জ ন্ম দি ন : আ মা দে র নি বে দ ন
কাকতাড়ুয়ার তাড়ায়
স ম তুহিন
০২ মে ২০২১ । রবিবার
সাতক্ষীরা
উনিশশো বিরানব্বই, সত্তর বছর সত্যজিতের।
হলিউড থেকে তাঁর হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়ার জন্য প্রতিনিধি এসেছেন। অড্রে হেপবার্ন লাইভ টেলিভিশনে নাম ঘোষণা করছেন।
“
দৃশ্যটি ভোলার নয়। অসুস্থ সত্যজিতের কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল, তবু বললেন। সামান্য কয়েকটি কথা, কিন্তু মর্মস্পর্শী। জীবনকৃতি বা লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অস্কার চলচ্চিত্রে নোবেল পুরস্কারের সমান। নিজে সম্মানিত হলেন, সেইসঙ্গে আমাদেরও সম্মানিত করে গেলেন।
দেহাবসান হলেও এরকম মানুষের ঠিক জীবনাবসান হয় না। দেহে নেই, কিন্তু আরও নানাভাবে যেন জীবন্তই রয়েছেন। তাঁর আঁকা ছবি, তাঁর লেখা বই, তাঁর রচিত গান, তাঁর দেওয়া সুর, তাঁর নির্দেশিত চলচ্চিত্র সবই নিয়ত আমাদের সঙ্গ দিচ্ছে। আর এটাই তো বেঁচে থাকা! …
(ক্ষণজন্মা : শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় : প্রচ্ছদকাহিনি। ‘দেশ’, ২ মে ২০২১)
”
সত্যজিৎ রায় ছিলেন বামনের দেশে মহামনা, তৃণগুচ্ছের দলে মহীরুহ, মধ্যমেধার মধ্যে অতিকায়, বহুমাত্রিক জ্যোতির্ময়।
কতশত দিকেই যে তাঁর মেধা ধাবিত হয়েছিল, তার তুলনা নেই। রবীন্দ্রনাথের মতো তিনি নিজেও ছিলেন আরেকজন প্রবর্তক পুরুষ। নানাভাবে তিনি আলোকিত হয়ে, আলো দিয়ে আমাদের জীবনে আছেন আশৈশবযৌবন।
“
আমাদের সময়ের নায়ক ছিলেন তিনি। খুব করে স্বপ্ন দেখতাম যাঁদের সাথে দেখা করব বলে, তিনি ছিলেন রায়পরিবারের সেই সদস্যদের অন্যতম। আরেকজন অবশ্যই লীলা মজুমদার। চরণছোঁয়ার সেসব স্বপ্ন বাকিই থেকে গেল আমৃত্যু!
আজ ০২মে, রায়পরিবারের সবচে খ্যাতনামা সদস্যের জন্মশতবার্ষিকী।
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যে-উন্মাদনা হয়েছিল ১৯৬১ সনে, যাতে যোগ দিয়েছিলেন সত্যজিৎ স্বয়ং, সেরকম কিছুই হলো না এবার। বাংলা মজে আছে নির্বাচন আর করোনা নিয়ে।
সত্যজিতের জীবনের কিছু টুকরো ঘটনা নিয়ে আমি আমার নৈবেদ্য সাজালাম। ঘটনাগুলো মোটের ওপর প্রামাণ্য বই থেকে নেওয়া। আশা করি, আপনাদের ভালো লাগবে।
পড়ুন, এক ডজন মানিক :
১.
যত কাণ্ড- কাঠমান্ডুতে
সত্যজিতের গোপন একাধিক দিক ছিল অন্য সব মানুষের মতনই। তার মধ্যে একটা বেশ চমকপ্রদ। তাঁর ওপর লেখা সুখ্যাত বই ‘দ্য ইনার আই’-এর লেখক মার্ক রবিনসন বইটির মুখবন্ধে জানিয়েছেন সত্যজিতের এই ঘটনাটি। সত্যজিৎ মাঝেমধ্যে কলকাতা থেকে উধাও হয়ে যেতেন। যেতেন তিনি কাঠমা-ুতে যেখানে তাঁকে কম লোকই চিনতেন। কেন যেতেন সেখানে তিনি লুকিয়ে লুকিয়ে?
সারপ্রাইজ, সারপ্রাইজ!
তিনি সেখানে যেতেন ক্যাসিনোতে জুয়ো খেলতে প্রাণ খুলে।
সন্দীপ রায় মার্ক রবিনসনকে দেঁতো হাসি হেসে জানিয়েছিলেন তাঁর পিতাশ্রী একটি ‘স্লট মেশিন ফ্রিক’। সন্দীপ একটা টিভি ফিল্মের শুটিঙে একবার কাঠমান্ডুতে ছিলেন যখন তাঁর বিশ্বখ্যাত পিতৃদেব ক্যাসিনোতে কাঁচা পহা ওড়াচ্ছিলেন। তা হুমায়ূন আহমেদ বলেছেন বটে, সৃজনশীল লোকেরা জুয়ো খেলতে পছন্দ করেন। আর আমরা তো বলিউডের তরফেই জেনেছি, ‘জিন্দগি এক জুয়া’।
২.
