বিশেষ নিবেদন সংখ্যা -১ । শওকত আলী : প্রদোষে সোনালী স্রোত

বিশেষ নিবেদন সংখ্যা -১

শওকত আলী : প্রদোষে সোনালী স্রোত

শওকত আলী (১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৬ – ২৫ জানুয়ারি ২০১৮ )

অনেক ভালো অনুবাদেও নয় একটু ভালো অনুবাদেও শওকত আলীকে চিরায়ত বিশ্বসাহিত্যের লেখকদের তালিকা থেকে অনেক চেষ্টা করেও বাদ দেওয়া যাবে না। গল্প-উপন্যাসের নানা আখ্যানে বৈচিত্র্য আর ভাষাশৈলীর স্বতন্ত্রস্বর শওকত আলী। বাংলা কথাসাহিত্যে বর্ণিল বর্ণাঢ্য জগৎ তৈরির এক অনন্য স্থপতি ।

“ ষাটের দশকের মানুষের মধ্যে চিন্তাভাবনার যে পরিবর্তন আসছে, সেটাই ‘দক্ষিণায়নের দিন’ যার মানে হচ্ছে শীতকাল আসছে। ‘কুলায় কাল স্রোত’ হচ্ছে পরিবর্তন যেখানে আঘাত করছে। আর ‘পূর্বরাত্রি পূর্বদিন’ হচ্ছে নতুন সময়টি আসার একেবারে আগের সময়টি। মূলত ষাটের দশকে আমাদের মধ্যবিত্ত এবং সমগ্র সমাজব্যবস্থায় একটা পরিবর্তন আসে। নতুন একটা চিন্তা-চেতনা দ্বারা আলোড়িত হয় পুরো সমাজ। ধ্যান-ধারণা চাল-চলন জীবনব্যবস্থায় একটা পরিবর্তনের সুর বেজে ওঠে। সেসবই উপন্যাসে আনতে চেয়েছি। ” — একটি কখোপকথনে বলেছিলেন শওকত আলী ।

ইচ্ছে ছিল চিকিৎসক হওয়ার। কিন্তু নানা কারণে কলা বিভাগে পড়তে বাধ্য হন। ছাত্র জীবনেই জড়িয়ে পড়েন কমিউনিস্ট আন্দোলনে। ১৯৫২ সালের কথা– যোগ দেন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে। এর পরই মায়ের মৃত্যু। ১৯৫২ সালে শওকত আলি তার ভাই-বোনদের নিয়ে সে সময়ের পূর্ব বাংলার দিনাজপুরে চলে আসেন।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে বিশেষ অবদান রেখেছেন তিনি। ১৯৫৪ সালে তাকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হয়। ১৯৫৫ সালে বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় এমএ-তে ভর্তি হন ও ১৯৫৮ সালে এমএ পাশ করেন।

১৯৫৫ সালে দৈনিক মিল্লাতে সাংবাদিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন শওকত আলি। এর পরই সুযোগ আসে শিক্ষকতার। ১৯৫৮ সালে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন দিনজাপুরের একটি স্কুলে। ১৯৬২ সালে জগন্নাথ কলেজে লেকচারার হিসেবে যোগ দেন তিনি। এর আগে বিভিন্ন পত্রিকা, ম্যাগাজিনে লেখালেখি চালালেও ঢাকায় আসার পর লেখালেখির প্রসার ঘটে তাঁর। ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস ‘পিঙ্গল আকাশ’। ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত হয় তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’

বামপন্থীদের ‘নতুন সাহিত্য’ পত্রিকায় তিনি লেখালেখি করেছেন। দৈনিক মিল্লাত, মাসিক সমকাল, ইত্তেফাকে তার অনেক গল্প, কবিতা ও শিশু সাহিত্য প্রকাশিত হয়েছে।

শওকত আলি তার ‘ওয়ারিশ’ উপন্যাসে ব্রিটিশ শাসনকাল, দেশভাগ আর হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার মর্মন্তুদ ছবি এঁকেছেন। ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ উপন্যাসে তিনি তথাকথিত নিম্নবর্গের মানুষের বঞ্চনার কথা তুলে এনেছেন, পাশাপাশি ফুটিয়ে তুলেছেন শোষকের বিরুদ্ধে ‘অচ্ছুৎ’ সম্প্রদায়ের বিপ্লব-বিদ্রোহের চিত্র।

‘উন্মুল বাসনা’, ‘লেলিহান সাধ’, ‘শুন হে লখিন্দর’, ‘বাবা আপনে যান’-সহ বেশ কয়েকটি গল্পগ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন শওকত আলি।

বাঙালি সমাজব্যবস্থার ক্রমপরিবর্তন নিয়ে যে ক’জন লেখক কাজ করেছেন, শওকত আলি তাঁদের অন্যতম। বিভিন্ন দশকে বাঙালি মধ্যবিত্তের চিন্তাধারার পরিবর্তনও উঠে এসেছে তার লেখায়।

সাহিত্যে অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৬৮ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান তিনি। ১৯৭৭ সালে পেয়েছেন হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার। ১৯৮৩ সালে পেয়েছেন অজিত গুহ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার। উপন্যাসত্রয়ী ‘দক্ষিণায়নের দিন’, ‘কুলায় কালস্রোত’ এবং ‘পূর্বরাত্রি পূর্বদিন’-এর জন্য শওকত আলি ১৯৮৬ সালে পেয়েছেন ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার। ১৯৮৯ সালে পেয়েছেন আলাওল সাহিত্য পুরস্কার। এর পর কথাসাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৯০ সালে পেয়েছেন একুশে পদক।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তাঁকে বন্দি করে জেলে পাঠায় পাকিস্তানের সামরিক জান্তা।

শওকত আলীর কথাসাহিত্য : তিন প্রেক্ষাপট
আলী রীয়াজ

কথাসাহিত্যিক শওকত আলীর অসামান্য সৃষ্টিকে তিনটি প্রেক্ষাপট থেকে বিবেচনা করতে হবে বলে আমি মনে করি। প্রথমটি হচ্ছে ইতিহাস এবং ফিকশনের সম্পর্ক; দ্বিতীয়টি হচ্ছে বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের বিভিন্ন প্রবণতা, বিশেষত যে সময় তিনি লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন সেই ষাটের দশকের প্রবণতাসমূহ; তৃতীয়ত তাঁর উপন্যাসের পটভূমি এবং চরিত্রগুলো। সাহিত্য বিষয়ক যে কোনো আলোচনাই সাবজেকটিভ; পাঠক হিসেবে ওই আলোচক কিভাবে সাহিত্যকে দেখেন তার ওপরে সেটা নির্ভর করে। আমার এই লেখা তার ব্যতিক্রম নয়। পাঠক হিসেবে আমি সাহিত্য এবং সাহিত্যিককে তাঁর দেশকালের প্রেক্ষাপটেই বিবেচনা করি। এমনকি কালোত্তীর্ণ সাহিত্যও একটা সময়ের ভেতরে স্থাপিত বলে আমার ধারণা। ফলে শওকত আলীকেও আমি সেইভাবেই বিবেচনা করি, তাঁর লেখা আমি সেইভাবেই পড়ি।

ইতিহাস এবং ফিকশনের সম্পর্ক বিষয় নিয়ে বৈশ্বিক সাহিত্য প্রেক্ষাপটে যে আলোচনা তার কোনো সুস্পষ্ট প্রভাব আমরা বাংলা ভাষায় দেখতে পাইনা। যা আছে তা অত্যন্ত সীমিত। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা একেবারেই অনুপস্থিত। দক্ষিন এশিয়ায় বেশ জোরেসোরে এই প্রসঙ্গের অবতারনা ঘটেছে ১৯৪৭ প্রসঙ্গে, যাকে আমরা দেশভাগ বা পার্টিশন বলেই চিহ্নিত করি। এই আলোচনার অন্যতম একটি অন্যতম সূত্র হচ্ছে ১৯৪৭ বিষয়ে ডমিন্যান্ট বা প্রচলিত ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক। উপমহাদেশের ইতিহাস বিষয়ে ঐতিহাসিকদের বর্ণনা এবং সরকারী ভাষ্য প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে প্রশ্নাতীতভাবে নারী, প্রান্তিক জন এবং সাধারন মানুষকে অবজ্ঞা করেছে। শুধু তাই নয়, এই সব প্রচলিত ইতিহাস নির্মিত হয়েছে ব্যক্তি ও দলকে কেন্দ্র করে, তাঁদের ভূমিকা এবং সাফল্যের জয়গাঁথা বর্ণিত হয়েছে ইতিহাসে। এই ইতিহাস-বর্ণনাকে যখন সমাজবিজ্ঞানীরা প্রশ্নবিদ্ধ করলেন, বিশেষত ১৯৮০-এর দশকে, তখন থেকেই ইতিহাসের অন্যান্য উপাদানের দিকে দৃষ্টি আকর্ষনের উদ্যোগ লক্ষ্য করা গেলো। সেই পটভূমিকায়ই সাব-অল্টার্ন বা ব্রাত্যজনের ইতিহাসের গুরুত্বকে ধর্তব্যে নেয়ার ধারা তৈরি হয়। সেই সময়ে সমাজের অন্যান্য প্রান্তিকায়িত বর্গের মানুষের কথা উঠে আসলো, জেন্ডারের প্রশ্নও আসলো – নারীর ভূমিকার প্রশ্ন আসলো। একইভাবে এই সব বিষয়ের সাহিত্যিক প্রকাশ, যার একটি বড় দিক হচ্ছে ফিকশন, সে দিকেও মনোযোগ আকর্ষিত হল।

অনেক ইতিহাসবিদের ধারণা যে ফিকশনের এই ধারা ইতিহাসের ‘গাম্ভির্য্য’ এবং সত্যনিষ্ঠার বিপরীতে, ফলে এর কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। কিন্ত এটা ক্রমেই স্পষ্ট যে ইতিহাসের যে ডমিন্যান্ট ধারা, যা আসলে নির্ধারিত হয় রাজনীতি ও সমাজে ক্ষমতা কাঠামো দিয়ে, তার বাইরের কন্ঠস্বর তুলে আনার জন্যে মৌখিক ইতিহাস (ওরাল হিস্ট্রি), স্মৃতিকথা, আত্মজীবনী এবং ফিকশনের গুরুত্বকে অস্বীকারের উপায় নেই। ইতিহাসের যে বিভিন্ন ধরণের বয়ান (ন্যারেটিভ) থাকে তা কেবল দলিল-নির্ভর বা পরিচিত ক্রীড়নকদের কথনেই থাকে তা নয়; ইতিহাসের ভিন্ন ভিন্ন ন্যারেটিভ আমরা অন্যত্রও দেখতে পাই। এগুলো ইতিহাস-বর্ণনার বিকল্প নয়। বরঞ্চ এগুলো একাদিক্রমে প্রচলিত ইতিহাসের পরিপূরক এবং সেই ইতিহাসে অনুপস্থিত ভাষ্য। পাশাপাশি ইতিহাস-আশ্রয়ী / ইতিহাস-নির্ভর ফিকশন যে কাজটি করে তা হচ্ছে পাঠককে ‘ঘটনার অত্যাচার’ থেকে মুক্ত করে; এই ধরণের ফিকশন আমাদেরকে ওই সময়ের ভেতরে আপাতদৃষ্ট নয় কিন্ত উপস্থিত প্রবণতাগুলোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। আমি মনে করি যে, শওকত আলীর উপন্যাস এবং ছোট গল্প পড়লে আমরা সেই সময়কে বুঝতে পারি। কেবল ঘটনা প্রবাহের কারণে নয়, বরঞ্চ তারচেয়ে বেশি করে সেই সময়ের সমাজের ভেতরে প্রবহমান ধারা ও প্রবণতাকে। এই ধরণের ফিকশন আমাদেরকে কেবল চরিত্র বা কাহিনী উপহার দেয় না, যা দেয় তা হচ্ছে দেখবার চোখ। কিছু কিছু লেখক আছেন যারা জীবন সম্পর্কে, চারপাশের জগত সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে দেন; আমাদেরকে তাঁরা যা দেন তা হচ্ছে দেখার চোখ, সমাজকে বোঝার যুক্তি এবং অনুভব করবার মতো হৃদয়। এই ধরণের লেখকদের মধ্যে সৃষ্টিশীল লেখকরাই অন্যতম। কথা সাহিত্যিক শওকত আলী সেই ধারার লেখক।

তাঁর অনেক উপন্যাস এবং ছোটগল্প এইভাবে অর্থাৎ সমাজের ভেতরে প্রবহমান প্রবণতার ভাষ্য বলে পাঠ করা সম্ভব। আমি তিনটির কথা উল্লেখ করতে চাই। তাঁর ট্রিলজি ‘দক্ষিনায়নের দিন’; বহুল পরিচিত এবং আলোচিত ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ এবং ‘নাঢ়াই’। ১৯৭৬, ১৯৭৭ এবং ১৯৭৮ সালে তার তিনটি উপন্যাস – দক্ষিনায়নের দিন, কূলায় কালস্রোত এবং পূর্বদিন পূর্ব রাত্রি প্রকাশিত হয়েছিলো সাপ্তাহিক বিচিত্রার ঈদ সংখ্যায়। এই তিন উপন্যাসের সময় হচ্ছে ষাটের দশকের উত্তাল আন্দোলন। ষাটের আন্দোলনের পটভূমি যে কেবল ইতিহাসের ধারাবাহিক বর্ণনার মধ্যে নেই তা আমি ব্যক্তিগতভাবে বুঝতে পারি ওই তিন উপন্যাস পাঠ করে। যে জাগরণের উত্তরাধিকার হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ তা কেবল ঘটনা পরম্পরা নয়, সমাজের ভেতরে ধীরে ধীরে যে বদল ঘটেছিলো তাকে অনুভব না করে ইতিহাসকে বোঝার চেষ্টার মধ্যে অপূর্নতা থাকবে সেই সত্য আমি শওকত আলীর উপন্যাস পড়ে উপলব্ধি করি। এই যে উপন্যাসের মধ্যে, রাখির জীবনের মধ্যে, তাঁর ব্যর্থতার, অপূর্ণতার মধ্যে, দীর্ঘশ্বাসের মধ্যেই একটা জনপদের মানুষেরর ইতিহাস লেখা হয়েছে সেটা বুঝতে পারি কিন্ত উপন্যাসের যে শিল্পরূপ তাকে বাদ দিয়ে নয়। হৃদয় দিয়ে ইতিহাসকে বোঝার অর্থ যে সমাজের মর্মবানীকে উপেক্ষা করা নয় সে কথা বোঝার পথ হচ্ছে এই তিনটি উপন্যাস। সেন রাজার শাসন শেষ পর্যায়ে তুর্কী আগমনের অন্তর্বর্তী সময়কে ধারন করা হয়েছে ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’। এর ঐতিহাসিক পটভূমি বিস্তারিতভাবে বলার প্রয়োজন হয়না। সম্ভবত শওকত আলীর সবচেয়ে পঠিত উপন্যাস হচ্ছে ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’‘নাঢ়াই’ উপন্যাস আমার বিচারে ইতিহাস, তেভাগা আন্দোলনেরই ইতিহাস। শওকত আলী আমাদেরকে ইতিহাসচারী হতে বলেছেন, অন্যথায় কেন তিনি ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ লিখবেন? একাধিক সাক্ষাতকারে তিনি আমাদের মনে করিয়ে দেন যে এটা ‘ঐতিহাসিক উপন্যাস নয়।’ কিন্ত ইতিহাস তো কেবল ঘটনার বর্ণনা নয়। ইতিহাস হচ্ছে সমাজ পরিবর্তনের যে স্রোত। ইতিহাসের সেটাই মর্মবস্ত। কথাসাহিত্য আমাদের ইতিহাসের ধারাক্রম বোঝায় না, কিন্ত ফিকশন আমাদেরকে জানিয়ে দেয় সমাজের ভেতরে কী ধারাগুলো প্রবাহিত হয়েছিল। সেই অর্থে এগুলো ইতিহাসের পাঠ। ইতিহাস ও সাহিত্যের এই সম্পর্কের প্রশ্নটি বোঝার এবং এই বিষয়ে আলোচনার দরজা খুলে দিয়েছেন শওকত আলী। সেই আলোচনা এখন আমাদের জন্যে আরো জরুরি কেননা সমাজ ও রাজনীতিতে ক্ষমতা সম্পর্ক বাংলাদেশের ইতিহাসের যে ডমিন্যান্ট ন্যারাটিভ তৈরি করেছে তাকে চ্যালেঞ্জ করতে হলে আমাদের এই দিকে মনোযোগ দিতে হবে।

শওকত আলীর কাজকে বিচারের দ্বিতীয় প্রেক্ষাপট হচ্ছে বাংলাদেশের সাহিত্যের প্রচলিত প্রবণতা। বিশেষ করে যে সময়ে তিনি সাহিত্যের জগতে প্রবেশ করলেন সেই প্রেক্ষাপট। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর, যখন পূর্ব বাংলা একটি রাজনৈতিক সত্তা হিসেবে প্রকাশিত হলো যেখানে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চার একটা নতুন এবং ভিন্ন ধারা গড়ে ওঠার সুযোগ এবং সম্ভাবনা তৈরি হল। সেটা কবিতা এবং কথাসাহিত্য দুইয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আমার ধারণা কথা সাহিত্যে সেই পরিবর্তন, আলাদা কণ্ঠস্বরটা তৈরি হয় পঞ্চাশের দশকে। যার উদাহরণ হচ্ছেন, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্, শওকত ওসমান, আবু ইসহাক, আবু রুশদ, সরদার জয়েনউদ্দীন, রশীদ করীম, শামসুদ্দীন আবুল কালাম, শাহেদ আলী, আলাউদ্দিন আল আজাদ, হাসান হাফিজুর রহমান, মুর্তজা বশীর, রাবেয়া খাতুন প্রমুখ। সবাই একই ধারায় লিখলেন তা নয়, কিন্ত একটা স্বতন্ত্র ধারা তৈরি হল। আমার কাছে এটাকে পুর্ব বাংলার আলাদা ধারা বলে মনে হয়। তখনকার কথাসাহিত্যে যে জীবন আমরা দেখতে পাই সেটা প্রধানত গ্রামীন জীবনের। শহর, নগর জীবন এই সব তৈরি হয়নি। ফলে মানুষের জীবনের কাহিনী গ্রাম জীবনের কাহিনী। শুধু তাই নয়, এই সব লেখকদের এক বড় অংশই সেইভাবেই জীবনের প্রাণ স্পন্দনকে অনুভব করেছে। ষাটের দশকে এসে মধ্যবিত্ত তৈরি হতে থাকলো, নগর জীবন তৈরি হতে থাকলো। আমরা দেখলাম যে কথাসাহিত্যে সেই জীবনের ছবি উঠে আসতে শুরু করেছে। সেটা খুব অস্বাভাবিক নয়। কিন্ত যেটা আমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হয় তা হল যে বড় আকারের বাংলাদেশ, গ্রামের মানুষ, ব্রাত্যজন তাঁরা হারিয়ে যেতে থাকলেন। সে সময় যারা লিখলেন তাঁদের মধ্যে হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শওকত আলী, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, আল মাহমুদ, বিপ্রদাশ বড়ুয়া, কায়েস আহমেদ, মাহমুদুল হক, বুলবুল চৌধূরী, রিজিয়া রহমান আছেন যারা এই জীবনের দিকে তাকালেন। শওকত আলী যদিও ‘পিঙ্গল আকাশ’-এ মধ্যবিত্তের জীবনের দিকেই চোখ রেখেছিলেন, কিন্ত অবিলম্বে তিনি বড় আকারের বাংলাদেশকে ধরতে চাইলেন। বাংলাদেশে যে জনপদ, বাংলাদেশের মানুষের যে জীবন তাই হয়ে উঠলো তাঁর প্রধান বিষয়। ষাটের দশকের এক বড় সংখ্যক কথাসাহিত্যিক যে ধারাকে বেছে নিলেন শওকত আলী তা থেকে ভিন্ন হয়ে থাকলেন। তিনি এক স্বতন্ত্র কন্ঠস্বর হয়ে উঠলেন।

