
পৃথিবীর কত বাইরে কত উপরে আছি
না ফেরার দেশে চলে গেলেন আমাদের প্রিয় শম্ভুদা, মহাপৃথিবীর কবি শম্ভু রক্ষিত! নিজের কবিতায় তিনি লিখেছিলেন-
‘আমি পৃথিবীর কত বাইরে, কত উপরে আছি!’
২৯ মে ২০২০ শুক্রবার সকাল আটটায় করোনার ক্রান্তিকালে আমাদের গৃহবন্দি অসহায় দশায় আমফান ঝড়ের পর আমরা যখন লন্ডভন্ড অবস্থায় আছি ঠিক এই সময়ে নিঃশব্দে তিনি আমাদের ছেড়ে এই পৃথিবীর বাইরে সত্যি সত্যি অনেক উপরে চলে গেলেন! যেখানে আমরা আর তাঁকে কিছুতেই ছুঁতে পারবো না! দেখতে পাবো না প্রবল কষ্টের মধ্যে থাকা মানুষটির মুখে সেই অমায়িক হাসি! যিনি অবর্ণনীয় দারিদ্র্যের কষ্ট বহন করে ও সারা জীবন কেবল কবিতায় যাপন করে গেলেন! যিনি বিশ্বাস করতেন এই পৃথিবীজুড়ে সারাক্ষণ কেবল একটি মহৎ কবিতা লেখা হচ্ছে! আর পৃথিবীর সমস্ত কবি সেই মহৎ কবিতায় কেবল লাইন সংযোজন করে যাচ্ছেন! এই মহৎ কবিতায় কবিতার লাইন সংযোজনের জন্য কবি শম্ভু রক্ষিত এর ছিল ‘প্রিয় ধোনির জন্য কান্না’! শুধু কবিতা লেখার জন্য জরুরি অবস্থায় জেলখাটা কবি শম্ভু রক্ষিত সয়েছেন পুলিশের অকথ্য অত্যাচার! তবুও ভালোবেসেছেন কবিতাকেই সারাজীবন! কারণ তিনি বলতেন কবিতা লেখা ছাড়া আর কিছুই তিনি পারেন না! কবিতা লেখা এবং মহাপৃথিবী মত সাহিত্য পত্রিকা বার করা ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র কাজ! তাঁর সম্পাদিত মহাপৃথিবী পত্রিকার ৫০ বছরে পা দেওয়াকে স্মরণীয় করে রাখতে আমাদের মত কয়েকজন অর্বাচীন এর উদ্যোগে তাঁর সুতাহাটা বিরিঞ্চি বেড়িয়া বাড়িতে এ বছরই লকডাউন এর কিছুদিন আগেই বসেছিল মহাপৃথিবীর ৫০ বছর পূর্তি উৎসব! কবি শম্ভু রক্ষিত এর প্রিয়জন এবং অনুরাগীদের উপস্থিতিতে এই মহতী সাহিত্য অনুষ্ঠান এখন ইতিহাসের সাক্ষী ! শম্ভুদার সজীব উপস্থিতিতে আমরা সেই মহাপৃথিবীর সাহিত্য অনুষ্ঠানের অংশীদার ছিলাম এটাই কেবল আমাদের কাছে সান্তনা হয়ে রইল!
‘আমার জীবন বিশুদ্ধ ভালোবাসার ও বিশ্রুত সজ্জিত ভালোবাসা নতুন অবদানে সমৃদ্ধ করা- বিপুলতর এক জগত যা পৃথিবীর গোলকের মতো বিরাট
শাত ও আধাঁর অর্থাৎ তোমার মূল্য পরিশোধ করতে না পারা’
আবু রাইহান
( বিশেষ নিবেদন সংখ্যার সম্পাদক ও পরিকল্পক )
ম্যানগ্রোভ সাহিত্য-র নিবেদন–


কবি শম্ভু রক্ষিত : হাংরি আন্দোলন থেকে মহাপৃথিবী
মলয় রায়চৌধুরী
‘তিতীর্ষু’ পত্রিকার শম্ভু রক্ষিত সংখ্যায় ( ২০১৭ ) শম্ভু রক্ষিত ‘আমি স্বাধীন’ শিরোনামে লেখাটি শুরু করেছেন ‘আমি স্বাধীন । আমি হাংরি।’ ঘোষণার মাধ্যমে । ওই প্রবন্ধেই তিনি বলেছেন, ‘মলয় রায়চৌধুরীদের সাথে পরিচয় হওয়ার ফলে হাংরি জেনারেশনের সাথে আমিও জড়িয়েছিলাম ।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘এর পরেও বাংলা সাহিত্যে অনেকে আন্দোলনের কথা বলে থাকেন ; কিন্তু আমার মতে হাংরি-র পর বাংলা সাহিত্যে সেই অর্থে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো আন্দোলন হয়নি ।’ পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি চতুর্দশ লিটল ম্যাগাজিন মেলা ২০১২ স্মারক পত্রিকায় প্রকাশিত স্বরূপ মন্ডলকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘কবিতা লেখার প্রেরণা প্রথম পাই মলয় রায়চৌধুরীর কাছ থেকে । ওঁর সাথে কফিহাউসে আলাপ । মলয় রায়চৌধুরী ও উৎপলকুমার বসু এই দু’জনের কাছেই আমি কবিতা লেখা শিখি।’
হ্যাঁ, শম্ভু রক্ষিতকে আমিই হাংরি আন্দোলনে যোগ দেবার জন্য উসকে ছিলুম । ওনার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল ১৯৬৩-৬৪ নাগাদ, সবে কবিতা লেখা আরম্ভ করেছেন, উৎসাহ দেবার মতন বন্ধুর প্রয়োজন, থাকেন মামার বাড়িতে, হাওড়ার কদমতলায় । হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে ওনার আগ্রহ প্রথম থেকেই এমন ছিল যে উনি নিজেই একটা হাংরি পত্রিকা প্রকাশ করার ইচ্ছের কথা জানান । আমরা সেসময়ে আন্দোলনের পক্ষ থেকে এক পাতার লিফলেট প্রকাশ করতুম, বড়োজোর এক ফর্মার বুলেটিন । শম্ভু ওনার সম্পাদনা আর প্রকাশনায় হাওড়ার বাড়ি থেকে বের করলেন ‘ব্লুজ’ নামে একটি পত্রিকা । কতোগুলো সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল মনে নেই, তবে শম্ভুর মধ্যে ভাষার প্রতিষ্ঠান ভাঙার যে হলকা ছিল তা পত্রিকার প্রথম সংখ্যাতেই ধরা পড়েছিল । সেই সংখ্যায় উৎপলকুমার বসুর একটা ছোটো গদ্যও ছিল ভাষার প্রতিষ্ঠান ভেঙে ফেলার ডাক দিয়ে ।
মামারবাড়িতে তাঁর নিজস্ব একটি ঘর ছিল । শম্ভুর আশা ছিল যে তিনি বাড়ির একটা অংশ, অন্তত তাঁর ওই প্রিয় ঘরটা, পাবেন । কিন্তু দিদিমা মারা যাবার পর তাঁর মামারা তাঁকে ওই বাড়ি থেকে উৎখাত করেন, ( শম্ভুর কথায়, সিপিএম-এর ক্যাডারদের সাহায্যে ) আর তাই নিয়ে বেশ কিছুকাল মামলা করেছিলেন শম্ভু, যদিও শেষ পর্যন্ত মামলায় হেরে গিয়ে দেশের বাড়িতে ফিরে যান ।
শম্ভু রক্ষিতের আদিবাড়ি মেদিনীপুরের বিরিঞ্চিবেড়িয়া গ্রামে, যেখান থেকে তিনি ‘মহাপৃথিবী’ নামের প্রায় নিয়মিত একটি পত্রিকা গত ছেচল্লিশ বছর যাবত সম্পাদনা ও প্রকাশ করে চলেছেন । কবিরাও ওনার ‘মহাপৃথিবী’ প্রকাশনা থেকে নিজেদের কাব্যগ্রন্হ প্রকাশ করে গর্ববোধ করেছেন । তাঁর জন্ম মামার বাড়িতে, ১৯৪৮ সালের ১৬ই আগস্ট । কিন্তু শৈশব কেটেছে বিরিঞ্চিবেড়িয়ায় ; পড়াশোনা হাওড়ার বাড়ি থেকে । তাঁর বাবা নন্দলাল রক্ষিত সিন্দুকের ব্যবসা আর চাষবাস করতেন ; স্বাভাবিক যে আধুনিকতার ধাক্কায় এই ধরণের ব্যবসা ক্রমশ ব্র্যাণ্ডেড লোহার আলমারি আর অ্যালুমিনিয়ামের ট্রাঙ্কের কাছে জায়গা ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো । ফলে চাষাবাদ করেই তাঁকে সংসার চালাতে হতো । শম্ভুর মায়ের নাম রাধারানি দেবী ।
শম্ভু রক্ষিত যে হাংরি আন্দোলনে ছিলেন, জানি না কতোজন জানেন ব্যাপারটা । যাঁরা পরে আদালতে মুচলেকা দিয়ে হইচই করলেন আন্দোলনটা নিয়ে, তাঁরা শম্ভুকে পাত্তা দিলেন না, অথচ প্রথম থেকেই শম্ভু রক্ষিত একেবারে নতুন ধরণের কবিতা লেখা আরম্ভ করেছিলেন । কলেজ স্ট্রিটের প্রকাশকরা “হাংরি জেনারেশন” নামে যে-সমস্ত সংকলন প্রকাশ করেছেন তাতে উল্টো-পাল্টা অনেকের লেখাপত্র আছে, এমনকি হাংরি আন্দোলনের সময়ে জন্মাননি যাঁরা, তাঁদের লেখাও সংকলিত হয়েছে, কিন্তু শম্ভু রক্ষিতের লেখা সেগুলোয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। শম্ভু রক্ষিতেরও তাতে বিশেষ কিছু আসে-যায় না ।
‘তিতীর্ষু’ পত্রিকায় অধ্যাপক সুমিতা চক্রবর্তী ‘হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের পটভূমি : শম্ভু রক্ষিত’ প্রবন্ধে লিখেছেন যে হাংরি আন্দোলনের ‘অষ্টম সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৪তে এবং অশ্লীলতার দায়ে সংখ্যাটির বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করা হয় । এই মামলায় অল্পসল্প হাজতবাস ছাড়া শেষ পর্যন্ত বিশেষ শাস্তি কারোরই হয়নি । বাংলার কবিরা একযোগে কবিদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।’ সুমিতা চক্রবর্তী যে ভুল বক্তব্য রেখেছেন হুবহু সেই একই বক্তব্য দেখা যায় আধ্যাপক শঙ্খ ঘোষের ‘শব্দ ও সত্য’ প্রবন্ধে : ওনারা দুজনেই জানেন না যে এই মামলা ৩৫ মাস চলেছিল আর ব্যাংকশাল কোর্টে আমার দুশো টাকা জরিমানা ( সেই সময়ে সর্বোচ্চ ) অনাদায়ে একমাস কারাদণ্ডের সাজা হয়েছিল । বলা বাহুল্য যে কবিরা একযোগে আমাদের পাশে দাঁড়াননি, শঙ্খ ঘোষও ছিলেন না আমাদের পাশে । সুমিতা চক্রবর্তী যে হাংরি বৈশিষ্ট্যগুলো শম্ভুর কবিতায় চিহ্ণিত করেছেন তা স্বীকার্য । আরেকটা কথা, ওই সংখ্যাটা মোটেই অষ্টম সংখ্যা নয় ; তার আগে শতাধিক বুলেটিন বেরিয়েছিল, বহু বুলেটিন স্টেনসিল করে, যাতে সুবিমল বসাকের আঁকা ড্রইং থাকতো ; বহু পোস্টার বুলেটিনও বের করেছিলেন অনিল করঞ্জাই এবং করুণানিধান মুখোপাধ্যায় ।
অধ্যাপক শঙ্খ ঘোষ সম্পর্কে ‘নতুন কৃত্তিবাস’ পত্রিকায় ( এপ্রিল – জুন ২০১৭ ) ‘এক কৃত্তিবাসীর আত্মকথা’ স্মৃতিচারণে শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় যে কথাগুলো লিখেছেন, তা, আমার মনে হয় লেখা জরুরি ছিল। শরৎ লিখেছেন, ‘শঙ্খ ঘোষ মহাশয় কিছুদিন আগে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের হাত থেকে জ্ঞানপীঠ পুরস্কার গ্রহণ করলেন । কয়েক বছর আগে প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর হাত থেকে তিনি একটি পুরস্কার নিতে অসন্মত হন, কারণ তিনি ছিলেন হিন্দুবাদী, বিজেপি পার্টির নেতা । শঙ্খ ঘোষ যে সিপিএম-সিপিআই দলের সমর্থক, এ-কথা আমরা আগেই জানতাম, কিন্তু একথা জানতাম না প্রধানমন্ত্রীর পদ পেলেও পার্টির দুর্গন্ধ মোছে না।’
হাংরি আন্দোলনের পক্ষ থেকে শম্ভু পত্রিকার নাম ‘ব্লুজ’ ( Blues ) কেন রেখেছিলেন আমার ঠিক মনে নেই, কয়টা সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল, তাও মনে নেই। আমরা তখন গাঁজা-আফিম-চরস-এলএসডি খেলেও শম্ভু খেতেন না সেই সময়ে, মানে আমরা দলবেঁধে বেরোবার সময়ে শম্ভুকে সঙ্গে পাইনি । কাঠমাণ্ডুতে আর খালাসিটোলাতেও তাঁকে সেই সময়ে দেখিনি কোনো দিন । বয়স কম হবার দরুন বেশ ইনোসেন্ট চেহারা ছিল শম্ভু রক্ষিতের । তখন শম্ভু হাওড়ার ঠাকুরদত্ত লেনে থাকতেন । হাংরি বুলেটিন ৯৯ নম্বরের প্রচ্ছদে হাংরি আন্দোলনকারীদের মুখগুলোর ফোটো সাজিয়ে একটা কোলাজ তৈরি করেছিলুম, তাতে আছে শম্ভুর ইনোসেন্ট মুখখানা ।
শম্ভুর কবিতা কয়েকটা হাংরি বুলেটিনে প্রকাশিত হয়েছিল । প্রকাশিত বুলেটিনগুলো নিজেদের সংগ্রহে রাখিনি বলে অধিকাংশই হারিয়ে গেছে । সম্প্রতি হিডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ড্যানিয়েলা ক্যাপেলো এসেছিলেন, যিনি হাংরি আন্দোলন নিয়ে পিএইচডি করছেন, তাঁর কাছ থেকে জানতে পারলুম বিদেশের বিভিন্ন আরকাইভে হাংরি বুলেটিনগুলো সংরক্ষণ করা হয়েছে, এমনকি তিনি মুখোশ আর বিয়ের কার্ডও দেখেছেন কার্ল ওয়েসনারের আরকাইভে । প্রথম যে কবিতা শম্ভু লিখেছিলেন তার শিরোনাম ছিল ‘আমি বাঁচতে চাই’ ।
হাংরি আন্দোলনের সময়ে আমি “জেব্রা” পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলুম, তার দ্বিতীয় সংখ্যায় শম্ভুর যে কবিতাটা প্রকাশিত হয়েছিল তার শিরোনাম ছিল “আমি স্বেচ্ছাচারী”, তাতে শম্ভু বলছেন যে তিনি রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ছেনি-শাবল চান, এবং তিনি হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন যে বাঘের মতন লাফিয়ে পড়বেন — শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের “আমি স্বেচ্ছাচারী” কবিতার অনেকদিন আগেই লিখেছিলেন শম্ভু। কবিতাটা এখানে দিলুম, লক্ষনীয় যে সেই সময়ের একরৈখিক কবিতার অনুশাসনকে শম্ভু ষাটের দশকে শুরুতেই অস্বীকার করেছিলেন :
আমি স্বেচ্ছাচারী
এইসব নারকেল পাতার চিরুনিরা, পেছন ফিরলে, এরাও ভয় দেখায় ।
কিছুই, এক মিনিট, কিছুই জানি না, সাম্যবাদী পার্লামেন্টে জনশ্রুতি সম্পর্কে বা ।
চণ্ডাল কুকুরদের আর্তনাদ আমাকে ঘিরে– এবং আমাকে আলবৎ জানতে হবে, আলবৎ আমাকে
ডুবতে দিতে হবে, যেতে দিতে হবে যেখানে যেতে চাই না, পায়চারি করতে দিতে হবে ।
আমার গলা পরিষ্কার — আমি স্বেচ্ছাচারী – কাঁচের ফেনার মধ্যে চুল — স্পষ্ট করে কথা বলতে দিতে হবে
আর কথাবার্তায় তেমন যদি না জমাতে পারি সেরেফ
পায়চারি করে ঘুরে বেড়াবো — সমস্ত পৃথিবীর মেঘলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে ।
ক্রোধ ও কান্নার পর স্নান সেরে । ঘামের জল ধুয়ে — শুদ্ধভাবে আমি সেলাম আলয়কুম জানিয়ে
পায়চারি করে ঘুরে বেড়াবো ১ থেকে ২ থেকে ৩, ৪, ৫ গাছের পাতার মতো । রিরংসায় ।
মাটিতে অব্যর্থ ফাঁদ পেতে রেখে । রাস্তায় । ব্রিজের ফ্ল্যাটে । ট্রেনে,
যে কোনো কিশোরীর দেহে । শেষ রাতে — পৃথিবীর মানচিত্র এঁকে, কেবল স্হলভাগের
হু হু করে জেটপ্লেনে আমি যেতে চাই যেখানে যাবো না, এর ভেতর দিয়ে
ওর ভেতর দিয়ে — আর । হুম । একধরনের ছেনি-শাবল আমার চাই–
যা কিছুটা অন্যরকম, রবীন্দ্রনাথ বা জীবনানন্দের নয় — ঠিক
খেলার মাঠে স্টার্টারের পিস্তলের মতো — রেডি — আমি বাঘের মতন লাফিয়ে পড়ব । খবরদার ।
তারপর ১৯৬৪ সালে আমার মামলা-মকদ্দমা আরম্ভ হল, পঁয়ত্রিশ মাস চলল, শৈলেশ্বর ঘোষ আর সুভাষ ঘোষ রাজসাক্ষী হল আমার বিরুদ্ধে । পুলিশের পক্ষের সাক্ষী হিসাবে আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিলেন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং উৎপলকুমার বসু । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যে চিঠি অ্যালেন গিন্সবার্গকে লিখেছিলেন তাতে উনি জানিয়েছিলেন যে পুলিশ সবসুদ্ধ ছাব্বিশজন কবি-লেখককে জেরা করেছিল লালবাজারে ডেকে । ‘নতুন কৃত্তিবাস’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছেন যে যাদের ডাকা হয়েছিল তাদের মধ্যে অনেকেই মুচলেকা দিয়েছিল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মুচলেকার বদলে হাংরি আন্দোলনের বিরুদ্ধে ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকায় একটা সম্পাদকীয় লিখেছিলেন, যাকে মুচলেকাই বলা চলে, তখন কেস সাব জুডিস ।
শম্ভু রক্ষিত আর বিনয় মজুমদারকে লালবাজারে ডেকে জেরা করা হয়েছিল কিনা জানি না । কিন্তু মামলার জন্য শম্ভু রক্ষিতের ‘ব্লুজ’ পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায় । তার বেশ কিছুকাল পরে উনি প্রকাশ করা আরম্ভ করেন ‘মহাপৃথিবী’ নামের পত্রিকা । বিনয় মজুমদার আর শম্ভু রক্ষিত দুজনেই কবিতা লেখা ছাড়া সারাজীবনে আর কিছু করেননি । আর এনারা দুজনে কবিতা লিখে জানাননি যে শুধু কবিতার জন্যই তাঁরা বেঁচে আছেন, যেমনটা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখে গেছেন । যাই হোক, শম্ভু রক্ষিত আর বিনয় মজুমদার মুচলেকা দেননি এবং পুলিশের পক্ষের সাক্ষী হননি । আমার অনেক সময়ে মনে হতো যে হাংরি আন্দোলনে ছিলেন বলেই প্রাতিষ্ঠানিক পুরস্কারগুলো শম্ভু রক্ষিতকে দেয়া হয়নি এবং বিনয় মজুমদারকে মৃত্যুশয্যায় দেয়া হয়েছিল । তাছাড়া আত্মসন্মানের দরুণ এনারা দুজন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের স্তাবকদের দলে ঢোকেননি । অথচ কবিদের মধ্যে এঁদের দুজনের আর্থিক অবস্হা সবচেয়ে দয়নীয় বলা চলে, পুরস্কারের টাকা এনাদের কাজে লাগতো ।
সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় মুচলেকা দিয়েছিলেন আর পুলিশের পক্ষে আমার বিরুদ্ধে সাক্ষী হয়েছিলেন । তিনি বলেছেন যে তিনিই প্রতিষ্ঠানবিরোধি, অথচ প্রাতিষ্ঠানিক পুরস্কারের জন্য দুবেলা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে গিয়ে বনসে থাকতেন । তাঁর অযুহাত ১৯৮৬ সালে সুমিতাভ ঘোষালের ‘গদ্য-পদ্য সংবাদ’ পত্রিকায় লিখে জানিয়েছিলেন ; লেখাটা তুলে দিচ্ছি এখানে, অনেকে পড়েননি বলেই মনে হয় :
“সে-সময়ে আমাদের কেউই পাত্তা দিত না তা যারা হাংরি আন্দোলন শুরু করে সেই মলয় রায়চৌধুরী এবং সমীর রায়চৌধুরী আমাকে জানান যে আমার লেখা ওদের ভালো লেগেছে, ওরা যে ধরণের লেখা ছাপাতে চায়, তা নাকি আমার লেখায় ওরা দেখতে পেয়েছে, তাই আমার লেখা ওরা ছাপতে চায় । ওদের কাছে পাত্তা পেয়ে আমি খুবই আহ্লাদিত হয়েছিলুম।
হাংরি আন্দোলনের ইস্তাহার আমি অনেক পরে দেখেছি । সসময়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের একটা গল্প আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল । বলতে গেলে সেই গল্পটার জন্যই আমি হাংরি আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলুম । গল্পটার নাম আমার ঠিক মনে নেই । গল্পটা ছিল অনেকটা এইরকম — একটা ছেলে, তাত ভীষণ খিদে । একদিন ছাত্রীকে পড়াতে পড়াতে ছাত্রীর আঁচলের খুঁটটা খেতে শুরু করে । এই ভাবে সে একটু-একটু করে পুরো শাড়িটাই খেয়ে ফ্যালে । তাতে তার বেশ ভালোই লাগে । তখন সে ছাত্রীকেই খেতে শুরু করে । একটু টক টক লাগে কিন্তু শেষ পর্যন্ত পুরো ছাত্রিকেই সে খেয়ে ফ্যালে । এ বভাপারটায় সে বেশ মজা পেয়ে যায় । এরপর থেকে সে অনেককিছুই খেতে শুরু করে। যেমন জানালা, চেয়ার,ছাপাখানা, নোটবুক ইত্যাদি । একদিন এক হোটেলের সান্ত্রীকে সে খেয়ে ফ্যালে । এই ছেলেটিই একদিন গঙ্গার ধারে তার প্রেমিকাকে নিয়ে বসেছিল । হঠাৎ তার সেই খিদেটা চাগাড় দিয়ে ওঠে । তখন সেই ছেলেটি গঙ্গার পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটা জাহাজকে খেতে যায় । কিন্তু সেই ছেলেটি জাহাজটাকে খেতে পারে না । জাহাজটা ছেড়ে দ্যায় । তখন সেই ছেলেটি একটা চিরকুট গঙ্গায় ভাসিয়ে দ্যায় । সেটা ঠিক কার উদ্দেশ্যে ভাসিয়েছিল তা জানা যায় না । ছেলেটির প্রেমিকার উদ্দেশ্যেও হতে পারে । পৃথিবীর উদ্দেশ্যেও হতে পারে । বা অন্য কিছুও হতে পারে । এখানেই গল্পটার শেষ । এই গল্পটা আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল এবং আমার মনে হয়েছে ক্ষুৎকাতর আন্দোলনের এটাই মূল কথা ।
আমি হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে ভীষণভাবেই জড়িত ছিলাম । হাংরি আন্দোলনের আদর্শ — আমার ভালো লেগেছিল এবং তা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেছিলাম বলেই আমি ওদের সঙ্গে ছিলাম । এ ব্যাপারে আমার কোনো দ্বিমত নেই । কিন্তু পরের দিকে ওরা আমাকে না জানিয়ে আমার নামে পত্রিকা-টত্রিকা বার করে । যা আমাকে ক্ষুব্ধ করেছিল ।
তখন আমি কৃত্তিবাসের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম । কিন্তু এই হাংরি আন্দোলন যখন শুরু হয় তখন সুনীল আমেরিকায় । এই আন্দোলনকে সুনীলের অসাক্ষাতে একটা ক্যু বলতে পারা যায় ।
প্রতিষ্ঠানের লোভ আমার কোনোদিনই ছিল না । বাংলাদেশে যদি কেউ্ আগাগোড়া প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার ভূমিকা পালন করে থাকে তবে তা আমি । আমার ‘বিজনের রক্তমাংস’ গল্পটি বেরনোর পর থেকে আমার সে ভূমিকা অব্যাহত ।
আমি মনে করি ওরকমভাবে দল পাকিয়ে সাহিত্য হয় না । একজন লেখক নিজেই অতীত, নিজেই ভবিষ্যত, নিজেই সমাজ, নিজেই সভ্যতা এবং নিজেই সবকিছু । সাহিত্যের দৃষ্টিতে দলের কোনো ভূমিকা থাকতে পারে না ।
আমি মুচলেকা দিয়েছিলাম তার দুটো কারণ । এক, আমি পুলিশকে ভীষণ ভয় পাই আর দুই, আমার বউ আমাকে জেলে যেতে বারণ করেছিল । বউ বললো যে একেইতো তোমার মতো মদ্যপকে বিয়ে করার জন্য আমার আত্মীয় পরিজনরা সব আমার সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়েছে । তার ওপর তুমি যদি জেলে যাও তাহলে সোনায় সোহাগা হবে । সেই জন্যে আমি ওদের সঙ্গে সব সম্পর্ক ত্যাগ করি ।”
ইন্দিরা গান্ধির চাপানো এমারজেন্সির সময়ে জেলে পোরা হয়েছিল শম্ভু রক্ষিতকে । প্রেসিডেন্সি জেলে ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে থাকার সময়ে ২ ডিসেম্বর ১৯৭৬ তিনি এই কবিতাটি লিখেছিলেন, শিরোনাম ‘রাজনীতি’ :
চ্যান্টার — অশ্ব আর গ্রহদের নিয়ে আমি এখন আর পালিয়ে বেড়াই না
নির্দোষদের বন্দি করার নীতি ধ্বংস করে আমি আমার খনন শুরু করি
এবং বস্তুতঃ এমন একটা বক্তব্য উচ্চকন্ঠে তুলে ধরতে চেষ্টা করি
ঐন্দ্রজালিক উদোম ন্যাংটো সব বিশ্লেষণকে যা আগেই এড়িয়ে যায়
আমি চিন্তানায়কদের দিকে ককনও তাকাইনি, এখনও তাকাচ্ছে না
তবে জেলের টাইপরা সুপারকে কয়েকবার বলেছি :
আপনাদের শ্রুতিঘোড়াটি একমাত্র ‘সর্বশক্তিমান’ নয়, আপনিও !
বন্দিনিবাসেও দু-দশদিন অন্তর তাই আমার চামড়া ভাঁজ করে শুকিয়ে ফেলা হয়
ভোঁ… ভোঁ… ও অশান্ত অঞ্চল গান শব্দে ‘পাগলি’ বেজে ওঠে…
কারাবাস সম্পর্কে শম্ভু বলেছেন :
দেখুন জেল খুব ভালো জায়গা । এই জেলখানাতে খুব সহজে
যাওয়া যায় না । আপনার টাকাপয়সা থাকলে আপনি
পৃথিবী ভ্রমণ করতে পারবেন, কিন্তু আপনি ইচ্ছেমতো
জেলখানায় জেতে পারবেন না । আমার তো জেলখানা খুব
ভালো লেগেছে । আমার মনে হয় প্রত্যেক কবি যদি
একবার করে জেলখানায় ঘুরে আসতে পারতেন তো খুব
ভালো হত ।
বিনয় মজুমদার পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়াই সীমান্ত পেরিয়ে চলে গিয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তানে । সেখানে তাঁকে তিন মাসের জন্য জেলে পোরা হয়েছিল । শম্ভু রক্ষিত আর জ্যোতির্ময় দত্ত আট মাস জেলে ছিলেন । স্পেশাল ব্রাঞ্চের যে পুলিশ অফিসার তাঁদের ওপর দৈহিক অত্যাচার করেছিল তার নাম তারাপদ, যে কমিশন ব্যাপারটি অনুসন্ধান করেছিল, তার রিপোর্ট থেকে জানা গেছে ।
অক্ষয়কুমার রমনলাল দেশাই সম্পাদিত “ভায়োলেশান অফ ডেমোক্র্যাটিক রাইটস” এর তৃতীয় খণ্ডে লেখা হয়েছে যে ১৯৭৬ সালে পুলিশ শম্ভু রক্ষিত, জ্যোতির্ময় দত্ত এবং প্রশান্ত বসুর ওপর হাজতে অকথ্য অত্যাচার করেছিল, তারপর বিনা বিচারে তাঁদের আটমাস আটক রাখা হয়েছিল । গ্রেপ্তার করার সময়ে তাঁদের বাসস্হানের সমস্ত জিনিস পুলিশবাহিনী ইচ্ছাকৃতভাবে লণ্ডভণ্ড করেছিল । জ্যোতির্ময় দত্তের বাড়ি শম্ভু রক্ষিতের হাওড়ার ফ্ল্যাটের তুলনায় অভিজাত ছিল । জ্যোতির্ময় দত্তের মেয়ে সেই সময়ে পুলিশের আচরণের যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা পড়ে শম্ভু রক্ষিতের সঙ্গে কেমন আচরণ করা হয়েছিল, তার হদিশ মেলে, কেননা গরিবের ওপর অত্যাচার করে পুলিশ যারপরনাই উল্লসিত হয় । শম্ভু রক্ষিতের তখনকার পোশাক যেমন ছিল, এখনও তেমনই জীর্ণ ও মলিন, পায়ে রবারের চটি ।
এমারজেন্সি উঠে যাবার পর নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধি হেরে গেলে প্রশাসন ও পুলিশের বাড়াবাড়ি অনুসন্ধানের জন্য কমিশন বসানো হয়। অনুসন্ধান করে রিপোর্ট দেবার জন্য সরকার যে কমিশন নিয়োগ করেছিল, তার রিপোর্টে স্পষ্ট নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, যে-পুলিশকর্মীদের বেআইনি কাজ সম্পর্কে রিপোর্টে অভিযোগ করা হয়েছে, তাদের উপযুক্ত শাস্তি দেয়া হোক । শাস্তি দেবার ভার এসে পড়ে ১৯৭৭ সালে গদিতে-বসা বামপন্হী সরকারের ওপর, কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু হাত গুটিয়ে বসে থাকেন, বরং তারাপদ আর রুণু গূহনিয়োগীকে উঁচু পদে প্রোমোশানের জন্যে সুপারিশ করেন । সেই তখন থেকেই বামপন্হীদের প্রতিশ্রুতিভঙ্গের কালখণ্ড আরম্ভ হয় ।
শম্ভুর সঙ্গে আমার আবার দেখা হলো আশির দশকের শেষ দিকে, কফিহাউসে । আমি সেসময়ে লখনউতে থাকতুম । আমি কলকাতায় গিয়েছিলুম উত্তম দাশ-এর মহাদিগন্ত প্রকাশনী থেকে আমার কবিতার বই ‘মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর’ প্রকাশ উপলক্ষ্যে । দেখলুম শম্ভু রক্ষিতের চেহারায় দরকচা পড়ে গেছে, মুখ থেকে বাংলা মদের গন্ধ, সেই ইনোসেন্ট চাকচিক্য আর নেই, চোয়াল দুমড়ে গেছে । শম্ভু আমার ঠিকানা নিলেন আর মাঝে-মধ্যে ‘মহাদিগন্ত’ পাঠাতেন, দুটি কাব্যগ্রন্হ পাঠিয়েছিলেন, “প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না” আর “পাঠক অক্ষরগুলি” । আমি কয়েকবার লিখেছি ওনার পত্রিকায়, যতোদূর মনে পড়ে । দেখে বুঝতে পারলুম যে হাওড়ানিবাসী “ব্লুজ” পত্রিকার সম্পাদক সেই কচি গালফোলা শম্ভু রক্ষিতকে আমি ভুলে গেছি।
‘প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না’ কাব্যগ্রন্হটি পড়ে বুদ্ধদেব বসু শম্ভু রক্ষিতকে লিখেছিলেন, “বইটি পড়ে আমি অভিভূত হয়েছি”। শক্তি চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, “সত্তরের আধুনিক কবিদের মধ্যে সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিমান ও সম্ভাবনাময়” কবি শম্ভু রক্ষিত । শঙ্খ ঘোষ বলেছিলেন, “তাঁর কবিতা সমকালের পাঠকরা সেভাবে অনুধাবন করতে না পারলেও, আগামী দিনের পাঠকরা সঠিক মূল্যায়ন করবে।” ব্যাস, এই পর্যন্তই । যাঁরা অকাদেমি, বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা ও তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ, সংস্কৃতি দপতরের কর্ণধার, বড়ো কাগজের কবিতা-সম্পাদক, তাঁরা শম্ভু রক্ষিতকে নিজেদের পরিমণ্ডলের বাইরে অস্পৃশ্য করে রেখে দিলেন । পাওয়া আর পাইয়ে দেবার যে সাংস্কৃতিক নোংরামি বামপন্হীদের রাজত্বের সময় থেকে আরম্ভ হলো, শম্ভু রক্ষিত স্বেচ্ছায় সেই নোংরামির বাইরে রাখলেন নিজেকে, যাতে তাঁর কবিজীবন দূষিত না হয়ে যায় । এতাবৎ তাঁর আটটি কাব্যগ্রন্হ প্রকাশিত হয়েছে । কলেজ স্ট্রিটের প্রকাশকদের মধ্যে কেবল অধীর বিশ্বাসের গাঙচিল প্রকাশনী থেকে বেরিয়েছিল “শম্ভু রক্ষিতের কবিতাগুচ্ছ”।
আমার সঙ্গে শম্ভু রক্ষিতের আবার দেখা হলো দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুটিয়ারির বাড়িতে, তখনও পুরোনো বাড়িটা ভেঙে ফ্ল্যাটবাড়ি হয়নি । আমি হুইস্কির একটা বড়ো বোতল নিয়ে গিয়েছিলুম । আমার “অ” বইটা উৎসর্গ করেছিলুম দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়কে, সেটা দিতে গিয়েছিলুম, আর বইটা সেলিব্রেট করার জন্য হুইস্কি। আমার কোনো বইয়েরই ঘটা করে কোনো মঞ্চে লেকচারবাজিসহ উদ্ঘাটন বা মোড়ক মোচন হয় না । অনুমান করি শম্ভুর বইয়েরও তেমন আনুষ্ঠানিক হইচই হয় না । যাই হোক কিছুক্ষণ পরে শম্ভু রক্ষিত এলেন, দেবীপ্রসাদের কাছ থেকে কবিতা নেবার জন্য আর ওনাকে ‘মহাদিগন্ত’ দেবার জন্য, হাতে একগোছা প্রুফ– দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতার । আমাকে অবশ্য দিলেন না, কবিতাও চাইলেন না । কাঁচাপাকা কয়েক দিনের দাড়ি, মাথার সামনে দিকে টাক পড়ে গেছে, চোখের কোল বসে গেছে, হনু আর কন্ঠা ঠেলে বেরিয়ে এসেছে, রোগাটে হয়ে গেছেন ।
শম্ভু রক্ষিত চলে যাচ্ছিলেন, আমি বললুম, কিছুক্ষণ থাকো, মদের বোতলটা ঝোলা থেকে বের করলুম । শম্ভুর মুখে ঔজ্বল্য ফুটে উঠলো । মদ খাওয়া আরম্ভ হলো । আমি নিজেকে জানি যে কতোটা মদ আমি খেতে পারবো অথচ মাতাল হবো না । তারপর আমি খাই না, কেননা বাড়িতে একা মদ খেয়ে আমার অভ্যাস হয়ে গেছে ; সাধারণত আমি একা বসে মদ খেতে ভালোবাসি, আর সিঙ্গল মল্ট ছাড়া খাই না ।
শম্ভু গেলাসের পর গেলাস খেয়ে চললেন ; মাতাল হয়ে গেলেন । দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন শম্ভুকে টালিগঞ্জ মেট্রোয় পৌঁছে দিতে । মদ খেতে-খেতে শম্ভু বললেন যে, প্রেসে বসে উনি নিজেই হরফ সাজাবার কাজটা করেন । এখন কমপিউটার এসে যাবার পর তিনি কী করে ছাপান, বা পত্রিকা বেরোয় কিনা জানি না ।
রিকশায় বসে টলছিলেন শম্ভু । বললেন, ওনার কোনো অসুবিধা হয় না, অন্যের, যারা মুখ থেকে গন্ধ পায়, তাদের অসুবিধা হয় । পথে শম্ভু রক্ষিত প্রস্তাব দিলেন একদিন ওনার বিরিঞ্চিবেড়িয়া গ্রামে মহাপৃথিবীতে যেতে, এক কাঠা জমিতে গাঁজার চাষ আরম্ভ করেছেন, ফোঁকা যাবে । আমার যাওয়া হয়নি। শম্ভুর কাঁধের ঝোলায় প্রচুর প্রুফের কাগজ দেখে মনে হচ্ছিল যে অন্যান্য কবিরাও শম্ভুকে দিয়ে প্রুফ দেখার কাজটা করিয়ে নেন, কেননা প্রুফ দেখতে-দেখতে শম্ভু এক্সপার্ট হয়ে গেছেন । আর সেকারণেই ওনার দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে গেছে।
ভূমেন্দ্র গুহ, আমার দ্বিতীয় হার্ট অ্যাটাকের পর যিনি আমার চিকিৎসা করেছিলেন, তিনি গিয়েছিলেন হলদিয়ার সুতাহাটার প্রত্যন্ত গ্রাম বিরিঞ্চিবেড়িয়ায় শম্ভুর বাড়িতে, বেশ খানিকটা হাঁটা পথ । বলেছিলেন যে ঢুকেই দেখা যায় দেয়ালে বড়ো-বড়ো করে লেখা রয়েছে মহাপৃথিবী । ভাঙাচোরা চালা । নিজেই কোদাল চালিয়ে চাষবাস করেন ; মনে হয় নিত্যদিনের প্রয়োজন চাষ থেকে, আর পত্রিকা-বই বিক্রি করে কিছুটা মেটে । ছেলের নাম কীর্তিকর, সে এক কারখানায় চুক্তিভিত্তিক কাজ করে ; মেয়ে দিওতিমা । তাঁর একমাত্র টেবিল ফ্যানটি চোরে তুলে নিয়ে চলে গেছে ।
ভূমেন্দ্র গুহের কাছেই শুনেছিলুম যে শম্ভুর শরীর অত্যন্ত খারাপ এবং রোগ সারাবার টাকাকড়ি না থাকায় ভূমেন্দ্র গুহর উদ্যোগে কলকাতার একচল্লিশজন খ্যাতনামা পেইনটাররা, পরিতোষ সেন, যোগেন চৌধুরী, রবিন মন্ডল, তপন মিত্র এবং বুদ্ধিজীবি কালীকৃষ্ণ গুহ, সন্দীপ রায় প্রমুখ শম্ভু রক্ষিতের সাহায্যার্থে একটি প্রদর্শনী করেছিলেন, আর পেইনটিং বিক্রির টাকা শম্ভুকে দেয়া হয়েছিল । সে যাত্রা শম্ভু সেরে ওঠেন ।
এখন শম্ভু রক্ষিতের স্বাস্হ্য আরও খারাপ হয়ে গেছে, চোখে ঠিকমতন দেখতে পান না, একটি চোখের দৃষ্টি হারিয়েছেন, বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে অসুবিধা হয়, হাঁটাহাঁটি করতে, পায়ে ও বুকে ব্যথা ধরে । ফলে আগের মতো আর নিয়মিত কবিতা লিখতে পারেন না । পুলিশের অত্যাচারে ভেঙে-পড়া স্বাস্হ্য ফিরে পায়নি বলেই মনে হয় ।
আগের প্রসঙ্গে ফিরে যাই । দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি থেকে বেরিয়ে রিকশায় বসে শম্ভু রক্ষিতের সঙ্গে কথা বলতে-বলতে মনে হচ্ছিল যে, উনি নিজের গড়ে তোলা কবিতার জগতে একা বসবাস করেন । সেখানে কাউকে ঢুকতে দেন না । তাঁর লিখে যাওয়াই প্রধান কাজ । কেউ পড়লো কি পড়লো না, কোথাও আলোচনা হলো কি হলো না, তাঁকে কবিতা পড়তে কোথাও ডাকা হোক বা না হোক, তাতে শম্ভুর কিচ্ছু যায় আসে না । কলকাতার দু’তিন দিনব্যাপী বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠকদের যে দীর্ঘ তালিকা আমন্তনপত্রে ছাপানো হয়, তাতে ওনার নাম কচ্বিৎ কখনও দেখেছি । সম্প্রতি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাহিত্য অকাদেমির উদ্যোগে আগস্ট ২০১৬ সালে যে কবিসন্মেলন হলো তাতে শম্ভু রক্ষিতকে কবিতা পড়ার জন্য ডাকা হয়েছিল । হাংরি আন্দোলনের কবি প্রদীপ চৌধুরীকেও ডাকা হয়েছিল । মূলত অধ্যাপক সুতপা সেনগুপ্তের উদ্যোগে । শম্ভুর কবিতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুললে উনি কেবল মুচকি হাসি দিয়ে তার উত্তর দেন । সম্ভবত মনে করেন. “এ শালারা আমার কবিতা কী বুঝবে।”
সাহিত্য জগতের দিকে যে তিনি একেবারেই হাত বাড়িয়ে দেন না, তা বোধহয় বলা যাবে না, কেননা ২০০৮ সালে তিনি বুদ্ধদেব বসুকে নিয়ে ‘মহাপৃথিবী’র বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছিলেন । তিনি আমেরিকা নিবাসী বাংলাদেশের সাহিত্যানুরাগীদের দেয়া “শব্দগুচ্ছ” পুরস্কার পেয়েছিলেন । তাঁর কবিতা ইংরেজি ও হিন্দিতে অনুদিত হয়েছে ।
আসলে বর্তমান বাংলা সাহিত্যের সামন্তবাদী ভুলভুলাইয়ার বাইরে সম্পূর্ণ বেপরোয়া না হলে নিজের যা ইচ্ছে লেখা যায় না, যা আমরা দেখেছি উইলিয়াম ব্লেক, আর্তুর র্যাঁবো, মালার্মের প্রথাবহির্ভূত কবিতার ক্ষেত্রে । শম্ভুর কবিতা পড়ে টের পাওয়া যায় যে তিনি কারোর তোয়াক্কা করেন না, যেমন ইচ্ছে হয় তেমনভাবেই লেখেন। আমি প্রতিষ্ঠান শব্দটা প্রয়োগ করলুম না । প্রতিষ্ঠান ভাবকল্পটা এমন ঘেঁটে গেছে যে বঙ্গসাহিত্য ও সংস্কৃতির সামন্তবাদী দিকটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো যায় না ।
যাঁরা আমাদের সংবিধান লিখেছিলেন তাঁরা কেউই অনুমান করতে পারেননি যে উত্তর-ঔপনিবেশিক সামন্তবাদ ওই সংবিধানেই ঘুমিয়ে আছে, আর সময়ে মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে । ক্ষমতাবানদের জুতো সাফ করবে বা জুতোর ফিতে বেঁধে দেবে আমলারা, সরকারি চাকুরেকে চটিপেটা করে ফলাও করে সেকথা বলে বেড়াবেন সাংসদ । হাজার-হাজার গরিবের টাকা মেরে লোপাট করে দেয়া হবে, আর জেলফেরত রাজনৈতিক আসামীরা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াবে, জেল থেকে বেরিয়ে দু-আঙুল তুলে ভিক্টরি সাইন দেখাবে, বুড়ো-বুড়িরা তাঁদের থেকে কম বয়সী নেতা-নেত্রীর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করবেন । উত্তর-ঔপনিবেশিক সামন্তবাদের পচাইতে বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি যে ভাবে পচেছে, দিকে-দিকে গজিয়ে উঠেছে গ্যাঙলর্ডরা আর তাদের জিহুজুরিরা । আত্মসন্মানবোধসম্পন্ন শম্ভু রক্ষিতের পক্ষে, তাঁর অর্থনৈতিক দারিদ্র্য সত্ত্বেও, কোনো গ্যাঙের সদস্যতা নেয়া অসম্ভব ছিল ।
শম্ভুর একটি লেখা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত কেমন করে গজিয়ে ওঠে তা এক রহস্য । কবিতা বিশেষটি আরম্ভ করে শম্ভু ক্রমশ ভঙ্গুর ডিকশনের মাধ্যমে তাঁর গঠনবিন্যাসের ল্যাবিরিন্হে নিয়ে যান । ছবি পুরো গড়ে ওঠার আগেই অন্য ছবিতে চলে যান । ষাট, সত্তর, আশি, নব্বুই দশকের কবিতার যে ধারা তার সঙ্গে শম্ভুর কবিতার মিল নেই । তিনি নিজের বাক্য-সাজানোর কৌশল গড়ে ফেলেছেন এবং তা থেকে কখনও সরে যাননি, আশে-পাশে নানারকমের আন্দোলন ও শৈলী-নিরীক্ষা সত্তেও। মনে হয়, এই বুঝি একটা ন্যারেটিভ গড়ে উঠলো, কিন্তু পরের পংক্তিতেই বাঁকবদল নিয়ে ভিন্ন দিকে চলে যান, ছিঁড়ে যায় ন্যারেটিভ ।
তাঁর “প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না” কাব্যগ্রন্হ থেকে ২৭ সংখ্যক কবিতাটা পড়া যাক :
হৃদরোগের সন্ধান নিয়ে ঢুকে পড়ো । সরবরাহকারী নির্মাণযন্ত্র
পৃথিবীর মেঘময় আতঙ্ক শেষপর্যন্ত আধার হিসেবে ।
উর্ধ্বময় সর্বনাশ ভেবে স্নায়ুতন্ত্রের কাজ । সুরক্ষিত জল
দহনক্রিয়া মাথার ধমনী ছিঁড়ে যাও, বোতল, বায়ুর কাঠিন্য অনুশীলন শরীর
অরণ্যসমগ্র, পাখিদের শ্রবণশক্তি, আঙুর সমস্যা সহজ নয়
উজ্বল মাথার পর্যবেক্ষণ ভেঙে অবসাদগ্রস্ত উচ্চগ্রামের অংশে
প্রমাণিত হই ; অন্ধ দৈবজ্ঞ, সৌরশক্তি, প্রশান্তি যেন আওয়াজ বিক্রি
টিন-ভর্তি কুয়াশা নিয়ে মানুষ-জীবজন্তুর মাথা হয়ে হাতজোড় করি
বসো গৌরবসূর্য, অদ্ভুত ভুত-প্রেত বিশ্বাস সে-বিষয়ে সচেতন
পৃথিবীর মেঘ, শিস, দৃষ্টিনির্ভর আস্বাদনের ফসল-রহস্যের মিশ্রণ চেতনা
অতুল ঘনরাশি ও উরসুলার কিয়দংশের লাল রং লেগে আছে দুর্যোগমথিত
এলাকায় ; তোমার কোনো অলৌকিক পরিক্রমা নেই । শুধু ফুলবাগিচার
ও জলবায়ু কুয়াশার অংশ লক্ষনীয়, সাড়া দাও, রূপকের মতো বিবরণ, দৈববাণী
সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়ে যায় ; শরীরের ভিতর বেশি, নিশ্চিত প্রমাণ এই
গবেষণাশক্তি, কেন না, এখানে এই উক্তি সত্যি স্বর্ণসূর্য হয় — আবিষ্কার
রং তুলি বিপদের হুঁশিয়ারি রূপকর্ম হয় ও যেন আদানপ্রদান
তোমার সহানুভূতিশীল হৃদয়টি আমার চাই
শম্ভু রক্ষিতের কবিতার সঙ্গে তাঁর সমসাময়িক কবিদের তুলনা আমি গাজর বা আলু আর আদার তফাত দিয়ে বোঝাতে চাইব, যাতে পাঠকদের বুঝতে সুবিধা হয় । গাজর উপড়ে তোলার আগেই আমরা জানি গাজরের আদল-আদরা রঙরূপ কেমন । আলুর ক্ষেত্রেও তাই, আলাদা আলাদা প্রায়-গোল আলু বেরোবে । কিন্তু আদা গাছ ওপড়াবার সময়ে কেউই বলতে পারেন না যে কেমনতর চেহারা নিয়ে আদা মাটি থেকে বেরোবে, তার আদল-আদরা কেমনধারা হবে । শম্ভুর সমসাময়িক কবিদের কবিতা গাজর আর আলুর মতন, কবির নাম দেখেই বলে দেয়া যায় যে লেখাটা লম্বা বা গোল কেমন হবে । আদার ক্ষেত্রে বলা যায় না । আদা কেমনভাবে মাটির তলায় এঁকে-বেঁকে শুয়ে আছে তা ওপড়াবার আগে বলা যায় না । শম্ভু রক্ষিতের নাম দেখে কবিতাটার আদল-আদরা কেমন হবে বলা সম্ভব নয় । কবিতাটা পড়েই কেবল তা বোঝা যাবে । মাটির তলায় আদা যে প্রক্রিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে তার নাম রাইজোম ; অর্থাৎ শম্ভু রক্ষিতের কবিতাগুলো রাইজোম্যাটিক ।
গাজর হলো রৈখিক, আদা কিন্তু রৈখিক নয় । তেমনই শম্ভু রক্ষিতের কবিতা বহুরৈখিক । আলু স্বয়ংসম্পূর্ণ, আর্ট ফর আর্টস সেকের মতন আলু ফর আলুজ সেক । তাকে আদার মতন ভেঙে ফেলা যায় না । আসলে মানুষ তো জলে ঘেরা দ্বীপ নয়, তেমনই শম্ভুর কবিতাও ভাষায় ঘেরা দ্বীপ নয়, তাঁর পাঠবস্তু ছড়িয়ে পড়ে । শম্ভুর সমসাময়িক কবিদের কবিতা আমাদের স্মৃতিকোষে ঢুকে পরিচিত ইশারা পেয়ে যায় । শম্ভুর ক্ষেত্রে তাঁর কবিতার বহুমাত্রিকতার কারণে আমাদের স্মৃতিকোষে পরিচিত ইশারা খুঁজে পায় না । কবিতাটি কেমনভাবে এগিয়ে চলেছে তা যদি পাঠক নিখুঁতভাবে অনুসরণ না করেন, তাহলে তিনি পথ গুলিয়ে ফেলতে পারেন, কিংবা পূর্বেকার কোনো ইশারার সঙ্গে মিশিয়ে ফেলতে পারেন ।
শম্ভুর কবিতাটি শুরুতেই বলছে “হৃদরোগের সন্ধান নিয়ে ঢুকে পড়ো।” তারপরেই লাফিয়ে চলে যাচ্ছে অন্য একটি প্রসঙ্গে যা আগের বাক্যটির সঙ্গে সংযুক্ত হতেও পারে বা নাও পারে, “সরবরাহ নির্মাণকারীযন্ত্র পৃথিবীর মেঘময় আতঙ্ক শেষপর্যন্ত আধার হিসাবে।” পাঠককে নির্ণয় নিতে হবে যে তিনি নিজের না কবির, কার হৃদরোগের সন্ধান নিয়ে ঢুকবেন, এবং কোথায় ঢুকবেন, হাসপাতালের আইসিইউতে, অপারেশান থিয়েটারে, নাকি কবিতাটির ভুলভুলাইয়ায়, যা আতঙ্কের আধারকে কোনও একটি দিকে চালিত করে চলেছে । যে ‘ভাইব’ কবি গড়ে তুলছেন, তা কার আত্মসচেতনার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছে, তা অনুধাবন করতে হবে ।
শম্ভুর সমসাময়িক অধিকাংশ কবিই মিনিম্যালিস্ট, তাঁরা শব্দ গুণে-গুণে, সংক্ষেপে কবিতার থিমকে তার ভেতরে ঢুকিয়ে দিতে চান । যদি বিশেষ ছন্দের আঙ্গিকে লিখতে হয়, যেমন সনেট, তাহলে সেই আঙ্গিকেই আঁটিয়ে দিতে হবে । শম্ভু ওই ঔপনিবেশিক মানদণ্ডকে মান্যতা দিচ্ছেন না । তিনি একজন ম্যাক্সিম্যালিস্ট কবি, নির্দিষ্ট সীমায় আবদ্ধ থাকতে রাজি নন, পাঠবস্তুটিকে তিনি ছড়িয়ে যাবার স্বাধীনতা দেন, মাঝপথে হঠাৎ ডাইভার্সান নিয়ে অন্যান্য থিমের সন্ধানে এগিয়ে যান । একদিকে তিনি “উজ্বল মাথার পর্যবেক্ষণ ভেঙে অবসাদগ্রস্ত উচ্চগ্রামের অংশ প্রমাণিত” হন, আবার আরেকদিকে “টিন ভর্তি কুয়াশা নিয়ে মানুষ জীবজন্তুর মাথা হয়ে হাতজোড়” করেন । তাঁর এই অবসাদ যেমন ভাস্কর চক্রবর্তীর মধ্যবিত্ত শহরজীবনের অবসাদ নয়, তেমনই হাতজোড়টা শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের প্রভু নষ্ট হয়ে যাই-এর মতন নয় ।
বিনয় মজুমদার ‘ফিরে এসো, চাকা’ কবিতার বইয়ের কবিতাগুলো লিখেছিলেন মিনিম্যালিজম প্রয়োগ করে । পরে ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ লিখলেন ম্যাক্সিম্যালিজম প্রয়োগ করে । জীবনানন্দ দাশ ‘ঘাস’ লিখলেন মিনিম্যালিজম প্রয়োগ করে ; ‘আট বছর আগের একদিন’ লিখলেন ম্যাক্সিম্যালিজম প্রয়োগ করে । পক্ষান্তরে শম্ভু রক্ষিত তাঁর প্রতিটি কবিতাতেই ম্যাক্সিম্যালিজম প্রয়োগ করেছেন । ঠিক কোন কৌশলে আপাতবিচ্ছিন্ন ভাবধারা ও ছবিবাক্যকে একের পর এক বসাতে থাকেন তা তাঁর পাণ্ডুলিপি দেখে হয়তো বলা যেতে পারে ।
শম্ভু তাঁর কবিতায় আরেকটি কৌশল অবলম্বন করেছেন, তা হল ফ্র্যাগমেন্টেশান বা ভঙ্গুরতা বা ছবির খন্ড একত্রীকরণ । একটি বাক্যের সঙ্গে পরের বাক্যের সরাসরি জৈবিক যোগাযোগ অনেক সময়ে থাকে না । এই ভঙ্গুরতা আলোকপ্রাপ্তির কারণে ব্যক্তি-প্রতিস্বের দুঃখ কষ্ট গ্লানি ক্ষোভ ক্রোধের ভঙ্গুরতা নয়, যা আমরা তথাকথিত বিষাদগ্রস্ত কবিদের লেখায় অহরহ পড়ি। শম্ভুর কবিতার ভঙ্গুরতা উঠে এসেছে উত্তরঔপনিবেশিক কালখণ্ডের সামাজিক অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক সাহিত্যিক ভঙ্গুরতা থেকে, পশ্চিমবঙ্গের দেশভাগোত্তর ভঙ্গুরতা থেকে, জনগণের ক্ষুদ্ধ দারিদ্রিক চাপ থেকে, নিম্নবিত্ত বা বিত্তহীনের বাকহারা অসংলগ্নতা থেকে, লুকিয়ে রাখা আর্তনাদ থেকে, পরিবর্তনের চক্রনাভি থেকে, চাষির জীবনের ছত্রখান অবস্হা থেকে ।
শম্ভু, যিনি নিজেই এককালে চাষবাস করতেন, কোদাল চালিয়ে মাটি কোপাতেন,, কলকাতা কফিহাউসে আড্ডা মারতে যেতেন, মদের আড্ডায় গিয়ে বাংলা মদ খেতেন, চাকরি-বাকরি করলেন না, পত্রিকার জন্য প্রেসে গিয়ে নিজেই হরফ সাজাতেন, বিরিঞ্চিবেড়িয়ার ভাঙা চালাঘরে থাকতেন, তাঁর কবিতায় শহুরে কবিদের লোকদেখানো বিষাদের বাজার নেই । বৈশিষ্টটা তাঁর এই কবিতাটি পড়ার সময়ে পাওয়া যাবে :
মুক্তিবাদ
যারা আমাকে ডিগডিগে
আমার রুহকে যুদ্ধের হিরো
আমার ঈশ্বরকে অনিষ্টজনক
আমার কবিতাকে
চাকচিক্যময় আভিজাত্য বা বিক্ষিপ্ত প্রলাপ মনে করে
আহ ভাইরে
তারা বাণিজ্যের অযথার্থ ক্ষমতা দিয়ে
তাদের নাক কান মুখ দখল করে
এই শক্তিশালী প্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রের
অস্তিত্ব রক্ষা করুক
যারা বালি ফুঁড়ে
আমাকে বাল্যপাঠ শেখাচ্ছে
আহ ভাইরে
তারা মেকি সুন্দরের মিথ্যে সীমারেখা প্রত্যাখ্যান করে
অন্তত একটা ছোটোখাটো দেবদূতের সন্ধান করুক
অকেজো জ্যুকবক্সে স্হির ডিস্ক
জীবনের আর ভাঙা ইঁটের
অশুভ যুদ্ধপরায়ণ যন্ত্রণায় আন্তর্জাতিক কোরাস
আহ ভাইরে
কবরখানা আর সুড়ঙ্গের মধ্যে গুঞ্জন-করা
আস্তাবলের ধূর্ত পিটপিটে মায়া
মধ্যে মধ্যে ফ্যাঁকড়া
আহ ভাইরে
কাঁধে অগ্নিবর্ণের ক্যামেরা
হাতে অ্যান্টিএয়ারক্র্যাফ্ট ট্রানজিসটার
অন্য সম্রাটের দায় যাতে মেটে
মাংস ভেদ করে সচল ফ্রেস্কোর মতো
এই সব রেডিও-টিভি-অ্যাকটিভ যুবশক্তি
মুক্তিবাদ এবং জাঁকজমক খুঁড়ে নৈশ-স্তব্ধতা
আহ ভাইরে
উপরোক্ত কবিতায় যে বৈশিষ্ট্য লক্ষনীয় তা হল আয়রনি বা শ্লেষ বা ব্যাজস্তুতি বা বিদ্রূপ । শম্ভু রক্ষিতের প্রায় প্রতিটি কবিতায় লুকিয়ে রাখা থাকে আয়রনি, কিন্তু তা নিছক বক্রোক্তি নয় । তা ফরাসি কবি-নাট্যকার আতোঁয়া আর্তোর মতন সিরিয়াস অবস্হার অসম্ভাব্যতা ও তীব্রতাকে সামনে তুলে ধরার খেলা । প্রাকঔপনিবেশিক ও ঔপনিবেশিক কালখণ্ডে ক্লাসিসিজম, রিয়্যালিজম ও রোমান্টিসিজম সব কয়টিই বাইরের জগতটিকে নিয়ে ব্যস্ত ছিল ; ঔপনিবেশিকতার শেষ দিকে কবিরা নিজেদের ভেতরে প্রবেশ করলেন, আধুনিক জীবনযাত্রার বিভিন্ন প্রসঙ্গকে নিয়ে এলেন নিজেদের কবিতায়, অভিজাত বাঙালির তিরিশের দশক থেকে চালাক-চতুর পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত । যে কবিতাটির জন্য আমার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল, “প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার”, তাও ছিল একটি কনফেশানাল কবিতা, এবং জজ সাহেব সেই কথাই তাঁর রায়ে গুরুত্ব দিয়ে সাজা দিয়েছিলেন আমায় । ওপরে শম্ভু রক্ষিতের ‘মুক্তিবাদ’ নামের যে কবিতাটি দিয়েছি তাতে তিনি সমসাময়িক সামন্তবাদী কবিদের আক্রমণ করছেন না, স্রেফ তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছেন, তাদের নিয়ে ঠাট্টা করছেন, তারা যে কতো হাস্যকর তা বার বার ‘আহ ভাইরে’ বলে-বলে তাদের বিব্রত করছেন ।
ওই সময়ে কনফেশানাল কবিতা লেখার চল আরম্ভ হল, যা আমরা বিনয় মজুমদার, শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত প্রমুখের কবিতায় পেলুম । এনাদের কবিতা এমনভাবে বাজার দখল করে ফেলেছিল যে কারোর কারোর কবিতার লাইন টিশার্টেও দেখা যেতে লাগল, অনেকটা চে গ্বেভারার মুখের বাণিজ্যকরণের মতন, যে প্রতীকটির বার্তা ভারতীয় ক্রনি ক্যাপিটালিজমের দৌরাত্ম্যে ফালতু হয়ে গেছে । অনেকের কবিতা স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তকে ঢুকে গেল । এমনকি পরীক্ষার প্রশ্নেও আসতে লাগলো, যার অর্থ কবিতা-বিশেষের সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা থাকতে হবে, নয়তো ছাত্র-ছাত্রী গোল্লা পাবে। মাঝরাতের বেপাড়া-জাগানো কবিরা বাড়িতে কোলবালিশ জড়িয়ে শোবার কবিতা লেখা আরম্ভ করলেন ।
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন উপরোক্ত দুটি টিলার মাঝে জলবিভাজক । হাংরি ও শ্রুতি আন্দোলনে, এবং শম্ভু রক্ষিতের পরের কবিরা যেমন অলোক বিশ্বাস, প্রণব পাল, ধীমান ভট্টাচার্য, বারীণ ঘোষাল, দেবযানী বসু, অনুপম মুখোপাধ্যায় প্রমুখ , দেখালেন, ভাষা কেমনভাবে নিজের সৃষ্টিক্ষমতার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে, তারই ভেতরে গোপনে রাখা নানা কৃৎকৌশলের মাধ্যমে, বিভিন্ন আঙ্গিকহীন পাঠবস্তু নির্মাণের মাধ্যমে ।
জীবনানন্দের সময় থেকেই আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল মুক্তসূচনা ও মুক্তসমাপ্তির কবিতা, যা আমরা শম্ভু রক্ষিতের প্রতিটি কবিতার ক্ষেত্রেই লক্ষ্য করি । শম্ভুর কবিতা যে-কোনো পংক্তি থেকে পড়া আরম্ভ করা যায়, শেষ থেকে শুরুর দিকে পড়া যায়, শিরোনাম না হলেও চলে । শম্ভুর কবিতার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, যা আমরা জীবনানন্দের বহু কবিতার ক্ষেত্রে পাই, কবিতার শিরোনাম তার বিষয়কেন্দ্রকে চিহ্ণিত করে না । বস্তুত শম্ভুর কবিতায় তিরিশ-চল্লিশ-পঞ্চাশ দশকের কবিদের যেমন থাকতো, তেমন বিষয়কেন্দ্র থাকে না, ফলে কবিতার নামকরণে কবি নিজেকে একজন টাইটেল হোল্ডার হিসাবে উপস্হাপন করেন না ।
তাঁর আগের কবিদের লেখা পড়ে শম্ভু রক্ষিতের মনে হয়েছে যে তাঁদের কবিতা বড়ো বেশি আস্রবণশীল হয়ে গেছে, কিংবা হাড়ের মতন অত্যন্ত শক্ত হয়ে গেছে, যে ধরণের কবিতা বার-বার পেছন ফিরে তাকাতে ভালোবাসে, এবং যা বড্ডো নিয়ন্ত্রিত, তাদের গড়ে ওঠার স্বাধীনতা দেয়া হয়নি, তাদের টেনে আটকে রাখা হয়েছে । শম্ভুর মনে হয়ে থাকবে যে রবীন্দ্রনাথের প্রগাঢ় নিষ্ঠাকে সরিয়ে সেই জায়গায় বসানো হয়েছে কবিতা/কৃত্তিবাস/শতভিষার গোঁড়ামি । শম্ভু রক্ষিত বাধ্য হলেন ভাষার, ছবির, বিন্যাসের, বাক্যগঠনের, পংক্তিনির্মাণের আইকনোক্লাস্ট হিসাবে আবির্ভূত হতে । নিজেকে আলাদা করে নিতে । অগ্রজ কবিদের জৈবিক আঙ্গিক এবং সঙ্গতির প্রতি বাড়াবাড়ি রকমের আত্মসমর্পণকে প্রত্যখ্যান করতে বাধ্য হলেন শম্ভু রক্ষিত । সেই জন্যই আরো পাঠবস্তুকে ভঙ্গুরতা দিয়ে মন্তাজ বা কোলাজ তৈরি করতে থাকলেন কবিতার পর কবিতা । কবিতাকে আদল-আদরা দেবার প্রচলিত মেটাফর এবং অন্যান্য আলঙ্কারিক গূঢ়োক্তিকে এড়িয়ে যাওয়া জরুরি মনে করলেন শম্ভু রক্ষিত ।
অনেকে শম্ভুর আভাঁগার্দ টেকনিক বুঝে উঠতে পারেন না, অথচ তাঁরা একই ধরণের টেকনিক প্রয়োগে তৈরি আভাঁ গার্দ চিত্রপরিচালক ফেদেরিকো ফেলিনি, রবের্তো রোসেলিনি, লুই বুনুয়েল, সের্গেই আইজেনস্টিন, ড্যামিয়েন পেটিগ্রিউ, এমির কুস্তেরিকা, ওজেচিয়েহ হাস, মার্কো ফেরেরি, জাঁ লুক গোদার, আব্বাস, কিয়ারোস্তামি, জাফর পনাহি, আলাঁ রোব-গ্রিয়ে, রাইনের ওয়ের্নার ফাসবিন্দার, আনদ্রেই তারকোভস্কি, অ্যাণ্ডি ওয়ারহল প্রমুখের ফিল্ম দেখার জন্যে ভিড় করেন !
“শব্দগুচ্ছ” আন্তর্জাতিক ওয়েব-পত্রিকায় প্রকাশিত শম্ভু রক্ষিতের ‘গাঁয়ের চাষাভুষোরা আবার’ কবিতাটা এবার পড়ে দেখা যাক:
গাঁয়ের চাষাভুষোরা আবার
প্রত্যেকটি পৃথ্বীর নিচে একটি করে পাহাড় গড় রয়েছে
এবং কবিতা কি ? গাঁয়ের চাষাভুষোরা জানে না,
তাদের যে যা বোঝায় আর কি !
তাদের সবল স্পর্ধার শক্তি এবং গুটিয়ে থাকা ফুসফুস
তাদের ছোট ধাইমার দূরবিন দিয়ে দেখা সৌজন্য
যা বলা যায় তাই করে ।
মহার্ঘ ঝুনঝুনি-নাড়া বৃক্ষের উপবাসী চোখ, শহরের সন্মুখভাগ
অতোটা বড়ো নয়
প্রকৃতির আঁচলপাতা কুশল
মিথুনজননীর স্পর্ধা
তাদের বাহুর ওপর দৌড়ে এসে উঠতে পারে—
ভিলাই সঙ্গীত, খেলনাপাতি করাত, চোঙা রেকর্ড, ফোনোগ্রাফ
এবার কি এদের সহযোগ করা যেতে পারে ?
ঘুটেগেড়িয়ার ওই ধাতু তৈরি হতে যে উপকরণ লাগে
সে সমস্তই এদের আত্মীয়বর্গের জানা হয়েছে
বাস্তবিক কাছেই বারুদ-ফাঁপা লোহার গোলার মধ্যে
এদের আত্মীয়বর্গ ব্রক্ষা গৃধ্নু ছুরি নিয়ে মহাযজ্ঞ সারছে ।
আর যাদের উদাসীনতা আজ দু’হাজার বর্গমাইলের খাদ্যসম্ভারের ওপরে
যাদের দাদামহাশয় কিংবা বড়োদাদা তাদের টিপ্পনীকার ও প্রযোজক
বা যারা ক্ষেপণাস্ত্রের পাথর তারামণ্ডলের কাছ থেকে
এনেছে বলে দাবি করছে
মজা, তাদের যৌবন পড়ে গেছে ।
মজা, গাঁয়ের চাষাভুষোরা আবার কবিতার মধ্যে
একটা প্রাকৃত জানোয়ার কুড়িয়ে পেয়েছে
মজা, তারা শহরের মঞ্জিলে এসে পড়লো ।
এই কবিতাটি পড়ে সন্দেহ হয় যে কখনও কলকাতা মহানগরে শম্ভু রক্ষিতকে কোনো কবি বা কবির দল চাষাভুষো হিসাবে নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন এবং শম্ভুর কবিতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছিলেন, হয়তো বলেছিলেন চাষাভুষোরা আবার কবিতার কী বুঝবে ! আমরা আবার এসে পড়ি সামন্তবাদী সাহিত্যিক মূল্যবোধের ধ্বজাধারীদের আখাড়ায় । এই সামন্তবাদী ধ্বজাধারীদের শোষণ থেকে মুক্তি পাবার জন্য বহু নিম্নবর্গের বাঙালি পালিয়েছিল মরিশাস, ক্যারিবিয়ান দ্বীপপূঞ্জ, লাতিন আমেরিকা আর ফিজিতে । শম্ভু রক্ষিতের এই কবিতাটি পড়লে আমরা আরেকবার চার্লি চ্যাপলিনের সেই কথাটা মনের ভেতরে গেঁজিয়ে নিতে পারি যে, দূর থেকে যাকে মনে হয় সুন্দর একটি কমেডি, কাছে গেলে টের পাই যে তা মূলত ট্র্যাজিক ।
যাঁরা কলকাতা মহানগরের নিবাসী তাঁরা জানেন না গ্রামের কালবৈশাখি সেখানকার কৌমজীবনে কেমন প্রভাব ফেলে, তাঁরা জানেন না মাঝরাতে ঘুর্ণিবাত্যার লেজের ঝাপট একটা চালাবাড়ির ওপর কেমন অত্যাচার করে, বৃষ্টির দাপটে চাষের ক্ষেতে কতোটা লোকসান ঘটায়, প্রচণ্ড গরমে ভাঙা চালাবাড়িতে একজন কবি কেমনভাবে তার দিন আর রাত কাটায়, অন্ধকার রাতে একজন কবি মাইলের পর মাইল হেঁটে কেমন করে বাড়ি ফেরে আর রাত জেগে কবিতা লেখে । ফলে শম্ভু রক্ষিত কলকাতা মহানগরের কবিদের রচনায় প্রাকৃত জানোয়ার আবিষ্কার করেন । কবিতার সামন্তবাদ গ্রামে নেই, আছে মহানগরে । বস্তুত কবিতার জগতে দেখা দিয়েছে ক্ষমতার দুর্ভিক্ষ, বাতাসে ঝুলতে থাকা ডিজেলগুঁড়োর মতন নোংরামি । যারা ক্ষুদকুঁড়ো পায় না তারা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার জন্য মারামারি করে, তা জানেন শম্ভু, এবং উনি নিজেকে সেই পৃথিবী থেকে দূরে রেখেছেন । শম্ভু জানেন কলকাতা মহানগরের কবিদের “মহার্ঘ ঝুনঝুনি-নাড়া উপবাসী চোখ”, তাঁদের মাথার ওপরে লাল সরকারি আলো জ্বেলে সভা সমিতিতে কবিতা পড়তে যান, “দাদামহাশয় বা বড়োদাদা তাদের টিপ্পনীকার ও প্রযোজক”।
আগের কবিতাগুলোর মতন এই কবিতাটিতেও শম্ভু রক্ষিত পূর্বজদের সাহিত্যিক মানদণ্ডকে ডিক্যাননাইজ করেছেন, প্যারডির দ্বারা সুত্রগুলোয় অন্তর্ঘাত ঘটিয়েছেন, সাংস্কৃতিক দমনপ্রক্রিয়ার প্রতিরোধ করছেন, প্রসঙ্গের আবরণ খুলে দিচ্ছেন, বলতে চাইছেন যে মর্মার্থ অমীমাংসিত, মানুষের অবস্হা পর্যবেক্ষণ করতে বাধ্য করছেন, বিশেষ করে যারা মহানগরের অধিবাসী নয়, শেষতম বা পছন্দযোগ্য ব্যাখ্যার সুযোগ দিচ্ছেন না ।
উল্লেখ্য যে বিদ্যায়তনিক চাপ সবসময়েই এই তর্ককে সমর্থন করেছে যে ঔপনিবেশিক কালখণ্ডে কবিতার ঐতিহ্যের সঙ্গে সমসাময়িক বা শম্ভু রক্ষিতের সময়কার কবিতার অনবছিন্নতা বজায় আছে । আসলে বিদ্যায়তনিক ইনডাসট্রি একটি ভানের ভাঁড়ার । এই ইনডাসট্রি যতোই মৌলিকতা এবং প্রামাণিক সত্যের বাগাড়ম্বর করুক, লেখক মাত্রেই জানেন যে তাকে, অর্থাৎ সাহিত্যিক মানদণ্ডকে চ্যালেঞ্জ ছাড়া উপায় নেই। যে কবি মুক্ত আঙ্গিকে লেখেন তিনি নিজের লেখালিখির প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই গড়ে ওঠেন, তাঁর কবিতা তাঁর ভাবনাকে লেখার সময়ে অনুসরণ করতে থাকে, তিনি কখনই একটা বদ্ধ আঙ্গিকে নিজেকে বেঁধে ফেলতে চাইবেন না, বিশেষ করে যে কবি দীর্ঘকাল জেল খেটে বেরিয়েছেন, রাষ্ট্রযন্ত্রের অমানুষদের দ্বারা অত্যাচারিত হয়েছেন । এই একই কারণে, জেল খাটার পর বিনয় মজুমদার যে কবিতাগুলো লেখা আরম্ভ করেন তা ‘ফিরে এসো, চাকা’ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা । তাঁদের কাছে আগের তৈরি পথে চলা সম্ভব নয়, তা তাঁদের লেখালিখির বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তাঁদের মনে হয় তা অসৎ, তা সৃজনশীলতার পথের কাঁটা।
লেখাটা শেষ করছি শম্ভু রক্ষিতের একটা পুরোনো কবিতা দিয়ে, যে কবিতাকে হাংরি আন্দোলনের সময়ে লেখা উৎপলকুমার বসুর ‘পোপের সমাধি, ফালগুনী রায়ের ‘নষ্ট আত্মার টেলিভিসন’, ত্রিদিব মিত্রের ‘হত্যাকাণ্ড’, সুবিমল বসাকের ‘হাবিজাবি, প্রদী্প চৌধুরীর ‘চর্মরোগ’ আর আমার ‘জখম’ কবিতার সঙ্গে একই হাংরি-চেতনায় রাখা যায়, শিরোনাম ‘মৈত্রীভাবনা’ :
আমার সমঘন মগজটি আবার মদিরা ও যবনীগ্রহণ করে
চাষআবাদ, মৎস্যধরা, পলুপোষার কাজে জমায়েত হয়েছে
আমার ভয় লগুড়গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে উড়ে যাবার উপায়
উপকরণ সম্পর্কে বিদেশি বণিক দেশপতির কাছে ভক্তিভাব যোগাচ্ছে
আমার শাসিত দেহটি নিচ্ছে এই অংবিঅং ববম ববম মালকোষের তালিম
আমার অনুবর্তীগণ অধরারুন কুন্দবদন ছোকরাবেশী যুবকের সুরত নিয়েছে
আমার পুরোনো অধভাঙা খেলনা আমার কোষের ভেতরে এসে অদৃশ্য
ফলে আমার কিছু কোষ এখনও অক্ষত, কিছু অতিশয় হতে চলেছে
আমার ক্ষোভ : আমি আজও গাঁদাফুলের মালা গলায় পরে মাঙ্গলিক গান গাইতে পারিনি
( কোষকারীর দেশে তাই আমার চলচিত্ত লোককবিতা নিক্কণ পায়নি )
আমি মদহিভাষী আমি ক্ষুদে প্রফুল্ল আমার বাড়ি
নবদ্বীপে বুনো রামনাথের ভিটের ওপর
আমার মিশরকুমারী শহরে ছুটে বেড়াচ্ছে
হর্ষ ! আমার কাছে একটি কালো বাউথাস
একজন সন্ত পিটার আবলার্ড
অত্যন্ত হ্র-স্বীকৃতভাবে, একেবারে কোনঠাসা অবস্হায় অস্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে
আমি উলো বীরনগরের ঢিবিতে ভবেশ্বরীর মমতায় সাজিয়ে রেখে বিব্রত
আমি পরমোৎসবের কার্পেটে শয়পত্রী ফুল এখনও ছড়াইনি
রামাই, সেতাই, নেলাই আমি নয়, ধুমসা ও মাদল সংগতে
ভেসে সরবরাহ করতে চাই ভবিষ্যপুরাণ
বীরহাম্বীরের সঙ্গে মানতের হাতিঘোড়াও আমি গড়তে চাই
হ্যাঁচ্ছো ! আমার গলার কোনো কোক-তেওহার ফুলের মালা নেই
কিন্তু মালার বদলে আছে এক বিত্রস্ত থলি
এমারজেন্সির সময়ে তাঁরা যখন পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন, জ্যোতির্ময় দত্ত একটা চিরকুট পাঠিয়েছিলেন স্ত্রী মীনাক্ষীর কাছে, শম্ভু রক্ষিতের হাতে । পুলিশের নাকের ওপর দিয়ে শম্ভু জ্যোতির্ময় দত্তের গলফ ক্লাবের বাড়িতে গিয়ে সেই চিঠি দিয়ে এসেছিলেন । মীনাক্ষী আঁৎকে উঠে বলেছিলেন, ‘সেকী, তুমি এখানে কেন?’ শম্ভু বলেছিলেন, ‘দুর, পুলিশ আমায় জিগ্যেস করলে বলব, আমি ধোপা, বউদির কাপড় নিতে এসেছি । আমায় একটা নোংরা বোঁচকা দিয়ে দেবেন।’


শম্ভু রক্ষিত- এর কাব্যগ্রন্থ ‘প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না’ নিয়ে পর্যালোচনা
শুভঙ্কর দাস
‘আমার একাকীপাখি আমার মধ্যে বিশ্রাম রাখে চিরকাল’
প্রসঙ্গ- ‘প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না’
স্বরান্ত কবি শম্ভু রক্ষিত।
কাব্যরচনার শুরুতে যদি কেউ সরস্বতীর নিদারুণ সারস্বত কৌতুকে স্বরান্ত কবি শম্ভু রক্ষিতের কাব্যগ্রন্থ হাতে পায় এবং হৃদয় ডোবায়,তাহলে তার কাব্যযাত্রা এমন এক নক্ষত্রলোকের একেবারে নতুন পৃথিবীর পথে পৌঁছাবে,যে সেখান থেকে ফিরে আসা কঠিন নয়,অসম্ভব হয়ে পড়বে।
কথাবলা বাতাস থেকে জানলাম,
শম্ভু রক্ষিত অক্ষরে অক্ষরে এমন পাথর সাজায়,যা দেবমূর্তি বা রাক্ষসের গুহা বোঝা যায় না!
এত কবিতায় দুর্বোধ্যর দুর্বাশাচিত ক্রোধ ও কাঠিন্য বাস করে যে,পড়তে পড়তে নিজেকেই হয়তো অভিশাপ দিয়ে ফেলবে!
এত সূর্যকরোজ্জ্বলহীন জঙ্গল যে, একবার ঢুকলে, আর রক্ষা নেই, একেবারে বন্যজন্তুর মুখের খাদ্য হতে হবে!
এত বাধা, এত ভয়, এত দুর্গমতার দেওয়াল ভেদ করে যাওয়া কি ঠিক হবে!তারপর ভাবলাম, আমার জেলার লোক, আমার শিল্পশহরের বসবাসকারী, আমার বাড়ী থেকে মাত্র ছয়-সাত কিলোমিটার দূরে থাকেন, আমিও তো একটু আধটু কবিতা লিখি, তখনআমার কোনো ক্ষতি হতেই পারে না।যাত্রা শুরু করলাম, প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না
শুরুতেই বিস্ময়, রোগাপাতলা, ইন্দ্রলুপ্ত মাথায় উসকোখুসকো চুল, চেখের স্থির দৃষ্টি, জামার কলারে ময়লা, কম্পিত হাত, শ্লেষাজড়ানো কন্ঠস্বরের স্বরান্ত কবি বলছেন, ‘কবিতা ছাড়া অন্য কোনো পবিত্রতায় আমার বিশ্বাস নেই’
ভেতরে কম্পন শুরু হয়ে গেল! বলে কি লোকটা!
আবার যখন জানতে পারলাম, বাংলা ভাষায় লেখা অক্ষরের হাজারদুয়ারী কাব্য ‘প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না’, মাত্র তেইশ বছর বয়সে লেখা
তখন নিজের ঐ বসয়ের কাব্যগ্রন্থগুলিকে বালকের কাঠি লজেন্স মনে হল! তেইশ বছর বয়সে এমন কাব্য লেখা সম্ভব!
আবার যখন কবি জ্যোতির্ময় দত্ত কবি সম্পর্কে বলেন, ‘এই বুনো অসামাজিক শব্দ আবিস্কারক ও নির্মাতা হাতে একটা পেন মাত্র সম্বল করে বেরিয়েছে বিশাল জগতের সঙ্গে টক্কর দিতে’
তখন মনে হয়, শম্ভু রক্ষিত লোকটা কি বাঙালি সামুরাই।দেখি তো, লোকটা কী করে কলমকে অস্ত্র করেছে,অক্ষরকে আলো করেছে আর নিজেকে করে তুলেছে, একটি নিটোল সার্থক কবিতা।
পড়তে গিয়ে , একটা পণ মনে মনে নিয়েছিলাম,স্বরান্ত কবি শম্ভু রক্ষিত এর কাব্য অভিধান ছাড়াই পড়ব। শুনেছিলাম,কোনো এক নারীর প্রেমে পড়ে এই আক্ষরিক কান্নাকাটি করেছেন।আমিও প্রেমে বিশ্বাসী, তাহলে আবার অভিধান কিসের?
পড়তে গিয়ে মনে হল, সামনে যেটা দুর্গম পাহাড়ের গুহা মনে হয়েছিল, তা আসলে তাতে সিঁড়ি আছে,ভেতরে আলো আছে এবং আপ্যায়নের সুব্যসস্থা। যেটাকে সূর্যকরোজ্জ্বল জঙ্গল মনে হয়েছিল, তাতে দেখার মত ফুল, স্বাদবহুল ফল আর জীবনদায়ী বৃক্ষছায়া আছে।কী আশ্চর্য!
তেশই বছরের এক কবি, প্রেমিকাকে জানাচ্ছেন, ‘তোমার যৌনাঙ্গকে আমার প্রণতি / তোমার উন্মুখ স্তনে মুখ দিয়ে আমি ব্যবধানহীন বেঁচে রয়েছি’। — এরকম স্বর্গাদপি প্রেমের ব্যাখ্যা কোথাও পড়িনি!যে দেশে আটবছর থেকে সত্তর বছরের স্ত্রীলিঙ্গ ধর্ষনের করাতে চিরে যাচ্ছে, সেখানে এক কবির নারীর প্রতি বিশুদ্ধ প্রেমার্তি অবাক করে তোলে।
প্রেমিকাকে কবি জানাচ্ছেন,’সব মানুষ জন্মকাল থেকে সমান’ এমন ভাবনাও নিজেকে শুধু প্রেমিক রূপে উত্সর্গ করা নয়, মানুষ হিসেবে প্রেমিকার সামবে তুলে ধরে। প্রেমের এমন হৃদয়াক্ষর সত্যি বিরল, যেমন
‘আমার গভীরতর সাম্রাজ্যে তুমি আছ।’
‘তুমি কণিকা ও সূর্যের মধ্যে বিন্দু ও বিস্ফোরণজাত গোলাপ।’
‘তোমায় দেখে আমি পরিণত হয়েছি/জগতের সৌন্দর্য বহুদিন নির্মীয়মান, তোমাকে রাণী’
‘তোমার তেজস্ক্রিয় মৌলিক পদার্থ কখন আবিষ্কৃত হয়’
‘তোমার নিঃসঙ্গতা আমাকে উপহার দেয় দীর্ঘ আনন্দময় সমাধি’
ভাবুন, কবি যদি প্রেমিক হয়, তিনি আবার যদি শম্ভু রক্ষিত হন, তাহলে প্রেমের সমর্পণ মাটি-ঘাস ছেড়ে আকাশের এমন মেঘ সৃষ্টি করে, যাতে বৃষ্টির মত শস্য ঝরতে থাকে ধরায়। আমি অসংখ্য প্রেমের কাব্য পড়েছি, কিন্তু এরকম কথা কোনো প্রেমিককে বলতে শুনিনি, ‘আমি তেমাকে পান করি, তোমাকে নিয়ে উত্তাল স্বপ্ন দেখি’
‘হৃদয় নিশার স্বপ্ন তোমার চালক চিরস্থায়ী হও, তুমি কি ধুমকেতুর সহচর, চুম্বকের আকর্ষণ নির্মম ভূমিতে সঞ্চয় বিজয়ী মদ নিয়ে রসায়নবিদরাও বৈদ্যুতিক প্রস্তুত ’
‘তুমি আলাস্কার নদী থেকে আসা দূত,উজ্জ্বল আকাশ।’
মনে হয় কবির প্রেমিকা কি বাঙালি ছিলেন?ভারতীয়? কোনো বিদেশী নারীর প্রেমে কি পড়েছিলেন? সেই নারীকে দেখতে ইচ্ছে করে,যাকে কবি বলছেন, ‘তোমার সৌন্দর্যের মায়ামন্ত্রে আমার অভিযান রূপায়ণের ইতিহাস’
যাকে কবির মনে হয়, ‘তুমি অহোরাত্র বিশাল নাগরদোলার মত’
যার কাছে যাওয়ার জন্য কবি একটা কবিতায় বলেছেন, ‘ভিসা চাই’
স্বরান্ত কবির প্রেমিকা এমন সুন্দরী, এমন নির্ভরযোগ্য, এমন স্থিরকলা, এমন স্থাপত্য যে কবির কাছে এলে, কবির মনে হয়,
‘তুমি হবে আমার পরিশ্রম, সশস্ত্র সম্ভাবনা’
‘দৈববাণী সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়ে যায়’
‘তুমি কারুশিল্প নিয়োগের দেশ’
‘সেখানেও চাঁদ ষোলোকলা গোলাকার নয়’
‘অখিল মহাশূন্য আজ নিরুদ্দেশ হবে’
‘তোমার স্থাপনগবেষণা করা দরকার’
এই ধরণের প্রেমের কাব্য পড়ার পর,মনে হল,আবার নিজের প্রেমের বয়সে চলে যাই, আরও নক্ষত্রময়, সৌরবাত্যা, রমণীয়, মহামহিমান্বিত ও স্পনৃদনবর্নিত ও নির্বেদগাথা করা যেত! কবির এই হৃদয়ের নির্মিত বিদ্যুত্বেগের কারুকার্য দেখে কাব্যটিকে একটি জীবন্ত প্রেমের মন্দির মনে হয়।
প্রেমের কাব্যগ্রন্থ আছে,কিন্তু তা ব্যঞ্জনধ্বনির মতো, উচ্চারণে স্বরধ্বনি ধার করতে হয়।শম্ভু রক্ষিতের কবিতার প্রতিটি চরণ, পংক্তি, উপমা, রূপকল্প সবই অভিনব, নতুন, স্বরধ্বনির মত, তাই তিনি স্বরান্ত কবি। কাব্যগ্রন্থের প্রচ্ছদ কৃষ্ণবর্ণ কেন? মনে হয়, প্রেমের কাব্যে কবি মহাকালীয় রমণ বা মহাশূন্যময় অনন্ত সমর্পনের কথা বলতে চাইছেন, কারণ মহাকালী ও মহাশূন্য, দুইই কৃষ্ণবর্ণ।
পরিশেষে একটি কথা, এই কাব্যগ্রন্থ শেষ করে যখন আমি আমার দোতলার পাঠঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে মানছি, মনে হল, ভেতরটা বদলে যাচ্ছে, আশ্চর্য প্রেমের দর্শনে ও শব্দের অলৌকক অভিঘাতে! এত অসম্ভব দেখার আর অমৃত বোঝার বাকি ছিল!
জয়তু স্বরান্ত কবি শম্ভু রক্ষিত। অক্ষরের আগুন হয়ে বেঁচে থাকুন।


আবু রাইহান
বিশেষ নিবেদন সংখ্যার সম্পাদক ও পরিকল্পক
Нові фільми 2021 року. форсаж: хоббс и шоу
generic tadalafil from uk tadalafil dosage
Дивитися фільми українською мовою онлайн в HD якості
Дэдпул 2
Дивитися популярні фільми 2021-2021
року Link
https://cialismat.com/ cost tadalafil generic
Дивитися фільми українською онлайн Link
Дивитися фільми онлайн в HD якості українською мовою Link
Не пропустіть кращі новинки кіно українською
2021 року Link
Фільми українською в хорошій якості –
онлайн без реклами Вечер с Владимиром Соловьевым
Дивитися фільми онлайн в HD якості українською мовою z.globus-kino.ru
Найкращі фільми 2021 filmiwap.store
Дивитися популярні фільми 2021-2021 року
Захар Беркут
https://extratadalafill.com/ side effects of tadalafil
Новинки фільми, серіали, мультфільми
2021 року, які вже вийшли Ви можете дивитися українською на нашому сайті
link
tadalafil cost in canada side effects for tadalafil
tadalafil cost walmart tadalafil daily online
tadalafil generic where to buy https://cialistrxy.com/
tadalafil blood pressure tadalafil cost in canada
tadalafil online https://cialisvet.com/
side effects of tadalafil where to buy cialis without prescription
cheapest tadalafil cost prescription tadalafil online
tadalafil goodrx where to buy cialis without prescription
tadalafil daily online where to buy tadalafil on line
Фільми українською в хорошій якості – онлайн без реклами link
buy generic cialis online with mastercard https://cialiswbtc.com/
buy cialis pills buy tadalafil
https://cialisusdc.com/ tadalafil drug
tadalafil goodrx tadalafil order online no prescription
can you drink wine or liquor if you took in tadalafil tadalafil com
cialis at canadian pharmacy https://nextadalafil.com/
para que es cialis tadalafil 20 mg cialis lilly icos tadalafil
cipla tadalafil tadalafil versus cialis
where to buy female viagra uk cheap viagra 100mg tablets
ivermectin 400 mg ivermectin oral solution
sildenafil sample sildenafil for pe
https://cialiswbtc.com/ tadalafil brands
yutube
buy generic cialis online with mastercard buy cialis
stromectol 3mg ivermectin usa
stromectol generic stromectol where to buy
stromectol buy ivermectin oral solution
ivermectin iv ivermectin 10 ml
Топ Ган Мэверик
ivermectin where to buy for humans stromectol ivermectin
ivermectin tablets order ivermectin 6 mg tablets
cost of ivermectin lotion ivermectin cream
ivermectin lotion how much is ivermectin
ivermectin 12 stromectol canada
cost of ivermectin medicine ivermectin ireland
what is tadalafil buying cialis in mexico
ivermectin uk buy ivermectin over the counter uk
blue sky peptide tadalafil when will cialis be over the counter
stromectol price price of stromectol
RRR смотреть онлайн
ivermectin 500ml stromectol south africa
where can i buy sildenafil citrate over the counter sildenafil generic walmart
eli sex pill/tadalafil find tadalafil
viagra online viagra soft tablets
maxim peptides tadalafil tadalafil generico farmacias del ahorro
sildenafil natural alternatives natural sildenafil
tadalafil citrate tadalafil reviews
buy female viagra from united states sildenafil 100mg from india
sildenafil without prescription generic sildenafil price
certified canadian pharmacy online oxford pharmacy store
viagra 75 mg price how to get viagra prescription australia
buy adderall canadian pharmacy pharmacy no prescription required
levitra and viagra together levitra and cialis together
Viagra Gold doctor of pharmacy degree online
does cialis make you last longer how can i get cialis in australia
cialis shipping where to buy liquid cialis
geo peptides tadalafil tadalafil tablets 10 mg
cheapest price for sildenafil 100 mg generic viagra online purchase
canada-pharmacy-365 lamictal canadian pharmacy
ivermectin fda label ivermectin covid
stromectol tablets ivermectin eye drops
canadian pharmacy for viagra buy viagra 200 mg
cialis erection online cialis canada
giant eagle pharmacy big mountain pharmacy in canada
lisinopril and levitra what is the shelf life of levitra
how much is cialis without insurance walmart cialis price
viagra cialis e levitra levitra pro
tretinoin cream canadian pharmacy rx pharmacy canada
concerta canada pharmacy list of prescription drugs available in mexico
reputable canadian mail order pharmacy canada pharmacy online reviews
cvs pharmacy store locator usa latisse online pharmacy
you have a great blog here! would you like to make some invite posts on my blog?
Himplasia disposing of prescription drugs
Cordarone comfortis canadian pharmacy
reputable online pharmacy canadian pharmacy meds promo code
Фільми та серiали 2020 українською мовою в HD якості
Link
hydroxychloroquine sulfate 200 mg hydroxychloroquine cost
Не пропустіть кращі новинки
кіно українською 2021 року Link
Нові сучасні фільми дивитися українською мовою онлайн в хорошій якості
HD Link
Нові фільми 2021 року. Link
Новинки фільми, серіали,
мультфільми 2021 року, які вже вийшли Ви можете дивитися українською на
нашому сайті Link
Фільми українською в хорошій якості
– онлайн без реклами Link
Найкращі фільми 2021 Link
Новинки фільми, серіали, мультфільми 2021 року, які вже вийшли Ви можете
дивитися українською на нашому сайті Link
Дивитися фільми українською мовою онлайн в HD якості Link
Всі фільми новинки 2020 року онлайн українською в хорошій якості 2022
Watch the best Xvideos com videos, free movies, mobile xvideos, and download for on this
tube https://t.me/xvideos_xvideo
Imodium ed drugs from canada
Watch the best Xvideos com videos, free movies, mobile xvideos,
and download for on this tube https://t.me/xvideos_xvideo
Watch the best Xvideos com videos, free movies,
mobile xvideos, and download for on this tube https://t.me/xvideos_xvideo
Watch the best Xvideos com videos, free movies, mobile xvideos, and download for on this tube https://t.me/xvideos_xvideo
buy generic modafinil 100mg buy provigil without prescription
modafinil usa buy modafinil sale
Watch the best Xvideos com videos, free movies, mobile xvideos, and download for on this tube https://t.me/xvideos_xvideo
how Much Does Costco Chatge For Cialis?
modafinil 100mg brand modafinil drug
when Does Thapatent Expire For Cialis?
how Does Cialis Work For Bph?
buy modafinil provigil online modafinil order
how To Cut 20 Mg Cialis In Half?
Link
Психолог онлайн. Консультация
Психолога – 4044 врачей, 7056 отзывов.
Психолог онлайн. Консультация Психолога –
7174 врачей, 5922 отзывов.
Психолог онлайн. Консультация Психолога – 3864
врачей, 6117 отзывов.
Психолог онлайн. Консультация Прием психолога? – 5878 врачей, 4217 отзывов.
Cialis How It Works?
Психолог онлайн. Консультация
Когда необходим прием психолога? – 5792 врачей,
3196 отзывов.
Психолог онлайн. Консультация Когда необходим прием психолога? – 4361 врачей, 6439 отзывов.
Психолог онлайн. Консультация
Когда необходим прием психолога? – 7321
врачей, 7168 отзывов.
Психолог онлайн. Консультация Когда необходим прием психолога?
– 7789 врачей, 4522 отзывов.
Психолог онлайн. Консультация Прием психолога?
– 7751 врачей, 3066 отзывов.
Психолог онлайн. Консультация Когда необходим прием психолога? – 4131 врачей, 5005
отзывов.
Психолог онлайн. Консультация Прием психолога? – 6833 врачей, 6525 отзывов.
Психолог онлайн. Консультация Психолога онлайн
– 4283 врачей, 3340 отзывов.
Психолог онлайн. Консультация Психолога онлайн – 3359 врачей, 3295 отзывов.
Психолог онлайн. Консультация Когда необходим прием психолога? – 3480
врачей, 6477 отзывов.
best canadian prescription prices
best online pharmacy stores
canadian pharmacies no prescription
If ovulation does not occur the dose can be raised 2 cialis cost