এক দুই তিন
রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী ছিল ১৯৬১ সালে। শ্রদ্ধা ও কর্মকৃতি নিবেদনের হৈহল্লা সারা বাংলা জুড়ে। সত্যজিৎও যোগ দিলেন তাতে সাগ্রহে, সানন্দে। খুব দ্রুতই তিনি বানিয়ে ফেললেন রবীন্দ্রনাথের ওপর তথ্যচিত্র, এক ঘন্টার, যেটা নিয়ে ঋত্বিক ঘটক বলেছিলেন তিনি ওটা বানালে অন্যরকম করে বানাতেন, ওটায় বেশ কিছু ত্রুটি আছে তবে তারপরেও তিনি ছবিটা উত্তমাঙ্গের মনে করেন। এছাড়া, রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ থেকে তিনটি ছোটোগল্প নিয়ে সত্যজিৎ নির্মাণ করেন ‘তিন কন্যা’, সেও সেই ১৯৬১ সালেই। মার্ক রবিনসন বলেছেন, যদি সত্যজিতের ছবি কেউ না-দেখে থাকেন তবে প্রথমবার দেখার জন্যে তিনি এই ছবিটার কথাই বলবেন।
তিন কন্যা নামে ছবি তিনটি একসাথে দেখানো হতো, ধারাবাহিকতা ছিল পোস্টমাস্টার, মণিহারা, ও সমাপ্তি, এরকমভাবে। মূল গল্পের নাম তিনি পাল্টাননি। সত্যজিৎ মন্তব্য করেছিলেন যে, প্রতিটা ছবিই একটা পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবির কাজ করিয়ে নিয়েছে।
মজার ব্যাপার হলো, বিদেশে ছবিগুলো ‘দুই কন্যা’ বা ‘টু ডটারস’ নামে পরিচিত। ‘মণিহারা’ ছবিটার সাবটাইটেল যথাসময়ে করা যায়নি বলে সেটা আর পাঠানো হয়নি। সত্যজিতের একমাত্র ভৌতিক ছবি দেখা থেকে, তাই, ভিনদেশি দর্শকেরা চিরতরে বঞ্চিত রয়ে গেলেন।
৩.
সম্পাদন, সংশোধন-এক
সত্যজিৎ ছিলেন যাঁকে বলে অর্ত(ইং) পরিচালক। তিনি চলচ্চিত্রের অনেকগুলো দিকই একা হাতে সামলাতেন যেগুলো উন্নত জগতে একেকজন বিশেষজ্ঞের হাতে থাকে, যেমন : চিত্রনাট্য রচনা, সঙ্গীত পরিচালনা এসব। তবে এও ঠিক যে তাঁর দলে তিনি বেশ কজন চমৎকার দক্ষ লোক পেয়েছিলেন যাঁরা তাঁর কল্পনা বাস্তবায়ন করতে সহায়তা করেন।
তেমনই একজন হলেন দুলাল দত্ত, তাঁর সম্পাদক। তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র পথের পাঁচালী (১৯৫৫) থেকে তিনি সত্যজিতের সঙ্গে ছিলেন দীর্ঘদিন। পথের পাঁচালী বিদেশে যাবে, হাতে সময় সামান্যই। সত্যজিৎ এই তথ্য দুলালবাবুকে জানানোর পর তিনি একটা থলেতে করে টাওয়েল, তেল, মাজন, ব্রাশ, সাবান ইত্যাদি পুরে চলে এলেন ল্যাবে, কারণ রাতদিন ওখানেই থাকতে হবে। ব্যাপারটা চমকে দিয়েছিল পরিচালককেও, কারণ এই ঘটনা অদৃষ্টপূর্ব।
তো সেই সময়ের একাধিক ঘটনার ভেতর একটা শোনা যাক স্বয়ং দুলালবাবুর কথাতেই:
“ছবিতে শেষের দিকে একটা সাপের দৃশ্য আছে, মনে আছে? খুব বিখ্যাত দৃশ্য। সেটা এডিট করতে আমাদের প্রায় একটা দিন নষ্ট হয়ে গেল। সাপের শটটা সুব্রতবাবু স্টপ গেটের মতো করে নিয়েছিলেন। মানে সাপ চলছে, ক্যামেরা চলছে, যেই সাপ থামছে অমনি ক্যামেরাও বন্ধ হচ্ছে। কিন্তু ক্যামেরা জায়গা পাল্টাচ্ছে না। এডিটিং-এর সময় আমার অ্যাসিস্টান্টের নেগেটিভ কাটতে একটু গোলমাল হয়ে যাওয়ায় একটা টুকরো হারিয়ে গিয়েছিল। ওই টুকরো না থাকলে সাপের স্মুথ (ইং) যাওয়াটা বোঝা যাবে না। পাহাড় প্রমাণ কাটা নেগেটিভের টুকরোর ভেতর থেকে ওই ছোট্ট টুকরোটা খুঁজতেই লেগে গেল একটা পুরো দিন। ওই সময় আমাদের একটা দিন নষ্ট হওয়ায় খুব ক্ষতি হয়েছিল। এমনও হয়েছে আমি মানিকদার পা ধরে কেঁদেছি যে আমি আর পারছি না। তখন উনি অভয় দিয়েছেন, রাতে আমাদের সঙ্গ দিয়েছেন। তাড়াহুড়োয় ভুল হয়ে যাবার সম্ভাবনা নিশ্চয়ই ছিল। কিন্তু ঈশ্বরের অশেষ করুণা যে সেরকম কিছুই হয়নি।”
তো দেখা গেল ঈশ্বর মাঝেমধ্যে ভুলভাল করে করুণা করেই ফেলেন। এবং এক চুটকি নেগেটিভ কি কেয়া কিমত, সেটা রায় ও দত্তবাবু হাড়ে হাড়েই টের পেয়েছিলেন।
৪.
এ্যাকশন!
সত্যজিৎ নানান রঙের ছবি করেছেন তাঁর সমগ্র পরিচালকজীবনে। করতেও পারেননি অনেকগুলো যা আমাদের বেদনা ও হতাশার জন্ম দেয়। এজন্যে নানারকম প্রতিবন্ধকতা ছিল, আর্থিক, কারিগরি ও অন্যান্য। কিন্তু যখন যেটাই করেছেন সত্যজিৎ, প্রাণ ঢেলে করেছেন শত বাধা ঠেলে বা পেরুনোর রাস্তা খুঁজে।
সোনার কেল্লা ছবির শুটিঙের একটা ঘটনা।
ডক্টর হেমাঙ্গ হাজরার চরিত্রটি করেছিলেন শৈলেন মুখার্জি। ছবিতে পাহাড়ের গা থেকে গড়িয়ে-পড়ার একটি দৃশ্য রয়েছে তাঁর। তিনি ভেবেছিলেন, সত্যজিৎ রায় যেহেতু ফাঁকি পছন্দ করেন না, তাই হয়তো তাঁকে পাহাড় দিয়ে সত্যিই গড়িয়ে পড়তে হবে। তিনি শুটিঙে যাওয়ার আগে বাড়িতে তাই বলে এসেছিলেন, যাচ্ছি, তবে হাড় কখানা হয়তো রেখে আসতে হতে পারে। পরে যখন শুনলেন, ছবিতে দেখানো হবে তাঁকে ধাক্কা মারা হচ্ছে, এবং পরের শটে তাঁকে দেখানো হবে তিনি পাহাড়ের নিচে, তখন তিনি বাড়িতে চিঠি লিখে দিলেন, ভয় পেও না। হাড় নিয়েই ফিরতে পারব।
তবে একটু অন্যরকম ঘটনা ঘটেছিল জলসাঘর ছবিতে। সেখানে শেষ দৃশ্যে দেখানো হয় জমিদার বিশ্বম্ভর চৌধুরী ঘোড়া ছুটিয়ে যাওয়ার সময় সেখান থেকে পড়ে যান। এই দৃশ্য ছবি বিশ্বাসকে দিয়ে করানো সম্ভব নয় বলে কলকাতার সে সময়ের সবচে নামকরা স্টান্টম্যান খান সাহেবকে দিয়ে করানো হয়।
একটিবার মাত্র ঘোড়া থেকে পড়ে খান সাহেবকে অন্তত এক সপ্তাহ শয্যাশায়ী হয়ে থাকতে হয়।
হয়তো এজন্যেই এ্যাকশনধর্মী ছবির পরিচালনা সত্যজিৎ সাহস করে আর করে উঠতে পারেননি, অন্তত বাংলায়।
৫.
চিরবিভাজন রেখা-এক
গুগাবাবা ছবির শুটিং করতে সত্যজিৎ তখন সদলবলে জয়সলমিরে।
হাল্লার সৈন্যদলের প্রথমে অশ্বারোহী হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু জয়সলমির যখন শুটিঙের জন্যে নির্ধারিত হলো, তখন সেখানে ঘোড়ার বদলে উটই ব্যবহার সিদ্ধান্ত হয়। তো হাজারখানেক উট কিভাবে পাওয়া যাবে?
সমস্যার সমাধান করলেন স্বয়ং জয়সলমিরের মহারাজা। তিনি কুমার বাহাদুরের সাথে কথা বলতে বললেন। কুমার বাহাদুর আহ্লাদে আটখানা শুটিঙের সাথে জড়িত থাকতে পেরে।
উট এল। প্রথম দিনের কাজ শেষ হল। সূর্য ডোবে ডোবে। সবাই ঘরে ফেরার জন্যে তৈরি হচ্ছে বেঁধেছেঁদে।
এমন সময় কোত্থেকে যেন ভেসে এল মনকাড়া বাঁশির সুর। দেখা গেল বংশিবাদক সেনাদলের সাথে এলেও পোশাক পরে শুটিঙে নামেননি। তাঁকে অনুরোধ করায় তিনি সন্ধ্যের সময় সত্যজিৎদের আবাসে এলেন বাঁশি শোনাতে, ভালো লাগলে সেটা ছবিতে ব্যবহার করা যাবে।
বাজিয়ের নাম শওকত আলি। তিনি দুটো বাঁশি একত্রে মুখে পুরলেন। একটার মাত্র একটা ফুটো খোলা, বাকিগুলো মোমআঁটা। আরেকটার সব ফুটোই খোলা। এর নাম সাতারা, উদ্ভব জয়সলমির থেকে মাইল পঁচিশ দূরের গ্রামে। বাঁশি বাজিয়ে রেকর্ড করা হলো প্রায় এক ঘন্টা ধরে। সেই রেকর্ড শওকত আলিকে শোনানোর পর তাঁর মুখের ভাব বদলে অদ্ভুত হয়ে গেল।
অনুরোধ করলেন তিনি। ‘আমার একমাত্র ভাই সীমানা পেরিয়ে চলে গেছে পাকিস্তানে। তোমরা যদি আমার এ বাঁশি রেডিওতে বাজাতে পারো, তাহলে হয়তো সে সেখান থেকে শুনতে পাবে।’
রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের ইতিহাস মানুষের হৃদয়- ও সম্পর্কভঙ্গের ও প্রাণনাশের ইতিহাস। শওকত আলি শেষতক ভারত ছেড়ে পাকিস্তানেই চলে যান। ভাইকে তিনি ভারতে থেকে তাঁর বাঁশির সুর আর শোনাতে পারেননি।
৬.
