দেবেশ রায়ের উপন্যাসচিন্তা : চন্দন আনোয়ার

দেবেশ রায়ের উপন্যাসচিন্তা

চন্দন আনোয়ার

দেবেশ রায়ের মননশীল লেখা আমার গদ্যচর্চার সাম্প্রতিক সম্মোহন। ২০১০ সালের আগে পর্যন্ত আমি দেবেশ রায়কে স্রেফ কথাসাহিত্যিক হিসেবেই পাঠ করে আসছি। তাঁর ছয় খণ্ডে প্রকাশিত গল্পসমগ্র ও বেশ কয়েকটি অসাধারণ উপন্যাস আমার আবশ্যকীয় পাঠের তালিকায় আছে। এরকম আরো চারজন আছেন- মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, কমলকুমার মজুমদার, হাসান আজিজুল হক ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। এঁদের মধ্যে শুধু হাসান আজিজুল হকের মননশীল গদ্যের সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে। এই কবছর দেবেশ রায়ের মননচর্চার সঙ্গে সংযোগ ঘটেছে। বাকি দুজনের মননশীল লেখার প্রতি আমার তেমন আগ্রহ নেই। এর বাইরে যাঁদের কথাসাহিত্য আমি পাঠ করে আসছি এবং যাঁরা বাংলার খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক, তাঁদের মধ্যে খুব কমজনকেই দেবেশ রায়ের মতো শক্তিমান গদ্যনির্মাতা হিসেবে পাই। অবশ্য, এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ সকলের ঊর্ধ্বে এবং আমার ধর্তব্যের বাইরে। একজন শীর্ষ কথাসাহিত্যিকের গদ্য বলে আলাদা কোনো তাৎপর্যের কথা বলছি না। এভাবে ভাবছিও না। দেবেশ রায়ের মননচর্চার ব্যাপ্তি ও দীপ্তি, শাণিত যুক্তি দিয়ে শাণিত গদ্যে বক্তব্য উপস্থাপনরীতি, চিন্তার স্বাবলম্বন, বিষয়ের বৈচিত্র্য বাংলা মননশীল গদ্যের মূল্যবান সংযোজন হিসেবেই পাঠ্য- এ-কথায় আমার কোনো দ্বিধা নেই। দেবেশ রায়ের মননচর্চায় উপন্যাস নিয়ে ভাবনা এক বিশেষ দিক। প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত পাশ্চাত্য মডেল বা ফর্মকে প্রত্যাখ্যান করে বাঙালির নিজস্ব মডেলে বা ফর্মে বাংলা উপন্যাসের ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা থেকেই দেবেশ রায় নতুন ধরনের উপন্যাসের খোঁজ করেন। তাঁর ভাবনার এই দিকটিই আমার নিজের মতো সাজিয়ে নিয়েছি মাত্র। দু-একটি জায়গায় বিরোধে জড়িয়েছি বটে, তবে সার্বিক অর্থে দেবেশ রায়ের এই মিশন আমার সমর্থনেরই জায়গা। অবশ্য এই মিশনকে ঘিরে জিজ্ঞাসাগুলোও বহুমাত্রিক।

বাংলা উপন্যাসের সোয়াশো বছরের ইতিহাসের পোস্টমর্টেম করে, গ্রহণ-বর্জন-প্রত্যাখ্যানের ভেতর দিয়ে তিনি কি শেষপর্যন্ত নিজেই কোনো পাঁকে জড়িয়ে পড়লেন কিনা? নতুন ধরনের উপন্যাসের খোঁজে বেরিয়েছেন অর্থ বাংলা উপন্যাসের প্রচলিত ঐতিহ্যকে তিনি মানছেন না অথবা সন্তুষ্টি নেই। নতুন ধরনের উপন্যাসের কোনো হদিস কি তিনি আমাদের দিতে পারলেন? নাকি অতীত অনুসন্ধানের নামে বাংলা উপন্যাসের শূন্যতা, অসম্পূর্ণতা, মুমূর্ষুতাকে হাট করে খুলে দিলেন মাত্র। উপন্যাসের সংজ্ঞাহীনতার নামে তিনি নতুন কোনো সংজ্ঞা নির্মাণ করে ফেললেন কিনা? এ-ধরনের অনেক জিজ্ঞাসাই আছে বিষয়ের প্রাসঙ্গিকতায়।

‘নির্বিকল্প অতীত’ নয়, ‘বহুবিকল্প অতীত’কে অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে সিনেমার পর্দা ওঠানোর মতো একে একে বিস্ময়, বিতর্ক, যুক্তি ও তর্কের পর্দা সরিয়ে সামনে এগিয়ে যায় দেবেশ রায়ের নতুন ধরনের উপন্যাস খোঁজার মিশন। এই মিশন অবশ্যই বর্তমান সময় পরিপ্রেক্ষিতকে সামনে রেখে। নতুন ধরনের উপন্যাস খোঁজার মিশনে বেরিয়ে কোথাও যুক্তিরহিত আবেগ দ্বারা পরাস্ত হননি দেবেশ রায়। নিজের মধ্যে কোনো ধরনের আবরণ রাখেননি অথবা সম্মোহন জাগিয়ে রাখেননি। সোয়াশো বছরের নির্মিত বাংলা উপন্যাসের অপুষ্ট শরীরের কোনো একটি জায়গাও অক্ষত রাখেননি। দক্ষ সার্জারি ডাক্তারের মতো বাংলা উপন্যাসকে ব্যবচ্ছেদ করে প্রায় নির্বিকারভাবে তিনি চিহ্নিত করে গেছেন, কোথায় কোথায় এবং কী কী কারণে বাংলা উপন্যাসের নিজস্ব ঐতিহ্য বা মডেল তৈরি হয়নি, এই কাজে তিনি প্রথাগত সাহিত্যের ইতিহাস লেখার ঐতিহ্য থেকে বেরিয়ে এসে সম্পূর্ণ নিজস্ব একটি যুক্তিসৌধ নির্মাণ করেন।

আলালের ঘরের দুলাল (১৮৫৮) ও হুতোম প্যাঁচার নকশা (১৮৬১-৬২) – এই দুটি বিবরণধর্মী গদ্যাখ্যান বাংলা আধুনিক উপন্যাসের যাত্রাবিন্দু- দুর্গেশনন্দিনী প্রথম আধুনিক বাংলা উপন্যাস -সাহিত্যের ইতিহাসের এই প্রতিষ্ঠিত ধারাক্রমকে প্রায় নাকচ করে দিয়েছেন দেবেশ রায়। স্বল্পতম ব্যবধানে দুই বিপরীত ধরনের আধুনিকতাকে চিহ্নিত করেন বাংলা উপন্যাসে। পত্র-পত্রিকার খবরকে বিবরণধর্মী গদ্যাখ্যানে সুস্বাদু করে পরিবেশনের প্রচল রীতিটিকেই প্যারীচাঁদ মিত্র ও কালীপ্রসন্ন সিংহ বাংলা উপন্যাসের ফর্মে রূপান্তর করেছিলেন। এই ফর্ম বঙ্কিমচন্দ্রের কাছে শুধু গ্রহণ-প্রতাখ্যানের বিষয়ই হয়ে থাকেনি, অপ্রাসঙ্গিক, মূল্যহীন ও নির্বাসন দণ্ডের শিকার হয়।
আমাদের শিক্ষা, রুচি, মেজাজ, মনন, মগজ সবকিছুই যখন ইংরেজদের দাক্ষিণ্য, তখন বাংলা উপন্যাস কেন এই দাক্ষিণ্য থেকে বঞ্চিত হবে? বাস্তবে হয়ওনি। উপন্যাস কী ধরনের হবে, উপন্যাসের সংজ্ঞা কী হবে, চরিত্র-ভাষা-বয়ান কী ধরনের হবে, জাতিগত আত্মপরিচয়ের সন্ধানের উপাদানগুলো কী কী হবে, যা উপন্যাসের উপকরণ হবে, এই সবকিছুই যখন ইংরেজরা শিখিয়েছে, আর এই শিক্ষায় যিনি চরমসিদ্ধি লাভ করেছিলেন সেই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যখন উপন্যাস লিখছেন তখন আর প্রত্যাশা করে কী লাভ যে, বাংলা কাহিনিগদ্যের ধারাটিকেই নিজ প্রতিভাবলে আধুনিক বাংলা উপন্যাসের ঐতিহ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবেন। বাস্তবে তিনি সেদিকে তাকানোর প্রয়োজন মনে করেননি। তাঁর দরকারই পড়েনি। যেমন দরকার পড়েনি মধুসূদনের।

উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্র প্রথম আধুনিক পুরুষ, আর কাব্যে মধুসূদন। এতকাল আমি একে বাংলা সাহিত্যের সৌভাগ্যই ভেবে এসেছি। দেবেশ রায় আমার এই ভাবনাকে নড়বড়ে করে দিয়েছেন! চলনে-বলনে, পোশাকে, আচার-অনুষ্ঠানে ইংরেজের চেয়েও খাঁটি ইংরেজ হওয়ার চেষ্টা যাঁর, যিনি ভারতীয় সংস্কৃতিকে বিষয় করে মূলত বিদেশি মহাকাব্যই লিখলেন, সেই তিনিই বাংলা ভাষার প্রথম আধুনিক কবি! একইভাবে, সেই তিনিই প্রথম আধুনিক ঔপন্যাসিক, যিনি বাংলার গদ্যাখ্যানের ঐতিহ্যকে গ্রহণ না করে ইংরেজি উপন্যাসের মডেলকে বাংলা উপন্যাসের মডেল বানিয়েছেন!
কবিতায় মধুসূদনের আধুনিকতা তাঁর মৃত্যুর পরে আর চর্চিত হয়নি। মধ্যযুগের গীতিকাব্যের ঐতিহ্যকেই রবীন্দ্রনাথ গ্রহণ করেন। তিরিশের কবিরা ইউরোপীয় কবিদের দিকে সম্মোহনের চোখে তাকিয়েছেন বটে, তবে তা মধুসূদনের মতো বাংলা কবিতার ঐতিহ্যকে একেবারেই উপেক্ষা করে নয়; কিন্তু বাংলা কথাসাহিত্য ইউরোপীয় আধুনিকতা বা মডেলের বাইরে আসতে পারেনি। এই কারণেই, সোয়াশো বছর পরে দেবেশ রায়কে নতুন ধরনের বাংলা উপন্যাস খোঁজার মিশনে বের হতে হয়। এই কারণেই, দেবেশ রায়ের মতে, খাঁটি উপন্যাস আজো একটিও রচিত হয়নি। এই অভিজ্ঞতা তাঁর লেখকজীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা।

উপন্যাসের ফর্ম বা মডেল বলব কাকে? ঔপন্যাসিকের অভিজ্ঞতা বা জ্ঞানকে যা উপন্যাসে পরিণত করে সেটাই তো ফর্ম। প্রায় চল্লিশ বছর ধরে গল্প-উপন্যাস লেখার নানা চেষ্টায় বারবার হয়তো এখানেই ঠেকে গেছি। ঠেকে যে গেছি তাও হয়তো বুঝিনি, বুঝি না। এখন যখন নিজের অতীতটাকে একসঙ্গে দেখার মতো চড়াইয়ের দিকে চলছি আর সেই চড়াই থেকে যতই চোখের সামনে বাংলা উপন্যাসের সমতল বিস্তৃততর হচ্ছে, ততই অসহায় ও ক্ষমতাহীন ক্ষোভে বুঝতে পারছি, ইয়োরোপীয় মডেলে আমাদের পরিত্রাণ নেই।
(উপন্যাসের নতুন ধরনের খোঁজে, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ২০০৬, পৃ ২০-২১)

বাংলা উপন্যাসকে বঙ্কিমচন্দ্র নতুন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, বাংলা উপন্যাসের সমস্ত অর্জনও বঙ্কিমচন্দ্রের দান, আবার বাংলা উপন্যাসের নিজস্ব একটি ঐতিহ্য গড়ে ওঠার সম্ভাবনাকে বিনষ্টির দায়ও তাঁর। আধুনিক কবিতায় একই দায় ছিল মধুসূদনের। কিন্তু কবিতাকে মধুসূদনের মডেল থেকে বের করে আনেন রবীন্দ্রনাথ। এই কারণেই রবীন্দ্রনাথ বাঙালি কবি হয়ে থেকে গেলেন। বাঙালি কবি হয়ে গেলেন বলেই তাঁর কবিতাকে মূল্যায়ন করার জন্যে বা তাকে তুলনা করার জন্যে ইউরোপের কোনো কবিকে খুঁজতে হয় না। আর এই নিজস্বতার গুণেই বাংলা কবিতার এই সর্বৈব ব্যাপ্তি ও অবস্থান। সামান্য ব্যতিক্রম ব্যতীত বাংলার উপন্যাস সোয়াশো বছর ধরে মূলত বঙ্কিমচন্দ্রের মডেলেই চলছে। এই একটি মাত্র মডেলে সীমাবদ্ধ থেকে যাওয়ায় স্থবিরতা ও আধুনিকতার অন্যান্য উৎস থেকে বাংলা উপন্যাস বরাবরই বিচ্ছিন্ন থেকে যাচ্ছে।

দেশীয় যুবসমাজ পঞ্চাশের দশকেই নতুন এক আত্মজীবনী পাঠের জন্য নতুন চোখ মেলে ধরেছিল। ইংরেজি শিক্ষা ও সরকারি চাকরি এই নতুন চোখের কারণ। তার বাস্তব আত্মজীবনী – আলালের ঘরের দুলাল বা হুতোম প্যাঁচার নক্সার আত্মজীবনীর বাইরে বিস্তৃত পটভূমির নতুন আত্মজীবনী সন্ধান করে। এই নতুন আত্মজীবনী তাঁকে ব্রিটিশ নাগরিকের তুল্য ভাবার গৌরব দেবে। এই ভাবনাকে বাস্তবরূপ দিতে হলে অতীত ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরানো ছাড়া বিকল্প ছিল না। শিক্ষিত আধুনিক বঙ্গযুবকের অতীত ইতিহাস বর্তমান ইংরেজি প্রজার চেয়ে গৌরবোজ্জ্বল ও মহিমান্বিত। তাই আলাল-হুতোমের নিরেট বাস্তবতাকে সে পাঠ করতে চায় না। এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করেই তো তাঁকে নতুন এক আত্মজীবনী পাঠ করতে হবে। এই আত্মজীবনী রচনা করতে গিয়ে প্রায় শখানেক বছর ধরে প্রবহমানতার ইতিহাসকে কোনো প্রকারেই গ্রাহ্য করেননি বঙ্কিমচন্দ্র। ইংরেজি উপন্যাসের মডেল হাতে নিয়ে বিষয়ের জন্যে একলাফে ফিরে গেলেন দুশো বছর পেছনে!

বঙ্কিমচন্দ্রে ফিরে যাওয়ার বাস্তবতা ততোদিনে তৈরি হয়ে গেছে- এই বাস্তব অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ফিরে না গেলে কি বাংলা উপন্যাসের বিকাশ থেমে যেত? বঙ্কিম যদি আলালের ঘরের দুলাল থেকে শুরু করতেন তবে কি বাংলা উপন্যাসের বর্তমান আধুনিক চেহারা আমরা দেখতে পেতাম না? এবং তাই সংগত ও স্বাভাবিক ছিল কি-না? দেবেশ রায় এই প্রশ্নগুলোকেই মূলত উসকে দিয়েছেন। তাঁর নতুন ধরনের উপন্যাস খোঁজার মিশনে এই আরম্ভ বিন্দুটিই টার্নিং পয়েন্ট।

বাঙালি যুবক ইংরেজি শিক্ষা ও চাকরির সুবাদে নিজেকে এক আত্মবৈপরীত্যের পাঁকে জড়িয়ে ফেলেছিল। ভিক্টোরীয় নাগরিক হওয়ার চেষ্টাই হয়ে যায় আধুনিক হওয়ার চেষ্টা। নিকট-আগত একটি স্বপ্ন তাকে তাড়া করে। ভিক্টোরীয় সভ্যতার অংশীদারিত্বের কথাও ভাবে। এই স্বপ্নই বাঙালি যুবক মধুসূদনকে আর মধুসূদন থাকতে দেয়নি, মাইকেল হতে হয়। বঙ্কিমচন্দ্র দেশ-ধর্ম-সমাজ ত্যাগ করেননি বটে; কিন্তু ভিক্টোরীয় সভ্যতায় তাঁর মানস-পরিভ্রমণ ছিল সুতীব্র। তাই, দুর্গেশনন্দিনী উপন্যাসেই বাঙালি ভিক্টোরীয় নাগরিক হওয়ার সব উপাদান পেয়ে যায়। তাই, দুর্গেশনন্দিনী হয়ে গেল ইংরেজি শিক্ষিত যুবকের গৌরবমণ্ডিত নতুন এক আত্মজীবনী। এতে সংস্কৃতিনির্ভর অপ্রচল ভাষা ব্যবহার করে সনাতনদেরও বঞ্চিত করেননি বঙ্কিম। তাদেরও সুখপাঠ্য হয়।

বাংলা উপন্যাস দুদিক দিয়েই পেছনে ফিরল। কি কাহিনি, কি ভাষা – দুটিরই তার ছিঁড়ে গেল। দীর্ঘদিনের চর্চিত ভাষা প্রত্যাখ্যাত হয়ে যেমন মৃতবৎ ভাষা সংস্কৃতির আধিপত্য প্রতিষ্ঠা পায়। একইভাবে বিষয়-বিভ্রাটও ঘটে। বাঙালির চালু জীবনবিন্যাস ও হাজার বছরের চর্চিত লোকঐতিহ্য অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেল। এভাবেই বঙ্কিমচন্দ্র কাহিনি বিবরণের গদ্যের আর সমস্ত চেষ্টাকে অবান্তর ও অপ্রাসঙ্গিক করে দিলেন ।
মধুসূদন কবিতায় তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী আধুনিকতার বিপরীতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন যেমন, তেমনি, বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী আধুনিকতার বিপরীতে নিজেকে স্থাপন করলেন। মধুসূদনের কাছে ভারতচন্দ্র-ঈশ্বরগুপ্ত ধারাই ছিল কবিতার আধুনিকতার প্রতিপক্ষ। বঙ্কিমচন্দ্রের কাছে আলাল-হুতোমই ছিল উপন্যাসের আধুনিকতার প্রতিপক্ষ। (উপন্যাস নিয়ে, দে’জ পাবলিশিং, দ্বিতীয় সংস্করণ ২০০৩, পৃ ২০)

এই দুই প্রতিপক্ষ আধুনিকতার মধ্যবর্তী ধারাবাহিকতার সংযোগ সেতু নেই। দুর্গেশনন্দিনী যেমন আধুনিক, তেমনি আলালের ঘরের দুলালও আধুনিক। স্বভাবতই প্রশ্নটি ওঠে, বঙ্কিমচন্দ্র তাহলে কোন আধুনিকতা আমাদের দিলেন? ইউরোপীয় আধুনিকতাকে ভারতীয় আধুনিকতার প্রতিপক্ষ করে তুলেছেন একজন ভারতীয়, এই বৈপরীত্যের কোনো একটি সঠিক ব্যাখ্যা কি দাঁড় করানো যাবে? এই বৈপরীত্য কি ভয়ানক আত্মোপহার নয়? এই বৈপরীত্য কি শেষ পর্যন্ত বাংলা উপন্যাসের নিয়তি হয়ে গেল? আর এই কারণেই কি বাংলা উপন্যাসের কোনো ভিত তৈরি হয়নি? যথার্থ উপন্যাস লেখার চেষ্টাতেই থেমে থাকতে হয়েছে। বাঙালির নিজের একটিও উপন্যাস লেখা হয়নি। এই কারণেই কি বাংলা উপন্যাসের কার্যকারণে ধারাবাহিকতা নেই, যা আছে তা মূলত নামপঞ্জির কালানুক্রমিক? বাংলা উপন্যাসের কোনো গ্রাহ্য ফর্ম গড়ে ওঠেনি বলে বা যথার্থ আধুনিকতায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি বলে বঙ্কিমচন্দ্রকেই দায়ী করা চলে? এসব জিজ্ঞাসার সোজাসাপ্টা উত্তর পেয়ে যাই দেবেশ রায়ের কাছে। কোনো প্রকার ঘোরপ্যাঁচ বা দ্বিধার মধ্যে থাকেননি তিনি। স্পষ্টতই বলেন, বঙ্কিমচন্দ্রই দুই আধুনিকতার মধ্যবর্তী ‘খাদ’ তৈরি করেছেন। কলকাতার ইংরেজি শিক্ষিত যুবসমাজের নতুন আত্মজীবনী রচনার পুরো দায় বহন না করে যদি বাংলা কাহিনিগদ্যের একটি ক্ষীণ ধারাবাহিকতা অথবা ক্ষীণ কার্যকারণও রক্ষা করতেন, তাহলে বাংলা উপন্যাসের নিশ্চয় একটি গ্রাহ্য ফর্ম গড়ে উঠত।

আলাল-হুতোমের আধুনিকতা বাঙালির নবোত্থিত জীবনবাস্তবকে ধারণ করার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলছিল। এদের অপরিশীলিত ভাষা শিক্ষিত রুচিশীল মানুষের কাছে ক্রমেই অপভাষা বলে প্রতীয়মান হচ্ছিল। সময়ের বাস্তবতায় তা ঘটতেই পারে। বঙ্কিমচন্দ্রের মতো বিরাট প্রতিভা অবশ্যই বাংলা উপন্যাসের এই ধারাবাহিকতাকে নতুন এক উচ্চতায় পৌঁছাতে পারতেন। বিষয়ের জন্য পেছনে ফিরে গিয়ে নয়, ইংরেজি ফর্ম ব্যবহার করেও নয়, সমসাময়িক জীবনবাস্তবতাকে বিষয় করে, বাংলা কাহিনি-বিবরণে ধারাকেই যদি নতুনভাবে প্রাণ দিতেন, নতুন একটি ফর্ম তৈরি করে নিতেন, অপ্রচল ভাষা ব্যবহার না করে প্রবহমান জনমানুষের দৈনন্দিন ব্যবহারের ভাষাকে সাহিত্যিকরূপ দিতেন অর্থাৎ আলাল-হুতোমের ভাষাকেই প্রমিতরূপ দিয়ে আধুনিক করে বাঙালির জন্য যদি নতুন একটি আত্মজীবনী লিখতেন, তাহলে এতোদিনে বাংলা উপন্যাসের নিজস্ব একটি ঐতিহ্য অবশ্যই গড়ে উঠত বলে দেবেশ রায়ের স্থিরবিশ্বাস।
এখনো পর্যন্ত বাংলা উপন্যাসের আধুনিকতা বলতে ইউরোপের আধুনিকতা দিয়েই মূল্যায়ন করি। নানা উদাহরণ দিয়ে ইউরোপীয় উপন্যাসর সঙ্গে বাংলা উপন্যাসের তুলনা করি। নানাদিক থেকে দেবেশ রায় বাংলা উপন্যাসের নিজস্ব ঐতিহ্য গড়ে না ওঠার পেছনে বঙ্কিমকেই দায়ী করেন। কথাসাহিত্যের সংজ্ঞা, ভাষা, বিষয়, ফর্মের বিকাশ নিরন্তর একটি প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে, পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে, ‘অভাবিত ও অনিশ্চয়তা’ পথে ঋদ্ধ হয়। বাংলা উপন্যাস সেই ‘অভাবিত ও অনিশ্চিত’ বিকাশের পথেই ছিল, বঙ্কিমচন্দ্র সেই সম্ভাবনাকে নষ্ট করেছেন। ইউরোপের প্রতিষ্ঠিত মডেলকেই শুধু গ্রহণ করেননি, নিজে ও পাঠককে একটি নিশ্চিত, নির্ভার, নিঃসংকোচ রাখার উদ্দেশ্যে নিকট-অতীতের অতিচেনা ইতিহাসকে উপন্যাসের বিষয় করেন। পাঠক ও লেখক – দুই দিক থেকেই বঙ্কিমচন্দ্র কোনো প্রকার অনিশ্চয়তা বা শঙ্কা-সংকোচের মধ্যে রাখেননি। বাংলা উপন্যাসের ঐতিহ্য গড়ে না ওঠার পেছনে এটিও বড় রকমের একটি দুর্ঘট। দেবেশ রায়ের ভাষ্যে :
বাংলা উপন্যাসকে সেই অভাবিত ও অনিশ্চিত পথে বিকশিত হতে হচ্ছিল। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র উপন্যাসের বা কাহিনীগদ্যের যে-ধরনটি, যে-ফর্মটি প্রতিষ্ঠিত করলেন তার ভিতরে কোন অনিশ্চয়তা ছিল না, কোনো দ্বিধা বা সঙ্কোচ ছিল না। কারণ তাঁর কাছে ইউরোপীয় উপন্যাসের মডেলটিই ছিল একমাত্র মডেল। সে-রকমভাবে উপন্যাস লিখলেই বাংলায় উপন্যাস হবে, নইলে হবে না – বঙ্কিমচন্দ্র উপন্যাস ফর্ম সম্পর্কে ছিলেন এমনিই স্থিরজ্ঞান ও স্থিতসিদ্ধান্ত। তাই তাঁর প্রথম উপন্যাসই পুরো উপন্যাস। তাই বছরের পর বছর তিনি যে-উপন্যাসের পর উপন্যাস লিখে যান – তাতে উপন্যাসের সংজ্ঞা সম্পর্কে অনিশ্চয়তা বা অনির্দিষ্টতা সচেতনভাবে কাজ করে না। (উপন্যাস নিয়ে, পৃ ২২)

বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা উপন্যাসের আত্মখণ্ডন ঘটিয়েছেন। বাংলা উপন্যাসের আধুনিকতার বিকাশধারাকে গ্রাহ্য না করে বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার না করেই ইউরোপের উপন্যাসের প্রতিষ্ঠিত মডেলকেই বাংলা উপন্যাসের মডেল করে প্রকারান্তরে বাংলা কাহিনিগদ্যের বিকাশের ধারাকে শুধু প্রত্যাখ্যান নয়, বাংলা উপন্যাসের নিজস্ব ফর্ম বা ঐতিহ্য গড়ে ওঠার পথকেও রুদ্ধ করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্রের বিরুদ্ধে দেবেশ রায়ের এসব অভিযোগের কার্যকারণ আছে। অন্তত, বাংলা কাহিনিগদ্যের বিকাশের কথা ভাবলে বঙ্কিমচন্দ্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ গুরুতরই হয় বটে। বাংলা উপন্যাসের কাহিনিগদ্যের নির্ভরতা ভেঙে চরিত্রের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করেন বঙ্কিমচন্দ্র- উপন্যাসের শিল্পতত্ত্বের দিক থেকে এই সত্য নিশ্চিতভাবেই মানেন দেবেশ রায়। এমনকি, বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম তিনটি উপন্যাসের কাহিনি-বিন্যাস বাঙালির কাহিনি স্মৃতিরই অংশবিশেষ। উপন্যাসগুলোর পাঠকপ্রিয়তার কারণ তাই। উদ্দেশ্য ও পরিপ্রেক্ষিত আলাদা হওয়ায়, ফর্ম ও ভাষা আলাদা হওয়ায় তা আর বাংলা কাহিনিগদ্যকে এগিয়ে নিয়ে যায় না।

বাংলা কাহিনিগদ্যে উপন্যাসের নিজস্ব ঐতিহ্য বা ফর্ম গড়ে ওঠার যথেষ্ট উপাদান ছিল- দেবেশ রায় প্রামাণ্য দলিলের মতো তুলে ধরেন। মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্য, চৈতন্যজীবনী, চৈতন্যপরবর্তী পালাগান বা মৈমনসিং গীতিকার কাহিনিগদ্যগুলোতে কাহিনি-বিন্যাস এবং চরিত্র রূপান্তর প্রক্রিয়া প্রায় আধুনিক উপন্যাসকে স্পর্শ করেছে। এইগুলোতে কম-বেশি বাঁধা ছকের অন্তর্ঘাত ঘটেছে। অন্তর্ঘাত ঘটে গেছে চৈতন্যজীবনী ও রাধাকৃষ্ণের কাহিনিতে এবং বৈষ্ণবপালাকীর্তনের আখরগুলোতে। ঔপন্যাসিক অন্তর্ঘাতের উদাহরণের অভাব নেই। পুত্রøেহের কাছে যদি চাঁদ সওদাগর বশ্যতা না মানতেন, তবে হয়তো চাঁদ সওদাগরই হয়ে যেতেন আধুনিক বাংলা উপন্যাসের প্রথম নায়ক। মৈমনসিং গীতিকা কোনো কোনো কাহিনিগদ্যে অনুবাদ করলে পরিপূর্ণ উপন্যাসই হবে। মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গলকে তো অনেকে উপন্যাসই বলেন। উদাহরণের অভাব নেই। মধ্যযুগের এতসব কাহিনিগদ্যের কোনো একটি উদাহরণের দিকেও তাকালেন না বঙ্কিমচন্দ্র! বাংলা উপন্যাসের এই এক ট্র্যাজেডিই বটে।

কাহিনিগদ্যের বিস্তৃত উদাহরণ উপস্থাপন শেষে দেবেশ রায় ফের বঙ্কিমচন্দ্রের কাছেই ফিরে আসেন। ফিরে আসেন উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে সেই সময়টাতে, যখন বাঙালির জীবনে ইংরেজপুরাণ প্রতিষ্ঠিত রূপ লাভ করেছে। বঙ্কিমচন্দ্র উপন্যাস লিখতে গিয়ে এই পুরাণকেই গ্রহণ করলেন। ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালির সমবেত ইচ্ছার সেই পুরাণ বঙ্কিমের একক চেষ্টায় বাঙালির জাতীয় জীবনে আরো দৃঢ় ও মহত্তর হয়। বাঙালির জাতীয় জীবনের পুরাণ- মঙ্গলকাব্য থেকে শুরু করে পালাকীর্তনে মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত লোকপুরাণকে অবজ্ঞা করে বঙ্কিমচন্দ্র ইংরেজি উপন্যাসের নির্দিষ্ট ছককেই বাংলা উপন্যাসের মডেল বা আদর্শ বলে গ্রহণ করলেন। কথাগুলো পুনরাবৃত্তির মতো ঘুরে ঘুরে আসছে। আসছে মূলত একটির সঙ্গে আরেকটির সম্পর্ককে পরিষ্কার করার উদ্দেশ্যেই। তাই, বঙ্কিমচন্দ্রের কাছেই ফিরে ফিরে আসে দেবেশ রায়ের নতুন উপন্যাস খোঁজার মিশন।

ইংরেজি উপন্যাস ইংরেজি ভাষার প্রাক্-উপন্যাসের কাহিনিগদ্যের বিবর্তন-পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে একটি নির্দিষ্ট ছকে এসে পৌঁছেছে। বঙ্কিমচন্দ্র শুধু সেই ছকটিই গ্রহণ করতে পারলেন। ইংরেজি উপন্যাসের উৎসটিকে গ্রহণ করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। প্রকারান্তরে দেবেশ রায় যা বলতে চাচ্ছেন, তা হলো, ইংরেজি উপন্যাসের উৎসের দিকে তাকিয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের কেন বোধোদয় হয়নি যে, বাংলা উপন্যাসের ঐতিহ্য গড়ে তুলতে হলে মধ্যযুগের কাহিনিগদ্যগুলোকেই পরিবর্তনের-বিবর্তনের ভেতর দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

ইংরেজি উপন্যাসের সার্বিক উৎকর্ষতা থেকে একটি ছককে বিচ্ছিন্ন করে বাংলা উপন্যাসে আমদানি করা হয়। এই একটি মাত্র ছকই বাংলা উপন্যাসের বাঁধা ছক হয়ে আছে সোয়াশো বছর ধরে। সময়ে সময়ে পাশ্চাত্যের নতুন মডেলের বাংলা সংস্করণ ঘটেছে মাত্র। অর্থাৎ বাংলা উপন্যাসের আদি-মধ্য বা উৎস নেই, যা আছে তা একটি বিদেশি উপন্যাসের একটি নির্দিষ্ট ও বিচ্ছিন্ন ছক মাত্র। বাংলা উপন্যাসের নিজস্ব কোনো ঐতিহ্য নেই। নিজস্ব কোনো ফর্ম গড়ে ওঠেনি। এই কারণে, বাংলা উপন্যাসের বয়স যত বেড়েছে, নতুন নতুন আধুনিকতা এসেছে, ততোই বাঙালির লোকজীবন থেকে সরে সরে গেছে।
‘আধুনিকতার ভ্রান্তিচেতনা’, ‘আধুনিকতার বিভ্রান্তি’, ‘আধুনিকতার বিভ্রম’. ‘আধুনিকতার সংজ্ঞাবিভ্রাট’ ইত্যাদি নেতিবাচক শব্দযুগল ব্যবহার করে বাংলা উপন্যাসের নির্মিত ঐতিহ্যকে নাকচ করেন দেবেশ রায়। তাঁর মতে, এসবই ঘটে উনিশ শতকের বাংলা উপন্যাসের জন্মের সময়। সোজাসাপ্টা বললে, দেবেশ রায় স্পষ্টতই বলেছেন, বঙ্কিমচন্দ্রের হাতেই ঘটেছে এইসব। সোয়াশো বছরেরও বাংলা উপন্যাস আধুনিকতার সেই ভ্রান্তি, বিভ্রান্তি, বিভ্রম বা বিভ্রাট থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, মানিক, তারাশঙ্কর, বিভূতি, সতীনাথ, কমলকুমার প্রত্যেকেই চেষ্টাতেই থেমে গেছেন। এঁর কেউ-ই কোনো রকমের বিদ্রোহ করেননি। যে রবীন্দ্র-প্রতিভা আধুনিক বাংলা কবিতাকে মাইকেলের ইউরোপীয় মডেল থেকে বের করে বাঙালির নিজস্ব ঐতিহ্যে ফিরিয়েছে- বাংলা কবিতাকে বিশ্বজনীন করেছে- সেই রবীন্দ্র-প্রতিভা উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্রের মডেলের কাছে অর্থাৎ ইউরোপীয় উপন্যাসের প্রতিষ্ঠিত ফর্মের কাছে প্রায় নিঃশর্তভাবেই আত্মসমর্পণ করেছে! চোখের বালি, গোরা, ঘরে বাইরে এইসব উপন্যাস বঙ্কিমচন্দ্রের মডেলরই শাণিত রূপ। বাঙালির আত্মপরিচয়ের সন্ধানে নতুন একটি আত্মবিবরণী তৈরি করেছেন মাত্র। একই আত্মবিবরণী তৈরি করেছেন শরৎচন্দ্রও। বঙ্কিমচন্দ্রের মতো বাঙালিকে ইংরেজ বানানোর চেষ্টা করেননি রবীন্দ্রনাথ। ইংরেজি উপন্যাসের ফর্মকেই ভারতীয় ইতিহাসের সঙ্গে সন্নিহিত করে সমকালীন জীবনের কার্যকারণের সূত্র খুঁজেছেন। তুলনায় শরৎচন্দ্রকে বিদ্রোহী বলে মনে হয়। এই বিদ্রোহের এমনি ঝলক, ধমক ও শাসন ছিল যে, ইউরোপীয় মডেলে শাণিত রূপ রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসগুলো পর্যন্ত তাৎক্ষণিকভাবে বাঙালি পাঠককে টানেনি। খোদ রবীন্দ্রনাথই শরৎচন্দ্রের চোদ্দ বছরের রাজত্বকালে (১৯১৪-২৮) একধরনের স্তম্ভিত বিস্ময় নিয়ে অপেক্ষা করে গেছেন, কী হতে চলেছে? বাঙালির ইংরেজ হওয়ার বিভ্রান্তিকে চ্যালেঞ্জ করে শরৎচন্দ্র বাঙালিকে বাঙালি করার যে-চেষ্টা করেন, সে-চেষ্টা ছিল মূলত আরেক বিভ্রান্তি। কাল্পনিক সাহেবানার বিরুদ্ধে কাল্পনিক বাঙালিয়ানাকে রূপ দিতে গিয়ে ইংরেজি উপন্যাসের ফর্মকেই অন্ধভাবে গ্রহণ করেছিলেন। শক্তিশালী সংলাপ প্রয়োগ করে সেন্টিমেন্টাল নাটকীয়তা তৈরি করেন, যা মূলত ইউরোপীয় উপন্যাসের মডেলের অনুকৃতি।

বস্তুত, ইউরোপীয় উপন্যাসের ফর্মের বাইরে গিয়ে বাংলা উপন্যাসের নিজস্ব ঐতিহ্য তৈরি করা সম্ভব; বাংলা উপন্যাসকে একটি নির্দিষ্ট মডেলের সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্তি দিতে হবে; বড় ধরনের বিদ্রোহ করতে হবে; অনাধুনিক বলে বর্জনীয় – এই ধরনের প্রবণতাই দেখা যায় না রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের মধ্যে। বাংলায় উপন্যাস লিখতে হলে বা বাংলা উপন্যাসে আধুনিকতা আনতে হলে এই একটি ফর্ম বা মডেল- ইউরোপীয় মডেল। যে-কারণে বঙ্কিমচন্দ্রকে রবীন্দ্রনাথ বা শরৎচন্দ্র প্রতিপক্ষ মনে করেন না বা অনাধুনিক মনে করেন না, সেই একই কারণে প্রেমেন্দ্র-অচিন্ত্য-বুদ্ধদেবরাও রবীন্দ্রনাথ বা শরৎচন্দ্রকে প্রতিপক্ষ বা অনাধুনিক মনে করেন না। তাদের জানার দরকারই হয় না, রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র বাংলা উপন্যাসকে কতদূর নিয়ে গেছেন অথবা তাঁরা কী করতে পারেননি। কারণ তাঁদের সেখান থেকে শুরু করার প্রয়োজন নেই। আধুনিকতার মানদণ্ড একটিই- কে কত বেশি, কত নিখুঁতভাবে ইউরোপের মডেল গ্রহণ করতে পারেন। তাই বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ-শরৎ কোনো বিবেচ্য বিষয়ই নয়, মূল্যায়নেরও বিষয় নয়। তাদের বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে ভার্জিনিয়া উলফ, জেমস জয়েসরা। একইভাবে, বাংলা উপন্যাসের ঐতিহ্যকে রাশিয়ায় প্রতিষ্ঠিত সমাজতন্ত্রের দার্শনিক ব্যাখ্যা ও রাজনৈতিক ব্যাখ্যার অনুবর্তী করে গড়ে তোলার চেষ্টা ছিল মার্কসবাদী ঔপন্যাসিকদের মধ্যে। এই চেষ্টাও ফলবতী হয়।

দেবেশ রায়ের নতুন ধরনের উপন্যাস খোঁজার মিশন শরৎচন্দ্র পর্যন্ত সরলরৈখিকই বটে। বাংলা উপন্যাসের জন্মবিভ্রাট অথবা আধুনিকতার সংজ্ঞাবিভ্রাট তিরিশের দশকের আরেক পাঁক তৈরি করে। দেবেশ রায়ের নিজের তৈরি আধুনিকতায় অথবা আধুনিকতার ধারণা তিরিশের দশকে এসে হোঁচট খায়। যে সংজ্ঞায় তিনি বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রকে ফেলেন, একই সংজ্ঞায় আর মানিককে ফেলতে পারেন না। একইভাবে ফেলতে পারেন না তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ ও সতীনাথ ভাদুড়িকে। এসব শক্তিমান কথকরা বাংলা উপন্যাসের প্রচলিত আধুনিকতার বাইরে প্রায় বিকল্প এক অনাধুনিকতাকে গ্রাহ্য করে তুলেছেন। গ্রাহ্য করে তুলেছেন মাত্র কিন্তু প্রতিষ্ঠা দিতে পারেননি। দেবেশ রায় যথেষ্ট জোরের সঙ্গেই বলেছেন, এঁরা ইউরোপের ফর্ম ভেঙে ফেলেছিল প্রায়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারেননি। যতটা পেরেছেন তা স্থায়ী করতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিগত সিদ্ধিতেই সমাপ্তি ঘটে। মানিক সর্ম্পকে তাঁর বক্তব্য হচ্ছে : ‘এই প্রবল শক্তিমান ঔপন্যাসিকের জন্যে কোনো ইউরোপীয় মডেল প্রয়োজন হয়নি- তিনি সেই মডেলকেও ছাপিয়ে গিয়েছেন তাঁর ঔপন্যাসিক কল্পনার তুঙ্গগতিতে কিন্তু মানিকের উপন্যাসের মানুষজন তাদের সম্পর্ক গড়ে তোলে ইউরোপীয় উপন্যাসের তৎপরতার নিয়মে।’ আর এই ছাপিয়ে যাওয়ার কাজটি মানিক পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসেই প্রবলভাবে সম্পন্ন করেন। পরবর্তীকালে আর তা রক্ষিত হয়নি। পদ্মানদীর নদীর মাঝিতেই প্রথম বাংলা উপন্যাসের নির্দিষ্ট ‘ল্যান্ডস্কেপ’ পাই। কিন্তু মানিকের ক্ষেত্রে এই প্রথমই শেষ হলেও তারাশঙ্কর প্রায় সারাজীবনই একটি নির্দিষ্ট ‘ল্যান্ডস্ক্যাপ’ তৈরির চেষ্টায় ছিলেন। তাই, দেবেশ রায়ের কাক্সিক্ষত বিকল্প আধুনিকতার অবয়ব অনেকটাই রূপ পায় এ-লেখকের কাছে। কবি, তারিণী মাঝি – এরকম কিছু লেখায় বিকল্প আধুনিকতার অনেক উপাদানই আছে। এখানে ধর্মমঙ্গলের গরু-মহিষ, মঙ্গলকাব্যের নদীনালা অথবা ‘প্রাচীন গায়ক-কথকের কণ্ঠস্বর’ ইত্যাদি দেখতে-শুনতে পান। এই প্রাপ্তি ভীষণভাবে প্রাণিত করে তাকে। দুর্ভাগ্য হচ্ছে, এই ধারায় এগোয়নি তারাশঙ্করের মূল সাহিত্যকর্ম। যেখানে সচেতনভাবে বিকল্প আধুনিকতাকে রূপ দিতে গেছেন সেখানেই ঢুকে পড়েন ইউরোপীয় ফর্মে। অর্থাৎ তারাশঙ্কর একটি বিকল্প আধুনিকতার জন্ম দিয়েও শেষ পর্যন্ত স্থায়ী করতে পারেননি। আধুনিকতার বিভ্রান্তি তারাশঙ্করকেও ছাড়েনি। তারপরও তারাশঙ্করই দেবেশ রায়ের নতুন ধরনের উপন্যাস ধারণার সবচেয়ে নিকটবর্তী একজন, যতটা নিকটে মানিক তো ননই, বিভূতিভূষণও নন। প্রকৃতি-অন্বিষ্ট ও শক্তিশালী ঔপন্যাসিক বিবরণের জোরে বাংলা উপন্যাসের আরোপিত মডেল ভেঙে ফেলেন বিভূতিভূষণ। কিন্তু নতুন মডেলে তাঁর প্রকৃতিদর্শনকে ঠাঁই দেওয়া যাচ্ছিল না। প্রতিষ্ঠিত ফর্মেই তা সম্ভব হয়। সমগ্র যুক্তিতর্কে বা আলোচনায় সতীনাথ ভাদুড়িকেই দেবেশ রায় তাঁর নতুন ধরনের উপন্যাসের অগ্রগামী নায়ক ভাবছেন। সতীনাথের জাগরী ও ঢোঁড়াই চরিত মানস উপন্যাস দুটির বিষয় ও ফর্ম দেবেশ রায়কে দারুণভাবে আন্দোলিত করে। সতীনাথই ইউরোপীয় উপন্যাসের মডেলকে প্রত্যাখ্যান করে রামচরিতের মডেল গ্রহণ করে নতুন আধুনিকতার জন্ম দেন। রামচরিতের মডেল শুধু উপন্যাসের কৌশল হিসেবেই গ্রহণ করেননি সতীনাথ, তাঁর বিষয় ও চরিত্রের ভারতীয় এপিকতাকে শিল্পে রূপ দিতে গিয়ে রামচরিতের আধারকে গ্রহণ করা অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু এই নতুন আধুনিকতাবোধের আবিষ্কারে দেবেশ রায় উচ্ছ্বাস ও প্রত্যাশা- দুটিই শেষ পর্যন্ত হতাশাকেই ডেকে আনে আমাদের সামনে। এই আধুনিকতা হঠাৎ বিদ্যুৎ-ঝলকের মতোই- আর পরে চর্চিত হচ্ছে না- কোনো পরিণত রূপ পাচ্ছে না। সতীনাথ বিপ্লবের শুরুটা করেছিলেন, কিন্তু যোগ্য উত্তরসূরির অভাবে নীরবেই থেকে যাচ্ছে। তবে, শেষ পর্যন্ত দেবেশ রায় নতুন উপন্যাসের আশা জাগিয়ে রাখেন নিজের মধ্যে।

আমার কোনো সিদ্ধান্ত নেই। আমি শুধু একজন ঔপন্যাসিকের শিল্পসংকটের কথা ভাবছি এমন কোনো ঔপন্যাসিক যে আজ বা আগামীকাল উপন্যাসের এমন এক ভাষার অধিকার চাইতে পারে যে-ভাষায় তার কথা সত্য মনে হবে, বানানো মনে হবে না। আমি এমন একজন ঔপন্যাসিকের শিল্পসংকটের কথা ভাবছি, যে আজ বা আগামীকাল চাইতে পারে সে যে-বাক্যটি রচনা করবে আর সেই বাক্যের ভেতরে যে-অর্থটি ভরে দিতে চাইবে, তার মাঝখানে একমাত্র সংযোজক হিসেবে সে-ই থাকবে লেখক হিসেবে, কথক হিসেবে; যে কোনো কলোনির প্রজা হিসেবে কলোনির কোনো শিক্ষা তার বাক্যের ভিতরে ভরে দেবে না। আমি এমন একজন ঔপন্যাসিকের কথা ভাবছি যে আজ বা আগামীকাল চাইতে পারে- সে স্বাধীন, তার লেখা স্বাধীন ও সেই লেখায় নিহিত অর্থ স্বাধীন। (উপন্যাসের নতুন ধরনের খোঁজে, পৃ ২১-২২)

আধুনিকতা কী? আধুনিকতার সংজ্ঞা কী? আমরা কি আধুনিক? ইংরেজ আমাদের যে-আধুনিকতায় পৌঁছে দিয়ে গেছে, সেই আধুনিকতা কি আমাদের বাস্তবিকই আধুনিক করেছে, নাকি শেকড়চ্যুতি ঘটিয়েছে? সাহিত্য, ইতিহাস, সমাজ যা-ই আলোচনা করতে যাই না কেন- এই দ্বিধা আমাদের পিছু ছাড়ে না। এই দ্বিধার কারণেই কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে পারি না। এই দ্বিধা দেবেশ রায়কে তুলনামূলকভাবে কম পরাস্ত করেছে। দেবেশ রায় নিজের বক্তব্যের স্বপক্ষে এমন শাণিত যুক্তি, সমৃদ্ধ তথ্য উপস্থাপন, অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেন- বাংলা উপন্যাসের প্রচল ধারণাটিকে এমনভাবে ওলটপালট করেন আর নিজের মতকে প্রতিষ্ঠিত রূপ দেন, সেখানে দ্বিধা অনেকটাই কম।

বাংলা উপন্যাসের নিজস্ব ঐতিহ্য গড়ে উঠবে কিনা? সম্ভব কিনা? সম্ভব হলে কতদিনে সম্ভব? এই জিজ্ঞাসার কোনো সিদ্ধান্ত জানাতে পারেননি দেবেশ রায়। কেন গড়ে ওঠেনি? কীভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল বাঙালির লোকজীবনের গদ্যাখ্যানের ধারা থেকে বাংলা উপন্যাস? কারা কারা চেষ্টা করেছেন, তাঁরা কতদূর পারলেন আর কী পারেননি- ইতিহাসের এই বিষয়গুলোকেই নিজের মতো বিশ্লেষণ করেন নানা যুক্তিতর্ক দিয়ে। তিনি ভবিষ্যৎদ্রষ্টা নন, বাংলা উপন্যাসের ভবিতব্য নির্দেশ করা তাঁর দায়িত্বের মধ্যেও পড়ে না। ঔপন্যাসিক হিসেবে বাস্তব অভিজ্ঞতাই দেবেশ রায়ের মতের পক্ষে যুক্তিতর্কের প্রধান ভিত্তি-এ-কথা মান্য করেও বলতে হবে- তিনি মতের পক্ষে যেসব যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন, সেগুলো এমনভাবে নৈর্ব্যক্তিক ও যুক্তিগ্রাহ্য করে তোলেন যে, বাংলা উপন্যাসের চালু আধুনিকতার বিভ্রান্তির বিপরীতে তাঁর বিকল্প আধুনিকতা ও নতুন ধরনের উপন্যাসের আকাক্সক্ষাকে স্রেফ ব্যক্তির বলে পাশ কাটিয়ে যাওয়া যায় না।

আমার মনে হয়, বাংলা উপন্যাসে আধুনিকতার বিভ্রান্তি নিয়ে বা নতুন ধরনের উপন্যাস খোঁজার পক্ষে দেবেশ রায়ের যুক্তিগুলো ভাবার সময় এসেছে। যখন প্রায় দেড়শো বছরেও বাংলা উপন্যাসে নিজস্ব ঐতিহ্য গড়ে ওঠেনি অথবা উপন্যাসের আধুনিকতাতে বিভ্রান্তি ঘুরপাক খাচ্ছি, তখন দেবেশ রায়ের নতুন ধরনের উপন্যাস খোঁজার বিষয়টি ভাবতেই হবে। তাঁর ভাবনার গ্রহণ-বর্জন হতে পারে কিন্তু নতুন ধরনের উপন্যাস খোঁজার বাস্তবতাকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। এরপরও কিছু বিতর্ক তো থেকেই যাবে। এই বিতর্কে আমার জড়ানো বা না-জড়ানোর প্রসঙ্গ আসছে না। দেবেশ রায়ের বিকল্প আধুনিকতা বা নতুন ধরনের উপন্যাস খোঁজার ধারণাটি সত্যিই কি বাস্তবোচিত? তিনি আধুনিক বাংলা উপন্যাসের ঐতিহ্যকে প্রায় সবটাই নাকচ করে দিচ্ছেন! রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র ব্যর্থ, মানিক-তারাশঙ্কর-বিভূতি কেউই বাংলা উপন্যাসের ঐতিহ্য তৈরি করতে পারেননি। দেবেশ রায়ের এই বক্তব্য মেনে নিলে আরো বাকি অনেক বিষয়কে মেনে নিতে হবে। যেমন : বাংলা উপন্যাসের জন্মবিভ্রাট, আধুনিকতা বিভ্রান্তি, বঙ্কিমচন্দ্রে দায়, রবীন্দ্র-শরৎচন্দ্রের ব্যর্থতা, মানিক-তারাশঙ্কর-বিভূতির ব্যর্থতা, প্রচল ও প্রতিষ্ঠিত আরো অনেক বিষয়কেও মেনে নিতে হবে। এই মেনে নেওয়ার বিষয়টি বড় ধরনের সাহিত্যিক-বিপ্লব ও বড় প্রতিভা ছাড়া সম্ভব নয়। অবশ্য, মেনে নেব কি নেব না সেই সিদ্ধান্তটি আগে ঠিক করে নিতে হবে।

This image has an empty alt attribute; its file name is MANGROVE.jpg

চন্দন আনোয়ার

শিক্ষক, কথাসাহিত্যিক
সম্পাদক : গল্পকথা

About S M Tuhin

দেখে আসুন

আবিদ আজাদের কবিতা : শিল্পের বাগানবাড়ি । আমিনুল ইসলাম

আবিদ আজাদের কবিতা : শিল্পের বাগানবাড়ি আমিনুল ইসলাম   কবিতার ইতিহাস তার টেকনিকের ইতিহাস এই …

49 কমেন্টস

  1. canadian pharmacy for sildenafil: online pharmacy usa – best online canadian pharmacies

  2. mexico pharmacies prescription drugs: best online pharmacy – mexico drug stores pharmacies

  3. indian pharmacy online: online shopping pharmacy india – indian pharmacy paypal

  4. canadian pharcharmy cheap drugs online canadian pharmacy antiobotics without prescription

  5. online pharmacies no prescriptions: buy prescription drugs online without doctor – mexican pharmacies shipping to usa

  6. https://indiapharmacy.site/# buy medicines online in india

  7. best mexican online pharmacies: buy medication online – buy prescriptions online

  8. reliable online canadian pharmacy: legal drugs buy online – prescription prices

  9. wellbutrin prescription: Buy Wellbutrin SR online – 75 mg wellbutrin daily

  10. paxlovid covid: Paxlovid price without insurance – Paxlovid over the counter

  11. https://clomid.club/# how to buy cheap clomid

  12. how to get generic clomid without insurance: can you get clomid for sale – cost of generic clomid without insurance

  13. paxlovid india: paxlovid for sale – Paxlovid over the counter

  14. wellbutrin no precription: Buy Wellbutrin XL 300 mg online – zyban wellbutrin

  15. https://clomid.club/# how can i get clomid without rx

  16. ventolin over the counter singapore: Ventolin HFA Inhaler – ventolin otc

  17. https://claritin.icu/# can i buy ventolin over the counter in singapore

  18. farmacia online più conveniente: avanafil generico – farmacia online più conveniente

  19. farmacia online senza ricetta: farmacia online più conveniente – comprare farmaci online con ricetta

  20. farmacie online affidabili: farmacie online autorizzate elenco – farmacie online sicure

  21. п»їfarmacia online migliore farmacia online miglior prezzo farmacie online affidabili

  22. https://tadalafilit.store/# farmacia online miglior prezzo

  23. acquistare farmaci senza ricetta: kamagra oral jelly – farmacia online

  24. farmacie online autorizzate elenco: comprare avanafil senza ricetta – farmaci senza ricetta elenco

  25. migliori farmacie online 2023: farmacia online migliore – acquisto farmaci con ricetta

  26. farmacia online miglior prezzo kamagra gel prezzo acquisto farmaci con ricetta

  27. viagra naturale: viagra prezzo – gel per erezione in farmacia

  28. viagra originale in 24 ore contrassegno: viagra senza ricetta – viagra originale in 24 ore contrassegno

  29. farmacia online più conveniente: avanafil generico – top farmacia online

  30. acquistare farmaci senza ricetta: Farmacie che vendono Cialis senza ricetta – farmaci senza ricetta elenco

  31. comprare farmaci online all’estero: comprare avanafil senza ricetta – farmacie on line spedizione gratuita

  32. farmaci senza ricetta elenco: kamagra – farmacie online affidabili

  33. farmaci senza ricetta elenco avanafil generico comprare farmaci online con ricetta

  34. farmacie online autorizzate elenco: kamagra oral jelly – acquistare farmaci senza ricetta

  35. comprare farmaci online con ricetta: kamagra gel prezzo – comprare farmaci online all’estero

  36. farmaci senza ricetta elenco: kamagra oral jelly – farmacie on line spedizione gratuita

  37. farmacie on line spedizione gratuita: kamagra gel – farmacia online migliore

  38. farmacia online senza ricetta: Avanafil farmaco – farmacia online

  39. viagra prezzo farmacia 2023: alternativa al viagra senza ricetta in farmacia – viagra consegna in 24 ore pagamento alla consegna

  40. farmacia online miglior prezzo: Farmacie che vendono Cialis senza ricetta – farmacia online migliore

  41. pillole per erezioni fortissime viagra online spedizione gratuita miglior sito dove acquistare viagra

  42. farmacia online miglior prezzo: farmacia online miglior prezzo – farmacie online sicure

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *