
সাবদার সিদ্দিকি : একজন ক্রুশকাঠহীন যিশু
শুভ্র আহমেদ

(এক)
এমোনিয়ার জলা-নদী, উপসাগর -সাগর পার হয়ে তার সাম্রাজ্যে পৌঁছে যাওয়া খুব একটা কষ্টের-পরিশ্রমের ছিল না। ছিল অবশ্য অনেক আনন্দের, কৌতুহলের। কৌতুহল লোকটাকে নিয়ে, লোকটার কাঁধের ঝুল ব্যাগটাকে নিয়ে, হিজিবিজি লেখা ছোট-বড়, রঙিন-সাদা কাগজের টুকরোগুলো নিয়ে– আরো কত কী!
আমরা তখন দুষ্টু ছেলের দল আর তিনি তখন সাবদার, সাবদার সিদ্দিকি, গোলাম সাবদার সিদ্দিকী, টেডি সিদ্দিকী প্রভৃতি তন্ন নামের খোঁজে অশান্ত, বোহেমিয়ান একজন কবি ; প্রচলিত সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতির মুখে প্রচণ্ড থাপ্পড় লাগিয়ে যিনি নিজেই নিজের আইকন, প্রতীক। দুষ্টু ছেলেদের সেদিনের যাবতীয় আনন্দ- উচ্ছ্বাস -উল্লাস ছিল ক্রিকেট -ফুটবল-কাবাড়ি খেলার অবসরে কাগজের ছোট-বড়, রঙিন-সাদা প্লেনগুলোকে আকাশে উড়িয়ে দিয়ে সাবদার নামের চির অসুখী -সুখী মানুুষটার ক্রিয়া -প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষায় বসে থাকা। তারচেয়ে আরেকটু বেশি আনন্দ অই অদ্ভুত মায়াবীদর্শন, বেশভূষায় একেবারেই আলাদা, বড়দের মতে অসম্ভব প্রতিভাধর মানুষটাকে বিরক্ত করতে পারা।
সত্যি কী তিনি বিরক্ত হতেন? দুষ্টু ছেলের দল চাইতো এই আশ্চর্য মানুষটি তাদের লাঠি নিয়ে তাড়া করুক, ইট ছুড়ে মারুক, গালাগালি করুক, কিন্তু কই তেমনটা তো কখনোই করেন না তিনি।
যদি সেদিনের দুষ্টু ছেলের দল জানতো হিজিবিজি লেখা কাগজের টুকরোগুলো ছিল বহুমূল্য কবিতা, কবিতার খসড়া, অসাধারণ সব অক্ষরবিন্যাস নন্দনতত্ত্বের ভাষায় যাদের পরিচিতি ক্যালিগ্রাফি নামে, সাবদার যাদের আদর করে নাম দিয়েছিলেন ক্যলিগ্রাম , তাহলে কী তারা নষ্টের আনন্দে মেতে উঠে হারিয়ে যেতে দিতো সৃষ্টির সেইসব গ্রহাণু-উপগ্রহ-গ্রহ-নক্ষত্রগুলোকে ? একজন অন্তত কখনোই একাজ করতো না,এবং সেও তার বন্ধুদের উদ্বুদ্ধ করতো এরকম নির্মলদোষের আনন্দকাজ থেকে বিরত হওয়ার দীপ্ত অঙ্গীকারের শপথ নিতে। কিন্তু হায়– অনেক বছর পর কিশোরীর পাঠানো সবচেয়ে যত্নে বইয়ের ভাঁজে গুজে রেখে হারিয়ে যাওয়া বিবর্ণপ্রায় গোলাপ পাপড়ির মতো একটুকরো সাবদারকে স্মৃতি থেকে উদ্ধার করি–
‘ পতঙ্গ রঙ্গ করে
আলোর তরঙ্গে
সোনালি আগুন মাখে
মৃত্যু আনে অঙ্গে। ‘
(দুই)
ভারতবর্ষ ভাগ হওয়ার তিন বছর পর সাবদার (১৯৫০-১৯৯৪) জন্মেছিলেন কোলকাতায়। ১৯৬৪ সালের দাঙ্গা পরিবারসহ তাকে ঠেলে দিয়েছিল এপার বাংলায়, সাতক্ষীরায়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই তার পরিবার ফিরে যান কোলকাতায়। আইনজীবী পিতা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে আর ফিরে আসেননি, কিন্তু সাবদার ফিরে যাননি, সাতক্ষীরায় থেকেছেন, মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছেন,কোলকাতা গিয়েছেন, আরো অন্যত্র তবে সবটাই নিজের মতো করে।
লক্ষণীয় নিরাপত্তাহীনতায় যে কোলকাতা সাবদার ও তার পরিবার ছেড়েছিলেন, মাত্র সাত বছরের ব্যবধানে সেই কোলকাতা সাবদারের পরিবারের আশ্রয়স্হলে পরিনত হলেও কোলকাতা আর সাবদারকে স্হায়ীভাবে টানেনি কোনোদিন। এই বারবার বাস্তুচ্যুতি বাস্তু সম্পর্কে শেষপর্যন্ত তাকে করে তুলেছে স্বতন্ত্র ভাবনায় নিমজ্জিত উড়ুক্কু মানুষ। সাবদারের কাছে এই বাস্তুচ্যুতির কারন খুবই স্পষ্ট। দ্বিজাতিতত্ত্বের মূলে ধর্ম, ধর্মবিশ্বাস। অথচ সাবদার জানেন ধর্মের কোনো নিজস্ব ভূখণ্ড থাকতে নেই,যেমন নেই কবি,কবিতার। এই না থাকাটাই কবির কাছে ‘ ‘চতুর্থ বিশ্ব ‘–
‘যে রকম ধর্মের নিজস্ব নিদিষ্ট কোন ভূখণ্ড নেই
সেরকম ধর্মের কবিতার নেই কবির নেই সৌর সংসারের নেই
পৌর সংসারের নেই।
কবি ও কবিতার নিজস্ব ভূখণ্ড নেই
একজন কবি তাই চতুর্থ বিশ্বের নিঃসঙ্গ নাগরিক।’
(কবিও নিদিষ্ট ভূখণ্ড, পা ও অনান্য)
(তিন)
ক্লেদজ কুসুমের বোদলেয়ারের সাথে কোনো রকমের মনন সম্পর্কের আত্মীয়তায় আবদ্ধ করা চলে না তাকে। নারী লিপ্ততার বিশেষ কোনো সংবাদ রাষ্ট্র হয়নি জীবদ্দশায়, এমনকি মৃত্যুর পরও তবু সাবদার আক্রান্ত ছিলেন উপদংশে,সিফিলিসের চিকিৎসা নিয়েছিলেন ডাক্তার ক. আ. সিদ্দিকির কাছ থেকে। সবার যেখানে তীব্র আসক্তি সাবদার সেখানে নিরাসক্ত, তবু নষ্ট অনেক কাজ, অনেক অভ্যাসের দাসত্বে তিনি স্বেচ্ছায় বন্দি হয়েছিলেন সেকি প্রচলিত সকল বিশ্বাসের বাইরে বেরিয়ে এসে এক নিজস্ব নিয়মের ‘চতুর্থ বিশ্ব ‘প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায়ে ; প্রাতিষ্ঠানিক দাসত্বকে অস্বীকার করার প্রবল তাগিদ তিনি কি অনুভব করেছিলেন সমাজ -সংসার-রাষ্ট্রের পীড়ন বিভীষিকায়, নাকি অস্তিত্বের বিরামহীন টানাপোড়েনই ছিল তার যাবতীয় আচার -বিচারের তুল্যমূল্যের দণ্ডকাঠি, ওজনপাল্লা।
সাবদার কী শেষপর্যন্ত বিশ্বাস করেছিলেন ‘মৃত্তিকার বুকে শিল্পই গভীরতম রহস্য। শুভ্রতম অস্তিত্ব ‘। নিজস্ব স্বভাবের সাথে ছিল তার নিরন্তর রক্তাক্ত যুদ্ধ। সাবদার জানতেন যুদ্ধ মানে ক্ষয, যুদ্ধ মানে ধ্বংস, যুদ্ধ মানে এক ধরনের পরাজয়। তবু সেই অদৃশ্য -অসম, লৌকিক -অলৌকিক শক্তির সাথে যুদ্ধে কখনো কখনো জয়ী হতেন। দুঃসাহসের সেই স্বপ্নসখাকে বন্দি করতে ভালোবাসতেন অক্ষর-শব্দ-বাক্যের কাঁটাতারে। অক্ষর তার কাছে হয়ে উঠতো শস্যকণা, কখনো শস্যের তীব্র উঠোন।
কখনো কখনো অক্ষর, শব্দের আগন্তুক বিন্যাসে জন্ম নিতো কবিতা–
১.
‘কাপড় তলায় লুকিয়ে গোপন পাপ
হৃদয় তলায় পাকিয়ে শীতল সাপ
কাপড় তলায় লুকিয়ে গহীন তাপ
রক্তে মাংসে মধ্যবিত্ত চাপ
ভালোবাসা গহীন রঙিন তাপ।’
(বস্ত্রশিল্প, পা ও অন্যান্য)
২.
‘সবকথা যে যায় না লেখা কাগজে
আলো আর শব্দ মাঝে যা বাজে।
বলতে নেই সেসব কথা সহজে
রক্ত তড়িৎ দেয় দোলা যে মগজে।
তোমার কথা বলল সে কোন কাগজে। ‘
(অকথ্য অক্ষর /১, সুভাষ সাহা সম্পাদিত গোলাম সাবদার সিদ্দিকির কবিতা)
৩.
‘সংশপ্তক
এই একবিংশ শতক।
পাখায় পাখায় নৃত্য
মত্ত কথক।
হংসচক্ষু ডানা হংসশতক
সংশপ্তক
এই একবিংশ শতক।’
(সংশপ্তক /২৫, প্রাগুক্ত)
৪.
এক গাছ আমাকে হলুদ পাতা দেখাল ও ।
এক কুড়ি গোলাপ জ্বালাল ও ।
প্রলাপ স্বপ্ন রঙিন ঘুম ভাঙাল ও ।
রক্ত গোলাপগুলো চোখে চোখে চোখ রাঙাল ও ।
(ছোটগল্প /১৮, প্রাগুক্ত )
(চার)
সাবদার অনেক কিছু।একা অথবা অনেকে।বিপ্লবী অথবা সন্ত। অথবা ভাগ হয়েছেন, নিজেকে ভাগ করেছেন, যেনো সবটাই জরুরি। ভাগ ছাড়া এই মৃত্তিকা, এই সমাজে টিকে থাকা যায় না। অথচ টিকে থাকাটার গুরুত্ব অশেষ। এমনকি এই সমাজ-এই সংস্কৃতি -এই রাজনীতির মুখে যদি তীব্র কোনো চুম্বন বা চপেটাঘাত করতে হয তবেও বিভাজন প্রয়োজন। বিভাজনে অণু, বিভাজনেই পরমাণু, বিভাজনেই শক্তি।
এক অর্থে এক সময বিপ্লবী ও ব্রহ্মচারী এই দুজনেরই ঘর থাকে না,ঘরের প্রয়োজন থাকে না, কিন্তু শেষপর্যন্ত বিপ্লবীর ঘরের প্রয়োজন হয়,কিন্তু ব্রহ্মচারীর নয়। কিন্তু যদি কেউ হন বিপ্লবের ব্রহ্মচারী তাহলে কি সহজে হিসেব মেলে। সম্ভবত মেলে না। যেমন মেলাতে চাননি বা পারেননি সাবদার। সেজন্যেই তিনি তার মতো।সেতারের টুংটাং, টেলিগ্রাফের টরেটক্কা সবই কী তাহলে কেবল সময়ের চিত্র ? বিশেষ রঙিন বা বিশেষ বিবর্ণ সময়ের ? এমনকী নারীও কি হয়ে ওঠে সেইসব রঙিন বা বিবর্ণ সময়ের প্রতীক এবং প্রতীক ভগ্নাংশ :
‘টেলিগ্রাফের তার
যেনো রবিশংকরের সেতার
সুরের মুর্চ্ছনায় মুর্চ্ছনায়
টক্কা টরে টক্কায়
টরে টক্কায় বলে যায়
ডাক দিয়ে যায়
আয় ওরে আয় আয়
আয় নারী
আয় বিপ্লবের ব্রহ্মচারী ‘
(টেলিগ্রাম টেলিগ্রাম, )
(পাঁচ)
‘— নারী আমার মাংসপুতুল নাচ আবহমান কালোশ্বেত
মাংসজন্ম,ব্যক্তিগত নারী আমার প্যাকেট পকেট
ঝলোমলো সিন্ধু সিন্দুক রঙিন রক্ষিত
মুখোশ রাশি রাশি আলখাল্লাহাস
দাঁতে বিদ্ধ যার শস্য আদিম মাংসকনা।
নারী আমার মাংস উদ্ভিদ —‘
(পুনর্মুদ্রণ-০১ সাবদার সিদ্দিকি, কবিতা সংগ্রহ, আবদুল মান্নান সৈয়দ সম্পাদিত)
নারীর প্রতি সহনশীল হলেও সাবদার ততোবেশি শ্রদ্ধাশীল নন। নারীর প্রতি তীব্র অবিশ্বাস সর্বত্র-সবসময়, তবু নারী তার মিত্র। কেনো এই অবিশ্বাস ? অবিশ্বাসের একমাত্র না হলেও অন্যতম কারন নারীর সবকাজ, সবকথা অতিরঞ্জিত মনে হয় কবির কাছে ;
‘একদা তুমি বলেছিলে
লাল সূর্যটাকে পিটিয়ে পিটিয়ে হাতুড়ি
কাস্তে বানাবে, লোহা পিটিয়ে সোনা
গাধা পিটিয়ে ঘোড়া
কবিতার শেষাংশ:-
এছাড়া এরকম আবহাওয়া দেশলাই
নাও জ্বলতে পারে
আমাকে লবন চাষের উৎসাহ দিয়ে
সমুদ্রে পাথর ভেলায় ভাসবার
ইচ্ছা প্রচণ্ড ছিল তোমার। ‘
এই অবিশ্বাস নিয়েও কবি থাকেন চুপ করে। অনেকটা সে/তারা (নারী) বলছিল বলেই থুথুর রসায়নে মুখভর্তি সত্ত্বেও শব্দ-বাক্যহীন নিশ্চুপ তিনি। কবির এই যে চেহারা,এটি সেই বিভাজনেরই ইঙ্গিত করে যার কথা আমি ইতিপূর্বে বলার চেষ্টা করেছি। কবি নারীর প্রতি সহিংস নন, নারীকে পরিত্যাগেও ইচ্ছুক নন কিন্তু নারীর ক্ষমতায়ন তার কাছে অলীক হাস্যকর কিছু একটা।আর সম্ভবত সেই কারনে তিনি অবলীলায় বলতে পারেন :
‘ওরা চলে যাবে ওরা নদীর মতো যাবে
ওরা বয়ে যাবে
তরঙ্গসংকুল তরঙ্গ বুকে নিয়ে
আবহমান ওরা বয়ে যাবে
স্রোতস্বিনী নদীর মতো ওরা
বয়ে যাবে, ওরা নারী
তুমি তোমার পুণ্য স্নান সেরে নাও’
(ওরা নদী ওরা নারী,পা ও অন্যান্য)
এই ভাবনা কি কোনোভাবেই হতে পারে একজন মার্কস শাসিত ভাবুক,কবির ?
(ছয়)
বিচ্ছিন্নতাবোধ, স্বেচ্ছাকৃত শারীরিক ও মানসিক দুরত্ববোধ এবং নিষ্ঠুরতা অধিকাংশ সময় যার শিকার স্বয়ং কবি নিজে, আতঙ্কজাগানিয়া বা কৌতুক ও কৌতুহল উদ্দীপক বেশ ভূষার আড়ালে কোনো এক জীবনসত্যকে আড়াল করার প্রবণতা, মানবজীবনে স্পর্শকাতর আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপ ইত্যাদি বিষয় ও প্রবণতার কারনে সাবদার সিদ্দিকি কে একজন অস্তিত্ববাদী হিসাবে চিনতে কষ্ট হয় না। সাবদারের এই মার্কসঘেষা অস্তিত্ববাদী চরিত্র আমাদের জ্যঁ পল সাত্রের কথা মনে করিয়ে দেয় যিনি সকল প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতিকে প্রত্যাখান করেছিলেন এবং মার্কসবাদের প্রচারে পারির রাস্তায় একজন সাধারন হকারের মতো সরকারের নিষেধ উপেক্ষা করে মার্কসবাদের প্রচার পুস্তিকা বিক্রি করতে নেমেছিলেন। আমাদের মনে পড়ে সাবদারকেও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কলকাতার ব্যস্ততম রাস্তায় প্রচার পত্রিকা একজন সাধারণ হকারের মতো বিক্রি করতে দেখা গেছে, যদিও তার এইসব কর্মকাণ্ড ছিল মুজিবনগর সরকারের নিয়ন্ত্রণ ও জানাশোনার বাইরে।
মান্নান সৈয়দ সাবদার সিদ্দিকির এপর্যন্ত উদ্ধারকৃত একমাত্র গদ্যরচনার পাঠান্তে সাবদারের মনোপ্রতিন্যাস সম্পর্কে যে ইঙ্গিত দিয়েছেন তা হচ্ছে ‘একই সাথে বিপ্লবের ও স্বপ্নের প্রতি মুগ্ধতা ’ । ‘… সমস্তের ভেতর এক গহীন একাকিত্বের দখল করেছিল তাকে’ এরকম বয়ানের মধ্য দিয়ে তিনি সাবদারের মনোজগতের যে নিঃসীম একাকিত্বের আভাস দিয়েছিলেন তা অবশ্য প্রথিতযশা বক্তা, চিন্তক, অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান এভাবে একবাক্যে খারিজ করেন, ‘সিদ্দিকীর সংগৃহিত কবিতা পড়ে আমাদের মনে হয়েছে ওর (সাবদারের) মেজাজ ব্যক্তিগত একাকিত্বের অভিযোগ আশ্চর্য বিরল। যাকে সহজ কথায় বলে দেশ ও দশের ভাবনা— চলতি অর্থে রাজনীতি ও সমাজচিন্তাও বলা যায়– তার উপস্থিতি প্রবল ওর কবিতায়।’
তবে খান এবং সৈয়দ দুজনেই সাবদারের মনোজগত ও কবিতার উপর অবচেতনের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবের কথা উল্লেখ করেছেন।অবচেতনের লেজ ধরে আমরা এখন কিছু সময়ের জন্য ফ্রয়েডে প্রবেশ করবো।
অনেক কাজ-কথা-ভাবনায় আমরা প্রায়ই বলে থাকি, ‘আমার মনে হয়’। এই ব্যাখ্যাতীত মনে হওয়ার একমাত্র কারন মন স্বনির্ভর এবং কিছুটা হলেও খামখেয়ালি। মিঃ হেমহজ ও তার অনুসারীরা যারা মনে করেন যে কোনো ঘটনারই প্রয়োজনীয় যথোচিত কারন না থেকেই পারে না, তাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে এটুকু বলা যায়, সৃষ্টি করার মুহূর্তে আমাদের মনকে এই এক ধরনের স্বনির্ভরশীল ও খামখেয়ালি হতেই হবে, এই হওয়া ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই বলে।
কারন আমাদের মনের মধ্যে যে দুটি পরষ্পরবিরোধী শক্তি সর্বদা কাজ করে বলে ফ্রয়েড মনে করেন, তার একটি জীবনমুখী ও অন্যটি মৃত্যুমুখী। এরস বা জীবনমুখী যে শক্তি তার বিকাশ দুটি প্রধান প্রবৃত্তি যথাক্রমে আত্মরক্ষা ও বংশরক্ষার মধ্যে প্রকাশ পায়। সাবদার এদিকে আগ্রহী ছিলেন কি ? যারা সাবদারকে কাছ থেকে চিনতেন তাদের মতামতের পাল্লা ‘না’ এর দিকে অর্থাৎ না ধ্বনি জয়যুক্ত হয়েছে বলে ধরে নেয়া যাক।
দ্বিতীয় শক্তি ফ্রয়েড যেটাকে থ্যানাটস্ বলেছেন সেটিও প্রথমটির মতো দুটি প্রবৃত্তির মধ্যে প্রকাশিত হয়। প্রথমত এই প্রবৃত্তি আত্মঘাতী হতে পারে দ্বিতীয়ত এটি পরঘাতী হতে পারে। যখন আত্মঘাতী তখন এর উদ্দেশ্য হলো জীবন (প্রচলিত জীবনবোধ) থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়া, আর যখন পরঘাতী তখন অপরকে জীবন (প্রচলিত জীবনবোধ) থেকে ঠেলে দেয়া যা প্রকৃতপক্ষে অন্ধকারের দিকে দিক নির্দেশ করে । সাবদার কেনো প্রথমটি বেছে নিয়েছিলেন তার উত্তর যেমন ‘ বৃত্তহীন বৃত্তের ‘বিষয়ভুক্ত তেমনি আবারও বলি সাবদারের রাজনৈতিক দর্শনকেও মেলানো যায় না সহজ কোনো মতাদর্শে। এই জীবন থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়ার মধ্যে চমক হয়তো থাকে কিন্তু সেই ডানপিটে কৃতিত্ব নেই যার কারনে একজন, একমাত্র রাজনৈতিক বোধ ও বিশ্বাসের কবি হিসেবে তাকে তুলে ধরা সম্ভব হতে পারে।সে যেমনটা হোক, দুষ্টু ছেলের দল তার (সাবদার) লেখাগুলোকে যখন প্লেন বানিয়ে আকাশ শূন্যে হারিয়ে যেতে দিতো তখন তিনি (সাবদার) কিছু বলতেন না কারন তারমধ্যে পরঘাতী প্রবৃত্তির চেয়ে আত্মঘাতী প্রবৃত্তি সর্বদাই পূর্ণাঙ্গ ও প্রবল থাকতো।
এবার অবচেতনের ব্যাপার -স্যাপারগুলোকে একটু নেড়েচেড়ে দেখা যাক। অবচেতনের ব্যাপার-স্যাপারগুলোকে সাধারণভাবে আমরা স্মৃতি বলে থাকি। পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রমতে শক্তির ধ্বংস নেই তবে রূপান্তর আছে। ফ্রয়েডও মনে করেন সব ধরনের মানসিক উদ্দীপনারও ধ্বংস নেই তবে রূপান্তর আছে এবং সেই রূপান্তর মূলত অবদমিত অবস্থায় থাকে অবচেতনে, ক্ষেত্রবিশেষে নিশ্চেতনে। ফ্রয়েড যে তিন ধরনের উপাদানের কথা বলেছেন তার মধ্যে শেষোক্ত দুটি যথাক্রমে অহং(সামাজিক উপাদান) এবং অধিশান্তা (শাস্তি ও পুরস্কার উপাদান) কে সাবদার সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। অহং যখন অদস(জৈবিক উপাদান) এর সমাজ অস্বীকৃত ইচ্ছাকে চরিতার্থ করতে চায় তখন অধিশান্তা তার মধ্যে পাপবোধ জাগিয়ে তোলে। অহং এর মধ্য দিয়ে অথবা সোজাসুজি অধিশান্তা অনৈতিক ইচ্ছেগুলোকে অনবদমিত করে। অহং এবং অধিশান্তা যেহেতু সাবদারের নিয়ন্ত্রক উপাদান নয় সুতরাং আমরা ধরে নিতে পারি সাবদারের মনোজগত ও কবিতা অদস শাসিত । অতএব রাজনৈতিক দর্শনের আলোয় তার কবিতার টিকা-টিপ্পনি রচনা আর যাই হোক সাবদারের কবিতার একমাত্র মূল্যায়ন হতে পারে না। হয়ওনি। আবার অদস-অহং-অধিশান্তার যতখানি পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ায় ‘স্বপ্নের ধ্বনিরা এসে ‘ চেতনার প্রদীপ্ত সূর্যটাকে একফুয়ে নিভিয়ে দিয়ে তিমিরঘন অন্ধকারের ভাষায় কবিতার সীমানাকে আরো প্রশস্ত করে সম্পূর্ণ পরাবাস্তব রূপ নিতে পারে তার থেকে কিছুটা দূরে শেষপর্যন্ত শক্তি হারিয়েছি সাবদারের কবিতা। সাবদারের কবিতায় এরকম একাধিক অসম্পূর্ণ দর্শনের সবসময় বাহিত চিহ্নের কারনে সৈয়দ এবং খান দুজনের পক্ষেই সাবদারের কবিতাকে তাদের নিজ নিজ পছন্দের পাত্রে ঢেলে নেয়া সম্ভব হয়েছে। এর ফলে সাবদার মূল্যায়িত হয়েছেন খণ্ডিতভাবে।এবার সাবদারের কবিতা থেকেঃ
অদসের শাসন স্বেচ্ছায় মেনে নিয়ে দাঁত- নোখ-মুখ-চোখ লুকিয়ে পুড়তে পুড়তে কবি এতটুকু হতে হতে রাজি–
১.
‘ক্রীতদাস রচিত সভ্যতা থেকে
এক মানবিক অশ্ব ব্যবধান
আমি এভাবেই হেঁটে হেঁটে যাই মঞ্চে
মঞ্চ সফল মানুষের কাছে
এভাবেই নিজের মধ্যে আত্মগোপন
করে থাকি ভুলে থাকি
দাঁত নোখ মুখ চোখ
সর্বদা লুকিয়ে রাখি গোপন অস্ত্র যেমন। ‘
(অপ্রকাশিত গদ্য /গ/৫ প্রাগুক্ত সুভাষ)
২.
‘নিজেকে শাসন করি
নভনীল ব্যথা অভিমানে ভুলে যাই।
বারুদে আগুনে ঝলসাই
পুড়তে পুড়তে
আমি এই এতোটুকু হয়ে যাই।’
(স্বায়ত্বশাসন /৬ প্রাগুক্ত সুভাষ)
৩.
‘সন্ধানে ভয়ের তীর্থপথিক
আর তাই কাউকে নয়।
আমাকে আমি ছাড়া
করিনা কাউকে ভয়। ‘
(পাওয়া না পাওয়া /৭ প্রাগুক্ত সুভাষ)
কিন্তু কবি যখন ভালোবাসার প্রত্যাশা করেন তার প্রিয় মানুষ /মানুষীর কাছে তখন তিনি অন্যরকম,যে নিয়ন্ত্রণ দেখি আমরা প্রতিনিয়ত নিজের প্রতি তা যেনো একটু দুর্বল, একটু শিথিল হয়ে যায়, কবিতাও ফিরে যায় চিরচেনা তুমি/তোমরার মধ্যে।
১.
‘তবু রয়ে যাও শূন্য দূরত্বে তুমি
এই ধূ ধূ মাঠ মাটি বালিয়াড়ি
ভেঙে যায় কাঁচচোখ নিসর্গ নিমগ্ন
ভাস্কর্য
তবু এক শূন্য দূরত্বে রয়ে যাও
তুমি কেবলই আমার।’
(একশূন্য /৯ প্রাগুক্ত সুভাষ)
২.
‘ভালোবাসা হারান ওর চেয়ে
ভূমণ্ডলে শ্রেষ্ঠ কোনো ভয় কি আছে
আছে কোন ও সন্তাপ
ভালোবাসা হারান ওর চেয়ে
দেখি আছে কি তোমার কাছে।’
(অপ্রকাশিত পদ্য /ঘ/ ১০ প্রাগুক্ত সুভাষ)
কিন্তু নির্লিপ্ততা,অদস এর কাছে অহং এবং অধিশান্তার পরাজয়ের কারনে শেষপর্যন্ত সবকিছু অর্থহীন হয়ে যায় কেবল কথা,শব্দ আর বাক্য ছাড়া :
‘কথারা কথার সাথে
কথা বলছে
শব্দেরা বাক্যের।
নয় কেউ
সেই তুমি আমি তুই
কেউ ময়
শব্দেরা বাক্যের সাথে
বাক্যেরা অর্থের সাথে
কথারা কথার সাথে।’
(কথাশিল্প / ১২ প্রাগুক্ত সুভাষ)
একজন মানুষ যখন সকল সত্যকে অস্বীকার করে নিজেই নতুন সত্য হয়ে ওঠেন, তখন খুব তাড়াতাড়ি প্রাথমিক বিরোধ কাটিয়ে ওঠার পর কুৎসিততম পৃথিবীও তাকে তাদের করে নেয়ার কৃতিত্ব দেখাতে চায়।অধিকার ও অধ্যাপকীয় অভিভাবকত্বে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সক্ষম হলেও অহং ও অধিশান্তাকে অস্বীকার করে তিনি যখন সকল জাগতিক নামগানের উদ্ধে চলে যান তখন প্রতিষ্ঠানগুলোই না চাইতেই হয়ে ওঠে তার শিষ্য-সাগরেদ। না চাইলেও তার নামগান জারি রাখতে চায় তারা। কিন্তু সাবদারতো এসবের উদ্ধে এক ক্রস কাঠহীন যিশু, সুতরাং রক্তচক্ষুর লেখনীকেও তিনিই তো পারবেন উপহাস করতে, আশ্বাস আর সাহস যোগাতে স্বজনের।
১.
‘নাম নিয়ে খেলা করি
নামের গান গাই
নামের গভীরে ভিড়ে কচিৎ হারাই
ঐ নাম থেকে কতদূর এলাম
রসনায় রসনায় রাষ্ট্র এই নাম
নাম নিয়ে খেলা করি
নাম গান গাই
নাম ছেড়ে কচিৎ হারাই।’
(নামগান / ২৪ প্রাগুক্ত সুভাষ)
২.
‘ সাবদার সাবধান
দেয়ালে দেয়ালে এ
বাক্য দেখলাম
আহত বান্ধব বললেন
বললাম এইমাত্র
আমিই লিখলাম
হুঁশইয়ার সাবদার
সাবধান ‘
(সাবদার সাবধান, সোনার ছবি)
(সাত)
অধিশান্তা এবং অহং এর নির্বাসনের পর সাবদার যখন বিরলপ্রজ সাবদার হয়ে ওঠেন, খোঁজ করেন সত্যের, অনুভব করেন প্রিয়জন আর সত্যের ভয়ঙ্কর অভাব ওখন খুব জটিল হয়ে ও্ঠেন সাবদার।বিরলপ্রজও। বিরলপ্রজ অবশ্যই কিন্তু জটিল কেনো ?
সলিমুল্লাহ খান যখন লেখেন– ‘আমার সিদ্ধান্ত : সাবদার সিদ্দিকী পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত রাজনীতির কবি। ইজম-তাড়িত নন, ইজম-তাড়ুয়া কবি সাবদার। তিনি স্লোগান লেখেন ঢের। সাবদার সিদ্দিকী স্বর্গত্যাগের পর থেকেই সিম্বোলিক অর্ডারের কবি। ‘ তখনই প্রশ্ন জাগে সত্য কোনটি। আমরা এখন ধরে নিচ্ছি সত্য তার সংজ্ঞা যেমনটাই হোক এখানে সত্য নিয়তই নিয়মমাফিক পরিবর্তনশীল।সাম্প্রদায়িকতা সাবদারের কাছে সম্ভবত প্রথম সত্য। তাহলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কি সাবদারের কাছে প্রথম সত্যের ইলাস্ট্রেশন, নাকি এটা দ্বিতীয় সত্য। কারন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পিছনে অসাম্প্রদায়িক চেতনার সাথে আমি বলবো অনেক বেশি
অর্থনৈতিক বঞ্চনার বিষয়টি প্রতীক হিসাবে জারি ছিল। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী রাজনীতির গতি প্রকৃতি এবং জাসদের নীল কাদার ভেতরের চন্দ্রালোকিত রাজনীতি সাবদার কি সত্যি সাম্রাজ্যবাদী বা আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদের ভেল্কিবাজি মনে করতেন? জাসদ ছাত্রলীগের সাথে তার সম্পর্কের ব্যাখ্যাই বা কি ? নাকি তার কাছে এর সমস্তটাই ছিল তৃতীয় সত্য। নাকি ‘লাল গল্পে’ র লাল বলের মতো সবকিছু হারিয়ে ফেলাই ছিল তার চতুর্থ বা শেষতম সত্য।
সাবদারের অধিকাংশ কবিতাই মাত্র কয়েক পংক্তির। দুষ্টু ছেলের দল নষ্টের মহোৎসবে যে কাগজগুলোকে হারিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল তার মধ্যের প্রায় সব লেখাই এরকমই। এ পর্যন্ত উদ্ধারকৃত অথবা সংকলিত সাবদারের কবিতাগুলোকেও আমরা এমনই পাই।কয়েকটি কবিতাঃ
১.
‘বিরল সকল দেখি
বাঘ ও মানুষ
বিরল বিরল
কেবল রন পবন
বিরল সকল কেবল
বাঘ ও মানুষের মন ‘
(বিরলপ্রজ, সোনার ছবি)
২.
‘প্রয়োজন তত নেই
খাদ্যের
প্রয়োজন শুধু আজ
পথ্যের
প্রিয়জন শুধু আর
সত্যের ‘
(পথ্যাবলী, সোনার ছবি)
৩.
‘তারপর বাচ্চারা খুব কান্নাকাটি করছিল
পৌড়জন বললেনঃ
বাচ্চারা খুব লাল ভালোবাসে
প্রাজ্ঞ একজন লাল বল ছুড়ে দিলেন
একবার পূবে
একবার পশ্চিমে
খেলতে খেলতে ঘুমিয়ে গেল
বাচ্চারা তারপর স্বপ্নের মধ্য
হারিয়ে লাল বলটা
আবার কান্নাকাটি করতে লাগল।’
(লাল গল্প, পা ও অন্যান্য)
(আট)
বুর্জোয়া সংস্কৃতির অব্যাহত বিস্তার এবং বিকল্প সংস্কৃতির অনুসন্ধানের মধ্যেই শুরু হয়েছিল বিভাগোত্তর কবিতার দুটি উল্লেখযোগ্য ধারা। বিকল্প সংস্কৃতির পথ একটা সময়ে জাতীয়তাবাদী এবং সমাজবাদী এই দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু বিশেষ করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রবল জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিস্তারের সাথে সাথে ভাষা আন্দোলনকেন্দ্রিক সংস্কৃতিই সাহিত্যের প্রধান পৃষ্ঠপোষকের রূপ লাভ করতে থাকে। এইসময় সমাজবাদী তথা মার্কসবাদী সাহিত্যের ধারাটিকেও কিছুটা রূপবদল করে ভাষাভিত্তিক প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী চেতনায় লীন হয়ে যেতে দেখা যায়।
উনিশ শ’একাত্তর বা এর সামান্য পূর্ব ও পরবর্তী সাংস্কৃতিক চেতনা ছিল মূলত ৬ দফা, গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ এবং যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতাকেন্দ্রিক। সাবদারের মনোজগতের উপর প্রথম আলোড়ন তুলেছিল ‘কোরক সংসদ ‘ নামক সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং এর প্রধান সংগঠক শহীদ আজমল হক। শহীদ আজমল হক ছিলেন ইস্ট পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির অনুসারী। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে শহীদ আজমল হক পশ্চিম পাকিস্তানের নরঘাতকদের হাতে ধরা পড়েন এবং যশোর ক্যাণ্টনমেণ্টে অমানুষিক নির্যাতনের ফলে মৃত্যবরণ করেন। লক্ষণীয় শহীদ আজমল হক ও তার অনুসারীরা দেশের মধ্যে থেকে ভারতের সাহায্য না নিয়ে যুদ্ধ শুরু করার পর সাবদার তাদেরকে ত্যাগ করে ভারতে চলে যান। কিন্তু আমি পূর্বেই বলেছি তিনি মুজিবনগর সরকারের নিয়ন্ত্রণে না থেকেও কবিতা লিখে, পত্রিকা প্রকাশ করে এককথায় তার নিজের মধ্যে নিজের মতো করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।
সাবদার সিদ্দিকি যে শেষ পর্যন্ত শহিদ আজমল হকের প্রভাব সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে গিয়েছিলেন এমনটা মনে হয় না।আবার তিনি যে তার (শহীদ আজমল হক) প্রভাব সম্পূর্ণভাবে আত্তীকরণ করেছিলেন এমনটাও নয়।মূলত তার ভিতরে এই প্রথম এমন এক দ্বান্দ্বিক অবস্থা তৈরি হয় সেখান থেকে তিনি শেষপর্যন্ত আর মুক্তি খুঁজে পাননি, অথবা মুক্তি খোঁজেননি, বরং এই দ্বান্দ্বিকতায় আত্মসমর্পণই স্বাধীনতা পরবর্তী কবিতা তাকে শৃঙ্খল ভাঙবার, শৃঙ্খল মুক্তির সীমানায় পৌঁছে দিয়েছিল।
যদিও সাবদার বলেন ‘আলো জ্বালাতে এসে আগুন ফেলেছি জ্বেলে ‘ তবু এটাই যে তার শেষ কথা এমনটা মনে করার কোনো কারন নেই। বরং আমরা উল্টোভাবে বিষয়টাকে দেখতে এবং বলতে পারি যে আগুন জ্বালার চেষ্টায় একসময় অব্যাহতি দিয়ে তিনি পুনরায় আলো জ্বালতেই চেয়েছিলেন। মনের যত্নই শেষ পর্যন্ত সত্য হয়ে উঠেছিল, কখনো কখনো পিছনেও তাকিয়েছেন তিনি কিন্তু সে তাকানো নতুন কোনো সম্পর্কের পর যেভাবে সকলে কখনো কখনো পিছনে তাকায় অনেকটা সেইভাবে :
(১)
‘কলম ও
বন্দুকসম
মন
কানের ও
মনের
রাখিও যতন ‘
(বাঁশীর গান, সোনার ছবি)
(২)
‘প্রাপ্তির পর
যেভাবে যায়
পুনরায় সামনে
চায়
পুনঃ
পুনঃ
কখনও
পিছনে তাকায় ‘
(পর্যবেক্ষণ, সোনার ছবি)
শহীদ আজমল হকের দীক্ষা, অন্যদিকে জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দর্শন ও সংস্কৃতির সুবিশাল আয়োজন আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এই দুয়ের মধ্যে সাবদার শেষপর্যন্ত কোনো মীমাংসাযোগ্য সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেননি। সুতরাং রাজনীতি তার কাছে হয়ে উঠলো পূর্ব পুরুষের বিচ্যুতি, শঠতার অধ্যাবসায়, ধূসর ভবিষ্যৎ, শূন্যতার মধ্যে দিনযাপন ইত্যাদি :
‘অথচ আমার ঘরে কোনো ক্যালেন্ডার নেই
কোনো ঘড়ি কাঁটা কম্পাস নেই
তালা নেই, চাবি নেই
শুধু আছি আমি আর আমার মায়াকান্না।’
(স্কাইল্যাব, পা ও অন্যান্য)
রাজনীতি বদলে গেছে, যা নিয়ে সকলের এতো উত্তেজনা, এতো আগ্রহ, এতো উদ্দীপনা কবির কাছে তা কেবলই পঁচাগলা শবঃ
‘ সবাই বলে
বদলে গেছে
বদলে গেছে সব।
তবু কাম্যতা আর যৌনতার
থামেনি মহোৎসব।
বদলে গেছে বদলে গেছে
দশদিকে দশরব
মানুষ নয় পাথর নয়
পঁচাগলা শব। ‘
(বলাকওয়া /১৬ সুভাষ প্রাগুক্ত)
অতএব অনুভূতি দিয়ে জগৎ তৈরি করতে চাইলেন তখন তিনি। কবিতায় ক্রমশ বক্তব্য সীমিত হয়ে উঠতে থাকলো, বক্তব্যের জায়গাটা সুস্পষ্টভাবে প্রতীকের দখলে চলে গেলো।
কবিরা কবিতা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন নানা কারনে —‘ কখনও প্রথা থেকে বেরুবার জন্য, কখনও নিজেকেই পালটাবার জন্যে কখনও বিশেষ বক্তব্যের প্রয়োজনে, কখনও শুধুই চমকপ্রদ নতুনত্ব সৃষ্টির উদ্দেশ্যে। পরীক্ষার ভাংচুর আঙ্গিকের উপর যতো সহজে ঘটে, অন্তর্বস্তুর কিন্তু ততো সহজ নয়। ‘ (আধুনিক কবিতার ইতিহাস, সম্পাদকঃ অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত ও দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়। পৃষ্ঠা ১৯৩)
এমতাবস্থায় সাবদার চেয়েছিলেন তার কবিতার ভূগোলটাকে যতদূর সম্ভব দীর্ঘ করতে। লিখে রাখা ভালো ইতিমধ্যে সাবদারের মনোজগতে নাটকীয় পরিবর্তনের কারণে তিনি অদসের অধীন হয়ে উঠবেন, অথবা ইতিমধ্যে সম্ভব্য অন্য স্তরগুলো পার হয়ে অদসের কাছাকাছি এসে পৌঁছেছিলেন। কবিতায় গোলক ধাঁধাঁর স্থাপত্য তৈরি করতে এইসময় তিনি প্রতীক কৌশলের চুড়ান্ত ব্যবহার শুরু করলেন। মুদ্রণ বিন্যাসের সাহায্যে কবিতার নতুন দৃষ্টিগ্রাহ্য রূপসৃষ্টি থেকে শুরু করে দৃশ্যসমূহের কার্ট টু কার্ট উপস্হাপন সবকিছুই যেনো পুরাতন থেকে পলায়নের চেষ্টা ,