শওকত আলীর সাহিত্য বিচারের তৃতীয় প্রেক্ষাপট বিষয়ে বিস্তারিত বলা বাহুল্য। যে মানুষদের কথা তিনি লেখেন তাঁরা ব্রাত্যজন। যেমন ‘নাঢ়াই’ উপন্যাস প্রান্তজনের মধ্যেও যারা প্রান্তজন তাঁদের কাহিনী। ফুলমতি, অল্প বয়সী বিধবা নারী, ফুলমতি বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের এক গণ্ডগ্রামের অতিদরিদ্র আধিয়ার আহেদালীর স্ত্রী এবং আবেদালী নামের এক বালকের জননী। দারিদ্র এবং জেন্ডার তাঁকে প্রান্তজনের প্রান্তজন করেছে। শওকত আলীর উপন্যাসে আমরা তাঁকে কেবল দেখিই না, তাকেই মনে হয় প্রতীক। শওকত আলীর লেখার পটভূমি ভৌগলিকভাবে উত্তর বাংলার। যে জনপদের কথা তিনি লেখেন সেটি উত্তর বাংলার মানুষের জীবন – যাকে আমরা তাঁর (এবং হাসান আজিজুল হকের) কলমে চিনতে পারি। এটা তাঁর অভিজ্ঞতা সঞ্জাত; তিনি যেখানে বড় হয়েছেন, যেখান থেকে তাঁর নতুন জীবনের সূচনা হয়েছে। ‘ওয়ারিশ’, ‘উত্তরের খেপ’ এবং ‘দলিল’ যারা পাঠ করেছেন তাঁরা শওকত আলীকে বোঝেন কোথায় তার শেকড়। তিনি শেকড় গেড়ে বসে আছেন শহরের আলো থেকে দূরে এমন এক জীবনে যেখানে আমাদের বড় সংখ্যক লেখকেরা কখনো যান না। এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেছিলেন, ‘নগরে বেশির ভাগ জীবন কাটিয়েছি বটে, কিন্তু আমার ভাবনায় ছিল সাধারণ মানুষ। আর কিছু সুযোগ হয়েছে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেলামেশার, কিছু কৌতূহলও ছিল। গ্রামীণ জীবনের দিকে টান থাকার কারণে স্কুলে চাকরি করেছি কিছুদিন এম এ পাস করার পরে, ঠাকুরগাঁও অঞ্চলে। পরে সেখানে যখন প্রথম কলেজ হলো, সেই কলেজে চাকরি নিলাম। সেই অঞ্চলের উত্তরে যে আদিবাসীরা ছিল তাদের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ হয়েছিল’ (প্রথম আলো, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৩)।

শওকত আলীর সৃষ্টি আরো অনেকভাবেই বিশ্লেষিত হবে। আমি সেই আলোচনায় এই তিন প্রেক্ষাপট বিবেচনার তাগিদ জানাতে চাই বলেই এই লেখার অবতারণা।

শওকত আলী ও তাঁর সৃষ্টিকথা
আনু মুহাম্মদ

কথাশিল্পী ও শিক্ষক শওকত আলী (১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৬-২৫ জানুয়ারি ২০১৮) বা আমাদের শওকত ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হওয়ার অনেক আগেই তাঁর লেখালেখির সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। সে পরিচয় ছিল একজন শক্তিশালী লেখকের সৃষ্টির সঙ্গে যোগাযোগের আনন্দঘেরা। শওকত ভাইয়ের লেখা পড়ার সুযোগ হয় প্রথম সাপ্তাহিক বিচিত্রায়। সম্ভবত প্রথম দেখাও হয় সেখানেই।

১৯৭৩ থেকে আমার সাপ্তাহিক বিচিত্রার সঙ্গে সম্পর্ক। বিচিত্রা তখন দিনে দিনে রাজনীতি, অর্থনীতি শিল্প-সাহিত্যজগতে একটি প্রবল দাপট নিয়ে হাজির হচ্ছিল। শাহাদত চৌধুরীর নেতৃত্বে এ পত্রিকা ক্রমে বহু তরুণ-প্রবীণ লেখকের মঞ্চ হয়ে দাঁড়ায়; শুধু লেখালেখি নয়, আড্ডায়ও। বিচিত্রায় এমনিতে গল্প বা উপন্যাস প্রকাশের কোনো নিয়ম ছিল না। দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতাগুলোই তখন ছিল লেখকদের একমাত্র ভরসা। সেখানে গল্প ছাড়াও মাঝেমধ্যে ধারাবাহিক উপন্যাস প্রকাশিত হতো। দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা তখন ছিল অনেক কম, তার ওপর সাহিত্য পাতা আর কতটা জায়গা দিতে পারত? তাই সৃজনশীল লেখকদের প্রস্তুতির তুলনায় প্রকাশের সুযোগ ছিল খুব সীমিত। কলকাতায় দেশ ও আনন্দবাজারের পূজা সংখ্যা যেভাবে অনেক নতুন উপন্যাস, গল্প ও প্রবন্ধ প্রকাশের নিয়মিত একটি ক্ষেত্র ছিল, বাংলাদেশে সে রকম কোনো পত্রিকা ছিল না। এক পর্যায়ে, সম্ভবত সত্তরের দশকের মাঝামাঝি, বিচিত্রা বাংলাদেশে প্রথম ঈদ সংখ্যা চালু করে ; যেখানে এখানকার লেখকদের গল্প ও উপন্যাস প্রকাশিত হওয়া শুরু হয়। একসঙ্গে এক মলাটের মধ্যে সীমিত দামে এতগুলো ভালো গল্প ও উপন্যাস পাওয়া পাঠকদের জন্য তখন ছিল একটি বড় প্রাপ্তি।

স্বাধীনতা উত্তর নতুন উদ্দীপনা-স্বপ্ন-প্রত্যাশাকালে সৃজনশীলতার জগতেও শক্তিশালী পদধ্বনি শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু প্রকাশনা জগতের ক্ষুদ্র সীমা, এ বিষয়ে যথাযথ পরিকল্পনা বা উদ্যোগহীনতার কারণে লেখা প্রকাশের সুযোগ সম্প্রসারিত হচ্ছিল না। অনেকেই নিরুৎসাহিত হচ্ছিলেন। বিচিত্রা ঈদ সংখ্যা প্রকাশনা শুরু হওয়ার পর বছর বছর নতুন নতুন উপন্যাস প্রকাশের সহজ রাস্তা তৈরি হয়। পাঠকদের জন্যও অনেক কম পয়সায় একসঙ্গে নতুন অনেক গল্প ও উপন্যাস পড়ার সুযোগ আসে।

এ ঈদ সংখ্যাগুলোতেই শওকত ভাইয়ের একাধিক উপন্যাস ও গল্প প্রকাশিত হয়। শওকত আলী, হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, কায়েস আহমেদ, রাজিয়া খান, সৈয়দ শামসুল হক, আল মাহমুদ, রিজিয়া রহমানসহ আরো অনেকের গল্প ও উপন্যাস আমি প্রথম বিচিত্রা ঈদ সংখ্যাতেই পড়ি। আরো বহু পাঠকের জন্যই এই একই পরিস্থিতি ছিল। বই কিনে পড়ার মতো অবস্থা তখন আরো কম ছিল।
আশির দশকে আরো সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হওয়া শুরু হয়। ঈদ সংখ্যার প্রতি পাঠকের আগ্রহ বুঝে একে একে অনেকেই ঈদ সংখ্যা বের করারও উদ্যোগ গ্রহণ করে। এখন প্রতি বছর ঈদসহ নানা উপলক্ষ ধরে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়। লেখকদের ‘অপ্রকাশের ভার’ এখন কিছু হয়তো কমেছে।

শওকত ভাইয়ের বই আকারে যে উপন্যাস প্রথম পড়ার সুযোগ হয়, তার নাম প্রদোষে প্রাকৃতজন। এ বইয়ের ভাষা, চরিত্রবিন্যাস, ইতিহাসের কালকে আয়ত্ত করা, বলার ঢং সবকিছুতে মোহিত হয়েছিলাম। অনেককে তখন বলেছি বইটি পড়তে। তখনো শওকত ভাইয়ের সঙ্গে আমার আলাপ হয়নি।

পরে জেনেছি শওকত আলীর জীবন খুব মসৃণ ছিল না। তার জীবনে সবচেয়ে বড় তোলপাড় সৃষ্টির ঘটনা ছিল ভারতভাগ। জন্ম বর্তমান ভারতের অন্তর্ভুক্ত দিনাজপুরে। বাবা ছিলেন ডাক্তার, তবে রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। মা ছিলেন শিক্ষক। স্কুলে পড়াকালেই মা মৃত্যুবরণ করেন। এর মধ্যে ভারতভাগও হয়ে যায়। এ ভাগের আগে-পরে দুই পারে মানুষের মহাবিপর্যয়ের তিনি সাক্ষী এবং শিকারও বটে। সে সময় ওই অঞ্চলের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতিতে তাদের টিকে থাকা সম্ভব না হওয়ায় শওকত আলীর পরিবার পাকিস্তানে চলে আসে। প্রথম দিকে কিছু সময় সাংবাদিকতা করেছেন, পরে শিক্ষকতাতেই স্থিত হয়েছেন। এটাই ছিল তাঁর জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত। তাঁর মতো সংবেদনশীল, দায়িত্বশীল, অবিরাম জ্ঞানের জগতে বিচরণে আগ্রহী মানুষের জন্য শিক্ষকতাই সঠিক পেশা।

নিজের শৈশব-কৈশোর যে ভূমিতে শিকড়, ইচ্ছার বিরুদ্ধে তা ত্যাগ করে অন্য জায়গায় স্থায়ী হওয়া যে খুব কঠিন, আজীবন যন্ত্রণার বিষয়, তা এ রকম অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে না গেলে উপলব্ধি করা কঠিন। টানাপোড়েন, উন্মূল হওয়ার যাতনার মধ্যেই থাকতে হয় এই মানুষদের। শওকত আলীরও তা-ই হয়েছিল। তাঁর বিভিন্ন উপন্যাস, গল্প, গদ্যে এসব বিষয় ঘুরেফিরে এসেছে।

আশির দশক ছিল শওকত ভাইয়ের সবচেয়ে সক্রিয় সময় কিংবা বলা যায়, এর আগের কয়েক দশক নিজের চিন্তাজগতে, ভাবনায়, বুননে যা কিছু সঞ্চিত হয়েছিল, তার সৃজনশীল প্রকাশ সবচেয়ে বেশি ঘটেছিল আশির দশকে। এ দশকেই তার আরো যেসব উপন্যাস পড়ি, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো দক্ষিণায়নের দিন (১৯৮৫), কুলায় কালস্রোত (১৯৮৬), পূর্বরাত্রি পূর্বদিন (১৯৮৬), ওয়ারিশ (১৯৮৯), উত্তরের খেপ (১৯৯১)।
আর এই আশির দশকেই শওকত ভাইয়ের সঙ্গে দেখা, কথা ও নিয়মিত কাজের সম্পর্ক তৈরি হয়। এ দশকে কয়েক দফায় আমি বাংলাদেশ লেখক শিবিরের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করি। এ সংগঠনকে লেখক-শিল্পীদের একটি স্বাধীন সংগঠন হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টায় ক্রমে এতে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন হাসান আজিজুল হক, শওকত আলী, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মতো বাংলা সাহিত্যের শক্তিশালী প্রধান লেখকরা। তার ফলে আমার সুযোগ হয় এ কিংবদন্তি ব্যক্তিদের চিন্তা ও কাজের সঙ্গে আরো ঘনিষ্ঠভাবে পরিচয়ের। তাঁদের সঙ্গে বহু সভা, আলোচনা, সফর আর আড্ডা আমার উজ্জ্বল স্মৃতির অংশ। শওকত ভাই কথা কম বলতেন কিন্তু যখন বলতেন তখন তাঁর মধ্যে পেতাম এক গভীর ইতিহাস অনুসন্ধানী সামাজিকভাবে দায়বদ্ধ চিন্তাশীল মানুষের ছবি।

নব্বইয়ের দশকে আমাদের যোগাযোগ আরো সংহত হয়। বিশেষত ইলিয়াস ভাইকে কেন্দ্র করে আমাদের অনেক উদ্যোগে, আলোচনায় শওকত ভাই ছিলেন উৎসাহী অংশীদার। এ দশকেই ১৯৯৭ সালের শুরুতে ইলিয়াস ভাইয়ের মৃত্যু আমাদের সবার জন্য ছিল অনেক বড় আঘাত। এরপর শওকত ভাই আরো সামনে এসেছিলেন, অনেক কাজে হাল ধরেছিলেন। ইলিয়াস ভাইয়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত হতো বাংলাদেশ লেখক শিবিরের সাহিত্য পত্রিকা তৃণমূল। তাঁর অকালমৃত্যুর পর এ পত্রিকার ‘আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সংখ্যা’ সম্পাদনার দায়িত্ব আমাকেই নিতে হয়। এ সংখ্যায় শওকত ভাই ‘ইলিয়াসের মিথ’ নিয়ে যে লেখাটা লিখেছিলেন, তা সাহিত্য ও জগৎ নিয়ে তাঁর সমৃদ্ধ চিন্তাভাবনা বুঝতে অনেক সহায়ক হবে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের লেখা সম্পর্কে শওকত ভাইয়ের এ বিশ্লেষণে, অন্যান্য আলোচনায়ও, ইলিয়াসের শক্তিমত্তার বিভিন্ন দিক বিশেষত গল্প-উপন্যাসে মিথ ব্যবহারের দক্ষতা নিয়ে বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।

২০১৮ সালে মৃত্যুর আগের এক দশকে শওকত ভাই শারীরিকভাবে অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। নিঃসঙ্গতাও তাঁকে কাবু করেছিল অনেকখানি। তার পরও তিনি লিখছিলেন, বলছিলেন দায়িত্ব নিয়ে। সর্বশেষ তাঁর উপন্যাস পড়েছি নাঢ়াই (২০০৩) এবং মাদারডাঙ্গার কথা (২০১১)। জনপদ ও মানুষ নিয়ে এগুলো তাঁর খুবই শক্তিশালী সৃষ্টি।

মানুষের জীবন, মনোজগৎ, তার বিশ্বাস-অবিশ্বাস ধরার জন্য শুধু বর্তমান যথেষ্ট নয়, অতীতকেও জানতে হয়; শুধু প্রকাশ্য বিশ্বাস-অবিশ্বাস নয়, মনের ভেতরের অপ্রকাশিত জগতের দোলাচলও বুঝতে হয়। বাংলাদেশের গ্রাম এখন আর আগের গ্রাম নেই, গ্রামের মানুষের অনেকেই এখন শহরে, রাজধানী ঢাকায় এমনকি একটি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ এখন কাজের খোঁজে, আয়ের খোঁজে কঠিন জীবনযাপন করছে ভিনদেশে। কিন্তু মানুষ যেখানেই যাক না কেন, শিকড় তাকে ছাড়ে না। শিকড়ের কাছে যদি ফিরতে না-ও পারে মানুষ, তবুও তার মনোজগতে শিকড়ের নানা ডালপালা চিরসতেজ থাকে। এখানেই বাস করে মিথ। শৈশব-কৈশোরে যার মধ্য দিয়ে মানুষ বড় হয়, তা-ই তাকে সচেতনে কিংবা অবচেতনে প্রভাবিত করে। শওকত ভাই মানুষকে তার সমগ্রের ভেতর ধরতে চেয়েছিলেন, সেজন্য তার অজানা জগৎও সন্ধানের চেষ্টা করেছেন লেখার মধ্য দিয়ে।

শওকত ভাইকে কখনো উচ্চকিত দেখিনি। তিনি দায়িত্ব নিয়ে ভার দিয়ে কথা বলতেন, বিশ্লেষণ করতেন। তাঁর সৃষ্টিও ছিল তা-ই।

This image has an empty alt attribute; its file name is MANGROVE.jpg

শওকত আলী : নাগরিক মধ্যবিত্তের কথাকার
দীপংকর গৌতম

শওকত আলী বাংলা কথাসাহিত্যের দিকপাল। ইতিহাস সচেতনতার মধ্য দিয়ে ভাষাবিন্যাসী আয়োজন তাকে ভিন্নমাত্রা দিয়েছে। দশক বিচারে সাহিত্য নির্ণয় করার কোনো সঙ্গত বিষয় না থাকলেও কালের যাত্রায় শওকত আলীর অবস্থান ষাটের দশক। ব্যাপক চিন্তা, প্রতিচিন্তার মধ্য থেকে তিনি সাহিত্যের বন্ধুর পথে যাত্রা করেন এবং মাধ্যম হিসেবে বেছে নেন কথাশিল্প। অর্থাৎ কথাসাহিত্যের মধ্য দিয়েই তিনি তার ভাবনা তুলে ধরেন।

পিঙ্গল আকাশ উপন্যাস রচনার মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যে তার উজ্জ্বল রেখাপাত। প্রধানত উপন্যাসকেই তিনি চিন্তা-চেতনা প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তার শেষ রচনা সম্ভবত মাদারডাঙ্গার কথা (২০১১)। তবে পিঙ্গল আকাশ প্রকাশের পর বোঝা গিয়েছিল সাহিত্যের এ বন্ধুর পথে তিনি সিন্ধু তীরে বালু নিয়ে খেলতে আসেননি। উপন্যাসে মঞ্জুর আত্মহননে ফুটে ওঠে ক্ষয়িষ্ণু ও মূল্যবোধহীন বিকৃত একটি নগরসংস্কৃতি বিকাশের চিত্র। এ প্রসঙ্গে মনে রাখা ভালো, শওকত আলীর উপন্যাসের সব চরিত্রই কম-বেশি আত্মোন্নয়নকামী। এর পেছনে যে লেখকের ব্যক্তিজীবনের সংগ্রাম-সংকটের ছায়াপাত ঘটেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশের ষাটের দশকের গল্প-উপন্যাসে গ্রাম ও শহরকেন্দ্রিক নাগরিক জীবনের যে আশা-আকাঙ্ক্ষা-স্বপ্ন এবং সংগ্রামশীলতা কিংবা সামষ্টিক জীবনে সামাজিক-রাজনৈতিক যে প্রভাব পড়েছে, তা উপন্যাসে তুলে ধরার ক্ষেত্রে শওকত আলীর দক্ষতা অসামান্য। একই সময় তিনি উপন্যাস-গল্প রচনার একটি স্বাতন্ত্র্য ভাষা গড়ে তুলেছেন সফলভাবে; যে ভাষা সহজেই সাধারণ পাঠককে আকর্ষণ করে। আর এভাবেই ‘পিঙ্গল আকাশ’ থেকে ‘মাদারডাঙ্গার কথা’ তার সবগুলো উপন্যাসে আমরা যে শওকত আলীকে আবিষ্কার করি সেখানে তিনি ভিন্ন পথরেখা নির্মাণ করেছেন- যা শুধুমাত্র শওকত আলীর কথাসাহিত্য নির্দেশ করে।

শওকত আলীর জন্ম পশ্চিমবঙ্গের দিনাজপুর জেলায়। ১৯৪৭ সালের দেশভাগ তার অন্তর-বাহির কুড়ে কুড়ে খায়। নিজ ভূমি হারানোর বেদনা থেকে তিনি আর মুক্ত হননি। তার কথায় বিভিন্নভাবে উঠে আসতো পৈতৃক বাড়ি, বাড়িতে একটা পুকুর ছিলো, পুকুরের জল কাকচক্ষু যাকে বলে; একটা কুকুর ছিলো খুব প্রভুভক্ত। বাড়ির পাশে মেলা হতো, কীর্তন, যাত্রা, সার্কাস- মোদ্দাকথা তিনি সংস্কৃতিসমৃদ্ধ এলাকায় বড় হয়ে উঠেছিলেন। কাছ থেকে সেসব দেখেছেন। তারপর একদিন সকালে শোনা গেল- এদেশ আর তাদের নেই! সেই কষ্ট তিনি লালন করেছেন।

দুই
জন্মভূমি ত্যাগের পরও সার্বিক শান্তি কখনোই আসেনি। বাংলাদেশে এসে প্রত্যক্ষ করেছেন পাকিস্তানের নব্য ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ-নির্যাতন। পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বাংলার মানুষ ঐক্য গড়ে তুলে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু স্বাধীনতার প্রত্যাশা পূরণ হয়নি পুরোপুরি। আগে যারা সামন্ত ছিলো, সেখানে নতুন সামন্ত এলো। শ্রেণী বদলালো, শ্রেণী চরিত্র রয়েই গেল। ফলে স্বপ্ন ভাঙার নতুন কষ্ট জমা হলো। এই স্বপ্ন ভঙের বেদনা তার ট্রিলজিতে (দক্ষিণায়নের দিন, কুলায় কালস্রোত, পূর্বরাত্রি পূর্বদিন) লিখেছেন তিনি। এখানে বাংলাদেশের যাত্রালগ্ন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা-উত্তর অস্থির রাজনৈতিক বাস্তবতা। সামরিক শাসনের অবরুদ্ধ কালের চিত্রসহ সচেতন নাগরিক শ্রেণীর ভিতর-বাহির অসাধারণ দক্ষতায় অঙ্কন করেছেন। একাত্তর-পরবর্তী বাঙালির জীবন দেখতে গিয়ে শওকত আলী বাঙালি জাতি-গোষ্ঠীর পেছনের ইতিহাসও এক নজরে দেখে নেয়ার প্রয়াস গ্রহণ করেছেন ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ উপন্যাসে। এই উপন্যাসে তিনি বাংলায় মুসলিম আগমন, সেনদের অত্যাচার-নির্যাতনে অতিষ্ঠ সমাজের নিচু শ্রেণীর অবস্থা পাঠকের সামনে হাজির করেছেন। এখানেই থেমে যাননি। দেখিয়েছেন সমাজের এই নির্যাতিত শ্রেণীই প্রকৃতপক্ষে ছিল বাঙালির আদি-বংশধর। শওকত আলী ইতিহাসশ্রয়ী এ উপন্যাসে স্পষ্টভাবেই দেখিয়েছেন, বাঙালি জাতিকে প্রাচীনকালে তো বটেই মধ্যযুগে এবং আধুনিক যুগেও তার ভাষা-শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি রক্ষার সংগ্রাম করতে হয়েছে।

প্রদোষে প্রাকৃতজন উপন্যাসটি শওকত আলীকে রাতারাতি খ্যাতির শীর্ষ পর্যায়ে পৌঁছে দেয়। এই উপন্যাসে তিনি বিশ শতকের প্রায় শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে সুদূর পেছনপানে তাকিয়ে ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণের শিল্পভাষ্য রচনা করেছেন। লক্ষণ সেন ২৮ বছরের রাজত্বকালের শেষ বছরগুলোতে বার্ধক্যে এবং ক্ষমতা প্রয়োগে খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। অনেক সময় শাসনকার্য পরিচালনা তার জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছিল। এই দুর্বলতার সুযোগে সাম্রাজ্যের ভেতরে ঐক্য ও সংহতিতে ফাটল ধরে এবং কিছু স্বাধীন শক্তির উত্থান ঘটে। এ ছাড়া শক্তিমান ও ক্ষমতাধরদের অরাজকতা দেশময় ছড়িয়ে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে তুরস্কের অভিযানকারী বখতিয়ার খিলজি অনায়াসেই বাংলা দখল করে নেন। এই বিশৃঙ্খল পটভূমিতে গ্রামবাংলা কীভাবে অস্থির হয়ে উঠেছিল, ক্ষমতাধরদের তাণ্ডব ও লুটপাটে কীভাবে মানুষ গ্রামছাড়া হয়েছিল এবং এর মধ্যে কিছু নরনারী বিচিত্র সম্পর্কের টানাপোড়েনে কীভাবে রক্তাক্ত হয়ে উঠেছিল, সেসবের নানামাত্রিক বুনন-বিন্যাসে গড়ে উঠেছে প্রদোষে প্রাকৃতজন উপন্যাসটি।

উল্লিখিত উপন্যাসের সবচেয়ে বড় শক্তি এর ভাষা; প্রতিটি পদে, পদবন্ধনে। সাধু ভাষার শব্দভান্ডার বিস্ময়কর নৈপুণ্যে তিনি ব্যবহার করেছেন চলিত ভাষার গড়ন-সৌষ্ঠবে। সম্ভবত ষোড়শ শতকের ভাষিক জগতের ধ্রুপদি আবহের স্বাদ পাইয়ে দেওয়ার জন্য তিনি এই অসাধারণ ভাষাপ্রপঞ্চ বেছে নিয়েছেন। কমলকুমার মজুমদারের ভাষাব্যবহারের সঙ্গে আমাদের পরিচয় আছে, বাক্যগড়নের রীতির সঙ্গে পরিচয় আছে। সেখানে কাঠিন্য নির্ধারণই যেন কর্তব্য। কিন্তু সে অন্য অভিধা। শওকত আলী ভাষার মধ্যে পুরে দিতে চেয়েছেন জীবনের প্রতি গভীর মমত্ববোধের আলো, আনন্দ আর অফুরন্ত প্রবাহ। বাক্যের গড়নসৌষ্ঠবের মধ্যেও তার এই অফুরন্ত শক্তির পরিচয় মেলে। পথ চলতে চলতে ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত শ্যামাঙ্গ সম্মুখে যে প্রহেলিকা দেখতে পায়, তার বর্ণনা দিতে গিয়ে শওকত আলী লিখেছেন: ‘সে বড় বিচিত্র অবস্থা’। এখন স্মরণ হলে কৌতুক বোধ হয়। অবশ্য তখনও তার কৌতুক বোধ হচ্ছিল। কৌতুক বোধ হবারই কথা। কারণ প্রথমে তুমি দেখলে বংশবীথিকার বিনত শাখায় একটি বনকপোত। পরক্ষণে সেই ক্ষুদ্রাকার পাখিটি হয়ে গেলো একটি ঊর্ধ্বলম্ফী মর্কট মুহূর্তেক পরে সেই মর্কটও আর থাকলো না, নিমেষে হয়ে গেলো একটি বিশুদ্ধ বৃক্ষশাখা। চক্ষু কচালিত করলে অতঃপর তুমি আর কিছুই দেখলে না। বংশবীথিকা না, বনকপোত না, মর্কট না, বিশুদ্ধ শাখাও না।

এই রচনার মধ্যে প্রায় প্রতিটি শব্দই তৎসম। কিন্তু কোথাও দুর্বোধ্যতার লেশ নেই। অধিকন্তু এমন একটি সহজতা বিরাজমান, যা পাঠকের বোধের জগত তৃপ্ত করে। লেখকের কুলায় কালস্রোত, পূর্বরাত্রি পূর্বদিন নতুন সময় আসার একেবারে আগের সময়ের বয়ান। মূলত ষাটের দশকে আমাদের মধ্যবিত্ত এবং সমগ্র সমাজ ব্যবস্থায় একটা পরিবর্তন আসে। নতুন একটা চিন্তা-চেতনা দ্বারা আলোড়িত হয় পুরো সমাজ। ধ্যান-ধারণা, চাল-চলন জীবন ব্যবস্থায় একটা পরিবর্তনের সুর বেজে ওঠে। সে সবই উল্লিখিত দুটো উপন্যাসে তিনি তুলে ধরেছেন। শওকত আলীর উপন্যাসের জগৎ নির্মিত হয়েছে মূলত মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীকে ঘিরে ; এদের জীবনের টানাপোড়েন, জীবনবোধ, সংগ্রাম প্রভৃতি তার উপন্যাসের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ হিসেবে উঠে এসেছে। নগরকেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত সমাজ মূলত তার উপন্যাসে ঘুরেফিরে এসেছে। একই সময় তার রচনায় সমকালীন রাজনৈতিক বাস্তবতা, ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ও স্থান করে নিয়েছে।

শওকত আলীর প্রথম উপন্যাস ‘পিঙ্গল আকাশ’-এ নাগরিক মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নগ্ন, নীতিহীনতা, রুচির বিকৃতি, কামনার করাল গ্রাসের পরিণাম, উপন্যাসের কেন্দ্রীয় নারী-চরিত্র মঞ্জুর দীর্ঘশ্বাস, রক্তরক্ষণ ও আত্মহনন শিল্পিত হয়ে উঠেছে। এর মধ্যে দিয়ে বোঝা যায় তার সাহিত্য রস আস্বাদন বা প্রদানের ক্ষমতা। এই মধ্যবিত্ত জীবনেরই নানাকৌণিক দিকের প্রতিফলন ঘটেছে লেখকের অন্যান্য উপন্যাসে।

শওকত আলীর রচিত উপন্যাসের তালিকা দীর্ঘ না হলেও একেবারে সংক্ষিপ্ত নয়। জীবনভর সাহিত্যসেবায় নিয়োজিত থেকে গুণী এই কথাশিল্পী বাংলা একাডেমি এবং একুশে পদকসহ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। বামঘেঁষা রাজনৈতিক চেতনা দ্বারা তিনি উত্তাল যৌবনে প্রভাবিত হলেও তার রাজনৈতিক বিশ্বাস ও ধারণা স্বচ্ছ। তার ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারণা কতটা স্বচ্ছ সে কথার প্রমাণ আমরা পাই ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ উপন্যাসে।

This image has an empty alt attribute; its file name is MANGROVE.jpg

কথাসাহিত্যিক শওকত আলী : হৃদয়ে মম
ড. অরিজিৎ ভট্টাচার্য

বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক শওকত আলী আর আমাদের মধ্যে সশরীরের কোনোদিন ফিরে আসবেন না, এই নির্মম সত্যটা তাঁর অনুরাগীদের কাছে কতোখানি বেদনার তা ভাষায় প্রকাশ করা অত্যন্ত দুরূহ কাজ। তবে একথা নিশ্চিতভাবেই বলা যেতে পারে যে, তাঁর সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে তিনি আমাদের হৃদয়ে চিরদিন শ্রদ্ধার আসনে থাকবেন। বাংলাদেশের মানুষের জীবনে যেমন আজ গভীর শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি পশ্চিমবঙ্গে তাঁর মাতৃভূমির শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছেও আজ স্বজন হারানোর বেদনা। ১৯৩৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারী পশ্চিমবঙ্গের রায়গঞ্জে জন্মগ্রহণ করা শওকত আলীর সৃষ্টির ভুবন বাংলা সাহিত্যকে নিরন্তর সমৃদ্ধ করেছে। তাঁর উপন্যাস-গল্পে একদিকে যেমন সাধারণ মধ্যবিত্তের জীবন চিত্রিত হয়েছে, তেমনি একেবারে খেটে খাওয়া সাধারণ নিম্নবর্গের জীবনও স্থান পেয়েছে। মানুষের উজ্জীবনের যে চেতনা তার প্রতিফলন সর্বক্ষেত্রে উঠে এসেছে তাঁর লেখায়। জীবনের সামগ্রিকতাকে ধরার লক্ষ্যেই তিনি সদা ব্রতী থেকেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে স্মরণ করে নেওয়া যায় পিঙ্গল আকাশ (১৯৬৩), যাত্রা ( ১৯৭৬), প্রদোষে প্রাকৃতজন ( ১৯৮৪), সম্বল (১৯৮৬), ওয়ারিশ (১৯৮৯), নাঢ়াই (২০০৩), বসত (২০০৫), মাদারডাঙার কথা (২০১১) প্রভৃতি। তাঁর লেখা উন্মূল বাসনা (১৯৬৮), লেলিহান সাধ (১৯৭৮) প্রভৃতি গল্পও পাঠকের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিলো।

তিনি মনে করতেন যে, সামগ্রিকভাবে কেউ যদি রাজনীতিকে পরিত্যাগ করে সাহিত্যের উপাদান সংগ্রহ করে, বিশেষ করে কথাসাহিত্যে, সেটা ঠিক হয় না। জীবনকে সেক্ষেত্রে পুরোপুরি ফুটিয়ে তোলা যায় না। জীবনের একটা খণ্ড অংশই সেখানে পাওয়া যায় মাত্র। প্রকৃতিলগ্ন যে মানুষ, তাদের জীবন-যাপন, তাদের চিন্তাভাবনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, আনন্দ-বেদনা, এগুলো যেমন উঠে আসা দরকার, তেমনি যারা বিলাসপূর্ণ জীবনযাপন করছে, নগর-সভ্যতার মধ্যে বসবাস করে, শোষনের মধ্যে যাদের অস্তিত্ব নির্ভর করছে, তাদের কাহিনিও সমানভাবে বলা দরকার।

বর্নাঢ্য ও সংগ্রামমুখর জীবনে ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পালাবদলের সাক্ষী তিনি। দেখেছেন দেশভাগ। শিকার হয়েছেন নির্মম বাস্তবতার। জন্মস্থান ছেড়ে আসার সুতীব্র বেদনা তাঁর রক্তে বপন করেছে সাধারণ মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। তৃণমূল মানুষের মুক্তি ও প্রাপ্তির জায়গায় তিনি ছিলেন আপোসহীন। তাঁর গল্প-উপন্যাসে তাই ধ্বনিত হয়েছে সাধারন মানুষের শোষন, নির্যাতন, বঞ্চনার, মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। প্রকাশের ভিন্নতায় তা হয়ে উঠেছে শিল্পোর্ত্তীন জীবনের ঘনিষ্ঠ পাঠ।

শওকত আলীর গল্প-উপন্যাসের মূল জায়গা জুড়ে আছে নিম্নবর্গের মানুষ ও শোষিত জীবনের কথকতা। সামন্তবাদী সমাজ-ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়েছে তাঁর কলম। জীবনের খুব কাছ থেকে তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষের জীবনযাত্রা। অনুভব করেছেন একাত্মতা। তাঁর মতো করে নির্মোহভাবে জীবনকে খুব কম মানুষই প্রত্যক্ষ করেছেন। আমাদের ইতিহাসের গভীরে ঢুকে তিনি মুক্তির পথ খুঁজে পেতে সচেষ্ট হয়েছেন।

আবহমান বাংলার আঞ্চলিকতার বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট হয়ে ফুটেছে তাঁর লেখার মধ্যে। তাঁর উপন্যাসের ঘটনাশ্রিত চরিত্রে মুখ্য হয়ে উঠে মননের সক্রিয় ভূমিকা। গ্রাম-বাংলা, বিশেষত উত্তরবঙ্গের দিনাজপুর অঞ্চলের প্রকৃতি, পারিপার্শ্বিকতা, গ্রামীণ বা মফস্বলী মানুষের জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত, দুরাশা, বিষন্নতা, নিষ্ঠার সঙ্গে প্রকাশ পেয়েছে তাঁর লেখার মধ্যে। ধর্মীয় বিশ্বাস, কুসংস্কার, শোষণ, প্রতারণা, যৌনতাবোধ, মান-অভিমান, প্রত্যয়, অসহায়ত্ব, প্রভৃতি মানবিক আচার-আচরণকে উপলব্ধির আলোকে উদ্ভাসিত করেছেন তিনি। তাঁর প্রয়াস মানুষ ও মাটির খুব কাছাকাছি থেকে এক স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বজায় রেখেছে।
তাঁর প্রয়াণে বাংলা সাহিত্যের বিপুল ক্ষতি হয়ে হলো, একথা বললে অত্যুক্তি হয় না।

ড. অরিজিৎ ভট্টাচার্য- সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, মানকর কলেজ, পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ। তিনি কথাসাহিত্যিক শওকত আলীর সৃষ্টিকর্ম নিয়ে আসাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি উপাধি অর্জন করেছেন। শওকত আলী গবেষক হিসেবে তাঁর মৃত্যু পরবতী একটি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া।

This image has an empty alt attribute; its file name is MANGROVE.jpg

শওকত আলী: বাংলা সাহিত্যের এক নিভৃতচারী তারকার উপাখ্যান
মিনহাজুল আবেদিন

উত্তর দিনাজপুরের থানাশহর রায়গঞ্জ। সময়টা ১৯৩৬ সাল, ভারতবর্ষে ইংরেজদের শাসনামল চলছে। রায়গঞ্জের উকিলপাড়ায় কাঁচা-পাকা দালানের বাড়ি। সাথে আছে পুকুর, বাড়ির লাগোয়া খেতে সবজি আর চারদিক ঘিরে আছে গাছগাছালি। একটু দূরেই ঝিল দেখা যায়। গ্রাম বাংলার রেশ কাটিয়ে না ওঠা ছোট মফস্বলে বেড়ে উঠেছেন বালক ‘শওকত আলী’। শিশুদের জীবনে শহুরে আবেশ নেই, ধরাবাঁধা বয়সে স্কুলে যাওয়ার বালাই নেই। হাডুডু, দাঁড়িয়াবান্ধা সহ নানা ধরনের খেলাধুলার সাথে মিতালী করেই কেটে যায় সারাটা দিন। তবে একদম ছোটবেলা থেকেই প্রকৃতির মাঝে অনেকটা নিমগ্ন থাকতেই ভালোবাসতেন শওকত আলী। অনুসন্ধানী চোখ নিয়ে প্রকৃতিকে অনেক কাছ থেকে দেখার এই সুযোগ তাকে জীবনঘনিষ্ঠ সাহিত্যিক হয়ে উঠার পথে নিঃসন্দেহে অনেক দূর এগিয়ে দিয়েছে।

বাবা খোরশেদ আলী সরকার সক্রিয়ভাবে কংগ্রেসের রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। তবে পেশায় ছিলেন হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার। বাড়িতে ব্রিটিশ ভারতের রাজনীতি নিয়ে বেশ ভালোই আলোচনা হতো। বাড়ি জুড়ে বইয়েরও অভাব ছিলো না। রাজনীতি তো বটেই, সাহিত্য কিংবা কবিতা সব বইয়েরই ভালো একটা সংগ্রহ ছিলো খোরশেদ আলীর। বাড়িতে রাখা হতো সাহিত্য পত্রিকাও। শওকত আলীর মা সালেমা খাতুনেরও পড়ালেখার ঝোঁক ছিলো। কিন্তু অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়ায় পড়ালেখাটাকে অনেক দূর নিয়ে যাওয়ার স্বপ্নে ভাটা পড়ে। তবে একদম করতে পারেননি বললেও ভুল হবে। হুগলি থেকে ডিপ্লোমা করেছিলেন সালেমা খাতুন। স্থানীয় বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। মায়ের কাছ থেকে তাই পড়ার আগ্রহটা বেশ ভালো রকমই পেতেন। বাবা কংগ্রেসের রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকলেও মা ছিলেন মুসলীম লীগের সমর্থক। কিন্তু তার মা-ও তাকে ছেড়ে বড্ড তাড়াতাড়ি চলে গেলেন। ১৯৪৯ সালে শওকত আলী যখন ক্লাস এইটে, তার মা ধরাধাম ত্যাগ করেন। একা শওকত বইয়ে ডুবে থাকা বাবাকে দেখে ভাবতেন দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্তি পাওয়ার এই উপায়টা তাকে আরো ভালোভাবে শিখতে হবে। বইয়ের রাজ্যে তিনিও ডুব দিলেন।

রায়গঞ্জ করোনেশান স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে ভর্তি হলেন সুরেন্দ্রনাথ কলেজে। ছাত্রাবস্থায় বামপন্থী আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন শওকত আলী। ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে তিনি জড়িয়ে পড়েন নানা ধরনের আন্দোলন সংগ্রামের সাথে। ফলে জেলেও যেতে হয়েছে থাকে। জেলে যাওয়ায় জীবনকে আরো ভালোভাবে উপলব্ধি করার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। মানুষের জীবনের সাথে সংগ্রাম, দুঃখ আর আর তাই জেলে বসেও পরীক্ষা দিয়েছেন তিনি। এই কলেজ থেকেই আই.এ এবং বি.এ পাশ করেছেন।

এর মাঝে ভারতের রাজনীতিতে এসেছে গুণগত পরিবর্তন। ভারতবর্ষ এখন শুধু আর একটিমাত্র রাষ্ট্র নেই। জন্ম নিয়েছে পাকিস্তান নামের আরেকটি রাষ্ট্র। ১৯৫২ সাল, দেশভাগের পরপরই পূর্ব বাংলায় স্থায়ী হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন শওকত আলীর বাবা। পাকিস্তান সৃষ্টির আগেও বাঙালি মুসলমানেরা নানাভাবে তাদের প্রাপ্য সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিলো। নতুন দেশ পাকিস্তানের জন্মের সাথে সাথে সাধারণ বাঙালি মুসলমানেরা স্বপ্ন সাজাতে থাকেন, নতুন দেশে মিলবে তাদের প্রাপ্য সব অধিকার। অনেকটা সেই আশা বুকে নিয়েই খোরশেদ আলী সরকার দিনাজপুর চলে এলেন। দিনাজপুরে বাড়ি কিনে স্থায়ী হয়ে গেলেন। শওকত আলীর স্মৃতিঘেরা সেই রায়গঞ্জ তখন কাঁটাতারের অন্য পাশে। বেদখল হয়ে গেছে তাদের সেই সবুজে ঘেরা বাড়িটি। দেশভাগের দাঙ্গা-হাঙ্গামাও তরুণ শওকত আলীর মনে বেশ দাগ কাটে। এই বাস্তব অভিজ্ঞতাকে ভিত্তি করে ১৯৮৯ সালে লিখেছেন ‘ওয়ারিশ’ উপন্যাস। যেখানে তিনি সুনিপুণভাবে ব্রিটিশ শাসনামল, দেশভাগ আর হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় সাধারণ মানুষের কথা তুলে ধরেছেন।

বাবা ছিলেন হোমিও চিকিৎসক, তাই প্রথম জীবনে তিনিও চিকিৎসক হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কলেজে বিজ্ঞান বিভাগ না থাকায় মানবিক বিভাগ নিয়েই পড়াশোনা করেছিলেন। সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে আই.এ এবং বি.এ পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন বাংলায় এম.এ পড়ার জন্য।

পড়াশোনার মাঝপথে এসেই বুঝতে পেরেছিলেন, মানুষের সাথে সম্পৃক্ত হতে সাহিত্যের ভূমিকা অপরিসীম। যে বাংলাকে ধারণ করে সাহিত্যজগতে গল্প বোনা শুরু করেছিলেন, সেই বাংলার উপর আঘাত তিনি মেনে নিতে পারেননি। পাকিস্তানী শাসকদের বাঙালিদের উপর রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দু চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্তে নেমে আসেন রাজপথে। ভাষা আন্দোলন থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে স্ফুরণ জাগ্রত হয়, তাকে নিয়ে অনেক দূর হেঁটেছেন শওকত আলী। পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক শাসনের বিরোধী হয়েও রাজপথে আন্দোলন করেছেন। ১৯৫৪-র ৯২ (ক) ধারা জারি করা হলে গ্রেফতার হয়েছিলেন শওকত আলী, ফরহাদ মজহার আর হাজি মোহাম্মদ দানেশের মতো রাজপথে সক্রিয় ব্যক্তিরা। আর এই রাজনৈতিক মতাদর্শের অনেকটাই উঠে এসেছে তার লেখায়। সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রামকে পরম মমতায় তুলে এনেছেন শওকত আলী।শওকত আলীর উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মের একটি হলো প্রদোষে প্রাকৃতজন। ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাস দিয়ে বাংলা সাহিত্যে একটি উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে নেন শওকত আলী। অনেক পাঠক এই উপন্যাসটিকে ঐতিহাসিক হিসেবে আখ্যা দিলেও শওকত আলীর মতে, প্রদোষে প্রাকৃতজন নামকরণ নিয়ে শওকত আলী বরাবরই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন। মূলত দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এক কালের বিদায় ঘন্টা বাজিয়ে যখন নতুন কালের সূচনা হচ্ছে, সে অন্তবর্তী সময়কেই বলা হয় প্রদোষকাল।

এই অঞ্চলে যখন হিন্দু শাসনের শেষে মুসলিম শাসনের সূচনা হচ্ছে, ঠিক সেই সময় নিয়ে এই উপন্যাস। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হলো, উপন্যাসে সাম্প্রদায়িকতার চেয়ে বড় হয়েছে এই সময়ে সাধারণ মানুষ কী ভাবছে এই নিয়ে। একটি নির্দিষ্ট ভূখন্ডে নতুন ধর্ম, নতুন চিন্তা ও বদলে যাওয়া শাসকদেরকে কেন্দ্র করে সাধারণ কিছু জীবন ঘুরপাক খাচ্ছে ইতিহাসের কালস্রোতে। উঠে এসেছে প্রান্তিক মানুষের গল্প। বসন্তদাস, লীলাবতী, ছায়াবতীরা প্রত্যকেই সাধারণ মানুষের স্বার্থক রূপক হিসেবে বাংলা সাহিত্যে জায়গা করে নিয়েছেন। উপন্যাসের একদম শেষে শ্যামাঙ্গকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। আরো ভালো করে বলতে গেলে, ঐ সময়ের সমাজ আর সভ্যতার সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে হেরে গেছে এই মৃৎশিল্পী। তাই এই উপন্যাস শেষ করে সাধারণ মানুষের করুণ আকুতি তীব্র হয়ে ধরা দেয় পাঠকের কাছে। অকপট চিত্তে শওকত আলীও স্বীকার করে গেছেন, এই মৃত্তিকালগ্ন মানুষ আজীবন তাকে মোহের মতো টেনেছে।

সেই মোহ ধরানো মৃত্তিকালগ্ন মানুষগুলোই তো ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারতকে মুক্ত করেছে, এদের মধ্যেই উন্মেষ ঘটেছে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের, মুক্তিযুদ্ধ আর স্বাধীনতার ক্রান্তিলগ্ন পাড়ি দিয়ে আশায় বুক বেঁধেছে একটি সুন্দর নাগরিক জীবনের। আর এই ব্যাপারটিকে শওকত আলী তার বিখ্যাত ত্রয়ী উপন্যাস দক্ষিণায়নের দিন, কুলায় কাল স্রোত ও পূর্বরাত্রি পূর্বদিন এ তুলে ধরেছেন। এই ত্রয়ীর জন্য তাকে ভূষিত করা হয়েছ ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কারে। এই তিন কালজয়ী উপন্যাসের ব্যাপারে শওকত আলীর ভাষ্য অনেকটা এরকম,

কর্মজীবনে পেয়েছিলেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মতো বন্ধুদের। জগন্নাথ কলেজে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস আর শওকত আলী একসঙ্গে শিক্ষকতাও করেছেন।চিলেকোঠার সেপাই আর খোয়াবনামার কারিগরকে দেখেছেন, শিখেছেন। স্বাধীনতার পরে বাংলা সাহিত্যকে হাতে ধরে অনেকদূর নিয়ে যাওয়ার যে মঞ্চ তৈরি হয়েছিলো, সেখানে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন এই দুজন। টিকাটুলীর বিরতি ভিলার নিচের তলার একটি ঘরে থাকতেন ইলিয়াস। শওকত আলীও তার জীবনের শেষভাগটি কাটিয়ে দিয়েছেন একই ঘরে।

তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, শওকত আলী আর আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের জন্মদিনটিও একই দিনে, ১২ ফেব্রুয়ারি। বয়সে ইলিয়াসের চেয়ে বছর সাতেকের বড় ছিলেন শওকত আলী। কিন্তু ১৯৯৭ সালে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের অকালপ্রয়াণে গভীরভাবে মর্মাহত হয়েছিলেন শওকত আলী।

শওকত আলীও চলে গেলেন ২০১৮ সালের ২৫ জানুয়ারি। নিভৃতচারী এই মানুষটি চলে যাওয়ার শেষ জীবনে আরো বেশি অন্তর্মুখী হয়ে উঠেছিলেন। চারদিকে সাহিত্যসভা, বইমেলা, লেখক আড্ডা থেকে অনেকদূরের দ্বীপে নির্বাসিত করেছিলেন নিজেকে। কিন্তু কেন? উত্তরটা অনেকটা এভাবেই দিয়ে গেলেন,

আক্ষেপ থাকলেও কম লেখেননি বাংলা সাহিত্যের প্রদোষকালের এই প্রাকৃতজন।

This image has an empty alt attribute; its file name is MANGROVE.jpg

About S M Tuhin

দেখে আসুন

O. Henry পুরস্কারে ভূষিত হলেন ম্যানগ্রোভ সাহিত্য-র প্রধান উপদেষ্টা সাহিত্যিক অমর মিত্র

O. Henry পুরস্কারে ভূষিত হলেন অমর মিত্র বাংলা সাহিত্য তথা বাংলা ভাষার আরও এক গৌরবোজ্জ্বল …

89 কমেন্টস

  1. Major thanks for the blog. Will read on…

  2. canadian pharmacy: buy drugs online safely – canadiandrugstore.com

  3. https://mexicopharmacy.store/# buying from online mexican pharmacy

  4. top 10 pharmacies in india world pharmacy india online pharmacy india

  5. Do you have a spam issue on this site; I also am a blogger, and I was curious about your situation; many of us have created some nice methods and we are looking to trade strategies with other folks, why not shoot me an e-mail if interested.

  6. Thanks for the post.Thanks Again. Keep writing.

  7. top rated canadian pharmacies: buy medication online – canada meds

  8. Pretty nice post. I just stumbled upon your blog and wished to say that I havetruly enjoyed browsing your blog posts. In any case I willbe subscribing to your rss feed and I hope you write again very soon!

  9. I don’t even know how I ended up here, butI thought this post was good. I do not know whoyou are but definitely you are going to a famous blogger if you aren’t already 😉 Cheers!

  10. canadian pharmacy online: certified canada pharmacy online – buy canadian drugs

  11. https://indiapharmacy.site/# online shopping pharmacy india

  12. Hello! I know this is kind of off topic but I was wondering if you knew where I could find a captcha plugin for my comment form? I’m using the same blog platform as yours and I’m having trouble finding one? Thanks a lot!

  13. I value the blog post.Thanks Again.

  14. online pharmacy india: reputable indian online pharmacy – online pharmacy india

  15. This is one awesome blog post.Really looking forward to read more. Want more.

  16. When someone writes an article he/she keeps the idea of a user in his/her brain that how a user can understand it. Therefore that’s why this piece of writing is amazing. Thanks!

  17. canadian pharmaceuticals for usa sales Mail order pharmacy no 1 canadian pharmacy

  18. trusted online pharmacy: buy drugs online safely – canadian pharcharmy online viagra

  19. online medication: legal drugs buy online – rx prices

  20. http://wellbutrin.rest/# wellbutrin buy online uk

  21. EN İYİ LEKE KREMİ VE ŞAMPUAN SATIN ALMA SİTESİile hemen tanışın saç dökülme karşıtı şampuanlar sadece 49tlsaç dökülme karşıtı şampuan.

  22. Highly energetic article, I liked that a lot. Will there be a part 2?

  23. buying ventolin in usa: Ventolin inhaler – ventolin us price

  24. Sport betting is in some instances severely regulated, and in some cases is central tothe sport.

  25. trusted essay writing service federalist papers writers step to write an essay

  26. This is one awesome article post.Really thank you! Keep writing.

  27. Could I ask who’s calling? omeprazole vs lansoprazole You don’t have to do anything, it’s all under control, on TV screens or in video games on computers: there you can do everything, all sort of mayhem is possible

  28. can i purchase generic clomid tablets: Clomiphene Citrate 50 Mg – how to get cheap clomid price

  29. I cannot thank you enough for the post.Thanks Again. Really Cool.

  30. I am really impressed with your writing skills as well as with thelayout on your blog. Is this a paid theme or did you modify it yourself?Anyway keep up the excellent quality writing, it’s rare to see a great blog likethis one today.

  31. https://clomid.club/# can i purchase generic clomid

  32. I really like reading through a post that can make people think. Also, thanks for allowing me to comment!

  33. Appreciate you sharing, great blog post.Really looking forward to read more.

  34. paxlovid buy https://paxlovid.club/# paxlovid cost without insurance

  35. I wanted to thank you for this very good read!! I definitely enjoyed every bit of it. I’ve got you bookmarked to look at new stuff you post…

  36. wellbutrin 450 mg cost: wellbutrin prescription cost – wellbutrin 150 mg discount

  37. It’s really a cool and useful piece of information. I’m glad that you shared this useful info with us. Please keep us up to date like this. Thanks for sharing.

  38. Thanks for the article post.Thanks Again. Fantastic.

  39. It’s actually a nice and useful piece of information. I am satisfied that you shared this helpful info with us.Please keep us informed like this. Thank you for sharing.

  40. Paxlovid buy online: cheap paxlovid online – buy paxlovid online

  41. ivermectin 0.5 lotion – stromectol humans ivermectin 8000 mcg

  42. Appreciate you sharing, great post.Really looking forward to read more. Want more.

  43. paxlovid for sale: Paxlovid over the counter – paxlovid cost without insurance

  44. Muchos Gracias for your blog article.Really thank you! Cool.

  45. Great blog.Really thank you! Want more.

  46. It’s awesome to go to see this web site and reading the views of all friends about this post, while I am also eager of getting familiarity.

  47. order cheap clomid without prescription: clomid best price – cheap clomid without insurance

  48. Great, thanks for sharing this blog article.Really thank you!

  49. https://claritin.icu/# buy ventolin online europe

  50. This is really interesting, You are a very skilled blogger.
    I’ve joined your rss feed and look forward to seeking more of your excellent post.
    Also, I’ve shared your site in my social networks!

  51. Really informative blog post.Thanks Again. Really Great.

  52. acquistare farmaci senza ricetta: Tadalafil prezzo – acquistare farmaci senza ricetta

  53. acquistare farmaci senza ricetta: farmacia online spedizione gratuita – farmacia online piГ№ conveniente

  54. farmaci senza ricetta elenco farmacia online piu conveniente п»їfarmacia online migliore

  55. farmacie on line spedizione gratuita: Farmacie che vendono Cialis senza ricetta – farmacia online

  56. migliori farmacie online 2023: avanafil spedra – acquisto farmaci con ricetta

  57. https://avanafilit.icu/# comprare farmaci online all’estero

  58. viagra generico recensioni: viagra generico – miglior sito dove acquistare viagra

  59. comprare farmaci online all’estero: avanafil generico – farmacie online autorizzate elenco

  60. farmacia online miglior prezzo farmacia online spedizione gratuita comprare farmaci online all’estero

  61. farmaci senza ricetta elenco: avanafil prezzo – farmacie online autorizzate elenco

  62. b52
    Tiêu đề: “B52 Club – Trải nghiệm Game Đánh Bài Trực Tuyến Tuyệt Vời”

    B52 Club là một cổng game phổ biến trong cộng đồng trực tuyến, đưa người chơi vào thế giới hấp dẫn với nhiều yếu tố quan trọng đã giúp trò chơi trở nên nổi tiếng và thu hút đông đảo người tham gia.

    1. Bảo mật và An toàn
    B52 Club đặt sự bảo mật và an toàn lên hàng đầu. Trang web đảm bảo bảo vệ thông tin người dùng, tiền tệ và dữ liệu cá nhân bằng cách sử dụng biện pháp bảo mật mạnh mẽ. Chứng chỉ SSL đảm bảo việc mã hóa thông tin, cùng với việc được cấp phép bởi các tổ chức uy tín, tạo nên một môi trường chơi game đáng tin cậy.

    2. Đa dạng về Trò chơi
    B52 Play nổi tiếng với sự đa dạng trong danh mục trò chơi. Người chơi có thể thưởng thức nhiều trò chơi đánh bài phổ biến như baccarat, blackjack, poker, và nhiều trò chơi đánh bài cá nhân khác. Điều này tạo ra sự đa dạng và hứng thú cho mọi người chơi.

    3. Hỗ trợ Khách hàng Chuyên Nghiệp
    B52 Club tự hào với đội ngũ hỗ trợ khách hàng chuyên nghiệp, tận tâm và hiệu quả. Người chơi có thể liên hệ thông qua các kênh như chat trực tuyến, email, điện thoại, hoặc mạng xã hội. Vấn đề kỹ thuật, tài khoản hay bất kỳ thắc mắc nào đều được giải quyết nhanh chóng.

    4. Phương Thức Thanh Toán An Toàn
    B52 Club cung cấp nhiều phương thức thanh toán để đảm bảo người chơi có thể dễ dàng nạp và rút tiền một cách an toàn và thuận tiện. Quy trình thanh toán được thiết kế để mang lại trải nghiệm đơn giản và hiệu quả cho người chơi.

    5. Chính Sách Thưởng và Ưu Đãi Hấp Dẫn
    Khi đánh giá một cổng game B52, chính sách thưởng và ưu đãi luôn được chú ý. B52 Club không chỉ mang đến những chính sách thưởng hấp dẫn mà còn cam kết đối xử công bằng và minh bạch đối với người chơi. Điều này giúp thu hút và giữ chân người chơi trên thương trường game đánh bài trực tuyến.

    Hướng Dẫn Tải và Cài Đặt
    Để tham gia vào B52 Club, người chơi có thể tải file APK cho hệ điều hành Android hoặc iOS theo hướng dẫn chi tiết trên trang web. Quy trình đơn giản và thuận tiện giúp người chơi nhanh chóng trải nghiệm trò chơi.

    Với những ưu điểm vượt trội như vậy, B52 Club không chỉ là nơi giải trí tuyệt vời mà còn là điểm đến lý tưởng cho những người yêu thích thách thức và may mắn.

  63. top farmacia online: Cialis senza ricetta – farmacie on line spedizione gratuita

  64. viagra cosa serve: viagra generico – viagra 50 mg prezzo in farmacia

  65. http://farmaciait.pro/# farmacia online piГ№ conveniente

  66. acquisto farmaci con ricetta: kamagra oral jelly consegna 24 ore – farmacia online miglior prezzo

  67. migliori farmacie online 2023: Cialis senza ricetta – comprare farmaci online con ricetta

  68. viagra generico recensioni viagra online spedizione gratuita viagra originale recensioni

  69. farmacia online migliore: farmacie on line spedizione gratuita – farmacia online miglior prezzo

  70. viagra pfizer 25mg prezzo: sildenafil prezzo – kamagra senza ricetta in farmacia

  71. acquisto farmaci con ricetta: kamagra oral jelly – farmaci senza ricetta elenco

  72. viagra 50 mg prezzo in farmacia: viagra originale in 24 ore contrassegno – cialis farmacia senza ricetta

  73. viagra online spedizione gratuita: viagra prezzo – viagra online consegna rapida

  74. viagra generico sandoz: sildenafil prezzo – viagra generico recensioni

  75. acquisto farmaci con ricetta Tadalafil prezzo farmacia online piГ№ conveniente

  76. comprare farmaci online con ricetta: kamagra gel prezzo – acquisto farmaci con ricetta

  77. Thank you ever so for you blog article.Really looking forward to read more. Fantastic.

  78. comprare farmaci online con ricetta: farmacia online miglior prezzo – farmacie online autorizzate elenco

  79. comprare farmaci online all’estero: avanafil generico – acquistare farmaci senza ricetta

  80. acquistare farmaci senza ricetta: kamagra oral jelly consegna 24 ore – farmaci senza ricetta elenco

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *