নভেলা / ছোট উপন্যাস
ধুলো-মানুষের দেশ
মৌলীনাথ গোস্বামী

আদিল হুসেন। ১৯৯৫ সালে যেদিন তাকে ছেড়ে এলাম, তার বয়স তখন ৮ বছর…
সদ্য চাকরিতে ঢুকেছি। দিল্লিতে অফিস। রাজধানীতে পা রেখেছি মাসখানেক হয়েছে। প্রবল উত্তেজনা- নতুন জীবন! নতুন জগৎ! নতুন মানুষ! নতুন পরিবেশ!
আমাদের আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে এর আগে কেউ চাকরি নিয়ে হাওড়া-হুগলি-বর্ধমানের মায়া কাটিয়ে বাংলা ছাড়েনি। সময়… তার নিজের চলার খেয়ালে, চার দেওয়ালের ভেতর থেকে বাইরে টেনে এনে ফেলেছে আমায়- এক অনন্য যাত্রায়…
চাকরির প্রধান শর্ত ছিল ভ্রমণ; অবশ্যই কোম্পানির ব্যবসার হিতার্থে। সানন্দ-সম্মতি ছিল আমার। দিল্লি আসার পাঁচ-দিনের মাথায় আমায় যেতে হয়েছিল হিমাচল প্রদেশ– থাক,
সে বৃত্তান্ত এখানে নয়, অন্য কোনোদিন।
হঠাৎ আদেশ এলো দুল-হস্তি-জল-বিদ্যুৎ-প্রকল্পের হাল-হকিকৎ জেনে আসার জন্য রওনা দিতে হবে–
কোথায়? কিশ্তওয়ার।
সেটা কোনখানে? উত্তর এলো–
`জম্মু হয়ে যেতে হয়; রুট দেখে নাও!’
তখন গুগল্-ম্যাপের এতো রমরমা হয়নি। জম্মু-কাশ্মীরের একখানা মানচিত্র জোগাড় করা হলো। খুব মন দিয়ে পড়ে বোঝা গেল, জম্মু থেকে কাটরা হয়ে কিশ্তওয়ার যেতে হয়, উধমপুর আর ডোডার ওপর দিয়ে।
‘ডোডা’- নামটায় চোখ যেতেই বুক ছ্যাঁৎ করে উঠল! এই জায়গাটি আতঙ্কি-হামলার জন্য প্রায়শই খবরের শিরোনামে থাকে। উধমপুরও। রোমাঞ্চের শিহরণ খেলে গেল শরীরে… কিঞ্চিৎ ভয়ও জেঁকে বসল। মাতা বৈষ্ণোদেবীর কল্যাণে কাটরা নামটা জানতাম। মাতাজীই বোধহয় সাহস যোগালেন!
রুট নিয়ে খোঁজখবর করা হলো। প্রথমে দিল্লি থেকে জম্মু ট্রেনে। সেখান থেকে সড়কপথে কিশ্তওয়ার বাসে। এজেন্ট মারফত ট্রেনের টিকিটও এসে গেল। তারপর এক রাত্তিরে চেপে বসলাম ট্রেনে। চাপা উত্তেজনা আর অজানার আশঙ্কা নিয়ে…
সহযাত্রীরা সকলেই হিন্দিভাষী। প্যান্ট-শার্ট পরা। মহিলাদের পরনে শাড়ি। দিল্লির ছাপ সকলের মধ্যে। এই ক’মাস থেকে বুঝেছি দিল্লির সুর একটু চড়ায় বাঁধা। এখানে শীত তীব্র, গ্রীষ্মও তেমন। এখানকার আদি-বাসিন্দাদের কথা বলার ধরণ কর্কশ, সামগ্রিক মেজাজ রুক্ষ। কেমন এক উদ্ধত প্রকাশ… শব্দে, কর্মে, ব্যবহারে। বাংলার নরম জমিতে লালিত আমার বোধ প্রথম-প্রথম ধাক্কা খেত এঁদের চালচলনের উগ্রতায়। এঁরাও তো ভারতবর্ষেরই লোক!
অনেক রাত অবধি উচ্চগ্রামের হিন্দিভাষার মাঝে খাবি খেতে-খেতে ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন জম্মু-স্টেশনে যখন নামলাম, তখন বেশ বেলা হয়েছে। লক্ষ্য করলাম যে, আমায় নিয়ে সাকুল্যে চারজন মানুষ পা রেখেছে ওখানে। গোটা প্ল্যাটফর্ম শুনশান। বাদবাকি যারা আছেন তারা সকলেই উর্দিধারী। গম্ভীর মুখে টহল দিচ্ছেন এক-প্রান্ত থেকে আর এক-প্রান্ত। এই বুঝি আমায় পাকড়াও করে! আড়চোখে তাকিয়ে, ত্রস্ত পায়ে পাশ কাটিয়ে, বেরিয়ে এলাম স্টেশনের বাইরে।
রাস্তাঘাট কিছুই চিনি না। চেনার প্রয়োজন অবশ্য হয় না যেখানে অটো চলে। আমার হিন্দি যতদূর বিশ্বাসযোগ্য করা যায় ক’রে, অত্যন্ত বিনয়ের সাথে প্রশ্ন করলাম-
‘ভাইসাব, কিশ্তওয়ার যানা হ্যাঁয়। বাস কাঁহা সে মিলেগি?’
ভাইসাব জানালে, আমায় জম্মু বাস-স্ট্যান্ড যেতে হবে। চেপে বসলাম। চোখ রাখলাম আমার বাঁ-দিকে, অটো ছুটল সোজা। দ্রুত সরে যাওয়া দৃশ্যপট দেখতে দেখতে দুটো উপলব্ধি হল- দাড়ি-মণ্ডিত গালের সংখ্যা বাড়ছে, আর প্যান্ট-শার্টের দেশ ছেড়ে এসে পড়েছি পাঠান-স্যুটের রাজ্যে। এও এক ভারত!
উত্তর-ভারতে ওরা বলে ‘বাস-আড্ডা’। বাসেরা না দিলেও, মানুষের আড্ডার শেষ নেই। দাঁড়িয়ে, বসে, হাঁটতে-হাঁটতে… এ আড্ডায় মহিলার সংখ্যা বেশ কম এবং তারা শব্দহীন। হিন্দি কানেই আসছে না। যা আসছে, তা আমার বোধের বাইরে। কিন্তু এটা বেশ বুঝতে পারছি যে, যা উচ্চারিত হচ্ছে তা বেশ একটি শক্তপোক্ত ভাষা। দাড়িহীন-কণ্ঠনালী থেকেও যা বেরচ্ছে, তা বেশ জোরালো।
বেজায় বিশৃঙ্খলা চারিদিকে। ছোটাছুটি চলছে। সবাই আগে বাস ধরতে চায়, যদি ছেড়ে যায়! দূরের বাস কম যে! কেউ সন্ধে-রাত করে পৌঁছতে চায় না। সকলেই জানে যে, জানা রাস্তাই কখন কোন অজানা-পথে হাঁটা দেবে, তার কোন স্থির আশ্বাস নেই!
হট্টমেলার ভেতর একে তাকে জিজ্ঞেস করে, পেয়ে গেলাম আমার গন্তব্যের রথ। টিকিট কেটে কপাল ঠুকে উঠে পড়লাম। জানলার ধারে একটা জায়গাও হলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাস ভরে গেল সওয়ারিতে। একটুকরো জ্যান্ত পূর্ব-ভারত নিজের খোঁদলে ভরে উত্তর-ভারতের এক বাস চলল কিশ্তওয়ার।
গোটা বাসে আমিই যে একমাত্র বেমানান ব্যক্তি, সেটা আর বলে দিতে হল না। চোখে চশমা, ক্ষীণকায়, পরনে প্যান্ট-শার্ট; বাকি সবাই চশমাহীন, দীর্ঘদেহী, বলিষ্ঠ, ‘এক মুখ দাড়ি-গোঁফ’ আর পাঠান-স্যুট; সকলেই হাসে কম! বাঙালির দেবতা জম্মুতে কার্যকরী হবেন এই বিশ্বাসে ‘ঠাকুর ঠাকুর’ জপে রওনা দিলাম…
বাস চলতে থাকে। যাত্রী নামে, যাত্রী ওঠে। আমার আসন পাল্টায় না। বেখাপ্পার আড়ষ্টতা নিয়ে আমি জবুথবু বসে থাকি। একটা চাপা উত্তেজনা কাজ করে চলে ভেতরে। একটা উৎকণ্ঠা। কিছুতেই নিজের মনকে ‘আতঙ্কবাদ’ মুক্ত করতে পারছিলাম না! যেই কোনো চাপদাড়ি ওঠে, আমি তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকে জরিপ করি। আশঙ্কায় মন বলে ওঠে- ‘এই লোকটা নয়ত!’…
ফেলুদা থাকলে নির্ঘাত আমায় বলে উঠত– ‘তুই যা ভাবছিস তা নয় রে তোপসে!’
জামা-প্যান্টের নিজস্ব একটা ভাষা আছে, যা পড়ে একটি মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থান বেশ আন্দাজ করা যায়; পাঠান-স্যুট সে ব্যাপারে বেশ নিস্পৃহ। যারা উঠলেন বা নামলেন, পোশাক দেখে তাদের শ্রেণী বিচার করা যে অসম্ভব– সেটা বেশ বুঝলাম। যদিও ভাষা এক বর্ণও বোধগম্য হচ্ছিল না, তবু কথোপকথনের ধরণ শুনে ধারণা করলাম যে, এরা সকলেই মধ্যবিত্ত। খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। অনেকেই হয়ত নিম্ন-মধ্যবিত্ত।
মনে প্রশ্ন জাগল–
এখানকার সব মানুষ কি এমনই?
না কি এখানে পয়সাওয়ালা লোকজন বাসে সফর করেন না?
ক্রমে ক্রমে সন্দেহ, আশঙ্কা, ভয় যে থিতিয়ে যাচ্ছে, বেশ বুঝতে পারছিলাম। অন্য উপায়ও হয়তো ছিল না। প্রায় সাড়ে-সাত ঘণ্টার পথ। এতটা সময়ের জন্য এই বাসই আমার সাময়িক ঘর। সহযাত্রীরা সেই ঘরের সদস্য- আর যাই হোক বাড়ির লোকজনকে আতঙ্কবাদী ভেবে তো আর বসবাস করা যায় না!
মনকে বললাম– আমরা তো একই দেশের নাগরিক!
কই, আসানসোল বা দিল্লির বাসে চাপলে পাশের লোকটিকে নিয়ে এমন খেয়াল তো মাথায় আসে না!
বেশ স্বস্তি অনুভব করলাম…
বাটোট বলে একটা জায়গায় বাস থামলে নেমে পড়লাম। খিদে পেয়েছিল প্রচণ্ড। ভেবেছিলাম মধ্যাহ্নভোজের পর্বটা এখানেই সেরে নেবো, কিন্তু বিধি বাম! পেলাম না কিছু। অগত্যা একটা দোকান থেকে কয়েক প্যাকেট ক্রিম-বিস্কুট কিনলাম। দোকানের পাশেই মাটিতে আপেলের পাহাড় নিয়ে বসে দুটি লোক; আপেল বাছাই করে বাক্সবন্দি করা হচ্ছে। লাল রঙের নয়, হলুদ। রাস্তায় আলুর পাহাড় হামেশাই দেখে থাকি, কিন্তু এমনটি আগে দেখিনি,
বেশ চমক লাগল!
ফিরে আসতে গিয়ে দূরে চোখ আটকে গেল–
নয়নাভিরাম দৃশ্য…
পাটনিটপ! — পরে কখনও যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে উঠে বসলাম বাসে।
আমার পাশের সিট বেশ অনেকক্ষণ ধরে খালিই ছিল। একজন নেমে যাওয়ার পরে আর কেউ বসেনি। জল-বিস্কুট খেয়ে, একটু হাত-পা ছড়িয়ে বসে, শরীর এলিয়ে দিলাম। রাস্তা মসৃণ। বাসের দুলুনিতে চোখ লেগে গেল। নিজেকে একটু বেশিই ছড়িয়ে দিয়েছিলাম বোধহয়- বাঁ-পাশে চাপ অনুভব করলাম। ঘুমের চট্কা ভেঙে গেল। একটি মাঝবয়সী ছেলে বসার চেষ্টা করছে আমার পাশে। চাপদাড়ি। তড়িঘড়ি সরে জায়গা দিলাম তাকে। এক গাল হাসল সে।
বেশ উৎফুল্ল হলাম–
এখানে মানুষজন হাসে তাহলে!
‘ইয়ে কৌনসি জগাহ হ্যাঁয়?’
‘ডোডা।’
মুহূর্তে তরঙ্গ খেলে গেল শিরদাঁড়ায়! এই সেই জায়গা– যার এতো নাম দেখি খবরের কাগজে! আতঙ্কি-হামলার সাথে জড়িয়ে আছে এই নামটি– উদগ্রীব হয়ে ছেলেটিকে দেখছিলাম…
‘আপ কাঁহা সে?’ … বাসে এই প্রথম কেউ আমার সাথে কথা বলল, তাও হিন্দিতে!
‘কলকত্তা’– বলতে গিয়েও আটকে দিলাম।
‘দিল্লি’– আমার ছোট্ট জবাব।
‘কাঁহা যাওগে আপ?’
‘কিশ্তওয়ার।’
‘আপ দিল্লি সে হো?’
‘ফিলহাল। অসল মে ম্যায় বঙ্গাল সে হুঁ।’
চাপদাড়ি ‘বঙ্গাল’ জানে না। ওয়েস্ট বেঙ্গল-ও শোনেনি। আমায় দেখে হয়তো বা আন্দাজ করে নিল, ভারতবর্ষের আর এক ভূ-খণ্ডকে।
‘কিশ্তওয়ার কিসলিয়ে?’
‘প্রজেক্ট কে কাম সে।’
কথায় কথা বাড়ে, না বাড়ানোর ইচ্ছে আমারও ছিল না। এতক্ষণ মুখ-টিপে বসে থাকতে থাকতে চোয়াল ব্যথা করছিল। চুপ করে থাকারও তো একটা সীমা আছে! বাক্যালাপ চালু রাখলাম আমার সুকুমার হিন্দিতে…
ছেলেটি মিতভাষী। এ-কথা সে-কথায় জানা গেল সে স্নাতক। হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজছে কিন্তু পাচ্ছে না। সরকারি তো নয়ই, বেসরকারিও না, তাই টুকটাক কাজ করে সে। উপার্জন বলতে কিছুই হয় না। গ্রামে নিজেদের যেটুকু জমি আছে সেখানে অল্প বিস্তর চাষাবাদ হয়। সব মিলিয়ে কোনোমতে চলে যায়।
ও নেমে যাবে মাঝপথে। সেখানেই এক গ্রামে ওর সন্তানসম্ভবা দিদি থাকেন। ওই গ্রামেরই একজনের মুখে শুনেছে যে, ইদানিং দিদির শরীর না কী ভালো যাচ্ছে না। ছেলেটি দুশ্চিন্তায় আছে কারণ ওই গ্রামে ডাক্তার নেই। দেখা করতে যাচ্ছে সে। কাল হয়তো ফিরে আসবে। দিদির আর্থিক অবস্থা ভালো নয়, তাই একদিন ওর ওখানে থাকা মানে দিদিকে বিব্রত করা। ম্লান মুখে ছেলেটি জানাল আমায়। অবাক হলাম! এ যে আমাদের বাংলার কোন গ্রামেরই চিত্র। করুণ অর্থনীতির ও দিনগত যাপনের হুবহু একই প্রতিচ্ছবি! তারপরেই মনে হল, আমি এদের আলাদা কেন ভাবছি? এরা তো ভারতবর্ষেরই লোক! এই দেশেরই কোনো এক অংশের বাসিন্দা। অন্য দেশের তো নয়!
এটা সেটা বলতে-বলতে নিজের কৌতূহল মেটানোর জন্য ইচ্ছে করেই আতঙ্কবাদের প্রসঙ্গ এনে ফেললাম কথার ফাঁকে–
হামলা হয়– নিরুত্তাপ গলায় জানাল সে।
মাঝে-মাঝেই হয়। রাতের অন্ধকারে, দূরের পাহাড় থেকে তারা নেমে আসে। গ্রাম লক্ষ্য করে গুলি চলে। অনেকে মারা গেছে।
‘অওরত, মর্দ সব মরতে হ্যাঁয়!’ শান্ত গলায় বলে সে।
আমি চমকে উঠি ওর উত্তেজনাহীনতায়!
এখন ওদের গ্রামে আত্মরক্ষার জন্য বন্দুক দেওয়া হয়েছে। চালানোর জন্য প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু এইভাবে কতদিন– এই আতঙ্কের আবহে দিনাতিপাত? উত্তর নেই ওর কাছে! ও যে জানে না রাতের ছায়া-শত্রুর অত্যাধুনিক অস্ত্রের সামনে বন্দুক কতটা সফল হবে–
আদৌও হবে কি! হয়েছে কোনদিন!
‘মুঝে উতরনা হ্যাঁয়…’
এক রাশ চিন্তা নিয়ে নেমে গেল ছেলেটি। ও চলে যেতেই কেমন যেন অসহায় বোধ করলাম। যেন ওর ভরসাতেই এই পথে আসা। আবার সেই আশঙ্কার মেঘ ঘিরে ধরল আমায়। টের পেলাম সে এবার বেশ জাঁকিয়ে বসেছে!
লোক নামছে একজন দু’জন করে। উঠছে কম। বাস ফাঁকা হচ্ছে একটু-একটু। মনকে অন্যদিকে ব্যস্ত রাখার জন্য জানলায় মুখ রাখলাম–
চোখ জুড়িয়ে গেল আমার…
আমার রাস্তার সাথে-সাথে চলেছে পাহাড়ের শৃঙ্খলা। তার পাদদেশে নিজের মর্জিমাফিক এঁকেবেঁকে চলেছে একখানা নদী। স্কুলের ভূগোল বইয়ের পাতায় পড়া পঞ্চনদের একটি।
চেনাব; অন্য নাম চন্দ্রভাগা!
কী চমৎকার দৃশ্য! চোখের আরাম, মনেরও আরাম…
তখন দুপুরের রোদ মরে আসছে। পৃথিবীর গায়ে ঈষৎ লাল আভা। পাহাড়ের গায়ে খয়েরি রং ধরেছে। দূরে সারি দিয়ে লম্বা-লম্বা ঋজু দেবদারু আর পাইন গাছের কারওয়াঁ চলেছে আমার সঙ্গে সঙ্গে…
পাহাড়ের কোল ঘেঁষে পাক খেয়ে সাপের মতো ঘুরে যাচ্ছে সরু রাস্তা।
সব কিছু ফ্রেমে বাঁধানো ছবির মতন। তফাৎ একটাই, নিসর্গের ছবিতে কেউ সেনাবাহিনী আঁকে না। ওপর থেকে নীচের দিকে তাকাতে চোখে পড়ল, পাকদণ্ডীতে সেনাবাহিনীর ট্রাকের কাফিলা চলেছে পিঁপড়ের মতো। রাস্তা পাহারা দিচ্ছে ওরা। কোথাও জওয়ানরা ইতস্তত রুট-মার্চ করছে। আমাদের বাস থামিয়ে তল্লাশিও হল। অদ্ভুত ভাবে আমায় কেউ কিছু জিজ্ঞেস করল না, অথচ আমিই ওই বাসের ভেতর একমাত্র প্রবলভাবে বেমানান ব্যক্তি!
… এইসব দেখছি আর ভাবছি–
এতো সুন্দরের মাঝে এতো আতঙ্কের-বাতাবরণ চারদিকে!
অসহায় সৌন্দর্যকে ধ্বংস করেই বোধহয় মানুষ সবথেকে বেশি আনন্দ পায়–
আর একমাত্র মানুষই যে, এই ভয়টা তৈরি করতে পেরে খুশি হয় মনে-মনে খুব!
মন প্রশ্ন করল– কেন করে মানুষ এমন?
আমার কাছে উত্তর ছিল না… এখনও আছে কি!
…ভাবতে ভাবতে কখন অন্ধকার নেমে গেছে খেয়াল করিনি।
বাসের ভেতরে আলো জ্বলে উঠতেই সম্বিৎ ফিরে এল। বাল্বের হলুদ নিস্তেজ আলো। এই আলোয় আর কিছু না হোক, গা-ছমছমে অনুভূতি বুকের ভেতর আরও জাঁকিয়ে বসে। বাসে আমি আর কন্ডাক্টর ছাড়া তিন-চারজন যাত্রী। বাইরে কিছু দেখা যাচ্ছে না। হাওয়ায় ধূসর কালো আস্তরণ। চেনাব অদৃশ্য। কখনো-কখনো দূরে পাহাড়ের গায়ে দেখা যাচ্ছে একটা দুটো টিমটিমে আলো-
কারও বাড়ি?
হবেও বা।
মানুষ আছে ওখানে?
কে থাকে অমন বিচ্ছিন্ন একার নির্বাসনে!
এভাবেও থাকে মানুষ?
অবাক হলাম!
‘কিশ্তওয়ার আ গয়া জী!’… কন্ডাক্টর হাঁক পাড়লে-
এসে গেছি? অবশেষে!
ঘড়িতে তখন ৭:৩০। ধীরে-সুস্থে উঠে কোমরের খিল ছাড়ালাম। এতটা সময় একভাবে বসে থাকার অভ্যেস ছিল না। দাঁড়িয়ে বিধ্বস্ত, আড়ষ্ট শরীরটাকে টান করতে হলো। বাসের জানলাগুলো দিয়ে বাইরেটা এক ঝলক জরিপ করলাম- খুব বেশি আলোর আভাস পেলাম না।
একটু ঘুরিয়ে বাসটি থামল….
‘উতর যাইয়ে’– আদেশ এল!
ব্যাগ পিঠে নিয়ে বাস থেকে নেমে মাটিতে পা রাখতেই- ঠিক চোখের সামনে কী-ই যেন এক লহমায় ঝিকিয়ে উঠল– বেয়নেট!!
আমার সামনেই অন্ধকার একটা দোকান। বাইরে একটা বেঞ্চ। সওয়ারি তল্লাশি করার জন্য, সেখানে বসে আছে তিনজন বিশালাকায় পাগড়িধারী সর্দারজি। মিলিটারি। হাতে আধুনিক বন্দুক। বন্দুকের নলে লাগানো তীক্ষ্ণ ধারালো ইস্পাতের-ফলা- বেয়নেট! আলোয় ঝলসে উঠছে…
হাড় হিম হয়ে গেল আমার!
কোনোমতে যন্ত্রের মত পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে এলাম। কেবল মনে হচ্ছিল এই বুঝি ডাকল আমায়! এবারেও সন্দেহ-তালিকার ঊর্ধ্বে আমি। সেরকম কিছুই হল না। খানিক স্বস্তি পেলাম। মন বলল, অবিলম্বে একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই দরকার- খোঁজ নিতে হবে।
চারপাশ কেমন যেন অন্ধকার অন্ধকার। বড় রাস্তার ওপরেই নেমেছি, কিন্তু গোটা এলাকাটা একটু বেশি আবছায়া যেন। ছোট ছোট দোকানপাটও আছে, যার প্রায় সবই ঝাঁপ ফেলা। যেগুলো খোলা আছে, বাল্বের-আলো টিমটিম করছে। আলোর থেকে অন্ধকারই বেশি সেখানে। একটি-দু’টি লোক ইতস্তত দাঁড়িয়ে আছে; খদ্দের হয়ত। ভালো করে ঠাহর করে দেখলাম, রাস্তার ওপাশে বেশ কয়েকটা বাড়ি, কিন্তু কোনটাতেই এতটুকু আলো জ্বলছে না!
আর একটু এগোতেই পা প্রায় আটকে গেল–
ওদিক থেকে সারি দিয়ে আমার দিকে হেঁটে আসছে একদল সেনা। স্তব্ধ রাতে রাস্তার বুকে তাদের ভারী-বুটের শব্দ গমগম করছে!
সকলের হাতে….-আরে! এ.কে.৪৭ না?
চাঁদের আলোয় সরু-নলগুলো চকচক করছে- কম করে কুড়িটা!
ওরা মার্চ করে আসছে গোটা রাস্তা জুড়ে। অতি শিষ্টতা দেখিয়ে রাস্তা থেকে নেমে দাঁড়ালাম। আমার ছোট্ট বুকে ধড়াস ধড়াস আওয়াজ তুলে ওরা চলে গেল সামনে দিয়ে। এই প্রথম এত কাছ থেকে এতগুলো এ.কে.৪৭ দেখার সৌভাগ্য হল। বিস্মিত হলাম! ভীতও হলাম–
এখানে এতো মিলিটারি কেন?
কেনই বা এমন অন্ধকার?
কেমন জায়গা এই কিশ্তওয়ার!!
ক্লান্তিতে শরীর আর চলছে না তখন। একটা হোটেল চাইই চাই। একটু এগোতেই চোখে পড়ল আর একটা দোকান। বেশ কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে। এ.কে.৪৭ হাতে দু’জন সেনাও আছে। সর্দারজি! বিপদে পড়লে তো বিপদত্তারণেরই শরণ নিতে হয়!
‘ইঁয়হা হোটেল মিলেগা রাত গুজ়ারনে কে লিয়ে?’ –অনেক সাহস সঞ্চয় করে জিজ্ঞেস করলাম।
‘তুসি আগ্গে দেখো জি, মিল যায়েগা।’
দৃপ্ত উত্তর এল। শুনে তৃপ্ত হলাম। হাঁটার গতি বেড়ে গেল। একটু হাঁটার পর দেখলাম বাঁ-পাশে একটা বিশাল চওড়া জায়গা। ছোট-ছোট ঝুপড়ি মতো দোকান। আলো যথারীতি নেই বা কম। পাশে একটা বড় বাড়ি। দোতলা।
চোখ সয়ে যেতে বুঝলাম ওটা একটা মসজিদ হতে পারে। মন্দিরও। সামনে মাটিতে বসে উনুনে একটা লোক চপ জাতীয় কিছু ভাজছে। হোটেলের কথা জিজ্ঞেস করতে ওই বাড়িটার দিকেই ইশারা করল। চটপট এগোলাম।
একতলায় একটা লোক কড়াইয়ে কিছু একটা রাঁধছে। চারদিকে পেঁয়াজ রসুনের ঝাঁঝাল গন্ধ। খালিপেটে গা গুলিয়ে উঠল! একটা সিঁড়ি চোখে পড়ল, দোতলায় উঠে গেছে। হলুদ আলোর আভাস দেখা যাচ্ছে সিঁড়ির শেষে…
সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতেই সামনে পেলাম দেশলাই-বাক্সের মত একটা ঘর। ঘরজোড়া একটা চৌকি, আর জায়গা নেই। ছাদ থেকে লম্বা একটা তারের শেষ প্রান্তে ঝুলে একটা ঝুল-পড়া বাল্ব, আলো দেবার আপ্রাণ চেষ্টায় রত।
দু’টি লোক তার তলায় বসে তাস খেলছে। ভগ্নদূত দেখে তারা কিঞ্চিৎ অবাক!
‘রাত কে লিয়ে কমরা মিলেগা?’ আমার মরিয়া প্রশ্ন!
‘জ়রুর মিলেগা, আইয়ে আপ…’
টপাটপ খাট থেকে ঝাঁপ দিল ওরা। তারপর প্রচণ্ড তৎপরতার সঙ্গে যে ক’টি কামরা খুলে দিল, সেগুলো সবকটাই সেই দেশলাইয়ের-খোল। জানলা নেই। বাথরুম নেই। দরজা আছে, ছিটকিনি নেই! গোটা কামরার তিনটে দেওয়াল জুড়ে একটা চৌকি। আর যেটা আছে সেটা, একটা তীব্র দুর্গন্ধ- দোতলার সার্বজনীন প্রস্রাবাগার আর একতলার পেঁয়াজ-রসুনের ভয়ঙ্কর মিশ্রণের যোগফল!
নাঃ!
এভাবে রাত কাটানো অসম্ভব। সঙ্গে টাকাপয়সাও আছে। অচেনা জায়গা। এত মিলিটারি তবু নিজের নিরাপত্তা নিয়ে সংশয়ও দেখা দিল। নেমে এলাম তাড়াতাড়ি ওই দূষিত-পরিবেশ ছেড়ে!
সামনে যতদূর দৃষ্টি যায় শুধুই জনমানবহীন জমাট অন্ধকার…
যেখানে বাস থেকে নেমেছিলাম, সেদিকে যাওয়াই শ্রেয় মনে হল; অন্তত কিছু লোক আছে ওদিকে, উপায় একটা হবেই। উল্টোদিকে হাঁটা দিলাম। এবার এদিকে একটা দোকান পেলাম। যাওয়ার সময় খেয়াল করিনি। একটু বড়সড়। কিছুটা সাজানো। খিদে পেয়েছিল খুব। আবার এক-প্যাকেট বিস্কুট! আশ্চর্যরকমভাবে মিনারেল ওয়াটারের একটা বোতলও পেয়ে গেলাম! দোকানদারকে হোটেলের কথা জিজ্ঞেস করতে জানা গেল, এখানে তেমন ভালো কিছু থাকার জায়গা প্রায় নেই বললেই চলে। সামনের দিকে একটা আছে দোতলায়। জানালাম, ওটা দেখে এসেছি, থাকা যাবে না!
দোকানদার আর একটি মারাত্মক কথা শোনাল–
এখানে রাত ৮ টা থেকে কারফিউ জারি হয়ে যায়
সব আলো নিভে যায়
রাস্তায় বেরলে মিলিটারি পাকড়াও করে!–
… তারপর কী করে সেটা আর বলল না!
শোনার অবস্থায় আমিও ছিলাম না। ঘড়িতে তখন ঠিক ৮-টাই বাজে! এ-কোন অন্ধকারাচ্ছন্ন ভারতবর্ষে এসে পড়েছি আমি? আমার মাথায় রাতের অন্ধকার আকাশ ভেঙে পড়ছে…
-ভাবছি, রাত কাটাব কোথায়! খাব কী?
সব আশা যখন তলানিতে এসে ঠেকেছে, ঠিক তখনই, দোকানে একটা বাইক এসে দাঁড়াল। সাদা পাঞ্জাবি পরে একজন হন্তদন্ত হয়ে নেমে কী একটা কিনতে এলেন–
‘জলদি! কারফিউ লগ জায়গা…’
আমায় দেখে অচেনা মনে হওয়াতে আমার পরিচয় জানতে চাইলেন-
আমার অবস্থার কথা জানালাম। শুনে উনি যা বললেন তাতে আমি আকাশের চাঁদ পেলাম যেন!
‘আগে বাঁয়ে হায়াত-হোটেল হ্যাঁয়। কমরা মিল যায়েগা।
জলদি যাইয়ে, কারফিউ লগ গয়া!’
হায়াত! এখানে? লোকটা বলে কী? এ যে অবিশ্বাস্য!
দিল্লিতে হায়াত আছে জানি। পাঁচতারা-হোটেল। হায়াতের শাখা এইখানে! নিশ্চয়ই খুউব দামি হবে। পকেটে কুলোবে তো! আর বুঝি হোটেলে রাত কাটানো হল না!
ভাবতে ভাবতে দ্রুত পায়ে হাঁটা দিলাম।
ঠাহর করতে অসুবিধে হচ্ছিল যখন- তখনই আবার বিপদত্তারণ!-
‘উয়হো সামনে…’ –জানাল সে।
কিন্তু কোথায়?
বিশাল উঁচু পাঁচিল। তার মাঝে বিশাল লোহার ফটক। বন্ধ। অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে না ভালো। লাইটপোস্টের আবছা আলোয়, ফটকের গায়ে নীচের দিকে চোখে পড়ল, একটা ছোট দরজা। একটু ফাঁক করা।
মরিয়া হয়ে ঝুঁকে ঢুকে পড়লাম সেই গহ্বরে-
অন্ধকার যক্ষপুরীতে!
ঘন আঁধারে কিছুই দেখা যায় না। কোন দিকে যাব বুঝতে পারছি না।
হাতড়ে-হাতড়ে এক-পা, দু’-পা করে এগোচ্ছি। অন্ধকারে চোখ সয়ে গেলে বুঝলাম- একটা পেল্লায় তিনতলা বাড়ি। আয়তক্ষেত্রের তিনটি বাহুর আকারে। পাঁচিলের ওপারে অশরীরীর মত আবছায়ে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে রয়েছে!
-এটা হোটেল?
-এ কোন্ হায়াত!
-মন হায় হায় করে উঠল!
-এ আমি কোথায় ঢুকে পড়লাম!
ভয় হল… এই নিঝুমপুরীতে আমায় মেরে ফেললে অন্ধকারও টের পাবে না যে! একতলায় থামওয়ালা বারান্দা রয়েছে মনে হল। আন্দাজে এগোলাম সেদিকে। কাউকে তো পেতে হবে! লোকাল লোক যখন হদিস দিয়েছে, তখন নিশ্চয়ই কাউকে পাবো। বারান্দায় উঠে মনে হল, এবার কোন দিকে যাই? সামনে একটা ছোট্ট করিডোর–
ঢুকে দু-পা যেতেই চোখে পড়ল বাঁ-পাশে আলোর আভাস।
কামরায় দরজা নেই। বোঝা গেল, দাঁড়িয়েছি একটা লম্বা-ঘরের চৌকাঠে। একটু দূরে, ঘরের মাঝখানে, সেই একইভাবে একটা বাল্ব পেণ্ডুলামের মত ঝুলছে। কিঞ্চিৎ উজ্জ্বল আলো, তবে ঘরের আয়তনের অনুপাতে বেশ কম। ঘরের বেশিরভাগ অংশ আধো-অন্ধকারে ডুবে আছে। কেবল যেখানে বাল্বটি ঝুলে আছে সেই জায়গাটুকু আলোকিত।
দেখে রোমাঞ্চিত হলাম–
স্পটলাইটের নীচে কয়েকটি মানুষের জটলা!
একখানা উনুন জ্বলছে। ওপরে তাওয়া চাপানো। তার সামনে একটি মোড়ায় সোজা হয়ে বসে এক বৃদ্ধ। সাদা দাড়ি। মাথায় সাদা ফেজ়-টুপি। পরনে সাদা পাঠান-স্যুট। মানুষটি রুটি সেঁকছে। বৃদ্ধের সামান্য পেছনে উবু হয়ে দুটি ব্যস্ত যুবক। একজন আটা মাখছে, অন্যজন বেলছে; আর বৃদ্ধটির বাঁ-পাশে, গা-ঘেঁষে, একটি ছোট্ট ছেলে শতরঞ্চির ওপর রাখা খোলা খাতায় ডুবে আছে। কয়েকটি বই ইতস্তত ছড়ানো…
গরম রুটির গন্ধে ভরে উঠেছে ঘর…
আবছায়া ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করে, আমিও স্পটলাইটের তলায় এসে দাঁড়ালাম। এত ক্লান্তির মধ্যেও ভাবতে অবাক লাগছিল, সেই-ই আসানসোলের কতদূর থেকে এসে আমি, কেমন ঝপ্-করে এখানকার দৈনন্দিন জীবন যাপনের চিত্রের মধ্যে ঢুকে পড়েছি! আমার বুটের শব্দে চার-জোড়া হতচকিত কৌতূহলী চোখ চকিতে ঘুরে গেল আমার দিকে-
‘দিল্লি সে আয়া হুঁ, প্রজেক্ট কে কাম সে, রহনে কে লিয়ে কমরা চাহিয়ে-’
…এক নিঃশ্বাসে আমার আগমন-বার্তা জানিয়ে জনতার কৌতূহল মেটালাম।
যুবক দু’টি দাঁড়িয়ে পড়েছে ততক্ষণে–
‘ইন্তজ়াম হো যায়গা!’–একজন বলে উঠল।
শুনে মনে হল, এর থেকে সুখকর বাক্য পৃথিবীতে বোধহয় আর হয় না!
খাবার পাওয়া যাবে কী না জিজ্ঞেস করলাম না;
রুটি যখন হচ্ছে তখন রাতে না খেয়ে শুতে যাব না!
আমাকে নিয়ে ওঁদের তৎপরতা চোখে পড়ার মতো। সৌম্য বৃদ্ধ উঠে দাঁড়িয়েছেন। বাচ্চা ছেলেটিরও পড়াশোনায় আপাতত ইতি। সে শতরঞ্চি ভাঁজ করে, একটা বাজারের থলিতে সব বই-খাতা ভরে ফেলেছে। যুবক দু’টি চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল! বৃদ্ধ জানালেন যে, ওপরের ঘর পরিষ্কার নেই। বহুদিন হল কেউ আসে না, তাই আজ নীচের একটি ঘরে রাত কাটাতে হবে। কাল সকালে ছেলেরা ঘর খুলে গুছিয়ে রাখবে। আমার এত কষ্টের জন্য তিনি বেশ কুণ্ঠিত! আমার কোনও আপত্তি ছিল না। থাকার জায়গা যে পেয়েছি এই অনেক।
‘আইয়ে….’- একটি যুবকের উদয় হলো।
ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দা ধরে হেঁটে, একটা বাঁক নিয়ে দাঁড়ালাম এক তালা-লাগানো কামরার সামনে। অপর যুবক অপেক্ষায় ছিল সেখানে। তালা খুলতে খুলতে প্রশ্ন করল সে–
‘কব তক রহেঙ্গে?’
‘দো সে তিন-দিন…’– জানালাম আমি।
‘আপকে পাস জিতনা পয়সা হ্যাঁয়, আপ হমারে পাস রখ্ সকতে হ্যাঁয়। অনজান জগহ হ্যাঁয় ইয়ে। পয়সা লেকর ঘুমনা ঠিক নহি হোগা।’
যুবকের অতি শান্ত কণ্ঠস্বর আর এ হেন বক্তব্য, মনে একটা দারুণ খটকার বীজ বুনে দিল- টাকা পয়সা কেন চাইছে এরা! এদের আসল উদ্দেশ্য কী?
‘আপ হাত-মুহ ধো কে আইয়ে, খানা তইয়ার হো রাহা হ্যাঁয়…’ বলে ছেলেরা চলে গেল।
কামরাটি নেহাতই দরিদ্র, তবে বড়। আসবাব বলতে একটা বড় খাট আর প্রায় সোফার মতো দেখতে একটা ছোট চেয়ার– ব্যস! এটুকুই! আলো জ্বালালাম। সেইই হলুদ বাল্ব, তবে এখানে এর স্থান দেওয়ালে যথাযথ জায়গায় হয়েছে। দরজা বন্ধ করতে গিয়ে দেখি ছিটকিনি গায়েব! দরজা ভেতর থেকে আটকানোরও কোনো ব্যবস্থা নেই। অগত্যা, পাল্লা দুটো চেপে বন্ধ করে, ব্যাগ রেখে, ঘামে বিধ্বস্ত জামা-গেঞ্জি খুলে, বাথরুমের দিকে পা বাড়ালাম- শুধু চিন্তা, কতক্ষণে গায়ে জল ঢালব…. কী আশ্চর্য! বাথরুমটি নেহাত ছোট নয়! তার দুই প্রান্তে দু’টি বাল্ব। তাদের উজ্জ্বল আলোয় যা আলোকিত হয়ে উঠল, তা মোটেও দৃষ্টিনন্দন নয়–
সব ভাঙা…
বেসিনে বিশাল ফাটল!
কল বেঁকে আটকে আছে!
ফাটা বালতি!
হাতল ভাঙা মগ!
দেওয়ালে কাপড় ঝোলানোর হুক একটা পেরেকের ভরসায় ঝুলছে!
কমোড একটা আছে বটে, কিন্তু তার ভেতরে চাপ হয়ে বসে আছে অনেক কালের কোষ্ঠ-কাঠিন্য!
–সর্বোপরি কলে জল প্রায় নেই বললেই চলে, তিরতির করে পড়ছে!
মেঝেতে কাদা-ময়লার শুকনো আস্তরণ!
বুঝলাম, এটিই এখানকার সকলের গণ-বাথরুম!
হা ঈশ্বর!!!
এইসব এখন পরিষ্কার করতে হবে?
করতেই হবে! না হলে নিজে পরিষ্কার হব কী করে!
বমি পেল!!
নাক টিপে আর দাঁতে-দাঁত চেপে নিজের অবশিষ্ট শক্তি দিয়ে সব পরিস্কার করলাম, যতটা পারলাম! ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এসে বুঝলাম মাথা ঘুরছে। খিদেয়! দরজা বাইরে থেকে তালা মেরে এগোলাম রুটি-ঘরের দিকে।
বৃদ্ধ অপেক্ষা করছিলেন। জানালেন, রান্না সেরকম কিছু নেই। যা আছে, তাই খেতে হবে। আমি যে আসব, সেটা আগে থেকে জানা থাকলে, আয়োজন করা যেত। কাল থেকে ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া হবে। আমি যেন আজ রাতটুকু মানিয়ে নিই।
অনুভব করলাম,
এঁদের অনেক অভাব আছে সত্যিই, কিন্তু ভালোবাসার অভাব?- নাহ্! এতটুকু নেই কোত্থাও…
চারটে গরম রুটি, পেঁয়াজের একটা বড় টুকরো, গরম এক বাটি আলুর-ঝোল, আলু কম, ঝোল বেশি! বুঝলাম, এঁদের রাতের খাবারে ভাগ বসিয়েছি। একটা ছোট্ট স্টিলের থালা কোলে নিয়ে, হাসি হাসি মুখে, বাচ্চাটিও আমার পাশে খেতে বসে গেল–
একটা রুটি, একটু আলু, একটু পেঁয়াজ;
নিজেরই বিবেকে বাধছিল– কিন্তু পেট মরিয়া এবং নির্লজ্জ!
আরও দুটো রুটি পাওয়া গেল, গরম গরম। আহা… অমৃত! দুনিয়ার সেরা খাবার খেয়ে উঠলাম যেন! পরক্ষণেই মন বলল- এই-ই এদের প্রতিদিনের খাবার? এতো বড় হোটেল, তবু এতো দারিদ্র!
তবুও বৃদ্ধের মুখে কেমন কোমল প্রশান্তি।
শিশুটির মুখে অমলিন হাসি।
নদীর মতই প্রবাহশীল মানুষ যেন এঁরা…
চোখ টেনে ধরছে ঘুম। শীতও করছে। এদিকটায় এখনও একটু ঠাণ্ডা আছে। ছেলেগুলো আমায় এগিয়ে দিতে ঘর অবধি এল। বললাম, কলে জল আসছে না ভালো। ওরা জানাল, পাইপ ফেটে গেছে বাইরে, কাল সকালে ঠিক করে দেবে; তাছাড়া কাল ওপরের ঘরে ব্যবস্থা হবে।
এটা সেটা বলতে বলতে আবার সেই কথা–
‘ব্যাংক সমঝকে আপ পয়সা হমারে পাস রখ্ সকতে হ্যাঁয়।’
আমায় ভীষণ বিচলিত করল। বেশ দুশ্চিন্তা চেপে বসল মাথায়। এদের অভিসন্ধি কী?
ঘরে ঢুকে খেয়াল হল, দরজায় তো ছিটকিনি নেই, তায় আবার ওই ছেলেগুলোর অমন অদ্ভুত কথা! সাবধানের মার নেই! শব্দ না করে চেয়ারটা আস্তে আস্তে ঠেলে দরজায় চেপে দিলাম, অন্তত কেউ ঢুকতে গেলে শব্দ তো হবে– তবে শরীরে যা ক্লান্তি, ঘুম ভাঙলে হয়!
আজকের সারাদিনের যাত্রাপথে কত বিচিত্র অভিজ্ঞতা হলো।
কতো কী দেখলাম, জানলাম।
ভাবতে ভাবতে ঘুম এসে গেল…
ভূস্বর্গের ভোর কেমন দেখতে, জানা হলো না। চোখ খুলতেই স্কাইলাইট দিয়ে ঝকঝকে আলো আর নীল আকাশ দর্শন দিল। বেশ বেলা হয়ে গেছে। বেরতে হবে- আমায় যে দুলহস্তি-জল-বিদ্যুৎ-প্রকল্পে যেতে হবে! চট্ করে দাঁত মেজে, দরজার গা থেকে চেয়ার সরিয়ে, বেরিয়ে এলাম বাইরে চায়ের সন্ধানে। দরজায় দাঁড়াতেই সোজা চোখে পড়ল গতরাতের সেইই লোহার ফটক। বারান্দা টপকে নেমে এলাম সামনে। অনেকটা ফাঁকা চত্বর, পেরলেই ফটক। ওটার দিকে পিছন ফিরে দাঁড়ালাম। দিনের আলোয় বোঝা গেল, হোটেলটি বেশ বড়। এক সময় রং করা হয়েছিল। এখানে বাতাসে দূষণ নেই, তাই রং-টা এখনও টিকে আছে। তিনদিকে টানা বারান্দার গায়ে-গায়ে অনেক কামরা। সব বন্ধ। ধুলোর হালকা-স্তর জানলা দরজার গায়ে…
তার মানে দীর্ঘসময় ধরে বন্ধ আছে এগুলো। নীচে আমার ঘরটির গায়ে বড় বড় করে লেখা–
‘হায়াত। হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্ট।’
আমার ডান পাশের বারান্দা থেকে লাফ দিয়ে নামল গতরাতের বাচ্চা ছেলেটি। পরণে, জলপাই-রঙা পাঠান-স্যুট। মাথায় জাল-কাটা হলদে ফেজ় টুপি। অসম্ভব সাদা গায়ের-রং। ঠোঁট দু’টি গোলাপি। চোখের মণি ধূসর। মুখে একগাল হাসি–
‘চায়ে পিয়োগে?’– লজ্জা মেশা হাসি নিয়ে প্রশ্ন করল আমায়।
‘নাম ক্যায়া হ্যাঁয় তুমহারা?’– আমি প্রশ্ন করলাম।
ছটফটে গলায় চটপট জবাব এল- ‘আদিল হুসেন।’
…বলেই এক দৌড়ে রুটি-ঘরের ভেতর গায়েব! আমি ওর কাণ্ড দেখছি। মজা লাগছে। হঠাৎ দেখি পা টিপে-টিপে বেরিয়ে আসছে। হাতে একটা স্টিলের গ্লাস। বেশ ধোঁয়া উঠছে। খুব সাবধানে পা ফেলছে, যাতে পড়ে না যায়। বুঝলাম চা আনছে। এত গরম চা ঐটুকু কচি হাতে কেমন করে আনছে! ওর কষ্ট হচ্ছে না! তাড়াতাড়ি এগিয়ে হাত থেকে গ্লাসটা নিলাম। দেখি হাতের তালু টকটকে লাল হয়ে গেছে–
আদিল আমার দিকে তাকিয়ে তখনও লজ্জা-লজ্জা মুখ করে হাসছে… !!
ছেলেদুটিও বেরিয়ে এসেছে আমার গলা পেয়ে। দিনের আলোয় ওদের প্রথম দেখলাম। প্রশান্ত মুখ। হাসিখুশি। নাস্তা করবো কি না জিজ্ঞেস করল আমায়। বললাম, করবো না; এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। রাস্তায় কিছু খেয়ে নেবো। কিন্তু যাব কী করে? গাড়ি চাই তো! ভাড়ায় গাড়ি পাওয়া মুশকিল ওরা জানাল, কিন্তু বলল, আগে গেলে একটা স্টুডিও পড়বে। স্টুডিওর মালিকের গাড়ি আছে। সে ভাড়া দেয়। ওখানে গিয়ে খোঁজ করতে হবে। আরও খোঁজ নিয়ে জানলাম, প্রজেক্ট যেতে প্রায় পৌনে-একঘণ্টা সময় লাগবে, তাই দেরি না করে, চট্ করে তৈরি হয়ে, হাঁটা দিলাম স্টুডিওর খোঁজে।
পেলাম। স্টুডিওটি দোতলায়। সরু সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেলাম। বিশাল একটা ঘর। কালো-নীল পর্দা টাঙানো। একটা দেয়ালে চড়া-রঙে আঁকা নিসর্গ। সেখানে বরফ, গনগনে সূর্য, নদী, সাঁকো, পাখি, ফুল সব আছে! কয়েকটা বড় পোর্ট্রেইট, অনেকটা সিনেমার পোস্টারের ধাঁচে, দেয়ালে ঠেকা দিয়ে রাখা। একটা টেবিল- তাতে অনেক মোটা মোটা তুলি, গোলা রঙের বাটি ছড়ানো, কিন্তু কেউ নেই!
গলা খাঁকাড়ি দিয়ে একটু জোরেই বললাম- ‘কোই হ্যাঁয়?’
কালো পর্দার ওপার থেকে বেরিয়ে এল খয়েরি লোক।
নাঃ, পাঠান-স্যুট পরে নয়! প্যান্ট, হাফহাতা শার্ট। শার্টের শেষের বোতামগুলো ভুঁড়ির আগ্রাসনে পরাজিত!
‘ক্যায়া চাহিয়ে?’ …দানাদার গলায় প্রশ্ন এলো–
‘প্রজেক্ট জানা হ্যাঁয়। হায়াতওয়ালোঁনে ভেজা আপকে পাস। ওয়হিঁ ঠহরা হুঁ। গাড়ি চাহিয়ে।’
এ কী কলকত্তা না দিল্লি- যে গাড়ি চাইলেই হুট্ করে দশখানা দাঁড়িয়ে যাবে! গাড়ি আছে কিন্তু কাছে নেই। গাড়ি আসছে। দেরি হবে, জানাল স্টুডিওর মালিক। অগত্যা বসলাম। ওর স্টুডিওর খদ্দের নেই, আমার গাড়ির পাত্তা নেই! সময় কাটে না, তাই জড়তা কাটিয়ে আলাপচারিতায় মন দিলাম। মানুষটির নাম ফৈয়াজ। দিলখোলা সহজ মানুষ। আপন হয়ে যান। আপন করে নেন; এতোটাই আপন যে স্টুডিও বন্ধ করে, নিজে গাড়ি চালিয়ে, আমায় নিয়ে চলে গেলেন জল-বিদ্যুৎ-প্রকল্পে।
এমন মানুষ হয়?
এতো অল্প সময়ে এতো কাছে টেনে নিতে পারার মানুষ আছে এখানে, যেখানে এ.কে.৪৭ শাসন করে!!
ফৈয়াজ় ভাইয়ের গাড়ি করে চলেছি দুল-হস্তি-প্রকল্পের উদ্দেশ্যে। কিশ্তওয়ারের প্রকৃতি বড় সুন্দর। স্নিগ্ধ। চেনাবের কোলে গড়ে ওঠা জনপদ। চিনার, দেবদারু, পাইনে মোড়া সবুজের দেশ। কিশ্তওয়ারকে ঘিরে চেনাবের শরীর ঘেঁষে উঠে গেছে যে পাহাড়ের সারি, তারাও সবুজ। দূরে… দিগন্তে তাকালে পাহাড়ের স্তর দেখা যায়। একটার পর একটা। তারপরে আর একটা। তাদের সবুজ রং গাঢ়-সবুজ থেকে হালকা হতে হতে একসময় আকাশে মেঘের মাঝে হারিয়ে যায়…
রাস্তা মসৃণ। মনোরম আবহাওয়া। দৃষ্টিনন্দন পরিবেশ। কেবল তাল কাটছে রাস্তার বাঁকে-বাঁকে বালির বস্তা দিয়ে বানানো দেওয়ালের পেছন থেকে বেরিয়ে থাকা জোয়ানের হেলমেট পরা সন্দিগ্ধ মুখ আর এ.কে.৪৭-এর নল। এরা পাথরের মতো। অবিচল। এদের চোখের মণি নড়ে শুধু, কথা বলে না! অতন্দ্র প্রহরা! গাড়িতে কাশ্মীরি ভাষার গান চলছে তারস্বরে। ফৈয়াজ় ভাইও গুনগুন করছে। আমি চোখ আর মন রেখেছি রাস্তায়।
একসময় এসে পড়লাম প্রকল্প এলাকায়। দুটি গ্রাম দুল এবং হস্তি ঘিরে এই প্রজেক্ট। চেনাবের একটি শাখা নদী- চন্দ্রার জল কাজে লাগিয়ে এই জল-বিদ্যুৎ-উৎপাদন-প্রকল্প। ১৯৯২ সালে বন্ধ হয়ে যায়। অন্যান্য অনেক কারণ ছিল, তবে প্রধান কারণ ছিল ক্রমশ বেড়ে ওঠা জঙ্গী-কার্যকলাপ। নিরাপত্তার অভাব হেতু যে ফরাসী কোম্পানি মূল কাজটি করছিল, তারা পাত্তাড়ি গুটিয়ে ফিরে যায়। সেই থেকে কাজ থমকে- ফৈয়াজ় ভাই জানাল আমায়। প্রজেক্ট এলাকায় গিয়ে তার প্রমাণ পেলাম। একটা খণ্ডহরে এসে পড়েছি যেন। সব শুনশান। সব অফিসঘর খালি। কর্মীদের থাকার ব্যারাক খালি। কিছু শ্রমিক অবশ্য আছে। গ্রামের লোক, লোকাল ঠিকাদারের হয়ে কাজ করে। যে সব বড়-বড় যন্ত্র, ক্রেন, পাহাড় কাটার মেশিন, ডোজ়ার সাইটে পড়ে আছে, সেগুলোর দেখভাল করে। পরিত্যক্ত বাতাবরণ চারদিকে।
অনেকক্ষণ ছিলাম। বিশেষ সুরাহা হলো না। কবে কাজ শুরু হবে, কারা করবে, কোন কোম্পানি- কিছু তথ্যই তেমন পাওয়া গেল না। কেউ মুখ খুলতে চাইছে না মনে হল। কিন্তু কেন? জানা গেল, কে এক সাইট-ম্যানেজার আসবে একদিন পরে, তার কাছ থেকে সব খবর পাওয়া যেতে পারে; তবে এটুকু বেশ বুঝলাম, আমার কোম্পানি আমার এই যাত্রার পেছনে যত টাকা খরচ করেছে, সব আদতে চেনাবের গর্ভেই যাবে!
একটু মুষড়েই পড়েছিলাম আমার উদ্দেশ্য ব্যর্থ হওয়ায়। ফৈয়াজ় ভাই আন্দাজ করেছিল। আজব মানুষ! ফিরে আসার সময় ছবির মতো সুন্দর নরম সবুজ ঘাসে-মাখা এক মাঠের পাশে গাড়ি দাঁড় করাল। তারপর গাড়ির ভেতর থেকে বিশাল শতরঞ্চি বের করে পেতে দিল একটা বড় গাছের তলায়–
‘আইয়ে। ইয়ে চৌগান হ্যায়। আরাম কিজিয়ে। কাম-ধন্ধা তো চলতা রহেগা জী।’
সত্যিই আরাম। চোখের, দেহের, মনের। গাছের নীচে ঠাণ্ডা ছায়া। যতদূর চোখ যায় দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ। মাঠে বড় বড় ভেড়া চরছে। গায়ে তুলোর মত সাদা লোম। কিছু দুধেল গরু ঘাস চিবুচ্ছে। হাওয়ায় পাখি খেলছে এলোমেলো… মাটি থেকে উঠে দাঁড়িয়ে নীল আকাশের গায়ে কড়া নাড়ছে দূরের পীরপঞ্জল পাহাড়। লম্বা লম্বা বাহারি চিনার গাছের সারি। বাচ্চারা খেলছে মাঠে। মৃদুমন্দ শীতল বাতাস বইছে…
শতরঞ্চির ওপর শুয়ে আছি আমি আর ফৈয়াজ় ভাই…
মানুষটা যেন কতো দিনের চেনা! কতো কাছের!
ধন্য দেশ আমার! মানুষকে ভয়ও দেখায়, আবার কাছেও টেনে নেয়।
সব কিছু জুড়িয়ে যাচ্ছে আমার…
উঠতে ইচ্ছে করছিল না। তখন প্রায় সাড়ে-এগারোটা বাজে। সকালের নাস্তা করা হয়নি। পেটে ছুঁচোয় ডন দিচ্ছে।
‘চলিয়ে, আপকো কিশ্তওয়ার ঘুমাতে হ্যাঁয়’…
উঠে পড়ল ফৈয়াজ নামের মানুষটা। এতো সজ্জন মানুষকে না বলতে পারলাম না। একটু গিয়েই গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল।
‘ইয়ে হ্যাঁয় শাহ্-আসরারউদ্দিন কা দরগা। বহৎ মহ্শুর।’
নেমে পড়ল ফৈয়াজ ভাই। আমিও। দেব-দ্বিজে তেমন ভক্তি আমার কোনকালেই ছিল না, তায় আবার অন্য ধর্মের! প্রবল অনিচ্ছাসত্ত্বেও ওর পিছু নিলাম। ফৈয়াজ় ভাই ইতিমধ্যে রুমাল বের করে মাথায় পরে ফেলেছে। আমিও অনুসরণ করলাম। বেশ সুদৃশ্য দরগা। ছিমছাম কারুকার্য। অবধারিতভাবে সবুজ রঙের আধিক্য বেশি। ভেতরটা সাজানো এবং পরিষ্কার। ভেতরে শাহ্-আসরার-এর কবর বা মাজার।
ফৈয়াজ ভাই দেখলাম হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছে ওদের প্রার্থনার রীতি অনুযায়ী। এটা আর অনুসরণ করতে পারলাম না। করলে বাড়াবাড়ি হতো,কিন্তু ভক্তি বলে-কয়ে আসে না, ভেতর থেকে জাগে। আমায় অবাক করে আমারও জাগল!- হাত-দু’টো নিজে থেকেই নমস্কারের ভঙ্গিতে এসে স্থির হয়ে গেল বুকের ধুকপুকের কাছে। কেমন একটা আছন্ন করা অনুভূতি। গভীর প্রশান্তিতে মন ভরে গেল। ওদের আল্লাহ্ কি আমায় কৃপা করলেন! নিশ্চয়ই করলেন, নইলে এতো ভালোলাগা শরীরের ভেতর থেকে উঠে এলো কী করে! উপলব্ধি হলো, মন্দির বা মসজিদ বাতুলতা মাত্র!- অন্তরের প্রেমই শেষ কথা…
পেট চিরকাল ভক্তিভাবে অন্তরায়। বড্ড খিদে পেয়েছিল। পরশুদিন সকালে আবার গাড়ি নেব জানিয়ে ফৈয়াজ় ভাইকে স্টুডিওয় ছেড়ে ফিরে এলাম হোটেল হায়াতে। ফটকের আওয়াজ পেয়ে ছেলেরা বেরিয়ে এল। আমায় দেখে হাসিমুখে অভ্যর্থনা করল তারা। আমার কাজ কেমন হল জানতে চাইল। সবিস্তারে সারা সকালের খবর নিয়ে আমায় জানাল যে, দোতলায় ঘর খুলে দেওয়া হয়েছে। আমি যেন ওপরে চলে যাই। আমার ব্যাগ ওরা পৌঁছে দেবে।
‘চলিয়ে, কমরা দিখাতা হুঁ…’
বলল ছোট্ট আদিল। চোখে খুশির আভাস। ওর চুল ঘেঁটে দিতেই লজ্জা পেয়ে গেল। ব্যস্তবাগীশের মতো চাবি নিয়ে চলল ওপরতলায়। পেছন পেছন আমি।
কামরা নেহাত মন্দ নয়। বড় ঘর। বড় খাট। নরম লেপ। দু’টো সোফার চেয়ার, টেবিল- কিন্তু সবার গায়েই দীর্ঘদিনের অবহেলার ছাপ। লেপে ধুলোর গন্ধ। বোঝাই গেল, ব্যবহার হয় না। টিভিও একটা আছে--
‘নহি চলেগা জী…’
হাসতে হাসতে বলল আদিল!
বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে, ঠোঁটে সেইই হাসি ঝুলিয়ে আদিল জানালে–
‘নল মে পানি হ্যাঁয়।’
অবাক হলাম! ওইটুকু ছেলে কেমন খেয়াল রেখেছে!
একটুক্ষণ খুটখাট করে চলে গেল সে। ছেলেটা দু’দণ্ড স্থির হয়ে বসে না। আমিও স্নানে ঢুকলাম। স্নান করে, তাজা হয়ে, নেমে এলাম নীচে। রুটি-ঘরে। আদিলকে দেখতে পেলাম না। যুবকদ্বয় রান্নায় ব্যস্ত। তদারকিতে ব্যস্ত বৃদ্ধটি। আমায় দেখে একগাল হাসলেন। কুশল জিজ্ঞেস করলেন। কম কথার মানুষ, কিন্তু প্রবল স্নেহপ্রবণ… ওঁর মুখমণ্ডল সেকথাই বলে দেয় যে!
ভাত, ডাল আর ডিম-আলুর ঝোল রান্না হচ্ছে। মুরগি সর্বত্রই ডিম পাড়ে, তাই ডিমটা যদিও বা কিশ্তয়ারের, আলুগুলো হুগলির হলেও আশ্চর্য হবো না! পেঁয়াজ রসুনের যা খুশবু হাওয়ায় ভাসছে, মনে হচ্ছে যেন মাংস বসানো হয়েছে।
জানলাম রাতে চিকেন হবে, যদি আমি খেতে চাই।
‘বানাও বানাও…’ খুব উৎসাহ দিলাম আমি! ওরাও দেখলাম খুশি হল।
দুপুরের খাওয়াটা নেহাত মন্দ হোল না। আমি আর আদিল একসাথেই খেলাম।
ভূস্বর্গেও ভাতঘুম আসে। ওপরে নিজের ঘরে ঢুকে খাটে আধশোয়া হয়েছি; ভাবছি আজকের সকালের সফরের কথা… এমন সময় বারান্দার দিকের খোলা জানলা দিয়ে বেড়ালের মতো টুপ্ করে লাফিয়ে ঘরে ঢুকলেন শ্রীমান আদিল। ঢুকেই খাটে উঠে লেপের তলায় পা-দু’টো চালান করে দিলে।
‘ক্যায়া করোগে অভি?’- বাচ্চাটির অকপট প্রশ্ন ।
‘সোনা হ্যায়। নিন্দ আ রহি হ্যাঁয়’- আমার জবাব।
‘রাত কো নিন্দ নহি আয়েগি’
দুপুরের ঘুমে তার বিপুল আপত্তি। ওর কথার ধরণে মজা পাই।
‘তুম পঢ়হাই করতে হো?’
‘হাঁ’
‘কৌন সে ক্লাস মে?’
‘এক’
‘ইতনা বড়া লড়কা, ফিরভি এক-ক্লাস!’
‘হমারে য়াঁহা সব দের সে পঢ়তে হ্যাঁ য়’… সপ্রতিভ জবাব আদিলের।
‘এ, বি, সি, ডি পঢ়তে হো স্কুলমে?’
‘নহি। ম্যায় তো আলিফ পঢ়তা হুঁ’
‘ম্যায় তো এ, বি, সি, ডি পঢ়তা থা স্কুলমে”
-“তুমহারা- এ, মেরা- আলিফ’… আদিলের সহজ উত্তর।
‘উয়ো জো সফেদ দাড়ি-বাবা হ্যাঁয় না, ক্যায়া লগতা হ্যাঁয় তুমহারা?’
‘নানা’
‘তুমহারা পিতাজী কাঁহা হ্যাঁয়? আম্মিজী?’
‘নহি হ্যাঁয়। মর গয়া!’
… ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে আদিল–
কেমন একটা শূন্যতার প্রলেপ ওর মুখে!
আমারই মনটা কেমন তেতো হয়ে গেল। ধাক্কাটা বেশ জোরেই লেগেছিল। আচমকা এরকম একটা খবরের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না! আদর করার জন্য মা নেই! আবদার মেটাবার জন্য বাবা নেই! এইটুকু একটা ছেলে… তবু কেমন হাসতে হাসতে বড় হয়ে যাচ্ছে! একা একাই স্বাবলম্বী হয়ে উঠছে। কতটুকু শৈশব আছে ওর?
খুব কষ্ট হল ওর জন্য। মায়া হল। আহা রে… একরত্তি দুধের শিশুটা!
পরে বৃদ্ধের মুখে শুনেছি… আদিল ওঁর মেয়ের একমাত্র সন্তান। বেশ কিছু বছর আগের ঘটনা। আদিল তখন আরও ছোট। সেইবার আদিলের মা আর বাবা, ছোট্ট আদিলকে তার দাদুর কাছে রেখে, এক আত্মীয়ের বাড়ির অনুষ্ঠানে যায়– সেইই শেষ যাওয়া… ওরা আর ফেরেনি! আতঙ্কবাদীরা সেই রাতে ওই গ্রামের ওপর হামলা চালায়। অনেক মানুষ মারা যায়। তার মধ্যে আদিলের মা আর বাবাও ছিল। ছোট্ট আদিল বেঁচে থাকে শুধু। সেই থেকে এই নানাই ওর মা, বাবা, ভাই, বোন- সব, সবকিছু…
‘জব তক সাঁস রহেগা…!’
বৃদ্ধটির শান্ত উক্তি।
আমার মন বলল… আর কতদিন, কতদিন!!
কেমন অদ্ভুত লাগছিল। এত বয়সে এই প্রৌঢ়টিকে কতরকম চরিত্রে অভিনয় করতে হচ্ছে! শুধু মাত্র ওই একরত্তি নাতিটির জন্য… যার হয়ত নিজের বাবা-মাকে আর মনেই পড়ে না! পড়ার কথাও নয়। বাবা-মা কী, কেমন- সে জানলোই না কোনোদিন! জানবেও না এই জীবনে!
‘উয়ো উস্ পাহাড়িয়োঁ কে পিছে সে আতা হ্যাঁয়। রাত কে অন্ধেরে মে…’
রক্তাক্ত গোধূলির মাঝে, ছায়াময়-আততায়ীর মতো দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়ের দিকে আঙুল দেখাল যুবকদ্বয়…
কথায় কথায় ওরা জানাল যে, একসময় হোটেলে অনেক মানুষ আসতো, থাকতো। এই দেশের মানুষ আর ‘গোরা-লোগ’ ; বুঝলাম, ফরাসিদের কথা বলছে। প্রজেক্টের কাজের দৌলতে হোটেলে খদ্দেরের আনাগোনা লেগেই থাকতো। তারপর আতঙ্কি-হামলা বাড়তে থাকলো আর লোকজন কমতে থাকলো…
‘জব সে প্রজেক্ট কা কাম বন্ধ হুয়া তবসে হোটেল ভি বয়ঠ গয়া ; অব মুশকিল সে সাল মে এক-আধ আদমি আতা হ্যাঁয়। হালাত ঠিক নহি। রাত আট-বজে কে বাদ কারফিউ লগ যাতা হ্যাঁয়। বত্তি বন্ধ রখনা পঢ়তা হ্যাঁয়। চারোঁ তরফ মিলটারী। য়াঁহা আম-আদমি সে য়াদা ফৌজী হ্যাঁ য়!’
নিজেদের অসহয়তায় ওরা কিঞ্চিৎ উত্তেজিত এবং হতাশ…
যে হতাশা হায়াত হোটেলের প্রতিটি কামরার বন্ধ জানলা আর দরজার গায়ে ধুলো দিয়ে লেখা আছে…
সেদিন রাত্রে চিকেন-উৎসব হয়েছিল হায়াতে!!!
দুপুরে আগাম টাকা দিয়েছিলাম মুরগি কেনার জন্য। রান্নায় সব থেকে বেশি উৎসাহ ছিল ওই ছেলে দু’টির। আমার আর কতটুকুই বা লাগে খেতে! গরম রুটি, বাটি-ভর্তি মুরগির মাংস, পেঁয়াজ। আমি আর আদিল পাশাপাশি বসে খেলাম। রুটি-ঘরের আলোয় খুশির ছোঁয়া। একে তো এতোদিন পরে খদ্দের এসেছে হোটেলে- তার মানে কিছু আমদানি তো বটেই, তায় আবার মাংস!…
— এ কেমন জীবন, যেখানে একবাটি গরম মাংস একটা বাচ্চাকে আর দু’টো জোয়ান-মদ্দকে এত আনন্দ দেয়?
বৃদ্ধ খেলেন। ছেলেরাও খেল। আমি বসে ওদের সাথে গল্প করছিলাম। এটা সেটা। প্রজেক্টের ভবিষ্যৎ নিয়ে ওদের কৌতূহল বেশি। ওদের নিজেদের ভবিষ্যৎ জড়িয়ে আছে প্রজেক্টের পুনরুজ্জীবনের সাথে। হঠাৎ খেয়াল হলো, শতরঞ্চির ওপর ছোট্ট আদিল কখন ঘুমিয়ে পড়েছে…
পরদিন হাতে কাজ ছিল না। ঠিকই করেছিলাম দেরি করে ঘুম থেকে উঠবো। ঘুম ভাঙলেও আলতো করে লেপটাকে গায়ে ফেলে শুয়েছিলাম। উঠতে হলো জানলার ঠক্ঠক্ আওয়াজে।
জানলা খুলতেই ঘরে লাফিয়ে ঢুকল এক ঝলক টাটকা রোদ্দুর আর তার সাথে এক গাল হেসে, লাফ দিয়ে ভেতরে ঢুকল আদিল হুসেন!
‘উঠো। চায়ে তৈয়ার হ্যাঁয়।’…. বলেই লেপের তলায় পা-দু’টো ঢুকিয়ে দিলে…
‘তুম দরওয়াজ়ে সে কিঁউ নহি আতে হো?’– মজা করে জিজ্ঞেস করলাম।
‘য়ুঁউহি! মজ়া আতা হ্যাঁকয়’ … মিষ্টিই করে রিনরিনে গলায় জবাব দিল সে।
ছটফটে মিশুকে সরল ছেলে আদিল। বেলার দিকে সে-ই বাজারের থলি নিয়ে এসে আমায় ওর পড়ার বই-খাতা দেখাল। সেদিন দুপুরে একতলায় হোটেলের সিঁড়িতে বসে প্রথম আদিলই আমায় শিখিয়েছিল কেমন করে আলিফ লিখতে হয়। তারপর কেমন করে বে, তে, ছে– উচ্চারণ করতে হয় উর্দুতে। সেইই প্রথম। সেইই শেষ। উর্দু-ভাষার এতো সহজ শিক্ষক পরে আর পাইনি কোনোদিন, তাই শেখাও হয়নি!
ওর ছেঁড়া খাতার পাতায় পাহাড় এঁকেছিল আদিল। পাহাড়ের ফাঁকে সূর্য উঠছে;
কিন্তু সেখানে মিলিটারি আঁকেনি সে। হয়ত ওর মনের সরল-রেখা বুঝেছিল, পাহাড়, নদী, চিনারগাছের সাথে সেনাবাহিনী মিশ্ খায় না… তা সাদা বিছানার চাদরে লেগে থাকা রক্তের দাগের মতোই– বিসদৃশ আর অস্বস্তিকর!
‘কল্ চলে যাওগে?’ …আমায় জিজ্ঞেস করেছিল সে।
‘অওর ফির কভি নহি আওগে?’
… কেউ গেলে যে আর ফিরে আসে না- একথা আদিল ওর জীবন দিয়ে বুঝেছে। ওর মা কিংবা বাবা, দু’জনের একজনও ফিরে আসেনি তাদের সন্তানের কাছে। আদিল স্থির জানতো, আমি আর ফিরে আসবো না, তাই পরদিন যখন হোটেল ছেড়ে চলে আসছি তখন আদিল বাদে সকলেই আমায় ফটক অবধি এগিয়ে দিতে এসে বলেছিল–
‘ফির আইয়েগা’…
–শুধু আদিল বলেনি কিছু। ওর চুল ঘেঁটে, গাল টিপে দিয়েছিলাম শেষবারের মতো। লজ্জায় দাদুর ঋজু-দেহের আড়ালে লুকিয়েছিল সে- না কি অন্য কারণে!
বাসে করে ফিরছি। মনের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে এই ক’টি দিনের একের পর এক ছবি। সবথেকে বেশি করে ফিরে ফিরে আসছে আদিল। আদিল হুসেন।
যারা আদিলকে অনাথ করেছে তারা কেমন আছে?
ওর মা-বাবা বেঁচে থাকলে তাদের কি খুব ক্ষতি হতো?
আদিলের অনাথ হওয়ার মধ্যে দিয়ে কি আতঙ্কবাদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ হয়েছে?
নিশ্চয়ই হয়েছে!
এতোবড় নর-সংহার ঘটানোর জন্য ওদের ভগবান নিশ্চই খুব সন্তুষ্ট হয়েছিলেন! হয়েছেন! হয়তো হবেনও!!
ভগবান নিদ্রা যাবেন আর আদিলরা সমগ্র দুনিয়া জুড়ে অনাথ হতে থাকবে। ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে একটু একটু করে বড় হয়ে উঠতে থাকবে ওরা।
তারপর একদিন…
কেমন মানুষ হবে আদিল হুসেন?
রাস্তায় সেইই মিলিটারি ট্রাকের কাফিলা!
আমি মনে মনে বললাম– এই ভারত তোমাদের দেশ নয়! ঘরে ফিরে যাও!
… এ-দেশ আদিলের মতো সরল মানুষের, আদিলের দাদুর মতো অতিথিবৎসল হৃদয়ের, ফৈয়াজ়ের মতো অকপট সুজনের।
ভারতবর্ষ এইসব অমর ধুলো-মানুষদের…


মৌলীনাথ গোস্বামী
জন্ম ১৯৭০
আজন্ম বসবাস আসানসোলে। স্কুলজীবন কেটেছে আইরিশ মিশনারিদের মাঝে। ম্যানেজমেন্ট নিয়ে স্নাতকোত্তর। বর্তমানে, রাজ্য সরকারের আধিকারিক।
দীর্ঘ সময় ধরে কবিতা ও গল্প, উপন্যাসের চর্চা করে চলেছেন। বিশ্বাস করেন, জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি বস্তু নিয়ে কবিতা রচনা করা সম্ভব। তাঁর লেখায় বারবার উঠে এসেছে প্রেম, বিচ্ছেদ, মানুষের সামাজিক অবস্থান এবং গভীর মৃত্যু-চেতনা। একাধিক পত্র-পত্রিকায়, তাঁর কবিতা, গল্প নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে।
কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ- দয়াল । প্রকাশকাল, বইমেলা, ২০২০, প্রতিভাস, কোলকাতা।
লিখবেন, যতদিন জীবন লেখাবে তাঁকে দিয়ে…

লেখকের আরও লেখা
canadian online pharmacies ratings: buy prescription drugs online – online pharmacies of canada
http://canadiandrugs.store/# canada drugs reviews
buying prescription drugs in mexico: top mail order pharmacy from Mexico – mexican rx online
Hi! I just would like to give you a huge thumbs up for the great info you have here on this post. I’ll be coming back to your site for more soon.
good online mexican pharmacy: Top mail order pharmacies – cheapest canadian pharmacies
mexico drug stores pharmacies: mexican online pharmacy – pharmacies in mexico that ship to usa
https://indiapharmacy.site/# indian pharmacy
safe reliable canadian pharmacy order medication online canadian mail order drug companies
online shopping pharmacy india: world pharmacy india – india online pharmacy
purple pharmacy mexico price list: top mail order pharmacy from Mexico – medicine in mexico pharmacies
https://canadiandrugs.store/# reliable canadian pharmacy
Your style is very unique compared to other people I have read stuff from. Thanks for posting when you have the opportunity, Guess I will just bookmark this page.
https://claritin.icu/# ventolin prescription coupon
brand name wellbutrin cost: Buy Wellbutrin XL 300 mg online – wellbutrin 300 mg
You can definitely see your expertise in the article you write. The world hopes for more passionate writers like you who aren’t afraid to mention how they believe. All the time go after your heart.
http://wellbutrin.rest/# can i purchase wellbutrin without prescription in canada
buy ventolin no prescription: Ventolin HFA Inhaler – ventolin order online without prescription
http://clomid.club/# buying cheap clomid without dr prescription
buy wellbutrin australia: Buy Wellbutrin XL 300 mg online – wellbutrin coupon canada
Paxlovid over the counter http://paxlovid.club/# Paxlovid buy online
Link exchange is nothing else except it is only placing the other person’s website link on your page at proper place and other person will also do same for you.
https://wellbutrin.rest/# generic wellbutrin 300
can i purchase cheap clomid: Clomiphene Citrate 50 Mg – can i buy cheap clomid
https://clomid.club/# how can i get clomid price
where to get clomid pills: clomid best price – where can i get cheap clomid without insurance
https://gabapentin.life/# neurontin 900
wellbutrin prices: Buy Wellbutrin SR online – wellbutrin prescription mexico
I think this is one of the most important information for me. And i’m glad reading your article. But want to remark on few general things, The website style is perfect, the articles is really nice : D. Good job, cheers
http://claritin.icu/# ventolin price australia
farmacia online miglior prezzo: Tadalafil generico – comprare farmaci online all’estero
dove acquistare viagra in modo sicuro: viagra prezzo farmacia – viagra naturale in farmacia senza ricetta
comprare farmaci online all’estero Dove acquistare Cialis online sicuro acquistare farmaci senza ricetta
https://avanafilit.icu/# farmacie online autorizzate elenco
farmacia online senza ricetta: kamagra oral jelly consegna 24 ore – acquistare farmaci senza ricetta
farmacie online affidabili: kamagra – farmacie on line spedizione gratuita
farmacie online affidabili: farmacia online spedizione gratuita – migliori farmacie online 2023
Appreciate the recommendation. Will try it out.
alternativa al viagra senza ricetta in farmacia: viagra prezzo – dove acquistare viagra in modo sicuro
farmacie online sicure farmacia online piu conveniente farmacia online piГ№ conveniente
farmacia online senza ricetta: kamagra gel prezzo – farmacia online migliore
http://avanafilit.icu/# farmacia online senza ricetta
farmacie online sicure: avanafil generico – farmacie online affidabili
viagra cosa serve: viagra prezzo farmacia – miglior sito per comprare viagra online
farmacia online più conveniente: farmacia online miglior prezzo – acquistare farmaci senza ricetta
farmacie online autorizzate elenco farmacia online piu conveniente comprare farmaci online all’estero
farmacia online miglior prezzo: Tadalafil generico – comprare farmaci online all’estero
viagra online spedizione gratuita: sildenafil 100mg prezzo – viagra online in 2 giorni
Excellent web site you’ve got here.. It’s hard to find good quality writing like yours these days. I truly appreciate people like you! Take care!!
https://farmaciait.pro/# farmacie online affidabili
farmacie on line spedizione gratuita: comprare avanafil senza ricetta – acquistare farmaci senza ricetta
comprare farmaci online con ricetta: farmacia online – farmaci senza ricetta elenco
farmacie online autorizzate elenco: kamagra gel – farmacia online senza ricetta
farmacie online affidabili: farmacia online migliore – farmacia online più conveniente
farmacie online autorizzate elenco kamagra gold farmacia online migliore
comprare farmaci online con ricetta: comprare avanafil senza ricetta – farmacia online migliore
viagra online in 2 giorni: viagra 100 mg prezzo in farmacia – viagra online consegna rapida
farmacia online: farmacia online – farmacia online senza ricetta
https://farmaciait.pro/# comprare farmaci online all’estero
farmacia online senza ricetta: Farmacie a milano che vendono cialis senza ricetta – acquistare farmaci senza ricetta