সিঙ্গাপুর : দ্য সিটি ইন এ গার্ডেন
কুমার দীপ
সিঙ্গাপুর প্রসঙ্গ এলে প্রায়ই শোনা যায়- ‘সিঙ্গাপুর সিটি’ অর্থাৎ সিঙ্গাপুর এমন একটি দেশ, যেখানে গ্রাম নেই, শহরই সব। বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ এ-কারণে সিঙ্গাপুরকে শহরের দেশ হিসেবেই জানেন। তারা নিজেরাও ‘সিঙ্গাপুর সিটি’ পরিচয় দিতেই অভ্যস্ত। দেশজুড়ে আকাশচুম্বী সব ইমারত, সুপ্রশস্ত রাস্তা আর সবশেষ মডেলের সারি সারি গাড়ি এই কথাটিকে পূর্ণসত্য মনে হওয়াই স্বাভাবিক। সিঙ্গাপুর ভ্রমণের পূর্ব পর্যন্ত, এমনকি সিঙ্গাপুরে প্রবেশের প্রাথমিক পর্বেও উক্ত ‘সিটি’ভাবনা থেকে বিচ্যুত হওয়ার কথা ভাবিনি আমি। কিন্তু দু-একদিন যেতেই, একটু একটু করে দেশটিতে ঘুরতে ঘুরতে মনে হতে লাগলো, সিঙ্গাপুর দেশটি প্রায় পুরোটাই সিটি বা শহর এটা যেমন সত্য, তেমনি সেই সত্যের ভেতরে আরেকটি অনন্য সত্য হচ্ছে- সেই শহরটি জুড়ে রয়েছে বাগান। একটু অন্যভাবে বললে, সিঙ্গাপুর দেশটি যদি শহর হয়, সেই শহরটাই অবস্থান করছে একটি বাগানে- The city in a garden. অবাক লাগছে ? আমিও অবাক হয়েছিলাম প্রথম দিকে। ২৩ দিনের সিঙ্গাপুর ভ্রমণের অভিজ্ঞতায় আমার যেমন আস্তে আস্তে সেই অবাক ভাবটা চলে গিয়েছিল, প্রিয় পাঠকের হৃদয় থেকেও সেই অবাক ভাবের কিছুটা উধাও হতে পারে আমার এ-লেখায়। তার আগে কিঞ্চিৎ ভণিতার ভার বইতে অনুরোধ করি পাঠকদিগের কাছে।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘নন্দলাল’-এর কথা মনে পড়ে ? ‘নন্দ বাড়ির হত না বাহির, কোথা কি ঘটে কি জানি / চড়িত না গাড়ি, কি জানি কখন উল্টায় গাড়িখানি। / নৌকা ফি-সন ডুবিছে ভীষণ, রেলে কলিসন হয়, / হাঁটতে সর্প, কুকুর আর গাড়ি-চাপা পড়া ভয়।’ এরকম সৃষ্টিছাড়া ভয়ে বাড়ির ভেতরে বদ্ধ জীবন কাটানোর মতো নন্দলাল আমি নই, তবু পথদুর্ঘটনার ভয় যে আমার ব্যাপক, সেটা আমি আগেই কবুল করি। ভয় আমার আরেকটি জিনিসের- বিবমিষা। দুর্ঘটনার চেয়ে বিবমিষার ভয় বোধহয় কম না, ঢের বেশিই হবে। বাস-মিনিবাস-প্রাইভেট কার এসবে আমি স্বচ্ছন্দে চড়তে পারি না ! শৈশব থেকেই সড়কপথে কোথাও আমাকে নিয়ে যেতে হলে অনেকবার ভাবতে হতো মা-বাবাকে। কতোবার বমি করে দিয়েছি বাসে ! আমাকে নিয়ে একাধিকবার নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই নেমে যেতে হয়েছে আমার মাকে। একবার তো কলকাতার চিড়িযাখানায় পৌঁছে গিয়েও ভেতরে ঢোকার সাহস পায়নি বমি করতে করতে আমার অজ্ঞানপ্রায় অবস্থা দেখে ! পশ্চিমবঙ্গের কোনো এক বাসে একবার আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক ভদ্রমহিলার দামি শাড়িতে যেভাবে উগরে দিয়েছিলাম, সেই স্মৃতি মনে এলে (মহিলাটি কী ভেবেছিলেন, এটা ভেবে) মনে মনে কিছুটা লজ্জিত হই। অবশ্য বছর আঠারো আগে ঢাকায়, এনএসআই অফিসার বন্ধু জুয়েলের সাথে দেখা করতে শেরাটন যাওয়ার পথে বাসের হাতল ধরে দাঁড়িয়ে থাকা আমার পিছন দিকে একজন বিপুলভাবে উগরে দিলে যতটা বিরক্তি তার চেয়ে বরং হাসিই পেয়েছিল আমার; হয়তো আত্মকর্মের অতীত স্মরণ করেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে যাওয়ার সময় যশোরে পৌঁছানোর পরে দুই সহযাত্রী বন্ধু আমাকে দু-বাহু ধরে বাস থেকে নামিয়েছিল, আমি বলেছিলাম- ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়া হোক আর না-হোক, আমি আর বাসে উঠতে পারবো না। ওরা একটা রিকশা করে আমাকে রেলস্টেশনে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই আমি আকাশে উড়বো ! জীবনে প্রথম বিমানে উঠবো ! বিজ্ঞানে আস্থাশীল, যুক্তিবাদী এই আমার মনেও কেমন টেনশন খেলা করলো কয়েকদিন ধরে। মনোসিজ দাদা ফোনে জানালেন- ‘তোর তো বাসে-টাসে সমস্যা হয়, বিমানে আবার অন্য চাপও আছে। বিশেষত ওঠার সময় অনেকেরই সমস্যা হয়। তুই একটা এভোমিন ট্যাবলেট খেয়ে নিতে পারিস।’ দাদার কথা শুনতে শুনতে মনে পড়লো আমার আগের বছর ফিলিপাইনে যাওয়া সহকর্মী ইমরানুল আলম বলেছিলেন, বিমান যখন উপরের দিকে ওঠে, তার নাকি নাক দিয়ে রক্ত বের হয়েছিল। যা-হোক, একটা বিষয় স্বীকার করা ভালো- বাস-মাইক্রো বাসে জার্নির ক্ষেত্রে আমার প্রধানতম বন্ধু হলো সানোফি কোম্পানির এই এভোমিন ট্যাবলেট। সেই ১৯৯৬ সালে, বিশ্ববিদ্যায়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ফিরে আসার আগে কোনো এক সুহৃদ অগ্রজ (নাম ভুলে যাওয়া এই মানুষটিকে এই সুযোগে হাজার কৃতজ্ঞতা জানাই) আমাকে বলেছিলেন- ঘন্টাদুই আগে একটা এভোমিন খেয়ে নিও, বমি হবে না। খুব অবিশ্বাসের সাথে খেলেও ওর যাদু দেখে বিস্মিত ও আনন্দিত হয়েছিলাম। সেই থেকে দু’টাকার এভোমিন ট্যাবলেটটি আমার পরম বন্ধু। এর চেয়ে দশগুণ দামি ট্যাবলেটও ট্রাই করে দেখেছি, কোনো লাভ হয়নি। দুঃখের সাথে জানাতে হয়, এই দু’টাকার ক্ষুদ্র বড়িটি আমার ছেলে-মেয়েরও বন্ধু হয়ে উঠেছে ! যা হোক, ভ্রমণের আত্মগত ভয়ের সাথে যুক্ত হলো মায়ের ভার ভার মুখ। রাস্তায়-গাড়িতে যখন-তখন দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে কতো মানুষ, আর ওই শূন্যের উপরে এতগুলো মানুষ নিয়ে একটা বিমান উড়ে যাবে একদেশ থেকে আরেক দেশে ! অশীতিপর বৃদ্ধ, পুরনো সংস্কারযুক্ত, দুর্বল হৃদয়ের মমতাময়ী মাকে বোঝানোই মুশকিল হলো। আমাদের মতো সাধারণ মানুষ যেখানে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ পায় না, মা সেখানে বললেন- না-গেলে হয় না, পাগল ? মা আমাকে পাগল বলেই ডাকেন। সাত ভাই-বোনের কনিষ্ঠতম আমাকে নিয়ে সবসময়ই কেমন যেন বেশি চিন্তায় থাকেন। ৮ই এপ্রিল সন্ধ্যার পরে যখন ভাড়া করা প্রাইভেট কারটি বাসার নিচে এলো, মায়ের চোখের জল আর বন্ধ হয় না। প্রণাম করতে গেলে নিঃশব্দের কান্নাটা সশব্দে আছড়ে পড়ে কানে। আমার ডান হাতটা নিয়ে কনিষ্ঠ আঙুলটাকে আলতো করে কামড়ে দিলেন তিনবার। সেই ছোট্ট থেকে দেখে আসছি, একটু দূরে কোথাও বের হলে একইভাবে কড়ে আঙুলটাকে দাঁতের আলতো চাপে এঁটো করে দিয়ে পিঠে ও মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ করে দেন। আমার ভেতরে কোনো অযৌক্তিক আকাক্সক্ষা বা অলৌকিক আস্থা নেই কিন্তু মায়ের মানসিক তৃপ্তির জন্য অনেক যুক্তিশূন্য সংস্কারকে মাথা পেতে নিই, আর ভেতরে ভেতরে একধরনের আবেগ অনুভব করি। স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে সবারই মুখে একটা বিষণœতার ছাপ। কয়েকদিন থাকার পরে কোনো বাড়ি থেকে বিদায় নিতে গেলে স্বজনদের চোখ যেখানে ভারী হয়ে ওঠে, সেখানে বিদেশে-বিভুঁইয়ে যাওয়ার আগে পরিবারের মানুষের মনের অবস্থা কেমন হতে পারে, তা বাঙালিমাত্রই অনুমান করতে পারেন। অলোকা, রবীন্দ্রনাথের সেই ‘যেতে নাহি দিব’ কবিতার প্রিয়ার মতো অবস্থা তার- ‘ঘরের গৃহিণী, চক্ষু ছলছল করে, / ব্যথিছে বক্ষের কাছে পাষাণের ভার, / তবুও সময় তার নাহি কাঁদিবার / একদ- তরে; বিদায়ের আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে ফিরে; যথেষ্ট না হয় মনে…’। কাজ করছে, এটা-ওটা গুছিয়ে দিচ্ছে আর ভেতরে ভেতরে কতো কী যে ভাবছে ! গাড়িতে ওঠার আগে তার কোলের থেকে চার বছরের মেয়েটাকে ( এবং কী আশ্চর্য, ‘যেতে নাহি দিব’ কবিতার সেই মেয়েটি, যে-কি না বাবাকে বলেছিল- ‘যেতে নাহি দিব’ সেই মেয়েটিও ছিলো চার বছরের ! ) নিজের বুকে আদর করবার সময় নিজেকে আর সামলে রাখতে পারলাম কই !
বুকের ভেতরে অব্যাখ্যেয় একটি কম্পন নিয়ে গাড়িতে চেপে আমার সিঙ্গাপুর যাওয়ার সফরসঙ্গী, সহকর্মী আবুল কালাম আজাদকে টেকনিক্যাল কলেজের পিছনে তার বাসা নিয়ে রওনা হলাম খুলনার পথে। অমিয়দাও (অমিয় কুমার পাল) গেলেন খুলনা পর্যন্ত এবং সেখানে বিদায় জানাতে এলেন ভোলাদা ( ভোলানাথ ম-ল)। আমাদের ফ্লাইট ছিলো ১১ই মে সকাল ৮টা ২৫মিনিটে, বাংলাদেশ বিমানের বোয়িং ৭৮৭-এ। তার আগে ইমিগ্রেশনসংক্রান্ত কাজগুলো স্বাচ্ছন্দ্যেই হলো। দেখার অভ্যাস, বাস-ট্রেন… সবখানেই জানালার কোলঘেঁষে বসা আমার পছন্দ। কয়েকদিন ধরে ভাবছিলাম, বিমানের জানালার ধারে বসতে হবে, বাইরের অসীম শূন্যের দুনিয়াটা দেখতে হবে। কিন্তু কীভাবে ? সিট বরাদ্দ দেন যিনি, তাকে রিকোয়েস্ট করার পরামর্শ দিয়েছিলেন শোভনদা (শোভেন্দু কুমার পাল)। কিন্তু তা আর করতে হলো না, ওই ডেস্কের কর্মরত অফিসারটি বললেন- দাদা, কেমন আছেন ? ফেসবুক মারফত জেনেছি, আপনি সিঙ্গাপুর যাচ্ছেন। আমি বললাম- ভালো আছি, কিন্তু আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না ! তিনি বললেন- আমি আপনার লেখা-টেখা মাঝেমধ্যে পড়ি, আমিও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম, আপনার কয়েক বছরের জুনিয়র। আলাপের মধ্যেই জানালেন- দাদা, একেবারে সামনের ছিটের ঠিক পরের লাইনে, এটাকে সকলে ভিইআপি সিটের মতোই মানে, জানালার পাশের সিটেই আপনাকে দিলাম। না চাইতেই বৃষ্টির খবরে আনন্দিত আমি বললাম- ধন্যবাদ, আমার ঠিক পাশের সিট্টাতে আমার সহকর্মী আবুল কালাম আজাদকে দিন।
ইমিগ্রেশনের কাজকর্ম সেরে অপেক্ষমান যাত্রীদের জন্য নির্ধারিত কক্ষে বসে কাচের দেয়ালের ভেতর দিয়ে বাইরে, রানওয়েতে দাঁড়ানো বিমানগুলোর দিকে তাকিয়ে ভাবছি, বড়ো বড়ো দুটো হাত আর ছোটো ছোটো দুটো পা দুদিকে প্রসারিত করে রাখা এই যানগুলো মানুষকে পরিযায়ী পাখি বানিয়ে দিয়েছে ! কয়েকঘণ্টার মধ্যে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে কয়েক হাজার মাইল দূরে, একেবারে বিপরীত গোলার্ধের একটি দেশের মাটিতে নামিয়ে দিচ্ছে দিন না ফুরোতেই ! এরইমধ্যে বাংলাদেশ বিমানের ৭৮৭ বোয়িংটা যখন রানওয়েতে নড়তে শুরু করলো, আমাদের সঙ্গীরা একটু শোরগোল তুলে একে-অপরের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে অন্যরকম অনুভূতি নিয়ে একসময় বিমানের সিটে গিয়ে বসলাম। একটু পরে যখন বিমান আকাশে উড়বে, মোবাইল নেটওয়ার্ক থাকবে না বিধায় দু-একজন প্রিয়জনের সাথে কথা বলতে মুঠোফোনটা হাতে নিলাম। ছোটদাকে ফোন দিলাম, শাশুড়িমাকে ফোন দিলাম, শেষে বাসাতেও। অলোকা বললো- মা’র প্রেসার বেড়ে গেছে অনেক। মুহূর্তেই মনটা বিষণœ হয়ে এলো। অন্য অনেকের চেয়ে অনেক বেশি কোমলস্বভাব ও দুর্বল মনের মানুষ আমার মা। তার উপর যে-বয়স হয়েছে, মায়া ও মৃত্যুচিন্তা নিশ্চয় অনেক বেশি। মা’র সাথে কথা বলো- বলে ফোনটা মায়ের হাতে দিলো অলোকা, কিন্তু মা ফোনটা হাতে নিয়েই যে হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলেন, তাতেও আমারও বুকের ভেতরটা আটকে আসতে চাইলো।- মা, তুমি এতো চিন্তা করছো কেন ? নিজেকে সামলে নিয়ে আমি বললাম। কান্নাজড়িত কণ্ঠে মা বললেন- আমি তো চিন্তা কত্তি চাচ্ছিনে, তাও এরকম হচ্ছে তা কী করবো ?- বলতে বলতে আবারও কেঁদে ফেললেন। কিছুক্ষণ নীরব থেকে অনেকটা স্বাভাবিক কণ্ঠেই বললেন- ঠিক আছে, তুমি সাবধানে যাও, বাবা।
বিভিন্ন যাত্রীর মালামাল গোছানোর কাজ, বিমান স্টাফদের নিজস্ব প্রস্তুতি এসব চলছে; আমরাও টুকটাক কথা বলছি, কিন্তু মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে। বিমানের মাইকে সর্বশেষ সংকেত বেজে ওঠার পরই আরেকবার বাসায় যোগাযোগের চেষ্টা করলাম। কিন্তু ওপাশ থেকে স্পষ্ট কোনো কথা শুনতে পেলাম না, মনে হলো একাধিক মানুষের কান্নার স্বর। মাথার ভেতরে বিদ্যুৎ খেলে গেল- আমার মা’র কোনো দুর্ঘটনা ঘটলো না তো ! বুকটা ধুক্ ধুক্ করতে থাকলো। পাশে বাস আজাদ সাহেবকে বললাম- আজাদ ভাই, মনে হলো লোকজন কাঁদছে, কে জানে, মা’র কোনো সমস্যা হলো কি না ? মনে মনে এরকম ভাবনাও এলো- সিঙ্গাপুরে পৌঁছানোর পরপরই মায়ের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে আবার ফিরে আসতে হবে না তো ! সেই মুহূর্তের মনোভাবটা এখন আর পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়।
নীল আকাশে মেলেছি যখন ডানা…
রানওয়েতে গতি বাড়াতে বাড়াতে সহসাই শূন্যে উড়াল দিলো বোয়িং ৭৮৭। জানালা দিয়েই দেখতে থাকলাম ক্রমে ক্রমে দেশের মাটি, গাছপালা, জলাশয় ছোটো হতে হতে কয়েকমুহূর্তেই সব ঝাপসা হয়ে এলো। একটু বলে রাখি, সিঙ্গাপুরে যাওয়ার অফিস অর্ডার প্রাপ্তি থেকে শুরু করে বিমানের উপরে ওঠার আগ্মুহূর্ত পর্যন্ত মাঝেমধ্যেই বিমান দুর্ঘটনার বিভিন্ন উদাহরণ আমার মনে কাঁটার মতো খচ্খচ্ যে করেনি, তা কিন্তু নয়। এমনকি সহকর্মী দু-একজনের সাথে মাঝে-মধ্যে ইয়ার্কি করে বলতাম- সবার নিকট থেকে বিদায়-টিদায় নিয়ে যাবো, আমি যে ফ্লাইটে উঠবো, সেটা দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হতে পারে। অবশ্য শেষপর্যন্ত সাহস সঞ্চার করেছি এই ভেবে যে- হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন এভাবে আকাশে উড়ছে, বছরে দু-একটি দুর্ঘটনা ঘটছে, সেটা যদি এই ফ্লাইটেই হয়, আছে শতাধিক মানুষ, সকলেরই নিয়তি তো অভিন্নই হবে। এ আর এমন কী ! অন্তত, সড়ক দুর্ঘটনার মতো গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালের বিছানায় কাতরাতে তো হবে না ! কয়েকমুহূর্তের মধ্যে ছেলেমানুষি দুর্ভাবনা থেকে বের হয়ে নিজেকে বরং রিল্যাক্স মুডে নিয়ে নিলাম। চোখ জানালার বাইরে। কিছুক্ষণের মধ্যেই নিচে ঝাপসা কিন্তু অথৈ জলরাশির অস্তিত্ব অনুভব করলাম, কিন্তু সে-ও কয়েকমুহূর্তই। অচিরেই সাদা মেঘের রাজ্যকেও অনেক নিচে দেখতে পেলাম। সাদা সাদা মেঘমালাকে মাটি থেকে দেখে এসেছি এতদিন, তাদেরকে টপকে কতো উপরে উঠেছি আমি ! মনে পড়ে গেল শৈশব-কৈশোরের দিনগুলো। নীল আকাশের বুকে সাদা মেঘের পাহাড় দেখে মনে হতো- আহ, ওই পাহাড়ের উপরে গিয়ে যদি বসে থাকতে পারতাম ! বিশেষত শরতের বিকেলে সাদা মেঘের ভেলায় মনটাই ভেসে গেছে চিরকাল। আজ সেই মেঘকে অনেক অনেক নিচে রেখে শূন্যে ভেসে যাচ্ছি আমি ! অনাস্বাদিতপূর্ব এক শিহরণ বয়ে গেল ভেতরে। আমার সামনের সিটের পিঠে আমার জন্য যে স্ক্রিন বরাদ্দ, তাতে মাঝে মাঝে দেখে নিচ্ছি আমাদের গতিপথের মানচিত্র ও ভূ-পৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা। একসময় দেখলাম ৪৩,০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থান করছি আমরা। আজাদ ভাই বললেন- দীপ দা, তেতাল্লিশ হাজার ফুট ! আমিও রোমাঞ্চিত হলাম। মনে মনে ভাবছি, এখন যদি বিমানটা বিধ্বস্ত হয়, তাহলে তো আমাদের কোনো অস্তিস্ত¡ই খুঁজে পাবে না কেউ। অতএব- নো চিন্তা, ডু ফুর্তি। মুখে বললাম- আজাদ ভাই, কতো রকমের দুশ্চিন্তা আসতে চাইছে মনে, কিন্তু ওসবকে পাত্তা না-দিয়ে আমরা এই জার্নিটা উপভোগ করি। আজাদ ভাই বললেন- রাইট। চোখ ভরে দেখতে থাকলাম জানালার বাইরে। আমরা দু-জনে সিট বদলেও নিলাম। জানালার একেবারে কাছের সিটটিতে বসে আজাদ ভাইয়ের আনন্দ আরও বেড়ে গেল। বিমান বালিকা এসে যখন বললেন- চিকেন না কি মাটন ? জার্নিতে ‘মাটন’ বিষয়ে আমার সামান্য দ্বিধা থাকলেও আজাদ ভাই সাহস করে ‘মাটন’ই অর্ডার দিলেন দুজনের জন্য। পরে খাওয়ার সময় আমি বললাম- খাসির মাংসের অর্ডার দিয়ে আপনি কিন্তু ভালোই করেছেন। অসীম নীল শূন্যতা আর সাদা মেঘের অরণ্যের দিকে চেয়ে চেয়ে অনিন্দ্য ভাবনার রাজ্যে ভেসে আছি। মোবাইলের ক্যামেরাটিও চলমান। ছবি তুলছি, ভিডিও করছি- কাচের এপার থেকে। সাদা মেঘরাশির উপরে মাঝে-মধ্যে কুয়াশার চাদরের মতো দেখে পর্বতমালার সাদৃশ্য অনুমান করে নিচ্ছি। মনে মনে ধন্যবাদ দিচ্ছি অরভিল রাইট আর উইলবার রাইটকে।
২.
ঘন্টায় প্রায় এক হাজার কিলোমিটার গতির কথা ভাবলে সিঙ্গাপুর খুব বেশি দূরের দেশ নয়, ঘন্টাচারেকের পথ মাত্র। আমার তো বাগেরহাট থেকে শ্যামনগরে যেতেই লাগে সাড়ে চার ঘন্টা, ঢাকায় যেতে মাঝে মাঝে দিন কাবার হয়ে যায়; আর ঢাকায় পৌঁছে সায়েদাবাদ থেকে মিরপুর পৌঁছাতেই তিন ঘন্টা লেগে যেতে পারে কখনওবা। এসব যখন ভাবছি, সহসা নীল জলরাশি ঝকঝক করে উঠলো জানালার বাইরে। নীল ভূ-মানচিত্রও যেন। সিঙ্গাপুরের এসেই গেছি ! চাঙ্গি বিমানবন্দর। দেশ হিসেবে সিঙ্গাপুর খুব ক্ষুদ্র, তবে বিমানবন্দর হিসেবে চাঙ্গি বিশ্বের অন্যতম। অনেক ব্যস্ত বিমানবন্দর। জায়গা কম, রানওয়ে হিসেবে কেবল ভূমিই নয়, ফ্লাই ওভারের মতোও আছে মনে হলো। সত্যি বলতে কী, দেশটা যে সাজানো-গোছানো, বিমান ল্যান্ড করার পূর্বেই তা বোঝা যাচ্ছে। মাটি স্পর্শ করার আগেই আমাদের মনে একটা শিহরণ খেলে গেল- আহ, সিঙ্গাপুর ! বিমান থেকে নেমে বন্দরের বিভিন্ন ক্রিয়াকর্মের মুখোমুখি হচ্ছি একের পর এক। একটু অন্যরকম হলো লাগেজ বুঝে নেওয়ার প্রক্রিয়াটি। একটি দীর্ঘ আঁকা-বাঁকা চলন্ত পথে অনেক লাগেজ ঘুরে বেড়াচ্ছে, যার একাধিক আবার একইরকমের দেখতে, সেগুলোর থেকে নিজেরটা চিহ্নিত করে ছিনিয়ে নিতে হবে। হ্যাঁ, অনেকটা ছিনিয়ে নেওয়াই, চলমান রাস্তা থেকে লাগেজ ধরে নামিয়ে নিতে গেলে বেশ খানিকটা শক্তি প্রয়োগ করতে হয়, যেন চলন্ত গাড়ি থেকে ছিনতাই প্রক্রিয়া ! লাগেজ নেওয়ার পরপরই আমাদের গাইড চলে এলেন। মুখে একরাশ হাসি নিয়ে- ও’স গৎ ঐবব বলে স্বাগত জানালেন আমাদেরকে। প্রাথমিক কিছু কাজ সম্পর্কে বুঝিয়ে বললেন। প্রত্যেকের জন্য পরিচয়পত্র, কলেজের গেইট বন্ধ থাকলে তা খোলার জন্য একটি পাঞ্চ কার্ড এবং কলেজ ও এ্যাপার্টমেন্ট এলাকায় ওয়াই-ফাই ব্যবহারের আলাদা আলাদা পাসওয়ার্ডসহ অতি-প্রয়োজনীয় দু-একটি কাগজপত্র দিলেন। তার পরামর্শমতো আমরা অনেকেই ডলার চেঞ্জ করে নিলাম। ঢাকা থেকে মার্কিন ডলার ও সিঙ্গাপুর ডলার নিয়েছিলাম। মার্কিন ডলারগুলো সিঙ্গাপুরিয়ান করে নিলাম। পরে বুঝেছি, ওখান থেকে এক্সেঞ্জ না করে ফেরার পার্ক এলাকার মোস্তফা সেন্টারের পাশের থেকে বিনিময় করলে আরও কিছু ডলার বেশি পাওয়া যেতো।
বিমান বন্দর থেকে বের হতেই দেখলাম বাস অপেক্ষমান। তাগড়া এক জোয়ান এসে আমাদের লাগেজগুলো তুলে নিলেন একটি লরিতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা নামলাম নানিয়াং পলিটেকনিক ইন্টারন্যাশনাল-এর আবাসিক বিল্ডিং-এর নিচে। এলাকার নাম এ্যাঙ-মো-কিও। আগে থেকেই আমাদের জন্য ফ্ল্যাট বরাদ্দ ছিলো। চারজন মানুষের জন্য একটি ফ্ল্যাট। ফ্ল্যাটে একটি ডাইনিং কাম টিভি রুম, দুটি শয়নকক্ষ, দুটি ওয়াশরুম ও একটি কিচেনরুম আছে। আজাদ ভাই একটু রিকোয়েস্ট করে আমাদের দুজনের জন্য এটাচড্ বাথসহ একটি বড়ো রুমের ব্যবস্থা করতে সমর্থ হলেন। উল্লেখ্য, আমাদের কুড়ি জনের ব্যাচের তিনি কো-লিডার। ঢাকার কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে আমাদের যে-ব্যাচটির তালিকা হয়েছিল, সেখানে আমার নামটি এক নম্বরে ছিলো বিধায় অধিদপ্তরের একজন পরিচালক স্যার আমার কাছেই জিজ্ঞাসা করেছিলেন, টিম লিডার ও কো-লিডার কাকে বানাবেন। অন্য শিক্ষকদের বিষয়ে আমার জানাশোনা কম থাকায় এবং আমি নিজে খানিকটা ভেতরগোঁজা স্বভাবের মানুষ হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় সহপাঠী, বন্ধু ইমদাদুল হক মামুনকে লিডার ও আমারই বাগেরহাট টেকনিক্যাল কলেজের সহকর্মী মো. আবুল কালাম আজাদকে কো-লিডার করার অনুরোধ করেছিলাম। এবং একথাও বলা ভালো, সিঙ্গাপুরে যেহেতু ইংরেজি ভাষাতেই আমাদের যোগাযোগ করতে হবে, স্পোকেন ইংলিশে দক্ষ আজাদ ভাইকে বেছে নেওয়াটাই স্বাভাবিক ছিলো।
আমাদের বিল্ডিংটি ছোট্ট টিলার ওপর। অবশ্য টিলা যে, তা খুব স্থিরভাবে না-দেখলে সহজে বোঝা যায় না। কক্ষটির একটি পাশ প্রায় পুরোটাই কাচের জানালা, এ্যাঙ-মো-কিও’র প্রধান সড়কের একটি মোড়সহ শহরটাকে অপূর্ব দেখা যায়। রাতের বেলায় রঙিন আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওরা আরও মোহনীয় হয়ে ওঠে। আর হ্যাঁ, শহর মানে কোনো একদিকে শহর অন্যদিকে শহর নয়, এরকমটা নয়; সবদিকেই শহর। কিন্তু এর চেয়ে বড়ো কথা হলো সেই সবদিকে শহরেরও সবদিকে গাছপালা, সবুজের সমারোহ। প্রকৃতিকে বাদ দিয়ে কোনোদিকের কোনো শহর নেই; শহর আর প্রকৃতি একাকার। বাসায় থেকেও যেটুকু দেখা যায়, মুগ্ধ হয়ে যাই। এই মুগ্ধতার রেশ পুরো সিঙ্গাপুর যাপনকালেই (২৩দিন) অব্যাহত ছিলো। শুধু রাত নয়, কক্ষে থাকা অবস্থায় অবসর পেলেই আমরা জানালার দিকে গেছি। আজাদ ভাই মাঝে-মধ্যে পুরো কাচটাই খুলে দিয়ে কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন, ভাবি এবং কোনো কোনো স্বজনকে দেখিয়েছেন ভিডিওকলে।
নানিয়াং পলিটেকনিক ইন্টারন্যাশনাল
আমরা গেছি আমাদের শিক্ষাদান পদ্ধতির অগ্রগতি বিষয়ক বিশেষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে। সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত সেই কাজেই নিবেদিত থেকেছি। কিন্তু ছুটির সাথে সাথেই বের হয়ে পড়েছি সিঙ্গাপুর দর্শনে। ছুটে বেড়িয়েছি একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে। এ্যাঙ-মো-কিও আমাদের আবাসিক। এবং সেখানেই আমাদের প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট ‘নানিয়াং পলিটেকনিক ইন্টারন্যাশনাল’ অবস্থিত। নানিয়াং একটি কমপ্লেক্স শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। প্রথম দু-তিন দিন লেগেছে আবাসস্থল থেকে শ্রেণিকক্ষে যাওয়া-আসার পথগুলো ঠিকঠাক চিনে রাখতে। তা-ও কি পেরেছি আমরা ? দূরদেশে দিকভ্রম- খুব সহসাই কাটতে চায় না। বিশেষত, দলবদ্ধভাবে আসা-যাওয়া না-করে একা যখনই কেউ মুভ করতে গেছি, পথভ্রষ্ট হয়েছি বা হওয়ার উপক্রম হয়েছি। মাটির উপরে যেমন, তেমনি মাটির নিচেও এর অনেক ক্লাসরুম, প্রশিক্ষণশালা ও গবেষণাকেন্দ্র। চলতে চলতে কখন মাটির নিচের কক্ষে প্রবেশ করছি, কখন মাটির উপরের কক্ষে উঠছি, খুব সতর্ক না-থাকলে বুঝতে পারিনি। আর প্রকৃতিগতভাবে মাটিও অসমতল, ফলে একই উচ্চতায় একস্থানে মাটির উপরে, তো অদূরেই তা মাটির নিচে। বিল্ডিং নির্মাণের জন্য কোথাও মাটিকে জবরদস্তি করে সমতল করবার চেষ্টা করেনি বলেই মনে হয়। তাই বলে অপরিকল্পিত বা অসুন্দর নয়, বরং একেবারে সুপরিকল্পিত এবং সুন্দরের ছোঁয়া সর্বত্র। ক্লাসরুমের করিডোর কিংবা ব্যালকনিতেই রয়েছে সবুজের নান্দনিক আয়োজন। কোনো কোনো জায়গা দেখে অপরূপ নন্দনকানন বলেই মনে হয়। শুধু সবুজ নয়, একাধিক জায়গায় আছে নির্মিত লেক, ঝরনা, আর আলোকসজ্জা। আর হ্যাঁ, লেকে মাছও আছে নানারঙের। একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শুধু শিক্ষাদান ও গ্রহণ নয়, নান্দনিকতার চর্চাও যে কতটা জরুরি, এখানে দেখলে তা অনুভব করা যায়। ছাত্র-শিক্ষকের মন ভালো করে দেওয়া সব দৃশ্য। প্রকৃতি এখানে সৌন্দর্যচর্চার অনিবার্য সঙ্গী।
নানিয়াং-এ বর্তমান আধুনিক বিশ্বের প্রয়োজনীয়তা ও আগামীর অগ্রগতির সাথে তালমিলিয়ে বিভিন্ন ফ্যাকাল্টি রয়েছে। এখানকার ছাত্র-ছাত্রীরা সিঙ্গাপুর থেকে শুরু করে এশিয়া-ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশের। এরা শুধু শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের লেকচার শোনে না, লেকচারের চেয়ে বেশি যা তাদের অনুসরণ করতে হয়, তা-হলো ব্যবহারিক ক্লাস। তথ্যপ্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার ও তার শিক্ষা তো আছেই, গেঞ্জি, ভ্যানিটি ব্যাগ, খেলনা প্রভৃতি ক্ষুদ্র শিল্পের চর্চাও করে এখানকার শিক্ষার্থীরা। একেক দিন একেকটি ফ্যাকাল্টি ও তাদের ক্রিয়াকর্ম দেখেছি আমরা। মোবাইল-কম্পিউটার থেকে বিমান তৈরির প্রযুক্তিও সেখানে শেখানো হচ্ছে ! ওদের শ্রেণিকক্ষগুলোতে উচ্চস্বরে বকাবকি তো নেই-ই তাত্ত্বিক বক্তব্যও কম; হাতে-কলমে শিক্ষাটা সত্যিকার অর্থেই সার্থকতা পেয়েছে এখানে। ‘স্কুল অব ডিজাইন’-এর কক্ষগুলোতে কতোরকমের ডিজাইন যে দেখলাম ! ছবিও তুললাম কতো ! অধিকাংশ পাঠকেরই ধারণা রয়েছে, এখানে কেবল তথ্যপ্রযুক্তিগত ও বাণিজ্যপ্রভাবিত শিক্ষাব্যবস্থাই বহাল আছে। আমারও ধারণা হয়েছিল তাই। কিন্তু এক বিকেলে ঘুরতে ঘুরতে দেখলাম ‘হেলথ এ্যান্ড সোশাল সাইন্স ফ্যাকাল্টি’ এবং সেই বোর্ডে ‘থিয়েটার ফর দ্য আর্টস’ ! প্রথম দৃষ্টিতে খানিকটা অবিশ্বাসের সাথে চোখ কচলে নেওয়ার মতো ব্যাপার। আমাদের দেশে সরকারি-বেসরকারি শতাধিক পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট আছে, কিন্তু কোথাও থিয়েটার বা আর্টস আছে বলে আমার জানা নেই। বরং আমাদের পলিটেকনিক-এর লোকজন শিল্প-সংস্কৃতিকে বিশেষ সুনজরে দ্যাখেন না বলেই আমার পর্যবেক্ষণ। নানিয়াং-এর শিক্ষাদান পদ্ধতি অভিনব ও প্রভাববিস্তারী হওয়ার আরেকটি কারণ, আমার মনে হয় এখানকার শিক্ষক নির্বাচন প্রক্রিয়া। কৃতিত্বের সাথে সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই এখানে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান না। প্রশিক্ষণ তো আছেই, তিন-চার বছরের শিক্ষানবিশী কাল অতিবাহিত করেই তবে শিক্ষক হওয়া যায় এখানে। নানিয়াং-এ যারা শিক্ষক হিসেবে আছেন, শিক্ষার্থীদের মতো তারাও বিভিন্ন দেশের। যিনি যেখানকারই হোন না কেন, পড়ার ও পড়ানোর ভাষাটা ইংরেজি। ইংরেজি, তবে উচ্চারণে স্বদেশীয় প্রবণতার ঝাঁঝ টের পাওয়া যায়। আমাদের একজন চীনা প্রশিক্ষক ছিলেন, যিনি অত্যন্ত কোয়ালিটিসম্পন্ন, কিন্তু উচ্চারণে স্বাদেশিকতার কারণে দু-একটি শব্দ দুর্বোধ্য হয়ে উঠতো আমাদের কাছে। এ্যান্জেলিনা জেলি নামের একজন ম্যাডাম ছিলেন, একেবারে অমায়িক স্বভাবের, মাতৃমূর্তি যেন; অসামান্য দরদ মিশিয়ে তিনি বক্তৃতা করেন, পড়ানোর বিষয়গুলোকে সহজবোধ্য করে তুলে ধরেন। একদিন আমার পাশে এসে বসে পারিবারিক বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ ও আলোচনা করেছিলেন। আমি যে মাঝে-মধ্যে আমার ছেলের উপরে রাগ করি, সকল কাজে ওর অসহনীয় শ্লথগতিতে বিরক্ত হয়ে দু-একবার গায়ে হাত তুলি, এ-বিষয়টি শেয়ার করায় তিনি অনেকটা ¯েœহের সুরেই বকে দিলেন আমাকে। ম্যাডাম এসথার বে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকা, কিন্তু আমাদের দেশের শীর্ষকর্তাসুলভ কোনো ভাবগাম্ভীর্য নেই, কথাবার্তায় বড়োকর্তাসুলভ কঠোরতা নেই; মুখে ও হাসিতে তারুণ্যের মূর্তি ও মায়া জেগে থাকে সর্বক্ষণ। আরও বেশ কয়েকজন শিক্ষক-কর্মকর্তার সংস্পর্শ পেয়েছি আমরা, কিন্তু কোনো বড়কর্তা পাইনি। আর হ্যাঁ, তারা প্রত্যেকেই তাদের বয়সের তুলনায় অন্তত বিশ বছরের কম হিসেবে ধরা দেন আমাদের বাংলাদেশিদের কাছে। ছাত্র-ছাত্রীদেরকে দেখেছি হই-হুল্লোড়হীন, যেমন শ্রেণিকক্ষে, তেমনি শ্রেণিকক্ষের বাইরে। কোনো শ্রেণিকক্ষে যখন গেছি, নিবিষ্ঠচিত্তে নিজেদের কাজে মগ্ন তারা। আমরা যে ভিন-পোশাক ও চেহারার একদল লোক প্রবেশ করেছি, আমাদের দেশের মতো হা-চোখে তাকিয়ে থাকছে না কেউ ! শ্রেণিকক্ষের বাইরে তারা ঘোরাঘুরি করছে, কথাবার্তা বলছে, গান-বাজনা শুনছে, খাবারের কেন্টিনগুলোতে ভিড় জমাচ্ছে; কিন্তু কোথাও আমাদের দেশের মতো অহেতু শোরগোল নেই, বিরক্তিকর শব্দদূষণ নেই। সবখানে কেমন শৃঙ্খলাপূর্ণ সহাবস্থান।
সিঙ্গাপুরের পথে পথে…
রশিক্ষণ গ্রহণের দিনগুলোতে বিকাল ৫টা পর্যন্ত নানিয়াং-এর ভেতরেই ব্যস্ত থেকেছি, কিন্তু ছুটি হতেই ছুটে গেছি প্রতিষ্ঠানের বাইরে। আমরা যেন অপেক্ষা করতাম, কখন ছুটি হবে; ছুটি হলেই ছুটোছুটি বেধে যেতো আমাদের। আগের থেকেই পরিকল্পনা থাকতো- কোনদিকে যাবো আজ। আমাদের দুই ব্যাচ মিলিয়ে ৪০ জন শিক্ষক, যেদিন নানিয়াং কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে বেড়ানোর ব্যবস্থা থাকতো, কখনও এক ব্যাচ এক ব্যাচ করে, কখনও আবার দুই ব্যাচ একত্রিত করে; সেদিন আমাদের আবাসিক বিল্ডিং-এর নিচ থেকেই বাসে ওঠার ব্যবস্থা থাকতো। ক্লাসের মতোই বাসে ওঠা-নামা ও ভ্রমণের জন্য সময় নির্ধারিত ছিলো। আমাদের প্রধান গাইড মিস্টার হি অত্যন্ত কো-অপারেটিভ মাইন্ডের, আমাদের হাজার প্রশ্নের জবাব দিতেন হাসিমুখেই। কিন্তু সময়ের হেরফের হলে তিনি অসন্তুষ্ট হতেন, মাঝেমধ্যে সেই অসন্তোষ প্রকাশও করতেন। আসলে শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নয়, সবক্ষেত্রেই সিঙ্গাপুরের মানুষ সময়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল; সময়ের অপচয়- বোধকরি ওদের ধাতে নেই। পূর্ব নির্ধারিত সময়ের আগেই বাস এসে অপেক্ষা করতো। অপেক্ষা করতেন মি. হি’ও। কিন্তু আমরা তো বাঙালি, প্রায়ই দেখা যেত আমাদের কেউ না কেউ সাজুগুজু করে নেমে আসতে দু-চার মিনিট সময় পার দিচ্ছেন। বেড়ানোর দিনে আমরা কোর্ট-প্যান্ট পরতাম না সাধারণত, আর ওরা কোনো সময়ই ওসব পরতে চান না। ভারি পোশাক ওদের কালচারে নেই। বাসে উঠে একেকদিন একেক বিশেষ স্থানে আমাদেরকে নিয়ে যেতেন মি. হি (একদিন অন্য আরেকজন ছিলেন, যার নামটা এখন আর মনে নেই)। কী সুন্দর সব বাস ! শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত, দুপাশে কাচের দেয়াল। কাচগুলো এতো স্বচ্ছ যে, কিছু নেই বলেও ভ্রম হতে পারে মাঝে-মধ্যে। আমরা চর্মচক্ষে তো বটেই মোবাইল ক্যামেরার চোখগুলোকেও অবিরাম খুলে রাখতাম কাচের ভেতর থেকে। আগেই জানতাম- সিঙ্গাপুর ছোট্ট দেশ, যেখানে কোনো গ্রাম নেই। চোখে দেখলাম, শহর হলেও দেশটা আসলে ছবির চেয়ে সুন্দর। সারি সারি অট্টালিকা এখন অল্পোন্নত দেশেও আছে, কিন্তু সেই অট্টালিকার ভেতরে এমন নান্দনিকতা ও পরিচ্ছন্নতা, এমন সবুজের ছোঁয়া কেবল উন্নত রুচি আর সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার মানসপ্রসূত দেশের পক্ষেই সম্ভব। দুপাশে একটার পর একটা অসাধারণ ডিজাইনের সুউচ্চ ভবন দেখতে দেখতে আমাদের অনেকের মুখ থেকে মাঝে-মধ্যেই ‘ওয়াও’ ‘ওয়াও’ ধ্বনি বের হচ্ছিল। আমাদের রাজধানী শহরেও উঁচু বিল্ডিংয়ের অভাব নেই এখন, কিন্তু নান্দনিকতা ও পরিকল্পনার দিক থেকে সেগুলো তুলনীয়ই নয় সিঙ্গাপুরের সাথে। বার বার রোমাঞ্চিত হয়েছি- এমন অসাধারণ সব ডিজাইন হতে ইমারতের ! ডিজাইনের পাশাপাশি প্রায় প্রত্যেকটি ভবনেই সবুজকে যেখানে সাজানো হয়েছে, তাতে ওগুলো অপরূপ রূপেই ধরা দেয় যে-কোনো মানুষের চোখে। অনেক ভবনেই সবুজের সমাহার, কোনো কোনো ভবনে গাছপালার আধিক্য দেখে মনে হতে পারে– এরা তপোবনপ্রেমি। কিন্তু আসল কথা হলো, প্রকৃতিকে ভালোবাসে প্রত্যেকেই, কিন্তু প্রকৃতিকে সকল ক্ষেত্রে নান্দনিকভাবে ব্যবহারের কাজটি করতে হলে সুন্দর পরিকল্পনা থাকতে হয়। ওদের সব ভবনের সবুজই প্রাকৃতিক নয়, কোনো কোনোটা আর্টিফিশিয়াল বা কৃত্রিম, কিন্তু উভয়ক্ষেত্রেই এমন সাজানো-গোছানো যে দুটোকেই প্রাকৃতিক ও অভিন্নসুন্দর বলে মনে হয়।
সুউচ্চ সৌধগুলোতে যেখানে সবুজের সমারোহ, সেখানে রাস্তা-মাঠ বা ফাঁকা জায়গাগুলোতে যে সবুজের অবগাহন থাকবে, এটা সাধারণভাবেই অনুমেয়। যে-কদিন ছিলাম, প্রত্যেকদিনই বের হয়েছি। তন্ন তন্ন করে ঘুরে বেড়িয়েছি দেশটা। আমাদের পদছাপ পড়েনি কিন্তু দর্শনযোগ্য, এমন জায়গা যেন বাকি না-থাকে, তার জন্য সাধ্যমতো ছুটে বেড়িয়েছি আমরা। তো, ট্রেনে-বাসে-পায়ে হেঁটে, এমনকি পিকআপেও দীর্ঘ পথ অতিক্রম করেছি, কিন্তু রাস্তার পাশে, দু-রাস্তার মাঝের ডিভাউডার এলাকায় কখনও প্রকৃতি ও সবুজশূন্য দেখিনি। রাস্তার পাশ দিয়ে ঘনো সবুজের চোখ জুড়ানো সাজসজ্জা। শুধু কি রাস্তায় ? রাস্তার উপর দিয়ে যে পায়ে চলার ‘ওভার পাস’, একটি সড়কের উপর দিয়ে আরেকটি সড়ক কিংবা এমআরটি রেল-এর আরেকটি রাস্তা, সেখানেও সবুজের সযত্ন লালন। উড়ালসেতু বা সাধারণ সড়কগুলোতে লতাজাতীয় গাছ ও ফুলের সমারোহ লক্ষণীয়। ফুলগুলো কেমন যেন ঝরে না, ঝরলেও আমাদের দেশের মতো দ্রুত না; অন্তত আমার তাই মনে হয়েছে। এটা হতে পারে আবহাওয়ার কারণে। সিঙ্গাপুরের আবহাওয়া খুব গরম নয়, খুব ঠা-াও নয়, আমাদের দেশের বসন্তের মাঝামাঝি সময়ের মতো। সারাবছর প্রায় একইরকমের থাকে, যেন চিরবসন্তের দেশ। অবশ্য চিরবসন্তের দেশ বললে আমাদের দেশের বসন্তের চেহারাটাই যদি মনে পড়ে, তাহলে ভুল হবে। সিঙ্গাপুর এমন একটি রাষ্ট্র, যার মাটি ও আবহাওয়া ঠিক আমাদের মতো শস্য-শ্যামল নয়। মাটিতে ধুলিকণা কম, তুলনামূলকভাবে শক্ত ও মোটা কণাবিশিষ্ট। এখানে গাছপালা আমাদের মতো এমনি এমনি ভরে যায় না, লাগাতে হয়। তাছাড়া আয়তনে খুব ক্ষুদ্র হওয়ায়, এমন কোনো গাছপালা ওরা লাগায় না, যাতে খুব জায়গা জুড়ে নিতে পারে। পাতাঝরা কিংবা খুব পচনশীল বৃক্ষও বিরলপ্রায়। ফলের গাছও নেই বললেই চলে। আমগাছ দেখেছি, আমও ঝুলছে তাতে, কিন্তু মাটির প্রতিকূলতা আর জায়গার অপ্রতুলতা হেতু এ-ধরনের ফলের গাছ লাগানোর চেয়ে ফল আমদানিতেই ওদের আগ্রহ। বিভিন্ন বাজারে বিচিত্র রকমের ফলের যে প্রাচুর্য দেখেছি, কিন্তু সবই আমদানিকৃত। চীন ওদের ফলের প্রধান যোগানদাতা, তবে মালয়েশিয়ার ফলও প্রচুর আছে। রয়েছে ভারত এমনকি বাংলাদেশের দু-একটি ফলও। অবশ্য বাংলাদেশি ও ভারতীয়দের বসবাস ও আনাগোনা বেশি, এমন এলাকাতেই ভারত-বাংলাদেশের ফল, এমনকি ফুলও পাওয়া যায়।
শুধু রাস্তার আশেপাশে ও উড়াল সেতুর গায়ে নয়, যেখানে যেটুকু ফাঁকা অবশিষ্ট আছে, সেখানেই সবুজের আয়োজন দেখতে পেয়েছি। মালয়েশিয়ার সীমান্তসংলগ্ন উডল্যান্ড ওয়াটারফ্রন্ট দেখতে গিয়েছিলাম। বেশ বড়ো একটি নদী, ওপারে মালয়েশিয়া; নদীর উপরে রেস্টুরেন্ট, ঘুরে বেড়ানোর মতো প্রশস্ত ও দীর্ঘ রাস্তা। সেখানে দাঁড়িয়ে নদীর বাঁকে তাকালে সিঙ্গাপুরের তীরে দেখা যায় ঘনো অরণ্য নদীর জলে ঝুঁকে আছে। ওটা দেখেই সুন্দরবনের কথা মনে পড়েছিল আমার। ভেতরে না-হলেও ওই অরণ্যের মুখের দিকে সামান্য প্রবেশ করেছিলাম। রাস্তা আছে, পার্কের মতো খানিকটা। গাছ-ফল-ফুল সবই আছে, কিন্তু গাছপালা সম্পর্কে ব্যাপক অজ্ঞতাহেতু কোনটাই ঠিক চিনতে পারলাম না। অরণ্য বা অরণ্যের মতো সবুজ আরও আছে সিঙ্গাপুরে। তবে সিঙ্গাপুরের প্রধান অরণ্যগুলো মূল ভূখ-ের বাইরে ছোটো ছোটো কয়েকটি দ্বীপে। অবশ্য মূল ভূখ-ের পুরোটাই নগর হলেও নাগরিক জীবনের কোনো একটি জায়গাকেও সবুজ থেকে বিচ্ছিন্ন করেনি পরিকল্পনাবিদরা।
নাগরিক সৌন্দর্যে ফিরে আসি। সিঙ্গাপুর ভ্রমণের কাহিনিতে সবুজের আলাপ দীর্ঘ করলে হতাশ হতে পারেন পাঠক। সুউচ্চ আর অপূর্ব ডিজাইনের সব বিল্ডিং-এর দেশ সিঙ্গাপুরের রয়েছে দুর্দান্তসুন্দর যোগাযোগ ব্যবস্থা। সবচেয়ে বেশি মানুষ যে-বাহনে চলে, তা-হলো ট্রেন। হয়তো ভুল বললাম, ট্রেন বললে আমাদের চিরচেনা ট্রেনের সাথে মেলাতে গিয়ে ভুল করে ফেলবেন পাঠক। ট্রেন বলতে বলতে গজঞ ট্রেনকে বোঝাতে চেয়েছি। গজঞ- গধংং জধঢ়রফ ঞৎধহংরঃ লাইনে চলাচল এতো সুন্দর ও আরামপ্রদ, বলার অপেক্ষা রাখে না। অল্প দূরত্বেই এক-একটি স্টেশন, ফলে যে-কোনো জায়গাতে যাওয়ার জন্যেই মানুষের প্রথম পছন্দ এমআরটি ট্রেন। আমরা এ্যাঙ মো কিও এলাকায় থাকতাম। ওখান থেকে পায়ে হাঁটা দূরত্বেই দুটো ট্রেন স্টেশন- ‘এ্যাঙ মো কিও’ এবং ‘ইও ছু কাং’। এমনকি ‘বিশান’ স্টেশন এলাকাতেও মাঝেমধ্যে হেঁটে গেছি। আমি ও আজাদ ভাই নিয়মিত, বন্ধু মামুন প্রায়ই, মাঝে-মধ্যে বরিশাল টিএসসি’র বন্ধুপ্রতিম মাহফুজ, সাতক্ষীরা টিএসসি’র শফিক সাহেব এবং আরও দু-একজন, আমরা ‘এ্যাঙ মো কিও’ থেকে ট্রেনে উঠতাম। বলে রাখি, যদিও আমাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও আবাসন ‘এ্যাঙ মো কিও’ এলাকায়, তবে ‘ইও ছু কাং’ স্টেশনটি আবাসন থেকে অপেক্ষাকৃত কাছে ছিলো বিধায় অনেকেই এখান থেকে ট্রেনে উঠতেন। প্রায়ই আমাদের গন্তব্য যেদিকে থাকতো, ‘এ্যাঙ মো কিও’ থেকে উঠলে একটা স্টেশন কম হতো। একটু হাঁটাও হলো, কিঞ্চিৎ পয়সা সেভ করাও হলো। আর না-হাঁটলে সৌন্দর্যদর্শন থেকে যেমন বঞ্চিত হতে হয়, তেমনি জায়গাগুলোও ঠিকমতো চেনা যায় না। ‘এ্যাঙ মো কিও’, ‘বিশান’, ‘ব্রাডেল’, তোয়া পাইয়ো’, ‘নভিনা’, ‘নিউটন’, ‘অর্চাড’, ‘সমারসেট’ পার হয়ে ‘ধোবিঘট’ এসে ট্রেন পাল্টে ‘লিটল ইন্ডিয়া’ হয়ে ‘ফেরার পার্ক’ স্টেশনে নামাটা একসময় আমাদের নিত্যকর্ম হয়ে ওঠে। ওখান থেকে পায়ে হেঁটে জামান সেন্টারের পাশ দিয়ে অদূরেই পৌঁছে যেতাম মোস্তফা সেন্টার এলাকাতে। এই এলাকাটা বাংলাদেশ ও বাঙালিদের জন্য অনেকটা আপন এলাকা। রবিবারের বিকেলে এই এলাকাটি একটুকরো বাংলাদেশ হয়ে ওঠে। রোজার সময় দেখেছি শত শত বাংলাদেশি এখানে প্রায় প্রত্যেক সন্ধ্যাতেই ইফতারে বসে, রবিবারে সেটা হাজার পার হয়ে যায়। এখানকার রাস্তায়ও এমন ভিড় জমে যায় যে বাংলাদেশের কোনো এলাকা বলে ভ্রম হয়। জামান সেন্টারের সামনের মাঠে থাকে ফ্রি ইফতারে ব্যবস্থা। সাতক্ষীরার ছেলে আমিনুরের মাধ্যমে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি শ্রমিকের সঙ্গে আলাপ পরিচয় হয়েছে আমাদের। শ্যামনগরের একটা ছেলের ফোন নাম্বার সংগ্রহ করে ফোন দিলে ছেলেটি তার ব্যস্ততা ফেলে আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল একদিন। আমিনুর আমাদেরকে অনেক সঙ্গ দিয়েছে এবং বেশ সহযোগিতা করেছে। নিজের কাজ বাদ রেখেও আমাদের কাছে ছুটে এসেছে। তার সঙ্গে অনেক জায়গায় ঘুরেছি, অনেক কিছুই জেনেছি তার কাছ থেকে। মালয়েশিয়া সংলগ্ন উডল্যান্ড এলাকায় পৌঁছে গেছি তার সঙ্গে। যা বলছিলাম- ট্রেন। ট্রেনের ভেতরটা অনেক সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন। কেউ এখানে জলের বোতল নিয়ে উঠতে পারে না, চকলেট কিংবা অন্য কোনো খাবারও খায় না। নিষিদ্ধ জিনিসপত্রের একটা তালিকা লাগানো থাকে চোখের সামনেই। অমান্য করলে মোটা অংকের জরিমানা গুণতে হয়। ট্রেনে কোনো কিছু খেলে বা পান করলে ৫০০ ডলার, ধূমপান করলে ১০০০ ডলার জরিমানা গুনতে হবে। জরিমানার বিষয়টি সমস্ত সিঙ্গাপুর এলাকাতেই রয়েছে। এজন্যে সিঙ্গাপুর সিটিকে কেউ কেউ ‘ফাইন সিটি’ বলে থাকেন। ফাইন মানে সুন্দর, আবার ফাইন মানে জরিমান। কোথায় কী করা যাবে না, তা সেই জায়গার তালিকা দেখেই বুঝতে হবে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও দেশের কল্যাণের জন্য যেখানে যেটা প্রয়োজন, সেটা তারা করেছে নির্দ্বিধায়। সিঙ্গাপুরের আরেকটি ট্রেন ব্যবস্থা খজঞ- খরমযঃ জধঢ়রফ ঞৎধহংরঃ. তুলনামূলক যাত্রীর ভিড় বোধকরি কম এলাইনে। তবে পুরো সিঙ্গাপুরটাই এমআরটি ও এলআরটি ট্রেনের মানচিত্রে বাঁধা। সিঙ্গাপুরের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে আমরা ট্রেনে চলার চেষ্টা করেছি, কদাচিৎ বাসে।
বাস ভ্রমণও সিঙ্গাপুুরে অত্যন্ত আরামদায়ক ও ঝামেলাশূন্য। এমআরটি’র মতো এখানেও ড্রাইভার ব্যতীত কোনো হেলপার থাকে না। পার্থক্য হলো ট্রেনে ওঠার আগেই স্টেশনের ভেতরে কার্ড শো করে যন্ত্রের নিকট থেকে অনুমতি নিতে হয়, বাসে ওঠার পরে কিন্তু নামার আগে কার্ড দেখিয়ে যন্ত্রের নিকট থেকে অনুমতি নিতে হয়। কার্ড কিন্তু একই। ওই কার্ড কিংবা নগদ টাকা দিয়ে যান্ত্রিক কাউন্টার থেকে কেনা টিকিট ছাড়া ট্রেন কিংবা বাসে ওঠা যায় না। খুব সকাল থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত নির্দ্বিধায় চলা যায় বাস ও ট্রেনে। আমি ও আজাদ ভাই একদিন দোতলা বাসের দোতলায় উঠে একেবারে সামনের সিটে বসে কোথায় যেন যেতে যেতে যে ভিডিও করেছিলাম, ফেসবুকে শেয়ার করলে কেউ কেউ বলেছিলেন- সিঙ্গাপুরে গিয়ে গাড়ি চালাচ্ছেন নাকি ? ছবিটি দেখে আমারও তাই-ই মনে হয়েছে, রোমাঞ্চকর। তো, যে-কথা বলছিলাম- রাত ১১টার পরে কোথাও যেতে হলে ব্যক্তিগত যান এবং ভাড়ায় চালিত প্রাইভেট ট্যাক্সিই ভরসা। বাস-ট্রেনের তুলনায় খরচ খানিকটা বেশি। তবে আমরা দুদিন বিনা পয়সায় পিক-আপে করে দীর্ঘপথ ঘুরে বেড়িয়েছি আমাদের দেশীয় শ্রমিক বন্ধু আমিনুর-শামীমদের সৌজন্যে। সেকথা সুযোগ পেলে পরে জানাবো।
সিঙ্গাপুরের মানুষের ব্যক্তিগত যান হিসেবে নামী-দামি ব্র্যান্ডের প্রাইভেট কারের ছড়াছড়ি, তুলনায় মটরসাইকেল বিরলপ্রায়। বেশকিছু মানুষ সাইকেলে চলেন, দু-চাকার প্যাডেল সাইকেলের পাশপাশি দু-চাকা ও এক চাকার ব্যাটারিচালিত সাইকেলও বেশ দেখা যায়। প্রত্যেক রাস্তার পাশেই রয়েছে সুন্দর ও মসৃণ পায়ে হাঁটার পথ। সাইকেলগুলোও সেইপথে চলে, কিন্তু হাঁটা মানুষদেরকে বিন্দুমাত্র ডিস্টার্ব করে না। সাইকেল আরোহীরা বেল প্রায় বাজানই না, সামনে কোনো পায়ে হাঁটা মানুষ থাকলে সাইকেলের গতি কমিয়ে মৃদুস্বরে ‘এক্সিউজ মি’ ‘এক্সিউজ মি’ বলে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। আমি একবার অন্যমনষ্ক হয়ে হাঁটছিলাম। বেশ কয়েকবার পিছন থেকে ‘এক্সিউজ মি’ ‘এক্সিউজ মি’ বলার পরে বুঝতে পেরে বেশ খানিকটা লজ্জিতবোধ করছিলাম। সন্ধ্যার পরে ‘বিশান এ্যাঙ মো কিও’ পার্কে হাঁটার সময় এক শিশুও সাইকেল চালাতে চালাতে পিছন থেকে এরকম ‘এক্সিউজ মি’ বলেছিল। পথে চলতে ওদের ভদ্রতা ও সৌজন্যবোধ সত্যিই ভালো লাগার মতো। আজাদ ভাই ও আমি একদিন বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে উদ্দিষ্ট জায়গাটির নাম জানিয়ে পথনির্দেশ জানতে চাইলে এক ভদ্রমহিলা তার নিজের গন্তব্যপথ রেখে আমাদেরকে পথ দেখিয়ে দিয়েছিলেন। এমআরটি ট্রেন স্টেশনে চলন্ত সিঁড়িতে পথ আগলে দাঁড়িয়ে থাকলেও পিছন থেকে মৃদুস্বরে ‘এক্সিউজ মি’ বলতে শুনেছি। কোথাও কেউ চিৎকার করে কথা বলেন না, কোনো শব্দদূষণ নেই কোথাও।
মারিনা বে
সিঙ্গাপুর এমনিতেই জলরাশি বেষ্টিত দ্বীপ, মালয়েশিয়ার সীমান্ত সংলগ্ন অংশটি নদী, বাকি সবটাই সাগরঘেরা। আদিগন্ত স্বচ্ছ নীল জলরাশি আর তার উপরে ভাসমান জাহাজের সারি, সিঙ্গাপুর সীমান্তের সাধারণ দৃশ্য। ওদের যতগুলো দর্শনীয় স্থান ও অবকাশ যাপনকেন্দ্র আছে, মারিনা বে সেগুলোর অন্যতম। ২৩ দিনের সিঙ্গাপুর যাপনের সময়ে বেশ কয়েকবার সেখানে গিয়েছি আমরা। প্রথমবার নিয়ে গিয়েছিলেন মিস্টার হি, আমাদের গাইড। মারিনা বে এলাকাতে ঘোরার পাশাপাশি এর লেক-এ আমরা সেদিন নৌকা বিহার করেছিলাম। প্রচলিত অর্থে এটাকে ঠিক লেক বা হ্রদ বলা যায় না। কেন না, এর একটি দিক সমুদ্রের সাথে যুক্ত, কিছুটা নদীর মতো লম্বা ও প্রশাখাযুক্ত। এখানে জলের উপরে আছে বিরাটকায় সিংহমুখ। জল থেকে বিরাট গ্রীবা তুলে হা-করা মুখ দিয়ে অবিরল জলের ধারা ফেলছে সিংহটি, যেন উঁচু পাহাড় থেকে নেমে আসছে ঝরনাধারা। পরে আরও অন্তত তিনবার গেছি এই এলাকায়। সিংহ এখানকার সবচেয়ে বড়ো আকর্ষণ নয়, সবচেয়ে বড়ো আকর্ষণ হলো রাতের বেলায় এখানকার লেজার শো। আর আছে মারিনা বে সমুদ্র সৈকত, মারিনা স্যান্ডস্ বে হোটেল, মারিনা ব্যারেজ। রাত ৮টা ও ৯টার সময় দুটো লেজার শো দেখতে হাজির হয় হাজার মানুষ। এই শো দেখতে যারা আসেন তাদের মধ্যে বহু বিচিত্র চেহারা ও ভাষা দেখে অনুমান করেছি, এটি পৃথিবীর বহু দেশ ও ভাষার মানুষকে টেনে আনতে সক্ষম। মালয়েশিয়া থেকে আগত কোনো কোনো কর্মজীবী মানুষই তাদের কাজের শেষে বোধহয় এখানে এসে মিলিত হয়, সুখ-দুঃখের কথা বলে। মিলিত হয় দক্ষিণ ভারতের লোকও। বাংলাদেশের মানুষও এখানে মিলিত হন, কিন্তু তাদের মিলনের প্রধান স্থান বোধকরি ফেরার পার্ক এলাকার জামান সেন্টার ও মোস্তফা সেন্টারের আশে-পাশে। যা-হোক, একটানা ১৫ মিনিটের ওই লেজার শো দুই রাত দেখেছি; একরাতে আবার দুবারও। চোখে পলক ফেলানো দায়। জলের বহুবিধ উচ্ছ্বাস, ৭০ তলা বিল্ডিয়ের ছাদ থেকে ছুটে আসা নানারঙের আলো, সেই আলোর কারিশমায় ফুটে ওঠা নানারঙের ফুল, জল ও আলোর বিচিত্র নকশা আর তারই তালে লাউড স্পিকারে চলতে থাকা সুরমূর্ছনা দর্শনার্থীদের হৃদয়ের ভার লাঘব করে দেয়। কিছুটা সময়ের জন্য নান্দনিক এক আলোর রাজ্যে হারিয়ে যান মানুষ। চর্মচক্ষে অবলোকনের পাশাপাশি যন্ত্রচক্ষেও ধারণ করেন অনেকেই।
লেজার শো এবং অন্যান্য অনুষঙ্গ রাতের মারিনাকে সিঙ্গাপুরের রূপসী রানিতে পরিণত করে। এই মারিনাতে মুগ্ধ আমি পরে লিখেছি-
বিকেল থেকেই লোকজন ঘুরতে থাকে ইতস্তত মাছের মতো
সন্ধ্যা হতে না হতে ‘মারিনা স্যান্ডস বে’র বিশাল চত্ত্বরে
কেন্দ্রীভূত হতে থাকে মানুষ;
যেন নেতা আসবেন, একটু পরেই শোনা যাবে তার মোহন কণ্ঠস্বর
রাত আটটা বাজতেই সমস্ত পৃথিবী মিলিত হয় এখানে
নীল জলরাশির আঙিনায়; এখনই যেন এখানে শুরু হবে সার্কাস,
অলৌকিক জাদুর পসরা হাতে দাঁড়াবে জাদুকর !
আমার গা-ঘেঁষে বসা মার্কিনি মেয়েটি ছবি তুলতে ব্যস্ত
বাঁ-পাশে শুয়ে-বসে কিচির-মিচির করছে একদল মালয়-রমণী
বয়ফ্রেন্ডের সাথে নিবিড় হয়ে ছবি তুলছে যে ইউরোপিয়ান
তার পিছনেই দাঁড়িয়ে তামিল আওড়াচ্ছে একগুচ্ছ দক্ষিণে ছেলে-মেয়ে
আরও কতো কতো রকমের মুখাবয়বী মানুষেরা… !
সহসা বিরাট শব্দে বিদীর্ণ হলো শ্রবণেন্দ্রিয়
সচকিত হলো চোখ
সহস্র মানুষের ক্ষীণধ্বনি ঢেকে গ্যালো যন্ত্রসঙ্গীতের মূর্ছনায়
আকাশে ছড়িয়ে পড়লো আলো; কতো যে রঙের বাহার !
জলের ঊর্ধ্বগামী ফোয়ারাগুলো হরেক আলোতে মাতোয়ারা
আলোরা সঙ্গীতের তালে নৃত্যশীল।
চারদিকের সুরম্য অট্টালিকা; তারাও মেতেছে অভিন্ন আনন্দে
জাহাজের মতো দেখতে যে ‘হোটেল মারিনা স্যান্ডস বে’;
ওরই আকাশচুম্বী মিনার থেকে ছুটে আসছে তীক্ষè আলোকরশ্মি
পলক ফেলবার সময় নেই মানুষের
তিরিশ মিনিটের মহড়া শেষে
ভিড় গ্যালো কমে
আমাকে খুঁজে পেলো আমার সঙ্গীরা
আবাসে ফিরতে ফিরতে ভাবছি :
স্মৃতির বাগানে অনেক দিন ফুটে র’বে
মারিনার রাতের গোলাপ।
তবে দিনের আলোতেও এখানকার সৌন্দর্য দেখবার মতো। মারিনা সমুদ্র সৈকতে যেমন সুন্দরের পিয়াসীদের ভিড়, তেমনি সিঙ্গাপুরের সবচেয়ে বিখ্যাত বিল্ডিং এবং হোটেল ‘মারিনা স্যান্ডস বে’ও এখানেই। এই হোটেলের নিচেই রয়েছে পৃথিবীবিখ্যাত ক্যাসিনো সেন্টার। ক্যাসিনোতে কতো মানুষ যে ডলারকে ডলার উড়িয়ে দিচ্ছে ! আমার মতো গো-বেচারার কাছে সে এক বিপন্ন বিস্ময়। আছে বিলাসবহুল শপিং কমপ্লেক্সও, যেখানে দেখা ছাড়া কেনা-কাটা করবার চিন্তাও করতে পারিনি আমরা ! এক-একটি ছোট্ট জিনিসের মূল্য দিয়ে মাস চলে যায় আমাদের। আমি নিরুৎসাহিত করা সত্ত্বেও আমাদের এক সহকর্মী তার গিন্নির জন্য একটি ভেনিটি ব্যাগ কিনতে ঢুকেছিলেন এক বিপনিতে। কম দাম হবে ভেবে ছোট্ট একটি ব্যাগ পছন্দও করেছিলেন। কিন্তু ব্যাগের চেইন খুলতেই যখন মূল্য লিখিত কাগজটি বেরিয়ে এলো, লোকটি ¯্রফে হা-হয়ে গেছিলেন। তড়িতাহতের ন্যায় চমকে উঠে দ্রুত পিঠটান দিলেন। আমার কৌতূহল আছে, কিন্তু এমন সব জায়গায় বুকটা দুরু করে- কী জানি কে কী বলেন ! আজাদ ভাইয়ের কৌতূহল ও সাহস দুটোই আছে। বিভিন্ন দোকানে আমরা ঢু মারছিলাম আর আজাদ ভাই দু-একটা কথাও বলছিলেন বিক্রয়কর্মীর সাথে। কতো বিচিত্র ডিজাইনের জিনিসপত্র ! একটি ঘড়ির দোকানে ঢুকে সুন্দর সুন্দর সব ঘড়ি দেখতে দেখতে একটা চোখ আটকে গেল। আজাদ ভাইকে দেখালাম। ঘড়িটার গায়ের মূল্য ২৬৯,০০০.০০ ডলার (দুই লাখ ঊনসত্তর হাজার ডলার)। দুজনে মিলে হিসেব করে দেখলাম, বাংলাদেশি টাকায় এর যা দাম, আমার চৌদ্দ পুরুষের সহায়-সম্পত্তি মিলেও তা হবে না। ফেসবুকে একটা কৌতুককর পোস্টও দিয়েছিলাম এটা নিয়ে। আশেপাশেও অনেক সুদৃশ্য বিল্ডিং ও শপিং কমপ্লেক্স আছে, কিন্তু এই বিশেষ বিল্ডিংটি, যার ছাদের আকৃতি বিশাল জাহাজের ন্যায়; সেটি অনেক দূর থেকেই খুব টানে কৌতূহলী চোখকে। এই বিল্ডিংটিকে অনেক বাঙালি নাম দিয়েছে- জাহাজ বিল্ডিং। তিনটি আকাশচুম্বি টাওয়ার মিলে মাথায় করে রেখেছে একটি বিরাটাকৃতির জাহাজ। সেই জাহাজের উপরে রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু এবং বৃহত্তম স্কাই পার্ক। সেখানে বিরাট বিরাট প্রাকৃতিক ও আর্টিফিশিয়াল গাছের সারি আর ফুলের সমাহার এবং অপরূপ সুন্দর এক সুইমিং পুল। সুইমিং পুল অংশটি খুব সম্ভবত এই হোটেলে যারা অবকাশ যাপন করেন, তাদের জন্য। সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য সুইমিং পুলের বাইরের প্রান্তটি খোলা থাকে। এখানে দাঁড়িয়ে সমুদ্রতীরবর্তী মারিনা বে এলাকাটি অসামান্য সুন্দররূপে ধরা দেয়।
মারিনা ব্যারেজ
চারদিক থৈ থৈ
নীল সাগর আর নীল আকাশে
কী গভীর মিলনের সুর !
হরিৎ তীরেও রয়েছে সুখের টান
বিরহ নেই, তবু চিঠি হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে মেঘ
এখানে আসে না বাঁশিয়াল
নেই অলকাপুরীও
খামোখাই কবিগুরু লিখেছেন গান
চারদিক থৈ থৈ
তবুও গলা শুকিয়ে কাঠ
সাদামেঘ পরা মেয়েটি তখন
বন্ধুবাহুতে; শয্যা করেছে মাঠ
থৈ থৈ জলে মেটে না পিপাসা
অতএব, সাগরকে বাঁধো, সাগরিকাকে বশ মানাও
নিউ-ওয়াটার, মারিনা ব্যারেজ আঁকো
বিশুদ্ধ জলের গাথা, বিশ্বকে জানাও।
মারিনা ব্যারেজের দাঁড়িয়ে বোধহয় কবিতার দু-একটি লাইন মাথায় আনতে চেয়েছিলাম। পারিনি। পরে এ্যাং মো কিও-তে আমাদের থাকবার ফ্ল্যাটটিতে শায়িত আমার মগজে দু-একটি শব্দের অঙ্কুরোদগম হয়েছিল বটে, তবে কবিতায় রূপ পাওয়ার ফুরসত পেলে দেশে ফিরে। বড্ড চাকচিক্যের কারণে কিংবা নিয়ত দৌড়ের উপরে থাকায় হয়তো সিঙ্গাপুরে কোনো কবিতা রানি ধরা দেয়নি আমার আঙুলের পরশে।
মারিনা বে থেকে খানিকটা দূরে মারিনা ব্যারেজ। এখানকার উঁচু সবুজ ঘাসের মাঠ থেকে গভীর নীল জলের সমুদ্র, সমুদ্রে ভাসমান জাহাজের সারি আর নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা অনন্য মনোরম দৃশ্য তৈরি করে। দুপুরের পরপরই, সূর্যের আলোর উজ্জ্বলতা মুখে নিয়েই এখানে দাঁড়িয়েছিলাম আমরা। আমার মোবাইল ক্যামেরা বেশ ভালো হওয়া সত্ত্বেও বন্ধু মামুনের ডিএসএলআর-এর দিকে ঝোঁক ছিলো অধিক। বিবিধ দৃশ্যপটে ছবি ওঠার চেষ্টা ছিলো আমাদের ভেতরে। এই মারিনাতে বিরাট একটি বাঁধ দিয়ে সমুদ্রের জলকে সংরক্ষণ ও ব্যবহার উপযোগী করা হচ্ছে। রয়েছে ঝঁংঃধরহধনষব ঝরহমধঢ়ড়ৎব এধষষবৎু, যেখানে সিঙ্গাপুরকে আরও অধিক নান্দনিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রধান পরিকল্পনার নকশাগুলো। ইকো সিস্টেমকে সমুন্নত রেখে আরও উন্নত ও বসবাস উপযোগী করবার মাস্টারপ্লানের একটা অসাধারণ প্রদর্শনী এখানে রয়েছে। আর রয়েছেন একজন স্মার্ট তরুণী, যিনি টেকসই সিঙ্গাপুরকে অত্যন্ত স্বাচ্ছন্দ্যময় বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তুলে ধরছেন পর্যটকদের নিকট। সিঙ্গাপুর পুরো দেশটাই যে সিটি হলেও একটা গার্ডেন সিটি, ওদের ভাষায় ঈরঃু রহ ধ এধৎফবহ, মারিনা বে’র গ্যালারিতে এর পক্ষে নানা আলোকচিত্র ও নকশা তুলে ধরা হয়েছে। এখানে গিয়ে আমরা জানতে পারি সিঙ্গাপুরের এই ঈরঃু রহ ধ এধৎফবহ বা গার্ডেন সিটির পরিকল্পনা সাম্প্রতিক কালের কোনো বিষয় নয়, এর শুরু হয়েছিল সেই ১৯৬৩ সালে, মালয়েশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পরপরই। আধুনিক সিঙ্গাপুরের স্থপতি তৎকালীন প্রেসিডেন্ট খবব কঁধহ ণবি এঁর হাত ধরেই সেই সবুজায়নের যাত্রা শুরু হয়েছিল। সেই যে সবুজ সিঙ্গাপুরের ক্যাম্পেইন তিনি শুরু করেছিলেন, তার ফল আজকের সিঙ্গাপুরে সবুজ কেবল মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকা বৃক্ষরাজি নয়, একইসঙ্গে তা নান্দনিক ও টেকসই নগরের অনিবার্য প্রতিচ্ছবি। সব ধরনের দূষণমুক্ত, পরিচ্ছন্ন ও সবুজ সিঙ্গাপুরের মডেল এই মারিনা বে’র গ্যালারির অন্যতম আকর্ষণ। দূষণমুক্ত, সবুজ, সুন্দর ও টেকসই সিঙ্গাপুর তৈরির জন্য গৃহীত প্রধান পদক্ষেপসমূহের নাম ও সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেখতে দেখতে আমার নিজের দেশের কথা মনে পড়ছিল। সিঙ্গাপুরের তুলনায় কী বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ আমাদের, অথচ সেগুলো সুষ্ঠু ব্যবহারের সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা নেই ! পরিকল্পনা যদি কিছু কিছু হয়ও, তার পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন দেখতে পাওয়াটা রীতিমতো দুর্লভ ব্যাপার ! অন্যদিকে সিঙ্গাপুর তাদের অত্যন্ত সীমিত সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহারই শুধু নিশ্চিত করেনি, যে-কোনো ধরনের বর্জ্য বা পরিত্যক্ত জিনিসকেও অত্যন্ত দক্ষতার সাথে পুনর্ব্যবহারের চূড়ান্ত পরিকল্পনা নিয়েছে এবং তা বাস্তবায়ন করে চলেছে। এমনিতেই সিঙ্গাপুরের কোথাও কোনো ময়লা-আবর্জনা বা কোনো ধরনের অতিরিক্ত কিছু কোথাও পড়ে থাকতে আমরা দেখিনি, তারপরও যখন এখানে এসে জানতে পারি- জিরো দূষণ সিঙ্গাপুর বানানোর মানচিত্র তাদের হাতে জ্বলজ্বল করছে, খুব ভালো লাগে। যে-খাবার সিঙ্গাপুরের মানুষ যা-খায়, তার ভেতরে সবজি-ফলসহ অধিকাংশ খাবারই আমদানিকৃত। আমদানিকৃত হলেও বাজারে তার কোনো ঘাটতি থাকে না বলেই হয়তো ওরা সিঙ্গাপুরকে ফুড প্যারাডাইস বলে থাকে। আর যেহেতু খাবারের অভাব নেই, তাই ব্যক্তিপর্যায়ে কিছুটা খাবার অতিরিক্ত থেকে যাওয়া বা নষ্ট হয়ে যাওয়ার ব্যাপার আছে বৈকি। এই নষ্ট খাবারটাকেও তারা রিসাইকেলিং পদ্ধতিতে পুনর্ব্যবহারের উপযোগী করতে সচেষ্ট। মোটকথা হলো, তারা শুধু উন্নয়নের পরিকল্পনাই করে না, সেই পরিকল্পনার ভেতরে কী পরিমাণ স্থায়িত্ব আছে, পরিচ্ছন্নতা আছে, পরিববেশ বান্ধব নান্দনিকতা আছে; সেটাও যাচাই-বাছাই করে নেয়।
ne Water
মারিনা ব্যারেজ ছাড়াও সিঙ্গাপুরের আরেকটি অসাধারণ ওয়াটার প্লান্ট দেখেছিলাম- হবডধঃবৎ। মিস্টার হি আমাদেরকে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে আমরা জানতে পারি, নিজস্ব কোনো মৌলিক উৎস প্রায় না-থাকা সত্ত্বেও সিঙ্গাপুর কীভাবে তাদের জলের চাহিদা মেটায়। তাদের জলের একটি বড়ো অংশ আসে মালয়েশিয়া থেকে। একসময় প্রায় পুরোটাই আসতো, কিন্তু বর্তমানে একাধিক জলশোধনাগার প্রকল্প হাতে নিয়েছে সিঙ্গাপুর। সর্বশেষ এবং সর্বোন্নত প্লান্ট হলো এই- নিওয়াটার প্লান্ট। মাটির নিচে প্রায় ৭০তলা গভীর পর্যন্ত বিস্তৃত এই বিরাটাকৃতির জলশোধনাগার। এক এটা চালুর পরে ৪০ শতাংশেরও বেশি জল নিজেদের মাধ্যমেই মেটাতে সক্ষম হয়েছে তারা। সমুদ্রের লবণাক্ত জল এখন তাদের প্রযুক্তির সংস্পর্শে শতভাগ পানযোগ্য হয়ে ধরা দিয়েছে। এই ওয়াটার প্লান্ট এলাকাতেও প্রকৃতির এক অপূর্ব আয়োজন রেখেছে কর্তৃপক্ষ। গাছ আছে, প্রচুর ঘাস আছে; চেয়ে থাকবার মতো সবুজের সমারোহ এখানেও আছে। শুধু সবুজ নয়, বিশুদ্ধ জলের হ্রদে কতো রঙের মৎস্যবিহার যে রয়েছে ! মুগ্ধচোখে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। সিঙ্গাপুরে জলের আরেকটি উৎস হলো বৃষ্টি। সারাবছরই কম-বেশি বৃষ্টি হয়। সেই বৃষ্টির জল সংরক্ষণ ও পরিশোধন করে তারা প্রয়োজন মেটাচ্ছে। আমরা দেখেছি, বৃষ্টি হওয়ার পরে প্রায় কোথাও জল জমে থাকে না। বিভিন্ন পথ ও পদ্ধতি অনুসরণ করে এই জলকে নির্ধারিত সংরক্ষণাগারে নিয়ে তা ব্যবহারের উপযোগী করা হয়।
জুয়েল
সিঙ্গাপুরের চাঙ্গিতে নবনির্মিত এই জুয়েল পার্কটি অবিশ্বাস্য সুন্দর একটি স্থাপনা। এটি বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু অভ্যন্তরীণ জলপ্রপাত। ১.৪ মিলিয়ন বর্গফুট এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই জলপ্রপাতের ভেতরে হোটেল, সিনেমা হল, ছোটো-বড়ো শতাধিক খাবারের দোকান রয়েছে। ৪০মিটার উঁচু জলপ্রপাতটি ‘জধরহ ঠড়ৎঃবী’ নামেও পরিচিত। এক বিকেলে পিক-আপে চড়ে জুয়েলে গিয়েছিলাম আমরা। কাচস্বচ্ছ লিফটের সাহায্যে এই পার্কের ভেতরে একবার ঢুকলে বেরই হতে ইচ্ছে হবে না সারাদিনেও ! বহুতল বিল্ডিংয়ের উচ্চতায় এর কাচের ডিজাইন করা ছাদ। চারপাশে দর্শনার্থীদের জন্য গ্যালারি। ছাদের নিচে আরেকটি গোল ছাদের মতো, কাচের জলাধার। সেখান থেকে জল এমনভাবে নামছে, যেন পাহাড় থেকে নেমে আসা বিপুল ঝরনা ! আর স্টেডিয়ামসদৃশ এলাকাজুড়ে পাহাড় আর জঙ্গল, ছোটো বড়ো অসংখ্য জানা-অজানা গাঢ়-সবুজ গাছ- চারতলাজুড়ে বাগান। ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান দেখিনি, দেখলাম জুয়েল জলপ্রপাতের ঝুলন্ত বাগান ! উঁচু-নিচু আঁকা-বাঁকা পথ ঘুরে ঘুরে শত শত মানুষের চোখ। ছোটো ছোটো ব্রিজ তো রয়েছেই, ডাবল লেনের রেল লাইনও রয়েছে এই ছাদের ভেতর দিয়ে ! তিন-চার মিনিট পরপর সেখানে দেখা যাচ্ছে ট্রেন। পথ বেয়ে চলছি, সিঁড়ি বেয়ে উঠছি-নামছি আর মুগ্ধতার কিছুটা যান্ত্রিক চোখের দ্বারা স্থায়িত্ব দেওয়ার চেষ্টা করছি আমরা। আজাদ ভাই আর আমি ছবি বেশকিছু ছবি উঠলাম এখানে। কতো চেহারা ও ভাষাভাষীর নারী-পুরুষের সোৎসুখ দৃষ্টি এখানে ! নগরসভ্যতা আর অরণ্যের এমন অপূর্ব সংমিশ্রণ না-দেখলে বিশ্বাস করতে পারতাম না।
অর্কিড গার্ডেন
সিঙ্গাপুরের অন্যতম দর্শনীয় স্থান ন্যাশনাল অর্কিড গার্ডেন-এ প্রবেশ করলে ঘনো সবুজ আর নানা রঙের ফুলের রাজ্যে হারিয়ে যেতে হয়। মনে হয়, একটি পাহাড়ী অরণ্যে প্রবেশ করেছি, যেখানে নাম না-জানা অসংখ্য গাছ-লতা আর ফুল নিজেদেরকে মেলে ধরে আছে নানা ভঙ্গিমায়। কংক্রিটের আঁকাবাঁকা পথ, পথের দু’পাশে হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে কতো রকমের লতা ও ফুল ! শুধু দু’পাশেই নয়, মাথার উপরেও রয়েছে সবুজের তোরণ। একটা-দুটো নয়, কিছু দূর পরপর মাথার উপরে ধনুকের ঢঙে ভেসে আছে সবুজ সবুজ সেতু। পাহাড় আর অরণ্যের আবহকে আরও নৈসর্গিক করে তুলতেই পথের দুপাশে রয়েছে অজ¯্র পাথরের টুকরো। সেই পাথরগুলো আবার সবুজ শ্যাওলার পোশাক পরে আরণ্যক করে তুলেছে পরিবেশকে। একটু বড়ো পাথরের উপরে বসে ছবি তোলার প্রতিযোগিতায় নেমেছেন পরিদর্শকরা। পরিদর্র্শকদের ভেতরে দেখলাম বিচিত্র চেহারা ও ভাষাভাষীর সমাহার। আমি একটু ভেতরগোঁজা মানুষ, অচেনা মানুষের সাথে পরিচিত হতে বা কথা বলতে চিরকালই জড়তা বোধকরি। আজাদ ভাই বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই পরিচিত হলেন কানাডা, ফিলিপাইন, ফ্রান্স, মার্কিন ইত্যাদি দেশের কয়েকজন শ্বেতললনার সাথে। দু-একজনের সাথে সেলফিও তুললেন। এক মার্কিন তরুণীর হাতে ক্যামেরা দিয়ে ফটোগ্রাফারের কাজও করিয়ে নিলেন। আমাদের জন্য একটা সময় বেঁধে দেওয়া ছিলো, কিন্তু ভালোভাবে দেখা তো পরের কথা, পছন্দের জায়গাগুলোতে যদি একটি করে ছবি তুলেই দৌড় দিই, তাহলেও সেই সময়ে কিছুই হয় না। অথচ এক-একটি নৈসর্গিক কোণ এমনই টানছিল যে, বসে থাকি অনির্দিষ্ট সময়জুড়ে !
অর্কিড গার্ডেন থেকে বের হয়ে দেখলাম সিঙ্গাপুর বোটানিক গার্ডেনের গেইট। তখন হাতে কোনো সময় নেই, বরং নির্ধারিত সময় পার হয়ে গেছে। কিন্তু অনেকেই তখনও ফিরে আসেননি অর্কিড গার্ডেন থেকে। কেউ কেউ আবার গার্ডেনে ঢুকে বহুদূরে অদৃশ্য হয়ে আছে। আমি, আজাদ সাহেব এবং আরও কেউ কেউ বোটানিক গার্ডেনের ভেতরে একবার ঢুঁ মারতে চাইলাম। এখানে আমাদের দেশের সঙ্গে কিছুটা মিল পেলাম, তাল-নারকেল গাছের সারি দেখলাম। সবুজ মাঠের উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দেখলাম বেশ কয়েকজন তরুণী আর একজন তরুণ, ব্রিটিশ কিংবা মার্কিন হবে হয়তো, শুয়ে-বসে আড্ডা দিচ্ছে। আমি একটু সাহস নিয়ে ক্যামেরা তাক করতেই সবাই অধিকতর সপ্রতিভ হয়ে ছবির জন্য পোজ দিলো। ওদের একটি সেলফোন আমার দিকে ধরে ছবি তুলে দেওয়ার রিকোয়েস্ট করলো।
বার্ড পার্কে
জুরং এর বার্ড পার্ক সিঙ্গাপুরের আরেক প্রাকৃতিক আনন্দরাজ্য। এখানে ঢুকে প্রথমেই আমরা যেটা দেখলাম, তা হলো ভালচার প্লে- শকুনের খেলা। ছেলেবেলা থেকে শকুনকে অসুন্দর প্রাণী হিসেবে জানি। ভাগাড়ে গরু-মহিষ-ছাগলের মৃতদেহ নিয়ে কুকুর-শকুন-কাকের দৃশ্যগুলো খুব অরুচির জন্ম দিতো একসময়। শকুনকে অমঙ্গলের প্রতিক হিসেবেও দেখতেন আমাদের সমাজের মানুষ। নারকেল গাছে শকুন এসে বসলে বাবাকে দেখেছি বিভিন্নভাবে তাড়াতে। বড়ো হয়ে জেনেছি, শকুন বড়ো প্রয়োজন আমাদের পরিবশের জন্য, কিন্তু শকুন ততদিনে আমাদের দেশে বিলুপ্ত প্রাণীর পর্যায়ে চলে গেছে। সেই শকুনকে সিঙ্গাপুরের মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর সভ্য দেশে দেখতে পাবো, অনুমান করতে পারিনি। কিন্তু এখানে এসে শকুনকে কেবল দেখলাম না, অত্যন্ত আভিজাত্যের সাথে তাকে মানুষের সাথে খেলতে দেখলাম। আমাদের দেশে সার্কাসে ছাগল-কুকুর-হাতি-ঘোড়া এমনকি বাঘ-সিংহকেও দেখেছি মানুষের সংকেতকে অনুসরণ করে নিখুঁতভাবে নানারকমের ক্রীড়াশৈলী দেখাতে। সিঙ্গাপুরে এসে দেখলাম, আমাদের অবহেলিত শকুন কতো দক্ষতার সাথে মানুষের শব্দ ও সংকেত অনুসরণ করে। নিষ্পলক মুগ্ধতায় দেখলাম একাধিক শকুনের অনন্যসাধারণ দক্ষতার নমুনা।
শকুনের খেলা দেখার রেশ কাটার আগেই বসে পড়লাম চড়ড়ষং অসঢ়যরঃযবধঃৎব এর গ্যালারিতে। ম্যাকাও, পেলিকন এবং নাম না-জানা একাধিক পাখির প্রদর্শনী এখানে আছে, তবে ম্যাকাও পাখির দক্ষতা আর সবকিছুকে ছাড়িয়ে মুগ্ধতার সীমা বাড়িয়ে দিতে থাকে। প্রশিক্ষকের সংকেত অনুসরণ করে গ্যালারিতে উপবিষ্ট এতগুলো মানুষের মাথার উপরে রাখা রিঙের ভেতর দিয়ে উড়ে যাওয়া, এমনকি দর্শকসারিতে থাকা মানুষের হাতে এসে বসে খেলা দেখানোর মতো চমৎকারিত্ব না-দেখলে বিশ্বাস করতে পারতাম না।
ন্যাশনাল বার্ড পার্কে আরও অনেক প্রজাতির পাখি আছে। বেশ কয়েকটি লেক আছে, যার ভেতরে আছে জলচর পাখি। কিন্তু সবচেয়ে বেশি যেটা বিস্মিত করতে পারে, তা হলো অমন ছোট্ট একটি দেশে বার্ড পার্কের জন্য বিরাট একটি জায়গা বরাদ্দ রাখা। অর্কিড গার্ডেন এবং বোটানিক গার্ডেন দেখেও মনে হয়েছিল- সিঙ্গাপুর খুব ছোটো দেশ নয় হয়তো ! প্রগাঢ় সবুজে ভরা উঁচু-নিচু অরণ্যপথের যাত্রা যেন ফুরোতে চায় না সহজে। আমরা অবশ্য পার্কের ট্রেনের মতো ছোট্ট কিন্তু চাকাগুলো সড়কপথে চলার উপযোগী একটি গাড়িতে চড়ে ঘুরে দেখলাম বেশিরভাগ জায়গা। কিছু কিছু স্থানে পায়ে হেঁটে ছবি-টবি তুলে ঘুরে বেড়ালাম। পাখির বৈচিত্র্য যে খুব বেশি তা নয়, কিন্তু এমন অরণ্যসদৃশ ঘনো সবুজের বিস্তৃত আয়োজন দেখে সিঙ্গাপুরের বিরাট নগরসভ্যতার রূপটা কেমন ফিকে হয়ে আসে ক্ষণিকের জন্য। অবশ্য এই কথাটি যদি আরেকবার মনে করি যে, সিঙ্গাপুরের নির্মাতারা দেশটিকে কেবল কংক্রিটের জঙ্গল বানাতে চাননি, দেশটিকে শহর আর শহরটিকে সুবজের মোড়কে মনোরম করতে চেয়েছিলেন, বানাতে চেয়েছিলেন ঈরঃু রহ ধ এধৎফবহ , তাহলে ফিকে হওয়া নয়, বরং অসাধারণ উজ্জ্বল একটি নগরসভ্যতার ছবি ফুটে ওঠে, যেখানে সবুজ প্রকৃতিকে নাগরিক প্রাসাদের চেয়ে কোনো অংশেই কম গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ‘লি কা শিং লাইব্রেরি’, ‘ন্যাশনাল মিউজিয়াম’, ‘মালয় হেরিটেজ’ ইত্যাদি যেখানেই গেছি, সবুজের সুনিপুণ প্রয়োগ দেখে আনন্দিত হয়েছি। কোনো পর্যটন এলাকা ছাড়াও আমরা যখন হেঁটেছি, একথার প্রমাণ পেয়েছি সর্বত্র। বিশেষত আজাদ ভাই ও আমি প্রচুর হেঁটেছি, কখনও প্রকৃতিবিযুক্ত দেখিনি কোথাও। কোনো কোনো জায়গায় বাংলদেশের কিছু কিছু ফল-ফুলকে দেখে চক্ষু ও মনের তৃপ্তি ঘটিয়েছি। আমিনুর যেখানে থাকে, সেই শ্লেটার হিল এলাকায় যাওয়ার পথে বাগান বিলাস, রাধাচূড়ার মতো ফুল দেখেছি। কোনো এক পথের পাশে বাঁশগাছ দেখেছিলাম, যদিও সেই বাঁশে বাংলাদেশিত্ব ছিলো না। তবে আকন্দফুলকে একেবারে বাংলারই চেহারায় দেখে কী-যে রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম !
অর্চাড
সিঙ্গাপুরে প্রচুর গাছ থাকলেও ফলের গাছ প্রায় নেই বিধায় পাখিও সেখানে বিরল। আর পাখি কম থাকায় পাখির বিষ্ঠাও বিরলপ্রায়। অথচ সিঙ্গাপুরের সবচাইতে অভিজাত এলাকার অন্যতম যে-অর্চাড, সেখানে মোড়ের কাছের একাধিক রাস্তা ও ফুটপাতে সাদা সাদা আলপনা ! আমাদের চলার পথে এবং আশেপাশে প্রচুর কবুতর দেখে বুঝতে পারলাম সে-আলপনার উৎস। ঝরে পড়া পাতা দেখে উপরে তাকিয়ে দেখলাম গাছও আছে। কোথাও মাটি দেখা যায় না, কংক্রিট ফুঁড়েই যেন দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি বৃক্ষ ! তাতে সবুজের সমারোহ। আমরা প্রথমবার অর্চাড পৌঁছেছিলাম এক দুপুরে এমআরটি রেল হয়ে। এই স্টেশনটি আরও অনেক স্টেশনের মতোই মাটির নিচে এবং আয়তনেও বেশ বড়ো। সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে স্টেশন থেকে বের হয়ে মনে হলো কোনো আধুনিক গুহা থেকে বের হলাম সুড়ঙ্গ পথ ধরে ! বের হয়েই দেখি আমাদের বাগান বিলাসের মতো ফুলের নান্দনিক আয়োজন। পরে আবারও গেছি সেখানে। অর্চাড এলাকায় বিরাট বিরাট সব অট্টালিকা, বিলাশবহুল হোটেল আর চোখ ধাঁধানো সব শপিং সেন্টার। বিশ্বখ্যাত বিভিন্ন ব্রান্ডের বিপনীবিতানগুলোতে কেনাকাটা করার সামর্থ্য না-থাকলেও দু-চারটের ভেতরে ঢুঁ মারতে ভুল করিনি আমরা। মোড়ের থেকে সামান্য সরে গিয়ে রাস্তার পাশের প্রাসাদোপম বিল্ডিং-এর একটি ঘএঊঊ অঘঘ ঈওঞণ -র সামনে প্রশস্ত আঙিনায় রয়েছে সুদৃশ্য এক ঝরনা। বেশ বড়ো আকারের এই ঝরনার আশেপাশে সৌন্দর্যপিয়াসী মানুষের ভিড়। এই এলাকাটি অধিকতর ব্যয়বহুল এবং বিদেশি পর্যটকের আনাগোনাও বেশ। পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা অনেক বেশি এখানে। আমি ভেতরগোঁজা মানুষ ও নারী পরিবেশে চিরকাল লাজুক প্রকৃতির। ভিনদেশের ভিনভাষার এই স্বল্পবসনা ললনাদের দিকে তো ভালো করে তাকাইও না। আমি আজাদ ভাই এবং মামুন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে যখন কথা বলছিলাম। কিছুক্ষণ পরে খেয়াল করলাম এক তরুণী খুব নিকট থেকে আমার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ! আমার শরীর কেমন কেঁপে উঠলো যেন ! সেদিকে না-তাকিয়ে আমি সঙ্গীদের দিকেই তাকিয়ে দু-একটি কথা বলতে থাকলাম অস্বস্তি নিয়ে। মেয়েটি আরও কিছুক্ষণ তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে পা চালালো। আমিও যেন ধড়ে প্রাণ ফিরে পেলাম। মামুন বললো- ও তো তোকে চাইছিল দীপ। আমি বললাম- কে জানে, কিন্তু আমি খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম রে। চাওয়া বলতে কী বোঝায় এখানে, সেটা আমরা জানি। আমরা আরও কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করে একটি গলিপথে হাঁটতে শুরু করে কয়েক মিনিট বাদেই পেয়ে গেলাম মাউন্ট এলিজাবেথ। দেশে থেকেই মাঝে মধ্যে এর নাম শুনি আমরা। আমাদের দেশে খুব ধনী ও ভিভিআইপি ব্যক্তিরা এখানে চিকিৎসা সেবা নিতে আসেন। দেশ থেকে রওনা দেওয়ার আগে অলোকা বলেছিল, সিঙ্গাপুর থেকে বডিটা চেক করিয়ে নিয়ে এসো। সিঙ্গাপুরে এসে বুঝলাম, এখানকার কোনো হাসপাতালে ঢুকলে সর্বোচ্চ চিকিৎসাসেবা পাওয়া যাবে ঠিকই, কিন্তু পকেটটা একেবারে ফাঁকা হয়ে গেলেও হয়তো সেই সেবার কাছাকাছি পৌঁছাতে পারবো না। তো, খুব আটঘাট বেঁধে মাউন্ট এলিজাবেথেও গেইটে এবং ভেতরের প্রবেশমুখে ঢুকে ফটাফট কয়েকটি ছবি উঠে নিলাম। ভাবখানা এমন যে, বাড়িতে এসে বউকে বলবো- এই দ্যাখো, যেখান থেকে আমাদের মাননীয় মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাহেব প্রায় মৃত অবস্থা থেকে সুস্থ হয়ে ফিরে এসেছিলেন, সেখানে গিয়েছিলাম !
আরও কতো আছে সবুজ…
আগেই বলেছি, যতদিন ছিলাম, যতদূর পেরেছি ছুটে বেড়িয়েছি আমরা। কোনোখানেই সবুজশূন্য দেখিনি। যেদিন ঢাকায় ফেরার ফ্লাইট, তার আগের দিন বিকেলেও আজাদ ভাই বললে- দীপ দা, আজ বিকেলেও আমরা ঘুরবো শেষবারের মতো। আমি বললাম- সবাই যেখানে শেষমুহূর্তের গোছগাছ নিয়ে ব্যস্ত, সেখানে আমরা বেড়াতে যাবো ! আজাদ ভাইয়ের গলায় অন্য আবেগ- আমাদের তো মোটামুটি গোছানো শেষ। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী কালই দেশে ফিরবো। কিন্তু এ-জীবনে আর সিঙ্গাপুরে আসা হবে বলে তো মনে হয় না। চলেন, আমরা আজ নতুন কোনো দিকে যাবো। এবং পায়ে হেঁটেই। আজাদ ভাইয়ের অদম্য স্পৃহার সায় দিয়ে বিকেলে বের হয়ে পড়েছিলাম নানিয়াং ইন্টারন্যাশনালেরই নিকটস্থ রোডে কিন্তু নতুন লক্ষ্যের দিকে। লক্ষ্য বললাম বটে, কিন্তু আমাদের সুনির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য ছিলো না। কাছের কিন্তু যেদিকে কোনোদিন যাওয়া হয়নি, এরকম একটি রোড ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। প্রায় জনমানবহীন ফুটপাতের উপর দিয়ে পড়ন্ত বিকেলে অনেক পথ হাঁটলাম আমরা।
সমাপ্তহীন শেষের দিকে…
রচনার শিরোনাম দিয়েছিলাম- সিঙ্গাপুর : দ্য সিটি ইন এ গার্ডেন। যারা আমাদের দেশ থেকে সিঙ্গাপুরে যান, তারা তথ্য-প্রযুক্তি আর পূর্ণ-পরিকল্পিত নাগরিক জীবনের জন্য সিঙ্গাপুরকে মডেল হিসেবে বর্ণনা করেন। কিন্তু দেশটা ঘুরে-ফিরে দেখলে এবং একটুখানি তলিয়ে ভাবলে অতিরিক্ত হিসেবে পাওয়া যাবে এই সবুজ সিঙ্গাপুরকে। পুরো দেশজুড়ে যেভাবে সবুজ ও প্রকৃতি প্রাধান্য পেয়েছে, তাতে একটু সৃজনশীল মনে ‘সিটি ইন এ গার্ডেন’ ভাবনাটাই প্রাধান্য পেতে পারে।
Good blog! I truly love how it is easy on my eyes and the data are well written. I’m wondering how I could be notified whenever a new post has been made. I’ve subscribed to your feed which must do the trick! Have a great day!
Hmm it looks like your site ate my first comment (it was extremely long) so I guess I’ll just sum it up what I wrote and say, I’m thoroughly enjoying your blog. I as well am an aspiring blog writer but I’m still new to the whole thing. Do you have any helpful hints for novice blog writers? I’d certainly appreciate it.