সবকিছু, সবকিছুর মধ্যেই তখন কেবল প্রতীক, প্রতীকী। প্রতীক হয়ে উঠলো মুক্তির নতুন নিশান। তৈরি হতে থাকলো ‘অপ্রকাশিত ০৩ ও ০৪, ছবিঘর, ফলাফল, চুম্বক, পারমানবিক, মুখবন্ধ, হাল সাকিন’ প্রভৃতি কবিতা। দুটি নমুনা :
স্বাধীনতা হীনতায় কখনই বাঁচাতে চাননি কবি। সর্বদাই চেয়েছেন স্বাধীনতা, অফুরান-অফুরন্ত ইচ্ছেশক্তির নিয়ন্ত্রণহীন মুক্তি। কিন্তু সর্বত্রই দেখেছেন নিয়ন্ত্রণ আর নিয়ন্ত্রণ। স্বাধীনতা যখন কবিকে দিতে পারে না কাঙ্ক্ষিত মুক্তি তখন কবির সব অধঃপতন, সব পাপের উৎস হয়ে ওঠে অই অর্থহীন স্বাধীনতা, যার আরেক নাম পরাধীনতা। স্বাধীনতাই তখন কবির পছন্দ- অপছন্দের দয়িতা, সবকিছু :
‘বলো তুমি, বলো
কোন সে অধঃপতনের দিকে
আমি এগিয়ে যাবো
দিগ্বিজয়ীর মতো। ‘
(কোন সে অধঃপতন, পা ও অন্যান্য) এবং
‘তোমার রক্ত দিয়ে ধুয়ে দাও
তোমার একান্ত ভঙ্গিতে ধুয়ে দাও
আমার আজন্ম পাপ।
আমি আসন্ন বিপ্লবের শহীদ মিনার
তোমার রক্ত দিয়ে আমায় পূত পবিত্র করে তোলো।’
(তোমার রক্ত দিয়ে ধুয়ে দাও, পা ও অন্যান্য)
অবশেষে কবি যখন খুঁজে পান, চিহ্নিত করতে পারেন তার কাঙ্ক্ষিত স্বাভাবিক স্বাধীনতার কে হন্তারক, শাসকগোষ্ঠীকে প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে নিষেধের সব সাইনবোর্ড তুলে নেয়ার হুকুম করতে তখন তার আর এতোটুকু বাঁধে না :
‘তুমি কে, কে তুমি এই বাগানের
বলো তুমি কার পাহারাদার, তুমি তো মন আমার মন
এই ফুল ফল তরুলতা জল এ সবই আমার
তবে খুলে ফেলো ঐ দেয়াল থাকে
সাইনবোর্ড ঐ নিষেধের।’
(ফুলতোলা নিষেধ, পা ও অন্যান্য)
কিন্তু সবকিছুর মধ্যেই, সবকিছুর পরেও সাবদার সম্পূর্ণভাবে জানেন একজন কবির গন্তব্য, তার শেষ ও নিরাপদতম আশ্রয় কবিতা :
‘প্রত্যেকটা কবিতাই যেন
এক একটি স্বাধীনতার সনদ।
প্রত্যেকটা কবিতাই যেন
পোস্টারে উৎকীর্ণ
আগ্নেয় ভাষা। ‘
(প্রত্যেকটা কবিতাই যেনো, পা ও অন্যান্য)
(নয়)
প্রকৃত কবির দুটি চোখ থাকে। একটা বাইরের আর একটা ভেতরের। একজন কবি যতদিন লেখায় তরুণ থাকে ততোদিন তাদের বাইরের চোখ সক্রিয়, কাজ করে বেশি। তারপর আস্তে আস্তে খুলে যায়, সক্রিয় হয় তার ভেতরের চোখ। একপর্যায়ে অনেক কবি স্বেচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় বাইরের চোখ হারিয়ে ফেলে হয়ে ওঠে অন্তর্মুখী। সাবদার এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। সাবদারের লেখার সাথে খুব সাবধানে বন্ধুত্ব জমিয়ে তুললে যে কেউ দেখতে পাবেন, অহং এবং অধিশান্তার পর অদসের সাথে বোঝাপড়ার শেষেও তার দুটি চোখই সমান সক্রিয় ছিল। সাবদার সমাজ ও রাজনীতির যৌথ খামার থেকে যখন কবিতার উপাদান সংগ্রহ করেছেন তখন তিনি সেগুলোকে বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দর্শনের তাওয়ায় ছেকে রুটির মতো ফুলিয়ে তুলেছিলেন এমনটা কবিতার কোথাও কোথাও সামান্য দেখা গেলেও সেটি কোনো অবস্হাতেই সামগ্রিক চিত্র নয়। বরং বলা যায়, পূর্বে উল্লেখিত যৌথ খামারের উপাদানসমূহ কৌটায় ভরে বিশেষ প্রক্রিয়ার ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে তীব্র ঝাঁজ আর স্বাদের ঝালমুড়ির মতো খুব সাবধানে, খুব সাধারণভাবে সবচেয়ে সহজ অথচ সবচেয়ে অব্যর্থ, অপরিহার্য শব্দে, বাক্যে কবিতার নির্মাণ পথে পত্র-পল্লবের মতো গেঁথে নিয়েছেন মাত্র।
পূর্বে উল্লেখিত হয়েছে সাবদারের কবিতা কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া প্রধানত ক্ষুদ্র ও ক্ষীণকায় তনুশ্রী। ‘কলকাতা আমি এক তরুণ মহাপুরুষ, হে শহর হে অশ্বারোহী, পুনর্মুদ্রণ, বানো কাপতা, ওয়াকিটকি, খসড়া কবিতা, কবিওয়ালা ‘ ইত্যাদি কবিতাগুলো পরিভাষায় যাকে বলা হয় দীর্ঘকবিতা, অনেকটা তাই।এরসাথে আরেকটু যোগ করা যায় ‘ ক্রুশকাঠহীন যিশু, কবির শোকসভায় ভাষণ, বিনোদিনী চক্ষু হাসপাতাল, বন বিজ্ঞপ্তি’ ইত্যাদি। ব্যাস এটুকুই।
বাংলা ছাড়া অন্যভাষার কবিতাগুলোর দিকে তাকালে দেখতে পাই দীর্ঘকবিতার হাতে হাত রেখে কবিতা নামক সবচেয়ে জীবন ঘনিষ্ঠ শিল্পমাধ্যমটির বিকাশ। দীর্ঘ কলেবর, ভাষাগত কৃষ্টির নান্দনিক বিন্যাস, অধ্যায়গত সুশৃঙ্খলতা, বহুঘটনা ও বহু চরিত্রের সুনিপুণ গাঁথুনি যা মূলসুত্রের সাথে লাটাইয়ের মতো আবদ্ধ ইত্যাদি দীর্ঘ কবিতার গড় বৈশিষ্ট্য। গিলগামেশ পৃথিবীর আদিতম দীর্ঘ কবিতা। এছাড়াও রামায়ণ, মহাভারত, ইলিয়াড, অডিসি, ইনিদ, বিউলফ, ডিভাইন কমেডি, প্রভৃতি মহাকাব্যগুলি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় দীর্ঘ কবিতাও বটে।
রবীন্দ্রনাথ, এলিয়ট, মায়াকোভস্কি, এ্যলেন গিনসবার্গ, সুধীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, শক্তি, সুনীল,শঙ্খের হাতে দীর্ঘ কবিতা নতুনভাবে এগিয়েছে অনেক দূর। তবে পুঁজি ও ভোগের ক্রমবর্ধিত সন্ত্রাস ও বৈষম্যের শিকার হয়ে দীর্ঘ কবিতা সাম্প্রতিক কবিদের কাছ থেকে বিষাদ বিদায়ের পথে। অথচ অধিকাংশ সাহিত্য সংস্কৃতির আলোচক যারা কবিতা নিয়ে কথা বলার অধিকার ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন তাদের মতে কবির মূল যোগ্যতার পরিচায়ক হচ্ছে, ‘কনস্ট্যান্ট পোয়েটিক এ্যপ্রোচ’। লেখা বাহুল্য এই কনস্ট্যান্ট পোয়েটিক এ্যপ্রোচই দীর্ঘ কবিতার প্রাণ। সেইদিন দিয়ে দীর্ঘ কবিতা হতে পারে একজন কবির কবিত্বশক্তি পরিমাপের অপেক্ষাকৃত কম বিতর্কিত মাপকাঠি।
সাবদারের দীর্ঘ কবিতার কোনো পাণ্ডুলিপি খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। যে দ্রুততার সাথে তিনি ছোট কবিতাগুলো রচনা করতে সক্ষম ছিলেন দীর্ঘ কবিতার ক্ষেত্রে সম্ভবত তেমনটা করেননি।কেনো একথা বলছি সে প্রসঙ্গে পরে আসছি । অথচ সাবদার যে যত্নের সাথে তার কবিতার পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণ করতেন এমনটাও নয়। তাহলে কেন ব্যতিক্রম এইসব দীর্ঘ কবিতার ক্ষেত্রে ? সাবদার কি বিশেষ কোনো মমত্ব বা যন্ত্রনাবোধ অনুভব করতেন এই কবিতাগুলো নিয়ে ?
দীর্ঘ কবিতাগুলোতে সাবদার বার বার ইতিহাসের উজ্জ্বল-অনুজ্জ্বল পাতাগুলো উল্টেপাল্টে দেখার চেষ্টা করেছেন। ইংরেজ শাসন, ভারত ভাগ,দাঙ্গার মতো ঘটনাগুলো রাজনীতি নিশ্চয়ই কিন্তু এর সুফল-কুফল কী কেবল রাজনীতির হাটে-মাঠে-বাটে সীমিত ও সীমাবদ্ধ থেকেছে ? এইসব ঘটনাবলী কি আমাদের সামাজিক সাংস্কৃতিক বোধ ও বিশ্বাসের জায়গাগুলোকে একবারের জন্য হলেও নাড়িয়ে দেয়নি, কিংবা সে সমস্তকে টেনে নিয়ে যায়নি কখনো আলো কখনো অন্ধকারের বৃত্তে। সাবদার আপাদ মস্তক রাজনীতির কবি হলে এইসব সঙ্গতি-অসঙ্গতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নিশ্চয়ই পাবলো নেরুদা, মায়াকোভস্কি, ভাৎসারোভ কিংবা আরো অন্যদের মতো বিপ্লবের ডাক দিতেন। সাবদার তার কবিতায় এমন করে কোনো বিপ্লবের বানী উচ্চারণ করেননি।
কবি সম্পাদক স ম তুহিন সাবদারকে ‘একজন আপাদমস্তক মার্কসিস্ট কবি’ হিসাবে দেখতে চেয়েছেন। কিন্তু একজন প্রকৃত মার্কসিস্ট কখনই ভুল রাজনীতির শিকারে পরিনত হতে পারে না। অথচ সাবদার হয়েছিলেন। কিছু সময়ের জন্য হলেও তিনি জাসদ ছাত্রলীগের নিবেদিত প্রাণ কর্মী ছিলেন। অবশ্য ঐ একই লেখায় তিনি (স ম তুহিন)সাবদারের ভিতরে ‘একজন বোহেমিয়ান কবির প্রতিচ্ছবির বদলে একজন আলটিমেট বুদ্ধিজীবীর’ বুদ্ধিদীপ্ত কথার ইশারা -ইঙ্গিত খুঁজে পেয়েছেন। আমি এই জায়গাটাতেই বিশেষভাবে নজর দিতে অনুরোধ জানাই।
কারণ আপাদমস্তক রাজনীতি অথবা দায়বদ্ধ মার্কসিস্টের কাছে কোনো অবস্হাতেই একজন আলটিমেট বুদ্ধিজীবীর প্রজ্ঞা, সহিষ্ণুতা, সাহস, গঠনমূলক শক্তি ইত্যাদি আশা করা যায় না। সাবদারের কবিতার সেটি যায়। কারণ সুন্দর মানুষের জন্য, সুন্দর সমাজের জন্য, সুন্দর সকল কিছু বিশেষ করে কল্যাণ রাষ্ট্রের জন্য সাবদারের মনোজগতে যে আকুতি ছিল তারই ধারাবাহিক প্রতিচ্ছবি সাবদারের দীর্ঘ কবিতাগুলো।
এখন আমারা সাবদারের দীর্ঘ কবিতায় কিছু সময়ের জন্য পরিভ্রমণ করবো। দৈবচয়ন পদ্ধতির মতো কিছু একটা করে প্রথমে বেছে নেবো, ‘কলকাতা/ আমি এক তরুণ মহাপুরুষ’ শীর্ষক কবিতাটি। গোলাম মাওলার ঔরসে জন্ম নেয়া একজন মানব শিশুর বেড়ে ওঠা ইতিহাসের সাথে মাথে কলিকাতা নামক প্রায় তিন ‘শ বছরের এক নগর সভ্যতার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বদলগুলো আলোচ্যে কবিতায় উঠে এসেছে। কবিতার শরীর নির্মিত হয়েছে ঊনআশি লাইনে, তিনশো শব্দে। সর্বনিন্ম একটি শব্দ এবং সর্বোচ্চ ছয়টি শব্দের মধ্যে প্রতিটি পংক্তি সীমাবদ্ধ। কলকাতা কবির কাছে খুব প্রিয়, আপনার জনের মতো, তাই তার সাথে জন্মমুহূর্তের কথোপকথন :
‘কলকাতা তোমার মনে নেই ? মনে নেই ?
পঞ্চাশের কলকাতা ?
দাঙ্গামথিত শহরের বাতাসে ধ্বনিত
বিবেকের মতো তোমার আমার জন্ম চিৎকার ?
কিংবা ‘৬৪ দাঙ্গামথিত শহরের
নগ্নভগ্ন মৌলালীর উলঙ্গ দরগাহ
অথবা
রাজপথে নিঃসঙ্গ সুনীল ভগ্ন শঙ্খের
নিঃশব্দ নিনাদ ‘
একজন যিশুর মতো সমস্ত কলকাতার রুপ-রস-বর্ণ, গন্ধের উপর একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করার অভিপ্রায়ে কিশোর বয়সে মায়ের ডাক পিছনে ফেলে রাজপথে নেমে আসার পর তার স্বপ্নভঙ্গ :
‘তখন কলকাতা
জবচার্ণকের নয়
রবীন্দ্রনাথের নয
তখন কলকাতা মানে আগুন’
কিন্তু গান্ধী, সুভাষ, বিবেকানন্দের উজ্জ্বল উপস্থিতির পরও অনাচার, অবিচার,ধর্মের নামে ধর্মহীনতা,খুন সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক সংস্কৃতির দর্শনহীনতার কারনে তার কলকাতা যখন ‘সন্ন্যাসীর লিঙ্গের মতো নিস্পৃহ’ তখন তার চেনা কলকাতাকে রক্তহীন,পুষ্টিহীন মনে হলেও সংঘহীন কবি কলকাতার সাথে কলকাতার জন্য কাঁদতে থাকেন, কাঁদতে কাঁদতে ব্যবহার
অসমর্থ অস্ত্রের অস্তিত্বের পরও নিঃসঙ্গ হয়ে যান :
‘কলকাতা আমি এক তরুণ মহাপুরুষ
কৃষ্ণের বাঁশির মতো আমার হাতে
কৃষ্ণ পাইপগান, পকেটে ‘পেটো’
বুক পকেটে চিৎকার নিয়ে
তোমার যাদুঘরে সংরক্ষিত মমির মতো
বড়ই নিঃসঙ্গ আমি আজ।’
কবিকে ক্ষেত্রবিশেষে গুরুদেব, বিপ্লবী, সমাজসেবক, সমাজসংস্কারক, রাজনৈতিক পদ-পদবির অাধিকারিক হতে হলেও একজন কবি মূলত ইতিহাসের নিরপেক্ষ কথক, চলচ্চিত্রকার। তাই আসন্ন যুগচিহ্ন যেমন ভূগর্ভে প্রবাহিত লৌহশব্দ নদী, ডেলি প্যাসেঞ্জারের মুষ্টিবদ্ধ হাত, কেরানির রুটি আলুভাজি, টিয়ারগ্যাস ইত্যাদি শেষপর্যন্ত সাবদারের কাছে প্রধান হয়ে ওঠে। এখানেই কবিতাটির অনন্যতা।
আমার পরবর্তী গন্তব্য সাবদারের তিনটি দীর্ঘ কবিতার দশাবস্হা । আমরা ইতিমধ্যে জেনেছি সাবদার প্রচলিত জীবনচর্চা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন, কিন্তু প্রচলিত কাব্যধারা থেকে কি ? একটি তথ্য জানিয়ে রাখি সাবদারের দীর্ঘ কবিতাগুলো রচিত হয়েছিল মূলত গত শতকের সত্তর ও আশির দশকের প্রথম দিকের কাছাকাছি সময়ে। সত্তর দশকের সমাজ ও রাজনীতিচেতন ধারাটির প্রধান লেখকরা দীর্ঘ কবিতা লিখতে অভ্যস্ত ছিলেন। সাবদার তার দীর্ঘ কবিতাগুলো যখন লেখেন তখন এই ধারার প্রভাব একেবারেই কাটিয়ে ওঠা ছিল তার পক্ষে অসম্ভব।
মালার্মের মতে, ক্রাইসিসই কবিতার জনক। মার্কসবাদের চরমরূপ নকশালবাড়ি আন্দোলনের ব্যর্থ সমাপ্তি, কর্মসূচিহীন বামজোটের ক্ষমতা গ্রহণ, এবং এর ফলে সৃষ্ট যন্ত্রণা ছিল পশ্চিম বাংলার সাহিত্যের অন্যতম প্রধান ক্রাইসিস। বাংলাদেশে এই ক্রাইসিসের স্বরূপ তৈরি হয়েছিল দীর্ঘ পঁচিশ বছরের জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম ও রক্তঝরা সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত সদ্য স্বাধীন দেশে, সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন ও বহুমাত্রিক ষড়যন্ত্রের শিকার রাষ্ট্রযন্ত্র, রাষ্ট্রনায়কের নায়কোচিত ভাবমূর্তির পতন, আদর্শ ও আদর্শহীনতার সহাবস্থানের বিকল্প পাঠ গ্রহণ ইত্যাদি কারণে। বোধগম্য কারণে, সাবদার যে এই দু’ ধরনের ক্রাইসিসের সম্মুখীন হয়েছিলেন এবং তাকে অতিক্রমে সাধ্যের অতিরিক্ত চেষ্টাও করেছিলেন, তা লেখা বাহুল্য হলেও একজন ব্যক্তি সাবদার অথবা একজন কবি সাবদারের জন্য বিষয়টি ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ।
কবিতায় সাবদার সর্বদাই নিচুস্বরে কথা বলতে ভালোবাসতেন।যাপনের অপূর্ণতার কথা সচারাচর উচ্চস্বরে বলাটা স্বাভাবিক হলেও সাবদার খুব সযত্নে সেটি পরিহার করেছিলেন। এই পরিহারের সম্ভাব্য কারণ আমরা খুঁজে পাবো জয়ের কাছে, জয়ের একটি চিঠি থেকে। জয়ের চিঠির অংশবিশেষ :
‘আজ আমার খুবই মনে হয় যে সব কবিতাই প্রতিবাদের কবিতা। একজন লোক যখন একেবারে একটা লিরিক কবিতা লিখল, প্রেমের কবিতা লিখল, তখন সে প্রতিবাদই করল, কেননা সে এই নষ্ট সামাজিক অন্যায়গুলোকে ভ্রূক্ষেপমাত্র না করে সুর পাগল গান শোনাতে চাইল। ধুয়ে দিতে চাইল অশ্রুবাষ্পের আলোয় সব পথ। আবার একজন হয়তো কথা বললো মহাসময় নিয়ে, কথা বললো আদিজন আদিরাত্রিকে নিয়ে– ফিরে যেতে চাইলো গভীরতম শূন্যের ভিতর । সেই প্রথম বিস্ফোরণে, যে বিন্দু থেকে তারকাজগৎ শুরু হল, শুরু হলো, এমনকি সময় অথবা পৃথিবীব্যাপী মহাজন থেকে জেগে উঠলো প্রাণীজগৎ– হয়তো সে স্পর্শ করতে চাইল এইসব মুহূর্তগুলি, কিন্তু তখনও সে প্রতিবাদই করল’– হাঁ আমরা স্বীকার করি আর নাই করি এটাও তো প্রতিবাদের একটা পদ্ধতি। সাবদার এটাই পছন্দ করেছিলেন, আর করবেন নাই বা কেনো , আমি ইতিপূর্বে সাবদারের মনোজগতের যে চিত্র তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছি সেখানে তো এটিই সবচেয়ে অব্যর্থ, অপরিহার্য বিবেচিত হওয়াই স্বাভাবিক।
সাবদারের আরো তিনটি দীর্ঘ কবিতা — পুনর্মুদ্রণ, ওয়াকিটকি, খসড়া কবিতা, এবার আমাদের আলোচ্য বিষয়ঃ’পুনর্মুদ্রণ’ যতটা না রাজনীতির কবিতা তার চেয়ে বেশি সংকটের। এই সংকট শুধু যে সামাজিক বা রাজনৈতিক তা কিন্তু নয় কিছুটা ব্যক্তিকেন্দ্রিকও। সাবদার যেভাবে দেখছেন সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি, নীতি ও নৈতিকতা, এমনকি যেভাবে লেখা হচ্ছে কবিতা, যেভাবে করা হচ্ছে প্রতিবাদ, প্রতিবাদের সেই চিরাচরিত ভাষা কোনোটাই সাবদারের কাছে গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না :
‘চন্দন, এখন এখানে তেমন কবিতা
লিখছে না আজকাল
চঞ্চল কিছু কিলবিল শব্দের কুটিল
কুটিরশিল্প কবিতা এখন’
‘চন্দন মাইরি,
যৌবন ডায়েরি কেউ লেখে না তেমন
সেরকম সবাই দ্রুত ধুয়ে নিচ্ছে লণ্ড্রীতে মুখোশ
ঘাতক মুছছে হাত নারী আঁচলে’
সাবদার শহরের সভ্যতাকে লৌহ সংস্কৃতির সভ্যতা মনে করেন। তিনি নিজেও ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় সেই সভ্যতারই মধ্যে বেড়ে উঠেছেন। কিন্তু অন্যদের মতো নন। তাই তার ক্ষোভ :
‘শুধু হাই তুলে তুড়ি মেরে
হামাগুড়ি কাটিয়ে দিচ্ছে কাল
লৌহসংস্কৃতির ক্রীতদাসেরা
শৃঙ্খলিত এরা মাংসে মজ্জায়
মুখোশজীবি এক নির্বাক সম্প্রদায়
রাষ্ট্রীয় পরিবহনে প্রত্যহ ফিরে যায়
নির্দ্ধারিত সিমেন্ট কৌটায়, মমি শয্যায়।’
সাবদারের আরো ক্ষোভ, কেননা যারা কথা বলেন, তারা সবসময় সত্য আড়াল করে বলেন আর সত্য আড়ালে থাকে বলে ক্ষমতার কেন্দ্রগুলোর কাছে তাদের কথাগুলোই বাক স্বাধীনতার তকমা পায়, পায় ফুল-হাততালি :
‘ঘাতক হাতে রঞ্জিত ইতিহাস দেখে
লেখে না কেনো কেউ
কেবলই উড়তে থাকে প্লাকার্ড ফানুস
খঞ্জ ভিখারীর করুণ ব্যাগপাইপ থাকে
বাজতে ময়দানে নেতার থুথুমাখা
মাউথপিসে বিভিন্ন রসায়ন
বাক-স্বাধীনতা পায় যুগপৎ ফুল ও লাল হাততালি’
এই যে সংকট তা যে কেবল দেশজ নয়, এর রয়েছে এক বিরাট বহু/আন্তর্জাতিক নেটওয়র্ক তাও কবির অজানা নয, সেই অনুভব :
‘আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপনযন্ত্রের বিরুদ্ধে
অস্থিমজ্জালিঙ্গপা আমাদের এই জন্ম
জননতন্ত্র প্রজনন অথচ লিখল না কেউ
এক স্ফিংকস স্হবির তন্দ্রা নীরবতা এখানে অগ্নিকোন
এমনকি গাছ-নিঃশ্বাস শোনা যায় তা নিয়ে
লিখলো না কেউ’
শোভন কোনোকিছু নেই। তবু স্বপ্ন পুনর্মুদ্রিত হয় বারবার :
‘ফুলের দোকানে
বাগানে ফুল নাই–
রক্তব্যাঙ্ক রক্তহীন, রক্ত চাই–
চক্ষু ব্যাঙ্ক, চক্ষুহীন, চোখ নাই। চোখ গেল
স্বপ্ন দেখতে দেখতে নষ্ট হচ্ছে চোখ, চাই চোখ।’
মানুষ কেবল আবহাওয়া সৌর বেলুন
(ওয়াকিটকি, সাবদার সিদ্দিকীর কবিতা সংগ্রহ )
কবি কী বিপ্লবী, কবি কী যোদ্ধা, কবি কী কমরেড, যদি বন্ধুত্বের কথাই তুলতে হয় তবে প্রশ্ন কে প্রকৃত বন্ধু , কার সাথে বন্ধুত্ব ইত্যাদি। সতত পরিবর্তনশীলতা কী মানুষের ধর্ম, একমাত্র ধর্ম।এইসবের মধ্যে কবির একমাত্র কাম্য-ধর্ম কী হতে পারে ?
সাবদারের পছন্দ, স্বাধীনতা। ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা, বাক ও লেখার স্বাধীনতা। কবি তাকেই কমরেড জানেন যিনি সত্যিকার অর্থে পরাধীনতাকে ঘৃণা করেন। তবে প্রশ্ন, কবি যাকে কমরেড জানেন কী তার রাজনীতি ? আনুগত্যে যিনি বিশ্বাসী, তিনি যতো কথার মানুষ হোক না কেনো তিনি কী কবির নিকটজন হতে পারে, হতে পারে কমরেড, হতে পারে বন্ধু ? সাবদার স্পষ্টই বলেন তিনিই কমরেড যিনি প্রথমত স্বাধীনতাকামী এবং শেষ পর্যন্ত তাই। বন্ধুত্ব নির্বাচনের সূত্র কবিতার একেবারে শেষ অংশে :
‘আমি তো ক্রীতদাস নই, চাই স্বাধীনতা
কেবলই চাই, চাই।
না রাষ্ট্র, না নেতা, না জনতা, না অস্ত্র
দেবে, চাইব কার কাছে স্বাধীনতা ?
জানি না কি তোমাদের মানুষের
ব্যবধান বারুদের, ক্রীতদাস নই তাই
কেবলই চাই স্বাধীনতা, ‘
(ওয়াকিটকি, প্রাগুক্ত)
সাবদারের সাথে রাজনীতির সম্পর্ক যে অতি দূরবর্তী তার শ্রেষ্ঠতম প্রমান আলোচ্য কবিতা। কেননা রাজনীতি মানেই সংঘ, রাজনীতি মানে মতবাদ, রাজনীতি মানেই কারো না কারো আনুগত্য। কবি এবং কবির ভিতরের স্বপ্নসৈনিক যিনি তখনো অদসের পাহারায় নিরাপদ, যাকে তিনি কমরেড হিসেবে আলোচ্য কবিতায় দেখাতে চেয়েছেন, যাকে রাষ্ট্রীয় মহাসড়ক পরিবহন উগরে দিল নামহীন উপশহর থেকে অচেনা শহরে তিনি এসবের কোনোটির মধ্যে নেই, আর নেই বলে :
‘ইতিমধ্যে সচল অবাক সবাক গ্রাহকযন্ত্রে টরেটক্কা
তুখোড় একক হকার চীৎকার সংবাদে বিস্ফোরিত
সময় বোমা, গোয়েন্দা সন্দেহে কবিকে জনৈক
পিটিয়ে করেছে হত্যা মুর্খ কয়েকজন গণআদালত
ভাসমান জনতার।’
(ওয়াকিটকি, প্রাগুক্ত)
তারপর, অদসের পাহারামুক্ত কবি, কমরেড কিছুক্ষণ স্বপ্ন দেখেন বিপ্লবেরঃ
‘দেশলাই ছাড়া কোন বাক ব্যক্তি সম্পত্তি নেই
তুলে নিই তাই
কলম কিংবা কারবাইন
রুটির বদলে বারুদ কিংবা কৃষ্ণঘর্মাক্ত কলম বল্লম।’
(ওয়াকিটকি, প্রাগুক্ত)
কিন্তু তারপর আবার মাইল স্টোন রূপকে অদস প্রাচীরমধ্যে আশ্রয় :
‘কমরেড কণ্ঠস্বর দৃঢ় স্পষ্ট থেকে অস্পষ্ট হলে
গোপন বেতার কেন্দ্রের মতো ইথারে ধ্বনি প্রতিধ্বনিত
জিহ্বাউদ্ভূত ধ্বনি তার বাণী রূপ পেল
মুদ্রিত নিউজপ্রিন্টে, কাগজে- মগজে
মাইল স্টোন হাঁটতে থাকলো এক পা দুপা।’
(ওয়াকিটকি, প্রাগুক্ত)
সবকিছু অচেনা হয়ে ওঠার পর সেই প্রশ্ন, যেমন নতুন জন্মের পর শিশু তার মায়ের কাছে জানতে চায় :
‘রাস্তায় বাংকারে তরুণ ব্লাডগ্রুপ
দোদুল্যমান সূর্য সৌর ঘড়ি পেন্ডুলাম
এলাম কোথায় আমরা এলাম ?’
(ওয়াকিটকি, প্রাগুক্ত)
সাবদার এভাবেই হেঁটে হেঁটে যেতে থাকেন দার্শনিকতার সর্বশেষ ও সর্বোচ্চ স্তরে।
সাবদারের কবিতা সামাজিক, রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক বাস্তবতায় কালিক প্রেক্ষাপটকে ধারণ করেও একদিকে যেমন কালোত্তীর্ণ অন্যদিকে সমাজ, রাজনীতি, ইতিহাস ঘেষা হয়েও ব্যক্তির আশাভঙ্গ ও প্রহসনের অনবদ্য চিত্র। তবে সর্বত্রই তিনি কথা বলেন তার মতো করে, শমিত-প্রমিত উচ্চারণে। কখনই নিজের তৈরী শিল্পরৃদ্ধির সীমা অতিক্রম করেন না। সাবদারের প্রত্যেকটি কবিতাই যে তার সত্ত্বার অনুঘটক এবং সজ্ঞা সঞ্জাত তা খুব স্পষ্ট করে বোঝা যায়।
একথা বললে অত্যুক্তি হবে না সাবদার তার কবিতার জন্য যে কাব্যভাষায় স্ব প্রনোদিত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছিলেন তা মূলত শামসুর রাহমান প্রস্তুতকৃত। শামসুর রাহমানের মতোই নাগরিক চৈতন্য তার উপর প্রভাব ফেলেছিল। তবে শামসুর রাহমান যেখানে রাজনৈতিক উপাদানগুলো দেশজ প্রেক্ষাপটে গ্রহণ করেছিলেন, এবং গ্রহণ-বর্জন, তর্ক- বিতর্ক শেষে তার কবিতার অপরিহার্য বিষয় করে তুলেছিলেন সাবদার সেখানে রাজনীতিকে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে স্হাপন করে কার্যসিদ্ধি করতে চেয়েছেন। বলা চলে এ ব্যাপারে তিনি চমৎকারভাবে সফলও।
প্রত্যাশা, স্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গের নতুন চরিত্রের আল্পনাই সাবদারের কবিতা। শ্রেণিসাম্যের প্রতিষ্ঠার চেয়ে জাতিগত বৈষম্যের (প্রধানত অর্থনৈতিক) বিরুদ্ধেই ছিল তার আস্থা তার কবিতার প্রকাশ :
‘এখানে কি চাই তোমার, এখানে কি কাজ
মেডিন জাপান সভ্যতা
দ্রুততম টয়োটার পিছে দ্রুতগামী মিতসুবিশি
পিছনে ফক্সওয়াগান আর ফোর্ড ডিজেল ট্রানজিট
ভিলাই ইস্পাত ভেল্কি
ঠা ঠা কুট বৈশ্যহাসি টা টা ট্রাক
নিয়ন্ত্রিত অন্ধকার শীতাতপে টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি ফক্স।’
(খসড়া কবিতা, কবিতা সংগ্রহ /মান্নান সৈয়দ সম্পাদিত)
এভাবে তিনি প্রবেশ করেন সমস্যা সংকটের মুহূর্তে, আর দেখতে পান ঔপনিবেশবাদের নতুন নিশান সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের কাছে জীবনের মূল্য নিতান্তই তুচ্ছ :
‘তোমার মূল্যবান জীবনের চেয়েও চঞ্চল পেট্রোল-এ্যালকোহল।
রঙিন আন্ডারওয়্যার ট্রাউজার, ছেড়া কাচুলি
রাবারের পাহাড় ছেড়া ব্রেসিয়ার
সুগন্ধি পাউডার ?’
(খসড়া কবিতা, প্রাগুক্ত)
কবি জানেন সাম্রাজ্য সম্প্রসারণের অভিপ্রায় যাদের তারা দেশ মহাদেশ মানে না, এবং সাম্রাজ্যবাদ কখনই একা নয়, দেশজ সুবিধাবাদীরাও নিজ নিজ স্বার্থ উদ্ধারে সাম্রাজ্যবাদীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতে তৎপর :
১.
‘জান না কি নিউটন মানে না দেশ মহাদেশ
কন্টকিত আকাশ ভূসীমানা।
এখানে এসো না, না
তোমার হাতে দাতে লেগে আছে
সবুজ মাংস শস্য কনা।’
(খসড়া কবিতা, প্রাগুক্ত)
২.
‘ঘুরছে বনবন রাজনীতি হুইল চেয়ার
মসলিন রক্তকরবীর তন্তুবায় সম্প্রদায়
আমলা সংস্কৃতি, ভোজবাজি বারোভাজা
মিশ্র অর্থনীতি
রঙিন টিভি টিউবে কূট করমর্দন দোলায় ‘
(খসড়া কবিতা, প্রাগুক্ত)
কবি পাখি,মাছ প্রভৃতির কাছ থেকে শিক্ষা নিতে চান, এবং অস্বীকার করতে চান সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদের যাবতীয় নয়া কৌশল, তাদের শক্তি এবং সব কর্মযজ্ঞ। সাবদারের কবিতার এখানে আমরা ব্যতিক্রমী ব্যাপার-স্যাপার দেখতে পাই। স্বভাব বিরুদ্ধ হলেও এখানে তিনি সংঘের আসন্নবর্তী শক্তির প্রতি আস্হা রাখতে চান। আর এখানেই কবিতাটির নতুনত্ব :
‘স্টক এক্সচেঞ্জের নির্বোধ সংখ্যাতত্ত্ব, ভিক্ষুকের ডেমোগ্রাফি
মুদ্রাস্ফীতির ন্যাশনাল প্যানাসনিক ব্যুরো
টেকনোক্রাটিক ক্লিক নিঃশেষিত ফিল্মের সেন্টিমিটার
লেন্সে লোরেন মনরো লাস্য লেন্সে হাসিরেখা
বিজ্ঞান পৃথিবীর ধূলিপরমানু নুড়ি নক্ষত্র কণা
এখনো কিছুই জানে না জানো না সৌর ব্যুরো টেকনোক্রাটিক
ক্লিক প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির রবোট বৈজ্ঞানিক।’
(খসড়া কবিতা, প্রাগুক্ত)
(দশ)
স্টিফেন জে ব্রাউনের মতে চিত্রকল্পই কবিতার প্রাণ।অন্তত সাম্প্রতিক কবিতার ক্ষেত্রে চিত্রকল্প যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক, রবীন্দ্রনাথের পরে যাকে বাংলা ভাষায় সবচেয়ে প্রভাবশালী কবি মনে করা হয় সেই জীবনানন্দই তার সবচেয়ে মোক্ষম উদাহরণ। চিত্রকল্প কখনো কখনো কবিতার প্রাথমিক রঞ্জক হিসেবেও কাজ করে এমনটা এমনটাই আমাদের জানিয়েছিলেন উইন্ডহ্যাম লুইস। একজন কবির সবচেয়ে নির্ভরশীল সংবেদনশীলতা ধারনের পক্ষে চিত্রকল্প কতখানি শক্তিধর অস্ত্রের কাজ করতে পারে সেটি দেখিয়েছেন কবি এজরা পাউন্ড, যিনি অসম্ভব বড় মাপের কবি ও কবিতার শিক্ষক হওয়ার পরও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে তার কৃতকর্মের জন্য নিন্দিত এবং পরবর্তী দীর্ঘসময়ের জন্য বাধ্যতামূলক সংশোধনালয় ছিল তার আবাসস্থল।সাবদারের কবিতায আমরা এমন অনেক চিত্রকল্পের দেখা পাই যা কখনো কখনো কবিতার প্রাথমিক রঞ্জক হয়েও অসাধারণ অর্থ বহন করে :
১.
হাওড়া ব্রীজ যেন লোহার ব্রেসিয়ার তোমার
কলকাতা যন্ত্রের সমান বয়সী তুমি
২.
আমার কিশোর কলকাতা
সন্ন্যাসীর লিঙ্গের মতো নিস্পৃহ তুমি আজ
আবার কখনো কখনো একটি চিত্রকল্প একটা সম্পূর্ণ সম্পর্কের ইঙ্গিত করেঃ
১.
একজন পুলিশ একটি রাষ্ট্র।
২.
কাক সাম্রাজ্যবাদ মূলত জ্ঞাতি ভাই।
৩.
মাও সেই লোকটা
কয়েক ঘন মিটার অন্ধকারে
মাও সেই লোকটা
কয়েক বর্গ মিটার কাষ্ঠ অন্ধকারে
(এগার)
‘রাজনৈতিক আশ্রয়ের মনস্কামনা জানাই
নইলে চাঁদের সাথে চলবে তুমুল লড়াই
আজীবন মুক্তিযুদ্ধ রত আমি ক্ষতক্লান্ত এক রক্তের সমুদ্রে
সাহসী নাবিক এক সশস্ত্র দৈনিক ধারিনা কিছুর ধার
পদক স্মারক প্রমাণপত্র উপহার ভাতার কিংবা শহীদ মিনার
মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ সংসদ সদস্য আজীবন
মাটির মুকুট এ আমার মাটির সিংহাসন
কল্যাণ প্রশাসন ঐ
চাই ঐ চাঁদের সিংহাসন।’
(কবিওয়ালা, অগ্রন্থিত কবিতা,সাবদার সিদ্দিকী)
জ্ঞানী সক্রেটিস প্রায় চার হাজার বছর আগে বলেছিলেন, ‘নিজেকে জানো’।নিজেকে জানার চেষ্টায় সাবদার কবিতা লিখেছেন, ক্রমাগত নিজের বেশভূষার পরিবর্তন জরুরি মনে করেছেন। শার্ট-প্যান্ট বা শার্ট-পাজ্ঞাবির আধুনিক সাবদার মোটা তোষক কাপড়ে মুড়ি দিয়ে উত্তরাধুনিক সাবদার পরিবর্তিত হয়ে খুঁজে পেয়েছেন স্বস্তি, শান্তি। একদা তার মনে হয়েছিল তার জন্য অপেক্ষায় জেগে থাকবে একটি শহর, সেই শহর বিষন্ন হলেও নতুন ব্লেডের মতো তা ঝকমকে।তার আগমনে কম্পাস কাঁটার মতো সে শহর কাঁপতে থাকবে তারই শাসনের, তারই দাসত্বের অপেক্ষায়। অথচ যখন তিনি অনুভব করতে শিখলেন তিনি নন ট্রাফিক দীপপুঞ্জ থেকে অন্য শক্তির নিয়ন্ত্রণে থেমে যায় তার প্রিয় শহর তখন একজন ক্রুশকাঠহীন যিশুর মতোই তার সুন্দরতম প্রতিবাদ, আত্মসমর্পণ-বিষন্ন-বিনয় :
‘হে শহর হে অশ্বারোহী
গুপ্ত ঘাতকের ধারালো চকচকে
চোখের চারিদিকে বেড়ে ওঠা
হে শহর, আমি তো এসেছি
এই তো এই আমি।’


শুভ্র আহমেদ
জন্ম : ০৩ অক্টোবর ১৯৬৬
প্রকাশিত বই
কার্নিশে শাল্মলী তরু : কবিতা : ১৯৯৯, আড্ডা
বিচিত পাঠ : প্রবন্ধ : ২০১৪, ম্যানগ্রোভ
বলা যাবে ভালোবেসেছি : কবিতা : ২০১৫, ম্যানগ্রোভ
দুই ফর্মায় প্রেম ও অন্যান্য কবিতা : কবিতা : ২০১৬, ম্যানগ্রোভ
রবীন্দ্রনাথ যেভাবে বাঁশি বাজিয়েছেন এবং অন্যান্য : প্রবন্ধ : ২০১৯, ম্যানগ্রোভ
পুরস্কার / সম্মাননা
কবিতাকুঞ্জ সম্ম্ননা (১৪০৮ ব)
বিজয় সাহিত্য পুরস্কার (২০০৯)
কবি শামসুর রাহমান পদক (২০১০)
দৈনিক কালের কণ্ঠ শিক্ষক সম্মাননা (২০১২)
কবি সিকানদার আবু জাফর স্বর্পদক (২০১৪)

লেখকের আরও লেখা
আনন্দ পাঠে প্রেম প্রকৃতি : দিলরুবার কবিতা- শুভ্র আহমেদ
игровые автоматы cat casino
игровые автоматы cat casino
казино чемпион играть на деньги
казино чемпион играть на деньги
играть кэт казино
играть кэт казино
mexican mail order pharmacies mexican online pharmacy medicine in mexico pharmacies
canadian online drugs: accredited canadian pharmacy – cheapest pharmacy canada
казино чемпион играть бесплатно
казино чемпион играть бесплатно
cool cat casino
https://t.me/s/cool_cat_casinoo
http://ordermedicationonline.pro/# pharmacy canada
canadian prescription drugs online: online pharmacy usa – recommended canadian online pharmacies
казино чемпион играть
казино чемпион играть
cool cat casino no deposit bonus
https://t.me/s/cool_cat_casino_no_deposit_bonus
cool cat casino no deposit
https://t.me/s/cool_cat_casino_no_deposit
казино чемпион официальный сайт лицензионный скачать бесплатно
казино чемпион официальный сайт лицензионный скачать бесплатно
кэт казино зеркало на сегодня
https://t.me/s/cat_kazino_zerkalo_na_segodnia
казино чемпион бонусы
https://t.me/s/kazino_chempion_bonusy
Thanks a lot! Excellent information!
1win app download 1win телеграм бк 1win официальный
кэт казино зеркало
кэт казино зеркало
казино чемпион бонус
https://t.me/s/kazino_chempion_bonus
кэт казино вход
кэт казино вход
Cheers. I like this.
1win бесплатная ставка https://1winoficialnyj.website/ 1win зеркало сейчас
approved canadian pharmacies: Top mail order pharmacies – canadiandrugstore.com
казино чемпион бездепозитный бонус
казино чемпион бездепозитный бонус
кэт казино регистрация
https://t.me/s/cat_kazino_registracija
mexican pharmacy: buy prescription drugs online without doctor – buying prescription drugs canada
кэт казино онлайн
https://t.me/s/cat_kazino_online
казино чемпион бесплатно
казино чемпион бесплатно
https://ordermedicationonline.pro/# canadian medications
cat casino промокод
cat casino промокод
казино чемпион
https://t.me/s/kazino_chempi0n
cat casino зеркало
cat casino зеркало
казино кэт зеркало
казино кэт зеркало
mexican border pharmacies shipping to usa mexican medicine mexico pharmacies prescription drugs
казино чемпион вход
казино чемпион вход
cat casino зеркало на сегодня
https://t.me/s/cat_Casino_zerkalo_na_segodnia
With thanks. Excellent information.
aviator 1win скачать приложение 1win 1win côte d’ivoire
интернет казино чемпион
https://t.me/s/internet_kazino_chempion
cat casino зеркало 2022
https://t.me/s/cat_casino_zerkalo_2022
online pharmacy no perscription: legal drugs buy online – buy online prescription drugs
игры чемпион казино
игры чемпион казино
cat casino зарегистрироваться
cat casino зарегистрироваться
best online pharmacies: order medication online – cheap rx drugs
cat casino вход
https://t.me/s/cat_casino_whod
http://indiapharmacy.site/# india pharmacy mail order
50 фриспинов за регистрацию в казино чемпион
50 фриспинов за регистрацию в казино чемпион
Transportation of Pets around the world
cat casino войти
https://t.me/s/cat_casino_vojti
Thank you! A good amount of posts!
1win logo 1win зеркало рабочее что такое ваучер в 1win
чемпион казино зеркало
https://t.me/s/chempion_kazino_zerkalo
Regards. I appreciate this!
1win vs forze https://1winregistracija.online/ официальный сайт 1win зеркало
кэт казино войти
кэт казино войти
кэт казино телеграм
кэт казино телеграм
http://clomid.club/# can i order cheap clomid prices
cat casino скачать
cat casino скачать
paxlovid generic: paxlovid club – paxlovid price
Cel mai bun site pentru lucrari de licenta si locul unde poti gasii cel mai bun redactor specializat in redactare lucrare de licenta la comanda fara plagiat
Medicine course
Mount Kenya University (MKU) is a Chartered MKU and ISO 9001:2015 Quality Management Systems certified University committed to offering holistic education. MKU has embraced the internationalization agenda of higher education. The University, a research institution dedicated to the generation, dissemination and preservation of knowledge; with 8 regional campuses and 6 Open, Distance and E-Learning (ODEL) Centres; is one of the most culturally diverse universities operating in East Africa and beyond. The University Main campus is located in Thika town, Kenya with other Campuses in Nairobi, Parklands, Mombasa, Nakuru, Eldoret, Meru, and Kigali, Rwanda. The University has ODeL Centres located in Malindi, Kisumu, Kitale, Kakamega, Kisii and Kericho and country offices in Kampala in Uganda, Bujumbura in Burundi, Hargeisa in Somaliland and Garowe in Puntland.
MKU is a progressive, ground-breaking university that serves the needs of aspiring students and a devoted top-tier faculty who share a commitment to the promise of accessible education and the imperative of social justice and civic engagement-doing good and giving back. The University’s coupling of health sciences, liberal arts and research actualizes opportunities for personal enrichment, professional preparedness and scholarly advancement
кэт казино сайт
кэт казино сайт
Sun52
Sun52
cat casino сайт
cat casino сайт
cat casino ru
https://t.me/s/cat_casino_ruu
фоп самойленко
cat casino регистрация на сайте
https://t.me/s/cat_casino_registraciya_na_sajte
https://wellbutrin.rest/# wellbutrin 150 xl
neurontin online usa: cheap gabapentin – neurontin
cat casino регистрация
cat casino регистрация
Many thanks, Terrific stuff!
1win bet app как ставить бонусы в 1win как использовать бонусы 1win казино
cat casino рабочее зеркало
cat casino рабочее зеркало
кэт казино рабочее зеркало
кэт казино рабочее зеркало
Whoa lots of amazing knowledge!
1win официальный сайт вход в личный кабинет https://1winvhod.online/ 1win на андроид
кэт казино промокод
кэт казино промокод
Wonderful content, With thanks.
скачать 1xbet на айфон зеркало скачать 1xbet на айфон бонус 1xbet
cat casino отзывы
cat casino отзывы
казино кэт отзывы
https://t.me/s/cat_casino_otzyvy
вавада. казино. онлайн. официальный. сайт.
https://t.me/vavada_kazino_onlajn_oficialnyj
http://claritin.icu/# ventolin spray
вход joycasino
вход joycasino
neurontin 400 mg price: generic gabapentin – neurontin 300 mg tablets
кэт казино онлайн официальный
кэт казино онлайн официальный
вавада. казино. онлайн. бесплатно.
https://t.me/vavada_kazino_onlajn_besplatno
зеркало joycasino
https://t.me/s/zerkalo_joycasin0
скачать joycasino на андроид
https://t.me/s/skachat_joycasino_na_android
cat casino онлайн
https://t.me/s/cat_casino_onlinee
vavada зеркало
https://t.me/s/vavada_zerkaloo
paxlovid cost without insurance https://paxlovid.club/# paxlovid covid
kantorbola
Kantorbola adalah situs slot gacor terbaik di indonesia , kunjungi situs RTP kantor bola untuk mendapatkan informasi akurat slot dengan rtp diatas 95% . Kunjungi juga link alternatif kami di kantorbola77 dan kantorbola99
чемпион казино зеркала
чемпион казино зеркала
сайт joycasino com
сайт joycasino com
кэт казино онлайн регистрация
кэт казино онлайн регистрация
вавада вход в казино
https://t.me/s/vavada_vhod_v_kazino
“””текущее”” зеркало joycasino”
“””текущее”” зеркало joycasino”
Useful tips. Regards!
1win промокод при регистрации игры 1win 1win букмекерская скачать
чемпион казино вход в личный кабинет
чемпион казино вход в личный кабинет
Jagoslot adalah situs slot gacor terlengkap, terbesar & terpercaya yang menjadi situs slot online paling gacor di indonesia. Jago slot menyediakan semua permaina slot gacor dan judi online mudah menang seperti slot online, live casino, judi bola, togel online, tembak ikan, sabung ayam, arcade dll.
cat casino официальный
https://t.me/s/cat_casino_oficialnyj
вавада. вход. в. казино.
вавада. вход. в. казино.
промокоды joycasino
промокоды joycasino
Terrific stuff, With thanks!
1win partenaire 1win apk 1win é confiável
чемпион казино вход
https://t.me/s/chempion_kazino_vh0d
vavada
https://t.me/s/vavada_vavada_casinoo
cat casino официальный сайт вход
cat casino официальный сайт вход
скачать joycasino
скачать joycasino
промо код joycasino
https://t.me/s/promo_kod_joycasino
чемпион казино верификация
https://t.me/s/chempion_kazino_verifikaciya
vavada рабочее зеркало
https://t.me/s/vavada_rabochee_zerkaloo
cat casino официальный сайт
cat casino официальный сайт
antoshka
отзывы о joycasino
https://t.me/s/otzyvy_o_joycasino
http://gabapentin.life/# prescription drug neurontin
вавада онлайн казино
https://t.me/s/vavada_onlain_kazino
сайт joycasino
сайт joycasino
кэт казино официальный сайт
кэт казино официальный сайт
чемпион казино скачать
https://t.me/s/chempion_kazino_skachat
ventolin 108: Ventolin inhaler online – ventolin uk
VPS SERVER
Высокоскоростной доступ в Интернет: до 1000 Мбит/с
Скорость подключения к Интернету — еще один важный фактор для успеха вашего проекта. Наши VPS/VDS-серверы, адаптированные как под Windows, так и под Linux, обеспечивают доступ в Интернет со скоростью до 1000 Мбит/с, что гарантирует быструю загрузку веб-страниц и высокую производительность онлайн-приложений на обеих операционных системах.
отзывы joycasino
https://t.me/s/otzyvy_joycasino
вавада официальный сайт казино
https://t.me/s/vavada_oficialnyj_sajt_kazino
кэт казино официальный
https://t.me/s/cat_casino_oficialnyi
чемпион казино промокод 2022
https://t.me/s/chempion_kazino_promokod_2022
vavada официальный сайт
vavada официальный сайт
официальный сайт joycasino
https://t.me/s/oficialnyj_sajt_joycasino
рабочее зеркало joycasino
https://t.me/s/rabochee_zerkalo_joycasinoo
cat casino официальный войти
https://t.me/s/cat_casino_oficcialnyi_voiti
чемпион казино промокод
https://t.me/s/chempion_kazino_promok0d
вавада казино
вавада казино
cat casino на деньги
https://t.me/s/cat_casino_na_dengi
обзор joycasino
обзор joycasino
Perfectly expressed of course. !
1win букмекерская рабочее зеркало игра как я вынес и 1вин стратегия 1win игра 1win-rate com
вавада казино скачать
вавада казино скачать
чемпион казино онлайн официальный сайт
чемпион казино онлайн официальный сайт
промокод joycasino
https://t.me/s/promokod_joycasinoo
почасовой отель пушкинская
cat casino мобильная версия
cat casino мобильная версия
мобильная версия joycasino
https://t.me/s/mobilnaya_versiya_joycasino
вавада казино сайт
вавада казино сайт
чемпион казино онлайн
https://t.me/s/chempion_kazino_onlajn
кэт казино мобильная версия
кэт казино мобильная версия
Very well spoken truly! !
1win мобильный 1win скачать на андроид 1win casino games xyz игры
казино. joycasino.
https://t.me/s/kazino_joycasin0
http://paxlovid.club/# paxlovid cost without insurance
онлайн казино joycasino
https://t.me/s/onlajn_kazino_joycasino
вавада казино рабочее зеркало
вавада казино рабочее зеркало
Sun52
cat casino игровые автоматы
https://t.me/s/cat_casino_igrovye_avtomaty
sound meter smart tools
apps to measure noise level
чемпион казино официальный сайт
https://t.me/s/chempion_kazino_oficialnyj_sajt
150 wellbutrin: Buy Wellbutrin SR online – cost of wellbutrin 75mg
joycasino зеркало сайта
https://t.me/s/joycasino_zerkalo_sajta
вавада казино отзывы
https://t.me/s/vavada_kazino_otzyvy
cat casino играть
https://t.me/s/cat_casino_igratt
чемпион казино играть на деньги
чемпион казино играть на деньги
обзор казино joycasino
обзор казино joycasino
joycasino зеркало рабочее
joycasino зеркало рабочее
вавада казино онлайн рабочее зеркало
вавада казино онлайн рабочее зеркало
кэт казино играть онлайн
кэт казино играть онлайн
чемпион казино бездепозитный бонус
https://t.me/s/chempion_kazino_bezdepozitnyj_bo
joycasino зеркала
https://t.me/s/joycasino_zerkala
вавада казино онлайн официальный сайт
https://t.me/s/vavada_kazino_onlajn_oficialnyjj
кэт казино играть
https://t.me/s/cat_casino_igrat
b52 club
казино joycasino
https://t.me/s/kasino_joycasino
чемпион казино бездепозитный бонус за регистрацию
чемпион казино бездепозитный бонус за регистрацию
вавада. казино. онлайн. официальный.
https://t.me/s/vavada_kazino_onlajn_oficialny
joycasino зайти на официальный сайт
https://t.me/s/joycasino_zajti_na_oficialnyj_sa
https://clomid.club/# can you buy generic clomid without prescription
cat casino промокод бездепозитный бонус
cat casino промокод бездепозитный бонус
чемпион казино бесплатно
https://t.me/s/chempion_kazino_besplatno
You reported it very well.
1win зеркало скачать 1win казино 1win telegram
вавада казино официальный сайт регистрация
https://t.me/s/vavada_kazino_oficialnyj_sajt_re
joycasino vip
https://t.me/s/joycasino_vipp
canadian pharmacy
joycasino.
https://t.me/s/joykazino_joykazino
cat casino бездепозитный бонус
cat casino бездепозитный бонус
чемпион казино бонус
https://t.me/s/chempion_kazino_b0nus
вавада. казино. официальный. отзывы.
https://t.me/s/vavada_kazino_oficialnyj_otzyvy
joycasino украина
https://t.me/s/joycasino_ukraina
Thanks, Numerous content.
1win букмекерская контора вход ваучер 1win 2024 авиатор 1win
Перевозка животных за границу
казино супер кэт
https://t.me/s/casino_super_cat
how to get generic clomid pills: Buy Clomid Online Without Prescription – where to buy cheap clomid pill
Thanks for every other magnificent article.
Where else could anyone get that type of information in such an ideal approach of writing?
I have a presentation subsequent week, and I am on the look for
such information.
joycasino com
https://t.me/s/joykasino_com
вавада. казино. играть. онлайн.
https://t.me/s/vavada_kazino_igrat_onlajn
joycasino telegram
https://t.me/s/joycasino_telegram
чемпион казино
чемпион казино
казино кэт официальный сайт
https://t.me/s/casino_cat_oficialnyi_sait
вавада. казино. играть. онлайн. зеркало.
вавада. казино. играть. онлайн. зеркало.
joycasino скачать приложение
joycasino скачать приложение
чемпион казино официальный сайт зеркало
чемпион казино официальный сайт зеркало
бонусы кэт казино
https://t.me/s/bonusy_ket_kazino
joycasino 777
https://t.me/s/joycassino_777
вавада казино играть
https://t.me/s/vavada_kazino_igrat
бонусы cat casino
https://t.me/s/bonusy_cat_casino
joycasino скачать бесплатно
https://t.me/s/joycasino_skachat_besplatno
бездепозитные промокоды казино чемпион
бездепозитные промокоды казино чемпион
вавада казино бонус
https://t.me/s/vavada_kazino_bonus
joycasino рабочее зеркало 2022
joycasino рабочее зеркало 2022
чемпион казино официальный сайт вход
https://t.me/chempion_kazino_0ficialnyj_sajt
joycasino зеркало сегодня
https://t.me/s/joycasino_zerkalo_segodnya
comprare farmaci online all’estero: avanafil spedra – farmacie on line spedizione gratuita
vavada casino
vavada casino
joycasino рабочее зеркало на сегодня
https://t.me/s/joycasino_rabochee_carkalo_naseg
Regards, Quite a lot of content!
фрибет 1win 1win вход как пополнить баланс на 1win
I think, that you are not right. I suggest it to discuss.
viagra pfizer 25mg prezzo: viagra generico recensioni – cerco viagra a buon prezzo
acquistare farmaci senza ricetta: cialis generico consegna 48 ore – acquistare farmaci senza ricetta
b52
Tiêu đề: “B52 Club – Trải nghiệm Game Đánh Bài Trực Tuyến Tuyệt Vời”
B52 Club là một cổng game phổ biến trong cộng đồng trực tuyến, đưa người chơi vào thế giới hấp dẫn với nhiều yếu tố quan trọng đã giúp trò chơi trở nên nổi tiếng và thu hút đông đảo người tham gia.
1. Bảo mật và An toàn
B52 Club đặt sự bảo mật và an toàn lên hàng đầu. Trang web đảm bảo bảo vệ thông tin người dùng, tiền tệ và dữ liệu cá nhân bằng cách sử dụng biện pháp bảo mật mạnh mẽ. Chứng chỉ SSL đảm bảo việc mã hóa thông tin, cùng với việc được cấp phép bởi các tổ chức uy tín, tạo nên một môi trường chơi game đáng tin cậy.
2. Đa dạng về Trò chơi
B52 Play nổi tiếng với sự đa dạng trong danh mục trò chơi. Người chơi có thể thưởng thức nhiều trò chơi đánh bài phổ biến như baccarat, blackjack, poker, và nhiều trò chơi đánh bài cá nhân khác. Điều này tạo ra sự đa dạng và hứng thú cho mọi người chơi.
3. Hỗ trợ Khách hàng Chuyên Nghiệp
B52 Club tự hào với đội ngũ hỗ trợ khách hàng chuyên nghiệp, tận tâm và hiệu quả. Người chơi có thể liên hệ thông qua các kênh như chat trực tuyến, email, điện thoại, hoặc mạng xã hội. Vấn đề kỹ thuật, tài khoản hay bất kỳ thắc mắc nào đều được giải quyết nhanh chóng.
4. Phương Thức Thanh Toán An Toàn
B52 Club cung cấp nhiều phương thức thanh toán để đảm bảo người chơi có thể dễ dàng nạp và rút tiền một cách an toàn và thuận tiện. Quy trình thanh toán được thiết kế để mang lại trải nghiệm đơn giản và hiệu quả cho người chơi.
5. Chính Sách Thưởng và Ưu Đãi Hấp Dẫn
Khi đánh giá một cổng game B52, chính sách thưởng và ưu đãi luôn được chú ý. B52 Club không chỉ mang đến những chính sách thưởng hấp dẫn mà còn cam kết đối xử công bằng và minh bạch đối với người chơi. Điều này giúp thu hút và giữ chân người chơi trên thương trường game đánh bài trực tuyến.
Hướng Dẫn Tải và Cài Đặt
Để tham gia vào B52 Club, người chơi có thể tải file APK cho hệ điều hành Android hoặc iOS theo hướng dẫn chi tiết trên trang web. Quy trình đơn giản và thuận tiện giúp người chơi nhanh chóng trải nghiệm trò chơi.
Với những ưu điểm vượt trội như vậy, B52 Club không chỉ là nơi giải trí tuyệt vời mà còn là điểm đến lý tưởng cho những người yêu thích thách thức và may mắn.
joycasino зеркало рабочее сегодня и сейчас
joycasino зеркало рабочее сегодня и сейчас
вавада казино вход
вавада казино вход
joycasino промо код
https://t.me/s/joycasino_promo_kod
acquisto farmaci con ricetta comprare avanafil senza ricetta farmacia online piГ№ conveniente
Promo code
no deposit bonus
Whoa loads of useful information!
фриспины 1win 1win вход зеркало 1win рабочее зеркало сейчас
farmacia online migliore: farmacia online più conveniente – farmacia online
вавада казино регистрация
https://t.me/s/vavada_casino_registracia
http://farmaciait.pro/# comprare farmaci online all’estero
joycasino promo code
joycasino promo code
мелбет промокод
промокод на melbet на сегодня
joycasino зеркало на сегодня мобильная версия
https://t.me/s/joycasino_zerkalo_na_segodniamob
вавада казино онлайн
вавада казино онлайн
acquistare farmaci senza ricetta: kamagra gel – farmacie online sicure
joycasino полный онлайн joycasino игровые джойказино бонусы
https://t.me/s/joycasino_polnyj_onlajn_joycasin
вавада казино зеркало
вавада казино зеркало
farmacia online migliore: avanafil – farmacia online migliore
joycasino полный joycasino игровые автоматы джойказино бонусы
joycasino полный joycasino игровые автоматы джойказино бонусы
joycasino зеркало на сегодня
https://t.me/s/joycasino_zerkalo_nasegodnia
Tiêu đề: “B52 Club – Trải nghiệm Game Đánh Bài Trực Tuyến Tuyệt Vời”
B52 Club là một cổng game phổ biến trong cộng đồng trực tuyến, đưa người chơi vào thế giới hấp dẫn với nhiều yếu tố quan trọng đã giúp trò chơi trở nên nổi tiếng và thu hút đông đảo người tham gia.
1. Bảo mật và An toàn
B52 Club đặt sự bảo mật và an toàn lên hàng đầu. Trang web đảm bảo bảo vệ thông tin người dùng, tiền tệ và dữ liệu cá nhân bằng cách sử dụng biện pháp bảo mật mạnh mẽ. Chứng chỉ SSL đảm bảo việc mã hóa thông tin, cùng với việc được cấp phép bởi các tổ chức uy tín, tạo nên một môi trường chơi game đáng tin cậy.
2. Đa dạng về Trò chơi
B52 Play nổi tiếng với sự đa dạng trong danh mục trò chơi. Người chơi có thể thưởng thức nhiều trò chơi đánh bài phổ biến như baccarat, blackjack, poker, và nhiều trò chơi đánh bài cá nhân khác. Điều này tạo ra sự đa dạng và hứng thú cho mọi người chơi.
3. Hỗ trợ Khách hàng Chuyên Nghiệp
B52 Club tự hào với đội ngũ hỗ trợ khách hàng chuyên nghiệp, tận tâm và hiệu quả. Người chơi có thể liên hệ thông qua các kênh như chat trực tuyến, email, điện thoại, hoặc mạng xã hội. Vấn đề kỹ thuật, tài khoản hay bất kỳ thắc mắc nào đều được giải quyết nhanh chóng.
4. Phương Thức Thanh Toán An Toàn
B52 Club cung cấp nhiều phương thức thanh toán để đảm bảo người chơi có thể dễ dàng nạp và rút tiền một cách an toàn và thuận tiện. Quy trình thanh toán được thiết kế để mang lại trải nghiệm đơn giản và hiệu quả cho người chơi.
5. Chính Sách Thưởng và Ưu Đãi Hấp Dẫn
Khi đánh giá một cổng game B52, chính sách thưởng và ưu đãi luôn được chú ý. B52 Club không chỉ mang đến những chính sách thưởng hấp dẫn mà còn cam kết đối xử công bằng và minh bạch đối với người chơi. Điều này giúp thu hút và giữ chân người chơi trên thương trường game đánh bài trực tuyến.
Hướng Dẫn Tải và Cài Đặt
Để tham gia vào B52 Club, người chơi có thể tải file APK cho hệ điều hành Android hoặc iOS theo hướng dẫn chi tiết trên trang web. Quy trình đơn giản và thuận tiện giúp người chơi nhanh chóng trải nghiệm trò chơi.
Với những ưu điểm vượt trội như vậy, B52 Club không chỉ là nơi giải trí tuyệt vời mà còn là điểm đến lý tưởng cho những người yêu thích thách thức và may mắn.
farmacie online autorizzate elenco: avanafil – farmacia online miglior prezzo
вавада казино официальный сайт вход зеркало
https://t.me/s/vavada_casino_oficialnyi_sait_ze
farmacie online autorizzate elenco: comprare avanafil senza ricetta – farmacie on line spedizione gratuita
joycasino полный онлайн казино joycasino джойказино бонусы
joycasino полный онлайн казино joycasino джойказино бонусы
farmaci senza ricetta elenco avanafil spedra farmacia online miglior prezzo
joycasino зеркало
joycasino зеркало
вавада казино официальный сайт вход
https://t.me/s/vavada_casino_oficialnyi_sait_vh
comprare farmaci online con ricetta: Dove acquistare Cialis online sicuro – comprare farmaci online all’estero
joycasino полный онлайн joycasino игровые автоматы бонусы
joycasino полный онлайн joycasino игровые автоматы бонусы
https://farmaciait.pro/# farmacie online autorizzate elenco
вавада казино официальный сайт
https://t.me/s/vavada_casino_oficialnyi_sait
acquisto farmaci con ricetta: top farmacia online – comprare farmaci online con ricetta
joycasino. отзывы.
joycasino. отзывы.
Thank you. Lots of postings!
1win вывод средств сколько ждать 1win какие слоты дают 1win отзывы
joycasino вывод денег
joycasino вывод денег
вавада казино официальный
вавада казино официальный
slot gacor gampang menang
slot gacor gampang menang
farmacie online autorizzate elenco: cialis generico – farmaci senza ricetta elenco
joycasino отзывы игроков
joycasino отзывы игроков
In recent years, the landscape of digital entertainment and online gaming has expanded, with ‘nhà cái’ (betting houses or bookmakers) becoming a significant part. Among these, ‘nhà cái RG’ has emerged as a notable player. It’s essential to understand what these entities are and how they operate in the modern digital world.
A ‘nhà cái’ essentially refers to an organization or an online platform that offers betting services. These can range from sports betting to other forms of wagering. The growth of internet connectivity and mobile technology has made these services more accessible than ever before.
Among the myriad of options, ‘nhà cái RG’ has been mentioned frequently. It appears to be one of the numerous online betting platforms. The ‘RG’ could be an abbreviation or a part of the brand’s name. As with any online betting platform, it’s crucial for users to understand the terms, conditions, and the legalities involved in their country or region.
The phrase ‘RG nhà cái’ could be interpreted as emphasizing the specific brand ‘RG’ within the broader category of bookmakers. This kind of focus suggests a discussion or analysis specific to that brand, possibly about its services, user experience, or its standing in the market.
Finally, ‘Nhà cái Uy tín’ is a term that people often look for. ‘Uy tín’ translates to ‘reputable’ or ‘trustworthy.’ In the context of online betting, it’s a crucial aspect. Users typically seek platforms that are reliable, have transparent operations, and offer fair play. Trustworthiness also encompasses aspects like customer service, the security of transactions, and the protection of user data.
In conclusion, understanding the dynamics of ‘nhà cái,’ such as ‘nhà cái RG,’ and the importance of ‘Uy tín’ is vital for anyone interested in or participating in online betting. It’s a world that offers entertainment and opportunities but also requires a high level of awareness and responsibility.
joycasino вход
https://t.me/s/joycasino_vhod
вход cat casino
catalog2you.ru
вавада казино играть онлайн
вавада казино играть онлайн
joycasino онлайн казино joycasino автоматы джойказино бонусы
https://t.me/s/joycasino_online_kazino_igrovie
Чтобы воспользоваться промокодом, вам необходимо зарегистрироваться на сайте 1xBet и ввести этот промокод в соответствующем поле при регистрации. После этого вам будет начислен бонус до 32500 рублей, который вы сможете использовать по своему усмотрению.
1xbet промокод при регистрации com
вавада. казино. бонус.
https://t.me/s/vavada_casino_bonuss
joycasino скачать официальный сайт
joycasino скачать официальный сайт
joycasino официальный сайт зеркало
joycasino официальный сайт зеркало
comprare farmaci online con ricetta: kamagra oral jelly consegna 24 ore – top farmacia online
comprare farmaci online con ricetta: kamagra oral jelly – farmacia online senza ricetta
]gama casino
vavada казино
https://t.me/s/vavada_casinno
joycasino официальный сайт мобильная версия
joycasino официальный сайт мобильная версия
farmacia online: avanafil generico prezzo – migliori farmacie online 2023
joycasino скачать на андроид
joycasino скачать на андроид
canada pharmacy online
no deposit bonus
вавада. казино.
вавада. казино.
https://sildenafilit.bid/# viagra originale recensioni
joycasino официальный
joycasino официальный
comprare farmaci online all’estero: avanafil spedra – farmacia online senza ricetta
joycasino скачать
https://t.me/s/joycasino_skachat
скачать вавада казино
скачать вавада казино
viagra originale in 24 ore contrassegno: viagra prezzo – cerco viagra a buon prezzo
joycasino на деньги – джойказино слоты
joycasino на деньги – джойказино слоты
скачать казино вавада на андроид
https://t.me/s/skachat_kazino_vavada_na_android
vavada рабочее
vavada рабочее
joycasino сайт
joycasino сайт
acquisto farmaci con ricetta: avanafil – farmacie on line spedizione gratuita
joycasino мобильная версия скачать
https://t.me/s/joycasino_mobilnaia_versija_skac
скачать казино вавада
https://t.me/s/skachat_kazino_vavada
miglior sito per comprare viagra online: viagra senza ricetta – esiste il viagra generico in farmacia
vavada сегодня
https://t.me/s/vavada_segodnya
секреты и зеркало joycasino джойказино промокод
https://t.me/s/sekrety_i_zerkalo_joycasino_dzho
joycasino mobile
joycasino mobile
esiste il viagra generico in farmacia viagra consegna in 24 ore pagamento alla consegna esiste il viagra generico in farmacia
joycasino review
joycasino review
canadian pharm support group
сайт онлайн казино вавада
https://t.me/s/sajt_onlajn_kazino_vavadaa
сайт vavada
https://t.me/s/sajt_vavada
top farmacia online: farmacia online miglior prezzo – farmacie online affidabili
farmacie online sicure: avanafil prezzo – farmacie online autorizzate elenco
joycasino коды
https://t.me/s/joycasino_kody
joycasino регистрация
https://t.me/s/joycasino_registraciya