used within for advertising purposes without . . . written consent” can sue… Core Areas of Counsel Include: Full Service International Law Firm Greenspoon Marder’s Entertainment & Sports practice group has a keen understanding of copyright, trademark and related areas of law. Intellectual property is the foundation for the majority of our clients’ entertainment related assets and our team knows how to identify, leverage and protect those rights. We serve the intellectual property needs of both institutional and personal clients and our services range from patent, trademark and copyright registrations to full oversight and rights management and litigation services to protect and defend our client’s intellectual property.
    http://resurrection.bungie.org/forum/index.pl?profilesave
    Also read Do I have a NC Personal Injury Case? A hospital is likely the last place you expect to suffer an injury, in large part because there is an assumed expectation that a hospital is a safe place where people are healed, not harmed. But this assumption isn’t always accurate and, unfortunately, hospitals can be just as dangerous–or even more so–as other types of properties. One of the more common types of hospital accidents is a slip and fall. If you have been involved in a hospital slip and fall accident, our lawyers at the office of Fisher & Talwar can help. Here’s what you should know about hospital slip and fall accident claims and whether or not you can file a lawsuit.  Medical negligence is one of the most common reasons for suing a hospital. Medical negligence is a broad term that can refer to many issues within a hospital setting. When a hospital staff member is negligent, it means they made an error that a reasonable person with the same training and job role would not have made. 

  9. darknet сайты список darknet market controlled delivery

  10. hidden wiki tor onion urls directories grey market link

  11. what bitcoins are accepted by darknet markets links deep web tor

  12. darknet markets that take ethereum reddit onion list

  13. alphabay market url darknet adresse tor2door market

  14. black market prescription drugs for sale project versus

  15. how to buy bitcoin and use on dark web dark markets guyana

  16. how to get to the black market online incognito url

  17. which darknet markets are still open bohemia url

  18. hidden financial services deep web incognito link