চিরবিভাজন রেখা-দুই
এই ঘটনাও গুগাবাবা-র, এবং সেটা শুন্ডি ও হাল্লার লড়াইয়ের সময়কার কাহিনি।
এর আগের দিনের শুটিং শেষ। এবার শেষ দিনের শুটিং। সেখানে গুপীবাঘার গান গেয়ে যুদ্ধ থামানোর এবং আকাশ থেকে মিষ্টিনামানোর দৃশ্য তোলা হবে। জয়সলমিরের বিখ্যাত মিষ্টি হলো ক্ষিরের মিষ্টি। শখানেক বড় বড় মাটির হাঁড়ি তৈরি করিয়ে উটের সারি থেকে শখানেক গজ দূরে এই মিষ্টি ভরে রাখা হলো। এরপর দেখানো হবে আকাশ থেকে নামা মিষ্টি দেখে সৈন্যরা ‘মিঠাই, মিঠাই’ বলে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই মিষ্টি গা-েপি-ে গোগ্রাসে গিলবে, সাথে পেটুক মন্ত্রীও।
ঝামেলা দেখা দিল একটু পরেই।
মিষ্টির হাঁড়ি থেকে মুফতে মিঠাই গেলার কথা শুনে ভারতের চিরবিভাজন রেখা জেগে উঠল সেই জয়সলমিরের মরুভূমির বুকে। উটচালকদের অনেকেই হিন্দু, সাথে মুসলিম তো আছেই। তারা দুদল একই হাঁড়ির মিষ্টি খাবে না! একই বৃন্তে দুটি কুসুম বটেই, তবে কুসুমগুলো আসলেই আলাদা।
কেউ কেউ আবার মিষ্টিই খায় না। যাহোক, তাদের ছুটি দেওয়া হলো।
হিন্দু আর মুসলিমদের হাঁড়ি আলাদা করে বলা হলো, তোমাদের এই হাঁড়ি আর তোমাদের ওই হাঁড়ি।
ওয়াজেদ আলীর ভাষায়, ভারতের সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে।
৭.
তুমি কি কেবলি ছবি?
সিধুজ্যাঠার অলৌকিক স্মৃতিশক্তি ও বিশ্লেষণাত্মক ক্ষমতায় আমরা অনেকেই মুগ্ধ ও আপ্লুত হয়েছি। কেউ কেউ কি ফেলুদার গল্প পড়তে গিয়ে সেই অমানুষি স্মৃতিশক্তিধর হওয়ার কল্পনায় মগ্নও হইনি? তো এই সিধুজ্যাঠা কি আদ্যোপান্তই কাল্পনিক চরিত্র? বাস্তবের কারোর সাথেই কি তাঁর সাযুজ্য নেই?
বিজয়া রায়ের জবানিতে জানা যাচ্ছে তাঁদের এরকম একজন পারিবারিক বন্ধু ছিলেন বৈকি।
আমাদের কথা বইয়ের ভূমিকায় বিজয়া রায় বলছেন, ‘মানিকের বিশিষ্ট বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই চলে গেছেন, নাম লিখতে শুরু করলে এই ভূমিকা শেষ করতে পারব না। শুধু শাঁটুলবাবুর (রাধাপ্রসাদ গুপ্ত) কথা বলব, কারণ মানিক ওঁকে দারুণ শ্রদ্ধা করতেন। ওঁর অপরিসীম জ্ঞানের জন্য। কিছু বুঝতে অসুবিধা হলেই মানিকের কাছে ছুটে যেতাম, উনি বুঝিয়ে দিতেন, মাঝে মাঝে বলতেন, এ-বিষয়ে তোমাকে বোঝাতে গেলে অনেক সময় লাগবে, কারণ আমাকেও চিন্তা করতে হবে। তুমি বরং শাঁটুলবাবুকে জিজ্ঞেস করে নিও। ওঁর অজানা কিছু নেই।’
রাধাপ্রসাদ গুপ্ত বাংলা গানের বিশাল সমঝদার ছিলেন। এছাড়া তিনি ছিলেন নামকরা সংগ্রাহক। প্রচুর কালিঘাটের পট ও প্রাচীন বাংলার চিত্র ছিল তাঁর সংগ্রহে। ‘মাছ আর বাঙালি’ এবং ‘কলকাতার ফেরিওয়ালার ডাক ও রাস্তার আওয়াজ’ তাঁর নামকরা বই। তিনি বিজ্ঞাপনী জগতে ছিলেন এবং সত্যজিতের সাথে তাঁর পরিচয় অনেক পুরনো।
৮.
