

তাঁর বোহেমিয়াপনা, ধোঁয়াশা ধোঁয়াশা ক্যালিগ্রাফির মতো খ্যাপাটে বুদ্ধিজীবীময় জীবন ছাপিয়ে সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি কবি।
কবি সাবদার সিদ্দিকি (১৯৫০- ১৯৯৪)। বিচিত্র এই মানুষটি সম্পর্কে সংখ্যাহীন গল্প ছড়িয়ে-ছিটিয়ে জমে ছিল, জমে আছে নানাজনের কাছে, তা যেন এ সময়ের এক নতুন মিথ্। শৈশবের একটা অংশ ভারতের পশ্চিমবাংলায় অন্য একটি অংশ বাংলাদেশের সাতক্ষীরায়। যৌবনের বেশিরভাগ সময়ে ঢাকা, স্বস্তির খোঁজে সাতক্ষীরায়। মাঝের জীবন খুলনা, ঢাকা, কোলকাতা। কখনো দিল্লিসহ ভারত, বাংলাদেশের নানা জায়গায়। রাজনৈতিক পরিবর্তনের পটভূমি দেখেছেন নিজের চোখে। দেশ ভাঙা-দেশ গড়া– সে সব ভাঙন-কথন তার কবিতায়, তার জীবনেও অনেক প্রভাব ফেলেছিল।
চাল-চলন পোশাকের ধরনের সাথে বলার ধরনও ছিল অন্যদের থেকে আলাদা। তার বেডশিটের কাপড়ের তৈরি কিংবা চটের আলখাল্লার মতো পোশাক, টায়ারের চটি, নিজের কাছে রাখা প্লেট-কাপে খাওয়া, হঠাৎ হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়া, চুলের অন্যরকম ছাট সব মিলিয়ে গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে ঢাকায় শিল্প-সাহিত্যের মানুষদের কাছে বোহেমিয়ান শব্দের প্রতিশব্দ ছিল সাবদার।
ঢাকার বিশেষ কিছু আড্ডায় অলিখিত প্রদর্শক ছিলেন সাবদার। সাবদারের চিহ্নিত উত্তরসুরীরা পরবর্তীতে প্রায় সবাই কমবেশি আলোচিত বাংলা সাহিত্যে এবং তারা স্বীকার করেন অকপটে সাবদারের সম্মোহনী শক্তির। গত শতাব্দীতে মুখে মুখে কোলকাতার আরেক বোহেমিয়ান অমিতাভ সেনের বিশেষ খ্যাতির কথা শ্রুতি থাকলেও তার সৃষ্টির কথা আমাদের তেমন জানা নেই বিপরীতে সাবদারের আছে অসংখ্য ক্যালিগ্রাফির মতো শিল্প, শক্তপোক্ত শক্তির অনেক কবিতা।
এই সতন্ত্রস্বর কবি সাবদার সিদ্দিকির সুহৃদ সতীর্থ আবুল হাসানের (০৪ আগস্ট ১৯৪৭-২৬ নভেম্বর ১৯৭৫) শক্তিময়-দ্যুতিময় সৃষ্টি এবং বয়সে অল্প একটু বড় আরেক শুভার্থী-সুহৃদ, সতীর্থ নির্মলেন্দু গুণের (২১ জুন ১৯৪৫-) প্রকাশিত বিপুল সৃষ্টি আমাদের বিস্মিত করে। প্রচলিত নিয়ম-নীতির ধারাবাহিকতা ধারায় জীবনের ছক আঁটকে থাকলে সাবদার সিদ্দিকির লেখাগুলো হতে পারতো আবুল হাসানের উজ্জ্বলতম অধ্যায়ের উপাখ্যানের মতো অথবা নির্মলেন্দু গুণের প্রকাশিত বিপুল শব্দসমাহারের মতো।

ব্যক্তি সাবদারের বোহেমিয়াপনা, কথিত ছন্নছাড়া ভঙ্গিমা ইত্যাদি নিয়ে এতো বেশি আলোচনা হয়েছে সে তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম আলোচনা হয়েছে তার কবিতা ও অন্যান্য সৃষ্টি । আপাত আলোচনায় তার কবিতার ক্যানভাসে চোখ রাখতে চাই, সাথে অন্যান্য সৃষ্টির একটু-আধটুতেও–
সম্মিলিত সিদ্ধান্ত (অসংখ্য লেখার সুত্রের ভিত্তিতে) ছিল এতোদিন সাবদার সিদ্দিকির প্রথম কবিতা ১৯৬৬ সালে সাতক্ষীরার কোরক সংসদের সাহিত্য বিভাগ কর্তৃক দেশত্ববোধক কবিতার সংকলন ‘অনন্য স্বদেশ’-এ প্রকাশিত হয়েছিল সাবদার হোসেন সিদ্দিকি নামে ‘সার্থক জনম আমার’ শিরোনামে। ওই সংখ্যাটিতে বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান কবিদের কবিতাই ছাপা হয়েছিল।
কিন্তু আমরা দেখেছি সাতক্ষীরা পি. এন. মালটিল্যাটারাল হাই স্কুল পত্রিকা ‘নবনূর’-এর দশম বর্ষ, ৩১ ডিসেম্বর, ১৯৬৫ সালে বারো পাতায় ‘সার্থক জনম আমার’ শিরোনামে প্রকাশিত হয় সাবদার হোসেন সিদ্দিকি নামে। সেকারণে উপরোক্ত সিদ্ধান্তটিতে আপাতত স্থির থাকার আর সুযোগ থাকছে না। কবিতাটি–
সার্থক জনম আমার
হে আমার
জননী জন্মভূমি,
আমার শরীরের প্রতিটি উষ্ণ রক্ত কণা
তোমার জন্য।
প্রতি মুহূর্তে আমি জাগ্রত
তোমার জন্য,
তোমাকে জড়িয়ে থাকাতেই
আমার অধীর আকাক্সক্ষা :
হে জন্মভূমি,
আমার সকল গান তোমাকে লক্ষ্য করে-
আমি তোমার
শুধু তোমার।
(* তুমি তা জানো না কিছু– না জানিলে, / আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে– নির্জন স্বাক্ষর : জবিনানন্দ দাশ)
কবিতাটিতে জীবনানন্দের বহুল পঠিত কবিতার লাইন প্রায় হুবহু ব্যবহার করেছেন কবি। সাবদারের বয়স তখন পনেরো। প্রভাব থাকা অস্বাভাবিক নয়, শৈলী সচেতনতার অভাব– সেটিও স্বাভাবিক।
প্রথম কবিতা প্রকাশের তেরো বছর পর “১৯৭৮ সালে প্রকাশিত স্বপন খান-সম্পাদিত ‘পা’ নামের সংকলনে এককভাবেই সাবদার সিদ্দিকির একগুচ্ছ কবিতা মুদ্রিত হয়েছিলো।‘পা’ সংকলনের কবিতায় সব প্রভাবের বৃত্ত থেকে বের হয়ে কবিতার আলাদা সার্বভৌম ভূখণ্ডের মানচিত্র চিহ্নিত করে নিজের পতাকাও উড়িয়েছেন সাবদার।
রাজনৈতিক মতবাদের বিশেষ এক আদর্শিক চিরুণি দিয়ে আঁচড়েছেন চুল নিজের মতো করে। এই সব কবিতায় ছন্নছাড়া, কম্পাসহীন কলম্বাস মনে হয়নি সাবদারকে। বিশেষ রাজনৈতিকবোধে আচ্ছন্ন তাঁর কবিতার প্রায় প্রতিটি লাইন। একজন বোহেমিয়ান কবির প্রতিচ্ছবি খুঁজে পাওয়া যায় না কবিতায়, বরং আলটিমেট বুদ্ধিজীবীর বুদ্ধিদীপ্ত কথার মতোই মনে হয় ইঙ্গিতে-ইশারায়। উপস্থাপিত একটি কবিতাই কথাগুলোর স্বপক্ষে যুৎসই প্রমাণ বলে মনে হবে আমাদের–
চন্দন, এখন এখানে তেমন কবিতা
লিখছে না আজকাল
চঞ্চল কিছু কিলবিল শব্দের কুটিল
কুটিরশিল্প কবিতা এখন
বাগানে সঙ্গমরত প্রফুল্ল প্রজাপতি
অথচ কেউ–
যাত্রাপথ থেকে মুছে যাচ্ছে নদী
কেউ লিখছে না
কীটকে ফুল থেকে বিচ্ছিন্ন করা যাচ্ছে না
আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপনযন্ত্রের বিরুদ্ধে
অস্থিমজ্জালিঙ্গপা আমাদের এই জন্ম
জননতন্ত্র প্রজনন অথচ লিখল না কেউ
এক স্ফিংস স্থবির তন্দ্রা নীরবতা এখানে অগ্নিকোণে
এমনকি গাছ নিঃশ্বাস শোনা যায় তা নিয়ে
লিখলো কেউ।
তিনজন ফেরেস্তা ছুড়ে দিল শব্দ কয়েকটা
ঈশ্বরের শব নিয়ে হেঁটে গেল দেবদূতেরা
লিখল না কেউ অথচ এরা
বন্ধুরা নয়, কেবল দর্জিরা কাঁধে রাখছে হাত
মগজ দ্রুত কাগজ হয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন
খাদ্য সমস্যা কেবল মানুষের
পাখি-ইঁদুরের খাদ্যসমস্যা নেই
একথা কবিতায় কেউ লিখল না কেউ
চন্দন মাইরি,
যৌবন ডাইরি কেউ লেখে না তেমন
সেরকম সবাই দ্রুত ধুঁয়ে নিচ্ছে লন্ড্রিতে মুখোশ
ঘাতক মুছছে হাত নারী আঁচলে।
লিখব লিখব বলে
কেউ– সবাই কিংবা সকলে লেখে না এখন
দুষ্প্রাপ্য কবিতা তেমন
চন্দ্রশিলা যেমন।
তুই কি জানিস না চন্দন
নতজানু জানতে চায় এরা
কম্পিউটর কাছে
ঈশ্বর নেই কিংবা আছে
প্রথম দিনের সূর্য নিরুত্তর
কম্পিউটর
দেয় না এদের উত্তর।
নির্বাক সম্প্রদায় এক বৃদ্ধি পায় উত্তরোত্তর
ঘাতক হাতে রঞ্জিত ইতিহাস দেখে
লেখে না কেউ
কেবলই উড়তে উড়তে থাকে প্লাকার্ড ফানুস
খঞ্জ ভিখারীর করুণ ব্যাগপাইপ থাকে
বাজতে ময়দানে নেতার থুতুমাখা
মাউথপিছে বিভিন্ন রসায়ন
বাক-স্বাধীনতা পায় যুগপৎ ফুল ও লাল হাততালি
দেয়াল ভাঙছে, খসছে সবাই শব্দ
সবাই অবাক কেউ লিখছে না
কেননা আমরা সকলেই নয় কেউ কেউ
স্বর্গে যাব বলেছেন যেরকম জেসাস
আমরা সকলেই নয় সে রকম আমরা
কেউ কেউ কবি।
নিরস্ত্র কলম না থাকলে যিনি
কবি তিনি
বুকপকেট আগুনে জ্বালিয়ে নেন সিগ্রেট যিনি
তাকে জানি, কবি তিনি।
ফুলের দোকানে
বাগানে ফুল নাই–
রক্তব্যাঙ্ক রক্তহীন, রক্ত চাই
চক্ষু ব্যাঙ্ক, চক্ষুহীন, চোখ চাই। চোখ গেল
স্বপ্ন দেখতে দেখতে নষ্ট হচ্ছে চোখ, চাই চোখ।
দম্পতিরাতে কম্পিত সফেন পিচ্ছিল নিয়ন
বেলুন লীলা মৈথুন ক্লান্ত তরুণ
কু-লী বিছানায় খুঁজে নেয় সর্বশেষ আশ্রয় লালাসিক্ত বালিশে শুয়ে থাকে এ যুগের লক্ষণ।
কিছু সমস্ত্র অতিথি কড়া নাড়ে
মাংস দোকানে ঝোলে নিরীহ
পশুমাংস নির্বাক মানুসে মানুষে কত ডিগ্রি
সেন্টিগ্রেড ভালোবাসা হয় বিনিময়
কেউ বলে না, কেউ লেখে না।
কেবল কাকস্য পরিবেদনা কাকভোরে
সংবাদপত্রের পাতায় লেপ্টে যায় কালি
শুধু হাই তুলে তুড়ি মেরে
হামাগুড়ি কাটিয়ে দিচ্ছে কাল
লৌহসংস্কৃতির ক্রীতদাসেরা
শৃঙ্খলিত এরা মাংসে মজ্জায়
মুখোশজীবী এক নির্বাক সম্প্রদায়
রাষ্ট্রীয় পরিবহনে প্রত্যহ ফিরে যায় নির্ধারিত সিমেন্ট কৌটায়, মমি শয্যায়।
(পুনর্মুদ্রণ : পা : সাবদার সিদ্দিকি : ১৯৭৮)
আরো স্বপক্ষ-সমর্থণচিন্তা যোগ করা যেতে পারে– ‘সিদ্দিকীর সংগৃহীত কবিতা পড়ে আমাদের মনে হয়েছে ওঁর মেজাজে ব্যক্তিগত একাকিত্বের অভিযোগ আশ্চর্য বিরল। যাকে সহজ কথায় বলে দেশ ও দশের ভাবনা-চলতি অর্থে রাজনীতি ও সমাজ চিন্তাও বলা যায়– তার উপস্থিতি প্রবল ওঁর কবিতায়। বস্তুতপক্ষে সাবদার সিদ্দিকীর কবিতায় মোটেও নৈরাশ্য নেই, মধ্যম শ্রেণির দুঃখের ফিরিস্তি সম্পূর্ণ অনুপস্থিত, বিলাপ মাতম একেবারে নেই বললেও চলে।’ (গোলাম সাবদার সিদ্দিকীর কবিতায় রাজনীতি : আবদুল মান্নান সৈয়দের সঙ্গে বিচার : আমি তুমি সে : সলিমুল্লাহ খান : সংবেদ, ঢাকা : ফেব্রয়ারি ২০০৮ : পাতা ১৮০)
তোষামোদির, মানিয়ে নেওয়ার, এড়িয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি সাবদারের মধ্যে ছিল না। নিজের কথা বলার চেয়ে নিজেদের কথা মানে সবার কথা বলার প্রবণতায় স্থির এবং স্থির থাকতে পেরেছিলেন বলে আমরা জানতে পারি। মননে আধুনিকতা আর আধুনিক কবিতার ইশতেহারের সাথে তালে তাল রেখে পৃথিবীকে আপন করে নিতে পারার প্রতিচ্ছবি তাঁর কবিতায়–
যেখানেই পা রাখি
ভিনগ্রহে কিংবা ভিনগাঁয়ে দেখি
পায়ের নিচে টুকরো দুই জমি
হয়ে যায় আপন মাতৃভূমি
(পা : পা : সাবদার সিদ্দিকি : ১৯৭৮)
আচরণে ছন্নছাড়া– এটি তাঁর নিজের। কিন্তু কবিতার সাবদার, শিল্পের সাবদার আলাদা। তাঁর আচরণের যে সব গল্প আমরা শুনেছি তাঁকে সাধারণ মানুষেরা কখনো সুস্থ মনে করেনি। উল্টো করে যদি বলা হয় : হয়তো সাবদারই অন্যদের স্বাভাবিক মনে করেননি। বৈষম্যের বাজারে তিনি কখনো বেঁচা-কেনার থলি হাতে ঢুকতে চাননি। প্রবল প্রতিবাদের নানা ভঙ্গিমা থাকে একেক জনের। আলাদা ধরণে তাই তিনি বলতে পারেন–
তোমার কাছে পত্র লেখা
বিশুদ্ধ যে গদ্যলেখা
হল না তাই হয় না তা শব্দ লেখা
মাকে কিংবা তোমাকে।
তোমার আমার গ্রহটা গদ্যময়
জেনেছি সেকথা কাব্যে গদ্যে নয়।
(গদ্য লেখা : : পা : সাবদার সিদ্দিকি : ১৯৭৮)
সাম্রাজ্যবাদ এক অদৃশ্য মাধ্যম। শুধুমাত্র সু-চিন্তকের কাছে পাত্তা পায়নি এই মাধ্যম। যত রকম কলাকৌশলে ঢুকতে চেয়েছে সাম্রাজ্যবাদ তারচেয়ে বেশি রকমের কৌশলে ঠেকিয়ে দিয়েছে বরাবর সুজনেরা। এই সব সুজনদের সবচেয়ে বড় অংশটির সামনে থেকেছে কবিরা। সুযোগ নেওয়া সুবিধাবাদীরাও স্বাগত জানানোর সুযোগ নিতে পারেনি সংখ্যালঘু এই কবি সম্প্রদায়ের জন্যে। কখনো উচ্চস্বরে, কখনো ইশারায়, কখনো অংকের মতো হিসেব কষে কষে, যেন ভুল না হয়। সাবদার এই সংখ্যালঘুদের অন্যতম। এক, দুই, তিন করে গুণে নেওয়া যায় এমন গুণি তিনি। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সিমেন্টের বাক্সে সংসার পাতেন নি, সুনির্দিষ্ট কোনো মাজহাবের কাছে মাথা বেঁচেননি। শুধু মানুষের জন্যে, সুন্দর একটি সমাজের জন্যে, কল্যাণ রাষ্ট্রের জন্যে স্বপ্ন-শব্দের পাল উড়িয়ে সাবলীল ভাসতে চেয়েছেন পৃথিবীময়। এই চিন্তার সাথে যাওয়া আরেক চিন্তা-সহযাত্রী কবি বিনয় মজুমদারকে কবিতায় বেঁধেছেন সাবদার–
