দীপ মুখোপাধ্যায় : ছড়ার জাদু ওস্তাদ । আহমেদ সাব্বির

স্ম র ণ

দীপ মুখোপাধ্যায় : ছড়ার জাদু ওস্তাদ

আহমেদ সাব্বির

‘বারুদ বারুদ গন্ধ বেরোয় / এই সময়ের থেকে
বিষ্ফোরণের প্রতীক্ষাতে / বিপন্ন প্রত্যেকে।
আঁকড়ে ধরে শূন্যতাবোধ / ইর্ষা আসে পাশে
লাশ ভেসে যায় নদীর জলে / রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে।
বারুদ বালক এর ভেতরেই / খুঁজছে প্রেমের মানে
খিদের সময় আগুন খেয়ে / ভষ্ম হতে জানে’।
{বারুদ বালক , (সংক্ষেপিত)}

দীপ মুখোপাধ্যায়ের লেখা ‘বারুদ বালক’ শিরোনামে ২৪ লাইনের ছড়াটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ২০০২ সালে সানন্দা পত্রিকায়। সেই সময়ে গুজরাতে দাঙ্গা হয়েছিল। ভয়াবহ সেই দাঙ্গায় হাজারেরও বেশি নিরীহ মানুষ প্রাণ হারায়। দাঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে লেখা ছড়াটি পড়ে সেদিন চমকে উঠি। অনেকটা আক্রান্তও হই। সাতক্ষীরা পাবলিক লাইব্রেরিতে সানন্দা পত্রিকা রাখা হতো। পত্রিকা থেকে সেদিন ছড়ার পাতাটি ছিঁড়ে নিয়ে পকেটে ঢুকিয়ে নিয়েছিলাম। আজও সংগ্রহে আছে। দীপ মুখোপাধ্যায় নামটি ‘বারুদ বালক’ থেকেই মস্তিষ্কে ফলার মতো গেঁথে গিয়েছিল।

ছড়া-অন্তঃপ্রাণ দীপ মুখোপাধ্যায়। আজীবন তিনি ছড়া নিয়েই থাকতে চেয়েছেন। এই চাওয়া ছিল অনন্ত পরিক্রমার মতো। ছড়াকে তিনি ভেঙে সাজাতেন। সাজিয়ে ভাঙতে দ্বিধাবোধ করতেন না। ছড়ার চিরায়ত ইঙ্গিতকে ভেঙে তিনি নতুন আঙ্গিক অনুসন্ধান করেছেন আজীবন। কিন্তু কখনো তা বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ লোকছড়াকে আড়াল করে নয়। এ কারণে তার ছড়ায় লেকায়ত সুর, বক্তব্যের বলিষ্টতা, সময়ের সৌন্দর্য এবং কবিতার কান্তি খুঁজে পাওয়া যায়। তিনি বিশ্বাস করতেন ছড়া সূচনাপর্ব থেকেই আদ্যোপান্ত আধুনিক। পরিশীলিত নির্মাতারা ছেলেভোলানো ঘুমপাড়ানি ছড়াগুলো অতিক্রম করতে পেরেছেন কিনা সেই প্রশ্ন তিনি রেখে গেছেন। তার ছড়ায় চটুলতা যেমন আছে তেমনি কাব্যকলার নান্দনিকতা হৃদয় সঞ্জাত।

‘দীপ মুখোপাধ্যায়ের ছড়া’ শিরোনামে তাঁর প্রথম ছড়াগ্রন্থ প্রকাশ পায় ১৯৯০ সালে। প্রথম ছড়াগ্রন্থ প্রকাশেই তিনি আলোতে আসেন। অন্নদাশংকর রায়, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, শঙ্খ ঘোষ, সুভাষ মুখোপাধ্যায়সহ সেই সময়ের খ্যাতিমান কবি-সাহিত্যিকদের প্রশংসায় ভেসেছিলেন। কেউ তাঁকে বুকভরে পিঠ চাপড়িয়ে দিয়েছিলেন। আবার কেউ কেউ প্রশ্ন রেখেছিলেন- শুধু ছড়া লিখে কী হবে? তাঁর অভিমত ছিল- ‘ছড়া যে নিয়মিত সমাজ-বাস্তবতাকে প্রকাশ করে। আনন্দ, দুঃখ, শোক, দ্রোহ প্রকাশ করে। এটা এক আনিবার্য মুখর মাধ্যম যা কল্পনা আর বাস্তবের শৈল্পিক মিশ্রণ। সুনির্বাচিত শব্দবিন্যাসে হৃদয়গ্রাহী। বিভিন্ন বানিজ্যিক পত্রিকায় আমার উজ্জ্বল উপিস্থিতি জনপ্রিয়তা না দিলেও প্রিয় জনতা দিয়েছে’।

তিনি ‘জনপ্রিয়তা’ এবং ‘প্রিয় জনতা’ দুইই কোঁচড়ভরে কুড়িয়ে নিয়ে গেছেন। পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় তাঁর জন্ম হলেও বাংলাদেশ তাঁর পিতৃপুরুষের দেশ। এদেশের আনাচে কানাচে অবিরাম ঘুরে ঘুরে তিনি শ্বাস নিয়েছেন। বুকভরে গ্রহণ করেছেন বরিশালের দোহারগাতির আঁতুড়ঘ্রাণ। ঢাকার জাতীয় কবিতা উৎসব থেকে টাঙ্গাইল, সিলেট, চট্রগ্রাম, পাবনা, রংপুর, কিশোরগঞ্জ কোথায় তিনি যান নি! তুবড়ি আতসের মতো ছড়া ফোটাতে ফোটাতে তিনি ছড়িয়ে যেতেন সর্বত্র। বাংলাদেশের জেমস, আইয়ুব বাচ্চু, জুয়েল আইচ, লুৎফর রহমান রিটন, আমীরুল ইসলাম থেকে হালের নবীন ছড়াশিল্পীদের সঙ্গেও ছিল তাঁর তুমুল সখ্যতা। কলকাতায় বেড়ে উঠলেও তিনি বারিশালের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে পারতেন অনর্গল।

২০০৭ সালের এপ্রিলে ঢাকা থেকে ‘ছোটদের পত্রিকা’ প্রকাশ হলো। সম্পাদক: আবু হাসান শাহীন। সেই পত্রিকা খুলে দেখি দীপ মুখোপাধ্যায়ের ছড়া ‘ছুতোনাতা’। ছড়া পড়ে মুগ্ধতার সীমা ছাড়াল। বিষয় বৈচিত্র দৃশ্যকল্প চকচকে ও আধুনিক। ছন্দের ধ্বনিগত পারম্পর্যে কানের সঙ্গে প্রাণকেও নাচিয়ে ছাড়ল। এরপর দীপ মুখোপাধ্যায়ের বই কোথায় পাওয়া যায় হন্যে হয়ে খুঁজতে লাগলাম। সে সময় রকমারি ডট.কম অথবা অন্য কোনো অনলাইন প্লাটফর্ম ছিল না। একবার ঢাকায় গেলাম। শাহবাগের বইয়ের দোকানে ঘুরতে ঘুরতে দীপ মুখোপাধ্যায়ের একটি বই পেয়ে গেলাম– ‘ছড়া যখন হাসে’। ছড়ার ছবিগুলো দেখে মন জুড়িয়ে গেল। বইটিতে ‘ছুতোনাতা’ ছড়াটিও আছে দেখে আরো ভাল লাগল।

‘সমস্ত দিন করছে টো টো / বইখাতা সব ফেলে
ফেল করেছে মাধ্যমিকে / স্কুল পালানো ছেলে।
নতুন একটা দ্বি-চক্রযান / পাশ করলেই পাবি
ওর কিছুটা ভালোর জন্য / করছি ভাবাভাবি।
গড়ায় বছর এমনি করে / নানান ছুতোনাতায়
বইগুলো হয় আচ্ছাদিত / ক্যালেন্ডারের পাতায়
ফেল করেছিস এই বছরেও / মন ছিল তোর কীসে?
বললে ছেলে- ‘ব্যস্ত ছিলাম / সাইকেল প্রাকটিসে’।

‘ছড়া যখন হাসে’ বইটিতে চমৎকার সব ছড়া আছে। সরস বিষয় বৈচিত্র, নিখুঁত ছন্দ আর ধ্বনির অপূর্ব সমন্বয় সব ছড়াতেই। ওই একমাত্র ছড়াগ্রন্থ আঁকড়ে ধরে অনেক বছর কেটে গেছে। প্রায়ই গভীর রাতে যখন ঘুম আসত না, তখন বুকশেলফ থেকে বইটি টেনে নিয়ে পড়তে বসে যেতাম। ব্যাক্তিগত সম্পর্কের খাতিরে নয়, ছড়ার শক্তিই দীপ মুখোপাধ্যায়কে আমার কাছে আরাধ্য করে তুলেছিল।

২০১৯ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘চন্দ্রাবতী আন্তর্জাতিক শিশু সাহিত্য সম্মেলনের’ আমন্ত্রণ এলো। অনুষ্ঠানে হাজির হয়ে দেখি বাংলা একাডেমির ঘর-বারান্দা-উঠোন শিশু সাহিত্যে একাকার। প্রায় চারশত লেখক, কবির উপস্থিতি। বাংলাদেশসহ পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা থেকেও শিশুসাহিত্যের নামকরা লেখক, প্রকাশক, সম্পদক অতিথি হয়ে এসেছেন। পশ্চিমবঙ্গের শিশুসাহিত্যিক দলে দীপ মুখোপাধ্যায় এসেছেন শুনে ভীষণ আনন্দ হলো। মঞ্চের দিকে ছুটলাম দীপদর্শনে। কিন্তু পেলাম না। মঞ্চে নেই, অতিথিদের জন্য রাখা প্রথম সারির গদিওয়ালা চেয়ারে নেই, এমনকি দর্শক সারিতেও নেই। আবারও ছুটলাম আরেকটা কক্ষে। ছড়াপাঠের মঞ্চ যেখানে। সেখানেও নেই দেখে বাইরের লবিতে এসে দাঁড়ালাম। লবিতে ছোট ছোট জটলা, কফির লাইন। সবাই আড্ডা দিচ্ছে, ছবি তুলছে। একটা জটলা দেখলাম বেশ জমজমাট। তুমুল হৈ-হল্লা মুখর। আমি এগিয়ে গেলাম। এক বন্ধু বলল- ওই যে দীপ মুখোপাধ্যায়। ফর্সা, ছিপছিপে লোকটা। পরনে সুবজ পাঞ্জাবী-কোটি, কাঁধে ঝোলা। তরুণ কিছু ছাড়াকারদের ঘিরে ঠাট্টা-কৌতুকে মেতেছেন তিনি। কিছুক্ষণ পর পর হাসির হল্লা। আমি এগিয়ে গিয়ে পরিচিত হতেই কাছে টেনে নিলেন।

দীপ মুখোপাধ্যায়কে ভাবতাম ধীরস্থির আত্মনিমগ্ন লেখক হবেন। মঞ্চ অথবা নরম গদির প্রথম সারিতে তিনি থাকবেন। তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত পাওয়াটাও হবে হাতি দর্শনের মতো। কিন্তু বাস্তবে দীপ মুখোপাধ্যায়কে দেখলাম তুখোড় আড্ডাবাজ, গায়ে পড়ে আপন করে নেওয়া মানুষ। খ্যাতিমান লেখকের এমন ভড়ংবর্জিত, সরল ব্যাক্তিত্ব দেখে ভিতরের অন্ধকার কিছুটা ধুয়ে গেল। আড্ডায় পরিচয় ঘটলেও সম্পর্ক গড়ে ওঠে একটু পরে।বাংলা একাডেমির গেটে। তিন বন্ধু মিলে রংচা খাচ্ছি, হঠাৎ হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন দীপদা। দোকানীকে বললেন- এক প্যাকেট ব্যানসন দিন তো। আমরা কৌতুহলী হতেই বললেন, জানেন আমার প্যাকেটটা না হোটেলে ফেলে এসেছি। সিগারেট ছাড়া কি চলা যায় বলুন? ভক্ত বলে কথা। বেশ জোর জবরদস্তি করেই সিগারেটের দামটা মিটিয়ে দিলাম। উনি সংকোচে না! না! করতে করতে পরাস্ত হলেন। আমি বললাম, এক প্যাকেটে কি সারাদিন চলবে দাদা? দীপদা বললেন, আরে আমি তো সিগারেট খাই না। খায় পেসমেকার। দাদার কথা শুনে চমকে উঠলাম। কী ভয়ংকর কথা!

দীপদাকে যতই দেখি ততই মুগ্ধ হই। চটুল চুটকি আর ছন্দকথার ফুলকিতে প্রাণবন্ত । ছোট-বড় সবাই তাকে নিয়ে টানা-হ্যাঁচড়া করে। সেদিন অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে তুমুল আড্ডা হলো। গল্প হলো। ফেসবুকে নিজেই আমাকে সংযুক্ত করে নিলেন। প্রসঙ্গক্রমে একের পর এক মুখস্ত বলে গেলেন অপূর্বসব ছড়া। ভূতের ছড়া, ভাতের ছড়া, রাজনীতির ছড়া, প্রেমের ছড়া। ছড়া থামিয়ে একফাঁকে বললেন, ‘জানেন আমার কী সৌভাগ্য! আমি একবার ভিখিরিদের নিয়ে ছড়া লিখেছিলুম। সেই ছড়া তুমুল জনপ্রিয় হয়েছিল। কিছুদিন পরে দেখি এক ভিখিরি আমারই ছড়া কাটতে কাটতে আমার বাড়িতে ভিক্ষে করেতে এসেছে। একবার ভাবুন তো ব্যাপারটা? আমি সেই ভিখিরিকে দশটাকা ভিক্ষে দিয়েছিলুম’।

চন্দ্রাবতীর শিশুসাহিত্য সম্মেলন শেষ হল। আমরা ফিরে এলাম যার যার গন্তব্যে। বড় লেখকদের সঙ্গে ফোনে কথা বলতে বা সঙ্গ পেতে আমার জড়তা চিরকাল। দূরত্বে দাঁড়িয়ে দেখার দূর্বলতা আমার। তাই প্রবল ইচ্ছা করলেও হুটহাট ফোন করতে কেমন যেন লাগে। করোনাকাল শুরু হয়ে গেল। সবাই বন্দী। ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার আর হোয়াটস অ্যাপ আমাদের সম্বল। এক সন্ধ্যায় দীপদা’র ফোন পেয়ে লাফিয়ে উঠলাম। রিসিভ করতেই কোন সম্বোধনের তোয়াক্কা না করে বললেন- সাব্বির, এইমাত্র দুটো কিশোর কবিতা লিখে শেষ করলাম। একটু শুনুন তো, কেমন হলো। তিনি ঘোরগ্রস্থ হয়ে বলতে লাগলেন তার অসামান্য সুন্দর কবিতা:

একটুখানি

আয়রে কাগা আয়রে বগা
মাঠ-বেমাঠের হিনচে ডগা মানকচুবন
আমরুলিশাক কলমিলতা
তোদের সঙ্গে মনের কথা বলব এখন ।

জলপিপি আয়, শোন পাতিহাঁস
পাগলাটে খুব বইছে বাতাস উথালপাথাল
চোখের সামনে সেই কুঁড়েঘর
জামরুলগাছ নাক বরাবর নেই কতকাল।

ঢেউ তোলে ধানগাছের চারা
আলপথে ঘর ফিরছে যারা সব চেনামুখ
শিউলিফুলের গন্ধ হলো
সন্ধে হতেই বন্ধ হলো রোদের চাবুক ।

দিন ফুরোতেই রাত নেমে যায়
আদুর বাদুড় গাছের শাখায়, শিয়াল ডাকে
আলতো আলো ছায়ায় দোলে
পাখির ছানা মায়ের কোলে পাতার ফাঁকে।

আকাশ থেকে রুপোর ঘড়ায়
চতুর্দিকে জোছনা ছড়ায় চাঁদ-তারারা
সে রাত্তিরে আমিও তখন
একটু আধটু মন উচাটন আত্মহারা।

দিগন্তরে আলোর ফিতে
জুঁই-জোনাকির কী ইঙ্গিতে ঝলমলানি?
ঘাসের ডগা বুনছে চাটাই
ইচ্ছে তোদের সঙ্গে কাটাই একটুখানি ।

দিনে দিনে দীপদা’র সঙ্গে বন্ধুত্ব বাড়তে লাগল। প্রায়ই ফোন করে ছড়া শোনাতেন, গল্প করতেন। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ তুই-তুকারিতে বিশ্বাসী। কিন্তু মাঝেমধ্যে তিনি ‘আপনি’ সম্বোধন করতেন। আমার বাড়ি সাতক্ষীরায় শুনে বলতেন- সাতক্ষীরার ইছামতির এপারেরই টাকিতে আমার শালির বাড়ি। খুব বেশি দূর নয়। একদিন চলে আসব সাতক্ষীরায়। বললাম, সে তো খুব খুশির কথা। তিনি বললেন- আমি সাতক্ষীরায় গেলে কোর্মা পোলাও খাওয়ানোর প্রয়োজন নেই। একটু ইছামাছ খাওয়াবেন। ইছামাছ মানে কি জানেন তো? বললাম- জানি দাদা। হ্যাঁ চিংড়ি মাছ। মোর বাড়িও কইলাম বরিশাল। মুই বরিশাইল্যা পোলা। বলেই হো হো করে হাসলেন।

দীপদা বাংলাদেশকে নিজের দেশ ভাবতে গৌরব বোধ করতেন। এদেশে অসংখ্য বন্ধু তাঁর। নবীন-প্রবীন সবাই। সবার সঙ্গেই আত্মার সম্পর্ক। যখন বলতেন- আমার বন্ধু রিটন, অভিনেতা আফজাল হোসেন, জুয়েল আইচ, আমীরুল ইসলাম তখন তাঁর বুকটা যে ফুলে উঠত তা টের পেতাম। বন্ধুত্বের টানেই তিনি বারবার বাংলাদেশে এসেছেন। শৈশবে আম-কাঁঠালের ছুটিতে মামার বাড়ি বেড়াতে গেলে আমরা যেমন বেসামাল হয়ে পড়তাম, লাগামছাড়া দস্যিপনায় দাপিয়ে বেড়াতাম, দীপদাও তেমনি বাংলাদেশ চষে বেড়াতেন। বাংলাদেশি বন্ধুরাও তার কলকাতায় বাসায় গেলে আন্তরিকভাবে আপ্যায়ন করতেন। দীপদার স্ত্রী শুভ্রা। যখনই দাদার সঙ্গে কথা হতো, মাঝপথে বৌদিকে ধরিয়ে দিয়ে বলতেন- আপনার বৌদির সঙ্গে কথা বলুন। বউদির সঙ্গে অনেকবার কথা হয়েছে। কথা বলে মনে হয়েছে সহজ আন্তরিক মানুষ।

দীপ মুখোপাধ্যায় কেবল ছড়াকবি ছিলেন না। গদ্যসাহিত্যেও ছিলেন অসামান্য। তিনি গল্প লিখেছেন। উপন্যাস লিখছেন। সেসব গদ্য সরল সরস কিশোরজগতের উপাদানে অনন্য। নেংটির পৃথিবী, রাত বিরেতের জঙ্গলে, ভতিষ্যতের ভূত, রূপকথাপুর, শামুক দ্বীপের কবিরাজ, গোলকুন্ডার হিরে, টালিগঞ্জের নবাব, প্যাঁচার পেঁচালি ইত্যাদি। বাংলাদেশেকে নিয়ে তিনি লিখেছেন চমৎকার গদ্য: ‘স্মৃতিমদির জীবনচর্চা আর বাংলাদেশের বন্ধুরা’। যার প্রথম পর্ব প্রকাশ পেয়েছিল ২০১৯ সালে। দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার ঈদ সংখ্যায়। তাঁর গদ্যের একটি অংশে তিনি বাংলাদেশের বন্ধুদের সম্পর্কে লিখেছেন:

“এক মেদুর অতীত আমাকে টানতে থাকে। আমার শেকড়ও তো বরিশালের দেহেরগতি গ্রামে। টের পাই নিজের ব্যবহারিক অসম্পৃক্তিরও। লক্ষ্য করলাম বাংলাদেশের বন্ধুদের সঙ্গে জীবনচর্চার সান্নিধ্য বেশ উপভোগ্য। তারা চ্যানেলের দৌলতে আলাপিত হলাম আইয়ুব বাচ্চু, জেমস, চ্যানেল আই কর্তা সাগর ভাই কিংবা জাদুকর জুয়েল আইচের সঙ্গে। আমি, শ্যামলকান্তি আর প্রয়াত শিবায়ন ঘোষ কবি সালেম সুলেরির আতিথ্যে ছড়ার আসরে অবতীর্ণ হলাম, ছড়া আনন্দের অংশী হতে। তবে পরের বছর জাতীয় কবিতা উৎসবে ছড়াকার হিসেবে দাওয়াত পাওয়াটা সত্যিই একটা ব্রেকিং নিউজ। লক্ষাধিক জন-সমাগমে ছড়াপাঠ উল্লসিত হওয়ার মতোই ঘটনা। সৈয়দ আল ফারুক, আনজীর লিটন, তপংকর চক্রবর্তী, রহীম শাহ, ফারুক হোসেন, রাশেদ রউফ অথবা আসলাম সানি বাড়িয়ে দিলেন তাদের সৌহার্দের হাত। কইলজায় তহন তাজা অক্সিজেন ঢোকছে। ঢাকা থেকে প্রকাশিত ছড়াগ্রন্থ উৎসর্গ করেছি প্রিয় কবি আল মাহমুদকে। তিনি একটি রচনায় ভুলক্রমে আমাকে বাংলাদেশের ছড়াকার বলে উল্লেখ করলেন। এর আগে অবশ্য লুৎফর রহমান রিটনের সঙ্গে কলকাতায় ব্যাটে-বলে হয়ে গিয়েছে। ঋষিতুল্য শিল্পী ধ্রুব এষ কিংবা কবি-কথাশিল্পী ইরাজ আহমেদ এবং তদীয় স্ত্রী আবিদা নাসরিন কলি আমার অভেদাত্মা হয়ে উঠল। গভীর আত্মীয়তাবোধে আবদ্ধ করল ব্যতিক্রমী আমীরুল ইসলাম। এমন ঐকান্তিক ও বহুমাত্রিক হৃদয়বান সুহৃদ জীবনে কম এসেছে। যেমন ছড়ার হাত তেমনই পাণ্ডিত্যে টইটম্বুর। রসিকতা করে বলত- দীপদা, তোমাকে আমি অন্তত পাঁচ বছর প্রতিপালন করার ক্ষমতা রাখি। এটা শিশুসাহিত্যের জন্য দায়বদ্ধতা।

আমার প্রধান মুরুব্বি হয়ে উঠলেন কিংবদন্তি ছড়াকার রফিকুল হক দাদুভাই। মধ্য বাসাবো থেকে শান্তিনগরের বাসায় এখনও আমার অবারিত দ্বার। শুঁটকি ভর্তা থেকে গরুর ভুনা- চাইলেই ফাতেমা ভাবির সৌজন্যে টেবিলে হাজির। এই আন্তরিকতা পশ্চিমবঙ্গ আমাকে দিতে পারেনি। আমার কোলে গাঢ় প্রীতির বন্ধনে দাদুভাইয়ের কন্যা জয়িতার ছবি। এখনও তাদের বসার ঘরের দেয়ালে টাঙানো। সম্পদের প্রাচুর্য না ঢাললেও ছড়া আমাকে ঐক্যের ব্যাপকতায় নতুন নতুন সম্পর্কের গভীরতায় জড়িয়েছে। এবার কোন হান দিয়া কি বৃত্তান্তে যামু তা কী কওন যায়? এহানে মুরুব্বি মহাজন তো আপনেরাই”।

দীপ মুখোপাধ্যায়কে সবাই ভালবাসত। বন্ধুরা মজা করে তাঁকে ডাকত ‘বুড়োখোকা’ বলে। কেবল বন্ধু-স্বজন নয়, পশুপাখিদের প্রতিও তাঁর মমতা ছিল দেখার মতো। মৃত্যুর বেশ কিছুদিন আগে নিজের পোষা কুকুরের মৃত্যুতে তিনি মুষঢ়ে পড়েছিলেন। প্রায় বিলুপ্ত পাখি পেঁচার প্রতিও ছিল দুর্বার আকর্ষণ। ‘প্যাঁচার পেঁচালি’ নামে তিনি একটি গ্রন্থও লিখেছেন। সেই গ্রন্থে তাঁর গদ্যভাষার জাদু দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। ফোনে জানিয়েছিলাম সেই মুগ্ধতার কথা। তিনি আপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন। একদিন দীপদা আমাকে বললেন, সাব্বির গদ্য লেখেন না? বললাম- না দাদা। পারি না। অল্প-বিস্তর কসরৎ করে দেখেছি। ভীষণ পরিশ্রমের কাজ। তিনি আমাকে উৎসাহ দিলেন। বললেন- আপনার শৈশব জীবন কি গ্রামে কেটেছে? বললাম- হ্যাঁ দাদা। তাহলে লিখুন না। যা দেখেছেন অল্প অল্প করে তাই লিখুন, দেখবেন অনেক হয়ে গেছে। দাদার কথায় সবসময় উৎসাহ পেতাম। তিনি পশ্চিমবঙ্গের বাঘা বাঘা পত্রিকায় লিখতেন। পূজোবার্ষিকীর প্রায় সকল পত্রিকায় তার ছড়া থাকতো। দীপদা গর্ব করে বলতেন- আমি সন্দেশে লিখেই লেখক হয়েছি। সন্দেশ আমার পরিবারের পত্রিকা। আপনিও সন্দেশে লেখা পাঠাবেন। আমি দেখব।

‘ছড়া-কবিতার সীমান্ত সমস্যা’ শিরোনামে তাঁর একটি চমৎকার গুরুত্বপূর্ণ গদ্য রচনা রয়েছে। পদ্যকবিতা ও ছড়ার যে কাঠমোগত পার্থক্য এবং পাঠকের সংজ্ঞাগত গোলকধাঁধা, সেটিই তিনি সমাধানের পথ খুঁজেছেন। সুধীসমাজের কাছে ছন্দোবন্ধ শিশুতোষ পদ্যকে ছড়া এবং অতিমর্যাদার কারণে ছড়াকে কবিতা হিসাবে আখ্যায়িত করার প্রবণতাকে তিনি চিহ্নিত করেছেন। ছড়া-কবিতার এই সীমান্তগত সমস্যার জন্য তিনি বিনয়ের সঙ্গে শিল্পবোধের অসচ্ছতাকে দায়ী করেছেন।

সর্বত জীবন ছাপিয়ে দীপ মুখোপাধ্যায় ছিলেন মনেপ্রাণে ছড়াকার। ছন্দই তাঁর ভাব প্রকাশের একতারা। ছড়াতেই তিনি ছড়িয়ে থাকতে চেয়েছেন আজীবন। পেয়েছেন খ্যাতি, ছাড়কারের মর্যাদা। অগণিত পাঠক-বন্ধুর ভালবাসা এবং রাষ্ট্রীয় সম্মান। তাঁর সান্নিধ্যে ছড়ারাও হয়ে উঠেছে কীর্তিময়-কালজয়ী। একদিনে কেউ লেখক হন না। যাপিত জীবনের নিরন্তর সাধনায় আসে সিদ্ধি। তাঁর মৃত্যুতে বাংলা ভাষা তার এক নিবেদিত সাহিত্যস্রস্টাকে হারিয়েছি। আমরা হারালাম অকৃত্রিম ছড়াবন্ধু আদরের বুড়োখোকা দীপ দা’কে।

‘একদিন চলে যাব রাস্তাটা ছাড়িয়ে
গাছপালা ফুল পাখি
শুধু্ই দেখতে থাকি
ঘাসপাতা ধানচারা ডাকে হাত নাড়িয়ে।’