আফসার আমেদ (৫ এপ্রিল ১৯৫৯ – ৪ আগস্ট ২০১৮)
উনষাট বছরেই বাংলা সাহিত্যের এক শক্তিশালী কলম আচম্বিতেই থেমেছিল। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতেই আফসার আমেদ তাঁর উপন্যাস ‘সেই নিখোঁজ মানুষটা’–র জন্য সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পান। ১৯৭৯ সালে কিশোর বয়সে ‘পরিচয়’ পত্রিকায় লিখেছিলেন প্রবন্ধ ‘মুসলমান অন্দরে বিয়ের গীত’। তারপরই বেরোয় তাঁর প্রথম গল্প। শুরু থেকেই আফসার যেন এক পরিণত লেখক। জিন্নত বেগমের বিরহ মিলন, ডিপ টিউবওয়েলের দাম কত— এমন গল্প লিখতে লিখতেই প্রথম উপন্যাস ‘ঘরগেরস্তি’। শানু আলির নিজের জমি, আত্মপরিচয়, ব্যথা খুঁজে আনা, স্বপ্নসম্ভাষ প্রভৃতি উপন্যাসের পর আফসার প্রবেশ করেন তাঁর কিস্সা সিরিজে। ‘বিবির মিথ্যা তালাক ও তালাকের বিবি এবং হলুদ পাখির কিস্সা’ লিখে বাংলা সাহিত্যে সাড়া ফেলে দেন। একের পর এক কিস্সা তিনি লিখে চলেন। মুসলমান জীবনের অন্দরের প্রত্যাশা, প্রত্যাখ্যান, স্বপ্ন, আলো ও অন্ধকার আফসারের লেখায় এক সম্পূর্ণ ভিন্ন গদ্যে ফুটে উঠেছে। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর পাঠ নেন। কাজ করতেন পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমিতে। লিখতেন প্রধানত লিটল ম্যাগাজিনে, তবে বাংলা ভাষার সমস্ত বিখ্যাত কাগজেই তাঁর লেখা বেরিয়েছে। পেয়েছেন ছোট গল্পের জন্য সোমেন চন্দ স্মারক পুরস্কার, বঙ্কিম পুরস্কার ছাড়াও আরও অজস্র পুরস্কার ও সম্মান।

পিতা : খলিলুর রহমান
মাতা : আরফা বেগম
স্ত্রী : নাসিমা বেগম
সন্তান : পুত্র- শতাব্দ আমেদ । কন্যা- কুসুম হিয়া
জন্মস্থান : কড়িয়া, বাগনান, হাওড়া
কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ।
পশ্চিমরঙ্গ বাংলা আকাদেমিতে খণ্ডকালীন কাজ ।
১৯৯৫-এ ভারত সরকারের মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের সাংস্কৃতিক শাখা থেকে ফেলোশিপ দেওয়া হয়,
একটি লেখার জন্য। ২০০৩ সালে উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ‘মেটিয়াবুরুজে কিসসা’ নামে ।
ম্যানগ্রোভ সাহিত্য-র নিবেদন–


আফসার আমেদ এক উদার মানবিক লেখক
অমর মিত্র
আমি আর আফসার আমেদ একসঙ্গে জমি কিনেছিলাম পাশাপাশি থাকব বলে। কিন্তু আমাদের কারওরই থাকা হয়নি। ও চলে গেছে বাগনানে, পৈতৃক ভিটেতে। আমি বাড়ি করেছিলাম, কিন্তু সেই বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছি, যেহেতু দু’জনে একসঙ্গে থাকা হল না। আফসার আমার অনুজপ্রতিম। আমাদের যোগাযোগ, বন্ধুত্ব আগের মতোই আছে। আমার অনুজ, আমার বন্ধু আফসার এ বছর (২০১৮) সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পাওয়ায় আমি খুশি। খুবই ভালো খবর। ‘সেই নিখোঁজ মানুষটা’ উপন্যাসের জন্য তাঁর এই পুরস্কারপ্রাপ্তি। সাহিত্যে নিবেদিতপ্রাণ আফসার সেই অর্থে কোনও স্থায়ী চাকরি করেনি কোনও দিন। সাহিত্যই তাঁর ধ্যানজ্ঞান। আফসার মূলত ছোট অবাণিজ্যিক কাগজের লেখক।
বাস্তব, পরাবাস্তবের ভেতর অনায়াস যাতায়াত আফসারের লেখার বৈশিষ্ট্য, যা পুরস্কৃত উপন্যাসেও রয়েছে। অনেক দিন আগে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া একটি শিক্ষিত মানুষ হঠাৎ গঞ্জে ফিরে আসে। গ্রামবাসীর কাছে যায়। বিড়ম্বিত গ্রামবাসীদের নানান বিড়ম্বনা নিরসনের উপায় সে বলে দিচ্ছে। দোলাচলের মধ্যে তারা লোকটার আশ্বাসবাণীতে সন্তুষ্ট। তারপর আবার একদিন উধাও হয়ে যায় লোকটি। উপন্যাসটি যেন এক আধুনিক রূপকথা।
সদ্য যুবক আফসার আমেদ ১৯৭৮ সাল নাগাদ ‘পরিচয়’ পত্রিকায় আসে একটি লেখা নিয়ে। লেখাটি হচ্ছে ‘বাঙালি মুসলমানের বিয়ের গান’। এই লেখা আফসারকে লেখক হিসেবে চিনিয়ে দেয়। লেখাটি ছেপেছিলেন পরিচয় সম্পাদক দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। লেখাটি পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন দেবেশ রায়, অমলেন্দু চক্রবর্তী। আফসার ততদিনে গল্প লেখা শুরু করে দিয়েছেন। পরিচয়, কালান্তর, বারো মাস, সারস্বত–এ তাঁর লেখা বেরোতে থাকে। ১৯৮০–তে তাঁর প্রথম উপল্যাস ‘ঘর গেরস্তি’ প্রকাশিত হয় শারদীয়া কালান্তর–এ। এই উপন্যাস তাঁকে ভালো লেখক হিসেবে চিহ্নিত করে। এরপর চাকরি করে কয়েক বছর ‘প্রতিক্ষণ’–এ। সেই সময় সে একটা বড় কাজ করেছিল। দেবেশ রায়ও তখন যুক্ত প্রতিক্ষণ–এর সঙ্গে। জীবনানন্দ দাশের রচনাবলি খণ্ডে খণ্ডে সম্পাদনা করছেন। আফসারের ওপর ভার পড়েছিল জাতীয় গ্রন্থাগার থেকে জীবনানন্দর যাবতীয় লেখা কপি করে নিয়ে আসার। এই কাজটা তাঁর কাছে ছিল একটা বড় অভিজ্ঞতা।
উর্দু কবি কলিম হাজিখের সঙ্গে যৌথভাবে উর্দু উপন্যাস অনুবাদের জন্য ২০০০ সালে আফসার পেয়েছিল সাহিত্য আকাদেমির অনুবাদ পুরস্কার। তাঁর ‘আত্মপরিচয়’ উপন্যাস হচ্ছে একটি ধনী মুসলমান পরিবারের বধূহত্যা দিয়ে। সে এক ভয়ঙ্কর লেখা। বাঙালি মুসলমান সমাজের অন্তঃপুরের কথা বের করে নিয়ে আসে সে। এই উপন্যাসের পর সে আরও খ্যাতিমান হয়। বইপাড়ায় বাঁধাই ও অন্য কর্মীদের একদিন প্রতিদিনের দুঃখকথা ধরা আছে তার ‘খণ্ড বিখণ্ড’ উপন্যাসে। মৃণাল সেন তাঁর ‘ধানজ্যোৎস্না’ উপন্যাস অবলম্বনে করেছিলেন ‘আমার ভুবন’ ছবিটি। বলতে হয় তাঁর কিস্সা সিরিজের কথা— ‘বিবির মিথ্যা তালাক, তালাকের বিবি ও হলুদ পাখির কিস্সা’— এরকম ৬টি কিস্সা লিখেছে আফসার। এই কিস্সা সিরিজ বাংলা উপন্যাসে একটি আধুনিক যাত্রাপথ, যা আফসারই খুঁজে বের করেছে। প্রচলিত লোককাহিনী, কিংবদন্তি, নানারকম কিস্সা— এগুলোকে অসম্ভব ভালোভাবে ব্যবহার করেছে। যা পড়ে সিরাজদা (সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ) তাঁর মুগ্ধতার কথা বলেছিলেন আমাকে। আফসার আমেদ এক উদার মানবিক লেখক এবং নিম্নবর্গের মানুষ, মুসলমান সমাজের অসামান্য রূপকার।
আজকাল অনলাইন : কোলকাতা

আফসার ও তার একটি গল্প
স্বপ্নময় চক্রবর্তী
আফসার বয়সে আমার চেয়ে অনেকটাই ছোট, কিন্তু আমরা ছিলাম সহযাত্রী। ওর লেখার আলাদা একটি চলন বরাবরই ছিল, এবং এ জন্য আমার ভেতরে একটা শ্রদ্ধাও ছিল ওর ওপর। আফসার হঠাৎই চলে গেল। কিছুদিন ধরেই ভুগছিল, এটা সেটা লেগেই ছিল শরীরে। কিন্তু যখন হাসপাতালে ভর্তি হল, জানতে পারলাম ওর ব্যাধি গুরুতর।
আফসার একেবারে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্তরসূরি। লেখায় নয় হয়তো। কিন্তু ওর যাপনে। ওর পরিণতিতে। মানিক অভাবকে সঙ্গে নিয়েই সাহিত্যচর্চা করে গেছেন, আফসারও। ওর এরকম হওয়া উচিত ছিল না। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা অ্যাকাডেমিতে দীর্ঘদিন সেবা দিয়ে গেছে, গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে গেছে, কিন্তু ওর চাকরিটা পাকা হয়নি। অন্য কর্মচারীদের মতো স্কেলও পায়নি। এজন্য যারা দায়ী, তাদের অনুতাপ হয় কিনা জানি না। তবে আমাদের ক্ষোভ হয়। যে অসুখটা ওকে খেল, তার নাম দারিদ্র্য। ওর লেখার মধ্যে দরিদ্র মানুষ থেকেছে, কিন্তু ওর লেখার মধ্যে দারিদ্র্য নেই। লেখাগুলির মধ্যে ঝলকে ওঠা রত্ন আছে। মন্দ্রস্বরও আছে। আজ আফসারকে নিয়ে কিছু লিখতে হচ্ছে। কিন্তু কী লিখব? আফসারের এতগুলি উপন্যাস, দুশোর বেশি গল্প থেকে আমি একটি মাত্র গল্প বেছে নিয়ে তা নিয়ে দুটো কথা বলব।
আফসারের লেখা আমি পেলেই পড়ি না। পড়া সম্ভব নয়, বা পড়ার কোনও মানেই হয় না। ট্রেনে যেতে যেতে পড়া যায় না, সময় কাটানোর জন্য আদৌ উপযুক্ত নয়। হাতে অল্প সময় আছে, একটা গল্প টুক করে পড়ে নেওয়া যাক — এরকম অভীপ্সায় পড়া সম্ভব নয়। গোগ্রাসে পড়া যায় না, দু-একটা লাইন বাদ দিয়ে বাদ দিয়ে হপিং হয় না। সুতরাং আফসারের লেখা পেলেই পড়া হয় না। যখন মনে হয়, লেখাটির প্রতি সুবিচার করতে পারব, তখনই পড়া হয়। আমি আফসারের চার-পাঁচটি উপন্যাস ও ডজন দুয়েক গল্প পড়েছি, যদিও আফসার আড়াইশোর উপর গল্প লিখেছে বলে আমার ধারণা।
আফসারের শেষ গল্প যেটি পড়েছি তার নাম ‘আগাগোড়া আকাশের চাঁদ সঙ্গে নিয়ে’। এটি গ্রাম জীবনের বিজড়িত গল্প নয়। এই গল্পটি আমার হাতের কাছেই ছিল, কিন্তু এই গল্পটি নিয়ে আমার আলোচনা করতে ইচ্ছে করল না। আমি চেষ্টা করলাম যে গল্পটি পড়ে আমি তিরিশ বছর আগে চমকে গিয়েছিলাম সেই গল্পটি খুঁজে নিতে। গল্পটির নাম ‘ডিপ টিউবওয়েলের দাম কত?’ গল্পটি ওর শ্রেষ্ঠ গল্পের সংকলনে আছে। এই গল্পটি আফসার লিখেছিল আশির দশকের প্রথম দিকে। তিরাশি-চুরাশি সালে। ওর বয়স তখন কত কম। চব্বিশ-টব্বিশ হবে। কিন্তু অবাক হয়েছিলাম কী মুন্সিয়ানায় ও ফ্রেমের পর ফ্রেমে লিখিত কথাছবি নির্মাণ করেছে। কিন্তু ছবিগুলি কেবলই ছবি নয়। ছবিগুলি ধারণ করে থাকছে সময়ের সংবেদন। গল্পটির কেন্দ্রীয় চরিত্রের নাম শাকু। পুরো নাম বলেনি। বলার দরকার নেই। একটি বাক্যে শাকুর পুরো পরিচয় দেওয়া হয়। ‘মুক্তার আর লাইলি আর খুকির বাপ, এক পা সরু নসিবার গোরামি কোনচৌকির আড়াই বিঘের চাষি শাকু’। এই আড়াই বিঘে ওর নিজের নয়, সে ভাগচাষি। বলা না হলেও আমরা বুঝি। জমিতে ডিপ টিউবওয়েল বসলে শাকুর জমি হারানোর ভয় আছে। রটনা হয়েছে একটি ডিপ টিউবওয়েল বসবে, ঠিক কোথায় বসবে শাকু এখনও জানে না। এই শাকুর একটি দিন-রাত নিয়ে গল্প। এটা শাকু বা শাকুদের জীবন-নির্বাহের আপাত নির্মোহ ধারাবিবরণীর মধ্য দিয়ে একটি পরিবারের একদিন প্রতিদিনের ভার, ভালোলাগা-ভালোবাসা, ভয়-ভীতির চিত্রভাষ্য তৈরি হয়েছে। বসন্ত রোগের চিহ্ন ধারণ করা মাংসহীন মুখের প্রসন্নতাকে ভাষা দেওয়াটা একটা ম্যাজিক। গরুর এঁটুলি বাছবার মধ্যে, হাঁসকে ঘরে ডাকবার মধ্যে যে বাৎসল্য রস সেটা নিজ সন্তানকে ফেনা ভাত খাওয়ানোর চেয়ে আলাদা — এগুলো দেখতে গেলে পাঠকের মনে একটা আতস কাচের প্রয়োজন হয়, এবং সেটা দেখতে পেলে একটা প্রশান্তি হয়। আফসারের লেখার একটা অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল আণুবীক্ষণিক পর্যবেক্ষণ বা মাইক্রো অবজার্ভেশন। এই সূক্ষ্মতাই একটা রস সৃষ্টি করে। আফসারের লেখার একটা গুণ হল আবেগ নিয়ন্ত্রণ করা। আরও ভালো করে বলতে গেলে নিজেকে গোপন রাখা বা আন্ডারস্টক থাকা। কিছুতেই লেখক প্রকাশ হন না — যেটা বিরল গুণ। আর, আফসার খুব ছোট ব্যাপার যা প্রতীকায়িত হতে পারে সেটা আন্ডারলাইন করতে জানেন, আর বড় ব্যাপার সেটা কম কথায় ছেড়ে দিতে পারেন। এই গল্পটিতে ডিপ টিউবওয়েল এলে উচ্ছেদ হওয়ার সম্ভাবনাজনিত ভয়ের ব্যাপারটা নিয়ে বেশি সময় খরচ করা হয়নি। শাকু কীভাবে কলসি করে জল সেচন করে চলেছে পালং বেগুনের শরীরে, সেটাই বেশি করে বলা আছে। ডিপ টিউবওয়েল এলে জল সেচনের পদ্ধতিটাই পালটে যাবে। ডিপ টিউবওয়েল-পূর্ব সেচনে গাছপালার সঙ্গে বেশি একাত্ম থাকা সম্ভব। কলসি বা ঝারি নিয়ে একটা একটা করে গাছে জল দেওয়া হয়। ডিপ টিউবওয়েল এলে ছোট ছোট নালার মধ্যে দিয়ে মাঠের চারদিকে জল ছড়িয়ে পড়ে। ফলে একজন চাষির সঙ্গে তরুলতা ফুল ফল তথা প্রকৃতির সম্পর্ক পরিবর্তন হয়ে যায়। একটা দূরত্ব তৈরি হয়। টেকনোলজির সঙ্গে সমাজ সম্পর্ক পরিবর্তনের ব্যাপারটা অনেক সূক্ষ্ম ব্যাপার। আফসারের এই গল্পে এখানেই আন্ডারলাইন করা হয়েছে মনে হয়। তাই টেকনোলজিকে প্রশ্ন করা হয় — তুমি কতটা দামী? মানবিক সম্পর্কের চেয়ে তোমার দাম বেশি? এই প্রশ্ন এক সহজ চাষির সরল প্রশ্ন। প্রশ্নটা সহজ, কিন্তু উত্তরটা সহজ নয়। কিন্তু একটা প্রশ্ন আমার কাছে থেকে যায় এর পরেও। আফসার টিউবওয়েল বলল কেন? কেন ডিপটিকল্ বা টিউকল নয়? যেখানে ফেস কাটিংকে ফেমকাটিম বলা হয়েছে, মিটিন, অনছল, সিপিএ্যান, কংরেস, এই সব বলেছে। তবে? গল্পের ভিতরে কিন্তু ডিপটিকল শব্দটা আছে দু’বার। কিন্তু শীর্ষনামে ডিপটিকল রাখা হয়নি। টিউবওয়েল এই ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রটি রেখে দিয়েছে। এটা কি ইচ্ছে করেই? বোঝবার জন্য — এই নতুন প্রযুক্তি একটি গরীব কৃষিজীবীর কাছে এলিয়েন। এটি ডিপটিকল নয়। এটি ডিপ টিউবওয়েল।

আফসার আমেদ : এক অনন্য কথাকার
ইন্দ্রজিৎ খান
মাত্র ঊনষাট বছর বয়সে মৃত্যু হল আফসার আমেদের। এক অনন্য কথাকার ছিলেন তিনি। লেখার নিজস্ব এক ভাষা ও ভঙ্গি তিনি আয়ত্ত করেছিলেন। একজন লেখককে চেনা যায় তাঁর লেখার বিশেষ এক ধরনের জন্য। এক অন্যরকম গদ্যে তিনি লিখতেন। আফসার আমেদের লেখা পড়লে বোঝা যায় এটা তাঁরই লেখা। তাঁর লেখার ভাষা আর পাঁচজনের মতো নয়, একেবারেই স্বতন্ত্র। এই ভাষা দিয়েই তিনি বুনেছিলেন এক আশ্চর্য গালিচা। আশ্চর্য সেই গালিচায় গল্প, কাহিনী, কিস্সা সব কিছুই জড়িয়েমড়িয়ে আছে। সেই গালিচায় আমরা দেখতে পাই দরিদ্র মুসলিম জনজীবনের ছবি। বাস্তব ও পরাবাস্তবে মেশা সে এক আশ্চর্য জীবনচিত্র। দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত জীবনের গল্প লিখতে লিখতে তিনি চলে যেতেন না-গল্পের দিকে। নিছক কাহিনী বর্ণনা করে যাওয়া তিনি পছন্দ করতেন না। কিছু অনুভূতি, কিছু জীবনচিত্র, কিছু নিসর্গদৃশ্য, কিছু স্বপ্ন এবং জীবনবোধ – ব্যাস এই নিয়েই তিনি লিখে যেতে পারতেন পাতার পর পাতা। তখন সেইসব গল্প বা উপন্যাস নিছক কাহিনীকথন হয়ে উঠত না, তা অন্য এক মাত্রা পেয়ে যেত। বাস্তব থেকে অতি সহজেই পরাবাস্তবে চলে যেতে পারতেন তিনি। যে জীবনের কথা তিনি লিখতেন সেই জীবন খুব কাছ থেকে দেখাই শুধু নয়, সেই জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে তিনি যেন জড়িয়ে রেখেছিলেন নিজেকে। তাই আফসার আমেদের যে কোনো লেখাই আমার খুব জীবন্ত বলে মনে হয়।
খুব কম বয়সেই আফসার আমেদ ঠিক করেন তিনি একজন লেখক হবেন। কালি ও কলম নিয়েই কাটিয়ে দেবেন সারাটা জীবন। একটা সময় যদিও তিনি শুধু লেখার আয় দিয়েই সংসার চালিয়েছিলেন। কিন্তু সেটা বেশি দিন সম্ভব হয়নি। জীবনযাত্রা নির্বাহের জন্য চাকরিও করতে হয়েছিল তাঁকে। যদিও চাকরি করে জীবনে স্বচ্ছলতা আসেনি তাঁর। খুবই দারিদ্রের জীবন কাটাতে হয়েছে তাঁকে। লেখার প্রধান উপকরণ কালি ও কাগজের অভাব ছিল তাঁর। লেখার জন্য অনেকসময় কালির অভাবে মেয়েদের আলতাও ব্যবহার করতে হয়েছিল তাঁকে। এমনকি লেখার কাগজের অভাবে হ্যান্ডবিলের পিছনের দিকটা ও ক্যালেন্ডারের পিছনের সাদা দিকটা তিনি লেখার কাগজ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এতোটাই অভাব ছিল তাঁর গল্প লেখার শুরুর দিনগুলিতে। কিন্তু কোনো প্রতিকূলতাই তাঁকে সাহিত্য রচনা থেকে ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। সংসারে পদচারণা করার চিহ্নের টানে তিনি পেতেন সাহিত্য রচনার ইশারা। এক সাক্ষাৎকারে নিজেই বলেছেন তিনি এই কথা। এই ব্যাপারে মালয়ালাম লেখক ভৈকম মুহম্মদ বশীরের সঙ্গে তাঁর তুলনা করা যেতে পারে। বশীরও তাঁর নিজের জীবনের চারপাশ ও নিজের জীবন থেকে উপাদান সংগ্রহ করে গল্প ও উপন্যাস রচনা করতেন।
সাহিত্যিক অমলেন্দু চক্রবর্তী প্রতিক্ষণ থেকে প্রকাশিত ‘আফসার আমেদের ছোট গল্প’ বইয়ের একটা চমৎকার ভূমিকা লিখেছিলেন। সেই ভূমিকা থেকে জানতে পারি একবার ১৯৭৭ সাল নাগাদ বাগনান বিডিও অফিসের মাঠে এক সাহিত্য আসরে কয়েকজন স্থানীয় যুবকের সঙ্গে বসেছিলেন তিনি। সেই আসরে তিনি শোনেন আফসার আমেদের গল্পপাঠ। দ্বাদশ শ্রেণীতে পাঠরত সেই কিশোরের গল্পপাঠ শুনে তিনি মোহিত হয়ে যান। সেই কিশোরের সঙ্গে আলাপ সেরে বাড়ি ফিরে আসেন তিনি। কিন্তু দিন সাতেক কাটতে না কাটতেই সেই কিশোর ছেলেটি তাঁর বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়। সঙ্গে তার একটা প্রবন্ধ ও একটা মোটা খাতা। ইতিমধ্যেই সেই বালক ঘুরে ঘুরে সংগ্রহ করে ফেলেছে মুসলমান সমাজে প্রচলিত এবং লুপ্তপ্রায় প্রায় দ্বিশতাধিক বিয়ের গান। অমলেন্দু চক্রবর্তী ‘পরিচয়’ পত্রিকার সম্পাদক দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে তুলে দেন আফসার আমেদের ওই খাতাটি। সে বছর বৈশাখ মাসের ‘পরিচয়’ পত্রিকার ‘বিশেষ সাহিত্য সংখ্যা’র প্রথম প্রবন্ধটি ছিল আফসার আমেদের লেখা ‘মুসলমান অন্দরে বিয়ের গীত’। এই হলেন আফসার আমেদ। পরবর্তী জীবনে যিনি অজস্র ছোটো গল্প ও উপন্যাস লিখে পাঠককে চমকে দেবেন।
প্রায় তিনশোর মতো গল্প লিখেছেন আফসার আমেদ। প্রতিটা গল্পই একে অপরের থেকে আলাদা। তাঁর লেখা অজস্র ছোটো গল্পের মধ্যে কয়েকটি হল – ‘পক্ষীরাজের ডানা’, ‘জিন্নত বেগমের বিরহমিলন’, ‘জিন্নত বেগমের দিবসরজনী’, ‘খরা’, ‘গোনাহ্’, ‘হাড়’, ‘দ্বৈরথ’, ‘আদিম’, ‘সুখের নির্মাণ’, ‘বাগদান’, ‘বাসর’, ‘মিলন’, ‘বিরহ’, ‘অভিমান’, ‘কান্না’, ‘ভয়’, ‘আর্তি’, ‘প্রবাসের রূপক’, ‘নিঃসঙ্গতার শর, স্বর’, ‘দ্বিতীয় বিবি আসার প্রথম দিন’, ‘মকসুদা কিছু বলবে না’, ‘এই বসবাসে’, ‘এই দাম্পত্যে’।
উপন্যাসও তিনি লিখেছেন অনেক। ‘ঘরগেরস্থি’ দিয়ে তাঁর উপন্যাস লেখা শুরু। এরপর তিনি লিখেছেন অজস্র উপন্যাস। ‘সানু আলির নিজের জমি’, ‘স্বপ্নসম্ভাষ’, ‘খণ্ড-বিখণ্ড’, ‘প্রেমে অপ্রেমে একটি বছর’,‘অন্তঃপুর’, ‘আত্মপরিচয়’, ‘দ্বিতীয় বিবি’, ‘বসবাস’, ‘ধানজ্যোৎস্না’, ‘ব্যথা খুঁজে আনা’, ‘একটি মেয়ে’, ‘বিবির মিথ্যা তালাক ও তালাকের বিবি এবং হলুদ পাখির কিস্সা’, ‘কালো বোরখার বিবি ও চল্লিশজন লোক এবং কুসুমের গন্ধ’, ‘মেটিয়াবুরুজে কিস্সা’, ‘এক ঘোড়সওয়ার কিস্সা’, ‘হিরে ভিখারিনি ও সুন্দরী রমণী কিস্সা’, ‘হত্যার প্রমোদ জানি’, ‘জীবন জুড়ে প্রহর’, ‘ছায়ারূপ টকিজ’, ‘অশ্রুমঙ্গল’, ‘সেই নিখোঁজ মানুষটা’ ইত্যাদি তাঁর লেখা উপন্যাস। তাঁর কিস্সা সিরিজের উপন্যাসগুলিতে আমরা আবিষ্কার করি এক ভিন্ন গদ্যশৈলী। একই রকম ভাষা ও ভঙ্গিমায় উপন্যাস লেখেননি তিনি। লেখায় লেখায় অনবরত পালটেছেন নিজেকে। তাঁর লেখা এক আশ্চর্য উপন্যাস ‘স্বপ্নসম্ভাষ’। এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র মুনসুর, সে এক জনমজুর, পরে সে রিকশা চালক হয়ে ওঠে। মুনসুরের স্ত্রী ফিরোজা। কিন্তু স্ত্রী তার অসুস্থ, শরীর তার ভেঙে পড়েছে। মুনসুর একদিন দেখে তারই ঘরের পাশে এক তরতাজা যুবতী খোদেজাকে। সম্পর্কে সে তার প্রতিবেশী সাজেদের শালি। মুনু খোনকারের বিবাহিতা স্ত্রী সে। স্বামীর অতাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সে এসেছে তার দিদির বাড়িতে। এখানেই থাকছে সে। মুনসুর মধ্যবয়সী, বড়ো বড়ো ছেলেমেয়ে আছে তার। তবুও সে খোদেজাকে পেতে চায়। সে খোদেজার মধ্যে খুঁজে পায় তার কাঙ্ক্ষিত নারীকে। সে নারী যেহেতু আবার বিবাহিতা তাই তাকে বিয়ে করার জন্য তার চাই ছাড়পত্র। সেই নারীকে নিয়ে চলে মুনসুরের স্বপ্নের বীজ বোনা। কিন্তু সে কি পায় তার সেই নারীকে? একদিন এক আশ্চর্য মেঘ দেখল ফিরোজা। সেই মেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ল। আর সেই বৃষ্টি বাদলের মধ্যেই ফিরোজার শরীরে নতুন করে যৌবন ফিরে আসতে থাকে। তার শরীর ভরে উঠতে থাকে। সেই যুবতী ফিরোজাকে দেখে মুনসুর প্রলোভিত হয়। শহরের ভাড়া করা বাড়িতে, যেখানে সে খোদেজাকে নিয়ে নতুন করে সংসার পাততে চেয়েছিল, সে ফিরোজাকে নিজের রিকশায় চাপিয়ে নিয়ে চলে। বাস্তবের মাটিতে নতুন এক স্বপ্ন দেখতে চায় যেন সে জীবনকে নিয়ে।
আফসার আমেদের এক গল্পের নাম ‘শুধু মাত্র মৃত্যু অপেক্ষায় যাওয়া’। এই গল্পটি বেরিয়েছিল ১৪০০ বঙ্গাব্দের শারদীয় ‘প্রতিদিন’ পত্রিকায়। গল্পটির বিষয়বস্তু খুবই সাধারণ। একজন যুবককে এসএসকেএম হাসপাতালে রাত কাটাতে হবে এমন এক মহিলার জন্য যে তার পরিচিত নয়। যে মহিলাটি অগ্নিদগ্ধ হয়ে ভর্তি হয়েছে ওই হাসপাতালে। আর যে ব্যক্তির সঙ্গে তাকে রাত্রি জাগরণ করতে হবে তাকেও সে চেনেনা। গল্পের ওই যুবকের নাম সুহাস মাইতি। সে কলকাতার মেসে থেকে টিউশনি করে জীবন চালায়। সরকারী চাকরি পাবার বয়স তার পেরিয়ে গেছে। তার বাড়ি নন্দীগ্রামে, যেখানে আছে তার বিধবা মা ও তার বড়দার সংসার। নরেনদা বলে একজন ব্যক্তি যার বাড়িতে সুহাস একবছর টিউশনি করেছে সে-ই তাকে হাসপাতালে রাতে থাকার জন্য বলে। তিনবছর আগে তার বাড়িতে সে টিউশনি করতে যেতো। কোনো এক প্রাইভেট সংস্থায় তার চাকরি করে দিতে পারে নরেনদা, এই আশায় আশায় সে বেশ কয়েকবার তার বাড়িতে গিয়েছিল টিউশনি ছেড়ে দেওয়ার পরেও। আর নরেনদা তার চাকরির জন্য চেষ্টা করতেও পারে এই আশা নিয়েই সুহাস হাসপাতালের অপেক্ষা গৃহে রাত কাটাতে রাজি হয়। নরেনদার এক বন্ধুর স্ত্রী গুরুতরভাবে অগ্নিদগ্ধ হয়ে ভর্তি হয়েছে হাসপাতালে। সেখানে তাকে আর একজনের সঙ্গে রাতে থাকতে হবে। নরেনদা সুহাসকে সেই লোকটিকে দেখিয়ে দেয়। সুহাস দেখে মাফলার ও গুলি সুতোর চাদর জড়ানো একজনকে। সুহাস তাকে শুধু দেখে রাখে, তার নাম জানতে পারেনা। এরপর নরেনদা স্কুটারে করে তাকে তার বউবাজারের মেসে পৌঁছে দেয়। সে মেস থেকে রাতে বেরিয়ে পড়ে এসএসকেএম হাসপাতালের উদ্দেশে। শীতের রাত্রে টু-বি বাসে করে সে এক অলৌকিক যাত্রা যেন সুহাসের। বাইরে হিমরাত্রি, হু হু করে ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। হাসপাতালে পৌঁছে সে সেই লোকটাকে খুঁজে পায়না। বেশ কিছু পরে একজন এসে তাকে অপেক্ষা গৃহে নিয়ে যায়। কিন্তু পরে সে তার সঙ্গে কথাবার্তা বলে বুঝতে পারে সে ভুল লোকের সঙ্গে রাত জাগছে। সেই লোকটার নাম রোবে হাজরা, সে একজন রিকশা চালক। সেই রোবে হাজরাও রাত জাগতে এসেছে জনৈক ছায়া দাস নামে যে মহিলা অগ্নিদগ্ধ হয়ে ভর্তি হয়েছে তার জন্য। ততক্ষণে সে জেনে ফেলেছে ছায়া দাস সম্পর্কে অনেক কথাই। স্বামীর সঙ্গে জল ব্যবহার নিয়ে ঝগড়া হয় তার। কষ্ট করে বয়ে নিয়ে আসা জল তার স্বামী যথেচ্ছভাবে খরচ করে ফেলে। আর এই তুচ্ছ ঝগড়ার জেরেই নাকি সে আগুনে পুড়িয়ে নিজেকে মারতে চেয়েছে। পদ্মা তীরের মেয়ে সে। শহরের জলাভাব সে বোধহয় মেনে নিতে পারেনি। গুরুতরভাবে অগ্নিদগ্ধ হয়ে সে ভর্তি আছে হাসপাতালের এমারজেন্সি ওয়ার্ডে। যে কোনো সময় আসতে পারে তার মৃত্যুর খবর। কী অদ্ভুত এই গল্প। সুহাস এই হাসপাতালে এসেছে যার জন্য বা যার সঙ্গে রাত্রি জাগরণ করতে সে তাদের কাউকেই চেনেনা। তাদের সঙ্গে সম্পর্কহীনতায় থেকেও কোনো এক সম্পর্কে যেন জড়িয়ে পড়ে সে। এই শীতরাত, সম্পর্কহীনতা, জনৈক অগ্নিদগ্ধ মহিলার মৃত্যুর খবর পাওয়ার জন্য অপেক্ষা তাকে কেমন যেন এক আবেশে জড়িয়ে ধরে। এক গল্পহীন গল্পই যেন আফসার আমেদ লিখতে চেয়েছেন। অবশেষে সুহাসকে সেই লোকটি খুঁজে পায় নরেনদা যাকে দেখিয়ে সুহাসকে বলেছিল যে এর সঙ্গে তাকে রাত কাটাতে হবে। সেই লোকটি তার পরিচয় দিয়ে বলে তাদের পরিচিত যে মহিলা অগ্নিদগ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল সে মারা গেছে। সেই মহিলার নাম মালতী। অবশেষে সে বুঝতে পারে এক সহমর্মিতার বোধের ভেতর সে প্রবেশ করে ফেলেছে। যার হাত থেকে সে নিস্তার চায়ও না। এখানেই গল্পের সমাপ্তি। একে গল্প বলবো না না-গল্প বলবো ঠিক যেন বুঝে উঠতে পারিনা। এই গল্প অন্য ধরনের এক রেশ রেখে যায় আমাদের মনে।

আফসার আমেদ : সারা জীবন এক আউটসাইডারের মতো
হিন্দোল ভট্টাচার্য
আফসার আমেদ ছিলেন প্রকৃতপক্ষেই ‘সেই নিখোঁজ মানুষটা’, যিনি এক আধুনিক রূপকথার মতোই আমাদের এই বাংলা সাহিত্যে এনে দিয়েছিলেন নিম্নবর্গ ও মুসলিম সমাজের ভাষ্য, তাঁদের জীবনযন্ত্রণা, কাহিনি ও সমাজের অন্দরমহলের কথা। প্রাদেশিক ভাষার যে তেমন চর্চা বাংলা ভাষায় হয় না, এ বিষয়ে অবহিত ছিলেন বলেই হয়তো নিযুক্ত ছিলেন অনুবাদের কাজে। ‘ঘর গেরস্তি’ দিয়ে যাঁর সাহিত্যের পথে যাত্রা, সেই মানুষটি মিশে গেলেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সম্পদ অসামান্য কিছু কিসসা-য়। উপন্যাসের একটি অর্থ যে কথন, যা প্রায় আমরা ভুলতে বসেছি এই সময়ে, তা আফসার আমেদ তাঁর সারাজীবনের সাহিত্যকর্মে নানা ভাবে প্রতিফলিত করতে করতে গেছেন। তবু, এই কথন, সোজাসাপ্টা ন্যারেটিভ নয়। এর মধ্যে মিশে যায় পরাবাস্তবের নানান স্পর্শ, নানান গলিঘুঁজি, আলো-অন্ধকার। মূলত, বাস্তবের এক পরাবাস্তবিক রূপের মধ্যেই তিনি বাস্তবের কঠিন কাঠামোগুলিকে তুলে ধরেন আমাদের সামনে। পাই হলুদ পাখির কিসসা, মেটিয়াবুরুজে কিসসা, এক ঘোড়সওয়ার কিস্সা, হিরে ভিখারিনি ও সুন্দরী রমণী কিস্সা-র মতো অসামান্য কিছু উপন্যাস। এই কিসসা সিরিজের উপন্যাসগুলি বাংলা সাহিত্যের এক চিরকালীন সম্পদ হয়ে থাকবে বলাই বাহুল্য। হরি মেটোয়ানির সিন্ধি উপন্যাস আশ্রয় এবং আব্দুস সামাদের উর্দু উপন্যাস সাড়ে তিন হাত ভূমি অনুবাদ করেছিলেন তিনি।
মুসলমান সমাজের অন্দরমহলের কথা, তাঁদের জীবনযাত্রার কথা, জীবনের নানান মনস্তাত্বিক সংকটের কথা যেমন তিনি লিখেছেন, তেমন তাঁর লেখার মধ্যে দিয়ে ভারতের বিভিন্ন নিম্নবর্ণীয় মানুষের জীবনসংগ্রাম ও যাপনের কথাও উঠে এসেছে। কিন্তু তাঁর লেখনীর মাধ্যমে আমরা মুসলমান সমাজের ক্যানভাসটি আরও ভাল করে পড়তে পারি। এক ধরনের সাহিত্য হয় দূর থেকে লেখা, সেখানে যে লেখকের আদর্শ নৈতিক ‘ভিশন’ থাকেনা, তা নয়, কিন্তু শ্রেণিকে, শ্রেণিচেতনাকে, তাদের মধ্যবর্তী সংকটগুলি কীভাবে যাপনে আর বাকধারায় ফুটে ওঠে, তা সৎভাবে অনেক সময় ফুটে ওঠে না। বোঝা যায়, লেখকের উদ্দেশ্য মহৎ হলেও শ্রেণিগত কারণেই এই সব লেখার মধ্যে রক্তমাংস নেই। কিন্তু আফসার আমেদের লেখনী ছিল অন্যরকম, কারণ তাঁর যাপনের মধ্যে ‘নির্মাণ’ ছিল না বলেই তিনি পেরেছিলেন বাংলার মুসলিম সমাজের ভাষাকে সঠিক ভাবেই ধরতে। কিন্তু অন্ত্যজ মুসলমানের কিসসা ধরতেও তাঁর লেখনী থেকে বেরিয়েছে জাদুবাস্তবতা বা কুহকী বাস্তবতার এক অপরূপ প্রেক্ষাপট, যার মধ্যে দিয়ে আমরা পেয়ে যাই সেই নিখুঁত বাস্তবতার অন্তর্জগতের ছবি। ঘরগেরস্থি, হিরে ও ভিখারিনি, সুন্দরী রমণী কিস্সা, দ্বিতীয় বিবি, এক আশ্চর্য বশীকরণ কিস্সা, হত্যার প্রমোদ জানি, ধানজ্যোৎস্না, ব্যথা খুঁজে আনা – তাঁর সেই সব উপন্যাস, যা বাংলা সাহিত্যে কথন-এর মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল বলা যায়।
সেভাবেই বলা যায় তাঁর ছোটগল্পগুলির কথা। ঘটনার আপাত বর্ণনার মধ্যে দিয়ে যে প্রতীকী বাস্তবতার ক্যানভাস তিনি রচনা করতেন, তা যেন গল্পগুলির মধ্যে অন্য এক বৃত্তান্ত-ও হাজির করত। কিন্তু তা লেখা থাকত না, পাঠককে চলে যেতে হত তার পাঠক্রিয়ার মধ্যে। ফুটে উঠত ভিতরের বাস্তবতা। কাহিনি চলছে একধরনের, পাশাপাশি উঠে আসছে আরেকধরনের কাহিনি।
প্রথম-জীবনে কবিতা দিয়ে শুরু করলেও অচিরেই তিনি গদ্য লিখতে শুরু করেন। প্রাতিষ্ঠানিক, বাণিজ্যিক, অবাণিজ্যিক – সব রকম কাগজেই তিনি লিখেছেন। তবে মূলত তিনি লিটল ম্যাগাজিনের লেখক। তাঁর লেখা গল্পগুলো বেরোতে থাকে ‘পরিচয়’, ‘কালান্তর’, ‘বারোমাস’, ‘সারস্বত’ ইত্যাদি পত্র-পত্রিকাগুলিতে। ‘বাঙালি মুসলমানের বিয়ের গান’ তাঁর এক উল্লেখযোগ্য কাজ। প্রকাশিত হয় ১৯৭৮ সালে ‘পরিচয়’ পত্রিকায়। এই কাজই তাঁকে বাংলার বিদ্বজ্জন সমাজের কাছে ব্যাপকভাবে পরিচিতি ঘটায়। ১৯৮০ সালে প্রথম উপন্যাস ‘ঘরগেরস্তি’ প্রকাশিত হয় ‘শারদীয়া কালান্তর’-এ। অল্প সময়ের জন্য ‘প্রতিক্ষণ’ পত্রিকায় চাকরি করেন। ২০০০ সালে উর্দু-কবি কলিম হাজিখের সঙ্গে যৌথভাবে অনুবাদের জন্য সাহিত্য আকাদেমি অনুবাদ পুরস্কার লাভ করেন। ২০১৭ সালে ‘সেই নিখোঁজ মানুষটা’ – উপন্যাসের জন্য পেয়েছিলেন সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার।
মনে হয়, সারা জীবন এক আউটসাইডারের মতো, এক নিখোঁজ মানুষের মতোই তিনি কাটিয়েছেন। তাই পুরস্কার পেলেও, তাঁর জীবন কখনওই স্বচ্ছল হয়নি। প্রবল অর্থকষ্টের মধ্যে কেটেছে। মহানগরীর কুলীন সাহিত্য সমাজে ঘুরে বেড়ালেও তাঁর গায়ে লেগেছিল এক চিরকালীন মাটির জায়মান গন্ধ। সেই মাটির কাছেই তিনি চিরকাল স্বচ্ছন্দ ছিলেন। আর হয়ত কলম ধরবেন না তিনি। আসলে মৃত্যু এক এমন জাদুবাস্তবতা যার দরজা দিয়ে একবার ঢুকে গেলে আর বাস্তবে ফেরা যায় না। হয়ত এ জীবনটাই ছিল তাঁর উনষাট বছরের নিঃসঙ্গতার জীবন। অথবা এখন তিনি যে রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন, তার কিসসা হয়ত কখনও লিখবেন। অন্য কোনও কলমে।

আফসার আমেদের ‘অন্তঃপুর’ : নারী মনস্তত্ত্বের রূপায়ণ
পুরুষোত্তম সিংহ
মুসলিম জনজীবনকে বাংলা কথাসাহিত্যে তুলে আনতে যেসব কথাসাহিত্যিক অগ্রসর হয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম আফসের আমেদ। আফসের আমেদ জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে হাওড়া জেলার বাগনানের কাছাকাছি অঞ্চলে। মুসলিম সমাজ জীবনের অভিজ্ঞতা তাঁর বড় সহায়ক ছিল। যেমন সহায়ক ছিল কথাসাহিত্যিক নলিনী বেরার, তিনি মেদিনীপুরের সাঁওতাল, লোধা, শবরদের হাতের তালুর মতো চিনতেন। ভগীরথ মিশ্র, অনিল ঘোড়াই, সৈকত রক্ষিত প্রত্যেকেরই স্বভূমির মাটির সাথে নিবিড় যোগ। ফলে খুব স্বাভাবিক ভাবে এই এইসব কথাকারদের কথাভুবনে সেই সব অঞ্চলের জনজাতি, ভাষা, সংস্কৃতি খুব স্বাভাবিক ভাবেই এসে যায়। বাংলা কথাসাহিত্যে মুসলিম জনজীবন প্রথম বিরাট আকারে দেখা দেয় সৈয়দ মুস্তফা সিরাজের রচনায়। এই জাতি সংখ্যালঘু মুসলিম জাতি। স্বাধীনতার পূর্বে শরৎচন্দ্র বা অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের লেখায় মুসলিম জনজীবন এলেও তা ছিল বাঙালি মুসলিম। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে সিরাজের ধারাকেই বহন করে চলেছেন আফসার আমেদ, আবুল বাশার ও সোহরাব হোসেন, নীহারুল ইসলাম ও আনসারুদ্দিন।
নকশাল আন্দোলন পরবর্তীকালে বাংলা কথাসাহিত্যে যে বিরাট পালাবদল দেখা দিয়েছিল তার অন্যতম পথিক আফসার আমেদ। আফসার আমেদ, অমর মিত্র, সাধন চট্টোপাধ্যায়, ভগীরথ মিশ্র, নলিনী বেরা, স্বপ্নময় চক্রবর্তী ও ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যয় – এঁদের জন্ম প্রায় একই সময়ে, সাধন চট্টোপাধ্যায় ও ভগীরথ মিশ্র একটু আগের। নকশাল আন্দোলন পরবর্তীকালে বাংলা উপন্যাসের পালাবদলে এঁরা বিভিন্ন পথে গেলেন। কেউ জমি মানুষের সম্পর্ক, কেউ নিম্নবর্গের জনজাতি, কেউ মুসলিম সমাজের কথা, কেউবা উপন্যাসের রীতি বদলে অগ্রসর হলেন। আফসার আমেদের প্রথম উপন্যাস ‘ঘরগেরস্তি’ প্রকাশিত হয় ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে। এরপর প্রকাশিত হতে থাকে ‘বসবাস’ (১৯৮২ ), ‘দানু আলির নিজের জমি’ ( ১৯৮৯ ), ‘স্বপ্নসম্ভব’ ( ১৯৯১ ), ‘খণ্ড বিখণ্ড’ ( ১৯৯২ ), ‘অন্তঃপুর’ (১৯৯৩ ) ও ‘আত্মপরিচয়’ ( ১৯৯৪ )। বিংশ শতকেই তিনি ঔপন্যাসিক হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। একবিংশ শতকে সে তালিকা আরো বৃদ্ধি পায়। ধীরে ধীরে প্রকাশিত হতে থাকে ‘ সেই নিখোঁজ মানুষটা’, ‘জীবন জুড়ে প্রহর’, ‘প্রেমিকা নেই’, ‘হত্যার প্রমোদ জানি’ ও ‘প্রেমপত্র’। মুসলিম নর- নারীর প্রেম, মুসলিম সমাজের মিথ, আধুনিক সময়ের প্রেক্ষিপ্তে প্রেমের ক্ষেত্রে জাতি মিশ্রণ, ধর্মীয় জীবন, রীতি- নীতিকে অতিক্রম করে বেরিয়ে আসার প্রচেষ্টা, প্রচলিত ধর্মের বিরোধ ও দ্বন্দ্ব এসবই বড় আকারে দেখা দিয়েছে তাঁর লেখায়। তিনি নিজেই বলেছেন- ‘মুসলমান সমাজ নিয়ে কাজ করেছি, যা অনালোচিত ও অনালোকিত- এই চেষ্টার পথশ্রমটুকু সাক্ষী হয়ে থাক’ ( গাধা পত্রিকা )। মুসলিম গ্রামীণ সমাজের অর্থনীতি, সময় পরিবর্তন ও নারী জীবনের ভাষ্যই উঠে এসেছে প্রথম পর্বের উপন্যাসে। গ্রামীণ অর্থনীতির সঙ্গে নারী জীবনের পরিবর্তন মুসলিম সমাজে কিভাবে দ্রুত ঘটে চলেছিল তা লেখক বিরাট আকারে দেখিয়েছেন। প্রসঙ্গত ‘সোমেনচন্দ্র স্মারক পুরস্কার’ ( ১৯৯৮ ) উপলক্ষে প্রকাশিত পুস্তকের একটি মন্তব্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ –
‘বাংলার মুসলমান সমাজ আফসারের কথাসাহিত্যের মূল ভিত্তি। … গত দু-তিন দশকের বাংলার গল্প উপন্যাসে এই সমাজ জীবনের অল্পবিস্তর প্রতিফলন যে শক্তিশালী লেখকদের রচনায় নতুন করে দেখা যায় আফসার আমেদ তাঁদের অন্যতম। গ্রামীণ মুসলমান নারী জীবনের অর্থনৈতিক- সামাজিক শোষণের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আফসারের গল্প উপন্যাসের মূল কাঠামো তৈরি করেছে। এই সমাজের খুঁটিনাটি, নারীজীবনের চাওয়া-পাওয়া, স্বভাব, সংস্কার, ভাষা, আহার- বিহার এমন আশ্চর্য বাস্তবতায় তাঁর গল্প উপন্যাসে ধরা পড়েছে যে তা বৃহত্তর পাঠক সমাজের কাছে একটি অনাবিস্কৃত রাজ্যের যবনিকা অপসারণের মতো।’ ( পৃ. ২২)
‘অন্তঃপুর’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে। লেখক মুসলিম সমাজের একটি পরিবারের অন্তঃপুরের মহিলাদের জীবনকাহিনির নিপূণ বিশ্লেষণে অবতীর্ণ হয়েছেন । তিনি মহিলাদের আচার- অনুষ্ঠান, রীতি-নীতি, জীবন যাপনের চালচিত্র অদ্ভুত সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। বাংলা উপন্যাসে মহিলাদের জীবনের total life মহিলা ঔপন্যাসিকরা যে স্বতন্ত্রভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন সেখানে পুরুষরা অনেকটাই দায়িত্বহীন। আসলে লেখকের অভিজ্ঞতার জগৎটা বড় কথা। কত বড় শিল্পী হলে নারী জীবনের অন্তঃপুরে সমস্ত চিত্র তুলে ধরা যায় তা উপন্যাস পাঠেই বোঝা যাবে। অন্তঃপুরে কথা তুলে ধরতে বহু নারী চরিত্র এসেছে। তাদের প্রেম- ভালোবাসার মধ্য দিয়েই রাজমিস্ত্রি পরিবারের অন্দরমহলের চিত্র সম্পূর্ণতা পেয়েছে। সে চিত্রকে প্রথম আমরা একটি বলয়ের মধ্য দিয়ে তুলে ধরি-
(বৃত্ত ছবি)
১. আসমা + সাবির = ব্যর্থ প্রেম।
২. জাহিরা + মাসুদ = অবৈধ প্রেম।
৩. সরুছুতার + জাহিরা = অবৈধ প্রেম।
৪. আসমা + মাসুদ = সামাজিক বিবাহ।
৫. জাহিরা + মাইবু = সামাজিক বিবাহ।
এ উপন্যাসের কাহিনি গড়ে উঠেছে একটি রাজমিস্ত্রি পরিবারকে কেন্দ্র করে। এ প্রসঙ্গে মনে আসে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধভায়ের ‘ইমারাত’ গল্পের কথা। সে গল্পের রাজমিস্ত্রি জনাব আলি বহু ঘর তৈরি করেছে কিন্তু জীবনের শেষে তাঁর আশ্রয় হয়েছে বটতলার চালাঘরে। রাজমিস্ত্রি জীবনের প্রকৃত ইতিহাস তারাশঙ্কর এ গল্পে তুলে ধরেছিলেন। রাজমিস্ত্রিরা শুধু ঘরই তৈরি করে কোনদিনই ইমারতে থাকার অধিকার পায় না। গল্পটি ১৩৫২ বঙ্গাব্দে শারদীয়া ‘ আনন্দবাজার পত্রিকা’য় প্রকাশিত হয়েছিল। ‘ইমারাত’ গল্পের সঙ্গে ‘অন্তঃপুর’ উপন্যাসের সময়ের ব্যবধান প্রায় চার দশক, সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক অবস্থাও কিছুটা পাল্টেছে। তাই এ উপন্যাসের কেন্দ্রে থাকা পরিবারটির অবস্থা স্বচ্ছল। অন্তঃপুরের কর্তা মরিয়ম আর পরিবারের কর্তা বড় ছেলে ফিরোজ। এ উপন্যাসে বহু চরিত্রের প্রাধান্য। কাহিনির অগ্রগতি ঘটেছে মূলত তিনটি নারীকে কেন্দ্র করে- আসমা, জাহিরা ও মরিয়ম। আসমা তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিল, তারপর আর পড়াশুনার প্রয়োজন বোধ করেনি পরিবারের কর্তারা। আসমা আজ যৌবনে উত্তীর্ণ হয়েছে, তাঁর জীবনে প্রথম ভালোলাগা পুরুষ সাবির। তবে আসমা ভালোবাসা প্রকাশ করেনি, নিজের অন্তরের মধ্যেই রেখে দিয়েছে ভালোবাসার স্বরূপ। আসমা উপলব্ধি করতে পারে না তাঁর ভালোবাসার স্বরূপ। বাড়ির সমস্ত ছেলেদের সঙ্গেই তো তাঁর নিবিড় সখ্য, সবাইকেই সে ভালোবাসে। কিন্তু সাবিরের প্রতি ভালোবাসা যে বৈষ্ণব পদাবলির ভাষায় মধুর প্রেম সে বোধ গড়ে ওঠেনি –
‘রাতে ঘুম ভেঙে ঘুঘুরডাঙা জ্যোৎস্নায় আলোকিত দেখে আসমা ভাবে, সে কি শুধু সাবিরকেই ভালোবাসে? শহিদভাইকে নয় ? সোহরাবভাই নয় ? রহমতকে নয় ? আজম ভাইকে নয় ? কেন নয় ? এই সার্বিক প্রেম তাকে বিচলিত করে। সে যেন এই নির্বাচনের কেউ নয়।’ ১ /
ধীরে ধীরে প্রেমের বন্ধন নিবিড় হয়। সাবির প্রেমপত্র পাঠায় আসমাকে। কিন্তু আসমা তো চিঠি পড়তে পারে না তাই অন্যের সাহায্য নেয়। সাবির যেহেতু আসমার পিসির ছেলে তাই মরিয়মের বাড়িতে সে প্রায়ই আসে, তবে আসমার সঙ্গে কোন শারীরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। সাবির ও আসমার ভালোবাসা গোপন থাকে না মরিয়মের কাছে। মরিয়ম এ পরিবারের মহিলাদলের রক্ষক। অভিজ্ঞ মহিলা মরিয়ম মেয়েদের চোক দেখলেই বুঝতে পারে হৃদয় রহস্যের কথা। আসমা স্বীকার করে নেয় সাবিরকে ভালোবাসার কথা মরিয়মের কাছে-
‘ সে যেমন চাচাতো খালাতো মামাতো ভাইদের ভালবাসে, তার থেকে সাবিরকে অতিরিক্ত কিছু ভালবাসছে এটুকু তার মনে হয়। সাবির ভালবাসা চাইচে বলে আসমা ভালবাসছে। না হলে আসমা নিজে জেগে ওঠে নি। তাকে জাগিয়ে তুলেছে সাবির।’ ২ /
কিন্তু মুসলিম পরিবারে মেবেদের ইচ্ছা- অনিচ্ছার কোন মূল্য নেই। তাই আসমা যেমন নিজের ভালোবাসার কথা বাড়ির পুরুষদের জানাতে পারেনি তেমনি বড়কাকা ফিরোজের ঠিক করে দেওয়া পাত্রই মেনে নিতে হচ্ছে। ফিরোজের ঠিক করা পাত্র হল মাসুদ আলি। মাসুদ আলিও ফিরোজের বোনের ছেলে, ছোটবেলায়ই পিতা-মাতা হারিয়ে মামাবাড়িতে থাকে। মুসলিম সমাজে পারিবারিক বিবাহ হয় একথা লেখক আগেই জানিয়েছেন তেমনি মুসলিম লোকাচার ও সমাজ সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেছেন। আবার মাসুদ আলি প্রেম করে জাহিরার সঙ্গে। বিবাহিত জাহিরা বাবার বাড়ি থাকে, জাহিরার রূপের কাছে সহজেই আকৃষ্ট হয় মাসুদ আলি। সাবির- আসমা ও জাহিরা- মাসুদের সম্পর্ক কাহিনজি প্রথম পর্বেই ভেঙে যায়। আর এই কাজে বড় ভূমিকা নেয় মরিয়ম। মুসলিম সমাজে প্রেম- ভালোবাসার যে কোনো মূল্য নেই তা জানে মরিয়ম। সে নিজেও চায় নারীরা তাঁদের স্বাধীন পুরুষকে বিবাহ করুক কিন্তু মুসলিম সমাজের অন্তঃপুরে সেই ঢেউ তখনও আসেনি। কিন্তু নিরুপায় বৃদ্ধ মরিয়মকেও পুরুষ সমাজের নিয়মকে মেনে চলতে হয়। মরিয়ম তাই আসমাকে বোঝায় মুসলিম পরিবারে আগে বিবাহ, তারপরে ভালোবাসা। সেখানে হৃদবসত্তার কোন মূল্য নেই। তাই মরিয়ম বলে-
‘মেয়ে মানুষের জিন্দেগির আর কি দাম আছে রে আসমা বুন ! কেউ দাম দেয় না।’ ৩ /
আসমার হৃদবসত্তা খণ্ড- বিখণ্ড করতে ভূমিকা নিতে হয় মরিয়মকে। স্নেহ- প্রীতি নয় শরীরই ভালোবাসার মূল স্বরূপ একথা বলে মরিয়ম। আসমা তখন সবে যৌবনে পা দিয়েছে, যৌনতার চাহিদা দেখা দিয়েছে। নিরক্ষর মরিয়ম প্রেম- ভালোবাসার কিছু জানে না, সে শুধু পারে মেয়েদের মন বুঝতে। তাই সে আসমার মনকে নিয়ে যায় মাসুদের দিকে। মাসুদেরও ইচ্ছা নয় আসমাকে বিবাহ করার, সেও জাহিরার সঙ্গে প্রেমের বন্ধনে যুক্ত। কিন্তু পরিবারের কর্তার কাচে মুখ ফুটে বলতে পারেনি, তাই আজ তাঁক বিবাহ করতে হচ্চে। একটি বিবাহে ভেঙে যাচ্ছে সাবির ও জাহিরার ভালোবাসা। তবে পুরুষ হয়তো বড় কঠিন ! তাই বিবাহ ঠিক হওয়ার পর আসমার মনে সাবির থাকলেও মাসুদ ভুলে যায় জাহিরাকে। আসমা শুধু একটি দাবি জানায় মহিলা মহলে, বিবাহতে যেন সাবির আসে-
‘ভাবি তোমার পায়ে পড়ি, একটা কাজ করবে ? ও যেন আমার বিয়েতে আসে। তুমি খবর পাঠাবে।’ ৪ /
এবার মাসুদের প্রতি ভালোবাসা পড়েছে আসমার, কিছুদিনের মধ্যেই বিবাহ হয়ে যায়। বিবাহ নিয়ে মেতে ওঠে নারীরা, এইটুকু তাঁদের স্বাধীনতা। তবে বিবাহের পরও কিন্তু আসমার হৃদয় থেকে মুছে যায় নি সাবির বা মাসুদের হৃদয় থেকে জাহিরা। এভাবে জোড় করে মানুষের হৃদয়সত্তাকে চাপা দেওয়া যায় না তা দেখিয়েছেন লেখক। তেমনি লেখকের ভাষায় আসমা যেন যৌনসঙ্গী, আর মন পড়ে আছে জাহিরার কাছে। আসমাও প্রথমে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেনি তাই জানলা দিয়ে শুধু প্রকৃতিই দেখে গিয়েছে, মাসুদও ঘরের৪ বাইরে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়েছে-
‘মাসুদের মনে হয়, তার আর আসমার বিয়ে মিথ্যে মিথ্যে ! আসমার শরীরই শুধু তার অধীকারে এসেছিল বলে সে সেই অধিকার গ্রহণের অপেক্ষায় বাইরে দাঁড়িয়েছিল সে চলে এসেছে জাহিরার কাছে সে মুহূর্তে।’ ৫/
তবুও তাঁরা মিলেছে, সন্তানের জন্ম দিয়েছে। আসলে আসমারও মন চায়নি শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হল নারী বলেই কি তাঁকে আত্মসমর্পণ করতে হল- উত্তর অবশ্যই হ্যাঁ। আসলে লেখক মুসলিম নারী জীবনের মনস্তত্ত্বের চুলচেরা বিশ্লেষণে নিজেকে নিয়োজিত করেচেন, তাই জীবনে বেঁচে থাকতে আজ আসমাকে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে। আজ আসমা সন্তান সম্ভবা হয়েছে, আসমার প্রতি দায়িত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে মাসুদের। জীবনের প্রথম প্রেম দুজনেই ভুলে গিয়ে নতুন করে আবার জীবন শুরু করেছে। পিতা-মাতার মৃত্যুর পর বারো বছর নিঃসঙ্গ জীবন কেটেছে মাসুদের, আজ সে আবার জীবনসাথী পেয়েছে। লেখকের ভাষায় এই পর্বান্তরকে ভালোবেসে ফেলে সে। আসমা সন্তান জন্ম দিয়েছে, সে সন্তান নিয়ে তাঁরা নতুন ঠিকানায় চলে গেছে।
২
‘এপার ওপারে চলে দড়ি টানাটানি
আশাপূর্ণা লিখেছেন গণ্ডির কাহিনি
বোভোয়া শিখিয়েছেন গণ্ডি ভাঙা গান
গণ্ডি ভাঙতে গেলে বড় পিছুটান।’
( ‘গণ্ডি’, মল্লিকা সেনগুপ্ত )
এই ‘গণ্ডি’ ভাঙার কথাই লেখক লিখে চলেছেন জাহিরা চরিত্রের মাধ্যমে। এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় নারী চরিত্র বলা যেতে পারে জাহিরাকে। উপন্যাসের অনেকটা জায়গা জুড়েই তাঁকে পাওয়া যায়। জাহিরা মিস্ত্রি পরিবারের বড় মেয়ে। বিবাহ হয়েছিল মইবুর সঙ্গে। কিন্তু অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে পিতৃগৃহে চলে আসে। জাহিরা তিন সন্তানের জননী কিন্তু সন্তানদের সে পিতৃগৃহে আনেনি। জাহিরা যৌবনে পৌঁছেছে, স্বাভাবিক ভাবেই পিতৃগৃহে এসে সে প্রেমে পড়েছে। আসলে সে স্বাধীন জীবন কাটাতে চেয়েছে। লেখকের একটি মন্তব্য জাহিরা প্রসঙ্গে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক –
‘আসলে নারী তার নিজস্বতা চায়। জননী জায়া- অতিরিক্ত জীবন তাদের নেই। নিহিত সমমনে তারা মিলিত হয় বুঝি বা। বুঝি বা গলায় জড়িয়ে কাঁদতে চায়। বুঝি বা চুম্বন করে একে-অপরে সেই সমব্যথায়।’ ৬/
প্রথম সন্তান হওয়ার জন্য বড় আদরের সে। কৈশোরে মা- কাকিমার সঙ্গে বহু ছড়া ও বিবাহের গীত সে শিখেছিল। এই জাহিরার প্রেমে মজেছে বয়সে ছোট মামুদ। মুসলিম সমাজে এই প্রেম অবৈধ। তাই মরিয়ম নিষেধ করেছে জাহিরাকে। কিন্তু প্রেম তো কোনো জাতি ধর্ম বর্ণ মানে না তাই জাহিরাও মজেছে মাসুদের প্রেমে। আবার জাহিরাকে ভালোবাসে সরুছুতোর। কোন একদিন জাহিরাও প্রেমে পড়েছিল সরুছুতোরের, আবার প্রত্যাখভান পেয়ে মনে হয়েছে সরুছুতার হৃদয়হীন। এই প্রত্যাখ্যানের জ্বালা মেটাতেই জাহিরা মজেছে সরুছুতারের প্রেমে। তবে সরুছুতারকে ভোলে নি সে, একসময় সরুছুতোরের উষ্ণ স্পর্শ পেতে চেয়েছিল জাহিরা। কিন্তু সে আশা শেষ হয়ে গেলে জাহিরার মনে হয়েছে- ‘তুমি কি মেয়েদের মন বোঝ না’। অন্যদিকে আসমার সঙ্গে মাসুদের বিবাহ ঠিক করেছে ফিরোজ। আসমা ও মাসুদ কেউই নিজেদের প্রেমের কথা প্রকাশ্যে আনতে পারে নি। তেমনি সরুছুতোরের সঙ্গে প্রেম প্রথমে জাহিরার অবৈধ মনে হলেও পরে সে ভুল ভেঙে যায়। আসলে তাঁর প্রেম পেলে সরুছুতোরের জীবন সুন্দর হয়ে যাবে এই বোধ জাগে জাহিরার। তাঁর হৃদয়ে দোলাচলতা দেখা যায় কাকে সে গ্রহণ করবে ? সরুছুতোর না মাসুদ। জাহিরা ধীরে ধীরে পরিবারের চাঞ্চল্য থেকে দূরে চলে যায়। তেমনি লেখক নিজেই বলেছেন এমন সুন্দর রূপ থাকা স্বত্ত্বেও তার ভাগ্য বদলাছে না।জাহিরার প্রথম সন্তানের বয়স তেরো। জাহিরা ত্রিশ উত্তীর্ণ। লেখক আসমার বিবাহ দিচ্ছেন। আসলে লেখক নিজেও মেয়েদের অন্তঃপুর থেকে বাইরে আনতে চেয়েছেন। কিন্তু সমাজের প্রথা তাঁকে পিছুটান দিচ্চে তাই মাসুদ আর জাহিরা পালিয়ে যেতে পারছে না। জাহিরা সন্তানদের বাবার বাড়িতে আনেনি, কেননা এখানে সে নিজেই বোঝা। কিন্তু মিস্ত্রিবাড়ির যে স্বচ্ছল পরিবার সেখানে সন্তানদের আনলেও খুব বেশি বোঝা হত না। আসলে জাহিরা সংসার বন্ধন থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিল প অনভের সঙ্গে সম্পর্কে গড়ে তুলতে চেয়েছিল।
সরুছুতোরের কাছে প্রত্যাখ্যিত হবে অবলম্বন হিসেবে পেতে চেয়েছিল মাসুদকে। আবার মাসুদের কাচে প্রত্যাখ্যিত হয়ে জাহিরা পেতে চেয়েছে সরুছুতোরকে। তবে মাসুদ কিন্তু জাহিরাকে নিবে পালিয়ে যেতে চেয়েছিল কিন্তু সে পালায়নি। সে পালিয়ে গেলে ছোটবোন আসমা কষ্ট পাবে এদিকেও সজাগ দৃষ্টি জাহিরার। আবার কোনসময় জাহিরা বলে –
‘মেয়েদের মন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার কী দরকার ছিল ? যে আসমাকে এক কথায় বিয়ে করতে সম্মত হয়, সে আসলে ভালোবাসায় জাহিরার হাত ধরতে চায় নি, ভালোবাসায় জাহিরার মুখ দেখতে চায়নি, ভালোবাসায় আরো খানিক কাছে থাকার অনুরোধ জানাতে চায়নি।’ ৭ /
সবার কাছেই প্রত্যাখ্যিত হয়ে জাহিরা নিজের দুঃখ পুকুরের জলকে জানায়। জাহিরার এই ভাবনা মিশে যায় গীতিকার পালার সঙ্গে –
‘এই দেশে দরদী নাইরে কারে কইবাম কথা।
কোন জন বুঝিবে আমার পুরা মনের ব্যথা।।
মনের সুখে তুমি ঠাকুর সুন্দর নারী লইয়া।
আপন হালে করছ ঘর সুখেতে বানইয়া।।’
– (মহুয়া পালা )
আসমার বিবাহ শুরু হয়েছে। বাড়িতে বিবাহের আনন্দে মহিলারা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছে অথচ নীরব পথের যাত্রী জাহিরা। জাহিরা এই দুঃখ শুধু মরিয়ম আর মাসুদ বুঝতে পারে। জাহিরাকে নিয়ে পালিয়ে যাবার কথা বললে সে বলে – ‘তুমি আমাকে ভালোবাস, এতেই আমার শান্তি ’। জাহিরা যেন রবীন্দ্রনাথের ভাষায়- ‘এ নারী খেলা করবার নয় আবার একে প্রত্যাখ্যানও করা যায় না’। আসমার কথা ভেবে জাহিরা নিজের ভালোবাসা বিসর্জন দিয়েছে তবে মাসুদকে ধরে রাখতে চাইছে। মাসুদের ভালোবাসা নিয়েই সে বেঁচে থাকতে চেয়েছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন্যাসে কুসুমকে শশী বলেছিল – ‘শরীর শরীর তোমার মন নাই কুসুম’। এ উপন্যাসে জাহিরা শুধু মন পেতে চেয়েছে মাসুদের। মাসুদ যৌনক্রিয়ায় মেতে উঠুক আসমার সঙ্গে এতে কোন আপত্তি করেনি জাহিরা। তবে জাহিরাও যে যৌনকামনা ছিল না তা কিন্তু নয়। বিবাহের লোকাচারে মাসুদের গায়ে হলুদ মাখাতে গিয়েই সে বিষয়টি ফুটে উঠেছিল। বিবাহের পর মাসুদ জড়িয়ে ধরলেও আপত্তি করে নি জাহিরা। কিন্তু জাহিরার সমস্ত কথা গোপনে ধরে ফেলে মরিয়ম। তাই জাহিরা চলে যায় শ্বশুরবাড়ি। মরিয়ম মৃত হলে আবার সে বাড়িতে আসবে- এ ভাবনা ছিল। কিন্তু মাসুদরা অন্য জায়গায় চলে গেলে আর মাসুদের সঙ্গে দেখা হবে না বলে সে আর এ বাড়িতে আসেনি এমনকি মরিয়মের মৃত্যুতেও।
জাহিরার শ্বশুরবাড়ির ইতিহাস রয়েছে উপন্যাসের শেষ অংশে। জাহিরা চলে যাওয়ায় মইবু আবার নতুন করে বিবাহ করেছে হাসিনাকে। হাসিনাই বড় করে তুলেছে জাহিরার সন্তানদের, জাহিরার সংসার আজ চলে গেছে হাসিনার হাতে। জাহিরা প্রথমে আশঙ্ক্ষা ছিল সতীনের সংসারে কিভাবে থাকবে, কিন্তু হাসিনা সে রকম নারী নয় –
‘হাসিনার ওপর এক ধরণের নিরুচ্চার মিহি স্নেহ তৈরি হয়েছে জাহিরার।’ ৮ /
তাই হাসিনাকেই সে স্বামী দান করে দিয়েছে। স্বামীর ওপর নিজের কোন দাবি রাখেনি সে, আসলে দীর্ঘদিন বিচ্ছিন্ন থাকায় মইবুর ওপর তাঁর কোন মায়া নেই। জাহিরাও তো চেয়েছিল এ সংসারে কিছুদিন থাকতে, মরিয়ম মারা গেলেই আবার ফিরে যাবে মাসুদের কাছে। কিন্তু মাসুদ চলে যাওয়ায় আজ এখানেই বাকি জীবন কাটাতে হবে জাহিরার। তাই আজ জাহিরার স্বামী ও সংসারবোধ জেগে উঠেছে, হিংস্রা করতে শুরু করেছে হাসিনার সাথে। তাই কখনো মনে হয়েছে- ‘হাসিনা মরে যাক, মরে যাক না !’– জাহিরার দুটি সত্তা এখানে ফুতে উঠেছে- সতীন সত্তা ও নারীসত্তা। তাই স্বামীর কাছে হাসিনা মার খেলে সে এগিয়ে যায় না। আবার যখন নারীসত্তা জেগে ওঠে তখন হাসিনার কাছে ছুটে আসে, তাঁর দুঃখে সমব্যথী হয়, সে গর্ভবতী বলে তাঁকে সাহায্য করে। লেখক আশ্চর্যভাবে জাহিরার মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন দেখিয়েছেন-
‘হাসিনা মরে যদি যায়, এতে লোভ জন্মায় জাহিরার। পরমুহূর্তেই হাসিনার প্রতি স্নেহমমতার হাত প্রসারিত হয়। কেঁপে ওঠে, দুলে ওঠে। হাসিনার নবীন জীবন। একজন মেয়েমানুষ অনাদর অবহেলায় পড়ে আছে। এভাবে থাকতে থাকতে তার মৃত্যূও হতে পারে। তার এভাবে থাকাটাকে ঘোচায় জাহিরা। কাছে এসে উবু হয়ে বসে কপাল স্পর্শ করে। হাত স্পর্শ করে। কপাল থেকে চুল সরিয়ে দেয়। একটু পাখা টেনে কপাল থেকে ঘামের কনা শুকোয়।’ ৯/
হাসিনার কম বয়স বলে তাঁর প্রতি বেশি টান মইবুর। জাহিরার সঙ্গে যৌনক্রিয়া করে না এমন নয় – কিন্তু সবই থাকে অন্তরালে ফলে জাহিরার স্বামী অধিপত্য স্থাপিত হয় না। ইতিমধ্যে মরিয়ম মারা গেছে, মাসিদও চলে গেছে। একদিকে সতীনের সংসারে স্বামী অধিপত্য থেকে বঞ্চিত অন্যদিকে প্রেমিকাকে হারানোর দুঃখ – দুই দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত জাহিরার মনে হয়েছে –
‘মাসুদ আলি নিষ্ঠুর নিজের সংসার সাজাতে ব্যস্ত ! সে আসলে জাহিরাকে কোনদিন ভালোবাসেনি। ভুল ভালোবাসা। ভালোবাসার অভিনয় মাত্র। সেই ভালোবাসার হাতে পড়ে জাহিরা আহতই হয়েছে।’ ১০/
সমস্ত হারিয়ে জাহিরা আজ সংসারকেই আকড়ে ধরতে চেয়েছে। সন্তানরাও মাতার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়ে দূরে চলে গেছে। আজ স্বামীর সংসারে থাকা ছাড়া আর কোন পথ খোলা নেই জাহিরার কাছে তাই সে ক্ষমা চেয়েছে। কিন্তু ইচ্ছা হলেই তো আর ভালপবাসা পাওয়া যায় না তাই লেখক বলেছেন-
‘তখন জীবনযাপন ছিল প্রদর্শন ছিল না। এখন প্রদর্শন না করতে চাওয়ার মধ্যেও প্রদর্শন এসে যায়, জীবনযাপন আসে না।’ ১১/
তাই জাহিরকে আজ তালাক প্রাপ্ত হতে হয়েছে। সমস্ত জীবন শূন্য করে দিয়ে জাহিরা আজ অন্য বাড়িতে চলে গেচে- এভাবেই ট্র্যাজিক চরিত্রে পরিণত হয়েছে জাহিরা।
৩
‘ঘর ও বাহির থেকে প্রেম প্রতারণা
স্বামী ও শাশুড়ি থেকে বিশ্বউষ্ণায়ন
ছোটপরিবার থেকে বড় কাজে টানা ও পোড়েন
নিপূণ সামলে নিই আমি দশভুজা
মালতী এখন আর হারিয়ে যায় না
কোন এক নরেশের উপেক্ষার মেঘে’
(‘সাধারণ মেয়ে, একুশ শতক’, মল্লিকা সেনগুপ্ত )
এই ঘর- বইরের দ্বন্দ্ব, স্বামী- সন্তান ও পুত্রবধূ সমস্তকে নিয়েই গড়ে উঠেছে মরিয়মের জীবন। পরিবারের মহিলা মহলের কর্তা মরিয়ম। ছয়পুত্রের জননী, অল্প বয়সেই হারিয়েছে স্বামীকে। সেখান থেকেই সে- সংসারের আল ধরেছে। তাই মরিয়মের বিশ্বাস স্বামীকে না পেলে জীবনের খুব বেশি ক্ষতি হয় না। এ সংসারে পুরুষের সংখ্যা তেরো জন। সবাই মরিয়মের অন্তরের স্নেহধন্য। তাই কেউ বাড়ি ফিরতে দেরি হলে সব থেকে বেশি চিন্তিত হয় মরিয়ম, রাতের অন্ধকারে বসে থাকে কখন ফিরে আসবে পুত্র ও নাতি। এই অন্ধকারে বসে থাকা মরিয়মের জীবনের রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে তেমনি বাড়ির মেবেদের প্রতি সজাগ দৃষ্টি মরিয়মের। তাই জাহিরা বা আসমার গোপন প্রেম ধরা পরে মরিয়মের চোখে। বাড়ির মেয়েদের সে যেমন আগলে রাকে তেমনি ভালোবাসেও সেই বেশি। তবে মরিয়মের হৃদয় আছে, সেও বোঝে নর- নারীর প্রেম ভালোবাসা। তাই সেও মনে করে সাবিরের সঙ্গে আসমার বিবাহ হলে সে খুশি হবে। কিন্তু পুরুষ শাষিত সমাজে মরিয়ম এক অবএলিত নারী, নিজের সমস্ত আশা- আকাঙ্ক্ষা বলি৯ দিয়েছে। সমস্ত ইচ্ছা বিসর্জন দিয়ে মরিয়মের মনে হয়েছে-
‘মরিয়মের বিশ্বাস এই ভাব- ভালবাসা কোনো শিলালেখ নয়, মেয়েমানুষের যার সঙ্গে বিয়ে হয়, স্বামী- সংসারকে সে ভালবাসে। চকিত ব্যাকুলতাকে তার মুছিয়ে দিতে হয়।’ ১২/
সে নিরক্ষর বৃদ্ধা, সমাজের প্রতি তাঁর ভয় প্রবল। লেখক নিজেই বলেছেন জীবনের গতিতে ভেসে চলা মানুষ সে, জীবনের গতি পরিবর্তন সে জানে না বা পারে না। তাই সমাজ সংস্কার রক্ষা করতে সে আসমার মনকে মাসুদের প্রতি নিয়োজিত করেছে। মরিয়ম জানে বাড়ির মেয়েদের দুঃখের কথা কিন্তু এ পথ ছাড়া অন্য কোনো পথ ছিল না। তাই তাঁর কমনে হয়েছে মেয়ে মানুষের জীবনের কোনো দাম নেই, পুরুষের কাছে নারী খেলবার পুতুল মাত্র। তাই আসমার বিবাহতে সে খুশি হলেও অন্তরে রয়েছে গোপন ব্যথা। কেননা সাবিরকে সে বঞ্চিত করেছে –
‘ভালয় ভালয় যে বিয়েটা হয়ে গেল, এতে মনে বড় শান্তি পেয়েছে সে। কিন্তু মনে গোপন ব্যথা পায় সে। এই ব্যথার বিনিময়ে শান্তি বজায় থাকুক চেয়েছে সে। হয়েছেও তাই। সাবির তারই মেয়ের ঘরের ছেলে। এই বিয়েতে আসেনি। ছোঁড়াটা কত না ব্যথা পেয়েছে। জানে, ওসব ঠিক হয়ে যাবে। আসমাও তার মন থেকে সাবিরকে তুলে ফেলেছে। তা না হলে কেলেঙ্কারি হত। এই শান্তি বজায় যাতে ধাকে সে ব্যাপারে মরিয়মের দৃষ্টি থাকে, উদ্যোগ থাকে।’ ১৩/
তেমনি জাহিরার স্বামী পরিত্যাগ মেনে নিতে পারেনি মরিয়ম। আবার বড় নাতি হওয়ার জন্য স্নেহের বশে জাহিরাকে কিছু বলতে পারে না সে। আবার মাসুদের প্রতি জাইরার ভালোবাসা অন্যায় মনে হয়েছে তাঁর কাছে। আজ সে বৃদ্ধ, জীবনে বেঁচে থাকার কোন অর্থ তাঁর কাছৈ নেই। যেটুকু সুখ ভোগ করার সে করেছে, তাঁর জীবনের সমস্ত আশা- আকাঙ্ক্ষা মিটেছে।তাঁর ইচ্ছার সঙ্গে মিলে যায় কবি শঙ্খ ঘোষের বক্তব্য-
‘এই তো জানু পেতে বসেছি, পশ্চিম
আজ বসন্তের শূন্য হাত-
ধ্বংস করে দাও আমাকে যদি চাও
আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।’
( ‘বাবরের প্রার্থনা’ )
তাঁর জীবনের শেষ ইচ্ছা বড় নাতি জাহিরাকে কিছু দিয়ে যাবার। কিন্তু সে ইচ্চা পূরণ হয়নি কেননা জাহিরা অভিমানে আর আসেনি। এই দুঃখ নিয়েই জীবন সমুদ্র পাড়ি দিতে হয়েছে মরিয়মকে।
এ উপন্যাসে এক অবহেলিত নারী হাসিনা। জীবনে সে কিছুই পায়নি। শুধুই কর্তব্য পালন করে গেছে। জাহিরা চলে যাওয়ায় মইবু বিবাহ করেছে হাসিনাকে। হাসিনা এসে সংসারের সমস্ত দায়িত্ব নিয়েছে, জাহিরার সন্তানদের মানুষ করেচে। কিন্তু জাহিরা আবার সংসারে ফিরে এলেো জাহিরার সঙ্গে সতীন স্বরূপ ব্যবহার করেনি। অথচ জাহিরা তাঁকে ভালোভাবে মেনে নেয়নি। তাই জাহিরা চেয়েছে স্বামীর কাছে অপদস্ত হোক হাসিনা। কিন্তু হাসিনা কখনই ব্যঙ্গ দৃষ্টিতে দেকেনি জাহিরাকে। জাহিরা আজ যৌবন অতিক্রান্ত। জীবনের অর্থবেলায় এসে সে আর স্বামীকে আকর্ষণ করতে পারে না, তাই সমস্ত ক্রোধ গিয়ে পড়ে হাসিনার ওপর –
‘এত বছর সংসার করার পর হাসিনার কাছে হেরে যেতে হচ্ছে জাহিরাকে। জাহিরার দীর্ঘ বছরের অবদান মিথ্যে হবে যাচ্ছে। কেননা হাসিনার বয়স কম। মইবুর কম বয়সী বৌয়ের ওপর যথেষ্ট টান। হঅসিনার বয়সের কাছে হেরে যাচ্ছে জাহিরা।’ ১৪/
তবে হাসিনা সবসময়ই পাশে দাঁড়িয়েছে জাহিরার। স্বামী অত্যাচার বা দুঃখ সমস্ত ব্যাপারেই সে জাহিরার মনে প্রবল সাহস জুগিয়ে এসেছে। সহজ- সরলতাই বড় গুণ হাসিনার, এই গুণকে অবলম্বন করেই সে বাঁচতে চেয়েচে। বিংশ শতাব্দীর সাতের দশকের লেখক আফসার আমেদ। লেখকের অভিজ্ঞতার জগৎ হল মুসলিম সমাজ। তাই মুসলিম সমাজের সমস্ত খুঁটিনাটি তিনি তুলে ধরতে সচেষ্ট হয়েছেন। আর কত বড় শিল্পী হলে অন্তঃপুরের নারীদের সমস্ত চিত্র তুলে ধরা যায় তা ভবিষ্যৎকালই বিচার করবে। তেমনি এ উপন্যাস শুধু মুসলিম সমাজেই আটকে নেই, জাহিরা – আসমা চিরকালীন নারী। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা নিজেদের সমস্ত ইচ্ছা বিসর্জন দিয়েছে, জাহিরা- আসমা তারই প্রতিনিধি। জাহিরা আসমার চরিত্র রূপায়ণের মধ্য দিয়ে লেখক চিরকালীন নারী জীবনের ভাষ্য রচনা করেছেন।
তথ্যসূত্র
১/ আফসার আমেদ, অন্তঃপুর, প্রথম প্রকাশ জানুয়ারি ১৯৯৩, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা -৭৩, পৃ. ৩০।
২/ ‘প্রাগুক্ত’, পৃ. ৫৮। ৩/ ‘প্রাগুক্ত’, পৃ. ৬৭ । ৪/ ‘প্রাগুক্ত’, পৃ. ৭৪। ৫/ ‘প্রাগুক্ত’, পৃ. ১১৪। ৬/ ‘প্রাগুক্ত’, পৃ. ২৯। ৭/ ‘প্রাগুক্ত’, পৃ. ৮০। ৯/ ‘প্রাগুক্ত’, পৃ. ১৬৯। ১০/ ‘প্রাগুক্ত’, পৃ. ১৮০। ১১/ ‘প্রাগুক্ত’, পৃ. ১৮৯।
১২/ ‘প্রাগুক্ত’, পৃ. ৬৬। ১৩/ ‘প্রাগুক্ত’, পৃ. ১২৬। ১৪/ ‘প্রাগুক্ত’, পৃ. ১৭৯।

indian pharmacy paypal: canadian pharmacy india – best online pharmacy india
Hello my loved one! I want to say that this post is awesome,nice written and include approximately all significant infos.I’d like to peer more posts like this.Also visit my blog :: wenalway.com
https://ordermedicationonline.pro/# best online canadian pharmacy review
the best ed pills: best ed pill medicine for erectile
For newest news you have to visit web and on world-wide-web I found this website as a best site for latest updates.
Aw, this was an exceptionally good post. Taking a few minutes and actual effort to generate a really good article… but what can I say… I put things off a whole lot and don’t manage to get nearly anything done.
п»їlegitimate online pharmacies india: buy medicines online in india – mail order pharmacy india
medication online: buy prescription drugs online without doctor – amazon pharmacy drug prices
Muchos Gracias for your article.Really looking forward to read more. Fantastic.
There is definately a lot to find out about this topic. I really like all of the points you have made.
world pharmacy india india pharmacy mail order indian pharmacy paypal
Very neat blog post.Thanks Again. Really Great.
http://indiapharmacy.site/# mail order pharmacy india
Hi everyone, it’s my first visit at this web site, and article is really fruitful in favor of me, keep up posting these articles.
Im grateful for the blog post.Thanks Again. Will read on…
list of safe online pharmacies: Online pharmacy USA – canadian pharmacy delivery
best rated canadian pharmacy: canada rx pharmacy – canadian pharmacy 24h com safe
ed treatment pills certified canadian online pharmacies best rated canadian pharmacies
https://mexicopharmacy.store/# mexican mail order pharmacies
Simply want to say your article is as surprising. The clearness for your post is simply nice and i can assume you are a professional in this subject. Well with your permission allow me to seize your RSS feed to stay up to date with coming near near post. Thank you one million and please continue the gratifying work.
I value the post.Really looking forward to read more. Will read on…
price of wellbutrin without insurance: Buy Wellbutrin SR online – wellbutrin 151
Howdy! Do you know if they make any plugins to help with SEO? I’m trying to get my blog to rank for some targeted keywords but I’m not seeing very good results. If you know of any please share. Thank you!
Wow, great article post.Really thank you! Awesome.
Hi there, all is going nicely here and ofcourse every one is sharing facts, that’s actually excellent, keep upwriting.
https://claritin.icu/# ventolin otc australia
I appreciate you sharing this article.Really looking forward to read more. Awesome.
quality writing, it is rare to see a nice blog like this one nowadays.
best generic wellbutrin 2015: Wellbutrin online with insurance – wellbutrin 75 mg cost
When I initially commented I clicked the “Notify me when new comments are added”checkbox and now each time a comment is added I get several emails with the same comment.Is there any way you can remove me from that service?Many thanks!
Hello! This post couldn’t be written any better! Reading this post reminds me of my old room mate! He always kept talking about this. I will forward this article to him. Pretty sure he will have a good read. Thanks for sharing!
SAC LANCEL PAS CHER ??????30????????????????5??????????????? ????????
https://paxlovid.club/# paxlovid for sale
Appreciate you sharing, great article post.Much thanks again. Great.
where can i get cheap clomid no prescription: Buy Clomid Shipped From Canada – how can i get generic clomid
Hi there! I simply wish to offer you a huge thumbs up for the excellent info you have got here on this post. I am returning to your blog for more soon.
Really appreciate you sharing this blog.Really thank you! Much obliged.
https://claritin.icu/# ventolin without a prescription
over the counter lasix at walmart furosemide online usach Wet
It’s difficult to appear by seasoned men and women for this topic, but you seem to be you determine what you’re talking about! Thanks
paxlovid generic http://paxlovid.club/# paxlovid covid
plaquenil for psoriatic arthritis flxfm – hydroxychloroquine sulfate generic
generic ventolin price: buy Ventolin inhaler – ventolin prescription australia
There is certainly a lot to find out about this subject. I love all the points you have made.
http://wellbutrin.rest/# wellbutrin buy online uk
Thanks so much for the blog article.Really looking forward to read more. Awesome.
This is a good tip especially to those new to the blogosphere. Brief but very accurate information… Thank you for sharing this one. A must read post!
buy wellbutrin from canada: Buy Wellbutrin XL 300 mg online – wellbutrin 65mg
Appreciate you sharing, great blog post.Thanks Again. Cool.
http://wellbutrin.rest/# wellbutrin canadian pharmacy
Im grateful for the blog article.Thanks Again. Will read on…
neurontin tablets uk: gabapentin best price – neurontin pfizer
Great blog post.Really looking forward to read more. Much obliged.
https://wellbutrin.rest/# wellbutrin cost
Thanks for the blog article. Really Cool.
neurontin 100mg caps: generic gabapentin – gabapentin medication
Very good blog! Do you have any helpful hints for aspiring writers? I’m planning to start my own site soon but I’m a little lost on everything. Would you advise starting with a free platform like WordPress or go for a paid option? There are so many choices out there that I’m totally confused .. Any ideas? Cheers!
http://claritin.icu/# ventolin prescription cost
Major thanks for the blog article.Really looking forward to read more. Will read on…
http://kamagrait.club/# п»їfarmacia online migliore
kamagra senza ricetta in farmacia: sildenafil 100mg prezzo – miglior sito per comprare viagra online
farmacia online: avanafil prezzo – farmacia online più conveniente
acquisto farmaci con ricetta farmacia online migliore acquistare farmaci senza ricetta
farmacie on line spedizione gratuita: farmacia online migliore – acquistare farmaci senza ricetta
Im obliged for the article. Want more.
comprare farmaci online con ricetta: comprare avanafil senza ricetta – farmaci senza ricetta elenco
migliori farmacie online 2023: avanafil – farmacie online autorizzate elenco
http://kamagrait.club/# comprare farmaci online all’estero
comprare farmaci online con ricetta: kamagra oral jelly consegna 24 ore – farmacia online
farmacia online: kamagra gold – farmacie on line spedizione gratuita
comprare farmaci online all’estero farmacia online spedizione gratuita farmacie on line spedizione gratuita
farmacie online autorizzate elenco: Tadalafil generico – top farmacia online
acquisto farmaci con ricetta: avanafil generico prezzo – acquistare farmaci senza ricetta
acquisto farmaci con ricetta: avanafil spedra – acquisto farmaci con ricetta
viagra naturale: viagra online spedizione gratuita – pillole per erezione immediata
http://tadalafilit.store/# migliori farmacie online 2023
farmacia online più conveniente: Farmacie che vendono Cialis senza ricetta – farmacia online miglior prezzo
farmacie online affidabili: kamagra gold – farmacie online affidabili
farmacia online senza ricetta farmacia online migliore farmaci senza ricetta elenco
comprare farmaci online con ricetta: Farmacie che vendono Cialis senza ricetta – farmacia online più conveniente
farmacia online migliore: avanafil prezzo – top farmacia online
acquisto farmaci con ricetta: dove acquistare cialis online sicuro – farmacia online senza ricetta
п»їfarmacia online migliore: kamagra – farmacia online piГ№ conveniente
https://avanafilit.icu/# farmacia online piГ№ conveniente
farmacia online senza ricetta: Dove acquistare Cialis online sicuro – farmacia online miglior prezzo
Thanks again for the blog post.Thanks Again. Fantastic.
comprare farmaci online con ricetta: Farmacie a roma che vendono cialis senza ricetta – comprare farmaci online con ricetta
ivermectin cream 1 ivermectin – ivermectin tablets uk
farmacia online migliore kamagra gel prezzo comprare farmaci online con ricetta
Some truly interesting details you have written.Aided me a lot,just what I was looking for :D.my blog post :: free indoor growing
comprare farmaci online all’estero: cialis prezzo – comprare farmaci online all’estero