প্রেক্ষণ : মিজানুর রহমান

প্রেক্ষণ

মিজানুর রহমান

ঘণ্টা ছয়েক ঘুমের সাথে ধস্তাধস্তি করে যখন সে উঠোনের ভেঙে পড়া রান্নাঘরের পোতার উপর দাঁড়িয়ে বুড়ো বটগাছের পাতার ফাঁকে চোখ গলিয়ে চাঁদ-তারা দেখে বয়স অনুমানের চেষ্টা করছিলো, ততক্ষণে রাত ঠাঁয় দাঁড়িয়ে মধ্য বয়সে। মধ্যবয়সী রাত ঘোর লাগায় ভুলু গাজীকে। আলো-আঁধারীর ছলা-কলা দিয়ে নিজের বয়স লুকিয়ে যে রূপে হাজির হয় সময়, তাতে ভুলুর ঠোঁটে কাঁপন ওঠে-

এখনো আন্ধার পানা নুয়েছে। আবার খানিক খানিক আলোও দেখা যেতেছে। নাত্তির আর কডডুককুন আছে তা কি জানি; এখন বারুবো; না থাক্পে?

এ সময়টাতে ক্লান্তি আলতোভাবে দোলা দিয়ে তার উপস্থিতির জানান দেয় ভুলুর দেহ-মনে। তাতে করে বার দুই আড়মোড়া আর হাই তোলা ভাব নিয়ে ‘আর এট্টুকুন্ ঘুমিয়ে তারপরে যাবানে’ এ চিন্তা অন্তরে জীবন্ত রেখে সে ঘরের দিকে বেশ কয়েক পা গিয়েওছিলো। আর একটু সময় পেলে সে ঘরে গিয়ে বউয়ের পাশে শুয়ে পড়তে পারতো। সে সময়ে বিপত্তি ঘটায় দরজার চৌকাঠের পাশে রাখা বউয়ের ভাঙা পিঁড়িখানা।

বছর দুয়েক আগের বছরে, আর এলাকায় ঘের হওয়ার তিন বা চার বছরের মাথায় হঠাৎ করেই রাতারাতি কমে যায় চাষের জমি। এতে করে অনেকের মতো ভুলুও যে বেশ খানিকটা স্বাচ্ছন্দ্যের মুখ দেখেনি তেমনটি নয়। তবে ঘের জনিত কারণে স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে থোকা থোকা ঘুণপোকা যে জাঁকিয়ে বসবাস শুরু করেছে তার পরিচয় প্রাথমিক অবস্থায় অনেকের মতো পায় নি সেও। এ ঘুণ নানাভাবে গুনগুন করতে শুরু করে। নব্য ঘের মালিকদের অতি উৎসাহের কারণে প্রথম দিকে অনেকের মতো ভুলুও মুজুরির টাকা বলতে গেলে প্রাপ্য অপেক্ষা থোকা থোকা পেয়েছে। ভেঁড়িবাঁধে জমি কোপানো, ড্রেন তৈরি, বাঁধ নির্মাণ এ সব কাজে ঘের তৈরির প্রথম দিকের সময়গুলো সাধারণ মানুষের কাছে ছিলো সোনালী সময়। লিজ নিয়ে বিস্তীর্ণ বিলের জমি দখল করে যে ঘের পত্তন করেছিলো নব্য ঘের মালিকরা তাতে প্রথম বছরে তারা সেজেছিলো দাতা হাতেম তাই। অনেকের মতো ভুলুও দাতাদের কথা বেশ আনন্দের সাথেই ছড়িয়েছিলো যথা-তথা। মাছের ঘেরে মাছ ধরে, মুজুরি দিয়ে, জাল ধরে বলতে গেলে সংসারের সব খরচ দিয়ে-থুয়েও তার হাতে দু’পয়সা জমেছিলো। ঘের থেকে পাওয়া মালিকের করুণার দানে পাওয়া যে মাছ তা এলাকার অনেক দরিদ্রের মতো ভুলুকেও আঁচ করিয়েছিলো-‘মাছে ভাতে বাঙালি’।

চোত-বোশেখের গতর ঘামানো খাটুনি, আষাঢ়-শ্রাবণের হিমেল শ্রম বিক্রি, মাছ ধরার আনন্দ, টুকরো চুরি-চামারি, আর করুণার দান এ নিয়ে দু’থেকে তিন বছর বেশ রমরমা ছিলো হরিনগর গ্রামের হরিজনদের। তারপর তারা উপলব্ধি করতে পারে ঘেরের কল্যাণে পেটে কিছু গেছে বটে, তবে তাতে স্থায়ী লাভ হয়নি মোটে।

আগের বর্ষায় ভুলুর খড়ের ছাউনির চাল থেকে যে ছিটেফোঁটা পানি পড়েছিলো তার সমাধান বৌ আমরি বিবি করেছিলো বিভিন্ন স্থানে ঘটিবাটি পেতে। পরের বর্ষার আগেই ভুলুর অন্তরে খড়ের ছাউনির কথাটা যে উঁকি মারে নি এমন নয়, তবে কাজের মৌসুমে কাজের মাঝে থেকে থেকে এ এক চিলতে উঁকি শেষ-মেষ বাকিই থেকে যায়। আর বর্ষাকালে যখন পচনযুক্ত পলের পানি ঘরের মধ্যে কানাকানি শুরু করে তখন কী করার ভাবনায় সে দৃষ্টি দিগন্ত প্রসারিত করে। এ সময়ে অনেক চেষ্টার পরে সে ঘেরের দিগন্ত বিস্তৃত আধা ঘোলা পানি আর পল থেকে চুইয়ে পড়া ঘরের মধ্যে রক্তবর্ণের পানি দেখে।

সে বছরই বাপের আমলের সুন্দরি কাঠের ডিজাইনের দরজার খিল পানি পেয়ে বলহীন হয়ে পড়ে; কয়েকদিন পরে তা পরিণত হয় বড় ছেলে কালুর খেলার সামগ্রীতে, অতঃপর আমরি বিবির জ্বালানী কাঠে। এখন দুর্বল দরজার চৌকাঠ বরাবর ভাঙা পিঁড়ি দিয়ে খিল আটকানোর কাজ করে আমরি। সে পিঁড়িতে হঠাৎ হোঁচটে ধাক্কা খায় ভুলুর দেহ-মনের ক্লান্তি। তাতেই সে উপলব্ধি করতে পারে ঘুমের জন্য যদি যাওয়া হয় ঘরে, কপালে দুঃখ আছে তারপরে।

ঘেরের ভেঁড়িবাঁধে প্রতিবছরে এখন যে কাজ হয় তার উপর ভর করে সংসারের চাকা পাঁচ থেকে ছ’মাস ঘোরে। অন্য সময় তাকে পরিবারসহ কাটাতে হয় অর্ধাহারে অনাহারে। দিন গতের সাথে সাথে মজবুত হতে শুরু করেছে ঘেরের মাটি, ফলে কমতে শুরু করেছে কাজের সময়।

বছর চারেক পরে যখন ভুলুরা আবিষ্কার করে বেড়িবাঁধ হয়েছে শক্ত থেকে শক্ততর; তার মধ্যে মাছ হয়েছে ক্রমাগত পূর্ণ, বিপরীতে তারা হয়ে পড়েছে কাজশূণ্য। এ শূন্যতা আর আকর্ষণ করতে পারে না মালিকদের করুণা। ফলে অল্প শ্রমের বিনিময়ে বেশি পয়সা পাওয়ার আশা ফেলে আবার তাদের ছুটতে হয় চাষের জায়গায়।

ঘেরব্যবসা বেশ জোরে-সোরে শুরু করলেও সব জমিতে লোনা পানি তোলে নি আকরাম মোড়ল। এমন হতে পারে, তার বেশ কিছু জমি সমতল ভূমি ছাড়া বেশ খানিকটা উপরে বলে সেখানে লোনা পানি যায় না, কিংবা এ রকম যে, লোকটা অতি বুদ্ধিমান তাই কিছু ভূমি রেখেছে আবাদী, অথবা হতে পারে, পৈত্রিক পেশা কৃষিকাজ থেকে দ্রুত বাঁক নেওয়া ঘের ব্যবসা একমাত্র নেশা হয়ে তাকে আটকাতে পারে নি। খালপাড়ের উচুঁ যে কয়েক টুকরো চিলতে ভূমি আকরাম ও অন্যান্যের, তা’ই এখন লোভনীয় ক্ষেত্র ভুলুদের শ্রম উজাড়ের।

ঘের শুরুর প্রথম দিকের বছরগুলোতে শ্রমের বাজার বেশ খানিকটা চড়া থাকার কারণে চাষের জমিগুলো ছিলো বলতে গেলে মড়ার দশার। ঐ সময়ে খনার-

ষোল চাষে মুলো
তার অর্ধেক তুলো
তার অর্ধেক ধান
বিনা চাষে পান।

প্রবাদটা হয়ে গিয়েছিলো পুরো অকার্যকরী। ভূমি মহাজনদের ইচ্ছার ঘাটতি না থাকলেও শ্রমিকের অভাবে পূর্বের একাধিক চাষের ইচ্ছাগুলো তাদের পাঠাতে হয়েছিলো নির্বাসনে। এতে করে ধান-পাট এ সবের ফলন হয়েছে বটে, তবে তা সবল হয়নি মোটে। ঐ সময়টাতে আকরামরা ছিলো শ্রমিক তালাসী, এরই বিপরীতে ভুলুরা ছিলো প্রচণ্ড রকমের শ্রম বিলাসী।

দিন উল্টানোর পরে সুদে-আসলেই শ্রমব্যবসা শুরু করে আকরাম। গেল বছরে আমনের মৌসুমে দৈনিক মজুরি নিয়ে বেশ অনেকটা জারিজুরি চলেছিলো মহাজন-কামলার মধ্যে।

-ও’চা হিসেব কুরে দ্যাখো চালির যা দাম তাতে পেত্যেক দিনি খাবা বাদদে তুমি যদি তিনকুড়ি কুরে টাকা না দ্যাও তাহলি তো ওপোষ কুরে মরতি হবেনে বৌ ছেলেপিলে নে।
-ষাট টাকা খেলা দিকেছো না। এখন যে খুব ত্যাল মেরতেছো। আর বছর যখন খোসামোদ কুরেলাম তখন যে পোঙা বিকিয়ে গিউরিইলে।
-কী করবো কও? ঐ বছর তো ঘেরের কাজ ছেলো। তাও তো তোমার ঘেরে আইল বানবার সময় জোন খেটে দিচি তিন চারদিন।
-তা দেচো তবে এক আনাও তো কোম নেওনি।

অবশেষে অবশ্য দফারফা হয়েছিলো ষাট এর পরিবর্তে পঞ্চাশে। চাষের জমির পরিমাণ অনেক থাকার কারণে বিক্রির দিন অনেকটা পেয়েছিলো ভুলু। এ বছরেও দৈনিক খাটার আশা অনেকদিন ধরেই সে যতেœর সাথে লালন-পালন করে আসছিলো অন্তরে। কিন্তু মৌসুমের শুরুতে কায়-কারবারের দেন-দরবার করার জন্য যখন সে মহাজন আকরামের কাছে যায় তখন মহাজনের কথা শ্রমিকের অন্তরে ঝরায় লোভের লালা।

-তার চেয়ে তুই এট্টা কাজ কর, জমি ডেকে নে। খালপাড়ে পুবির বিলি আমার যে এগারো বিঘে জমি আছে, ও জমিডা তুই তিনটে পুরো চাষ কুরে দিবি, তারপর ভুই রোবার সময় আমি আরো জোন লাগাবানে। তিন চাষ পোযন্ত তুই মোট ক’টাকা নিবি তাই ক?

একথা শোনার পর ভুলুর দৈনিক মজুরি খাটার যে অন্তরভাবনা তা দ্রুত শাখা-প্রশাখা বিস্তার করতে শুরু করে। খালপাড়ের এগারো বিঘের মানচিত্র দিব্যি অন্তরে প্রতিচ্ছাপ ফেললে সে লাঙল কাঁধে জমির অলি-গলি অতিক্রম করতে থাকে। গত বছরে ঐ জমিতে লাঙল চালানোর কারণে হোক কিংবা দীর্ঘদিনের চাষকাজের অভিজ্ঞতাহেতু অতি দ্রুততার সাথেই দিনের সংখ্যা, ঘাম ঝরানো কষ্ট, মালিকের হাত থেকে মজুরির টাকা পাওয়া ইত্যাদি বিষয় চক্রাকারে ঘুরপাক খেতে থাকে তার অন্তরে। অনেক ঘুরপাক খাওয়ার পর যেখানে ভাবনা ঝিমুতে শুরু করে-
-পেত্যেক দিনি জোন খাটপার চেইতে কাজডা ফুরিয়ে নিলি ভালো হবে। ক্যাননা তাগালি ঐ জমিতি আর কেউ কামলা খাটতি পারবেনা। এ্যাকলা এ্যাকলা চাষ কাজ কোরতি গিলি এট্টু কষ্ট হবেনে; তা হোকগে, ঐ জমিডা যদি আমি এ্যাকলা ফুরিয়ে নিতি পারি তাহলি মেলা কডা টাকা পাবানে।

শেষ পর্যন্ত এগারো বিঘে জমি তিন চাষ পর্যন্ত, এর মজুরি বাবদ বারোশ টাকার দফা-রফা হয়।

বিশ দিনের মধ্যেই এ জমির চাষ-কাজ শেষ করার একটা দৃঢ় সংকল্প নিয়েই কাজ শুরু করেছিলো ভুলু। সংকল্পের উপসর্গগুলো প্রথমাবস্থায় বেশ ভালই দেখা গিয়েছিলো। মনের ভাষা, খাসা গান হয়ে বেশ জোরে সোরে বের হতো মুখ থেকে। বলদ দু’টো বলতে গেলে মাত্রাতিরিক্ত যত্ন পাওয়া শুরু করে, বৌ এবার রথের মেলার সময় ইমিটেশনের হার-চুড়ি পাওয়ার প্রতিশ্রুতি পায়, কালু-ভেলু দু’ছেলে জানতে পারে, এ বছরে তারা একসেট করে জামা প্যান্ট পাবে একত্রে।

উপসর্গের রেশ প্রথম ক’দিন বেশ থাকলেও আস্তে আস্তে কমতে থাকে এর জৌলুস। ফলে ভুলুর গানের কলিতে কালি পড়া শুরু হয় এবং আস্তে-আস্তে তা পরিণত হয় গালিতে। আট দিন পর্যন্ত শ্রমের টাকার জন্য আকরামের মুখোমুখি হতে হয়নি তার। বৌ অবশ্য বিপদ সংকেতের পূর্বাভাস উচ্চারণ করেছিলো কয়েকবার। ভুলু আমলে আনে নি তা। কিন্তু নবম দিনে বেশ জোরে-সোরে বেজে ওঠে বিপদের দামামা-

-আজ কদিন ধুরে কতিছি তা কানে সান্দায় সে সব কোথা। শাক-পাতাড়ি, কচুর পাতা, কোস্টার পাতা যোগাড় কুরে নেন্দে দিচ্ছি তাই কাড়ি গিলতেছে। তাও নাই যা হয় কুরতেলাম। কালকেরতেতো চুলোয় হাড়ি ওঠপে না। চাল একেবারে শ্যাষ। আজকে নাত্তির বেলা আধপেটা খেয়ে থাকলি হব্যানে।

উপার্জিত বারোশ টাকা থেকে স্বাস্থ্যবান অংকের জমানো যে সংকল্প ভুলুর অন্তরে বেশ তরতাজা অবস্থায় বেড়ে উঠেছিলো আমরির কথা অকস্মাৎ ঝড় হয়ে ভেঙে দেয় তার অনেক শাখা-প্রশাখা। আর ছটফটে সে লাঙল কাঁধে জমিতে গিয়ে যখন দেখে মোট কাজের তিনভাগের মাত্র এক ভাগ শেষ করতে পেরেছে নয় দিনে, তখন তার সুখচিন্তার ভাবনাগাছে জন্ম নেয় অস্বস্তির পরগাছা। ফলে যতটা সময় কাজ করা যেতো তার অনেক আগেই লাঙল ফেলে তাকে দৌঁড়তে হয় মহাজন আকরামের কাছে।

-ও’চা টাকা না দিলি তো আর হুতেছে না। মনে কুরেলাম কাজ শেষ কুরে তারপরে সপ টাকা একেস্তার কুরে নেবানে। তা বৌ-ছেলে পিলের দন্তি হবার মতোন আছে? বৌ কুলো চাল কেনা লাগাব্যেনে তাই …
-ঠিক আছ্, ঠিক আছ্। কাজ করিছিস টাকা নিবি অতো কোথা ক্যান। তা বল তোর কাজ কদ্দুর আগুলো?
-আগুয়েছ্ মেলা খানি। আর ক’দিনির মদ্যি শেষ নামব্যেনে।

আর কয়েক দিনের মধ্যে শেষ নামানোর বিষয়টা মুখে উচ্চারণের সাথে সাথে তার অন্তরে বেশ পাকা-পোক্তভাবেই গেঁড়ে বসে সংকল্প পাহাড়। এর কারণে তার কাজগুলো হয় যন্ত্রবৎ। সংসারের চাল, মাছ-তরকারী ইত্যাদি দ্রব্য সামগ্রী কেনার সময় যে রকমের দরাদরির স্বভাবে মোড়া তার চরিত্র, সেখানে সেদিন তাই লক্ষ করা যায় ব্যতিক্রমিতার উপস্থিতি। এ কারণে পণ্য বিক্রেতারা বেশ খানিকটা অতিরিক্ত লাভ পেয়ে ধন্য হলেও তাদের দিকে ফিরেও তাকায় না ভুলু। অবশ্য এর রেশ বেশ খানিকটা বেঁকে গিয়ে পড়ে বৌ আমরির উপরে।

-এইনে থেকলো তোর বাজার। কাড়ি গেলবার ব্যবস্থা কর। পারিস তো কালকে আবার কইসকোনে সব শ্যাষ। আমি মরি খেটে-খুটে; আর পুরির গুষ্টি আছে চেটে-পুটে খাবার দন্তি।
-মনে হচ্ছে আমি এ্যাকলা প্যাটে সান্দাই আর ওরা সব প্যাটে পাথর বেন্দে থাকে।

বৌয়ের সাথে ঝগড়া করার ইচ্ছাটা ও সময়ে বেশ শক্তভাবেই একবার নড়ে-চড়ে ওঠে অন্তরে। কিন্তু পরমুহূর্তে ‘আগুয়েছ্ মেলা খানি’ এ ভাবনা জোরে থাপড় মারে ঝগড়া ভাবনাকে। তখন তা পরাজিত হয়ে ঝিমুতে শুরু করে। এই ঝিমের মধ্যে আসে দেহের ঝিম। তার মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে যখন সে খালপাড়ে বিলের কিনারে পৌঁছে; তখনের অনেক পূর্বেই মৃত্যু হয়েছে বুড়ো দিনের। দিনের কবরের উপর দাঁড়িয়ে অনেক চেষ্টা করে সর্বগ্রাসী দৃষ্টি ফেলে সে বারবার আশ্বস্ত করতে চাইলো চোখকে ‘আগুয়েছ্ মেলা খানি।’ প্রতিবারই মেলাচোখ ঘোলা হয়ে আসে; তখন সামনে ঝুলতে থাকে চাপ-চাপ অন্ধকার।