বিনয় অংক মানসাংক ভালো করে
মন ও মগজ বিনয়ের অনায়াসে
সরল সুদকষা-লসাগু-গসাগু বলতে পারে
কত কিউসেক জল হলে
কত টন শষ্য হতে পারে।
ক টন তেল হলে রাধা ভারতনাট্যম নাচতে পারে।
ক সেন্টিমিটার বৃষ্টি হলে রবিশষ্য ক মিটার
প্রসারিত হতে পারে।
ইত্যাদির যাবতীয় গণিতের বিভিন্ন সূত্রের টানাপোড়েনে
বিনয় বিন্দু দিয়ে অনায়াসে বুঝিয়ে দিতে পারে অতএব
একদিন ও একদিন
হাতে পেলাম দুদিন
জন্মদিন ও মৃত্যুদিন
৪৮ ঘন্টা ব্যবধানে অতএব
একদিন আর একদিন
বিনয় অংক, বিশেষত মানসাংক ভালো করে।
(মানসাংক বিজ্ঞান : পা : সাবদার সিদ্দিকি : ১৯৭৮)
পৃথিবী সৃষ্টির পর নানা রকম তকমা দিয়ে এক এক তত্ত্বকে শ্রেষ্ঠ বলে গছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালানো হয়েছে মানুষের উপর। একেক আদর্শের ছাঁচে ফেলে আমাদেরকে আঁটকে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। সকল চেষ্টার অপর নাম শেষ পর্যন্ত মানবিকতা বলছেন সবাই কিন্তু সেই সব বাদ-মতবাদের ফাঁক গলে বেরিয়ে গেছে বার বার কল্যান। অনেকে অনেক কথা বললেও এখনো পর্যন্ত পৃথিবী ‘মার্কসবাদ’-কে মানবিক উত্তোরণের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য তত্ত্ব হিসেবে বিশেষ সম্মানের সাথে মেনে নিয়েছে। কেননা এই মতবাদের আদলেই আধুনিক কল্যানরাষ্ট্রগুলো গড়ে উঠছে বর্তমান পৃথিবীতে।
সাবদার আপাদমস্তক একজন মার্কসিস্ট। বিভিন্ন জনের আলোচনায় জানা যায়, এইসব ভাবনা, এইসব কথা– বলতেন, ভাবতেন সাবদার। নিজের সময় থেকে এগিয়ে ছিলেন সাবদার, তাই সে সময়ের সাধারণ মানুষেরা সাবদারের অসাধারনত্বকে ধারণ করতে পারেনি। আপাদমস্তক রাজনীতির কবি, রাজনৈতিক মতবাদের বিশেষ এক আদর্শিক চিরুণি দিয়ে আঁচড়েছেন চুল নিজের মতো করে। সাবদার সারা পৃথিবীর মুক্তি চাওয়া মানুষের রিপ্রেজেন্টেটিভ–
“
…
কবিতা আবৃত্তির চিন্তা করলেন, মনে মনে কমরেড :
আলো জ্বালতে এসে ভুলে
আগুন ফেলেছি জ্বেলে
অসম্ভব চুপ করে আছি
আমি অসম্ভব
দেশলাই ছাড়া কোন বাক-ব্যক্তি সম্পত্তি নেই
তুলে নিই তাই
কলম কিংবা কারবাইন
রুটির বদলে বারুদ কিংবা কৃষ্ণঘর্মাক্ত কলম বল্লম।’
হাঁটতে লাগলেন কমরেড
হাঁটছেন ভাবছেন
লাল ডাকবাক্সটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এক পায়
ঝিমাচ্ছিল তার পাশে সংরক্ষিত কাঁটাতার
এলাকার কাছে, নিষেধ সাইনবোর্ড নিচে
কমরেড পুনর্বার উচ্চারণ চাইলেন :
আমি তো ক্রীতদাস নই, চাই স্বাধীনতা
কেবলই চাই চাই।
না রাষ্ট্র, না নেতা, না জনতা, না অস্ত্র
দেবে, চাইব কার কাছে স্বাধীনতা ?
জানি না কি তোমাদের মানুষের
ব্যবধান বারুদের, ক্রীতদাস নই তাই কেবলই চাই স্বাধীনতা।
(ওয়াকিটকি : পা : সাবদার সিদ্দিকি : ১৯৭৮)
১৯৮১ সালে কোলকাতা থেকে সুভাস সাহা সম্পাদিত আরেকটি ছোট কবিতা সংগ্রহে সাবদারের আরেক গুচ্ছ কবিতা ছাপা হয়। এখানেও তার স্বকীয়তা নজর এড়ায় না। কবিতার আমি যে নিজে নই, সবার হয়ে নিজেকে উপস্থাপন করার স্বচ্ছন্দ প্রয়াস–
আমি এভাবেই নিজের মধ্যে
আত্মগোপন করে থাকি
দাঁত নখ মুখ চোখ লুকিয়ে রাখি সশরীরে
ক্রীতদাস রচিত সভ্যতা থেকে
এক মানবিক অশ্ব ব্যবধান
আমি এভাবেই হেঁটে হেঁটে যাই মঞ্চে
মঞ্চ সফল মানুষের কাছে
এভাবেই নিজের মধ্যে আত্মগোপন
করে থাকি ভুলে থাকি
দাঁত নখ মুখ চোখ
সর্বদা লুকিয়ে রাখি গোপন অস্ত্র যেমন।
(অপ্রকাশিত পদ্য / গ / ৫ : সুভাস সাহা সম্পাদিত সাবদার সিদ্দিকির কবিতা : কলকাতা)
শব্দের মারপ্যাচে আমাদের ধাঁধায় ফেলতে চান ! কেনো ? কবি যেন এক তুখোড় চৌকষ বিড়াল আর আমরা ইঁদুর–
কথা শিল্প / ১২
কথারা কথার সাখে
কথা বলছে
শব্দেরা বাক্যের।
নয় কেউ
সেই তুমি আমি তুই
কেউ নয়
শব্দেরা বাক্যের সাথে
বাক্যেরা অর্থের সাথে
কথারা কথার সাথে।
নাম নিয়ে তাঁর বিশেষ মোহ ছিল– এমনটি আমরা খুঁজে পাইনি। কবিতায় কবি নাম নিয়ে খেলতে, নামের গান গেয়ে, নামের ভিড়ে হারিয়ে যেতে চেয়েছেন কখনো কখনো–
নামগান /২৪
নাম নিয়ে খেলা করি
নামের গান গাই
নামের গভীরে ভিড়ে কচিৎ হারাই
ঐ নাম থেকে কতদূর এলাম
রসনায় রসনায় রাষ্ট্র এই নাম
নাম নিয়ে খেলা করি
নাম গান গাই
নাম ছেড়ে কচিৎ হারাই।
‘সোনার হরিণ’ নামের একটি পকেট সাইজের কবিতার সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৬ সালে। ঐ সংকলনে সবগুলো কবিতার নাম কবিতার নিচে ব্যবহার করেছেন সাবদার। সব কাজে অন্যদের থেকে আলাদা সেখানেও সেই ছবি দেখি আমরা।
ধাঁধা তার নিজেকে নিয়ে, ধাঁধায় বাঁধা জীবন তার। সেই ধাঁধার ফাঁদে বার বার ফেলতে চান আমাদের। ফাঁদে ফেলার আনন্দই যেন তার আনন্দ–
অন্যের জন্য বেঁচে
থাকি নাকি
নিজের জন্য বাঁচা
খাঁচার জন্য
পাখি
নাকি
পাখির জন্য খাঁচা
সোছ
নিজেকে নিয়ে বলা, নিজেকে সাবধান করা। আহত বান্ধব কবির সাথে কথা বলেন। আহত বান্ধব কি পৃথিবী ?
সাবদার সাবধান
দেয়ালে দেয়ালে এ
বাক্য দেখলাম
আহত বান্ধব বললেন
বললাম এইমাত্র
আমিই লিখলাম
হুঁশইআর সাবদার
সাবধান
সাবদার সাবধান
আপন হবার গোপন বাসনা সবার মাঝে করে বসবাস, মুখ-মুখোশের আড়ালে–
কেউ নেই
কেউ নেই
একথা বলে
সবাই
হতে চায়
সবার আপন
সদরে ঝুলিয়ে
তালা
অন্দরে করে
বাস
একথা জেনও সবাই
একান্ত গোপন
অন্তর্বাস
১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অমর একুশে গ্রন্থমেলার কোনো এক সময়ে ফোল্ডার টাইপের একটি প্রকাশনা মেট্টোপলিটন কবিতা ‘গুটিবসন্তের সংবা-এ সাবদারের কয়েকটি কবিতা ছাপা হয়েছিল। সেই ভাঁজপত্রে তার ‘কলকাতা / আমি এক তরুণ মহাপুরুষ’, ‘কয়েকটি শব্দ কয়েকটি বাক্য’ এবং একটি দীর্ঘ কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল।
‘কলকাতা / আমি এক তরুণ মহাপুরুষ’ কবিতায় কোলকাতাকে জীব্য-উপজীব্য করে বাংলা বাঙালির ইতিহাস, ত্যাগ, ঐতিহ্য, বিস্তার তুলে ধরেছেন। সেই কবিতাটির উপসংহার স্তবকের বিখ্যাত কয়েকটি লাইন–
…
হাওড়া ব্রীজ যেন লোহার ব্রেসিয়ার তোমার
কলকাতা, যন্ত্রের সমান বয়সী তুমি
কলকাতা, তোমার ইতিহাস
বাইবেলের পিছনে গাদাবন্দুক
বাংলা গদ্যের সমান বয়সী
আমার কিশোর কলকাতা
সন্যাসীর লিঙ্গের মত নিস্পৃহ তুমি আজ।
কলকাতা
তুমি কি রক্তহীন
পুষ্টিহীন আজ ?
অথচ বারবার তুমি রক্ত দিয়েছ জানি
মিছিলে
ব্লাডব্যাঙ্কে
টিয়ার গ্যাসের মুখোমুখি
তুমি বারবার কেঁদেছ
আমিও কেঁদেছি কলকাতা
ইয়ং বেঙ্গলের হুররে হাহ্হা
কলকাতা।
ওই ভাঁজপত্রে ‘কয়েকটি শব্দ কয়েকটি বাক্য’ শিরোনামের কবিতাটিতে ছোট ছোট কথায় সাবদার সমসাময়িক পৃথিবীর চিত্র উপস্থাপন করেছেন। রাজনীতির নতুন বেশে ঔপনিবেশিকতার নতুন প্রবর্তন, বাজার অর্থনীতির মুক্ত চল, মানুষের সাথে মানুষের নতুন সেতু থাকা সত্বেও ব্যবধানের বিস্তার তুলে ধরেছেন। ‘জাতিসংঘের বদলে / একটি কম্পিউটার যথেষ্ট।’Ñ এমন কথার মতো বিস্তর কথা মফনিয়ে-বিনিয়ে বললেও সবাই বললেও এমন করে সাবদারের আগে কেউ কবিতায় লেখেনি– সেকারণে সাবদার অনন্য–
কয়েকটি শব্দ
কয়েকটি বাক্য
১. একজন পুলিশ একটি রাষ্ট্র।
২. কাক ও সাম্রাজ্যবাদ মূলত জ্ঞাতি ভাই।
৩. গৌতম বুদ্ধ কয়েক কোটি লোককে গৃহহারা করেছেন এটা সুমহান
সত্য।
৪. মিসেস ইসাবেলা পেরন একজন
মহিলা ফ্যাসিস্ট।
৫. গোলাপ মূলত চরিত্রহীন ফুল
গোলাপের শ্রেণী চরিত্র বিশ্লেষণ করা যাক।
৬. শান্তির পিকাসো পারাবত
এযাবত কোন ডিম্ব প্রসব
করেননি, একথা জেনে
দুঃখ পাওয়া ভাল।
৭. জাতিসংঘের বদলে
একটি কম্পিউটার যথেষ্ট।
৮. মানুষ মহাশূন্য করায়ত্ত করেছে
একথা যেমন সত্য সেমত
মানুষের সাথে মানুষের ব্যবধানগত
মহাশূন্যতা আজও করায়ত্ত
করতে পারেনি।
৯. মাও সেতুঙ একটি মাংস
উপগ্রহ।
১০. একজন গেরিলা ও সন্ন্যাসীর
মধ্যে মৌলিক পার্থক্য নেই
যেহেতু উভয়েই
মূলত ভ্রাম্যমান।
কবি রাষ্ট্র নন। কবি ‘কম্পাসহীন কলম্বাস’ ? কবির পৃথিবী আলাদা ? কবি সংসারে থেকেও প্রতিনিয়ত আবিস্কার করতে থাকেন, খুঁজতে থাকেন এই পৃথিবীর সুন্দর রূপ-রূপচ্ছবি। বিশ্ব-বিভাজনের সরল একরৈখিক অফরিপক্ক অংককে একপাশে সরিয়ে তাই কবি বলতে পারেন, কবিরা : ‘চতুর্থ বিশ্বের নিঃসঙ্গ নাগরিক’–
কবি ও নির্দিষ্ট ভূখন্ড
কেননা একজন কবি কোন রাষ্ট্র নন।
নির্দিষ্ট সুনির্দিষ্ট কোন ভূখ- নেই একজন কবির
সৌর সংসারেও নয়
পৌর সংসারেও নয়।
একজন কবি, কম্পাসহীন কলম্বাস।
যে রকম ধর্মের নিজস্ব নির্দিষ্ট কোন ভূখ- নেই
সেরকম ধর্মের কবিতার নেই কবির নেই সৌর সংসারেও নেই
পৌর সংসারের নেই।
কবি ও কবিতার নিজস্ব ভূখ- নেই
একজন কবি তাই চতুর্থ বিশ্বের নিঃসঙ্গ নাগরিক।
তার একটিমাত্র গদ্যেও তাকে মানুষের জন্য ভালোবাসার নামে চলতে দেখেছি। পাবলো নেরুদাকে নিয়ে লেখা। নেরুদার কবিতার শব্দ এবং বিষয়বস্তুতে মানবতাবোধ ও সর্বহারা মানুষের কথা উঠে এসেছে চমৎকার বিশ্লেষণে সে-সময়ের পাঠকদের জন্যে তুলে ধরেছেন। নিজের কথা নিজের নয়, সবার– কবিতার এই ধারায় চিহ্নিত করেছেন সেই গদ্যে।
তার সমসাময়িকদের মতো প্রচলিত কবিতার বই কিংবা কবিতা সংগহের গ্রন্থিত রূপের মতো করে প্রকাশিত হয়নি সাবদারের কবিতার বই। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কবিতাগুলো নিয়ে ছোট-ছোট সংকলনÑ সেই সব সংকলন থেকেও সাবদারকে চিনে নেওয়া যায়। জীবন জুড়ে ছড়িয়ে থাকা শত শত ক্যালিগ্রাফি নষ্ট কাগজের ঝাঁপিতে, বৃষ্টিতে-কুয়াশায় ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে তার হিসেব নেই। সে কটি টিকে আছে সেগুলো থেকে আঁচ করা যায় তার প্রতিভার ব্যতিক্রমী রূপ।
সাবদার নিজেকে উপস্থাপনের চেষ্টা করেননি, কবি হিসেবও নিজেকে জাহির করার প্রচেষ্টা করেননি। নিজের খেয়ালে কবিতা লিখেছেন। যদিও অল্পসংখ্যক আলোচক সাবদারের কবিতা নিয়ে আলোচনা করেছেন। তাঁর কবিতার ঠিক ঠিক আলোচনা এখনো উপস্থাপিত হয়নি। বলা যায় অনজ্জ্বল উপস্থাপন, ব্যাতিক্রম নন এক্ষেত্রে প্রভাববিস্তারী সমালোচকরাও।
অথচ সাবদার কবিতার প্রতিটি লাইনে সম্মিলিত মানুষের কথা বলতে চেয়েছেন। শুধুমাত্র শ্লোগান আর প্রোপাগণ্ডার কবি হওয়ার চেষ্টা করলে সাবদারের অল্পসংখ্যক কবিতা থেকেও অসংখ্য লাইন শ্লোগান হিসেবে ব্যবহার করা যায়। অনেকের অভিমত তাঁর কবিতার প্রতিটি লাইনই এক একটি শ্লোগান হতে পারে। কবিতার শৈলী বিচারেও তাঁর কবিতা অনন্য। মানুষ, মানুষের কথা কবিতায় বলতে যেয়ে ঠিক ঠিক শিল্প বজায় রাখতে পেরেছেন খুব কম সংখ্যক কবি, যারা পেরেছেন সেই সব ব্যাতিক্রমীদের মধ্যে সাবদার অন্যতম। সচেতনতার সাথে শৈলীতে রেখেছেন তাঁর কবিতাকে। কবিতার উপর বিশ্বাস না-হারানো কবি সাবদার। জীবনে, কবিতায়, গদ্যে সাবদার ইউনিক স্টাইলের নির্ভীক ভাষ্যকার।




লেখাটি সাহিত্যের কাগজ ‘মৃৎ’ সংখ্যা ০৪ । ফাল্গুন ১৪২৬ থেকে নেওয়া