সত্যজিতের কম্পু : আমাদের আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স, ভবিষ্যতের সুপার এআই । বাবলু ভঞ্জ চৌধুরী

সত্যজিতের কম্পু : আমাদের আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স, ভবিষ্যতের সুপার এআই

বাবলু ভঞ্জ চৌধুরী

সত্যজিৎ রায় ১৯৭৮ সালে তাঁর ‘কম্পু’ গল্পে এমন একটা যন্ত্রের কথা কল্পনা করেছিলেন, এই ক’দিন হলো মাত্র আমরা তা দেখতে শুরু করেছি। যন্ত্রটি আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স বা এআই। সত্যজিতের গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল আনন্দমেলা পূজা বাষিকী-১৩৮৫-তে , অর্থ্যাৎ এখান থেকে পয়তাল্লিশ বছর আগে। গল্পটি শঙ্কু অ্যাডভেঞ্চার সিরিজের।

বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তি বিকাশের প্রবণতা এবং তা নিয়ে সাহিত্য রচনা সম্পর্কে সত্যজিতের যে প্রবল পাণ্ডিত্য ও ঝোঁক ছিল, শঙ্কু অ্যাডভেঞ্চার সিরিজের অন্যান্য গল্পে তার প্রমান থাকলেও, কম্পু গল্পটি একেবারে স্পেশাল। কারণ, কল্পনা করা যায় অনেক কিছু, বাস্তবে তা হোক আর না হোক। কিন্তু যে কল্পনা তার বাস্তবাকারকে নিয়ত ডাকে, সেই কল্পনার প্রাণশক্তি যাই হোক না কেন, সাধারণ্যে গ্রাহ্যশক্তি অনেক বেশি। সে ধরণের কল্পনা তৈরিতে সংশ্লিষ্ট ফিল্ডে সম্যক জ্ঞান এবং রসালো উদ্ভাবনী চিন্তা থাকতে হবে। ঠিক এইরকম জ্ঞান ও চিন্তার থকথকে সাদা ফুল ফুটে আছে কম্পু গল্পটির সর্বত্র। ‘কম্পু’ তাই বাংলাসাহিত্যে আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স সম্পর্কিত প্রথম কোনো মৌলিক ও পূর্ণাঙ্গ কল্পবিজ্ঞান গল্প।