সে রাতে বৌয়ের সাথে খুনসুটি বাধে ভুলুর। এ খুনসুটির কারণে জুম্মান তার কাছে জীবন্ত হলে সে দিব্যি উপলব্ধি করতে পারে, শক্তি সামর্থ্যে তার চেয়ে কম হওয়া সত্ত্বেও জুম্মান শ্বশুর বাড়ি থেকে একটা বকনা গরুর সাথে পাজামা-পাঞ্জাবি সেই সাথে ছয়-সাত খানা কড়ির থালা-বাসন পেয়েছিলো। মৃত শ্বশুর ছদন গাজীকে হাতের কাছে না পেয়ে রাগে থিতুনি আসতে শুরু করলে তার রেশ ঢিমে তালে আমরির দিকে ছুটতে ছুটতে এক সময় পুরো স্তিমিত হয়। অথচ সকাল হওয়া মাত্রই বৌ আবার স্তিমিত রেশ বেশ করেই উস্কে দেয়-
-কালকে কলাম ঈদ। আজকে খ্যাতে যাবার সময় গঞ্জি-গামছা থুয়ে যাবা। ছবাল দুটোরও তো পরবার কিছু নি। যা আছে তাই কেচে-কুচে থোবানে। আমার আর কি। নিজির দন্তি কিছু চাইনে। ছাবাল দুটো ছেড়া প্যান পুরে নুয়েচ্ আজ কদিন তাও যদি মিনসের চোখির খোলে সান্দিতো-

এ রকমের অবস্থার মধ্যে ভুলু লাঙল নিয়ে খালপাড়ে যাওয়ার পর অস্বস্তির আরো একটা বড়-সড় চাঙর তার দেহ-মনে, চোখ-মুখে ছিটকে পড়ে দ্রুত।

হাজরা শেখের গরুর অসুখের খবরটা সে শুনেছিলো গ্রামের হাতুড়ে পশু চিকিৎসক আমজাদ ডাক্তারের কাছ থেকে। তিন দিনেক আগের অসুখটা শেষ পর্যন্ত যে গরুটাকে লাশ বানাবে এ চিন্তা সে না করলেও গেল কাল সকালে জমিতে আসার সময় মুচিপাড়ার গুয়ে, গোবর্দ্ধন দু ভাইকে ছুটতে দেখে খানিকটা কৌতূহলী হয়েই সে জিজ্ঞাসা করেছিলো-

-এও নোড়াতি নোড়াতি কোয়ানে যাতিচিস দুই ভাই? কার গোরু মুরলো?
-হাজরা শেখের বড় এড়ে গোরু মুরেছে। তা খালপাড়ের কোন বাড়ে ফিলেছে কতি পার নাই?

মুখে এ রকমের প্রশ্ন করলেও দাঁড়ায়নি দু’ভাই। হাজরা শেখের তাগড়া এড়ের মুত্যুর খবরে বেশ খানিকটা অসহায় বোধ করে ভুলু। তাতেই হাতের লাঠি গরুর পিঠে না উঠে তা চলে যায় বাম বগলদাবায় আর ভুলু ক্রমাগত ডান হাত বলদের পিঠে বুলাতে থাকে। এ অতি মন্থর গতি হোঁচট খায় যখন সে জমির কিনারায়। খানিক আগে দু’ভাইয়ের জিজ্ঞাসিত প্রশ্নের জবাব তার অজানা থাকার কারণে সে দিতে পারে নি। অথচ যদি জিজ্ঞাসাটা হতো এ সময়ে তাহলে দিব্যি বলে দিত-

-হ্যায় কতি পারি, হাজরা শেখের মোরা গোরু আকরাম মোড়লের যে এগারো বিঘে জমি নুয়েছে খালপাড়ে উকেনে ফিলেচে।

গরু দুটো খানিকটা সময় আপন মনে হাঁটার সুযোগ পায় কারণ ঐ সময়ে জনা আষ্টেক মুচির একত্রে মরা গরুর ছাল ছাড়ানোর দৃশ্যটা সে আনমনা হয়ে আয়েসি ভঙ্গিতে দেখতে থাকে। লাঙল চষা শুরুর পর তার দুটো গরুর যে কোন একটি অথবা দুটোর অসুখ হওয়া, আমজাদ ডাক্তারকে ডাকা, বাড়িতে জমানো টাকা না থাকলে কী করা যায় এ সব চিন্তার চর্ষণ চলতে থাকে ঘূর্ণ্যমানের অন্তরে। প্রতিবারই চষা অবস্থায় ঘূর্ণ্যমানের সাথে সাথে ছাল ছাড়ানো মুচিবেষ্টিত মরা গরুতে দৃষ্টি পড়া মাত্রই তার চিন্তার খটখটে ভূমির উপর দিয়ে ক্রমাগত হাঁটতে থাকে নিজের হাঁড় জিরজিরে গরু দুটো।

বাঁক ঘুরলে নিজের গরু অস্পষ্ট, বিপরীতে জুম্মানের শ্বশুর প্রদেয় বকনা গরু তার সামনে তরতাজা গাভী হয়ে বাছুর প্রসব করলে ছটফটে হয়ে সে অকারণে নিজের দু’গরুর পিঠে দমাদম বাড়ি কষে।

জুম্মানের শ্বশুর, নিজের শ্বশুর, বাপ তিনজন একত্রে স্মৃতিতে জীবন্ত হওয়া মাত্রই এদের মধ্যে সে নিজের শ্বশুরকে দাঁড় করায় ছাল ছড়ানো মুচিদের কাতারে। বিপরীত জুম্মানের শ্বশুর আর নিজের বাপ এ দু’জনের মধ্যে কে বেশী উদার তা মাপতে ব্যস্ত হয়। শ্বাসকষ্টে মরা বাপ বাটুল গাজী শেষ পর্যন্ত জুম্মানের শ্বশুরকে পরাজিত করে। শ্বশুর জুম্মানকে একটা বকনা দিয়েছিল বটে তবে বাপও কম দেয় নি। শেষ অবস্থায় ঔষধের টাকা যোগাড়ের জন্য বাপ যদি নিজের হালের গরু দুটো বিক্রি করতো তাহলে কারো বলার কিছু থাকতো না। বাপ তা করে নি। আর বাপের কথা মনে করে দু’পশুর দিকে তাকিয়ে নিজেকেও পশু মনে হয় তার। তিন পশু মিলে যে আয় করছে তা বসে আরো যে তিন জন খাচ্ছে তাদের পশু ভাবার চেষ্টা সে বেশ কয়েকবার করে ব্যর্থ হয়। নিজের দু’ছেলে একপাশে সরে যাওয়ার পর যখন বৌ স্মৃতিতে তখন তড়িৎই তার পাশে দাঁড়ায় জুম্মানের বৌ। জুম্মানের চেকনাই বৌয়ের রোশনাই ঝলমল করে উঠলে তার দু’ঠোঁটের ঢাকনাতে কাঁপন ওঠে।

-আমি কী করবো? ওর শকুর বোকনা দেচে। সেই বোকনা গাভীন হুয়ে বিয়েলো তারপরে দুধ দ্যালো। সেই দুধ খেয়েই তো ওর বৌর শরীল ওন্দার জ্বলজ্বলে নুয়েছে। আমার শকুর যদি আমারে গরু দিতো তাহলি আমিও বৌরি দুদ খাবাতি পারতাম।

নিজের শ্বশুরের উপরে রাগ, লাঙল চালানোর কষ্টের পায়ে পিষ্টের ফলে এক সময়ে তা তোবড়ানো ছিঁবড়ে হয়ে সেখান থেকে করুণার জন্ম হয়ে তা ছোটে নিজের বৌ আমরি বেগমের দিকে। ছুটতে ছুটতে সে করুণা স্থির হয় কালু-ভেলুর মার প্রতি। নিজে আমানি খেয়ে পান্তা তিন ভাগে ভাগ করে বাপ আর দু’ছেলেকে দেওয়ার ঘটনা এ সময়ে সামনে জীবন্ত হলে ভুলুর কাছে আমরি বেগম সত্যি সত্যিই স্ত্রী ও মা হয়ে ওঠে। এমনটি হওয়ার ফলে অনেকটা সম্মোহিত অবস্থায় দ্রুততার সাথেই তাকে লাঙল চষা বাদ দিয়ে বাড়ির রাস্তায় হাঁটতে হয়। এ সময়ে চলার পথের পাশে হওয়ার কারণে অনিচ্ছায় তাকে হাজরা শেখের ছাল ছাড়ানো মরা গরুর দিকে তাকাতে হয়।

গরু নিয়ে বাড়িতে ঢুকলো ভুলু অথচ হম্বি-তম্বি হলো না; বিষয়টা সন্দেহের বীজ হয়ে তা আলতোভাবে পড়ে আমরি বেগমের মনোজমিনে। খানিক পরে যখন-
-কালুর মা ভাত তরকারি নান্দা হুয়েচে তো। কী নানলি আজকে? চ্যান-দ্যান কুরে আয়, ছাবাল দুটো নে আজকে সোকগুলি এক সঙ্গে খাবো।
তখন সন্দেহের বীজ অঙ্কুরিত হতে শুরু করে। ফলে তাকে থামতে হয়। এ থামার কারণে দৃষ্টি অনাসৃষ্টি ঘটায়। ফলে দেখতে হয়, দেখতে হয় নিজের হাত নিজেকে। চামড়ার জমিনের খানা-খন্দ মন খারাপ করে ফলে কাজের গতি ধীর হয়। অথচ খানিক আগেও কাপড় কাচার তাল এনে দিয়েছিল নাচের তাল। নিজের উদ্যোগে তৈরী করা ক্ষার যে এভাবে তার হাতকে ক্ষত করবে তা সে ভাবে নি । গত ঈদে সোডা কেনা নিয়ে স্বামীর সাথে বাক-বিতণ্ডার কথা স্মরণ হলে চোখে পানি আসে।
-ঈদের দিন, ছাবাল দুটো ঈদগায় যাবে, নোকের বাড়ি যাবে, জামা-কাপড় যদি মুচিগো মতোন ওন্দার কালো থাকে তাগালি দেখলি খুব ভাল ন্যাগবেনে তাই না?
-যেন্দার নাগে নাগুক। ভাত জোটেনা আবার জামা কাচা নেগতেচে। কোথায় কয়, পোঙায় নি ছাল চামড়া খাতি চায় পাকা আমড়া।

শেষ পর্যন্ত অবশ্য কয়লা বেচা পয়সায় আটআনার সোডা কিনে স্বামীর, ছেলেদের, নিজের কাপড়-চোপড় যেটুকু হয় পরিষ্কার করেছিল আমরি বেগম। এর পুরস্কার হিসেবে স্বামীর কাছ থেকে তাকে পয়সাচোর উপাধি পেতে হয়েছিলো। অভিমানহেতু উপযাচক হয়ে পরের জন্য, হোক সে স্বামী বা সন্তান, কিছু করবে না, এমন প্রতিজ্ঞা অনেকদিন ঘাপটি মেরে বসেছিলো আমরির অন্তরে। অথচ বৈশাখ মাসের ঝড়ের সময় যখন সরদার বাড়ির বেড়ের পাশের কলার ঝাড় বলতে গেলে অর্ধেকের বেশী পড়ে যায়, তখন মনের প্রতিজ্ঞা উড়াল দেয় অজান্তে।

জসিম সরদারের বৌয়ের ঠিকে কাজের জনা চারেকের মধ্যে আমরি স্বভাব আর সততার কারণে দয়া পাওয়া তালিকার একেবারে ঊঁচু স্থানে নিজের নাম লেখাতে সক্ষম হয়েছিল। ফলে সুযোগ আসে।

-ও বু; কুতেলাম কী কচি কোলার কান্দি তো নিতি কুলে। ঐ সঙ্গে কোলাগাছটা নে যাবো? আঙ্গো ছাবালের বাপ থোড়দে চিংড়েমাছ ভাজি খুব পছন্দ করে। ছ্যাকনা দে যদি কডা চিংড়ে ধরতি পারি তাহলি ঐ থোড় দে ভাজি কুরে দেবানে।
-তা নে যা।

কলাগাছ থেকে থোড় বের করার পর এর পরিত্যক্ত অংশ ফেলতে ইচ্ছা হয় নি আমরি বেগমের। অনেক যতেœ শুকিয়ে, পুড়িয়ে তা দিয়ে ক্ষার তৈরী করে কুড়িয়ে পাওয়া পলিথিনের প্যাকেটে যতেœর ওমে মুড়ে রেখেছিল। অনেকটা ক্ষার, নিজেদের কাপড়- চোপড়, কাঁথা, ছেঁড়া মশারি, তেল চ্যাটচেটে বালিশের কভার, এ সব কাচার কারণে ক্ষার তার হাত ছারখার করবে, এ যদি আগে থেকে আচঁ করতে পারতো তাহলে নিশ্চয়ই সে আরো সতর্ক হতে পারতো। আঁচ তার কাছ ঘেঁষেনি ফলে রেহাই পেয়েছে কৌশল। এর মধ্যে ছাওয়ালের বাপের মমতাময়ী আরো দু একটা কথাবার্তা যখন দ্রুত সন্দেহবৃক্ষে শাখা-প্রশাখা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে, সে সময়ে হাতে ভুলুর বাবার আমলের পাঞ্জাবি। রাগে কিংবা দুঃখে অথবা যন্ত্রণায় হাতের তেজ বলবান হলে ডান পকেটের সুতোর বেড়া বলশূন্য হয় এবং তা মুহূর্তের মধ্যে। সুতোর বেড়া আলগা হওয়া মাত্রই আমরি বলশূন্য হয়ে পড়ে। তখন একটু আগের রাগ, দুঃখ বা যন্ত্রণার উপর খবরদারি শুরু করে ভয়।

ভয়কে সাহস যোগাতে বুদ্ধি এগিয়ে এলে আমরি বেগম উঠোনের টানানো বাঁশে পাঞ্জাবি মেলে তার ডান পাশ বরাবর নিজের কাপড় মেলায়। আর সেদিন রাতে ভুলু খাওয়ার সময় ভাত তরকারি সব গরম, বিপরীতে বৌয়ের মেজাজ অবাক করা নরম পায়। রাতেই সকালের ঈদের প্রসঙ্গ ওঠে। ও সময়েই বেশ ঠাণ্ডা গলায় খুশির প্রসঙ্গ তোলে আমরি বেগম।

-তোমারে অত্তো ভাবা ন্যাগবেন না। খ্যাতে যদি না যাতি চাও তাগালি যাতি হবে না। সোকাল-সোকাল চ্যান-দ্যান কুরে ছাবাল দুটো নে নামায পড়তি যেয়ো কোনে। তোমাগো তিন জনের জামা আমি কেচে বালিশির তোলায় থুয়চি। দিকোকোনে সোন্দর দেখাব্যেনে। কালকে বাজারেও যাতি হবেনা। কালু ছিপ বেয়ে তিনটে কৈ মাছ ধরিলো। আজ কদিন যাবিয়ে থুয়চি। কালকে ঐ মাছ ঝোল করবো।

এমন নির্ভরতার খবর নিশ্চিন্ত ঘুমকে নির্বিঘেœ আমন্ত্রণ জানাবে এটা হওয়া ছিল স্বাভাবিক। তেমন পরিবেশও সৃষ্টি হয়েছিল। হঠাৎ বৌ-
-কালকে তো মেলা বাড়িত সেমাই খাবা। ভাত খাতিতো সেই দুকুর…

তখন কোথা থেকে শুরু। তাতে গ্রামের পুবপাড়ার প্রথমবাড়ি আকরামের হওয়াতে ফিরে আসে খালপাড়ের আধা চষা এগারো বিঘে। এগারো বিঘের সাথে মাঝ রাত সখ্য করে ভুলুকে নিয়ে যায় খালপাড়ে। ঘুম কাতুরে গরু দুটোর ঘুম তাড়ানোর কারণে প্রথমে উপলব্ধি করতে পারে নি সে। একটু পরে তখন গরু দুটো চোখ মেলে ভালভাবে হাঁটতে শুরু করেছে। ঐ সময়ে বিষয়টা স্পষ্ট হয়। এ স্পষ্টতায় আলো ফেলে গতকালের দৃশ্য। সে বোঝে দুর্গন্ধ আসছে হাজরা শেখের ছাল ছাড়ানো মরা গরু থেকে।

নিজের বুদ্ধিতে নিজেই মুগ্ধ হয় ভুলু। ভাগ্যিস বৌয়ের ক্ষারে কাঁচা গামছাটা কোমরে বেঁধে এনেছিল সে। নাকে গামছা বেঁধে হই, হই ধ্বনি তুলে কিছুক্ষণ অথবা দীর্ঘক্ষণ ঘুর্ণায়মান ভুলু আবার ভুলু হয় পুব পাড়ার মসজিদের মাইকের আল্ল¬াহুআকবর ধ্বনি শুনে। আল্ল¬াহু আকবর ভুলুকে ভুলু করলে তার মনে পড়ে আজ ঈদ। মনে পড়ে ঈদ বলেই তাকে নিদহীন কাটাতে হয়েছে। দীর্ঘশ্বাসটা হয় অন্তর উজাড়ি তৃপ্তির।

-ঈদির দন্তি দিনডে মাটি হব্যেনে, তবে নাত্রি জেগে মেলা কাজ কুরে কাজতো পুষিয়ে নিচি।

আজকের দিনটা কিভাবে কাটানো যায়, এ ভাবনা অন্তরে চরতে দিলে তা লাফালাফি বা মন্থর গতিতে হাঁটা শুরু করে। বেশ জোরে-সোরে লাফাতে-লাফাতে সামনে আসে গতবারের ঈদ। জুম্মানকে সাথে নিয়ে অন্যান্য ঈদের মতো বাড়ি-বাড়ি যেয়ে সিমাই-সুজি খাওয়ার প্রতিযোগিতায় নামার পরিকল্পনা ছিল আগে থেকেই। এমনকি অনেক বাড়িতে যাতে খাওয়া যায় তার একটা বিজ্ঞানভিত্তিক উপায় পরিকল্পনা করে ঠিকও করেছিল তারা। পরিকল্পনা আসে জুম্মানের মাথা থেকে।

-শোন, কালকে শুরু করবো পুব মুড়োরতে। তা ধর দশ বারো বাড়ি তো হবেই। কবির গাজীর বাড়ি পোযন্ত খাবার পর যাবো বাচা শেখের বাড়ি। ঐ বাড়িত সেমাইর সাথে আস্ত যে ডাল নেন্দে খাতি দেয় তা ঝালদে নান্দা। এট্টু ঝাল খালি দেখিসকোনে আরো মেলা বাড়িত সেমাই খাতি পারবানে।

-ঠিক কয়চিস। বাচা শেখের ছোট পুতির বৌ টাউনেত্তে এসে কী সব টেস্টো নান্দা নান্দে। তোরে কয়নি; আগের ঈদি যকুন ওগো বাড়ি গেইলাম স্যাখন ঝন্টু সাহেবের প্লে¬টে কুরে কিড়মি পানা সাদা-সাদা লম্বা-লম্বা কি দেলো। পিন্টু খাতি খাতি থুইলো আমি তাত্তে তুলে গালে দেলাম। উঃ, কি টেস্টো নেগেলো তোরে কী কবো।

পরিকল্পনা ঠিক থাকলেও তা বাস্তবায়িত হয় নি। ফলে বাঁধা-ধরা প্রতি ঈদের আঠারো থেকে বাইশ বাড়ির যে সেমাই খাওয়া তা কমে নেমে আসে মাত্র তিনে। দোষ কার? এ জিজ্ঞাসা অন্তরে ঝুলতে থাকলে তা নানা জনের দিকে নিশানা করে দুলতে থাকে। জিজ্ঞাসা ভুলুর দিকে আঙুল তুললে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য ঠোঁটে শুরু হয় মৃদু ভূকম্পন।
-আমার দোষ কী? আমি তো ওগো গায় তা তুলতি চাই নি। বৌর দোষ।

ঐ ঈদেও ভুলু তাই করেছিল, যা সে প্রতি ঈদে করে। বেশ খুশি মনেই দু’ছেলেকে সাথে নিয়ে গোসল করে তারপরে ভেঙেছিল লক্ষ্মীর ভাণ্ডার। পয়সার বংশ ভাণ্ডারমুক্ত হওয়ার পর নানা দিকে ছড়িয়ে পড়ে। বড় ছেলে কালু নিজেকে বাপের চেয়ে বুদ্ধিমান ভেবে ছড়িয়ে পড়া থেকে একটা দশ পয়সা টপ করে তুলে অবলীলায় লুকিয়ে ফেলেছিল গালে। হ্যাঁ, ছেলের উচুঁ গাল দেখে ভুলু চড় মেরেছিল বটে। তবে দিতে তো সে কার্পণ্য করে নি। গাল থেকে বেরুনো দশ পয়সা শুধু না, দু ছেলের হাতে এক টাকা করে দিয়ে তারপরে তাদের নিয়ে গিয়েছিল ঈদের মাঠে। কথা ছিল ছেলেরা দাঁড়াবে ঈদগাহের গেটে। নামাজ শেষে তারাও বাপের হাত ধরে দু’এক বাড়িতে যাবে, সেমাই খাবে তারপরে ফিরবে বাড়িতে।

কোথা থেকে শুরু, কাদের বাড়ির প্লে¬টে বেশী থাকে, এ সব চিন্তা আসার কারণে মোনাজাতের মধ্যেই আনমনা সে দু’বার উত্তোলিত হাত মুখে ঘষেছিল। আর হুজুর যখন আলহামদুলিল্লা বলে তখন সে দ্রুতই পাটি না গুটিয়ে তাল করে ছোটে ঈদগাহের গেটে। তার চোখ জোকতালাশী হয়েও ছেলে পেতে ব্যর্থ হয়। অগত্যা সেমাই খাওয়া বাদ রেখে তাকে বাড়িতে ছুটতে হয় অনিচ্ছায়। এখানে সন্ধান মেলে ছেলেদের, হদিস মেলে ঘটনার।

ছেলেদের কান্না, বউয়ের বাজখাই গলা, এ থেকে যে তথ্য মেলে তাতে জানা যায়, বাপের দেওয়া এক টাকা দিয়ে ঈদগাহের গেইট থেকে প্রথমে বড় ছেলে কটকটি কেনে। দেখাদেখি ছোট ছেলে অনুসরণ করে অগ্রজকে। বড় সংযমী হলেও ছোট পারে নি তা। ফলে নিজের কটকটি শেষে সে থাবা মারে বড়র হাতে। বড়র কটকটি মাটিতে পড়লে প্রথমে রাগে, দুঃখে তার হাত ওঠে ছোটর পিঠে। অতঃপর মায়ের সহানুভূতির জন্য সে বাড়ির দিকে ছোটে। বাড়িতে যাওয়ার পর সে কাঁদতে কাঁদতে ঘটনার প্রায় সবটাই মাকে শোনাতে পেরেছিল। মা তার পক্ষ নিলে হয়ত সে তৃপ্ত হতে পারতো, পরিবর্তে-
-ঈদির দিনি তুই ছোট ভাইর গায় ক্যান হাত তুললি…

এরপর নিজের পিঠে-মুখে কিলচড় উপহার পায়। তখন উঠোনে বসে ভ্যা ভ্যা করে কান্না ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। সব শোনার পর ভুলুর পৌরুষত্ব জেগে উঠলে বৌ কেন ছেলের পিঠে হাত তুলেছে, তাই তার হাত ওঠে বৌয়ের পিঠে। এতে করে যে জগাখিচুড়ি অবস্থা তাতে লোকসান শেষ পর্যন্ত ভুলুরই হয় অধিক। ছেলেদের কান্না, কান্না জড়িত বৌয়ের শাপ শাপান্ত, এ সবের মধ্যে পড়ে সেমাই খাওয়া বাড়ি আঠারো বাইশ থেকে নেমে তিনে আসে।
-এবার আর ঐ ভুল কত্তিচনে। লক্ষ্মীর ঘট ভাঙবো। তবে আগেত্তে ওগো হাতে পয়সা দিতিচনে।

ঠোঁটে বিড়বিড়ের কারণে হোক, অথবা দমকা একটা বাতাস কিংবা অনেকক্ষণ থাকার কারণে এমনি এমনি শিথিল; এ সব কারণে গামছা যখন নাকখসা, তখনই বাতাস বয়ে আনে নাড়ি উল্টানো গন্ধ। গন্ধ এত মন্দ যে তড়িৎ উৎসস্থলের দিকে তাকানো ছাড়া গত্যন্তর থাকেনা ভুলুর। রাতের গা থেকে ততক্ষণে অন্ধকার খসায় দেখা যায়। দেখা যায় দিব্যি; অনেক গলা লম্বা শকুন ভুলুর লাল-সাদা ডোরাটানা গামছাকে ঘিরে উৎসবে মেতেছে। ও সময়টাতে লাঙলের ফলাতে মাটির নীচের শক্ত ইট বেঁধার কারণে তাকে থমকাতে হয়, একই সময়ে খামচা মেরে সে গামছা আবিষ্কার করে নিজের গলায়। লাঙলের ফলা ছেড়ে দৃষ্টি উজাড় করলে ভুলু ইতোপূর্বের গামছা বিছানো স্থানে দেখে মরা গরু। তখন-
-দুত শালা! আমার গামছা আমার গোলায় পেচানো নুয়েছে। শকুনির পাল মোরা গরু খাতি খাতি ওন্দার কুরেছে।

ঈদের সকাল বলতে গেলে তাড়া করেই বাড়িতে ফেরায় ভুলুকে। প্রতি ঈদের মতো এবারও সে যন্ত্রবৎ দু’ছেলেকে নিয়ে পুকুরে নামা, বৌয়ের যতেœর ওমে রাখা অসমান ভাজের জামা বালিশের তলা থেকে বের করা, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার ভাঙা ইত্যাদি কাজ করে। ও সময়েই খুশির একটা প্রলেপ বেশ মোটা রকমের আস্তরণ ফেলে ভুলুর অন্তরে।

লক্ষ্মীর ভাণ্ডের সব পয়সা গোনার পর যে পরিসংখ্যান, তাতে হিসেব গিয়ে স্থির হয় ছয় টাকা ত্রিশ পয়সায়। এর মধ্যে সাক্ষাৎ মেলে দুটো স্বাস্থ্যবান আধুলির।
-ও বাপ আঙ্গো পয়সা দ্যাও।
-আমি কটকটি আর কাটিমেটাই কেনবো।

দু’ছেলের এ সব কথাতে গেল ঈদ ভুলুর কাছে ফিরে এলে মুহূর্তে সে কঠোর হয়। তাতে-
-শয়তানের বাচ্চারা আগেত্তে তোগো টাকা দেই আর মারামারি করো তাই না? আমার সাথে ঈদগার মাঠে যাবি, নামায শেষ হবে তারপরে পয়সা পাবি।

কিন্তু ঈদগাহের মাঠে যাওয়ার আগেই হাত নিশপিশ করে ওঠে ভুলুর। ক্ষারে কাঁচা পাঞ্জাবির ফর্সাত্ব দেখে মুগ্ধ সে যখন বৌয়ের প্রতি মমত্ববান হতে শুরু করেছে তখন তাতে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় ডান হাত। সবটুকু ঢুকিয়ে এমনকি উপুড় হয়ে ডান হাতকে স্বাধীন করে দিলেও সে তলের হদিস পায় না। স্বাধীন হাত তখন বৌয়ের পিঠের সন্ধানে ব্যস্ত, সে সময়ে বৌ লাগামছাড়া হওয়ায়, গত ঈদ ফিরে আসায় অগত্যা বাম পকেট সুযোগ পায়। ঐ সময় ভুলুর ডান-বাম দুহাত দু’ছেলে ধরায় বৌয়ের খেজুর পাতায় বোনা পাটি বগলদাবায় করে তাদের সাথে হাঁটতে হয় ঈদগাহমুখি।

-ইকেনে দাঁড়াবি; আমি নামায পুড়ে বয়কায় বারুবো তারপরে তোগো পয়সা দ্যাবো। ইকেনেত্তে যদি এক পা নড়িচিস তাগালি পয়সার বদলে কানচাবাল জ্বালিনে চড় পাবি।

ছেলে দুটো ঈদগাহের গেটে রেখে ভেতরে প্রবেশ করলে আমন্ত্রণ আসে জুম্মানের কাছ থেকে। আগে পৌঁছে নিজের পাটি লম্বায় না দিয়ে আড়াআড়ি পেতে সে জায়গা দখলে রেখেছে ভুলুর জন্য।

খুচরা পয়সার বহরে বামে ঝোলা পাঞ্জাবী গায়ে যখন জুম্মানের পাশে সে বসে তখন ঝোনাৎ শব্দ আশপাশের দু’চারজনকে চকিত করে, এটুকু মাত্র। অতঃপর সুন্দরভাবেই সমাধা হয় নামাজের প্রাথমিক পর্ব। হুজুর দাঁড়িয়ে যা বলা শুরু করে তা মাইক সমবেতদের কাছে বিলাতে কার্পণ্য করে না মোটেও, তা সত্ত্বেও হয় না। বোঝা হয় না বলেই ভুলুর অন্তরে শক্ত করে আঁটা চিন্তার বোঝা খুলে যায়। পাঞ্জাবির পকেট ছেড়ার কারণে বৌয়ের পিটানি উপহার পাওনা কিনা এ চিন্তা প্রথমে গুনগুন শুরু করলেও যখন বামহাত পকেটে থাকা পয়সার অস্তিত্ব টের পায় তখন পালায় পূর্বের চিন্তা।

তার পকেটে ছ’টাকা ত্রিশ পয়সা। ক্যালকুলেটার সচল হলে যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ মারামারি বাঁধায়। হট্টগোল একটু কমলে ভাগ কর্তৃত্ব নিয়ে নেয়। শেষ সিদ্ধান্তে ভাগ, রায় ঘোষণা দেয়; তাতে ঈদগাহের মাঠের তিন হাজী রুমাল দশ পয়সা করে ত্রিশ পয়সা, দু’ছেলে দু’দু চার টাকা আর বৌয়ের কটকটি কেনা বাবদ দু’টাকা বরাদ্দ হয়।

ভাগের নির্দেশিত দু’টাকা কটকটির জন্য বৌ বরাদ্দ পাওয়া মাত্রই ভুলুর বয়স নয় বছর কমে। তখন আমরি তার কাছে অমরিসোনা। এ জন্য বিয়ের আগের জমানো পয়সার প্রতি যে অতি মমতা তা উবে যায়। ফলে সমস্ত দিনের মাটি কাটা খাটুনির পরও তাকে রথের মেলায় বেরুতে হয় অমরিসোনাকে নিয়ে। মেলায় ঘোরা, সার্কাস দেখা, এ সবের পরেও মাত্র চার আনার কটকটি অমরি কি তৃপ্তির কটকট চিবায় আর কটকট করে তার মুখ থেকে কথা ঝরে। এতদিন পরে আবার দু’টাকা বরাদ্দ পেয়েই অমরি কথা বলা শুরু করে। অমরি হয়তো বলতো, বলতো, বলতো। তার বলা থামায় হুজুর, -জোরে বলুন ‘আলহামদুলি¬ল্লাহ’।

অনেকের সঙ্গে ভুলুও আলহামদুলিল্ল¬াহ বেশ জোরে-সোরে উচ্চারণ করার পর অমরি উধাও হয় পুরোপুরি। তাছাড়া হুজুর এখন যা বলছে তা আগের মতো বোধহীন নয়। ধোনই দিব্যি বুঝছে, সে এটাও বোঝে; সবাই বুঝছে। হুর-পরী, গেলমান এ সব কথা অনেক পিছনে যায়, শুধু হুরের রূপ চিলতে খানিক স্থায়ী হলে চেয়ারম্যান বাড়ির কলের বাক্সের মেয়েলোক সামনে দাঁড়ায়। ভোটের আগে প্রতিদিন বারান্দায় চালানোর কারণে দেখার সুযোগ মিলতো। অনেক আগের দেখা তবুও দিব্যি সামনে এসে হাঁটা-চলা, নাচা, কথা বলা শুরু করে। বেহেস্তে যে হুর মেলবে তা দেখতে কতটা ভাল এ চিন্তাতরঙ্গ তখন কলের বাক্সের, জুম্মানের, নিজের মেয়েলোক ঘিরে কলকল শব্দ তুলেছে। সে তরঙ্গ হঠাৎ বাড়ি খায় ‘মারহাবার’ গায়। দু তালবেএলেম হাজী রুমালের দু’প্রান্ত ধরে কোমর বেঁকিয়ে সবার সামনে দিয়ে হাঁটছে। সুদে কারবেরে নুরো গাজীর সামনে যাওয়ার পর রোমালে একশত টাকার নোট পড়েছে তাই হুজুরের মুখে ‘মারহাবা’।

ক’দিন ধরে ভুলু বাজারে কানাঘুষা হতে শুনেছে নুরো গাজী করবে মেম্বারি ইলেকশন। চলতি পথে শোনা সে সব কথাবার্তায় মনে না পড়লেও মারহাবা তার দৃষ্টিকে আমন্ত্রণ জানিয়ে যে নুরোকে দেখায় তাতে বিশ টাকা ঋণের কারণে এক সপ্তাহ যাবৎ শোধ না দেওয়া পর্যন্ত প্রতিদিন পালা করে বৌয়ের হাঁসের, মুরগির একটা করে ডিম খরচ হয়।

সুদে কারবেরে নুরো গাজী এবার মেম্বর হবে কী না, কে কে তাকে ভোট দিতে পারে. এ সব চলতে পারতো আরো কিছুক্ষণ। আবারো বাঁক বদল করায় হুজুর। তার মুখে এখন পানি আর ফলের কথা। ভুলু আম, জাম, কাঁঠাল, আপেল, কমলালেবু এ সব ফলের নাম শুনেছে। হুজুর মেওয়া নামের যে ফলের কথা বলছে তা সে কোনদিন শুনেছে এমনটি মনে করতে পারে না।

অথচ হুজুর যা বলে তাতে ঐ ফলই সেরা ফল। দেখতে কেমন? এ জিজ্ঞাসা অন্তরে উড়ে আসলে কয়েকটা ফল দ্রুতই চেহারা দেখিয়ে বিদায় নেয়। শুধু দাঁড়িয়ে থাকে মাঝারি সাইজের একখানা শশা। শশা না আসলে হয়তো আসতো না মরা বাপ।

চেষ্টার ত্রুটি সে করে নি। বাপ বাটুল গাজী, যে বাটুল কবিরাজ নামে পরিচিত ছিল, সে একমাত্র ছেলে ভুলুর সুখের কথা চিন্তা করে ভিটের মাটি বা গোয়ালের গরু অন্যের হাতে তুলে দেয় নি। কবিরাজ নিজে গাছ-গাছড়ার ঔষধ খাইয়ে প্রথম দিকে রোগ তাড়াতে পারলেও শেষ দিকে এসে রোগে-ঔষধে যে মারামারি বাঁধে তাতে কখনো রোগের জয় আবার কখনো ঔষধের জয় শুরু হয়। একেবারে শেষ দিকে রোগ, ঔষধের বুকের উপর চেপে বসলে ভুলু বাপকে প্রথমে সুখেন কবিরাজ, তারপর হোমিওপ্যাথ মান্দার ডাক্তার আরো পরে তিন টাকা ভিজিটের কুদ্দুস ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। কুদ্দুস ডাক্তার নাড়ি টিপে, নিজের কানের নল বাপের বুকে ঠেকিয়ে, বাপকে জোরে দম ছাড়তে বলে তারপরে ভুলুকে নিয়ে কোণায় গিয়ে-
-হবে না, আর হবে না। বুকি যা কপ জুমেছে, আর যে পরিমাণ এ্যাজমা তাতে হবে না রে। ঔষুধ পানি আর কত করবি। বাড়িত নে যা। ভালো-মন্দো খাতি দিস। পারলি এট্টু ফল-ফুলুরি খাবাইস।

এত কথার পরও কমেনি। কুদ্দুস ভিজিটের সাথে ট্যাবলেটের দাম সাড়ে চার টাকা নিয়েছিল। বাপকে বাড়িতে রেখে কাজের সারাটা সময় লাঙল ঘোরার সাথে সাথে তার মাথায় ফল-ফুলুরি ঘুরেছিল। ঐ দিনের আধাবেলার পঁয়তাল্লি¬শ টাকা মজুরি হাতে পেয়ে প্রথমে সে আতিয়ারের ফলের দোকানে গিয়েও ছিলো। আতিয়ার যখন এক কেজি আপেলের দাম তার একবেলার উপার্জনের দ্বিগুণ হাঁকে তখন ভুলু মাথা হাতড়ে আর ফল-ফুলুরির অস্তিত্ব পায় না। আপেলের নাম আর তার দাম মাথায় ঝিমুতে দিয়ে সে চাল পট্টি, মাছ পট্টি অতিক্রম করে তরকারি পট্টিতে আসলে ঝিমানো শব্দ আবার প্রাণ পায়। ফলে মাছ তরকারির সাথে মৃত পথযাত্রী বুড়ো বাপের জন্য ফল হিসেবে শশা কিনে বাড়ি ফিরতে হয়।

-আলহামদুলিল্লাহ! মজনু শেখ হাজী রোমালে পাঁচশত টাকা দান করলো মসজিদ, ঈদগাহ আর আল্ল¬ার রাহে, আপনারা সামর্থ্য অনুযায়ী দান করেন। দান করেন মৃত মাতা-পিতা, আত্মীয়-স¡জনের নামে।
তখনো ভুলুর সামনে বারান্দায় শোয়া বাপ শশা খাচ্ছে, লালা ঝরাচ্ছে, হাঁফাচ্ছে। বাপের অসহনীয় কষ্ট সহ্যাতীত হলে ভুলু চোখ খুলে নিজের সামনে হাজী রুমাল পাতা দেখতে পায়। তখন-
-দান করুন। দান করুন দুনিয়া-আখেরাতের জন্য, মৃত মাতা-পিতা আত্মীয়-স্বজনের জন্য। বেহেস্তে …

মুহূর্ত মাত্র, ভুলুর অনুমতি ব্যতিরেকেই বামহাত পকেটে যায়, মুঠো হয়, বাইরে আসে তারপর হাজী রুমাল বরাবর আলগা হয়। সামনে থেকে রুমাল সরলে, কিসে কী হলো তা দেখতে গিয়ে ভুলু দেখে ডান-বামের ঝগড়া। সে দিব্যি দেখে ছেঁড়া ডান শূন্য বামকে ভেঙচি কাটছে।

নিজের পকেট শূন্য সে কারণে কিনা বোঝা গেল না তা। তবে মোনাজাতের দীর্ঘ সময়টা অন্তর হাতড়ে সেখান থেকে ভাবনাশূন্যতা ছাড়া আর কিছু উদ্ধার করতে পারে না সে। ভাবনা হাতড়ে ক্লান্ত কিংবা মৃত বাপের কথা মনে পড়ায় মন খারাপ, নতুবা হঠাৎ করেই ভুলু অতিরিক্ত নামাযী বনে গিয়েছে, অথবা এমন যে এটা ঈদে সিমাই সুজির প্রতি জন্মেছে আসক্তিহীনতা। খানিকটা সময় বসে থেকে অনেকটা সময় নিয়ে বৌয়ের খেজুর পাতার বোনা পাটি গুটিয়ে যখন সে উঠে দাঁড়ায় তখন ঈদগাহ বলতে গেলে প্রায় জনশূন্য।

-ধ্যাক কুরে চল্। মোটে যে উট্টিছনে, কী হুলো? সেমাই সুজি সব শেষ হলি তারপরে নোকের বাড়ি যাবো গু খাতি?

জুম্মানের এ কথায় ভুলু তাকায়। তার দৃষ্টি দৌঁড়–তে শুরু করলে সে প্রথমে ভাবলেশহীন দু’ছেলেকে ঈদগাহের গেটে দেখতে পায়। দ্বিতীয় রাউণ্ডের দৃষ্টিদৌঁড় অন্য স্থানে স্থির হলে সে কলারহীন পাঞ্জাবীর লম্বা গলাওয়ালা কয়েকজন তালবেএলেমকে হাজী রুমালের চারপাশে বসে পয়সা গুনতে দেখে।

অকস্মাৎই কুয়াশা নামে। অনেকবার চোখ রগড়ে হাজী রুমাল, লম্বা গলার তালবেএলেমদের দেখতে ব্যর্থ হলে ‘তাহলে সে কোথায়’? এ চিন্তা যখন মুক্ত হয়ে বনবন করে ওড়া শুরু করে তখনই বিশ্রী দুর্গন্ধটা নাকে ঢোকে। ফলে ভুলু নিশ্চিত হয়; সে যেখানেই থাকুক না কেন এখন সে খালপাড়ে আকরাম মোড়লের জমির উপরে।

This image has an empty alt attribute; its file name is 8418617.jpg

মিজানুর রহমান

সাতক্ষীরা জেলা, শ্যামনগর উপজেলা, নূরনগর গ্রাম মিজানুর রহমানের জন্মস্থান। জন্ম ১৯৬৬ আগস্ট ০৬। পিতা- ডি.এম. ইব্রাহিম খলিল (১৯৪১-২০১০) খ্যাত মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনীতিবিদ। মাতা ডি.এম. আমেনা খলিল (১৯৪৮) গৃহিণী। সরকারি কলেজের বাংলাভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক এ লেখক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল (বাংলাদেশের ছোটগল্পের বিষয় ও প্রকরণ ১৯৭১-১৯৯১), ও পিএইচডি (আবুল মনসুর আহমদের রচনায় সমাজচিন্তার স্বরূপ) ডিগ্রি নিয়েছেন। লেখক হিসেবে সৃজনশীল ও মননশীল উভয়ক্ষেত্রে তার অবাধ বিচরণ। মাঠ পর্যায়ের একজন সফল পুরাকীর্তি গবেষক হিসেবে তিনি নন্দিত হয়েছেন সকল মহলে। কয়েকখানি আকরগ্রন্থের লেখক ছাড়াও দেশ-বিদেশের খ্যাত জার্নালে তার প্রকাশিত গবেষণার সংখ্যা অর্ধশতাধিক। তার কথা সাহিত্যে আকাড়া বাস্তবতা মেধা-মনন শাণিত করার উৎকৃষ্ট উপাদান।

সফলতার স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন শ্রেষ্ঠ শ্রেণিশিক্ষক ও আবুল মনসুর আহমেদ গবেষণা পুরস্কার।

লেখকের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ
প্রতিধ্বনির আত্মচিৎকার (ছোটগল্প, ১৯৯৮, মুক্তধারা )
অনুবিদ্ধ মানচিত্র (ছোটগল্প, ২০০০, মুক্তধারা)
সাতক্ষীরার পুরাকীর্তি (গবেষণা, ২০০৮, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি)
আবুল মনসুর আহমদের চিন্তাধারা (গবেষণা,২০০৮, বাংলা একাডেমি)
তবিবুর রহমান : জীবন ও কর্ম (গবেষণা,২০০৮, গতিধারা)
সাতঘরিয়ার সাতকহন (ছোটগল্প, ২০১২, নওরোজ কিতাবিস্তান)
আবদুল ওহাব সিদ্দিকী : জীবন ও কর্ম (গবেষণা, ২০১৫, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ)
খুলনার পুরাকীর্তি (গবেষণা, ২০১৭, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ)

About S M Tuhin

দেখে আসুন

হেডস্যার আতঙ্ক : নেলী আফরিন

হেডস্যার আতঙ্ক নেলী আফরিন ০১. ‘কী আবদার! ইশকুলে যাবে না, উঁ-হ! রোজ রোজ এক অজুহাত …

73 কমেন্টস

  1. best india pharmacy: online shopping pharmacy india – reputable indian pharmacies

  2. top 10 pharmacies in india: canadian pharmacy india – buy prescription drugs from india

  3. https://mexicopharmacy.store/# buying prescription drugs in mexico online

  4. india pharmacy mail order: mail order pharmacy india – indianpharmacy com

  5. indian pharmacy paypal: buy medicines online in india – pharmacy website india

  6. pharmacy rx world canada international online pharmacy canada rx pharmacy

  7. Discover http://www.strongbody.uk for an exclusive selection of B2B wholesale healthcare products. Retailers can easily place orders, waiting a smooth manufacturing process. Closing the profitability gap, our robust brands, supported by healthcare media, simplify the selling process for retailers. All StrongBody products boast high quality, unique R&D, rigorous testing, and effective marketing. StrongBody is dedicated to helping you and your customers live longer, younger, and healthier lives.

  8. mexican border pharmacies shipping to usa: mexico pharmacy – pharmacies in mexico that ship to usa

  9. mexican rx online: mexican pharmacy online – purple pharmacy mexico price list

  10. https://indiapharmacy.site/# Online medicine home delivery

  11. https://wellbutrin.rest/# purchase wellbutrin online

  12. ventolin cost canada: buy Ventolin inhaler – buy ventolin over the counter

  13. I read this article completely regarding the resemblance of most recent and preceding technologies, it’s amazing article.

  14. Cel mai bun site pentru lucrari de licenta si locul unde poti gasii cel mai bun redactor specializat in redactare lucrare de licenta la comanda fara plagiat

  15. Best Diploma Courses In Kenya
    Mount Kenya University (MKU) is a Chartered MKU and ISO 9001:2015 Quality Management Systems certified University committed to offering holistic education. MKU has embraced the internationalization agenda of higher education. The University, a research institution dedicated to the generation, dissemination and preservation of knowledge; with 8 regional campuses and 6 Open, Distance and E-Learning (ODEL) Centres; is one of the most culturally diverse universities operating in East Africa and beyond. The University Main campus is located in Thika town, Kenya with other Campuses in Nairobi, Parklands, Mombasa, Nakuru, Eldoret, Meru, and Kigali, Rwanda. The University has ODeL Centres located in Malindi, Kisumu, Kitale, Kakamega, Kisii and Kericho and country offices in Kampala in Uganda, Bujumbura in Burundi, Hargeisa in Somaliland and Garowe in Puntland.
    MKU is a progressive, ground-breaking university that serves the needs of aspiring students and a devoted top-tier faculty who share a commitment to the promise of accessible education and the imperative of social justice and civic engagement-doing good and giving back. The University’s coupling of health sciences, liberal arts and research actualizes opportunities for personal enrichment, professional preparedness and scholarly advancement

  16. neurontin 400 mg price: buy gabapentin online – neurontin brand coupon

  17. http://gabapentin.life/# neurontin pills for sale

  18. wellbutrin 151: Wellbutrin online with insurance – buy generic wellbutrin

  19. paxlovid https://paxlovid.club/# paxlovid covid

  20. kantorbola
    Kantorbola adalah situs slot gacor terbaik di indonesia , kunjungi situs RTP kantor bola untuk mendapatkan informasi akurat slot dengan rtp diatas 95% . Kunjungi juga link alternatif kami di kantorbola77 dan kantorbola99

  21. Jagoslot adalah situs slot gacor terlengkap, terbesar & terpercaya yang menjadi situs slot online paling gacor di indonesia. Jago slot menyediakan semua permaina slot gacor dan judi online mudah menang seperti slot online, live casino, judi bola, togel online, tembak ikan, sabung ayam, arcade dll.

  22. https://clomid.club/# can i order cheap clomid for sale

  23. can you get generic clomid without insurance: Buy Clomid Online Without Prescription – cheap clomid now

  24. VPS SERVER
    Высокоскоростной доступ в Интернет: до 1000 Мбит/с
    Скорость подключения к Интернету — еще один важный фактор для успеха вашего проекта. Наши VPS/VDS-серверы, адаптированные как под Windows, так и под Linux, обеспечивают доступ в Интернет со скоростью до 1000 Мбит/с, что гарантирует быструю загрузку веб-страниц и высокую производительность онлайн-приложений на обеих операционных системах.

  25. Kantorbola merupakan agen judi online yang menyediakan beberapa macam permainan di antaranya slot gacor, livecasino, judi bola, poker, togel dan trade. kantor bola juga memiliki rtp tinggi 98% gampang menang

  26. https://clomid.club/# can you get clomid no prescription

  27. wellbutrin without a prescription: cost of wellbutrin in south africa – price of wellbutrin without insurance

  28. http://clomid.club/# cheap clomid for sale

  29. average cost of wellbutrin: purchase wellbutrin sr – wellbutrin canadian pharmacy

  30. Great beat ! I wish to apprentice while you amend your website,
    how can i subscribe for a blog site? The
    account aided me a acceptable deal. I had been a little bit acquainted of this
    your broadcast provided bright clear concept

  31. how to get wellbutrin in australia: Buy bupropion online Europe – wellbutrin 151

  32. п»їfarmacia online migliore: avanafil prezzo in farmacia – migliori farmacie online 2023

  33. farmacie online autorizzate elenco farmacia online miglior prezzo acquisto farmaci con ricetta

  34. http://kamagrait.club/# acquistare farmaci senza ricetta

  35. farmacie on line spedizione gratuita: Farmacie a milano che vendono cialis senza ricetta – farmacia online senza ricetta

  36. b52 club
    Tiêu đề: “B52 Club – Trải nghiệm Game Đánh Bài Trực Tuyến Tuyệt Vời”

    B52 Club là một cổng game phổ biến trong cộng đồng trực tuyến, đưa người chơi vào thế giới hấp dẫn với nhiều yếu tố quan trọng đã giúp trò chơi trở nên nổi tiếng và thu hút đông đảo người tham gia.

    1. Bảo mật và An toàn
    B52 Club đặt sự bảo mật và an toàn lên hàng đầu. Trang web đảm bảo bảo vệ thông tin người dùng, tiền tệ và dữ liệu cá nhân bằng cách sử dụng biện pháp bảo mật mạnh mẽ. Chứng chỉ SSL đảm bảo việc mã hóa thông tin, cùng với việc được cấp phép bởi các tổ chức uy tín, tạo nên một môi trường chơi game đáng tin cậy.

    2. Đa dạng về Trò chơi
    B52 Play nổi tiếng với sự đa dạng trong danh mục trò chơi. Người chơi có thể thưởng thức nhiều trò chơi đánh bài phổ biến như baccarat, blackjack, poker, và nhiều trò chơi đánh bài cá nhân khác. Điều này tạo ra sự đa dạng và hứng thú cho mọi người chơi.

    3. Hỗ trợ Khách hàng Chuyên Nghiệp
    B52 Club tự hào với đội ngũ hỗ trợ khách hàng chuyên nghiệp, tận tâm và hiệu quả. Người chơi có thể liên hệ thông qua các kênh như chat trực tuyến, email, điện thoại, hoặc mạng xã hội. Vấn đề kỹ thuật, tài khoản hay bất kỳ thắc mắc nào đều được giải quyết nhanh chóng.

    4. Phương Thức Thanh Toán An Toàn
    B52 Club cung cấp nhiều phương thức thanh toán để đảm bảo người chơi có thể dễ dàng nạp và rút tiền một cách an toàn và thuận tiện. Quy trình thanh toán được thiết kế để mang lại trải nghiệm đơn giản và hiệu quả cho người chơi.

    5. Chính Sách Thưởng và Ưu Đãi Hấp Dẫn
    Khi đánh giá một cổng game B52, chính sách thưởng và ưu đãi luôn được chú ý. B52 Club không chỉ mang đến những chính sách thưởng hấp dẫn mà còn cam kết đối xử công bằng và minh bạch đối với người chơi. Điều này giúp thu hút và giữ chân người chơi trên thương trường game đánh bài trực tuyến.

    Hướng Dẫn Tải và Cài Đặt
    Để tham gia vào B52 Club, người chơi có thể tải file APK cho hệ điều hành Android hoặc iOS theo hướng dẫn chi tiết trên trang web. Quy trình đơn giản và thuận tiện giúp người chơi nhanh chóng trải nghiệm trò chơi.

    Với những ưu điểm vượt trội như vậy, B52 Club không chỉ là nơi giải trí tuyệt vời mà còn là điểm đến lý tưởng cho những người yêu thích thách thức và may mắn.

  37. farmacia online miglior prezzo: farmacia online miglior prezzo – acquisto farmaci con ricetta

  38. kamagra senza ricetta in farmacia: sildenafil 100mg prezzo – pillole per erezioni fortissime

  39. If some one wants to be updated with most recent technologies after that he must be go
    to see this web page and be up to date all the time.

  40. acquistare farmaci senza ricetta: kamagra gel prezzo – comprare farmaci online all’estero

  41. farmacia online miglior prezzo: Farmacie che vendono Cialis senza ricetta – farmacie online affidabili

  42. migliori farmacie online 2023 farmacia online spedizione gratuita acquistare farmaci senza ricetta

  43. https://kamagrait.club/# farmacia online piГ№ conveniente

  44. comprare farmaci online all’estero: farmacia online migliore – comprare farmaci online con ricetta

  45. farmacia online miglior prezzo: avanafil prezzo – acquistare farmaci senza ricetta

  46. comprare farmaci online con ricetta: Farmacie a roma che vendono cialis senza ricetta – acquisto farmaci con ricetta

  47. farmacia online miglior prezzo: cialis generico consegna 48 ore – top farmacia online

  48. RG nhà cái
    In recent years, the landscape of digital entertainment and online gaming has expanded, with ‘nhà cái’ (betting houses or bookmakers) becoming a significant part. Among these, ‘nhà cái RG’ has emerged as a notable player. It’s essential to understand what these entities are and how they operate in the modern digital world.

    A ‘nhà cái’ essentially refers to an organization or an online platform that offers betting services. These can range from sports betting to other forms of wagering. The growth of internet connectivity and mobile technology has made these services more accessible than ever before.

    Among the myriad of options, ‘nhà cái RG’ has been mentioned frequently. It appears to be one of the numerous online betting platforms. The ‘RG’ could be an abbreviation or a part of the brand’s name. As with any online betting platform, it’s crucial for users to understand the terms, conditions, and the legalities involved in their country or region.

    The phrase ‘RG nhà cái’ could be interpreted as emphasizing the specific brand ‘RG’ within the broader category of bookmakers. This kind of focus suggests a discussion or analysis specific to that brand, possibly about its services, user experience, or its standing in the market.

    Finally, ‘Nhà cái Uy tín’ is a term that people often look for. ‘Uy tín’ translates to ‘reputable’ or ‘trustworthy.’ In the context of online betting, it’s a crucial aspect. Users typically seek platforms that are reliable, have transparent operations, and offer fair play. Trustworthiness also encompasses aspects like customer service, the security of transactions, and the protection of user data.

    In conclusion, understanding the dynamics of ‘nhà cái,’ such as ‘nhà cái RG,’ and the importance of ‘Uy tín’ is vital for anyone interested in or participating in online betting. It’s a world that offers entertainment and opportunities but also requires a high level of awareness and responsibility.

  49. comprare farmaci online con ricetta dove acquistare cialis online sicuro farmaci senza ricetta elenco

  50. farmaci senza ricetta elenco: kamagra gel prezzo – farmacie online autorizzate elenco

  51. https://avanafilit.icu/# farmacia online piГ№ conveniente

  52. viagra consegna in 24 ore pagamento alla consegna: alternativa al viagra senza ricetta in farmacia – farmacia senza ricetta recensioni

  53. I was recommended this blog through my cousin. I am now not certain whether this publish is written via him as nobody else realize such specific about my trouble.
    You are amazing! Thanks!

  54. farmacie online affidabili: farmacia online miglior prezzo – comprare farmaci online con ricetta

  55. top farmacia online: kamagra gel prezzo – farmacia online migliore

  56. viagra ordine telefonico: viagra prezzo farmacia – gel per erezione in farmacia

  57. comprare farmaci online con ricetta: farmacia online migliore – farmacia online senza ricetta

  58. migliori farmacie online 2023 Cialis senza ricetta comprare farmaci online all’estero

  59. acquisto farmaci con ricetta: Farmacie a roma che vendono cialis senza ricetta – farmaci senza ricetta elenco

  60. farmacia online piГ№ conveniente: Farmacie a milano che vendono cialis senza ricetta – п»їfarmacia online migliore

  61. http://tadalafilit.store/# farmacie on line spedizione gratuita

  62. top farmacia online: cialis prezzo – comprare farmaci online con ricetta

  63. farmacie online affidabili: kamagra gel prezzo – comprare farmaci online con ricetta

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *