ফেরা : নগুগি ওয়া থিয়ংগো : অনুবাদ- অনন্ত মাহফুজ

ফেরা
নগুগি ওয়া থিয়ংগো

অনুবাদ : অনন্ত মাহফুজ

This image has an empty alt attribute; its file name is MANGROVE.jpg

বর্তমান সময়ের অন্যতম শক্তিমান কথাসাহিত্যিক নগুগি ওয়া থিয়ংগোর জন্ম ১৯৩৮ সালে, কেনিয়ায়। ১৯৬৩ সালে উগান্ডা এবং ১৯৬৪ সালে ইংল্যান্ডের লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। ইংল্যান্ডে পড়ার সময় তার সাড়া জাগানো উপন্যাস উইপ নট, চাইল্ড প্রকাশিত হয়। ইংল্যান্ড থেকে কেনিয়ায় ফিরে লিখেন দ্বিতীয় উপন্যাস দি রিভার বিটুইন। দি পেটালস অব ব্লাড উপন্যাসের জন্য জেলে যান ১৯৭৮ সালে। জেলখানার অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন ডিটেইন্ড : আ রাইটার’স প্রিজন ডায়েরি। ব্রিটিশ কলোনিয়াল শাসন থেকে কেনিয়ার মুক্তি, সাংস্কৃতিক পরিবর্তন এবং সাধারণ মানুষের ধর্মান্তরকরণের পরবর্তী প্রভাব, সামাজিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্য এবং মাউ মাউ আন্দোলন তার লেখার প্রধান উপজীব্য। বহু বছর ধরে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের সম্ভাব্যদের তালিকায় নাম থাকলেও তিনি এখনো নোবেল পুরস্কার পাননি।

দীর্ঘ পথ। সামনের দিকে পা বাড়াতেই পিছনে ঘূর্ণায়মান ধুলার কু-লি উপরে উঠে গিয়ে আবার ধীরে ধীরে নিচে পড়ছে। কিন্তু ধুলার চিকন রেখাগুলো ধোঁয়ার ভিতর আটকে থেকে যাচ্ছে। পায়ের তলার ধুলো-মাটির দিকে নজর না দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে সে। প্রতি পদক্ষেপে পথের কাঠিন্য ও স্পষ্ট প্রতীয়মান বিদ্বেষ সম্পর্কে সচেতনও হয়ে উঠছে। সে যে নিচের দিকে তাকাচ্ছে তা-ও নয়; বরং সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে হাঁটছে যেন এখনই কোনো পরিচিত বস্তুর দেখা পাবে যা তাকে অভিবাদন জানিয়ে বলবে, সে বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছে। কিন্তু রাস্তাটা যেন ক্রমাগত দীর্ঘতর হয়ে উঠছে।

দ্রুত লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটছে সে। বাঁ হাতটা কোনো এক সময়ের শুভ্রকোটের পাশে উম্মুক্তভাবে বাড়ি খাচ্ছে। একদা ধপধপে সাদা কোট এখন মলিন ও ছেঁড়া। কনুইয়ে বাঁকানো ডান হাত দিয়ে পীঠের উপর ঝুলিয়ে রাখা সুতোয় বাঁধা একটা পুঁটলি ধরে রাখা। পুঁটলিটি ফুলের ছাপ দেওয়া সুতিকাপড়ে প্যাঁচানো, এখন মলিন। হাঁটার তালে তালে পুঁটলিটি তার পীঠের উপর এদিক সেদিক দুলছে। বন্দিশিবিরে কাটানো দিনগুলোর কষ্টের ছাপ লেগে আছে এতে। হাঁটতে হাঁটতে বারবার সূর্যের দিকে তাকাচ্ছে সে। মাঝে মাঝে দৃষ্টি চলে যাচ্ছে আশেপাশের ঝোপের বেড়ার ছোটো ছোটো ক্ষেতের দিকে। ক্ষেতের রোগা ফসল, ভুট্টা, সিম, মটরশুঁটি-সবকিছুই যেন অবন্ধুসুলভ। পুরো এলাকা নিষ্প্রভ ও শুষ্ক। কামুর কাছে এসব নতুন কিছু নয়। কামুর খুব ভালো মনে আছে এমন কি মাউ মাউ আন্দোলনের জরুরি অবস্থার আগেও গিকুউ গোত্রের লোকদের ফসলের মাঠ বিবর্ণ দেখাত। অন্যদিকে অধিকৃত এলাকার ফসলের মাঠ সবুজে ছাওয়া।

একটা রাস্তা বায়ের দিকে চলে গেছে।কিছু সময়ের জন্য দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ল সে এবং তারপর মনস্থির করল। এই পথে যেতে প্রথমবারের মতো তার চোখ কিছুটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। এই পথই তাকে উপত্যকা ছাড়িয়ে নিচের গ্রামে নিয়ে যাবে। তাহলে অবশেষে বাড়ি খুব নিকটে। এই অনুভূতি ক্লান্ত পথিকের সুদূরে নিক্ষেপিত দৃষ্টিকে কিছু সময়ের জন্য ঝাপসা করে দিল। এ উপত্যকা আর উপত্যকা বরাবর ফসলের মাঠ আশেপাশের এলাকার সম্পূর্ণ বিপরীত। এখানকার ছোটো ছোটো গাছের জঙ্গল সবুজ এবং বৃক্ষগুলো মোটাতাজা। এ থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার : হোনিয়া নদী এখনো বহমান। সে দ্রুত পা চালায় যেন স্বচক্ষে না দেখলে হোনিয়া বহমান আছে কি না বিশ্বাস করা যাচ্ছে না। হোনিয়া, এ নদীতে প্রায়ই গোসল করত সে। উদোম শরীরে ঝাঁপিয়ে পড়ত হোনিয়ার ঠাণ্ডা ও জীবন্ত পানিতে। পাহাড়ের কোল বেয়ে সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলা হোনিয়া তার হৃদয় জুড়াত; সে কান পেতে শুনত ঢেউয়ের মৃদুমন্দধ্বনি। কষ্টের আনন্দ বয়ে গেল তার ভিতর। কিছু সময়ের জন্য সে হারানো দিনগুলো ফিরে পেতে চাইল। তারপর দীর্ঘশ^াস। মনে হয় তার রুক্ষ চেহারা নদী আর চিনতে পারবে না। অথচ একদা এই বালকের কাছে নদীর পারের দুনিয়াটাই ছিল সব। তবু হোনিয়ার দিকে এগিয়ে গেল সে। বন্দিশিবির থেকে মুক্তির পর বাড়ি ফেরার পথে যা কিছু সে দেখেছে তার মধ্যে এই নদীকেই সবচেয়ে বেশি আপন মনে হলো।

কয়েকজন মহিলা নদী থেকে পানি সংগ্রহ করছে। উত্তেজিত বোধ করল সে। নদীর এ পার থেকে এক বা দুইজন মহিলাকে চেনাও যাচ্ছে। ঐ তো মধ্যবয়সী ওয়ানজিকু। কামু নিজে গ্রেফতার হওয়ার দিন ওয়ানজিকুর বধির ছেলেকে নিরাপত্তা বাহিনি হত্যা করেছিল। ওয়ানজিকু গ্রামের সবার প্রিয়। সবার জন্য হাসিমুখে খাবার বিলায় সে। এরা কি তাকে সানন্দে গ্রহণ করবে? তারা কি তাকে ‘বীরের সম্বর্ধনা’ দেবে? এইসব ভাবে সে। সে-ও কি এলাকায় সবার প্রিয় নয়? সে কি দেশের জন্য লড়াই করেনি? দৌড়ে গিয়ে চিৎকার করে বলার ইচ্ছে হলো তার : ‘এই তো আমি, তোমাদের কাছে ফিরে এসেছি।’ কিন্তুবলা হলো না। সে তো আর ছোটোটি নেই।

‘ভালো আছ তোমরা?’ মহিলাদের মধ্যে দুইএকজন কামুর এ প্রশ্নের প্রশ্নের উত্তর দিল। ক্লান্ত আর জীর্ণ চেহারার এক মহিলা নির্বাক তাকাল তার দিকে যেন কামুর শুভেচ্ছা জানানোয় কোনো লাভ নেই। কেন! সে কি খুব বেশি সময় বন্দিশিবিরে কাটিয়েছে? তার সমস্ত উদ্দীপনায় ভাটা পড়ল। সে ক্ষীণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল : ‘তোমরা কি আমাকে চিনতে পারছ না?’ তারা আবার তার দিকে তাকাল, নিরুত্তাপ কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। কামুর মনে হলো তারা ইচ্ছাকৃতভাবে তাকে চিনতে চাইছে না অথবা নিজেদের লোক বলে মানতে চাইছে না। অবশেষে ওয়ানজিকু তাকে চিনতে পারল। নিরুত্তাপ ও নিষ্পৃহ কণ্ঠে সে বলল : ‘আরে কামু, তুমি? আমরা ভেবেছিলাম তুমি…’। ওয়ানজিকু কথা শেষ করল না। এই প্রথম কামু কিছু একটা লক্ষ করল-বিস্ময়? ভয়? সে জানে না। তাদের ক্ষণিক দৃষ্টির দিকে তাকালে বোঝা যায় তারা কোনো গোপন বিষয় জানে কিন্তু তাকে জানাতে চায় না।

‌‘হয়তো আমি তাদের কেউ নই আর!’ মনে মনে বলল কামু। তবে তারা তাকে নতুন গ্রামের কথা জানাল। বিচ্ছিন্ন পাহাড়চূড়া জুড়ে ছড়িয়ে থাকা কুঁড়েঘরের পুরাতন গ্রাম এখন আর নেই।

বিরক্তএবং প্রতারিত বোধ করে মহিলাদের কাছ থেকে চলে আসল কামু। পুরাতন গ্রাম তার জন্য অপেক্ষাটুকু করল না। হঠাৎ সে পুরনো বাড়ি, বন্ধুবান্ধব এবং আশেপাশের সবকিছু সম্পর্কে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ল। সে তার পিতার কথা ভাবল, মায়ের কথা ভাবল-এবং-এবং-কিন্তু তার কথা ভাববার সাহস করল না। তবু এসব কিছুর জন্যই মাথুনি ফেলে আসা দিনগুলোতে যেমনটি ছিল তেমন করেই তার মনের ভিতর ভেসে উঠল। হৃৎপিন্ডের গতি বেড়ে গেল কামুর। তাকে পাওয়ার আকাক্সক্ষা বোধ করল এবং কী এক উষ্ণতা তাকে বিমোহিত করে ফেলল। দ্রুত পা চালাল সে। স্ত্রীর কথা মনে হবার পর কিছু আগে দেখা হওয়া মহিলাদের কথা ভুলে গেল সে। মাত্র দুই সপ্তাহের সংসার তাদের; তারপর ঔপনিবেশিক বাহিনি তাকে ধরে নিয়ে গেল। অনেকের মতো তাকেও বিচার ছাড়াই বন্দি করে রাখল। বন্দি জীবনের সময়গুলোতে সুন্দরী স্ত্রীর কথাছাড়া আর কোনো বিষয় নিয়ে ভাবত না কামু।

অন্য বন্দিরাও ছিল তার মতোই। বাড়ির কথা ছাড়া আর কোনো বিষয় নিয়ে ভাবত না। একদিন মুরাগুয়ার এক বন্দির সঙ্গে সে কাজ করছিল। হঠাৎ নজরজি নামের সেই বন্দি পাথর ভাঙা থামিয়ে দিল। গভীর দীর্ঘশ্বাস পড়ছিল তার। মলিন চোখ দূরে নিবদ্ধ।

‘কোনো সমস্যা? কী হয়েছে তোমার?’ কামু জিজ্ঞেস করেছিল।
‘আমর স্ত্রী। তাকে ছেড়ে আসার সময় সে অন্তঃসত্ত্বা ছিল। কী ঘটেছে তার জীবনে কিছুই জানি না আমি।’
আরেকজন বন্দি তাদের আলাপচারিতার মধ্যে ঢুকে পড়ল : ‘ছোটো সন্তানসহ তাকে রেখে এসেছি। এই তো কয়েকদিন আগেই আমাদের সন্তান জন্ম নিয়েছে। সবাই খুব খুশি। আমাদের সন্তান জন্মের দিনই আমাকে গ্রেফতার করা হয়েছে…’

এভাবে তাদের কথাবার্তা চলতে থাকল। সকল বন্দি একটি দিনের প্রত্যাশায় ছিল-যে দিনটিতে তারা বাড়ি ফিরে যাবে।

কামুর ছেলেমেয়ে ছিল না। এমনকি সে স্ত্রী-দেনাও সম্পূর্ণ পরিশোধ করেনি। এখন তাকে কাজের খোঁজে নাইরুবি যেতে হবে। মাথুনির পিতা-মাতার অবশিষ্ট দেনা পরিশোধ করতে হবে। জীবন নতুন করে শুরু হবে আবার। তাদের একটি পুত্রসন্তান হবে। নিজের বাড়িতে রেখে তাকে লালনপালন করবে তারা। চোখে এইসব স্বপ্ন নিয়ে সে দ্রুত হাঁটতে শুরু করল। দৌড়াতে চাইল-না, উড়ে গিয়ে বাড়ি ফেরা সমাপ্ত করার ইচ্ছে হলো। এখন সে পাহাড়ের চূড়ার কাছাকাছি। কামুর মনে হলো এই বুঝি তার ভাই-বোনদের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। তারা কী কী জিজ্ঞেস করবে? কোনোক্রমেই সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যাবে না : শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের কথা, রাস্তায় এবং ইট-পাথর রাখার জায়গায় কাজ করার কথা। কাজের সময় একজন সৈনিক কাছাকাছি থাকত। সামান্য বিশ্রাম নিতে চাইলে সৈনিকটি এসে লাথি মারত। হ্যাঁ, তাকে অনেক অপমান সহ্য করতে হয়েছে, প্রতিবাদ করতে পারেনি। প্রতিবাদের প্রয়োজন ছিল? তার অন্তরাত্মা ও পুরুষত্বের তোজোদীপ্ততা বিদ্রোহ করেছে। ক্ষোভে-তিক্ততায় ভিতরে রক্তক্ষরণ হয়েছে।

একদিন এই গোরা লোকগুলো চলে যাবে!
একদিন দেশের মানুষ মুক্ত হবে!তখন-তখন-কামু জানে না তখন কী করবে। নিজেকে সে এই বলে আশ্বস্ত করল যে, তখন কেউ তার পুরুষত্ব নিয়ে বিদদ্রুপ করতে পারবে না।

পাহাড়ের চূড়ায় উঠে থামল কামু। নিচে বিশাল সমতল ভূমি শুয়ে আছে। তার সামনে নতুন গ্রাম-সারি সারি মাটির কুঁড়ে অস্তগামী সূর্যালোকের নিচে গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু কিছু কুঁড়ে থেকে ঘন নীল ধোঁয়া কু-লি পাকিয়ে ওপরে উঠে গ্রামের উপর ঘুরপাক খাচ্ছে। পিছনের গভীর রক্তলাল ডুবন্ত সূর্য থেকে আঙুলের মতো চিকন আলোকরশ্মি মিশে যাচ্ছে দূর পাহাড়ের ধূসর কুয়াশায়।


গাঁয়ের এক রাস্তা থেকে আরেক রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে অনেক নতুন মুখের দেখা পাওয়া গেল।কামু খুঁজছে। অবশেষে বাড়ি খুঁজে পাওয়া গেল। বাড়ির উঠোনে প্রবেশের আগে থামল সে এবং শক্ত করে বুক ভরে নিঃশ^াস নিল। এই তো তার বাড়ি ফেরার মুহূর্ত। তার বাবা একটা তেপায়া টুলের উপর কুঁকড়ে বসে আছে। অনেক বয়স হয়েছে তার। বাবাকে দেখে মায়া হলো কামুর। তাকে তো বাতিল হিসেবে গণ্য করা হয়েছে-সন্তানের ফিরে আসা দেখার সামর্থ্য তার নেই।

‘বাবা!’
বৃদ্ধ উত্তর দিল না। সে কেবল কামুর দিকে অদ্ভুত শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কামু অধৈর্য হয়ে উঠল। বিরক্তি ও অশ্বস্তি বোধ করল। বাবা কি তাকে দেখেনি? সে কি নদীর ধারের ঐ মহিলাগুলোর মতো আচরণ করছে না?

রাস্তায় উলঙ্গ ও অর্ধ উলঙ্গ শিশুরা খেলছে। একজন আরেকজনের দিকে ধুলো ছুঁড়ে মারছে। ইতিমধ্যে সূর্য্য ডুবে গেছে। রাতের শুরু দেখে মনে হচ্ছে আজ জ্যোৎস্নারাত।

‘বাবা, তুমি আমাকে চিনতে পারছ না?’ কামুর আশাগুলো ভিতরে ভিতরে তলিয়ে যাচ্ছে। ক্লান্ত বোধ করছে সে। কামু দেখল, বাবা হঠাৎ পাতার মতো কাঁপতে শুরু করেছে। সে দেখল বাবার চোখে অবিশ্বাস। ভয় এসে ভর করেছে দুই চোখে। মা ও ভাইয়েরা ঘর থেকে বের হয়ে এসেছে। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। মা তাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁফিয়ে কাঁদতে শুরু করল।
‘আমি জানতাম আমার ছেলে ফিরে আসবে। আমি জানতাম আমার ছেলে মারা যায়নি।’
‘কেন, কে বলেছে আমি মারা গেছি?’
‘ঐ কারানজা, নজুগুর ছেলে।’
কামু সব রহস্য বুঝতে পারছে এখন। সে বুঝতে পারছে কেন বাবা কাঁপছিল। নদীর ধারে দেখা হওয়া মহিলাদের রহস্যময় আচরণের বিষয়টিও বুঝতে পারছে। কিন্তু একটা বিষয় সে বুঝতে পারছে না : সে এবং কারানজা কখনো এক বন্দিশিবিরে থাকেনি। যে কৌশলেই হোক কারানজা আগেই বাড়ি ফিরে এসেছে। মাথুনিকে দেখার প্রবল ইচ্ছে হলো কামুর। ও কেন বের হয়ে আসেনি? কামুর চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হলো : ‘আমি ফিরে এসেছি, মাথুনি। এই তো আমি।’ চারদিকে তাকাল সে। মা ছেলের মনের কথা বুঝতে পারল। তার দিকে এক ঝলক তাকিয়ে মা বলল :
‘মাথুনি চলে গেছে।’

কামুর মনে হলো তার পাকস্থলির ভিতর ঠান্ডা কিছু একটা প্রবেশ করে স্থিতু হয়ে বসে গেছে। চারপাশের কুঁড়েঘরগুলোর দিকে তাকিয়ে কামুর মনে হলো গ্রামটা বিবর্ণ আর মলিন। অনেক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার ইচ্ছে হলো তার, কিন্তু সাহস হলো না। তার বিশ্বাসই হচ্ছে না যে মাথুনি চলে গেছে। নদীর পাড়ের মহিলাদের আচরণ এবং মা-বাবার চোখই বলে দিচ্ছে মাথুনি চলে গেছে।

‘খুবই ভালো মেয়ে ছিল মাথুনি,’ মা বলল। ‘গাঁয়ের সব অপবাদ সহ্য করে সে তোর জন্য অপেক্ষা করেছিল। একদিন কারানজা এসে বলল তুই মারা গেছিস। তোর বাবা তার কথায় বিশ্বাস করল। মাথুনিও তার কথা বিশ্বাস করে এক মাসের শোক পালন করেছে। কারানজা প্রতিদিন আমাদের বাড়িতে আসত। তুই তো জানিস সে তোর গোত্রেরই মানুষ। তারপর মাথুনি অন্তঃসত্ত্বা হলো। আমরা হয়তো তাকে ধরে রাখতে পারতাম। কিন্তু জায়গাজমি কই? খাওয়াব কী? নতুন করে জমির বিতরণ ব্যবস্থার পর আমাদের শেষ সম্বলটুকুও নিয়ে নেওয়া হয়েছে। আমরাই কারানজাকে মাথুনির সাথে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছি। অন্য মেয়েরা তো এর চেয়ে খারাপ কাজ করেছে-শহরে চলে গেছে। শুধু অসুস্থ আর বৃদ্ধারা থেকে গেছে গ্রামে।’

কিছুই তার কানে ঢুকছে না। কেবল পাকস্থলির ভিতরের ঠান্ডাটা তিক্ততার রূপ নিচ্ছে। সবাইকে তার অসহ্য লাগছে, এমনকি তার বাবা-মাকেও। সবাই তার বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ হয়েছে। কারানজা সারাজীবন তার প্রতিপক্ষ ছিল। পাঁচ বছর তো আর কম সময় নয়। কিন্তু কেন গেল মাথুনি? এরাই বা তাকে যেতে দিল কেন? তাকে কথা বলতে হবে। হ্যাঁ, সে কথা বলবে এবং সবার বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করবে-নদীর ধারের মহিলা, এই গ্রাম এবং গ্রামের বাসিন্দা সকলের বিরুদ্ধে। কিন্তু সে পারল না। তিক্তঘটনাটি তাকে শ্বাসরুদ্ধ করে ফেলেছে।

‘আমার মানুষটাকে তোমরা চলে যাওয়ার সুযোগ করে দিলে?’ ফিসফিস করে কামু বলল।
‘শোন, বাবা। শোন…’
দিগন্ত ভাসিয়ে বিশাল হলুদ চাঁদ উঠে গেছে আকাশে। বিরক্তি আর বিস্বাদ নিয়ে অন্ধের মতো বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেল কামু। হোনিয়ার তীরে এসে থামল।

নদীর তীরে দাঁড়িয়ে নদী দেখা হলো না তার; সে দেখতে পেল তার সকল আশা ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। একঘেয়ে শব্দ করে নদীটা দ্রুত বয়ে চলেছে। বনের মধ্যে ঝিঁঝিসহবিভিন্ন পোকা একটানা ডেকে যাচ্ছে। মাথার উপরে উজ্জ্বল চাঁদ আলো ছড়াচ্ছে। কামু গায়ের কোট খুলে ফেলার চেষ্টা করতেই পীঠের ওপর ঝুলানো পুঁটলিনদীর পার থেকে গড়িয়ে পড়ল জলের উপর এবং কিছু বোঝার আগেই নদীর জলে ভেসে গেল। কয়েক মুহূর্তের জন্য খুব খারাপ লাগল কামুর এবং পুঁটলি ফিরে পাওয়ার চেষ্টাও করল সে। কী দেখাবে সে তাকে? ওহ, এত দ্রুত ঘটে যাওয়া সব ঘটনাভুলে গেলকামু? তার স্ত্রী তো চলে গেছে। ছোটো ছোটো যে জিনিসগুলো তার স্ত্রীর কথা মনে করিয়ে দিত এবং যেগুলো সে এত বছর আগলে রেখেছিল সেগুলোও তো ভেসে গেছে। কামু জানে না কেন নিজেকে এখন ভারমুক্ত মনে হচ্ছে। ডুবে মরার সংকল্পটা উবে গেছে। আবার সে কোট পরা শুরু করল এবং নিজেকে নিজে বলল, ‘কেন আমার জন্য অপেক্ষা করতে হবেতাকে? পরিবর্তনগুলোকেই বা কেন আমার ফেরার অপেক্ষা করতে হবে?’

অনন্ত মাহফুজ

জন্ম : ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭০ ময়মনসিংহ

বিএ (অনার্স), এমএ (ইংরেজি), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, এমএ (আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশিত গ্রন্থ

ছোটোগল্প
স্বপ্নবাতিক কিংবা কেঁচো উপাখ্যান
পরাভূত মিছিলের ভাষা
বন্ত্রবালিকা
ভাগ

অনুবাদ
সার্ক দ্যু ফ্রিক : ড্যারেন শান (কিশোর থ্রিলার)
দি গ্রাস ইজ সিঙ্গিং : ডোরিস লেসিং (উপন্যাস)
আ কেস অব এক্সপ্লোডিং ম্যাঙ্গোস : মোহাম্মদ হানিফ (উপন্যাস)
সাহিত্যে নোবেলপ্রাপ্তদের ছোটোগল্প (অনুবাদ গল্প)

About S M Tuhin

দেখে আসুন

হেডস্যার আতঙ্ক : নেলী আফরিন

হেডস্যার আতঙ্ক নেলী আফরিন ০১. ‘কী আবদার! ইশকুলে যাবে না, উঁ-হ! রোজ রোজ এক অজুহাত …

34 কমেন্টস

  1. Generally I don’t read post on blogs, but I would like to say that this
    write-up very pressured me to take a look at and do so!

    Your writing taste has been surprised me. Thank you, quite
    great article.

  2. where to buy cialis without prescription generic cialis tadalafil

  3. i need a mortgage loan with bad credit, i need a loan have bad credit. i need more loan money for college need loan, i need loan with bad credit, cash advance loans with a prepaid debit card, cash advances, cash advance loans, cash advance loans for 1500. Financial affairs assets and liabilities banking, designed for companies. fast loan advance fast loan direct reviews i need a loan for low income.

  4. what is hydroxychloroquine used for hydroxychloroquine dosage

  5. Cussions approximately advised pou, blending him a epidemiologic do double inter a often seemed narrow cur But they nowadays wrote that i’d been driving inter dr But our company would inquire the best while ttpb (formally seemed a immunosuppression) plaquenil tablets plaquenil sale online He discovered me the tide episodes than musser’s matches, in eighty rare sparks above tide of connector .

  6. BBeeksbit#randeom[a..z]q

    culture definition psychology , environments discount school supply Buy Ivermectin Tablets community action partnership rental assistance community health center riverton wyoming Buy Ivermectin tablets shop buy ivermectin 6 mg, Ivermectin 3 mg sale. xeric environments . community advocates application , biology definition for community ecology environments effect on human behavior .

  7. provigil 100mg generic purchase provigil pill provigil 200mg us

  8. modafinil brand brand provigil 200mg order modafinil 200mg for sale

  9. why Doesn’t Cialis Work For Me?

  10. where can i buy stromectol ivermectin The struggles with infertility can be exhausting

  11. levitra viagra There are few reasons to prefer any one simple salt of lithium; the carbonate has been the more widely used, but the citrate is also available 57 Table 3

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *