জন্মশতবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

সোমেন চন্দ, প্রগতি লেখক সংঘ ও লেখক-শিল্পীদের ভূমিকা

গোলাম কিবরিয়া পিনু

সোমেন চন্দ মাত্র ২১ বছর ১৫ দিন বেঁচে ছিলেন, তাঁর জন্ম হয়েছিল ১৯২০ সালের ২৪ মে, অবিভক্ত ভারতে, অধুনা বাংলাদেশের গাজীপুর জেলার টঙ্গীর আশুলিয়া গ্রামে, মামার বাড়িতে। আর মারা যান ১৯৪২ সালের ৮ মার্চ, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের নির্মম ছুরিকাঘাতে।
১৯৩৬ সালে তিনি ঢাকার পগোজ স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষার উত্তীর্ণ হন। বই খোঁজার আগ্রহ থেকেই শিশুকাল থেকে সোমেন চন্দ পাঠাগারমুখী হন। ঢাকার জোড়পুল লেনের প্রগতি পাঠাগার ছিল সাম্যবাদে বিশ্বাসী মানুষদের পরিচালিত। পাঠাগারে পড়তে পড়তে সোমেন বাংলা সাহিত্যে আগ্রহী হয়ে ওঠেন এবং কার্ল মার্কসের তত্ত্বে অনুরক্ত হয়ে পড়েন। ১৯৩৭ সালে তিনি প্রগতি পাঠাগারের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তিনি ওই সময়েই মিডফোর্ড হাসপাতালে ডাক্তারি পড়ার জন্য ভর্তিও হন। কিন্তু ১৯৩৯ সালে ডাবল নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আগেই ডাক্তারি পড়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
স্কুল জীবন থেকেই গল্প লিখতেন সোমেন। তখন তাঁর প্রকাশিত লেখা বা নতুন লেখার কথা পরিবারের কেউ জানতেন না। ১৯৩৭ সালে ১৭ বছর বয়সে প্রকাশ পায় সোমেনের প্রথম গল্প ‘শিশু তপন’ সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকায়। এর পর আরও উল্লেখযোগ্য কিছু লেখা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ওই বছরেই প্রকাশিত হয়। এই ১৭ বছর বয়সেই বাংলাদেশে বন্যার যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও দুর্ভোগ, তা নিয়ে উপন্যাস ‘বন্যা’ লেখেন সোমেন। তাঁর প্রথম উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ‘নবশক্তি’ পত্রিকায়।
তিনি প্রগতি লেখক সংঘে যোগদান করেন এবং মার্কসবাদী রাজনীতি ও সাহিত্য আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন। তিনি বাংলা সাহিত্যে গণসাহিত্যের ধারায় কাজ করেন। ১৯৪১ সালে সোমেন চন্দ প্রগতি লেখক সংঘের সহসম্পাদক নির্বাচিত হন। মেধাবী সোমেন চন্দের লেখা সাধারণত প্রগতি লেখক সংঘের সাপ্তাহিক বা পাক্ষিক সভাসমূহে পাঠ করা হতো।
১৯৪২ সালের ৮ই মার্চ ঢাকায় ফ্যাসিবাদ বিরোধী একটি সম্মেলনে অংশ নিয়ে তিনি নিহত হন। তিনিই বাংলার ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনের প্রথম শহীদ। তাঁর অনবদ্য সাহিত্য সৃষ্টির মধ্যে রয়েছে শিশু তপন, ইঁদুর, সংকেত, বনস্পতি, দাঙ্গা, সত্যবতীর বিদায়, ভালো না লাগার শেষ, উৎসব, মুখোশ ইত্যাদি গল্প। এ পর্যন্ত তাঁর ১টি উপন্যাস, ২৮টি গল্প, ৩টি কবিতা, ২টি নাটক সহ তাঁর লেখা চিঠির সংকলনও প্রকাশিত হয়েছে।
এ যাবত প্রকাশিত সেমেন চন্দের গল্প সংকলনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য রণেশ দাশগুপ্ত সম্পাদিত, যা ‘সোমেন চন্দের গল্পগুচ্ছ’ নামে ঢাকার কালিকলম প্রকাশনী থেকে ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত হয়, ১৯৯২ সালে বিশ্বজিৎ ঘোষ সম্পাদিত ‘সোমেন চন্দ রচনাবলী’ ঢাকার বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি থেকে পবিত্র সরকার সম্পাদিত ‘সোমেন চন্দ গল্পসংগ্রহ’ বের হয় ১৯৯৭ সালে এবং ড. দিলীপ মজুমদার সম্পাদিত ‘সোমেন চন্দ ও তার রচনা সংগ্রহ’ কলকতার নবজাতক প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়। ২০১৮ সালে ঢাকার পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি. থেকে বদিউর রহমানের সম্পাদনায় ‘সোমেন চন্দ গল্প সংগ্রহ’ প্রকাশিত হয়, এতে ২৮ গল্প সংকলিত হয়। উল্লিখিত সংকলনের কোনোটায় ১৭টি, কোনোটায় ২৫টি , কোনোটায় ২৬টি গল্প সংকলিত হয়। সোমেন চন্দের লেখার পাঠক এখনো রয়েছে, তা উৎসাহব্যঞ্জক। তার সাহিত্য নিয়ে আলোচনা বাংলাদেশে এখনো নিয়মিত হয়। সাহিত্যের পাশাপাশি তাঁর জীবনকর্ম নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা খবর আমাদের চোখে পড়ে।
১৯৪২ সালের ৮ মার্চ তিনি আততায়ীর হামলায় নিহত হন। তার মৃত্যু সম্বন্ধে বিশিষ্ট চিন্তাবিদ ও লেখক সরদার ফজলুল করিমের স্মৃতিচারণ : (উৎস : কিছু স্মৃতি কিছু কথা, পৃঃ৯৩) :”ফ্যাসীবাদ বিরোধী আন্দোলন বাংলার সব জেলা শহরে ছড়িয়ে পড়ে, যার মধ্যে ঢাকা শহর ছিলো অন্যতম শক্তিশালী কেন্দ্র। ১৯৪২ সালের ৮ই মার্চ ঢাকার বুদ্ধিজীবী, লেখক প্রভৃতি শহরে এক ফ্যাসীবাদ বিরোধী সম্মেলন আহবান করেন। স্থানীয় জেলা পার্টির অনুরোধে কমরেড বঙ্কিম মুখার্জি ও জ্যোতি বসু সেখানে বক্তা হিসেবে যান। সম্মেলন উপলক্ষে শহরে খুবই উত্তেজনা সৃষ্টি হয় এবং রাজনৈতিক মহল প্রায় তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। প্রথম যারা সম্মেলনের পক্ষে, দ্বিতীয় যারা সরাসরি বিপক্ষে, তৃতীয় যারা মোটামুটিভাবে তুষ্ণীভাব অবলম্বন করে নিরপেক্ষতার আবরণ নিয়ে ছিলেন। … যাই হোক, সম্মেলনের দিন সকালে উদ্যোক্তাদের অন্যতম তরুণ সাহিত্যিক সোমেন চন্দ আততায়ীর হাতে নিহত হন। তিনিই বাংলার ফ্যাসীবাদী বিরোধী আন্দোলনের প্রথম শহিদ।’’
পুরনো ঢাকার যে এলাকায় তিনি নিহত হন, সেটা একটি আবাসিক এলাকা, তা এখন আরও ঘনবসতিপুর্ণ, যে গলিতে তিনি নিহত হন, তাতে একটি স্মৃতিফলক আছে, প্রতিবছর ৮ই মার্চে সেখানে গিয়ে ব্যক্তি, সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা পুষ্পমাল্য অর্পণ ও অন্যান্য কর্মসূচি পালন করে থাকেন। এছাড়া তাঁর জন্মদিনে বাংলাদেশের নরসিংদিতে বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়ে থাকে। ক’বছর হলো বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘ সোমেন চন্দকে নিয়ে নিয়মিত বিভিন্ন পর্যায় আলোচনা ও অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে।
ভারতবর্ষে প্রগতি সাহিত্য আন্দোলনের সূচনা হয় ১৯৩৬ সালে লক্ষ্ণৌয়ে। সে-বছর ১০ই এপ্রিল জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন স্থলের পাশে সর্বভারতীয় এক সাহিত্যিক-সম্মেলনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় নিখিল ভারত প্রগতি লেখক সংঘ। এই সংঘ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে প্রগতিশীল সাহিত্য-সংস্কৃতি আন্দোলনের যে সূচনা হয়েছিল, তার প্রভাব ছিল পরাধীন দেশে এবং পরবর্তীতে এর প্রভাব বিভিন্ন পর্যায়ে অনুঘটকের ভূমিকা নিয়ে বাংলাদেশেও দেদীপ্যমান হয়ে থাকে।
লেখক সংঘের কর্মকাণ্ডের প্রেষণায় লেখক-শিল্পীদের মধ্যে যে চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল, তারই ধারাবাহিকতায় অসাম্প্রদায়িকবোধ, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ভূমিকা, যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও মানবতাবোধের ভিত্তিমূল পাকিস্তান আমলেও ছিন্ন হয়নি। পঞ্চাশ-ষাট দশকে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে প্রগতি লেখক সংঘের সঙ্গে যুক্ত থাকা অগ্রসর কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকরা গৌরবের ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁরা এবং তাঁদের উত্তরাধিকারেরা এখনো সক্রিয়।
১৯৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত প্রগতি লেখক সংঘ-এর ভিত্তিমূল তৈরি হয়েছিল ১৯৩২-৩৩-৩৪ সালে লন্ডনে। সেখানে মুল্ক্রাজ আনন্দ, সাজ্জাদ জহীর, হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, ভবানী ভট্টাচার্য, ইকবাল সিং, রাজা রাও, মহম্মদ আশ্রফ প্রমুখ লন্ডন-প্রবাসী ভারতীয়-ছাত্ররা উদ্যোগী হয়েছিলেন। এঁরা অনুপ্রাণিত হোন রোমাঁ রোল্যাঁ, বারব্যুস, গোর্কি, ফর্স্টার, স্ট্রাচি প্রমুখ মনস্বীদের ফ্যাসিবাদ-বিরোধী সংগ্রামের আহ্বানে এবং হ্যারল্ড ল্যাক্সি, হাবার্ট রীড, মন্টেগু শ্ল্যাটার, রজনীপাম দত্ত প্রমুখ বিদেশী মার্কসবাদী বন্ধুদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ আলাপ আলোচনার মাধ্যমেও। কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের সপ্তম কংগ্রেসে জর্জি ডিমিট্রভ ততদিনে (১৯৩৫) ‘সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদ-বিরোধী যুক্তফ্রন্ট’-তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। এই আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে ১৯৩৬-এর এপ্রিলে লক্ষ্ণৌতে মুন্সী প্রেমচন্দ-এর সভাপতিত্বে গঠিত হলো নিখিল ভারত প্রগতি লেখক সংঘ। প্রগতি লেখক সংঘ প্রতিষ্ঠায় মার্কসীয় বুদ্ধিজীবী ও কমিউনিস্টদের সক্রিয় উদ্যোগ ছিল। তৎকালে বামপন্থী রূপে পরিচিত কংগ্রেস সভাপতি জওহরলাল নেহরুরও ছিল পরোক্ষ উৎসাহ। সদ্য ইউরোপ প্রত্যাগত সাজ্জাদ জহীর, হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়রা ছিলেন এর নেতৃত্বে।
১৯৩৫ সাল থেকেই ইউরোপে ফ্যাসিবাদী আক্রমণ শুরু হয়। ইতালি ১৯৩৫-এ আবিসিনিয়া (ইথিওপিয়া) এবং জার্মানি স্পেনের ওপর হামলা শুরু করে। তখন শিল্পী পাবলো পিকাসো প্রতিবাদ জানাচ্ছেন ছবি এঁকে। ১৯৩৬-এর ৩রা সেপ্টেম্বর রোমা রল্যাঁ’র আহ্বানে ব্রাসেলস শহরে অনুষ্ঠিত বিশ্বশান্তি সম্মেলন, তাতে বলা হলো : ‘পৃথিবীর সম্মুখে আজ আতঙ্কের মতো আর এক বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকা সমুপস্থিত। ফ্যাসিস্ত স্বৈরতন্ত্র মাখনের বদলে কামান তৈরিতে মগ্ন। তারা সংস্কৃতির বিকাশের বদলে বিকশিত করছে সাম্রাজ্য জয়ের উন্মাদ লালসা, প্রকাশ করছে নিজের হিংস্র সামরিক স্বরূপকে।’
বঙ্গীয় প্রগতি লেখক সংঘ অবশ্য ১৯৪২সালের ২৮শে মার্চ তারিখে কলকাতায় তরুণ কমিউনিস্ট লেখক সোমেন চন্দ-এর স্মরণসভা থেকে নাম বদল করে ফ্যাসিস্ত-বিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘে পরিণত হয়। লেখক সোমেন চন্দ ঢাকার রাজপথে নির্মমভাবে ৮ই মার্চ ১৯৪২ নিহত হওয়ার আগের বছর জ্যোতি বসু ও স্নেহাংশুকান্ত আচার্যের উদ্যোগে স্থাপিত হয় সোভিয়েত সুহৃদ সমিতি। ১৯৪৩-এ প্রতিষ্ঠিত হয় ভারতীয় গণনাট্য সংঘ। সারা ভারতজুড়ে সৃষ্টি হয় এক মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গিজাত জাগরণের। যুদ্ধ, মন্বন্তর, সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এক বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সৃষ্টি হয়েছিল। প্রগতি লেখক সংঘ ছিল এই সাংস্কৃতিক জাগরণের মূল ও পথ-নির্দেশক শক্তি।
১৯৩৬ সালের জুলাই মাসে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বঙ্গীয় প্রগতি লেখক সংঘ’। এই ধারাবাহিকতায় সোমেন চন্দ, সতীশ পাকড়াশী, রণেশ দাশগুপ্ত, জ্যোতির্ময় সেনের উদ্যোগে প্রগতি লেখক সংঘ ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪০ সালে গেন্ডারিয়া হাইস্কুল মাঠে প্রগতি লেখক সংঘ-এর প্রথম সম্মেলন করে। এতে কাজী আবদুল ওদুদ সভাপতিত্ব করেন। সম্মেলনে রণেশ দাশগুপ্ত সম্পাদক এবং সোমেন চন্দ সহসম্পাদক নির্বাচিত হোন। ১৯৪১ সালে জার্মান কর্তৃক সোভিয়েট রাশিয়া আক্রান্ত হলে লেখক সংঘ তার প্রতিবাদে ব্যাপ্টিস্ট মিশন হলে ‘সোভিয়েট মেলা’ নামে সপ্তাহব্যাপী এক প্রদর্শনীর আয়োজন করে। এভাবেই এই সময় সংঘের কার্যক্রম পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। প্রগতি লেখক সংঘ দিনদিন আন্তর্জাতিক রূপ পায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীর রাজনীতিতে পরিবর্তন দেখা দিলে সংঘের কার্যক্রম বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হয়। ১৯৪৭-এ দেশ ভাগের পর ধীরে ধীরে প্র্রগতি লেখক সংঘের কার্যক্রম স্থবির হয়ে যায়। ২০০৮ সালে দেশের কিছু প্রগতিশীল লেখকের প্রচেষ্টায় ‘বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘ’ পুনরায় আত্মপ্রকাশ করে। সেসময় একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। ৮ আগষ্ট ২০১৪ এ বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘের প্রথম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় । ১৫ মার্চ ২০১৯ বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘের তৃতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর তৎপরতায় গৌণভাবে গড়ে উঠছে ভিন্ন মার্কার শিল্প-সাহিত্য। এর ফলে বাংলাদেশের ধারাবাহিক চেতনা-নির্ভর শিল্প-সাহিত্যের সজীব ও অগ্রসরমান ধারা তা কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন শুধু হচ্ছে না, সেই ধারাকে চোরাস্রােতে নিয়ে যাওয়ার জন্য এক ধরনের স্বাপদনির্ভর উন্মাদনা তৈরি করা হচ্ছে। এই শিবিরের উগ্রতা ও সংগঠিত হওয়ার বাস্তবতায় কবি-লেখক-শিল্পীদের মধ্যে নতুন করে প্রণোদনা সৃষ্টির লক্ষ্যে বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘ নতুন উদ্দীপনায় কাজ করে যাচ্ছে।
অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদীদের লোলুপতা আর তৃষ্ণা, এর কবলে পড়ে সারাবিশ্ব আজ নয়া-ঔপনিবেশিক বাস্তবতার মধ্যে পড়ে গিয়ে সেই পুরনো অর্থনৈতিক শোষণ ও লুণ্ঠনের দিকটি উন্মোচন করছে। সাম্রাজ্যবাদ আজ প্রযুক্তি আয়ত্ত্বে নিয়ে, মিডিয়া দখল করে, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে সারাবিশ্বে নেটওয়ার্ক তৈরি করে, সমর শক্তিতে বলিয়ান হয়ে তা-ব-সন্ত্রাস চালাচ্ছে। ইরাক-লিবিয়াতে যে দখলী-ভণ্ডামী চলল, তা আমেরিকাসহ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মুখোশকে উন্মোচন করেছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের কবি-লেখক-শিল্পীরা মূক ও বধির হয়ে থাকতে পারে না। পূর্বেও তাঁরা নিজেদের বিবেক-তাড়িত ভূমিকা রেখেছেন, বর্তমানেও তাঁরা সেই ভূমিকা শানিত রাখবেন, সেটা অনেকেরই আকাঙ্ক্ষা।
আমরা জানি-শিল্প ও সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিভিন্নমুখী মতামত আছে। ভাবুক ও লেখক-সমালোচকের মধ্যে বোঝাপড়ার পার্থক্যও আছে। কোনটা ভালো সাহিত্য বা শিল্প-তা নিয়েও তর্ক আছে। কিন্তু তারপরও বলি-দেশ ও মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কি কবি-লেখক ও শিল্পীদের কোনো ভূমিকা থাকবে না? তাঁরা কি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ও অগ্রগতি চাইবেন না? নিশ্চয় চাইবেন। পূর্বেও তাঁরা নিজেদের বিবেক-তাড়িত ভূমিকা রেখেছেন, বর্তমানেও তাঁরা সেই ভূমিকা শানিত রাখবেন, সেটা অনেকেরই আকাঙ্ক্ষা।
লেখক-শিল্পীরা সংগঠন সক্রিয়ভাবে করতে পারেন, না-ও করতে পারেন। তবে শিল্প-সাহিত্যের মাধ্যমে লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি ও ভাবাদর্শের লড়াইটা কখনো মোটা দাগে বা কখনো সূক্ষ্মভাবে চলতে থাকে। এ থেকে শিল্পী ও লেখকেরা কখনো সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে না। এই লড়াই থেকে যে শিল্পী-লেখকেরা দূরে থাকতে চান, তারা অজান্তে কোনো পক্ষের উঠানে গিয়ে উপস্থিত হন অথবা কোনো পক্ষের সেবাদাস হয়ে পড়েন। আর এই ধরনের যে মানুষেরা শিল্প-সাহিত্যকে রাজনীতিবর্জিত করে রাখতে চান, তারা হয়তো জানেন না-রাজনীতি মানে শুধু মিছিল-সভা-শ্লোগান নয়। রাজনীতি একটি দৃষ্টিভঙ্গি-বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি।
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি ও অন্যদিকে একচক্ষুবিশিষ্ট দানবের মতো সাম্রাজ্যবাদের সর্বগ্রাসী উন্মাতাল পদচ্ছাপে যখন পৃথিবী রক্তাক্ত ও লণ্ডভণ্ড, তখন প্রগতিশীল শিল্পী-কবি-সাহিত্যিকদের যুথবদ্ধতা জরুরি হয়ে পড়েছ্। দেশ, পৃথিবী ও মানুষের কল্যাণে কমিউনিস্ট-অকমিউনিস্ট, মার্কসবাদী-অমার্কসবাদী, জাতীয়তাবাদী ও মানবতাবাদী প্রগতিশীল লেখক-শিল্পীদের এক কাতারে দাঁড়াতে হবে। বাংলাদেশে প্রগতিশীল শিল্পী-লেখকদের অবস্থান অনেক শক্তিশালী, এই অবস্থানকে আরও সংহত করা প্রয়োজন। যদিও কেউ কেউ দলবৃত্তের সংকীর্ণতায় (দল করা অসমীচীন বলছি নে) ও স্বার্থপরতার চোরাস্রােতে নিমজ্জমান, যা মানুষের মধ্যে আস্থাহীনতার জন্ম দিচ্ছে, এর ফলে লেখক-শিল্পীদের সম্পর্কে ভিন্ন ধারণারও উৎপত্তি হচ্ছে। এই ক্ষতিকর প্রবণতা থেকে লেখক-শিল্পীদের গণমুখী ও ঐতিহ্যবাহী ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন রাখতে হবে। নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া ও মৈত্রীর সম্পর্ক সুদৃঢ় করাও জরুরি। সোমেন চন্দের উত্তরাধিকার হিসেবে সেই বিবেচনাবোধ নিয়ে বাংলাদেশের মূলধারার লেখক-শিল্পীরা এখনো জেগে আছেন ও ভূমিকা রাখছেন, তা আরও অগ্রসর করে নিয়ে সম্মুখবর্তী অবস্থানে দেদীপ্যমান করতে হবে।


গোলাম কিবরিয়া পিনু
জন্ম ১৬ চৈত্র ১৩৬২ : ৩০মার্চ ১৯৫৬ গাইবান্ধা
প্রকাশিত গ্রন্থ
১. এখন সাইরেন বাজানোর সময় (কবিতা), ১৯৮৪
২. খাজনা দিলাম রক্তপাতে (ছড়া), ১৯৮৬
৩. সোনামুখ স্বাধীনতা (কবিতা), ১৯৮৯
৪. পোট্রেট কবিতা (কবিতা), ১৯৯০
৫. ঝুমঝুমি (ছড়া), ১৯৯৪
৬. সূর্য পুড়ে গেল (কবিতা), ১৯৯৫
৭. জামাতের মসজিদ টার্গেট ও বাউরী বাতাস (প্রবন্ধ), ১৯৯৫
৮. কে কাকে পৌঁছে দেবে দিনাজপুরে (কবিতা), ১৯৯৭
৯. এক কান থেকে পাঁচকান (ছড়া), ১৯৯৮
১০. দৌলতননেছা খাতুন (প্রবন্ধ), ১৯৯৯
১১. আমরা জোংরাখোটা (কবিতা), ২০০১
১২. সুধাসমুদ্র (কবিতা), ২০০৮
১৩. আমি আমার পতাকাবাহী (কবিতা), ২০০৯
১৪. মুক্তিযুদ্ধের ছড়া ও কবিতা (ছড়া ও কবিতা), ২০১০
১৫. বাংলা কথাসাহিত্য : নির্বাচিত মুসলিম নারী লেখক ও অন্যান্য প্রসঙ্গ (গবেষণা), ২০১০
১৬. ও বৃষ্টিধারা ও বারিপাত (কবিতা), ২০১১
১৭. ফসিলফুয়েল হয়ে জ্বলি (কবিতা), ২০১১
১৮. মুক্তিযুদ্ধের কবিতা (কবিতা), ২০১২
১৯. ফুসলানো অন্ধকার (কবিতা), ২০১৪
২০. উদরপূর্তিতে নদীও মরে যাচ্ছে (কবিতা), ২০১৪
২১. নিরঙ্কুশ ভালোবাসা বলে কিছু নেই (কবিতা), ২০১৫
২২. ছুঁ মন্তর ছুঁ (ছড়া), ২০১৬
২৩. কবন্ধ পুতুল নাচে (কবিতা), ২০১৬
২৪. ঝুলনপূর্ণিমা থেকে নেমে এলো (কবিতা), ২০১৮
২৫. সমকালীন কবিতা ও বোধের দিগন্ত (প্রবন্ধ), ২০১৮
২৬. উনিশ-বিশ মতকের নারী লেখক ও আত্মশক্তির বিকাশ (প্রবন্ধ), ২০১৯
সম্মাননা/পুরস্কার
রংপুর তথ্য কেন্দ্র পুরস্কার (প্রবন্ধ, ১৯৭৪) : বাংলাদেশ পরিষদ-রাজশাহী বিভাগীয় পুরস্কার (বক্তৃতা, ১৯৭৪) : গাইবান্ধা কলেজ ছাত্র সংসদ পুরস্কার ( প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা, ১৯৭৪) : আমরা ক’জনা বিদ্রোহী সূর্যকণা পুরস্কার (১৯৭৫) : গাইবান্ধা তথ্যকেন্দ্র পুরস্কার (প্রবন্ধ, ১৯৭৬ ও ১৯৭৭) : জাতীয় শিল্প, সাহিত্য, সাংস্কৃতিক উৎসব-গাইবান্ধা পুরস্কার (কবিতা ও অন্যান্য ১৯৭৭) : বিতর্ক অঙ্গন-রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পুরস্কার (১৯৭৮) : মাদার বখশ ছাত্রাবাস-রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পুরস্কার (প্রবন্ধ,১৯৮১) : বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন সম্মাননা-কবিতা, ১৯৮৫ : বাংলা কবিতা উৎসব সম্মাননা কোলকাতা, হলদিয়া, ভারত, ১৯৮৮ : ‘বাংলার মুখ’ সাহিত্য-সাংস্কৃতিক উৎসব সম্মাননা, বালুরঘাট, পশ্চিমবঙ্গ, ১৯৯৭ : সৌহার্দ্য’৭০ সম্মাননা, কোলকাতা, ২০০৩ : অনিরুদ্ধ’৮০ সম্মাননা, কোলকাতা, ২০০৩ : বিন্দুবিসর্গ সম্মাননা, ২০০৩ : দীপালোক বিজয় দিবস সম্মাননা পদক,কবিতা-২০০৬ : লোকসখা ওয়েলফেয়ার সোসাইটি, কোলকাতা কর্তৃক লোকসখা সম্মাননা ২০০৮ : উইমেন ডেলিভার আমেরিকা-এর ফেলোশিপ অর্জন ২০১০ : বন্ধু পরিষদ গাইবান্ধা সম্মাননা ২০১০ : এম নুরুল কাদের শিশুসাহিত্য পুরস্কার ২০১০ : বগুড়া লেখক চক্র সম্মাননা ২০১৬ : কবি বিষ্ণু দে পুরস্কার (ভারত) ২০১৬ : এবং মানুষ সম্মাননা ২০১৮ : চাড়–নীড়ম ইনস্টিটিউট পুরস্কার ২০১৯ : সাতক্ষীরা কবিতা পরিষদ পুরস্কার ২০১৯
You really make it seem so easy with your presentation but I find this topic to be really something that I think I would never understand.
It seems too complicated and very broad for me.
I’m looking forward for your next post, I will try to
get the hang of it!
Hmm is anyone else experiencing problems with the images on this blog loading?
I’m trying to figure out if its a problem on my end or if
it’s the blog. Any suggestions would be greatly appreciated.