উপন্যাস
১৯৭১-র ২৫ মার্চ থেকে পাকিস্তানি জান্তা বাঙালিদের নির্বিচারে হত্যা করা শুরু করলে মানুষগুলো হঠাৎই নাম বদলে নতুন অভিধা পায়- ‘শরণার্থী’। শুরু হয়ে যায় হাবুডুবু-জীবন। বারবার ডুবে যাওয়া, আবার ভেসে ওঠা। শরণার্থীজীবনে প্রবেশ করে দীপ্তি ও তার পরিবারের সকলের জীবনকে ঘিরে ঘটে যাওয়া নানাবিধ ঘটনাই এ উপন্যাসের উপজীব্য।
স্বাধীনতাযুদ্ধে স্বজনহারা একদঙ্গল মানুষের অসহায়ত্ব, বেদনাবিধুর হৃদয়ের করুণ আহাজারি পলে পলে যে মানুষগুলোকে দহন করেছে তারই একটি হৃদয়বিদারক চিত্র উপস্থাপন করবার চেষ্টা করা হয়েছে কাহিনিতে।
উপন্যাসটির রচনাকাল ১৯৯৬-১৯৯৮ সাল।
সিরাজুল ইসলাম
প্রসঙ্গ-কথা
১৯৭১। যুদ্ধের বছর। প্রথমদিকেই রাজাকার রজব আলি ও তার দলবল দীপ্তিদের গ্রাম বাগেরহাটের বেতাগা লুট করে। দীপ্তিদের বাড়িও বাদ যায় না। সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েন দীপ্তির বাবা শৈলেন দাশ। অবশেষে প্রাণের ভয়ে তাদের পুরো পরিবার গ্রামের অন্য মানুষের সাথে ভারতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। মুহূর্তেই মানুষগুলোর পরিচয় পাল্টে যায়। নতুন নাম পায়- ‘শরণার্থী’। শুরু হয় হাবুডুবু-জীবন। ডুবে যাওয়া আবার ভেসে ওঠা। তবু শেষরক্ষা হয় না। গ্রাম থেকে বহুদূরে খুলনার চুকনগরে ভদ্রা নদীর পাড়ে খানসেনাদের হাতে শত শত মানুষের সঙ্গে পাকবাহিনীর গুলিতে নির্মমভাবে নিহত হন দীপ্তির বাবা শৈলেন দাশ, দাদু মতিলাল দাশ, দুই কাকা- তপন দাশ ও বিধান দাশ। বেঁচে থাকে দীপ্তি, মা পারুলবালা, ছোটোবোন তৃপ্তি, ছোটোভাই গৌতম ও ঠাকুরমা হরিদাসি দাশ।
এদিকে দীপ্তির প্রেমিক রণজিতপুরের রাজেন তরফদার পরিবারের সবাইকে হারিয়ে আগেই তার বন্ধু হাফিজুর রহমানকে নিয়ে ভারতে পৌঁছে যায়। সেখানে বসে শুনতে পায় দীপ্তিদের পরিবারের কেউ বেঁচে নেই। চুকনগর হত্যাকাণ্ডে শত শত মানুষের সঙ্গে তারাও নিহত হয়েছে। মা-বোনহারা রাজেন দীপ্তিদের করুণ পরিণতির কথা শুনে নিজেকে আর সামলাতে পারে না। মুক্তিবাহিনীতে নাম দিয়ে চলে যায় বিহারের দেরাদুনে, ট্রেনিংয়ে। এদিকে হাফিজ ফিরে এসে দীপ্তিদের ভারতে যেতে সাহায্য করে। রাজেন বিহারে চলে যাওয়াতে তার সঙ্গে আর কারও দেখা হয় না। হাফিজও মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়, সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধ করে। তবে এক যুদ্ধে পায়ে গুলি লেগে আহত হয়।
ট্রেনিংশেষে রাজেন চলে যায় যুদ্ধে। স্বাধীনতার সূর্য যখন উঠি উঠি করছে তখন হাফিজই একদিন রাজেনকে নিয়ে আসে দীপ্তিদের শরণার্থীশিবিরে। ট্রাকের ওপর লাল-সবুজ পতাকায় মোড়া ফুলে ফুলে ঢাকা তার কফিন। কয়েকদিনের জ্বরে তৃপ্তিও ইতিমধ্যে সবাইকে ছেড়ে চলে গেছে।
এসব দেখে আর স্বাভাবিক থাকতে পারে না দীপ্তি। জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। কিছুই আর বলতে পারে না।
১.
‘পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়-
ও সেই চোখের দেখা, প্রাণের কথা, সে কি ভোলা যায়!’
গৌতমের চিঠিটা পেয়ে দীপ্তির চোখে জল এসে যায়। একটানা পড়ে ফেলে চিঠিটা। পড়তে বেশি দেরি করলে চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়তে পারে। কেউ দেখে ফেললে বিব্রতকর অবস্থায় পড়বে সে। সহকর্মীদের কেউ শুনতে চাইবে, অফিসে বসে কান্না কেন? নিশ্চয়ই স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে। অথবা জানতে চাইবে, চিঠিতে কোনো দুঃসংবাদ আছে কিনা? দীপ্তি এসব ঘটনা আর স্মরণ করতে চায় না। সবসময় ভুলেই থাকতে চায়। দীপ্তি জানে, একই স্বপ্ন রাতের পর রাত দেখলে সেটা বিবর্ণ হয়ে যায়। কিন্তু চোখের সামনে বাবা, দাদু ও কাকাদের হারিয়ে যাওয়ার সেই দৃশ্য যখনই তার মনে পড়ে স্বাভাবিক থাকতে পারে না। সে যে অফিসের টেবিলে কাজ করছে তা আর মনে থাকে না। কেঁদে ফেলে হঠাৎ করে। কেউ জিজ্ঞেস করলে বা কান্নার কারণ জানতে চাইলে বলতে চায় না। মেয়েমানুষ বলে কেউ জোরাজুরিও করে না। এসব কথা বসের কানে গেলে তিনি দীপ্তিকে ডেকে বাসায় যেতে বলেন। দু-একটি কথায় এটা ওটা জিজ্ঞেস করে কান্নার আসল কারণ জানবার চেষ্টা করেন। কিন্তু দীপ্তি বলে না। বলতে চায় না। তার কষ্ট হয়। বলতে গেলে হয়তো এলোমেলো হয়ে যাবে সব। অঝোরে অশ্রু গড়িয়ে পড়বে দু চোখ থেকে। কোনো বাঁধা মানবে না।
গৌতম লিখেছে- ‘দিদি, চুকনগর থেকে ফিরোজের একটি চিঠি পেয়েছি। চুকনগর গণহত্যা স্মরণে ২০ মে সেখানে প্রতিবারের ন্যায় একটা শোকসভা হবে। এবারের শোকসভায় মুক্তিযুদ্ধের ১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার ও অস্থায়ী সরকারের রাষ্ট্রপতির সাবেক উপদেষ্টা মেজর (অব) রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম ও মুক্তিযুদ্ধের ৮ নম্বর সেক্টর কমান্ডার কর্নেল (অব) আবু ওসমান চৌধুরী উপস্থিত থাকবেন। গতবার যেতে পারিনি। এবার আমি যাব। আমাদের বাবা, দাদু ও কাকারাসহ শত শত শহিদদের স্মরণে চুকনগরে কিছু একটা হচ্ছে জেনে খুব ভালো লাগছে। তবে দিনটি যতই এগিয়ে আসছে ততই খারাপ লাগছে। মনে পড়ছে সবার কথা। আমি ২০ মে চুকনগর থাকব। তাই এ বছর ওইদিনে তোদের সাথে বাড়িতে থাকতে পারব না। তুই দাদাবাবুকে নিয়ে বাড়ি যাস। মা তো একা থাকে। মা-র পাশে থাকিস। আমি ২১ তারিখে যাব। মাকে বলিস চুকনগরের শোকসভার কথা। মা যেন বেশি কান্নাকাটি না করেন।’
দীপ্তি টেবিলের ড্রয়ার থেকে ভ্যানিটি ব্যাগ বের করে চিঠিটা তার মধ্যে রাখে। চুকনগরে শোকদিবস পালন কর্মসূচির কথা সে শুনেছে। পোস্টারিং হয়েছে। পোস্টারের ওপরের দিকে লেখা- ‘চুকনগরে একাত্তরের ট্রাজেডি’। খানসেনাদের হাতে একদিনে একই স্থানে শত শত মানুষের করুণ মৃত্যু। তাদের স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। আর প্রতিবছর এভাবে পালিত হয়ে আসছে চুকনগর গণহত্যা ৭১ স্মরণে শোকসভা।
গৌতম রাজশাহী ইউনিভার্সিটিতে পড়াকালীন ফিরোজের সঙ্গে একবার চুকনগরে এসেছিল। ফিরোজ তার বন্ধু। বাড়ি চুকনগরেই। গৌতম তার সঙ্গে সমস্ত ঘটনা খুলে বলে। ফিরোজ গৌতমকে চুকনগরে নিয়ে যায়। দুদিন ছিল সেখানে। স্মৃতির আয়নায় জ্বলজ্বল করে ওঠে সবকিছু। ঘুরেঘুরে জায়গাটি চেনার চেষ্টা করে সে। ভদ্রা নদী অনেক শুকিয়ে গেছে। মরা কঙ্কালসার খালের চেহারা পেয়েছে। আশেপাশে কত মানুষের বসতবাড়ি গড়ে উঠেছে। কী জঙ্গলই-ই না ছিল এখানে! কিছুই চিনতে পারে না গৌতম। না পারারই কথা। কতটুকুইবা ছিল সে। কোনোকিছু ভালো করে বুঝবার বয়স হয়নি তখন তার। বাচ্চা। নিষ্পাপ শিশু।
জল্লাদ খানসেনাদের হাতে দীপ্তি আর গৌতমের সামনেই নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন তাদের বাবা শৈলেন্দ্রনাথ দাশ, দাদু মতিলাল দাশ, দুই কাকা- বিধান দাশ ও তপন দাশ। সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান দীপ্তির মা পারুলবালা দাশ, ঠাকুরমা হরিদাসি দাশ, আর-এক দাদু মতিলালের স্ত্রী পাচিবালা দাশ, কাকিমা রেখা রানি দাশ, কাকির কোলের শিশুসন্তান তরুণ, ছোটোবোন তৃপ্তি। তৃপ্তি সেদিনের সেই হত্যাযজ্ঞ থেকে রেহাই পেলেও পরবর্তীতে নিয়তি তাকে ছাড়েনি। ভারতে ওর মৃত্যু হয় শরণার্থীশিবিরে। সান্নিপাতিক জ্বরে।
দীপ্তি আর অফিসের কাজে মন বসাতে পারে না। আনমনা হয়ে পড়ে সে। অফিসে বস্ নেই। তাই তার এক সহকর্মীকে বলে বাসায় চলে আসে। গৌতমের চিঠিটা আজ তার সব কাজ ওলটপালট করে দিয়েছে। দিনটাই মাটি হয়ে গেছে।
দীপ্তি বাসায় ফিরে গরম এককাপ চা খায়। কাজের মেয়েটাকে বলে বাচ্চাটাকে খাওয়াতে। এখন আর কিছু ভালো লাগছে না। দুটো বাজে। ঠিক করেছে খাবে না সে। কাঁদবে সারাদিন ধরে? না, কাঁদবে না। কাঁদছে সেই পনেরো বছর বয়স থেকে। অনেক চোখের জল ঝরিয়েছে। কিন্তু তার যেন কোনো শেষ নেই। সত্যি সত্যি চোখে কী সাগর আছে! এত জল আসে কোত্থেকে? কোনো কিছুতেই মন বসছে না তার। একসময় কাজের মেয়েটাকে খেয়ে নিতে বলে। সোনাতনের ফিরতে আজ দেরি হবে। রাতও হতে পারে। অফিসে তার নাকি জরুরি কাজ আছে। ফরেন ডেলিগেট আসবে। তাদের নিয়ে চিংড়ি মাছের হ্যাচারি দেখাতে নিয়ে যাবে।
প্লাবনকে নিয়ে একটুখানি শোয় দীপ্তি। সারাদিন সে কাজের মেয়েটার সঙ্গে থাকে। ছুটির দিন ছাড়া এ সময় মাকে পাবার কথা নয় প্লাবনের। তাই অযাচিত মায়ের পরশ পেয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ে সে। দীপ্তির চোখে ঘুম নেই। এক মহা-অমানিশায় আচ্ছন্ন তার মনটা। বারবার একটা নাম মনে দোল খায়- চুকনগর! চুকনগর! দীপ্তির কাছে এখনও আতঙ্কের একটি নাম। এখনও নামটি শুনলে তার অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। খুলনা, যশোর ও সাতক্ষীরা- এই তিন জেলার মিলনস্থল। পুরনো মোকাম, ব্যবসাকেন্দ্র। চুকনগর থেকেই শুরু হয়েছে দক্ষিণে সাতক্ষীরা, পূর্বে খুলনা এবং পশ্চিমে যশোর। রাস্তাঘাট মোটেই উন্নত ছিল না। খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়কটি তখন ছোট্ট পরিসরের ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিলের রাস্তা। সাতক্ষীরা পৌঁছতে চার-পাঁচটি নদী পেরুতে হতো নৌকোয়। খুলনা-সাতক্ষীরাগামী রাস্তার মতো একটি পাকা সড়ক তখনও ছিল চুকনগর থেকে যশোরমুখী। হাজার-হাজার মানুষ জড়ো হয়েছিল চুকনগরে সেদিন। কেউ হেঁটে, কেউ নৌকোয়। পথচলার ক্লান্তিতে কেউ আর হাঁটতে পারছিল না। চুকনগরে বড়ো বাজার পেয়ে ডাল-চাল দিয়ে রান্নাবান্না করে খাওয়াদাওয়ার সাথে একটু বিশ্রাম নিতে মানুষগুলো দলে দলে ভাগ হয়ে বসেছিল।
গৌতম এই প্লাবনের মতই ছিল। ঠিক এই বয়সের। মা সারাক্ষণ সংসারের কাজে ব্যস্ত থাকতেন বলে গৌতম বেশিরভাগ সময় বাবার কোলে থাকত। সেদিনও সে বাবার কোলেই ছিল। দীপ্তি আর তৃপ্তি ছিল মার পাশে। বুটের একটা লাথি মেরে গৌতমকে বাবার কোল থেকে সরিয়ে দেয় খাকি পোশাকের এক জল্লাদ। তারপর গুলি করে। প্রথমে পড়ে যান বাবা, তারপর দাদু, তারপর দুই কাকা। তৃপ্তি দেখেছিল রক্তের বন্যা। আতঙ্কিত হয়ে উদভ্রান্তের ন্যায় ছুটে গিয়েছিল দীপ্তির কাছে। বলেছিল- ‘দিদি দিদি, চোখ খোল, দেখ রক্ত। কেউ বেঁচে নেই।’ দীপ্তি চোখ খুলতে পারেনি। হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিল সে। রক্তের বন্যা সে দেখতে চায়নি। দেখতে চায়নি বাবার মৃত মুখ, দাদু-কাকাদের নিষ্প্রাণ রক্তাক্ত দেহ। বিধান কাকা প্রথমে মরেননি। খানসেনারা চলে গেলে তিনি জল চেয়েছিলেন। ঠাকুরমা একটু জলের জন্য কী চেষ্টাটাই না করেছিলেন! কিন্তু জল জোগাড় করতে পারেননি। মা-র কোনো হুঁশ ছিল না। বেহুঁশ হয়ে পড়ে ছিলেন লাশের পাশে। ঠাকুরমা খালি হাতে ফিরে এসে দেখেন বিধান কাকা আর জল চেয়ে কাতরাচ্ছেন না। নিথর হয়ে গেছে তার দেহ। তখন তিনি হাতে একটি ইটের টুকরো নিয়ে নিজের মাথায় মারতে থাকেন। বিলাপ করতে করতে একসময় তিনিও অজ্ঞান হয়ে পড়েন। কাকিমা কোলের বাচ্চাটিকে নিয়ে কাঁদছে। তৃপ্তি কাঁদছে, গৌতম কাঁদছে। গুলির প্রচ- শব্দে শিশু তরুণ অথর্ব। কাঁদছে না সে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে লাশগুলোর দিকে। সে জানে না কী ঘটেছে, আর কী ঘটছে। জানবার বা বোঝবার মতো বয়স হয়নি তার।
প্লাবন নড়ে ওঠে। তার মুখের ওপর দীপ্তির দুফোটা অশ্রু পড়েছে। দীপ্তি সেটা শাড়ি দিয়ে মুছে দেয়। সেই সাথে চোখদুটোও মুছে ফেলে। চারটে বাজে। তবুও খিদে নেই দীপ্তির। খেতে ইচ্ছে করছে না। গীতা দুবার এ ঘর থেকে ঘুরে গেছে। সাথী স্কুলে। দীপ্তির বড়ো মেয়ে। এখনও ফেরেনি। গীতা পরিবেশের আবহাওয়া বুঝে দু-একবার দীপ্তিকে জিজ্ঞেস করেছে-‘দিদি, খাবেন না?’
– ‘না গীতা। আমি এখন কিছু খাব না। তুই খেয়েছিস?’
– ‘না।’
– ‘বলিস কী! চারটে বাজে এখনও খাসনি! খেয়ে নে। শিগ্গির খেয়ে নে।’
দীপ্তির অফিসফেরতা কাপড়চোপড় গোছাতে গোছাতে গীতা জিজ্ঞেস করে, ‘অফিসে আজ কি কিছু হয়েছে? একবেলা করে চলে এলেন যে!’
– ‘না গীতা, অফিসে কিছু হয়নি। এমনি মনটা খুব খারাপ।’
– ‘চা দেবো? চা খাবেন?’
– ‘আরেকটু বেলা যাক। পাঁচটার দিকে চা আর মুড়ি দিস। এখন এক গেলাস জল দে।’ হাই তোলে দীপ্তি।
জল দিয়ে গীতা তার কাজে চলে যায়। খুব বিশ্বস্ত কাজের মেয়ে সে। ছোটোবেলা থেকে আছে দীপ্তির সাথে। যেখানে বদলি হয় তারা সেখানেই যায়। আপত্তি করেনি কোনোদিন। সারাদিন টুকটাক কাজ করে আর প্লাবনকে রাখে। প্লাবন তার কাছেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে বেশি। তাই দীপ্তির কোনো অসুবিধে হয় না। সে নিশ্চিন্তে থাকে। স্কুল থেকে ফেরবার সময় হয়েছে সাথীর। সকালে তাকে ও প্লাবনকে খাইয়ে দীপ্তি অফিসে চলে যায়। আর ফেরে বিকাল সাড়ে পাঁচটা-ছটার দিকে। সোনাতনও তাই। সকালে বেরিয়ে পড়ে। তার ফিরতে আরও দেরি হয়। কোনো-কোনোদিন সন্ধে হয়, রাতও হয়। দীপ্তি মাঝে মাঝে টিফিন নেয়। যেদিন নেয় না সেদিন দুপুরের দিকে কোয়ার্টার পাউ- ব্রেড ও একটি ভেজিটেবল রোল খেয়ে নেয়। কোনো-কোনোদিন অন্যকিছু। তবে সাথী ও সোনাতনের জন্য টিফিন দিতে সে ভুল করে না।
একটি পাত্রে কিছু মুড়ি, দুটো টোস্ট ও এক গেলাস জল দীপ্তির ঘরে দিয়ে গীতা চা আনতে যায়। এসে দেখে দীপ্তি আনমনা হয়ে মুড়ি চিবুচ্ছে। আর কিছু ছোঁয়নি। গীতা চায়ের কাপটা রাখলে দীপ্তি গেলাস থেকে দু ঢোক জল খেয়ে চায়ের কাপে চুমুক দেয়। খুব বিষণ্ন লাগে তার। মানুষ কত নির্মম ও পাষাণ হতে পারে তাই ভাবে। সেদিন ছিল বুধবার। একাত্তরের ২০ মে। বেলা এগারো কী সাড়ে এগারোটা। যশোরের দিক থেকেই নাকি এসেছিল জল্লাদেরা। চোখের সামনে শত শত মানুষকে লাশ বানিয়ে চলে গেল। কোনো অন্ত্যেষ্টি বা সৎকার করা হয়নি। লাশ পচে দুর্গন্ধ ছড়াবে তাই স্থানীয় কিছু মানুষ সাহস করে এসে সন্ধের দিকে নদীর ধারে অনেক গর্ত খোঁড়েন। প্রতি গর্তে দশ-পনেরো-বিশটি করে লাশ ফেলে মাটিচাপা দেয়। তবে কেউ জানে না কত মানুষকে সেদিন গণকবর দেওয়া হয়েছিল। বহু মানুষকে নদীতে ভাসিয়েও দেওয়া হয়।
ভদ্রা নদীর তখন ভরা যৌবন। জীবন বাঁচানোর জন্য অনেকে নদীতেও ঝাপ দেন। কিছু মানুষ প্রাণে বাঁচলেও অধিকাংশ মানুষ মেশিনগানের গুলি খেয়ে ভেসে চলে যায়। কেউ কেউ গাছে ওঠে বাঁচতে। পারেনি। খুঁজে খুঁজে পাখির মতো গুলি করে মারা হয় তাদের। গাছের ডালেও ঝুলে ছিল অনেক লাশ। এসব ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে পড়ে দীপ্তি।
– ‘আজ আপনার কী হয়েছে দিদি?’ গীতা নিঃশব্দে দীপ্তির পাশে বসে ঘনিষ্ট হয়। তারপর বড়ো আন্তরিকভাবে জিজ্ঞেস করে।
– ‘কই কিছু হয়নি তো!’ দীপ্তি স্বাভাবিক কণ্ঠে উত্তর দেয়।
– ‘তবে কিছু না খেয়ে কাটালেন যে!’
– ‘ও এমনি!’ তারপর বলে, ‘আমি একটু শুচ্ছি। ঘুম এলে যেন ডাকিসনে। আর তোর দাদাবাবু এলে খেতে দিস। রাতে রুটি খাবে তোর দাদাবাবু। প্লাবন উঠলে ভাত খাওয়াস। দেখিস যেন কাঁদে না।’
সন্ধে হয়ে আসে। একটুখানি ঘুম এসেছিল দীপ্তির। কিন্তু প্লাবনের ডাকে ঘুম ভেঙে যায়। সাথে সাথে গীতা এসে প্লাবনকে নিয়ে গেছে ঠিকই, কিন্তু চোখে আর ঘুম আনাতে পারেনি দীপ্তি। চুপচাপ শুয়ে আছে। আর নানান কিছু ভাবছে। মা ও ঠাকুরমার কথা মনে হচ্ছে বারবার। জীবনে কী কষ্টটাই না করেছেন তারা। অথচ বিয়ের পর কিছুই করতে পারছে না দীপ্তি তাদের জন্য। বিয়ে হয়ে গেলে মেয়েরা পর হয়ে যায়। বাপের বাড়িতে আর তেমন ঠাঁই থাকে না, অধিকার থাকে না। ঠাকুরমা হরিদাসি মারা গেলেন গত বছর। দীপ্তি চাকরি পাবার পর তার জন্য অনেককিছু করেছে। বিয়ের আগে দীপ্তি তার ঠাকুরমাকেই নিজের কাছে রাখত। তিনিই ছিলেন দীপ্তির চাকুরিজীবনের গার্জিয়ান। মা ছিলেন গ্রামের বাড়িতে। এখনও সেখানেই থাকতে হয় তাকে। গৌতম রাজশাহী ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করে চাকরি পাবার পর বাড়িতে খরচ দেওয়ার ব্যাপারে কিছু চিন্তা কমেছে দীপ্তির। কিছুটা লাঘব হয়েছে তার। ব্র্যাক-এ চাকরি করে গৌতম। ফরিদপুর পোস্টিং। মা ছাড়া গ্রামের বাড়িতে আর কেউ নেই। অথচ তাদের সংসারে কত লোক ছিল। আনন্দ ছিল। উৎসব ছিল। হইহই রইরই ছিল। ডিসেম্বরের শেষে ভারত থেকে ফেরার পর তাদের ঘরবাড়ির কোনো চিহ্ন পায়নি তারা। শ্মশানের মতো পোড়া কাঠ কয়লার কিছু স্তূপ ছিল। রাজাকাররা তাদের ঘরবাড়ির সবকিছু লুট করেও ক্ষান্ত হয়নি। আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। লুটপাটের পর অবশিষ্ট যা ছিল ভস্ম হয়ে গিয়েছিল আগুনে। সেই শ্মশান থেকেই শুরু হয়েছে যাত্রা, যুদ্ধ। রণক্লান্ত সৈনিক পারুলবালা দাশ তবু পরাজিত হননি। বৈধব্যের যন্ত্রণা ভোগ করবার পাশাপাশি দুই সন্তান দীপ্তি ও গৌতম এবং শাশুড়ি হরিদাসি দাশকে নিয়ে নতুন করে শুরু করলেন বেঁচে থাকার সংগ্রাম। জীবনের সংগ্রাম। জীবনযুদ্ধের সংগ্রাম।
রাত সাড়ে ন-টার দিকে ফেরে সোনাতন। এসেই বুঝতে পারে আজকের দীপ্তি অন্যদিনের মতো উজ্জ্বল নেই। গীতা-ই বলে সব। দিদি কখন ফিরেছে, কী খেয়েছে না খেয়েছে ইত্যাদি। মনটা খারাপ। কথা বলছে কম। সারাক্ষণ শুয়ে আছে। কিন্তু এসবের কারণ বলতে পারে না সোনাতনের সঙ্গে।
সোনাতন দীপ্তির পাশে যায়। শুনতে চায় একনাগাড়ে সবকিছু। ততক্ষণে দীপ্তি অনেক সামলে নিয়েছে নিজেকে। সে সোনাতনের ডাকে উঠে পড়ে। গীতাকে ডেকে রুটি বানানো হয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করে। প্লাবন খেয়েছে কিনা, কখন থেকে ঘুমুচ্ছে, সাথী কী করছে, পড়েছে কিনা, কতক্ষণ পড়েছে, সব শুনে নেয়। তারপর গীতাকে টেবিলে খাবার দিতে বলে। সাথীকে ডাকে। সোনাতন হাত-মুখ ধুয়ে নেয়। চেয়ারে বসে রুটির প্লেটটা টান দেয়। দীপ্তি ভাজি আর হালুয়ার পিরিচ দুটো সোনাতনের দিকে এগিয়ে দিয়ে নিজে একটা প্লেটে ভাত নেয়। রুটি খেতে পারে না সে। পাঁচ-ছটা রুটি খেলেও তার মনে হয় কিছুই খাওয়া হয়নি। তাই তিন বেলাই ভাত খায়। মাঝে মাঝে দু একদিন বাদ যায়। অফিসে দুপুরের খাবার নিতে আলসেমি ধরলে এটা-ওটা খেয়ে নেয়।
রুটি ছিঁড়তে ছিঁড়তে সোনাতন জিজ্ঞেস করে- ‘কী ব্যাপার, গীতা বলল, আজ নাকি দুপুরেই ঘরে ফিরেছ? অফিস করোনি?’
– ‘না, মনটা খারাপ লাগছিল তাই চলে এসেছি।’
– ‘কেন, কী হয়েছে? অফিসে কোনো গোলমাল-টাল না কি?’
– ‘না, অফিসের কোনো ব্যাপার নয়।’
– ‘তবে?’
– ‘না, তেমনকিছু না। এমনি চলে এসেছি। মনটা ভালো লাগছিল না।’
– ‘ব্যাপারটা কী, একটু খুলে বললেই তো হয়! বুঝতে পারি।’
– ‘আগে খেয়ে নাও তারপর বলব।’
– ‘প্লাবন খেয়েছে তো?’
– ‘হ্যাঁ! গীতা তাকে খাইয়েছে।’
– ‘তুমি তো সারাদিন কিছু মুখে দাওনি?’
– ‘চা-মুড়ি খেয়েছি। তবে ভাত খাইনি।’
খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে সোনাতন ঘরের সোফায় বসে। পাশে সাথী। দীপ্তি সবকিছু গোজগাজ করে বালিশের নিচ থেকে চিঠিটা বের করে সোনাতনের হাতে দেয়। সোনাতন দেখে গৌতমের চিঠি। ফরিদপুর থেকে লিখেছে। তাকে আর কিছু বলতে হয় না।
দীপ্তিও সোনাতনের পাশে বসে। মুহূর্তের জন্য অতীতের সেই আলো ঝলমলে দিনে ফিরে যায়। বেতাগায় তাদের ঘরের দেয়ালে কাঁচের একটি ফ্রেমে বাঁধাই করা লেখাতে তার চোখ আটকে যায়-
ভালো যেবা হয় বাক্যে
কার্যে কল্পনায়,
ভাগ্যদেবী নিজে তাকে
খুঁজিয়া বেড়ায়।
২.
‘বিষম পুড়ছে চতুর্দিকে ঘরবাড়ি’
বেতাগা থেকে পাঁচ-ছয় মাইল দূরের গ্রামটির নাম রণজিতপুর। গ্রামটি বেশ বড়ো এবং সেটিতে অনেক অবস্থাপন্ন লোকের বাস। গ্রামটির চারিপাশে নদী। দক্ষিণ ও পূর্বে জৌখালি নদী। উত্তরে হাকিমপুর গ্রামের সঙ্গে স্থলপথের সংযোগ, পশ্চিমে ভোলা নদী ও সন্ন্যাসী খাল। অদ্ভুত এই গ্রামটিতে ঢোকবার সাতটি রাস্তা আছে। তবে একটিমাত্র সড়ক গেছে গ্রামের মধ্য দিয়ে। গ্রামের মানুষের চলাচলসহ বাইরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে ওই সড়কটি।
একদিন ভোরবেলা। পাখ-পাখালির কিচিরমিচির শব্দ তখনও থামেনি। সূর্য উঠি উঠি করছে। গ্রামবাসীদের অনেকেই ঘুম থেকে উঠেছে। আঁধারের ঘোর তখনও পুরোপুরি কাটেনি। প্রচ- গরম পড়েছে রাতে। দু-একজন রাস্তায় এসে আড়ামোড়া খাচ্ছে। খালি গায়ে ফুরফুরে বাতাসের পরশ নিচ্ছে। পাড়ার দু-একজন কিশোরী ছোটো ঝুড়ি আর খোন্তা নিয়ে এসেছে ভেড়ির পাশ থেকে সাজিমাটি নেওয়ার জন্য। সাজিমাটি দিয়ে ঘরবাড়ি লেপা হলে যেন হেসে ওঠে।
রাস্তার পাশেই নদী। নদীর হাওয়া খেতে দু-একজন একেবারে তার কিনারে চলে গেছে। এমন ভোরবেলাতেই দুটো নৌকো আসে নদী দিয়ে তাদের দিকে। হঠাৎ রাজেনের চোখে নৌকো দুটো ধরা পড়ে। আবছা অন্ধকারে ভালো করে দেখল সবাই- দুটো নৌকো। একটার পিছনে আর-একটা। নৌকো দুটো তাদের সামনেই ভিড়ল। দুটোতে মিলে পনেরো-ষোলোজন লোক হবে। এত ভোরে গ্রামের ঘাটে অচেনা নৌকো! বিষ্ময়ের চোখ সেদিকে সবার। নৌকোর মধ্যে লোকজন আর তাদের কথাবার্তা শুনে তীরের লোকগুলো দাঁড়িয়ে গেল। তীক্ষ্ম দৃষ্টি দিয়ে তারা দেখতে থাকল নৌকো দুটো। প্রথম নৌকোর ভেতর থেকে তীরে নামল দুজন লোক। দূর থেকে বেশ বীভৎস চেহারার মনে হলো তাদের কাছে। তীরের তিন-চারজন মানুষের মন আতঙ্কিত হলো। রাজেন উঠে দাঁড়ালো ভালো করে দেখবার জন্য। কারা এরা, কী করতে এসেছে তারা? এমন সময় কতকগুলোর মুখ থেকে অশ্লীল শব্দ ভেসে এলো সবার কানে- ‘এই খানকির বাচ্চা, এখানে কী তোদের? দূর হ আমার সামনে থেকে।’
তীরের মানুষগুলো ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল। সবার মনে একটাই প্রশ্ন, কারা এরা? এমন কথা বলে কেন? ভয় ধরে যায় মনে। রাজেন রাস্তায় দয়মান পাড়ার লোকগুলোকে জোরে চিৎকার দিয়ে ডাকে, ‘ওরে কে কোথায় আছিস, এদিকে আয়! দেখ, নৌকোর লোকগুলো কী বলছে!’ মুহূর্তেই ছুটে যায় কানাই, নির্মল, দুলাল, কালিপদ, গৌর। এর মধ্যে দুটো নৌকো খালি করে পনেরো-ষোলোজন লোক তীরে নেমেছে। তাদের কারও হাতে বন্দুক, কারও হাতে লাঠি, কারও হাতে ঢাল-সড়কি। একজনের হাতে একটি রাইফেল। দূর থেকে হলেও ভালই দেখা যাচ্ছে।
নদীর পাড় থেকে এক দৌড়ে রাস্তায় আসে রাজেনসহ অন্যান্যরা। ইতিমধ্যে গ্রামের আরও কিছু মানুষ উঠে পড়েছে। অনেকেই প্রাতঃক্রিয়া সারছে। অনেকে হাওয়া খেতে রাস্তায় এসেছে। সাজিমাটি নিতে আসা কিশোরীগুলো ভয় পেয়ে দৌড়ে যে যার বাড়ি চলে যায়।
মুহূর্তের মধ্যে সারা গ্রাম জেনে যায় ডাকাত এসেছে। ডাকাত পড়েছে গ্রামে। দ্রুত জানাজানি হয়ে যায় খবরটা। বাকি সবাই ঘুম থেকে উঠে গেছে। পাখির কলবর কমে এসেছে। ভোরের লাল সূর্য উঁকি দিয়েছে।
গ্রামবাসীর প্রবল প্রতিরোধের মুখে ডাকাতরা সেদিন সুবিধা করতে পারেনি। রাস্তা পেরিয়ে গ্রামেই ঢুকতে দেয়নি ঐক্যবদ্ধ গ্রামের মানুষ। ফিরে গিয়েছিল বাগেরহাটের ত্রাস রজব আলি ও তার দলবল। গ্রামবাসীরা রজব আলির বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল লাঠিসোটা নিয়ে। অস্ত্রের বিরুদ্ধে নিরস্ত্রের যুদ্ধ। দীপ্তির মামার বাড়ি ওই রণজিতপুর গ্রামে। দীপ্তির দুই মামা অনিল ও সুধিরও রাজেনের সঙ্গে সেদিন রজব আলি গ্যাংদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছিল। তবে আহত হয়েছিল বেশ কয়েকজন। তারা গ্রামবাসীদের নিয়ে পরবর্তীতে সংগঠিত হয় এবং দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
বেশ কিছুদিন পরে রজব আলি আবার তার দলবল নিয়ে ডাকাতি করতে রণজিতপুর গ্রামে উপস্থিত হয়। ইতিমধ্যে রণজিতপুরে রাজেনের নেতৃত্বে এবং অনিল, সুধীর, সফিক, মহব্বত ও হৃষীকেশের সার্বিক সহযোগিতায় ‘গ্রাম প্রতিরক্ষা দল’ গঠিত হয়েছে। এবার গ্রামবাসীদের কঠোর প্রতিরোধের ফলে রজব আলি ও তার লোকজন নৌকো থেকে তীরে উঠতেই পারেনি। অপমানিত হয় রজব আলি। নরমাংসলোভী বাঘের মতো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে রণজিতপুরবাসীদের ওপর। চরম প্রতিশোধস্পৃহা জেগে ওঠে তার মধ্যে। ভেতরে ভেতরে ফুসতে থাকে সে। চিন্তিত হয়ে পড়ে গ্রামবাসীরা। রাজেন সবাইকে সাহস জোগায়। বাগেরহাট থানা থেকে দুজন পুলিশ আনা হয় থাকা-খাওয়ার বিনিময়ে। তারপর গ্রামের যুবকদের তিনটি ভাগে ভাগ করে গ্রাম প্রতিরক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়। একটি দলের দায়িত্ব নেয় রাজেন। অপর দুটি দল পরিচালনার দায়িত্ব পায় মহব্বত, মকবুল, অনিল, সুধীর ও হৃষীকেশ।
ইতিমধ্যে দেশে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ‘জয়বাংলা’ স্লোগানে আলোড়িত হয় সারাদেশ। রণজিতপুর গ্রাম প্রতিরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ দুজন থানায় ফিরে যায়। চারিদিকে অরাজকতা। সাধারণ মানুষের ওপর যত নির্যাতন আর অত্যাচার। পাকিস্তানিদের প্রধান টার্গেট আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী, মুক্তিযোদ্ধা আর হিন্দুধর্মাবলম্বী যারা। এই তিন শ্রেণির মানুষকে ধ্বংস ও নিশ্চিহ্ন করাই তাদের পরিকল্পনা। রণজিতপুর গ্রামের অধিকাংশ মানুষ হিন্দু। ফলে ভয়ে সবার জড়সড় অবস্থা। কখন কী হয়। ঢাকায় ব্যাপক গোলাগুলি হয়েছে। অসংখ্য মানুষ মারা গেছে। দলে দলে তাই সবাই ঢাকা ছেড়ে যে যেখানে পারছে পালাচ্ছে। রণজিতপুরের ভোলা দত্ত ও মোহন মিয়া ফিরেছে। ভোলা দত্ত চকবাজারে ব্যবসা করেন। দোকান লুট হয়ে গেছে তার একরাত্রে। মোহন মিয়া চাকরিজীবী। কিন্তু থাকতে পারলেন না। কোনো নিরাপত্তা নেই। কোনোরকমে জীবনটা নিয়ে এসেছেন তারা। রণজিতপুরের আরও বেশ কয়েকজন চাকরি করেন ঢাকায়। তারাও ফিরেছেন। শেখ মুজিবকে ধরে নিয়ে গেছে পাকিস্তানে। আওয়ামী লীগের নেতা-সমর্থকদের ব্যাপক ধরপাকড় চলছে। মারা হচ্ছে, গুম করা হচ্ছে। আর হিন্দু হলে তো রক্ষে নেই। শেখ মুজিব স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন। পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন বাংলা ঘোষণা করেছেন। ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে তাঁর ভাষণের শেষে বলেছেন- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
সারাদেশ এখন শেখ মুজিবের আহবানে উদ্বেল। স্বাধীনতাসংগ্রামের উত্তাল তরঙ্গে মুখরিত মানুষ। সেই সাথে বয়ে যাচ্ছে রক্তের গঙ্গা। চট্টগ্রামস্থ কালুরঘাটে সদ্য প্রতিষ্ঠিত ‘বিপ্লবী স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র’ থেকে প্রচারিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। প্রচার করেছেন মেজর জিয়াউর রহমান। চারিদিকে যুদ্ধের সাজ সাজ রব। প্রাণের ভয়ে দলে দলে মানুষ ভারতে চলে যাচ্ছে। কী হিন্দু কী মুসলমান কেউ থাকছে না।
১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়েছে মেহেরপুরের আ¤্রকাননে। ১০ এপ্রিল শপথ গ্রহণের মাধ্যমে অস্থায়ী বিপ্লবী সরকারের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। নির্বাসিত সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে ক্যাম্প অফিস স্থাপিত হয়েছে। প্রধান সেনাপতি এম.এ.জি ওসমানীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত হচ্ছে। ছাত্র, তরুণ, কৃষক থেকে শুরু করে আবালবৃদ্ধবনিতা সবাই দেশকে শত্রুমুক্ত করবার জন্য স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশ নিতে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নাম লেখাচ্ছে। তাদের ট্রেনিং হচ্ছে ভারতের নানা জায়গায়।
পাকিস্তানিরাও বসে নেই। পূর্ব বাংলার মানুষের স্বাধীনতার আন্দোলন স্তব্ধ করবার জন্য পাকিস্তানি সৈন্যরা ছড়িয়ে পড়েছে দেশের আনাচেকানাচে। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকলের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিচ্ছে। গুলি করে মারছে নিরীহ মানুষ। বিশেষ বিশেষ স্থানে ক্যাম্প বা ঘাঁটি করে অবস্থান নিচ্ছে। বাঙ্কার করছে, পরিখা খুঁড়ছে। টহল দিচ্ছে। সন্দেহভাজন লোকজন ধরে নিয়ে মারছে, গুম করে দিচ্ছে। পূর্ব বাংলার কিছু বিপথগামী মানুষকে নিয়ে তারা রাজাকার-আলবদর বাহিনী গঠন করছে। অনেককে ধরে নিয়ে জোর করে রাজাকার বানাচ্ছে। আবার অনেকে অভাবের তাড়নায়ও নাম লেখাচ্ছে। কোনোরকমে রাইফেল চালানোর মতো সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে তাদের। হাতে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে একটি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল। লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে। এদেশের সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে। পাকিস্তানের সংহতি রক্ষার নামে মুক্তিবাহিনীকে গ্রাম-গঞ্জে প্রতিরোধ, মিলিটারিদের পথ দেখানোসহ সর্বপ্রকার সহযোগিতা প্রদান, পাকিস্তানের শত্রুদের চিহ্নিত করে নির্মূল করাই তাদের উদ্দেশ্য। পাকিস্তানি সৈন্যরা দেশের সব এলাকা চেনে না, কাউকে জানে না। তাই রাজাকারদের দিয়ে তারা এসব কাজ সারছে। হাসিল করছে তাদের মূল লক্ষ্য, আসল উদ্দেশ্য।
বাগেরহাটের রজব আলি মওকা পেয়ে যায়। বেতাগার মানুষের ওপর ভীষণ খাপ্পা সে। প্রতিশোধ নেবে। তাই সে তার দলবল নিয়ে রাজাকারে নাম লেখায়। সাতদিনের ট্রেনিং নেয়। রাইফেল পায়, গুলি পায়, ক্ষমতা পায়। মানুষ মারবার ক্ষমতা। লুট করবার ক্ষমতা। ঘরবাড়ি পোড়াবার ক্ষমতা। তারপর বিনা বাধায় বিনা প্রতিরোধে প্রবেশ করে রণজিতপুরে। গুলি করে মারে অসংখ্য মানুষ। অপমানের প্রতিশোধ নেয়। রণজিতপুরের অধিকাংশ পুরুষমানুষ তার গুলিতে মারা পড়ে। রাজেনের মা ও বোন রক্ষা পায়নি। বড়ো নির্মমভাবে রজব আলি তাদের মেরে ফেলে। মারা যায় শ্রীবাস, রাধাকান্ত, গণেশ, নকুল, চিত্তরঞ্জন, নিশিকান্ত, নিমাই, পরিতোষ, কানাই, নির্মল, দুলাল, নিতাই, কালিপদসহ আরও অনেকে। কিছু মানুষ নদী সাঁতরে পাশের গ্রাম বেতাগায় যেয়ে ওঠে। ধর্ষিত হয় অনেক মা-বোন রজব আলি ও তার দলবলের কাছে। ধর্ষণের ভয়ে তিন-চারজন মহিলা গলায় শাড়ি পেঁচিয়ে ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে। রণজিতপুরের চারিদিকে নদী বলে অনেকেই পালাতে পারেনি। গ্রাম থেকে বাইরে যাবার সুযোগ পায়নি। লুট হয়ে যায় অধিকাংশ ঘরবাড়ি। রজব আলির লোকজন সবকিছু নিয়ে যায়। সোনা-গহনা, টাকা-পয়সা থেকে শুরু করে জিনিসপত্র যার যা ছিল হারিয়ে ফেলে। সহায়-সম্পদের পাশাপাশি মানুষের মান-সম্মান ইজ্জত ভুলুণ্ঠিত হয়।
মুহূর্তের মধ্যে ছবির মতো গ্রামটিকে শ্মশান বানিয়ে রজব আলির লোকজন চলে যায়। মৃত মানুষগুলোকে দাহ করবার মতো কোনো লোক আর জীবিত থাকল না। সৌভাগ্যক্রমে রাজেন, অনিল ও সুধীর পালাতে পেরেছিল। রজব আলির সাথে প্রতিরোধ যুদ্ধে হৃষীকেশ আহত হয়। তবে ধরা পড়েনি সে। যুদ্ধশেষে পালিয়ে জীবন বাঁচিয়েছিল মহাদেব সাহা, বংশধর দাশ, নরেন ঠাকুর, ভণ্ডুল দাশ, নিরঞ্জন দেবনাথ, মহব্বত হোসেন, আবদুল খালেক, মকবুল হোসেন, সফিক আহমেদ। অনিল ও সুধীর অনেকের সাথে নদী পার হয়ে বেতাগায় যেয়ে ওঠে। এ খবর কেউ জানত না। দীপ্তির দুই দিদিমা তাদের খুঁজে হয়রান হয়। কিন্তু খোঁজ পায় না। দীপ্তির দুই দিদিমার ছেলে তারা। তারা দুজনে সারা গ্রাম তন্নতন্ন করে। লাশের স্তূপ দেখে। না, অনিল ও সুধীর নেই। তারপর লোকমুখে তারা শুনতে পায় রজব আলির হাতেই অনিল ও সুধীর মারা পড়েছে। মিথ্যে এ সংবাদটি শুনে দীপ্তির দিদিমাদের মাথায় যেন বজ্রপাত হয়। মস্তিস্ক বিকৃত হয়ে যায়। এ অবস্থায় দুই মহিলা যার যার ঘরে নিজেদের শাড়িতে গলায় ফাঁসি দিয়ে আত্মহত্যা করে।
সংবাদটি বেতাগা পৌঁছল দেরিতে। তার আগেই অনিল ও সুধীর বেতাগা পৌঁছে যায়। সেখানে তারা আর দেরি করেনি। কখন কী হয়ে যায়। কোন অঘটন ঘটে যায় বলা যায় না। রজব আলির বিরুদ্ধে রাজেন ও হৃষীকেশের সঙ্গে তারাও দুজন সংগঠিত করেছিল গ্রামবাসীদের। দু-দুবার রজব আলি গ্যাংদের হটিয়ে দিয়েছে। গ্রামে ঢুকতে দেয়নি। তাই রজব আলির কোপানল থেকে বাঁচবার জন্য তারা দুজন তৎক্ষণাৎ ভারতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। আহত হৃষীকেশ রণজিতপুরের এক মুসলমান বাড়িতে পালিয়ে থাকে। রাজেন ও মহব্বত বেতাগায় না উঠে পাশের মধুদিয়া গ্রামে যেয়ে ওঠে। রণজিতপুরের তা-ব, হত্যাকা-, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের সংবাদ, দীপ্তির দিদিমাদের আত্মহত্যা- এসব সংবাদ যখন বেতাগা পৌঁছাল ততক্ষণে অনিল ও সুধির বেতাগা ত্যাগ করে চলে গেছে।
দীপ্তির সব মনে আছে। এক দুপুরে তার অনিল ও সুধীর মামা তাদের বাড়িতে আসে। খুলে বলে রণজিতপুরের নারকীয় ঘটনা। দীপ্তির মা চিৎকার দিয়ে কেঁদে ওঠেন। কেঁদে ওঠে দীপ্তি নিজেও, সেই সাথে তৃপ্তি, গৌতমও কাঁদতে থাকে। কান্নাকাটির রোল পড়ে যায় বাড়িতে। সেদিন কেঁদেছিল ডাকাতের ভয়ে, বন্দুকের ভয়ে, গুলির ভয়ে, মৃত্যুর ভয়ে। আর কিছু অনুমান করতে পারেনি তারা। দীপ্তির বাবা তখন বাড়িতে ছিলেন না। পরে এসে এসব শুনে তিনি ভয়ে কুঁকড়ে গিয়েছিলেন। গোলমালের শুরু থেকেই তার চোখে ঘুম ছিল না। নির্ঘুম কাটাতেন রাতের পর রাত। পরিবারের লোকজন, ঘরবাড়ি, জমিজমা ইত্যাদি নিয়ে সবসময় খুব সন্ত্রস্ত ছিলেন শৈলেন দাশ।
রাতে ঘুমোতে পারত না বেতাগার মানুষ। ভয়। সবসময় ভয়। ওই বুঝি আসে। ওই বুঝি মারে। কোনোরকম শব্দের আওয়াজ কানে এলে সবার পিলে চমকে ওঠে। শৈলেন দাশ ভাবেন, হাজার হাজার ঘুমন্ত মানুষের ওপর গুলি হয়েছে ঢাকায়। গুলি হয়েছে দেশের প্রধান প্রধান শহরগুলোতে। ধরপাকড় চলছে। হতভম্ব হয়ে গেছে দেশের লোক। এক ধরনের বিষাদের ছায়া যেন লেপটে আছে সবার মুখম-লে। ৭ মার্চ শেখ মুজিবের ভাষণ থেকেই অনুমান করা গিয়েছিল ওদের সাথে আর হবে না। বার বার তারা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করছে। কথা ও কাজের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি তার ভাষণের এক পর্যায়ে বলেছিলেন- ‘জেনারেল ইয়াহিয়া খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। দেখে যান কীভাবে আমার গরিবের ওপর, আমার বাংলার মানুষের বুকের ওপর গুলি করা হয়েছে। কীভাবে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে। কী করে মানুষ হত্যা করা হয়েছে। আপনি আসুন, আপনি দেখুন।’
শেখ মুজিবকে তারা ধরে নিয়ে গেছে। এদেশের মানুষের ভাগ্যে কী আছে কে জানে। খুবই দুঃসময় যাচ্ছে। মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করবার পরই পুরো ঘটনাটা যুদ্ধে রূপ নিয়েছে। টেবিলে বসে আলোচনার সকল দ্বার রুদ্ধ হয়ে গেছে। পাকিস্তানিরা এখন তাই বেপরোয়া। সন্দেহজনক মনে হলেই নির্বিচারে গুলি করে মারছে। জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিচ্ছে ঘরবাড়ি। আওয়ামী লীগের নেতা বা কর্মী অথবা হিন্দু বলে কেউ শনাক্ত করলেই তাকে মারা হচ্ছে। তার বাড়ি পোড়ানো হচ্ছে। বীভৎস কা-। সবাই শহর ছেড়ে পালাচ্ছে। কেউ কেউ চলে যাচ্ছে গ্রামে, অজ পাড়াগাঁয়। কেউ সীমান্ত পার হয়ে ভারতে যাচ্ছে। তাও যেতে হচ্ছে লুকিয়ে, চুরি করে। খানসেনাদের সামনাসামনি পড়ে গেলে আর রক্ষে নেই। শুরু হচ্ছে টানাটানি। জেরার পর জেরা। জেরায় উত্তীর্ণ হতে পারলে বাঁচা, নইলে ক্ষমা নেই। দাঁড় করিয়ে গুলি। সংখ্যায় বেশি হলে লাইন দিতে হয়। পাখি মারার মতো। টু শব্দটি করবার উপায় নেই। আকার-ইঙ্গিতে কিছু বলারও জো নেই। আইন নেই, বিচার নেই। আছে কেবল সাজা। তাও মৃত্যুদ-। মেরে রেখে গেলে আত্মীয়স্বজনদের কান্নাকাটি ছাড়া গতি নেই। হিন্দু ও মুসলমান বাছাই হচ্ছে। কলেমা না জানলে সে হিন্দু। তাই অনেক হিন্দুও কলেমা শিখে নিয়েছে প্রাণের ভয়ে। কলেমা পড়ে অনেকেই রেহাই পেয়ে যাচ্ছে। অনেককে কাপড় খুলে পুরুষাঙ্গ দেখাতে হচ্ছে। সেটা কাটা আছে কি না। হিন্দু-মুসলিম নির্ণয় করবার সহজ পদ্ধতি। কাটা থাকলে সে ব্যক্তি সাচ্ছা আদমি। আর পুরুষাঙ্গ কাটা না থাকলে সে মালাউন কা বাচ্চা। অতএব তাকে মারতে হবে। সে হলো শত্রু। তাকে গুলি করে অথবা খুঁচিয়ে মারতে হবে। শৈলেন দাশ ভেতরে ভেতরে দুর্বল হয়ে পড়েন। তিনি চিন্তা করে দেখেন, যুগের পর যুগ ধরে এখানে হিন্দু-মুসলমান দুটো সম্প্রদায় পাশাপাশি বাস করে আসছে। কোনোদিন কারও সাথে কোনো বিষয়ে টক্কর লাগা তো দূরের কথা সামান্য মনোমালিন্য পর্যন্ত হয়নি। হিন্দু-মুসলিম একে অপরের ভাই হয়ে বসবাস করে আসছে। কিন্তু এখন কী শুরু হলো। নিজেদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা হচ্ছে কেন? আমরা ‘বাঙালি’- এটাইতো আমাদের পরিচয়। কবি নজরুলইতো সাম্যের গান গেয়েছেন- ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান্।’
সমস্ত দেশ জুড়ে একই অবস্থা। রাস্তায় বের হবার পর আর বাড়ি ফেরা যাবে কিনা কেউ বলতে পারে না। জীবনের কোনো নিরাপত্তা নেই; নিশ্চয়তা নেই। যখন-তখন যে কোনো মুহূর্তে একটি গুলির এফোঁড় ওফোঁড়ে জীবনটা চলে যেতে পারে। গুলির শব্দ দিগন্তে মিলিয়ে যাবার আগেই প্রাণপাখিটা উড়ে চলে যেতে পারে। ফিনকি দিয়ে বের হয়ে যেতে পারে দেহের সমস্ত রক্ত। সেই দিনই অনিল ও সুধীর দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে চলে যায়। কিন্তু, নিয়তির নির্মম পরিহাস, সেখানে পৌঁছে তারা তাদের মায়েদের সংবাদ নিয়ে জানতে পারে যে, তাদের মায়েরা গলায় ফাঁসি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে পুত্রের মৃত্যুশোক সহ্য করতে না পেরে। কারণ, তারা শুনেছিল তাদের অনিল ও সুধীর আর বেঁচে নেই। রজব আলির হাতে প্রাণ হারিয়েছে।
উদভ্রান্ত হয়ে পড়ে দু ভাই। এ কী সর্বনাশ হয়ে গেছে তাদের! তারা যে পালিয়ে বেঁচেছে এ খবর তাদের মায়েদের কাছে পৌঁছয়নি। সন্তান বিয়োগের দুঃসহ জ্বালা বিধবা মহিলা দুজনের মনকে ভেঙে খান খান করে দিয়েছিল। তাই শেষ পর্যন্ত তারা আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।
দেশ স্বাধীন হয়েছে। খানসেনাদের ভয় আর নেই। নেই সেই রজব আলিরাও। তবু মনের দুঃখে অভিমানে দীপ্তির দুই মামা অনিল দাশ ও সুধীর দাশ আর এদেশে ফেরেননি। ভারতেই থেকে গেছেন।
৩.
‘আজ খেলা ভাঙার খেলা খেলবি আয়,
সুখের বাসা ভেঙে ফেলবি আয়-’
বেতাগার সমস্ত বাড়িতে চিড়ে কোটা হচ্ছে। গ্রাম ছেড়ে এ মাটি ছেড়ে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে। ঘর-সংসার ত্যাগ করা খুব কঠিন কাজ। কান্নার রোল পড়ে গেছে। এ অবস্থায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আর থাকাও যাবে না। নিরাপত্তা নেই। রণজিতপুরের অধিকাংশ পুরুষ মানুষ মারা গেছে। অবশিষ্ট যা ছিল বেতাগায় চলে এসেছে। এ দুটো গ্রামের মানুষের মধ্যে সম্পর্কের বাঁধন বড়ো নিবিড়। পরস্পরের আত্মীয়স্বজনে ভরা। রণজিতপুরের মানুষ আক্রান্ত হয়েছে শুনে বেতাগার মানুষ কান্নায় ভেঙে পড়েছে। রণজিতপুরের মানুষেরা তাই এখন বেতাগায়। অধিকাংশই নারী ও শিশু। সংবাদটি পৌঁছে গেছে রজব আলির কানে। এবার বেতাগার মানুষদের দেখে নেবে সে।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হাজার হাজার মানুষ চলে যাচ্ছে ভারতে। হিন্দু-মুসলমান সবাই যাচ্ছে। তবে হিন্দুরাই বেশি। লুটপাটও হচ্ছে প্রতিদিন। কোনো নিয়ম-শৃঙ্খলা নেই। এক ধরনের যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে সারা দেশে। মারো, ধরো, কাটো, খাও। মৃত্যুর খবর আসছে প্রতিনিয়ত। ঘরবাড়ি পোড়ানোর ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন পূর্ব বাংলার আকাশ। ইজ্জতহারা মা-বোনের আর্তচিৎকারে বাতাস ক্রমান্বয়ে ভারি হয়ে উঠছে। সর্বত্র রক্তের চিহ্ন। নদীর জলে ভেসে যাচ্ছে মানুষ। ঘরেবাড়িতে, রাস্তাঘাটে সর্বত্র লাশ আর লাশ। কাকে-কুকুরে-শকুনে ছিঁড়ে খাচ্ছে আদম সন্তান, সৃষ্টির সেরা জীবকে। লাশ দাফন বা দাহ করবার মানুষ পাওয়া যাচ্ছে না। সবাই যে যার জানমাল রক্ষার কাজে ব্যস্ত। শশব্যস্ত।
মুক্তিযোদ্ধারা মোটামুটি সংগঠিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকে ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি ও জোরদার করবার উদ্দেশ্যে মুজিবনগর সরকার রণাঙ্গণকে এগারোটি সেকটরে ভাগ করেছে। সাতক্ষীরা-দৌলতপুর সড়কসহ খুলনার সমগ্র দক্ষিণাঞ্চল এবং বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলা নিয়ে গঠিত হয়েছে নয় নম্বর সেকটর। সেকটর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন মেজর এম.এ জলিল। তারই নেতৃত্বে সংগঠিত হচ্ছে এ অঞ্চলের তরুণরা। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। দলে দলে সবাই ভারতে চলে যাচ্ছে। মুক্তিবাহিনীতে নাম লেখাচ্ছে। বেতাগা ও রণজিতপুরের অনেকেই ইতিমধ্যে চলে গেছে। আরমান, ছফেদ আলি, চিত্তরঞ্জন, আনন্দ মোহন, কালিপদ, সোহরাব এরা সবাই এখন ভারতে। বেতাগার এরাই অপেক্ষাকৃত তরুণ ও যুবক সম্প্রদায়। কেউ ছাত্র, কেউ বেকার, কেউ কৃষক, কেউ শ্রমিক। কিন্তু যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠবার সাথে সাথে কেউ আর বসে থাকেনি। দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার জন্য ঘর ছেড়েছে। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নাম লেখাচ্ছে, ট্রেনিং নিয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
রজব আলির বাহিনী দ্বারা এবার বেতাগা আক্রান্ত হলো। রজব আলি কেবল সাধারণ রাজাকার নয়, পুরাদস্তুর রাজাকার কমা-ার। ‘রাজাকার মেজর’ বলে প্রচার করে নিজেকে। অসীম ক্ষমতা তার। যা খুশি তাই করতে পারে। কারও কাছে কোনো কৈফিয়ত দিতে হয় না। বেতাগার সমস্ত বাড়ি লুট করলো সে। এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত। দীপ্তিদের বাড়িও বাদ গেল না। দীপ্তির বাবা বাড়িঘর ফেলে পরিবারের সবাইকে নিয়ে জান বাঁচানোর জন্য আশ্রয় নিলেন তাদের বাড়ি থেকে মাইলখানেক দূরে চাকলিতে, তার বন্ধু ইলিয়াছের বাড়িতে। চাকলি মুসলমানপাড়া। তাই শুধু দীপ্তিরা নয়, জীবন বাঁচানোর জন্য বেতাগার অনেকেই চাকলিতে আশ্রয় নিল। বেতাগা লুট হয়ে গেল। দীপ্তিদের বাড়ির সবাই চলে গেলেও দীপ্তির এক বুড়ি ঠাকুরমা পাচিবালা দাশ বাড়ি ছেড়ে যাননি। তিনি বাড়িতেই ছিলেন। শৈলেন তাকে না থাকবার জন্য অনুরোধ করলেও তিনি শোনেননি। বলেছিলেন, আমি এক মড়–ঞ্চে বিধবা। আমাকে আবার মারবে কে? আমি পচাকে নিয়ে থাকবো। ওরে পচা, যা তুই দাঁড়াকোদালটা নিয়ে মাঠে যা। আমি ঘরে থাকি।
পচা, দীপ্তির এক মঞ্চে বিধবা ঠাকুরমার ছেলে। বেশ কটা সন্তান হয়ে মারা যাওয়ার পর ছেলেটা হলে ওর নাম রাখা হয় পচা। দীপ্তির এক কাকা। নিচে দাঁড়াকোদালটা রেখে তিনি মাঠের মধ্যে একটি গোয়ালঘরের ওপরে পাটাতনে লুকিয়ে বসেছিলেন।
বেলা দশটার দিকে রজব আলির বাহিনী দীপ্তিদের বাড়িতে এলো। শূন্য বাড়ি। বাড়িতে কেউ নেই। ঘরের বারান্দায় এক বুড়ি বসে আছে। বুড়িকেই আক্রমণ করলো তারা, কোথায় কী আছে বের করে দেওয়ার জন্য। দীপ্তির ঠাকুরমা তাদেরকে ধর্মের বাবা-পুত্র বলেও রেহাই পেল না। বাড়ির অনেক জিনিসপত্র নিয়ে গেল তারা। বাড়ির অন্যরা কোথায় গেছে, কোথায় পালিয়েছে শুনতে চাইল। বুড়ি আমতা আমতা করতে থাকলে রজব আলি স্বয়ং বুড়িকে জেরা করতে শুরু করল।
-‘টাকা-পয়সা, সোনা-দানা কোথায় আছে?’
বুড়ি শুধু একটা কথাই বারবার বলে গেল- ‘আমি জানিনে বাবা, আমি জানিনে…’
– ‘শুয়োরের বাচ্চারা কোথায় লুকিয়েছে! কারও রেহাই নেই। সব কটারে কচুকাটা করব। শেষ করে দেব।’ হুংকার দিয়ে ওঠে রজব আলি। তারপর বুড়ির দিকে থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল তাক করে। বুড়ি প্রাণের ভয়ে আর কথা চেপে রাখতে পারেন না। অবচেতন মনেই বলে ফেলেন দীপ্তির কাকা অর্থাৎ তার পুত্রের কথা। যিনি প্রাণের ভয়ে মাঠের গোয়ালঘরে লুকিয়ে আছেন।
এ কথা শুনে আর যায় কোথায়! রজব আলি দীপ্তির ঠাকুরমাকে ছেড়ে দিয়ে চললো সেই গোয়ালঘরের দিকে। যেয়ে দেখে সত্যি সত্যি একজন লুকিয়ে আছে সেখানে। যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেল তারা। তাকে টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে আনল। রজব আলির ধমকানিতে তার কাছে যা ছিল বের করে দিলেন। কিন্তু, রজব আলি এতে খুশি নয়। বুড়ি বলেছে তার কাছে অনেক টাকা। সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না বলে রজব আলির লোকজন তাকে বেদম মার মারল। আসলে তার কাছে সামান্যই টাকা ছিল। আর তাই নিয়েই তিনি লুকিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত রেহাই পেলেন না তিনি। প্রাণ হারালেন রজব আলির হাতে। এক গুলিতেই পড়ে গেলেন। আর উঠলেন না। রক্তে ভেসে গেল দীপ্তিদের গোয়ালঘরের আঙিনা।
দীপ্তিরা চাকলিতে ইলিয়াছ আলির বাড়িতে বসে শুনলো এসব ঘটনা। দীপ্তির ঠাকুরমা ছাড়া পাওয়ার পরপরই চাকলি চলে গেলেন। তিনি আর এক মুহূর্তও থাকতে চান না। সবাইকে নিয়ে ভারতে চলে যেতে চান। এ ঘটনার পর কেউ আর বেতাগায় যেতে সাহসী হলো না। তবে শৈলেন দাশ এলেন বেতাগায়। বাড়িতে গেলেন। লুটপাটের চিহ্ন দেখে কেঁদেকেটে অস্থির হয়ে পড়লেন। দেখলেন কিচ্ছু নেই। সব নিয়ে গেছে জানোয়ারের দল। বিমর্ষ মনে ফিরে গেলেন চাকলিতে। দীপ্তির মা পারুলবালা দাশ শুনলেন সব কথা। তিনিও একঝলক কেঁদে নিলেন পশলা বৃষ্টির মতো। সেই সাথে ঝঙ্কার দিয়ে কেঁদে উঠল দীপ্তি, তৃপ্তি আর গৌতম। তারা কাঁদল মায়ের কান্না দেখে। তবে প্রকৃতপক্ষে কী ঘটেছে বা কী ঘটছে দীপ্তি ছাড়া বাকিরা অনুমান করতে পারল না।
বাচ্চাদের স্বভাবই এমন। প্রিয়জনের কান্না দেখলেই তারা কেঁদে ওঠে। বিশেষ করে মা-বাবার কান্না তারা মোটেই সহ্য করতে পারে না। হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে। কারণ খুঁজে দেখে না।
ইলিয়াছের বাড়িতে থেকেই শৈলেন দাশ সিদ্ধান্ত নেন আর এখানে থাকবেন না, ইন্ডিয়ায় যাবেন। জীবনের নিরাপত্তা যেখানে নেই, সেখানে কোন্ ভরসায় থাকবেন। মালপত্র যা যাবার গেছে। এখন পরিবারের মানুষগুলোর প্রাণ নিয়ে কোনোরকমে ভারতে পৌঁছতে পারলে হয়। এখানে থাকলে কখন কী হয়ে যায় বলা যায় না। ত্রাসের রাজত্ব। জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই। চারিদিকে অরাজকতা। পাখির মতো ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ মারা যাচ্ছে। পাড়ার পর পাড়া জ্বলছে দাউ দাউ আগুনে। লুট হয়ে যাচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। মানুষের ধনসম্পদ, মা-বোনদের ইজ্জত ও সম্ভ্রম। আশ্চর্য হয়ে যান শৈলেন দাশ। নিজ দেশে পরবাসীর মতো মনে হয় নিজেকে। পারুলবালা বলেন, ‘আর এক মুহূর্তের জন্যও নয়। আমি আর এখানে থাকতে চাই নে। চলো চলে যাই।’
শৈলেন দাশ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উত্তর দেন, ‘তাই চলো পারু, বাচ্চাদের নিয়ে আমরা ওপারেই চলে যাই।’
আবার কেঁদে ফেলেন পারুলবালা। সেই সাথে ছেলেমেয়েরাও। তবুও উপায় নেই। বাঁচতে গেলে তাদের গ্রাম ছাড়তে হবে। কোথাও চলে যেতে হবে। কে তাদের রক্ষা করবে? যে যার মতো বাঁচবার চেষ্টা করছে। কারও দিকে কারোর চোখ ফেরাবার সময় নেই। আপন প্রাণ বাঁচাতেই গলদঘর্ম সবাই।
মা-বাবার কথা শেষে মায়ের কান্না দেখেই তৃপ্তি বাবাকে জিজ্ঞেস করে, ‘মা কাঁদছে কেন বাবা?’
– ‘আমাদের চলে যেতে হবে তাই।’ উত্তর দেন শৈলেন দাশ
– ‘কোথায় যাব আমরা? বেতাগায়?’ তৃপ্তি আবার জানতে চায়?
– ‘না, মা! আমরা ওপারে যাব। ইন্ডিয়ায় যাব।’
– ‘কেন? সেখানে কি আমাদের বাড়ি?’
এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি শৈলেন দাশ। গোঁজামিল দিতে চেষ্টা করেছিলেন মেয়ের সাথে। কিন্তু পারেননি। শেষবধি বেড়াতে যাবার কথা বলে তৃপ্তিকে আশ্বস্ত করেছিলেন।
তবে দীপ্তি অনুমান করেছিল তাদের আসন্ন বিপদের কথা। সে আর বাবা-মাকে কিছু জিজ্ঞেস করেনি। কারণ ইতিমধ্যে তার জানা হয়ে গেছে যুদ্ধের বিস্তারিত খবরাখবর। এখানে সেখানে মানুষ মারার অনেক ঘটনা শুনেছে সে। খানসেনাদের মুখোমুখি হলে আর রক্ষে নেই। বুঝতে পারে দীপ্তি তাদের পরিণতি কী হতে পারে। কারণ, রজব আলির নজর পড়েছে বেতাগায়। রণজিতপুর জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে, দলে দলে মানুষ মেরে শ্মশান করে ফেলেছে। দীর্ঘকালের বাস তাদের এদেশে। বাপ-ঠাকুরদা এমনকি তাদের চোদ্দপুরুষ ধরে বাস করে আসছে। এ দেশ তো কেবল মুসলমানদের নয়। তবে হিন্দুদের প্রতি খানসেনাদের এমন বৈরী আচরণ কেন? কিছুই অনুমান করতে পারে না দীপ্তি। রাজনৈতিক ব্যাপার-স্যাপার অত বোঝে না সে। শুধু জানে শেখ মুজিব নামে একজন নেতা আছে। জাতির জনক তিনি। বাঙালি জাতির মঙ্গলের জন্য তিনি চেষ্টা করছেন। বঞ্চিত বাঙালি জাতির জন্য তিনি মুক্তির ডাক দিয়েছেন। স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন। ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছেন। সারা জাতি তার সেই ভাষণে উদ্দীপ্ত। ভাষণের অনেক অংশই এখন জনগণের মুখে মুখে।
শেখ মুজিবের সেই ‘ম্যাগনাকার্টা’ ভাষণ রেকর্ড করে সারাদেশে পাঠানো হয়। দীপ্তি অনেক পরে তার কিছুটা শুনেছে। বেতাগায় মাইকে বাজানো হয়েছে। বেতাগার মানুষের কানে এখনও তার রেশ যায়নি। দীপ্তির মনে পড়ে বজ্রকণ্ঠের সেই উদাত্ত আহবান- ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয়বাংলা।’
চারিদিক থেকে শুধু দুঃসংবাদ পাচ্ছেন শৈলেন দাশ। কী করবেন একা ভেবে কুলোতে পারছেন না তিনি। তবে এটা নিশ্চিত ভেবে নিয়েছেন যে, এখানে আর থাকা যাবে না। শরণার্থী হয়ে ভারতে চলে যেতে হবে। তা ছাড়া কোনো উপায় নেই। বাড়ি লুট করে নিয়ে গেছে। এবার সুযোগ বুঝে প্রাণে মেরে যাবে। রজব আলির হাতে আগে ছিল বন্দুক। এবার পেয়েছে রাইফেল। তার হাতে এখন অসীম ক্ষমতা। যা তাই করতে পারে যখন তখন। কাউকে কৈফিয়ত দিতে হবে না। দীপ্তিকে নিয়ে শৈলেন দাশের ভয়। দীপ্তির বয়সই এ ভয় এনে দিয়েছে। শৈলেন দাশ শুনেছেন- ‘আপণা মাংসেঁ হরিণা বৈরী।’ নিজের মাংসের জন্যেই হরিণ নিজের শত্রু।
ইলিয়াছ আলির বাড়ির বারান্দায় বসে ভীত-সন্ত্রস্ত একদল মানুষের নানান কথাবার্তা ও শলাপরামর্শ করার মধ্যে এক ঘটনা ঘটে গেল। ইলিয়াছের মা অনর্গল বকে যাচ্ছেন। আবোলতাবোল বকছেন। পরে বোঝা গেল তার মধ্যে জ্বিন ভর করেছে। তার কাছে নাকি জ্বিন আছে। মানুষের ভালো-মন্দ, ভূত-ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারেন। অনেকে উৎসুক হয়ে এটা ওটা জিজ্ঞেস করছে। অনেককিছুর জবাবও দিচ্ছেন তিনি। শৈলেন দাশও বাদ গেলেন না। তারও জানতে ইচ্ছে হলো নিজেদের ভবিষ্যতের কথা। তাই এক ফাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘চাচিমা আমরা দু-একদিনের মধ্যে ভারতে যেতে মনস্থ করেছি। আপনি কী বলতে পারবেন, আমরা নিরাপদে ভারতে পৌঁছতে পারব কি না? পথে কোনো বিপদে পড়ব কি না?’
ইলিয়াছ আলির মায়ের কণ্ঠে জ্বিন উত্তর দিল- ‘নিরাপদে যেতে পারবে, তবে শত্রুপক্ষের কারও সঙ্গে দেখা হলে জীবন বাঁচানো কষ্ট হবে।’
কেউ খুব একটা আমল দিল না ইলিয়াছের মায়ের কথায়। এরপরও মহিলা বকছেন। অনর্গল কথা বলছেন। ছোটো ছোটো বাচ্চারা যে যা পারছে জিজ্ঞেস করছে।
দীপ্তিরা রাত কাটাল ইলিয়াছ আলির বাড়ি। পরদিন সকালে শৈলেন দাশ গেলেন বেতাগায়। বাড়িতে যেয়ে দেখেন খালি ঘরখানা ছাড়া আর কিছুই নেই। সব নিয়ে গেছে রজব আলির লোকজন। গ্রামের কারও কিছু রাখেনি। শৈলেন দাশের মূর্ছা যাবার মতো অবস্থা। কত কিছুই না ছিল বাড়িতে। মনে উঠতেই তিনি জ্ঞান হারালেন কয়েকবার। তবুও মেনে নিলেন এই মনে করে যে পরিবারের সবাইতো অন্তত প্রাণে বেঁচে গেছে। মাল যায় যাক, জান তো আছে। জান থাকলে আবার সবকিছু হবে। মনকে সান্ত¡না দিলেন তিনি। সান্ত¡না দিলেন পারুলবালাকেও। তিনি তো কেন্দেকেটে অস্থির। তার সাজানো সংসার এক লহমায় পিষে দিয়ে গেছে জানোয়ারের দল। ঘরে চাল ছিল, ডাল ছিল, গুড় ছিল, আলু ছিল, পেয়াজ ও রসুন ছিল, হলুদ ছিল, শাড়ি ছিল, কাপড়চোপড় ছিল, শোবার খাট-পালঙ্ক ছিল, বসবার চেয়ার ছিল, শীতের লেপ-কাঁথা ছিল, সেগুলো রাখার বাক্স ছিল, হাঁড়িপাতিল, বাসনকোসন কত কিছু ছিল। পুকুরে মাছ ছিল, গোয়ালে গোরু ছিল, কটা ছাগল ছিল, বেশ কিছু হাঁস-মুরগি ছিল, দীপ্তির লাগানো কয়েকটা ফুলের গাছ ছিল, গাছে লাল-সাদা ফুল ছিল। সেগুলো মানুষের পায়ের দলনে পিষে গেছে। বাড়ির উঠোনে কতরকম গাছ ছিল। গাছে ফল ছিল, ফুল ছিল, পাখি ছিল। পাখির কণ্ঠে গান ছিল। সন্ধ্যায় উলুধ্বনি ছিল, সকাল-সন্ধ্যায় ‘আহ্নিক’ ছিল, শাঁক বাজানো ছিল। তুলসীতলা ছিল, ঘরে মা কালীর ছবি ছিল, গণেশের মূর্তি ছিল, গঙ্গার জল ছিল, পারুলবালার সিঁদুর ছিল। পিতলের কাজললতা ছিল। কাঠের আলমারিতে টুকরো টুকরো হরেকরকমের জিনিসপত্র ছিল। টেবিলের ওপর দীপ্তির বইখাতা ছিল, তৃপ্তির ‘সবুজ সাথী’ ও ‘বর্ণ পরিচয়’ ছিল, গৌতমের শ্লেট-পেনসিল ছিল, পিতল-কাঁসার তৈজসপত্র ছিল, খাটের তলায় সুপারি ও নারকেল ছিল, সর্ষের বস্তা ছিল, কৌটো ভর্তি ঘানি ভাঙা তেল ছিল, বোতলে গাওয়া ঘি ছিল, ধর্মগ্রন্থ ‘শ্রীমদ্ভগবদগীতা’ ছিল, রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি’, নজরুলের ‘সঞ্চিতা’ ছিল। শেখ মুজিবের ছবি ছিল, আনন্দ ছিল, সারা বাড়ি জুড়ে সুখময় পরিবেশ ছিল, সন্ধের পর গল্পগুজব ছিল, জোনাকির আলো ছিল, লাটু চৌকিদারের হাঁক ছিল। হইহই রইরই ছিল। শৈলেন দাশ আপন মনে বুদবুদের মতো বুনে যায় একটি বিমূর্ত উপাখ্যান-
অনেককিছু পাবার ছিল
ইচ্ছেমতো যাবার ছিল
শত্রুর সঙিন ছিল, রুধতে পারিনি
দেশের অনেক ঋণ ছিল, শুধতে পারিনি।
৪.
‘মেঘের পরে মেঘ জমেছে’
মুজিবনগর সরকার সম্প্রসারিত হয়েছে। এদেশ থেকে যে সমস্ত শরণার্থী ওপারে যাচ্ছে মুজিবনগর সরকারই ভারতীয়দের সাহায্যে তাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করছে। সমগ্র রণাঙ্গণকে এগারোটি সেকটরে ভাগ করা হয়েছে। মুজিবনগর সরকারের সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব পেয়েছেন সাতক্ষীরার রুহুল কুদ্দুস। ভারতের কয়েকটি স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা হয়েছে। পার্বত্য ত্রিপুরা, আসাম, মেঘালয়, জলপাইগুড়ি, বিহার ও ছোটোনাগপুরে ভারতীয় কর্তৃত্বাধীনে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং হচ্ছে। এদেশের তরুণরা দলে দলে ওই সমস্ত ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে ট্রেনিং নিয়ে যুদ্ধ করবার জন্য সেকটর কমান্ডারদের অধীনে যোগ দিতে শুরু করেছে।
রাজেন এলো চাকলিতে ইলিয়াছ আলির বাড়ি দীপ্তিদের খোঁজখবর নিতে। তার সবই গেছে। মা ও বোনকে রজব আলি গুলি করে মেরেছে। অধিক শোকে পাথর হয়ে গেছে রাজেন। শোকে মূহ্যমান সবাই। এক ধরনের অসহায় পরিস্থিতির হাতে বন্দি। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের যেন কোনো উপায় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ইন্ডিয়ায় যাবার ব্যাপারে রাজেন আলাপ করে শৈলেন দাশের সাথে। অজানা পথ, অচেনা রাস্তাঘাট। কীভাবে যাবে, কাদের সাথে যাবে, ভেবেচিন্তে অস্থির হয়ে পড়ে সকলে।
দীপ্তির সাথে রাজেনের এখনও দেখা হয়নি। সে তার ইলিয়াছ চাচার বাড়ির পিছনে একটি মাটির উঁচু ঢিবিতে বিমর্ষ অবস্থায় বসে আছে। তার জীবনে এ কী হয়ে গেল! রাজেন হারিয়েছে তার মা ও বোনকে। বেতাগা ও রণজিতপুর শ্মশান হয়ে গেছে। তাদের ঘরবাড়ি লুট হয়ে গেছে। তার স্কুল বন্ধ। পড়াশুনো বন্ধ হয়ে গেছে। এ বছর তার মেট্রিক পরীক্ষা দেবার কথা। রাজেন ও দীপ্তির মধ্যে গোপনে টুকটাক কথা চালাচালি হয়। দুজনই দুজনকে পছন্দ করে। রাজেনের কাছে দীপ্তি যেন দেবী দুর্গা। গোলাকার মুখ। ত্রিনয়না। রাজেন খুব ভালো ছেলে। বি.কম পাস করেছে। এখনও কোনো চাকরি পায়নি। বেকার। রণজিতপুরকে রক্ষা করতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছে সে। কিন্তু পারেনি। এবার মুক্তিযুদ্ধে যাবে। যুদ্ধ করবে শত্রুর বিরুদ্ধে। স্বাধীন করবে দেশ। তার সব বন্ধুরা চলে গেছে। সে এখনও যেতে পারেনি দীপ্তিদের জন্য। দীপ্তির কোনো বড়ো ভাই নেই। বাবার বয়স হয়েছে। তাই তাদেরকে নিয়ে যাবে সে। তার মনের শোক এখন অসীম শক্তিতে পরিণত হয়েছে। যুদ্ধে যাবেই সে। আর দেরি করা ঠিক হবে না। এরপর হয়তো বর্ডার পার হতে পারবে না। ভীষণ কড়াকড়ি হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। তারপর তার মতো বয়সের যুবক পেলে তো আর রক্ষে নেই। প্রথম দর্শনেই গুলি। হিন্দু-মুসলমান দেখবে না। এ বয়সের তরুণদের খুব ভয় পায় খানসেনারা। তারা বুঝতে পেরেছে ছাত্র ও যুবকরাই মূলত স্বাধীনতার আন্দোলনে নেমেছে। মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে। তারাই ভারতে সংগঠিত হচ্ছে এবং যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সুতরাং আর দেরি নয়। তাহলে রাজেনের পক্ষে পার হওয়া মুশকিল হয়ে যাবে। যেমন দীপ্তির ক্ষেত্রে ঘটেছে। ঘর থেকে বের হতে পারে না। তাকে নিয়েই শৈলেন দাশের ভয়, পারুলবালার ভয়। অনেকটা গৃহবন্দিনীর মতো জীবন হয়ে গেছে তার। একঘর থেকে অন্যঘর। রান্নাঘর থেকে শোবার ঘর। এছাড়া আর কোথাও সে যেতে পারে না। বাবা বলে দিয়েছেন, ‘যতদিন না ওপারে যেতে পারছি ততদিন অসূর্যস্পর্শার মতো থাকো।’
সারাদেশে যখন স্বাধীনতাযুদ্ধ চলছে মুক্তির আন্দোলন হচ্ছে তখন দীপ্তি কাটাচ্ছে এক ধরনের বন্দিত্বের জীবন। কারণও আছে। খানসেনারাতো দূরের কথা রাজাকার রজব আলি পর্যন্ত মেয়েদের দিকে হাত বাড়িয়েছে। ইতিমধ্যে গ্রামের দুজন মেয়ের সর্বনাশ করেছে সে। তার মধ্যে একজন তার সহপাঠী মহুয়া। মহুয়ার জন্য খুবই কষ্ট হয় দীপ্তির। বড়ো সাদাসিধে মেয়েটা। কেউ কিছু বলতে সাহস পাচ্ছে না। তার হাতে রাইফেল, কোমরে গুলির বেল্ট, পরনে খাকি পোশাক, রাইফেলের মাথায় ছুঁচালো বেয়নেট। তার ধারে কাছে যায় কে। সে-ই এখন বেতাগা ও রণজিতপুর গ্রামের ভাগ্যবিধাতা। অসীম ক্ষমতা তার হাতে। কিছু বললেই নাকি ট্রিগার টানে।
দীপ্তিই এখন শৈলেন দাশের একটা বড়ো সমস্যা। আর যা হয় হোক। সবকিছু তিনি মেনে নিতে রাজি। তবে দীপ্তির কোনো ক্ষতি তিনি সহ্য করতে পারবেন না। দীপ্তিকে অনেকক্ষণ না দেখে রাজেন উৎসুক হয়ে পারুলবালার কাছে জিজ্ঞেস করে, ‘কাকিমা দীপ্তিকে দেখছি না যে! সে কোথায়?’
– ‘ঘরের পিছনেই আছে মনে হয়।’ পারুলবালা উত্তর দেন। ‘সারাদিন তো আর বের হতে পারে না। তাই একটু আগে বের হয়েছে। দাঁড়াও আমি তাকে ডেকে দিচ্ছি।’
– ‘আপনাকে আর যেতে হবে না। আমি নিজেই যাচ্ছি।’
রাজেন ঘরের পিছনে চলে যায়। জায়গাটা চমৎকার। লম্বা লম্বা ঘাস আর গাছ-গাছালিতে পরিপূর্ণ ঢিপিটা বেশ সুন্দর। দীপ্তি সেখানে আনমনা হয়ে বসে আছে। রাজেন দীপ্তিকে দেখে ছুটে গেল টিপির ওপর। দুজনে পাশাপাশি। কী বলবে দীপ্তি ভেবে পায় না। কদিন আগে রাজেন হারিয়েছে তা মা ও বোনকে। তাকে সান্ত¡না দেবার মতো ভাষা খুঁজে পায় না। শুধু একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে রাজেনের দিকে।
একসময় রাজেন নীরবতা ভাঙে- ‘কী দেখছ দীপ্তি’?
– ‘তোমাকে।’ অস্ফুটস্বরে উত্তর দেয় দীপ্তি।
– ‘আমার মধ্যে কী…’
– ‘তোমাকে দেখছি আর ভাবছি। সৃষ্টিকর্তা একে একে তোমার সব প্রিয়জনকেই কেড়ে নিয়েছে। অথচ মনে হচ্ছে তোমার কিছুই হয়নি।’
– ‘এখন আর হারানোর ব্যথায় ব্যথিত নই আমি। আমার মা-বোনের মতো শত-শত, হাজার-হাজার মা-বোন গেছে। তাদের রক্তের, তাদের ইজ্জতের বদলা নিতে আমি এখন প্রস্তুত।’ রাজেনের কথায় প্রচ- দৃঢ়তা প্রকাশ পায়।
– ‘তুমি কি যুদ্ধে যাবে?’
– ‘নিশ্চয়ই। দেশকে শত্রুমুক্ত করবার শপথ নিয়েছি। বসে থাকার আর কোনো অবকাশ নেই। আমাকে কালই চলে যেতে হচ্ছে। এদেশে আর থাকা সম্ভব হচ্ছে না। মোটেই বিপদমুক্ত হতে পারছিনে। শুনছি, রজব আলি নাকি জেনে গেছে আমি এখনও আছি। সে তার দলবল নিয়ে আবার যে কোনো মুহূর্তে আক্রমণ করতে পারে।’
রাজেনের কথা শুনে মুষড়ে পড়ে দীপ্তি। দুজনের মনেই এক ধরনের ভয়। কত কিছুর গড়াপেটা শুরু হয় মনের মধ্যে। কী হবে দেশের পরিণতি। কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে স্বাধীনতার আন্দোলন। অস্ত্রের বিরুদ্ধে খালি হাতে অসম যুদ্ধ হবেই বা কীভাবে?
দীপ্তি ভাবে তার মনের মানুষটি চলে যাচ্ছে। তাদেরও যাওয়া দরকার। এভাবে আর কতদিন থাকা যায়। তার বাবাও ঠিক করেছেন দু-একদিনের মধ্যে তারাও চলে যাবে।
– ‘ইন্ডিয়ায় যেয়ে তো দেখা হবে আমাদের?’ দীপ্তি শুনতে চায়।
– ‘তা তো অবশ্যই হবে।’
– ‘কীভাবে যাবে তুমি? কার সাথে?’
– ‘আমি আর হাফিজ যাব। হাফিজ আমার বন্ধু। তার সাথেই যাব। সে পথঘাট সবই চেনে।’
– ‘কোন বর্ডার পার হবে?’
– ‘হাকিমপুর দিয়ে যাবো। সেটাই নাকি নিরাপদ।’
– ‘তোমার মা ও কল্যাণীর কথা খুব মনে পড়ছে।’
– ‘কী আর হবে। আমার সব শেষ। ছোটোবেলায় বাবাকে হারিয়েছি। আর বড়ো হয়ে মা ও বোনটাকে বাঁচাতে পারলাম না।’
– ‘বাবার সাথে কথা হয়েছে?’
– ‘হ্যাঁ। তোমার বাবা ও মা দুজনের সঙ্গেই কথা হয়েছে। বললেন, দু-একদিনের মধ্যে রওয়ানা দেবেন।’
– ‘আমাদের বাড়ি লুট হয়েছে শুনেছ?’
– ‘হাঁ, শুনলাম তো সবই।’
– ‘কিচ্ছু নেই। শুধু ঘরখানা পড়ে আছে। রজব আলি ও তার লোকজন করেছে।’
– ‘শালা ওই রজব আলির খুব বাড় বেড়েছে রাজাকারে যোগ দিয়ে। দিনরাত আর্মিদের ক্যাম্পে পড়ে থাকে আর দুশমন ধরার নাম করে গ্রামের পর গ্রাম লুট করছে। মেয়েদের গায়েও নাকি হাত তুলেছে সে।’
– ‘আমিও তো তাই শুনেছি। এজন্য বাবা আমাকে লুকিয়ে ছাপিয়ে রাখেন। ঘর থেকে বেরুতে দেন না।’
– ‘তাহলে কিছুই আর বাদ রাখছে না সে। লুটতরাজ, মানুষ হত্যা, মা-বোনদের ইজ্জত লুণ্ঠন, ঘরবাড়ি পোড়ানো সবই করে যাচ্ছে একের পর এক। তবে একদিন সে ধরা পড়বে। শাস্তি তার পেতেই হবে।’
– ‘এটা দুর্বল চিত্তেরই কথা।’
– ‘না দীপ্তি না। মুক্তিযোদ্ধারা যেভাবে সংঘটিত হচ্ছে তাতে আর একতরফা মার খাবো না আমরা। অচিরেই পাল্টা আক্রমণ হবে। যুদ্ধ হবে সরাসরি। আমরা স্বাধীনতার জন্য লড়ছি। আমাদের বিজয় অনিবার্য।’
– ‘তাই যেন হয়। নইলে আমাদের তো ফেরবার কোনো পথ থাকবে না।’
বাপ-দাদা চোদ্দপুরুষ এ দেশের মাটিতে বাস করছেন। এখন সেই মাটি সেই ঠিকানা ছেড়ে আমাদের চলে যেতে হচ্ছে। হারিয়েছি সব। এখন শেষ ঠিকানাটুকুও এভাবে যেন চিরদিনের মতো হারিয়ে না যায়।’
– ‘খুব খারাপ লাগছে, তাই না দীপ্তি?’
– ‘আসলে তাই। খুবই খারাপ লাগছে। কেমন যেন একা হয়ে গেছি আমি। শুধু আমি নই আমার মতো সকলেই। আমার সাথে যারা পড়ে মহুয়া, শর্মিলা, রিজিয়া, তহুরা, বাসন্তী, ফিরোজা সবাই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল কয়েকদিনের মধ্যে। কোনো যোগাযোগ নেই। দেখা নেই, কথা নেই। কে কোথায় গেছে তাও জানিনে। সারাক্ষণ ঘরে বসে থাকি। খুব খারাপ লাগে আমার।’
দীপ্তির মনে পড়ে মহুয়ার পদবি ছিল পান্তি। মহুয়া পান্তি। গ্রামে ওর বাবার গ্রামে কয়েক বিঘা জমিতে পানের বরজ আছে। পানের ব্যবসা করেন ওর বাবা। শত শত টাকার পান বিক্রি হয়। মহুয়ার পদবির সাথে মিল করে ওরা সবাই মিলে একটা ছড়া বানিয়েছিল। সহজ-সরল মেয়েটার সামনে ছড়াটা বললে ওর ফরসা মুখ লজ্জায় লাল হয়ে যেত, আর সবাই খুব মজা পেত।
মহুয়া পান্তি
পারে না রানতি,
তাকে কিছু বললে
পারে শুধু কানতি।
আবার রাজেনের কথায় মনোযোগ দেয় দীপ্তি। বলে, ‘তোমার কথা মনে হলেই কেমন যেন বিহ্বল হয়ে পড়ি আমি।’
– ‘আমার কথা থাক। আমি সব মেনে নিয়েছি।’
– ‘তবুও তো স্বজন হারানোর বেদনা…স্বজন হারানোর শোক…
– ‘শোকই আমার এখন শক্তি।’
– ‘তুমি তো কাল চলে যাবে, তাই না?’
– হ্যাঁ দীপ্তি, আমি কালই চলে যাবো। খুব ভোরে বেরিয়ে পড়তে হবে।’
দীপ্তি জানে রাজেন চলে যাবে। তবু রাজেনের মুখ থেকে একথা শোনবার পর দীপ্তির চোখে জল এসে যায়। রাজেনকে সে খুব ভালোবাসে।
দীপ্তির চোখের জল মুছে দেয় রাজেন। সান্ত¡না দেয় তাকে। ভারতে যেয়ে দেখা করবার প্রতিশ্রুতি দেয়।
– ‘কথা দাও, আমার সাথে দেখা না করে তুমি যুদ্ধে যাবে না!’ কাঁদতে কাঁদতে জানতে চায় দীপ্তি।
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে। আমি সীমান্ত পেরিয়ে পৌঁছে তোমাদের জন্য অপেক্ষা করবো। তোমাদের সাথে দেখা করে তারপর মুক্তিযোদ্ধার খাতায় নাম লেখাবো। ট্রেনিং নেবো। যুদ্ধ করবো দেশমাতৃকার জন্য। স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনবো।’
সূর্য অস্তগামী প্রায়। টিপির বাগানে দু-একটি ঝিঁঝি পোকা ডাকা শুরু হয়েছে। দীপ্তির মা ডাক দেয় দুজনকে। ঘরে এসে কথা বলবার জন্য বলে। চোখের পলকে একরাশ অন্ধকার ওদের দুজনকে ঘিরে ধরে। জীবনের সব দুঃখ ও বেদনা ভুলে গিয়ে দুজনে খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে। রাজেনের মুখ থেকে ফিসফিস করে অস্পষ্ট কটা শব্দ বেরোয়- ‘আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি, দীপ্তি! ভালোবাসি!’ তৃপ্তির সারা শরীর কেঁপে ওঠে। পৃথিবীর সব সুখ যেন তার কোলে টুপ করে পড়ে। তিরতির করে কাঁপে রাজেনের ঠোঁট। সেই কম্পমান ঠোঁট কোন ফাঁক গলে দীপ্তির ঠোঁটকে ছুঁয়ে ভিজিয়ে দেয়, কেউ টের পায় না। ফিসফিসিয়ে ওঠে দীপ্তির ঠোঁট- ‘তুমি আমার কৃষ্ণ, আমি তোমার রাধা…।’
এর মধ্যে শৈলেন দাশ বেতাগায় নিজের ভিটে থেকে একবার ঘুরে এসেছে। খুব মন খারাপ তার। চারিদিক থেকে লোকজন দলে দলে চলে যাচ্ছে। কেউ থাকছে না। সবাই গোজগাজ করে নিচ্ছে। সাজ সাজ রব পড়ে গেছে সর্বত্র।
সন্ধে ঘনিয়ে আসে। দুজনেই উঠে পড়ে। হাঁটতে থাকে বাড়ির দিকে। অনেক কথা হয় দুজনের মধ্যে। রণজিতপুর শ্মশান হয়ে গেছে। কত মানুষের ক্ষতি হয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। লুটপাটে বেতাগা গ্রামটি শূন্য হয়ে গেছে। রাতদিন খা খা করে। বেতাগার গাড়োয়ান রমিজ আলি গ্রাম ছেড়ে অন্য গ্রামে চলে গেছে প্রাণের ভয়ে। চায়ের দোকানদার ভবতোষের কিচ্ছু নেই। তার দোকান বন্ধ। সন্ধের পর তার দোকান ঘিরে জমে উঠতো গ্রাম্য আড্ডা। বড়ো বাজার বসতো বেতাগায়। লোকজন গমগম করতো। তার কিছুই নেই। বিরান হয়ে গেছে সব। জনমানবহীন, পরিত্যক্ত।
বিষ্টু পরামাণিকের কাপড়ের দোকান ছিল বেতাগা হাটে। লুট করে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। জায়গাটায় কয়েকটি পোড়া কাঠের খুঁটি ছাড়া আর কিছু নেই। পোড়ানো হয়েছে আরও অনেকের বাড়ি ও দোকান। তা-বলীলা বয়ে গেছে যেন গ্রামের ওপর দিয়ে। নরপিশাচগুলো মানুষ মারা খেলা শুরু করেছে। মানুষের রক্ত দেখলে মানুষের ক্ষতি দেখলে মানুষ আঁতকে ওঠে, মানুষের অন্তরাত্মা কেঁদে ওঠে। আর নরপিশাচদের রক্ত টগবগিয়ে ওঠে। আরও রক্ত ঝরাবার নেশায় মাতাল হয়ে যায়। আরও ঘর পোড়ানোর আশায় উসখুস করে। আরও মা-বোনের ইজ্জত লুটবার আনন্দে মেতে ওঠে। রক্তের ফিনকি দেখলে তাদের খুশি লাগে। মানুষ মারার ছটফটানিতে তারা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। বিপদগ্রস্ত হয়ে কেউ দয়া বা করুণা ভিক্ষা করলে তাদের অত্যাচার বেগবান হয়। এরাই এদেশের বুদ্ধিজীবীদের মারবার নীলনকশা তৈরি করে পশ্চিমাদের হাতে তুলে দিয়েছে। এরাই পথ দেখিয়ে খানসেনাদের গ্রামে ঢুকিয়েছে। ঘরবাড়ি লুট করছে, মানুষ মারছে, গ্রামের পর গ্রাম পোড়াচ্ছে, মা-বোনের ইজ্জত নষ্ট করছে। এরাই হাজার হাজার মানুষকে ভারতে যেতে বাধ্য করছে।
রণজিতপুর ও বেতাগায় সর্বনাশ করেছে রজব আলি। ডাকাত সরদার থেকে হয়েছে রাজাকার কমান্ডার। তার অঙ্গুলিহেলনে এখন অনেককিছু হয়। মুখে মুখে প্রবাদ উঠেছে, মারে রজব আলি রাখে কে।
রাজেনের জন্যে রান্না হয়েছে। সে খেয়ে যাবে। রাতের অন্ধকারেই তাকে বেরুতে হবে।
খেতে বসে রাজেন। দীপ্তি নিজের হাতে খাওয়ায় রাজেনকে। খুব ভালো লাগছে তার। আবার খারাপ লাগছে রাজেনের চলে যাবার কথা ভেবে। তবে এটুকু সান্ত¡না যে তারাও যাচ্ছে। সুতরাং দেখা হবে। ভারতে পৌঁছে রাজেন দেখা করবে। এইতো আর কটাদিন মাত্র।
রান্নাঘরে ঢোকেন শৈলেন দাশ। এর আগে তিনি কোনোদিন ইলিয়াসের বাড়ির রান্নাঘরে ঢোকেননি। প্রয়োজন হয়নি ঢোকবার। কিন্তু আজ বড়ো প্রয়োজন তার। রাজেনের সাথে কথা বলবেন। বেতাগায় গিয়েছিলেন। অনেক দুঃসংবাদ অনেক অশুভ পাঁয়তারার কথা শুনে এসেছেন।
– ‘রাজেন, আজ অক্ষয়তৃতীয়া। চান্দ্র বৈশাখের শুক্লাপক্ষের তৃতীয় তিথি। বেতাগায় থাকলে এদিন বাড়িতে লক্ষ্মীপুজো হতো। এদিন সকালে ¯œান সেরে দু-একজনকে সামান্য বস্ত্র দান করা হতো। কিছুই হলো না এবার। এদিন কারও মনে দুঃখ বা আঘাত লাগে এমন কথা বলতে নেই। তবু একটা কথা তোমাকে না বলে পারছিনে। তুমি যেন দুঃখ পেয়ো না বাবা। তোমার কাল যাবার দরকার নেই। তুমি আজ রাতেই রওয়ানা হও।’ শৈলেন দাশের চোখে মুখে উদ্বিগ্নতা।
তারপর পারুলবালা একবাটি আম কেটে দেন রাজেনের সামনে। ‘খাও বাবা খাও। তোমার কাকাবাবু এনেছেন বেতাগা থেকে। এদিনে মন্দিরে মরশুমের ফল দান করলে শুভ ফল পাওয়া যায়। এখন তুমিই আমাদের মন্দির। তুমি খেলে আমাদের ব্রতটি পালন করা হয়।’ বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন পারুলবালা। পরক্ষণেই বিচলিত হয়ে পড়েন তিনি। ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে যায় মুখ। দীপ্তিকে কাছে টেনে নেন। পারলে পেটের মধ্যে পুনর্বার ধারণ করতেও কুণ্ঠিত নন তিনি।
বিচলিত হয়ে পড়ে রাজেনও। তার কণ্ঠ যেন আটকে আসছে। কথা বলতে পারছে না। তবু রাতেই তার যাবার কথা বলছে কেন এরা!
– ‘কেন কী হয়েছে কাকাবাবু?’ বেশ কিছুক্ষণ পর উত্তর দেয় রাজেন।
– ‘বেতাগা থেকে শুনে এলাম রজব আলি ও তার দলবল তোমাদের কজনকে হন্যে হয়ে খুঁজছে। তুমি এখনও দেশে আছো ওরা জেনে গেছে।’
– ‘তাই নাকি কাকাবাবু। তাহলে তো…’
– ‘হাঁ, আজ রাতেই তোমার চলে যাওয়া ভালো।’
– ‘তাই যাব। তবে রাতেই আমাকে মধুদিয়া পৌঁছতে হবে। হাফিজ যাবে আমার সঙ্গে। সে আমার জন্যে অপেক্ষা করছে।’
একদ- সবাই আতঙ্কিত হলো। কেঁদে ফেলল দীপ্তি। কেঁদে ফেললেন পারুলবালাও। তৃপ্তি ও গৌতম ঘুমিয়ে পড়েছে। তারা কিছু জানে না এসবের।
রাজেন চলে যাচ্ছে। ইলিয়াস আলির বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে সে। মন তার চঞ্চল, উদ্বিগ্ন। তাকে ঘিরে রয়েছে সবাই। দীপ্তিকে সান্ত¡না দিচ্ছে রাজেন। সে বর্ডারে অপেক্ষা করবে। তবু দীপ্তির চোখের জল থামছে না। এ যেন এমন এক বেদনা যা হৃদয়ে কামড়ে ধরে, জ্বালা বাড়ায়। ক্ষত-বিক্ষত করে দেয় মন। আর তাই অবচেতন মনের গভীর থেকে বেরিয়ে আসে কান্না। যে কান্না সামাজিক বাধা-বিপত্তি মানে না। মা-বাবা মানে না। সবার সামনেই ঝরিয়ে দেয় নীরব অশ্রু, শ্রাবণের ধারার মতো।
ইলিয়াসের বাড়িতে তুলসীতলা নেই, গণেশের মূর্তি নেই, মা কালীর ছবি নেই, গঙ্গার জল নেই- যাতে শ্রদ্ধা জানিয়ে রাজেন রওয়ানা হবে। তাই শৈলেন দাশ আর পারুলবালাকে দুই হাত জড়ো করে নমস্কার দিয়ে সে বিদায় নেয়! দীপ্তিকে বলে, ‘আমি যাই তোমরা এসো। দেখা হবে।’
দীপ্তি অস্ফুটস্বরে বলে ওঠে, ‘দুগ্গা দুগ্গা!’…
৫.
‘যাত্রা হল শুরু’
রাজেনকে বিদায় দিয়ে দীপ্তিরাও আর থাকতে পারেনি ইলিয়াস আলির বাড়িতে। সেই রাতেই সংবাদ এলো রাতের মধ্যে গ্রাম ছাড়তে হবে। নতুবা পরদিন ভোরে শুধু রজব আলি নয় স্বয়ং খানসেনারা আসবে। প্রাণে বাঁচতে হলে আজ রাতেই ছাড়তে হবে গ্রাম। চাকলি ছেড়ে শেষবারের মতো বেতাগায় নিজেদের বাড়ি আসে দীপ্তিরা। বেতাগার সবাই তৈরি হচ্ছে। রণজিতপুরের লোকজনও এসে গেছে। সবাই এখন বেতাগায়। সবাই একসঙ্গে রওয়ানা হবে। মুহূর্তের মধ্যে ছোটাছুটি শুরু হয়ে গেল। গোছগাছ শুরু করল সবাই। কোনটা নেবে আর কোনটা ফেলে যাবে ভেবে পাচ্ছে না কেউ।
পারুলবালা চলে যাবার চূড়ান্ত সংবাদ শুনে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। এতদিন ভেবেছিলেন হয়তো যেতে হবে না। কিন্তু না, সত্যি সত্যিই যেতে হচ্ছে। থাকা যাবে না বাপ-ঠাকুরদা বা স্বামীর ভিটেয়। মেয়েটার জন্যও চিন্তাক্লিষ্ট তিনি। সোমত্ত মেয়ে। পথে বেরুনো কতটুকু নিরাপদ হবে তাই ভেবে অস্থির শৈলেন দাশও। তার কেবল চিন্তা মেয়েটাকে নিয়ে। কখন কোত্থেকে কী হয়ে যায়! সব যায় যাক। মেয়ের ইজ্জতই তার কাছে সবচেয়ে বেশি মূল্যবান। সে রক্ষা পেলে তার আর কোনো দুঃখ নেই।
দীপ্তিদের স্কুল মার্চের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত খোলা ছিল। তারপর আপনাআপনি বন্ধ হয়ে গেছে। সবাই যে যার জীবন বাঁচানোর ফিকিরে আছে। দেশের সমস্ত স্কুল-কলেজ বন্ধ। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। হলগুলো খালি। অফিস-আদালতের অবস্থাও তাই। কোনো লোকজন নেই। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এভাবে থাকাটাকে কেউ নিরাপদ মনে করছে না। যে যেভাবে পারছে পালাচ্ছে। চলে যাচ্ছে। তাই যাওয়ার আগে পূর্বপুরুষের সন্তুষ্টির জন্য একটু তর্পণ করে যাওয়া ভালো বলে মনে করেন শৈলেন দাশ। আর ফিরে আসতে পারবেন কিনা, ভাবতেই বুকের মধ্যে হু হু করে ওঠে। তাই দেরি না করে কাউকে কিছু না জানিয়ে তিনি চলে যান বাড়ির পাশে নদীর ঘাটে। শেষবারের মতো ‘জলদান’ করেন তিনি।
পাকিস্তানি সময়নায়করা ইউনিয়ন পর্যায়ে পিস কমিটি গঠন করে দিয়েছে। পিস কমিটিতে একজন চেয়ারম্যান ও কয়েকজন মেম্বর আছে। মানুষের বাঁচা-মরার সিদ্ধান্তটা অনেকটা তাদের মর্জির ওপর নির্ভরশীল।
মুজিবনগর সরকারের রাষ্ট্রপতি করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। যদিও তাঁকে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি রাখা হয়েছে। উপরাষ্ট্রপতি অর্থাৎ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে কাজ চালাচ্ছেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন তাজউদ্দীন আহমেদ, অর্থমন্ত্রী এম. মনসুর আলী। স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুর্নবাসন মন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন এম. কামরুজ্জামান, পররাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রীর দায়িত্বে খন্দকার মোশতাক আহমেদ, প্রধান সেনাপতি এম.এ.জি (মোহাম্মদ আতাউল গণি) ওসমানি, চিফ অব স্টাফ আবদুর রব, বিমানবাহিনী প্রধান এ.কে. খন্দকার।
মুজিবনগর সরকার গঠিত হবার পর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ দেশবাসীর প্রতি ১৭ দফা নির্দেশ প্রদান করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনামা প্রচারপত্র আকারে ছাপিয়ে পূর্ব বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত বিলি করা হয়েছে। বেতাগায় তার এক-দুটো পাওয়া গেছে। খুব গোপনে পড়া হচ্ছে। কেউ যেন টের না পায়। দেয়ালেরও কান আছে। রাজেন চলে যাবার পরপরই একটি প্রচারপত্র নিয়ে এসেছেন ইলিয়াস আলি। কাউকে বলেননি তিনি। গোপনে দীপ্তিকে ঘরে ডেকে হারিকেনের মৃদু আলোয় কাগজটি মেলে ধরেন। তাজ্জব হয়ে যায় দীপ্তি। এ তো স্বাধীনবাংলা মুজিবনগর সরকারের নির্দেশনামা! গায়ের রক্ত হিম হয়ে যায় তার। ইলিয়াস আলি অভয় দিয়ে বলেন, ‘পড়ো মা পড়ো।’ দীপ্তি নিচু স্বরে পড়ে-
১. কোনো বাঙালি কর্মচারী শত্রুপক্ষের সাথে সহযোগিতা করবেন না। ছোটো-বড় প্রতিটি কর্মচারী স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশ মোতাবেক কাজ করবেন। শত্রুকবলিত এলাকায় তারা জনপ্রতিনিধিদের এবং অবস্থা বিশেষে নিজেদের বিচার-বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করবেন।
২. সরকারি, আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের যে সমস্ত কর্মচারী অন্যত্র গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন, তারা স্ব স্ব পদে বহাল থাকবেন এবং নিজ নিজ ক্ষমতা অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করবেন।
৩. সামরিক, আধা-সামরিক লোক কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্ত অবিলম্বে নিকটতম মুক্তিসেনা শিবিরে যোগ দেবেন। কোনো অবস্থাতেই শত্রুর হাতে পড়বেন না বা শত্রুর সাথে সহযোগিতা করবেন না।
৪. স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার ছাড়া অন্য কারও বাংলাদেশ থেকে খাজনা, ট্যাক্স, শুল্ক আদায়ের অধিকার নেই। মনে রাখবেন, আপনার কাছ থেকে শত্রুপক্ষের এভাবে সংগৃহীত প্রতিটি পয়সা আপনাকে ও আপনার সন্তানদের হত্যা করার কাজে ব্যবহার করা হবে। তাই যে কেউ শত্রুপক্ষকে খাজনা, ট্যাক্স দেবে অথবা এ ব্যাপারে সাহায্য করবে, বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিবাহিনী তাদেরকে জাতীয় দুশমন বলে চিহ্নিত করবে এবং তাদের দেশদ্রোহের দায়ে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করবে।
৫. যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিশেষ করে নৌ-চলাচল সংস্থার কর্মচারীরা কোনো অবস্থাতেই শত্রুর সাথে সহযোগিতা করবেন না। সুযোগ পাওয়া মাত্রই তারা যানবাহনাদি নিয়ে শত্রুকবলিত এলাকার বাইরে চলে যাবেন।
৬. নিজ নিজ এলাকার খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির চাহিদার প্রতি লক্ষ রাখতে হবে। আর এ চাহিদা মিটানোর জন্য খাদ্যশস্য উৎপাদন বৃদ্ধির ব্যাপারে জনগণকে উৎসাহিত করতে হবে। মনে রাখবেন, বর্তমান অবস্থায় বিদেশী খাদ্যদ্রব্য ও জিনিসপত্রের উপর নির্ভর করলে তা আমাদের জন্য আত্মহত্যার শামিল হবে। নিজেদের ক্ষমতানুযায়ী কৃষি উৎপাদনের চেষ্টা করতে হবে। স্থানীয় কুটিরশিল্প বিশেষ করে তাঁতশিল্পের উপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে।
৭. কালোবাজারি, মুনাফাখোরী, মজুতদারি, চুরি, ডাকাতি বন্ধ করতে হবে। এদের প্রতি কঠোর নজর রাখতে হবে। জাতির এই সংকটময় সময়ে এরা আমাদের একনম্বর দুশমন। প্রয়োজনবোধে এদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
৮. আর এক শ্রেণির সমাজবিরোধী ও দুষ্কৃতি সম্পর্কেও সদা সচেতন থাকতে হবে। এদের কার্যকলাপ দেশদ্রোহমূলক। এরা হচ্ছে শত্রুপক্ষকে সংবাদ সরবরাহকারী।
৯. গ্রামে গ্রামে রক্ষিবাহিনী গড়ে তুলতে হবে। মুক্তিবাহিনীর নিকটতম শিক্ষা শিবিরে রক্ষিবাহিনীর স্বেচ্ছাসেবকদের পাঠাতে হবে। গ্রামের শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষা ছাড়াও এরা প্রয়োজনবোধে মুক্তিবাহিনীর সাথে প্রতিরোধ সংগ্রামে অংশগ্রহণ করবে। আমাদের কোনো স্বেচ্ছাসেবক বা কর্মী যাতে কোনো অবস্থাতেই শত্রুর হাতে না পড়ে, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।
১০. শত্রুপক্ষের গতিবিধির সমস্ত খবরাখরব মুক্তিবাহিনীর কেন্দ্রে জানাতে হবে।
১১. স্বাধীনবাংলা মুক্তিবাহিনীর যাতায়াত ও যুদ্ধের জন্য চাওয়া মাত্র সমস্ত যানবাহন (সরকারি-বেসরকারি) মুক্তিবাহিনীর হাতে ন্যস্ত করতে হবে।
১২. বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী অথবা বাংলাদেশ সরকার ছাড়া অন্য কারও কাছে পেট্রোল, ডিজেল, মবিল ইত্যাদি বিক্রি করা চলবে না।
১৩. কোনো ব্যক্তি পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর অথবা তাদের এজেন্টদের কোনো প্রকারের সুযোগ-সুবিধা, সংবাদ সরবরাহ অথবা পথ নির্দেশ করবেন না, যে করবে তাকে আমাদের দুশমন হিসাবে চিহ্নিত করতে হবে এবং প্রয়োজনবোধে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
১৪. কোনো প্রকার মিথ্যা গুজবে কান দেবেন না বা চূড়ান্ত সাফল্য সম্পর্কে নিরাশ হবেন না। মনে রাখবেন, যুদ্ধে অগ্রাভিযান ও পশ্চাদাপসরণ দুটোই সমান গুরুত্বপূর্ণ। কোনো স্থান থেকে মুক্তিবাহিনী সরে গেছে দেখলেই মনে করবেন না যে, আমরা সংগ্রামে বিরতি দিয়েছি।
১৫. বাংলাদেশের সকল সুস্থ ও সবল ব্যক্তিকে নিজ নিজ আগ্নেয়াস্ত্রসহ নিকটস্থ মুক্তিবাহিনীর শিবিরে রিপোর্ট করতে হবে। এ নির্দেশ সকল আনসার, মুজাহিদ ও প্রাক্তন সৈনিকদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
১৬. শত্রুবাহিনীর ধরা পড়া সমস্ত সৈন্যকে মুক্তিবাহিনীর কাছে সোপর্দ করতে হবে। কেননা, জিজ্ঞাসাবাদের পর তাদের কাছ থেকে অনেক মূল্যবান তথ্য সংগৃহীত হতে পারে।
১৭. বর্বর খুনি পশ্চিমা বাহিনীর সকল প্রকার যোগাযোগ ও সরবরাহ ব্যবস্থা যাতে পুন প্রতিষ্ঠিত না হতে পারে তৎপ্রতি লক্ষ রাখতে হবে।
প্রচারপত্রটি পড়া শেষ হলে ইলিয়াস আলি সেটা দীপ্তির হাত থেকে নিয়ে নেন। চার ভাঁজ দিয়ে রেখে দেন লেপ-কাঁথা রাখবার বাক্সের মধ্যে। কেউ যেন না দেখে। কেউ যেন না খুঁজে পায়। সকালেই খানসেনারা আসবে রজব আলির সঙ্গে। কখন কার বাড়ি ঘরে ওঠে কে জানে? ইলিয়াস আলির বাড়িতে শেখ মুজিবের যে ছবিটা টাঙানো ছিল সেটাও নামিয়ে ওই বাক্সের মধ্যে লেপ-কাঁথার তলায় লুকিয়ে রাখা হয়েছে। বাক্স খুলে চেক করলে রক্ষে থাকবে না। সবাইকে মেরে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে যাবে। তবুও ইলিয়াস আলি নষ্ট করতে পারে না ছবিটি। ছিঁড়ে ফেলতে পারে না মুক্তিযোদ্ধাদের গোপনে বিলি করা প্রচারপত্রটি। বড়ো কষ্ট হয় তার। মায়া হয় শৈলেন দাশের প্রতি। বেচারা স্ত্রী ও পুত্র-কন্যা নিয়ে রাতেই চলে যাবে। কটাদিন তাদের সাথে ছিল। আর থাকতে পারছে না। ইলিয়াস আলিরও সাহসে কুলোচ্ছে না তাদের রাখতে। খানসেনারা না চিনলেও রজব আলি জানোয়ারটা দেখিয়ে দেবে, ধরিয়ে দেবে ‘মালাউন’ বলে। তখন আর উপায় থাকবে না। চোখের সামনে অসহায়ভাবে ওদের মৃত্যু দেখতে হবে।
সব গোছগাছ করে নিয়েছেন পারুলবালা। জিনিসপত্রের মধ্যে নিজেদের কিছু কাপড়চোপড় আর এনামেলের কয়েকটা হাঁড়ি-পাতিল। ছোটো-বড়ো মিলিয়ে দলের লোকসংখ্যা হয়েছে বারো জন। বাবা শৈলেন্দ্রনাথ দাশ, মা পারুলবালা দাশ, দাদু মতিলাল দাশ, ঠাকুরমা হরিদাসী দাশ, দুই কাকা বিধান দাশ ও তপন দাশ, বিধান দাশের স্ত্রী রেখারানি দাশ, তাদের শিশুপুত্র তরুণ, দীপ্তি নিজে, ভাই গৌতম আর ছোটোবোন তৃপ্তিরানি দাশ।
কাপড়চোপড়গুলো দুটো বোঁচকাতে বাঁধাছাঁদা হয়েছে। দুটোতে হাঁড়িকুড়ি, একটাতে কিছু চিড়ে, ছোটো একটা থলিতে কিছু মুড়ি আর পাঁচ-ছটি পাটালির থান নেওয়া হয়েছে। পারুলবালা ও রেখা রানির গহনাগুলো শৈলেন দাশের কাছে। ধুতির এক কোণায় বেঁধে কোমরে গুঁজে নিয়েছেন। যা কিছু টাকা-পয়সাও তার কাছে। দীপ্তির পরনে সালোয়ার কামিজ। ফুটফুটে চাঁদের মতো এই মেয়েটিকে নিয়ে সবার চিন্তা। তাছাড়া দলে রয়েছে বিধান দাশের নব বিবাহিত স্ত্রী। তার কোলে শিশু তরুণ। সবমিলিয়ে ঝামেলা কম নয়। দলের মুরুব্বি মতিলাল দাশ। কিন্তু তার বয়স হওয়ায় সব ভার পড়েছে শৈলেন দাশের ওপর। তারই নেতৃত্বে গোটা পরিবার শরণার্থী হয়ে ভারতে পাড়ি জমাচ্ছে।
বেতাগা ও রণজিতপুরের সবাই একসঙ্গে যাবে। সবাই দক্ষিণতলা মন্দির মাঠে জড়ো হয়েছে। সেখান থেকেই তাদের যাত্রা শুরু হবে। গভীর রাত। সবার গা ছমছম করছে। জন্মভূমিকে ছেড়ে যাবার যন্ত্রণায় কাতরও। এ ব্যথা যেন সবাইকে দহন করছে, নীরবে মনের অন্তঃপুর কুরে কুরে খাচ্ছে। ইলিয়াস আলিও হতভম্ব হয়ে গেছেন। তার স্ত্রী রহিমা খাতুন সবাইকে শেষবারের মতো খাইয়ে দিয়েছেন। ছেলেমেয়েগুলোকে নিয়ে এতো রাত অবধি জেগে গোছগাছের কাজে সহায়তা করেছেন। বেশ কটি শাঁক আলু, পেয়ারা আর পাকা কলা ঢুকিয়ে দিয়েছেন একটি পোটলায়। পথে দীপ্তি, তৃপ্তি ও গৌতম খেতে পারবে। প্রত্যেকেই মাথায়, কোলে কাঁখে একটি করে বোঁচকা। দীপ্তির হাতে কেবল চিড়ে ও পাটালির থলিটা।
সন্ধের পরপরই সবাই ইলিয়াস আলির বাড়ি থেকে বের হয়। সেখান থেকে বেতাগা, নিজেদের বাড়ি। সেখান থেকে রাত আড়াইটার দিকে রওয়ানা হয়। প্রথমে দক্ষিণতলা মন্দিরের মাঠ, সেখান থেকে একসাথে গ্রামের সমস্ত লোক মিলে রওয়ানা হবে। পারুলবালার ইচ্ছে হলো শেষবারের মতো ভিটেটা আর-একবার দেখে যাবে। ভাগ্যে আর ফেরা হয় কি না। বিদেশ-বিভুঁইয়ে চলে যাচ্ছে।
বাড়িতে পৌঁছে সে কি কান্না তাদের। তবু থাকা যাবে না। এ যেন শবের অন্তিম যাত্রা। যেতেই হবে। তুলসীতলা থেকে বিদায় দিতে হবে। দীপ্তি তার হাতের থলিটা ভগ্ন বারান্দার কিনারে রেখে অন্ধকারের মধ্যে ঘরের মধ্যে গেল। একরাশ বেদনা তার অন্তরকে হাতুড়িপেটা করল। যে বেদনা নীরবে নিভৃতে দীপ্তির চোখ থেকে অশ্রুবর্ষণ করে গেল। কেউ তা দেখতে পেল না।
পারুলবালা উঠোনে মলনের খুঁটিটা ধরে বসে পড়েছেন। তিনি আর যাবেন না বলে কান্নাকাটি করছেন। শৈলেন দাশ তাকে বুঝাচ্ছেন- ‘এখানে থাকা যাবে না পারুল। সকালেই ওরা আসবে। তখন কী উপায় হবে। কেউ থাকছে না। আমরা থাকবো কোন্ ভরসায়, কার কাছে। চলো আমরা যাই। দেশ স্বাধীন হলে আবার আসব। তখন সবই হবে আবার ধীরে ধীরে। বেঁচে থাকলে সবকিছু ফিরে পাবো। এখন তো একটাই কাজ- প্রাণ বাঁচানো।’
সবাই উঠল। দক্ষিণতলা মন্দির মাঠে যেতে হবে। দেরি হয়ে যাচ্ছে। গ্রামের সব লোক সেখানে জড়ো হয়েছে। দীপ্তিরা বারোজন। বাড়ির একেবারে শেষ প্রান্তে যেখানে গোবর পচিয়ে সার তৈরি করা হয় সেই সারকুঁড়। শৈলেন দাশ চাঁদের আলোয় সারকুঁড়ের দিকে একপলক চেয়ে দেখলেন। তিনি হয়তো ভেবে নিয়েছেন, মাঠের ফসলের জন্য এটুকু গোবরসারও মানুষের কত প্রয়োজন। এখন কী অবলীলায় সবকিছু ত্যাগ করে ফেলে রেখে শরণার্থী হয়ে এক লাইনে হাঁটছে। সবার সামনে শৈলেন দাশ। পিছনে মতিলাল দাশ। সবার চোখে জল। তবে পারুলবালা ছাড়া আর কারও মুখে কান্নার শব্দ নেই। তৃপ্তি আর গৌতম মায়ের ঠিক পিছনেই হাঁটছে গুটি গুটি পায়ে। দীপ্তি নীরব। তার মুখে বেশ কিছুক্ষণ কোনো শব্দ নেই। কথা নেই। রাস্তার দু-পাশে বেশ ঝাঁজালো গলায় ডেকে চলেছে ঝিঁ ঝিঁ পোকার দল। অনেকদূরে একটানা ডেকে যাচ্ছে কতকগুলো ঘেয়ো কুকুর। অন্ধকারে বাড়ির পেছনের ঝাঁকড়া শেওড়াগাছের ভুতুমটাও ডাকলো- ভুত-ভুতুম, ভুত-ভুতুম…।
এর পর দ্বিতীয় পর্বে
Please let me know if you’re looking for a article author for your blog.
You have some really great posts and I think I would be
a good asset. If you ever want to take some of the load off, I’d really
like to write some material for your blog in exchange for a link back to
mine. Please shoot me an email if interested. Thanks!
Do you have a spam issue on this website; I also am a blogger, and I was wanting to know your situation; many of us have created some nice methods and we are looking to trade methods with other folks, be sure to shoot me an e-mail if interested.
Hello! Someone in my Myspace group shared this website with us so I came to give it a look.
I’m definitely enjoying the information. I’m
book-marking and will be tweeting this to my followers!
Outstanding blog and excellent design and style.
I absolutely love your blog and find most of your post’s to be exactly I’m looking for. Would you offer guest writers to write content for yourself? I wouldn’t mind composing a post or elaborating on some of the subjects you write regarding here. Again, awesome blog!
Its such as you learn my thoughts! You seem to understand
a lot approximately this, such as you wrote the e-book in it or something.
I believe that you just could do with some % to pressure the message house a bit,
but other than that, that is fantastic blog. A
great read. I’ll definitely be back.
Admiring the time and effort you put into your website and detailed information you provide.
It’s good to come across a blog every once in a while that isn’t the same unwanted rehashed material.
Wonderful read! I’ve saved your site and I’m including your RSS feeds to my Google account.
Good day I am so delighted I found your blog page, I really
found you by mistake, while I was researching on Digg for something else, Anyhow I am
here now and would just like to say cheers for a marvelous post and
a all round interesting blog (I also love the theme/design), I
don’t have time to read through it all at the moment
but I have saved it and also added your RSS feeds, so when I have time I will be back to read much more, Please do keep up the superb b.
Прекрасная статья! Действительно захватывающе узнавать о строительстве жилья.
Моя мечта всегда заключалась в том,
чтобы иметь свой собственный уютный дом,
и ваш блог мотивирует меня. musecollectors.org
Мне особенно понравилась идея
индивидуальных проектов, которые учитывают функциональность и дизайн.
Такой подход позволяет создать
дом, идеально соответствующий моим потребностям
и стилю.
Сейчас моя следующая цель – найти больше информации на
вашем сайте Проекты Домов и Коттеджей Stroyplans.
Ожидаю с нетерпением новых статей и советов о дизайне!
Спасибо вам огромное за полезную информацию и вдохновение!
Touche. Great arguments. Keep up the amazing effort.
I am extremely inspired along with your writing abilities as well as with
the structure for your blog. Is that this a
paid subject matter or did you modify it your self?
Anyway keep up the excellent quality writing, it is uncommon to peer
a great blog like this one today..
Looking for the perfect electric massager? Look no further!
At MassageSolutions konacardshop.com, we bring you detailed
electric massager reviews to help you make the right
choice.
Our dedicated professionals puts each electric massager to the test to provide you with impartial and insightful reviews.
Whether you are experiencing muscle tension, chronic pain, or simply need relaxation, we’ve got you covered.
Discover the best electric massagers on the market, see how they stack up, and pick
the ideal option for you. You can also find buying guides and tips
on how to make the most of your electric massager.
Bid farewell to aches and hello to comfort with the top-notch electric
massagers. Explore our reviews today!
I feel this is among the so much vital information for me.
And i’m glad studying your article. However should
statement on some general things, The web site taste is great,
the articles is really great : D. Excellent activity, cheers
Hello, the whole thing is going nicely here
and ofcourse every one is sharing information, that’s genuinely good, keep up writing.
It’s going to be finish of mine day, however before ending I am reading
this fantastic post to increase my know-how.
Good day! Do you know if they make any plugins to protect against hackers? I’m kinda paranoid about losing everything I’ve worked hard on. Any suggestions?
In search of the perfect electric massager? You’ve come to the right place! At MassageSolutions , we bring you comprehensive electric massager reviews to help you make the optimal choice.
Our dedicated professionals thoroughly tests each electric massager to deliver unbiased and insightful reviews. If you’re experiencing muscle tension, chronic pain, or simply want relaxation, we’ve got you covered.
Find out the best electric massagers on the market, compare, and choose the ideal option for you. We also provide shopping tips and guidance about how to make the most of your electric massager.
Wave farewell to tension and welcome relief with the top-notch electric massagers. Explore our assessments today!
Seeking the perfect electric massager? Your search ends here! At MassageSolutions , we bring you comprehensive electric massager reviews to help you make the right choice.
Our dedicated professionals puts each electric massager to the test to provide you with impartial and helpful reviews. Whether you are experiencing muscle tension, chronic pain, or simply need relaxation, we’ve got you covered.
Discover the best electric massagers on the market, compare, and select the ideal option for you. We also provide purchase guides and guidance about how to make the most of your electric massager.
Wave farewell to tension and hello to comfort with the best electric massagers. Explore our assessments today!
Looking for the perfect electric massager? You’ve come to the right place! At MassageSolutions , we bring you detailed electric massager reviews to help you make the optimal choice.
Our team of experts tests every electric massager rigorously to offer impartial and insightful reviews. Whether you’re dealing with muscle tension, chronic pain, or simply need relaxation, we’ve got you covered.
Explore the highest-rated electric massagers on the market, see how they stack up, and choose the one that suits your needs. Additionally, we offer purchase guides and guidance about how to make the most of your electric massager.
Wave farewell to aches and welcome relief with the top-notch electric massagers. Explore our reviews today!
Приобрести в интернет-магазине
Лучшие для занятий фитнесом по доступным ценам в нашем магазине
Надежность и удобство в каждой детали спорттоваров в нашем ассортименте
Спорттовары для начинающих и профессиональных спортсменов в нашем магазине
Некачественный инвентарь может стать проблемой во время тренировок – выбирайте качественные аксессуары в нашем магазине
Спорттовары только от ведущих производителей с гарантией качества
Улучшите результаты тренировок с помощью спорттоваров из нашего магазина
Разнообразие для самых популярных видов спорта в нашем магазине
Высокое качество спорттоваров по доступным ценам в нашем интернет-магазине
Удобный поиск и быстрая доставка в нашем магазине
Акции и скидки на спорттовары для занятий спортом только у нас
Прокачайте свои спортивные качества с помощью спорттоваров из нашего магазина
Широкий ассортимент для любого вида физической активности в нашем магазине
Проверенный инвентарь для тренировок спортом для мужчин в нашем магазине
Новинки уже ждут вас в нашем магазине
Не пропускайте тренировки с помощью спорттоваров из нашего магазина
Низкие цены на аксессуары в нашем интернет-магазине – проверьте сами!
Разнообразие для любого вида спорта по доступным ценам – только в нашем магазине
Инвентарь для амбициозных спортсменов и любителей в нашем магазине
магазин спорттоваров https://sportivnyj-magazin.vn.ua.
Seeking the perfect electric massager? You’ve come to the right place! At MassageSolutions , we bring you comprehensive electric massager reviews to help you make the best choice.
Our team of experts puts each electric massager to the test to provide you with unbiased and insightful reviews. Whether you’re suffering from muscle tension, chronic pain, or simply need relaxation, we’ve got you covered.
Find out the best electric massagers on the market, see how they stack up, and select the perfect one for your requirements. You can also find shopping tips and guidance about how to make the most of your electric massager.
Say goodbye to tension and hello to relief with the finest electric massagers. Explore our reviews today!
Seeking the perfect electric massager? Look no further! At MassageSolutions , we bring you comprehensive electric massager reviews to help you make the right choice.
Our dedicated professionals thoroughly tests each electric massager to deliver honest and informative reviews. If you’re dealing with muscle tension, chronic pain, or simply want relaxation, we’ve got you covered.
Explore the best electric massagers on the market, contrast, and select the perfect one for your requirements. You can also find buying guides and tips on how to make the most of your electric massager.
Bid farewell to aches and hello to serenity with the best electric massagers. Explore our evaluations today!
Looking for the perfect electric massager? You’ve come to the right place! At MassageSolutions , we bring you detailed electric massager reviews to help you make the best choice.
Our team of experts thoroughly tests each electric massager to offer unbiased and insightful reviews. Whether you are experiencing muscle tension, chronic pain, or simply need relaxation, we’ve got you covered.
Discover the best electric massagers on the market, see how they stack up, and select the ideal option for you. Additionally, we offer shopping tips and advice for how to make the most of your electric massager.
Wave farewell to tension and hello to comfort with the top-notch electric massagers. Explore our assessments today!
Seeking the perfect electric massager? Look no further! At MassageSolutions , we bring you comprehensive electric massager reviews to help you make the right choice.
Our reviewers tests every electric massager rigorously to provide you with impartial and informative reviews. Whether you are suffering from muscle tension, chronic pain, or simply want relaxation, we’ve got you covered.
Explore the highest-rated electric massagers on the market, see how they stack up, and choose the one that suits your needs. You can also find shopping tips and advice for how to make the most of your electric massager.
Wave farewell to tension and hello to comfort with the top-notch electric massagers. Explore our reviews today!
In search of the perfect electric massager? Look no further! At MassageSolutions , we bring you comprehensive electric massager reviews to help you make the optimal choice.
Our reviewers tests every electric massager rigorously to deliver honest and helpful reviews. Whether you are suffering from muscle tension, chronic pain, or simply need relaxation, we’ve got you covered.
Find out the best electric massagers on the market, contrast, and select the ideal option for you. Additionally, we offer purchase guides and tips on how to make the most of your electric massager.
Say goodbye to stress and welcome comfort with the finest electric massagers. Explore our evaluations today!
Looking for the perfect electric massager? Your search ends here! At MassageSolutions , we bring you detailed electric massager reviews to help you make the right choice.
Our dedicated professionals thoroughly tests each electric massager to offer honest and insightful reviews. Whether you’re experiencing muscle tension, chronic pain, or simply want relaxation, we’ve got you covered.
Find out the highest-rated electric massagers on the market, contrast, and pick the ideal option for you. We also provide shopping tips and guidance about how to make the most of your electric massager.
Say goodbye to tension and welcome relief with the top-notch electric massagers. Explore our reviews today!
In search of the perfect electric massager? Your search ends here! At MassageSolutions , we bring you comprehensive electric massager reviews to help you make the best choice.
Our dedicated professionals tests every electric massager rigorously to deliver honest and helpful reviews. If you’re experiencing muscle tension, chronic pain, or simply need relaxation, we’ve got you covered.
Explore the top-rated electric massagers on the market, see how they stack up, and choose the ideal option for you. You can also find shopping tips and tips on how to make the most of your electric massager.
Bid farewell to tension and welcome relief with the finest electric massagers. Explore our reviews today!
Right now it looks like Expression Engine is the best blogging platform out there right now. (from what I’ve read) Is that what you are using on your blog?
In search of the perfect electric massager? Your search ends here! At MassageSolutions , we bring you detailed electric massager reviews to help you make the optimal choice.
Our reviewers tests every electric massager rigorously to offer unbiased and helpful reviews. If you’re suffering from muscle tension, chronic pain, or simply need relaxation, we’ve got you covered.
Discover the best electric massagers on the market, contrast, and select the perfect one for your requirements. We also provide purchase guides and tips on how to make the most of your electric massager.
Wave farewell to stress and welcome comfort with the top-notch electric massagers. Explore our reviews today!
Looking for the perfect electric massager? Your search ends here! At MassageSolutions , we bring you detailed electric massager reviews to help you make the right choice.
Our team of experts thoroughly tests each electric massager to offer unbiased and informative reviews. Whether you’re dealing with muscle tension, chronic pain, or simply want relaxation, we’ve got you covered.
Explore the top-rated electric massagers on the market, contrast, and select the one that suits your needs. You can also find purchase guides and guidance about how to make the most of your electric massager.
Say goodbye to tension and welcome comfort with the finest electric massagers. Explore our assessments today!
Seeking the perfect electric massager? Look no further! At MassageSolutions , we bring you in-depth electric massager reviews to help you make the best choice.
Our team of experts thoroughly tests each electric massager to offer impartial and insightful reviews. If you’re experiencing muscle tension, chronic pain, or simply need relaxation, we’ve got you covered.
Find out the best electric massagers on the market, see how they stack up, and choose the one that suits your needs. You can also find purchase guides and guidance about how to make the most of your electric massager.
Say goodbye to tension and hello to serenity with the top-notch electric massagers. Explore our assessments today!
Прекрасная статья! Действительно захватывающе читать о дизайне домов. Я всегда мечтал о своем собственном уютном уголке, и ваш блог дает мне много вдохновения.
Мне особенно понравилась идея индивидуальных проектов, которые учитывают функциональность и дизайн. Это дает возможность создать дом, который абсолютно подходит под мои потребности и вкусы.
Сейчас моя следующая цель – найти больше информации на вашем сайте Проекты Домов и Коттеджей Stroyplans. Ожидаю с нетерпением новых статей и советов о дизайне!
Выражаю благодарность за ценную информацию и вдохновение!
Seeking the perfect electric massager? Look no further! At MassageSolutions , we bring you comprehensive electric massager reviews to help you make the optimal choice.
Our dedicated professionals thoroughly tests each electric massager to deliver unbiased and helpful reviews. Whether you’re experiencing muscle tension, chronic pain, or simply need relaxation, we’ve got you covered.
Discover the top-rated electric massagers on the market, contrast, and choose the ideal option for you. You can also find buying guides and tips on how to make the most of your electric massager.
Wave farewell to stress and hello to relief with the best electric massagers. Explore our evaluations today!
Отличная публикация! Действительно захватывающе читать о дизайне домов. Я всегда мечтал о своем собственном уютном уголке, и ваш блог дает мне много вдохновения. Стройпланс
Мне особенно понравилась идея индивидуальных проектов, которые учитывают функциональность и дизайн. Это дает возможность создать дом, который абсолютно подходит под мои потребности и вкусы.
Сейчас я отправлюсь исследовать ваш веб-сайт Проекты Домов и Коттеджей Stroyplans. Ожидаю с нетерпением новых статей и советов о дизайне!
Спасибо вам огромное за полезную информацию и вдохновение!
Looking for the perfect electric massager? Your search ends here! At MassageSolutions , we bring you comprehensive electric massager reviews to help you make the best choice.
Our team of experts thoroughly tests each electric massager to provide you with impartial and insightful reviews. Whether you’re suffering from muscle tension, chronic pain, or simply want relaxation, we’ve got you covered.
Discover the best electric massagers on the market, contrast, and select the one that suits your needs. Additionally, we offer shopping tips and tips on how to make the most of your electric massager.
Say goodbye to stress and hello to comfort with the best electric massagers. Explore our reviews today!
Отличная публикация! Действительно интересно узнать больше о строительстве жилья. Моя мечта всегда заключалась в том, чтобы иметь свой собственный уютный дом, и ваш блог мотивирует меня.
Мне очень нравится идея индивидуальных проектов, учитывающих функциональность и дизайн. Такой подход позволяет создать дом, идеально соответствующий моим потребностям и стилю.
Сейчас я отправлюсь исследовать ваш веб-сайт Проекты Домов и Коттеджей Stroyplans. Буду с нетерпением ждать новых публикаций и советов по дизайну!
Выражаю благодарность за ценную информацию и вдохновение!
In search of the perfect electric massager? Look no further! At MassageSolutions , we bring you in-depth electric massager reviews to help you make the optimal choice.
Our dedicated professionals puts each electric massager to the test to offer honest and informative reviews. Whether you are experiencing muscle tension, chronic pain, or simply need relaxation, we’ve got you covered.
Explore the best electric massagers on the market, compare, and pick the one that suits your needs. We also provide purchase guides and tips on how to make the most of your electric massager.
Say goodbye to stress and welcome relief with the best electric massagers. Explore our reviews today!
Прекрасная статья! Действительно захватывающе читать о дизайне домов. Я всегда мечтал о своем собственном уютном уголке, и ваш блог дает мне много вдохновения.
Мне особенно понравилась идея индивидуальных проектов, которые учитывают функциональность и дизайн. Такой подход дает возможность создать дом, идеально подходящий под мои потребности и предпочтения.
Сейчас я отправлюсь исследовать ваш веб-сайт Проекты Домов и Коттеджей Stroyplans. Буду с нетерпением ждать новых публикаций и советов по дизайну!
Большое спасибо за полезную информацию и вдохновение!
Замечательная статья! Действительно интересно узнать больше о проектах домов и коттеджей. Я всегда мечтал о своем собственном уютном уголке, и ваш блог дает мне много вдохновения.
Идея индивидуальных проектов, учитывающих функциональность и дизайн, мне очень нравится. Это дает возможность создать дом, который абсолютно подходит под мои потребности и вкусы.
Сейчас я буду искать больше информации на вашем сайте Проекты Домов и Коттеджей Stroyplans. Ожидаю с нетерпением новых статей и советов о дизайне!
Спасибо вам огромное за полезную информацию и вдохновение!
I do not even know how I ended up here, but I
thought this post was good. I don’t know who you
are but certainly you’re going to a famous blogger if you are
not already 😉 Cheers!
Thanks for sharing your thoughts. I really appreciate your efforts and I am waiting for your further post thank you once again.
Commerce Casino, also in Los Angeles, is among the most famous casinos in the world. It is you’ll the World Poker Tour’s L.A. Poker Classic along with the Poker Hall of Fame and fortune. It’s also the casino where you’re pretty much certainly to meet a recognition. If you want to rub elbows at the table with James Woods, Lou Diamond Phillips, or New jersey Lakers owner Jerry Buss, you’ll desire to stop by Commerce. Commerce has an extensive floor focused upon tournament play and two huge rooms for cash games, one for whites for high limit a single for lower limits. They have Hold`em, Omaha and Stud at almost any limit imaginable.
When you find yourself unsure when the free roulette systems you have found are legit then use them on also casino website and test out if they really are as good as this described. This goes for all tips. There isn’t a harm in practicing, actually it’s comfot knowing. Before you bet real money online have a go on will fun banqueting tables. In a real casino just start off with small wagers to get a feel for that table, or stand and observe an addict for years. There’s nothing worse than deciding head strong and released flat out of cash.
So crucial nutrient you should bet you placed would be the $30. The grand total before you play 3rd bet are of $60 total (the $30 bet placed on your part in brand-new bet used together with the second bet winning already applied to the table). From the $60 you are away $40 and method to bet is of $20.
Of course, it is really a usual thing to decide the best bonus for requirements but if you are not after gaining a lot, you may choose a 100% bonus with $50 limit for prime stakes gaming titles. With the so many kinds money and item bonuses readily available for online gamblers, you definitely have most of types. It just has a wrong method to lose heaps of day-to-day money. It’s that clear-cut.
If you play poker at an online casino reasonably frequently, you will start to make bonds with other players. There are plenty of good people who play poke – and a good friends to be generated. There are however a few people that normally takes liberties, our recommendation is that you never lend money to someone at an internet casino.
Most losers in online gambling often moan about how bad their software tools are. First of all, if ever the site you signed plan is reputable and is particularly transparent in its payout percentages, there isn’t any reason a person personally to blame their software but if you’d like to in order to your current situation, make the purchase anyway and never try appear for for some other reasons for your losses.
Now, let’s think on your actual suffer with. This is where Internet casinos lose away from. Although they became convenient, it’s impossibly to create the real environment that are of a casino online. For example, however, you on a hot run at a live Craps table, you’ll check out the excitement the particular air, and everybody will be cheering. However, online, you’ll only hear the dice rolling, to determine your money balance shifting up and down. Although online casino software made a great progress way, it still cannot marketplace the thrill you’ll receive when you hit an appreciable win having a live modern casino.
Online casinos are usually operated by real time tracking a software program. Please double check while using the website as not online casinos offer reliable software. Winnings, losses, balance and other important stats are updated in real-time so a person simply know your status. Only with real time information is it possible to make better decisions by what games to play, that you just much to bet.
Отличная публикация! Действительно захватывающе читать о дизайне домов. Собственный уютный дом – моя давняя мечта, и ваш блог стал для меня источником вдохновения.
Мне особенно понравилась идея индивидуальных проектов, которые учитывают функциональность и дизайн. Это дает возможность создать дом, который абсолютно подходит под мои потребности и вкусы.
Сейчас моя следующая цель – найти больше информации на вашем сайте Проекты Домов и Коттеджей Stroyplans. Буду с нетерпением ждать новых публикаций и советов по дизайну!
Выражаю благодарность за ценную информацию и вдохновение!
When a draft is completed, it goes via several rounds of editing by our editorial group.
I used to be recommended this blog by means of my cousin. I am no longer certain whether this submit is written by means of him as no one else realize such detailed about my trouble. You are wonderful! Thank you!
Замечательная статья! Действительно захватывающе читать о дизайне домов. Моя мечта всегда заключалась в том, чтобы иметь свой собственный уютный дом, и ваш блог мотивирует меня.
Идея индивидуальных проектов, учитывающих функциональность и дизайн, мне очень нравится. Такой подход позволяет создать дом, идеально соответствующий моим потребностям и стилю.
Сейчас я буду искать больше информации на вашем сайте Проекты Домов и Коттеджей Stroyplans. Ожидаю с нетерпением новых статей и советов о дизайне!
Спасибо вам огромное за полезную информацию и вдохновение!
Отличная публикация! Действительно интересно узнать больше о проектах домов и коттеджей. Собственный уютный дом – моя давняя мечта, и ваш блог стал для меня источником вдохновения.
Идея индивидуальных проектов, учитывающих функциональность и дизайн, мне очень нравится. Такой подход позволяет создать дом, идеально соответствующий моим потребностям и стилю.
Сейчас моя следующая цель – найти больше информации на вашем сайте Проекты Домов и Коттеджей Stroyplans. Ожидаю с нетерпением новых статей и советов о дизайне!
Большое спасибо за полезную информацию и вдохновение!
Отличная публикация! Действительно интересно узнать больше о проектах домов и коттеджей. Моя мечта всегда заключалась в том, чтобы иметь свой собственный уютный дом, и ваш блог мотивирует меня.
Идея индивидуальных проектов, учитывающих функциональность и дизайн, мне очень нравится. Такой подход дает возможность создать дом, идеально подходящий под мои потребности и предпочтения.
Сейчас моя следующая цель – найти больше информации на вашем сайте Проекты Домов и Коттеджей Stroyplans. Буду с нетерпением ждать новых публикаций и советов по дизайну!
Спасибо вам огромное за полезную информацию и вдохновение!
Today, I went to the beach front with my kids. I found a sea shell and gave it
to my 4 year old daughter and said “You can hear the ocean if you put this to your ear.” She put the shell to
her ear and screamed. There was a hermit crab inside and it pinched her ear.
She never wants to go back! LoL I know this is entirely off topic but I had to
tell someone!
Hello would you mind letting me know which web host you’re utilizing? I’ve loaded your blog in 3 completely different browsers and I must say this blog loads a lot quicker then most. Can you suggest a good internet hosting provider at a reasonable price? Thank you, I appreciate it!
Spot on with this write-up, I seriously believe this site needs a great deal more attention. I’ll probably be back again to see more, thanks for the advice!
These are really wonderful ideas in regarding blogging.
You have touched some nice things here. Any way keep up wrinting.
Howdy! I know this is somewhat off topic but I was wondering if you knew where I could find a captcha plugin for my comment form? I’m using the same blog platform as yours and I’m having difficulty finding one? Thanks a lot!
I got this website from my friend who informed me about
this web site and at the moment this time I am browsing this website and reading very
informative articles or reviews here.
As far as craps is concerned, there is really a bet will be called the ‘odds’ decision. This bet provides a minimal benefits the casino and as a result it is not drawn on your traditional table format. To elaborate further on the pass-line bets, the players are required to place this bet to begin with. This bet happens before a new shooter starts rolling the dice. The actual first roll is made, you can place your ‘odds’ bet directly after the ‘passionate’ put money on. Now if functioning at the outcomes, if for example the shooter hits the point, the player would be paid one-on-one and the player can go for the real odds for that odds decision.
Baccarat bonuses aren’t all tough to end up getting. In fact, you can acquire one with relative ease and shouldn’t really put in many effort towards it occasionally. Most casinos offer a bonus whenever you’re making a downpayment. This is the kind of Baccarat bonus that locate come across most are likely to. In a majority of the cases, the bonus is given out like a percentage on the deposit a person make a problem casino. Some might debate that this in fact coming from their deposit, it really is at least better to create something of this occurence sort instead of have almost nothing.
Card counting is usually associated with blackjack, in the instant it can be rather an effective strategy when utilized correctly to you can put odds within your favor during the long Baccarat Online span.
If an individual might be dealt a 3 and an ace, which suggests you get another card, and that third card is an eight, soon you have an entire of several Casino Baccarat . Remember, the key to the game is to obtain closest to nine, without going a lot more. Now what happens when you more than nine truth the first digit has become dropped have a scenic total. Therefore, instead of experiencing twelve, soon you have second. If the dealer has a great deal more two, but less than nine, the dealership is the winner.
These Mini Tables have similar betting ranges (low minimums) for the Blackjack Tables, depending upon the Casino, the day of the week, the use of the day etc.
26. A thing of warning – You are not in order to use your cell phone at computer games table. This is generally true in all casinos. Of course, in order to are playing at a web based gaming table, you can manage what you wish.
In 2003, a 2-year $308 million expansion program starts light and portable development of phase My spouse. This expansion includes a 98-suite hotel, luxuries spa and 2,400-car drive way. Turning Stone Casino is located between Utica and Rome, Central Large apple and is considered the fifth largest tourist attraction inside of the state of brand new York. Boasts of some for.5 million visitors yearly mostly from United States and Europe.
For your hand, anyone might have three choices. You can bet the player hand, the hand toned man walking tie hand held. The tie hand is always going to help the casino by providing them an edge of about 15%. The payout of actually winning the hand might entice you, but the house displays 15% edge over you. Material don’t bet on a tie. Betting on the player hand heading to to supply the steady house a somewhat higher advantage than betting on their bank hand. The particular hand allows you good possible probabilities of winning. It might seem boring, but the largest possibility of leaving the casino along with a pocket involving cash become exciting a lot of.
Your style is so unique in comparison to other folks I’ve read stuff from. Thanks for posting when you’ve got the opportunity, Guess I will just bookmark this blog.
Just on the internet checking things out … enjoy the pictures! I try to learn by looking at other images, too.
Merely internet checking things out … love the images! I attempt to know by checking out other photos, too.
I loved as much as you will receive carried out right here. The sketch is tasteful, your authored subject matter stylish. nonetheless, you command get got an shakiness over that you wish be delivering the following. unwell unquestionably come more formerly again since exactly the same nearly a lot often inside case you shield this hike.
Your style is so unique in comparison to other folks I have read stuff from. Many thanks for posting when you have the opportunity, Guess I’ll just bookmark this page.
Undeniably believe that which you said. Your favorite justification appeared to be on the internet the simplest thing to be aware of. I say to you, I certainly get annoyed while people think about worries that they just don’t know about. You managed to hit the nail upon the top and defined out the whole thing without having side effect , people can take a signal. Will likely be back to get more. Thanks
Thanks for consisting of the beautiful pictures– so vulnerable to a feeling of contemplation.
extremely terrific pic!
I’m not sure why but this website is loading incredibly slow for me. Is anyone else having this problem or is it a issue on my end? I’ll check back later on and see if the problem still exists.
incredibly outstanding photographs!
Your way of describing everything in this post is truly fastidious, every one be able to easily know it, Thanks a lot.
Замечательная статья! Действительно захватывающе узнавать о проектах домов и коттеджей. Собственный уютный дом – моя давняя мечта, и ваш блог стал для меня источником вдохновения.
Идея индивидуальных проектов, учитывающих функциональность и дизайн, мне очень нравится. Это дает возможность создать дом, который абсолютно подходит под мои потребности и вкусы.
Сейчас моя следующая цель – найти больше информации на вашем сайте Проекты Домов и Коттеджей Stroyplans. Ожидаю с нетерпением новых статей и советов о дизайне!
Выражаю благодарность за ценную информацию и вдохновение!
Отличная публикация! Действительно захватывающе узнавать о дизайне домов. Моя мечта всегда заключалась в том, чтобы иметь свой собственный уютный дом, и ваш блог мотивирует меня.
Мне особенно понравилась идея индивидуальных проектов, которые учитывают функциональность и дизайн. Такой подход позволяет создать дом, идеально соответствующий моим потребностям и стилю.
Сейчас я буду искать больше информации на вашем сайте Проекты Домов и Коттеджей Stroyplans. Буду с нетерпением ждать новых публикаций и советов по дизайну!
Выражаю благодарность за ценную информацию и вдохновение!
Hey there, You have performed a fantastic job. I will definitely digg it and in my opinion recommend to my friends. I am sure they will be benefited from this site.
Hi there it’s me, I am also visiting this web site daily, this
website is genuinely good and the viewers are actually sharing good thoughts.
This is the perfect blog for anybody who wants to understand this topic. You realize a whole lot its almost tough to argue with you (not that I actually will need to…HaHa). You certainly put a fresh spin on a subject that’s been written about for decades. Great stuff, just wonderful!
Доступные цены
Трубы из полиэтилена от надежных поставщиков
труба пэ купить https://www.truba-pe.pp.ua/.
Someone essentially help to make significantly articles I’d state.
This is the very first time I frequented your web page and so far?
I amazed with the research you made to make this particular publish incredible.
Excellent process!
Great website! It looks very professional! Maintain the excellent job!
I pay a quick visit each day a few blogs and websites to read posts, but this blog gives quality based writing.