তিসিডোর : মিশ্ররীতির একটি অনবদ্য উপন্যাস- রবিন পাল

 

বই নিয়ে

পাঠস্পন্দন

তিসিডোর; কেতকী কুশারী ডাইসন; প্রথম প্রকাশ : নভেম্বর ২০০৮, আনন্দ পাবলিশার্স – কলকাতা, পৃষ্ঠা : ৮৫৫

তিসিডোর : মিশ্ররীতির একটি অনবদ্য উপন্যাস

রবিন পাল

প্রাণের দায়ে, অনুরোধে অনেক বই আজও পড়তে হয়। কিন্তু আজ বলতে বসেছি এমন একটি উপন্যাসের কথা যা কিনেছি সাগ্রহে, ছাপার গণ্ডগোল ছিল বলে ভারী বইটি ভিড় ট্রেনে করে গিয়ে বদলে এনেছি, আর পড়তে গিয়ে পেয়েছি প্রভূত আনন্দ, পেয়েই চলেছি। আমার কপিটি ৪র্থ মুদ্রণের, এতে প্রমাণ হয় উপন্যাসটি আরো অনেক পাঠক পাঠিকাকে আনন্দ দিয়েছে ইতিমধ্যেই। এই বইটি দুবার পাঠের মধ্যবর্তী সময়ে কলেজ ষ্ট্রীটের পুরোনো দোকান থেকে কিনে ফেললাম কেতকীর লেখা ‘এই পৃথিবীর তিন কাহিনী’ যাতে আছে তিনটি উপন্যাস ও প্রায়োপন্যাস। আমি এই লেখিকাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি না, অবশ্য তাঁর বক্তৃতা শুনেছি, শান্তিনিকেতনে তাঁর রচিত নাটক দেখেছি। সুতরাং মুগ্ধতা নেহাৎই এক অপরিচিত পাঠকের চোখে। অবশ্য, পরিচয় তো মানুষের দু প্রকারের। বইয়ের ফাঁকে ফাঁকে অক্ষর বিন্যাসের ডালপালার আড়াল থেকে যে মানুষটি বেরিয়ে আসেন, যাকে হয়ত বলা যেতে পারে Implied Author, আমি সে পরিচয় আবিষ্কারেই অধিকতর আগ্রহী।

উপন্যাসটি যখন পড়িনি, বাতাসে উপন্যাসটির নাম ভাসছে সবে, তখন একবার মনে হয়েছিল বুদ্ধদেব বসু রচিত ‘তিথিডোর’ (১৯৪৯) উপন্যাসটির কোনো না কোনো প্রেরণা আছে এতে। পড়তে গিয়ে দেখলাম এটি একেবারে ‘ভিন্ন ধরনের বই’। বুদ্ধদেব বসুর উপন্যাসটি লিখতে লেগেছিল ১৯৪৬ থেকে ১৯৪৯, কেতকী না বললেও অনুমান করতে পারি ‘তিসিডোর’ লিখতেও সময় লেগেছে যথেষ্ট। ‘তিসিডোর’ এর পৃষ্ঠা সংখ্যা ৮৫৫ (বু. ব.-র বইটি বর্তমান ছোট হরফের মুদ্রণে ৩২৮)। ‘তিথিডোর’ কেন্দ্রিত এক মধ্যবিত্ত জীবনবৃত্তে, গার্হস্থ্য আনন্দে, স্বাতী ও সত্যেন-এর প্রেম ও কাঙ্ক্ষিত বিবাহে। যদিও বাইশে শ্রাবণ বিষয়ক ১৪-পৃষ্ঠা ব্যাপী বর্ণনা উপন্যাসটির পরিসরকে কিছুটা ‘এপিক’ লক্ষণ দিয়েছে, শেষ ২-পৃষ্ঠার চেতনাপ্রবাহের নিরীক্ষা, সেটাও বুদ্ধদেবীয় প্রবণতার পরিচায়ক। এর অলঙ্করণকে অলোকরঞ্জন baroque বলতে চান। কিন্তু কেতকীর উপন্যাসটির চেহারা একেবারে আলাদা। ছটি পর্যায়ে বিভক্ত এ উপন্যাসে আছে ‘তিসি’ নাম্নী ভদ্রমহিলার পারিবারিক কথা, অনার পোপ নাম্নী জনৈকা বয়স্ক বান্ধবী ও তাঁর বিস্ময়কর পরিচয় বৃত্ত কথা, তিসি পরিবারের টুকরো এবং সামগ্রিক ভ্রমণকথা, সেই সূত্রে পারিবারিক বিবরণে, ভ্রমণ বর্ণনায়, নানা বই ও নানা প্রসঙ্গ উল্লেখ, তার বিচারকথা। আর একটি বড়ো অংশ হল—জীবনানন্দ দাশ রচিত ‘সফলতা নিষ্ফলতা’ নামক উপন্যাসটির বহিরঙ্গ ও অন্তরঙ্গ উপস্থাপনা, টীকাকার ভূমেন্দ্র গুহর নানা ভ্রান্তি, প্রসঙ্গত: জীবনানন্দের জীবনী, অন্ততঃ দুটির, বুদ্ধদেবের আত্মজৈবনিক রচনা, পত্র প্রাসঙ্গিকী। রবীন্দ্রনাথ বিষয়েও অনেক কথা আছে। ছোটখাট প্রসঙ্গ অজস্র, যেমন – ভাষা, শব্দ বিচার, শব্দার্থ পরিবর্তন। এই অর্থে, এটি একেবারেই মিশ্র রীতির উপন্যাস, যা নিয়ে কেতকীর অনেক কথা আছে, সে কথায় পরে আসা যাবে। আপাতত বলি, ১৯৭৭-এ অলোকরঞ্জন বলেছিলেন—’Virginia Woolf’s description of the Novel as a mixed form fits Buddhadeva’s novels very well. For his novels are a medley of all the genres. (‘Buddhadeva Bose’, Sahitya Akademi) কিন্তু আমার মনে হয় অলোকরঞ্জনের এই মন্তব্য বুদ্ধদেবের ক্ষেত্রে যতটা প্রযোজ্য তার থেকে অনেক বেশী প্রযোজ্য কেতকীর উপন্যাসগুলির ক্ষেত্রে। তাঁর ‘রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্‌তোরিয়া ওকাম্পোর সন্ধানে’ (১৯৮৫) এবং ‘তিসিডোর’ (২০০৮) এই মিশ্ররীতির উপন্যাসের অনেক সার্থক উদাহরণ।

জীবনানন্দ রচিত উপন্যাসটির এই উপন্যাস-অংশটুকুর নির্যাস আগে উত্থাপন করি। ‘অপ্রত্যাশিত’ পর্বচিহ্নিত অংশে ৯৩ পৃষ্ঠায় পাঠক জানছেন তিসির বোন তিল দিদিকে পাঠাচ্ছে ‘সফলতা-নিষ্ফলতা’ নামের উপন্যাসটি কারণ – ‘যেটা তোর পড়া দরকার’। কিন্তু কেন? সে কি actual author ব্যক্তি বুদ্ধদেব সাহিত্যিক বুদ্ধদেবের প্রতি একটু বেশী পক্ষপাতী বলে, বুদ্ধদেব জীবনানন্দ বাংলা আধুনিক কবিতার দুই উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক বলে, লেখক বুদ্ধদেবীয় কবিতার একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিস্তৃত ভূমিকাসহ অনুবাদ সংকলন প্রকাশ করেছেন বলে। এ-কথা ওঠে এই কারণে যে কেতকীর প্রবন্ধ ও পুস্তক সমালোচনার সঙ্গে যে-পাঠকের পরিচয় আছে তিনি জানেন, তাঁর ‘পড়া দরকার’-এর সীমানা বিস্ময়করভাবে দিগন্তলীন। কারণ সাহিত্য বাদেও তিনি বিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব, সঙ্গীত, নাটক অনেক কিছুর প্রতিই আগ্রহী তা তিনি নিজেই জানিয়েছেন নানা রচনায়। সে যাক্‌। এই ‘চাবিওয়ালা উপন্যাস’টির চাবি খুলতে খুলতে চলেছেন কয়েকশ পৃষ্ঠা জুড়ে, এবং কখনই একটানা নয়, ফাঁকে ফাঁকে এসেছে উপন্যাসের বৈচিত্র্য-প্রত্যাশা মেনে অনার পোপ প্রসঙ্গ, অন্যান্য প্রসঙ্গ। জীবনানন্দের উপন্যাসটির গল্পকথক নিখিল, যার চোখ দিয়ে আসছে বাণেশ্বর (যাতে খানিকটা বুদ্ধদেব আর গৌণতঃ বিষ্ণু ও অচিন্ত্য), শঙ্কর (যাতে প্রেমেন্দ্র, শৈলজা) এটা উপন্যাসটির সম্পাদক টীকাকার ভূমেন্দ্র গুহর কথা। আলোচনা শুরু নিখিলের বোর্ডিং হাউজ থেকে, নিখিল মানসিকতা, জীবনানন্দের ভাষা প্রসঙ্গ, বোর্ডিং এর দু’-একটি চরিত্র, নারীবিষয়ক মনোভাব, ‘কারুবাসনা’ উপন্যাসের বনলতা নাম্নী মেয়েটির সঙ্গে আলোচ্য উপন্যাসের তুলনা, অষ্টম অধ্যায়ে বাণেশ্বর চরিত্রায়ন প্রসঙ্গে ভূমেন্দ্রর মন্তব্যের ভ্রান্তিবিচার, নিখিল বাণেশ্বরের বেকারত্ব, ব্যক্তি বুদ্ধদেব ও বাণেশ্বরের হাসির তুলনা, খেলা দেখতে যাওয়া, নিখিল ও বাণেশ্বরের পাঠ অভ্যাস, জলপাইহাটি উপন্যাসে ‘বাঞ্চোতি’ শব্দের ব্যবহার, অশ্লীল অন্যান্য শব্দ ব্যবহার, রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্রে রেখে নিখিলের ঈর্ষা, কল্লোলের বিদ্রোহ, রবীন্দ্রনাথের ‘পারস্যে’ গ্রন্থের বিশেষ প্রসঙ্গ, একেবারে উপন্যাসটির অধ্যায় ধরে ধরে নানা দিকের কথা তিনি বিচার করেছেন। তিসির মন্তব্য – ‘বুদ্ধদেবের প্রতি জীবনানন্দ অবিশ্বাস্য রকমের অবিচার করছেন।’ (পৃ. ২৪১) বাঙালির ও এই দুই উপন্যাস বর্ণিত লেখকের ডিম খাওয়া নিয়ে আলোচনা চমৎকার। সিটি কলেজ থেকে জীবনানন্দের চাকরি যাওয়া, জীবনানন্দ বা বুদ্ধদেবের রচনার অশ্লীলতা বিষয়ক অভিযোগ, বুদ্ধদেবের একাধিক উপন্যাসকে আলোচনায় টেনে আনা, স্ল্যাং ব্যবহার, টমসন-কৃত রবীন্দ্র-অনুবাদ প্রসঙ্গ, ভূমেন্দ্রর ধূর্জটি বিষয়ক অনুমান, সঙ্গমচেতনা, শ’ প্রসঙ্গ, রবীন্দ্রনাথের স্পেন যাত্রা নিয়ে ভূমেন্দ্রর ভুল, প্রভাঁস, ত্রুবাদুর, কীটসের দুটি বিখ্যাত কবিতা বিষয়ে ভুল টীকা—এরকম অজস্র প্রসঙ্গ আছে।

লেখিকা সদাই সচেতন লেখাটি যাতে প্রবন্ধে পর্যবসিত না হয়ে যায়। তাই জীবনানন্দ-বুদ্ধদেব প্রসঙ্গায়ন বলতে বলতেই তিনি সমান্তরাল ভিন্ন গল্পে চলে যান, ফিরে আসেন, চলে যান, অন্য একটি প্রসঙ্গে যান, এভাবে ব্যক্তি থেকে ভিন্ন ব্যক্তিতে, প্রসঙ্গ থেকে ভিন্ন প্রসঙ্গে যাওয়া এবং উপন্যাস-রসকে অব্যাহত রাখতে পারা কঠিন কার্য, গ্রেট আর্ট, তার পরিচয় রাখতে পারেন। যেমন, ‘বারো’ অধ্যায়ে (পৃ. ৩০৪ থেকে) শুরু হয় তিসির স্বামী লরেন্স, পুত্র রাফায়েল এর নিউ ইয়র্ক জাহাজঘাটার প্রসঙ্গ, স্বামীর আঙুল ছাপ নেওয়া, থেকে ফিরে যান বাণেশ্বরের ভ্রমণ-ফ্যান্টাসি প্রসঙ্গে, তার থেকে জীবনানন্দের নায়কের প্রিয় কাব্যভাবনায়, তার থেকে ‘অপরূপ’ শব্দের নানার্থে, তার থেকে ভূমেন্দ্রর টীকার অসম্পূর্ণতা প্রসঙ্গে, তার থেকে জীবনানন্দর এ উপন্যাসে ‘কোনো’র পরিবর্তে ‘কোনও’ ব্যবহার কেন, সে কি পাণ্ডুলিপিতে ছিলো? তার থেকে জীবনানন্দের সমুদ্রস্পর্শী কিছু পঙ্‌ক্তিচয়ন, তার থেকে রবীন্দ্রের ক্যানাডা ভ্রমণ, তথ্য বিচার, রবীন্দ্রের স্পেন ভ্রমণ সংক্রান্ত ভুল তথ্য পেশ, থেকে ‘তিথিডোর’ উপন্যাস স্রষ্টার মেয়েদের সম্পর্কে মনোভাব, ভূমেন্দ্রর ভ্রান্তি নির্দেশে বুদ্ধদেবের একাধিক গল্প উপন্যাস উদাহরণ, বাংলা উপন্যাসে একটা কালে realism-এর জোয়ার আসা নিয়ে বুদ্ধদেবের মতামত, প্রখ্যাত ফরাসী পিয়ানিস্ট Charles Camille Saint-Saens, ‘জলপাইহাটি’তে জীবনানন্দ বর্ণিত সাহেব মেমদের কাণ্ডকারখানা, সাহিত্যতত্ত্বের দাপট, বলতে বলতে অ্যাডাম রাফায়েলদের বন্ধু অলিভারের জীবনের একটি সংকট—একটি বর্ণিল ট্র্যাপেষ্ট্রির মতো, যার তুচ্ছ, নগণ্য, উপন্যাসস্থ প্রসঙ্গ, তিসির পারিবারিক প্রসঙ্গ, শব্দার্থের বিচার থেকে তরুণ তরুণীদের প্রেম—সব মিলিয়ে আগ্রহ অটুট রাখার যে আর্ট এ-অধ্যায়ে তার তুলনীয় কিছু বাংলা উপন্যাসে পেয়েছি বলে মনে পড়ে না। পাঠের আগ্রহ বজায় রাখার এই সযত্ন নিপুণ বিন্যাসের জন্য বারেবারে তারিফ জানাতে ইচ্ছে করে।

উপন্যাসটির আলোচনার এই বিচিত্র সুতোর কাজের মধ্যে ইজরায়েল লেবানন ইরাক হিজবুল্লা প্রভৃতির সাম্প্রতিক বিশ্বরাজনীতির এই প্রসঙ্গকে রচনাটির বিশ্বপ্রসারণ তৈরি করতে গিয়ে, রবীন্দ্রনাথের পারস্যভ্রমণ এই প্রসঙ্গেই, একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। কিন্তু আমার মনে হয়েছে এই প্রসঙ্গকে ছিটে ফোঁটা করে বিভিন্ন অধ্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়া তেমন সুপ্রযুক্ত হতে পারেনি। কারণ হয়ত—তিসি, তার স্বামী, ছেলেরা, বা অন্য যেসব চরিত্র তারা কেউই রাজনীতির জগতের ভাবনায় খুব বেশী ভাবিত নয়, কি ঘটছে তা জানা ছাড়া অতিরিক্ততা চরিত্রের মধ্যে নেই।

এটা খেয়ালে রেখেই হয়ত ‘জাদুবাক্স’ পর্বে ডিম খাওয়ার প্রসঙ্গ থেকে ফুল চেতনায় (যা এ উপন্যাসে বারংবার আসে, তিসির মানসিকতার দ্যোতক) থেকে অনারের স্কটল্যাণ্ড ভ্রমণের কয়েকটি দৃশ্যে, তার থেকে ইংলণ্ডে বিংশ শতাব্দীর একটা পর্বে নরনারীর মধ্যে আত্মসম্মান বোধের কথা, সমাজবিপ্লবের রুশ বা চীন মডেল, তার থেকে ইরাক, পোলাণ্ড, আফ্রিকা বা ল্যাটিন আমেরিকার কথা—এর ফাঁকে ফাঁকে অনারের শিল্পীজীবন, কাজের উপকরণ কেনার চিঠি, বটানি, থিওলজি, ইটালি নিয়ে অনার-এর বিচিত্র আগ্রহ, ‘অনারের দেওয়া নেওয়ার দুনিয়া’ আমাদের ও উপন্যাসের একটি চরিত্র হিসেবে তার প্রতি আকৃষ্ট করে তোলে। লেখা হয়ে যেতে পারত নীরস, কিন্তু আমার অন্তত তা মনে হয় নি। মুহূর্তে তিনি চলে যান The Old Market Woman ছড়াটির মধ্যে, পুরো ছড়াটিই তুলে দেন, সেখান থেকে বুদ্ধদেব বসু রচিত ‘মহাভারতের কথা’ থেকে কুকুর প্রসঙ্গে, প্রবন্ধের পাশে ‘স্বাগত বিদায়’ কবিতা থেকে ক্রমান্বয় হেঁটে যাওয়া জীবন উপলব্ধির কথায়, তার থেকে উদ্যান বৃক্ষের বিশেষ দক্ষতাচর্চায়, আর্ট হিস্ট্রি বিভাগের পুষ্প জিজ্ঞাসার উত্তর, তার থেকে হাঙ্গেরীয় শহর নগর নামের প্রসঙ্গ তার থেকে কলকাতা নামের, নানা দেশীয় পুরাবৃত্তে ‘দুরন্ত সত্তার কথা’, তার থেকে পুনরায় জীবনানন্দের উপন্যাস—যেন সমে ফিরে আসা। এই দূরে যাওয়া, এই কাছে আসা, কিন্তু কেন্দ্রভূমিটি আয়ত্তে রাখা, একটা থেকে আর একটায়, আমি যেকটা পড়েছি, কেতকীর অন্যান্য লেখায় এতো বিচিত্রতায় ছড়িয়ে ছিল না। তিসির মতোই অনার চরিত্রটি বিচিত্র জিজ্ঞাসায় ভরপুর। ফলে ন্যারেটরটি, তার বর্ণিত চরিত্রটি দুজনেই এবং স্বভাবত: স্রষ্টার চরিত্রটিও পাঠকের কাছে সমান ভাবে উন্মোচিত হতে থাকে। অনারের চিঠিপত্র, জীবনানন্দর উপন্যাস, সব কিছুই তিনি ‘একটু ডিটেলে বুঝতে চান’ এবং পাঠককেও যথাসম্ভব প্রাঞ্জলতায় তা বুঝিয়ে ছাড়েন। এই তিনজনেরই আছে ‘একটা অত্যন্ত সজীব জ্ঞানপিপাসু মন’। যেমন—বটস্‌ওয়ানা কোথায় জানতে গিয়ে মানচিত্র খুলে বসেন, ব্যক্তি নামের শেষাংশে ‘মারি’ ও ‘মারে’ গুলিয়ে ফেলা (ভূমেন্দ্রর) দেখিয়ে দেন। প্রাচীন তুরস্ক বিষয়ে বইয়ের অর্ডার অনারের পোলিশ উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশের ব্যাপারে পেঙ্গুইনকে অনুরোধ, উপন্যাস রচয়িতা বারবারা পিম বিষয়ে আগ্রহ, অ্যালেথিয়া হেয়টার এর শার্লটি ইয়ঙ বিষয়ে আগ্রহ, আফিং ও রোমান্টিক কল্পনা বিষয়ে আগ্রহ, লিওনার্দো দা ভিঞ্চির পৃষ্ঠপোষক লুদোভিকো তার পিতার ক’ নম্বর পুত্র এ-বিষয়ে ভুল সংশোধন করে অনারের চিঠি, ইউরোপের কোর্ট বিষয়ক জিজ্ঞাসা—এই খুঁটিনাটি জিজ্ঞাসা, গৌণ প্রান্তর – তিসি বলেই দেন—এই স্কলারশিপ, এই আগ্রহ, ‘ফ্যাশন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত’ নয়। (পৃ. ৪২৯) এই জানার সীমানা বাড়তে থাকে, খৃষ্টবিশ্বাসে, পেগান চেতনায়, হিন্দু চেতনার থেকে নাস্তিক বৈজ্ঞানিক রিচার্ড ডকিন্সের বইপত্রে—শেষোক্ত বিষয়ে তিসির স্বামীর আগ্রহ হিসেবে। পোস্ট কলোনিয়াল, পোস্ট মডার্ন তত্ত্বায়নে, সাহিত্য বিচারে তত্ত্ব প্রয়োগের অতিরিক্ততায় এ উপন্যাসের ন্যারেটর তিসি যে সচেতন কিন্তু আগ্রহী নন, তাঁর শ্লেষযুক্ত প্রয়োগে তা বোঝা যায়। লেখিকা উষ্মা প্রকাশ করতে পারেন লেবানন ইজরায়েল প্রসঙ্গ খাপ খায়নি বলার জন্য। তিনি দেখাতে পারেন গণতন্ত্র, নাগরিক সুযোগের উন্মোচন, রুশ গুপ্তচর কথা, শরণার্থী প্রসঙ্গ, বিশ্বায়ন, চীনের সাম্প্রতিক অর্থনীতি, (পৃ. ৪৫৭-৪৫৯) বিষয়ে স্পষ্ট প্রখর মতামত দেওয়ার দিকটা। এরকম আরো আছে। তবু আমার পর্যবেক্ষণ রাখলাম। যাহোক এখানেও তিনি চর্মকারের নৈপুণ্য, বা দর্জির নৈপুণ্যের কথা তোলেন, তার পরে সারা-র অক্সফোর্ডে পড়াশুনো করতে আসার কথা, অনারের পুতুল, কার্ড বানানোর কথা, ভেনিস প্রসঙ্গ আসে পৃ. ৪৬৮-৪৬৯-এ যা সবশেষ অংশে চমৎকার বর্ণিল স্বপ্নিল হয়ে ওঠে। বস্তুত: ভ্রমণপ্রীতি – সংস্কৃতিজগতে, বিশ্বে – এ বইটির মধ্যে বারংবার এসেছে। ভ্রমণ চিত্তশুদ্ধিতে সহায়ক, বিষাদ কাটাতে সহায়ক, তাই তো? কেতকী তাঁর বইতে মাঝে মাঝে চিঠি অনুবাদ করে দেন, মার্গারেট ক্লার্কের আত্মজীবনীর অংশবিশেষ অনুবাদ করে দেন (পৃ. ৬৫৭-৬৮২)। এ অংশগুলি চরিত্রের, তার সচল অনুভূতি জগতের ভ্রাম্যমাণতার, কিছুটা ভিন্নতার পরিচায়ক।

https://www.parabaas.com/bookstore/images/kkd_kachhe.jpg

জীবনানন্দ বুদ্ধদেব ভূমেন্দ্র আবার ফিরে আসে পৃ. ৫৯০ থেকে। সেখানে সমালোচ্য হয়ে ওঠেন সমীর সেনগুপ্ত-ও যিনি ওই উপন্যাসটির রিভিউ করেছিলেন একটি পত্রিকায়। কেতকী অসংখ্য টীকা টিপ্পনীর ভুল দেখিয়ে, মন্তব্য করেন—’ভূমেন্দ্রর কাজের সব থেকে গোলমেলে দিক সেটা এই যে তিনি বাণেশ্বরকে বুদ্ধদেবের সঙ্গে একেবারে মিলিয়ে মিশিয়ে দেবার জন্য প্রবল চেষ্টা করেছেন নানা কসরত করেছেন। …. পরের ঘটনাকে আগে টেনে এনে কালক্রমগত গণ্ডগোল করেছেন, কখনও বা অকারণে রবীন্দ্রপ্রসঙ্গ টেনে এনেছেন, যার ফলে পাঠকের হাতে উলটো পাল্টা সূত্র ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে।’ ভূমেন্দ্র বুদ্ধদেবের প্রতিকৃতিটি বাস্তবধর্মী কি না তা বিচার করেন না, জীবনানন্দের মনস্তত্ত্বেরও কোনো বিশ্লেষণ করেন না। (পৃ. ৫৯১-৯২) এইসব যাথার্থ্য বিচার করতে গিয়ে তিনি বুদ্ধদেবের স্মৃতিকথা (জীবনানন্দ বিষয়ক) উদ্ধৃত করেন, জীবনানন্দের ডায়েরী অংশও নানাস্থানে ব্যবহৃত হয়। আসে ‘মাল্যবান’ উপন্যাসটির আত্মজৈবনিক কাঠামোর কথাও। প্রসঙ্গতঃ আলোচিত হয় য়ুং এর মনস্তত্ত্ব, ছায়ার প্রক্ষেপণ কথা। এখানে রবীন্দ্রসাহিত্যে ছায়া প্রসঙ্গ অনুসন্ধান একত্রীকরণ এককথায় ব্রিলিয়ান্ট – সম্ভবতঃ এই ব্যাপারটা নিয়ে ইতিপূর্বে আলোকপাত হয়নি। সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় কৃত ‘আলো আঁধারের সেতু: রবীন্দ্র চিত্রকল্প’ বইটির কথা স্মরণে রেখেই একথা বলছি। ‘একুশ’ অধ্যায়ে জীবনানন্দ চরিত্র বিশ্লেষণ সূত্রে দেখান ‘টপমোস্ট ফিগার হওয়াই তাঁর অন্তর্লীন উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিলো’ (পৃ. ৬২২), সংক্রামক ব্যাধি বিষয়ে একটা আতঙ্ক তীব্র মাত্রায় ছিলো (পৃ. ৬২৭)। ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতার সম্পর্কে তিসি প্রশ্ন তোলেন—’এই কবিতায় একজন মানুষের আত্মহত্যার যে বিবরণ দেওয়া হয়েছে তা মনস্তত্ত্ব হিসেবে কতটা গ্রাহ্য?’ (পৃ. ৬২৯), ‘কারুবাসনা’র হেম ও তার মায়ের কথোপকথনও বেশ অলীক। সবিনয়ে বলি, বুদ্ধদেবের গল্প উপন্যাসে কথোপকথনেও এমন কিছু অলীক ব্যাপার আছে। ‘বোধ’ কবিতার একাকীত্ব বিশ্লেষণ যে সফলতা নিষ্ফলতার মানবিক বিনিময়ে সহায়ক একথা লেখিকার মনে হয়। সফলতা নিষ্ফলতা, জীবনানন্দ, বুদ্ধদেব বিচার এই বিস্তৃত অধ্যায়ের পর অধ্যায় জুড়ে নানাবিধ খুঁটিনাটি বিচার, যা close textual reading-এর এক অসামান্য, অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে রইল বলে আমি মনে করি।

দ্বিতীয় গল্পটি বয়স্ক বান্ধবী অনার পোপকে নিয়ে। তার দুই বাক্স চিঠি, বেঁচে থাকার সময় তিসির সঙ্গে কথা বিনিময়, অনার-এর অকপট আত্ম উন্মোচন, তার নানা গুণপনা, পুতুল ও পুতুলের পোশাক বানানোর নৈপুণ্য, অনার-এর বিশ্বব্যাপ্ত জিজ্ঞাসার সঙ্গে গান্ধী, রবীন্দ্র, নেহেরু, ইন্দিরা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা, সত্যজিতের চিঠি প্রাপ্তি ইত্যাদি মারফৎ। তিনি যেমন তিসি সম্পর্কে একটি রচনা লিখেছিলেন (সত্যজিৎ রায়ের দেশের মেয়ে – আমাদের এই ক্যানাল টাউনে) তেমনি অনুরোধ করে গিয়েছিলেন তাকে নিয়ে বাংলায় কিছু লিখতে। এখানে কেতকী showing এর পরিবর্তে telling রীতির আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁর বাক্‌পটুত্বের অসামান্য দৃষ্টান্তও অবশ্য প্রথমদিকে আমরা পেয়েছি। কেতকীর ভাষায়—ইতালি সম্বন্ধে অনারের অজস্র জিজ্ঞাসা যেমন অকৃত্রিম, তেমনি যেখানে তিনি গৃহিণী, উদ্যানশিল্পী, উদ্ভিদবিদ্যা-বিশারদ, কারুশিল্পী, বা অ্যামেচর ছবি আঁকিয়ে – সেই সমস্ত এলাকাতে ও তাঁর ক্রিয়াকলাপে কোনো ফাঁকি নেই।’ (পৃ. ৪৩১) অনারের ভেনিসযাত্রা, তিসির ভেনিসযাত্রা এটা দুই অংশের আর এক যোগসূত্র। জুডিথ, মার্গারেট প্রসঙ্গ এই বলন-পদ্ধতিতে পরিবেশিত।

https://encrypted-tbn0.gstatic.com/images?q=tbn:ANd9GcS5Fe879nfIqQ9PA6IoVnw4fNbH_Cs0A3E1NVynHW0RgSmOqxau

উপন্যাসটির যিনি ন্যারেটর সেই পরিণত বয়স্কা, গৃহিণী, অনন্য মেধাবী তিসির প্রসঙ্গে পাঠক যদি মনোনিবেশ করেন তাহলে লক্ষ্য করবেন যে তিসি একদিকে সংসারের তুচ্ছ কাজে, সম্পর্কায়নে, সন্তান ও স্বামীর সঙ্গে সহজতায়, দোকানির সঙ্গে মমত্ব রচনায় যেমনি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তেমনি পড়াশুনার জগতে তার তীক্ষ্ণ বিচারীরূপ। এ দুয়ের মিশ্রণ রচয়িতার কাছে কঠিন চ্যালেঞ্জ, কিন্তু কেতকী সে চ্যালেঞ্জকে তার কেশরকে দৃঢ় মুষ্টিতে ধরে এগিয়ে গিয়েছেন। অনারের সঙ্গে কথাবার্তায় উঠত—’জিনিসপত্রের প্যাকিং’ কথা (পৃ. ২৪), হিন্দু বাল্যবিবাহ কথা (পৃ. ৩৩) সেইসূত্রে অনারের জন্মকথা। চমৎকার একটি উপমা ব্যবহার করেছেন লেখিকা – ‘একটা দুঃখবোধ, যা একটা প্রাচীন ভাইরাসের মতো আমার স্নায়ুজালের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকে, সুযোগ পেলে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।’ (পৃ. ৪৭)। সিঁথি চুলকানো থেকে ক্লিনিকে যাওয়া, থেকে স্কুল জীবনের ছড়া (ঘটি বাঙাল নিয়ে) (পৃ. ৫৪), বাবার বাড়ির শেয়ার না পাওয়া (পৃ. ৭৪), ছেলে রাফায়েল ও অ্যাডামের মন মেজাজ কথা (১৪২ পৃ.), রাফায়েল-এর ক্ষণস্থায়ী প্রেম, স্বামী লরেন্সের বৃষ্টি জলের ড্রাম কেনা (পৃ. ১৪৯) একটু বাদে ইংলণ্ডে প্রচণ্ড গরম (পৃ. ১৯১) এবার জীবনানন্দের উপন্যাস আলোচনা চলতে চলতে ডিম প্রীতি সূত্রে তিসির ইংল্যাণ্ডে পড়তে আসা, গরম জলে রাতে স্নান (পৃ. ২৫৯), অল্প গরম দুধ ও কাঁচা ডিমে ব্রেকফাস্ট (পৃ. ২৬০), মশার কামড় (পৃ. ২৮১), স্বামী ও পুত্রের ভ্রমণে মজা (পৃ. ৩০৪), জীবনানন্দীয় উপন্যাস প্রসঙ্গের ফাঁকে ক্যারল ও অলিভারের প্রেম, ছেলের বন্ধুদের খেতে ডাকার মধ্যে জননী-কৌতূহল (পৃ. ৩৩৭), ডিনারের পর অলিভার, ক্যারল, রাফায়েল সমুদ্রের ছবি দ্যাখে, অলিভার ও ক্যারলের ঘর বাঁধার স্বপ্ন (পৃ. ৩৬৪-৩৬৫), Status Anxiety বইটি চেখে দেখতে দেখতে গোলাপের ফুল ফোটা, অনারের ছবিগুলো সাজিয়ে বসা, ফটো বিবর্তন, জীবন বুঝতে চিঠির গুরুত্ব (পৃ. ৩৮২), অনারের একের পর এক চিঠি – সত্যই ‘জাদুবাক্স’ অধ্যায়ের নামকরণ সার্থক। পাঠক নিশ্চয়ই বইটির বুনন অনুমান করতে পারছেন। চায়ের আসরে ঈশ্বরবিশ্বাস নিয়ে তিসির বিতর্ক-দ্বিধা (পৃ. ৪৪৪), নাস্তিক বৈজ্ঞানিক রিচার্ড ডকিন্সের বই পাঠে স্বামীর আগ্রহ (৪৪৯), লণ্ডনের চুরি, গুণ্ডামি, মুচি পরিবারের কথা, ক্যারল অলিভারের প্রেমে গোলাপের ভূমিকা, লণ্ডনে বাঙালির দুর্গা পূজা। একটা জিনিস লক্ষ্য করতেই হবে। লেখিকা – কখনই তিসি নাম্নী ন্যারেটরের জীবনপ্রসঙ্গকে অতিরিক্ত জায়গা দিয়ে বসেন নি, মেয়েলি আবেগ-বাহুল্যে ভাসান নি, আবার একটার সঙ্গে আর একটা প্রসঙ্গে বুনোটের মধ্যে তারিফযোগ্যতা বজায় রেখেছেন। স্বামী লরেন্স বিজ্ঞানের মানুষ, অতীত প্রসঙ্গ নিয়ে স্মরণ বজায়, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কথা বলতে ভালোবাসে, রাজনৈতিক হিংস্রতা তাকে গ্রস্ত করে তোলে।

https://encrypted-tbn0.gstatic.com/images?q=tbn:ANd9GcS5Fe879nfIqQ9PA6IoVnw4fNbH_Cs0A3E1NVynHW0RgSmOqxau

হয়তো বৈচিত্র্য আনার জন্যই, পাছে পাঠক বোর হয়ে যান, কুড়ি অধ্যায়ে চিঠি নয়, চিঠি-প্যাটার্নের অবতারণা। ছেলেদের নিয়ে বাবা মায়ের পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণ দেখা, জ্ঞানীদের রাজত্বে ঢুকতে ভয় পাই বললেও (পৃ. ৬০৯) সে জগতে ঢুকে পড়া, বোনের সঙ্গে আলোচনা চলতে থাকা উপন্যাসটা নিয়ে ‘ঘাঁটাঘাটি’ করা (পৃ. ৬২০) বোনকে দেশভাগ পরবর্তী স্কুল জীবনের কথা (জীবনানন্দ প্রসঙ্গ সূত্রেই)। বাইশ অধ্যায়ে স্রেফ বৈচিত্র্য আনার খেয়ালেই মার্গারেট ক্লার্কের আত্মজীবনীর নির্বাচিত অংশের অনুবাদ, ফাঁকে ফাঁকে তিসির মন্তব্য।

অবশেষে আমরা পৌঁছে গিয়েছি ৮৫৫ পৃষ্ঠার বইটির সর্বশেষ পর্বে যার নাম – ‘ভেনিসে’। ভেনিস, চক্ষুষ্মান পাঠক মাত্রেই জানেন, অনেক স্বপ্নের, চরিতার্থতা, অচরিতার্থতার দেশ, জলের শব্দ হয়ে ওঠে হৃদয়ের শব্দ। এ পর্বের প্রধান অবশ্যই তিসি ও তার পরিবার, যদিও মিশে আছে পূর্বোক্ত আরো অনেকে। তিসিরা বেড়াতে এসেছে ভেনিসে, উঠেছে গলির ভেতরের ছোট হোটেলে। এ হল তিসির ইচ্ছা – ‘আমাদের অনেক দিনের বাসনা পূর্ণ করতে এ শহরে এসেছি।’ (পৃ. ৬৮৬) অবশ্য, ছেলেরা দুবার দেখেছে, তাদের সংক্ষিপ্ত ভ্রমণে ও শব্দ-প্রভাব থেকে এই নগরীর আকর্ষণক্ষমতা বুঝে নেওয়া যায়।’ উদ্দীপনা জুগিয়েছে অধীত বিদ্যা, ছেলেদের পরামর্শ, ভেনিস বিষয়ক টিভি সিরিজ। পাঠককে জানানো হল বুদ্ধদেব রোম আর ফ্লোরেন্সে এলেও ভেনিসে যান নি, অনার পোপ ছিলেন ভেনিস-অভিজ্ঞ। তিনি অর্থাৎ তিসি বুদ্ধদেবের ছায়ামূর্তিকে ভেনিস দেখানোর দায়িত্ব নেন, তিসির সঙ্গে আছে বোনের পাঠানো ছোট মেয়েকে লেখা বুদ্ধদেবের চিঠি বইটি। এই বোন, অর্থাৎ তিল এ উপন্যাসে catalytic agent-এর কাজ করে, জীবনানন্দের উপন্যাস, বুদ্ধদেবের চিঠি দিদিকে পাঠানোয়, দিদির চিঠি ও নানা ভাষ্য বিনিময় প্রসঙ্গে। তিসির সঙ্গে এসেছে বুদ্ধদেবের চিঠি ছাড়াও মহাভারতের কথা, তিনি তথ্য যাচাই করতে করতে ‘আধুনিক মানসতা’র পরিচয় রাখতে চান। চিঠির মধ্যে কন্যা দময়ন্তীর কথা, সেই সূত্রে কলকাতার ট্রাম লাইনের পাশে বকুল গাছের কথা যা বিলেতে পড়তে এসেও মনে পড়ত। এই আলোচকও এই স্মৃতির অংশীদার, এতো বছর পরে সেই স্মৃতি শহরের এক হারিয়ে যাওয়া ‘সুন্দর’ কে আজও জাগিয়ে রাখে। এবার ভেনিসের গঠন, যা কেতকীর ভাষায় ‘মিরাক্‌ল, এঞ্জিনিয়ারিং আর স্থাপত্যশিল্পের এক অত্যাশ্চর্য কীর্তি।’ আর বুদ্ধদেবের নানা ‘টিপ্‌স’ কন্যাকে—
ক) যে সভ্যতা পাঁচশ বছরেও শ্রেষ্টত্ব হারায়নি তাতে প্রবেশই অভিজ্ঞতায় মূল্যবান। (পৃ. ৬৯৫)
খ) আত্মীয়, বন্ধু, স্বজনই সব এই মোহ আধুনিকতায় বর্জনীয়। (পৃ. ৬৯৫)
তিসি তার ছাত্রজীবনের বাড়িওয়ালির সঙ্গে বিরোধের একটি অভিজ্ঞতাও বলে। তার পর বুদ্ধদেবের খাদ্যপ্রসঙ্গিত পরামর্শ, নানা মজাদার প্রসঙ্গ। তিসির সন্দেহ নেই বুদ্ধদেব এবং তাঁর পিতা দুজনেই ‘বিশ্বমনস্ক যুগের সন্তান’। বুদ্ধদেব চান তাঁর মেয়ে পাশ্চাত্য জীবনচর্যার পরিশীলিত আঙ্গিকগুলোকে পরখ করুক, আনন্দ উপভোগে, দুঃসময়েও। চিত্রসংগ্রহশালার ছবি দেখার কৌশল-কথাও আছে। তিসি আক্ষেপ-আনন্দে আন্দোলিত – কারণ – ‘ইয়োরোপীয়রা তাদের ইতিহাসকে কত যত্ন ক’রে ধ’রে রাখে।’ (পৃ. ৭১২) উচ্চারিত অনুচ্চারিত আক্ষেপ সর্বত্র যে, বাঙালী তার ইতিহাস, ঐতিহ্য বিষয়ে আদৌ যত্নবান নন। এই পর্বে বুদ্ধদেবের ক্রমবিকাশমান জীবনদর্শন সযত্নে তুলে ধরেছেন কেতকী, যা বুদ্ধদেব-অধ্যয়নে প্রভূত সহায়ক বলে মনে করি। বুদ্ধদেব প্রসঙ্গ থেকে স্বামী লরেন্সের ‘ভগবান নামক ভ্রান্তি’ বইটি পড়ার কথা। যে-বই তিসিকেও আকর্ষণ জানায়। ব্রেকফাস্ট টেবিলে খাদ্য সংক্রান্ত কথার ফাঁকে বুদ্ধদেবের জন্য একটা চেয়ার রক্ষা উপন্যাসটিকে নিয়ে যায় প্রায় ম্যাজিকের জগতে। তারপর মোটর লঞ্চে ভিনিশীয় কাচশিল্পের প্রাচীন কেন্দ্র মুরানো দ্বীপে যাওয়া, খুচরো উপহারযোগ্য কেনাকাটার আগ্রহ চারজন মানুষকে একেবারে গড়পড়তা পারিবারিক মনস্কতায় নামিয়ে আনে। এরপর য়োলান্দাতে লাঞ্চের ভিড়, ভেনিশীয় রান্নার বৈশিষ্ট্য, ছেলেদের পছন্দের খাবার, ইতালীয় কায়দায় বিশ্রাম। একাকী বুদ্ধদেবের হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে এসে বাসন মাজা, হনলুলুর প্রাকৃতিক বর্নণা, গোলাপ কেন কালো উপন্যাসে দুবার ভেনিসের উল্লেখ, বিপন্ন বিস্ময় উপন্যাসে হনলুলুর স্মৃতি, যে কোনো অঞ্চলের পিছনের ইতিহাসে বুদ্ধদেবের আকর্ষণ, তাহিতি প্রসঙ্গে গগ্যাঁ, বুদ্ধদেবের ইতিহাস চেতনা নিয়ে উদাহরণ সহ উল্লেখ, ‘মৌলিনাথ’ উপন্যাসে আষাঢ় সন্ধ্যার বর্ণনা। —অবাক হতে হয় কেতকী বাংলা থেকে কতোদূরে বসে বুদ্ধদেবের লেখা কতো খুঁটিয়ে পড়েছেন। এর পর হেঁটে, যানে ভেনিসের নানা অংশের বিবরণ, ছাতার দুটি স্পেনীয় প্রতিশব্দ, নীল ঝর্নাপ্রতিম ভাস্কর্য দেখতে দেখতে ‘সোনার তরী’ কবিতাটি সম্পর্কে বুদ্ধদেবের ব্যাখ্যা, সুন্দর পাবলিক পার্ক্‌ চনমনে খিদেয় ব্যাস্‌ নামক মাছ, বুদ্ধদেবকে সম্বোধন করে মহাভারতের ব্যাস-কথা, ক্রেইপ্‌ সুজেৎ খাবারটি প্রসঙ্গে প্রাচীন ঋত্বিকদের যোগ্য খাবারের কথা, সান মার্কোর চত্বরে নানা জাতের সংগীত, হোটেলে ফিরে কম্পানিলের ইতিহাস পড়া, টমাস মানের ‘ভেনিসে মৃত্যু’ নভেলা পাঠ, বুদ্ধদেবের মান-প্রীতির প্রভাব, ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ প্রসঙ্গে বুদ্ধদেবের মতামত, ছাত্রজীবনে বুদ্ধদেবের বানান ভুল, অমিতাভ চক্রবর্তীর একটি বই প্রসঙ্গ, পোস্টমডার্ন ডিসকোর্স নিয়ে শ্লেষ, কলকাতার রাস্তার নাম বদলে ঐতিহ্য উদাসীনতা, ঋষ্যশৃঙ্গের জীবন নিয়ে বুদ্ধদেবের নাটক, ষাটের দশকে কলকাতার রাজনৈতিক দুর্যোগ, বুদ্ধদেবের ফ্যাশিজম বিরোধী মনোভাব, ঈশ্বরের করুণা নিয়ে তিসি ও তার স্বামী লরেন্সের কথা, ছেষট্টিতে বুদ্ধদেবের নাকতলায় চলে আসা, নকশাল আমল, স্বামী পুত্রসহ তিসির কলকাতা আসা ও নকশাল আতঙ্ক—প্রবাহ প্রাচীন থেকে আধুনিকে, ইউরোপ থেকে বাংলায়, বুদ্ধদেব থেকে রবীন্দ্রনাথে, ভেনিসের নানা প্রসঙ্গে চলছেই – এ আরেক ধরনের ভ্রমণ, যাতে আবেগ ও মনন একইসঙ্গে চলতে থাকে, ব্যক্তি ও চিন্তা কেউই বড়ো হয়ে ওঠে না, ঘটনা প্রবাহে চিন্তাপ্রবাহ, কিংবা চিন্তাপ্রবাহে ঘটনা অবহেলিত হয় না। ভ্রমণের ফাঁকে ফাঁকে পড়া চলছে, পেন্সিলে দাগানো চলছে বুদ্ধদেবের চিঠির বইটি। রাফায়েল-এর ছবি তোলা, রাফায়েলের শৈশব, শৈশব কিভাবে বেঁচে থাকে সাবালকত্বে, অ্যাডামের নিজের আঁকা ছবি বন্ধুর বিয়েতে উপহার, লিডো দ্বীপে এসে দুই ভাইয়ের পুরোনো স্মৃতি, যে হোটেলে তারা ছিলো সেই হোটেল দেখানোয় ছোট ভাইয়ের উৎসাহ, লিডোর সৈকতই মানের নভেলাটির ভৌগোলিক ভূমি, রাস্তায় খাদ্যপানীয় বিক্রি, পরিচ্ছন্ন সরকারী হাসপাতাল, ছাতার নীচে কফিতে চুমুক, আমেরিকার রাষ্ট্রপতি বিপর্যয়ে বুদ্ধদেবের মনোভাব, কলকাতায় সর্বভারতীয় কবিসম্মেলন নামের এক ‘বিশৃঙ্খল, প্রগলভ্‌ অর্থহীন মূর্খ ব্যাপার’ নিয়ে বুদ্ধদেবের মন্তব্য, ধর্মপুস্তক গীতা নিয়ে বুদ্ধদেব, রবীন্দ্রপত্নী মৃণালিণীর ৫ সন্তান রেখে ২৯ বছর বয়সে মৃত্যু, স্বধর্ম বলতে কি বোঝায়, দেশকাল মূল্যবোধ বদলানো বিষয়ে কন্যা দময়ন্তীর মন্তব্য, লরেন্সের দিবানিদ্রা এবং ঘুম ভেঙে ‘ভগবান নামক ভ্রান্তি’ বইতে চোখ দেওয়া, গীতা প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব এবং তিসি ও স্বামীর কথা, মহাভারত বিষয়ে প্রতিভা বসুর আলোচনা, মহাভারত, রবীন্দ্রনাথ নিয়ে বুদ্ধ ও তিসি, বুদ্ধদেবের পাঠক, সিলোনে দম্পতীর কথা চিঠিতে, তিসির আক্ষেপ সিলোনে তেমন পড়া হয়নি বলে, চলতে থাকে সমান্তরাল ভ্রমণ, খ্যাত অখ্যাত, তুচ্ছ ও গণ্যের মধ্য দিয়ে। ছাব্বিশ অধ্যায়ে বারক্‌ গির্জাশৈলী, বিখ্যাত এক গির্জার স্থাপন, চিত্রদর্শন, রেস্তরাঁয় সী ফুড স্যুপ, ক্লান্ত শরীরে হোটেলের ঘরে ফিরে চিঠির বইটি খুলে ধরা, ইংলণ্ডের বাড়ির কাছে রেস্তোরাঁয় বড়ো ছেলের ওয়েটারগিরি, অনার-এর ভাষা, গ্রন্থ, ভ্রমণ চর্চা – যেন চলচ্চিত্রের দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তর। সত্তরের শেষে কলেজস্ট্রীট রণক্ষেত্র, ‘রাত ভরে বৃষ্টি’ উপন্যাস নিয়ে মামলা, চিঠির সংকলনটিতে দুই প্রজন্ম কথা, ভাষার বিচিত্রতা নিয়ে বুদ্ধদেব, তিসির মতামত, উচ্চতর মনুষ্যধর্মের লক্ষণ বিষয়ে বুদ্ধদেব, রাজনীতি বুদ্ধদেবের চিন্তাভাবনার প্রধান ফোকাস না হলেও সে বিষয়ে মনোভাব (মনে হয় বুদ্ধদেবের ইতিহাস চেতনা এবং রাজনীতি ভাবনা নিয়ে একটিও প্রণিধান-যোগ্য আলোচনা শতবার্ষিকীতেও নজরে আসেনি), নকশাল আন্দোলনের প্রসঙ্গ বুদ্ধদেবের ‘নেপথ্য নাটক’-এ, উপন্যাস লেখা বিষয়ে বুদ্ধদেবের সে সময়ে বর্ধমান অনীহা, তাঁর চিঠিপত্র থেকে একটা সাংস্কৃতিক ইতিহাস গড়ে তোলার চেষ্টা, রাতের ঘুম নিয়ে স্বামীর অনুরোধ, শৈশবে অ্যাডাম এর উচ্চারণ ত্রুটি এবং টেম্পেস্টে ক্যালিবান সাজা স্মরণে মাতৃমনোভাব—ব্যক্তি অনুভব, চরিত্রায়ন – উপন্যাসে যা দরকার শেষপর্যন্ত, এনে দেয়। সর্বশেষ অধ্যায়ে কানাল গ্রান্দে দর্শন, রিয়াল্‌তো সেতু ও শেক্সপীয়রে উল্লেখ, মহাবাজার, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বিক্রয়যোগ্য পশরা, ভিক্ষুকবৃন্দ, গির্জায় দেখা চারটি অসাধারণ ঘোড়ার মূর্তি, বিকালে দোজের প্রাসাদ দর্শন, গির্জা চত্বরে, টিপটিপে বৃষ্টিতে কফি খাওয়া, পরিবেশ আবার স্মরণ করিয়ে দেয় মান-কে। সর্বশেষ কটি পাতায় আবার ফিরে এলো বহু আলোচিত ‘সফলতা নিষ্ফলতা’ উপন্যাসটি, যেখানে তিসির মনন তিনটি অন্তত সংহত প্রশ্ন তোলে পাঠকের চিন্তার কাছে – (ক) বাণেশ্বর বুদ্ধদেবের আদলে হলে সেটার জাত কি? তিসির উত্তর, এ এক ক্যারিকেচর। (খ) জীবনানন্দ কি বুঝেছিলেন বাণেশ্বর চিত্রণ বুদ্ধদেব প্রসঙ্গ স্মরণে ‘নিন্দাত্মক’ বিবেচিত হবে? (গ) ঐ উপন্যাসটির মক্স জীবনানন্দের মনস্তত্ত্বকে কিরকম তুলে ধরে। ভ্রমণসঙ্গী চিঠিপত্রের বইটি ও অন্যান্য কিছু বুদ্ধদেব মনস্তত্ত্বকে কি রকম তুলে ধরে তা লেখিকা অবশ্য দেখিয়েছেন। বুদ্ধদেব উপার্জনে নানা নিরীক্ষা করেছেন, মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর অ্যাডভেঞ্চারে গেছেন যা জীবনানন্দের পক্ষে সম্ভব ছিল না। জীবনানন্দের জীবনে অতৃপ্তি, অশান্তি, দ্বন্দ্ব ছিল যথেষ্ট। জীবনানন্দ মহৎ কবিতা নিশ্চয়ই লিখেছেন, কিন্তু বুদ্ধদেব জীবনানন্দের ‘অস্মিতার স্বাদ’ আলাদা। নারীচিত্রণও আলাদা। কেতকী একবারও ভোলেন নি তিনি শেষপর্যন্ত একটা উপন্যাস হাজির করছেন পাঠকের কাছে। তাই বইটি শেষ হয় দেদালুস আর ইকারুস তন্ময় হয়ে দেখার কথায়। তিসির মনে পড়ে ইকারুসের কথা আছে বুদ্ধদেবের এক আশ্চর্য কবিতাতে, চারজনে, বাবা মা দুই ভাই ভাবতন্ময় দাঁড়িয়ে থাকে ১৭৭৮-৭৯-তে আন্তোনিও কানোভার গড়া গ্রীক পুরাণের এই যুগলমূর্তির দিকে। এভাবেই ফিরে ফিরে আসে উপন্যাসধর্ম, ব্যক্তির শরীরী ও মনোভাবের উষ্ণ স্পন্দন, চরিত্রায়ণ, সংলাপ গড়ে তোলে ব্যক্তিবিশ্ব, যা ছড়িয়ে পড়ে বিশ্ব চরাচরে, মনন দিগন্ত এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে পড়ে সীমাহীনতায়। শেষ পর্যন্ত জীবন, জীবনের হাওয়ার ঝাপটা আছে আদ্যন্ত। আমরা পাঠকরা তার স্পর্শ পেয়েছি।

https://encrypted-tbn0.gstatic.com/images?q=tbn:ANd9GcS5Fe879nfIqQ9PA6IoVnw4fNbH_Cs0A3E1NVynHW0RgSmOqxau

গত ষাট বছর ধরে উপন্যাস পড়ছি। দেশী, বিদেশী, অনূদিত এমনকি পাণ্ডুলিপি আকারেও। তাতে এটাই বুঝেছি, উপন্যাস একপ্রকার হয় না, উপন্যাসকে সংজ্ঞায় বেঁধে ফেলাও যায় না। প্রতি দশকে, প্রতি দেশে উপন্যাস নামক জঁর তার বিধি ছাপিয়ে যায়। দেখতে হয় জীবন, জীবনের হাওয়ার ঝাপটা বজায় আছে কি না। মিরিয়াম অ্যালট ষাটের দশকের প্রারম্ভে বলেছিলেন উপন্যাসে অনুসন্ধেয় ছটি ব্যাপার— (ক) গঠনগত সমস্যা – Unity and coherence, plot and story, The time factor, (খ) ন্যারেটিভ টেকনিক (গ) চরিত্রায়ণ (ঘ) সংলাপ (ঙ) পটভূমি (চ) শৈলী। (‘Novelists on the Novel’, Miriam Allott, Pg. 161, Routledge and Kegan Paul Ltd. Pg. 161) আলোচ্য উপন্যাসটির বিস্তৃত আলোচনায় দেখিয়েছি এই ছটি বৈশিষ্ট্যই স্বাতন্ত্র্য নিয়ে বজায় আছে। এটা স্বীকার্য যে বিংশ শতাব্দীর উপন্যাসে ‘Though touching on reportage and history at one extreme, taking structure from … fictional prose forms (journalism, history, sociology) the novel touches on high literary formalism at its other extreme, taking structure from myth, and symbolic or linguistic coherence এবং prose novels are open to a wide variety of registers, structures, typologies, (Modern Critical Terms. Ed. by Roger Fowler, Pg. 162) যাঁরা কেতকীর মিশ্ররীতির উপন্যাস বরদাস্ত করতে নারাজ তাঁদের জানা দরকার মিশ্ররীতির উপন্যাস অনেক আছে, কেতকীর ‘রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্‌তোরিয়া ওকাম্পোর সন্ধানে’ (নাভানা ১৯৮৫) রচনা ও প্রকাশের পূর্বেই অনেকে লিখেছেন। সত্যেন্দ্রনাথ রায় সদ্য উক্ত বইটি সম্পর্কে বলেছিলেন – ‘এ বইয়ে কেতকী যা দিতে চাইছেন, এই বিশেষ আঙ্গিক ছাড়া আর কোনোভাবেই তা দেওয়া যেতো না।’ শিবনারায়ণ রায় এটিকে ‘একটি অসামান্য বই’ বলেছিলেন, আরও অনেকে সাধুবাদ জানিয়েছিলেন তার সঙ্গত কারণ আছে। কেতকী একটি প্রবন্ধে বলেন—’আমি চেয়েছিলাম গবেষণা আর কথাসাহিত্যের পারস্পরিক অভিঘাতের মাধ্যমে কতগুলো কথা বোঝাতে।’ যেহেতু তাঁর নিজের ‘জীবন পুবে পশ্চিমে বেণী-বাঁধা’ যেহেতু তিনি বিশ্বাস করেন ‘হাইব্রিডিজম একটা মস্ত শক্তি’ তাই মিশ্রতা তার কাছে কোনো ইস্যুই নয়।’ (‘আমার রবীন্দ্রনাথ – ভিক্তোরিয়া বিষয়ক বই দুটির সূত্রে’, চলন্ত নির্মাণ; দে’জ পাবলিশিং, পৃ. ১৭৫, ১৮০, ১৮১) ‘তিসিডোর’ বইটিও মিশ্র রীতিতে লেখা। রবীন্দ্র বিষয়ক বইটির সঙ্গে এর তফাৎ এইখানে যে এখানে জীবনানন্দের একটি উপন্যাসকে কেন্দ্রে রেখে বিচারের প্রশস্ত রাজপথ ও অলিপথ দিয়ে তিনি পৌঁছাতে চেয়েছেন জীবনানন্দ ও বুদ্ধদেবের লেখক মনস্তত্ত্বে, ইতিহাস ও সমাজ চেতনায়। এই সঙ্গে আছে অনার পোপ নামের এক ইংরেজ মহিলার কথা, তার জন্ম, বেড়ে ওঠা, বিচিত্র বিষয়ে আগ্রহ, চিঠি লেখা ইত্যাদি, আর মার্গারেট ক্লার্ক এর স্মৃতিচারণার অনুবাদ। তিসির জীবন ক্রম উন্মোচিত হয়েছে তাঁর স্বদেশ ও বিদেশের কাহিনী মারফৎ, স্বামী, পুত্র প্রসঙ্গে। উপন্যাসটির নামটি অত্যন্ত সার্থক, কারণ তিসির বন্ধনে বাঁধা অনেকগুলি মানুষ, তিসির ডোর-এ বাঁধা জীবন। জীবন আদ্যন্ত বয়ে চলে স্পন্দন নিয়ে দীর্ঘবিস্তারে। ভারতীয় রাগ সংগীতের মতই এর উপস্থাপনা, অনেক টুকরো খেলা, অনেক বন্ধুরতা, অনেক স্বপ্নিলতা, আর চিন্তা ও উপলব্ধির বিস্তার আবার তারা রাগের সামগ্রিক মূর্ছনাকে বারে বারে ফিরিয়ে আনে, দূরে যায়, ফিরে আসে। তিসি নাম্নী শিক্ষিত ভদ্রমহিলার অকপট জীবন বৃত্তান্তের সঙ্গে পরিচিত হতে হতে পাঠক ক্রমশঃ পেতে থাকেন, আঁতলেমি, উত্তর ঔপনিবেশিকতা উত্তর আধুনিকতা বিষয়ে নানা মাত্রার ক্ষোভ, তাঁর তীব্র প্রখর ইতিহাস চেতনা, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ঐতিহ্য বিষয়ে ঔৎসুক্য। তার আগ্রহ যে কোথায় আর কোথায় নয় কে জানে, যেমন ডাক্তারী তত্ত্ব, য়ুং এর ছায়াতত্ত্ব, স্থাপত্য, ভাস্কর্য, ছোটখাট শব্দ, প্রসঙ্গ নিয়ে দুর্নিবার যাচাই, রাজনৈতিকতা, বিশেষতঃ মধ্যপ্রাচ্যের, কলকাতা ও বাংলার ক্রমক্ষয় নিয়ে বিষাদ, পূর্ব ইউরোপের শহরের একাধিক নাম, ইতালীয় সংস্কৃতি ও উপন্যাস, বিশ্বায়ন, ঈশ্বর বিশ্বাস, প্রভৃতি। হ্যাঁ, রবীন্দ্র বিষয়ক বইটির মতো এ উপন্যাসেও আছে অনেক গবেষণা, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে, আরও অনেক ছোট বড় বিষয় নিয়ে। টুকরো টুকরো বিচার ছড়িয়ে দিয়েছেন উপন্যাসটির স্বচ্ছ মহাকাশে—স্বীকার করছি এই স্টাইলের সার্থক উদাহরণ আর একটিও বাংলায় অন্তত নেই। মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন—’লেখকের যেটা বলবার কথা পাণ্ডিত্য যখন সেটাকে ছাড়িয়ে যায় তখন সাহিত্যের হয় ভরাডুবি। সে-সমস্ত রচনাই ব্যর্থ হয়েছে যাতে পাণ্ডিত্য দিয়ে চোখ বাঁধিয়ে দেবার চেষ্টা আছে। সাহিত্যে জাহির পনার স্থান নেই।’ (তীর্থঙ্কর : রবীন্দ্রনাথ ও দিলীপকুমার রায়ের কথোপকথন, জেনারেল প্রিন্টার্স, ১৯৯৭ সংস্করণ, পৃ. ১৬৫) সৌভাগ্যক্রমে এই ‘তিসিডোর’ বইতে অজস্র পাণ্ডিত্য কথা আছে, কিন্তু পড়তে পড়তে কোথাও ‘জাহিরপনা’ বা ‘আঁতলেমি’ মনে হয় নি।

https://encrypted-tbn0.gstatic.com/images?q=tbn:ANd9GcS5Fe879nfIqQ9PA6IoVnw4fNbH_Cs0A3E1NVynHW0RgSmOqxau

সবশেষে আসছে পাঠকের কথা। Wolfgang Iser বলেছিলেন the text offers a ‘structure of appeal’ which calls for its ‘implied’ reader, their interaction creates the aesthetic object, as the reader works through gaps and indeterminacies in the text, through shifts of vantage point, through distinctions of theme and horizon. এখানে স্বীকার করে নিই আমার পড়াশুনার জগৎ অত্যন্ত সীমিত, বিশেষত: বিদেশী সাহিত্য। তবে জীবনানন্দের কিছু লেখা, বুদ্ধদেবের কিছু লেখা পড়েছি, এঁদের দুজনের গদ্যলেখা নিয়ে মাঝেমধ্যে লিখেছি। বিখ্যাত ইতালীয় ঔপন্যাসিক ইগনাৎসিও সিলোনের (১৯০০-১৯৭৮) কথা আছে অনার পোপের চিঠি প্রসঙ্গে, পরে দেখা যাবে সিলোনের স্ত্রীর সঙ্গে বুদ্ধদেবের আলাপ ও আতিথ্য কথা। মনে পড়ল সত্তরের দশকের শেষে কোনো এক দৈনিকের জন্য অন্যান্য সহ সিলোনের উপন্যাসে আকৃষ্ট হয়েছিলাম, তাঁর বহুবিখ্যাত উপন্যাস ‘ফন্টামারা’র একটি বাংলা অনুবাদ কি করে জানি আজও টিঁকে আছে। বুদ্ধদেব, কেতকীর বা অনার পোপের সিলোনে বিষয়ে আগ্রহ এবং আমার আগ্রহের মধ্যে একটা মূল তফাৎ অবশ্য আছে। কেতকীর আক্ষেপ তিনি সিলোনে বিষয়ে ভালো করে চর্চা করেন নি কেন, আমার আক্ষেপ আজকে যদি সিলোনে পড়তে চাই এমনকি কলকাতায়, জাতীয় গ্রন্থাগার ছাড়া কে-ই বা যোগান দেবে। গোপাল হালদার ‘ফন্টামারা’-র বাংলা অনুবাদের (পূরবী পাবলিশার্স, প্রকাশকাল নেই) ভূমিকায় বলেছিলেন—কৃষক জীবনের সত্য নিয়ে সাহিত্য রচয়িতাদের অন্যতম এই লেখক যার কাব্যি করার রোগ নেই, বৈচিত্র্যহীন কৃষক জীবন, ফ্যাশিজমের প্রথম উদয়ে, আশাভঙ্গে তাদের দুর্ভাগ্য ‘ফন্টামারা’র বিষয়। উপন্যাসটি ১৯৩০-এ লেখা, তারপর আবিসিনিয়ার যুদ্ধ নিয়ে লেখা – ‘রুটি আর মদ’ (১৯৩৭), Luca’s Secret (১৯৫৬), Story of a Humble Christian (১৯৬৮) তাছাড়া আছে Fascism – its Origin and Development (১৯৩৮) ইত্যাদি। সিলোনে ইয়ং সোসালিস্ট গ্রুপে যোগ দেন, ১৯২১-এ ইটালিয়ান কম্যুনিস্ট পার্টির বেরিয়ে আসা সদস্য গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা, ফ্যাশিস্ট রাজত্বে অন্যতম গোপন নেতা, কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য তাঁর ভাই গ্রেপ্তার ১৯২৮-এ, মৃত্যু ১৯৩১-এ। সিলোনে স্ট্যালিন বিরোধী হয়ে যান, ১৯৩০ থেকে সুইৎজারল্যাণ্ডে বসবাস। পার্টি বহিষ্কৃত এই লেখক ‘ফন্টামারা’ উপন্যাসের লেখক হিসেবে খ্যাতি পান, সুইৎজারল্যাণ্ড থেকেই নাজি প্রতিরোধ বাহিনীকে সমর্থন জানান। কম্যুনিজম বিষয়ে তাঁর মোহভঙ্গের বিবরণ আমরা ছাত্রজীবনে, ষাটের দশকে পড়েছি The God that Failed (১৯৪৯) মারফৎ। এ বইও ‘পরাভূত দেবতা’ নামে বাংলায় প্রচারিত হয়। এক সময় গুজব ওঠে সিলোনে নাকি ১৯১৯ থেকে ১৯৩০ ফ্যাসিস্ট পুলিশের গোপন সংবাদদাতা, পরে আমেরিকান ইনটেলিজেন্সের সঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কালে যোগ। এই ব্যাপারটি নিয়ে নানা বিতর্ক উঠেছে। কেতকী সেসব বিবরণ কিছুটা দিয়েছেন এবং মন্তব্য করেন – ‘ইতালীয় ফ্যাসিবাদী নিয়ন্ত্রণ, সোভিয়েত বলশেভিক শৈলীর নিয়ন্ত্রণ – দুটোই তাঁর চক্ষুঃশূল হয়ে উঠেছিল।’ (পৃ. ৪৯৯) তাছাড়া বলেন – তাঁর চিন্তাভাবনা রবীন্দ্রনাথের অথবা গান্ধীর কত কাছে।’ (পৃ. ৫০০) অনার পোপ এর মতো আমারও সিলোনে বৃত্তান্ত জানার আগ্রহ রয়ে গেল। উপন্যাসটির ৭৯৩ পৃষ্ঠায় বুদ্ধদেবের চিঠিতে পেলাম সিলোনের স্ত্রীর কথা, যিনি ইটালিতে আতিথ্য দেন বুদ্ধদেবকে। তাহলে অনার পোপ, কেতকী, বুদ্ধদেব এবং এই পাঠক সবাই যুক্ত হয়ে গেলাম সিলোনে বিষয়ক আগ্রহে। সিলোনের ফ্যাসিবাদ ও বলশেভিকবাদ অপছন্দ বুদ্ধদেবের সঙ্গে মেলে, কমিটি ফর কালচারাল ফ্রিডম-এ দুজনের যোগ, ত্রিশের দশকে বুদ্ধদেবের ‘সভ্যতা ও ফ্যাসিজম’ পুস্তিকা এসব কথাও মনে পড়ে। ৭৮৩ পৃষ্ঠায় উল্লিখিত হুয়ান মাস্কারোর গীতা অনুবাদের কথায় আমিও আকৃষ্ট হয়েছিলাম রবীন্দ্র অনুরাগী হোসে ভাসকোন্‌সেলোস বিষয়ে পড়তে গিয়ে। EStudios Indostanicos বইটিতে ছিল ভারতের নানা ধর্ম, দর্শন, উপনিষদ, বৌদ্ধ, জৈন, বেদান্ত প্রভৃতির কথা। বইটি অবশ্য হাতে পাইনি। তবে মাস্কারো নামটি ভুলিনি। লোরকা চর্চা কালে মানুয়েল দে ফায়া-র কথা শুনি (পৃ. ৭১৩ তে উল্লিখিত) জার্মানীতে ফায়ার একটি ক্যাসেট উপহারও পেয়েছিলাম, যা আজও বাড়িতে আছে। এ চর্চাও করা হয়নি। এসব কথা জেগে ওঠে স্মৃতিতে।

পাঠ প্রতিক্রিয়ার দ্বিতীয় দিকটি একেবারেই ব্যক্তিগত, অনুভবগত। বুদ্ধদেব বসুর ছোটগল্প নিয়ে বিস্তৃত লিখি সত্তর দশকের শুরুতে, জাতীয় গ্রন্থাগারে ‘প্রগতি’র ফাইল দেখি। তারপর তাঁর অনেক প্রবন্ধ, উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী পড়া হতে থাকে। ছাত্রজীবনের শেষদিকটায় বিকেলে ‘পানীয়ন’ রেস্তোরাঁয় সময় খরচ করছি নির্বোধের মতো, তখন দেখতাম সেই অপরাহ্নে গড়িয়াহাটের কলরোল উপেক্ষা করে বুদ্ধদেব নিবিষ্ট ধ্যানে কাজ করছেন, হয়তো অনুবাদের। সভা সমিতিতেও ক্বচিৎ দেখেছি। তাঁর বড়ো মেয়ে মীনাক্ষী ছিলো সহকর্মী, যদিও আলাপ ছিল অল্প, নাতি মৌলিনাথকে একদা ক্লাসে বাংলা লেখার সহজ ত্রুটির জন্য বুদ্ধদেবের প্রসঙ্গ তুলে তিরস্কার করেছিলাম। তিনি বিদেশে থাকার সময় চুরি হয়ে যাওয়া কবিতা পত্রিকার কিছু কপি হঠাৎ পেয়ে যাই গিনি ম্যানসনের তলায় পুরোনো বইয়ের দোকানে। মেঘদূতের অনবদ্য ভূমিকা, বাংলা কবিতার ইংরেজি সংকলন ইত্যাদি কয়েকটি কপি বাঁধিয়ে নিই। এক বিদ্যায়তন ছেড়ে অন্যত্র যাবার পথে আমার পছন্দে ‘বোদলেয়র তাঁর কবিতা’ আসে আমার কাছে, অবশ্য এ বইয়ের ভূমিকা আগে ও পরে পড়েছি অনেকবার, উপকৃত হয়েছি। বুদ্ধদেব যখন সাতসকালে আমাদের ছেড়ে চলে যান তখন স্কুলের কর্তা যে বিজ্ঞপ্তি দেন তাতে small hours কথাটি সে সময় নতুন শিখেছিলাম। তাঁর অনুরোধে স্কুলের পক্ষ থেকে মালা নিয়ে শ্মশানে যাই। এরপর জীবনপথে চলতে চলতে বুদ্ধদেবকে নিয়ে কিছু চর্চা করতেই হয়েছে, জীবনানন্দও ঢুকে পড়েন খেয়ালি চর্চায় এবং কেতকী তাঁর যাবতীয় চমকপ্রদ বই ও গবেষণাপত্র নিয়ে। তাঁর রচনার যে দুটি গুণ আমাকে মুগ্ধ করে, ঈষৎ মতাদর্শগত ভিন্নতা সত্ত্বেও, তা হল—বক্তব্যের ঋজুতা এবং তথ্যের যাথার্থ্য। ‘তিসিডোর’ উপন্যাসে এই দুই পেয়েছি বিস্তর, কিছু মিলিয়েছি, কিছু রেখে দিয়েছি। অতএব এই টেক্সট এর structure of appeal আমার পাঠকসত্তায় নানাভাবে ঢেউ তুলেছে, আমিও তাই এই রচনার ‘ডোরে’ জড়িয়ে গেছি সানন্দে।

 

* পুনঃপ্রকাশ

About S M Tuhin

দেখে আসুন

জন্মদিনের মোহে : আমার প্রাণের গানের ভাষা – কুমার দীপ

জন্মদিনের মোহে আমার প্রাণের গানের ভাষা কুমার দীপ   একটা বয়সের পর থেকে মানুষ কেবলই …

82 কমেন্টস

  1. your discount pharmacy: Mail order pharmacy – rx online no prior prescription

  2. https://buydrugsonline.top/# northeast discount pharmacy

  3. online pharmacies canadian: buy prescription drugs online – trusted overseas pharmacies

  4. I pay a visit everyday some sites and websites to read articles, except this blog provides quality based posts.

  5. canadian pharmacy prices: canada pharmacy online – ordering drugs from canada

  6. canadian meds no prescription: online pharmacy no prescription – canadian online pharmacy reviews

  7. canadian drugstore online order medication online canadian mail order viagra

  8. purple pharmacy mexico price list: top mail order pharmacy from Mexico – buying from online mexican pharmacy

  9. reputable mexican pharmacies online: top mail order pharmacy from Mexico – reputable mexican pharmacies online

  10. Hi there, I enjoy reading all of your article post. I like to write a little comment
    to support you.

  11. Sweet blog! I found it while searching on Yahoo News. Do you
    have any suggestions on how to get listed in Yahoo News?
    I’ve been trying for a while but I never seem to get
    there! Cheers

  12. Thanks to my father who stated to me regarding this web site, this blog is really amazing.

  13. I have read so many articles concerning the blogger lovers but this piece of writing is in fact a pleasant piece of writing, keep it up.

  14. paxlovid price: Paxlovid buy online – Paxlovid buy online

  15. This is a topic that’s close to my heart… Take care!
    Exactly where are your contact details though?

  16. ventolin price australia: Ventolin inhaler – can i buy ventolin over the counter in nz

  17. This is the right website for anybody who wants to find out about this topic. You understand so much its almost hard to argue with you (not that I personally would want toHaHa). You definitely put a new spin on a topic that has been written about for decades. Excellent stuff, just great!

  18. https://clomid.club/# how to get generic clomid without dr prescription

  19. order generic clomid for sale: Buy Clomid Online – get cheap clomid without a prescription

  20. Great selection of modern and classic books waiting to be discovered. All free and available in most ereader formats. download free books

  21. paxlovid cost without insurance https://paxlovid.club/# paxlovid covid

  22. cost cheap clomid: Buy Clomid Online – can i buy clomid online

  23. Hello there! I could have sworn I’ve been to this
    web site before but after looking at a few of the articles I
    realized it’s new to me. Anyways, I’m definitely pleased I came across it
    and I’ll be bookmarking it and checking back often!

  24. http://wellbutrin.rest/# wellbutrin no prescription

  25. Hi great website! Does running a blog like this take a great deal of work?
    I have very little understanding of computer programming however I was hoping to start my own blog in the near future.

    Anyhow, should you have any suggestions or tips for new
    blog owners please share. I understand this is off topic but I just needed to ask.

    Kudos!

  26. certainly like your website however you need to check the spelling on quite a few of
    your posts. Several of them are rife with spelling issues and I in finding it very
    bothersome to tell the truth on the other hand I’ll surely
    come back again.

  27. 2022-12-10 Beställ Billiga Generiska Butylscopolamine Stockholm Vart Beställ Buscopan Betala Med Visa Malmö Köpa Generisk Butylscopolamine Med Försäkring Butylscopolamine Officiell Apotek Pris För Butylscopolamine Med Försäkring Över Disken Butylscopolamine Med Försäkring Örebro Beställ Billiga Butylscopolamine Linköping Butylscopolamine Köp Billiga Generiska Helsingborg Vart Beställa Butylscopolamine Med Försäkring Köp Billiga Butylscopolamine Med Recept Norrköping Vart Beställ Butylscopolamine Utan Försäkring Västerås 22 01 2023nubi sparse Bristen på amoxicillin märks av på apoteken, enligt Fredrik Boström, chefsfarmaceut på Sveriges apoteksförening. Samtidigt kommer små signaler på minskad tillgång även på Kåvepenin.
    https://elliotttjvj554346.blog2news.com/23158327/köp-sildenafil-strömmar
    Besök Västra Järnvägsgatan 21, Stockholm Kamagra är namnet på en av de mest köpta, olagliga kopiorna av Viagra. Läkemedlet tillverkas i Indien och säljs i regel för ett kraftigt billigare pris än Viagra. Kamgra är, återigen, olagligt att såväl köpa som sälja i Sverige. 18 NOVEMBER HÄLSA Man köper viagra på nätet men det finns ju så mycket annat. 18 NOVEMBER HÄLSA Sildenafil, tadalafil och vardenafil och avanafil ingår i en grupp som kallas PDE5-hämmare. De gör att blodkärlen utvidgas. Skillnaden mellan de olika preparaten är hur snabbt de börjar verka och hur länge de verkar. De har också delvis olika biverkningar. Preparaten har olika namn och olika tillverkare. 18 NOVEMBER HÄLSA …är klara innan du sätter igång. Skicka in eventuella försenade redovisningar för tidigare beviljade bidrag innan du gör din nya ansökan. På kulturfonden.fi – Stipendier & bidrag finns mera viktig information för dig som gör en ansökan – bland annat för dig som representerar en arbetsgrupp. Kom ihåg att också utvärdera Det är viktigt att också utvärdera ett projekt. De…

  28. I really loved reading your blog. It was very well authored and easy to understand. Unlike other blogs I have read which are really not that good.Thanks alot!

  29. can you get clomid for sale: Clomiphene Citrate 50 Mg – can i get cheap clomid online

  30. best generic wellbutrin: Buy Wellbutrin XL online – wellbutrin generics

  31. http://gabapentin.life/# 600 mg neurontin tablets

  32. Thanks a bunch for sharing this with all of us you actually recognize what you’re talking approximately!

    Bookmarked. Please also talk over with my site =).
    We may have a hyperlink change arrangement among us

  33. п»їpaxlovid: paxlovid buy – paxlovid india

  34. It’s going to be finish of mine day, except before end I am reading this great piece of writing to increase my experience.

  35. http://farmaciait.pro/# farmacie online sicure

  36. WOW just what I was looking for. Came here
    by searching for Pokémon

  37. farmacia online senza ricetta: kamagra gel prezzo – farmacia online più conveniente

  38. farmacia online senza ricetta farmacia online farmacia online senza ricetta

  39. farmacia online: kamagra gel prezzo – п»їfarmacia online migliore

  40. acquistare farmaci senza ricetta: avanafil prezzo in farmacia – farmacie online autorizzate elenco

  41. We stumbled over here coming from a different web address and
    thought I may as well check things out. I like what I see so now
    i am following you. Look forward to looking into your web page repeatedly.

  42. farmacia online miglior prezzo: Farmacie a roma che vendono cialis senza ricetta – top farmacia online

  43. farmaci senza ricetta elenco: farmacia online spedizione gratuita – farmacia online migliore

  44. VPS SERVER
    Высокоскоростной доступ в Интернет: до 1000 Мбит/с
    Скорость подключения к Интернету — еще один важный фактор для успеха вашего проекта. Наши VPS/VDS-серверы, адаптированные как под Windows, так и под Linux, обеспечивают доступ в Интернет со скоростью до 1000 Мбит/с, что гарантирует быструю загрузку веб-страниц и высокую производительность онлайн-приложений на обеих операционных системах.

  45. https://tadalafilit.store/# farmacie online affidabili

  46. b52
    Tiêu đề: “B52 Club – Trải nghiệm Game Đánh Bài Trực Tuyến Tuyệt Vời”

    B52 Club là một cổng game phổ biến trong cộng đồng trực tuyến, đưa người chơi vào thế giới hấp dẫn với nhiều yếu tố quan trọng đã giúp trò chơi trở nên nổi tiếng và thu hút đông đảo người tham gia.

    1. Bảo mật và An toàn
    B52 Club đặt sự bảo mật và an toàn lên hàng đầu. Trang web đảm bảo bảo vệ thông tin người dùng, tiền tệ và dữ liệu cá nhân bằng cách sử dụng biện pháp bảo mật mạnh mẽ. Chứng chỉ SSL đảm bảo việc mã hóa thông tin, cùng với việc được cấp phép bởi các tổ chức uy tín, tạo nên một môi trường chơi game đáng tin cậy.

    2. Đa dạng về Trò chơi
    B52 Play nổi tiếng với sự đa dạng trong danh mục trò chơi. Người chơi có thể thưởng thức nhiều trò chơi đánh bài phổ biến như baccarat, blackjack, poker, và nhiều trò chơi đánh bài cá nhân khác. Điều này tạo ra sự đa dạng và hứng thú cho mọi người chơi.

    3. Hỗ trợ Khách hàng Chuyên Nghiệp
    B52 Club tự hào với đội ngũ hỗ trợ khách hàng chuyên nghiệp, tận tâm và hiệu quả. Người chơi có thể liên hệ thông qua các kênh như chat trực tuyến, email, điện thoại, hoặc mạng xã hội. Vấn đề kỹ thuật, tài khoản hay bất kỳ thắc mắc nào đều được giải quyết nhanh chóng.

    4. Phương Thức Thanh Toán An Toàn
    B52 Club cung cấp nhiều phương thức thanh toán để đảm bảo người chơi có thể dễ dàng nạp và rút tiền một cách an toàn và thuận tiện. Quy trình thanh toán được thiết kế để mang lại trải nghiệm đơn giản và hiệu quả cho người chơi.

    5. Chính Sách Thưởng và Ưu Đãi Hấp Dẫn
    Khi đánh giá một cổng game B52, chính sách thưởng và ưu đãi luôn được chú ý. B52 Club không chỉ mang đến những chính sách thưởng hấp dẫn mà còn cam kết đối xử công bằng và minh bạch đối với người chơi. Điều này giúp thu hút và giữ chân người chơi trên thương trường game đánh bài trực tuyến.

    Hướng Dẫn Tải và Cài Đặt
    Để tham gia vào B52 Club, người chơi có thể tải file APK cho hệ điều hành Android hoặc iOS theo hướng dẫn chi tiết trên trang web. Quy trình đơn giản và thuận tiện giúp người chơi nhanh chóng trải nghiệm trò chơi.

    Với những ưu điểm vượt trội như vậy, B52 Club không chỉ là nơi giải trí tuyệt vời mà còn là điểm đến lý tưởng cho những người yêu thích thách thức và may mắn.

  47. acquistare farmaci senza ricetta: kamagra gel prezzo – farmacia online più conveniente

  48. farmacia online farmacia online migliore farmacie on line spedizione gratuita

  49. gel per erezione in farmacia: sildenafil 100mg prezzo – viagra ordine telefonico

  50. farmacia online più conveniente: cialis generico – farmacia online

  51. I just like the helpful information you provide in your articles

  52. farmacia online miglior prezzo: farmacia online più conveniente – farmacie on line spedizione gratuita

  53. farmacie online autorizzate elenco: cialis prezzo – farmacia online senza ricetta

  54. farmacia online senza ricetta: Tadalafil generico – acquisto farmaci con ricetta

  55. https://tadalafilit.store/# farmacia online miglior prezzo

  56. viagra naturale in farmacia senza ricetta sildenafil prezzo viagra prezzo farmacia 2023

  57. farmacia online: farmacia online miglior prezzo – farmacia online senza ricetta

  58. comprare farmaci online con ricetta: acquisto farmaci con ricetta – migliori farmacie online 2023

  59. migliori farmacie online 2023: Farmacie a milano che vendono cialis senza ricetta – farmacie online sicure

  60. farmacie on line spedizione gratuita: kamagra gel – migliori farmacie online 2023

  61. farmacie online sicure: avanafil generico – farmacie online sicure

  62. Ahaa, its pleasant discussion about this post here at this blog, I have read all that, so now me also commenting here.

  63. It is the best time to make some plans for the future and it’s time to be happy.
    I have learn this post and if I may I desire to recommend you few fascinating things or suggestions.
    Maybe you can write subsequent articles relating to this
    article. I desire to read more things approximately
    it!

  64. acquisto farmaci con ricetta: avanafil prezzo – farmacia online senza ricetta

  65. comprare farmaci online con ricetta avanafil spedra farmacie online autorizzate elenco

  66. acquistare farmaci senza ricetta: farmacia online spedizione gratuita – acquistare farmaci senza ricetta

  67. https://avanafilit.icu/# farmacie on line spedizione gratuita

  68. farmacia online migliore: avanafil prezzo in farmacia – farmacie on line spedizione gratuita

  69. Hi, i think that i saw you visited my site thus i came to “return the
    favor”.I am trying to find things to improve my website!I suppose its ok to use a few of your ideas!!

  70. farmacia online: farmacia online più conveniente – farmacia online senza ricetta

  71. viagra originale in 24 ore contrassegno: viagra consegna in 24 ore pagamento alla consegna – esiste il viagra generico in farmacia

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *