‘আমি শিল্পী নই। নাট্যকার বা অন্য যে কোনো আখ্যা লোকে আমাকে দিতে পারে। তবে আমি মনে করি আমি প্রপাগান্ডিস্ট। এটাই আমার মূল পরিচয়।’ — নিজের সম্পর্কে এমনই মন্তব্য কিংবদন্তি বাঙালি নাট্যকার, অভিনেতা ও পরিচালক উৎপল দত্তের।
২৯ মার্চ তাঁর জন্মদিনে ম্যানগ্রোভ সাহিত্য-র বিশেষ সংখ্যায় তাঁকে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা…

মার্ক্সবাদ ও অভিনয়কলা : উৎপল দত্ত
আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় হল মার্ক্সবাদ এবং অভিনয়কলা। অনেকে ভাবতে পারেন, মার্ক্সবাদের সঙ্গে অভিনয়কলার কী সম্পর্ক? মার্ক্সবাদ হল সামাজিক ও অর্থনৈতিক মতবাদ। সেটা অভিনয়কে কীভাবে প্রভাবিত করল? করেছে। সারা পৃথিবীতে মার্ক্সবাদ অভিনয়ের নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। মার্ক্সবাদ বুঝে অভিনেতারা যখন অভিনয় করতে গেছেন তখন তাঁরা বুঝেছেন যে আগেকার তুলনায় তাঁরা ক্রমশ একশো গুণ ভালো অভিনয় করছেন। কীসের ভিত্তিতে, কেন এটা হয় — সেটা আমাদের জানা উচিত। যে জন্য পৃথিবীর কয়েকটি শ্রেষ্ঠ নাট্যবিদ্যালয়ে মার্ক্সবাদ আজ অবশ্যপাঠ্য। আমি শুধু সোভিয়েত ইউনিয়ন, পূর্ব ইউরোপ বা চীনের কথা বলছি না, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও হয়। স্ট্যান্ডার্ড বিশ্ববিদ্যালয়তে যে নাট্যশিক্ষার কলেজ আছে সেখানেও মার্ক্সবাদ পড়তে হয়। আস্তে আস্তে যাঁরা মার্ক্সবাদী নন, বা মার্ক্সবাদ বিরোধী তাঁরাও ক্রমশ হৃদয়ঙ্গম করছেন যে মার্ক্সবাদ এমন কতকগুলি জিনিস দিয়েছে যার ফলে অভিনেতা আরও ভালো অভিনয় করতে সক্ষম হন। সেগুলিকে আয়ত্ত করে, অবশ্যই আয়ত্ত করা খুবই কঠিন এবং সেটা দীর্ঘ অনুশীলনের বিষয়। অনেক পড়বার বিষয়, পড়ে চিন্তা করবার বিষয়। কারণ এটা হচ্ছে মার্ক্সবাদের দর্শনের দিক। মার্ক্সবাদ তো শুধু অর্থনীতি নয় বা শুধু রাজনীতি নয়। মার্ক্সবাদ, মার্ক্সবাদী দর্শন হচ্ছে আধুনিক এক দর্শন, যার পরে এখনও পর্যন্ত কিছু আবিষ্কৃত হয়নি। শুধু মার্ক্সের নাম করা ভুল হবে, হেগেল, মার্ক্স। এই দু’জনে মিলে যে দর্শন সৃষ্টি করেছিলেন ইউরোপে তারপরে এখনও আর কিছু হয়নি। দর্শনের দিকে আর কিছু হয়নি। হয়তো অ্যাট এ টাইম মার্ক্সবাদ মরে গেছে — অনেকে বলেছেন, সবচেয়ে বেশি চিৎকার করছেন মস্কো থেকে। কিন্তু তাতে কিছু এসে যায় না। মার্ক্সবাদ কোনওদিনই মস্কোর ওপর নির্ভরশীল ছিল না। বরং তা সারা পৃথিবীর শ্রমিক শ্রেণীর ওপর নির্ভরশীল। প্রথমে গির্জার যে দর্শন ছিল সেই দর্শন শতাব্দীর পর শতাব্দী ইউরোপের চিন্তাধারায় সবচেয়ে অগ্রসর দর্শন ছিল। কিন্তু তার পরে হচ্ছে হেগেল এবং মার্ক্সের দর্শন। যেটাকে এক কথায় বলা হয় দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ।
এটা অভিনেতা কী করে প্রয়োগ করবেন তাঁর কাজে? অভিনেতাকে কী জানতে হবে মার্ক্সবাদের, যেটা তাঁর অভিনয়কে সাহায্য করবে? মার্ক্সবাদের দ্বন্দ্বের তত্ত্ব, যেটা ডায়ালেকটিক্স — এটা প্রয়োগ করতে গিয়েই অভিনেতার উৎকর্ষ বাড়তে থাকে দিনের পর দিন। তিনি যদি তাঁর নিজের অভিনয় এবং যে চরিত্রে অভিনয় করবেন সেই চরিত্রের ওপর ডায়ালেকটিক্স প্রয়োগ করতে থাকেন সচেতনভাবে তাহলে তাঁর অভিনয় উন্নতি হবেই। এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে বহুদিন থেকে বড় বড় অভিনেতারা ডায়ালেকটিক্স প্রয়োগ করছেন — তবে সচেতনভাবে নয়, সেটা তাঁদের মজ্জাগত ছিল। কোনও চরিত্র সামনে রেখে তাঁরা ডায়ালেকটিক্স দিয়ে, দ্বন্দ্বতত্ত্ব দিয়ে সেটা বোঝার চেষ্টা করেছেন। সেই জন্যই তাঁরা বড় অভিনেতা হয়েছেন। সারা পৃথিবীতে, সেই গ্রিক আমল থেকে আজকের আমল পর্যন্ত তাই হয়ে আসছে। কিন্তু তাঁরা সচেতনভাবে প্রয়োগ করেননি। অভিনয় করার সময় এঁরা এসব চিন্তা করতেন না। তাঁদের মাথায় প্রথম যা আসত তাই তাঁরা করতেন। কিন্তু আকস্মিকভাবে ওঁরা যেটা করে এসেছেন সেটাই আসলে ডায়ালেকটিকাল, অর্থাৎ মার্ক্সবাদী দ্বন্দ্বতত্ত্বে সেটাই সঠিক। ওইভাবেই করা উচিত। অর্থাৎ মার্ক্সবাদ প্রথম পৃথিবীকে বলল যে, একটা নাটক যে লেখা হচ্ছে সেই নাটকের বিষয়বস্তু ছাড়াও নিশ্চয়ই একটা শ্রেণীর প্রশ্ন আছে। সেটা কোন শ্রেণীর? কোন শ্রেণীর পক্ষে, কোন শ্রেণীর বিপক্ষে তা নাটকটা পড়লেই বোঝা যায়। মার্ক্সবাদ আরও খানিকটা এগিয়ে বলল যে, শুধু নাটকের বিষয়বস্তু নয়, নাটকের ফর্ম, আঙ্গিকের ক্ষেত্রেও, আঙ্গিকটাও একটা শ্রেণীগত প্রশ্ন। আমি কীভাবে অভিনয় করব, কীভাবে মঞ্চ সাজাব, কীভাবে আলোকসম্পাত করব — তার ভেতরেও লুকিয়ে আছে আমার শ্রেণীগত অবস্থান, শ্রেণীগত দৃষ্টিভঙ্গি। আমি কোন শ্রেণীর মানুষ, কোন শ্রেণীর পক্ষে, কোন শ্রেণীর বিপক্ষে সেটা আমার প্রযোজনা দেখেই বোঝা যাবে। সেটা আমার অভিনয়ের কায়দা দেখেই বোঝা যাবে।
যখন মার্ক্সবাদীরা প্রথম এসব কথা বলতে শুরু করলেন, সেই ১৮৪৪ সালের পর থেকে, তখন অনেকেই এসব মানেননি। দূর, আমি কীভাবে অভিনয় করব, আমি টুপিটা ফেলে ওখানে যাব কিনা, কথা বলে একটু পিছিয়ে যাব কিনা, কথাগুলো কোন দিক থেকে বলব — তার মধ্যে শ্রেণীগত প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে?
আসছে কমরেড, আমরা যদি একটু চিন্তা করি তাহলে দেখব, নিশ্চয়ই আসছে। নাটকের বিষয়বস্তুতে তো অবশ্যই শ্রেণীগত বৈশিষ্ট্য বুঝতে পারা যায়। একটা নাটক পড়লে বোঝা যায়, এটা কোন শ্রেণীর পক্ষে লেখা, কোন শ্রেণীর বিপক্ষে লেখা। কিন্তু শুধু তা নয়, কীরকম মঞ্চসজ্জা হচ্ছে, কীরকম আলোকসম্পাত হচ্ছে, আর অভিনয়ের কৌশলটা কী নিয়েছে তা থেকেও বোঝা যায় এটা কোন শ্রেণীর পক্ষে আর কোন শ্রেণীর বিপক্ষে। মার্ক্সবাদীরা বোঝাতে লাগলেন যে, দেখুন, শেক্সপীয়ররা একরকমের নাটক লিখেছেন, অভিনয় করিয়েছেন। কিন্তু তারপরে একটা এত বড় পরিবর্তন কেন? আমরা যখন বার্নার্ড শ, ইবসেন প্রমুখের যুগে এসে পৌঁছই তখন দেখি নাটকের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ পালটে গেছে। নাটকের মূল যে উদ্দেশ্য সেটাই পালটে গেছে। আগে শেক্সপীয়ররা যে উদ্দেশ্য নিয়ে নাটক লিখতেন — শ, ইবসেনের সময়ে এসে সেটা সম্পূর্ণ অন্য উদ্দেশ্যে লেখা নাটক। এবং নাটকের উদ্দেশ্য নয়, সেই সঙ্গে সঙ্গে মঞ্চসজ্জাও সমস্ত পালটে গেছে। এর কারণটা কী? এইটে তদন্ত করতে করতে ওঁরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, শেক্সপীয়রাও বাস্তববাদী ছিলেন নিশ্চয়ই, তাঁরা তো আর আকাশের পরী নিয়ে নাটক লিখতেন না। তাঁরা মানুষ নিয়েই লিখেছেন, তাঁদের সময়কার সমাজ নিয়েই লিখেছেন। আবার ইবসেন, বার্নার্ড শ, তাঁরাও তাই নিয়েই লিখেছেন, তাঁদের সময়কার সমাজ। কিন্তু সমাজটা এত পালটে গেছে যে নাটকের বিষয়বস্তু এবং আঙ্গিক — দুটোই পালটে গেছে। ওঁরা নাম দিয়েছেন, বড় বড় পণ্ডিতেরা, শেক্সপীয়র পর্যন্ত হচ্ছে ধ্রুপদী বাস্তবতা, ক্ল্যাসিকাল রিয়ালিজম।
যখন সারা পৃথিবীতে পুঁজিপতিরা বা বুর্জোয়ারা পুরোপুরি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত তখন তাঁদের প্রয়োজনে নতুন নাটক যেমন লেখা হতে শুরু করল, ঠিক তেমনই নাটকের আঙ্গিকও পালটে যেতে লাগল। কোথায় প্রধান পার্থক্যটা আপনারা দেখুন — নিশ্চয়ই আপনারা পড়াশোনা করেন, শেক্সপীয়রের নাটক পড়েন নিশ্চয়ই। শেক্সপীয়রের নাটক না পড়ে কেউ অভিনয় করতে নেমেছেন এটা ভাবাই বাতুলতা। শেক্সপীয়রের নাটকে কোথাও মঞ্চসজ্জায় বোঝানো হচ্ছে না এটা কোন জায়গা। বা এখন দিন না রাত — এসব কিছু বোঝার উপায় নেই। মনে রাখবেন, তখন অভিনয় হত একই মঞ্চে, মঞ্চসজ্জা বলে কিছু ছিল না। বাঁধানো পাথরের মঞ্চে অভিনয় হচ্ছে। এবং যে কোনও নাটকই হোক, বা তার যে কোনও দৃশ্যই হোক — একই মঞ্চসজ্জা সব সময় দর্শকদের সামনে। অনেকখানি বড় জায়গা, বিশাল জায়গা। এবং সেই জায়গার তিনদিকেই দর্শক দাঁড়িয়ে রয়েছেন — সামনেও এবং দু’দিকেও। দর্শক দাঁড়িয়ে দেখবেন, দর্শকের বসার ব্যবস্থা নেই। দর্শকের বসবার ব্যবস্থা আছে প্রেক্ষাগৃহের পেছন দিকে এবং পাশে বক্স মতো করা আছে। সেইখানে বসেন শুধু বড়লোকরা। আর সমস্ত দরিদ্র মানুষ দাঁড়িয়ে নাটক দেখতেন।
শেক্সপীয়রের কোনও নাটকই তিন ঘণ্টার কম নয়। পাঁচ ঘণ্টার নাটকও আছে। হ্যামলেট আছে, অ্যান্টনি ক্লিওপেট্রা আছে। ভেবে দেখুন, পাঁচ ঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে দর্শক নাটক দেখতেন। সেরকম নাটকের, সেরকম দর্শকের মনোযোগ ধরে রাখা খুব কঠিন।
সেই জন্য শেক্সপীয়রের নাটকে এত ঘন ঘন তলোয়ার খেলা হয়। মাঝে মাঝে ভূত আসে, ডাকিনীরা আসে। এবং এত খুন হয়, এত মৃতদেহ পড়ে যায় রঙ্গমঞ্চের ওপরে। তা না হলে পাঁচ ঘণ্টা ধরে ওদের মনোযোগ আকর্ষণ করার কী উপায় আছে একজন নাট্যকারের? কিচ্ছু নেই। কিন্তু এটা হল ধ্রুপদী বাস্তবতা।
বুর্জোয়া বাস্তবতা এর একেবারে উলটো। একেবারে অন্য থিয়েটার। এখন গরিবদের থিয়েটারে ঢোকা বারণ হয়ে গেল। কেননা টিকিটের দাম এমন অসম্ভব যে প্রথমেই ইউরোপের শ্রমিক শ্রেণী থিয়েটারে যাওয়া বন্ধ করতে বাধ্য হল। দ্বিতীয়ত, সেখানে আইন চালু হল সান্ধ্য পোশাক ছাড়া কাউকে থিয়েটারে ঢুকতে দেওয়া হবে না। এখন ইউরোপের শ্রমিক শ্রেণীর সান্ধ্য পোশাকই নেই। সে যে পোশাক পরে থাকে সেই পোশাক পরে ওকে থিয়েটারে আসতে বারণ করে দেওয়া হল। সুতরাং বুর্জোয়া নাটকে দর্শক বুর্জোয়া শ্রেণী, আর কাউকে ওঁরা থিয়েটারে ঢুকতে দিতেন না। আগে ছিল সবথেকে সস্তা সিটগুলো সামনে। শেক্সপীয়রের নাটকে সব থেকে সস্তায় যাঁরা ঢুকতেন থিয়েটারে তাঁরা সব থেকে কাছে দাঁড়িয়ে নাটক দেখতে পেতেন। এই নতুন নিয়ম চালু হল বুর্জোয়া থিয়েটারে যে, সব থেকে সস্তা টিকিটগুলো হচ্ছে একেবারে পেছনে। যত বেশি দাম, তত বেশি সামনের দিকে বসবে। অর্থাৎ কিনা বড়লোকেরা থিয়েটারকে দখল করে নিল। ওরা সবথেকে সামনে বসে নাটক দেখছে, অভিনেতার সঙ্গে ওদের কমিউনেকিশন হচ্ছে সব থেকে বেশি।
ধূমপান বারণ হল থিয়েটারে — প্রেক্ষাগৃহে ধূমপান বারণ। এটা শেক্সপীয়রের যুগে কেউ কোনওদিন চিন্তাও করেনি। ধূমপান কেন সেখানে মদ্যপানও করত দর্শকরা। এখানে সব বারণ। যেন গির্জায় এসে বসেছে এরকম একটা গুরুগম্ভীর, কৃত্রিম আবহাওয়া সৃষ্টি হল।
যখন এই রঙ্গমঞ্চ এইভাবে সাজানো হল তখন নাটকের যে চরিত্র গোড়ায় ঢুকল, নাটকের শেষে সেই চরিত্রই আছে। এই কথাটাই নতুন আবিষ্কার হল যে, চরিত্র কী? এ কি নাটকের হিরো? না নাটকের ভিলেন? মার্ক্সবাদ আমাদের শেখাল যে মানুষ ভিলেনও না, হিরোও না। মানুষ হচ্ছে মানুষ। একটা বিশেষ অবস্থায় সে হিরো হয়, আবার একটা বিশেষ অবস্থায় সেই লোকটাই ভিলেন হয়। কে যে হিরো, কে যে ভিলেন, এখনও পর্যন্ত তা বলা যাচ্ছে না। পণ্ডিতদের এখনও তর্ক হয়। জুলিয়াস সিজার নাটক তো সবথেকে সহজ নাটক। তা কে এর নায়ক? নাটকের নাম জুলিয়াস সিজার, কিন্তু তিনি নায়ক হতে পারেন না। কারণ তিনি তৃতীয় অঙ্কের প্রথম দৃশ্যে মারা গেছেন। তারপরে নাটকটা আরও দু’ অঙ্ক চলেছে। এখন ব্রুটাস এই নাটকের নায়ক, না মার্ক অ্যান্টনি এই নাটকের নায়ক কেউ বলতে পারে না।
এখন, এই যে সাজিয়ে দিয়েছে ছোট্ট রঙ্গমঞ্চ, আর আমি রোজ যে ঘরটা দেখি সেই ঘরটা তৈরি করে দিয়েছে, একেবারে হুবহু তৈরি করে দিয়েছে, এমন একটা জায়গায় যে হয়েছিল ঘটনা, একটা দৃশ্যের কসাইখানা দেখানোর জন্য আস্ত গরু কেটে সেইগুলো কেটে কেটে ঝুলিয়ে দেখিয়েছিল — বাস্তবতা। শেক্সপীয়রের নাটকেও কিন্তু কসাই হত, কিন্তু দোকানশুদ্ধ নয়। কারণ শেক্সপীয়র খুব ভালোভাবেই জানেন যে আমি কসাইকে আনছি কসাই বলে নয়, কী কাজ করে সেটা গুরুত্বহীন আমার কাছে। কিন্তু এখন তা নয়। বুর্জোয়া থিয়েটারে এসে কে কী চাকরি করে সেটা মস্ত বড় গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।
মানুষকে এইভাবে লেবেল করে দিচ্ছে যেটা শেক্সপীয়ররা করতেন না। তাঁরা জানতেন, মানুষকে এভাবে লেবেল করা যায় না, মানুষ তার থেকে ঢের বেশি জটিল, ঢের বেশি আবেগপ্রবণ একটা জীব, যার কথাবার্তা আচরণ লজিকাল বলতে যা বোঝায় তা নয়। অনেক সময় দেখবেন, আমাদের নাট্য-সমালোচকরা লিখছেন: চরিত্রটির লজিক নেই। আরে, লজিক তো মানুষেরই নেই। মানুষের লজিক থাকলে আজ সোভিয়েত ইউনিয়নের লোকেরা বলতে পারে যে কমিউনিস্ট পার্টির আর প্রয়োজন নেই? বলছে তো! তো সেখানে লজিক খুঁজতে বসবেন আপনারা? লজিক নেই। মানুষের লজিক থাকে না। মানুষের আচরণে লজিক থাকে না। সমাজের কোনও পরিবর্তন নেই, মানুষের কোনও পরিবর্তন নেই, মানুষ চিরদিনই এরকম থাকবে — এইভাবে ব্যাখ্যা করা হত। নাটকের চরিত্রেও এইরকম লেবেল মেরে দেওয়া হত।
তো এই যেখানে অবস্থা সেখানে মার্ক্সবাদ আমাদের সামনে এসে বুঝিয়ে দিল যে এই বুর্জোয়া নাটক বর্তমানে সারা পৃথিবীর নাট্যশালাকে দমন করে রেখেছে। একে হঠাতে না পারলে, একে আধুনিক শক্তিতে জারিত করতে না পারলে থিয়েটার তার পূর্ণ শক্তি নিয়ে আত্মপ্রকাশ করতে পারবে না। থিয়েটারের দৃঢ় শক্তি ছিল, গ্রিক থিয়েটারে, বা শেক্সপীয়রের আমলে, সেটা চাপা পড়ে গেল। এবার আহ্বান এল, থিয়েটারের এই বুর্জোয়া আর্ট সরাও, নতুন থিয়েটার তার নিজস্ব পথে এগোতে থাকবে, এবং তা অমিতশক্তির জন্ম দেবে। যারা মার্ক্সবাদী নাট্যপরিচালক, অভিনেতা, তাঁরাই সর্বপ্রথম আমাদের সামনে দেখালেন যে অভিনয় ব্যাপারটাই হচ্ছে ডায়ালেকটিকাল, যে ডায়ালেকটিক্সের ওপর মার্ক্সবাদ দাঁড়িয়ে আছে, দ্বন্দ্বতত্ত্ব। প্রতি মুহূর্তে অভিনেতাকে কতগুলি দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হতে হয়, আর সেই দ্বন্দ্বকে অতিক্রম করার নামই হচ্ছে অভিনয়। যেমন ধরুন অভিনেতাকে part-টা ভালো করে মুখস্থ করতে হবে এটা জানা কথা। ঝাড়া মুখস্থ বলবে সে রঙ্গমঞ্চে। কিন্তু প্রতিদিন তাকে একই কথা এমনভাবে বলতে হবে যে জীবনে আগে কখনও যেন এসব কথা শোনেনি। প্রতি মুহূর্তে প্রত্যেকটা কথা যেন স্বতস্ফূর্তভাবে এই প্রথম তার মনে পড়ছে, সেই প্রথম সে বলছে এমনভাবে উচ্চারণ করতে হবে। তাকেই বলে অভিনয়। অন্য লোকের লেখা কথাগুলো আবার এমনভাবে বলতে হবে যেন এটা আমার কথা, আমার নিজের কথা। প্রতি মুহূর্তে সেটা উপলব্ধি করতে হবে, অন্য লোককে বোঝাতে হবে, কার চরিত্র আমি? সে-ই লিখেছে। কিন্তু এমনভাবে কথাগুলো উচ্চারণ করতে হবে যেন সেগুলো আমার কথা। দ্বন্দ্ব, প্রতি মুহূর্তে দ্বন্দ্ব।
সোনারপুর কৃষ্টি সংসদে উৎপল দত্তের বক্তৃতার অংশবিশেষ, নাট্যচিন্তা প্রকাশিত ‘উৎপল দত্ত — বিষয় থিয়েটার’, কোলকাতা — বই থেকে নেওয়া

বরিশালের হীরক রাজা : মাসুম আলী
‘খাঁচায় পোরা পাখির তড়পানি, ভেরি সুইট!’
‘অবিচার’ চলচ্চিত্রের প্রথম
দৃশ্যটা এই সংলাপ দিয়ে শেষ করলেন উৎপল দত্ত (মহেশ বাবু)। প্রথম দর্শনেই
যিনি প্রকাণ্ড ব্যক্তিত্ব। এই দৃশ্যে যাঁর সঙ্গে তাঁর কথা হয়, তিনি মিঠুন
চক্রবর্তী। দুজনই ভারতীয় চলচ্চিত্রের উজ্জ্বল মুখ। মজার ব্যাপার হলো, দুজনই
বাংলাদেশের সন্তান, বরিশাল তাঁদের জন্মভূমি। উৎপল দত্তের জন্ম বরিশাল
জেলায়। যদিও এই দত্ত পরিবারের আদি বাসস্থান ছিল কুমিল্লা জেলায়।
আজ ভারতের বরেণ্য অভিনেতা উৎপল দত্তের প্রয়াণদিবস। ১৯৯৩ সালের ১৯ আগস্ট মাত্র ৬৪ বছরে প্রয়াত হন তিনি। এই বাংলায় যিনি এসেছিলেন ১৯২৯ সালের ২৯ মার্চ মা শৈলবালা দত্তর কোলে। বাবা গিরিজা রঞ্জন দত্ত। অনেকের মতো একসময় দত্ত পরিবারও ভারতের পশ্চিমবঙ্গেই স্থায়ীভাবে থেকে যায়। উৎপল দত্ত পড়াশোনা করেছেন শিলংয়ের এডমন্ড স্কুলে, পরে কলকাতার সেন্ট লরেন্স, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। ১৯৪৮ সালে ইংরেজি বিষয়ে স্নাতক করেন। কলেজের ছাত্রদের মধ্যে প্রথম স্থান অর্জন করেন উৎপল। বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে ইংরেজি অনার্সে তাঁর স্থান হয় পঞ্চম।
ভুলটা করেই ফেললাম! লেখা হয়েছে ‘বরেণ্য অভিনেতা উৎপল দত্ত’। এই হচ্ছে মুশকিল। কী বিশেষণ তাঁর নামের আগে ব্যবহার করা হবে, সেটা নিয়ে রীতিমতো গবেষণায় বসতে হয়। উৎপল দত্তের বিচিত্র প্রতিভার বর্ণনা তো শেষ হওয়ার না। তিনি নাট্যকার, পরিচালক, অভিনেতা। প্রথাগত খলনায়ক থেকে কৌতুক, সব ধরনের চরিত্র চিত্রণের ক্ষেত্রে ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ। চলচ্চিত্রে যেমন ছিলেন খলনায়ক, তিনি অগ্নিগর্ভ রাজনীতির নায়ক। এসবের মধ্যে একটি পরিচয় বেছে নেওয়া শুধু কঠিন বটে। সাহিত্যেও তাঁর ছিল অবাধ যাওয়া–আসা। নিজেকে তিনি ‘প্রপাগান্ডিস্ট’ বলতেন। উৎপল দত্তের লেখা মৌলিক পূর্ণাঙ্গ ও একাঙ্ক নাটক, অনুবাদ নাট্য, যাত্রাপালা ও পথনাটকের সংখ্যা শতাধিক। লিখতেন কবিতা, ছোটগল্পও।
গত শতকের চল্লিশের উত্তাল সময়ে যাঁরা শিল্প দিয়ে সমাজ বদলের কথা ভেবেছিলেন, স্বপ্ন দেখেছিলেন; উৎপল দত্ত তাঁদের একজন। যেমনটা বলছিলেন তাঁর সহপাঠী কলকাতার খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ ও অধ্যাপক পুরুষোত্তম লাল, ‘উৎপল ছিলেন জন্মগত প্রতিভাধর মানুষ।’ আর সহপাঠী অধ্যাপক দেবব্রত মুখোপাধ্যায়ের এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘উৎপলকে প্রথম দিন স্কুলে দেখে মনে হয়েছিল “গ্যালিভার”-এর পাতা থেকে যেন এক অতিমানব এসেছে স্কুলে!’
নাটকের মানুষ উৎপল দত্ত
একটি পরিচয়ে যদি নিজেকে সীমিত রেখে শেষ করতেন জীবনকাল, তাহলেও তিনি অমর থাকতেন দুই বাংলায়। তা হলো মঞ্চনাটক। তাঁর প্রথম ও শেষ ভালোবাসা ছিল কিন্তু মঞ্চই। একাধিক সাক্ষাৎকারে উৎপল দত্ত বলেছেন, ‘সিনেমা করি পেটের জন্য আর থিয়েটার করি নিজের জন্য।’ বিশ্বখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব রিচার্ড শেখনার সম্পাদিত পত্রিকা দ্য ড্রামা রিভিউ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ তিনজন নাট্যপরিচালকের মধ্যে উৎপল দত্তকে অন্যতম বলে আখ্যা দিয়েছে।
১৯৪৭ সালের কথা। ১৮ বছরের তরুণ উৎপল দত্ত ছিলেন কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের ছাত্র। সহপাঠীদের নিয়ে দ্য অ্যামেচার শেক্সপিয়ারিয়ানস নাট্যদল গঠন করেন। এমনিতে ইতিহাস, রাজনীতি, দর্শন, সমাজবিজ্ঞান, থিয়েটার, চলচ্চিত্র এবং ধ্রুপদি সংগীত তাঁর মাথায় ঢুকেছিল ওই সময়ে। হেগেল, মার্ক্স, অ্যাঙ্গেলস, লেনিনে ঋদ্ধ হয়েছেন উৎপল। কলেজের গ্রন্থাগারটি তাঁর প্রিয় জায়গা ছিল।
ওই সময় উৎপল নামের পিদিমের সলতেটায় আগুন ধরিয়েছিলেন বিখ্যাত ইংরেজ পরিচালক ও অভিনয়শিল্পী জেফ্রি কেন্ডাল। ১৯৪৭ সালে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে একটি শেক্সপিয়ার প্রযোজনা দেখে জেফ্রি কেন্ডাল তাঁকে আমন্ত্রণ জানান। কেন্ডালের শিক্ষা আর প্রশিক্ষণে উৎপল হন বরেণ্য শিল্পী।
শেক্সপিয়ারের নাটক এবং তা ইংরেজিতেই মঞ্চস্থ করে উৎপল দত্তের নাট্যজীবন শুরু। ১৯৪৯ সালে এই দলের নাম বদলে হয় কিউব। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আবার দলের নাম বদলে করেন লিটল থিয়েটার গ্রুপ। ১৯৫২ সালে এই দলে যোগ দেন রবি ঘোষ, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো অভিনেতারা। ১৯৫১ সালে উৎপল ভারতীয় গণনাট্য সংঘে যোগ দেন।
উৎপল দত্তের সঙ্গে স্মৃতিচারণা করেন বাংলাদেশের নাট্যকর মামুনুর রশীদ বলেন, ‘তিনি ছিলেন আমার সিনিয়র ফ্রেন্ড। যতবার তাঁকে দেখেছি, যতটা জেনেছি মুগ্ধই হয়েছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার মতে, পাণ্ডিত্যের দিকে ভারতের ১০ জন পণ্ডিতের মধ্যে একজন, এমন কোনো বিষয় নেই যে সম্পর্কে তিনি জ্ঞান রাখেননি। অভিনয়শিল্পে এবং অভিনয়ের জ্ঞানে তাঁর সমকক্ষে হয়তো চার–পাঁচজন পাওয়া যাবে গোটা ভারতে। অসাধারণ বাগ্মিতা ছিল। মঞ্চ নির্মাণ থেকে আলো, সবকিছুতেই তাঁর প্রযোজনায় অভিনবত্ব থাকত, চমক থাকত।’
অভিনয় করতে করতে মঞ্চ থেকে নেমে দর্শকের মধ্যে চলে যাওয়া, মঞ্চকে আয়ত আকারে বেঁধে না রেখে তাঁকে দর্শকদের দিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং এভাবে দর্শক আর নাটকের কলাকুশলীকে একাত্ম করে তোলার প্রয়াস তাঁর নাটকে বারবার দেখা যেত।
চলচ্চিত্রে উৎপল দত্ত, যাত্রাও

তিনি মূল স্রোতের বাণিজ্যিক ছবির শীর্ষ অভিনেতা। তবে নায়ক নয়, চরিত্রাভিনেতা হিসেবেই তিনি স্মরণীয়। ‘গুড্ডি’, ‘গোলমাল’, ‘শৌখিন’ প্রভৃতিতে তাঁর কৌতুকাভিনয় আজও মানুষকে আনন্দ দেয়। সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় ‘হীরক রাজার দেশে’, ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ ও ‘আগন্তুক’ চলচ্চিত্রে তিনি অভিনয় করেছেন। গৌতম ঘোষের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, ঋত্বিক ঘটকের, ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্প’ ছবিতে তাঁর অভিনয় বাংলা চলচ্চিত্রকে সমৃদ্ধ করেছে।

কী দারুণ বৈচিত্র্য ছিল তাঁর অভিনয়ে, চরিত্র রূপায়ণে। ‘দেখলে কেমন তুমি খেল’ গানের সঙ্গে দুর্দান্ত অভিনয় দর্শক মনে রাখবেন অনেক অনেক বছর। যে মানুষটি হয়েছিলেন ‘হীরক রাজার দেশে’র রাজা, তিনিই আবার হলেন ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র হোসেন মিয়া। এমন কত বিখ্যাত চরিত্র তাঁর জীবনে, ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’-এর মেঘরাজ, ‘আগন্তুক’-এর মনোমোহন মিত্র, ‘অমানুষ’-এর মহিম ঘোষাল, ‘জন অরণ্য’র বিশুদা—এমন কত চরিত্রেই না অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি। ‘হীরক রাজার দেশে’র তাঁর সংলাপগুলো রীতিমতো চর্চার বিষয় হয়ে গেছে। সত্যজিৎও মুগ্ধ ছিলেন উৎপলের প্রতিভায়। বলেছিলেন, ‘উৎপল যদি রাজি না হতো, তবে হয়তো আমি “আগন্তুক” বানাতামই না।’
তিনি কয়েকটি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছিলেন, তার মধ্যে ‘ঝড়’, ‘বৈশাখী মেঘ’, ‘ইনকিলাব কি বাদ’, ‘ঘুম ভাঙার গান’ উল্লেখযোগ্য। পর্দায় যখন তিনি পুরোদস্তুর তারকা, বামপন্থী সতীর্থরা তাঁকে সন্দেহ করতে লাগলেন। হয়তো শ্রেণিশত্রুও ভেবেছিলেন। দূরত্ব তৈরি করেন উৎপল থেকে এবং তাঁকে বয়কট করেন; সেই সময় তিনি জনগণের কাছে সরাসরি পৌঁছে যাওয়ার জন্য যাত্রাপালাকে হাতিয়ার করেন। লিখলেন ‘রাইফেল’, ‘সন্ন্যাসীর তরবারি’র মতো নাটক। গ্রামবাংলার মানুষের কাছে সরাসরি পৌঁছে দেন সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের বার্তা।

সব্যসাচী উৎপল দত্ত
লেখালেখিতে উৎপল দত্তকে সব্যসাচী বললে বাড়াবাড়ি হবে না মোটেও। অজানা, অপ্রচলিত মুখের ভাষা (কিংবা ‘ইতর’ জনের ভাষা) উৎপল দত্তের নাটকে থাকত। নাট্যকার হিসেবে ভাষায়–বৈচিত্র্যে তিনি কতটা নিয়ম ভাঙার মানুষ ছিলেন, তার বড় প্রমাণ ‘টিনের তলোয়ার’ নাটকটি। নাটকের কিছু সংলাপ শুনুন, ‘বেটি আজ গ্রেট নেশনেলে চলে গেল ডাঙস করে’, ‘সে শালা যে ছ্যাং চ্যাংড়ার কেত্তন শুরু করে দেবে’, ‘ওই কাপ্তেনবাবু তো দেখছি ভুড়ুঙ্গে বজ্জাত’, ‘একের পর এক এমন পালা ধরছেন, যা দেখলে আমার থুতকুড়ি জাগে’, ‘আমি দল তুলে দেব তবু ভালো, অমন ঢোস্কা পালা করতে দেব না!’ ‘টিনের তলোয়ার’ নাটকে সংলাপে সংলাপে ছড়িয়ে অদ্ভুত কিছু শব্দ। যেমন গস্তানি, নুন চুপড়ি, বেদে বুড়ি, খুর কানাই, হেড়াহেড়ি, চিতেন, তজবিজ, ফররার, আচাভুয়া, বালতি পোঁতা, গররা, পাতা চাপা কপাল, মাড়গে, বউকাঁটকি, চৈতন ফক্কা! এসব যেন শুধু উৎপল দত্তের ক্ষেত্রেই মানায়। শিলংয়ের এডমন্ড স্কুল, কলকাতার সেন্ট লরেন্স, সেন্ট জেভিয়ার্স—আগাগোড়া নামী ইংরেজি মাধ্যম স্কুল–কলেজে লেখাপড়া করা উৎপল দত্ত এই ভাষা কীভাবে সংগ্রহ করতেন, সেটাও ভাবনার বিষয়।
১৯৬৫ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ‘ভারত রক্ষা’ আইনে গ্রেপ্তার হন উৎপল দত্ত। সাত মাস জেলে কাটে। কিন্তু কারাগারের দিনগুলোতেও দিনবদলের স্বপ্ন তাঁকে ছেড়ে যায়নি। বন্দিজীবনে লিখে গেছেন।
কথা বলায়ও তিনি ছিলেন পণ্ডিত। বাংলা, ইংরেজির পাশাপাশি জানতেন জার্মান, স্প্যানিশ। হাতে থাকত মোটা মোটা বই। শুটিংয়ের ফাঁকে পড়তেন। ডাক পড়লেই উঠে দাঁড়িয়ে বলতেন, ‘ইয়েস স্যার।’ নির্দিষ্ট পাতাটি ভাঁজ করে কোথাও রেখে চলে যেতেন ফ্রেমে।
এক জীবনে কত কিছু করলেন। ১৯৯০ সালে হঠাৎ করেই অসুস্থ হন। দীর্ঘদিন রোগে ভোগেন। শেষ পর্যন্ত হেরে গেলেন। দুনিয়ার ‘ফ্রেম’ থেকে হারিয়ে গেলেন। থেকে গেল তাঁর কাজ। থাকবে আরও বহু বছর, এ কথা বললে মোটেও বাড়াবাড়ি হবে না। কেননা, কারও কারও দেহান্তর মানে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া নয়। উৎপল দত্ত তো সেই ক্ষণজন্মাদের একজন।
প্রথম আলো : ১৯ আগস্ট ২০১৯ । প্রকাশিত লেখাটি লেখকের অনুমতিতে প্রকাশ
উৎপল ক্রান্তিদর্শী রাজনৈতিক ভাষ্যকার ও সম্মোহনী বাগ্মী : তপন মল্লিক চৌধুরী
উৎপল দত্তের বর্ণময় প্রতিভা নিয়ে আলোচনার শেষ নেই। নাট্যকার, পরিচালক, অভিনেতা, তাত্ত্বিক— এই চতুর্মুখ ব্রহ্মার মতো উৎপল তাঁর সৃজনে বারবার সৃষ্টিকর্তাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে গেছেন। বিশ্ববিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব রিচার্ড শেখ্নার সম্পাদিত পত্রিকা ‘দ্য ড্রামা রিভিউ’ (টিডিআর) পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ তিনজন নাট্যপরিচালকের মধ্যে উৎপল দত্তকে অন্যতম বলে মান্যতা দিয়েছিল। যদিও রিচার্ড শেখ্নারের বিতর্কিত মার্কিন ‘লিভিং থিয়েটার’কে উৎপল ‘অপসংস্কৃতির কবরখানা’ বলে তুলোধনা করেছেন। বাংলা থিয়েটারের ইতিহাস বিচার করলে উৎপলের নাট্যসৃষ্টির ব্যাপ্তি ও ঐশ্বর্য বিস্ময়কর। উৎপল দত্ত রচিত মৌলিক পূর্ণাঙ্গ ও একাঙ্ক নাটক, অনুবাদ নাটক, যাত্রাপালা ও পথনাটকের সংখ্যা একশোর বেশি। এর মধ্যে নব্বইটি নাটক প্রকাশিত ও গ্রন্থিত। উৎপল দত্ত পণ্ডিত ও বিদগ্ধ সমাজবিজ্ঞানীও বটে। বহু মৌলিক গ্রন্থের রচয়িতা। তিনি কবি ও ছোটগল্প লেখক। তিনি মূল স্রোতের বাণিজ্যিক ছবির অন্যতম অভিনেতা এবং কয়েকটা কলোত্তীর্ণ সিনেমার অমর চরিত্রস্রষ্টা। উৎপল ক্রান্তিদর্শী রাজনৈতিক ভাষ্যকার ও সম্মোহনী বাগ্মী।
১৯৪৭ সালে মাত্র ১৮ বছরের প্রতিভাশালী যুবক উৎপল দত্ত সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের ছাত্র থাকাকালীন সহপাঠীদের নিয়ে ‘দি অ্যামেচার শেক্সপিয়ারিয়ানস’ নাট্যদল গঠন করেছিলেন। তখন তিনি বিশ্বসাহিত্যের অক্লান্ত পাঠক। ছাত্র অবস্থাতেই ইতিহাস, রাজনীতি, দর্শন, সমাজবিজ্ঞান, থিয়েটার, চলচ্চিত্র এবং ধ্রুপদী সঙ্গীতের জগতে বিচরণ শুরু করেছিলেন। সেই বয়সেই উৎপলের অসামান্য মস্তিষ্ক ঋদ্ধ হয়েছিল কান্ট, হেগেল, ফয়েরবাখ, মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন পাঠে। তাঁর সহপাঠী উত্তরকালের খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ ও অধ্যাপক পুরুষোত্তম লাল পরে লিখেছিলেন, ‘Utpal was born brilliant’। ১৯৪৭ সালে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের ছাত্র উৎপল দত্তর একটি শেক্সপিয়ার প্রযোজনা দেখে জেফ্রি কেন্ডাল তাঁকে আমন্ত্রণ জানান। তিনি কেন্ডালের ‘শেক্সপিয়ারিয়ানা’ নাট্যদলে যোগ দিয়েছিলেন। কেন্ডালের জহুরির চোখ আসল সোনা চিনতে ভুল করেনি। কেন্ডালের শিক্ষা ও বৈজ্ঞানিক প্রশিক্ষণে উৎপল কালক্রমে একজন প্রকৃত আন্তর্জাতিকমানের পেশাদার অভিনেতা ও পরিচালক হয়ে ওঠেন। উৎপল দত্ত ১৯৭২ সালে তাঁর লেখা মৌলিক ও মননশীল গবেষণাগ্রন্থ ‘শেক্সপিয়ারের সমাজচেতনা’র উৎসর্গপত্রে তাই লিখেছিলেন, ‘আমার শেক্সপিয়ার পাঠের গুরু, শেক্সপিয়ার অভিনয়ের শিক্ষক জেফ্রি কেন্ডাল।’
১৯৪৭ সালের অক্টোবর থেকে ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত, এই পর্বে কেন্ডালের ‘শেক্সপিয়ারিয়ানা’ নাট্যদল বিপুল সাফল্য ও কৃতিত্বের সঙ্গে কলকাতার শিক্ষিত দর্শকদের অভিভূত করেছিল। ১৯৪৭–৪৮ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্য ভারতে অস্ত গেলেও কলকাতায় তখনও পুরোমাত্রায় সাহেবিয়ানার প্রভাব রয়ে গিয়েছিল। তাই কলকাতার অভিজাত ও কুলিন ‘দ্য স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় কেন্ডালের যাবতীয় নাট্যপ্রযোজনার বিস্তারিত সমালোচনা হয়েছিল। এই পর্যায়ে কেন্ডালের ‘শেক্সপিয়ারিয়ানা’ নাট্যপ্রযোজনায় ‘ম্যাকবেথ’, ‘হ্যামলেট’ ও ‘জুলিয়াস সিজার’ নাটকে উৎপলের অভিনয় ‘দ্য স্টেটসম্যান’–এর নাট্যসমালোচকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।
১৯৪৮ সালের জানুয়ারিতে কেন্ডালরা দেশে ফিরে গেলেন। জেফ্রি কেন্ডালকে গুরুরূপে বরণ করে তাঁর ‘শেক্সপিয়ারিয়ানা’ থিয়েটার দলের সুশৃঙ্খল সৈনিকের জীবন বেছে নিলেও উৎপল তাঁর নিজস্ব নাট্যদল ‘দি অ্যামেচার শেক্সপিয়ারিয়ানা’ বন্ধ করে দেননি। কেন্ডালরা ইংল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার পর ১৯৪৯ সালে উৎপল দত্তর নেতৃত্বে ‘লিটল থিয়েটার গ্রুপ’ বা এলটিজি–র জন্ম হয়। ১৯৫১ সালে উৎপল ‘ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘে’ যোগ দেন। কিন্তু দশ মাস উৎপ দত্তর ভাষায় ‘জনতার মুখরিত সখ্যে’ থাকার পর প্রবল রাজনৈতিক বিতর্কে জর্জরিত হয়ে ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন।
১৯৫৩–৫৪ সালে জেফ্রি কেন্ডাল তাঁর থিয়েটার দল নিয়ে আবার ভারত সফরে এলেন। উৎপল দত্ত তাঁর গুরুর ডাকে সাড়া দিয়ে ভ্রাম্যমাণ শিল্পীদলের শরিক হন। নিজের নাট্যদল লিটল থিয়েটার গ্রুপ থেকে ছুটি নিয়ে উৎপল কেন্ডালের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। এইভাবে তাঁর নাট্য পথের যাত্রা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর পথ পাড়ি দিতে থাকে। ইতিমধ্যে তিনি হয়ে ওঠেন বাংলা পরবর্তীতে হিন্দি ছবির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অভিনেতা।
রোজদিন, কোলকাতা : ২৯ মার্চ ২০১৮
বাংলার শেষ সাহেব উৎপল দত্ত : পার্থসারথি পাণ্ডা

পাঁচটা বলতে তিনি পাঁচটাই বুঝতেন, এক্কেবারে ফেলুদার মতো। খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনযাপন পুরোটাই ছিল তাঁর সাহেবিয়ানায় মোড়া। সাহেবদের মতোই তিনি ঘড়ির কাঁটায় বেঁধে ফেলেছিলেন জীবন। ছবিতে তাঁর সঙ্গে যাঁরা কাজ করেছেন, তাঁদের মুখে শুনেছি, তিনি আট ঘন্টার বেশি শ্যুটিং করতেন না। হাজির হতেন একেবারে ঘড়ি ধরা সময়ে, বেরিয়ে যেতেনও সেভাবেই। শ্যুটিং বাকি থাকলেও কোন অজুহাত বা অনুরোধে কাজ হতো না। হয়তো তাঁর শ্যুটিং তখনও বাকি আছে অথচ ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলেছে আট ঘন্টার দিকে। তখন তিনি বারে বারে ঘড়ি দেখতেন আর তাঁর সেই জলদগম্ভীর স্বরে মেকআপরুম থেকেই ইউনিটের উদ্দেশ্যে হাঁক ছাড়তেন, ‘ওয়ান আওয়ার টু গো ! হাফ এ্যান আওয়ার টু গো!’–এরকম। হয়তো আট ঘণ্টা পুরো হতে তখন আর দশটা মিনিট বাকি আছে, তাঁকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হল ফ্লোরে। ডিরেক্টার সিনটা টেক করার আগে একটা রিহার্সাল করিয়ে পজিশন কম্পোজিশন সব ঠিক করলেন, আর ঠিক তখনই হয়তো আট ঘণ্টা শেষ! অমনি উৎপল দত্ত বলে উঠতেন, ‘নাও টাইম টু গো!’ এবং বলেই হনহন করে বেরিয়ে যেতেন সবাইকে হতভম্ব করে দিয়ে। সময় নিয়ে বাতেলাপ্রিয় বাঙালির ভ্যানতাড়ামো একদম পছন্দ করতেন না তিনি। আর এতটা সময়নিষ্ঠ ছিলেন বলেই থিয়েটার-সিনেমায় অভিনয়, সিনেমা পরিচালনা, নাটক লেখা, যাত্রাপালা লেখার হাজার ব্যস্ততার মাঝেও বিশ্বসাহিত্য পাঠের অবসর বের করে নিতে পারতেন। তাঁর মতো পণ্ডিতমানুষ বাংলায় তখনো কম ছিলেন, এখন আরও কম আছেন।
পাঁচের দশকে উৎপল দত্ত ছিলেন ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সেন্ট্রাল স্কোয়াড-এর দায়িত্বে। এইসময় তিনি অভিনেতাদের কাছে প্রস্তাব দিলেন স্টেজে রবীন্দ্রনাথের ‘বিসর্জন’ নাটক নামানোর। এই স্কোয়াডে তখন অভিনেতা হিসেবে ছিলেন কালী ব্যানার্জি, ঋত্বিক ঘটক, উমানাথ ভট্টাচার্য, শোভা সেনের মতো মানুষেরা। সবাই মিলে আলোচনা করে ঠিক হল ‘বিসর্জন’ নাটকই হবে এবং রিহার্সাল হবে ৪৬ নং ধর্মতলা স্ট্রিটে, দুপুর বেলা। সবাইকে চরিত্র বুঝিয়ে দিয়ে এক একটা বই ধরিয়ে পাঠ মুখস্থ করে হাজির হতে বললেন রিহার্সাল শুরুর দিন। তাঁর নির্দেশ মানে, বেদবাক্য। মানতে সবাই বাধ্য।
রিহার্সাল শুরুর দিন সবাই তাই পাঠ মুখস্থ করে হাজির। তখন উৎপল তাঁদের সামনে দাবার ছক পেতে ঘুঁটি সাজিয়ে বসলেন। সবাই অবাক, এ দিয়ে হবেটা কি! এখন রিহার্সালের সময় খেলা হবে নাকি! একটু পরই সবার ভুল ভাঙল। তাঁরা বুঝতে পারলেন, এটাই আসলে উৎপলের মঞ্চ আর ঘুঁটিগুলো এক একটি চরিত্র। সে এক দেখার মতো জিনিস, অভিনব এক পদ্ধতি! অভিনেতারা নিজের নিজের সংলাপ মুখস্থ বলে যেতে লাগলেন আর উৎপল এক একটি ঘুঁটি চেলে বুঝিয়ে দিতে লাগলেন কোন চরিত্র কোন দিক দিয়ে ঢুকবেন, কোথায় এসে দাঁড়াবেন, কতটা এগোবেন–এভাবে পুরো কম্পোজিশন তৈরি হয়ে গেল। প্রতিটি অভিনেতাকে সেই ঘুঁটির চাল মাথায় রেখে মঞ্চে নামতে হয়েছিল। মনে না রেখে কারও উপায় নেই, একটু এদিক ওদিক হবার জো নেই; মেজাজী মানুষ উৎপল দত্ত ভুল একদম বরদাস্ত করতে পারতেন না। বকুনির চোটে একেবারে ভুত ভাগিয়ে ছাড়তেন। তবে এর মধ্য দিয়ে যখন তা মঞ্চস্থ হল, তখন ‘বিসর্জন’ হয়ে উঠল যেন সুপরিকল্পিত সুসংহত এক চলচ্চিত্র! সে এক অপূর্ব প্রযোজনা! যাকে বলে কালজয়ী। আর এই সুপরিকল্পিত প্রযোজনা সম্ভব হয়েছিল উৎপল দত্তের অভিনব উদ্ভাবনী ক্ষমতা, কড়া এবং খুঁতখুঁতে সাহেবি মেজাজের জন্যই।
উৎপল দত্তের আর একটি সাহেবিয়ানার পরিচয় দেব, অভিনেতা চিন্ময় রায়ের স্মৃতিকথা ‘গল্প হলেও সত্যি’ থেকে–
‘দুই ভাই’ ছবির আউটডোর শ্যুটিং চলছে ডায়মন্ডহারবারে। এই ছবির অভিনেতা চিন্ময় রায়, সন্তু মুখোপাধ্যায়, দীপঙ্কর দে, সুমিত্রা মুখার্জি আর উৎপল দত্ত একই ফ্লোরের পাশাপাশি ঘরে একটি হোটেলে রয়েছেন। একদিন সকালে হঠাৎ উৎপল দত্তের ঘর থেকে ভেসে এলো দুমদাম কাঁচের বাসন ভাঙার আওয়াজ। সেই আওয়াজে হোটেলের সবাই ছুটে গেল। অভিনেতারা ছুটে গেলেন। প্রযোজক ছুটে গেলেন। ঘরময় তখন ছড়িয়ে রয়েছে ভাঙা কাঁচের অজস্র টুকরো। প্রযোজক জানতে চাইলেন, কি হয়েছে উৎপলদা? উৎপল দত্ত শান্ত গলায় বললেন, ‘আটটা পঁয়তাল্লিশ মিনিটে খাবার চেয়েছি। এখন নটা দশ—দে আর লেট, সো আই থ্রো ইট।’ প্রযোজক বললেন, ‘ঠিক করেছেন। বাকিটা আমি দেখছি।’ প্রযোজকের এই সামান্য কথাতেই সেদিন ফুটে উঠেছিল ডিসিপ্লিনড একজন মানুষ এবং ডিসিপ্লিনড একজন শিল্পীর প্রতি অসীম ও অকৃত্রিম শ্রদ্ধা।
BAARTA TODAY, কোলকাতা : March 30, 2019
উৎপল দত্তের নাটকে রাজনৈতিক চেতনা : আসিফ আজিজ
উৎপল দত্ত (১৯২৯-১৯৯৩) জন্মেছিলেন এক সংক্ষুব্ধ সময়ের বুকে। সমগ্র বিশ্ব এবং বিশেষ করে পাক-ভারতীয় উপমহাদেশে তখন কালকের সকালটি কেমন হবে একথা বলা ছিল দুষ্কর।
উৎপল দত্ত (১৯২৯-১৯৯৩) জন্মেছিলেন এক সংক্ষুব্ধ সময়ের বুকে। সমগ্র বিশ্ব এবং বিশেষ করে পাক-ভারতীয় উপমহাদেশে তখন কালকের সকালটি কেমন হবে একথা বলা ছিল দুষ্কর। বিশ শতকের প্রথম দশক থেকে বৈশ্বিক রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যেতে থাকলো অর্থনৈতিক অবস্থা, সামাজিক মূল্যবোধের প্যাটার্ন, মানুষের আর্ন্তজাগতিক ভূগোল এবং তৎসম্পর্কিত বাহ্যিক আচার-আচরণ, যা চল্লিশের দশকে গিয়ে আরও পরিণত হলো। উৎপল দত্তের বেড়ে ওঠা এই কালখণ্ডে। এই সময়ের কল্যাণে যিনি বিশ্বের পাশে পেয়েছিলেন জীবনের অসংখ্য শাখা-প্রশাখাময় বৈচিত্র্যের সন্ধান। সেই কালোত্থিত জীবনের বৈচিত্র্যসংযাত রাজনৈতিক রসায়ন উৎপল দত্তের নাটকের প্রধান মনোযোগ।
রাজনৈতিক নাট্যশালা এক অনন্য রণক্ষেত্র। প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ রাজনৈতিক সংগ্রামের এই রণাঙ্গনে নানা ভূমিকায় নানা রূপে উৎপল দত্তের প্রবেশ ও সংগ্রাম। অভিনেতা, প্রযোজক, পরিচালক, নাট্যকার, নাট্যান্দোলন কর্মী- যখন যে রূপে প্রয়োজন তখন সে রূপে আবির্ভূত উৎপল দত্ত। অন্যদের থেকে তিনি স্বতন্ত্র কারণ এই সবগুলো ক্ষেত্রে তাঁর সফলতা ছিল তুঙ্গে। তবে নাট্যকার হিশেবে সকল প্রতিভাকে অতিক্রম করেছেন তিনি। এই শিল্পী-যোদ্ধার অক্ষয় তূণীরের শ্রেষ্ঠ আয়ূধ তাঁর নাটক। রাজনীতি যেমন মানুষকে মানুষের খুব কাছে নিয়ে যায়, চিনতে শেখায়, অধিকার সচেতন করে, সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথের দিশা দেখায়, ভুল-শুদ্ধ-প্রয়োজন-অপ্রোয়জনীয়তাকে বোঝার মঞ্চ তৈরি করে দেয়, তেমনি নাটক মানুষের সঙ্গে সরাসরি রাজনৈতিক, আত্মিক, সামাজিক, সাংস্কতিক, ঐতিহ্যিক সংগ্রামের যোগাযোগ স্থাপন করে।
নাটক এবং রাজনীতি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং অধিকার আদায়ের ভিন্ন দুটি মাধ্যম। দুটিরই আছে অনেকগুলি শাখা। নাটক কখনো কখনো প্রচার করতে চায় রাজনৈতিক আদর্শ। তবে কি রাজনীতি আর নাটক এক অন্যের পরিপূরক? সেটা জানার জন্য প্রয়োজন রাজনীতি কী তা একবার স্বল্প পরিসরে জানা। চেম্বারস অভিধানে রাজনীতি বলতে সরকার, রাজনৈতিক দল, রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ অথবা মতামত পরিচালনার কলাকৌশলকে রাজনীতি বলা হয়েছে। ভিন্ন কিছু অভিধানে রাজনীতি বলতে বোঝানো হয়েছে সরকার বা রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পদ্ধতি বা আন্দোলনকে। রাজনীতি প্রায় সময় দেশে সামাজিক বিপ্লব সংঘটিত করতে চায়, রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের চেষ্টা চালায়, নিজ দল বা মতাদর্শের পক্ষে জনমত সৃষ্টির চেষ্টা করে। বলা যায়-
‘রাজনীতি হলো একটা লড়াই, প্রতিকূল একটা শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাকে পরাভূত করাই হলো লক্ষ্য। রাজনীতি হলো ক্রমান্বয়িক গতিশীলতা, প্রতিকূলতাকে পরাজিত করেও তাকে এগিয়ে যেতে হয়। রাজনীতি হলো একটি বিজ্ঞান, যার একটা নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া আছে, পদ্ধতি আছে।’
মার্কসবাদী দৃষ্টির আলোকে রাজনীতি বলতে মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক, শ্রেণীগত ব্যক্তিগত সব কর্মকাণ্ডকে বোঝায়। রাজনীতির প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য হলো কর্তৃত্ব বা ক্ষমতা। রাজনৈতিক দল হলো সেই লক্ষ্যের বা অভিযানের সামগ্রিক বাহিনী। সেই লক্ষ্য অর্জনে সবথেকে বেশি প্রয়োজন হলো নিজ মতাদর্শের প্রতি মানুষের দৃষ্টিকে আকৃষ্ট করা। রাজনীতির এই ব্যাপকতার আলোকে কোন নাটককে তখনই রাজনৈতিক নাটক বলা যায় যখন সেটি সরকার, রাষ্ট্র এবং রাজনীতি নিয়ে কথা বলে। কোন একটি ভাবনা বা মতাদর্শকে একটি বিশেষ রাজনৈতিক অবস্থান থেকে হয় সমর্থন নয় আক্রমণ করে। কথনো প্রকাশ্যে, কখনো পরোক্ষভাবে, কখনো রূপকের সাহায্যে রাজনৈতিক নাটক তার উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে চায়। সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার ভুল-ত্রুটি নির্ণয় করে দর্শককে পরিবর্তন করতে চায়। সব মিলিয়ে বলা যায়, যদি কোন নাটক নির্দিষ্ট এক জনমণ্ডলীর কাছে কোন রাজনৈতিক, সামাজিক বা অর্থনৈতিক কোন নির্দেশ বা ধারণা বহন করে নিয়ে যায়, রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলে সেই নাটককে বলা যায় রাজনৈতিক নাটক।
অপরিহার্যভাবে প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় আলোচনার শুরুতে আমরা স্মরণ করবো শিল্প-সাহিত্য সমালোচনা প্রসঙ্গে মার্কসবাদের অন্যতম পুরোধা তাত্ত্বিক ও প্রবক্তা, মহান বিপ্লবী মাও সে তুং-এর ইয়েনান ভাষণের সেই অভ্রান্ত সিদ্ধান্ত :
‘শিল্প ও সাহিত্য সমালোচনার দুটি মানদণ্ড আছে : একটি রাজনৈতিক অপরটি শৈল্পিক। …শ্রেণীবিভক্ত সমাজে প্রত্যেক শ্রেণীর নিজস্ব রাজনৈতিক ও শৈল্পিক মানদণ্ড আছে। কিন্তু সমস্ত শ্রেণীবিভক্ত সমাজে সমস্ত শ্রেণীই সর্বদা শৈল্পিক মানদণ্ডের চেয়ে রাজনৈতিক মানদণ্ডকে স্থান দিয়ে থাকে।’ তাঁর মহামূল্যবান সুস্পষ্ট নির্দেশ : ‘আমরা দাবি করব রাজনীতি ও শিল্পকলার ঐক্য, বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকের ঐক্য, বিপ্লবী রাজনৈতিক বিষয়বস্তু এবং যত উচ্চমানের সম্ভব উৎকৃষ্ট শিল্পগুণান্বিত আঙ্গিকের ঐক্য।’
উৎপল দত্তের নাটক বিশ্লেষণকালে আমরা এই মহান নেতার শিল্প ও রাজনৈতিক আদর্শের প্রভাব এবং নাট্যকারের সফলতা-বিফলতা পর্যলোচনা করবো।
বাংলা
রাজনৈতিক নাটকের ইতিহাস শুরু বলা যায় দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটকের
মাধ্যমে। উনিশ শতকের মধ্যভাগে বাংলা নাটকের মূল চালিকাশক্তি ছিল সমাজ
সংস্কারের মানসিকতা। রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’রা সেকালে সমাজে
যে প্রবল প্রগতিশীল আন্দোলন উপস্থিত করেছিলেন, সেকালের নাটক মূলত তারই
প্রতিফলন। খুব সূক্ষ্ণ বিচারে অবশ্য দেখা যাবে আমরা ‘সমাজ সংস্কার-চেতনার
নাটক’ বলেছি, তাও প্রকৃতপক্ষে রাজনীতি-বিবর্জিত কিছু নয়। তাঁদের নাটকে
Negation-র লক্ষ্য ছিল আপন সমাজের মধ্যযুগীয় কুসংস্কার, ব্রিটিশ
সাম্রাজ্যবাদ নয় এখানেই দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ স্বতন্ত্র।
‘নীলদর্পণ’-এ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শোষণের নির্মম চিত্র উদঘাটনই ছিল মূল
লক্ষ্য। এরপর জাতীয়তাবাদের উন্মেষ পর্বে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর,
কিরণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, হরলাল রায়, উপেন্দ্রনাথ দাস, উমেশচন্দ্র গুপ্ত,
প্রমুখ মূলত ইতিহাসের প্রচ্ছদে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী রাজনৈতিক নাটক রচনা
করেছিলেন। পরবর্তীকালে এই ধারা গিরীশচন্দ্র-দ্বিজেন্দ্রলাল রায় প্রমুখের
মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত প্রবাহিত হয়েছে। আর বিশ শতকের
মাঝামাঝি পর্বে বাংলা নাটককে প্রচ্ছন্ন রাজনৈতিক নাটকের ধারা হিশেবে এগিয়ে
নিয়ে গেছেন উৎপল দত্ত।
এই ধারায় উৎপল দত্তের অনন্যতা, সফলতা,
বিশিষ্টতা বা স্বতন্ত্রতা কোথায়? পূর্বসূরিরা যে রাজনৈতিক নাটকের ধারা
সৃষ্টি করেছিলেন সেখানে সরাসরি রাজনীতিকে উপস্থাপন করা কঠিন ছিল ব্রিটিশদের
পদাবনত থাকার কারণে। তাঁরা ইতিহাসের উপর রাজনীতি আরোপ করে নাটক লেখার
চেষ্টা করেছেন। কিন্তু উৎপল দত্ত অন্য নাটকের পাশাপাশি রাজনৈতিক নাটকে
শাসক, শোষকশ্রেণীর বিরুদ্ধে কথা বলেছেন সরাসরি। শুধু তাই নয়, নাটক নিয়ে
তিনি চারদেয়ালে ঘেরা থিয়েটারে আবদ্ধ থাকেননি, পৌঁছেছেন গণমানুষের কাছে;
নাটকে সম্পৃক্ত করেছেন হাজার হাজার সাধারণ মানুষকে।
উৎপল দত্তের
রাজনৈতিক নাটকগুলোর মধ্যে আবার পাওয়া যায় শ্রেণীচেতনা, ইতিহাস চেতনা ও
মধ্যবিত্ত চেতনা। ‘টিনের তলোয়ার’, ‘রাতের অতিথি’, ‘ছায়ানট’, ‘সূর্যশিকার’,
‘মানুষের অধিকার’ প্রভৃতি নাটকে যেমন পাওয়া যায় শ্রেণীচেতনা সচেতনতা, তেমনি
‘টোটা, ‘লাল দুর্গ’, ‘তিতুমীর’, ‘কল্লোল’,‘দিল্লী চলো’, ‘ক্রুশবিদ্ধ কুবা’
প্রভৃতি নাটকের ইতিহাস চেতনা, ‘অঙ্গার’, ‘ফেরারী ফৌজ’ প্রভৃতি নাটকের
মধ্যবিত্ত চেতনা তাঁর নাটককে দেয় ভিন্নমাত্রা।
উৎপল দত্তের নাটকে
ভারতবর্ষের সমাজ, রাজনীতির পাশাপাশি উঠে এসেছে বিশ্বরাজনীতি, অত্যাচারের
বিরুদ্ধে সংগ্রাম, পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া, সাম্রাজ্যবাদের
বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রয়াস, মানবতার জয়তু
জীবনজিজ্ঞাসা প্রভৃতি বিষয়। ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ আজীবন সংগ্রামী। এখানে
যেমন অন্যায়, অত্যাচার, দখল, শাসন-শোষণ নিত্য চলেছে, তেমন নিপীড়িত, শোষিত,
সর্বহারা মানুষ তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে বারবার; আদায় করেছে তাদের
কাঙ্ক্ষিত অধিকার। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক গণ-বিপ্লবের কাহিনী তাঁর নাটকের
অন্যতম বিষয়বস্তু। গুপ্ত সাম্রাজ্যের সময়কালে হিন্দু ও বৌদ্ধ
ধর্মাবলম্বীদের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম, ১৮৫৭ সালের ভারতীয় মহাবিদ্রোহ,
নীলবিদ্রোহ, সন্ন্যাসীবিদ্রোহ, ওয়াহাবি আন্দোলন, জালিয়ানওয়ালাবাগের
রক্তাক্ত অধ্যায়, আজাদ হিন্দ ফৌজের দুঃসাহসিক অধ্যায়, ভারতের নৌবিদ্রোহ,
দেশবিভাগের মর্মদন্তু ঘটনা ইত্যাদি। শুধু তাই নয়, বিশ্বের সংগ্রামী মানুষের
মরণপণ সংগ্রামী ঘটনাগুলিও তাঁর নাটকে ধরা পড়েছে গভীর ইতিহাসবীক্ষার আলোকে।
পৃথিবীর প্রথম শ্রমিকশ্রেণীর রাষ্ট্রগঠনের যে ঘটনা আজও সর্বহারা শ্রেণীর
চোখের মণি সেই প্যারি কমিউন, অক্টোবর বিপ্লবের পূর্ব ও উত্তরকাল,
ফ্যাসিবিরোধী সংগ্রাম, চীনের বিপ্লব, ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধ, কিউবা,
ইন্দোনেশিয়া, একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্রের
বিপর্যয় ও প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের কলঙ্কজনক ভূমিকা- সবই তিনি লিপিবদ্ধ
করে গেছেন তাঁর নাটকের বিষয়বস্তুতে।
নিজেকে তিনি বলতেন
‘প্রোপাগান্ডিস্ট’। প্রচলিত সমাজব্যবস্থার ভিত কাঁপিয়ে দেওয়া ছিল তাঁর
প্রোপাগান্ডার বিষয়। প্রোপাগান্ডা করতে গেলে দরকার মানুষকে ক্রুদ্ধ করে
তোলা। গণ-আন্দোলনের পথে নামলে প্রকাশ পাবে সেই ক্রোধ ও সংগ্রামের
মুষ্টিবদ্ধ প্রয়াস। উৎপল দত্ত তাঁর সমগ্র নাট্যজীবনে এই ব্রতকেই শিরোধার্য
করেছিলেন।
ইতিহাস আশ্রিত নাটকগুলোর মধ্যে ‘কল্লোল’, ‘ব্যারিকেড’,
‘একলা চলো রে’, ‘জনতার আফিম’, ‘তিতুমীর’, ‘সন্ন্যাসীর তরবারি’, ‘ক্রুশবিদ্ধ
কুবা’, ‘টোটা’, ‘অজেয় ভিয়েতনাম’ উল্লেখযোগ্য।
ভারতের ঐতিহাসিক
নৌ-বিদ্রোহ নিয়ে লেখা ‘কল্লোল’ উৎপল দত্তের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক নাটক।
এই নাটকের মধ্য দিয়ে তিনি ইতিহাসের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। ইতিহাসের
দৃষ্টিকোণ থেকে এই বিদ্রোহ নতিস্বীকার করেছিল। কিন্তু না, ‘কল্লোল’ নাটকে
করেনি। উৎপল দত্তের নিজস্ব ভাষ্যে পাওয়া যায় :
‘৪৬-এর নৌ-বিদ্রোহ এক বৈপ্লবিক প্রক্রিয়ার সূচনা। এই সেই প্রক্রিয়া যা ব্রিটিশ কংগ্রেস-মুসলিম লিগ চক্রের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত করতে বাধ্য করলো স্বতঃসিদ্ধভাবে। ইতিহাসের প্রক্রিয়াই তাই। এই সেই প্রক্রিয়া এবং ষড়যন্ত্র যাতে সমগ্র ভারতবর্ষটাই প্রজ্জ্বলিত হলো বিদ্রোহে। এই সেই প্রক্রিয়া যার অমোঘ নিয়মে ভারতী বুর্জোয়া সশস্ত্র সংগ্রামের দুঃস্বপ্নে আজও ভীত। এই প্রক্রিয়া বৈপ্লবিক স্বপ্নের। বিপ্লবের। তাই থিয়েটারের বর্ণমালায় ‘খাইবার’ আত্মসমর্পণ করেনি যেমন আইজেনস্টাইনের ‘ব্যাটেনশিপ পোটেমকিন’-এ করেনি, যদিও ইতিহাস বলে করেছিল। পোটেমকিনের বিদ্রোহীরা মহান অক্টোবর বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে এসে নিজেদের উপনীত করেছিল। ইতিহাসের মানদণ্ডে পোটেমকিন নাবিকদের আত্মসমর্পণ কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বৈপ্লবিক প্রক্রিয়ার তার পুনঃসূচনা। সেই বৈপ্লবিক প্রক্রিয়ার এক অন্যতম উপাচার কল্লোল।’
এই নাটকের সব ঘটনাই ঐতিহাসিক এই অর্থে যে, ১৯৪৬ সালের নৌ-বিদ্রোহে যা ঘটেছিল তা থেকেই এর আদ্যোপান্ত গঠিত। তার মানে এই নয় যে খাইবার নামক জাহাজে এই ঘটনা ঘটেছিল নাট্যকার একাধিক জাহাজের অভিজ্ঞতাকে একত্রিত করে একটিমাত্র জাহাজে সন্নিবেশ করেছেন, সংক্ষেপন করেছেন। ‘খাইবার’কে এখানে প্রতীকীভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে সব বিদ্রোহী জাহাজের প্রতিনিধি হিসেবে। প্রকৃত ইতিহাস যদি উন্মোচিত হয় তবে আমরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে পারি কিভাবে সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল ও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ নাবিকদের বিনা শর্তে আত্মসমর্পণের উপদেশ দিয়ে শেষ পর্যন্ত নাবিকদের বন্দী করালেন এবং ব্রিটিশ লৌহ শক্তির যবনিকায় প্রেরণ করে সকল প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের অন্যতম শরিক হয়ে ইতিহাসের বিড়ম্বনায় রূপান্তরিত হলেন। এ কথা এখন স্পষ্ট যে দুই নেতার সরাসরি বিদ্রোহ-বিরোধীতা মোলায়েম ভাষায় আত্মসমর্পণের জাল তৈরি করেছিল। কারণ তারা তখন নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে স্বাধীনতার দর-দস্তুর করতে অনেক ব্যস্ত ছিলেন। কংগ্রেসের এই দেউলিয়া রাজনীতি নাটকে স্পষ্ট। ‘কল্লোল’ নাটক একটি বিশেষ যুগকে ধরে রেখে সেই যুগের সেই যুগের বৈশিষ্ট ফুটিয়ে তুলেছে। এ নাটক একটি যুগসৃষ্টির অধিকারী, এই কারণেই যে ঐ বিশেষ যুগের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক চেহারার যথাযথ প্রতিফলন ঘটে এ নাটকের সর্বত্রে।
‘একলা চলরে’ নাটকে দেখি ‘দেশের বিনা রক্তপাতে’ স্বাধীনতার সঙ্গে প্রকৃত গান্ধীবাদীদের নিগ্রহ। যারা নিগ্রহ করেছেন তারাও কংগ্রেসি, তবে তারা ভূস্বামী, জমিদার। স্বাধীনতার মুনাফা তারাই লুটেছেন বেশি। মুনাফার তাগিদে সাম্প্রদায়িকতার ইন্ধন তারাই জুটিয়েছেন নির্লজ্জভাবে। চাষীর অন্ন খেয়ে ভুঁড়ি বাড়িয়ে কৃষক সমাজকে ভাগ করেছেন মুসলমান চাষী এবং হিন্দু চাষী আক্ষ্যা দিয়ে। নাট্যকার দেখিয়েছেন স্পষ্টভাবে শান্তি এবং ক্ষমার প্রতীক সত্যাগ্রহী কংগেসি পিতাও রেহাই পায়নি ব্রিঠিশ রাজশক্তির পুলিশবাহিনীর হাত থেকে যখন তারা জানতে পেরেছে তার পুত্র ব্রিটিশের মূলোচ্ছেদে সশস্ত্র বিপ্লবীদের সঙ্গে যুক্ত। পুত্র সহিংস বলে অহিংস পিতাকে ক্ষমা করেনি।
‘রাইফেল’ নাটকের বিষয়বস্তু ত্রিশ থেকে চল্লিশের দশক পর্যন্ত। ১৯৩৪ সালে ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরে বিপ্লবী দলের যে অভ্যুত্থান ঘটেছিল সেটাকে নাট্যকার তুলে ধরেছেন এখানে। আন্দোলন নিয়ে বিপ্লববাদী ও গান্ধীবাদীদের মধ্যে যে মতদ্বৈততা ছিল তাকে নাট্যকার রূপায়িত করেছেন অসাধারণ নাট্যোৎকণ্ঠায়। অবশ্য এই মতদ্বৈততায় উৎপল দত্ত বিপ্লববাদেই বিশ্বাসী। নাটকের শুরুতেই নাট্যকার সূত্রধর চরিত্রের মাধ্যমে সেই প্রশ্নই তুলে ধরেছেন-
‘‘কান পেতে শুনুন, চারিদিকে ঢক্কা নিনাদ, দেশ স্বাধীন হয়েছে বিনা রক্তপাতে, অহিংস সংগ্রামের দৌলতে! দেশ নাকি স্বধীন হয়েছে খদ্দর পরার ফলে, আমরা একমনে চরকা কেটেছি বলে!
অহিংস সংগ্রামের ফলে দেশ স্বাধীন? তবে কি ক্ষুদিরামের নাম মুছে ফেলা হবে ইতিহাস থেকে? বিনা রক্তপাতে দেশ স্বাধীন? তবে কি সূর্যসেনের রক্ত রক্ত নয়? তবে কি সে যুগে ঝাঁসির রানী লক্ষ্ণীবাই আর তিতুমীর, আর এযুগে নৌ-বিদ্রোহী আর সুভাষচন্দ্রের সশস্ত্র আই. এন. এ. বাহিনী আমাদের কেউ নয়?’
এই সংলাপের মদ্য দিয়ে স্পষ্ট হয় নাট্যকারের আদর্শ। পরাধীন ভারতে যারা দোসর ছিল তারাই ’৪৭ পরবর্তী ভারতে ক্ষমতায় বসে। তাই গণমানুষের স্বাধীনতার স্বপ্ন থেকেই যায়। উৎপল দত্ত বোধহয় এটাই দেখাতে চান যে, পরাধীন ভারতে ব্রিটিশরা যেমন সাধারণ মানুষের ওপর নির্যাতন চালাত, শাসন-শোষণ করত, ঠিক তেমনিভাবে শোষণ নির্যাতন করে স্বাধীন দেশের কংগ্রেসীরা। কংগ্রেসী স্বাধীনতাকে নাট্যকার স্বাধীনতা বলতে নারাজ। সেটা শুধু ক্ষমতার পালাবদল, কাঠামো বদল নয়। নাটকের শেষে তাই বিপ্লবীরা আবার ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয় ব্যক্ত করে। লুকিয়ে রাইফেল নিয়ে তারা আবার ঘুরে দাঁড়াতে চায়। নাট্যকার স্পষ্টভাবে বোঝাতে চেয়েছেন অস্ত্র ছাড়া বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামে জেতা সম্ভব নয়। তাই রাইফেল হয়ে ওঠে গণমানুষের হাতিয়ার।
‘ফেরারী ফৌজ’ নাটকে নাট্যকার ১৯৪৭ পূর্ব ভারতবর্ষের রাজনীতি ও আন্দোলনকে তুলে ধরেছেন। বাংলার আন্দোলনের ইতিহাসে যা অগ্নিযুগ নামে পরিচিত সেই যুগটি যেন ভেসে ওঠে চোখের সামনে। ইতিহাসকে এখানে নতুন মাত্রায় উপস্থাপন করেছেন। ’৬০ এর দশকে লেখা এই নাটকের বিষয়বস্তু হিসেবে উঠে এসেছে স্বাধীনতা আন্দোলনে বিপ্লববাদীদের সাহসী ভূমিকা ও কার্যকলাপ। তিনি ষাটের দশকে বিপ্লবীদের উত্থান-পতন, সংগ্রাম-বিচ্যুতিকে দেখিয়েছেন। এই বিপ্লবী আসলে কমিউনিস্টরা আর কংগ্রেস হলো রূপান্তরিত ব্রিটিশ শক্তি। অশোক এই নাটকের অন্যতম প্রধান চরিত্র। শচী, বঙ্গবাসী, রাধারানী সবাই যেন বিপ্লবী। কেই প্রত্যক্ষ কেই পরোক্ষভাবে। এসব চরিত্রের মধ্য দিয়ে নাট্যকার আমাদের ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে নারীদের সাহসিকতাকে তুলে ধরেছেন।
কৃষকবিদ্রোহের নেতা তিতুমীরকে চব্বিশ পরগণার তৎকালীন ব্রিটিশ রেসিডেন্ট এজেন্ট, ক্রফোর্ড পাইরন, একজন গবেষক হিসেবে হাজির করেছেন ‘তিতুমীর’ নাটকে । তিতুমীরের ঐতিহাসিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার ফাঁকে ফাঁকে তিনি বাংলার প্রাচীন পুঁথি গবেষণায় মত্ত। নাট্যকার এখানে একদিকে ক্রফোর্ড পাইরনের গবেষকের আপাত বিচ্ছিন্নতার সঙ্গে সঙ্গে তার ঔপনিবেশিক স্বার্থরক্ষার বিষয়টিকে সুনিপুণ নাট্যকারের মতো আমাদের তিতুমীরের সাম্প্রদায়িকতা বিরোধীতা, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধীতার লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়। এ নাটকে তিতুমীর নাট্যকারের চোখে একজন অতিকথার নায়ক। ‘অতিকথা’ সমাজবিজ্ঞানীদের মতে মানুষকে এক বিশ্বাস প্রদান করে, যার ফলে সে নৈতিক বা ধর্মীয় কাঠামোর মাধ্যমে ঐ বিশ্বাসের দ্বারা বর্তমান জীবনকে ব্যখ্যা করতে চায়। তিতুমীরের চোখে দেশের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামই ধর্মরক্ষা করার সংগ্রাম :
‘যার যা আছে সব কিছু দিয়ে দিতে হবে, তবেই সে এই সংগ্রামের প্রকৃত যোদ্ধার দায়িত্ব বহন করার উপযুক্ত হবে।’
নাটক উৎপল দত্তের কাছে নিছক অবসর-বিনোদনের আশ্রয় নয়, তা অস্ত্র ; এবং এই নাট্যকারের হাতে তা ‘টিনের তলোয়ার’ও নয়, তা ‘রাইফেল’। ‘তীর’, ‘টোটা’, ‘কৃপাণ’, ‘রাইফেল’, ‘সন্ন্যাসীর তরবারি’, ‘টিনের তলোয়ার’- নানাধরনের অস্ত্রের নাম ব্যবহার করে এত বেশি নাটকের নামকরণ আর কোনো নাট্যকারই কি করেছেন? আর কোন নাট্যকারের নাটকে নানাধরনের যুদ্ধবিদ্যার অনুষঙ্গ- ‘ফৌজ’, ‘ব্যারিকেড’, ‘দুর্গ’- এত বেশি আছে? তাঁর নিজের কথাগুলোই এক্ষেত্রে আমাদের বেশি সাহায্য করে :
From the very beginning of my theater-work, we have tried to put revolution in a historical perspective. Studying social phenomena in isolation, assuming each phase of development as a hole, that is, substituting the General with the Perticular, is a universal bourgeois vice; (Twoards Revolutionary theatere, p28)
প্রাচীন ভারতে সমুদ্রগুপ্তের শাসনকালে শ্রেণীস্বার্থ এবং বিজ্ঞান সাধক কলহনের যুক্তিবাদী বিজ্ঞানভিত্তিক লড়াই নিয়ে লেখা ‘সূর্য শিকার’, ফকির সন্ন্যাসীর লড়াই নিয়ে ‘সন্ন্যাসীর তরবারি’, ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে মুক্তির লড়াই নিয়ে ‘টোটা’, উনিশ শতকে বাঙালি নাট্যকর্মীদের মুক্তির শপথ নিয়ে ‘টিনের তলোয়ার’, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়া নিয়ে ‘জালিয়ানওয়ালাবাগ’, চিনাগুড়ি কয়লাখনি শ্রমিকের ওপর মালিক পক্ষের নির্মম অত্যাচার নিয়ে লেখা ‘অঙ্গার’ দেশীয় ইতিহাস নিয়ে লেখা উলেখযোগ্য রাজনৈতিক নাটক।
মানবজাতির মুক্তির জন্য ধাবিত যে কোনও সংগ্রামের প্রতি উৎপল দত্ত শ্রদ্ধাশীল। মার্কসবাদী উৎপল দত্তের কাছে প্যারি কমিউন, সোভিয়েত, চীন, ভিয়েতনাম, কিউবার কমিউনিস্ট যোদ্ধারা তিতুমীর পরিচালিত ওয়াহাবী আন্দোলনের বীর সেনানীদের উত্তরসূরি। মার্কসবাদ ও লেলিনবাদের অবিচল আস্থায় বৈজ্ঞানিক পরিমণ্ডলে সত্য অন্বেষণ করেছেন। সেই সত্যই তার কাছে জীবনসত্য যা শ্রেণীসংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে বিচার্য। এটি তিনি তত্ত্বগতভাবে বিশ্বাস করতেন না, নাটকে প্রয়োগও করেছেন। হিটলালের নাৎসীবাহিনীর বিরুদ্ধে কমিউনিস্টদের ব্যারিকেড গড়ার ইতিহাস উঠে এসেছে উৎপল দত্তের ‘ব্যারিকেড’ নাটকে। এই নাটকে আমরা ভীত, মতামত প্রকাশে দ্বিধাগ্রস্ত ডাক্তার, হেরমান স্ট্রবেলদের পরিচয় পাই, ফ্রায়েৎসাইটুং পত্রিকার সম্পাদক ও মালিক হাইনরিশ লাস্টদের পরিচয় পাই, যারা ইচ্ছায়, অনিচ্ছায় ফ্যাসিবাদের স্বপক্ষে প্রচার করেন, কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে কুৎসার বান ডাকান, আবার অটো বিরখোলৎসের মতো দ্বিধা-দ্বন্দ্বে দীর্ণ, সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিকদের পরিচয়ও পাই। কমিউনিস্ট ও অন্যান্য গণতান্ত্রিক শক্তির নির্বাচনী জয়কে বার বার বাতিল করে এবং শেষ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করে কিভাবে হিটলারের নাৎসী পার্টি ক্ষমতা দখল করল, তারও পরিচয় এই নাটকে রয়েছে। এই বাংলার সাতের দশকের সন্ত্রাস, অসহিষ্ণু শাসকদের গণতন্ত্র নিধনের চেষ্টার সঙ্গে চমৎকার মিল খুঁজে পাওয়া যায় এখানে, অথচ কোথাও একটুও ইতিহাস বিকৃতি চোখে পড়ে না।
সমাজতন্ত্রের জন্য কিউবান জাতির লড়াই ইতিহাসে গাথা হয়ে আছে। ‘ক্রুশবিদ্ধ কুবা’ নাটকে উৎপল দত্ত’র ইতিহাসবীক্ষা কিউবার বর্ণময়, আলো-উজ্জ্বল ভূমিকাই শুধু তুলে ধরেননি, সমকালীন বিশ্ব সংকটের পরিসরকেও ছুঁয়ে গেছে। ঐতিহ্য বিস্মৃত সোভিয়েত, পূর্ব ইউরোপ সমাজতন্ত্রকে ত্যাগ করেছে, চীন গা বাঁচিয়ে চলার নীতি নিয়ে বিশ্ব পরিস্থিতি থেকে নিজেকে অনেকখানি গুটিয়ে রেখেছে। কিউবা পথ প্রদর্শক। ‘ক্রুশবিদ্ধ কুবা’ ইতিহাসের এই সংকটে হতমান সমাজতন্ত্র ও বিশ্বমানবতাকে নিয়ে গেছে অনিঃশেষিত এক সত্যে- সমাজতন্ত্র অজেয়, সমাজতন্ত্র মৃত্যুহীন।
সোভিয়েত রাশিয়া ও রুমানিয়ার পতনে উৎপল দত্ত প্রতিবিপ্লবের গন্ধ পান। লেখেন ‘প্রতিবিপ্লব’ গ্রন্থ। লালদুর্গের পতনে সমাজ বদলের ডাক বিঘ্নিত হবে। এই আশংকার প্রেক্ষিতে তিনি লিখলেন ‘লালদুর্গ’ নাটক। ফরাসি বিপ্লবের ঐতিহ্যকে নাট্যকার বিশ শতকের সমাজ বদলের লড়াইয়ের প্রেরণা সৃষ্টিতে স্মরণ করেছেন।
এছাড়া রুশবিপ্লব ও বিপ্লবী লেনিনকে নিয়ে ‘লেনিনের ডাক’, সোভিয়েত মুক্তির সংগ্রাম নিয়ে ‘লেনিন কোথায়’, রুশ বিপ্লবে লেনিন ও স্তালিন বিষয়ে ‘স্তালিন ১৯৩৪’, জার্মানির ফ্যাসিস্ট অত্যাচার, ইহুদি নিধন নিয়ে ‘প্রফেসর ম্যামলক’, আমেরিকার বর্ণবিদ্বেষ নিয়ে ‘মানুষের অধিকার’, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ভিয়েতনামি সৈন্য ও জনগণের লড়াই নিয়ে ‘অজেয় ভিয়েতনাম’, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম নিয়ে জয়বাংলা ও ঠিকানা উৎপল দত্তের অন্যতম রাজনৈতিক নাটক।
নাট্য আঙ্গিকের গুরুত্বকে উৎপল দত্ত কখনও অবহেলা করেননি। সেটাও তাঁর রাজনীতিরই অঙ্গ ছিল; কেন না তিনি বুঝেছিলেন যে, নাটকের মর্মবস্তুকে দর্শকের কাছে ব্যাখ্যা করার ভাষা হচ্ছে নাট্য আঙ্গিক। তাঁর হাতে আর অন্য কোনো উপাদান নেই। বিষয়বস্তু থেকে আঙ্গিক পর্যন্ত সমস্ত খুঁটিনাটি উপাদানকেও মার্কসীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা, এই ক্ষেত্রেই উৎপল দত্ত তাঁর ইতিহাসগত পূর্বসূরিদের থেকে স্বতন্ত্র এবং অনন্য।
উৎপল দত্ত স্টেজের কথা বা যাত্রার বৃহত্তর পরিসরের কথা ভেবে নাটক লিখেছেন। প্রতিমুহূর্তে মঞ্চসংস্থান, অভিনেতা-অভিনেত্রীর ক্ষমতা ও যোগ্যতার সীমা, দর্শকের প্রতিক্রিয়া অন্যান্য মঞ্চোপকরণের লভ্যতা- ইত্যাদি বিবেচনা করে নাটক লিখতে হয়েছে বলে তাঁর সংলাপ কদাচিৎ অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়। তাঁর সিচুয়েশন, তাঁর নর-নারীদের আচরণ কদাচিৎ নাটকীয়তা-বর্জিত। এই নাটকীয়তা উৎপলদত্তের একটি ইতিবাচক গুণ। এই নাটকীয়তাকে বাস্তবের সঙ্গে সমীকরণ করে দেখা উচিত নয়, এ নাটকীয়তা নাট্যশিল্পের নিজস্ব দাবিতে গড়ে ওঠে। নাটকের সংলাপগুলি দর্শকের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রক্ষা করে চলে। কল্লোল’, ‘অঙ্গার’, তিতুমীর’ প্রভৃতি নাটকের যে সেট এবং মঞ্চ পরিকল্পনা দেখা যায় তা আমাদের সত্যিই অভিভূত করে।
নাট্যকার, অভিনেতা, পরিচালক উৎপল দত্ত আধুনিক এই কারণে যে তিনি বিশ্বের বিপ্লবী রাজনৈতিক থিয়ৈটারের স্মরণীয় প্রতিভাদের অনুসরণে বাংলা থিয়েটারে কি জীবনদর্শনে, কি নাট্যতত্ত্বে, মঞ্চায়নে, আঙ্গিক সৌকর্যে বুর্জোয়া ধ্যানধারণা অতিক্রম করতে চেয়েছেন। তিনি একদিকে বাংলা থিয়েটারের প্রতিটি ঐতিহ্য ভেঙেছেন, অন্যদিকে প্রতিটি ঐতিহ্য বিশ্বের বিপ্লবী রাজনৈতিক থিয়েটরি তত্ত্বের নিরীখে নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে প্রয়াসী হয়েছেন। তাঁকে বলা যায় বিশ শতকের শেষ পঞ্চাশ দশকের সবচেয়ে সফল, বৈচিত্র্যসন্ধানী নাট্যকার।

২২ নভেম্বর ২০১২
উৎপল দত্ত ও তাঁর নাটক : শামসুল আরেফিন
‘আমি শিল্পী নই। নাট্যকার বা অন্য যে কোনো আখ্যা লোকে আমাকে দিতে পারে। তবে আমি মনে করি আমি প্রপাগান্ডিস্ট। এটাই আমার মূল পরিচয়।’
নিজের সম্পর্কে এমনই মন্তব্য করেছিলেন কিংবদন্তি বাঙালি নাট্যকার, অভিনেতা ও পরিচালক উৎপল দত্ত।
উৎপল দত্ত ১৯২৯ সালের ২৯ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্ম অবিভক্ত বাংলার বরিশালে। তিনি কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ইংরেজি বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন।
জীবনের প্রথম দিকে উৎপল দত্ত বাংলা মঞ্চনাটকে অভিনয় করতেন। তিনি ‘শেক্সপিয়ার আন্তর্জাতিক থিয়েটার কোম্পানি’র সাথে ভ্রমণ করেছেন বেশ কয়েকবার। কৌতুক অভিনেতা হিসেবেও তার খ্যাতি রয়েছে। তিনি হিন্দি কৌতুক চলচ্চিত্র গুড্ডি, গোলমাল ও শৌখিনে অভিনয় করেছেন। এছাড়া সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় হীরক রাজার দেশে, জয় বাবা ফেলুনাথ এবং আগন্তুক সিনেমায় অভিনয় করে প্রচুর প্রশংসা কুড়িয়েছেন। মননশীল ছবি ছাড়াও অজ¯্র বাণিজ্যিক বাংলা ছবিতে খলনায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন উৎপল দত্ত। তবে সবকিছু ছাপিয়ে তিনি নাট্যকার হিসেবেই সব থেকে বেশি পরিচিত পেয়েছেন।
উৎপল দত্ত যখন জন্মগ্রহণ করেছেন তখন বিশ্বব্যাপী বয়ে যাচ্ছে এক বিক্ষুব্ধ সময়। সমগ্র বিশ্ব এবং বিশেষ করে পাক-ভারতীয় উপমহাদেশে তখন প্রতিদিনের নতুন সকাল সম্পর্কে মন্তব্য করা কঠিন ছিল। বিশ শতকের প্রথম দশক থেকে বৈশ্বিক রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যেতে থাকলো অর্থনৈতিক অবস্থা, সামাজিক মূল্যবোধের প্যাটার্ন, মানুষের আন্তর্জাগতিক ভূগোল এবং তৎসম্পর্কিত বাহ্যিক আচার-আচরণ, যা চল্লিশের দশকে গিয়ে আরো পরিণত হলো। উৎপল দত্তের বেড়ে ওঠা এই সময়ের ভেতরে। যে কারণে সে সময়ের বৈচিত্র্যসংযাত এবং রাজনৈতিক রসায়ন উৎপল দত্তের নাটকের প্রধান মনোযোগ।
কলেজ জীবনেই অভিনয় শুরু করেন উৎপল দত্ত। ১৯৪৭ সালে নিকোলাই গোগলের ‘ডায়মন্ড কাট্স্ ডায়মন্ড’ এবং মলিয়েরের ‘দ্য রোগারিজ অব স্ক্যাপা’ দিয়েই তার কলেজ জীবনের অভিনয় শুরু। নাটক দুটি প্রযোজনা করেছিল কলেজের ইংরেজি একাডেমি এবং পরিচালনায় অধ্যাপক ফাদার উইভার। ক্রমশ উৎপল ও কলেজের কয়েকজন সহপাঠী মিলে গড়ে তোলেন একটি নাট্যদল- ‘দ্য অ্যামেচার শেকসপিয়ারিয়ান্স’। তাদের প্রথম উপস্থাপনা ‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’ এবং ম্যাকবেথ নাটকের নির্বাচিত অংশ। সেই সময়েই ১৯৪৭ সালের অক্টোবরে, ইংল্যান্ডের বিখ্যাত পরিচালক ও অভিনেতা জেফ্রি কেন্ডাল তার ‘শেকসপিয়ারিয়ানা’ নাট্যদল নিয়ে ভারত সফরে আসেন। কেন্ডালের আহ্বানে উৎপল যোগ দেন সফররত সেই নাট্যদলে। ১৯৪৭-এর অক্টোবর থেকে জানুয়ারি ১৯৪৮ পর্যন্ত শেকসপিয়ারিয়ান নাট্যদল কলকাতায় সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে তাদের প্রযোজনা মঞ্চায়ন করে। নাট্যমোদীরা অভিভূত হন। জেফ্রি কেন্ডালের দলে তখন নিয়মিত অভিনয় করেছেন তিনি। ইউরোপীয় থিয়েটার দলের শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা উৎপলের নাট্যজীবনে ফেলেছিল বিশেষ প্রভাব। এ সময়েই কেন্ডাল-কন্যা জেনিফারের সঙ্গে উৎপলের পরিচয়, অচিরেই যার উত্তরণ ঘটে প্রণয়ে। পরবর্তীকালে জেনিফারের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটলে তীব্র কষ্ট উৎপলকে ঘিরে ধরে। সে দহনের রেশ ছিল আজীবন। জেনিফারের সম্পর্ক মনে রেখে একাধিক কবিতাও লিখেছেন এ নাট্যকার। সহধর্মিণী শোভা সেনের কথন অনুযায়ী, উৎপলের ছিল কবিতা, ছিল ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভূতি অথবা কোনো তাৎক্ষণিক বক্তব্য প্রকাশের মাধ্যম।
উৎপল দত্ত কেবল একজন অভিনেতা, চলচ্চিত্র পরিচালক ও লেখকই ছিলেন না, রাজনৈতিক দর্শনের দিক থেকে তিনি ছিলেন বামপন্থি ও মার্কসবাদী। তিনি আজীবন বামপন্থি ও মার্কসবাদী উৎপল দত্ত গণনাট্য সংঘের সক্রিয় সদস্য হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে নাটক প্রদর্শনে অংশ নেন। মঞ্চের পাশাপাশি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করে বেশ সুখ্যাতি পেয়েছিলেন তিনি। ১৯৫০ সালে ‘বিদ্যাসাগর’ সিনেমায় অভিনয়ের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে তার যাত্রা শুরু হয়। ‘মাইকেল মধুসূদন’ সিনেমায় নাম ভূমিকায় অনবদ্য অভিনয় করে চরিত্রাভিনেতা হিসেবে নিজের আসন পাকা করেন।
বাণিজ্যিক ছবিতে মূলত তিনি নেতিবাচক চরিত্রে অভিনয় করে সব থেকে বেশি খ্যাতি পান। ১৯৬৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত মৃণাল সেন পরিচালিত ‘ভুবন সোম’ সিনেমায় অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেতার জাতীয় পুরস্কার পান তিনি। কমেডি চরিত্রে অভিনয়ের জন্য ‘গোলমাল’ (১৯৮০), ‘নরম গরম’ (১৯৮২) ও ‘রঙ বিরঙি’ (১৯৮৭) সিনেমার সুবাদে তিনবার ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পান। ‘সাহেব’ (১৯৮৬) সিনেমার অভিনয়ের জন্য পার্শ্ব-চরিত্রে সেরা অভিনেতার মনোনয়ন পান ফিল্মফেয়ার আসরে।
শুধু অভিনেতা হিসেবেই নন, নির্দেশক ও নাট্যকার হিসেবেও তিনি ছিলেন অনবদ্য। বিখ্যাত অনেক বিদেশি নাটক বাংলায় রূপান্তর করেন। পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তরের দশকে তিনি ছিলেন পশ্চিম বাংলার গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। শিল্প ও সাহিত্য সমালোচনার দুটি মানদণ্ড আছে : একটি রাজনৈতিক অপরটি শৈল্পিক। শ্রেণিবিভক্ত সমাজে প্রত্যেক শ্রেণির নিজস্ব রাজনৈতিক ও শৈল্পিক মানদণ্ড আছে। কিন্তু সব শ্রেণিবিভক্ত সমাজে সমস্ত শ্রেণিই সর্বদা শৈল্পিক মানদণ্ডের চেয়ে রাজনৈতিক মানদণ্ডকে স্থান দিয়ে থাকে। তবে উৎপল দত্ত তার রচিত ‘টিনের তলোয়ার’, ‘মানুষের অধিকার’, ‘ব্যারিকেড’, ‘অঙ্গার’সহ বেশকিছু নাটকের মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন একই সঙ্গে রাজনৈতিক ও শৈল্পিক মানদণ্ডকে স্পর্শ করা সম্ভব।
বাংলা রাজনৈতিক নাটকের ইতিহাস শুরু বলা যায় দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটকের মাধ্যমে। উনিশ শতকের মধ্যভাগে বাংলা নাটকের মূল চালিকাশক্তি ছিল সমাজ সংস্কারের মানসিকতা। রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’রা সেকালে সমাজে যে প্রবল প্রগতিশীল আন্দোলন উপস্থিত করেছিলেন, সেকালের নাটক মূলত তারই প্রতিফলন। ‘নীলদর্পণ’-এ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শোষণের নির্মম চিত্র উদঘাটনই ছিল মূল লক্ষ্য। এরপর জাতীয়তাবাদের উন্মেষ পর্বে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, কিরণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, হরলাল রায়, উপেন্দ্রনাথ দাস, উমেশচন্দ্র গুপ্ত, প্রমুখ মূলত ইতিহাসের প্রচ্ছদে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী রাজনৈতিক নাটক রচনা করেছিলেন। পরবর্তীকালে এই ধারা গিরীশচন্দ্র-দ্বিজেন্দ্রলাল রায় প্রমুখের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত প্রবাহিত হয়েছে। আর বিশ শতকের মাঝামাঝি পর্বে বাংলা নাটককে প্রচ্ছন্ন রাজনৈতিক নাটকের ধারা হিসেবে যারা এগিয়ে নিয়ে গেছেন তাদের মধ্যে উৎপল দত্ত অন্যতম।
উৎপল দত্ত তার অন্য নাটকের পাশাপাশি রাজনৈতিক নাটকে শাসক, শোষকশ্রেণির বিরুদ্ধে কথা বলেছেন সরাসরি। শুধু তাই নয়, নাটক নিয়ে তিনি চার দেয়ালে ঘেরা থিয়েটারে আবদ্ধ থাকেননি, পৌঁছেছেন গণমানুষের কাছে; নাটকে সম্পৃক্ত করেছেন হাজার হাজার সাধারণ মানুষকে।
উৎপল দত্তের রাজনৈতিক নাটকগুলোর মধ্যে আবার পাওয়া যায় শ্রেণি চেতনা, ইতিহাস চেতনা ও মধ্যবিত্ত চেতনা। ‘টিনের তলোয়ার’, ‘রাতের অতিথি’, ‘ছায়ানট’, ‘সূর্যশিকার’, ‘মানুষের অধিকার’ প্রভৃতি নাটকে যেমন পাওয়া যায় শ্রেণি চেতনা সচেতনতা, তেমনি ‘টোটা’, ‘লাল দুর্গ’, ‘তিতুমীর’, ‘কল্লোল’, ‘দিল্লি চলো’, ‘ক্রুশবিদ্ধ কুবা’ প্রভৃতি নাটকের ইতিহাস চেতনা, ‘অঙ্গার’, ‘ফেরারি ফৌজ’ প্রভৃতি নাটকের মধ্যবিত্ত চেতনা তার নাটককে দেয় ভিন্নমাত্রা।
উৎপল দত্তের নাটকে ভারতবর্ষের সমাজ, রাজনীতির পাশাপাশি উঠে এসেছে বিশ্বরাজনীতি, অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রয়াস, মানবতার জয়তু জীবনজিজ্ঞাসা প্রভৃতি বিষয়। ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ আজীবন সংগ্রামী। এখানে যেমন অন্যায়, অত্যাচার, দখল, শাসন-শোষণ নিত্য চলেছে, তেমন নিপীড়িত, শোষিত, সর্বহারা মানুষ তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে বারবার; আদায় করেছে তাদের কাক্সিক্ষত অধিকার। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক গণবিপ্লবের কাহিনী তার নাটকের অন্যতম বিষয়বস্তু। গুপ্ত সা¤্রাজ্যের সময়কালে হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম, ১৮৫৭ সালের ভারতীয় মহাবিদ্রোহ, নীলবিদ্রোহ, সন্ন্যাসীবিদ্রোহ, ওয়াহাবি আন্দোলন, জালিয়ানওয়ালাবাগের রক্তাক্ত অধ্যায়, আজাদ হিন্দ ফৌজের দুঃসাহসিক অধ্যায়, ভারতের নৌবিদ্রোহ, দেশ বিভাগের মর্মন্তুদ ঘটনা ইত্যাদি। শুধু তাই নয়, বিশ্বের সংগ্রামী মানুষের মরণপণ সংগ্রামী ঘটনাগুলোও তার নাটকে ধরা পড়েছে গভীর ইতিহাস বীক্ষার আলোকে। পৃথিবীর প্রথম শ্রমিক শ্রেণির রাষ্ট্রগঠনের যে ঘটনা আজো সর্বহারা শ্রেণির চোখের মণি সেই প্যারি কমিউন, অক্টোবর বিপ্লবের পূর্ব ও উত্তরকাল, ফ্যাসিবিরোধী সংগ্রাম, চীনের বিপ্লব, ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধ, কিউবা, ইন্দোনেশিয়া, একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্রের বিপর্যয় ও প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের কলঙ্কজনক ভূমিকা- সবই তিনি লিপিবদ্ধ করে গেছেন তার নাটকের বিষয়বস্তুতে।
আর এসব কারণেই সময়ে সময়ে তিনি হয়ে উঠেছেন অনিবার্য।
১৯৯৩ সালের ১৯ আগস্ট ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে মাত্র ৬৪ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। উৎপল দত্ত উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের ও মঞ্চের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন তার সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে।

৩০ মার্চ ২০১৮
উৎপল দত্ত : জীবন ও প্রয়ান
বাংলা তথা ভারতের নাট্য সমাজের এক আশ্চর্য, তুলনাহীন, ব্যাক্তিত্বের নাম উৎপল দত্ত । তিনি যে কেবল নট, নাট্যকার, নির্দেশক, গবেষক, চিন্তাবিদ বা কমিউনিস্ট বিপ্লবের প্রচারক ছিলেন, তা নয়। তার সব কিছু নিয়ে ভারতীয় নাট্য জগতে যে বিপুল আলোড়ন উঠেছিল, তার সময়কালে আর কোনো নাট্য ব্যাক্তিত্বকে ঘিরে তেমনটা হয়নি। তার মতো আগে কেউ ছিলোনা, পড়েও কেউ আসেননি। পুলিশি নির্যাতন, কারাবাস, দুস্কৃতি দের দিয়া তাঁর নাটকের উপর আক্রমণ…কোনও কিছুই থামাতে পারেনি সাম্যবাদের মন্ত্রে দীক্ষিত এই নাট্য ব্যক্তিত্বকে।
ছেলেবেলা
পুরো নাম উৎপলরঞ্জন দত্ত। জন্ম ১৯২৯ সালের ২৯ মার্চ, বাংলাদেশের বরিশাল জেলার কীর্তনখোলায়। যদিও তার পরিবারের আদি বাসস্থান ছিল কুমিল্লা জেলায়। কিন্তু তিনি নিজে তার জন্মস্থান শিলংয়ে তার মামার বাড়িতে বলে উল্লেখ করে গিয়েছেন। তাই সঠিক বলা দুষ্কর আসল জন্মস্থানটি কোথায়। উৎপলের বাবা গিরিজারঞ্জন দত্ত ও মা শৈলবালা রায়ের (দত্ত) পাঁচ পুত্র, তিন কন্যার মধ্যে উৎপল ছিলেন চতুর্থ সন্তান। পারিবারিক ধর্মগুরু তার ডাকনাম রেখেছিলেন শঙ্কর। বাবা গিরিজারঞ্জন ছিলেন শিক্ষায় শিক্ষিত পরাধীন ভারতে ব্রিটিশ প্রভাবিত সমাজের উচ্চশ্রেণির মানুষ। তিনি পরবর্তী কালে জেলার হিসেবে ইংরেজ কারাগারের ভারপ্রাপ্ত প্রশাসক (কমান্ড্যান্ট) নিযুক্ত হন। উৎপলের স্কুলজীবন শুরু হয়েছিল শিলং শহরের সেন্ট এডমন্ডস স্কুলে। গিরিজাশঙ্কর বদলি হয়ে আসেন বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র ছিলেন। বিপ্লবীদের ভয়ে স্কুলে যাতায়াতের সময়ে তাদের সঙ্গে দেহরক্ষী থাকত। জেলের পাঠান রেজিমেন্টের জওয়ানদের সঙ্গে উৎপল ড্রিল করতেন। এই সঙ্গই তাকে সময়ানুবর্তিতা শিখিয়েছিল। জেল-সংলগ্ন কোয়ার্টারে সপরিবার তারা থাকতেন। বাড়ির সদর দরজায় মা শৈলবালার হাতে তৈরি এমব্রময়ডারি করা শেক্সপিয়রের ‘হ্যামলেট’ নাটকের পেমেনিয়াসের সংলাপ ঝুলত, ‘নেভার কোয়ারেল, নেভার লেন্ড অর বরো ইফ ইউ আর অনেস্ট।’ বোঝাই যায়, বাড়িতে পাশ্চাত্য শিক্ষার পরিবেশে শেক্সপিয়ারের উপস্থিত ছিল অগ্রগণ্য। মেজদা মিহীররঞ্জন কিশোর উৎপলকে শেক্সপিয়ারের নাটকের গল্প পড়ে শোনাতেন। বাড়িতে রেকর্ড চালিয়ে নাটক শোনার চল ছিল। উৎপল সে সব নাটক মন দিয়ে শুনতেন। তাই তিনি মাত্র ছয় বছর বয়সেই শেক্সপিয়রের নাটকের সংলাপ মুখস্থ বলতে পারতেন। বড়দিদির মাধ্যমে হিন্দুস্থানী মার্গ সংগীতের সঙ্গে পরিচয় বহরমপুরের বাড়িতেই। আরও পরে কলকাতায় সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়ার সময়ে পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সঙ্গীতের সংস্পর্শে আসেন। তখনও নাটক তাকে টানেনি। তিনি চেয়েছিলেন কনসার্ট পিয়ানিস্ট হতে। কিন্তু শিক্ষিকা মিসেস গ্রিনহল তাকে বলেছিলেন তার হাতের আঙুলের দৈর্ঘ্য বা ‘রিচ’ কম হওয়ায় তার পক্ষে কনসার্ট পিয়ানিস্ট হওয়া সম্ভব নয়।
সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ
১৯৩৯ সালে গিরিজাসঙ্কর কলকাতায় বদলি হলে দত্ত পরিবার দক্ষিণ কলকাতার অভিজাত রয় স্ট্রিটে থাকতে শুরু করেন। কলকাতায় আসার পরই উৎপল বাবা-মায়ের সঙ্গে কলকাতার পেশাদার থিয়েটার দেখতে শুরু করেন। তিনি লিখেছেন, “ মহেন্দ্র গুপ্তের পরিচালনায় স্টার থিয়েটারের পরিচালনায় আমি তো রীতিমতো ভক্ত ছিলাম। আর অবশ্যই শিশির ভাদুরী মহাশয়ের শ্রীরঙ্গমের অভিনয় গুলি। নিরবচ্ছিন্ন মনোযোগে তার অভিনয় লক্ষ্য করতাম। সেইসব মহৎ কারবার দেখে মনে হলো, আমার পক্ষে অভিনেতা ছাড়া আর কিছুই হবার নেই। আমার বয়স তখন তেরো।”
বিশ্ব জুড়ে তখন যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে। সেই আবহাওয়ায় দশ বছর বয়সের উৎপল ভর্তি হলেন সেন্ট লরেন্স স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীতে। তাকে দেখে সহপাঠী, পরে অধ্যাপক, দেবব্রত মুখোপাধ্যায়ের মনে হয়েছিল, ‘গ্যালিভার’-এর পাতা থেকে যেন এক অতিমানব এসে হানা দিয়েছিল তাদের স্কুলে। স্কুলে বিদেশি নাটক হতো। উৎপল অভিনয় করতেন। আর পরে তিনি চলে আসেন সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে, নবম শ্রেণীতে। এই স্কুলে ও কলেজ জীবন উৎপল দত্ত কে তৈরি করে দিয়েছিল। ১৯৪৫-এ তিনি সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন। কলেজে তার কাছে সবচেয়ে আকর্ষণ ছিল গ্রন্থাগারটি। বিভিন্ন বিষয়ের বই টকর সামনে মেলে ধরেছিল জ্ঞানের বিপুল ভান্ডার। বন্ধু পুরুষোত্তম লালের ভাষায়, “উৎপল হলো বর্ন ব্রিলিয়ান্ট। ওই বয়সেই সে সেক্সপিয়ারের জগৎকে যেমন আবিষ্কার করেছিল, তেমনই মার্ক্স, লেনিন, স্তালিন, হেলেন, কান্টও, তার আয়ত্তে ছিল।” কলেজে ইউরোপীয় নাট্যচর্চার একটা ধরা আগে থেকেই সজীব ছিল। এখানে পড়াকালীনই এক দিকে যেমন ইবসেন বা শেক্সপিয়ারের নাটকের জগৎ তার আরও কাছে এসেছিল, তেমনই সেই নাটকে অভিনয় করার নেশা। কলেজ পত্রিকার জন্য তিনি ‘বেটি বেলশাজার’ নামে প্রথম ইংরেজি নাটকটি লিখেছিলেন। এ ছাড়াও বিভিন্ন বিষয় নিয়েও লিখতে শুরু করেন। সেখানে যেমন ছিল শেক্সপিয়র, বার্ট্রান্ড রাসেল, রুশ সাহিত্য, তেমনই রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র… আবার বেঠোভেন, বাখ, শুবার্ট ও ভাগনারের মতো সুরস্রষ্টারও বাদ যাননি। পরবর্তী কালে তাই থিয়েটারে সংলাপের পরে সঙ্গীতের প্রয়োগই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছিল তার কাছে। ১৯৪৭ সালে নিকোলাই গোগোলের ‘ডায়মন্ড কাটস ডায়মন্ড’-এ অভিনয়ের মধ্য দিয়ে কলেজজীবনে উৎপলের নাট্য অভিনয়ের শুরু। তারা সহপাঠি অভিনেতাদের মধ্যে ছিলেন প্রতাপ রায়, অনিল চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। এই বন্ধুদের নিয়েই তিনি তৈরি করেন তার প্রথম নাট্যদল ‘দি অ্যামেচার সেক্সপিরিয়নস’। তখন তার বয়স আঠেরো। যদিও ইতিমধ্যে ১৯৪৪ সালে ‘নবনাট্য আন্দোলন’-এর জন্ম দেওয়া ‘নবান্ন’ নাটকটি তিনি দেখেছেন ও চমকে গিয়েছেন। কিন্তু তিনি তার নিজের বৃত্তেই তখন তৈরি হচ্ছিলেন সেই নবনাট্যর এক স্বতন্ত্র অধ্যায় রচনা করার জন্য। কারণ, দিন বদলের দামামা উৎপল তত দিনে শুনে ফেলেছিলেন। তার কলেজ জীবনের সময় কালে অর্থাৎ বিংশ শতাব্দীর চারের দশক জুড়ে বিশ্বযুদ্ধ, ভারত ছাড়ো আন্দোলন, মন্বন্তর, দাঙ্গা, দেশভাগ, স্বাধীনতা, উদ্বাস্তুদের দল, গণনাট্য, কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হওয়া, নৌ-বিদ্রোহ ইত্যাদিতে সারা দেশ উত্তাল। সেই রাজনৈতিক, সামাজিক পরিবেশ উৎপলকে বাধ্য করেছিল তত্ত্বগত ভাবে আওতে থাকা মার্ক্সের দর্শনকে নাট্যমঞ্চে প্রোয়গের স্তরে নিয়ে আসতে। ১৫ জুলাই ৪৯ জেভিয়ার্সের মঞ্চে তিনি শেক্সপিয়রের ‘জুলিয়াস সিজার’ উপস্থাপন করলেন চরিত্রদের ইতালীয় ফ্যাসিস্ত শাসকের পোশাক পরিয়ে। সমকালীন মাত্রা পেল শেক্সপিয়রের নাটক।
জিয়োফ্রে কেন্ডাল ও সেক্সপিয়রানা নাট্যদল
সেন্ট জেভিয়ার্সে থাকাকালীনই শেক্সপিয়রের ‘রিচার্ড দ্য থার্ড’-এ উৎপলের
অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকে নিজের দলে টেনে নেন জিয়োফ্রে কেন্ডাল। ‘দ্য
সেক্সপিয়রানা ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার কোম্পানি’ তে অভিনেতা হিসেবে কাজ করতে
শুরু করলেন উৎপল। প্রথম পর্বে কলকাতা ও দ্বিতীয় পর্বে সারা দেশ ঘুরে তিনি
এই দলের পেশাদার অভিনেতা হিসেবে শেক্সপিয়রের মোট আটটি নাটকে অভিনয় করেন।
জিয়োফ্রেকে শিক্ষাগুরু মনে করতেন উৎপল। শেক্সপিয়রের নাটকে ঠিক কিভাবে অভিনয়
করতে হয়, নাটকের দল বলতেই বা কি বোঝায়, তা তাকে হাতেকলমে শিখিয়েছিলেন
জিয়োফ্রে শোভা সেনের লেখা থেকে জানা যায়, এই নাট্যদলে কাজ করার সময়ে
জেনিফার কেন্ডালের প্রেমে পড়েছিলেন উৎপল। কিন্তু সে সম্পর্ক বেশি দিন
টেকেনি। জেনিফারকে এক জন ক্ষমতাময়ী অভিনেত্রী বলে মনে করতেন উৎপল। তাই
পরবর্তী জীবনে শশী কপূরের সঙ্গে জেনিফারের বিয়ে ও অভিনয় ছেড়ে দেওয়ারয় খুব
দুঃখ পেয়েছিলেন তিনি।
নাট্যকার ও পরিচালক উৎপল দত্ত
গণনাট্য সংঘ
সেক্সপিওরানা দলের হয়ে অভিনয়ের পাশাপাশি নিজের ‘দ্য অ্যামেচার
সেক্সপিরিয়ানস’ নাট্য দলের হয়েও অভিনয় করে যাচ্ছিলেন উৎপল। ১৯৪৯ সালে এই
দলের নাম বদলে হয় ‘কিউব’। ১৯৫০-এ ইউরোপ আর আমেরিকার গ্ৰুপ থিয়েটার
আন্দোলনের থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আবারও দলের নাম বদলে করেন ‘লিটন থিয়েটার
গ্ৰুপ’। ১৯৫২ সালে এই দলে যোগদেন রবি ঘোষ, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো
অভিনেতারা। এর পরই বাংলা নাটকের দল হিসেবে ‘এল টি জি’ পাকাপাকি ভাবে
আত্মপ্রকাশ করে হেনরিক ইবসেনের বাংলা অনুবাদ ‘গোস্টস’ নাটকটি দিয়ে। এক সময়ে
উৎপল দত্ত গণনাট্য সংঘেও যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু সে সম্পর্ক মাত্র
আট (মতান্তরে দশ) মাস স্থায়ী হয়েছিল। গণনাট্যের অভ্যন্তরীণ সংঘাতে আরও
অনেকের মতো বিরক্ত হয়ে তিনিও বেরিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু গণনাট্যই তাকে শিল্পে
সামাজিক দয়াবদ্ধতার প্রথম পাঠ শিখিয়েছিল। উচ্চবিত্ত পারিবারিক পটভূমি,
ইঙ্গবঙ্গীয় থিয়েটারের অভিজ্ঞতা, কেতাদুরস্ত ইংরেজি, ইউরোপীয় পণ্ডিত্যে
ভরপুর আপাদমস্তক ‘সাহেব’ নাট্য পরিচালক নট উৎপল তার যাবতীয় প্রজ্ঞা ও
প্রতিভা নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছিলেন সর্বহারা মানুষের মাঝখানে। সেখান থেকে
জীবনে আর কখনও বিচ্যুত হননি। ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির বাইরে থেকেও তিনি
হয়ে উঠেছিলেন লাল দুর্গের এক অতন্দ্র প্রহরী। গণনাট্য সংঘের হয়ে তিনি পানু
পালের ‘ভাঙা বন্দর’, ইবসেনের ‘পুতুলের সংসার’, রবীন্দ্রনাথের ‘বিসর্জন’,
গোগোলের ‘রেভিজর’ অবলম্বনে ‘অফিসার’, উমানাথ ভট্টাচার্যর ‘চার্জশীট’, পানু
পালের ‘ভোটের ভেট’, ঋত্বিক ঘটকের ‘দলিল’ ও শেক্সপিয়রের ‛ম্যাকবেথ’ নাটকে
বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন।
এল টি জি প্রতিষ্ঠা পথনাটক
উৎপল দত্ত হলেন বাংলা পথনাটকের পথিকৃৎ। তার মতে, “পথনাটিকা হচ্ছে
সেই মাধ্যম যেখানে লক্ষ মেহনতী মানুষের রাজনৈতিক চেতনা ও অভিনেতার রাজনৈতিক
উপলব্ধি এক হয়ে বিস্ফোরিত হয় মঞ্চে।” সোভিয়েত ইউনিয়নের শ্রমিক শ্রেণির হাত
ধরেই এর উঠে আসা। ১৯৫১ সালে উমানাথ ভট্টাচার্যের এক রাতের মধ্যে লেখা
‘চার্জশীট’ ভারতীয় গণনাট্য সংঘের প্রথম পথনাটক। যা অভিনীত হয়েছিল হাজরা
পার্কে। যেখানে অভিনয় করেছিলেন উৎপল দত্ত, ঋত্বিক ঘটক, মমতাজ আহমেদ ও পানু পাল। ১৯৫২ সালে ‘পাসপোর্ট’ থেকে ১৯৯২ সালে ‘সত্তরের দশক’ পর্যন্ত দীর্ঘ একচল্লিশ বছরে উৎপল দত্ত মোট
২৫ টি পথনাটক করেছিলেন কখনও কোনও কারখানার গেটে, নির্বাচনী জনসভায় বা
বন্দিমুক্তি আন্দোলনে উত্তাল বাংলার বিভিন্ন মাঠে ময়দানে। এই প্রযোজনাগুলি
হয়েছিল গণনাট্য ও ‘উৎপল দত্ত সম্প্রদায়’-এর নামে। পথনাটকে অভিনয়ের সুযোগ তাকে করে দিয়েছিল গণনাট্য সংঘ।
মিনার্ভ, উত্তাল সময়
এই সময়কাল উৎপল দত্ত র জীবনে গোত্র বদলের কাল। মানুষের মুখরিত সখ্যে
নেমে আসছেন তিনি। আর সেই উদ্দেশ্যেই পেশাদার নাট্যমঞ্চ গড়ে নিয়মিত থিয়েটার
করে যাওয়ার বাসনায় মিনার্ভ থিয়েটার লিজ নিয়ে প্রতি বৃহস্পতি, শনি ও রবিবার
থিয়েটার করতে শুরু করেছিলেন। প্রথম দিকে আগে অভিনীত ‘ওথেলো’, ‘ছায়ানট’ ও
‘নীচের মহল’ দিয়ে শুরু হলেও পেশাদার নাট্যমঞ্চের দর্শক তেমন ভাবে সাড়া
দেয়নি। কিন্তু তারই মধ্যে ঘটেছিল এক আশ্চর্য যোগাযোগ। ‘নীচের মহল’ নাটকের
অভিনয় হচ্ছে মিনার্ভয়। দর্শক সংখ্যা খুবই কম নগন্য। নাটকের শেষে মুগ্ধ
রবিশঙ্কর দর্শকাসন থেকে উঠে এসে বলেছিলেন,“আমি আপনাদের পরের নাটকে সঙ্গীত
দিতে চাই, নেবেন ?” এ প্রস্তাব যেন মরা গাঙে জোয়ার এনেছি। এই সময়ে উৎপল দত্ত বেক্তিগত
জীবনও নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে এগোচ্ছিল। আর্থিক সঙ্কটে জর্জরিত।
মিনার্ভা হলের তিনতলার ঘরটাই ছিল তার বাসস্থান। তত দিনে পেশাদার অভিনেতা
হওয়ার তাগিদে সাউথ পয়েন্ট স্কুলের চাকরিটিও ছেড়েছেন। অন্য দিকে সহ-অভিনেতা
শোভা সেনের সঙ্গে তার স্বামী দেবপ্রসাদ সেনের সম্পর্ক তলানিতে এসে ঠেকেছে।
যার প্রভাব পড়ছিলো উৎপল দত্ত র জীবনেও। পরবর্তী কালে উৎপল ও শোভা
বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল। ১৯৬১-তে জন্মায় তাদের কন্যা বিষ্ণুপ্রিয়া। হার
না মানার পণ নিয়ে এল টি জির সদস্যরা মিনার্ভা ও অন্যান্য মঞ্চে নাটক করে
যাচ্ছিলেন। এমনই একসময় ধানবাদ অঞ্চলের জামাডোবায় চিনাকুড়ি ও বড়াধেমো
কয়লাখনিতে এক মর্মাস্তিক ঘটনা ঘটল। খাদে আগুন ধরে যায়। মালিক আটকে পড়া
শ্রমিকদের কথা না ভেবে জল ঢুকিয়ে খনি বাঁচাতে চেষ্টা করেন। শ্রমিকরা মারা
যান। এই দুর্ঘটনার খবর রবি ঘোষ তার এক আত্মীয় মারফত নিয়ে আসেন উৎপলের কাছে।
খবর পেয়েই তিনি ছুটে যান সাই কয়লাখনিতে। সঙ্গে তাপস সেন, নির্মল গুহরায়,
উমানাথ ভট্টাচার্য, রবি চট্টোপাধ্যায় ও রবি ঘোষ। হাজার ফুট নীচের সাই
খনীগহ্বরে তারা দু’ঘন্টা ধরে ঘুরে বেড়ান। জীবিত খনি শ্রমিকদের সঙ্গে কথা
বলেন। খনির ভিতরের বিভিন্ন শব্দ রেকর্ড করেন। তার পর সেখান থেকে ফিরে
মিনার্ভার তিনতলার ঘরে বসে টানা ১৫ দিনে লিখে ফেলেন কালজয়ী নাটক ‘অঙ্গার’।
১৯৫৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর এই নাটক প্রযোজনার কাহিনি আজ বাংলা নাট্যজগতে মিথে
পরিণত হয়েছে। এর পরে এল টি জি নাট্যদলকে আর পিছনে ফিরতে হয়নি। উৎপল দত্ত তার
পর থেকে ‘গ্যালিভার’-এর মতোই বিচরণ করেছেন বাংলার নাট্যজগতে। এই ভাবেই
ক্রমশ মিনার্ভায় ‘ফেরারি ফৌজ’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘চৈতালি রাতের
স্বপ্ন’ ‘প্রোফেসর মামলক’ ইত্যাদি নাটক পার হয়ে ১৯৬৫ সালের ২৮ মার্চ হয়েছিল
আর এক সাড়া জাগানো নাটক ‘কল্লোল’। ১৯৪৬-এর নৌ -বিদ্রোহকে কেন্দ্র করে এই
নাটক বিংশ শতাব্দীর ছয়ের দশকে যে অভূতপূর্ব গণআন্দোলনের সূচনা করেছিল, তা
আজও নজিরবিহীন। উৎপল দত্তের বয়স তখন ৩৬।
চলচ্চিত্র
“নাটক ও যাত্রা আমাকে সৃষ্টির আনন্দ দিলেও চলচ্চিত্র দিয়েছিল বেঁচে থাকার
রসদ, মনে টাকা। হিন্দি চলচ্চিত্র আমাকে সর্বভারতীয় অভিনেতা হয়ে ওঠার সুযোগ
করে দিয়েছিল।” মধু বসুর ‘মাইকেল’ ছবিকে মাইকেল মধুসূদনের ভূমিকায় অভিনয়ের
মধ্য দিয়ে উৎপল দত্ত-র চলচ্চিত্র জীবনের সূচনা। অসংখ্য বাংলা ও
হিন্দি বাণিজ্যিক ছবিতে অভিনয় করলেও তার নিজের ভালোলাগার ছবিগুলি তৈরি
হয়েছিল অজয় কর, তরুণ মজুমদার, তপন সিংহ, হৃদিকেস মুখোপাধ্যায়, শক্তি
সামন্তর মতো পরিচালকের ছবি দিয়ে। তিনি যে কত বড় কৌতুকাভিনেতা, তার পরিচয়
ছড়িয়ে আছে এদের ছবিতে। আবার মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, গৌতম ঘোষের ছবিতে তার
অভিনয় একেবারে অন্য গোত্রের। মৃণাল সেনের ‘ভুবন সোন’ তাকে চলচ্চিত্র
অভিনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল। তবে যাঁর ছবিকে তিনি বারবার কুর্নিশ
করেছেন প্রথম থেকেই, তিনি সত্যজিৎ রায়। ‘পথের পাচালি’ বা ‘জন অরণ্য’ দেখে
সত্যজিৎকে লেখা তার আবেগরুদ্ধ রয়েছে। সত্যজিৎকে তিনি ডাকতেন ‘স্যর’ বলে।
সত্যজিৎ ও মুগ্ধ ছিলেন উৎপলের প্রতিভায়। বলেছিলেন, ‘উৎপল যদি রাজা না হত,
তবে হয়তো আমি ‘আগন্তুক’ বানাতামই না।’ ‘আগন্তুক’ ছবিতে উৎপলকে নিজের
প্রতিভূ হিসেবেই ব্যাবহার করেছিলেন সত্যজিৎ।
জীবনসন্ধ্যা, প্রয়ান
নট, নাট্যকারের স্তর থেকে উৎপল দত্ত ক্রমশ উত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছিল বিশ্বের সেরা সেক্সপিয়র বিশেষজ্ঞদের অন্যতম ও এক জন প্রগতিশীল বামপন্থী চিন্তাবিদের পর্যায়ে। বাংলা নাটকে যেমন মাইকেলকে নতুন ভাবে এনেছিলেন গিরীশ ঘোষ, তেমনই বার্টোল্ড ব্রেখটকে যুক্ত করেছিলেন উৎপল দত্ত । নিজেই বলেছেন, তাঁর উপরে প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছিল, সোভিয়েত রাশিয়ার নিকোলে পাভলোভিচ অখলোপকভ-এর। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতে, সিনেমা নয়, তাঁর আসল জাত চিনিয়াছে নাটক। “নির্দেশক উৎপল দত্ত-র কর্মকাণ্ড শিশির-উত্তর বাংলা রঙ্গমঞ্চকে যতখানি সমৃদ্ধ করেছে, ইতিহাসই সেই অতুলনীয় সম্পদের কোষাগার হয়ে থাকবে।” উৎপল দত্ত-এর সঙ্গে নাটকে কাজ করতে চেয়ে তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন সৌমিত্র। আন্তন শেফারের ‘স্লিউথ’ নাটকটি তাঁকে অনুবাদ করতে দেন উৎপল। কথা ছিল, ওই নাটকে দু’জনে অভিনয় করবেন। কিন্তু তা আর হয়নি। পরে সেই নাটক ‘টিকটিক’ নামে সৌমিত্র করেছিলেন কৌশিক সেনের সঙ্গে। উৎপল দত্ত-এর সঙ্গে কাজ করার স্মৃতি আজও উজ্বল হয়ে আছে নাটক, চলচ্চিত্র ও যাত্রার অনেক অভিনেতা ও পরিচালকের মনে। কন্যা বিষ্ণুপ্রিয়ার মনে হত, “মহলার সময় বাবা যেন এক যুদ্ধের সেনানায়ক।” অভিনেতা সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, রবি ঘোষ তাঁকে গুরু মানতেন। রবি ঘোষ বলতেন, “উৎপল দত্ত ছিলেন সারা ভারতের শ্রেষ্ঠ ‘স্টেজ স্টলওয়ার্ট’। স্টেজ প্রোডাকশনের এ টু জেড জানতেন। আমার অভিনয়ের বেসিক ট্রেনিং তো ওঁর কাছেই পাওয়া।” তরুণ মজুমদারের মনে আছে, “ওঁর ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’ ছবির রায় সাহেবের চরিত্রটা এত পছন্দ হয়েছিলো যে, এগ্রিমেন্ট পেপারে সই করে পারিশ্রমিকের জায়গাটা ফাঁকা রেখে ফেরত পাঠিয়েছিলেন। ফ্লোরে মেকআপ নিয়ে পাঁচ মিনিট আগেই উপস্থিত হলেন। হাতে থাকতো মোটা মোটা বই। শটের ফাঁকে পড়তেন। ডাক পড়লেই উঠে দাঁড়িয়ে বলতেন, ‘ইয়েস স্যর’। মেয়ে বিষ্ণুপ্রিয়াকে ঠাট্টা করে তিনি বলেছিলেন, “ষাট বছর বয়স হলে বিপ্লবী আর বিপ্লবী থাকে না। প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে যায়।” ১৯৯৩ সালের ১৯ আগস্ট ৬৪ বছর বয়সে উৎপল দত্ত-র জীবনাবসান হয়।
বিশেষ সংখ্যা সম্পাদনা : শুভ্র আহমেদ, আহমেদ সাব্বির, বাবলু ভঞ্জ চৌধুরী, রনজু আহমেদ
বিশেষ সহযোগিতা : নূরুজ্জামান সাহেব, সুলতান মাহমুদ রতন, সায়েম ফেরদৌস মিতুল
