ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব এবং প্রথম ভাষা শহিদ আনোয়ার হোসেন : অরবিন্দ মৃধা

ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব
এবং
প্রথম ভাষা শহিদ আনোয়ার হোসেন

অরবিন্দ মৃধা

 

বাংলাভাষা আন্দোলন দুটি ধাপে সংগঠিত হয়। প্রথম ধাপ ১৯৪৮ খ্রিঃ ১১ মার্চ ‘বাংলা ভাষা দাবি দিবস’ এবং দ্বিতীয় ধাপ ১৯৫২ খ্রিঃ ২১ ফেব্রুয়ারি ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা সংগ্রাম পরিষদ’ এর আন্দোলন।

প্রথম ধাপের আন্দোলনে মূলত ছাত্ররা নেতৃত্ব দেন এবং দেশের প্রধান প্রধান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা আন্দোলনকে সংগঠিত করেন। তৎকালীন খুলনার বি এল কলেজের ছাত্ররা এই আন্দোলনে অংশ গ্রহন করেন এবং গুটি কয়েক ছাত্র দুঃসাহসিক ভুমিকা পালন করেন। এঁদের মধ্যে আনোয়ার হোসেন অন্যতম। তিনি এই প্রথম ধাপের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে পুলিশের হাতে বন্দি হন এবং তাঁকে কারাগারে বন্দি অবস্থায় গুলি করে হত্যা করা হয়। দ্বিতীয় ধাপের ২১শে ফেব্রুয়ারির আন্দোলনে ছাত্রদের পাশাপাশি সুধি সমাজ ও সাধারণ মানুষ অংশগ্রহণ করেন। দু’টি আন্দোলনেই তৎকালীন ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান নেতৃত্ব এবং নির্দেশনা প্রদান করেন।

১৯৪৮ এ ফেব্রুয়ারি মাসে করাচিতে অনুষ্ঠিত সংবিধান সভার বৈঠকে রাষ্ট্রভাষা নির্ধারণ সংক্রান্ত আলোচনায় পূর্ব বাংলার তৎকালীন কুমিল্লার কংগ্রেস সদস্য ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত উর্দুর পাশাপাশি বাংলা ভাষাকেও পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এটাই কোনো জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে বাংলা ভাষা রক্ষার প্রথম প্রস্তাব। এমনি অবস্থায় ১৯৪৮ এর ১৯ মার্চ মিঃ জিন্নাহ প্রথমবারের মতো ঢাকায় আগমনের খবর প্রচার হয়। তাঁর আগমনকে সামনে রেখে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলার’ দাবিতে সাংস্কৃতিক সংগঠন তমদ্দুন মজলিস, বাঙালি বুদ্ধিজীবী, শিক্ষকসহ নানা পেশার মানুষ ফুঁসে ওঠে এবং নানা আলোচনা সমালোচনা শুরু হয়।

১৯৪৮ সালে ৪ ঠা জানুয়ারি পূর্বপাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠিত হয় ঢাকায়, যার পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে ছিলেন কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের ছাত্রনেতা, অবিভক্ত ভারতের অন্যতম ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। তৎকালিন মুসলিম ছাত্রলীগ, প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনে প্রতিবাদী একটি অংশ নয়া পাকিস্তান সরকারের ভাষা বৈষম্য ও দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে সরাসরি আন্দোলনে নামে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১১ মার্চ-কে ‘বাংলা ভাষা দাবি দিবস’ ঘোষণা করে। কর্মসূচী সফল করার জন্য ছাত্রদের মাঝে দেশব্যাপি প্রচার চালানো হয়। এ বিষয়ে তৎকালীন ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান (পরে বঙ্গবন্ধু ও জাতির পিতা)সহ সমমনা ছাত্র নেতাগণ ১১ই মার্চকে সফল করার জন্য দেশের বিভিন্ন জেলায় স্কুল,কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল, মিটিং ও কমিটি গঠনের কাজ করেন।

এ উপলক্ষে শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা থেকে ফরিদপুর, যশোর, খুলনা, বরিশাল এবং দৌলতপুরে ছাত্রদের মাঝে আন্দোলনের বীজ ছড়িয়ে দিয়ে আন্দোলন সফল করার জন্য মিটিং সমাবেশ এবং কমিটি গঠন করেন। তিনি খুলনার দৌলতপুরে প্রগতিশীল সমমনা ছাত্রদের নিয়ে সভা করে। তিনি বলেছিলেন, ‘দৌলতপুরে মুসলিম লীগ সমর্থক ছাত্ররা আমার সভায় গোলমাল করার চেষ্টা করলে খুব মারপিট হয়, কয়েকজন জখম হয়। এরা সভা ভাঙতে পারে নাই। আমি শেষ পর্যন্ত বক্তৃতা করলাম।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী : শেখ মুজিবুর রহমান)।

শেখ মুজিবুর রহমান ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ এই সভা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু জেলায় জেলায় গিয়ে আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য ছাত্রলীগের কমিটি গঠন করেন। খুলনায় তিনি তাঁর অনুসারী মুসলিম ছাত্রলীগের শেখ আব্দুল আজিজ এবং মোমিন উদ্দিনকে সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক করে ১১ মার্চের ‘বাংলা ভাষা দাবি’ দিবসকে সফল করা এবং জনমত গড়ে তোলার জন্য ছাত্র জনতার প্রতি আহ্বান জানান। তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘আমি ফরিদপুর, যশোর হয়ে দৌলতপুর, খুলনা ও বরিশালে ছাত্র সভা করে ঐ তারিখের ৩দিন পূর্বে ঢাকায় ফিরে এলাম। (পূর্বোক্ত: পৃষ্ঠা : ৯২)

এই সময় প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলির নেতা কর্মীগণ পাক সরকারের দমন পীড়ন এবং ধড়পাকড়ে অস্থির হয়ে পড়ে। দৌতলপুর কলেজের ছাত্র ফেড়ারেশন ছাত্র নেতা এবং প্রগতিশীল অন্যান্য রাজনৈতিক দলের ছাত্ররা বঙ্গবন্ধু অনুসারি মুসলিম ছাত্রলীগের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে ভাষা আন্দোলনে এগিয়ে আসে।

তৎকালীন খুলনা জেলার দৌলতপুর ব্রজলাল কলেজের ছাত্র নেতৃবৃন্দের একটি অংশ নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে দিয়ে ১১ মার্চকে সফল করার জন্য চোঙা মুখে লাগিয়ে বাংলা ভাষা রক্ষার জন্য প্রচার প্রচারণা চালায় এবং নির্ধারিত দিনে মিছিল সহকারে দৌলতপুর থেকে হেঁটে খুলনার তৎকালীন গান্ধি পার্কে (বর্তমানে হাদিস পার্ক) জমায়েত হয়ে সভা করে বক্তব্যের মাধ্যমে এবং লিখিতভাবে বাংলা ভাষার দাবিনামা পেশ করেন বি.এল কলেজের তেজদীপ্ত মেধাবী ছাত্রনেতা আনোয়ার হোসেন। তার সাথে ছিলেন কলেজের অন্যান্য কয়েকজন ছাত্রনেতা। এই দাবিনামা পেশের কারণে ১১ই মার্চ ১৯৪৮ আনোয়ার হোসেনকে পুলিশ গ্রেফতার করে ডিটেনশন ও অন্যান্য মামলায় আটক রাখে। ১৯৪৯-এ তাঁকে রাজশাহী জেলে প্রেরণ করা হয়। এখানে অন্যান্য কারাবন্দিদের সাথে সরকারী নির্যাতন নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা রাখার এক পর্যায়ে রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়ার্ডে জেলার মি. এফ বিলের নির্দ্দেশে পাগলা ঘন্টা বাজিয়ে ১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল গুলি করে ৭(সাত) জন দেশপ্রেমিক রাজবন্দিকে নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এঁদের মধ্যে ভাষার দাবিতে বন্দি খুলনা বি.এল কলেজের ছাত্র আনোয়ার হোসেনও পুলিশের গুলিতে শহিদ হন।

এ বিষয়ে শিক্ষাবিদ, গবেষক, অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির উল্লেখ করেছেন, ‘বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াই’র মূল সংগঠকদের অন্যতম আনোয়ার হোসেন শহিদ হয়েছিলেন। তিনিই প্রকৃত পক্ষে ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহিদ’। (সূত্র : একুশে প্রবন্ধ সংকলন, একুশে বই মেলা-২০১৭ :  পৃষ্ঠা-৮)

আন্দোলন বিষয়ে খুলনার লেখক, ভাষা সৈনিক আবদুল হালিম উল্লেখ করেছেন, ‘তখন পাকিস্তান তথা তার জনকের বিরুদ্ধে মুখ খোলে কার সাধ্যি! এ অবস্থার মধ্যে যে কয়জন এগিয়ে আসেন তারা হলেন, ছাত্র ফেডারেশনের নেতা স্বদেশ বোস; সন্তোষ দাসগুপ্ত, ধনঞ্জয় দাস, আনোয়ার হোসেন ও মুসলিম ছাত্রলীগের তাহমিদ উদ্দীন আহম্মদ, জিল্লুর রহমান, মতিয়ার রহমানসহ আরও কয়েকজন। …তখনকার খুলনার একমাত্র কলেজ দৌলতপুর কলেজে বসেই তারা ঠিক করেন খুলনাতেও বাংলা ভাষার স্বপক্ষে মিটিং করার। (তথ্যসূত্র : খুলনার ভাষা আন্দোলন : আটচল্লিশ ও বায়ান্ন, পৃষ্ঠা-৩, প্রকাশকাল-২১ ফেব্রয়ারি ১৯৮৫)

বৃটিশের শাসন থেকে সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্র পাকিস্তানের নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলা খুবই কষ্টসাধ্য ছিল। ছাত্ররা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের বিশেষ করে মুসলিম লীগ নেতাদের নিকট থেকে দারুণভাবে বাধাগ্রস্থ হচ্ছিল। এমন অবস্থায় কয়েকজন সাহসী ছাত্র নানা বাধাবিঘ্ন, ভয়ভীতি উপেক্ষা করে বক্তৃতা এবং দাবিনামা পেশ করেন। এ বিষয়ে তিনি উল্লেখ করেছেন, “ দৌলতপুর কলেজ থেকে ২০/২৫ জনের একদল ছাত্র পায়ে হেঁটে এসে মিটিং-এ যোগ দেয় কিন্তু সাধারণ ছাত্ররা, জনসাধারণ কেউ ভয়ে মিটিং-এর কাছে আসে না, তারা সব রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে। এমন অবস্থায় ছাত্ররা কোনো রকমে সভা আরম্ভ করে (তাহমিদ উদ্দীনের) সভাপতিত্বে সামান্য বক্তৃতা এবং একটা লিখিত রেজুলেশন পড়ে সভা শেষ করে। কিন্তু তাতেও ছাত্র নেতারা রেহাই পেল না। ঐ দিন সন্ধ্যায় আনোয়ার হোসেনকে গ্রেফতার করে। কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র আনোয়ার হোসেনের সেই প্রথম কারাবরণ। আনোয়ারকে গ্রেফতারের পর এসপি মহীউদ্দীন সাহেব নিজেই তাকে ইন্ট্রোগেশন করতে লাগেন, কিন্তু তাতে পরাস্ত হয়ে বলেন, ‘তুমি কি জিন্নাহ সাহেবের চেয়ে বেশী বোঝ নাকি? তুখোড় ছাত্র নিবেদিত প্রাণ আনোয়ার সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেয়, ‘জিন্নাহ সাহেব জিন্নাহ সাহেবের মতো বোঝেন আর আমি বুঝি আমার মত। .. ‘।  সঙ্গে সঙ্গে এক ঘুষি মারেন আনোয়ারের মুখে। আনোয়ার…কোনদিন মাথানত করে নাই শত অত্যাচার, অবিচার আর অসত্যের কাছে এমনকি মৃত্যু ভয়েও না “

১৯৪৮ এর ১১ মার্চ তারিখে বাংলাভাষা দাবি দিবস প্রতিষ্ঠা আন্দোলনে দাবিনামা পেশ করায় খুলনা থেকে ছাত্র নেতা ‘তাহমিদ উদ্দীন, সন্তোষ ঘোষ, ধনঞ্জয় দাস, শৈলেন ঘোষ, স্বদেশ বোস ও আনোয়ার হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়। আনোয়ার হোসেন …মেধাবী ছাত্র হিসেবে চারিদিকে তার খ্যাতি ছিল। রাজশাহী সেন্ট্রাল জেলে খাপড়া ওয়ার্ডে বন্দী অবস্থায় তাকে হত্যা করা হয় (১৯৫০)।’ (ব্রজলাল কলেজের ইতিহাস :  প্রফেসর মোঃ বজলুল করিম । পৃষ্ঠা: ৭৫০)

খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ড ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বেঁচে যাওয়া নেতাগণের অনেকেই পরবর্তীতে খাপড়া ওয়ার্ড হত্যার বিবরণ দিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে- খাপড়া ওয়ার্ডে গুলির মুখ থেকে বেঁচে যাওয়া আহত রাজবন্দী সত্যরঞ্জন ভট্রাচার্য্য হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে উল্লেখ করেছেন, ‘কমরেড আনোয়ারের মুখে গুলি লেগে মুখটা প্রায় উঠে গিয়েছিল। তাঁর প্রতিটি নিশ্বাসের সংগে রক্ত বেরিয়ে আসছিল’ আহত কারাবন্দী সত্যেন সরকার উল্লেখ করেছেন, ‘ঘটনা ঘটে সকাল নয়টায়। তাৎক্ষনিক মৃত্যু হয় দিলওয়ারের বীরের মৃত্যু। তারপর আনোয়ারের মুখের বাঁ দিকটা উঠে যায়। গুলি আলাদা হয়নি।’

আহত বেঁচে যাওয়া সৈয়দ মনসুর হাবিবুল্লাহ; (পরবর্তীতে পশ্চিম বঙ্গের স্পিকার ও মন্ত্রী ছিলেন) উল্লেখ করেছেন, ‘সেদিন যাঁরা শহিদ হয়েছিলেন, সবাইকে আলাদাভাবে জানতাম। কম্পরাম, বিজন, আনোয়ারকে জেলে দেখেছি। আনোয়ার খুব ভালো ছিল। সে কথায় কথায় গান করতো, সুর করতো। স্কুলের শিক্ষক নানার কাছে মানুষ হয়েছে। বাবা গরীব কৃষক মা পাগল হয়ে গিয়েছিলেন আনোয়ারের শোকে। তাঁর মা লোকদের ধরে ধরে জিজ্ঞেস করতেন, ‘আনোয়ার কে দেখেছিস? ( খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ড : ১৯৫০ – মতিউর রহমান – প্রথমা, এপ্রিল ২০১৫ )

‘খাপড়া ওয়ার্ড’ গ্রন্থের লেখক প্রথম আলো সম্পাদক, মতিউর রহমান আন্দোলনকারী রাজবন্দীদের হত্যার বর্ণনায় উল্লেখ করেছেন, ‘উত্তেজনাপূর্ণ এক পটভূমিতে ১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল সকালে কোনো বিপদ সংকেত ছাড়াই খাপড়া ওয়ার্ডের চারদিক থেকে ২০টি বড় বড় জানালা দিয়ে ব্যাপক গুলি বর্ষণ করা হয়। গুলি বর্ষণের পর বর্বরভাবে লাঠিপেটা করা হয় আহত ব্যক্তিদের। পুলিশের গুলিতে সাত জন রাজবন্দী- বিজন সেন, দিলওয়ার হোসেন, হানিফ শেখ, কম্পরাম সিংহ, সুখেন্দু ভট্টাচার্য, সুধীন ধর ও আনোয়ার হোসেন নিহত হন। প্রায় বিয়াল্লিশজন রাজবন্দীর দু-একজন ছাড়া সবাই আহত হন।’ (পূর্বোক্ত পৃষ্ঠা-১৪৬)

অনুসন্ধানে জানা গেছে, আনোয়ার হোসেন এর পিতার নাম কোনাই গাজী, মাতার নাম পরীজান বিবি, আনোয়ার হোসেনের নানার বাড়ি সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি উপজেলার বুধহাটা গ্রামে। আনোয়াররা স্বপরিবারে নানা বাড়িতে থাকতেন। প্রাইমারী স্কুল (১৯২৬ খ্রিঃ প্রতিষ্ঠিত) স্থানটির পাশে তাদের ঘর ছিল। স্থানটি বর্তমানে বাঁশ বাগান ও কবরস্থান। আনোয়ারের পিতার বাড়ি ছিল সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি উপজেলার শোভনালী গ্রামে।

তাঁর নানা বাছের আলী সরদার (শিক্ষক) এবং মামা বাবর আলীর প্রেরণা ও সহযোগিতায় মেধাবী আনোয়ার লেখাপড়া করতেন। আনোয়ার বুধহাটা প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষা শেষ করে বুধহাটা হাইস্কুলে (স্থাপিত-১৯১৫ খ্রি.) কিছুদিন পড়াশুনা করেন, পরে খুলনা জিলা স্কুলে ভর্তি হন। এ তথ্য জানিয়েছেন আনোয়ারের বাল্য সহপাঠি হাবাশপুর গ্রামের আবুবক্কর সরদার (জন্ম ১৩৩৪ বঙ্গাব্দ) পিতা : মৃত্যু আক্কাস সরদার। তিনি আরো বলেন, ‘আনোয়ারের দিল কলজে ছিল, সাহসী ছিল ও লেখাপড়ায় ভালো ছিল। বিজ্ঞানী আচার্য্য পিসি রায় এখানে যাওয়া আসা করতেন। একবার বুধহাটা প্রাইমারী স্কুলের জন্য ৫০ (পঞ্চাশ) টাকা দিইলো, তাই স্কুল ঘর টিন দিয়ে ছাওয়া হইছিল।’ তিনি আরো জানান, ‘আনোয়ার আবুল ও আজিবর ওরা তিন ভাই ছিল। আজিবর অল্প বয়সে মারা যায়।’ (এ তথ্য ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সরেজমিনে সংগ্রহ করি)।

আনোয়ার হোসেনের খুলনা জিলা স্কুলের সহপাঠি এম,এ হালিম-এর তথ্যানুযায়ী তিনি এবং আনোয়ার ১৯৪৪ খ্রি. খুলনা জিলা স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়েছেন এবং আনোয়ার তখন ক্লাশের সেকেন্ড বয় ছিলেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘আনোয়ার মানে আনোয়ার হোসেন, … পাকিস্তানের প্রগতিশীল আন্দোলনের প্রথম বলি শহিদ আনোয়ার হোসেনের কথা বলছি।’ (সূত্র: মতিউর রহমান, খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ড-১৯৫০ : মতিউর রহমান – প্রথমা, এপ্রিল ২০১৫পৃ ১৩৪)। এ সূত্র থেকে বোঝা যায় আনোয়ার হোসেন ১৯৪৬ খ্রি. খুলনা জিলা স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন পাশ করেছেন কৃতিত্বের সাথে।

বাংলা ভাষার দাবিতে পুলিশের গুলিতে ১৯৫২ এর ২১, ২২ ফেব্রুয়ারি জীবন দিয়ে শহিদ হয়েছেন, আবুল বরকত, আব্দুস সালাম, আব্দুল জব্বার, রফিকউদ্দীন, শফিউর রহমান, আউয়াল ও আরো কয়েকজন।

ভাষা আন্দোলনের সূচনালগ্নে ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে ১৯৪৮ এর ১১ মার্চ ‘বাংলা ভাষা দাবি দিবস’ আন্দোলনে খুলনা থেকে নেতৃত্বদান করে,বাংলা ভাষা রক্ষার্থে দাবিনামা পেশ করে বন্দি অবস্থায় পাক পুলিশের গুলিতে ১৯৫০ এর ২৪ এপ্রিল রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়ার্ডে পুলিশের গুলিতে খুলনা বিএল কলেজের মেধাবী এবং প্রতিবাদী ছাত্র নেতা আনোয়ার হোসেন শহিদ হয়েছিলেন। তাই তিনি বাঙালি জাতির প্রথম ভাষা শহিদরূপে সরকারি স্বীকৃতির দাবিদার।

খুলনায় এই আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণে শেখ মুজিবুর রহমান বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি ঢাকায় ১১ মার্চের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন এবং বন্দি হন। বঙ্গবন্ধু জেলে থেকে সহকর্মী নেতা বন্ধুদের ১৯৫২সালের ভাষা আন্দোলনের তারিখ ও পরিকল্পনা দিয়েছেন। তাঁরই অনুপ্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ১১ই মার্চের ভাষা আন্দোলনে খুলনার ছাত্ররা দুঃসাহসী ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং নেতৃত্ব দিয়ে প্রথমেই হত্যার শিকার হন আনোয়ার হোসেন। তাই তিনি ভাষা আন্দোলনের প্রথম ভাষা শহিদ।

দেশ স্বাধীনের পর জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে ১৯৭৩ খ্রি. ‘রাজশাহী জেলের অভ্যন্তরে খাপড়া ওয়ার্ডের সামনে সাতজন শহিদের নাম সম্বলিত স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়।’ (পূর্বোক্ত পৃ ২৪)

মাতৃভাষা বাংলা রক্ষার দাবিতে আনোয়ার হোসেন ১১ই মার্চের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে জীবন দিয়ে হাজার বছরের নির্যাতিত পশ্চাৎপদ বাঙালি জাতির চেতনাকে শানিত করেছেন। তাঁর আত্মত্যাগের সিঁড়ি বেয়ে ২১-এর ভাষা আন্দোলন জনতার আন্দোলনে পরিনত হয়েছে এবং বাংলা ভাষা তার আত্মমর্যদা রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে।

এ কাজে আনোয়ার হোসেন আলোকবর্তিকা। ইতিহাসের অনন্য এক আলো অধ্যায়ের এই মহান দেশদরদী, মাতৃভাষা প্রেমিক, আত্মত্যাগীর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে মানুষের কাছে।

This image has an empty alt attribute; its file name is 23579pppp-Copy.jpg

লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক

About Mangrove Sahitya

দেখে আসুন

সত্যজিতের কম্পু : আমাদের আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স, ভবিষ্যতের সুপার এআই । বাবলু ভঞ্জ চৌধুরী

সত্যজিতের কম্পু : আমাদের আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স, ভবিষ্যতের সুপার এআই বাবলু ভঞ্জ চৌধুরী সত্যজিৎ রায় ১৯৭৮ …

304 কমেন্টস

  1. Pretty! This has been an incredibly wonderful article. Thanks
    for supplying this info.

  2. best online pharmacies in mexico: purple pharmacy mexico price list – buying prescription drugs in mexico

  3. top 10 pharmacies in india: top 10 pharmacies in india – cheapest online pharmacy india

  4. Asking questions are actually good thing if you are not understanding anything completely, except this post gives good understanding even.

  5. reputable canadian mail order pharmacy: buy medication online – aarp canadian pharmacies

  6. mexican pharmaceuticals online mexican pharmacy mexican rx online

  7. canadian pharmacy uk delivery: certified canada pharmacy online – canadian discount pharmacy

  8. I quite like looking through a post that can make people think.
    Also, thank you for allowing me to comment!

  9. I think what you postedtypedsaidthink what you postedwrotebelieve what you postedwrotethink what you postedtypedWhat you postedtyped was very logicala ton of sense. But, what about this?consider this, what if you were to write a killer headlinetitle?content?typed a catchier title? I ain’t saying your content isn’t good.ain’t saying your content isn’t gooddon’t want to tell you how to run your blog, but what if you added a titleheadlinetitle that grabbed a person’s attention?maybe get people’s attention?want more? I mean %BLOG_TITLE% is a little vanilla. You ought to peek at Yahoo’s home page and see how they createwrite post headlines to get viewers interested. You might add a related video or a related picture or two to get readers interested about what you’ve written. Just my opinion, it could bring your postsblog a little livelier.

  10. http://canadiandrugs.store/# canadian pharmacies that deliver to the us

  11. pharmacy drug store: Online pharmacy USA – overseas no rx drugs online

  12. indian pharmacy paypal: online shopping pharmacy india – Online medicine home delivery

  13. Hello there, You have performed an excellent job. I will definitely digg it and personally recommend to my friends. I am sure they will be benefited from this site.

  14. Девушки легкого поведения из Москвы готовы подарить вам незабываемые моменты. Эксклюзивное объявление: мне 18 лет, и я готова подарить тебе невероятный минет в машине. Ощути магию настоящего наслаждения! проститутки метро нагорная. Профессиональные куртизанки ждут вашего звонка. Узнайте, что такое настоящее удовлетворение в компании любовниц из столицы.

  15. buy neurontin online uk: buy gabapentin online – canada neurontin 100mg lowest price

  16. Awesome blog! Do you have any suggestions for aspiring writers? I’m planning to start my own site soon but I’m a little lost on everything. Would you suggest starting with a free platform like WordPress or go for a paid option? There are so many choices out there that I’m totally confused .. Any suggestions? Kudos!

  17. ventolin australia prescription: Ventolin inhaler online – can i buy ventolin over the counter singapore

  18. I like it when individuals come together and share views. Great blog, continue the good work!

  19. ventolin prices in canada: Ventolin inhaler best price – cheapest ventolin online uk

  20. paxlovid pill https://paxlovid.club/# paxlovid for sale

  21. order ventolin from canada no prescription: Ventolin inhaler – ventolin 90

  22. Модернизация апартаментов — наша специализация. Реализация строительных работ в сфере жилья. Мы предлагаем модернизацию жилого пространства с гарантированным качеством.
    ремонт квартиры бровары

  23. https://claritin.icu/# ventolin capsule price

  24. buy ventolin tablets uk: Ventolin inhaler online – ventolin cost in canada

  25. paxlovid cost without insurance: Buy Paxlovid privately – paxlovid for sale

  26. With havin so much written content do you ever run into any problems of plagorism or copyright violation? My website has a lot of exclusive content I’ve either created myself or outsourced but it looks like a lot of it is popping it up all over the web without my authorization. Do you know any methods to help protect against content from being ripped off? I’d certainly appreciate it.

  27. comprare farmaci online con ricetta: farmacia online miglior prezzo – acquistare farmaci senza ricetta

  28. https://avanafilit.icu/# farmacia online senza ricetta

  29. migliori farmacie online 2023: avanafil – farmacie online affidabili

  30. п»їfarmacia online migliore: kamagra oral jelly – farmacia online

  31. acquistare farmaci senza ricetta: kamagra oral jelly – farmacie on line spedizione gratuita

  32. farmacia online migliore: farmacia online miglior prezzo – farmacie on line spedizione gratuita

  33. farmacia online senza ricetta: avanafil prezzo in farmacia – migliori farmacie online 2023

  34. http://kamagrait.club/# farmaci senza ricetta elenco

  35. comprare farmaci online con ricetta: farmacia online – acquisto farmaci con ricetta

  36. farmacia online migliore: farmacia online miglior prezzo – п»їfarmacia online migliore

  37. farmacia online miglior prezzo: farmacia online migliore – farmacie online sicure

  38. farmacia online migliore: farmacie online affidabili – farmacia online più conveniente

  39. acquistare farmaci senza ricetta: kamagra gold – farmacie online affidabili

  40. cerco viagra a buon prezzo: viagra prezzo – viagra naturale

  41. http://tadalafilit.store/# farmacie online affidabili

  42. acquisto farmaci con ricetta: comprare farmaci online con ricetta – farmacie online autorizzate elenco

  43. viagra online spedizione gratuita: viagra consegna in 24 ore pagamento alla consegna – viagra consegna in 24 ore pagamento alla consegna

  44. farmacia online senza ricetta: farmacia online migliore – farmacie online autorizzate elenco

  45. Why viewers still use to read news papers when in this technological world all is available on net?

  46. top farmacia online: kamagra gel prezzo – comprare farmaci online all’estero

  47. farmacia online farmacia online farmacie online autorizzate elenco

  48. farmacia online senza ricetta: avanafil prezzo – farmacie on line spedizione gratuita

  49. farmacie online autorizzate elenco: kamagra oral jelly consegna 24 ore – comprare farmaci online all’estero

  50. top farmacia online: farmacia online miglior prezzo – acquisto farmaci con ricetta

  51. http://tadalafilit.store/# acquisto farmaci con ricetta

  52. farmacie online autorizzate elenco: comprare avanafil senza ricetta – comprare farmaci online con ricetta

  53. comprare farmaci online con ricetta: farmacia online miglior prezzo – farmacia online

  54. farmacia online più conveniente: kamagra gel – farmacia online

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *