ভোলা মেম্বরের মেয়ে
সিরাজুল ইসলাম

১.
একটা আধময়লা মাস্কের একপ্রান্ত কানে ঝুলিয়ে আলিম বক্শ হন্তদন্ত হয়ে নরিম আলির দোকানে ঢুকলো। হাতে চালভর্তি বড়ো একটা চটের থলি। থলিটা মাথা থেকে নামিয়ে ওজন যন্ত্রের ওপর রেখে দোকানের ছেলেটাকে বললো, ‘বাপ, চালির ওজনডা এট্টু দেকে দে দিন। বুঝি, ওই শালা ভোলা মেম্বর ওজনে কতডা চাল কম দ্যালো। এট্টু ভালো করে দেকে দিস।’
দোকানের ছেলেটা ওজন দেখে বললো, ‘চাচা তোমার চাল হয়েছে তেরো কেজি আট শ। তা তোমার থলেডায় ক কেজি চাল থাকার কোতা?’
- ‘পনরো কেজি।’
- বলো কি চাচা! তাহলি তো মেম্বর তোমায় হদ্দ ঠোকান ঠোকায়েচ। এক কেজি দু শ চাল কোম দেচ। তারপর রয়েচ থলের ওজন। থলেডা মোটে না হলিও পাঁচ শ তো হবেই। মানে মোট এক কেজি সাত শ চাল কোম দেচ তোমার পনরো কেজি চালির মদ্যি।
- তাহলি বোঝ। শুনি, ন্যায্যমূল্যের চালির দোকানে এট্টু কোম দেয়। মনে করেলাম দু-এক শ চাল মনে হয় কোম হয়। ওমা দশটাকার চাল বলে দশটা টাকার দাম নি না-কি! করোনার সময় কাজকম্ম বলতি কিচ্ছু নি। সরকার বলেচ, ঘরে থাকো। লকডাউন। ওরে ঘরে থেকে মানুষ খাবে কী? সারাদিন কাজ করে তাই সংসার চালাতি পেরতেচ না। ঘরে বসে কনে পাবে টাকা? কাল খুকির মা-র ভাই এসে দু শ টাকা দিগেলো। তারতি দেড়শ টাকা আর কার্ডটা নে গেলাম দশটাকা কেজির চাল তুলতি। তা পোঙায় আছেলা বাঁশ ঢুকুয়ে দেচ শালা মেম্বর। করোনা ওরগা ধরে না? শালা চোরের বাচ্চা চোর! করোনায় মরণ হোক তোর!
পাশ দিয়ে যাচ্ছিল রজব শেখ। আলিম বক্শের চেঁচামেচি শুনে দাঁড়িয়ে গেল। মুখের মাস্কটাকে একটু ওপরে তুলে মুখটা আগলা করে প্রথমে আলিমের মাস্কটাকে কান থেকে টান মেরে খুলে নিয়ে বললো, এডা তো এককানে এরকম ঝুলুই রাকলি হবে না। শুনুনি, মাস্ক পরার নিয়মকানুন? দিন-রাত রেডুয়ায় বলতেচ, মাইকি হেঁকতেচ, টেলিভিশনে দেকাচ্চে। শুদু বলতেচ না, শিকুয়েও দেচ্চে। তাও তোমারগা কানে ঢোকে না। কী হবে যে তোমারগা!
- থোও তোমার মাস্ক। পনরো কেজি চাল নেলাম তাতে এক কেজি দু শ চাল কোম। আর দোকানের খোকাডা বললো, থলেডার ওজন নাকি পাঁচ শ। তাতে পুরো এক কেজি সাত শ চাল কোম দেচ। করোনা কার হবে? বলে যাও।
- শুনতিচ, গোডাউন থে নাকি চাল কোম দেচ্চে। সরকারের গোডাউনে যে চাল কেনা থাকে তা থেকে শুখোরুখো বাদ দিলি চাল একটু কোম হয়। সেটুকুন ধরেই চাল কেনা-বেচা চলে। তাই একটু কম নিতি হয়।
- তাই বলে এক কেজি সাত শ কোম? তোমারে তো মনে হচ্ছে চোরের র্ধমপুত্তুর।
- আবার বস্তাডা তো মাগনা না। ওডাও তো চালির দামে দাম। তুমি বস্তা বা থলে নে যাওনি ক্যান? তা হলি চাল মেপে তোমার বস্তায় ঢেলে দিত। মিষ্টির দোকানে দেকোনা, মোটা কাগজের বাক্সে মিষ্টি ঢুকুয়ে তারপর ওজন দেয়। এমনকি ওজন দেবার সময় বাক্সের মুখটাও তোলায় লাগায়। তাহলি ঠোঙার, মানে কাগজের দাম পড়তেচ কত? মিষ্টির দামে না? দেড় শ-দু শ থেকে শুরু করে চার শ, পাঁচ শ পর্যন্ত হয় কি-না?
রজব শেখের কথায় আলিম বক্শ কিছুটা নরম হয়। উত্তেজনার পারদ গামা স্তর থেকে একলাফে আলফা স্তরে নেমে যায়। তারপরও তার হম্বিতম্বি থামে না। তার চাল নিয়ে চেয়ারম্যানের কাছে যাবে বলে জোরগলায় শাসায়।
আলিম বক্শের উচ্চস্বরের কথাবার্তা এতক্ষণ মন দিয়ে শুনেছেন নরিম আলি। লকডাউন হলেও মুদির দোকান বলে তারটা দু ঘণ্টা খোলা রাখা যাবে এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে মালপত্র কেনা-বেচা করা যাবে। এই সুবিধের আওতায় তার দোকান খুলেছে। দোকানের সামনে খদ্দেরকে দু-গজ দূরে দাঁড়ানোর জন্য চুন দিয়ে গোলাকার দাগ দিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু মানছে না কেউ। লোকজন যেখানে-সেখানে দাঁড়াচ্ছে। দোকানের মধ্যে ঢুকে পড়ছে। তাই নরিম আলি একটু রাগত ও ধমকের সুরে আলিম বক্শকে বললেন, তুমি কিন্তু সরকারি আইন মানোনি। হুট করে দোকানের মদ্যি ঢুকে পড়েচাও। তোমার কোনো কাজ বা দরকার থাকলি ওই গোল দাগে দাঁড়াতি হবে। ওকানে দাঁড়ায়ে কাজ মিটুতি হবে। দোকানে ঢোকা যাবে না। নরিম আলির কথায় আলিম বক্শ আরও নরম হয়ে যায়। তারপর বলে, হ্যাঁ, ভুলডা আমার হয়েচ সত্যি। তবে চাল কম দেয়ায় আমার মাথার ঠিক ছেলো না ভাই!
কোনোদিকে জিততে না পেরে আলিম বক্শের মনে এক ধরনের দুঃখ ও ক্ষোভের জন্ম হয়। চাল কিনতে যেয়ে ওজনে ঠকা এবং রজব শেখ ও নরিম আলির কাছে কথায় হেরে যাওয়ায় সে খুব মুষড়ে গেল। শরীর ও মনের যে তেজোদীপ্ত ভাব সে এতদিন বহন করে এসেছে, তাতে কে যেন পানি ঢেলে দিল। কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক তাকিয়ে অনেকটা মৃতবৎ মানুষের মতো চালের বস্তাটা নিয়ে সে বাড়ির উদ্দেশে রওয়ানা হয় এবং পথে একটা আরশোলাকে রাস্তা পার হতে দেখে তাকে ডান পায়ের একটা লাথি মারতে উদ্যত হলে পা খানা আরশোলার গায়ে না লেগে রাস্তায় অর্ধপোতা একটা ইটের কানায় লেগে এমন ব্যথা পেল যে, চালের বস্তাটাকে সে মাথা থেকে ফেলে দিল। তারপর চেয়ারম্যান-মেম্বর থেকে শুরু করে খোদ সরকার প্রধানকে পর্যন্ত এবার ভোট এলে দেখে নেবে বলে খিস্তিখেউড়ে ভরা কিছু বুলি আউড়ে খানিকটা প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করলো। তাতে দেহে কিছুটা হলেও তাগত ফিরে আসে। নতুবা চালের বস্তাটা সে আর বহন করতে পারছে না। তার খুব কষ্ট হচ্ছে।
২.
কদিন যাবৎ আলিম বক্শের খুবই মন খারাপ। মন খারাপের জন্য দুই-তিনটি কারণ ঘটে গেছে পরপর। তার মধ্যে প্রধানটি হলো, স্ত্রী নাহারকে সে একটু কড়া ভাষায় গালাগালি করেছে। ভাত দিতে দেরি হওয়ায় তার এই শাস্তি প্রদান। দ্বিতীয়টি হলো, করোনায় লকডাউন করাতে সরকারি সাহায্য দেওয়ার জন্য যে তালিকা করা হচ্ছে তাতে তার নাম নেই। মানে তার নামে কোনো কার্ড ইস্যু হবে না। আর কার্ড না হলে সাহায্য মিলবে না এটা তো জানার কথা। নাহারের ভাই এই দুঃসময়ে কটা টাকা দিয়েছিল বলেই না সে দশটাকা কেজি দরের চাল কিনতে পেরেছে। সেই নাহারকে সে ভাত দেরিতে দেওয়ার অপরাধে গালাগালি দিল! বউটা কদিন ধরে শুধু কেঁদেই যাচ্ছে। আলিম বক্শের সামনে আর আসছে না। কিন্তু আলিম বক্শ যে ভুলটা শুধরে নেবে সে সুযোগ পাচ্ছে না। যদি কার্ডটা হতো তবে সেটা বলতে স্ত্রীকে একান্তে ডেকে সুযোগ বুঝে ভুলটা স্বীকার করে বউয়ের মুখে হাসি ফোটাতে পারতো। কিন্তু কোনোভাবেই তার দুঃখের নদীতে সুখের ঢেউ উঠছে না।
এরই মধ্যে একটি ঘটনা ঘটে যায়। ঘটনাটা মারাত্মক এবং তা আলিম বক্শকে স্ত্রীর নিবিড় সান্নিধ্য পেতে একটি সূত্র তৈরি করে দেয়। প্রাক্তন ওয়ার্ডমেম্বর মকিম ঢালির বাড়ি থেকে রিলিফের দেড়শ বস্তা চাল উদ্ধার করেছে র্যাব। মকিম ঢালিকে ধরে থানায় নেওয়া হয়েছে। আলিম বক্শ জানে, ওই তিনঠেঙে মকিম ঢালিই তার নামটা বাদ দিয়েছে তালিকা থেকে। ভোলা মেম্বরের শ্বশুর এবং প্রাক্তন মেম্বর হওয়ার সুবাদে ভোলা মেম্বরের অনেক ব্যাপারে মকিম ঢালি হস্তক্ষেপ করে ও পরামর্শ দেয়। আলিম বক্শ ভাবে মকিম ঢালির গ্রেপ্তার হওয়ার সংবাদটা নাহারকে জানাতে হবে এবং এই সুযোগে তার ভারি মনটাকে হালকা করে দিতে হবে। তবেই তার শান্তি। সে চায় শহরের কোর্টে চালান করার আগে মকিম ঢালিকে পুলিশ একটু প্যাঁদানি দিক। তা হলে তার ক্ষোভের অর্ধেকটা প্রশমিত হয়। আর এমন একটা খবর খুব রসিয়ে রসিয়ে নাহারকে বলতে পারলে তার ক্ষোভের পুরোটাই উবে যাবে।
কিন্তু আলিম বক্শের পরিকল্পনার পুরোটা বাস্তবায়ন হলো না। সে জানতে পারলো মকিম ঢালিকে পরদিন আদালতে চালান করা হয়েছে। এদিকে আদালত মকিম ঢালির কাছ থেকে উদ্ধারকৃত চাল সুপার সাইক্লোন আম্পান-য়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মধ্যে বিতরণ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। তবে নাহারের অনাগ্রহের কারণে তার সাথে চিড় ধরা সম্পর্কের বন্ধন আগের মতো হলো না। সে শুধু বললো, যে যেমন পানতি লাববে তার তেমন কাপড় ভেজবে। ও হিসেব আমার করে লাভ নি। তার জন্যি সরকার আচে। আইন-আদালত আচে, বিচার-আচার আচে, জেল-জরিমানা আচে।
এটুকু বলে ছেড়ে দিলে আলিম বক্শের কোনো লাভ-ক্ষতি ছিলো না। কিন্তু তারপরও কথায় কথায় নাহার যখন বললো, চাল তো হয়েচ, কিন্তু চাল তো আর চিবুয়ে খাবা যাবে না। ওডা সেদ্ধ করতি গিলি কাঠ লাগে। অনেকদিন হয়েচ কাঠ নি। পাতা-নাতা কুড়–য়ে রান্না করতিচ তা এক-দেড় মাস হয়েচ। আর হতেচ না। পাত্তিচ নে। আবার ভাত খাতিও তো কিচু লাগে। শুদু ভাত হলি তো হয় না!
আলিম বক্শের মনটায় বড় একটা ধাক্কা খেল। কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। আর কতদিন যে লকডাউন চলবে? কোনো কাজে যেতে পারছে না। ঠাঁয় বাড়ি বসে। রাজমিস্ত্রির জোগালির কাজ তার। কাজই হচ্ছে না কোনোখানে। সব বন্ধ। ইলিয়াছদের বাড়ি কাজ হচ্ছিল বলে পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেট এসে বড় অঙ্কের টাকা জরিমানা করে গেছে। তারপর থেকে সব বাড়ির কাজ বন্ধ। আলিম বক্শ ভাবে, পেটটাকে লকডাউন করতে পারলে মানুষের কাজ না থাকলেও অসুবিধে ছিল না। শুধু শুয়েবসেই কাটিয়ে দিত। কিন্তু কথায় বলে, না শোনে কথা না শোনে বারণ, সবার বড় পেট মহাজন। এদিকে ডাক্তাররা কতরকম স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বলছে। এটা খাও ওটা খাও, যাতে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। দিন আধঘণ্টা রোদে থাকো। প্রচুর পানি খাও, ফলের রস খাও। হালকা ব্যায়াম করো। পর্যাপ্ত ঘুম দরকার। ওরে বাবা, প্যাটে খিদে থাকলি ঘুম আসে? কতরকম রসের কথা! হাত ধোও। বারবার হাত ধোও। পাক-পইষ্কার থাকো। বলি শুদু হাত ধুলি হবে? গা, মাথা, মুক, চোক ধুতি হবে না? কাপড়চোপড়? চালই জুটতেচ না, তো সাবান কেনবো কী দে? যত্তসব আহ্লাদে কোতা। মনটা আবার খারাপ হয়ে যায় আলিম বক্শের। কী করবে ভেবে কূল-কিনারা করতে পারে না।
আলিম বক্শ বাড়ির পাশের শ্মশানঘাটটায় যেয়ে বসে। ছোটোবেলায় শ্মশানঘাটের কদবেল গাছটা থেকে কত কদবেল সে পেড়ে খেয়েছে। আর ওই যে ছোট্ট পাকা জায়গাটা! ওখানেই একটা মানুষকে শুইয়ে দিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়। সেদিন এক করোনা রোগে মৃত মানুষকে রাত-দুপুরে এখানে পুড়িয়েছে। ভূতের মতো সাদা কাপড়ে ঢাকা মানুষগুলোর নড়াচড়া দূর থেকে দেখা গেছে। পুলিশও ছিলো। কাউকে ধারেকাছে যেতে দেয়নি। তারপর থেকে অনেকে আর শ্মশানঘাটের দিকে আসে না। কিন্তু সে কেন এসেছে? তবে কি তার জীবনের প্রতি মমত্ব কমে গেছে? বসে বসে ভাবে সে, কী যে একটা রোগ এলো পৃথিবীতে! কতরকম রোগ-বালাইয়ের কথা সে শুনেছে। কিন্তু এমন আজগুবি রোগের পাল্লায় মানুষ কোনোদিন পড়েছে কিনা সে জানে না। রোগের ওষুধ- ঘরে থাকো আর সাবান-পানি দিয়ে কুড়ি সেকেন্ড ধরে হাত ধোও। মানুষজন থেকে দূরে থাকো। ঘরে থাকো। ঘরে থেকেই করোনার সাথে যুদ্ধ করো।
৩.
-‘আমারে শুদু চুন্নি চুন্নি বলে গালি দেও! চোরের বাপ ডাকাত দেকোগে ওই পাড়ায়!’
-‘কার কোতা বলতিচিস রে মাজু?’ কেউ একজন অতি উৎসাহী হয়ে জিজ্ঞেস করলো।
-‘ভোলার মা-! ধোরা পোড়েচ! হাতেনাতে রিলিফের তেলসহ ধোরা পোড়েচ! পাড়ার লোক সব ছি থু করতেচ!’
-‘ক্যান রিলিফের তেল নে কী করেচ ভোলার মা?’
- ‘ঘরের খাটের তোলায় লাইন দে রিলিফের তেলের পট সাজায়ে রেকেলো। তেল আর তেল! পুলিশ এসে ধরেচ। ভোলার মা-র হাতে হ্যান্ডকাফ উটেচ।
মাজু বলেই চলে- ‘একজন তো বলেই ফেললো- ওরে মাজু, তুই অনেক ভালো। কারও পেটের দায়ে চাল চুরি, কারও পুকুর-নদী-খাল চুরি। আমি যে কী আনন্দ পাইচি নানি তা তোমারে বুজুতি পারবো না…। আমি অন্তত গেরামে ভোলার মা-র চেয়ে ভালো। এ কোতা শুনতি আমার খুউব ভালো লেগতেচ। কোতায় বলে না- উৎপাতের কড়ি চিৎপাতে যায়!’
গ্রামে মাজুর একটু বদনামই আছে। আর সেটা হলো কারও বাড়ি কাজ করতে গেলে বা কেউ মাজুকে কাজে নিলে সে বাড়ি থেকে মাজু কিছু একটা চুরি করবেই। মাজু এজন্য অনেকবার মার খেয়েছে। মাজুকে নিয়ে অনেক বিচার-শালিস হয়েছে। তাই অনেকে আর তাকে কাজে নিতে চায় না। আর কেউ কাজে নিলেও চোখে চোখে রাখে। বাগদা-গলদার ব্যবসা রমরমা হওয়ার পর গার্হস্থ্য কাজে গ্রামে কোনো লোকই পাওয়া যায় না। সবাই বাগদা-গলদার মাথা কাটতে ব্যস্ত। তাতে লাভ দুটো। টাকা-পয়সার সাথে বাগদা-গলদার ঘিলুসহ মাথাটা সে পায়। এতে অভাবের সংসারে সন্তানের মুখে মাছের একটু স্বাদ দেওয়া যায়। ছেলেমেয়েরাও পছন্দ করে খায়। তাই মাছ না কিনতে পারলেও চলে যায়। আবার কেউ কেউ গলদার মাথাগুলো বিক্রি করে দেয় দুটো টাকার জন্য।
ভোলার মা হলো নতুন মেম্বর সহিলদ্দির মা। সহিলদ্দির ডাক নাম ভোলা। তাই রহিমন বিবি এখন ভোলা মেম্বরের মা। আর ওই নামেই সে বেশ পুলক অনুভব করে। ছেলে মেম্বর। অথচ গ্রামের সবাই জানে ভোলা হলো জলজ্যান্ত একটা চোরখ-া, ছেঁচড়া। কী করে যে মেম্বর হয়ে গেল বুঝতে পারলো না কেউ। আবার মেম্বর হবার পর ভোলার ভোল সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। সাহায্যপ্রার্থী কেউ এলে সাহায্য দেওয়া তো দূরের কথা ঘাড় ধরে বের করে দেয়। বলে, ভোটের পরে আর ফচ্ করে না। তাইতো লোকজন বলাবলি করে-
ভোলারে রে ভোলা,
ভোটের পরে-
দেকালি কোলা!
ভোলা বিয়ে করেছে মকিম ঢালির মেঝ মেয়েকে। চোরে চোরে কুটুম্বিতে। মকিম ঢালি ধরা পড়লেও ভোলা মেম্বর পলাতক। একজন করে চাল চুরি, অন্যজন জোচ্চুরি। একজন তেলচোর তো অন্যজন গাঁজাখোর। আর তাতে গ্রামের মানুষের মুখে মুখে ছড়াও রচিত হয়েছে-
রহিমনের পোলা
তেলচোর ভোলা।
ভোলার নামের সাথে ‘তেলচোর’ শব্দের সিল পড়ে গেছে। একসময় মান্দার নামে অনেক লোক ছিল গ্রামটায়। তাদের শনাক্ত করতে কেউ ব্যাঙ মান্দার, কেউ লন্ড্রি মান্দার, কেউ জ্যাংড়ো মান্দার, কেউ বেড়ে মান্দার, কেউ গেটে মান্দার, কেউ হাসা মান্দার, কেউ কালো মান্দার ইত্যাদি নামে পরিচিতি ছিল। ভোলার ক্ষেত্রেও তাই হলো। পাঁচজন ভোলা পাঁচরকম পেশায় থাকায় পেশার সাথে সম্পৃক্ত করে তাদের পরিচিতি ছিলো। তবে এতদিন ভোলার পরিচয় ছিলো ভোলা মেম্বর। এখন তেলচোর ভোলা। আবার কেউ কেউ শুধু তেল ভোলা বলে ডাকতে শুরু করেছে।
সত্যি তাই। জনসেবক সেজে জনপ্রতিনিধিরা জনগণের চাল-ডাল-তেল-চিড়ে-গুড়-মুড়ি সবই মেরে খাচ্ছে। মনে হয় সরকার যেন ওদেরই দিচ্ছে। ওরাই খাবে। আর যাদের জন্য দিচ্ছে ওরা চেয়ে চেয়ে দেখবে। ভোলা মেম্বরের মা ও ছোটো মেয়েটার জন্য খুব দরদ হয় মাজুর। আলিম বক্শের বউ নাহারের পাশে গিয়ে বসে মাজু। ফিসফিস করে বলে, ‘ভোলার মারে পুলিশ ধরেচে শুনেচাও ভাবি?’ - শুনিচি।
- কেডা বললো তোমায়?
- তোমার ভাই বলতেলো। পাড়ায় সবাই বলাবলি করতেচ। তয় ভোলা মেম্বর ধোরা পড়িনি?
- ভোলা মেম্বর পোলায়েচে। যাবা কনে বাচা! মা থানায়। ধোরা তোমাকে দিতি হবে বাছাধন!
- তবে ভোলার ছোটো মেয়েডার না-কি অসুক, তুই কিচু জানিস?
- ঠিক বলেচাও ভাবি। মেয়েডা ফুটফুটে। কিন্তুক মাসে মাসে না-কি রক্ত দেবা লাগে। হাসপাতালে ছুটতি হয়। রক্ত জোগাড় করতি হয়। কিনতি হয়। করোনার মদ্যি রক্ত জোগাড় করতি পেরতেচ না শুনেলাম। হাসপাতালের ধারেকাছে যাতি দেচ্চে না মানুষরে। রোগ-ব্যাধি হলি হাসপাতালে যাবে না তো কনে যাবে? বাড়ি বসে মরবে? করোনা করোনা করে যা না তাই বেবহার করতেচ হাসপাতালের লোকে। এইতো সেদিন এক পোয়াতির বেতা উটলি তিনটে হাসপাতাল ঘুরেও ভর্তি হতি পারিনি। শেষে সদর হাসপাতালের সামনে ভ্যানের ওপর বউডার বাচ্চা হয়েচ। কী লজ্জার কোতা দেকোদিন ভাবি! দেশের একি হলো? সেদিন গে দেকি ভোলার বউডা কেনতেচ। রক্ত না দিলি মেয়েডাকে বাঁচানো যাবে না। যে করে হোক রক্ত দিতিই হবে। এক কঠিন রোগ নে এয়েচ বাচাডা। তার মদ্যি ভোলা মেম্বর তেল চুরি করে পোলায়ে বেড়াচ্চে। ভোলার মা থানায়।
- আহারে! বাচাডা তো তা হলি খুব অসুস্থ। কী যে হবেনি মাজু!
- কী আর হবে? পিথিবীতে কত নোকের কত রকমের অসুক-বিসুক আচে…! রুগিতি হাসপাতাল ভর্তি…! পথেঘাটে লোক মরতেচ বিনে চিকিৎসেয়…। শুনতি পালাম, ঢাকায় না-কি করোনার জন্যি হাসপাতালে পোয়াতি বউরে ভর্তি না কোরায় সিএনজি-র মদ্যি বাচ্চা হয়েচ। আর কী শোনবা কাইনি! ‘করোনা’ ‘করোনা’ করে কত কেচ্চা যে হয়ে গেল দেশটায়… । একের পর এক কেলেঙ্কারি! মাস্ক কেলেঙ্কারি। হাসপাতালের বেড, ওষুদ, করোনার নেগেটিভ-পজিটিভ সার্টিফিকেট কেলেঙ্কারি। মিথ্যের বেসাতি। প্রতারণার জালে ফেইলে রোগীকে সর্বশান্ত করা, লাশ আটকে রাকা, নকল ওসুদ আর ভুয়া ডাক্তারে ভরে গেচ দেশ।
কথাগুলো বলতে বলতে মাজু দেখে আলিম বক্শের হাতে একখানা পত্রিকা। জোরে জোরে পড়ছে আর বলছে, গরিবির রক্তচোষা হাজার হাজার কোটি টাকা মেরে সব বিদেশে পাচার কইরেচেরে মাজু পাচার কইরেচে! - কারা পাচার কইরেচে চাচা?
- শুনবি তবে? ক্যাসিনোর স¤্রাট, গণপূর্তের ঠিকাদার জি.কে শামিম, রিজেন্ট হাসপাতালের সাহেদ, স্বাস্থ্যের ঠিকাদার মিঠু, কেরানি আবজাল ও তার বউ, ডিজির ড্রাইভার মালেক, ডাক্তার সাবরিনা… আরও যে কতজন আচে তার ইয়ত্তা নেই!
- কত টাকায় কোটি হয় চাচা?
- সেডাইতো একন গুনে দেকতি হবে। শুদু কোটি না শ শ কোটি, হাজার হাজার কোটি…।
- সব্বোনাশ!
৪.
আলিম বক্শের সাথে মাজু কথা বলতে বলতে তাদের কানে আসে করুণ কান্নার আওয়াজ। মাজু এগিয়ে যায় রাস্তার দিকে। শুনতে পায় ও-পাড়ার ভোলার মেয়েটা মারা গেছে। থেলাসিমিয়া। সময়মতো রক্ত দিতে না পারায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। আর জ্ঞান ফিরে আসেনি।
আলিম বক্শও ছুটতে ছুটতে ভোলার বাড়ি যায়। উঠোনে দাঁড়ায়। একটা সাদা চাদরে মোড়া নিথর মেয়েটা সেখানেই শোয়ানো। চারিদিকে শুধু কান্না। আলিম বক্শও ডুকরে কেঁদে ওঠে। অশ্রু গড়িয়ে পড়ে তার চোখ থেকে। মনে মনে বলে, ভোলারে! কার জন্যি চুরি করে পোলালি? মেয়েডারে তো বাঁচাতি পারলিনে!
০৩ মে ২০২০


সিরাজুল ইসলাম
জন্ম ১৯৬০, সাতক্ষীরা জেলার দেবহাটা উপজেলাধীন পারুলিয়া গ্রামে।
প্রকাশিত গ্রন্থ
আবছা আপেক্ষিক (১৯৮৬), কাব্যগ্রন্থ
দুজনে (১৯৯৪), যৌথ গল্পগ্রন্থ
দৌড় ও দোলা (১৯৯৮), যৌথ গল্পগ্রন্থ
বামাবর্ত ও অন্যান্য গল্প (২০১৭), একক গল্পগ্রন্থ
১৯৮৮ তে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় (গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর) আয়োজিত উদীয়মান সাহিত্যিকদের দেশব্যাপী সাহিত্য প্রতিযোগিতায় কবিতা ও গল্প উভয় বিষয়ে বিভাগীয় পর্যায়ে শীর্ষস্থান অধিকার করে ‘একুশে সাহিত্য পুরস্কার’ লাভ করেন।
জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র থেকে ১৯৯২ তে পুস্তক রচনা, অনুবাদ ও সম্পাদনা পদ্ধতি এবং ১৯৯৩ তে গ্রন্থ রূপায়ণ ও চিত্রণ বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি-র গবেষণা সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন। তাঁর গবেষণামূলক রচনা বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট পত্রিকা ‘মাতৃভাষা’ ছাড়াও বাংলাদেশের অনেক প্রতিনিধিত্বশীল পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়েছে।
১৯৯৩ তে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র বাংলাদেশ আয়োজিত বাংলা চতুর্দশ শতাব্দী পূর্তি উপলক্ষে ‘গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানের পূর্বশর্ত গণগ্রন্থাগার’ শীর্ষক প্রবন্ধ রচনায় জাতীয় পর্যায়ে শীর্ষস্থান অধিকার করেন এবং পুরস্কৃত হন।
সম্পাদিত পত্রিকা
বিপরীত। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৫ : ২৬ মার্চ ১৯৮৫; শহীদ দিবস সংখ্যা ১৯৯০ ; জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৯১তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশিত, বৈশাখ-আষাঢ় ১৩৯৭, জুন ১৯৯০।
উচ্চারণ। ২৬ মার্চ ১৯৮৬ : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০০৪।
নৈর্ঋত। শহীদ দিবস ১৯৯২, ফাল্গুন ১৩৯৮।
স্রােত। ফেব্রুয়ারি ২০০০, ফাল্গুন ১৪০৬ : নভেম্বর ২০১৯।
চিত্রণ। ১ আগস্ট ২০০১।
সঙ্কলন। অকটোবর ২০০২, কার্তিক ১৪০৯।
নবনূর। জুলাই ২০১৪, শ্রাবণ ১৪২১
কবিতাপত্র। ২১ মার্চ ২০১৬, ৭ চৈত্র ১৪২২ : ১৮ অকটোবর ২০১৭।

লেখকের আরও লেখা :
best 10 online pharmacies: buy prescription drugs online – drug stores canada
https://indiapharmacy.site/# best india pharmacy
cheap rx drugs: online meds – certified online canadian pharmacies
canadian pharmacy online ship to usa: trust canadian pharmacy – canada pharmacy 24h
discount pharmaceuticals Online pharmacy USA online prescription
https://buydrugsonline.top/# reputable canadian online pharmacies
reputable indian pharmacies: cheapest online pharmacy india – india pharmacy mail order
canadian drugstore viagra: buy drugs online – overseas online pharmacy
https://ordermedicationonline.pro/# international pharmacies that ship to the usa
http://paxlovid.club/# paxlovid price
neurontin price comparison: buy gabapentin online – neurontin for sale
https://gabapentin.life/# generic gabapentin
buy paxlovid online: Paxlovid over the counter – paxlovid price
http://wellbutrin.rest/# wellbutrin 450 mg
where to buy cheap clomid pill: clomid best price – can i order cheap clomid prices
Paxlovid buy online https://paxlovid.club/# paxlovid cost without insurance
http://paxlovid.club/# paxlovid covid
paxlovid india: Paxlovid over the counter – Paxlovid buy online
https://claritin.icu/# ventolin 108 mcg
neurontin 300 mg cost: neurontin prescription – neurontin for sale
https://paxlovid.club/# Paxlovid over the counter
can i purchase cheap clomid: Buy Clomid Online – can you buy generic clomid without a prescription
http://clomid.club/# buying generic clomid no prescription
farmacia online più conveniente: cialis generico consegna 48 ore – farmacie online sicure
siti sicuri per comprare viagra online viagra prezzo farmacia viagra cosa serve
farmacia online miglior prezzo: farmacia online migliore – farmacia online più conveniente
https://avanafilit.icu/# comprare farmaci online all’estero
dove acquistare viagra in modo sicuro: alternativa al viagra senza ricetta in farmacia – viagra online in 2 giorni
farmacia online piГ№ conveniente: dove acquistare cialis online sicuro – farmacia online migliore
farmacia online miglior prezzo: farmacia online – farmacia online miglior prezzo
cialis farmacia senza ricetta: alternativa al viagra senza ricetta in farmacia – miglior sito dove acquistare viagra
viagra naturale in farmacia senza ricetta alternativa al viagra senza ricetta in farmacia dove acquistare viagra in modo sicuro
https://kamagrait.club/# farmacie on line spedizione gratuita
farmacie online sicure: farmacia online miglior prezzo – farmacia online migliore
farmacie online sicure: kamagra gel prezzo – farmacia online senza ricetta
top farmacia online: farmacia online migliore – farmacia online senza ricetta
migliori farmacie online 2023: farmacia online miglior prezzo – farmacia online senza ricetta
viagra 100 mg prezzo in farmacia: viagra online spedizione gratuita – alternativa al viagra senza ricetta in farmacia
farmacie online autorizzate elenco: farmacia online migliore – farmacia online senza ricetta
miglior sito per comprare viagra online viagra consegna in 24 ore pagamento alla consegna viagra generico prezzo piГ№ basso
top farmacia online: cialis generico – farmaci senza ricetta elenco
http://avanafilit.icu/# farmacie online autorizzate elenco
comprare farmaci online con ricetta: avanafil – farmacia online più conveniente
comprare farmaci online all’estero: Farmacie che vendono Cialis senza ricetta – farmacie online autorizzate elenco
farmaci senza ricetta elenco: Farmacie a milano che vendono cialis senza ricetta – farmacia online miglior prezzo
farmacie online autorizzate elenco: Tadalafil prezzo – comprare farmaci online con ricetta
farmacia online: Tadalafil generico – farmacia online migliore
comprare farmaci online con ricetta Farmacie a roma che vendono cialis senza ricetta farmacie online affidabili
farmacia online migliore: kamagra gel prezzo – top farmacia online
esiste il viagra generico in farmacia: viagra generico – gel per erezione in farmacia
http://kamagrait.club/# farmacia online senza ricetta