
১৯৭৫ সালে এক সন্ধ্যায় পরিচয় পত্রিকা অফিসে দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় আলাপ করিয়ে দিলেন, দেবেশ এর নাম…। এর গল্পই ছেপেছি পরিচয়ে।শকুন্তলার জন্ম। দেখলাম ধুতি এবং হাফ হাতা পাঞ্জাবি পরিহিত দেবেশ রায়কে। তখন আমি সারস্বত লাইব্রেরি প্রকাশিত তাঁর গল্পের বই পড়ে ফেলেছি। দুপুর, নিরস্ত্রীকরণ কেন, কলকাতা ও গোপাল, আহ্নিক গতি ও মাঝখানের দরজা…। তখন তিনি জলপাইগুড়ি থাকেন। এবং এক অলৌকিক প্রায় মানুষ। কলকাতায় এলে সাড়া পড়ে যায় নবীন লিখিয়েদের ভিতর। কেউ কেউ তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে শিয়ালদা স্টেশনে। আমার চেনা দুই অগ্রজ লেখক গিয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। তিনি রাতের গাড়িতে ফিরবেন উত্তরবঙ্গ। তাঁরা ফিরে এসে বলেছিলেন, তাঁদের গল্প দেবেশ রায় পড়েছেন, কিন্তু তাঁর মনে হয়েছে মাঝখান থেকে কটি পাতা নেই। দেবেশ রায় এমনিই বলতেন। আবার ভালো লাগলে দীর্ঘ মেসেজ করতেন। যখন কান ঠিক ছিল, ফোন।
সেই আলাপ, তারপর দীর্ঘ এত বছর কেটে গেল। দেবেশ রায় এবং শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, দুই মেরুর দুই লেখক। দুজনের সঙ্গ করেছি। এবং মহাশ্বেতা। শ্যামল চলে গেছেন ২০০১-এ, মহাশ্বেতা ২০১৭ , দেবেশদা গতকাল। অন্য দুজন প্রস্তুত করে দিয়েছিলেন মনে মনে। তাই এতটা আঘাত আসেনি। বজ্রপাত হল যেন।
দেবেশদা দিন দশ আগে বিকেলে ফোন করলেন, তারপর বললেন, শুনতে পাচ্ছি না, যন্ত্রটা লাগিয়ে আনি, ধর। কথা হয়েছিল। ৮৪ বছর বয়স। বললেন, মণিদা কতবার এসেছেন আমাদের জলপাইগুড়ির বাড়িতে। ললিতবাবুও। মণি সিং এবং ললিত সরকার ( হাজং )। বই ছাড়া থাকেন না। পঠিত বই নিয়ে কথা বলতেই আমাকে ফোন। ভাবতে এখন চোখে জল এসে যাচ্ছে। তার আগে লকডাউনের প্রথম দিকে আমি তাঁকে ফোন করেছিলাম।
তিনি বলেছিলেন, অমর আমার ভয় করছে। আমি বললাম, আমাদের দেশে হবে না তেমন, গরম দেশ ইমিউনিটি বেশি। সাহস জোগালাম। বললেন, ২৬ শে মার্চ আজকাল থেকে আসার কথা ছিল ইউসুফ ও জুলেখা শেষ করে চূড়ান্ত পাণ্ডুলিপি দেবেন, নিয়ে যাবে তারা। আর ৪-ই এপ্রিল যাবেন আহমেদাবাদ, পুত্রের কাছে। সব গোলমাল হয়ে গেল। ইউসুফ ও জুলেখা উপন্যাসটি শেষ করতে বলতাম আমি। প্রথম পর্ব পড়ে অভিভূত হয়েছিলাম। বলতাম দেবেশদা শেষ করুন। অনেক লেখাই শেষ হয়নি, যেমন তিস্তাদেশ। আমি কথা সোপান পত্রিকায় প্রতি শারদীয়তে তাঁর লেখা নিয়ে আসতাম। তিনি লিখতেন। তিস্তাদেশ কথা সোপান পত্রিকায় ছেপেছিলাম পরপর দুবার। একটি ক্রোড়পত্রও করেছিলাম তাঁকে নিয়ে। প্রতিক্ষণ পর্বে দেবেশদার সঙ্গে সাহিত্যের মেলামেশা শুরু হলো। ১৯৯০ সালে আমি বাঁকুড়া থেকে কলকাতা ফিরি। একাডেমি অফ ফাইন আর্টস এ নাট্যোৎসব দেখতে গেছি, পিঠে হাত। দেবেশদা। জুন মাস। বললেন, উপন্যাস লিখতে পারবে প্রতিক্ষণে। শারদীয়তে। তিন মাস সময়। হাঁসপাহাড়ি লিখলাম। ১৯৯৪ সালের মার্চে ভূমিকম্প বিধ্বস্ত লাতুর জেলার কিল্লারি গ্রামে যাই সাহিত্য অকাদেমির ভ্রমণ ভাতা পেয়ে। ফিরে এসে একটা রিপোরটাজ লিখব প্রতিক্ষণে, সম্পাদক স্বপ্না দেব তাই বলেছিলেন। স্বপ্নাদি লেখা চাইলেন। কী দেখেছ লিখে আন। দেবেশদা বললেন, কী লিখবে ও। রিপোরটাজ। কী দেখেছে লিখুক। দেবেশদা বললেন, ও ক্রিয়েটিভ লেখক। এসব লিখবে কেন, আমাকে বললেন যদি উপন্যাস লিখতে পার, লিখে নিয়ে এস। লিখেছিলাম, নিসর্গের শোকগাথা। সব মনে পড়ে যাচ্ছে, ১৯৯৭ সালের মে মাস। ফোন করলেন, কী লিখছ এখন। বললাম ১৯৮১-তে লেখা একটি খসড়া নিয়ে বসেছি। বিভ্রম। শুনলেন। বললেন অশ্বঘোষের বুদ্ধচরিত আছে ? ছিল। ধ্রুবপুত্র লেখার জন্য সংস্কৃত সাহিত্য সম্ভার কিনেছিলাম। মূল সূত্রটিকে ধরিয়ে দিলেন। কন্থক আর ছন্দক। উপন্যাস যখন লিখছি তাঁর পরামর্শ পেয়েছি। অশ্বচরিত নিয়ে এসব কথা।
এমন পরামর্শ যে লেখাই ঘুরে গেছে। আর আমি তো পড়ছি বাংলা সাহিত্যে রুশ উপন্যাসের মহাকাব্যিক চলন তাঁর লেখায়। সামান্য সূত্রকে কীভাবে নভেলাইজ করতে হয়, সেই কথা বলতেন। কবছর আগে একটি উপন্যাস লিখলেন, দীর্ঘ নাম, ” টৌন জল্পেশগুড়ি–যেখানে সূর্য রোজ দুদিক থেকে ওঠে–ও তার লোকজন’। উপন্যাস কীভাবে হয়ে ওঠে তা তাঁকে পড়লেই টের পেয়েছি এতটা জীবন ধরে। এ জীবনে তাঁর মতো লেখকের সঙ্গ করেছি, সে এক দুর্লভ পাওয়া। লকডাউনের আগে একবার গিয়েছিলাম, ফেব্রুয়ারিতে, মোমেনশাহী উপাখ্যান দিতে। বিকেল ৫টা থেকে রাত ৯টা। চার ঘন্টা কেটেছিল। তারপর নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশভাগ এবং বাঙালির সংস্কৃতি এই আলোচনাচক্রে তাঁর বক্তৃতা শোনা ছিল মহৎ অভিজ্ঞতা। তিস্তা পারের বৃত্তান্ত আর তিস্তাপুরান, না শেষ হওয়া তিস্তাদেশ… মানুষ খুন করে কেন, সময় অসময়ের বৃত্তান্ত, লগনগান্ধার, ইতিহাসের লোকজন, উচ্ছিন্ন উচ্চারণ, কত লেখার কথা বলব। এই বয়সেও লেখেন সেবার যখন মৌসুমী বায়ু এসেছিল, এ কে ৪৭… সমাজ এবং জীবন সব লেখায় মহাকাব্য।
দেবেশদাকে নিয়ে গতকাল সমস্তদিন ফোন এসেছে। যতটা জেনেছিলাম সুধাংশুবাবু এবং প্রিয়দর্শী চক্রবর্তীর কাছ থেকে তা বলেছি। রাতে ঘুমের আগে ডাঃ ললিতা চট্টোপাধ্যায়ের ( ললি ) সঙ্গে আচমকা হাই সুগার এবং অচেতন হয়ে থাকা নিয়ে যখন কথা বলছি, জানতে চাইছি কী হতে পারে, তখন তিনি চলে যাচ্ছেন। অলক্ষ্যে তিস্তানদীর দিকে রওনা হয়েছেন। তারপর সুদর্শন সেন শর্মার সঙ্গে একই বিষয়ে কথা বললাম। সুদর্শন বলল, সবটা শুনে বলবে। তারপর ঘুমিয়ে পড়তে ১১-১৫ নাগাদ ফোন বেজে গেল। ধরলাম না। একটুবাদে আবার ফোন, ধরতে হলো। প্রিয়দর্শী খবর দিল। আবার সুদর্শনের সঙ্গে কথা হলো। তারপর সুধাংশুবাবু। তারপর ফোন সাইলেন্ট করে ঘুমিয়েছি। রাত চারটেয় উঠে এই সব লিখলাম। শেষ মানুষটি যিনি পড়তেন। পুজোর লেখাও মন দিয়ে পড়তেন। তাঁর কাছ থেকে পড়তে হয়, এই শিক্ষাটি পেয়েছি। অনেক তরুণ লেখককে তাঁর কাছে পাঠিয়েছি। দেবেশদা চলে গেলেন! এই ভয়ানক সময় তাঁকে শেষ দেখা দেখতে দেবে না। প্রণাম জানাই। এ জীবন সুন্দর হয়েছে আপনার কাছাকাছি এসে। হে তিস্তা নদী, তোমার সন্তানকে তুমি নিজের কাছে নাও। যা অসম্পূর্ণ আছে তা বই হয়ে থাকুক আমাদের কাছে।
অমর মিত্র

দেবেশ রায়
(১৭ ডিসেম্বর ১৯৩৬ — ১৪ মে ২০২০)
‘ম্যানগ্রোভ সাহিত্য’-র নিবেদন


কথোপকথন
লেখক সত্তাটা খুব বেশি প্রাইভেট রাখতে হয়
দেবেশ রায়

আপনি বললেন, এগুলো পড়ে আপনার মনে হতো এগুলো গল্প না। তাহলে লেখাটা আপনার কাছে কি মনে হতো বা কিভাবে ধরা দিতো?
দেবেশ রায়
সেটাই বলছি। আমার মনে হতো এগুলো বানানো লেখা। আরোপিত। পুজো সংখ্যা বেরোতো তখন, প্রধানত- আনন্দবাজার। তাতে দাদাদের বন্ধু-বান্ধবেরা আলোচনা করতো, সিরিয়াস আলোচনা। তখন পুজো সংখ্যাটা খুব ইম্পোর্টেন্ট ছিল। বছরে একটামাত্র বেরোতো। আমাদের বাড়িতে অনবরত সাহিত্যের গল্পই চলতো। দাদারা কথা বলাবলি করতো, বাহ! দারুণ হয়েছে ওটা। এটা-ওটা বলতো। কিন্তু আমি যখন পড়তে যেতাম, আমার ভীষণ বানানো লাগতো। ভেতরে ভেতরে এগুলোর ব্যাপারে এক ধরনের রিজেকশন ছিল। আমি বলছি- সেই সময়ের কথা, যখন কালি-কলম ও কল্লোল যুগের প্রতিষ্ঠিত লেখক, যারা মূলত বাংলা সাহিত্যেরই লেখক, তাদের লেখা পড়তাম। আমার কিছুতেই মনে হতো না যে, এগুলো ঠিকঠাক লেখা। কিন্তু তারাশঙ্কর পড়লে ভীষণ ভালো লাগতো। ভীষণ! আমাকে অনুপ্রাণিত করতো। কিন্তু নিজে লিখবো বলে না।
কিংবা যখন বিদেশি গল্প পড়তাম, বিশেষ করে গোর্কির গল্প, চেখভের গল্প- আমাকে খুব অনুপ্রাণিত করতো। মোপাসাঁ ভালো লাগতো, কিন্তু মোপাসাঁর গল্পের শেষের দিকে একটা ক্লাইমেক্স-এর মোড়- সেটা আমার ভালো লাগতো না। কিন্তু চেখভের গল্পের চরিত্রগুলোর মধ্যে একটা আনসার্টেনিটির জায়গা আছে। সেটা যেন নিশ্চিত নয় লেখকের কাছে। সেটা আমাকে ভীষণ টানতো। চেখভের গল্প পড়তে গিয়ে আমি প্রায় একটা আত্ম-আবিষ্কারের আনন্দ পেতাম। আর ভালো লাগতো তুর্গেনিভ।
এগুলো কি আপনারা বাংলা অনুবাদে পড়তেন- না ইংরেজিতে?
দেবেশ রায়
না, ইংরেজি অনুবাদে পড়তাম। বাংলায় নয়। বাংলায় অনুবাদ হয়েছে অনেক পরে। আরেকটা বিষয় এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, তখন জগদীশ ভট্টাচার্যের সম্পাদনায় বেঙ্গল পাবলিশার্স থেকে শ্রেষ্ঠগল্পের সিরিজ বের হতো। ধারাবাহিকতা রক্ষা করে পরপর বেরিয়ে যেতো। সেখানে জগদীশ ভট্টাচার্যের ভূমিকা থাকতো- গল্পের ধরন ও চরিত্রের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ইত্যাদি থাকতো। বাংলা সাহিত্যের ছোটগল্পের ধারাবাহিকতা, তার চেষ্টা, তার জটিলতা, তার ব্যর্থতা, তার সফলতা- এ সবের একটি আকর-সিরিজ হিসেবে এটিকে বিবেচনা করতে পারি। আমার নিজের ক্ষেত্রে ওটা খুব উপকার করেছে। ছোটগল্পের ফর্মটা বাংলা সাহিত্যের এমন অন্তর্গত যে, আমি বলতে পারি, ছোটগল্পের মধ্য দিয়েই আমি বাংলা সাহিত্যের ভেতরে ঢুকেছি।
এ ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ…?
দেবেশ রায়
রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে একটা কথা পরিষ্কার করে দেয়া ভালো, রবীন্দ্রনাথ তো পাঠ্যও ছিলেন এবং খুব বেশি আলোচিতও ছিলেন। আমি গল্পগুচ্ছ যখন পড়তাম, শুধুই তা পড়তাম। যখন ইন্ডিভিজুয়ালদের গল্প পড়তাম, ধরুন, পুজো সংখ্যায় খুব বিরাট নাম হয়েছে এমন কারো গল্প বা কোনো একটা গল্প পড়তে গেলাম ভালো লাগলো না। বানানো লাগতো। ভাষাটাও বানানো লাগতো। সেই লেখকেরই যখন সঙ্কলন পড়লাম, তার মধ্যে একটা ভালো-একটা খারাপ, একটা খারাপ-একটা ভালো- এ রকম করতে করতেই পাঠক হিসেবে একটা সিলেকশন হয়েই যায়!
যে কোনো লেখার বেলায় আমরা একটা শিরোনাম দেই। যেমন- মানুষেরও একটা নাম থাকে। আপনার লেখায় নামকরণের বেলায় আপনি যে নামগুলো নির্বাচন করেন, যেমন : বৃত্তান্ত, প্রতিবেদন ইত্যাদি- বড় উপন্যাসের কাজগুলোতে- সেগুলো এত সাহসের সঙ্গে, এত সাদামাটাভাবে কিভাবে করলেন?
দেবেশ রায়
এ জায়গাটাতে আপনি ঠিকই ধরেছেন। বাংলা গল্প সম্পর্কে আমার আপত্তিটা শুরু হতো নামকরণ থেকেই। আমার একমাত্র ভালো লাগতো রবীন্দ্রনাথের নাম। গল্পগুচ্ছের নামগুলো। এখানে নামের কোনো চেষ্টা নেই। কোনো বানানো নাম না। যেমন ধরুন- একটা গল্পের নাম ‘দেনা-পাওনা’। এখানে ভালো লাগতো যে, গল্পের একটা মূল পয়েন্ট বলে দিচ্ছেন। শুধু উল্লেখ মাত্র। ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’, ‘পোস্টমাস্টার’, ‘একরাত্রি’, ‘যজ্ঞেশ্বরের যজ্ঞ’- এই নামগুলো অদ্ভূত লাগতো।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পের নাম আমার খুব ভালো লাগতো। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম সাংঘাতিক লাগতো। খুব খারাপ লাগতো সুবোধ ঘোষের নাম, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের নাম- একেবারে বানানো। তারাশঙ্করের গল্প খুব ভালো লাগতো, অভিভূত করে দিতো, কিন্তু নামকরণ খুব খারাপ লাগতো। বনফুল কোনোদিনই ভালো লাগতো না। না গল্প, না নাম- কোনোটাই না। বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের ‘রানুর কথামালা’ আমার কাছে অসামান্য লাগতো। শরৎকুমার রায় চৌধুরীর গল্পগুলো খারাপ লাগতো না, নামগুলো ভালো লাগতো না।
এ সব তো বিষয়ের আরোপিত ক্ষেত্র। স্বতঃস্ফূর্তও হতে পারে। আপনি তো সম্পাদকও ছিলেন। তখন এই নামকরণের বিষয়টা কিভাবে বিবেচনায় আনতেন?
দেবেশ রায়
ঘনিষ্ঠ কারো হলে বলেই দিতাম, কি নাম দিয়েছেন- বলেই বদলে দিতাম। আবার এমন অনেক তরুণ লেখক ছিলেন, যারা নাম দিতেনই না। গল্পটা আমাকে দিয়ে বলতেন, নাম আপনি দেবেন। এ রকম অনেক হয়েছে। কিন্তু নামকরণের জন্য কোনো গল্প আমি প্রত্যাখ্যান করিনি। আমার নিজের নামকরণের ব্যাপারে আমি সাদামাটা নাম পছন্দ করতাম। আমার গল্পের নামকরণ দেখবেন একেবারে অন্যরকম। আমার কাছে মনে হতো যে, গল্পের নামকরণটা হবে গল্পেরই একটা লাইন। আমি গল্পের নাম সব সময় শেষে দিতাম, শুরুতে নয়। গল্পের নামকরণটা গল্পের নির্দেশ হবে না, গল্পের নামকরণটা হবে গল্পের ভেতর থেকে।
আগে নাম দিয়ে লিখলে লেখার স্বতঃস্ফূর্ততা কি ক্ষুণ্ন হতে পারে?
দেবেশ রায়
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নাম আগে দিয়ে লিখতেন। এটার মধ্যে তফাৎ আছে। নামটা আগে দেয়া মানে কিন্তু নামটা গল্পের ভেতর থেকে আসছে। বিষয়টা ওর মনে মনে লেখা হয়ে আছে। মানিক বাবুর নামকরণ অসামান্য। আমার ধারণা- পৃথিবীতে ওঁর মতো সুন্দর নাম কেউ দেননি। ‘দুআনা ও দুপয়সা’, ‘সোনার চেয়ে দামি’ ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ ‘চতুষ্কোণ’, ‘মানুষ রাগ করে কেন’, ‘কাকে ঘুষ দিতে হয়’- অসামান্য সব নাম।
অনেকে আবার নামের চমৎকারিত্বও পছন্দ করেন। তাদের মধ্যে কি নামের মাধ্যমে নতুন কোনো চমক সৃষ্টির প্রবণতা কাজ করে?
দেবেশ রায়
না, এটা একসময় বাংলা গল্প-উপন্যাসে ছিল। বিশেষ করে চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকে তো এটা খুবই ছিল যে, নাম দিয়ে পাঠক ধরা বা নাম দিয়ে ক্রেতা ধরা। তখন তো বিয়েবাড়িতে বইপুস্তক দেয়ার রেওয়াজ ছিল বেশি। নাম শুনে যাতে মনে হয় যে, এর মধ্যে একটা রোমান্টিক ব্যাপার-স্যাপার আছে।
আপনার লেখায় দুটি শব্দ ‘বৃত্তান্ত’ এবং ‘প্রতিবেদন’ বারবার ঘুরে-ফিরে আসে। এ দুটির মধ্যে কি কোনো তফাৎ আছে?
দেবেশ রায়
তফাৎ আছে। নামকরণের বেলায় ‘বৃত্তান্ত’, ‘প্রতিবেদন’, ‘পুরাণ’- এগুলো আমি খুব সচেতনভাবে দিয়েছি। বাংলায় যে সব আখ্যান সাহিত্য আছে, সেগুলো যেভাবে বলতো কথা- সেগুলোর সঙ্গে যুক্ত করতে চেয়েছি। যেমন ধরুন মঙ্গলকাব্য ইত্যাদি। আর প্রতিবেদনটা এসেছে রিপোর্টিং থেকে। ওই সিরিজে যতগুলো লেখা আছে, সবই খবরনির্ভর। ওগুলোতে সংবাদটাকে নভেলাইজ করা হয়েছে।
একজন লেখকের নিরিবিলি পরিবেশ প্রয়োজন। কিন্তু আপনি এক জায়গায় বলেছেন, ‘আত্মগোপন লেখকের ধর্ম হওয়া উচিত’। আসলে কি তাই?
দেবেশ রায়
না, কথাটা আমি ঠিক ওভাবে বলিনি। আমি বলেছি, লেখক কখনো আইডল হতে পারে না। লেখক কখনো সামাজিক সেলিব্রেটি হতে পারে না। লেখক কখনো হিরো হতে পারে না। লেখকের সমস্ত কাজ হবে নেপথ্যে থেকে। লেখক সত্তাটা খুব বেশি প্রাইভেট রাখতে হয়। বিষয়টা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আমি প্রায়শ বলি- একজন লেখকের প্রয়োজন এনোনিমিটি, লেখকের অপরিচয়- এটা একজন লেখককে লালন করতে হয়। এটা যদি লালন না করা যায়, তাহলে লেখক তার লেখা তৈরি করে তুলতে পারবেন না।
আপনি বলেছেন, উপন্যাস সাহিত্যের সংজ্ঞা পশ্চিমারা আমাদের যেভাবে শিখিয়েছে, আমাদের তার প্রয়োজন নেই। বিষয়টি আরেকটু পরিষ্কারভাবে বলুন?
দেবেশ রায়
ইউরোপে নভেলের যে তত্ত্বটা তৈরি হয়েছে, আমার বক্তব্য হচ্ছে সে নভেলের বক্তব্যটা ঠিক নভেলের নয়। সেই তত্ত্বটা তৈরি হয়েছে পশ্চিমা সমাজ-বিকাশে বিজ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে। সেটা শিল্পসংজ্ঞা নয়। নভেলের মতো শিল্পকে সমাজ বিকাশের পদ্ধতির সঙ্গে মিলিয়ে দেখা, এ ব্যাপারটা বুর্জোয়া দার্শনিক এবং মার্ক্সিস্ট দার্শনিক- দুদলই করেছেন। সে জন্য আমি হেগেল, লুকাচের কথা বলেছি। এটা মার্ক্স নিজে কখনো করেননি। শিল্প-সাহিত্য থেকে তিনি সাক্ষ্য নিয়েছেন, কিন্তু শিল্প-সাহিত্যকে বাইরে এনে সমাজ-বিকাশের সঙ্গে একেবারে যুক্ত করে দেননি। এই যে তত্ত্বটা নভেল বুর্জোয়া শিল্প এবং নভেল- ব্যক্তি যে সমাজে আছে সে সমাজের কাহিনী- এটা সমাজবিজ্ঞানের সূত্র, সাহিত্যের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করাটা ভুল। এই ভুলটা ইউরোপ নিজের উপন্যাসের ক্ষেত্রে করেছে। উদার অর্থনীতি বা লিবারেল ইকোনমি ক্যাপিটালিজমের প্রগতির সঙ্গে উপন্যাস-শিল্প তৈরি হয়েছে। এটা ভুল অ্যানালজি। এই অ্যানালজি টেকে না।
আপনি বলেছেন, অনেক লেখা আপনাকে টানে না। অনেক লেখা আছে টানে। উভয় বাংলায় তরুণরা যেভাবে সাহিত্যচর্চা করছে, সে বিষয়ে আপনার বিস্তর পাঠ আছে। তো, এদের লেখার ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনি কতটুকু আশাবাদী?
দেবেশ রায়
ভবিষ্যৎ আবার কি- যা লেখা হবে, সেটাই। বর্তমান নিয়েই কথা। আমার ভীষণ প্রত্যাশা বাংলাদেশের গল্প-উপন্যাস নিয়ে। আমি বাংলাদেশের গল্প-উপন্যাস যা পড়েছি এবং এখানকার লেখকদের নিয়ে বইও লিখেছি। আমার ধারণা- বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আগে-পরে যাদের জন্ম, তারা এখন দারুণ গল্প-উপন্যাস লিখছেন। বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিস্থিতিতে এটার অনুমোদন আছে। কিন্তু এটা দুঃখের কথা যে, এ রকম যে হচ্ছে, চিরকালই তা-ই হয়, ইউরোপে অবশ্য হয় না। বাংলাদেশে যারা গল্প-উপন্যাসের সমালোচনা করেন, বিচার করেন, বিবেচনা করেন, তারা এটা বুঝতে পারছেন না। আমাদের ওখানেও বুঝতে পারছে না। তারা এটাকে কোনো প্রাইয়রিটি দিচ্ছেন না। কিন্তু আমার কাছে এটা এক বিরাট ঘটনা। কোনো দেশের কোনো সাহিত্যেই প্রত্যেক বছর বিরাট বিরাট লেখা বেরোয় না। মাত্র ৪-৫ বছরের মধ্যে, আমি নাম ধরে ধরে বলছি, বাংলাদেশের বয়স্কতম লেখক হাসান আজিজুল হকের ‘বিধবাদের কথা’, জাকির তালুকদারের ‘পিতৃগণ’, শাহীন আখতারের ‘সখী রঙ্গমালা’, সালমা বাণীর ‘ইমিগ্রেশন’, পারভেজ হোসেনের কয়েকটা বড় গল্প, প্রশান্ত মৃধার কয়েকটা বড় গল্প, আমি মাত্র ৫-৬ জনের নাম উল্লেখ করলাম। এদের প্রত্যেকটা লেখা হচ্ছে ল্যান্ডমার্ক। এ কথা কখনই বলতে চাই না যে, আমি যে ৫-৬ জনের নাম বললাম, এঁরাই বর্তমান বাংলাদেশের লেখক। আরো লেখক আছেন। একটা দেশে বা একটা ভাষায় মাত্র ৪-৫ বছরের মধ্যে যদি এ রকম দারুণ কাজ হয়ে থাকে, তাহলে আমি কি অন্ধ নাকি যে, আমি বুঝতে পারবো না। বাংলাদেশের লেখকদের এ আত্মবিশ্বাস থাকা দরকার যে, তারা বর্তমানে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কিছু গল্প, শ্রেষ্ঠ কিছু উপন্যাস লিখছেন। একজন পাঠক যদি ‘পিতৃগণ’ উপন্যাস পড়েন, তাহলে তাকে তো কোন ইতিহাসটা লেখক সেখানে পাল্টে দিলেন, সেটাও পড়তে হবে, জানতে হবে। ডায়াসপোরিক সাহিত্যেও বাংলাদেশের সম্ভাবনা অনেক উজ্জ্বল। ইউরোপ যতগুলো ডায়াসপোরিক সাহিত্য করেছে, যেমন ধরুন, ভিএস নাইপল, রুশদি, অমিতাভ ঘোষ, এঁরা যা করেছেন, সালমা বাণী একাই সবটাকে উল্টে দিয়েছেন। ‘সখী রঙ্গমালা’য় পুরনো ফোকলোরকে মর্ডানাইজ করা, সেটা শাহীন বেশ ভালোভাবেই করেছেন। এটা লাতিন আমেরিকার কোনো লেখক করেননি। দক্ষিণ আফ্রিকার কিছু লেখক এরকম দুয়েকটা কাজ করেছেন মাত্র।
বাংলাদেশে গল্প-উপন্যাসের ক্ষেত্রে রীতিমতো বিস্ফোরণ হচ্ছে। বাংলাদেশের ভূগোল নতুন করে আবিষ্কৃত হচ্ছে। সবকিছু যেন মাটির তলা থেকে ফুঁড়ে উঠছে। যেখানে হাসানকে সম্পূর্ণ নতুন শক্তিতে দেখা যাচ্ছে। আমি আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকেও ধরছি। তিনি নেই এখন। হাসান ও আখতারুজ্জামান থেকে শুরু করে বাংলাদেশের আজকের তরুণতম গল্পকাররা একটা অসম্ভব সম্ভাবনার ক্ষেত্র তৈরি করে ফেলেছেন।
পাঠকদের রুচিবান করার দায়িত্ব কি লেখকের? তার অন্য সামাজিক দায়ও তো থাকতে পারে- তাই না?
দেবেশ রায়
কিছুতেই না। বিন্দুমাত্রও না। লিখবো, পাঠকও বানাবো- এ হয় না। পাঠক যদি নিজেতেই তৈরি হয়ে না আসে, তাহলে তো হবে না। লেখকের কোনো সামাজিক দায় নেই, প্রত্যেকটা সৌন্দর্য সৃষ্টিই শিল্পীর সামাজিক দায়।
একজন পাঠক হিসেবে আমাদের দেশের ভালো লেখকদের আপনি শনাক্ত করতে পারছেন, ধরিয়ে দিতে পারছেন, এখানে আপনার দৃষ্টিটা কিংবা কৃতিত্বটা তো কম নয়!
দেবেশ রায়
দেখুন, আমি প্যালেস্টাইনের গল্প অথবা পশ্চিম আফ্রিকায় যে গল্পগুলো লেখা হচ্ছে, সেগুলো যদি ধরতে পারি- আমার ভালো লাগে, সে কথা প্রকাশ করতে পারি, তাহলে বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় যে গল্পগুলো লেখা হচ্ছে, সেগুলো আমি ধরতে পারবো না, বুঝতে পারবো না কেন? অন্যদিকে লাতিন আমেরিকা নিয়েও আমাদের মাঝে এক ধরনের অন্ধতা তৈরি হয়ে আছে। লাতিনের লেখক বলতে আমরা কাদের বুঝি? এক- মার্কেজ, খানিকটা- যোসা ছাড়া? তাদের নিয়েই আমরা লাতিন লাতিন বলে জিগির তুলি। লাতিন আমেরিকায় এখন এমন কিছু লেখা হচ্ছে না।
তরুণদের উদ্দেশ্যে আপনার কোনো বক্তব্য বা পরামর্শ থাকলে…?
দেবেশ রায়
না, তরুণদের আমি কোনো পরামর্শ দিতে চাচ্ছি না। তবে আমি এ কথাটা নিশ্চিত বলতে চাচ্ছি যে, আমি একজন বাঙালি লেখক হিসেবে, বাংলা ভাষার লেখক হিসেবে কখনই মনে করি না যে, আমি আন্তর্জাতিক লেখক নই। আমি ইংরেজিতে লিখি না বলে আমি আন্তর্জাতিক লেখক নই, এটা আমি মনে করি না। একজন আন্তর্জাতিক পাঠকের যদি আমার লেখা পড়তে হয়, তবে সে বাংলা ভাষা শিখে আমার লেখা পড়বে। একজন লেখক তার ইমিডিয়েট পাঠকের জন্যই লেখে। আসলে, কলোনিয়াল ইমেজটা আমাদের মাঝে এত বেশি যে, আমরা যেটুকু ইংরেজি জানি, সেটুকুই আমাদের ক্ষতি করছে।
ভোরের কাগজ : ২৪ জুলাই ২০১৫

গল্প পড়ার গল্প
দেবেশ রায়ের গল্প ‘মানচিত্রের বাইরে’

অমর মিত্র

দেবেশ রায়ের একটি গল্পের বই বেরিয়েছিল সারস্বত লাইব্রেরি থেকে। সেই আটষট্টি-ঊনসত্তরের কথা। এলা রাঙের ওপর লাল একটি অঙ্কন, এখনো স্পষ্ট মনে আছে। তখন অন্য রকম যাঁরা লিখতে চান, দেবেশ রায় ছিলেন তাঁদের অতি আগ্রহের লেখক। তিনি থাকতেন জলপাইগুড়ি। কখনো কলকাতায় এলে তরুণ অতি তরুণ লেখকদের কাছে তা ছিল খবর। দেবেশ রায়ের সেই বইটির নাম, দেবেশ রায়ের গল্প। সেখানে ছিল দুপুর, নিরস্ত্রীকরণ কেন, কলকাতা ও গোপাল, আহ্নিকগতি ও মাঝখানের দরজা এই সব আলাদা গল্প। মনে পড়ে ওই গল্পের কথা, যা প্রচলিত গল্পের বাইরে থেকে দেখা। দুপুর গল্প তো এখন মিথ হয়ে গেছে।
তারও পরে আপাতত শান্তি কল্যাণ হয়ে আছে, যৌবনবেলা, মানচিত্রে নেই কত গল্প। দেবেশ রায়কে প্রথম দেখি ১৯৭৫-এর প্রথমে। সেই সময়ে পড়ি তাঁর বড় উপন্যাস, মানুষ খুন করে কেন। সে ছিল উপন্যাস পাঠের নতুন অভিজ্ঞতা। আর সেই উপন্যাসের মূল চরিত্র ছিল একটি অসৎ ব্যক্তি। উত্তরবঙ্গ, চা বাগান, মানুষের লোভ, পাপ নিয়ে ছিল সেই মহা উপন্যাস। তার পর থেকে তাঁকে পড়ছি। মিশেছি অনেক। মূল্যবান পরামর্শ পেয়েছি। তিনি শিক্ষকের মতো। তাঁর গদ্য প্রথমে থমকে দেয়। প্রবেশ করলে তা অতি উচ্চাঙ্গের সংগীত। কবিতা। তার চিহ্ন তিস্তাপাড়ের বৃত্তান্ত থেকে অতিসম্প্রতি লেখা আলিফ-লায়লার পুরাণ কথা নিয়ে উপন্যাসেও রয়েছে। ছিল দুপুরেও। গ্রীষ্মের সেই দুপুরে বাতাসে ভেসে আসা বেহালার সুর এখনো কানে আসে। মনে পড়ে ‘নিরস্ত্রীকরণ কেন’ গল্পে মধ্যরাতে চলন্ত ট্রেনের বন্ধ দরজার বাইরে অবিরাম করাঘাত। কেউ উঠতে চায় ভেতরে। স্টেশনেও দরজা খোলেনি।
এই সব গল্প আমাদের প্রচলিত গল্পের থেকে আলাদা। মেধাবী মননের লেখক দেবেশ রায়। আমি এখানে তাঁর একটি অচেনা গল্প ‘মানচিত্রের বাইরে’ নিয়ে কথা বলছি। দেবেশ রায় কাহিনী লেখেন না, গল্প লেখেন। চারদিকে কাহিনী কথকের কথাই শুনতে পাই আমরা। এই গল্প কোনো এক খবরের কাগজের কলম লিখিয়ে পরমহংস ও ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফার বিনয়ের। আবার এই গল্পে জড়িয়ে আছে পরমহংসের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটে যাওয়া তার স্ত্রী অনু আর কন্যা বাবিও। কোনো এক দোসরা শ্রাবণের জন্য অপেক্ষা করছিল পরমহংস। সেদিন সে অনুর কাছে যাবে। অনুর জন্মদিনের উইশ করতে। এই গল্প সেই দোসরা শ্রাবণের। সেই দিনের বিকেলটিকে পরমহংস খোলা রাখতে চায়। তার কাগজের নিউজ এডিটর পরদিন থেকে একটি লেখা ছাপতে যাচ্ছেন, ক্যালকাটাজ ইজি ডেথ, ‘কলকাতার সহজ মৃত্যু’ এই শিরোনামে। লেখা দেওয়া হয়ে গেছে পরমহংসের। বিনয় দেবে ছবি। বিনয় যদি বিকেলের মধ্যে না আসে, আর ছবি যদি সন্ধের ভেতরে ঠিক না করে নিতে পারে পরমহংসের যাওয়া হবে না গলফ লিংক। বিচ্ছেদের পর অনুর সঙ্গে বা মেয়ে বাবির সঙ্গে তার দেখা হয়নি। বাবি একটি চিঠি তাকে দিয়েছিল, কিন্তু সেই চিঠির ভেতরে বাবির সম্বোধনে ছিল আড়ষ্টতা।
পরমহংস টের পাচ্ছে এক নিষ্পত্তিহীন যৌনতা তাকে প্রবল টানছে। তার কোনো তৃপ্তি অন্যত্র নেই। এমনকি অনুতেও নেই। কিন্তু যৌন টান রয়েছে প্রবল। সকাল ১০টায় জানালা দিয়ে দেখা পাশের বাড়ির দেয়াল, জানলায় নিমের ছায়ার দোলায় সেই যৌনতা মিশে যায়। মানিকতলা মোড়ে হঠাৎ বৃষ্টি ঝেঁপে আসার ভেতরে, রাস্তার আকস্মিক জনহীনতার ভেতরে… পরমহংসের দিন যাপনের ভেতরে, দোতলা বাসের ওপর থেকে দেখা শহর, এয়ারপোর্টের ভিআইপি লাউঞ্জে, দুর্গাপুর ব্রিজের মাঝখান থেকে দেখা পশ্চিমমুখো রেললাইনগুলোর ধাবমান প্রান্তরে বয়ে যায় অনুর শরীরের শাণিত ইস্পাত। দেবেশ রায় লিখছেন, ‘এই শহর কলকাতার অনুপ্রাসহীন সীমান্তহীন কলকাতার নাগরিক বিস্তার জুড়ে অনুর শরীর নিয়ত অন্বিত হয়ে থাকে পরমহংসের কাছে যৌনের আসঙ্গে।’ ওই যৌনই তাকে টানছে অনুর কাছে। টানছে অনেক দিন, কিন্তু সে এড়িয়ে থাকতে পেরেছে দোসরা শ্রাবণকে সামনে রেখে। যে স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ হয়ে গেছে, সেই স্ত্রীর প্রতি এই টান বোধ করার কোনো আইনি অধিকার, সামাজিক অধিকার তার নেই। গল্পের চালচিত্র এই। আর গল্প হয় বিনয়ের ছবি আর তার নিবার্চন নিয়ে।
পরমহংসের দ্বিধা আছে গলফ লিংক যাওয়ায়। তাই সে অনুর জন্মদিন এই দোসরা শ্রাবণ পর্যন্ত তা পিছিয়ে রেখেছিল। আজ বিনয় কখন ছবি দেবে, তার ওপর নির্ভর করছে তার যাওয়া। বিনয় কত ছবি নিয়ে বসে আছে তার নিজের ঘরে। পরমহংস যায় দুপুরে সেখানে। ফিরেও আসে। হাওড়া ব্রিজের একটা গর্ত থেকে আচমকা গলে গিয়ে মৃত্যু হয়েছে এক পথচারীর। তা নিয়ে খুব হৈচৈ হয়েছিল। তারপর এই শহরে যে যে সহজ মৃত্যুর বিষয় আছে, উপায় আছে সেই কাহিনী বেরোবে পরমহংসের পত্রিকায়। বিনয়ের সঙ্গে পরমহংস ছবির কথা বলতে থাকে। ঘেঁস চুরি করতে গিয়ে ঘেঁসের গুহার ভেতরে শিশুর মৃত্যু, রাস্তায় ঘুমন্ত পথচারীর ওপর মাতাল লরি, গঙ্গার তীরে শত বছরের পুরোনো বাড়ির ছাদ ভেঙে মৃত্যু সেখানে আশ্রয় নেওয়া মানুষের। সেই ছবি নেওয়া হয়েছিল গঙ্গার ভেতর থেকে। মৃত্যুর খবরও সাজিয়ে পরিবেশন করতে হয়। তারা মৃত্যু নিয়েই কথা বলে যায়।
গল্পের ভেতরে চলে আসে ঘেঁসের গুহার ভেতরে ঢুকে শিশু মৃত্যু। খোলা হাইড্রান্টে পড়ে শিশু মৃত্যু কমন, কিন্তু ক্রমাগত গর্ত খুঁড়ে ঘেঁসের গুহার ভেতরে ঢুকে গিয়ে ১৫-২০টি বাচ্চার মৃত্যু স্টোরি হিসেবে অভিনব নিশ্চয়। আসলে এই গল্প মৃত্যুর গল্প। সহজ মৃত্যু সব সময় রহস্যময়। ঘেঁস দিয়েই এই মৃত্যুর কাহিনী খবরের কাগজে শুরু হবে। কলকাতার সব হাউজিং প্রজেক্টই ঘেঁস দিয়ে ভরাট করা জমিতে মাথা তোলা। ঘেঁস আসলে কবরখানা। “ক্যালকাটা ইজ গোয়িং হাই অন গ্রেভস, ‘আসলে মৃত্যুর কথাই বলতে বসেছেন দেবেশ রায়। সহজ মৃত্যু। এই যে সময় যায়, বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হয়ে যায়, গলফ লিংক যাওয়ার সময় পেরিয়ে যায়। পেরিয়ে যাওয়া মানে আবার কোনো এক চৈত্র বা ফাল্গুনের জন্য অপেক্ষা করা। পরমহংসের কাছে বিনয় শুনতে চায় মৃত্যুর এক ধারাবিবরণ। পরমহংস তা শোনাতে আপত্তি করেনি। শোনাতে শোনাতে সে বোঝে অনু দূরে সরে যাচ্ছে। বিনয় তার কোলে ফেলে দিয়েছে অনেক মরা মানুষের ছবি। পরমহংস ঘাড় নামিয়ে দ্যাখে, থালাভরা জলে যেম গ্রহণের সূয দ্যাখে—মৃতদেহ ভাসা স্রোতে আরো যুগ-যুগান্তরের পারে চলে চলে যাচ্ছে দোসরা শ্রাবণ। আসলে একটি সম্পর্কের সহজ মৃত্যুর গল্প বললেন দেবেশ।
এনটিভি অনলাইন : ১২ নভেম্বর, ২০১৭

দেবেশ রায়ের উপন্যাসচিন্তা

চন্দন আনোয়ার

দেবেশ রায়ের মননশীল লেখা আমার গদ্যচর্চার সাম্প্রতিক সম্মোহন। ২০১০ সালের আগে পর্যন্ত আমি দেবেশ রায়কে স্রেফ কথাসাহিত্যিক হিসেবেই পাঠ করে আসছি। তাঁর ছয় খণ্ডে প্রকাশিত গল্পসমগ্র ও বেশ কয়েকটি অসাধারণ উপন্যাস আমার আবশ্যকীয় পাঠের তালিকায় আছে। এরকম আরো চারজন আছেন- মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, কমলকুমার মজুমদার, হাসান আজিজুল হক ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। এঁদের মধ্যে শুধু হাসান আজিজুল হকের মননশীল গদ্যের সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে। এই কবছর দেবেশ রায়ের মননচর্চার সঙ্গে সংযোগ ঘটেছে। বাকি দুজনের মননশীল লেখার প্রতি আমার তেমন আগ্রহ নেই। এর বাইরে যাঁদের কথাসাহিত্য আমি পাঠ করে আসছি এবং যাঁরা বাংলার খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক, তাঁদের মধ্যে খুব কমজনকেই দেবেশ রায়ের মতো শক্তিমান গদ্যনির্মাতা হিসেবে পাই। অবশ্য, এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ সকলের ঊর্ধ্বে এবং আমার ধর্তব্যের বাইরে। একজন শীর্ষ কথাসাহিত্যিকের গদ্য বলে আলাদা কোনো তাৎপর্যের কথা বলছি না। এভাবে ভাবছিও না। দেবেশ রায়ের মননচর্চার ব্যাপ্তি ও দীপ্তি, শাণিত যুক্তি দিয়ে শাণিত গদ্যে বক্তব্য উপস্থাপনরীতি, চিন্তার স্বাবলম্বন, বিষয়ের বৈচিত্র্য বাংলা মননশীল গদ্যের মূল্যবান সংযোজন হিসেবেই পাঠ্য- এ-কথায় আমার কোনো দ্বিধা নেই। দেবেশ রায়ের মননচর্চায় উপন্যাস নিয়ে ভাবনা এক বিশেষ দিক। প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত পাশ্চাত্য মডেল বা ফর্মকে প্রত্যাখ্যান করে বাঙালির নিজস্ব মডেলে বা ফর্মে বাংলা উপন্যাসের ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা থেকেই দেবেশ রায় নতুন ধরনের উপন্যাসের খোঁজ করেন। তাঁর ভাবনার এই দিকটিই আমার নিজের মতো সাজিয়ে নিয়েছি মাত্র। দু-একটি জায়গায় বিরোধে জড়িয়েছি বটে, তবে সার্বিক অর্থে দেবেশ রায়ের এই মিশন আমার সমর্থনেরই জায়গা। অবশ্য এই মিশনকে ঘিরে জিজ্ঞাসাগুলোও বহুমাত্রিক। বাংলা উপন্যাসের সোয়াশো বছরের ইতিহাসের পোস্টমর্টেম করে, গ্রহণ-বর্জন-প্রত্যাখ্যানের ভেতর দিয়ে তিনি কি শেষপর্যন্ত নিজেই কোনো পাঁকে জড়িয়ে পড়লেন কিনা? নতুন ধরনের উপন্যাসের খোঁজে বেরিয়েছেন অর্থ বাংলা উপন্যাসের প্রচলিত ঐতিহ্যকে তিনি মানছেন না অথবা সন্তুষ্টি নেই। নতুন ধরনের উপন্যাসের কোনো হদিস কি তিনি আমাদের দিতে পারলেন? নাকি অতীত অনুসন্ধানের নামে বাংলা উপন্যাসের শূন্যতা, অসম্পূর্ণতা, মুমূর্ষুতাকে হাট করে খুলে দিলেন মাত্র। উপন্যাসের সংজ্ঞাহীনতার নামে তিনি নতুন কোনো সংজ্ঞা নির্মাণ করে ফেললেন কিনা? এ-ধরনের অনেক জিজ্ঞাসাই আছে বিষয়ের প্রাসঙ্গিকতায়।
‘নির্বিকল্প অতীত’ নয়, ‘বহুবিকল্প অতীত’কে অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে সিনেমার পর্দা ওঠানোর মতো একে একে বিস্ময়, বিতর্ক, যুক্তি ও তর্কের পর্দা সরিয়ে সামনে এগিয়ে যায় দেবেশ রায়ের নতুন ধরনের উপন্যাস খোঁজার মিশন। এই মিশন অবশ্যই বর্তমান সময় পরিপ্রেক্ষিতকে সামনে রেখে। নতুন ধরনের উপন্যাস খোঁজার মিশনে বেরিয়ে কোথাও যুক্তিরহিত আবেগ দ্বারা পরাস্ত হননি দেবেশ রায়। নিজের মধ্যে কোনো ধরনের আবরণ রাখেননি অথবা সম্মোহন জাগিয়ে রাখেননি। সোয়াশো বছরের নির্মিত বাংলা উপন্যাসের অপুষ্ট শরীরের কোনো একটি জায়গাও অক্ষত রাখেননি। দক্ষ সার্জারি ডাক্তারের মতো বাংলা উপন্যাসকে ব্যবচ্ছেদ করে প্রায় নির্বিকারভাবে তিনি চিহ্নিত করে গেছেন, কোথায় কোথায় এবং কী কী কারণে বাংলা উপন্যাসের নিজস্ব ঐতিহ্য বা মডেল তৈরি হয়নি, এই কাজে তিনি প্রথাগত সাহিত্যের ইতিহাস লেখার ঐতিহ্য থেকে বেরিয়ে এসে সম্পূর্ণ নিজস্ব একটি যুক্তিসৌধ নির্মাণ করেন।
আলালের ঘরের দুলাল (১৮৫৮) ও হুতোম প্যাঁচার নকশা (১৮৬১-৬২) – এই দুটি বিবরণধর্মী গদ্যাখ্যান বাংলা আধুনিক উপন্যাসের যাত্রাবিন্দু- দুর্গেশনন্দিনী প্রথম আধুনিক বাংলা উপন্যাস -সাহিত্যের ইতিহাসের এই প্রতিষ্ঠিত ধারাক্রমকে প্রায় নাকচ করে দিয়েছেন দেবেশ রায়। স্বল্পতম ব্যবধানে দুই বিপরীত ধরনের আধুনিকতাকে চিহ্নিত করেন বাংলা উপন্যাসে। পত্র-পত্রিকার খবরকে বিবরণধর্মী গদ্যাখ্যানে সুস্বাদু করে পরিবেশনের প্রচল রীতিটিকেই প্যারীচাঁদ মিত্র ও কালীপ্রসন্ন সিংহ বাংলা উপন্যাসের ফর্মে রূপান্তর করেছিলেন। এই ফর্ম বঙ্কিমচন্দ্রের কাছে শুধু গ্রহণ-প্রতাখ্যানের বিষয়ই হয়ে থাকেনি, অপ্রাসঙ্গিক, মূল্যহীন ও নির্বাসন দণ্ডের শিকার হয়।
আমাদের শিক্ষা, রুচি, মেজাজ, মনন, মগজ সবকিছুই যখন ইংরেজদের দাক্ষিণ্য, তখন বাংলা উপন্যাস কেন এই দাক্ষিণ্য থেকে বঞ্চিত হবে? বাস্তবে হয়ওনি। উপন্যাস কী ধরনের হবে, উপন্যাসের সংজ্ঞা কী হবে, চরিত্র-ভাষা-বয়ান কী ধরনের হবে, জাতিগত আত্মপরিচয়ের সন্ধানের উপাদানগুলো কী কী হবে, যা উপন্যাসের উপকরণ হবে, এই সবকিছুই যখন ইংরেজরা শিখিয়েছে, আর এই শিক্ষায় যিনি চরমসিদ্ধি লাভ করেছিলেন সেই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যখন উপন্যাস লিখছেন তখন আর প্রত্যাশা করে কী লাভ যে, বাংলা কাহিনিগদ্যের ধারাটিকেই নিজ প্রতিভাবলে আধুনিক বাংলা উপন্যাসের ঐতিহ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবেন। বাস্তবে তিনি সেদিকে তাকানোর প্রয়োজন মনে করেননি। তাঁর দরকারই পড়েনি। যেমন দরকার পড়েনি মধুসূদনের।
উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্র প্রথম আধুনিক পুরুষ, আর কাব্যে মধুসূদন। এতকাল আমি একে বাংলা সাহিত্যের সৌভাগ্যই ভেবে এসেছি। দেবেশ রায় আমার এই ভাবনাকে নড়বড়ে করে দিয়েছেন! চলনে-বলনে, পোশাকে, আচার-অনুষ্ঠানে ইংরেজের চেয়েও খাঁটি ইংরেজ হওয়ার চেষ্টা যাঁর, যিনি ভারতীয় সংস্কৃতিকে বিষয় করে মূলত বিদেশি মহাকাব্যই লিখলেন, সেই তিনিই বাংলা ভাষার প্রথম আধুনিক কবি! একইভাবে, সেই তিনিই প্রথম আধুনিক ঔপন্যাসিক, যিনি বাংলার গদ্যাখ্যানের ঐতিহ্যকে গ্রহণ না করে ইংরেজি উপন্যাসের মডেলকে বাংলা উপন্যাসের মডেল বানিয়েছেন!
কবিতায় মধুসূদনের আধুনিকতা তাঁর মৃত্যুর পরে আর চর্চিত হয়নি। মধ্যযুগের গীতিকাব্যের ঐতিহ্যকেই রবীন্দ্রনাথ গ্রহণ করেন। তিরিশের কবিরা ইউরোপীয় কবিদের দিকে সম্মোহনের চোখে তাকিয়েছেন বটে, তবে তা মধুসূদনের মতো বাংলা কবিতার ঐতিহ্যকে একেবারেই উপেক্ষা করে নয়; কিন্তু বাংলা কথাসাহিত্য ইউরোপীয় আধুনিকতা বা মডেলের বাইরে আসতে পারেনি। এই কারণেই, সোয়াশো বছর পরে দেবেশ রায়কে নতুন ধরনের বাংলা উপন্যাস খোঁজার মিশনে বের হতে হয়। এই কারণেই, দেবেশ রায়ের মতে, খাঁটি উপন্যাস আজো একটিও রচিত হয়নি। এই অভিজ্ঞতা তাঁর লেখকজীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা।
উপন্যাসের ফর্ম বা মডেল বলব কাকে? ঔপন্যাসিকের অভিজ্ঞতা বা জ্ঞানকে যা উপন্যাসে পরিণত করে সেটাই তো ফর্ম। প্রায় চল্লিশ বছর ধরে গল্প-উপন্যাস লেখার নানা চেষ্টায় বারবার হয়তো এখানেই ঠেকে গেছি। ঠেকে যে গেছি তাও হয়তো বুঝিনি, বুঝি না। এখন যখন নিজের অতীতটাকে একসঙ্গে দেখার মতো চড়াইয়ের দিকে চলছি আর সেই চড়াই থেকে যতই চোখের সামনে বাংলা উপন্যাসের সমতল বিস্তৃততর হচ্ছে, ততই অসহায় ও ক্ষমতাহীন ক্ষোভে বুঝতে পারছি, ইয়োরোপীয় মডেলে আমাদের পরিত্রাণ নেই।
(উপন্যাসের নতুন ধরনের খোঁজে, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ২০০৬, পৃ ২০-২১)
বাংলা উপন্যাসকে বঙ্কিমচন্দ্র নতুন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, বাংলা উপন্যাসের সমস্ত অর্জনও বঙ্কিমচন্দ্রের দান, আবার বাংলা উপন্যাসের নিজস্ব একটি ঐতিহ্য গড়ে ওঠার সম্ভাবনাকে বিনষ্টির দায়ও তাঁর। আধুনিক কবিতায় একই দায় ছিল মধুসূদনের। কিন্তু কবিতাকে মধুসূদনের মডেল থেকে বের করে আনেন রবীন্দ্রনাথ। এই কারণেই রবীন্দ্রনাথ বাঙালি কবি হয়ে থেকে গেলেন। বাঙালি কবি হয়ে গেলেন বলেই তাঁর কবিতাকে মূল্যায়ন করার জন্যে বা তাকে তুলনা করার জন্যে ইউরোপের কোনো কবিকে খুঁজতে হয় না। আর এই নিজস্বতার গুণেই বাংলা কবিতার এই সর্বৈব ব্যাপ্তি ও অবস্থান। সামান্য ব্যতিক্রম ব্যতীত বাংলার উপন্যাস সোয়াশো বছর ধরে মূলত বঙ্কিমচন্দ্রের মডেলেই চলছে। এই একটি মাত্র মডেলে সীমাবদ্ধ থেকে যাওয়ায় স্থবিরতা ও আধুনিকতার অন্যান্য উৎস থেকে বাংলা উপন্যাস বরাবরই বিচ্ছিন্ন থেকে যাচ্ছে।
দেশীয় যুবসমাজ পঞ্চাশের দশকেই নতুন এক আত্মজীবনী পাঠের জন্য নতুন চোখ মেলে ধরেছিল। ইংরেজি শিক্ষা ও সরকারি চাকরি এই নতুন চোখের কারণ। তার বাস্তব আত্মজীবনী – আলালের ঘরের দুলাল বা হুতোম প্যাঁচার নক্সার আত্মজীবনীর বাইরে বিস্তৃত পটভূমির নতুন আত্মজীবনী সন্ধান করে। এই নতুন আত্মজীবনী তাঁকে ব্রিটিশ নাগরিকের তুল্য ভাবার গৌরব দেবে। এই ভাবনাকে বাস্তবরূপ দিতে হলে অতীত ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরানো ছাড়া বিকল্প ছিল না। শিক্ষিত আধুনিক বঙ্গযুবকের অতীত ইতিহাস বর্তমান ইংরেজি প্রজার চেয়ে গৌরবোজ্জ্বল ও মহিমান্বিত। তাই আলাল-হুতোমের নিরেট বাস্তবতাকে সে পাঠ করতে চায় না। এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করেই তো তাঁকে নতুন এক আত্মজীবনী পাঠ করতে হবে। এই আত্মজীবনী রচনা করতে গিয়ে প্রায় শখানেক বছর ধরে প্রবহমানতার ইতিহাসকে কোনো প্রকারেই গ্রাহ্য করেননি বঙ্কিমচন্দ্র। ইংরেজি উপন্যাসের মডেল হাতে নিয়ে বিষয়ের জন্যে একলাফে ফিরে গেলেন দুশো বছর পেছনে!
বঙ্কিমচন্দ্রে ফিরে যাওয়ার বাস্তবতা ততোদিনে তৈরি হয়ে গেছে- এই বাস্তব অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ফিরে না গেলে কি বাংলা উপন্যাসের বিকাশ থেমে যেত? বঙ্কিম যদি আলালের ঘরের দুলাল থেকে শুরু করতেন তবে কি বাংলা উপন্যাসের বর্তমান আধুনিক চেহারা আমরা দেখতে পেতাম না? এবং তাই সংগত ও স্বাভাবিক ছিল কি-না? দেবেশ রায় এই প্রশ্নগুলোকেই মূলত উসকে দিয়েছেন। তাঁর নতুন ধরনের উপন্যাস খোঁজার মিশনে এই আরম্ভ বিন্দুটিই টার্নিং পয়েন্ট।
বাঙালি যুবক ইংরেজি শিক্ষা ও চাকরির সুবাদে নিজেকে এক আত্মবৈপরীত্যের পাঁকে জড়িয়ে ফেলেছিল। ভিক্টোরীয় নাগরিক হওয়ার চেষ্টাই হয়ে যায় আধুনিক হওয়ার চেষ্টা। নিকট-আগত একটি স্বপ্ন তাকে তাড়া করে। ভিক্টোরীয় সভ্যতার অংশীদারিত্বের কথাও ভাবে। এই স্বপ্নই বাঙালি যুবক মধুসূদনকে আর মধুসূদন থাকতে দেয়নি, মাইকেল হতে হয়। বঙ্কিমচন্দ্র দেশ-ধর্ম-সমাজ ত্যাগ করেননি বটে; কিন্তু ভিক্টোরীয় সভ্যতায় তাঁর মানস-পরিভ্রমণ ছিল সুতীব্র। তাই, দুর্গেশনন্দিনী উপন্যাসেই বাঙালি ভিক্টোরীয় নাগরিক হওয়ার সব উপাদান পেয়ে যায়। তাই, দুর্গেশনন্দিনী হয়ে গেল ইংরেজি শিক্ষিত যুবকের গৌরবমণ্ডিত নতুন এক আত্মজীবনী। এতে সংস্কৃতিনির্ভর অপ্রচল ভাষা ব্যবহার করে সনাতনদেরও বঞ্চিত করেননি বঙ্কিম। তাদেরও সুখপাঠ্য হয়।
বাংলা উপন্যাস দুদিক দিয়েই পেছনে ফিরল। কি কাহিনি, কি ভাষা – দুটিরই তার ছিঁড়ে গেল। দীর্ঘদিনের চর্চিত ভাষা প্রত্যাখ্যাত হয়ে যেমন মৃতবৎ ভাষা সংস্কৃতির আধিপত্য প্রতিষ্ঠা পায়। একইভাবে বিষয়-বিভ্রাটও ঘটে। বাঙালির চালু জীবনবিন্যাস ও হাজার বছরের চর্চিত লোকঐতিহ্য অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেল। এভাবেই বঙ্কিমচন্দ্র কাহিনি বিবরণের গদ্যের আর সমস্ত চেষ্টাকে অবান্তর ও অপ্রাসঙ্গিক করে দিলেন ।
মধুসূদন কবিতায় তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী আধুনিকতার বিপরীতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন যেমন, তেমনি, বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী আধুনিকতার বিপরীতে নিজেকে স্থাপন করলেন। মধুসূদনের কাছে ভারতচন্দ্র-ঈশ্বরগুপ্ত ধারাই ছিল কবিতার আধুনিকতার প্রতিপক্ষ। বঙ্কিমচন্দ্রের কাছে আলাল-হুতোমই ছিল উপন্যাসের আধুনিকতার প্রতিপক্ষ। (উপন্যাস নিয়ে, দে’জ পাবলিশিং, দ্বিতীয় সংস্করণ ২০০৩, পৃ ২০)
এই দুই প্রতিপক্ষ আধুনিকতার মধ্যবর্তী ধারাবাহিকতার সংযোগ সেতু নেই। দুর্গেশনন্দিনী যেমন আধুনিক, তেমনি আলালের ঘরের দুলালও আধুনিক। স্বভাবতই প্রশ্নটি ওঠে, বঙ্কিমচন্দ্র তাহলে কোন আধুনিকতা আমাদের দিলেন? ইউরোপীয় আধুনিকতাকে ভারতীয় আধুনিকতার প্রতিপক্ষ করে তুলেছেন একজন ভারতীয়, এই বৈপরীত্যের কোনো একটি সঠিক ব্যাখ্যা কি দাঁড় করানো যাবে? এই বৈপরীত্য কি ভয়ানক আত্মোপহার নয়? এই বৈপরীত্য কি শেষ পর্যন্ত বাংলা উপন্যাসের নিয়তি হয়ে গেল? আর এই কারণেই কি বাংলা উপন্যাসের কোনো ভিত তৈরি হয়নি? যথার্থ উপন্যাস লেখার চেষ্টাতেই থেমে থাকতে হয়েছে। বাঙালির নিজের একটিও উপন্যাস লেখা হয়নি। এই কারণেই কি বাংলা উপন্যাসের কার্যকারণে ধারাবাহিকতা নেই, যা আছে তা মূলত নামপঞ্জির কালানুক্রমিক? বাংলা উপন্যাসের কোনো গ্রাহ্য ফর্ম গড়ে ওঠেনি বলে বা যথার্থ আধুনিকতায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি বলে বঙ্কিমচন্দ্রকেই দায়ী করা চলে? এসব জিজ্ঞাসার সোজাসাপ্টা উত্তর পেয়ে যাই দেবেশ রায়ের কাছে। কোনো প্রকার ঘোরপ্যাঁচ বা দ্বিধার মধ্যে থাকেননি তিনি। স্পষ্টতই বলেন, বঙ্কিমচন্দ্রই দুই আধুনিকতার মধ্যবর্তী ‘খাদ’ তৈরি করেছেন। কলকাতার ইংরেজি শিক্ষিত যুবসমাজের নতুন আত্মজীবনী রচনার পুরো দায় বহন না করে যদি বাংলা কাহিনিগদ্যের একটি ক্ষীণ ধারাবাহিকতা অথবা ক্ষীণ কার্যকারণও রক্ষা করতেন, তাহলে বাংলা উপন্যাসের নিশ্চয় একটি গ্রাহ্য ফর্ম গড়ে উঠত।
আলাল-হুতোমের আধুনিকতা বাঙালির নবোত্থিত জীবনবাস্তবকে ধারণ করার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলছিল। এদের অপরিশীলিত ভাষা শিক্ষিত রুচিশীল মানুষের কাছে ক্রমেই অপভাষা বলে প্রতীয়মান হচ্ছিল। সময়ের বাস্তবতায় তা ঘটতেই পারে। বঙ্কিমচন্দ্রের মতো বিরাট প্রতিভা অবশ্যই বাংলা উপন্যাসের এই ধারাবাহিকতাকে নতুন এক উচ্চতায় পৌঁছাতে পারতেন। বিষয়ের জন্য পেছনে ফিরে গিয়ে নয়, ইংরেজি ফর্ম ব্যবহার করেও নয়, সমসাময়িক জীবনবাস্তবতাকে বিষয় করে, বাংলা কাহিনি-বিবরণে ধারাকেই যদি নতুনভাবে প্রাণ দিতেন, নতুন একটি ফর্ম তৈরি করে নিতেন, অপ্রচল ভাষা ব্যবহার না করে প্রবহমান জনমানুষের দৈনন্দিন ব্যবহারের ভাষাকে সাহিত্যিকরূপ দিতেন অর্থাৎ আলাল-হুতোমের ভাষাকেই প্রমিতরূপ দিয়ে আধুনিক করে বাঙালির জন্য যদি নতুন একটি আত্মজীবনী লিখতেন, তাহলে এতোদিনে বাংলা উপন্যাসের নিজস্ব একটি ঐতিহ্য অবশ্যই গড়ে উঠত বলে দেবেশ রায়ের স্থিরবিশ্বাস।
এখনো পর্যন্ত বাংলা উপন্যাসের আধুনিকতা বলতে ইউরোপের আধুনিকতা দিয়েই মূল্যায়ন করি। নানা উদাহরণ দিয়ে ইউরোপীয় উপন্যাসর সঙ্গে বাংলা উপন্যাসের তুলনা করি। নানাদিক থেকে দেবেশ রায় বাংলা উপন্যাসের নিজস্ব ঐতিহ্য গড়ে না ওঠার পেছনে বঙ্কিমকেই দায়ী করেন। কথাসাহিত্যের সংজ্ঞা, ভাষা, বিষয়, ফর্মের বিকাশ নিরন্তর একটি প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে, পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে, ‘অভাবিত ও অনিশ্চয়তা’ পথে ঋদ্ধ হয়। বাংলা উপন্যাস সেই ‘অভাবিত ও অনিশ্চিত’ বিকাশের পথেই ছিল, বঙ্কিমচন্দ্র সেই সম্ভাবনাকে নষ্ট করেছেন। ইউরোপের প্রতিষ্ঠিত মডেলকেই শুধু গ্রহণ করেননি, নিজে ও পাঠককে একটি নিশ্চিত, নির্ভার, নিঃসংকোচ রাখার উদ্দেশ্যে নিকট-অতীতের অতিচেনা ইতিহাসকে উপন্যাসের বিষয় করেন। পাঠক ও লেখক – দুই দিক থেকেই বঙ্কিমচন্দ্র কোনো প্রকার অনিশ্চয়তা বা শঙ্কা-সংকোচের মধ্যে রাখেননি। বাংলা উপন্যাসের ঐতিহ্য গড়ে না ওঠার পেছনে এটিও বড় রকমের একটি দুর্ঘট। দেবেশ রায়ের ভাষ্যে :
বাংলা উপন্যাসকে সেই অভাবিত ও অনিশ্চিত পথে বিকশিত হতে হচ্ছিল। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র উপন্যাসের বা কাহিনীগদ্যের যে-ধরনটি, যে-ফর্মটি প্রতিষ্ঠিত করলেন তার ভিতরে কোন অনিশ্চয়তা ছিল না, কোনো দ্বিধা বা সঙ্কোচ ছিল না। কারণ তাঁর কাছে ইউরোপীয় উপন্যাসের মডেলটিই ছিল একমাত্র মডেল। সে-রকমভাবে উপন্যাস লিখলেই বাংলায় উপন্যাস হবে, নইলে হবে না – বঙ্কিমচন্দ্র উপন্যাস ফর্ম সম্পর্কে ছিলেন এমনিই স্থিরজ্ঞান ও স্থিতসিদ্ধান্ত। তাই তাঁর প্রথম উপন্যাসই পুরো উপন্যাস। তাই বছরের পর বছর তিনি যে-উপন্যাসের পর উপন্যাস লিখে যান – তাতে উপন্যাসের সংজ্ঞা সম্পর্কে অনিশ্চয়তা বা অনির্দিষ্টতা সচেতনভাবে কাজ করে না। (উপন্যাস নিয়ে, পৃ ২২)
বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা উপন্যাসের আত্মখণ্ডন ঘটিয়েছেন। বাংলা উপন্যাসের আধুনিকতার বিকাশধারাকে গ্রাহ্য না করে বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার না করেই ইউরোপের উপন্যাসের প্রতিষ্ঠিত মডেলকেই বাংলা উপন্যাসের মডেল করে প্রকারান্তরে বাংলা কাহিনিগদ্যের বিকাশের ধারাকে শুধু প্রত্যাখ্যান নয়, বাংলা উপন্যাসের নিজস্ব ফর্ম বা ঐতিহ্য গড়ে ওঠার পথকেও রুদ্ধ করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্রের বিরুদ্ধে দেবেশ রায়ের এসব অভিযোগের কার্যকারণ আছে। অন্তত, বাংলা কাহিনিগদ্যের বিকাশের কথা ভাবলে বঙ্কিমচন্দ্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ গুরুতরই হয় বটে। বাংলা উপন্যাসের কাহিনিগদ্যের নির্ভরতা ভেঙে চরিত্রের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করেন বঙ্কিমচন্দ্র- উপন্যাসের শিল্পতত্ত্বের দিক থেকে এই সত্য নিশ্চিতভাবেই মানেন দেবেশ রায়। এমনকি, বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম তিনটি উপন্যাসের কাহিনি-বিন্যাস বাঙালির কাহিনি স্মৃতিরই অংশবিশেষ। উপন্যাসগুলোর পাঠকপ্রিয়তার কারণ তাই। উদ্দেশ্য ও পরিপ্রেক্ষিত আলাদা হওয়ায়, ফর্ম ও ভাষা আলাদা হওয়ায় তা আর বাংলা কাহিনিগদ্যকে এগিয়ে নিয়ে যায় না।
বাংলা কাহিনিগদ্যে উপন্যাসের নিজস্ব ঐতিহ্য বা ফর্ম গড়ে ওঠার যথেষ্ট উপাদান ছিল- দেবেশ রায় প্রামাণ্য দলিলের মতো তুলে ধরেন। মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্য, চৈতন্যজীবনী, চৈতন্যপরবর্তী পালাগান বা মৈমনসিং গীতিকার কাহিনিগদ্যগুলোতে কাহিনি-বিন্যাস এবং চরিত্র রূপান্তর প্রক্রিয়া প্রায় আধুনিক উপন্যাসকে স্পর্শ করেছে। এইগুলোতে কম-বেশি বাঁধা ছকের অন্তর্ঘাত ঘটেছে। অন্তর্ঘাত ঘটে গেছে চৈতন্যজীবনী ও রাধাকৃষ্ণের কাহিনিতে এবং বৈষ্ণবপালাকীর্তনের আখরগুলোতে। ঔপন্যাসিক অন্তর্ঘাতের উদাহরণের অভাব নেই। পুত্রøেহের কাছে যদি চাঁদ সওদাগর বশ্যতা না মানতেন, তবে হয়তো চাঁদ সওদাগরই হয়ে যেতেন আধুনিক বাংলা উপন্যাসের প্রথম নায়ক। মৈমনসিং গীতিকা কোনো কোনো কাহিনিগদ্যে অনুবাদ করলে পরিপূর্ণ উপন্যাসই হবে। মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গলকে তো অনেকে উপন্যাসই বলেন। উদাহরণের অভাব নেই। মধ্যযুগের এতসব কাহিনিগদ্যের কোনো একটি উদাহরণের দিকেও তাকালেন না বঙ্কিমচন্দ্র! বাংলা উপন্যাসের এই এক ট্র্যাজেডিই বটে।
কাহিনিগদ্যের বিস্তৃত উদাহরণ উপস্থাপন শেষে দেবেশ রায় ফের বঙ্কিমচন্দ্রের কাছেই ফিরে আসেন। ফিরে আসেন উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে সেই সময়টাতে, যখন বাঙালির জীবনে ইংরেজপুরাণ প্রতিষ্ঠিত রূপ লাভ করেছে। বঙ্কিমচন্দ্র উপন্যাস লিখতে গিয়ে এই পুরাণকেই গ্রহণ করলেন। ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালির সমবেত ইচ্ছার সেই পুরাণ বঙ্কিমের একক চেষ্টায় বাঙালির জাতীয় জীবনে আরো দৃঢ় ও মহত্তর হয়। বাঙালির জাতীয় জীবনের পুরাণ- মঙ্গলকাব্য থেকে শুরু করে পালাকীর্তনে মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত লোকপুরাণকে অবজ্ঞা করে বঙ্কিমচন্দ্র ইংরেজি উপন্যাসের নির্দিষ্ট ছককেই বাংলা উপন্যাসের মডেল বা আদর্শ বলে গ্রহণ করলেন। কথাগুলো পুনরাবৃত্তির মতো ঘুরে ঘুরে আসছে। আসছে মূলত একটির সঙ্গে আরেকটির সম্পর্ককে পরিষ্কার করার উদ্দেশ্যেই। তাই, বঙ্কিমচন্দ্রের কাছেই ফিরে ফিরে আসে দেবেশ রায়ের নতুন উপন্যাস খোঁজার মিশন।
ইংরেজি উপন্যাস ইংরেজি ভাষার প্রাক্-উপন্যাসের কাহিনিগদ্যের বিবর্তন-পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে একটি নির্দিষ্ট ছকে এসে পৌঁছেছে। বঙ্কিমচন্দ্র শুধু সেই ছকটিই গ্রহণ করতে পারলেন। ইংরেজি উপন্যাসের উৎসটিকে গ্রহণ করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। প্রকারান্তরে দেবেশ রায় যা বলতে চাচ্ছেন, তা হলো, ইংরেজি উপন্যাসের উৎসের দিকে তাকিয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের কেন বোধোদয় হয়নি যে, বাংলা উপন্যাসের ঐতিহ্য গড়ে তুলতে হলে মধ্যযুগের কাহিনিগদ্যগুলোকেই পরিবর্তনের-বিবর্তনের ভেতর দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
ইংরেজি উপন্যাসের সার্বিক উৎকর্ষতা থেকে একটি ছককে বিচ্ছিন্ন করে বাংলা উপন্যাসে আমদানি করা হয়। এই একটি মাত্র ছকই বাংলা উপন্যাসের বাঁধা ছক হয়ে আছে সোয়াশো বছর ধরে। সময়ে সময়ে পাশ্চাত্যের নতুন মডেলের বাংলা সংস্করণ ঘটেছে মাত্র। অর্থাৎ বাংলা উপন্যাসের আদি-মধ্য বা উৎস নেই, যা আছে তা একটি বিদেশি উপন্যাসের একটি নির্দিষ্ট ও বিচ্ছিন্ন ছক মাত্র। বাংলা উপন্যাসের নিজস্ব কোনো ঐতিহ্য নেই। নিজস্ব কোনো ফর্ম গড়ে ওঠেনি। এই কারণে, বাংলা উপন্যাসের বয়স যত বেড়েছে, নতুন নতুন আধুনিকতা এসেছে, ততোই বাঙালির লোকজীবন থেকে সরে সরে গেছে।
‘আধুনিকতার ভ্রান্তিচেতনা’, ‘আধুনিকতার বিভ্রান্তি’, ‘আধুনিকতার বিভ্রম’. ‘আধুনিকতার সংজ্ঞাবিভ্রাট’ ইত্যাদি নেতিবাচক শব্দযুগল ব্যবহার করে বাংলা উপন্যাসের নির্মিত ঐতিহ্যকে নাকচ করেন দেবেশ রায়। তাঁর মতে, এসবই ঘটে উনিশ শতকের বাংলা উপন্যাসের জন্মের সময়। সোজাসাপ্টা বললে, দেবেশ রায় স্পষ্টতই বলেছেন, বঙ্কিমচন্দ্রের হাতেই ঘটেছে এইসব। সোয়াশো বছরেরও বাংলা উপন্যাস আধুনিকতার সেই ভ্রান্তি, বিভ্রান্তি, বিভ্রম বা বিভ্রাট থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, মানিক, তারাশঙ্কর, বিভূতি, সতীনাথ, কমলকুমার প্রত্যেকেই চেষ্টাতেই থেমে গেছেন। এঁর কেউ-ই কোনো রকমের বিদ্রোহ করেননি। যে রবীন্দ্র-প্রতিভা আধুনিক বাংলা কবিতাকে মাইকেলের ইউরোপীয় মডেল থেকে বের করে বাঙালির নিজস্ব ঐতিহ্যে ফিরিয়েছে- বাংলা কবিতাকে বিশ্বজনীন করেছে- সেই রবীন্দ্র-প্রতিভা উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্রের মডেলের কাছে অর্থাৎ ইউরোপীয় উপন্যাসের প্রতিষ্ঠিত ফর্মের কাছে প্রায় নিঃশর্তভাবেই আত্মসমর্পণ করেছে! চোখের বালি, গোরা, ঘরে বাইরে এইসব উপন্যাস বঙ্কিমচন্দ্রের মডেলরই শাণিত রূপ। বাঙালির আত্মপরিচয়ের সন্ধানে নতুন একটি আত্মবিবরণী তৈরি করেছেন মাত্র। একই আত্মবিবরণী তৈরি করেছেন শরৎচন্দ্রও। বঙ্কিমচন্দ্রের মতো বাঙালিকে ইংরেজ বানানোর চেষ্টা করেননি রবীন্দ্রনাথ। ইংরেজি উপন্যাসের ফর্মকেই ভারতীয় ইতিহাসের সঙ্গে সন্নিহিত করে সমকালীন জীবনের কার্যকারণের সূত্র খুঁজেছেন। তুলনায় শরৎচন্দ্রকে বিদ্রোহী বলে মনে হয়। এই বিদ্রোহের এমনি ঝলক, ধমক ও শাসন ছিল যে, ইউরোপীয় মডেলে শাণিত রূপ রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসগুলো পর্যন্ত তাৎক্ষণিকভাবে বাঙালি পাঠককে টানেনি। খোদ রবীন্দ্রনাথই শরৎচন্দ্রের চোদ্দ বছরের রাজত্বকালে (১৯১৪-২৮) একধরনের স্তম্ভিত বিস্ময় নিয়ে অপেক্ষা করে গেছেন, কী হতে চলেছে? বাঙালির ইংরেজ হওয়ার বিভ্রান্তিকে চ্যালেঞ্জ করে শরৎচন্দ্র বাঙালিকে বাঙালি করার যে-চেষ্টা করেন, সে-চেষ্টা ছিল মূলত আরেক বিভ্রান্তি। কাল্পনিক সাহেবানার বিরুদ্ধে কাল্পনিক বাঙালিয়ানাকে রূপ দিতে গিয়ে ইংরেজি উপন্যাসের ফর্মকেই অন্ধভাবে গ্রহণ করেছিলেন। শক্তিশালী সংলাপ প্রয়োগ করে সেন্টিমেন্টাল নাটকীয়তা তৈরি করেন, যা মূলত ইউরোপীয় উপন্যাসের মডেলের অনুকৃতি।
বস্তুত, ইউরোপীয় উপন্যাসের ফর্মের বাইরে গিয়ে বাংলা উপন্যাসের নিজস্ব ঐতিহ্য তৈরি করা সম্ভব; বাংলা উপন্যাসকে একটি নির্দিষ্ট মডেলের সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্তি দিতে হবে; বড় ধরনের বিদ্রোহ করতে হবে; অনাধুনিক বলে বর্জনীয় – এই ধরনের প্রবণতাই দেখা যায় না রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের মধ্যে। বাংলায় উপন্যাস লিখতে হলে বা বাংলা উপন্যাসে আধুনিকতা আনতে হলে এই একটি ফর্ম বা মডেল- ইউরোপীয় মডেল। যে-কারণে বঙ্কিমচন্দ্রকে রবীন্দ্রনাথ বা শরৎচন্দ্র প্রতিপক্ষ মনে করেন না বা অনাধুনিক মনে করেন না, সেই একই কারণে প্রেমেন্দ্র-অচিন্ত্য-বুদ্ধদেবরাও রবীন্দ্রনাথ বা শরৎচন্দ্রকে প্রতিপক্ষ বা অনাধুনিক মনে করেন না। তাদের জানার দরকারই হয় না, রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র বাংলা উপন্যাসকে কতদূর নিয়ে গেছেন অথবা তাঁরা কী করতে পারেননি। কারণ তাঁদের সেখান থেকে শুরু করার প্রয়োজন নেই। আধুনিকতার মানদণ্ড একটিই- কে কত বেশি, কত নিখুঁতভাবে ইউরোপের মডেল গ্রহণ করতে পারেন। তাই বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ-শরৎ কোনো বিবেচ্য বিষয়ই নয়, মূল্যায়নেরও বিষয় নয়। তাদের বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে ভার্জিনিয়া উলফ, জেমস জয়েসরা। একইভাবে, বাংলা উপন্যাসের ঐতিহ্যকে রাশিয়ায় প্রতিষ্ঠিত সমাজতন্ত্রের দার্শনিক ব্যাখ্যা ও রাজনৈতিক ব্যাখ্যার অনুবর্তী করে গড়ে তোলার চেষ্টা ছিল মার্কসবাদী ঔপন্যাসিকদের মধ্যে। এই চেষ্টাও ফলবতী হয়।
দেবেশ রায়ের নতুন ধরনের উপন্যাস খোঁজার মিশন শরৎচন্দ্র পর্যন্ত সরলরৈখিকই বটে। বাংলা উপন্যাসের জন্মবিভ্রাট অথবা আধুনিকতার সংজ্ঞাবিভ্রাট তিরিশের দশকের আরেক পাঁক তৈরি করে। দেবেশ রায়ের নিজের তৈরি আধুনিকতায় অথবা আধুনিকতার ধারণা তিরিশের দশকে এসে হোঁচট খায়। যে সংজ্ঞায় তিনি বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রকে ফেলেন, একই সংজ্ঞায় আর মানিককে ফেলতে পারেন না। একইভাবে ফেলতে পারেন না তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ ও সতীনাথ ভাদুড়িকে। এসব শক্তিমান কথকরা বাংলা উপন্যাসের প্রচলিত আধুনিকতার বাইরে প্রায় বিকল্প এক অনাধুনিকতাকে গ্রাহ্য করে তুলেছেন। গ্রাহ্য করে তুলেছেন মাত্র কিন্তু প্রতিষ্ঠা দিতে পারেননি। দেবেশ রায় যথেষ্ট জোরের সঙ্গেই বলেছেন, এঁরা ইউরোপের ফর্ম ভেঙে ফেলেছিল প্রায়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারেননি। যতটা পেরেছেন তা স্থায়ী করতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিগত সিদ্ধিতেই সমাপ্তি ঘটে। মানিক সর্ম্পকে তাঁর বক্তব্য হচ্ছে : ‘এই প্রবল শক্তিমান ঔপন্যাসিকের জন্যে কোনো ইউরোপীয় মডেল প্রয়োজন হয়নি- তিনি সেই মডেলকেও ছাপিয়ে গিয়েছেন তাঁর ঔপন্যাসিক কল্পনার তুঙ্গগতিতে কিন্তু মানিকের উপন্যাসের মানুষজন তাদের সম্পর্ক গড়ে তোলে ইউরোপীয় উপন্যাসের তৎপরতার নিয়মে।’ আর এই ছাপিয়ে যাওয়ার কাজটি মানিক পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসেই প্রবলভাবে সম্পন্ন করেন। পরবর্তীকালে আর তা রক্ষিত হয়নি। পদ্মানদীর নদীর মাঝিতেই প্রথম বাংলা উপন্যাসের নির্দিষ্ট ‘ল্যান্ডস্কেপ’ পাই। কিন্তু মানিকের ক্ষেত্রে এই প্রথমই শেষ হলেও তারাশঙ্কর প্রায় সারাজীবনই একটি নির্দিষ্ট ‘ল্যান্ডস্ক্যাপ’ তৈরির চেষ্টায় ছিলেন। তাই, দেবেশ রায়ের কাক্সিক্ষত বিকল্প আধুনিকতার অবয়ব অনেকটাই রূপ পায় এ-লেখকের কাছে। কবি, তারিণী মাঝি – এরকম কিছু লেখায় বিকল্প আধুনিকতার অনেক উপাদানই আছে। এখানে ধর্মমঙ্গলের গরু-মহিষ, মঙ্গলকাব্যের নদীনালা অথবা ‘প্রাচীন গায়ক-কথকের কণ্ঠস্বর’ ইত্যাদি দেখতে-শুনতে পান। এই প্রাপ্তি ভীষণভাবে প্রাণিত করে তাকে। দুর্ভাগ্য হচ্ছে, এই ধারায় এগোয়নি তারাশঙ্করের মূল সাহিত্যকর্ম। যেখানে সচেতনভাবে বিকল্প আধুনিকতাকে রূপ দিতে গেছেন সেখানেই ঢুকে পড়েন ইউরোপীয় ফর্মে। অর্থাৎ তারাশঙ্কর একটি বিকল্প আধুনিকতার জন্ম দিয়েও শেষ পর্যন্ত স্থায়ী করতে পারেননি। আধুনিকতার বিভ্রান্তি তারাশঙ্করকেও ছাড়েনি। তারপরও তারাশঙ্করই দেবেশ রায়ের নতুন ধরনের উপন্যাস ধারণার সবচেয়ে নিকটবর্তী একজন, যতটা নিকটে মানিক তো ননই, বিভূতিভূষণও নন। প্রকৃতি-অন্বিষ্ট ও শক্তিশালী ঔপন্যাসিক বিবরণের জোরে বাংলা উপন্যাসের আরোপিত মডেল ভেঙে ফেলেন বিভূতিভূষণ। কিন্তু নতুন মডেলে তাঁর প্রকৃতিদর্শনকে ঠাঁই দেওয়া যাচ্ছিল না। প্রতিষ্ঠিত ফর্মেই তা সম্ভব হয়। সমগ্র যুক্তিতর্কে বা আলোচনায় সতীনাথ ভাদুড়িকেই দেবেশ রায় তাঁর নতুন ধরনের উপন্যাসের অগ্রগামী নায়ক ভাবছেন। সতীনাথের জাগরী ও ঢোঁড়াই চরিত মানস উপন্যাস দুটির বিষয় ও ফর্ম দেবেশ রায়কে দারুণভাবে আন্দোলিত করে। সতীনাথই ইউরোপীয় উপন্যাসের মডেলকে প্রত্যাখ্যান করে রামচরিতের মডেল গ্রহণ করে নতুন আধুনিকতার জন্ম দেন। রামচরিতের মডেল শুধু উপন্যাসের কৌশল হিসেবেই গ্রহণ করেননি সতীনাথ, তাঁর বিষয় ও চরিত্রের ভারতীয় এপিকতাকে শিল্পে রূপ দিতে গিয়ে রামচরিতের আধারকে গ্রহণ করা অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু এই নতুন আধুনিকতাবোধের আবিষ্কারে দেবেশ রায় উচ্ছ্বাস ও প্রত্যাশা- দুটিই শেষ পর্যন্ত হতাশাকেই ডেকে আনে আমাদের সামনে। এই আধুনিকতা হঠাৎ বিদ্যুৎ-ঝলকের মতোই- আর পরে চর্চিত হচ্ছে না- কোনো পরিণত রূপ পাচ্ছে না। সতীনাথ বিপ্লবের শুরুটা করেছিলেন, কিন্তু যোগ্য উত্তরসূরির অভাবে নীরবেই থেকে যাচ্ছে। তবে, শেষ পর্যন্ত দেবেশ রায় নতুন উপন্যাসের আশা জাগিয়ে রাখেন নিজের মধ্যে।
আমার কোনো সিদ্ধান্ত নেই। আমি শুধু একজন ঔপন্যাসিকের শিল্পসংকটের কথা ভাবছি এমন কোনো ঔপন্যাসিক যে আজ বা আগামীকাল উপন্যাসের এমন এক ভাষার অধিকার চাইতে পারে যে-ভাষায় তার কথা সত্য মনে হবে, বানানো মনে হবে না। আমি এমন একজন ঔপন্যাসিকের শিল্পসংকটের কথা ভাবছি, যে আজ বা আগামীকাল চাইতে পারে সে যে-বাক্যটি রচনা করবে আর সেই বাক্যের ভেতরে যে-অর্থটি ভরে দিতে চাইবে, তার মাঝখানে একমাত্র সংযোজক হিসেবে সে-ই থাকবে লেখক হিসেবে, কথক হিসেবে; যে কোনো কলোনির প্রজা হিসেবে কলোনির কোনো শিক্ষা তার বাক্যের ভিতরে ভরে দেবে না। আমি এমন একজন ঔপন্যাসিকের কথা ভাবছি যে আজ বা আগামীকাল চাইতে পারে- সে স্বাধীন, তার লেখা স্বাধীন ও সেই লেখায় নিহিত অর্থ স্বাধীন। (উপন্যাসের নতুন ধরনের খোঁজে, পৃ ২১-২২)
আধুনিকতা কী? আধুনিকতার সংজ্ঞা কী? আমরা কি আধুনিক? ইংরেজ আমাদের যে-আধুনিকতায় পৌঁছে দিয়ে গেছে, সেই আধুনিকতা কি আমাদের বাস্তবিকই আধুনিক করেছে, নাকি শেকড়চ্যুতি ঘটিয়েছে? সাহিত্য, ইতিহাস, সমাজ যা-ই আলোচনা করতে যাই না কেন- এই দ্বিধা আমাদের পিছু ছাড়ে না। এই দ্বিধার কারণেই কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে পারি না। এই দ্বিধা দেবেশ রায়কে তুলনামূলকভাবে কম পরাস্ত করেছে। দেবেশ রায় নিজের বক্তব্যের স্বপক্ষে এমন শাণিত যুক্তি, সমৃদ্ধ তথ্য উপস্থাপন, অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেন- বাংলা উপন্যাসের প্রচল ধারণাটিকে এমনভাবে ওলটপালট করেন আর নিজের মতকে প্রতিষ্ঠিত রূপ দেন, সেখানে দ্বিধা অনেকটাই কম।
বাংলা উপন্যাসের নিজস্ব ঐতিহ্য গড়ে উঠবে কিনা? সম্ভব কিনা? সম্ভব হলে কতদিনে সম্ভব? এই জিজ্ঞাসার কোনো সিদ্ধান্ত জানাতে পারেননি দেবেশ রায়। কেন গড়ে ওঠেনি? কীভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল বাঙালির লোকজীবনের গদ্যাখ্যানের ধারা থেকে বাংলা উপন্যাস? কারা কারা চেষ্টা করেছেন, তাঁরা কতদূর পারলেন আর কী পারেননি- ইতিহাসের এই বিষয়গুলোকেই নিজের মতো বিশ্লেষণ করেন নানা যুক্তিতর্ক দিয়ে। তিনি ভবিষ্যৎদ্রষ্টা নন, বাংলা উপন্যাসের ভবিতব্য নির্দেশ করা তাঁর দায়িত্বের মধ্যেও পড়ে না। ঔপন্যাসিক হিসেবে বাস্তব অভিজ্ঞতাই দেবেশ রায়ের মতের পক্ষে যুক্তিতর্কের প্রধান ভিত্তি-এ-কথা মান্য করেও বলতে হবে- তিনি মতের পক্ষে যেসব যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন, সেগুলো এমনভাবে নৈর্ব্যক্তিক ও যুক্তিগ্রাহ্য করে তোলেন যে, বাংলা উপন্যাসের চালু আধুনিকতার বিভ্রান্তির বিপরীতে তাঁর বিকল্প আধুনিকতা ও নতুন ধরনের উপন্যাসের আকাক্সক্ষাকে স্রেফ ব্যক্তির বলে পাশ কাটিয়ে যাওয়া যায় না।
আমার মনে হয়, বাংলা উপন্যাসে আধুনিকতার বিভ্রান্তি নিয়ে বা নতুন ধরনের উপন্যাস খোঁজার পক্ষে দেবেশ রায়ের যুক্তিগুলো ভাবার সময় এসেছে। যখন প্রায় দেড়শো বছরেও বাংলা উপন্যাসে নিজস্ব ঐতিহ্য গড়ে ওঠেনি অথবা উপন্যাসের আধুনিকতাতে বিভ্রান্তি ঘুরপাক খাচ্ছি, তখন দেবেশ রায়ের নতুন ধরনের উপন্যাস খোঁজার বিষয়টি ভাবতেই হবে। তাঁর ভাবনার গ্রহণ-বর্জন হতে পারে কিন্তু নতুন ধরনের উপন্যাস খোঁজার বাস্তবতাকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। এরপরও কিছু বিতর্ক তো থেকেই যাবে। এই বিতর্কে আমার জড়ানো বা না-জড়ানোর প্রসঙ্গ আসছে না। দেবেশ রায়ের বিকল্প আধুনিকতা বা নতুন ধরনের উপন্যাস খোঁজার ধারণাটি সত্যিই কি বাস্তবোচিত? তিনি আধুনিক বাংলা উপন্যাসের ঐতিহ্যকে প্রায় সবটাই নাকচ করে দিচ্ছেন! রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র ব্যর্থ, মানিক-তারাশঙ্কর-বিভূতি কেউই বাংলা উপন্যাসের ঐতিহ্য তৈরি করতে পারেননি। দেবেশ রায়ের এই বক্তব্য মেনে নিলে আরো বাকি অনেক বিষয়কে মেনে নিতে হবে। যেমন : বাংলা উপন্যাসের জন্মবিভ্রাট, আধুনিকতা বিভ্রান্তি, বঙ্কিমচন্দ্রে দায়, রবীন্দ্র-শরৎচন্দ্রের ব্যর্থতা, মানিক-তারাশঙ্কর-বিভূতির ব্যর্থতা, প্রচল ও প্রতিষ্ঠিত আরো অনেক বিষয়কেও মেনে নিতে হবে। এই মেনে নেওয়ার বিষয়টি বড় ধরনের সাহিত্যিক-বিপ্লব ও বড় প্রতিভা ছাড়া সম্ভব নয়। অবশ্য, মেনে নেব কি নেব না সেই সিদ্ধান্তটি আগে ঠিক করে নিতে হবে।

এ বৃত্তান্ত এখানেই শেষ হোক . এই প্রত্যাখ্যানের রাত ধরে…

স ম তুহিন

‘… যার কথার দিকে কান আর কাজের দিকে চোখ রাখতে শুরু করেছে টাউনের লোকজন।’
লোকটি কে ?
লোকটির কথা বলার আগে একজন ঔপন্যাসিককে নিয়ে অন্য লেখকদের বলা-কওয়ার খসড়ার কিছু টুকরো অংশ উপস্থাপন করছি। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন- ‘চরম আধুনিক লেখক বলে মনে হয়’। আর ‘এই আধুনিক সময়ের সম্ভবত সবচেয়ে আধুনিক গল্পকার’– এমন বলেছিলেন মেধাবী এবং প্রভাববিস্তারী সমালোচক অশ্রু কুমার শিকদার।
‘যে-কোনো আক্কেলে মানুষই বুঝবেন- পুরনো একটি সময়, অনেকেরই জানা ঘটনা ও মানুষজন নিয়ে এত জনবহুল ও পৃষ্ঠাবহুল একটি লেখা কত মানুষের কত রকমের সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল। শিল্পকর্মের তেমন কোনো কৃতজ্ঞতার দায় স্বীকার করা অনর্থক। কিন্তু যদি কারো শারীরিক শ্রম নিয়ে থাকি, তা স্বীকার না-করা ঋণখেলাপি। …’ – কৃতজ্ঞাতাজ্ঞাপনের এমন স্টাইলিশ কথনই বলে দেয় সত্যিই তিনি ‘চরম আধুনিক’।
এবার লোকটি সম্পর্কে জানাই। লোকটি যোগেন মণ্ডল, বরিশালের। ‘যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল প্রায় সম্পূর্ণ বিস্মৃত এখন। ১৯৩৭ থেকে ৪৭ এই দশটি বছরে তিনি ছিলেন নমশূদ্রদের অবিসংবাদী নেতা। বাংলার ও ভারতের রাজনীতিতে পরে তিনি প্রধানতম বিসংবাদী নেতা হয়ে ওঠেন। ১৯৪৩-এ খাজা নাজিমুদ্দিনের প্রাদেশিক মন্ত্রিসভায় তিনি ছিলেন। ৪৬-এ পূননির্বাচিত হয়ে সারওয়ারদির মন্ত্রিসভাতেও। ১৯৪৬-এ তিনি মহম্মদ আলি জিন্না কর্তৃক অন্তবর্তী মন্ত্রিসভায় মুসলিগ লিগের প্রতিনিধি মনোনীত হওয়ায় হিন্দু ও মুসলিম দুই জাতেরই শত্রু হয়ে পড়েন। তিনি পাকিস্তানের প্রথম মন্ত্রিসভায় আইনমন্ত্রি ছিলেন। ১৯৫০-এ কলকাতায় চলে আসেন। আম্বেদকর ও যোগেন ম-ল তাঁদের শূদ্রতার কারণে কোনো জাতীয়তাবাদেই গৃহীত হন নি। কিন্তু বহু নিন্দা ও বিরোধিতার পর কংগ্রেসের দলিত-ভোটের জন্য আম্বেদকরকে জাতীয়-আখ্যানের দেবম-লিতে জায়গা করে দেয়। বাংলা বিভক্ত হওয়ায় যোগেন ম-ল সম্পর্কে তেমন কোনো দায় বা ভয় জাতীয়তাবাদীদের ছিল না। তাঁকে তাই ইতিহাস থেকে স-ম্-পূ-র্ণ মুছে দেয়া হয়েছে। তাঁর নাম এখন কোনো স্থানীয় ইতিহাসের ফুটনোটেও থাকে না। (অধ্যায়সূচি : বরিশালের যোগেন মণ্ডল : দেবেশ রায় : দে’জ, কলকাতা : বৈশাখ ১৪১৭, এপ্রিল ২০১০)
যোগেন মণ্ডলের নাম ফুটনোটে না থাকলেও একজন লেখক তাকে উপজীব্য করে ‘ভিন্নতর এক গদ্যস্থাপত্যে উপন্যাসের বৃহৎ নির্মাণ’ করেছেন এক হাজার উনষাট পাতার এক উপন্যাসে। উপন্যাসের নাম ‘বরিশালের যোগেন মণ্ডল’। লেখক দেবেশ রায় !
এতো পাতার উপন্যাসটি কেমন ?
শিবনারায়ণ রায়ের কাছে শুনলে তিনি বলেছিলেন, ‘দেবেশ নিবিষ্টচিত্ত নিপুণতায় প্রায় একটি মহাকাব্য লিখেছেন যা একই সঙ্গে উপন্যাস এবং সমকালীন ইতিহাস, কিন্তু ঐতিহাসিক উপন্যাস নয়।’
‘তিনি কখনো নিজের পুনরাবৃত্তি করেন না।’, ‘বাংলা সাহিত্যে দোসরহীন, তাকে সেই মর্যাদা দিয়েই দেখতে হবে।’
এই হলেন দেবেশ রায়।
দেবেশ রায় !
নামটির সাথে ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ নামটিও সেঁটে আছে এক সীমাহীন সম্মান আর ভালোবাসায়।
বাংলাসহ পৃথিবীর অন্যান্য ভাষার সাহিত্যে বিশেষ কাজের জন্যে অভিজাত পুরস্কার ‘নোবেল’ দেওয়া হয়। তুলনামূলক আলোচনার পর ঐ সব ভাষার কাজের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেও বলতে পারি কবিতা বাদেও বাংলা কথাসাহিত্যে ঐ রকম অন্তত চল্লিশ জনকে ঐ পুরস্কার দেওয়া যেতে পারে / দেওয়া যায়। একটি বাক্যে তিন তিনটি ‘ঐ’ ব্যবহার করেছি। আরো একটি ব্যবহার করছি। চল্লিশ জনের মধ্যে দেবেশ রায়কে অনেক উপরে ঐ পুরস্কারের জন্যে রাখা যায়।
দেবেশ রায় কেমন উপন্যাসের লেখক ?
‘আধুনিক বাংলা-উপন্যাস ঠিক যে যে জায়গায় দূর্বল, … ঠিক সেইখানেই দেবেশের রাজকীয় আধিপত্য।’- পূর্ণেন্দু পত্রী
রাজকীয় আধিপত্য কিংবা আধিপত্যের রাজকীয়তা, রাজস্বিকতা- যাই বলি, ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’র উৎসর্গপত্রটি অল্প রঙে ছোট আঁচড়ের বিশাল এক ক্যানভাস-
(উৎসর্গ :
নন্দনপুর-বোয়ালমারির নিতাই সরকার
ঘুঘুডাঙার আকুলুদ্দিন
বানারহাটের যমুনা উরাওনি
গয়েরকাটার রাবণ চন্দ্র রায়
এই বৃত্তান্ত তারা কোনোদিনই পড়বে না, কিন্তু তিস্তাপারে জীবনের পর জীবন বাঁচবে)
পুরো উপন্যাসখানা না পড়লে জীবন থেমে যাবে না, জীবনের হয়তো বড় রকমের কোনো ক্ষতিও হবে না, তবে যদি কেউ পড়ে- সে জীবনে একবার হলেও জুয়োতে জিতে যাবার আনন্দ পাবে নিশ্চিত।
আর এই উপন্যাসের শেষে পরিশিষ্ট অংশে খানিকটা যেন কৈফিয়তের ঢংয়ে দেবেশ রায় আমাদের জানিয়েছেন এই বৃত্তান্ত শুরু করার কারণ আর শেষ কেনইবা করে দিলেন। এই অংশটুকু যদি কেউ পড়ে তবে সে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ক্যাসিনোতে ডাবলপ্লাস জিতে যাবে, আবারও বলছি নিশ্চিত। তবে, ক্যাসিনোর ভেতরে যাওয়া যাক–
“
এই বৃত্তান্তরচনার যুক্তি ও বৃত্তান্ত সমাপ্তির কারণ
তিস্তাপারের বৃত্তান্ত শেষ হয়ে গেছে।
পাহাড় থেকে সমতলে নামার পর তিস্তার দৈর্ঘ্য ত মাত্র কয়েক মাইল। তাও আবার ভারতীয় ইউনিয়ন আর বাংলাদেশের মধ্যে ভাগ হয়ে গেছে। কিন্তু সেই কয়েক মাইলের মধ্যেই জোতপর্ব, বনপর্ব, চরপর্ব, ফরেস্টের বৃক্ষপর্ব, মিটিং-মিছিলপর্ব, তিস্তা ব্যারেজ পর্ব এই সব নানা ভাগ আছে। এগুলো আসলে নানা চিহ্নও ত বটে। এই সব চিহ্ন রেখে-রেখেই একটা নদী উপন্যাসের ভেতর দিয়ে-দিয়ে বয়ে যায়। এই সব চিহ্ন দেখে-দেখেই আমরা উপন্যাসের ভেতরে প্রবহমাণ একটা নদীকে চিনে নেই।
সেই আদি পর্বের লোকরা অনেকেই অন্ত্যপর্বে তিস্তা ব্যারেজের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিল। আদিপর্বে তিস্তার জলপ্রান্তর আপলচাঁদ ফরেস্টের ভেতর যে-গাজোলডোবা গ্রামে প্রথম এ-বৃত্তান্তে দেখা গিয়েছিল, ঘটনাক্রমে সেই গাজোলডোবাতে সেই আপলচাঁদের ভেতরই তিস্তার ভেতর মৈনাকের মাথা, মানুষের তৈরি মৈনাকের মাথা, জেগে উঠেছে- তিস্তা ব্যারেজ। এতে সত্যি-সত্যি যেন একটি বৃত্ত সম্পূর্ণ হল। একটি বৃত্তান্তের সমাপ্তি ঘটল।
বাস্তবে কিন্তু তেমনটি হয়নি। এ-বৃত্তান্ত লিখবার সময় জুড়ে তিস্তা ব্যারেজের কাজ চলেছে। এখনো সে কাজ শেষ হয়নি। এ-বৃত্তান্তে যখন প্রথম গাজোলডোবা গ্রামে তিস্তার পাড়ে সার্ভের কথা লেখা হয়েছিল, তখন জানাও ছিল না- ঐ গাজোলডোবাতেই তিস্তা ব্যারেজের প্রধান ঘাঁটি হবে। এ বৃত্তান্তে তিস্তা ব্যারেজের উদ্বোধনের কথা যখন লেখা হয়ে ছিল- তখন উদ্বোধন হবে এমন কথা ওঠেই নি। কিন্তু কিছু দিন পরে এই বৃত্তান্তের বর্ণনানুযায়ীই একটি উদ্বোধন-অনুষ্ঠান ঘটেছিল। এ-বৃত্তান্তে কোনো ব্যক্তি বা ঘটনাকে বা ইতিহাসকে নথিভুক্ত করা হয়নি। বরং বারবার এই বৃত্তান্ত থেকে বেরিয়ে গিয়ে কোনো ঘটনা বাইরে কোথাও ঘটে গেছে, হয়ত ইতিহাসও হয়ে গেছে। উপন্যাসের মতই এই সব ব্যারেজও ত একটা সৃষ্টিকর্ম। তাই সৃষ্টির যুক্তিতে এ দুই ঘটনা, এই ব্যারেজ আর এই বৃত্তান্ত, একই জায়গায় ফিরে-ফিরে আসছে। আসছেই যখন, তখন সেইখানে ফিরে আসার আগে এ-বৃত্তান্ত শেষ করা যেত না।
এ বৃত্তান্ত শেষ হওয়ার পর এর আর নতুন কোনো পর্বান্তরও সম্ভব নয়। ব্যারেজ উদ্বোধনের সঙ্গে সঙ্গে এ-বৃত্তান্তের তিস্তা ইতিহাস হয়ে গেল। এখন আর তিস্তা সেই পুরনো তিস্তা থাকল না। এখন প্রকৃতির সেই নদীর পুনর্জন্ম ঘটবে মানুষের হাতে। হিমালয়ের তুষারগলা জল আর মৌসুমি মেঘের বৃষ্টিধারায় তিস্তার জল যতই বেড়ে উঠুক, তা বয়ে যাবে মানুষের নির্দেশিত খাতে, নির্দেশিত গতিতে। তখন চর জেগে উঠবে মানুষের ইচ্ছায়। সে-চরকে সবুজ করে দিয়ে নদী তার পাশ দিয়ে অনুগত বয়ে যাবে- মানুষের তৈরি নিসর্গে। তিস্তা নিয়ে কোনো উপকথা পুরুষানুক্রমে বয়ে আসবে না। তিস্তা ব্যারেজের পর তিস্তার প্রাকৃতিক জীবন শেষ, এখন সে এক মানবিক নদী। তিস্তা তার মানবিক ইতিহাসের পর্বে ঢুকবে। তিস্তাবুড়ি, কুমারী হয়ে উঠবে।
এই ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ সেই প্রাকৃতিক তিস্তার সঙ্গে মানুষজনের সহবাসের রীতিনীতির বৃত্তান্ত। গয়ানাথের সঙ্গে তিস্তার সহবাসের এক রকম রীতিনীতি, নিতাইদের সঙ্গে আর-এক রকম আর সীমান্তবাহিনীর সঙ্গে আরো এক রকম। বাঘারুর রীতিনীতি বলে কিছু নেই। তিস্তা তার নদীস্বভাবে প্রাকৃতিক, সে জল ছাড়া কিছু নয়। বাঘারু তার মানবস্বভাবে প্রাকৃতিক- সে কেবল মানুষ, একজন মানুষ ছাড়া কিছু নয়।
এই বৃত্তান্ত লেখা এখানেই শেষ হল। তিস্তা ব্যারেজ আরো কয়েক বছর পর শেষ হবে। তখন সেই নতুন, মানুষের তৈরি নদীর সঙ্গে মানুষজনের সহবাসের রীতিনীতি একেবারে আমূল বদলে যাবে। কত দ্রুত আর কতটাই আমূল যে তা বদলায়- তা বদলানোর আগে আমরা ধারণাও করতে পারি না, বদলানোর পরও মাপতে পারি না।
ব্যারেজে জল আটকে ফেলায় কত নতুন জমি চাষে আসবে। ব্যারেজ থেকে জল ছাড়ায় কত নতুন জমি চাষে আসবে। দুই নম্বর কচুয়ার সঙ্গে ম-লঘাটের আর কোনো তফাত থাকবে না- সেটা ম-লঘাটের ভেতরই চলে আসবে।
নিতাইদের চরটা বোধহয় থাকবে না- ব্যারেজের অত কাছে অত বড় চর রাখা যাবে না। কিন্তু তার বদলে তিস্তার বাঁয়ে বা ডাইনে তিস্তাকে সরিয়ে এনে নতুন জমি বের করে নিতাইদের নতুন গা বসানো হবে হয়ত। দহগ্রামের ছিটমহলগুলো নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে কথাবার্তা বলে সীমান্তটা শুধু স্থলভাগ দিয়েই চিহ্নিত করা হবে হয়ত!
তিস্তা ব্যারেজের ফলে তিস্তার সঙ্গে গয়ানাথের সহবাসের রীতিনীতি সবচেয়ে বেশি বদলে যাবে। সে পুরনো মামলাগুলির কিছু জিতবে, কিছু হারবে। নতুন মামলাও কিছু করতে পারে। কিন্তু সে-ই সবচেয়ে তাড়াতাড়ি অভ্রান্ত বুঝে যাবে- ব্যারেজের অর্থ কী ? ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে ভাগের মামলায় সে জিতলেও পাবে এক চিলতে জমি আর কয়ে কটা শালগাছ। আর তিস্তা ব্যারেজের ফলে সে পাবে এক জমিতে তিন ফসল। ব্যারেজের নিশ্চিত জল, ব্যারেজের ফলে বন্যার অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি, কেমিক্যাল সার আর ট্র্যাক্টার- সেই তিনটি ফসল খোলানে তুলে দিল বলে। গয়ানাথ পাওয়ার-টিলার কিনে ভাড়া খাটাবে। গয়ানাথের গাই-বলদ কমে আসবে, জমিও হয়ত একটু কমে আসবে, বাঘারুও কমে আসবে- কিন্তু ফলন বাড়বে, বিক্রি বাড়বে, লাভ বাড়বে।
আর, এই ব্যারেজের ফলেই গয়ানাথের কত কাছাকাছি চলে আসবে রাধাবল্লভদের কৃষক সমিতি। গয়ানাথদের সঙ্গে রাধাবল্লভদের ঝগড়া-মারামারি ছিল খাশজমির দখল নিয়ে। পুরনো তিস্তায়, এই বৃত্তান্তের তিস্তায়, ছিল সম্পত্তির জোতদারি। নতুন তিস্তায়, এই বৃত্তান্তের পরের তিস্তায়, শুরু হবে ফলনের জোতদারি। সম্পত্তির জোতদারিতে রাধাবলল্লভদের সঙ্গে গয়ানাথদের সংঘাত ছিল। ফলনের জোতদারিতে রাধাবল্লভরা আর গয়ানাথরা ত সহকর্মী। গয়ানাথের পাওয়ারটিলার ছাড়া রাধাবল্লভদের চলবে না। আবার গয়ানাথের নিজের জমিতেও তিন-চারটি ফসল ফলবে, কৃষক সমিতির ভেস্টজমিতেও তিন-চারটি ফসল ফলবে। গয়ানাথ আর কৃষক সমিতি একসঙ্গে তখন ন্যাশন্যাল হাইওয়ের ওপর বসে- ‘রাস্তা রোকো’ আর ‘জেল ভরো আন্দোলন করবে। আন্দোলনের যে-সব কায়দা রাধাবল্লভদের কৃষক সমিতির জানা আছে, সেই সব কায়দা দিয়ে সরকারের কাছ থেকে কৃষিপণ্যের ‘ন্যায্য’ দর আদায় করার জন্যে গয়ানাথ আর কৃষক সমিতি মিলে আন্দোলন করবে- যেমন করছে উত্তরপ্রদেশে, যেমন করছে মহারাষ্ট্রের ‘খেতকারী’রা।
ব্যারেজের ফলে তিস্তাপারের ফরেস্ট বদলে যাবে, আপলচাঁদ বদলে যাবে। এ-সব ফরেস্ট ত মানুষের পরিকল্পনার ফলে তৈরি হয়নি। প্রচুর প্রচুর বৃষ্টিপাতে আর তিস্তার পলিতে এই তরাই-ডুয়ার্স সেই কবে থেকে ত এমন ঘন বন হয়ে আছে। যত ঘন হয়েছে, তত লম্বা-লম্বা গাছ হয়েছে। এক-একটা শাল, সেগুন, অর্জুন, খয়ের, লাম্পাতি গাছ দশকের পর দশক ধরে বেড়ে উঠেছে। আর সেই ভাবে বড় হতে-হতে স্থায়ী হতে-হতে এই পর্ণমোচী অরণ্য হয়ে উঠেছে প্রাকৃতিক। তা থেকে গাছ কেটে বিক্রি করা হয়েছে। দেশ-দেশান্তরে এখানকার শালগাছের সুখ্যাতি রটেছে। কিছু নতুন গাছ লাগানোও হয়েছে নিশ্চয়ই। কিন্তু আমাদের স্বাধীনতাই ত হয়েছে মাত্র চল্লিশ বছর। শালগাছের একটা বন তৈরি করতে চল্লিশ বছর আর কতটুকু সময়।
ব্যারেজ জল দেবে, ব্যারেজ বন্যা ঠেকাবে- তা হলে এই সব হাজার বছরের পরমায়ুওয়ালা গাছ নিয়ে কী হবে ? এ-সব গাছ উৎপাটিত হয়ে যাবে- তার জায়গায় নতুন গাছ বোনা হবে। সেসব গাছ অত্যন্ত তাড়াতাড়ি বাড়ে, তাড়াতাড়ি পাকে, তাড়াতাড়ি বিক্রি হয়। ইউক্যালিপটাস হয়ত এ-সব বৃষ্টিবাদলের জায়গায় তত ভাল হবে না। কিন্তু অন্য কোনো গাছ আবিষ্কার হবে- নরম গাছ। সে-গাছ থেকে ত স্থানীয় কোনো শিল্পও তৈরি হতে পারে।
বন বদলালে জীবজন্তু বদলে যাবে। হরিণ যদি তার খাবারযোগ্য ঘাস না পায়, তার নাকে যদি অভ্যস্ত গন্ধ না আসে, সে যদি এ বনভূমিতে নিজেকে মিশিয়ে দেবার কোনো আবরণ না পায়, তা হলে সে এখানে থাকবে কী করে । গ-ারের যদি ছায়া না জোটে, ভেজা পচা পাতা না জোটে, গড়াবার মত কাদা না জোটে তা হলে সে তার উদাসীন পা ফেলে-ফেলে কোনো এক দিকে হেঁটে চলে যাবে। হাতিরা দল বেঁধে চলাফেরা করে। শিশু বয়সে দলের সঙ্গে সঙ্গে থেকে শেখে পাহাড়ের কোন পথ দিয়ে নামতে হয়, কোন নদীর পাড় ধরে-ধরে এগতে হয়, কোথায় নদী পেরতে হয়, কোন জায়গায় পাওয়া যাবে স্বাধু চালতার বন, কোথায় আছে বড় বড় কলাগাছ। তারপর নিজে জোয়ান হয়ে তার দলকে সেই পুরুষানুক্রমিক পথেই নিয়ে আসে। কিন্তু এই বনই যদি না থাকে- হাতির পাল কী করে নিজে পথ নির্ণয় করবে। তা ছাড়াও সেই নতুন বনের নতুন গাছ দ্রুত বেড়ে ওঠে, দ্রুত বিক্রি হয়। হাতির পালকে ত আর সে-বনে ঢুকতে দেয়া যায় না। একটা শালগাছের ডাল ভাঙলে আর-একটা ডাল গজাবে। কিন্তু এসব গাছের ডাল ভাঙলে ত আর্থিক ক্ষতি ! নগদ ক্ষতি ! সেই নতুন বনে হাতির পাল পথ বদলাবে।
তিস্তাপারের এই সব বনে বানর খুব বেশি। এত ঘন বনে, এত উচু-উচু গাছে আর এত জমাট জঙ্গলে (‘আন্ডারগ্রোথ’) বানরদের সব দিক থেকেই সুবিধে। তারা একটা এলাকায় গাছ থেকে গাছে চলে যেতে পারে অনায়াসে। গাছেরও খেতে পারে, তলারও কুড়োতে পারে। পাখি আর জন্তু-জানোয়ারদের সঙ্গে তাদের নানা রকম খেলাও চলে। কিন্তু সেই নতুন ফরেস্টে বন ত এত ঘন হবে না – ফরেস্টেরই প্রয়োজনে। সেই নতুন বনে এই জঙ্গলও হয়ত থাকবে না- ফরেস্টেরই প্রয়োজনে। সেই নতুন বনে যে-গাছগুলো দ্রুত বেড়ে উঠবে আর দ্রুত বিক্রি হবে সেগুলোর ডালপালা এতই দামি যে বানরদের সেখানে ছেড়ে দেয়া যায় না !
এই সব ফরেস্টে অজ¯্র পাখি আছে। নতুন পাখি আসে কি না কে জানে কিন্তু পুরনো পাখিদেরই এক বিশাল পৃথিবী তৈরি হয়ে আছে বড়-বড় গাছের সুযোগে। আর ঘন জঙ্গলের সুযোগে আছে নানা ধরনের সাপ, প্রধানত পাইথন। এদের এই বন ছাড়তে হবে।
কিন্তু তিস্তাপরের বৃত্তান্ত যে-এমন আমূল বদলে যাবে- তাতে বাঘারু, মাদারির মা ও মাদারির কী হবে ?
তারা কি গয়ানাথ রাধাবল্লভ-নিতাইদের মত নতুন তিস্তার সঙ্গে, নতুন ফরেস্টের সঙ্গে, নতুন চাষবাসের সঙ্গে মিলেমিশে যাবে ? নাকি, তারা ঐ গণ্ডার, হরিণ, হাতির পাল, বানরের দল, পাখি, সাপদের মত এই বন বদলাবে, এই নদীকে ছেড়ে অন্য কোনো অপরিবর্তিত নদী-তীর খুঁজবে ?
নৃতত্ত্বে অবিশ্যি এর একটা জবাব আছে। বানর থেকে মানুষ হয়ে ওঠার পাঁচ লক্ষ বছর ধরে যেসব মানবগোষ্ঠী নিজেদের নিয়ত বদলাতে বদলাতে এসেছে, তাদের মধ্যে অনেকগুলি গোষ্ঠী সেই আদি মানবসমাজ থেকে আধুনিক মানবসমাজের রূপান্তরের মাত্র হাজার পাঁচেক বছর আর তাল রাখতে পারেনি। তারা সেই পাঁচ হাজার বছরের ভেতরে কেনো একটা স্তরে ঠেকে গেছে। যেমন, আন্দামান-নিকোবরের জারোয়া, উঙ্গি, সেনটিনেল বা কেরালার গুহামানবরা। তেমনি নদী-অরণ্য এই সব প্রাকৃতিক বিষয় বদলে দিয়ে যে-নতুন উৎপাদন ব্যবস্থা তৈরি হচ্ছে, তার সঙ্গে বাঘারু, মাদারির মা ও মাদারি তাল রাখতে পারেনি, তারা ঐ আদি একটা স্তরে আটকে গেছে। এদের জন্যে অর্থনীতিতে একটা নতুন নামও তৈরি করা যায়, ‘উৎপাদন ব্যবস্থার আদিবাসী-উপজাতি’। কিন্তু এরকম নৃতাত্ত্বিক তত্ত্ব বা তুলনা দিয়ে বাঘারু সমস্যা সামলানো যাবে না। অবিশ্যি সমস্যা বলে মেনে নিলে তবে ত সমাধানের কথা আসে। এ-বৃত্তান্তের যে-কোনো পাঠকই অনুমান করতে পারবেন যে এখন নদী যতই বদলাক, ফরেস্ট যতই বদলাক- বাঘারু, মাদারির মা ও মাদারি বদলাবে না। বদলের আগেই আমরা জানি কী বদলাবে আর কী বদলাবে না। কিন্তু নৃতত্ত্বে কি এমন কোনো পদ্ধতি আছে যাতে এরকম আগে থেকে বলা যায় কোন্-কোন্ গােষ্ঠী তাল মেলাতে পারবে না, ও আটকে যাবে ? মাদারির মা আর বাঘারু ত পুরনো উৎপাদন ব্যবস্থারও কেউ ছিল না। তাদের তাই আটকে থাকারও কোনা জায়গা নেই। আর, পুরনো উৎপাদন ব্যবস্থায় তারা কোথাও ছিল না বলেই নতুন ব্যবস্থাতেও তারা কোথাও থাকবে না। মাদারির মা যেখানে আছে, সেখানেই থাকতে-থাকতে ঘাসপাতার সঙ্গে মিশে যাবে। কিন্তু বাঘারু ও মাদারির কী হবে ? এরা দুজনই শেষ পর্যন্ত এই বৃত্তান্তে অমীমাংসিত থেকে যাচ্ছে।
সেদিন বাঘারু স্বাধীন পা ফেলে উদ্বোধন মঞ্চের দিকে হেঁটে আসছিল। স্বাধীন- কারণ, গয়ানাথ তাকে বলেনি ঐ উৎসবে যেতে। স্বাধীন-কারণ, সে তার শরীরে এক দায় বােধ করেছিল এই নদীর ভেতর গজিয়ে ওঠা পাহাড়টার সঙ্গে তার সম্পর্ক কী তা বোঝার। সে এক ঝাঁকিতে গয়ানাথের ঝা-া ফেলে দিযয়ে নদীর ব্যারেজ ও ব্যারেজের প্যান্ডেলের দিকে এগয়। আপলচাঁদ ফরেস্ট ও তিস্তা নদীতে ত এমন কিছু ঘটতে পারে না যা বাঘারুর শরীরনিরপেক্ষ। পাখিদেরও এ-রকমই স্বভাব। কোনো এক মহীরুহের ডালে-ডালে, খোঁদলে-খোঁদলে, কত বিচিত্র জায়গায় কত রকম ভাবে তারা বাসা বাঁধে, জন্ম-জন্মান্তর ধরে সে বাসায় থাকে। একটা পাখির জীবন একটা মহীরুহের তুলনায় ক-দিনের। সেই মহীরুহকে পাখিরা পুরুষানুক্রমিক চেনে। তারপর মহীরুহটি উৎপাটিত হলেও পাখিরা তাদের অভ্যেস ছাড়তে পারে না। তারা আকাশের সেই শূন্যতাটাকেই ডালপালা ভেবে নেয়, উড়ে-উড়ে এসে বসতে চায়। সেখানে যে সত্যি আর গাছটা নেই এটা বুঝতে সেই পাখিগুলোকে দু-এক বর্ষায় ভিজতেই হয়। শরীর দিয়ে তারা জেনে নেয়- পুরনো আশ্রয় আর নেই। তখন নতুন গাছ খোঁজে।
বাঘারু সেভাবেই এগচ্ছিল দক্ষিণ থেকে উত্তরে। যেন সে আছে আর ব্যারেজ আছে আর ব্যারেজের প্যান্ডেল আছে।
এখান থেকে মঞ্চে পৌছুবার কোনো রাস্তা ছিল না। ভি-আই-পিদের গাড়ি রাখার জায়গার পেছনে মিছিলগুলোকে বসাবার ব্যবস্থা- একেবারে ফরেস্টের ভেতর। জঙ্গল বহুদূর পর্যন্ত পরিষ্কার করে দেয়া হয়েছে। বাঘারু সোজা আসছিল। তার পা ফেলায় মুক্তির ছন্দও ছিল হয়ত। তার কাঁধে ঝা-া নেই, হাত-পা ঝাড়া। আপাদমস্তক খোলামেলা। অথচ অতটা নগ্নতাতেও দারিদ্র্য থেকে সে সম্পূর্ণ মুক্ত। বাঘারুকে এখন শালপ্রাংশু বলা চলে। সোজা হাঁটতে হাঁটতে এসে বাঘারু বাঁশের বেড়ায় ঠেকে যায়। ঠেকে গিয়ে বেড়াটা টপকাতে নেয়।
তখন এক পুলিশ এসে তাকে বোঝায় এ-বেড়াটা টপকাতে দেয়া যাবে না। পুলিশটি খুব ভদ্রতার সঙ্গে বাঘারুকে দেখিয়ে দেয় এবং এগিয়ে ও দেয়। বাঘারুকে এখন ডাইনে ঘুরে এই বাঁশের বেড়াটার সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে যেতে-যেতে আবার ফরেস্টের ভেতর ঢুকতে হবে। সেখান থেকেই বক্তৃতা শুনতে হবে। বেড়ার এক পাশে পুলিশ, এক পাশে বাঘারু- একই সঙ্গে পা ফেলে এগিয়ে যায়। তারপর এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পুলিশ আঙুল তুললে দেখাই যায়- ফরেস্টের ভেতর মানুষের অগুনতি মাথা। বাকি পথটুকু বাঘারু একাই যায়। এক জায়গায় বেড়াটা বাঁ দিকে ঘুরেছে। সেখান থেকে লোকজন বসেছে।
বাঘারু প্রথম সারিতেই ঢুকতে যায়।
বাঘারু যেদিক থেকে জনসভায় ঢুকছিল সেদিক থেকে আর-কেউই ঢোকেনি। মঞ্চ থেকে কেউ যদি নেমে এই সভার লোকজনের কাছে আসে, তাকেও ত প্রথম সারিতেই আসতে হবে।
কিন্তু প্রথম সারি ত দূরের কথা ততক্ষণে ত সভার সেই জায়গা মিছিলে-মিছিলে ভরে গেছে। সব মিছিলই এই তিস্তা ব্যারেজের উদ্বোধনে সরকারকে ‘জিন্দাবাদ’ দিতে এসেছে, কিন্তু, প্রত্যেকটা জায়গার মিছিলকে ত আলাদা-আলাদাই রাখতে হবে, থাকতে হবে। এক জায়গার মিছিলের সঙ্গে যদি আর-একটা জায়গার মিছিল মিশে যায় তা হলে ত সবাই হারিয়ে যাবে, একটা বিশৃঙ্খল অবস্থা হবে। ফলে, এক-একটা জায়গার মিছিল এক-একটা জায়গায় গায়ে -গা লাগিয়ে, হাঁটুতে হাঁটু লাগিয়ে বসে আছে প্রায় দেয়ালের মত । বাঘারু ঐ বেড়া ধরে এসে ঐ দেয়ালের ভেতর ঢুকতে যায়। তাকে তাই ঢুকতে হবে, কারণ, বাশের সেই বেড়া ওখানেই বাঁয়ে বেঁকেছে আর বাঘারু ত বেড়া ধরেই এগচ্ছে। কিন্তু বাঘারু ঢুকবেই বা কী করে, ঢুকতে দেবেই বা কে ? তাকে সেটা বুঝতে হয়, ধাক্কা খেতে-খেতে। নানা ভাষায় তাকে একটা কথাই শুনতে হয়, পেছনে যাও, পেছনে যাও, নিজের জায়গায় যাও, নিজের জায়গায় যাও। তাদের সবার বুকে ব্যাজ। তারা বাঘারুর ব্যাজহীন বুকের দিকে তাকায়। বাঘারুর বুকে ব্যাজ লাগানোর মত কাপড় নেই। কেউ রাগ করে তাকে বলে না। কেউ-কেউ ত সহানুভূতির সঙ্গেই তাকে রাস্তা দেখিয়ে দেয়। কিন্তু সবাইই এ-ব্যাপারে প্রায় রাতে গাঁয়ের পাহারাদারদের মত সতর্ক ও সাবধান যে, তাদের মিছিলের ভেতর যেন অন্য কেউ ঢুকে না পড়ে। এই কারণে বাঘারুকে ক্রমেই পেছিয়ে যেতে হয়, ক্রমেই সরে যেতে হয়, ক্রমেই দূরে যেতে হয়।
এই প্রসঙ্গটি এখানেই থাক। যদি এটা বৃত্তান্তের প্রধান অংশের অন্তর্গত হত তা হলে না হয়, ‘বাঘারুর মিছিল প্রবেশের চেষ্টা’ বা ‘মিছিলের বাঘারু-অবরোধ’ এই নামে একটি অধ্যায় লেখা যেত। কিন্তু এখন আমরা এ-রকম কোনো ঘটনার বর্ণনা দিতে পারি না। আমরা শুধু কয়েকটি খবর জানাতে পারি।
বাঘারুকে শেষ পর্যন্ত সেই ফরেস্টের ভেতর ঐ ফরেস্টেরই মত বিরাট জনসভার একেবারে শেষে পৌঁছুতে হয়। ততক্ষণে মাইকে নানা রকম চেঁচামেচি, বক্তৃতা, শুরু হয়ে গেছে। ততক্ষণে, ফরেস্টের ভেতর এই ফরেস্টেরই মত লক্ষ-লক্ষ মানুষ সেই মঞ্চের সঙ্গে গলা মিলিয়ে শ্লোগান দিতে শুরু করেছে। এই বক্তৃতা, এই শ্লোগান আর এই মিছিলের মধ্যে দিয়ে বাঘারু সেই মিছিলের শেষে এসে পৌঁছয়। সেখান থেকে একবার দেখবারও চেষ্টা করে- নদীর ভেতর গজানো সেই পাহাড়ের প্যান্ডেলটা দেখা যায় কি না। প্যান্ডেল ত দূরের কথা- মানুষের মাথারই শেষ দেখা যায় না। বাঘারু একটা গাছে হেলান দিয়ে মাটির ওপর বসে পড়ে। মিছিলের সেই শেষেও বাঘারুর আশেপাশে কিছু লোক ঘোরাফেরা করছিলই। মানে, অত শেষে গিয়েও বাঘারু মিছিলের মাঝখানেই থাকে, অথচ মিছিলগুলো সেখানে অতটা আত্মরক্ষাপ্রবণ নয়। বাঘারু সেখানে শুধু দাঁড়াবারই জায়গা পায় না, ইচ্ছেমত বসারও জায়গা পায়।
কিন্তু বাঘারু ত গয়ানাথের মিছিল ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর এগিয়েছিল তিস্তা নদীর ব্যারেজ ও ফরেস্ট ও তার ভেতরকার মিলটা বুঝে নিতে। একবার বুঝে নিতে। একবার বুঝে নিলেই তার সারা জীবন চলে যায়। কিন্তু শরীর দিযয়ে একবার অন্তত বুঝে নিতে হবে।
অথচ সেই মিছিল আর মিছিল আর মিছিল তাকে ঐ ব্যারেজ ও ব্যারেজের মঞ্চ থেকে এই এতদুরে সরিয়ে নিয়ে এসেছে যেখানে মাইকের আওয়াজ শুধু পৌঁছচ্ছে, সেখান থেকে নদীর বা ব্যারেজের বা মঞ্চের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। মাইকের আওয়াজের ত আর কোনো অর্থ নেই বাঘারুর কাছে। সুতরাং বাঘারু যে-গাছতলায় বসে পড়েছিল, সেই গাছতলাতেই ঘুমিয়ে পড়ে। গাছে হেলান দিয়ে বাঘারু বসেছিল। গাছে হেলান দিয়ে বাঘারু ঘুমিযে পড়ে। ঘুমিয়ে পড়লে মাথাটা আর সোজা থাকে না। বুকের ওপর হেলে পড়ে, না-হয় পাশে হেলে যায়। বাঘারুর মাথাটা ডান পাশে হেলে গেল। সে গাছতলায় গড়িয়ে পড়ে ঘুমায়। শরীরটা তার গাছটাকে এমন ঘিরে থাকে যেন মনে হয় ফরেস্টের ঐ গাছটার গোড়াটা সে আঁকড়ে জড়িয়ে থাকতে চাইছে।
কিন্তু এ-প্রসঙ্গ এখানেই থাক। এটা যদি বৃত্তান্তের প্রধান অংশের অন্তর্গত হত তা হলে না-হয়, ‘আপলচাঁদে বাঘারুর শেষবার ঘুমিয়ে পড়া’ বা ‘বাঘারু ও তার শেষ বৃক্ষ’ এই শিরোনামে একটি অধ্যায় লেখা যেত।
কিংবা, ‘বাঘারুর নিদ্রাভঙ্গ’ বা ‘মিছিলের বাঘারুবর্জন’ নামে আরো একটি অধ্যায়। কারণ, বাঘারু যখন জাগে, তখন সন্ধ্যা উতরে গেছে, কোথাও কোনো মানুষ নেই, আপলচাঁদ আপলচাঁদের মতই নির্জন, বাঘারুর চারপাশে জোনাকি জ্বলছে, একটা পাখি বাঘারুর মাথার ওপরে ডাল বদলায়- প্যাচা হতে পারে, ময়ুরও হতে পারে। বাঘারু দাঁড়ালে বহু দূরে কিছু আলোর সারি দেখতে পায়। বাঘারু সেই আলো দেখেই বুঝতে পারে ব্যারেজ, সেই নদীর ভেতর জেগে ওঠা পাহাড়, পাহাড়ের ওপর বানানো প্যান্ডেল। বাঘারু সোজা সেই আলোর দিকে হাঁটে।
এই হাঁটাটা বাঘারুকে বদলে দিল ? পরে, সে-রকমই মনে হতে পারে, কারণ সে আর ফিরে আসেও নি। কিন্তু এই হাঁটাটা কি মিছিল-মিটিঙের শেষে ঘুমভাঙা থেকে শুরু হল ? এই এখন ? নাকি এটা শুরু হয়েছিল, সেই সকালের দিকেই, যখন গয়ানাথের ঝা-া কাঁধ ঝাঁকিয়ে ফেলে দিয়ে সে গটগটিয়ে হাঁটতে শুরু করেছিল ঐ ব্যারেজ আর মঞ্চের দিকে ? যদি তখন বাঁশের বেড়ার ও পুলিশের বাধা না পেত, যদি তখন মিছিলের বাধা না পেত, তা হলে ফরেস্টের এই এত ভেতর পর্যন্ত ত সে পৌঁছুতই না ! এখন সব, বাধা সরে গেছে, এখন রাত্রি, এখন রাত্রির পাখিরা ডাল বদলায়, এখন বাঘারুকে ঘিরে জোনাকি জ্বলে ও ঝিঝি ডাকে, এখন সেই ব্যারেজের আলোর সারি দেখা যায়, এখন বাঘারু সোজা আপলচাঁদের ভেতর দিয়ে গয়ানাথের বাড়িতে চলে যেতে পারত, কিন্তু তা না গিয়ে বাঘারু সেই সকালের দিকের বাধ্যত ছেড়ে-দেয়া হাঁটা আবার শুরু করে। তখন পথ পায়নি বলে এতক্ষণ ঘুমল। এখন পথ পেয়েছে, এখন যাচ্ছে। বাঘারুকে এরকম ঘুরপথে ত অনেক সময়ই যেতে হয়েছে। নইলে, গয়ানাথ তিস্তার ভেতরে ডোবা জমি তাকে দিয়ে মাপাত কী করে, তিস্তায় ভাসিয়ে দেয়া ফরেস্টের গাছ ডাঙায় তুলে বেচত কী করে। বাঘারুর পথ ত এ-রকমই একটু অদ্ভুত গ্রহণে বাথানের গাইকে প্রসব করানো, রমণ-ইচ্ছুক পাখির ডাক ডেকে ওঠা, জলের ওপর দিয়ে হাটা, শ্রীদেবীর সামনে নাচা। এখন বাঘারুকে জোনাকির মধ্যে দিয়ে সেই ব্যারেজের দিকে হাঁটতে হয়।
কিন্তু এ-প্রসঙ্গ থাক। যদি একটা বৃত্তান্তের মূল অংশের অন্তর্গত হত তা হলে না-হয় ‘জোনাকিসহ বাঘারুর হাঁটা’, বা ‘বাঘারুকে নিয়ে জোনাকিস্রােত’ এই শিরোনামে কোনো অধ্যায় লেখা যেত। বাঘারুকে জোনাকির ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছিল। ফলে, দূর থেকে কেউ দেখলে, দেখত, ফরেস্টময় ঐ জোনাকির মধ্যে বাঘারুর শরীরের আকারের এক অন্ধকার এগিয়ে আসছে। সে-অন্ধকারের গায়েও দুটো-একটা জোনাকি লাগছে বটে কিন্তু তাতে জোনাকির ভেতর অন্ধকার দিয়ে তৈরি বাঘারুকে চিনে নেয়া যায়- আকাশের অবান্তর অত তারা সত্ত্বেও ত নানা তারার অন্তর্বতী অন্ধকার ‘কালপুরুষ’ বা ‘সপ্তর্ষি’ চিনে নিতে ভুল হয় না।
এবার বাঘারু বেড়া টপকায়। কয়েকটা ফ্লাড-লাইট ঐ ব্যারেজের প্যান্ডেলের ওপর ফেলা। বেড়া টপকে সেই আলোর ভেতর দু-চার পা যেতেই দুটো-একটা জায়গা থেকে চিৎকার ওঠে, ‘এই, এই, আরে থামো, এই কোথায় যাচ্ছ ? এই। এই।’
বাঘারু দাঁড়িয়ে পড়ে। এখন ত ফ্লাড-লাইটগুলি তার আপাদমস্তক নগ্ন শরীরের পেছনের ওপর। ঐ ভাবে আলোর বৃত্তে দাঁড়িয়ে বাঘারু কিন্তু দেখে সামনে সেই মঞ্চ। এখন আর মঞ্চের ওপর ঝা-া নেই।
দুজন পুলিশ বন্দুক ঘাড়ে করে ধীরেসুস্থে বাঘারুর দিকে আসে। তাদের শরীরের সম্মুখভাগে ঐ ফ্লাড-লাইটা পড়ে। তারা সামনে এসে বাঘরুকে একবার আপাদমস্তক দেখে ঘাড় হেলিয়ে তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে, বেশ শান্ত নিরুত্তেজ গলায় জিজ্ঞাসা করে, ‘কোথায় যাচ্ছ ?’
বাঘারুও হাতটা বাড়িয়ে দেখায়, ‘ঐঠে যাম, প্যান্ডেলত্ !’
একটি পুলিশ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে বাঘারু প্যান্ডেল বলে কাকে। আর-একটি পুলিশ তখনই অর্ধেক ফিরে বাঘারুকে হাত নাড়িয়ে বলে দেয়, ‘যাও, যাও, এখন ওখানে যাওয়া নিষেধ। মিছিল হারাইছ বুঝি-ই ?’
পুলিশ দুটো প্রায় সম্পূর্ণ পেছন ফিরলে বাঘারু একই জায়গায় দাঁড়িয়ে বলে, ‘না মোর কুনো মিছিল নাই।’ যেন সেই কথাটা শুনলে তাকে যেতে দিতে পারে। এবার একজন পুলিশ খুব জোরে বলে, ‘মিছিল নাই ত বানাও গিয়া। যাও যাও, এখন এখানে ঢোকা নিষেধ।
বাঘারু আর-একবার সেই ফাঁকা কিন্তু রঙিন ঝা-াহীন আলোকিত মঞ্চটা দেখে, তারপর পেছন ফিরে হাঁটা শুরু করে। যেন এদিক দিয়ে যখন ঢোকা গেল না, তাকে আর-এক রকম চেষ্টা করতে হবে। সে আলোর বৃত্তটা যখন প্রায় পেরিয়ে এসেছে, বেড়াটা টপকাবে, তখন পেছন থেকে শোনা যায়, ‘এই, এই, শোনো, এই, আরে এই বাউ, শুইন্যা যাও, এই।’ বেড়ার কাছ থেকে বাঘারু দেখে ঐ পুলিশদুটো কপালের ওপর হাত দিয়ে তাকে খুঁজছে। আলোর পেছনে তাকে দেখতে পাচ্ছে না।
বাঘারু কোনো জবাব না দিয়ে ঐ আলোর সীমায় ফিরে যায়, ঠিক সীমাটিতে, যাতে ওরা তাকে দেখতে পায়। ঢুকে, দাঁড়িয়ে থাকে।
পুলিশদুটোকে এবার অনেকটা হেঁটে তার সামনে আসতে হয়। এই জায়গাটা বালিভর্তি। মঞ্চে প্রবেশের রাস্তা আর সভার সীমার মাঝখানে নো-ম্যানস ল্যান্ড। তাই এখানে আর পাথর ফেলাও হয়নি, গাছও পোঁতা হয়নি। তিস্তার আদি বালি ফ্লাড লাইটে চকচক করছিল।
পুলিশদুটি সামনে এসে দাঁড়ায়। একজন বলে, ‘শুনো। একটা ছোটো ছেলে হারাইয়্যা গিছে। এইখানে আছে। কী চায় বুঝি না। ঐডারে নিয়া যাও ত, ঠিক জায়গায় পৌঁছাইয়্যা দিও, আর কী দেইখবার চ্যাও ত এক পাক দেইখ্যা যাও।’ তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে সেই মঞ্চের দিকে তাকিয়ে ডাকে, ‘এই চ্যাংড়া, এদিকে আয়।’ আবার বাঘারুর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘এক পাক কিন্তু, তার বেশি না। তারপর আবার ঘাড় ঘুরিয়ে সেই ছেলেটির আসার সম্ভাব্য পথের দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলে, ‘তা, তুমিও কি হারাইছ নাকি ? তোমার মিছিল গেল কই ?
‘মোর কুনো মিছিল নাই। বাঘারু জবাব দেয়।
‘একলা আইছ ?’ পুলিশটি আবার জিজ্ঞাসা করে, বাঘারু কোনো জবাব দেয় না। তখন বাঘারু দেখে, মঞ্চের তলা থেকেই যেন, বা, যেন ঐ ব্যারেজের ভেতর থেকেই একটা ছোট ছেলে বেরিয়ে ধীরে-ধীরে এদিকে এগিয়ে আসছে। এই দূরত্ব থেকে বাঘারু অনুমানও করতে পারে না ছেলেটা কত ছোট। কিন্তু ছেলেটি ধীরে ধীরে এই বেশি আলোতে স্পষ্ট হয়। ছেলেটি বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিল। এত তীব্র আলোর দিকে আসতে ক্রমেই সে চোখ কোঁচকায়, তারপর বন্ধ করে ফেলে। পুলিশদুটো বুঝতেই পারে না- ছেলেটি তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সে আসছে কি না দেখবার জন্যে ঘাড়টা ঘোরাতেই দেখে ছেলেটি পাশে দাঁড়িয়ে। তখন তার মাথায় একটা হাত দিয়ে বলে, ‘এই শোন্, এইডা এই মিটিঙের লোক, এইডার সঙ্গে যা, তােকে পৌঁছাইয়া দিব নে।’
বাঘারু ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলে ‘মুই মিটিঙের মানষি না হই।’ পুলিশটা ঠাট্টা করে ওঠে, ‘আ হা হা মণি আমার, আইল্যা ঐ মিটিঙের জায়গা থিক্যা আর এ্যাহন কও, মিটিঙের, লোক না।’ তার পর ধমকের সুরে বলে, ‘যাও, ছেলেডারে নিয়্যা ব্যারেজ-ম্যারেজ কী দেইখব্যা দেইখ্যা রওনা দ্যাও। জলদি।’ ছেলেটির মাথায় হাত দিয়ে পুলিশটি তাকে বাঘারুর দিকে ঠেলে কি ঠেলে না, মাদারি এসে বাঘারুর লম্বা হাতের আঙুলগুলি ধরে, ‘তোমরালা এই ব্যারেজখান দেখিবেন ?’ যেন সেই লোভেই সে বাঘারুর সঙ্গে যেতে রাজি হয়।
এই অংশ যদি মূল বৃত্তান্তের কোনো পর্বের অন্তর্ভুক্ত হত, তা হলে ‘মাদারি-হস্তান্তর’ বা ‘বাঘারু-মাদারি সাক্ষাৎ’ এই শিরোনামে একটা অধ্যায় লেখা যেত। ফ্লাড লাইটের আলো এই ছোট, ঘেরা, বালুভূমিতে যেন ফেটে পড়ছে। সেই আলোর দিকে মুখ করে দাঁড়ালে চারপাশের অন্ধকারকে কঠিন মনে হয়। মঞ্চের ওপর আলো- নির্জন, রঙিন মঞ্চের ওপর। পুলিশদুটি ও মাদারির মাথা থেকে পা পর্যন্ত সম্মুখভাগে আলো। বাঘারুর মাথা থেকে পা পর্যন্ত পশ্চাদ্ভাগে আলো। বাঘারুর সেই শালপ্রাংশু নগ্নতা। মুহূর্তের মধ্যে মাদারি পুলিশের দিক থেকে বাঘারুর হাত ধরে বাঘারুর দিকে চলে আসে। তারও সম্মুখভাগ আবছা হয়ে যায়। মাদারি বাঘারুর হাত ধরে টেনে সেই মঞ্চের নীচ দিয়ে ব্যারেজের দিকে টেনে নিয়ে যায়।
যে-পথে সকালে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, কেন্দ্রের রাষ্ট্রমন্ত্রী ও রাজ্যের অন্যান্য মন্ত্রীরা, নিরাপত্তার কারণে ছড়ানো পাথরের ওপর দিয়ে, মঞ্চের নীচের পর্দা তুলে ব্যারেজে প্রবেশ করেছিলেন, বাঘারুর হাত ধরে মাদারি সেই নিশীথ নির্জনতায় সেই পথ দিয়েই ব্যারেজে ঢোকে আর সঙ্গে-সঙ্গে সেই ব্যারেজের আলোহীন উচ্চতা, নির্জনতা, বিস্তার তাদের যেন গ্রাস করে ফেলে। নিজের চেনাজানা পথের বাইরে এসে হাতির পাল বা একলা বাঘ যেমন থমকে যায়, বাঘারু আর মাদারি তেমনি থমকায়। মাদারি ততটা নয়, বাঘারু যতটা। মন্ত্রীরা যেখানে গ্রুপ ফটোর জন্যে দাঁড়িয়েছিলেন, বাঘারুকেও সেখানেই দাঁড়াতে হয়। মাদারি বাঘারুর কব্জি শক্ত করে ধরে, যেন এখানে আচম্বিতে আত্মরক্ষার প্রয়োজন হতে পারে।
মঞ্চের পেছনে একটি মাত্র অবান্তর আলো। কিন্তু একটা আবছায়া ছড়িয়ে আছে- আকাশ-নদী জুড়ে যেমন থাকে। বাঘারু দেখে- তিস্তা কোথাও দেখা যাচ্ছে না, তারা যেখানে দাঁড়িয়ে সেখান থেকে সোজা তাকালে ওপারের বোদাগঞ্জ ফরেস্টের গাছগুলোকে মনে হচ্ছে তাদের পায়ের অনেক নীচে। এই আবছায়ায় বোদাগঞ্জ ফরেস্টের গাছগুলোকে চেনা যায় না। মনে হয়, ওর কাছাকাছি গিয়ে এই আলো, অন্ধকারের সঙ্গে মিশে গেছে। কিন্তু বাঘারু এ-আকাশের ছায়া-আবছায়া, আলো-অন্ধকার সবই দেখতে পায় ! সে জানে, ওটাই বোদাগঞ্জ ফরেস্ট। তা হলে, তারা কত উঁচুতে উঠে এসেছে, যেখান থেকে ফরেস্টের গাছগুলোকে তাদের পায়ের তলায় দেখা যায় ? কত উঁচুতে ? তিস্তা কোথায় ?
তিস্তাটাকে খুঁজে বের করতেই বাঘরুকে কয়েক পা হেঁটে এগতে হয়। খালি পায়ে পাথরের ওপর হাঁটতে তাদের অসুবিধে হয় না। বাঘারু লম্বা কিন্তু ধীর পা ফেলে- ডাইনে বায়ে ঘাড় ঘুরিয়ে। অথচ তার ডাইনে ও বাঁয়ে ধু ধু আকাশ- সেখানে কী এমন ঘটতে পারে যে বাঘারুকে আত্মরক্ষার ভঙ্গি নিতে হতে পারে ত্বরিত ?
মাদারির কব্জি বাঘারুর হাতে ধরা। বাঘারু জোরে চেপে ধরে ছিল- যেন কোনো কারণে মাদারিকে তার হাত থেকে ছিটকে যেতে হতে পারে, যেন তেমন কোনো টান আচমকা আসতে পারে। বাঘারুর মুঠোর ঐ চাপের ফলেই মাদারির ভেতর টান আচমকা আসতে পারে। বাঘারুর মুঠোর ঐ চাপের ফলেই মাদারির ভেতরও হয়ত বাঘারুর আশঙ্কা সঞ্চারিত হয়ে যায়। সে বাঘারুর পায়ের সঙ্গে লেপ্টে যায়।
কয়েক পা গিয়েই বাঘারু দাঁড়ায়। তারপর ডান দিকে সরে যায় ধীরে ধীরে। ধীরে-ধীরে, প্রায় ব্যারেজের কিনারায় এসে দাঁড়ায়।
‘এইঠে গেট বানাইছে, জল আটকি রাখিছে-’ বাঘারু বলে। আর, সেই নিজের কাছে বলা কথাগুলোও যেরকম উড়ে যায় তাতেই তারা বোঝে তাদের ডাইনে থেকে বাঁয়ে, উত্তর থেকে দক্ষিণে বাতাস ছুটে যাচ্ছে। সেই বাতাসে ভর দিয়ে বাঘারু ঘাড় নুইয়ে দেখে, নীচে, কোন পাতালে জল চিকচিক করছে। বাঘারু আরো খানিকটা তাকিয়ে থেকে দেখে নিতে পারে- আরো অনেক দূর পর্যন্ত জলের অস্পষ্ট চিকচিক। এই একটা স্লুইস গেট দিয়ে জল বের করে উদ্বোধন ঘটানোর জন্যে তিস্তায় নানা স্রােতকে দূর-দূর থেকে ছোট-ছোট বাধ বেঁধে-বেঁধে এই গেটটার সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। বাঘারু সেই বঁধগুলো দেখতে পায় না। সে দেখে, নীচে কিছুদূর পর্যন্ত জলের আবছা তরলতা। দেখে, সে বুঝে উঠতে পারে না তিস্তার স্রােত কোন দিক থেকে কোন দিকে বইছে। বুঝে উঠতে পারে না, তিস্তা কোন পথে কোথায় যাচ্ছে। বাঘারু ত তিস্তার ভেতর থেকে তিস্তা দেখে এসেছে- এখন সে কী করে, এত উঁচু থেকে তলায় তাকিয়ে তিস্তাকে চিনে নিতে পারবে।
বাঘারু কিনারা থেকে সরে আসে। হাতের মুঠিতে ধরা মাদারি এখন তার ডান পায়ের সঙ্গে সেঁটে। বাঘারু এবার উল্টো দিকের কিনারার দিকে চলে।
মাদারি জিজ্ঞাসা করে, ‘ঐঠে জল বান্ধি রাখিছে ?’
‘বান্ধি রাখিছে।’
‘ক্যানং করি বান্ধে জল ?’
‘না জানো-।’
এখন বাতাস তাদের পেছনে। বাঘারু মাদারিকে বাঁ হাতে নিয়ে নেয়- পেছনেই হাত বাড়িয়ে। মাদারি তার বাঁ পায়ের সঙ্গে সেঁটে। এবার আর অতটা কিনারে যায় না বাঘারু, যেন বাতাস পেছন থেকে তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিতে পারে। সে বাঁ হাত আর বাঁ পাটা শরীর থেকে সরিয়ে রাখে। মাদারিকে তলায় নদী দেখতে হয় সেই পায়ের বাধার ওপার থেকে। একটু ঝুঁকি দেবার জন্যে মাদারি বাঘারুর পেছনে হাত দেয় শরীরের ভর রাখতে। সেই ভরটা তাকে বদলাতেও হয়। বাঘারু টের পায়, মাদারি মাঝে-মাঝেই তার পেছনে সেই বাঘের থাবাটার ওপর হাত রাখছে। শেষে, সেখানেই রাখে- বাঘারুর পিচ্ছিল শরীরে ঐ বাঘের থাবার অসমতলে যেন হাতের ভর রাখার সুবিধে।
স্লুইস গেট খুলে জল এই দিক দিয়ে বের করা হয়েছিল। বেশিক্ষণ নয়, জল ছিল না। সেই জল এখন এদিকের নানা জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে-বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার পর যেমন দেখায়। বাঘারু অত উঁচু থেকে অত কিছু দেখতে পায় না কিন্তু জল যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সেটা বুঝতে পারে ।
‘এইঠে জল ছাড়িছে, এইঠে’, বাঘারু নিজের কাছে বলে বুঝে নেয়। কিন্তু ব্যারেজের সেই তলদেশ থেকে চোখ তুলে তাকে তার আনুমানিক তিস্তার ওপর দিয়ে আবছায়ায় চোখ ছড়িয়ে দিতে হয় তিস্তাকে চিনে নিতে। বহু ভাটিতে রাত্রির আকাশের তারাগুলোর ভেতর সে যেন দেখতে পায় তার শরীরের তিস্তাকে। কিন্তু নিশ্চিত হয় না। বাঁ হাতটা আরো পেছিয়ে মাদারিকে আগে সরিয়ে বাঘারু সেই কিনারা থেকে সরে আসে।
মাদারি তার পায়ের সঙ্গে লেপ্টে থেকে জিজ্ঞাসা করে, ‘জল ছাড়েন ক্যানং করি ?’
‘না জানো, না জানো’- বাঘারু ব্যারেজের মাঝখানে এসে দাঁড়ায়।
এখন বাঘারু ব্যারেজের ওপর দিয়ে সামনে তাকিয়ে। ব্যারেজ ধরে সে সামনে এগিয়ে যাবে- তার প্রস্তুতি নেয়, তারপর হাঁটা শুরু করে। মাদারি বাঁ হাতেই ধরা, বাঘারুর বাঁ পায়ের সঙ্গে লেপ্টে। আকাশের ভেতর দিয়ে যেন তারা হাঁটছে। আর, আকাশের সমস্ত বাতাস বাঘরু আর মাদারির শরীরের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। এ-বাতাস অনেক ওপরের বাতাস। এর কোনো আওয়াজ নেই কিন্তু বাঘারু শরীর দিয়ে বোঝে সেই নিঃশব্দ বাতাসের জোর কতটা। ব্যারেজের ওপর তার পা দুটো গেঁথে দিতে চায় কিন্তু ব্যারেজের ওপর পা সেঁটে যায় না। বাঘারু তার হাঁটুটায় ভাঁজ ফেলে, যেন প্রস্তুত হয়ে নেয়, এই বাতাস তাকে উল্টে দিতে গেলেই সে মাদারিকে টেনে নিয়ে বসে পড়বে। গভীর বনের ভেতর যে-প্রস্তুতির ভঙ্গি বাঘারুর শরীরগত, এই ব্যারেজে সেই ভঙ্গিতেই বাঘারু প্রস্তুতি খোঁজে। কিন্তু বনের গভীরতাও তার পায়ের চেনা, ব্যারেজের এই উচ্চতার মুক্তি তার চেনা নয়।
বাঘারু জানে না, ব্যারেজটা কতখানি লম্বা। সে শুনেছে বটে ব্যারেজ শেষ হয়নি কিন্তু কোন পর্যন্ত হলে শেষ তা ত আর সে জানে না। এই বাতাসের ধাক্কা সামলাতে-সামলাতে এই আবছায়া ঠেলে এগতে-এগতে তার মনে হয় সে অনেকদূর এসে পড়েছে। সে আর এগবার সাহস পায় না। বাঘারু সামনে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে । দাঁড়াানোর পর তার দুই পা ফাঁক করে দেয়- আবার সেই প্রস্তুতিতে। বাঘারুকে মাথাটা একটু পেছনে হেলাতে হয়- বাতাসের বেগ সামলাতে বা সামনের দূরত্বের আন্দাজ পেতে।
মাদারি তার শরীরের ভেতর থেকে চিৎকার করে, এইঠে শেষ ? এই ব্যারেজখান ?
‘না জানো।’
মাদারি শুনতে পায় না। সে বাঘারুর বাঁ পা থেকে মাথাটা বের করে এনে আবার চিৎকার করে, ‘এইঠে শেষ ? এই ব্যারেজখান ?’
এবার বাঘারু মাদারিকে পেছন থেকে সামনে টেনে আনে- ‘মোক জোর করি ধরি থাক্- ক্যানং বাতাস !’
মাদারি বাঘারুকে জড়িয়ে ধরে কিন্তু বেড় পায় না। না-পেয়ে ছোট-ছোট হাতদুটো বাঘারুর শরীরে আরো গেঁথে দেয়। তারপর বাঁ হাতটা আলগা করে বাঘারুর পেছনে সেই বাঘের থাবার অসমতলটা খোঁজে যেখানে হাতটা আটকানো যেতে পারে। মাদারি বাঘারুকে চিনে নিয়েছে- তিস্তা বদলে দেয়া এই অজ্ঞাতপূর্ব ব্যারেজের ওপর এই নিশীথিনীতে একসঙ্গে থাকলে যে-দ্রুততায় চিনে নেয়া যায়, চিনে নিচ্ছে। বাঘারু মাদারিকে দুই হাতে তার শরীরে জড়িয়ে ধরে।
মাদারি ঘাড় হেলিয়ে বাঘারুকে জিজ্ঞাসা করে, ‘এইঠে শেষ ? এই ব্যারেজখান ?’
‘না জানো।’
‘এইঠে তিস্তা ? তিস্তা নদী ?
কথাটার জবাব দেবার জন্যেই হোক অথবা নিজেই সে তিস্তাকে খুঁজছে বলেই হোক, বাঘারু ডাইনে বায়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে।
‘না জানো।’
‘তোমরালা তিস্তা নদীখান্ না-চেনেন ?
‘না চিনো।’
‘এইঠে তিস্তা নদীখান্ তুলি দিছে ?
‘না জানো।’
‘নতুন নদী বানাইছে ? এইঠে ?
‘না জানো।’
‘তোমরালা এইঠেকার মানষি না হন ?
বাঘারু জবাব দেয় না।
‘জলুশত্ আসিছেন ?
‘মোর কুনো মিছিল নাই।’ বাঘারু হাতদুটো মাদারির মাথার চুলের ওপর রাখে আর মাদারি এই মিছিলহীন ও নদীহীন সর্বহারা মানুষটিকে মমতায় আরো জড়িয়ে ধরে। তারপর আধা কৌতুকে জিজ্ঞাসা করে, তোমরালা কি মোর নাখান হারি (হারিয়ে গিছেন ?’
বাঘারু খুক করে হেসে ফেলে ।
পেছনে পুলিশের চিৎকার শোনা যায়, ‘এই চইল্যা আইস, টাইম হইয়া গিছে, চইল্যা আইস।’
মাদারি আর বাঘারু ঘুরে দেখে পুলিশ টর্চ ফেলে তাদের ফিরে যেতে বলছে। তারা ফিরে আসতে থাকে।
পুলিশটি তাদের ডেকে ও তাদের ফিরে আসতে দেখেই চলে গিয়েছিল। মঞ্চের তলার পর্দা ঠেলে বাঘারু আর মাদারি যখন সেই তীব্র আলোকিত, ছোট বালুভূমিতে ঢোকে তখন সেখানে আর-কেউ ছিল না। মাদারি বাঘারুকে ছেড়ে দেয়, বাঘারু মাদারির মুঠো আলগা করে দেয়। মাদারি এক পায়ে ভর দিয়ে নাচতে নাচতে সেই বালুভূমি পার হয়। পেছন ফিরে বাঘারুকে ডাকে, ‘আইসেন’। শাদা বালির ওপর তাদের ছায়াদুটো ক্রমেই লম্বা হতে থাকে, শেষে সেই শাদা মাঠের সবটুকু জুড়েই ওদের ছায়াদুটো । যেই তারা আলোর স্তম্ভটা পার হয় অত দীর্ঘ ছায়াদুটো নিমেষে মুছে যায়। ওখানে বাঁশের বেড়া আছে। বাঘারু ও মাদারি সেটা টপকে আপলচাঁদের ভেতর ঢুকবে। তাপলচাঁদে এখন জঙ্গলময় জোনাকি। মঞ্চের নীচ থেকে ঐ ফ্লাডলাইটগুলো পেরিয়ে বাঘারু-মাদারিকে বা সে-সব কিছু দেখা যায় না।
আমরা বাঘারু-মাদারিকে আর অনুসরণ করব না।
বাঘারু তিস্তাপার ও আপলচাঁদ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। মাদারিও তার সঙ্গে যাচ্ছে। যে-কারণে তিস্তাপর ও আপলচাঁদের শালবন উৎপাটিত হবে- সেই কারণেই বাঘারু উৎপাটিত হয়ে গেল। যে-কারণে তিস্তাপার ও আপলচাঁদের হরিণের দল, হাতির পাল, পাখির ঝাঁক, সাপখোপ চলে যাবে- সেই কারণেই বাঘারু চলে যায়। তার ত শুধু একটা শরীর আছে। সেই শরীর এই নতুন তিস্তাপারে, নতুন ফরেস্টে বাঁচবে না। এই নদীবন্ধন, এই ব্যারেজ, দেশের অর্থনীতি বদলে দেবে, উৎপাদন বাড়াবে। বাঘারুর কোনো অর্থনীতি নেই। বাঘারুর কোনো উৎপাদনও নেই। বাঘারু এই ব্যারেজকে, এই অর্থনীতি ও এই উন্নয়নকে প্রত্যাখ্যান করল। বাঘারু কিছু কিছু কথা বলতে পারে বটে কিন্তু প্রত্যাখ্যানের ভাষা তার জানা নেই। তার একটা শরীর আছে। সেই শরীর দিয়ে সে প্রত্যাখ্যান করল।
সে এখন সারারাত ধরে এই ফরেষ্ট পেরবে- যেখানে সে জন্মেছিল। দুটো-একটা রাস্তাও পেরবে। কাল সকালে আবার ফরেস্ট পেরবে। দুটো-একটা হাটগঞ্জও পেরবে। কখনো মাদারির ঘুম পাবে। বাঘারু মাদারিকে বুকে তুলে নেবে। কখনো মাদারি বাঘারুর আগে-আগে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে-দিয়ে রাস্তা বানাবে। মাদারিও ত আর-এক ফরেস্টের সন্তান। এ-রকম হাঁটতে-হাঁটতে যখন বাঘারুর মনে হবে নতুন একটা ফরেস্ট, নতুন একটা নদী খুঁজে পেল, তখন বাঘারু থামবে। সেই নতুন নদী, নতুন ফরেস্টটা বাঘারু এই শরীর দিয়েই চিনবে। বাঘারু জানে না- মাদারি কে, সে কোথায় থাকে, সে কেমন করে ফেরত যাবে। কিন্তু পাঠক ত জানেন—মাদারি কে, সে কোথায় থাকত। এখন, সারারাত, সারা দিন ফরেস্টের পর ফরেস্ট, নদীর পর নদী, হাটের পর হাট পেরতে-পেরতে তাদের কত কথা হবে, তারা দুজন-দুজনকে কত জানবে, তাদের কতবার ঘুম পাবে আর কতবার জাগরণ ঘটবে, তারা দুজন দুজনের পক্ষে কত অপরিহার্য হয়ে উঠবে। সে ত আর-এক স্বতন্ত্র বৃত্তান্ত।
এ বৃত্তান্ত এখানেই শেষ হোক।
এই প্রত্যাখ্যানের রাত ধরে বাঘারু মাদারিকে নিয়ে হাঁটুক, হাঁটুক, হাঁটুক…
”
দুশ আঠারো অধ্যায়ে তিস্তাপারের বৃত্তান্ত শেষ হয়েছে। অন্ত্যপর্বের শেষ অধ্যায়ও বলা হয়েছে এই অধ্যায়টিকে। কেনো তবে পরিশিষ্ট অংশটিকেও আলাদাভাবে একটি অধ্যায় (দুশ উনিশ) হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। হোক কৈফিয়তের মতো করে বলেছেন কেনো এই বৃত্তান্ত শেষ করতে হয়েছে। তবে কি আমরা এ অধ্যায়টিকেও উপন্যাসের অংশ হিসেবে ধরে নেবো ?


শুভ্র আহমেদ
সংখ্যা সম্পাদক
https://mexicopharmacy.store/# best online pharmacies in mexico
Heya i’m for the first time here. I came across this board and I to find It really useful & it helped meout a lot. I hope to provide one thing back and aid others such as you helped me.
best india pharmacy cheapest online pharmacy india top 10 pharmacies in india
A big thank you for your blog post.Really looking forward to read more. Much obliged.
highest rated canadian pharmacies: buy prescription drugs online – reputable canadian mail order pharmacy
generic modafinil – order provigil generic modafinil
fda approved online pharmacies: Online pharmacy USA – the best canadian online pharmacy
Thanks, Good information!top 10 essay writers creative college essay phd writers
I just like the helpful info you provide on your articles. I’ll bookmark your blog and test once more here frequently. I’m slightly certain I’ll be informed many new stuff proper here! Best of luck for the next!
https://ordermedicationonline.pro/# canadian pharmacy cialis cheap
Hi to every one, it’s actually a nice for me to visit this site, it consists of priceless Information.
A round of applause for your blog.Thanks Again.
canada drug: legal drugs buy online – canadian drug store
top 10 online pharmacy in india: best india pharmacy – best online pharmacy india
A big thank you for your article.Thanks Again. Much obliged.
generic chloroquine biden hydroxychloroquine
Its like you read my mind! You seem to know so much about this, like you wrote the book in it or something. I think that you could do with some pics to drive the message home a bit, but other than that, this is great blog. An excellent read. I’ll definitely be back.
http://mexicopharmacy.store/# mexican rx online
best online pharmacies in mexico best online pharmacies in mexico buying from online mexican pharmacy
best india pharmacy: online shopping pharmacy india – pharmacy website india
canada prescription drugs: cheap drugs online – list of legitimate canadian pharmacies
Thanks again for the blog.Really thank you!
https://gabapentin.life/# order neurontin over the counter
Fine way of explaining, and pleasant piece of writing to obtain information regarding my presentation subject, which i am going to deliver in school.
This piece of writing will help the internet viewers for creating new blog or even a blog from start to end.
Aw, this was a really nice post. Finding the time and actual effort to create a very good articleÖ but what can I sayÖ I put things off a lot and never seem to get nearly anything done.
An intriguing discussion is definitely worth comment. There’s no doubt that that you should write more about this subject matter, it might not be a taboo subject but usually people don’t talk about such topics. To the next! All the best!!
Im thankful for the article.Thanks Again. Much obliged.
ventolin 8g: Ventolin inhaler online – buy ventolin online europe
Hi my friend! I wish to say that this post is awesome, great written and include approximately all significant infos. I’d like to peer more posts like this .
https://gabapentin.life/# cheap neurontin online
Wow that was unusual. I just wrote an extremely long comment but after I clicked submit my comment didn’t show up. Grrrr… well I’m not writing all that over again. Anyway, just wanted to say fantastic blog!
wellbutrin 450 mg: Buy bupropion online Europe – price generic wellbutrin
Thanks for sharing, this is a fantastic blog.Thanks Again. Really Great.
At this time I am going away to do my breakfast, after having my breakfast coming over again to read additionalnews.
http://clomid.club/# where buy cheap clomid now
Thanks-a-mundo for the article.Thanks Again. Will read on…
There is definately a lot to learn about this topic. I love all the points you’ve made.
Probably the most stunning and top quality of these objects areoften sold for diamonds.Free Fire Account Free 2021 Garena Accounts And PasswordFree Fire Account Free
paxlovid generic https://paxlovid.club/# buy paxlovid online
There is certainly a lot to learn about this subject. I love all the points you made.
how to buy clomid online: Buy Clomid Shipped From Canada – get cheap clomid price
Some really excellent information, Gladiola I found this. “Someone’s boring me. I think it’s me.” by Dylan Thomas.
Very informative article post.Thanks Again. Really Cool.
http://clomid.club/# buy clomid without prescription
I got this site from my buddy who told me concerning this web page and now this time I am
browsing this web site and reading very informative content here.
Also visit my website … female cosplay costumes
Nice response in return of this matter with solid arguments and describing everything concerning that.
neurontin prescription coupon: generic gabapentin – neurontin 100 mg capsule
wow, awesome post.Really thank you! Want more.
I could not resist commenting. Perfectly written! Kyrstin Ragnar Custer
https://claritin.icu/# buy cheap ventolin online
Major thanks for the blog. Cool.
Major thankies for the blog.Really thank you!
wellbutrin 150 mg generic: buy wellbutrin – wellbutrin zyban
http://wellbutrin.rest/# can you buy wellbutrin without a prescription usa
Great, thanks for sharing this blog. Want more.
https://claritin.icu/# ventolin 4mg tablet
can you get generic clomid: Clomiphene Citrate 50 Mg – can i order generic clomid pill
Thanks a lot for the article.Really looking forward to read more. Fantastic.
migliori farmacie online 2023: kamagra gold – farmaci senza ricetta elenco
comprare farmaci online all’estero Cialis senza ricetta farmaci senza ricetta elenco
comprare farmaci online con ricetta: Avanafil farmaco – farmaci senza ricetta elenco
farmacia online migliore: farmacia online – farmaci senza ricetta elenco
migliori farmacie online 2023: kamagra oral jelly consegna 24 ore – farmacie online affidabili
top farmacia online: kamagra gold – farmacia online miglior prezzo
https://tadalafilit.store/# farmacie online sicure
Fantastic article post.Really looking forward to read more. Much obliged.
farmacia online piГ№ conveniente cialis generico farmacia online piГ№ conveniente
farmacie online affidabili: Farmacie che vendono Cialis senza ricetta – farmacia online più conveniente
farmacie online affidabili: comprare avanafil senza ricetta – farmacie online sicure
b52
Tiêu đề: “B52 Club – Trải nghiệm Game Đánh Bài Trực Tuyến Tuyệt Vời”
B52 Club là một cổng game phổ biến trong cộng đồng trực tuyến, đưa người chơi vào thế giới hấp dẫn với nhiều yếu tố quan trọng đã giúp trò chơi trở nên nổi tiếng và thu hút đông đảo người tham gia.
1. Bảo mật và An toàn
B52 Club đặt sự bảo mật và an toàn lên hàng đầu. Trang web đảm bảo bảo vệ thông tin người dùng, tiền tệ và dữ liệu cá nhân bằng cách sử dụng biện pháp bảo mật mạnh mẽ. Chứng chỉ SSL đảm bảo việc mã hóa thông tin, cùng với việc được cấp phép bởi các tổ chức uy tín, tạo nên một môi trường chơi game đáng tin cậy.
2. Đa dạng về Trò chơi
B52 Play nổi tiếng với sự đa dạng trong danh mục trò chơi. Người chơi có thể thưởng thức nhiều trò chơi đánh bài phổ biến như baccarat, blackjack, poker, và nhiều trò chơi đánh bài cá nhân khác. Điều này tạo ra sự đa dạng và hứng thú cho mọi người chơi.
3. Hỗ trợ Khách hàng Chuyên Nghiệp
B52 Club tự hào với đội ngũ hỗ trợ khách hàng chuyên nghiệp, tận tâm và hiệu quả. Người chơi có thể liên hệ thông qua các kênh như chat trực tuyến, email, điện thoại, hoặc mạng xã hội. Vấn đề kỹ thuật, tài khoản hay bất kỳ thắc mắc nào đều được giải quyết nhanh chóng.
4. Phương Thức Thanh Toán An Toàn
B52 Club cung cấp nhiều phương thức thanh toán để đảm bảo người chơi có thể dễ dàng nạp và rút tiền một cách an toàn và thuận tiện. Quy trình thanh toán được thiết kế để mang lại trải nghiệm đơn giản và hiệu quả cho người chơi.
5. Chính Sách Thưởng và Ưu Đãi Hấp Dẫn
Khi đánh giá một cổng game B52, chính sách thưởng và ưu đãi luôn được chú ý. B52 Club không chỉ mang đến những chính sách thưởng hấp dẫn mà còn cam kết đối xử công bằng và minh bạch đối với người chơi. Điều này giúp thu hút và giữ chân người chơi trên thương trường game đánh bài trực tuyến.
Hướng Dẫn Tải và Cài Đặt
Để tham gia vào B52 Club, người chơi có thể tải file APK cho hệ điều hành Android hoặc iOS theo hướng dẫn chi tiết trên trang web. Quy trình đơn giản và thuận tiện giúp người chơi nhanh chóng trải nghiệm trò chơi.
Với những ưu điểm vượt trội như vậy, B52 Club không chỉ là nơi giải trí tuyệt vời mà còn là điểm đến lý tưởng cho những người yêu thích thách thức và may mắn.
comprare farmaci online all’estero: Farmacie a roma che vendono cialis senza ricetta – farmacia online più conveniente
farmacia online senza ricetta: avanafil generico prezzo – comprare farmaci online con ricetta
alternativa al viagra senza ricetta in farmacia: viagra prezzo – viagra originale in 24 ore contrassegno
https://avanafilit.icu/# farmacia online senza ricetta
farmacia online migliore: avanafil prezzo – farmaci senza ricetta elenco
farmacia online piГ№ conveniente avanafil spedra acquistare farmaci senza ricetta
farmacia online senza ricetta: cialis generico – farmacie online affidabili
farmaci senza ricetta elenco: Dove acquistare Cialis online sicuro – farmacie on line spedizione gratuita
comprare farmaci online all’estero: farmacia online spedizione gratuita – farmacia online
comprare farmaci online all’estero: kamagra oral jelly consegna 24 ore – farmacia online più conveniente
farmacie online sicure: kamagra – acquisto farmaci con ricetta
farmacia online più conveniente: farmacia online miglior prezzo – acquistare farmaci senza ricetta
https://avanafilit.icu/# comprare farmaci online con ricetta
le migliori pillole per l’erezione viagra prezzo farmacia viagra online spedizione gratuita
farmacia online migliore: kamagra oral jelly consegna 24 ore – comprare farmaci online all’estero
There is definately a great deal to learn about this subject.I like all of the points you have made.
farmacie online affidabili: avanafil prezzo in farmacia – farmacie online sicure
When someone writes an piece of writing he/she retains the thought of a user in his/her brain that how a user can understand it. Thus that’s why this piece of writing is outstdanding. Thanks!
comprare farmaci online all’estero: kamagra gel prezzo – farmacie on line spedizione gratuita
I blog frequently and I genuinely thank you for your information. This article has truly peaked my interest. I will take a note of your blog and keep checking for new details about once per week. I opted in for your RSS feed too.
migliori farmacie online 2023: farmacia online miglior prezzo – farmacia online miglior prezzo