লক্ষ্মীর পাঁচালি
সবারই জানা যে সত্যজিতের পথের পাঁচালী করতে অন্তত বছর তিনেক সময় লাগে। মূলত আর্থিক সঙ্কটেই ছবির কাজ থেমে যায় বারংবার। এতে ভালোমন্দ দুইই হয়েছে। ছবির শেষ দিকটা দেখে সত্যজিৎ অনেকবারই বলতেন, শেষটা ভালো হয়েছে। শুরুর দিকটা আরেকবার করলে ঠিকমত করা যেত। তিনটে অলৌকিক ঘটনার কথাও তিনি বলতেন যা ঘটেছিল বলে ছবিটা শেষতক করা সম্ভবপর হয়। এক, অলার গলা ভাঙেনি এই সময়ে; দুই, দুর্গা বড় হয়নি তেমন; এবং, তিন, ইন্দির ঠাকরুন মারা যাননি।
অর্থের কারণে সত্যজিৎ নিজের প্রাণপ্রিয় রেকর্ডের সংগ্রহ থেকে বিক্রি করেছিলেন, বন্ধক দিয়েছিলেন নিজের জীবনবিমা পলিসি। সেই সাথে তাঁর সুচিরসঙ্গিনী বিজয়ার গয়নাও বন্ধক দেওয়া হয়। শেষমেশ টাকা এসেছিল পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের তরফে।
সেসময় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন স্বনামধন্য চিকিৎসক বিধান রায়। তিনি ছিলেন ব্রাহ্ম। সত্যজিতের আত্মীয় বেলা সেনের সাথে তাঁর সুসম্পর্ক ছিল। বেলা সেনকে সত্যজিতের মা গিয়ে বলায় তাঁর কন্যা অর্চনা সেন সত্যজিতের সাথে বিধান রায়ের কাছে যান এবং অর্চনার নির্বন্ধাতিশয্যে বিধান রায় পথের পাঁচালীর দায়িত্ব নেন।
বিজয়া রায় এজন্যে আমৃত্যু বেলা সেনের কাছে কৃতজ্ঞ ছিলেন। পথের পাঁচালী না-হলে এই সত্যজিৎকেই আমরা পেতাম কিনা সন্দেহ। এবং এতশত নারী চরিত্রের সহায়তা পাওয়াতেই হয়তো সত্যজিতের ছবিতে আমরা অগণিত শক্তিশালী, বিবেকবান, ও মহৎ নারী চরিত্র দেখি।
৯.
মাটিতে তারকার মেলা
ওম শান্তি ওম (২০০৭) নামের ফারাহ খান পরিচালিত ছবিতে শাহরুখ খান একটি নাচে অংশ নেন বলিউডের ৩০ জন তারকা। যেহেতু তাঁরা কেউই এজন্যে কোনো সম্মানী নেননি, তাই শাহরুখ তাঁদের সবাইকে একটি দামি বিদেশি ঘড়ি দেন যেটির ব্র্যান্ড এম্বেসেডর শাহরুখ স্বয়ং, একটি নোকিয়া এন-সিরিজ সেল ফোন, একটি স্বর্ণমুদ্রা, একটি ওম শান্তি ওমের টিশার্ট এবং একটি ব্যক্তিগত চিঠি যেটি শাহরুখ ও ফারাহ খান যৌথভাবে লেখেন।
ঠিক এরকম না-হলেও কাছাকাছি একটি ঘটনা ঘটেছিল সত্যজিতের একটি ছবির সেটে। সনটা ১৯৫৭। কাজ চলছে পরশপাথর (১৯৫৭) ছবির।
পরেশবাবু পরশপাথর পেয়ে বড়লোক হয়ে পার্টি দিয়েছেন। সেই পার্টিতে হাজির ছিলেন সে-আমলের টালিগঞ্জের তাবড় নামকরা সব অভিনয় শিল্পীরা। নামগুলো শুনলে অনেককেই হয়তো চিনবেন, বিশেষত যদি ছবির জগতের সাথে পরিচয় থাকে। ছবি বিশ্বাস, জহর গাঙ্গুলী, পাহাড়ি সান্যাল, কমল মিত্র, নীতিশ মুখার্জি, সুবোধ গাঙ্গুলী, তুলসী লাহিড়ী, অমর মল্লিক, চন্দ্রবতী দেবী, রেণুকা রায়, এবং ভারতী দেবী। এসব ডাকসাইটে অভিনেতাদের একই সময়ে একই স্টুডিওতে আনার মতো অসম্ভবটি সম্ভবপর করেন সত্যজিতের ছবির প্রযোজক প্রমোদ লাহিড়ী যিনি ঋত্বিকের ছবিরও প্রযোজক ছিলেন।
তাঁর অভিজ্ঞতাই শোনা যাক :
‘সবার কাছে গিয়ে বলেছিলাম যে একদিনের কাজ, একপ্রকার এক্সট্রাই বলা যেতে পারে। আসলে একটা রেকর্ড রাখতে চাইছি, যে একসঙ্গে এত স্টার একই ছবির একটি দৃশ্যে থাকবে। প্রত্যেককেই বলেছিলাম টাকায়পসার ব্যাপারে ভাবতে হবে না, কেউই অখুশি হবেন না। আমার সঙ্গে প্রায় সবায়েরই ব্যক্তিগত পর্যায়ের আলাপ ছিল। রাজি হয়ে গেলেন প্রায় প্রত্যেকেই। শুধু কমল মিত্র রাজি হলেন না। যাকে পাঠিয়েছিলাম তাকে বললেন কী ভেবেছ? আমি এক্সট্রার রোলে অভিনয় করব? তখন আমি নিজে গিয়ে ওঁকে রাজি করালাম। ইনডোর সেটে মডার্ন ফার্নিচারস থেকে সব ফার্নিচার এনেছিলাম। সেটে যে বড় আয়না ছিল সেটাও মডার্ন ফার্নিচার থেকে আনা। খুব দামি সেট বানিয়েছিলাম সে-সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে। আর্টিস্ট পেমেন্ট নিয়ে প্রায় পঁয়তিরিশ হাজার টাকা খরচ হয়েছিল ওই একটা দৃশ্য তুলতে। ছবির শুটিং-এর পরে ওই ডিনার টেবিল-চেয়ারগুলো সবাইকে প্রেজেন্ট করেছিলাম। ওই দৃশ্যের স্মৃতি বহুদিন মনে থাকবে।’
ইতিহাস কতভাবেই যে ফিরে ফিরে আসে!
১০.
কল্পবিশ্বচারী
অনেকেই জানেন, ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি গঠন করেন সত্যজিৎ সমমনা আরো কজনকে নিয়ে, ১৯৪২ সনে। এটা ভারতের দ্বিতীয় ফিল্ম সোসাইটি ছিল, প্রথমটা ছিল মুম্বইতে, তবে সেটা ছিল তথ্যচিত্রভিত্তিক। সত্যজিৎ রায়ের সাথে ছিলেন চিদানন্দ দাশগুপ্ত (অপর্ণা সেনের পিতা), রাধাপ্রসাদ গুপ্ত, বংশী চন্দ্রগুপ্ত, হরিসাধন দাশগুপ্ত ও অন্যেরা। প্রথম দেখানো হয় এতে সের্গেই আইজেনস্টাইনের বিশ্বখ্যাত ছবি ব্যাটলশিপ পটেমকিন (১৯২৫)।
অনেকেই জানেন না, মহানগরী কলকাতায় গড়ে উঠেছিল ভারতের প্রথম কল্পবিজ্ঞানভিত্তিক চলচ্চিত্র কেন্দ্র, সায়েন্স ফিকশন সিনে ক্লাব, ১৯৬৫ সালে। এবং তাতে সত্যজিৎ রায় ছিলেন সভাপতি। অদ্রীশ বর্ধন ছিলেন এর পেছনে, যিনি এর দুবছর আগে ১৯৬৩ সনে প্রকাশ করেছেন কল্পবিজ্ঞানবিষয়ক পত্রিকা ‘আশ্চর্য!’। এবং সায়েন্স ফিকশনের বাংলা হিসেবে কল্পবিজ্ঞান শব্দটিও অদ্রীশ বর্ধনেরই আবিষ্কার। ওই সিনে ক্লাবের সহ-সভাপতি ছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র ও সম্পাদক ছিলেন অদ্রীশ বর্ধন।
‘আশ্চর্য!’ পত্রিকায় সত্যজিতের লেখাও প্রকাশিত হতো। তিনি এর পেছনেও ছিলেন। আর্থার সি. ক্লার্কের সাথে তাঁর বন্ধুত্বের সুবাদে ক্লার্কও এই সিনে ক্লাবের উপদেষ্টা ছিলেন। এই সিনে ক্লাবের উদ্বোধন হয় ১৯৬৫ সনের ২৬ জানুয়ারি, একাডেমি অব ফাইন আর্টস-এ্। এর উদ্বোধন উপলক্ষে বার্তা পাঠান ওয়াল্ট ডিজনি, আর্থার সি. ক্লার্ক, রে ব্র্যাডবেরি, ও কিংসলে অ্যামিস যেগুলোর ছাপা হয় অনুষ্ঠানের স্মরণিকা পুস্তিকায় ও বঙ্গানুবাদ ছাপা হয় ‘আশ্চর্য!’-এর ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই, ১৯৬৫ সংখ্যায়। আর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেখানো হয় ভিলেজ অব দ্য ড্যামড (১৯৬০)।
ক্লাবের নানান দিকে সত্যজিতের তীক্ষè দৃষ্টি ছিল। ক্লাবের লোগো, নিমন্ত্রণপত্রের নকশা থেকে শুরু করে নানাভাবে তিনি যুক্ত ছিলেন। এমনকি ছবিগুলোও বেছে নিতেন তিনি নিজে দেখে। দিল্লি, মুম্বই, এমনকি বিদেশে গেলেও তিনি নজর রাখতেন এরকম চলচ্চিত্রের দিকে যেগুলো এই ক্লাবে দেখানো যাবে।
‘আশ্চর্য!’ পত্রিকায় ১৯৬৭ সনের মার্চ সংখ্যায় সত্যজিতের সাথে অদ্রীশ বর্ধনের সাক্ষাৎকার থেকে আমরা জানতে পারি সেই বিখ্যাত চলচ্চিত্র যা শেষাবধি হয়ে ওঠেনি এবং নানা রহস্যের জন্ম দিয়েছে, সেই ‘দ্য এলিয়েন’ চলচ্চিত্রের সম্ভাবনার কথা, সত্যজিতের হাতে। হলিউডে এই চলচ্চিত্র বাস্তবায়নের ব্যাপারে সত্যজিৎ যা বলেছিলেন সেটা সত্যি হলে হয়তো সত্যজিৎ ও বাংলা তথা ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাস বদলে যেত চিরতরে।
১১.
সম্পাদন, সংশোধন-দুই
পখের পাঁচালী ছবিতে একটি বিখ্যাত সিকোয়েন্স আছে, বৃষ্টির। সেটা শুধু ছবিতে নয়, শব্দেও চিরপরিচিত হয়ে আছে রবিশঙ্করের সেতারে।
সেখানটায় এক জায়গায় আছে জলের ওপর বৃষ্টি পড়ার পর জল-মাকড়সার চুটোছুটি, সেতারের তালে তালে। কিন্তু কিভাবে সম্ভব হলো সেতারের তালে এই পোকার নাচটা বাঁধা?
জবাব দিচ্ছেন সত্যজিতের সম্পাদক দুলাল দত্ত, আবারো।
‘জল-মাকড়সা মোটেই সেতারের ছন্দে ছন্দে নড়াচড়া করেনি। এটা করা হয়েছিল একটা বিশেষ কায়দায়। জল-মাকড়সার স্বাভাবিক নড়াচড়াকেই সুব্রতবাবু তুলেছিলেন। ওই দৃশ্যে ব্যবহারের জন্যে রবিশঙ্করের তৈরি সংগীতের একটা টুকরো তৈরি করা ছিল। সম্পদনার সময় মানিকবাবু বললেন জল-মাকড়সা আসলে যেমনই নড়াচড়া করে থাকুক এডিটিং টেবিলে তাকে নড়তে চড়তে হবে রবিশঙ্করের সেতারের ছন্দে। ফলে জল-মাকড়সার গোটা একটা দৃশ্যের অংশ কেটে সেটাকে অনেকগুলো প্রিন্ট করালেন। এরপর একই অ্যাকশনের অনেকগুলো প্রিন্টকে সেতারের তালে তালে ইচ্ছেমতো জুড়েছিলেন। কখনও সোজা করে, কখনও উলটো করে। এতে দর্শকের মনে হলো সেতারের তালে তালে বুঝি জল-মাকড়সা নড়াচড়া করছে।’
একেই বলে এডিটিং!
১২.
দাদাগিরি
‘অভিযান’ (১৯৬২) ছবি সৌমিত্রের একমাত্র ছবি সত্যজিতের সাথে যেটা অনেক দিক থেকেই আলাদা। এরকম রুক্ষ, পুরুষ চরিত্র সত্যজিতের তো বটেই, অন্য কোনো ছবিতেও সৌমিত্র করেছেন কিনা সন্দেহ। ছবিটায় তাঁর সহশিল্পী ছিলেন ওয়াহিদা রেহমান যিনি তখন বলিউডের সুপারস্টার। ছবির সংলাপও পুরো বাংলা নয়। এখানে তাঁর চেহারা, পোশাক-আশাক থেকে শুরু করে চলাফেরা অবদি বদলে গেছে পুরোপুরি।
এবং এটাই সত্যজিতের সাথে তাঁর একমাত্র ছবি যেখানে তিনি রীতিমতো হাতাহাতি অবদি করেছেন। ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ (১৯৭৯) ছবিতে তিনি বন্দুক ধরেছিলেন, গুলিও চালিয়েছিলেন, কিন্তু হাতাহাতির দৃশ্য ওই একটিমাত্র ছবিতেই।
আদ্যোপান্ত পরিশীলিত, সুসংস্কৃত সৌমিত্রের এই পরিবর্তন আমাদের কিছুটা ধাক্কা দেয়। কিন্তু আরো বেশি হয়তো দেবে তাঁর একটি সরল স্বীকারোক্তি, বাল্মীকি চট্টোপাধ্যায়ের সাথের এক সাক্ষাৎকারে তিনি আমাদের যেটা জানাচ্ছেন। প্রশ্ন ছিল,
“ ‘অভিযান’ ছবিতে মারামারির দৃশ্য ছিল। এই দৃশ্যের ভঙ্গিগুলো কী করে আপনি তৈরি করলেন? আপনার ব্যক্তিগত জীবনে মারামারির কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল কি?”
“
মারামারি করার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তো সকলেরই থাকে। আমারও ছিল। তাই ওই দৃশ্যের জন্য নতুন করে আমাকে মারামারি করা শিখতে হয়নি। শুধু ‘রি-কল’ করতে হয়েছিল মাত্র। মানিকদা যেরকম চেয়েছিলেন, ঠিক সেইরকমই করেছিলাম। ছাত্রাবস্থায় মারকুটে বলে আমার বেশ পরিচিতি ছিল। ভালোই মারামারি করতে পারতাম। বিশেষ করে স্কুল-জীবনেই মারামারিটা করেছি বেশি, কলেজে উঠে আস্তে-আস্তে কমে যায় ওই অভ্যেসটা। তা ছাড়া মারামারি দেখেছিও প্রচুর। কলকাতা শহরে, মারামারির তো কোনো অভাব নেই, প্রায় প্রত্যহই ঘটে। সুতরাং, মারামারির জন্য আলাদা করে ভাবার প্রয়োজন হয়নি। শুধু অভিনয় বলে যে-ব্যাপারটা ঠিকমতো করতে হয় সেটাই করেছিলাম- এই পর্যন্তই।”
একই অঙ্গে মানুষের কত যে রূপ! ‘বড় বিস্ময় মানি হেরি তোমারে, বড় বিস্ময় মানি!’
(হিল্লোল দত্তের পোস্ট : বইয়ের হাট)
”
হিল্লোল দত্ত সত্যজিতের এরকম একশটি নানান ঘটনা নিয়ে একটি বই করতে চেয়েছেন।
অপেক্ষায় রইলাম।
There is definately a lot to know about this subject. I love all the points you’ve made.
trusted canadian pharmacy: legal drugs buy online – canadian pharmacy products
https://buydrugsonline.top/# canadian pharmacy online no prescription
mexican pharmaceuticals online: mexican pharmacy – buying prescription drugs in mexico
Enjoyed every bit of your blog post.Really looking forward to read more. Fantastic.
how does plaquenil work chloroquine brand name
canadian pharmacy reviews canada pharmacy online canadian pharmacy checker
Hey! Do you know if they make any plugins to assist with Search Engine Optimization? I’m tryingto get my blog to rank for some targeted keywords but I’m not seeing very goodgains. If you know of any please share. Appreciate it!
trust online pharmacies: Mail order pharmacy – online pharmacy with no prescription
I think this is a real great blog.Really thank you! Keep writing.
https://canadiandrugs.store/# reputable canadian online pharmacy
canadian pharmacy online no prescription needed: online pharmacy no prescription – best rated canadian pharmacy
I value the blog post. Keep writing.
Great info. Lucky me I discovered your site by accident (stumbleupon). I have book marked it for later!
reliable canadian pharmacy: canada pharmacy online – canadadrugpharmacy com
http://ordermedicationonline.pro/# prescription drugs without prior prescription
online pharmacy reviews: buy medication online – get canadian drugs
Awesome blog article.Thanks Again. Really Cool.
Hello there! I could have sworn I’ve been to this website before but after going through some of the posts I realized it’s new to me. Anyways, I’m definitely happy I came across it and I’ll be bookmarking it and checking back regularly!
https://wellbutrin.rest/# wellbutrin pill
Enjoyed looking through this, very good stuff, thanks . “Whenever you want to marry someone, go have lunch with his ex-wife.” by Francis William Bourdillon.
wellbutrin drug: Buy Wellbutrin XL 300 mg online – cheap wellbutrin xl
Thanks for the blog. Great.
There is noticeably a lot to know about this. I assume you made various nice points in features also.
Hi there just wanted to give you a quick heads up and let you know a few of the images aren’t loading correctly. I’m not sure why but I think its a linking issue. I’ve tried it in two different internet browsers and both show the same outcome.
https://claritin.icu/# ventolin 50 mcg
paxlovid pill: Paxlovid price without insurance – paxlovid cost without insurance
Great blog.Much thanks again. Will read on…
https://gabapentin.life/# neurontin 330 mg
Enjoyed every bit of your blog post.Much thanks again. Will read on…
ventolin buy canada: Ventolin inhaler – ventolin 70
Hey there! I’ve been following your blog for some time nowand finally got the courage to go aheawd and ive you a hout outfrom Dalllas Texas! Just wanted to say keeep up the fantastic job!
I think this is a real great blog.Much thanks again. Awesome.
https://gabapentin.life/# neurontin 300 mg capsule
Hi my loved one! I want to say that this article is amazing, nice written and come with almost all vital infos.I would like to look extra posts like this .
paxlovid price: Paxlovid without a doctor – paxlovid pharmacy
Muchos Gracias for your article.Thanks Again. Fantastic.Loading…
Very informative article.Much thanks again. Keep writing.
Setting Up effuel reviews scam ECO OBD2is not made complex.
http://paxlovid.club/# buy paxlovid online
wellbutrin 150 mg cost: Wellbutrin online with insurance – wellbutrin prices
Great blog article.Thanks Again. Awesome.
https://claritin.icu/# ventolin order
generic neurontin 600 mg: generic gabapentin – neurontin gel
http://claritin.icu/# ventolin 4mg
Great, thanks for sharing this article. Cool.
comprare farmaci online con ricetta: kamagra gel – migliori farmacie online 2023
farmacia senza ricetta recensioni: farmacia senza ricetta recensioni – gel per erezione in farmacia
farmacie online sicure kamagra gold farmacia online
Hi, i think that i saw you visited my blog so i got here to go back the prefer?.I am trying to find things to improve my site!I assume its good enough to use some of your concepts!!
https://avanafilit.icu/# farmaci senza ricetta elenco
farmacie online sicure: avanafil generico – farmacie online autorizzate elenco
Wow, great post.Really looking forward to read more. Fantastic.
viagra acquisto in contrassegno in italia: viagra originale in 24 ore contrassegno – viagra cosa serve
farmacia online migliore: cialis generico – comprare farmaci online all’estero
farmacia online miglior prezzo kamagra oral jelly consegna 24 ore acquisto farmaci con ricetta
miglior sito dove acquistare viagra: viagra cosa serve – miglior sito per comprare viagra online
siti sicuri per comprare viagra online: viagra prezzo farmacia – pillole per erezioni fortissime
comprare farmaci online all’estero: Farmacie che vendono Cialis senza ricetta – farmacia online più conveniente
http://tadalafilit.store/# п»їfarmacia online migliore
comprare farmaci online all’estero: farmacie online affidabili – farmacia online miglior prezzo
farmacia online più conveniente: farmaci senza ricetta elenco – farmacia online senza ricetta
acquistare farmaci senza ricetta: Farmacie che vendono Cialis senza ricetta – farmacie online sicure
comprare farmaci online all’estero Farmacie a roma che vendono cialis senza ricetta farmaci senza ricetta elenco
comprare farmaci online con ricetta: farmacia online miglior prezzo – farmacie online autorizzate elenco
farmacia online miglior prezzo: farmacia online – farmacia online più conveniente
comprare farmaci online all’estero: cialis generico consegna 48 ore – farmacie online autorizzate elenco
http://avanafilit.icu/# farmacia online senza ricetta
farmacia online senza ricetta: kamagra – top farmacia online
farmacie on line spedizione gratuita: avanafil prezzo – farmacia online miglior prezzo
always i used to read smaller content which as well clear their motive, and that is also happening with this piece of writing which I am reading here.
farmaci senza ricetta elenco: kamagra gel – farmacie on line spedizione gratuita
farmacie online autorizzate elenco farmacia online miglior prezzo farmacia online migliore
farmacia online: cialis prezzo – migliori farmacie online 2023
farmacia online miglior prezzo: kamagra gel – farmacie online sicure