আজকের যা এআই, তার কাছাকাছি ধারণার কল্পবিজ্ঞান রচিত হয়েছে হাতে গোনা কয়েকটা। যেমন- আবছা আলোর মতো প্রথম ধরা দিয়েছে এ্যামব্রোস বিয়ের্স এর লেখা ছোটগল্প- মোক্সোনস মাস্টার -এ। গল্পটি প্রথম প্রকাশত হয়েছিল ১৮৯৯ সালে। এই গল্পে দাবাখেলুড়ে একটা যন্ত্রের কথা বলা হয়েছে, যে তার স্রষ্টা অর্থ্যাৎ মোক্সোনের ইচ্ছার বাইরে গিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, গল্পটি বুদ্ধিসম্পন্ন মেশিন নিয়ে প্রথম গল্প। তার পর ১৯৪২ সালে আইজাক অ্যাসিমভের ‘রানএরাউন্ড’, ১৯৫৬ সালে অ্যাসিমভেরই “দ্য লাস্ট কোয়েশ্চেন”, ১৯৫০ সালে আর্থার সি ক্লার্কের “দ্য সেন্টিনেল”, ১৯৬৮ সালে ফিলিপ কে ডিক এঁর ‘ডু এ্যান্ড্রয়েডস ড্রিম অব ইলেকট্রিক শিপ’ উল্লেখযোগ্য। এই গল্পগুলির সবকটিতে যন্ত্র বলতে একটি রোবটিক ধাঁচ এসে যায়, অ্যাসিমভ তো রোবট শব্দটির উল্লেখ করেছেন। কম্পুও হয়তো তাই, কিন্তু সত্যজিৎ রায় তাঁর গল্পের কোথাও রোবট শব্দটি ব্যবহার করেননি। কম্পু যে রোবটের চেয়েও আরও কিছু, সম্ভবত এই বিভাজনটা স্পষ্ট করার জন্য তিনি তা করেননি। বাঙালী পাঠকের কাছে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মানুষের মতো কথোপকথন চালাতে পারা একটা যন্ত্রের স্বপ্ন তিনি তুলে ধরেছেন। সেই স্বপ্ন আজ বাস্তবতা লাভ করেছে। আজ সময়ের সেই সোপানে আমরা পা রেখেছি, যেখানে কথোপকথন চালাতে পারা যন্ত্র হাজির। বিয়ের্স-অ্যাসিমভ-সত্যজিতরা স্বপ্নের বাক্স মাথায় নিয়ে পা ফেলেছিলেন আকাংখার ছায়া বিছানো অনির্দিষ্ট পথে। সেই পথ আজ দিশামুখে এসে সংযুক্ত হয়েছে। পুরো মানবজাতির মাথায় তারাই স্বপ্নের বাক্সটা তুলে দিয়েছিলেন।…ওপেন এআই কোম্পানির ‘চ্যাটজিপিটি’ বর্তমানে একটি জনপ্রিয় চ্যাটবট। আমরা ইতিমধ্যে জেনে গেছি যে, ল্যাংগুয়েজ মডেলের এই এআই সুস্থ মানুষের মতোই কথোপকথন চালাতে পারে, তবে তা লিখে-লিখে (যেহেতু ল্যাংগুয়েজ মডেলের, তাই)। চ্যাটজিপিটি সব যুক্তিসংগত প্রশ্নের উত্তর তো দিতে পারে, এমনকি গল্প,কবিতা, উপন্যাস, রিপোর্ট. দরখাস্ত লিখে দিতে পারে সঙ্গে সঙ্গে। আরও বেশ কিছু মডেলের এআই বের হয়েছে, তার মধ্যে বর্ণনা বা প্রম্পট লিখে দিলে সেই মোতাবেক ঠিক ঠিক ছবি এঁকে দেওয়ার এআই-ও বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এ ফিল্ডে নিরন্তর গবেষণা চলছে, এবং ভবিষ্যতে এর দৌঁড় কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা বলা যায় না।

সত্যজিৎ রায় শুধু যন্ত্রের স্বপ্ন দেখাননি, স্বপ্নের যন্ত্রটি কেমন হবে তাও আকার-ঈঙ্গিতে বলে গেছেন। এটাই এখন সবচেয়ে গুরুত্ববহ। আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স মানুষকে অতিক্রম করবে, এবং এর আশ্চর্য ক্ষমতার আঁচ করতে পেরে টেক-জায়ান্টরা কেউ কেউ এখনই এর রেশ টেনে ধরতে বলছেন। কারণ এআইয়ের আচরণ নির্ধারিত হয় প্রশিক্ষণের ভিত্তিতে। খারাপ কাজের প্রশিক্ষণ দিলে খারাপ কাজই করবে। মিথ্যে বলার প্রশিক্ষণ দিলে মিথ্যেই বলবে। অনেকটা বাড়ির পোষা কুকুরের মতো। আপনি যদি আপনার পোষা কুকুরকে শিখিয়ে দেন, এই রকম চেহারার মানুষকে দেখলে কামড়াবি, কুকুরটি যেমন কামড়াবে, এআই-ও তাই। কম্পিউটার প্রোগ্রাম ভিত্তিক লেন-দেন ও নিরাপত্তা প্রক্রিয়া তছনছ করে দিতে পারে কু-মন্ত্রণা দেওয়া এআই। দেখাতে পারে মিথ্যে পথ। অর্ধ্যাৎ ভয়ানক শয়তান এআইও তৈরী করা সম্ভব। ভাবুন, সেরকম হলে এর ওপর নির্ভরশীল মানবকুল কী ভয়ানক শূন্যতায় ভূগবে! এআই বরং শুধু মানুষের মঙ্গলের জন্য কাজ করুক। মানুষ অনেক অ্যাডভ্যান্সড হয়েছে। কিন্তু সে এখনও স্পষ্ট করে জানে না, ২০১৮ সালে সান্তা মারিয়ায় ঘটে যাওয়া “দি থমাস ফায়ার”র আসল কারণ। হয়তো তার একগুচ্ছ কারণ এমন এক জায়গায় বসে আছে যেখানে মানুষের বুদ্ধি ও ইন্দ্রিয়শক্তি পৌঁছাচ্ছে না। এখানেই মানুষ এআইয়ের সহায়তা নিক। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের অশনিসংকেত এখন যেমন কোটি কণ্ঠে গুঞ্জরিত হচ্ছে, বিভিন্ন আবহাওয়া মডেল তৈরী করে তার সঙ্গে মানুষের খাপ খাওয়ানো পথ বাতলে দিক এআই। দূর-দৃষ্টি সম্পন্ন সংবেদনশীল মানুষের ভয় কাটাক। ফসিল ফুয়েলের বিকল্প তৈরী করে গ্রিনহাউজ গ্যাস কমাতে পথ দেখাক, সোলার রেডিয়েশনের মাত্রা নিরীক্ষা করে তাকে সহনীয় করার বস্তু তৈরী করুক। চিকিৎসা, মানবিক মূল্যবোধ বৃদ্ধি, শিল্প-সংস্কৃতি-ইতিহাস-ঐতিহ্য রক্ষা এমনকি ভাঙনের হাত থেকে পরিবারগুলোকে বাঁচানোর ক্ষেত্রেও এআইয়ের তৎপরতা সমানভাবে আকাঙ্খিত।…আশ্চর্য এই যে, এই সকল আকাঙ্খা বর্তমানে অনুভূত হলেও, সত্যজিৎ রায় আগে-ভাগেই তা ব্যক্ত করে গেছেন। কম্পু ভূমিকম্পের স্থান, সময় ও মাত্রা আগেই বলে দিতে পারে। সৃষ্ট চরিত্রের মথ্যে এই ক্ষমতা দিয়ে, সত্যজিৎ রায় আদতে তো ভবিষ্যত যন্ত্রের কাছ থেকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার ক্ষমতাই আশা করেছেন। তিনি যন্ত্রের মধ্যে মানবিক সারল্যও আশা করেছেন; কম্পু ছোট বাচ্চাদের মতো পলাটু খেলতে বেরিয়ে আসে, ‘কু-উ’ শব্দ করে ধন্দ-কৌতুক জাগিয়ে দেয়।

কম্পু গল্পে যন্ত্র কিডনাপিংয়ের ঘটনা ঢুকিয়ে সত্যজিৎ রায় আজকের দিনের জন্য একটা বড় সতর্কতা জারি করে দিয়েছেন। স্টাবল ও সৎ উদ্দেশ্যের এআইকে ভেঙে দেওয়ার জন্য তো অবিরাম চেষ্টা চলবে। মানুষে-মানুষে, কোম্পানিতে-কোম্পানিতে, রাষ্ট্রে-রাষ্ট্রে সে চেষ্টা চলতেই থাকবে। নিরপত্তা ও স্বার্থ, ক্রোধ ও অহমিকা, লোভ ও ব্যবসা- এ ধরনের চেষ্টাকে উস্কে দেবে। সে ক্ষেত্রে তা হবে এক প্রকার কিডন্যাপিং-ই।

যন্ত্র যেন কোনো দর্শনকে না ভাঙে, চিরায়ত কোনো বিশ্বাস ও মুল্যবোধকে যেন অশ্রদ্ধা না করে- কম্পু গল্পে তারও ঈঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। গল্পে জাপানের বিখ্যাত মনিষী তানাকা’র সঙ্গে শঙ্কুর আলাপকালে শঙ্কুর অভিব্যক্তিতেই তা প্রকাশ পায়। এআই বিকাশের এই প্রাথমিক স্তরে আজকের দিনে নীতির আওতা ঠিক করতে এ বিষয়টি নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। এই নীতির বিষয়ে কম্পু গল্পে পরিষ্কার ধারণাও দেওয়া আছে। শঙ্কুর জবানীতে তা এখানে ছোট ছোট আকারে তুলে ধরা হল – ‘শুধু তথ্য পরিবেশন নয়, কম্পুর বিবেচনার ক্ষমতাও আছে।…কম্পুর যেটা ক্ষমতার বাইরে তা হল চিন্তা শক্তি, অনুভব শক্তি আর অলৌকিক শক্তি।…’ উইংফিল্ডের মতো অসৎ মানুষকে কম্পু আগেভাগে চিনতে পারে। তাকে সাবধান করে দেয়। এসবই এআই সংক্রান্ত নীতিগত কাঠামো তৈরীতে প্রয়োজ্য। আমরা যারা এআইয়ের কনসাসনেস আছে বলে গলা ফাটাচ্ছি, তাদের জানা উচিত যে, সেটা যন্ত্রের কনসাসনেস পর্যন্তই, তার বাইরে নয়। সেটা কম্পুর ওই ঠিক “বিবেচনা শক্তি”র মতো। তার এমন কোনো অলৌকিক ক্ষমতা দেখানোও উচিত নয়, যাতে তিনশ মানুষের কাজ একাই করে পৃথিবীতে অসংখ্য মানুষকে কর্মহীন করে দেয়।

কম্পু গল্পের আরেকটি আশ্চর্য দিক এই যে, সেখানে যে যন্ত্রের কথা বলা হয়েছে তা আমরা এখন দেখছি, আর তার যে পরিবর্তিত রুপের কথা বলা হয়েছে তা ভবিষ্যতের মানুষ দেখবে। এ কথা বলছি এই কারণে যে, এআইয়ের যে সিঙ্গুলারিটি তত্ব সামনে আসছে, তাতে এটা স্পষ্ট যে ভবিষ্যতে সুপার এআই চলে আসবে। সেই এআই প্রয়োজনে নিজে থেকেই নিজেকে পরিবর্তন করে নেবে, মানুষ তা পারবেও না। শঙ্কুর বর্ণনায় রয়েছে, ‘কিন্তু কম্পু এখন যে চেহারা নিয়েছে সেরকম যন্ত্র মানুষ কোনোদিনও তৈরি করতে পারবে কিনা সন্দেহ…।’

গল্পের শেষ দিকে কম্পু বলে, ‘শুধু একটা জিনিস আমার জানতে হবে, আমি মানুষ নই আমি যন্ত্র।’ সেটা কী জিনিস শঙ্কু জানতে চাইলে কম্পু নিরুত্তর থাকে, বলে না। গল্পের একেবারে শেষে কম্পু বলে,  ‘মৃত্যুর পরের অবস্থা আমি জানি।’ এই ঘোষণার সঙ্গে কম্পুর সেই নিরুত্তরের উত্তর আমি খুঁজে পাই, আর তা হল-কার ইচ্ছায় সে তৈরি হয়েছে। সে কি কোনো মহাইচ্ছা? যা এই মহাজগতকে নিরন্তর অমঙ্গলের অযুত বিচিত্র ফাঁদ থেকে বাঁচিয়ে জীবন ও মঙ্গলের দিকে ধাবিত করছে। এর উত্তর অষ্পষ্টই থাক।

২৯ এপ্রিল, ২০২৩, সাতক্ষীরা