জন্মদিনের মোহে
আমার প্রাণের গানের ভাষা
কুমার দীপ
একটা বয়সের পর থেকে মানুষ কেবলই স্মৃতির খোঁড়লে ডুব দেয়, আত্ম-অতীতের স্রােতস্বিনীতে ভাসতে ভাসতে কতো বাঁকের কতো স্মৃতিই তাকে ডাক দিয়ে যায় ! দীর্ঘশ্বাসের করুণ বীণায় ভর করে রবির সুরে সুর মেলাতে চায় – ‘দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না / সেই-যে আমার নানা রঙের দিনগুলি…।’
প্রকৃত জন্মতারিখ মেলানোর রেওয়াজ আমাদের গ্রাম্য সংস্কৃতিতে তখনও ছিলো না বললেই চলে। মা বলতো- চৈত্র মাসের এক ঝঢ়-জলের রাতে তোর জন্ম। জন্মের ক্ষণে সবেদা গাছের বড়ো ডাল ভেঙে গিয়েছিল বলে আমার দাদু না-কি ছোটোবেলায় বলতেন- এই শালা আমার সবেদা গাছের ডাল ভেঙে এসেছে ! বড়ো হয়ে বাবার পুরানো পঞ্জিকার স্তূপ থেকে একদিন আবিষ্কার করলাম- ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে (১৯৭৮) আমার জন্ম। স্বাধীনতা দিবসে নিজের জন্মদিনের অনুভূতিটা আরও রোমাঞ্চকর মনে হলো এক বর্ষার দিনে যখন হারিয়ে যাওয়া একটি সোনার অলঙ্কার খুঁজে পেলে আমার কাকিমা বললো- ‘ও হলো মায়ের অষ্টমগর্ভের সন্তান, ও পাবে না-তো কে পাবে ?’ বিবর্তিত পরের জীবনে ওসব অষ্টমগর্ভপ্রসূত আধ্যত্মিকতার মোহ কেটে গেছে বটে, তবে কৃষ্ণের বাঁশির সুর তো আর কাটেনি হৃদয় থেকে। সে-সুর কেটে গেলে বুঝি আরও অনেককিছুই কাটা পড়ে জীবনে!
দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলার একেবারে শেষপ্রান্তের উপদ্রুত উপকূল শ্যামনগর উপজেলার ভুরুলিয়া গ্রামের জাতক আমি। চারদিকে সবুজ-শ্যামলিমা, শ্রমজীবী কৃষাণ-কৃষাণী, বিরাট ধানের ক্ষেত, ক্ষেতের জলে কই-শিং-মাগুর-শোল-লাটা ইত্যাদি মাছকে ছিপের ডগায় ধরা, আবার জলের ভেতরে ভয়ঙ্কর লকলকে ঢেউ খেলানো জোঁকের শিকার হওয়া, কিংবা আপন গ্রাম থেকে কয়েক কিলোমিটার দক্ষিণে সরে গেলে সুন্দরবন, সুন্দরবনের গা ঘেঁষে বয়ে চলা মালঞ্চ স্রোতস্বিনী, তার তীরে বসে-দাঁড়িয়ে-হেঁটে; প্রকৃতির রহস্যের কতো বিচ্ছিন্ন অনুভব চেটেপুটে; শুরু হয়েছিলো যে তারুণ্য, তার তো কোনো প্রথাগত তারুণ্যসময় সাজে না। অবশ্য, যেখানে একদিন সোনালি ধান রৌদ্র পোহাতো, সেখানে গত ১৫-২০ বছর ধরে লোনা জলের ভেতর রূপালি চিংড়িরা জ্যোৎস্না মাখে, সাঁতার কাটে, ঘেরপ্রভুদের ফাঁদের ভেতর সাদা-কালো রাতে খলবল করে; সকাল হলে নানা রঙের মুদ্রায় রূপান্তরিত হয়ে লুঙ্গির উল্টো গাঁটে, ঘরে-বাইরের ব্যাংকে-ব্যবসাতে নিরাপদে সময় পোহায়। যে মাঠ এককালে কৃষকের কাজ শেষে, সোনালি ধানের হাসি হেসে, ছেলে-মেয়েদের খেলার জায়গা করে দিতো, মাঠ নিজেও খেলতো, সেই মাঠের আজ আর খেলাবার বা খেলবার অবসর নেই; সারা বছরই রূপালি মাছের কাছে বন্দি সে। রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটলে দীর্ঘশ্বাস পড়ে, একদিন ব্যাট ঘুরিয়েছি, বল করেছি যেখানে, সেখানে শুধুই জল আর জল; য্যানো মানুষের তৈরি সমুদ্র। তাহলে আজকের তারুণ্য বোতামবন্দি না হয়ে যাবে কোথায় ? ক্যানোই বা তারা নানারকমের অনাকাক্সিক্ষতকে আকাক্সিক্ষত করে তুলতে চাইবে না ? শৈশবে-শৈশবে, কৈশোরে-কৈশোরে, তারুণ্যে-তারুণ্যে কতো রকমের অসূয়াবৃত্তি আজ ! আমার এবং আমার সময়ের সেই দিনগুলোকে আর বাইরে খুঁজে পাই না। সেই সোনালি অমরত্বকে খুঁজতে গেলে আরও কতো কিছুই যে সামনে এসে সহস্র আমি হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে !
আমার মধ্যে উত্তম বলে যদি কিছু থাকে, তার জন্য আমি বইয়ের কাছেই ঋণী
এই কথাটি মহাত্মা ম্যাক্সিম গোর্কিরই শুধু নয়, ক্ষুদ্রাত্মা এই আমারও। আমি বিশ্বাস করি, বইয়ের চাইতে জ্ঞানী কেউ নেই পৃথিবীতে। থাকবেও না কোনোদিন। বই আমাকে যা দিয়েছে, দিচ্ছে, দিতে পারে; তার সমপরিমাণ তো দূরের কথা, কাছাকাছি কিছুও কারো পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু এই বড়ো বড়ো কথা কি সেদিন জেনেছিলাম, যেদিন বই পড়তে শুরু করেছিলাম ? না। আসলে শিশু য্যামন কারো পরামর্শ না নিয়েই তার মায়ের দিকে ছুটে যায়, আমিও বোধ হয় সেভাবেই বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম কৈশোরে। আমার কিশোর হৃদয়ে সোনার আসন নেয়া প্রথম বইটি – ঠাকুরমার ঝুলি। দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের বড়ো সাইজের একটি ঠাকুরমার ঝুলি ছিলো আমাদের বাড়িতে। আমার ছোটদাকে পড়তে দেখতাম, পরে ওটা আমার রাত-দিনের আশ্রয় হয়ে যায়। এক-একটি গল্প যে কতো বার করে পড়েছি ! রাজকন্যা আর ফুলপরিদের মুক্ত করে আনার রহস্যময় গল্পগুলো কী যে আচ্ছন্ন করে রাখতো আমাকে ! শুধু আমাকে ক্যানো, আরো অনেককে। আমার গ্রামের দু-একজন এমন মানুষ ছিলো যারা পড়তে পারে না বলে আমার কাছে আসতো গল্পগুলোর পাঠ শুনবার জন্যে। এছাড়া নানারকমের রূপকথা পড়ারও সময় ছিলো সেটা। উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর চমৎকার গল্পগুলো, এবং তাঁর ছোটদের রামায়ণ, মহাভারতও পড়েছি মুগ্ধতার মিনারে বসে। নানারকমের ধাঁধার বই এবং গোপাল ভাঁড় বা বীরবলের মতো হাস্যরসের কাহিনিগুলোও পড়া হতো মাঝে-মধ্যে। হাইস্কুলে পড়ার সময়েই শরৎচন্দ্র, ফাল্গুণী মুখোপাধ্যায়, নীহার রঞ্জন গুপ্তসহ অল্পখ্যাত কয়েকজনের উপন্যাসের প্রতিও আকৃষ্ট হয়েছিলাম। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়েই হাতে নিয়েছিলাম মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’। কিন্তু তখনও আমার দাঁত ওটা চিবোনোর মতো পোক্ত হয় নি। বঙ্কিম চন্দ্রের দুর্গেশ নন্দিনী পাঠের অভিজ্ঞতাও প্রায় অনুরূপ। তবু চেষ্টা স্থিমিত হয় না। কলেজে উঠতে না উঠতেই, মগজের আড়ষ্ঠতা ভাঙার সাথে সাথে বইয়ের রাজ্যেরও সভ্য হয়ে উঠি কিছুটা। আমার মামার ছিলো বইয়ের দোকান। শ্যামনগর বাজারের প্রথম এবং বড়ো দোকান পল্লীমঙ্গল লাইব্রেরিতে আমি তখন নিত্য বসি। যতটা কলেজে ক্লাস করি, তার চাইতেও বেশি ক্লাস করি পল্লীমঙ্গলের বইয়ের পাতায়। বই পেলেই পড়ি; বিশেষত কবিতা-উপন্যাস। দোকানে বসে পড়ি, বাড়িতে নিয়ে এসে পড়ি। পড়ে দোকানে রেখে আবার একটা নিই। বঙ্কিম, শরৎচন্দ্র, ফাল্গুণী, নীহার রঞ্জন গুপ্ত, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, নিমাই ভট্টাচার্য, শংকর, যাযাবর, প্রমুখের উপন্যাস আমার শীর্ষ আকর্ষণ; রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জসীমউদ্দীনের কবিতা তখন আমার প্রিয় সহচর। শ্যামনগর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ-এর লাইব্রেরি থেকেও পড়েছিলাম কয়েকটি বই। নির্মলেন্দু গুণের একটি কবিতাসংকলন (সম্ভবত ‘নির্বাচিতা’ কিংবা ‘রাজনৈতিক কবিতা’) এসময় আমার খুব আপন হয়ে ওঠে; বিশেষত রাজনৈতিক কবিতাগুলোকে মনে হয় তারুণ্যের বিস্ফোরণ। বঙ্কিমের ‘কপালকু-লা’, ‘মৃণালিনী’; শরৎচন্দ্রের ‘দেবদাস’, ‘বিপ্রদাস’ ‘দেনাপাওনা’; ফাল্গুণী মুখোপাধ্যায়ের ‘চিতা বহ্নিমান’, ‘শাপমোচন’; নীহার রঞ্জন গুপ্তের ‘ধূপশিখা’; যাযাবরের ‘দৃষ্টিপাত’; নিমাই ভট্টাচার্যের ‘মেমসাহেব’ ইত্যাদি কাহিনিপ্রধান উপন্যাসগুলো আমার তখনকার মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো অনেক দিন। হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলনও দু-একটা পড়েছি। পড়েছি খ্যাত-অখ্যাত আরও অনেক লেখকের উপন্যাস। অপেক্ষাকৃত হালকা চালের, একটু রোমান্স রহস্যে ভরা কাহিনিগুলোই যে বেশি ভালো লাগতো তা এখন বুঝি। পাঠ্য বইয়ের বাইরের বই পড়ার যথেষ্ট স্বাধীনতা ছিলো আমাদের বাড়িতে, তবু রাত্রি জেগে উপন্যাস পড়ছি জানলে বাবা কিংবা ছোটদা বকা দেবেন ভেবে মাঝে-মধ্যে লুকিয়েই রাখতাম পাঠ্যবইয়ের পাতার আড়ালে। মনে পড়ে ‘চিতা বহ্নিমান’ পড়া শেষ করেছিলাম রাত্রি প্রায় ৪টার দিকে। অবশ্য সুনীলের ‘যুবক যুবতীরা’ উপন্যাসটি নাম এবং উপরের ছবির কারণে লুকিয়ে না পড়ে কোনো উপায় ছিলো না। এখনকার ছেলেরা এ্যান্ড্রয়েড মোবাইল বা ট্যাব ছাড়া হাতে অন্য কিছু ভাবতে পারে না, আমি বিকেলে বন্ধুদের সঙ্গে বাইরে বের হলেও হাতে থাকতো একটি বই। আমার একটা নোটবুক ছিলো, যাতে লেখা হতো আমার পঠিত বইয়ের নাম এবং তা পড়ে ক্যামন লাগলো তার সংকেত। সাহিত্যের পাশা-পাশি বাংলাদেশ ও বিশ্বের সাধারণ জ্ঞানের ডায়েরি ছিলো আমার আগ্রহের অন্যতম জায়গা। বিশ্ব ইতিহাসের অসাধারণ ও বিচিত্র সব ঘটনাগুলো এবং খেলাধুলার খবর বরাবরই আলোড়িত করতো আমাকে।
তবে ঠিক গভীর ও চিন্তাশীল সাহিত্য-দর্শনের বইগুলোর সংস্পর্শে এসেছি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স ভর্তি হওয়ার পর। নিজের কেনার সামর্থ্য ছিলো না, কিন্তু বই আমাকে টেনে নিয়ে যেতো বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরির সুবিশাল সংগ্রহশালায় এবং বাংলা বিভাগের সেমিনারে। সেমিনার সব সময় খোলা থাকতো না, যা থাকতো তা ক্লাস টাইমের সময় হওয়ায় ক্লাস না হলেই কেবল সেখানে বসা যেতো। অবশ্য সেমিনার কার্ডের সাহায্যে প্রয়োজনীয় দু-চার খানা বই তুলে রুমে নিয়ে আসতাম ১৫দিনের জন্যে। লাইব্রেরি খোলা থাকতো সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলো বাদে। ক্লাস শেষে রুমে এসে খেয়ে সামান্য বিশ্রাম নিয়ে অথবা না নিয়ে ছুটে গেছি লাইব্রেরিকক্ষে; কখনও আবার রুমে না এসেই। এমন অনেক দিন আছে দুপুরে রুমে না এসে ঢুকে গেছি লাইব্রেরির পেটের ভেতর। হোটেল থেকে ভাত খাওয়ার সেরকম স্বাচ্ছল্য না থাকায় একটা সিংড়া আর দু’গ্লাস জল খেয়েই কোনো কোনো দিন থেকে গেছি বইয়ের ঘরে। দুপুরে ঘুম এলে বইয়ের টেবিলে মাথা রেখে ঝিমিয়ে নিয়েছি ১০-১৫ মিনিট। কখনও আবার ঘুমকে প্রতিহত করতে ভারি ভারি বই রেখে চলে যেতাম পত্র-পত্রিকা ও ম্যাগাজিন-সাময়িকীর কক্ষগুলোতে। রাত আটটায় লাইব্রেরি বন্ধ হওয়ার ১৫ মিনিট আগে সাইরেন বেজে উঠলে শেষ যারা বেরিয়ে আসতো, আমি তাদেরই একজন। কেবল লাইব্রেরিতে বসেই পড়তাম না, লাইব্রেরি কার্ড ছিলো তার মাধ্যমে দুটো করে বই নিয়ে ১৫ দিন রাখা যেতো, ফেরত দিয়ে আবার দুটো। ফেরত দিতে হবে বলে অনেক সময়ই বড়ো বড়ো বইও পড়া হয়ে যেতো অল্প সময়ে। বিমল মিত্রের ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ ১ম খ-টির সাড়ের আটশ’র বেশি পৃষ্ঠা পড়ে ফেলেছিলাম ৭দিনেই। লাইব্রেরি-সেমিনার ছাড়াও দু’একজন বন্ধুর নিকট থেকেও চেয়ে পেতাম দু’একটা বই । আতিকের (বর্তমানে খুলনার বিএল কলেজের বাংলা শিক্ষক) ভালো সংগ্রহ ছিলো, ও প্রায় কাউকেই বই দিতে চাইতো না, তবে আমাকে কোনো দিন না বলে নি। মাস্টার্সের থিসিস করবার সময় অনেক দিনের জন্যে কবি আবু হেনা মোস্তফা কামাল রচনাবলী দিয়ে দারুন উপকার করেছিলো বন্ধু রহমান রাজু (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত ও নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষক। অবশ্য এই মুহূর্তে গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নবপ্রতিষ্ঠিত বাংলা বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন)। বিভাগীয় শিক্ষক, প্রিয় গল্পকার মনিরা কায়েস; যিনি আমাকে যথেষ্ট স্নেহ করতেন, আপা বলবার সুযোগ দিয়েছিলেন, তাঁর নিকট থেকেও পেয়েছি শহীদুল্লা কায়সারের ‘সংসপ্তক’ বা জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর গল্পের মতো বই। আমার গবেষণা সুপারভাইজার প্রফেসর খোন্দকার সিরাজুল হক (বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত গবেষক) স্যারের ব্যক্তিগত বইয়ের সংগ্রহ ঈর্ষণীয়। স্যারের বাসায় গিয়ে যখন যে বইয়ের নাম করেছি, কয়েক মিনিটের মধ্যেই বের করে এনেছেন তিনি। দু-চারটা বই নিয়েছি আরেক প্রিয় শিক্ষক, সাহিত্যের কাগজ চিহ্ন’র সম্পাদক, অধ্যাপক শহীদ ইকবালের নিকট থেকেও। আর এই কর্মজীবনের একটা সময় বই দিয়ে কৃতার্থ করেছে অগ্রজ আশুতোষ সরকারও (বর্তমানে সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের সহাকারি অধ্যাপক।)। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না, এমন কারো নিকটা থেকেও যে দু-একটা বই পড়তে নিয়েছি, সেকথা বলাই বাহুল্য। আবার আমার সামান্য সংগ্রহ থেকেও কেউ কেউ তার প্রয়োজন মিটিয়েছে।
পৃথিবীতে যা কিছু সুন্দর, যা কিছু মহৎ, কবিতা তাকে চিরঞ্জীব করে রাখে
জীবন যে এমন মহোত্তম, বিচিত্র অনুভূতিময়; দুঃখেরও যে আছে মহৎ সৌন্দর্যসুধা; তা জেনেছি কবিতার কাছ থেকেই। কবিতাছাড়া একটা জীবন কতো বধির, বৈচিত্র্যহীন ও দরিদ্রতর হতো তা ভাবতেই শিউরে উঠতে হয়। আজ যখন শেলীর ওই কথাটা পড়ছি; না পড়লেও চিরঞ্জীব অনুভূতিটি অন্তরে যে গেঁথেই আছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কবে হলো কবিতার সাথে সখ্য ? ওই হাইস্কুল জীবনেই। ক্লাস নাইনে পড়বার সময়ে জসীম উদ্দীনের ‘প্রতিদান’ কবিতাটিকে অনুকরণ করে যে কবিতাচেষ্টা করেছিলাম তা শুনে কবিতার শিশিরসামান্যতা খুঁজে পেয়েছিলেন আমার প্রিয় মেসোমহাশয় অনিল রাজ (আমার ‘ভালোবাসার উল্টোরথে’ গল্পের বইটি তাঁকে উৎসর্গ করেছি)। তাঁর প্রশ্রয় ও প্রেরণায় সিক্ত হয়ে বেড়ে উঠতে থাকে আমার কবিতাচিন্তার চারাগুলো। ছন্দ-অলঙ্কার বুঝতাম না, বুঝতাম কবিতা দিয়ে নিজের অনুভূতিগুলো সংক্ষেপে ও ইঙ্গিতপূর্ণ ভাষায় ব্যক্ত করা যায়, যা অন্য কোনোভাবে সম্ভব নয়। এস এস সি পরীক্ষার পরেই আমার কবিতাচর্চায় একটা জোয়ার এসে পড়ে। কলেজের দু’বছরে লিখেছি প্রচুর কবিতা। সারাদিন অন্যভাবে কাটলেও রাতে ঘুমুতে যাবার আগে বসে যেতাম কবিতার খাতা নিয়ে। কবিতার পর কবিতা লিখে যেতাম। আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি গেলেও এটা করবার চেষ্টা করতাম। এই সময় অনেক রাত মামার বাড়ি থাকতাম, সবাই ঘুমিয়ে পড়লে হেরিকেনের আলোয় বসে লিখতাম কবিতা; এক রাতে ৯-১০টি কবিতাও লিখেছি ! ওইগুলো যে কোনো কবিতাই নয়, তা পরে জেনেছি; কিন্তু ওই লেখার প্রচেষ্টাই তো পরবর্তীতে আমাকে প্রকৃত কবিতাভাবনার দিকে টেনে এনেছে। আমি এমন একটা জায়গার ছেলে যেখানে শিল্পসাহিত্যের চর্চা ও প্রকাশের কোনো সুযোগই প্রায় ছিলো না। আমার প্রথম কবিতা ছাপা হতে তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে গমন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। দৈনিক আজকের কাগজের কাগজ পাঠক পাতায় ‘প্রতিবেশিনী’ নামের কবিতাটিই সম্ভবত আমার প্রথম প্রকাশিত কবিতা বা কবিতাপ্রচেষ্টা। এরপর রাজশাহীর স্থানীয় দৈনিক বার্তা, শালুক, মাসিক লোকপত্র ( আমার কবিতার অন্যতম প্রেরণাদানকারী লেখক ফজলুল হক সম্পাদিত) প্রভৃতি পত্রিকায়; রাজশাহী ও এর বাইরের কয়েকটি ছোটকাগজে দু-একটা করে কবিতা প্রকাশিত হতে থাকে। আজকের কাগজের কাগজ পাঠক ও ভোরের কাগজের পাঠক ফোরাম পাতা সে সময় আমার কবিতা, অনুগল্প চর্চার এক মোহন কেন্দ্র। পাঠক ফোরামে ফিচার লিখেছি অনেক, বেশ কয়েকবার সেরাও নির্বাচিত হয়েছি। অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ার সময় আমাদের ব্যাচের বেশ কয়েকজনের উদ্যোগে এবং প্রিয় শিক্ষক, কবি, অধ্যাপক অনীক মাহমুদের তত্ত্বাবধানে গঠিত হয় কাহ্নপা সাহিত্যচক্র। কবিতাই ছিলো এর প্রধান আরাধ্য। বন্ধু শামীম সুফিয়ান (ভালো কবিতা লিখতো, বর্তমানে বিভিন্ন বিজ্ঞাপন স্ক্রিপ্ট তৈরি ও নির্মাণকাজে নিয়োজিত), সোলায়মান সুমন ( গল্প লেখে, আইডিয়াল স্কুল এ্যান্ড কলেজের শিক্ষক), রহমান রাজু, মনিরা ইসলাম মনি (কবিতাপাগোল বন্ধুটি এখন কোথায় তা জানিনে) শেখ শফি (ঢাকার কোনো একটা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত), লিপি বিশ্বাস ( জ্যোৎস্নালিপি নামে এখন গল্প লেখে, দৈনিক সংবাদের ফিচার পাতা সম্পাদনা করে) সহ আমরা বেশ কয়েকজন মিলে কবিতার টানেই একত্রিত হতাম অনীক স্যারের সাথে সাপ্তাহিক আড্ডায়। শহীদুল্লাহ কলা ভবনের সামনের সবুজ ঘাস পরম মমতায় আমাদেরকে বুকে নিতো। এরপর আমার সাহিত্যজীবনকে সুউচ্ছ্বাসে উশ্কে দিতে আবির্ভূত হলো চিহ্ন। বর্তমানে গবেষক, অধ্যাপক ড. শহীদ ইকবালের সম্পাদনায় ১৫ বছর পার করা এই সাহিত্যের কাগজটি আমাদের প্রাণচাঞ্চল্যেই ভরা ছিলো শুরু থেকেই। প্রধান সম্পাদক তখনকার তরুণ শিক্ষক ইকবাল স্যারের বাইরে প্রথম সংখ্যার সম্পাদক ছিলেন নব্বইয়ের কবি শামীম নওরোজ। সঙ্গে ছিলেন তাঁরই বন্ধু গল্পকার শফিক আশরাফ(বর্তমানে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক), কাজল কাপালিক (বর্তমানে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক) সহ আরো কয়েক জন। দ্বিতীয় সংখ্যা থেকেই জুটে যাই আমি, আকতার আরণ্যক (বর্তমানে নটরডেম কলেজের শিক্ষক) এবং সৈকত আরেফিন (বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক)। এরপর একে একে রহমান রাজু, আতিকুজ্জামান, সোলায়মান সুমন, ত্রিস্তান আনন্দ (ঢাকার কোনো একটা ইংলিশস্কুলে আছে), নিত্য ঘোষ (রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক)-সহ আরও অনেকে। টিহ্নতে অবশ্য আমার প্রথম প্রকাশ কবিতা নয়, কবিতা বিষয়ক গদ্য দিয়ে। কবিতা : এখনও কি সেই আকাশে ওঠে গো চাঁদ হেসে ? শিরোনামে সেই দীর্ঘ রচনাটি চিহ্ন’র তৃতীয় সংখ্যার প্রধান প্রবন্ধ হিসেবে বহুল প্রশংশিত হয়েছিলো। প্রিয় কবি আবু হাসান শাহরিয়ার, কবি রহমান হেনরী-সহ অনেকেই, আনকোরা আমাকে অভিনন্দন জানান। এসময় বিভিন্ন ছোটকাগজে কবিতা লিখেছি কম-বেশি। এরপর পুরো বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত অন্যান্য বেশকিছু লেখা লিখলেও কবিতাই আমার নেশা, নৈরাশা ও নান্দনিক প্রত্যাশা পূরণের প্রিয়তম আশ্রয়। কবিতা লেখার সুবাদেই একাধিক উপলক্ষে রাবি শহীদ স্মৃতি সংহশালা সহ বিভিন্ন মঞ্চে প্রিয় স্যারদের সাথে স্বরচিত কবিতাপাঠের সুযোগ পেয়েঠি। কেবল লেখা নয়, কবিতা পাঠের আঙিনায় দাঁড়িয়ে যে অনন্য আনন্দরাজ্যের সন্ধান পাই, যে অতল বেদনায় ডুবে যাই; তা আর কিছুতেই সম্ভব নয় বলেই মনে হয়। কাঁচা তারুণ্যে ‘কবর’ কবিতাটি পড়তে বসে বৃদ্ধ দাদুর বাচনে যতবার বাষ্পরুদ্ধ হয়েছি; ‘দুই বিঘা জমি’র উপেনের দুঃখে আমার পৃথিবীটা যেভাবে দুঃখময় হয়ে উঠেছে; তারুণ্যের মধ্য গগনে বসে চণ্ডীদাস-বিদ্যাপতির বিরহের পদ পড়তে পড়তে প্রেমসমুদ্রের গভীরে যেভাবে ডুবেছি; ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’ পড়তে পড়তে আর্যপূরাণের দৈবসত্ত্বার বিরুদ্ধে মানবসত্ত্বার অবিনশ্বর অগ্রগমনের যে সুর আমি শুনেছি; ‘যেতে নাহি দিব’, ‘পরশ পাথর’, ‘সোনার তরী’ কিংবা আরও অজস্র রবীন্দ্রকবিতা যে ঐশ্বর্যের সন্ধান আমাকে দিয়েছে; নজরুলের ‘নারী’ কিংবা ‘বিদ্রোহী’র মতো পঙক্তিসমূহ যে প্রেরণা জাগিয়েছে; ‘অদ্ভূত আঁধার এক’ কিংবা ‘আট বছর আগের একদিন’-এর জীবনানন্দপ্রসূত কবিতাগুলো যে বিপন্ন বিস্ময় নিয়ে হাজির হয়েছে; সুকান্তের ‘ছাড়পত্র’ অথবা ‘দুর্মর’-এর মতো কবিতা নিচয় থেকে মনুষত্বের যে উন্মোচন আমি উপলব্ধি করেছি, তার কোনো তুলনা চলে না। কবিতামুগ্ধতার তারুণ্য উন্মাদনার সেই দীর্ঘ বিবরণ আজকের পরিসরে দেয়া সম্ভব নয়।
গান যদি পৃথিবীতে না থাকতো !
কার য্যানো একটা কথা আছে, সঙ্গীতের চেয়ে সুন্দর আর কিছু নেই। ঈষৎ যোগ করে আমি বলি, সুন্দর সঙ্গীতের চেয়ে সুন্দর আর কিছু নেই। সুন্দর শব্দটি যোগ করার কারণ হলো, কবিতার য্যামন অকবিতা আছে, তেমনি গানেরও রয়েছে গানহীনতার অজস্র উদাহরণ। ভালো গান হতে তাকে আগে কবিতা হতে হয়। রবীন্দ্রনাথের গান বাঙালির এ্যাতো ভালো লাগার অন্যতম কারণ এর কাব্যগুণ। কাব্যগুণের সাথে সুর-তাল-লয় আর উপযুক্ত কণ্ঠ মিলিয়েই গানের স্বার্থকতা। দেবব্রত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে আকাশ ভরা সূর্য তারা কিংবা হেমন্তর কণ্ঠে এমন দিনে তারে বলা যায়… শুনলে তারুণ্যের ওজন বেড়ে আভিজাত্যে পরিণত হয়। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, দুজনের কণ্ঠেই অপূর্ব লাগে আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে। চিন্ময় মুখোপাধ্যায়, সাগর সেন আর সুচিত্রা মিত্রও রবীন্দ্রসঙ্গীতের এক একটি অপরূপ অধ্যায়। সুমনের গায়কীতেও রবিগানের এক নবমাধুর্য যোজিত হয়েছে। আমার শিক্ষক, প্রায় অকালপ্রয়াত রাবির অধ্যাপক সরোয়ার জাহান বিখ্যাত কোনো শিল্পি নন, কিন্তু তাঁর কণ্ঠে তোমায় গান শোনাবো গানটি আমার তরুণ মনকে মুগ্ধ করেছে অনেক দিন। যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এবং দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইলো না, গান দুটো বিশেষ মুহূর্তে আমাকে কাঁদিয়েছে। আসলে রবীন্দ্রসঙ্গীত এমন একটি সঙ্গীতসমুদ্র যেখানে সিঞ্চন করলে জীবনের প্রায় সব বিশেষ মুহূর্তেরই অতুলনীয় লিরিকের সন্ধান পাওয়া যায়। অজস্র রবিগানই আমার নিত্যদিনের সঙ্গী; এ গানের কথা লিখে শেষ করা যাবে না। বস্তুত, রবীন্দ্রসঙ্গীত না থাকলে বাঙলা গানের মহোত্তম ঐশ্বর্যই যে বাঙালির কাছে অধরা হয়ে থাকতো এ বিষয়ে আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই। নজরুল সঙ্গীতের অনেক গানই আমার তরুণ হৃদয়কে টানতে না পারলেও তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়, শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে, চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়, আমায় নহে গো ভালোবাসো মোর গান কিংবা আধো রাতে যদি ঘুম ভেঙে যায়-এর মতো গানগুলো ভীষণ ভালো লাগার। ফিরোজা বেগমের কণ্ঠে মোরা আর জনমে হংসমিথুন ছিলাম কিংবা আরও অনেক গান শুনে মনে মনে বার বার প্রণাম করেছি শিল্পিকে। স্বপ্নেও দেখেছি তাঁকে। সতীনাথ, মানবেন্দ্র, অনুপ ঘোষালের কণ্ঠেও নজরুলের গান আমার বেশ প্রিয়। বাংলা গানের ঐশ্বর্যে আমি মোহ-মুগ্ধ। প্রথম তারুণ্যেই কাছে থাকতো রেডিও। আকাশবাণীর অভিজাত উপস্থাপনায় কতো গান যে শুনেছি ! মাঝে-মধ্যে শুনতাম রেডিও বাংলাদেশও। প্রেমে না পড়লে প্রেম-বিরহের গানগুলোর আসল ঐশ্বর্য অনুভব করা যায় না। শচীন দেব বর্মণ, জগন্ময় মিত্র, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, তালাত মাহমুদ, সতীনাথ মিত্র, মান্না দে, কিশোর কুমার, শ্যামল মিত্র, আবদুল আলীম, লতা মুঙ্গেশকার, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, গীতা দত্ত, হৈমন্তী শুক্লা, আবদুল জব্বার, রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমিন প্রমুখের গলায় অজস্রবার শ্রুত গানগুলো তারুণ্যের রাশি রাশি স্বর্ণের বন্যা। ভুপেন হাজারিকা, প্রতুল মুখোপাধ্যায় কিংবা পরবর্তী পর্যায়ের সুমন-নচিকেতা-অঞ্জনের বাস্তবমুখি গানগুলো না শুনলে গানেরও যে বীররস আছে তা জানা যেতো কি না সন্দেহ। শচীন কর্তার কণ্ঠে ডাকাতিয়া বাঁশি শুনলে বাঁশি ও বিরহিনী একাকার হয়ে যেতো। জগন্ময়ের তুমি আজ কতো দূরে কিংবা সতীনাথ মিত্রের জীবনে যদি দীপ জ্বালাতে নাহি পারো গান দুটি বেজে উঠলে যেখানে যে অবস্থাতেই থাকি, পঞ্চইন্দ্রিয় খাড়া করে স্থির হয়ে যেতাম। মান্না দে’র যদি হিমালয় আল্পসের সমস্ত জমাট বরফ…; দীপ ছিলো শিখা ছিলো, শুধু তুমি ছিলে না বলে..; গভীর হয়েছে রাত…; কতদিন দেখিনি তোমায়…; যদি কাগজে লিখো নাম…; ক’ফোটা চোখের জল ফেলেছো যে…; এইসব গান শুনে চোখে না হলেও মনে যে নিয়ত জল ঝরাতো সেকথা বলাই বাহুল্য। গ্রামের ছেলে, গ্রামের মেয়েকেই ভালোবাসা; প্রথম বার গ্রাম ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পথে পা বাড়িয়ে গাড়িতে উঠতেই যখন আবার হবে তো দেখা… বেজে উঠেছিলো, তখন চোখ ফেটেই ঝরেছিলো জল। আর কফি হাউজ না থাকলেও মান্নার কণ্ঠটা যে থেকে যাবে সেকথা বলতে আমি দ্বিধাহীন। হেমন্তর কণ্ঠকে মনে হতো ভালোবাসার পরম আদর; এই রাত তোমার আমার…কিংবা মুছে যাওয়া দিনগুলির মতো গানগুলো কোনো কালেই মন থেকে মুছে যাওয়ার নয়। আমার প্রিয়তম নায়ক উত্তম কুমারের ঠোঁটে হেমন্তের বাসন্তি গানেরা কী যে আশ্চর্য পেখম তুলেছে চিরকাল, তার কোনো ভাষা নেই। তেমনি প্রিয় নায়িকা সুচিত্রার মোহভরা ঠোঁটে সন্ধ্যার অবিস্মরণীয় সব গান। তালাত মাহমুদের কণ্ঠে রূপের ওই প্রদীপ জ্বেলে কিংবা তোমারে লেগেছে এ্যাতো যে ভালো.. না শুনলে প্রেমে পড়বার প্রথম প্রহরটা কীভাবে উপলব্ধি করা যায়, সে কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হতো আমার। কিশোর কুমারের এমন কিছু গান আছে, আর কেউ গাইলে সত্যই কি অমন হতো ? কী আশায় বাঁধি খেলাঘর কিংবা এই সেই কৃষ্ণচূড়া’র মতো গানগুলোর কী অপূর্ব মায়া ! আর লতা ! বাংলা না জেনেও বাংলা গানকে অমন অসাধারণ দরদে ফুটিয়ে তোলা, তা লতা ছাড়া আর কারো পক্ষে আদৌ কি সম্ভব ? হারানো সুর সিনেমায় সুচিত্রার হয়ে গীতা দত্ত যখন গেয়ে ওঠেন কানে কানে শুধু একবার বলো, তুমি যে আমার ওগো তুমি যে আমার…, তখন, যৌবনের সেই প্রারম্ভসন্ধ্যায়, সগৌরবে জেগে ওঠে প্রণয়ের সৌন্দর্যসুধা। তুমি কি দেখেছো কভু জীবনের পরাজয় কিংবা ওরে ও নীল দরিয়া’র মতো গানের মাঝেই তখন চিনেছি আবদুল জব্বারকে। রুনা লায়লা ও সাবিনা ইয়াসমিনের কোন গান রেখে কোন গানের কথা বলি ? বাংলাদেশে এই দু’জন শিল্পিই জন্মেছেন যারা গাইলেই গান হয়ে যায়। তবু রুনার যখন থামবে কোলাহল কিংবা সাবিনার একি সোনার আলোর জীবন ভরিয়ে দিলে’র মতো দু-একটি গান আমার কাছে স্পেশাল। সুবীর নন্দী আর এন্ড্রু কিশোরকে চিনতে দেরি হলেও এদের গান চিনতে বিশেষ দেরি যে হয় নি, তা বুঝতে পারি কেউ যখন বলেছিলেন এটা সুবীর নন্দীর গান, অথচ আগেই ওটা আমার শ্রুত এবং পছন্দকৃতও। একুশ শতকের সূচনালগ্নে বিবিসি বাংলা রেডিওর শ্রোতা জরিপের মাধ্যমে যে ২০টি সেরা গান নির্বাচিত হয়েছিলো, তার প্রথমটা ছিলো মানুষ মানুষের জন্যে, জীবন জীবনের জন্যে গানটি। কেবল এই গানটি নয়, আমি এক যাযাবর কিংবা বিস্তীর্ণ দুপারে অসংখ্য মানুষের হাহাকার-এর মতো একাধিক অতুল্য গানের জন্যে ভুপেন হাজারিকা তারুণ্যের প্রথম প্রহর থেকেই আমার শ্রদ্ধেয়। বাংলাদেশের অধিকাংশ তরুণ শ্রোতাই আমি বাংলায় গান গাই-কে মাহমুদুজ্জামান বাবুর গান হিসেবে জানলেও এই অসাধারণ গানটির প্রণেতা প্রতুল মুখোপাধ্যায় মানুষ হিসেবেও এক মহতি তরুণ। তারুণ্যের জীবনভাবনা গভীর হলে প্রতুলের বাদ্যযন্ত্রহীন আকুল কথনভঙ্গির গানগুলো হৃদয়ের অতুল্য সম্পদ হয়ে ওঠে কথামৃতের জন্য। সুমন-নচিকেতার গানগুলো আমাদের তারুণ্যের এক অনবদ্য খোরাক। কেবল সত্যভাষণ ও প্রতিবাদের ভাষা দিয়ে এরা দুজনই অনুকরণীয় শিল্পিমানস; কবিও। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বার সময় মুগ্ধ হয়ে শুনেছি উঠতি শিল্পি মৌসুমী ভৌমিকের মিউজিকহীন সাহসী লিরিকগুলো। আরো পরে এসে লোপা মুদ্রা মিত্র। সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড গানটি যদি মৌসুমী ভৌমিকের কণ্ঠে না শুনতাম, মুক্তিযুদ্ধের শরনার্থীদের বেদনাচিত্র এমন বিশেষভাবে অনুভব করতে পারতাম বলে মনে হয় না। তার আমি শুনেছি সেদিন তুমি গানটিও অনবদ্য। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সাঁকোটি দুলছে’, জীবনানন্দের ‘আবার আসিব ফিরে’ কিংবা জয় গোস্বামীর ‘বেণী মাধব’কে যেভাবে কণ্ঠে তুলে নিয়েছেন লোপা, এক কথায় অভিনব। বাংলা গানের আর এক মহতি সংযোজন দেশপ্রেমের গান। বাঙালির অন্তরের দেশপ্রীতি নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ করা যায়, কিন্তু তার দেশপ্রেমের গানগুলোর মাধুর্য নিয়ে কোনো সন্দেহ করা চলে না। সেই স্কুলজীবন থেকে গেয়ে আসছি আমার সোনার বাংলা আর আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি গান দুটি; আজও পুরনো মনে হয় না ! মাঝে বিষিয়ে ওঠা মন অনেকবারই গেয়ে উঠেছে এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের ‘দাসী’ সে যে আমার জন্মভূমি; তবু দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের এই গানটির আসল মাধুর্য আমাকে আপ্লুত করে, মুদিত নয়নে হারিয়ে নিয়ে যায়। যা হোক, ধান ভানতে শিবের গীতের মতো তারুণ্য লিখতে বাংলা গানের গীত আর গাইতে চাই না; শুধু বলি, ভালো গান ভালোবাসি, বেসে যাবো আমরণ।
বন্ধু, তোমার পথের সাথীকে চিনে নিও…
‘শেষের কবিতা’র অমিত বলেছিলো, আমার বন্ধুভাগ্য ঈর্ষাযোগ্য, শত্রুভাগ্য শোচনীয়। বাক্যের প্রথম অংশটি মাঝে-মাঝেই আমি বলি; দ্বিতীয় অংশটি কদাপি নয়। তারুণ্যের যখন জন্ম হয়নি, বন্ধুত্ব নামক অনুভূতিরই আবির্ভাব ঘটে নি; বন্ধু ছিলো তখনও। মার্বেল খেলার সাথী, আম কুড়ানোর সাথী, ফুটবলে লাথি দেওয়ার সাথী, পরান স্যারের পাঠশালায় যাওয়ার সাথী, স্কুলে যাওয়ার সাথী; এই সব সাথীই তো ছিলো তখন প্রাণের বন্ধু। মার্বেল খেলতে খেলতে একদিন স্বপনের সাথে মারামারি হয়েছিলো, কথাও বন্ধ ছিলো কিছুদিন; কিন্তু এক ঝড়ের বিকেলে আম কুড়াতে গিয়ে দুজনেই যে কথা বলবার জন্য গুমরে মরছিলাম, এবং মরে গেলেও যে আমের ভাগ কাউকে দেয়া যায় না, সেই আমটিই যে আমরা ভাগাভাগি করে নিয়েছিলাম, তার কি কোনো তুলনা আছে ? দু’-একবার বিরাট হাতা-হাতি হয়েছিলো প্রাইমারি ক্লাসের প্রিয় বন্ধু নাজমুস সাদত লাকির সঙ্গে; মুখ দ্যাখা-দেখিও বন্ধ ছিলো বহুদিন। তবু সেই যে একদিন ওর বাড়িতে ডেকে নিয়ে আলতাবরণ তেতুল খাইয়েছিলো, কোনোদিন কি ভুলতে পেরেছি তা ? প্রাইমারি স্কুলে সে-ই তো ছিলো আমার সবচাইতে কাছের বন্ধু ! আমার বাবারা দু’ভাই; বাবার চার ছেলে, কাকার একমাত্র। সাধন ও আমি; দু’ভাই বন্ধুর মতোই; একসাথে স্কুলে, খেলার মাঠে, আরও অনেক জায়গায়। ভুরুলিয়া সরকারি মডেল প্রাইমারি স্কুলে যাওয়ার পথে সামনে দিয়ে যদি একটা নির্বিষ সাপ ডান দিকের থেকে বাঁয়ে যেতো, সাধন বলতো, হাঁট, ফিরে যাই, আজ আর স্কুলি যাবো না। ফাইভে বৃত্তি পরীক্ষার ব্যাচ হিসেবে রাতের আঁধারে হেরিকেন (আলো) হাতে আমাদের সেই দুর দুরু বাড়ি ফেরার দৃশ্যগুলো স্মৃতিপটে আজও অম্লান। দীঘির পাড়ের ঘুট্-ঘুটে অন্ধকারের ভেতর অনেক কবর ছিলো; মনে হতো কেউ থেকে রাত হে গ্রামের সেই অবস্থা আজ আর নেই, সবখানে মানুষের বসতি এখন। হাইস্কুলের বন্ধুরা একটু বেয়াড়া হয়, সবকিছুতে অতিমাত্রায় কৌতূহলের পাশাপাশি অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও নিরীহকে বিরক্ত ও ব্যতিব্যস্ত রাখার কাজে কিছু ছেলে এসময় নিজেকে নিয়োজিত রাখে। আরও একটি কুৎসিত জিনিসের অপব্যবহার করে কেউ কেউ; না বুঝেই : সাম্প্রদায়িকতা। আমি দেখেছি আমার কয়েক জন সহপাঠীকে এই উভয়ধরনের বেয়াড়াপনায় মাঝে-মধ্যে লিপ্ত হতে। একই সঙ্গে কোনো ছেলে যদি দুর্বল, সংখ্যালঘু এবং নিরীহ হয়, তাহলে তার ভালো থাকার উপায় কম, ওই কয়েকজনের আক্রমণ থেকে। ক্লাসের ভালো ছাত্র হওয়ায় আমি অবশ্য এধরনের আক্রমণের শিকার হইনি কখনও। এপর্যায়ে আমার সেরা বন্ধু নিমাই চন্দ্র মণ্ডল। এক বছরের বড়ো নিমাই দা সেভেন থেকে এইচ এস সি পর্যন্ত সহপাঠী। শারীরিক শক্তি, সততা ও সাহসিকতায় জুড়ি ছিলো না তার। লঘু কিংবা দুর্বলেরও এক ভালো আশ্রয় সে। স্কুল থেকে খেলার মাঠ, সবখানেই আমাদের নৈকট্য ছিলো চোখে পড়ার মতো। অনেক বন্ধুর সাথে দু-একবার মনোমালিন্য হয়েছে, কিন্তু এই বন্ধুটির সাথে আজও কোনো মালিন্য নেই। আজও আমি বাড়ি গেলে, নিমাইদা যদি খবর পায়, আসবেই আমার কাছে। গ্রামের মানুষের মধ্যে নানা কারণে কখনও কখনও ঘোরতর বিরোধ তৈরি হয়, খুব ভালো সম্পর্কের দু’জন মানুষ কিংবা পরিবারের মধ্যেও একে অপরের সামাজিক কর্মকা- বর্জন থেকে শুরু করে কথা-বার্তা ওঠাবসাও বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটে। ঘটেছে আমাদের ভুরুলিয়া গ্রামের সাথে নাগবাটি গ্রামের মানুষেরও। কিন্তু আমাদের বন্ধুত্বে বিরোধ ঘটে নি কখনও। স্কুল সহপাঠিদের মধ্যে সাহিদুল, পাপড়ি (সহপাঠিনী), লিটন, শশাংক প্রমুখের নামও উল্লেখযোগ্য। গ্রামের সেই উচ্ছ্বল দিনগুলোতে সহপাঠিদের বাইরে মনে রাখবার মতো ভালো বন্ধু আরও ছিলো। অনেক সিনিয়র বাচ্চু ভাইয়ের সঙ্গে য্যামন ছিলো চমৎকার বোঝাপড়া, তেমনি ক্লাসে এক বছরের জুনিয়র হওয়া সত্ত্বেও তপন কিংবা তাপসের সাথে ছিলো রাত-দিনের চলা-ফেরা। কোথায় ছিলাম না আমরা ? খেলা-ধুলা টিভি-সিনেমা কিংবা কোথাও দলবদ্ধভাবে যাওয়া; সব খানেই ছিলো আমাদের চুম্বকের মতো একত্ব। ১৯৮৮ সালের প্রলয়ঙ্কারী ঝড়ে গাছ-পালা ফল-ফসল থেকে শুরু করে ঘর-বাড়িও হয়েছিলো লণ্ডভণ্ড । বই-পত্র নষ্ট হয়ে যাওয়ায় সেবার ফাইনাল পরীক্ষা না দিতে পারা অজয়ও এক বছর পিছিয়ে তপন-তাপসদের সাথে একাকার বন্ধু। এস এস সি পরীক্ষার পর কাকাতো বোন পুতুলদির বিয়ে হলে ভগ্নিপতি বীরেন বাবুর সাথে তৈরি হয় আরেক আকর্ষণীয় বন্ধুত্বের। বন্ধু ছিলো একই উপজেলার কাচিহারা গ্রামেও। এই সব বন্ধুকে ছেড়ে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম, লাজুক স্বভাবের এই আমারও জুটে গ্যালো নতুন নতুন বন্ধু। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ছাত্রদের একটা বড়ো অংশ থাকে আশে-পাশের মেসগুলোতে। চারুকলা বিভাগের পাশে মেহেরচ-ী গ্রামের সবুজ ছাত্রাবাস ছিলো আমার প্রথম আবাসনের জায়গা। নিজের কোনো সিট ছিলো না, পরম হিতৈষি মনোসিজদা’র (অর্থনীতি বিভাগের অন্যতম মেধাবি ছাত্র) রুমে কখনও তার সাথে, কখনও দাদার বন্ধু সুধাংশুদার সিটে ডাবলিং করেই রাত্রি কাটাতাম। দুপুরে ঘুমের দরকার ছিলো না সে তারুণ্যে; রাতেও খুব কম ঘুমেই কেটে যেতো। এখানে শুরুতে পেয়েছিলাম এক বছরের সিনিয়র অপুদার অমায়িক বন্ধুত্ব। একই ইয়ারের অনুপদা, যে কি না মান্নাদে’র গানের অনন্য ভক্ত, তার সাথেও ছিলো বলবার মতো হৃদ্যতা। তবে এই সবুজ ছাত্রাবাসের বন্ধুত্বের সেরা প্রাপ্তি আবু কালাম আজাদ, বাংলা বিভাগে আমারই সহপাঠি বিধায় ক্লাসে যাওয়া-আসা থেকে শুরু করে সবখানেই আমাদের যৌথ চলাচল। কিন্তু এই আনন্দদিনেরও পরিবর্তন এলো। কয়েক মাসের ব্যবধানেই আমাকে হলে উঠবার জন্য তৈরি হতে হলো। মনোসিজ দা’র সিট হলো; কিন্তু তিনি নিজে না উঠে আমাকেই হলে পাঠালেন। যে দিন শাহ্ মখদুম হলের ১৩৪ নং কক্ষে রাত্রি যাপনের জন্য যাই, সে দিন শুধু মন খারাপই করি নি, কেঁদেছিলামও। আমার ঘরকুনো মন; যেখানে একবার ভালো লাগে, মায়া পড়ে যায়, সেখান থেকে বিচ্যূতি সহজে মেনে নিতে পারে না। তবে ১৩৪-এও পেয়ে গেলাম দারুণ এক অভিভাবক; রসায়ন শাস্ত্রের বিশিষ্ট শিক্ষার্থী নরেশ চন্দ্র দাশ। নরেশ দা’র অমায়িক আচরণ, হলের কোলাহল মুখরিত পরিবেশ, ২৪ঘণ্টা চলমান স্যাটেলাইট চ্যানেলযুক্ত টেলিভিশন– এই সব আমার মনকে আগের চাইতে চনমনে করে তুললো অচিরেই। নতুন নতুন বন্ধুও পেতে থাকলাম। ভালো রেজাল্টের সুবিধা নিয়ে নরেশ দা চলে গেলেন দোতলার সিঙ্গেল রুমে, কিছুদিন পর আমি প্রথমে উঠলাম ১২৯ এ, আরও পরে ১২৬ নং কক্ষে। এই পর্বে পেলাম আরেক অহমিকাহীন অগ্রজ, মাস্টার্সের আশুতোষ সরকারকে। নরেশ দা’রও সিনিয়র এই দাদা ১ম বর্ষে পড়া আমাকে কেবল আপনিই বলতেন না, অন্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতেন জুনিয়র বন্ধু হিসেবে। আমার সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনির এই বড়ো ভাই, মাস্টার্স শেষে এম ফিল গবেষকরূপে আরও কিছুদিন রাজশাহী ছিলেন বিধায় বন্ধুত্বটা গাঢ়তর হয়েছিলো। পরবর্তীতে কর্মসূত্রে একই শহর বাগেরহাটে অনেক দিন অবস্থান করেছি আমরা। ১২৯ এবং ১২৬ এ রুমমেট ছিলেন যশোরের দীপঙ্কর দেবনাথ। দীপুদা চলে গেলে গোপালগঞ্জের বাবুল দা। সিনিয়র হলেও এঁরা বন্ধুর মতন। এসময়ই আমার বিছানায় দ্বৈতভাবে থাকবার জন্য আমন্ত্রণ জানাই আতাহারকে। সে এক দ্বৈত জীবন। সবুজ ছাত্রাবাসে থাকতেই একাডেমিক কিছু কাগজ-পত্র কপি করার সূত্রে পরিচয় হয়েছিলো সহপাঠী আতাহার আলীর সাথে। একই বিছানায় শোয়া হলেও প্রায় সব রাতেই, ও আগে ঘুমিয়ে যেতো। আমি বসে থাকতাম পড়ার টেবিলে; কবিতার জন্য, গল্পের জন্য কিংবা অন্য কোনো জীবনভাবনার জন্য। এই অমায়িক সহপাঠির সাথে কেটেছে বন্ধুত্বের এক অনুপম অধ্যায়। এই সময়ই আবিষ্কৃত হয় আরেক অসাধারণ বন্ধ রেজওয়ানুল হক জুয়েল। রাজশাহীরই গোদাগাড়ির এই বন্ধুর বাড়িতেও গেছি বেশ কয়েকবার। আজাদ-আতাহার-জুয়েল-দীপ– একই বৃন্তে গাঁথা। ক্যাম্পাসে ঘোরা, শহরে যাওয়া কিংবা যে কোনো সমস্যা সমাধানে, একাট্টা চার নাম। একজনের কাজ থাকলে, চারজনই যাবে। মোবাইল ছিলো না তখন, কিন্তু মনের যোগাযোগের প্রভাবেই আমাদের অনিবার্য মিলনমেলা, ইচ্ছে যখন। আমি তখন সৈয়দ আমির আলিতে, আজাদ লতিফ হলে, আতা ও জুয়েল এস এম হলে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এই তিনটি হলই গায়ে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে; মাঝখানে বড়ো ফাঁকা জায়গা। তিন হলের ছেলেদের হাঁটা-চলায় প্রায় সারারাতই সজাগ থাকে এই এলাকা। আমাদের একই লাড্ডু চারজনে কামড়ানোর রাতগুলোও মাঝে মাঝে হয়ে উঠতো রোমান্স জাগানিয়া। রাত বারোটায়ও পেপসি বা নাস্তা সেবনের জন্য রিকশায় চেপে কাজলা-তালাইমারি চলে গেছি আমরা। আতা-জুয়েল দীর্ঘদেহী; ৬ ফুটের জোয়ান। আতা’র ওজন ৯০ কেজির উপরে, জুয়েলের ৮০’র নিচে নয়। খাওয়াতেও দুজনের জুড়ি মেলা ভার। ডাইনিং-এ সাধারণের খাবারে ওদের হতো না; প্রায়ই এক্সট্রা বাটি তরকারি লাগতো; গোশ্তো হলে তো কথাই নেই ! একবার আমি ৫/৬ জনের জন্যে যে খিঁচুড়ি রান্না করেছিলাম, তা ওরা দুজনেই খেয়ে ফেলেছিলো। আতাহারের বাড়ি কুষ্টিয়ায় বেড়াতে গিয়েই প্রথম দেখেছি রবিঠাকুরের শিলাইদহের কুঠিবাড়ি, লালন শাহের মাজার। কেবল আনন্দ উদ্যাপনে নয়, একে অপরের দুঃখক্ষণগুলোকেও ভাগ করে নেয়ার চেষ্টা করতাম আমরা। প্রত্যেকেই প্রত্যেকের প্রেম-বিরহ থেকে শুরু করে পারিবারিক-সামাজিক প্রায় সব ধরনের কাহিনিই শেয়ার করতাম। আমার পারিবারিক দারিদ্র্যের ইতিহাসও লুক্কায়িত ছিলো না ওদের কাছে। বাইরে বের হলে চা-নাস্তা বা রিকশা ভাড়া আমাকে দিতেই দিতো না। আমি রাত-দিন লাইব্রেরি-সেমিনার এবং পড়ার টেবিলের সঙ্গের আঠার মতো লেগে থেকে তৈরি করা নোটগুলোও ওদেরকে দিতাম অবলীলায়। বিশেষত আজাদ পড়ালেখার ব্যাপারে আমার উপরেই নির্ভর করতো ব্যাপকভাবে। অনার্সে ওর সেকেন্ড ক্লাস হুমকির মুখে পড়লে খুব ভেঙে পড়েছিলো। আমিই ওকে ভরসা দিয়েছিলাম। মাঝে-মধ্যে দু-একটা বইও কিনে আনতো সে। সাহিত্যে আমার বিশেষত্বকে বিরাট মূল্য দিতো জুয়েল। আতাহার নিজে পড়ালেখার চেষ্টা করলেও আমার প্রতি ছিলো এক ধরনের আত্মিক নির্ভরতা। আমাদের মাস্টার্স-এর ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। শীতের রাত। ১১টার দিকে আতাহার আর আজাদ এলো সৈয়দ আমির আলি হলে আমার ১৩২ নং কক্ষে। জুয়েলের মা মারাত্মক অসুস্থ। জুয়েল চলে গেছে। আতাহার বললো, কী করবি ? আমি বললাম, তিন জনে মিলে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তবে সময় তো কম। একদিন বাদেই পরীক্ষা। আমার আবার ভালো রেজাল্ট করবার একটা টেনশান আছে ভেতরে ভেতরে। কিন্তু জুয়েল মায়ের জন্যে বাড়ি চলে গেছে, আমরা কি নিশ্চিন্তে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে পারবো ? না। সিদ্ধান্ত নিলাম রাতেই আমরা জুয়েলের বাড়ি যাবো। কিন্তু কীভাবে ? বারোটা প্রায় বেজে গেছে। আমি তখনও ভাত খাই নি। শীতের রাতে আগে ভাত খেলে অনেক সময় তাড়াতাড়ি ঘুম আসে, ঘুমকে প্রতিহত করতে পারলেও প্রবল ক্ষুধা লাগে বলে রাত্রি ১টার দিকে আমি ভাত খেতে শুরু করেছিলাম। ডাইনিং-এর ম্যানেজার কৃষ্ণ দা’কে বলে আসতাম। বিশ্বস্ত কর্মচারি ( সম্ভবত রণজিৎ ! নাকি শচী ? বড়ো ভাইয়েরা কেউ তাকে শচিন বলে ডাকতেন !) এসে আমার রুমে ভাত রেখে যেতো। যা হোক, আতা-আজাদ রেডি হতে গ্যালো। কিন্তু জুয়েলের মা’র যদি বড়ো কোনো দুর্ঘটনা ঘটে ! তাহলে জুয়েল পরীক্ষা দেবে কীভাবে ? আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। আমাদের বাংলা বিভাগের তখনকার চেয়ারম্যান ছিলেন জুলফিকার মতিন স্যার। কবি-কথাসাহিত্যিক-প্রাবন্ধিক এই প্রিয় মানুষটিসহ বেশ কয়েকজন শিক্ষকের সাথে আমার একটা পরিচিতি ছিলো লেখালিখির সূত্রে। আমি হলের টেলিফোন থেকে ফোন করে, স্যারকে সব বললে, স্যার বললেন, তোমরা খবর রাখো, যদি সেরকম কিছু ঘটে আমাকে জানাইও। প্রয়োজনে একটা পরীক্ষা পিছিয়ে দেয়া যাবে। আমি দ্রুত খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বাইরে প্রচ- শীত। দুটো ফুল সোয়েটারের উপর একটা হাফ সোয়েটার, মাফলারের উপর পুরো শীতটুপি জড়িয়ে বাসস্ট্যান্ডের দিকে রওনা দিলাম। রিকশাও যেতে চায় না; আমাদের অবস্থা জানাতেই একজন রাজি হলো। কিন্তু কয়েক কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে বাসস্ট্যান্ডে এসে বাস তো দূরের কথা, কোনো টেম্পুগাড়িও যেতে চাইলো না। আমাদের অনুনয়ে একটা টেম্পুওয়ালার বরফ গললো। রাজশাহী শহর থেকে গোদাগাড়ি জুয়েলদের বাড়ি যেতে এক ঘণ্টার বাসরাস্তা। টেম্পুটার দরজা পলিথিনে মোড়া ছিলো, তবু ঠান্ডায় জমে যাওয়ার উপক্রম। বিশেষত হাঁটু থেকে নিচের অংশটুক অবশ হওয়ার মতো। টেম্পুসহ জুয়েলদের ঘরের দরজায় যখন পৌঁছলাম, হয়তো দেড়টা বা তার বেশি বেজে গেছে। আমাদের আগমনে আপ্লুত জুয়েলের মা-বাবা। মা’য়ের অবস্থারও তখন কিছুটা উন্নতি হয়েছে। রাতে তিনজনই এক খাটে ঘুমোলাম। কিন্তু ঘুম কোথায়, কিছুক্ষণ পরেই সেহেরি করবার জন্য ডাক পড়লো। আমি ছাড়া আর সবাই রোজা রাখা মানুষ। খুব ভোরে আমরা রওনা হবো বলে আমাকেও খেতে ডাকলো। ঘুম জড়ানো চোখে, শেষ রাতে খাওয়ার অভ্যাস না থাকায় আমি খেলাম না। না খেয়েই রওনা দিলাম ভোরে। জুয়েলের বাবা-মা, আমার প্রিয়-শ্রদ্ধেয় কাকা-কাকিমার সাথেও গড়ে ওঠে দারুন সম্পর্ক। পড়া-লেখা শেষ করে চলে আসবার পরও যতটা না জুয়েলের সাথে যোগাযোগ, তার চাইতে কাকার সাথে কম ছিলো না। মোবাইল ফোনের ব্যবহার শুরু হলে কাকাই আমাকে ফোন করতেন মাঝে মাঝে; আমৃত্যু। জুয়েল-আতা-আজাদের বাইরে বলবার মতো বন্ধুত্ব ছিলো আরও অনেকের সাথে। সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে উক্ত তিনের কোনো সম্বন্ধ ছিলো না। সেদিক থেকে সহপাঠী সোলায়মান সুমন, রহমান রাজু, মনিরা ইসলাম মনি, জ্যোৎস্নালিপি, আতিকুজ্জামান, নুরুল ইসলাম, শামীম সুফিয়ান, শেখ শফি, নিত্য ঘোষ, আমিনুর; ঠিক পরের বর্ষের সৈকত আরেফিন, ত্রিস্তান আনন্দ এবং অগ্রজ শামীম নওরোজ, শফিক আশরাফ, তুহিন ওয়াদুদ, তুষার কান্তি, আকতার আরণ্যক, হাসানুজ্জামান প্রমুখের সাথে উল্লেখ করবার মতো সখ্য ছিলো। সুমন আমাকে ডার্লিং বলে ডাকতো, আমিও ; এখনও সে ডাক অব্যাহত আছে। বুদ্ধিমত্তা ও নেতৃত্বে রাজু সেরা; সে কারণে ব্যক্তিজীবনেও দারুনভাবে সফল। মনির মধ্যে কবিত্ব, পাগালামী, সরলতা সবই ছিলো। প্রায় প্রতিদিনই নতুন কোনো কবিতা লিখবার চেষ্টা করতো সে। শোনাতো আমাদেরকে; শুনতো আমাদেরটাও। আমরা দু’জন একদিন হাসান স্যারের (হাসান আজিজুল হক) বাসায় গিয়ে অনেকক্ষণ গল্প করেছিলাম স্যারের সঙ্গে। লিপির গল্পের হাত ভালো। বন্ধু হিসেবে খুব বিশ্বস্ত ও ইতিবাচক। কবিতা আবৃত্তির পাশাপাশি ‘রক্তকরবী’র মতো নাটকও মঞ্চস্থ করেছি আমরা। অনেক বইয়ের সংগ্রাহক ও পাঠক, প্রখর রুচিশীল, সংস্কৃতিবোধসম্পন্ন আতিকের সঙ্গে একই জেলার আমার ছিলো আন্তরিক এক সম্পর্ক। পাশের জেলা নবাবগঞ্জের ছেলে নুরুলের সাথে বেশি সময় না কাটালেও নির্মল একটা সম্পর্ক ছিলো আমাদের। আমার একটি কবিতাকে প্রচ- পছন্দ করতো সে; আমার কোনো একটি লেখাকে ও-ই প্রথম কোনো গবেষণাগদ্যে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করে। শামীমের মাঝে কবিত্ব ছিলো; ছিলো মানুষকে মুগ্ধ করবার মতো উপস্থাপনাশক্তি। দারুন মজাদায়ী এই বন্ধুটি এখন নানারকমের সৃজনশীল বিজ্ঞাপন নির্মাণের সাথে জড়িত। শফিও সরল চিত্তের কবিস্বভাবী এক দারুন বন্ধু। আমার কবিতাকে নির্মল সমর্থন দেয়া এই বন্ধুটি একাধিক পত্রিকার জন্য কবিতা চেয়ে চেয়ে নিতো। নিত্য’র সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষ দিকেই যেটুকু বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছিলো, পরে চিহ্ন’র সুবাদে আরও কিছুটা নৈকট্য লাভ করে তা। সহপাঠী অনেকের চাইতে প্রগাঢ় বন্ধুত্ব ছিলো সৈকতের সাথে। ভোরের কাগজে আমার অনুগল্প পড়ে আমাকে খুঁজে নিয়েছিলো সে। ও য্যামন আমার লেখা-লেখিকে সব সময় সম্মান করেছে; তেমনি আমিও ওর গল্পের এক অন্যরকম ভক্ত। সৈকতের অমায়িক সরলতা, অহমিকাহীন শিল্পবোধ আমাকে আজও মুগ্ধ রাখে। আমার খুব কাছের থেকে, অগ্রজ-অনুজ ও বন্ধুদের বেশ কয়েক জন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছে। একমাত্র সৈকতকেই এপর্যায়ে সর্বোচ্চ যোগ্য বলে মনে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হয় নি, কিন্তু সে যোগ্যতার কমতি ছিলো না যার, সে সৈকতেরই বন্ধু কবি ত্রিস্তান আনন্দ বাবু। বাংলা সাহিত্য থেকে শুরু করে বিশ্বসাহিত্য ইতিহাস-দর্শন-ধর্মদর্শন-বিজ্ঞান এই নব বিষয়েই দারুন পড়াশোনা ছিলো তার। চিহ্ন’র আড্ডায় ওর আলোচনা মুগ্ধবৎ শুনতাম আমরা; এমনকি আমাদের গুরু শহীদ ইকবালও। ওর সম্ভাবনা সম্পর্কে উচ্চাশা থাকলেও কী কারণে ছেলেটা নিজেকে আড়ালে রাখলো পরবর্তী জীবনে তা এক রহস্য বটে। শামীম নওরোজ যথার্থই কবিত্বের অধিকারী। মাত্র একটি কবিতা পাঠের পর থেকেই শামীম ভাইয়ের কবিতার আমি মুগ্ধ পাঠক। তার অস্বাভাবিক রকমের সাহসী বাচনগুলো আমাদেরকে মোহিত রাখতো। শফিক আশরাফ যতটা গল্প লেখক, তার চাইতে বেশি সাহিত্যের সমোঝদার পাঠক। তার কথার পরতে পরতে এক ধরনের শিল্পবোধ প্রকাশিত হতো। রংপুর রোকেয়া বিশ্ববিদ্যলয়ের শিক্ষক, ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সুশীলসমাজের তরুণ মুখ, ড. তুহিন ওয়াদুদকে এখন অনেকেই চেনেন। বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত তুহিন ভাই তার উত্তমোচিত চেহারা, শুদ্ধ-সাবলীল ও দৃঢ় উচ্চারণের জন্য অচিরেই যে মিডিয়ার একজন মধ্যমণি হয়ে উঠবেন তা বলাই বাহুল্য। রুচিবোধ সম্পন্ন আরেক সাহিত্যের সমোঝদার তুষার দা’র নিকট থেকে পড়া-লেখার ব্যাপারে কোনো কোনো সময় পেয়েছি প্রয়োজনীয় সুপরামর্শ। চিহ্ন’র আড্ডার বাইরে আকতার ভাই বা হাসান ভাইয়ের সাথে সেরকম সময় কাটে নি যা বিশেষ করে উল্লেখ করা যায়। বিশেষ করে উল্লেখ করার দরকার হয় না এরকম বন্ধু বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে অনেকেই থাকে। দীপ্তি, লাভলী, সুরভী, জিন্নাত, পাপড়ী, নাজমা, বিউটি, চৈতী, শহীদুল, দীপু, নিশাত, মুশফিক, আকরাম, মহসিন, রবি, অবিনাশ-সহ আরও অনেকের সাথেই ছিলো নির্মল বন্ধুত্ব। ২৫-৩০ হাজার ছাত্র-ছাত্রীদের ভেতরে সহপাঠীসহ অনেক বন্ধুই থাকতে পারে। আমার তারুণ্যের দিনগুলোতে তারাও স্মরণীয় মুহূর্ত দিয়েছে অনেক সময়। গ্রামে য্যামন সবুজ প্রকৃতির মাঝে-মাঠে-রাস্তায় কাটিয়েছি অনেক সুন্দর মুহূর্ত; তেমনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল ক্যাম্পাসে সবুজ মতিহার চত্বরে, পদ্মার তীরে, তৈরি হয়েছে জীবনের অগণিত সোনালী সময়। প্রবল তারুণ্যের সেই দিনগুলোতে কয়েক বন্ধু মিলে একদা পদ্মা পার হয়ে বালুর রাজ্য ডিঙিয়ে পশ্চিম বাংলার মুর্শিদাবাদ রাজ্যের ভেতরে প্রবেশ করেছিলাম বিনা ভিসায়; সেও এক উদ্দীপক অভিজ্ঞতা বটে।
হেলা-ফেলায় নয়, খেলা-ধুলাময়…
আমার তারুণ্যের এক আনন্দময় অধ্যায়ের নাম খেলা-ধুলা। প্রচলিত প্রায় সব খেলাই কম-বেশি খেলেছি জীবনে; তবে ফুটবল-ক্রিকেটেই কাটিয়েছি অনেকটা সময়। আষাঢ়-শ্রাবণের বৃষ্টি ঝরবে অথচ আমরা মাঠে ফুটবল নিয়ে নামবো না, এমন ঘটনা খুব একটা ঘটতো না। ঘরের কাছের ভুরুলিয়া হাইস্কুল মাঠ ছাড়াও আশে-পাশের বিভিন্ন মাঠ এবং বিলেও খেলেছি ফুটবল নিয়ে। নব্বইয়ের বিশ্বকাপের সময় গ্রামে টেলিভিশন ছিলো না বললেও চলে। দু-একটা খেলা দেখে এবং আমার ফুটবল পাগল ছোটদাদার (দারুন খেলতো সে। শ্যামনগর ও কালীগঞ্জ উপজেলার প্রায় সব মাঠেই বেশ দাপটের সঙ্গেই বল খেলে বেড়াতো।) কথা শুনে ম্যারাডোনাকে চিনতে শিখেছি তখন। পরে অবশ্য ১৯৯৪এর বিশ্বকাপের প্রায় সমস্ত খেলাই দেখেছি রাত্রি জেগে। বর্ষার কাদার ভেতর দিয়ে মধ্যরাতের অন্ধকারে টর্চলাইট ছাড়াই যেভাবে পথ চলতাম, এখন মনে পড়লে শিউরে উঠি। সেবার কয়েক ম্যাচ পর ম্যরাডোনা নিষিদ্ধ হলে খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। তবে মুগ্ধ হয়েছিলাম ক্যানিজিয়া, বাতিস্তুতা, বেবেতো, রবার্তো ব্যাজ্জিও, ভালদেরামাসহ বেশ কয়েকজন খেলোয়াড়ের খেলায়। আমি নিজে অবশ্য এই বিশ্বকাপের আরও এক বছর আগেই ফুটবল খেলা ছেড়ে দিয়েছিলাম। খালি পায়ে খেলতাম বলে ডান পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলে গোড়া ফুলে থাকতো সব সময়। ব্যথাও সারতো না। (এখনও চাপ দিলে ব্যথা অনুভূত হয়।) ফুটবল খেলে বাড়ি ফেরার পর, পড়ার সময় ঘুমও আসতো তাড়াতাড়ি। তাই ক্লাস নাইনে ওঠার পর ফুটবলটাকে বিদায় জানালাম । ১৯৯৮এর বিশ্বকাপ দেখেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে; অনেক মজা করে। ফুটবল বন্ধ দেয়ার পরে ক্রিকেটই টানতে থাকলো বেশি। ১৯৯১ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপে উপমহাদেশের দল হিসেবে বিশেষ কোনো কিছু না ভেবেই পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিলাম ফাইনালে। সেই খেলার পর থেকেই মূলত ক্রিকেটে আগ্রহ বাড়ে। উঠোনে, বিলে, চিংড়ি ঘেরের মাঠে, সবখানেই ক্রিকেট। হাতে তৈরি কাঠের ব্যাটও যখন জোটে নি, নারকেল গাছের ডেগো কেটে ব্যাট তৈরি করেছি আমরা। বল না পেয়ে আমড়ার আঠি এবং কচুর মূল দিয়েও বল বানিয়েছি। মাঠে-বিলে, কোথায় না ক্রিকেট খেলেছি। শ্যামনগরের এমন কোনো মাঠ নেই বললেই চলে যেখানে ক্রিকেট খেলতে যাই নি। খেলেছি কালীগঞ্জ এবং কয়রা উপজেলার মাঠেও। ক্রিকেটহীন দিন কাটতোই না বলা যায়। যেখানেই যেতাম ক্রিকেট; আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে গেলেও সময় পেলে ক্রিকেট খেলা চাই-ই চাই। এস এস সি পাশ করবার পরে তো ক্রিকেট একটা অনিরুদ্ধ জীবনই হয়ে উঠলো। যে দিন বাইরের মাঠে খেলা থাকতো কোনোরকমে একমুঠো লবণভাত খেয়ে ছুট দিতাম। ক্রিকেটেই কিছু একটা করে ফেলবো এমন মনে হতো মাঝে মাঝে। চলতে ফিরতে বল করবার জন্য হাত ঘুরতো, মনে হতো ব্যাটস্ম্যানের ব্যাট ফাঁকি দিয়ে মিডল স্ট্যাম্পটা বুঝি উড়ে গ্যালো। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বার সময়ও যখন বাড়ি যেতাম বড়ো ছুটিতে, খেলে বেড়াতাম নানা জায়গায়। ১৯৯৬ সালে ভারত-পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কার যৌথ আয়োজনে ক্রিকেট বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হওয়ার পরে এবং ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ আইসিসি ট্রফি জিতে ওয়ানডে স্ট্যাটাস পেয়ে গেলে, বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জেও ব্যাপক ক্রিকেট উন্মাদনা তৈরি হয়। ক্রিকেট খেলে এবং টিভিতে ক্রিকেট দেখে যতো সময় কাটিয়েছি তারুণ্যে, তা আর কিছুতে নয় বললেই চলে। বাংলাদেশ ভালো খেলতো না বিধায় দল হিসেবে ভারতই ছিলো প্রথম পছন্দ। আর শচিন টেডুলকারের ব্যাটিং দেখবার জন্য যে নাওয়া খাওয়া কিংবা যে কোনো কিছুকেই ত্যাগ করতে পারতাম। সৌরভ গাঙ্গুলীও ছিলেন দারুণ পছন্দের। ব্রায়ান লারা, সনাথ জয়সুরিয়া, স্টিভ ওয়া, রিকি পন্টিং-ও সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে আমার পছন্দের তালিকায়। এছাড়া হ্যান্সি ক্রনিয়ে, সাঈদ আনোয়ার, ইনজমাম উল হক, আজহার উদ্দিন, অজয় জাদেজা, রাহুল দ্রাবিড়, ভি ভি এস লক্ষণ, জ্যাক ক্যালিস প্রমুখের ব্যাটিং আমার ভালো লাগতো। বোলিংয়ে আমার সবচাইতে প্রিয় ওয়াসিম আকরাম; ওর চাইতে ভালো পেস বোলার আমি দেখেছি বলে মনে হয় না। স্পিনে শেন ওয়ার্ন, অনিল কুম্বলে আর মুত্তিয়া মুরলিধরনের তুলনা নেই। পছন্দের খেলোয়াড় না হলেও কার্টলি এ্যামব্রুসকে দেখে ব্যাটম্যানদের মতোই ভয় পেতাম আমি। কোটনি ওয়ালশ, গ্লেন ম্যাকগ্রা, ওয়াকার ইউনুস, চামিন্দা ভাস, জাভাগাল শ্রীনাথের বোলিংও ভালো লাগতো। পরবর্তীতে আরও অনেক ক্রিকেটার আমার মন কেড়েছে; যেমন আমাদের হাবিবুল বাসার সুমন। আরও পরে মাশরাফি, আশরাফুল এবং সম্প্রতি সাকিবের খেলা দেখে মুগ্ধ হওয়ার উপাদান খুঁজে পাই।
ফুটবল-ক্রিকেটের বাইরেও একাধি খেলা খেলেছি কৈশোরে তারুণ্যে। হাড়ের গুটি দিয়ে নাথিং এবং কাচের মার্বেল-এ খুব নেশা ছিলো এক সময়। গাজন খেলতাম দারুন আনন্দে। ডাংগুলি, কানামাছি, পলা টু, লুডু, হা ডুডু, কুড়ি গুটি চার বাঘ, তেতুল বিচি, কড়ি খেলা-সহ কতো খেলা যে খেলেছি! ক্যারম বোর্ড, দাবা, তাস-ও খেলেছি অনেক দিন। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে টেবিল টেনিস খেলতাম শখ করে। সব খেলা নিয়ে এখানে আলোচনার জায়গা নেই; শুধু বলি, খেলা-ধুলাতে অনেকটা সময় গেলেও আজকের ছেলে-মেয়েদের নেতিবাচক কর্মকা- দেখে ভাবি, খেলা-ধুলা কোনো হেলা-ফেলার জিনিস নয়।
ডোবা পুকুর খাল বিল নদী পেরিয়ে সমুদ্রে…
‘ভিক্ষে করে হলেও ভাইকে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবো’…। সত্যিকার অর্থেই কোনো সামর্থ্য ছিলো না, আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর। বিশ্ববিদ্যালয়ে বলি ক্যানো, আমার মতো পরিবার থেকে অনেক ছেলে-মেয়েরা স্কুল সার্টিফিকেট পাশ করবার কথাও ভাবতে পারতো না সে সময় ! আমার অনেক সহপাঠীকে দেখেছি প্রাইমারি স্কুল পার হতে না হতেই বই-খাতা-কলম ফেলে বলদ-হাল-কোদাল ধরেছে। করিম নামের এক সহপাঠী তো ক্লাস সিক্সে পড়তে পড়তেই বিয়ে হয়ে যায় ! আর পঞ্চম শ্রেণিতে থাকতেই কল্যাণী নামের যে সহপাঠিনীর বিয়ে হয়েছিলো, তার তো কোনো খোঁজই পাই নি জীবনে আর ! আমি পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি, ওদের দু’জনেরই পারিবারিক অবস্থা আমার চাইতে অনেক স্বচ্ছল ছিলো। আসলে পড়া-লেখাটা যতটা আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যের, তার চাইতে অনেক বেশি আত্মিক সদিচ্ছার। আমার বাবার বাবা বেশ ধনী ছিলেন, কিন্তু তার অকাল মৃত্যুর পরে অন্যান্য ভাইদের স্বেচ্ছাচার ও স্বার্থপরতার কারণে বাবার কিছুই ছিলো না। এমন কি যে ভিটেটা পৈতৃক, সেটাও অন্যের নামে চলে গিয়েছিলো। বহু বছর মামলা করে, অনেক প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়ে সেটা উদ্ধার করতে হয়েছে। তারুণ্যে খেলা-ধুলাতে সম্পূর্ণ নিবেদিত এবং পরবর্তীতে প্রায় দিনমজুর বাবার চার ছেলে আর তিন মেয়ের সকলের ছোটো আমি। বড়ো ভাই অন্যের বাড়ির স্থায়ী মজুর; মেজো জন দিন মজুর; সেজো ভাই তিন বছর প্রাইমারিতে পড়ে মাইনে খাটতে অন্যের বাড়িতে; সেখানে দু-তিন বছর থেকে আবার পড়ালেখায়। পড়ার মাঝে মজুরি, মজুরির মাঝে পড়া, এভাবে চলতে চলতে কলেজেই থামলো সে। কয়েকবারের প্রচেষ্টায় এইচএসসি পাশ করতে না পেরে আবারো মজুরিপনাতে (এখনকার মতো ৯২/৯৪% পাশের হার হলে প্রথমবারেই সে দারুন রেজাল্ট করতো।)। মামাতো ভাই মনোসিজ দাদা আমার জন্যে ফরম তুলেছিলো। আমি তার আগেই অবশ্য শ্যামনগর মহসিন কলেজে পাশ কোর্সে ভর্তি ডিগ্রি ভর্তি হই। কলেজে ভর্তি এবং এইচএসসি পরীক্ষার ফলের উপর ভিত্তি করে ১৫০০ টাকার একটা বৃত্তি পাই; সেই টাকাতেই ভর্তি পরীক্ষা দিতে রাজশাহী যাই। আমার চান্স পাওয়া যতটা সুখের ছিলো তার চাইতে ভারি ছিলো তা বহনের ভার। মনোসিজদা যখন আনন্দের খবরটা নিয়ে আমাদের বাড়িতে আসে, সকলের হাসির ভেতরে এক ধরনের কষ্টের ছায়া লক্ষ্য করেছিলাম। প্রাণখুলে আনন্দ প্রকাশের আগেই আমার তারুণ্যকে সেদিন ম্লান করে দিচ্ছিলো কীভাবে ভার্সিটিতে পড়বো তার চিন্তা। আমার শুভাকাক্সক্ষী অনেকেই সেদিন দুর্ভাবনার দেয়াল তুলে দিয়ে পশ্চাদপদ হতে বলেছিলো। বলবেনই তো। যাদের দু’বেলার দু’মুঠো লবণ ভাতের ব্যবস্থা নেই, পরনে পোশাকগুলো চেয়ে-চিন্তে পাওয়া; যে ছেলেটা সারা প্রাইমারি স্কুলে একটিমাত্র নতুন মুদ্দফরাস জামা-প্যান্ট ছাড়া কিছুই পাই নি; হাইস্কুলে যার কাছে যেটুকু পেয়েছে, পরেছে; সেই ছেলে পড়বে বিশ্ববিদ্যালয়ে ! চান্স পেয়েও না পড়তে পারার সম্ভাব্য বেদনায় নীল হয়ে যাচ্ছিলাম ভেতরে ভেতরে। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মা’ও বিমর্ষপ্রাণা। সেই মুহূর্তে আমার সেজভাই, যাকে আমি ছোট দা বলেই ডাকি; সে বললো, ‘মা, তুমি চিন্তা কোরো না, ভিক্ষে করে হলেও আমি ভাইকে পড়াবো।’ একথা মনে পড়লে আজও আমার চোখ ভারি হয়ে ওঠে, আবেগে দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর কাজী নজরুল ইসলাম মিলনায়তনে এক সংবর্ধনাসভায় নবাগতদের উদ্দেশ্যে উপাচার্য প্রফেসর আবদুল খালেক (আমাদের বাংলা বিভাগেরই যিনি স্যার ছিলেন।) বলেছিলেন, ডোবা পুকুর খাল-বিল-নদী পেরিয়ে সমুদ্রে এসে উপনীত হয়েছ। এখানে য্যামন সফল হয়ে সর্বোচ্চ স্থানে যাওয়া যায়, তেমনি সমুদ্রের অতলে তলিয়েও যাওয়া যায়। ভালো এবং মন্দ, দুটো বিষয়েরই বিপুল সুযোগ রয়েছে এখানে। ভালোটাকে ব্যবহার করে, কঠোর সাধনা করে তোমরা সফল হতে পারো, আবার এর বিপরীতে, ধ্বংসও হয়ে যেতে পারো। স্যারের কথাগুলো যে কতো বড়ো সত্য, তা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া যে কোনো পর্যবেক্ষণশীল শিক্ষার্থীই বুঝতে পারবেন। চোখের সামনে পূর্বের মেধাবিকে য্যামন ঝরে যেতে দেখেছি তারুণ্যের বিপুল প্রলোভনে, তেমনি সাধারণ মেধার কোনো কোনো শিক্ষার্থীকেও দেখেছি সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছে যেতে। অন্যের ভালো-মন্দের কথায় যাবো না, আমার নিজের যে প্রাপ্তি, তাতে মনে হয় : গ্রামের দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী একটি পরিবারের ছেলে আমি; বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বার সুযোগ যদি না পেতাম, যা জেনেছি, তার সাড়ে পনেরো আনাই অজানা থেকে যেতো; যা পেয়েছি, তার পৌনে ষোলো আনাই হয়তো অপ্রাপ্ত থেকে যেতো। বাংলাদেশের মতো গরিব দেশে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আমার মতো দরিদ্রসন্তানের তারুণ্য আর তারুণ্যের স্বপ্নকে নবরূপায়িত করতে এবং তা পূরণে করতে কী বিরাট ভূমিকা রাখে বা রাখতে পারে, তা তিলে তিলে অনুভব করেছি আমি। বাড়ি থেকে মাসের পর মাস যখন টাকা পাঠাতে পারতো না, চারদিকে সবাই যখন তারুণ্যের দারুণ আনন্দে উচ্ছ্বলিত হতো; তখন, পকেটে টাকা না থাকলে কোনো কোনো সময় নিজেকে খুব ছোটো মনে হতো, গরিবের সন্তান হওয়ার অভিশাপটা অভিমানে রূপ নিতো কখনওবা; তথাপি মনোসিজদা’র অমূল্য অগ্রজোচিত সহযোগিতা, কয়েকজন বন্ধুর নিবিঢ় অন্তরঙ্গতা, এমনকি হলের ডাইনিং-এর লোকগুলো, যারা আমাকে বাকিতে খাওয়াতো দিনের পর দিন, তাদের উদারতা; আমাকে অনুপ্রেরণা যোগাতো নিরন্তর। আমাদের দেশে অধিকাংশ মেধাবি শিক্ষার্থীরাই অন্য সাবজেক্টে চান্স না পেয়ে বাধ্য হয়েই নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বা বাংলার মতো বাণিজ্যমূল্যহীন সাবজেক্টে লেখা-পড়া করে। নিজেকে বিশেষ মেধাবি দাবি না করেই বলি, আমি কিন্তু অন্য সাবজেক্টে পড়ার সুযোগ গ্রহণ না করেই, পূর্ব পরিকল্পনা মতো, সাহিত্যকে ভালোবেসে বাংলাতে পড়েছি। আর হ্যাঁ, বাংলাতে পড়েছি বলেই খুব সহজে জানতে পেরেছি মানবজীবনের অনেক কিছু। মানুষ, মানুষের সভ্যতার ইতিহাস, তার নানারকমের জীবনদর্শন, প্রথাগত ধর্মের উৎস ও বিকাশ এবং আজকের প্রেক্ষাপটে তার মূল্য বা মূল্যহীনতা; এইসব বিষয়গুলো, সাহিত্য পাঠের সুবাদে যতো সহজে এবং স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গির সাথে গ্রহণ করতে পেরেছি; অন্য কোনোভাবে তা পারতাম বলে আমার মনে হয় না। আবার একথাও বলে রাখি, বাংলাতে পড়লেই যে সে এমন দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী হবে, এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। বহু তরুণের পোশাকের নিচে য্যামন বৃদ্ধের হৃদয় দেখেছি, তেমনি বাংলায় পড়েও অনেককেই দেখেছি একেবারে বিরূপ মানসিকতা থেকে বের না হতে। আসলে, আমরা যে বিষয়েই পড়ি না ক্যানো, সেই পড়াটা যদি প্রাণের পড়া না হয়, কেবল সার্টিফিকেট প্রাপ্তির জন্য অন্যের করে দেয়া নোট মুখস্ত করে উগরে দেয়ার মতো হয়, তবে তা আর্থিক অগ্রগতির সহায়ক হলেও, শিক্ষার্থীর আত্মিক উন্নতিতে কোনোদিনই ভূমিকা রাখতে পারে না। আমাদের দেশে যারা বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হিসেবে পড়া-লেখা করে, বিরাট মেধাপ্রসূত রেজাল্ট করে, তাদের প্রায় সকলেই কী পরিমাণ অবৈজ্ঞানিক মানসতা পোষণ করে, অশিক্ষিত মানুষের ভাবনাকেই প্রশ্নহীনভাবে জীবনে প্রয়োগ করে, তা দেখে কেবল অবাক হই না, ভেতরে ভেতরে বিদ্রুপের হাসিও উথলে ওঠে মাঝে মাঝে। বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনে অনার্স-মাস্টার্স শেষে অধিকাংশই যে চার্বাক-এপিকিউরিয়াস-সক্রেটিস কিংবা কার্ল মার্কসকে অন্তরে ধারণ করতে পারে না সে তো আমার চোখের সামনেই দেখি। মাঝে মাঝে মনে হয়, বিজ্ঞান আমাদের সামনে যা হাজির করেছে তা বিজ্ঞানের ছাত্র অপেক্ষা সাহিত্যের সেবকরাই উৎকৃষ্টরূপে গ্রহণ করেছে; দর্শনের শিক্ষার্থী অপেক্ষা একজন কবিই অনেক বড়ো দার্শনিকসত্যকে লালন করতে পারেন। আবারো বলি, এর জন্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাই যে একমাত্র উপযোগি তা কিন্তু সত্য নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে না পড়েও যে, কেউ কেবল তার চারপাশের জীবনকে বাস্তব সত্যের আলোকে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে, নানারকমের প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করে গ্রহণের মাধ্যমে যথার্থ দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে পারে। এর প্রমাণও যে একেবারে দুর্লক্ষ্য নয়, তা আরজ আলী মাতুব্বরের মতো মানুষের দিকে তাকালে অনুধাবন করা যায়। আমাদের এবং পৃথিবীর অনেক মহামনীষীই বিশ্ববিদ্যালয় তো দূরের কথা, কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখাও করেন নি জীবনে। এ বিষয়ে বিস্তারিত বাচনের ক্ষেত্র এটা নয়, সুযোগ পেলে ভিন্নক্ষেত্রে সে আলোচনা শেয়ার করা যাবে। এখন একথাটাই বলি, পারিবারিক ও সামাজিক প্রভাবে শৈশবে-কৈশোরে এমনকি প্রথম তারুণ্যে যে সমস্ত প্রথাগত জীবনভাবনাকে আরও গভীরভাবে আঁকড়ে ধরতাম, মোক্ষলাভের জন্য তীর্থে যেতাম, লোকালয়হীন সন্ন্যাসী সাজবার কথা ভাবতাম, বিদ্যালাভের জন্য মূর্ত সরস্বতীর পা জড়িয়ে ধরতাম; সেই আমি যখন অক্ষয় কুমার দত্তের কর্মজ্ঞানের অঙ্কটা পড়লাম, (কর্ম+ প্রার্থনা = ফল; কর্ম = ফল; অতএব, প্রার্থনা = শূন্য); যখন বিদ্যাসাগরের কর্মময় জীবনের কথা জানলাম; রামায়ণের প্রথাগত ভাবনার বিপরীতে যেয়ে মাইকেলের ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’ পড়লাম; রবিঠাকুরের ‘রবিবার’ গল্পের অভীককে উপলব্ধি করলাম; মানিকের বস্তুসত্যপ্রসূত কথাসাহিত্যকে বুকে ধারণ করতে চেষ্টা করলাম; বনফুলের অবিস্মরণীয় ‘স্থাবর’ উপন্যাসটি পড়লাম লাইব্রেরিতে কয়েক দুপুর জেগে; রাহুল সাংকৃত্যায়নের ‘ভোলগা থেকে গঙ্গা’ কিংবা ‘মানব সমাজ’ নাড়াচাড়া করলাম; জীবনানন্দ দাশের কবিতাগুলোকে অনুভব করতে চেষ্টা করলাম; সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহর ‘লালসালু’-‘চাঁদের অমাবস্যা’ পড়লাম; হাসান আজিজুল হকের ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ কিংবা ‘জীবন ঘষে আগুন’-এর মতো গল্প পড়লাম; শামসুর রাহমানের কবিতা ও তাঁর জীবনভাবনা উপলব্ধি করতে চাইলাম; গোর্কির ‘মা’ পড়লাম; শওকত ওসমান-সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের দু’একটা বই হাতে পেলাম; বুদ্ধ-চার্বাক-এপিকিউরিয়াস-গ্যালিলিও-মার্কস প্রমুখের জীবনদর্শনকে বুঝবার চেষ্টা করতে শুরু করলাম; আর এইসব পড়া ও বোঝার কাজে যখন আহমদ শরীফ-আরজ আলী-সনৎ কুমার সাহা-হুমায়ুন আজাদ প্রমুখের গদ্যগুলো সহযোগিতা করতে থাকলো; এমনকি আমার বিভাগীয় শিক্ষকদের কারো কারো প্রবল যুক্তি ও মানবতাপ্রসূত বাচন যখন আমাকে দারুণভাবে প্রভাবিত করলো; তখন আমার ভেতরে প্রবল, ঘনো এবং দৃঢ়চিত্তপ্রসূত প্রাগসর ও বৈপ্লবিক পরিবর্তণসূচিত হতে শুরু করলো, নিজেকে নতুভাবে আবিষ্কার করতে শুরু করলাম। যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরাট লাইব্রেরি-সেমিনার সুবিধা না পেতাম, প্রজ্ঞাবান শিক্ষকদের সাহচর্য থেকে বঞ্চিত হতাম; তবে আজকের এই তারুণ্যস্মৃতি লিখবার জন্য অগ্রজ কবি সরসিজ আলীম বা অন্য কেউ হয়তো এই আহ্বান জানানোরই প্রয়োজন বোধ করতেন বলে মনে হয় না।
ছায়ার মায়ায় কাটলো কতো ক্ষণ…
এইচ এস সি পরীক্ষা যখন সামনে, মাস তিনেক বাকি; এক দুপুরে মামার বাড়িতে খাচ্ছিলাম। বড়ো মামা, ছোটো মামা, বড়ো দাদা, মনোসিজ দা-সহ আরও কয়েক জন লোক একত্রে । আমার সেজো মেশোমহাশয় (অনিল রাজ) বললেন, ‘বিশ্বজিৎ তো বিখ্যাত হয়ে গেছে, সারা জায়গায় ক্রিকেট খেলে বেড়ায় আর সিনেমার বিশেষজ্ঞ। শ্যামনগরে যে কয়টা ভিডিও-র দেকান আছে, যেয়ে কেবল বিশ্বজিৎ বাবুর নাম বললেই হলো। যে সিনেমা চাও দিয়ে দেবে।’ আরও কিছু কথাও হয়তো ছিলো। কিন্তু ওই ক’টা কথার বিদ্রুপাত্মক সুরেই আমি এতোটা নতমাথা হয়েছিলাম যে, ভাতও মুখে উঠতে চাইছিলো না। পরের দিন কলেজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে কেঁদেছিলাম একা একা। সত্যিই তো, এস এস সি-তে নিজের স্কুল থেকে প্রথম হওয়া আমি যেভাবে দিনে ক্রিকেট, রাতে সিনেমা করে ফেলেছি জীবনটাকে; এইচ এস সি-তে পাশ করতে পারবো তো ! আসলে সিনেমা আমাকে খেয়ে ফেলেছিলোপ্রায়। প্রায় প্রতি রাতেই সিনেমা দেখতাম। এস এস সি পরীক্ষার পর একই সঙ্গে দু-দুটো ভিসিপি আসে আমার হাতের নাগালে। আমার গ্রামের প্রায়সমবয়সী দিলীপ কাকা এবং আমার ছোটো মামা’র ক্রীত সেই ভিসিপি দু’টোর প্রধান একজন হয়ে উঠলাম আমি। দিলীপ কাকা ভিডিও হল বানালো। সেখানে ৩-৫ টাকা টিকিটের বিনিময়ে সিনেমা দেখতো লোকে। বেশিরভাগই চলতো ভারতীয় বাংলা ও হিন্দি ছবি। কোন দিন কোন ছবি চলবে, তা অনেকটাই নির্ভর করতো আমার ওপর। ক্যানোনা, সিনেমার ক্যাসেট নেয়া-দেয়ার দায়িত্ব ছিলো প্রধানত আমার। আমার পছন্দের সিনেমা এনে তার শ্রেষ্ঠাংশে কারা অভিনয় করেছেন তা লিখে দেয়ার দায়িত্বও ছিলো আমার ওপর। এসময় মামার বাড়িতেও যেতাম প্রচুর। মামার দোকানে বইয়ের বিকিকিনিতে সামান্য সাহায্য করতাম, মামাতো ভাই উৎপল এবং ছোট্টুর পড়া-লেখার ওপর কিছুটা নজর রাখার দায়িত্ব দিয়েছিলেন মামা। যে দিন বাড়ি মামার বাড়ি যেতাম, সেদিনও ২-৩টা সিনেমা নিয়ে যেতাম। রাত জেগে কতো সিনেমা দেখেছি ও দেখিয়েছি ! ভারতীয় হিন্দি-বাংলা চলচ্চিত্রের অসংখ্য অভিনেতা-অভিনেত্রীর হাঁড়ির খবরও রাখতাম তখন ! আমার একটা খাতা ছিলো, সিনেমা দেখে তার প্রধান কুশিলবদের নাম লেখা এবং সিনেমাটা ক্যামন লাগলো তা মার্কিং করবার জন্য ! হিন্দিতে মিঠুন চক্রবর্তী প্রথম পছন্দ হলেও অমিতাভ বচ্চন, শত্রুঘœ সিনহা, ধর্মেন্দ্র, রজনীকান্ত’দেরকেও তারুণ্যের জোয়ার মনে হতো। নায়িকাদের মধ্যে হেমা, শ্রীদেবী’সহ অনেকেই মন কাড়লেও মাধুরীই ছিলো প্রথম পছন্দ। পরের দিকে শাহরুখ-সালমান-আমির-অক্ষয়-সুনীল-অজয় এবং মনীষা-জুহি-কারিশমা-ঐশ্বরিয়া’রা খানিকটা তারুণ্যসময় কেড়ে নিয়েছিলো তা বলাই যায়। তবে আমার প্রধান পছন্দ বাংলা সিনেমা। উত্তমের চেয়ে উত্তম কোনো নায়ককে আজও দেখি নি আমি। তার সঙ্গে সুচিত্রা জুটে গেলে তো কোনো কথাই নেই ! শিল্পী, সাগরিকা, হারানো সুর, অগ্নিপরীক্ষা, শাপ মোচন, সবার উপরে, সপ্তপদী, পথে হলো দেরী, বিপাশা প্রভৃতি ছবিগুলো যে কতবার দেখেছি ! আজও সুযোগ পেলেই দেখি । উত্তমের বাইরে সচিত্রার কোনো ছবি আমার বিশেষ পছন্দের নয়, তবে সুচিত্রার বাইরেও যে উত্তম সমান সাবলীল তা আনন্দ আশ্রম, অমানুষ, এন্টনি ফিরিঙ্গি, নায়ক প্রভৃতি ছবি দেখেও বোঝা যায়। নায়ক হিসেবে উত্তম তুলনাহীন; তবে অভিনেতা হিসেবে সৌমিত্র চট্টোপধ্যায় আমার কাছে মহীরুহ। তার চাইতে ব্যক্তিত্ববান ও শিল্পগুণসম্পন্ন অভিনেতা বোধ হয় পুরো বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসেই নেই। পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের সিনেমাগুলোতে সৌমিত্রের ব্যাপক উপস্থিতি তার অসাধারণত্বেরই প্রমাণ। একক কোনো চলচ্চিত্র নয়, যেখানেই তাকে পাই আজও মুগ্ধ হয়ে তার অভিনয় দেখি। এদের বাইরে উৎপল দত্ত, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, পাহাড়ি সান্যাল, ছবি বন্দ্যোপধ্যায়, কালী ব্যানার্জী, অনুপ কুমার, রবি ঘোষ, সাবিত্রী, সুমিত্রা, অপর্ণা সেন, রণজিৎ মল্লিক, সন্ধ্যা রায়, দেবশ্রী, চিরঞ্জিৎ প্রমুখ আমার তারুণ্যকে রাঙিয়ে চলেছিলো মাঝে মাঝেই। আমার নিজের দেশের অধিকাংশ সিনেমাই মানসম্মত না মনে হলেও রাজ্জাক আমার প্রিয় অভিনেতাদেরই অন্যতম। কবরী, আলমগীর, শাবানা, এটিএম শামসুজ্জামনও দারুণ; পরবর্তীতে মৌসুমী, সালমান শাহ কিছুটা মুগ্ধতা এনেছিলো বৈকি। তবে দু-একটি নান্দনিক সিনেমা এবং নাটকের কল্যাণে রাইসুল ইসলাম আসাদকে আমার বাংলাদেশের সৌমিত্র মনে হয়। আসাদুজ্জামান নূর, আবুল হায়াত, সুবর্ণা মুস্তফা, শমী কায়সার, বিপাশা হায়াত প্রমুখের অভিনয়ও আমার তারুণ্য উপভোগ্য করেছে খানিকটা। পাশে বা পাড়ায় কোথাও সিনেমা হচ্ছে, আর আমি অন্য কাজে ব্যস্ত আছি, এরকম ঘটনা অসহ্যই ছিলো সেসময়। একটা সিনেমা মিস হয়ে গেলে কী যে আফশোস হতো ! রাতে সিনেমা দেখে বাড়ি ফিরে দেখতাম সবাই ঘুমিয়ে গেছে। আমার কামরায় ভাত-তরকারি ঢাকা থাকতো, খেয়ে একটু বই-টই নাড়াচাড়া করে ঘুমিয়ে যেতাম। কোনো কোনো সময় আবার সারারাতও দেখেছি সিনেমা। অথচ আশ্চর্য, ক্লাস এইটের বার্ষিক পরীক্ষার পর টেলিভিশনে অমর সঙ্গী দেখবার জন্য আমি ও সাধন (কাকাতো ভাই, আমরা সগপাঠী ছিলাম।) দাদার নিকট থেকে অনুমতি নিয়েছিলাম মা-কাকিমার কাছে অনুরোধ করে। অবশ্য, এর আগেই প্রায় দু’মাসের জন্য ইন্ডিয়াতে থাকার সুবাদে সিনেমা হলে গিয়ে বেশ কিছু হিন্দি-বাংলা সিনেমা দেখেছিলাম আমি। যা হোক, আমার তারুণ্যের একটা বিরাট অংশ নষ্ট করেছি সিনেমার পিছনে। সত্যিই কি নষ্ট করেছি পুরোটাই ? জানিনে। ক্যানোনা, আমার অনেক জীবনভাবনার পিছনে, তারুণ্যে আবেগ প্রকাশের পিছনে শিল্পিত চলচ্চিত্রের একটা বড়ো প্রভাব রয়েছে বলে মনে হয়।
কেবলই আঁখি দিয়ে আঁখির সুধা পিয়ে…
পূর্ণেন্দু পত্রী ‘স্মৃতি বড় উৎশৃঙ্খল’ শিরোনামে লিখেছেন,
পুরনো পকেট থেকে উঠে এল কবেকার শুকনো গোলাপ। কবেকার ? কার দেওয়া ? কোন মাসে ?
বসন্তে না শীতে ?
গোলাপের মৃতদেহে তার পাঠযোগ্য স্মৃতি নেই।
স্মৃতি কি আমারও আছে ? স্মৃতি কি গুছিয়ে রাখা আছে বইয়ের তাকের মত, লং প্লেইং রেকর্ড-
ক্যাসেটে যে-রকম সুসংবদ্ধ নথীভূক্ত থাকে গান, আলাপচারিতা ?
আকাঙ্ক্ষার ডানাগুলি মিশে গেছে আকাশের
অভ্রে ও আবিরে আগুনের দিনগুলি মিশে গেছে সদ্যজাত ঘাসের সবুজে প্রিয়তম মুখগুলি
মিশে গেছে সমুদ্রের ভেতরে নীল।
স্মৃতি বড় উৎশৃঙ্খল, দু’হাজার বছরেও সব
মনে রাখে ব্যাধের মতন জানে অরণ্যের
আদ্যোপান্ত মূর্তি ও মর্মর।
অথচ কাল বা পরশু কে ডেকে গোলাপ দিল
কিছুতে বলবে না।
আমি একটি গোলাপের কথা বলি। কবির কাছে য্যামন কবিতা, তরুণের কাছে তেমনি প্রেম। প্রেম তারুণ্যের এক আশ্চর্য মোহস্বর্গ। প্রেম ব্যতীত তারুণ্য পূর্ণাঙ্গতা পায় না। উঠতি তারুণ্যে সবার জীবনে প্রেম আসে কি না জানিনে, তবে প্রেমের অনিরুদ্ধ অনুভূতি যে আসে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কোনো এক লাস্য-হাস্যময়ীর চোখে চোখ রেখে হারিয়ে যেতে, হাতে হাত ছুঁয়ে ঘাসের উপরে বসে গল্প করতে, পাশপাশি পথ চলতে… কার না ভালো লাগে ঘোর তারুণ্যে ! কৈশোরেই ভালো লাগার প্রথম পর্বটা শুরু হয় বলেই আমার ধারণা। না হলে আমার পাড়ার ক্লাস ফাইভে পড়া একটা ছেলে তার সহপাঠিনীকে চিঠি লিখে ভালোবাসার কথা জানিয়েছিলো ক্যানো ? তবে আমার প্রেমের শুরু তারুণ্যের প্রথম প্রহরেপ্রায়। তার আগে কারো মুখ কীভাবে বেসেছিলাম কিংবা আদৌ কাউকে বেসেছিলাম কি না জানিনে, কিন্তু আমার এইচ এস সি পরীক্ষার পরের শূন্য সময়টিতে আরও অনেক সিলেবাসবর্হিভূত জিনিসের মতো প্রেমও এসে প্রবেশ করেছিলো। আমার মতো সেই মেয়েটিরও একটা শূন্যতা তৈরি হয়েছিলো একই এস এস সি পরীক্ষা দিয়ে। আগেই বলেছি এই সময়টাতে বেশ বই পড়তাম এবং অন্যকে পড়াতে চাইতাম। একই পাড়ার সে, উপন্যাস পাঠে আগ্রহী হলে আমার আমার আগ্রহটাও দশগুণ বেড়ে যায়। একটা করে বই দিই আর দু’তিন দিনের ভেতরে সে পড়ে ফ্যালে। পড়েই আরেকটা নেয়ার জন্য আমার কাছে আসে। তখনও কিছুই নেই, কোনো ভাবনাও নেই; কিন্তু তার আসার অপেক্ষায় য্যানো সব কিছু বাদ দিয়ে বসে থাকি। গ্রামের মানুষ, খুব বেশি ভাবে না জীবন নিয়ে; তবু আমার পড়ার ঘরে একটা উঠতি তরুণীর আসা-যাওয়া পর্যবেক্ষণ করে অন্য কোনো গন্ধ শুঁকে দেখবার মানসিকতা দু’একজনের থাকেই। বাড়িতে নালিশ এলো। ছোটদা বন্ধু তপনকে বললো। তপন আমাকে বললো। আমি মেয়েটিকে বললাম। মেয়েটির আসা বন্ধ হলো। ব্যাস, মিটে গ্যালো। কিন্তু সত্যিই কি মিটে গ্যালো ? যে আমি তাকে আসতে নিষেধ করে দিলাম, সেই আমিই আবার তার মুখটা দেখবার জন্য প্রতি দণ্ডে ‘ঘর-বাহির’ করতে শুরু করলাম যে ! আশ্চর্য, আমি যখন কোনো কাজ ছাড়াই তার বাড়ির কাছের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতাম এবং তার সাথেই দ্যাখা হতো ক্যানো বার বার ? তবে কি সেও কারো আসার আশায় পথের পানে চেয়ে চেয়ে দিন কাটাতো ? আর বই পড়াও তো বন্ধ করে নি সে ! ঈষৎ দূরের শানের ঘাটে বিনে দরকারে দাঁড়িয়ে থাকা কিংবা অন্য কারো হাত দিয়ে আমার দেয়া বইটি ফেরত পাঠানো; আবার নতুন কোনো বইয়ের আশায় হাত বাড়ানো, সবই তো চলছিলো ! তবে ? একদিন এক ছোট্ট চিরকুটে লিখেছিলাম, ‘কী হয়েছে জানিনে, কিন্তু একটা মুখ সব সময় আমার কল্পচোখে ঘোরে। মুখটা দেখবার জন্য মনটা সব সময় ক্যামন ক্যামন করে। ক্যানো বলতে পারো ?’ কোনো উত্তর পাই নি। বেশ কয়েকদিন পর নিমাই ভট্টাচার্যের ‘মেমসাহেব’ উপন্যাসের ভেতরে রাখা আমার স্ট্যাম্প সাইজের ছোট্ট ছবিটার পিছনের শূন্য পিঠে আবিষ্কার করলাম, শূন্যটা পূর্ণ হয়ে আছে তিনটি ইংরেজি শব্দে : ও ষড়াব ুড়ঁ. জীবনে সে-ই প্রথম বুকের ভেতর নানারঙের ফুল, পরী আর নতুন কোনো গন্ধ অনুভব করলাম। তারপর লুকোচুরির নব নব ঘটনা-অনুঘটনা রচিত হতে থাকলো। একই পাড়ার ছেলে-মেয়ে, চারদিকে গুরুজনদের ছড়া-ছড়ি। বড়ো গোপনে, বড্ড লুকিয়ে স্রেফ দু’চার মিনিটের দ্যাখা করাতেই তৃষ্ণা মিটিয়েছি কতদিন ! বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর প্রেম নির্ভর করে থাকে পত্রের ওপর। কতো চিঠি লিখেছি ! কিন্তু পেয়েছি সে তুলনায় কমই বলা যায়। কতো বাধা-বিঘ্ন, চড়াই-উৎরাই ! কতো দূরতিক্রম্য প্রতিকূলতা ! ভার্সিটি ক্যাম্পাসে কতো মেয়ের ছড়াছড়ি ! না চাইতেই কেউ আবার ধরা দিতে চায় প্রণয়বন্ধনে ! কতো প্রলোভন ! হঠাৎ একদিন জরুরি তলব পেয়ে বাড়ি ফিরে শুনলাম, বিয়ে। কার ? আমার। মানে ? মানে, পরিবার আমার লেখা-পড়া চালিয়ে যেতে অক্ষম তাই…। অভিভাবক কর্তৃক নিয়োজিত ভগ্নিপতিকে একটু ঝাল ঝেড়েই বললাম, তাই বড়লোক বাবা আর তার মেয়ের কাছে আমাকে বন্ধক রাখতে চাও ? তিনি বললেন, তা নয়, তুমি না চাইলে এখন হবে না। শুধু মেয়েটারে দেখে রাখো। আমি জানালাম, পারবো না। এখন দেখে রাখবো আর তার বাপের কাছ থেকে মাসোহারা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বো। পরে যদি আমি তাকে না বিয়ে করি ? কিংবা মেয়েটারও যদি মতের পরিবর্তন ঘটে ? কোনো অ্যাকসিডেন্টও তো হতে পারে ! ভগ্নিপতি আমার একথার সদুত্তর দিতে পারে না। শুধু বলে, দ্যাখো তোমার যা ইচ্ছে। আমি তো আমার কথা বলছিনে, বলছি তোমার পরিবারের কথা। এখনই বলতে হবে তার নয়, দু’দিন সময় নাও, তারপর তোমার সিদ্ধান্ত জানাও। বীরেন বোনাইয়ের সাথে আমার বন্ধুপ্রতূল সম্বন্ধ। হাসতে হাসতেই বললাম বললাম, সময় দেয়া না দেয়া তোমাদের ব্যাপার, আমার বিষয়টা কিন্তু আমি ক্লিয়ার করেই দিচ্ছি, সম্ভব না হলে পড়া-লেখা করবো না, কিন্তু কোনো বড়োলোক শশুরের কাছে বিক্রি হতে পারবো না।
বিফল মনোরথে ক্ষান্ত হলো ভগ্নিপতি।
বললাম বটে, কিন্তু সেদিন রাতে আমার ঘুম হলো না। আমার লেখা-পড়া হুমকির মুখে পড়ে যাচ্ছে কিংবা আমার ভবিষ্যৎটা অনিশ্চিত হতে পারে বলে নয়, আমাকে কেন্দ্র করে আমার পরিবার, বিশেষত আমার অসহায় বাবা-মা যে স্বপ্ন দেখে আসছে সেই স্বপ্নটা ভেঙে যেতে পারে ভেবেই আমার মাথাটা ঘুরছিলো। আরো একটা ভাবনা বোধ হয় এসেছিলো তখন; ধনী শ্বশুর প্রাপ্তির প্রলোভন পরিত্যাগ করছি, সেটা ঠিক আছে, যে অবস্থাতেই থাকি তা য্যানো ত্যাগ করতে পারি সবসময়, কিন্তু আজ যাকে পছন্দ করি, সেই মেয়েটিও তো খানিকটা ধনী পরিবারেরই; তাকে পাওয়ার সম্ভাবনাটা বাস্তবের সাথে কতোটুকু মানানসই ? তারপরও আমার মন, আমার শিক্ষা বলে উঠলো, প্রয়োজনে পড়ালেখা বন্ধ করে দেবো, তবু ওভাবে বিক্রি হতে পারবো না। পারবো না একটা মেয়ের স্বপ্নের সঙ্গে জড়াতে গিয়ে আর একটা মেয়ের স্বপ্নকে ভেঙে দিতে, অথবা আমার নিজের ভালোবাসাটাকে উৎসর্গ করতে।
একদিন গ্যালো, দুদিন যেতে যেতে থমকে দাঁড়ালো; কী ভেবে লিখতে শুরু করলাম চিঠি; দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর এক টিঠি, যা লিখতে গিয়ে নিজের এবং লিখে অন্যের জীবনভাবনাকেও সম্ভবত প্রভাবিত করতে সমর্থ হলাম। তারপরও অনেক দিন গ্যালো। রূপসা-ভৈরবে অনেক জল গড়ালো। যার জন্যে যার জন্যে এতো ঝড়-ঝঞ্ঝা সয়েছি; প্রহরের পর প্রহর পুড়েছি; ক্যাম্পাস ও ক্যাম্পাসের বাইরের প্রলোভ্য সব প্রস্তাব ও প্রস্তাবনা উপেক্ষা করেছি; যার দিকে তাকিয়ে তিরিশ পয়সার বেশি মূল্যবান মনে করিনি তিরিশ বিঘে জমি; যে আমাকে অন্তর থেকে উচ্চারণ করতে বলেছিল ভালোবাসা শব্দটিকে; চেয়েছিল বাস্তবের মেমসাহেব হয়ে আমার পৃথিবীকে রাঙিয়ে তুলতে, সেই প্রিয়তমাসুর প্রচ- অনাকাক্সিক্ষত আঘাতে আহত হতে হতে এক সময় সবকিছু ছেড়েও দিয়েছি। তবু পরাভব মানে না যেন। প্রথম জীবনের ভালোবাসা স্বপ্নের মতো জেগে থাকে অন্তরে। তাই স্থায়ী বিচ্ছেদবারতা আর দীর্ঘ যোগাযোগহীনতার পরও মাস্টার্সের পরীক্ষা শেষে যখন গ্রামে ফিরলাম, মুখ্খানি দেখার জন্যে ভেতরে ভেতরে কী যে মুখরতা ! সহপাঠীদের অনেকেই যখন কাক্সিক্ষত ভবিতব্যের আশায় ঢাকাবাসী; কেউ কেউ লক্ষ লক্ষ মুদ্রানিবেদনে কর্মদুয়ারে দিগি¦জয়ী; আমার তখন প্রণয় আছে, দরখাস্ত করার পয়সা নেই ! পরীক্ষা দিতে গেলে ঋণ নিতে হয় ! অথচ তখনও আমার ও আমার মা-দাদাদের দরজায় টাকার থলে আর চাকুরির নিশ্চিন্তি হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে নতুন কোনো কনেপক্ষ। অথচ এরই মাঝে একদিন, আমার কিছু কথা আছে। যদি শোনার আগ্রহ থাকে দয়া করে কাল সকালে পিকনিক কর্নারে এসো— লিখিত পত্রবিন্দুটি পাওয়ার সাথে সাথে অখুশি কিংবা অবাক হওয়ার পরিবর্তে প্রহর গোনা শুরু করলাম ! এবং দ্যাখা হলে, আমরা কি আবার নতুন করে শুরু করতে পারি না, দীপ ? কোনো ভণিতা ছাড়াই আমার মাথাটা কাছে টেনে নিয়ে জানালো সে। আমি কেবল একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মনে মনে বললাম, তবে মাঝের থেকে এতটা ক্ষরণ ক্যানো দিলে ? মুখে বললাম, তুমি তো চাঁদের দেশের…! শেষ করতে পারলাম না। আমার বাচন দুয়ার রুদ্ধ করে দিলো সে। তারপরও কাজটা সহজ ছিলো না। উভয় পরিবারের অনতিক্রম্য ব্যবধান ছিলো এ বিষয়ে। সে আরেক ইতিহাস। এখন শুধু এটুকুই বলি, চাকরি প্রাপ্তির তিন বছর পরে, জুনের কুড়ি দিনের মাথায় আমার প্রেম তার কৌমার্য হারালো। কৌমার্য হারালেও ফিরে পেলো তার নতুন উদ্দীপনা, যা আজও অন্তরে-বাহিরে বহমান।
যৌবনের কবি নজরুল লিখেছেন, ‘বার্ধক্যকে সব সময় বয়সের ফ্রেমে বাঁধা যায় না। বহু যুবককে দেখিয়াছি যাহাদের যৌবনের উর্দির নিচে বার্ধক্যের কঙ্কাল মূর্তি। আবার বহু বৃদ্ধকে দেখিয়াছি – যাঁহাদের বার্ধক্যের জীর্ণাবরণের তলে মেঘলুপ্ত সূর্যের মতো প্রদীপ্ত যৌবন।’ সত্তরোর্ধ রবীন্দ্রনাথ তরুণ-তরুণীদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, ‘মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক / আমি তোমাদেরই লোক’। আমার কাছেও নিরন্তর মনে হয়, বয়স নয়, মনের যৌবন, মনের তারুণ্য আসল। মনে যদি গতি না থাকে, চিন্তা যদি ঘুনে ধরা জীবনের মরচে পড়া লৌহসিন্দুকের মতো হয়, প্রগতি অপেক্ষা পশ্চাৎপদতাই যদি জীবনকেন্দ্রে জায়গা করে নেয়, বাপ-দাদারা যেভাবে যা যা করতেন, লেখা-পড়া শিখে, আজকের এই বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির আলোকিত জগতেও যদি বিনা প্রশ্নে ঠিক তা-ই করতে হয়; তবে তো তারুণ্যের জন্মের আগেই তো নেমে আসে বার্ধক্যের স্থবিরত্ব। আমার দেশের অগণিত তরুণের দিকে তাকালে আমার হাসি পায়। পোশাকে-আশাকে, চলা-ফেরায়, কথা-বার্তায়, মোবাবাইলে-ইন্টারনেটে, ট্যাবে-স্মার্টফোনে… সবকিছুতেই আল্ট্রা আধুনিক; কিন্তু যখনই তার বহিরাবরণ ভেদ করে অন্তর্জগতে চোখ যায়, শাস্ত্রবিদ্ধ ধর্মাচার আর মধ্যযুগীয় পুরষশাসিত চিন্তা চেতনার অন্ধকার রাজ্য দেখে আৎকে উঠি। আমার নিজের ভাবনায় তারুণ্য অসীম ক্ষমতাঋদ্ধ একটা জীবনের নাম। বাইরে না হোক অন্তরে সে অসীম ক্ষমতাকে আজীবন অনুভব করতে চাই।
জীবনের হতাশায় আমিও দু-একবার মরবার কথা ভেবেছি, দু-বার মরতে মরতে ফিরেছি, একবার তো মরেই গেছি বলে খবর রটেছে গ্রামে ! অথচ এখনও, এই আশার সহস্র গুণ হতাশার সমুদ্রে ডুবে থাকতে থাকতেও বেঁচে থাকতে খুব ইচ্ছা করে। অনন্তকাল ধরে দেখে যেতে ইচ্ছা করে পৃথিবীর এই চিরসবুজ সুন্দরকে। আমারই লিখিত একটি কবিতা দিয়েই শেষ করি এই আলাপ কিংবা আলাপহীনতা :
ভোর হচ্ছে
একটু পরেই সোনার রেকাব হাতে
পৃথিবীর ঈশ্বর এসে দাঁড়াবেন পুব-আকাশে;
আলোয় হেসে উঠবে সবুজ পাতারা
রূপের হ্যাঙারে ফুটে উঠবে লাল-হলুদ ফুল,
গেয়ে উঠবে প্রিয় পাখি; অম্ল-মধুর ভুল।
আমি যাবো না।
ডোবাও
ভাসাও
কাঁদাও
হাসাও
পুনঃ পুনঃ পোড়াও যদি দুখের জতুবনে
তবু আমি যাবো না;
যেতে চাই না
তোমাদের ওই- অজানা আমন্ত্রণে !
ভোর হচ্ছে
সোনার রেকাব হাতে উঠে আসছেন ঈশ্বর
একটু পরে, সোনালি আলোয়
হেসে উঠবে পৃথিবী;
জানালায় চোখ
রাতবৃষ্টিতে ধুয়ে যাওয়া নারকেল পাতাগুলো
সারি সারি রুপো হয়ে জ্বলছে ! আর
আমার বুকের ভেতরে দুলে উঠছে
মাধবীলতার মতো জ্যোৎস্নার হার !
আমি যাবো না।
অনন্ত স্বর্গ চাই না
এই দুঃখ-সুখের পৃথিবীতে
ভিখিরির মতো হেঁটে যেতে চাই আরও কিছু পথ;
ফিরতে চাই আরও কিছু বিষণ্ন সন্ধ্যায়;
আরও কিছু দুঃখময় রাত কাটিয়ে যেতে চাই
এমন সোনায় মোড়ানো ভোরের অপেক্ষায়।
কী অসাধারণ সমৃদ্ধ ও সুন্দর কুমার দীপের স্মৃতিচারণ ! আমিও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। আমি উত্তবঙ্গের মানুষ হলেও চাকরি করেছি দক্ষিণবঙ্গে বহুদিন—–খুলনা, বাগেরহাট, বরিশাল, কুষ্টিয়া, কুয়াকাটা, যশোর, ভৈরব নদী, পশুর নদী, আড়িয়াল খাঁ, সন্ধ্যানদী, কীর্তনখোলা, ষাটগম্বুজ মসজিদ , সুন্দরবন, দক্ষিণডিহি, শিলাহদহ কুঠিবাড়ী, লালনের আখড়া, মধুকবির সাগরদাড়ি –্সবার সঙ্গে বহুবার দেখা হয়েছে আমার, কথাও। কুমার দীপ যাদের নাম বলেছেন, যেসব নাম বলেছেন– তার স্মৃতিলেখায় খায় , যেসকল বইয়ের কথা বলেছেন, যেসব গানের কথা উল্লেখ করেছেন, দুএকটা বাদ দিলে সবার এবং সবকিছুর সঙ্গে পরিচয় ছিল আমারও কৈশোরে ও প্রথম যৌবনে। আমিও ব্যাপক অর্থে বইপড়ুয়া এবং সংগীত-পাগল মানুষ। সংগীতের ক্ষেত্রে কুমার দীপের সঙ্গে আমার মিল সবই , শুধু এক স্থানে একটু পার্থক্য আছে,—- আমি ব্যাপকভাবে ও ব্যাপক মাত্রায় হিন্দি-উর্দু গজল ও ফিল্মী গান শুনে এসেছি ছোটকাল থেকে। কে. এল সায়গল, সামশাদ বেগম, নুরজাহান, সুরাইয়া, তালাত মাহমুদ, মুহম্মদ রফি, মুকেশ, লতামুঙ্গেশকর, মেহেদী হাসান, কিশোর কুমার, ফরিদা খান, আহমেদ রুশদী, আশা ভোঁসলে , সুমন কল্যাণপুর, রুনা লায়লা, নাজিয়া হাসান, এবং আরও ডজন ডজন শিল্পীর কণ্ঠে হিন্দি-উর্দু গান শুনে মুগ্ধ হয়ে এসেছি ছোটকাল থেকেই্। সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘ শবনম’ , এই উপন্যাসের তুলনা নেই, অন্তত আমার কাছে। তেমনি পাগল করেছে আমাকে নিমাই ভট্টাচার্যের ‘মমসাহেব’ , ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের ‘শাপমোচন’, যাযাবরের ‘দৃষ্টিপাত’, শরৎচন্দ্রের ‘দত্তা’ প্রভৃতি উপন্যাস। কুমার দীপের সঙ্গে আমার একটা বিশেষ ধরনের মধুর স্মৃতি আছ যা ভোলার নয়। তিনি শহীদ ইকবাল সম্পাদিত ‘ চিহ্ন’ পত্রিকায় আমার জীবনের প্রথম বই , প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ তন্ত্র থেকে দূরে’ নিয়ে লিখেছিলেন। তখনকার সময়ের প্রেক্ষাপটে সেটা ছিল আমার কাছে অভাবনীয় এবং তা নতুন লেখক হিসেবে আমার আত্মবিশ্বাস তৈরীর ভিত্তি নির্মাণে সহায়তার সমান। অবশ্য তখন তাকে আমি চিনতাম না, দেখাও হয়নি। পরে তিনি আমার কবিতা নিয়ে দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছেন। দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে। এখন তো সেই সম্পর্ক গভীর ও নিবিড় মাত্রা লাভ করেছে। আমি নিজেও স্মৃতিকথা লেখা শুরু করেছি। জন্মকাল থেকে হাইস্কুল জীবন পর্যন্ত লেখা হয়েছে। কুমার দীপের এই লেখাটি আমাকে অনুপ্রেরণা জোগাবে। এখন থেকে আমি বেশ কিছু তথ্য নিতে পারবো যা ভুলে গিয়েছিলাম। কুমার দীপ নিশ্চয়ই তার স্মৃতিকথার সম্প্রসারিত বর্ণনায় গিয়ে তাকে একটি গ্রন্থে রূপায়িত করবেন। পাঠক পাবেন আরও একখানি উপভোগ্য স্মৃতিসম্ভার। তার জন্য শুভকামনা।
এই দীর্ঘ গদ্য ধৈর্য ধরে পড়েছেন এবং অসামান্য মন্তব্যও করেছেন প্রিয় কবি! ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা অনিঃশেষ।
Find latest news about Online Casinos, New Slots Games and latest Sports Betting trends here At Onlinecasinoslotstips.com.
sildenafil generic viagra supreme suppliers viagra online sales
Идеи с целью женитьбы во Москве. Увлекательные мысли согласно проведению женитьбы. Креативный аспект ко компании брачного праздника создаст существенное явление во Вашей существования запоминающимся! https://anikolsky.com организация свадьбы в Москве
Знаменитым пророком написан смысл секретного древнего предсказания касательно РФ. В этих документах сказано что Россию ожидает три войны, они будут затратные для властей. В первых войнах Российское государство отпразднует победу. государство Россия одержит большое величие, но через 70 лет после второй победы государство Россия развалится на более 10 частей. Правитель крупнейшей территории не примет это и через двадцати лет находясь во власти, будет планировать мысли о воссоединении стран. Это решение будет провалом для страны. В самом начале он захватит побережье и именует это победой, через 10 лет он изъявит желание присоединить территорию на суше. Это решение принесет в их жизнь только смерть, воины большого государства будут гибнуть на чужой земле, а для мировых государств Русь будет болезнью которую нужно удалить. Только гибель правителя сможет вырвать страну из лап смерти. Что предпримут граждане страны?!
плакетка
Find latest news about Online Casinos, New Slots Games and latest Sports Betting trends here At Topjackpotbetreview.com
Hot galleries, thousands new daily.
http://upperexeter.gundumporn.alexysexy.com/?noemi
power pack porn comic porn maturemom large simpson porn foot fetish porn lesbian teens porn
Доброго времени суток товарищи!
Более подробная информация размещена https://drive.google.com/file/d/1e-qsrosEBvPPvIxO1GO9qvs5WH9WS7kV/view?usp=sharing
Предлагаем Вашему вниманию изделия из стекла для дома и офиса.Наша организация ООО «СТЕКЛОЭЛИТ» работает 10 лет на рынке этой продукции в Беларуси.Стоит задача грамотно и недорого организовать офисное помещение в короткий срок? Возникли трудности с планировкой? Предлагаем оптимальное решение — современные офисные перегородки на заказ, которые позволят офис разделить по отделам или предоставить каждому сотруднику личное рабочее пространство для спокойной, уединенной работы.
Увидимся!
hydrarusawyg5ykmsgvnyhdumzeawp465jp7zhynyihexdv5p74etnid.onion
hydrarusoeitpwagsnukxyxkd4copuuvio52k7hd6qbabt4lxcwnbsad.onion
Байден призвал американцев «сейчас же» покинуть Украину, поскольку в стране может обостриться ситуация.
hydra onion
[url=https://hydraclubbioknikokex7njhwuahc2l67fiz7z36md2jvopda7hydra-onion.com]настоящая ссылка на гидру[/url]
Она оценила действия Белого дома «показательную как никогда истерику». «Англосаксам нужна война. Любой ценой. Провокации, дезинформация и угрозы — излюбленный метод решения собственных проблем. Каток американской военно-политической машины готов идти вновь по жизням людей», — указала дипломат.
The Best Online [url=https://www.jackpotbetonline.com/]Sports Betting[/url] Tips
There are many different sports to bet on, but we have some favorite games that you should consider betting on this month to maximize your monthly profits. There are plenty of resources available online and in these lists that will get you started with the best bets for your own chosen sport this week.
The History of [url=https://www.jackpotbetonline.com/]Sports Betting[/url]
The first documented bets were made more than 7,000 years ago by Chinese and Babylonian scholars who called them “shan-yu” or fate lot. These investments didn’t pay out in a winner-takes-all format but rather in return for shares with the house holding roughly 60 percent of the control. Both civilizations bet on dice games, board games, and contests between members of their tribe.
How Online Bets Work
Online [url=https://www.jackpotbetonline.com/]Sports Betting[/url] is a popular activity. There are many different options to choose from. The best bets can be found in the tips that people share online, and you may want to take a look depending on your knowledge and preferred sports.
[url=https://www.jackpotbetonline.com/]Sports Betting[/url] Rules
The [url=https://www.jackpotbetonline.com/]Sports Betting[/url] rules are simple and every bet is based on money. There are many things to consider prior to placing a bet online, so you need to know what kind of bets and markets best fit your gambling desires.
Types of Online [url=https://www.jackpotbetonline.com/]Sports Betting[/url] Services
Online [url=https://www.jackpotbetonline.com/]Sports Betting[/url] services are divided into 2 main types: sportsbooks and odds aggregators. The biggest difference with other types of betting is that the odds on these bets are determined by the number of customers willing to take this wager rather than by traditional methods. Odds can also change from moment-to-moment depending on new information that the market perceives as relevant.
Top Tips for Making a Sports Bet
Saving for the future is hard
A lot of people find themselves in the position of having a lot of thinking to do about making their money last as long as possible. And in that fight many people mistakenly try, with an almost guaranteed result, often hearing these 5 hollow words: “I’ll work harder.” That said, gambling on sports isn’t so black and white. There are factors- like your bet selection- that result in tremendous variance over time. So if you’re looking for some advice on what horse might be your ticket to riches this weekend, check out our top 10 picks.
Conclusion
So, we have shown that online betting is a good place to get your [url=https://www.jackpotbetonline.com/]Sports Betting[/url] fix. There’s nothing to lose and much to gain. Just don’t bet on anything which you have no knowledge of or experience with, like soccer.
hydraruzxpnew4af
hidraruzxpnew4af.onion
февраля министр иностранных дел Украины Дмитрий Кулеба и госсекретарь США Энтони Блинкен обсудили стратегию по «сдерживанию» России. Кулеба поблагодарил американскую сторону за «беспрецедентную» помощь и выразил надежду, что Россия проявит «конструктивную позицию» в рамках «нормандского формата».
гидра не работает
[url=https://hydraclubbioknikokex7njhwuahc2l67lfiz7z36md2jvopda7nchid.onion-darknet-shop.com]hydrarusawyg5ykmsgvnyhdumzeawp465jp7zhynyihexdv5p74etnid.onion[/url]
В том же интервью Байден объяснил отказ посылать американские войска на Украину. Он предположил, что эта мера повлечет за собой начало новой мировой войны. Ранее в создании угрозы международного конфликта Байдена обвинил экс-президент США Дональд Трамп.
[img]https://media.newyorker.com/photos/622c1f41790b587b43a38c4d/16:9/w_1280,c_limit/220321_r40051.jpg[/img] What the Russian Invasion Has Done to UkraineThe New Yorker plsHelpUkraine03202229
hydraruzxpnew4af
гидра сайт
Мы продолжаем сокращать численность нашего персонала в посольстве в Киеве”, – сказал он. “Мы призываем всех американских граждан, которые остаются на Украине, немедленно покинуть страну. На данном этапе мы хотим выразиться предельно ясно: любой находящийся на Украине американец должен уехать как можно скорее – в течение ближайших 24-48 часов”, – добавил Салливан.
[url=https://vetalgerarewi.cf/post/Il-Piacere-Di-Scrittura-Creativa-Sono-Utili]Il Piacere Di Scrittura Creativa Sono Utili[/url]
[url=https://goooograhabalcounsie.cf/post/Come-Scrivere-Una-Tesi-Di-Un-Quotidiano]Come Scrivere Una Tesi Di Un Quotidiano[/url]
[url=https://epprogmic.gq/post/Ensayo-General-Violetta-En-Equipo-En-Una-Empresa]Ensayo General Violetta En Equipo En Una Empresa[/url]
[url=https://paviberost.cf/post/El-Libro-De-Las-Normas-Apa]El Libro De Las Normas Apa[/url]
[url=https://sulzcounjelec.ml/post/Como-Apresentar-Sua-Proposta-De-Rica]Como Apresentar Sua Proposta De Rica[/url]
[url=https://dysfunkbifibto.gq/post/Los-Espejismos-De-Emociones]Los Espejismos De Emociones[/url]
[url=https://lylabrohipbi.tk/post/Vlog-De-L-Preuve-Crite]Vlog De L Preuve Crite[/url]
[url=https://vultigangconscountmo.tk/post/Une-Voiture-Lectrique-De-Projet]Une Voiture Lectrique De Projet[/url]
порно старые большие [url=https://dyrka.top/]Порно Дырка[/url]
деревенское порно онлайн [url=https://dyrka.top/search/%D0%A4%D0%B8%D0%BB%D1%8C%D0%BC%D1%8B/]порно фильмы италия [/url]
[url=https://royaltyeliterecords.com/2021/06/04/hello-world/#comment-15992]скачать порно голые девушки[/url]
[url=https://gremiumalarm.cz/2020/05/20/vzdelavani-pro-clenske-firmy-aga/#comment-17757]порно онлайн муж смотрит[/url]
[url=http://dm20.net/forum/viewtopic.php?f=5&t=2211]самое красивое порно 2020[/url]
[url=http://criminallaw.webpin.com/?gb=1#top]порно больших секретарш[/url]
[url=http://rbzgoatf.pornoautor.com/site-announcements/1197374/bad-prednisone-subsides-outlives-heads-food-borne-feasible-60yrs?page=6#post-1666712]красивое порно в чулках фото[/url]
[url=https://www.xingguiweb.com/forum.php?mod=viewthread&tid=1383718&extra=]смотреть порно в киску[/url]
[url=https://www.sunriseholidays.net/]красивое порно друзей видео[/url]
[url=https://read.netreadz.com/2021/08/17/america-the-dead-chapter-read-01/#comment-1207]порно большие сиськи с другом[/url]
[url=http://emergency.phorum.pl/viewtopic.php?f=11&t=624928]порно члены молодых парней[/url]
[url=https://fr.swashvillage.org/article/pete-davidson-biography-3#comments]смотреть порно бесплатно две девушки[/url]
4324faf
секс с молодым парнем порно https://devaxa.xyz/
домашнее порно 1 [url=https://devaxa.xyz/search/%D0%98%D0%B7%D0%BD%D0%B0%D1%81%D0%B8%D0%BB%D0%BE%D0%B2%D0%B0%D0%BD%D0%B8%D0%B5/]смотреть порно видео жесткое изнасилование [/url]
[url=https://www.dreamteamunterwegs.de/the-loneliest-highway/#comment-848]смотреть порно ролики кончают[/url]
[url=http://manufacturasmexico.mex.tl/?gb=1#top]секс порно видео большие сиськи[/url]
[url=https://akenoss.com/pages/3/b_id=7/r_id=1/fid=54991ffe4a2adef5cac1da5002c9a9b4]дырки девушек порно[/url]
[url=https://solarkita.com/blog/kenali-jenis-dan-dampak-polusi-udara-berikut-ini]красивое гламурное порно[/url]
[url=https://brawnlabs.in/low-temperature-laboratory-aalto-university/#comment-196462]порно молодая и хуй[/url]
[url=https://rover.srl/2021/05/11/hello-world/#comment-19319]порно большие половые губы[/url]
[url=https://hipnomedia.com/foro/post1544712.html#p1544712]порно невеста анал[/url]
[url=http://icph.birzeit.edu/content/bacterial-resistance-results-isolated-blood-cultures-neonatal-sepsis-neonatal-intensive-care?page=96#comment-4950]порно рассказы молодая жена[/url]
[url=http://humbertologo.mex.tl/?gb=1#top]порно ролики зрелые дамы[/url]
[url=https://gte.com.vn/huong-dan-su-dung-phan-mem-xmeye-tren-may-tinh/?comment=2870226#comment]смотреть порно девушек бесплатно и без регистрации[/url]
4fafb23
плакетки
Girls of Desire: All babes in one place, crazy, art
http://kinda.pornportage.kanakox.com/?marilyn
tracy lords porn videos young fffm porn online porn videis pukes porn free asian xxx porn pictures
BR Projects. We from Ukraine. No War! https://www.youtube.com/watch?v=G1n69Gki1Io Gadgets that change the world! Start of the campaign in March-April. The first thousand participants will receive gadgets engraved with your name. All gadgets unisex
World’s first dimensionless bluetooth rings https://project-br.com/ power bank for iphone, power bank for ipad, power bank for cell phone, power bank for wifi router, power bank brands, bracelet ideas, bracelet images, bracelet iphone charger, bracelet organizing ideas
viagra usa pharmacy supreme suppliers in india buying viagra in india
патрик мен костюмы
Dirty Porn Photos, daily updated galleries
http://riverside.amandahot.com/?mariam
mature porn tv christian answers to cure porn addictions iesbian porn dad caught masturbating porn thin girl porn pics
blogspotgood.com Blog is your reliable Sport source of everything that you need to know about what is going on in the Breaking news community and abroad including vehicles and equipment, breaking news, international news and more. We focus on the people, the issues, the events and the technologies that drive tomorrow’s response.
Howdy! I could have sworn I’ve visited this web site before
but after looking at a few of the posts I realized it’s new to me.
Anyways, I’m certainly delighted I stumbled upon it and I’ll be book-marking it and
checking back often!
My spouse and I absolutely love your blog and find almost all
of your post’s to be exactly what I’m looking for.
Does one offer guest writers to write content for you personally?
I wouldn’t mind composing a post or elaborating on most of the subjects you write in relation to here.
Again, awesome weblog!
Hello, you used to write magnificent, but the last few posts have been kinda boringK I miss your great writings. Past several posts are just a little out of track! come on!
I don’t need to tell you how important it is to optimize every step in your SEO pipeline. But unfortunately, it’s nearly impossible to cut out time or money when it comes to getting good content. At least that’s what I thought until I came across Article Forge… Built by a team of AI researchers from MIT, Carnegie Mellon, Harvard, Article Forge is an artificial intelligence (AI) powered content writer that uses deep learning models to write entire articles about any topic in less than 60 seconds. Their team trained AI models on millions of articles to teach Article Forge how to draw connections between topics so that each article it writes is relevant, interesting and useful. All their hard work means you just enter a few keywords and Article Forge will write a complete article from scratch making sure every thought flows naturally into the next, resulting in readable, high quality, and unique content. Put simply, this is a secret weapon for anyone who needs content. I get how impossible that sounds so you need to see how Article Forge writes a complete article in less than 60 seconds! order here.
I don’t need to tell you how important it is to optimize every step in your SEO pipeline. But unfortunately, it’s nearly impossible to cut out time or money when it comes to getting good content. At least that’s what I thought until I came across Article Forge… Built by a team of AI researchers from MIT, Carnegie Mellon, Harvard, Article Forge is an artificial intelligence (AI) powered content writer that uses deep learning models to write entire articles about any topic in less than 60 seconds. Their team trained AI models on millions of articles to teach Article Forge how to draw connections between topics so that each article it writes is relevant, interesting and useful. All their hard work means you just enter a few keywords and Article Forge will write a complete article from scratch making sure every thought flows naturally into the next, resulting in readable, high quality, and unique content. Put simply, this is a secret weapon for anyone who needs content. I get how impossible that sounds so you need to see how Article Forge writes a complete article in less than 60 seconds! order here.
Being a digital marketer today is definitely not easy! Not only do you need high-quality content, you need a lot of it. But creating good content is incredibly time consuming. At least that is what I thought until I came across WordAi… In case you have never heard of WordAi, it is a lightning fast content rewriter that uses Artificial Intelligence to automatically create unique variations of any piece of content. The best part is, WordAi creates rewrites that both humans and Google love. I know, that’s a bold claim and I was pretty skeptical myself. So I decided to test their claims with their free trial and can tell you honestly, I opted directly for the yearly subscription after that. I’m not exaggerating when I tell you that WordAi is better than any other tool, service, or method on the market. I have been using WordAi to fill out my blogs and have already covered the cost of my yearly subscription. Its crazy but Im just scratching the surface of how far I can scale my SEO with WordAi! While I am using WordAi to scale my SEO efforts, you can also use WordAi to diversify your copy or even brainstorm to beat writers block! I could tell you about WordAi all day, but you really just need to try it for yourself. They are so confident in their technology that they offer a completely free 3-day trial AND a 30-day money back guarantee. So what are you waiting for? Click here to get started with WordAi for Free! Register here and get a bonus.
I got this web page from my friend who told me about this web page and now this
time I am browsing this website and reading very informative articles at this time.
Ahaa, its fastidious conversation on the topic of this paragraph here at this blog, I have read all that, so at this time
me also commenting here.
I want to to thank you for this great read!!
I definitely loved every little bit of it. I’ve got you book marked to check
out new stuff you post…
Thumuavaithanhly lua dao, thu mua vaithanhly danh nguoi, thumuavaithanhly quit
tien, thumuavaithanhly danh nhau, thumuavaithanhly khong tra tien mua hang
Right away I am going to do my breakfast, afterward having my breakfast coming yet
again to read other news.
Very great post. I simply stumbled upon your blog and
wished to say that I’ve truly enjoyed surfing around your blog posts.
After all I’ll be subscribing for your feed and I’m hoping
you write again very soon!
Very nice post. I just stumbled upon your blog and wanted to say that
I’ve really enjoyed surfing around your blog posts.
After all I will be subscribing to your rss feed and I hope
you write again very soon!
There’s definately a lot to learn about this issue.
I like all the points you have made.
bán vải cây minh quân chiếm đoạt tài sản, cảnh báo thu mua vải minh quân lừa
đảo
Hello to all, how is everything, I think every one
is getting more from this web page, and your views are nice
in favor of new viewers.
Наш интернет магазин предлагает вам приобрести у нас
любые базы для Xrumer и GSA, allsubmitter
Вы занимаетесь продвижением сайтов?
Тогда вам к нам. У нас вы можете выбрать любую нужную
для вашей работы базу для прогонов Xrumer и
GSA, allsubmitter по разной ценовой категории.
к нам в группу о различным вопросам адрес группы в телеграмм @pokras777 либо в скайп pokras7777
Thanks for the good writeup. It in truth was a entertainment account it.
Look complicated to more brought agreeable from you! However, how can we keep up a correspondence?
Hi there! I could have sworn I’ve been to this site before but after browsing through some
of the post I realized it’s new to me. Nonetheless,
I’m definitely glad I found it and I’ll be book-marking and checking back
often!
решение о создании филиала ооо
I just like the helpful information you provide in your articles.
I’ll bookmark your weblog and test again here regularly.
I am somewhat certain I’ll be informed many new stuff right
here! Best of luck for the next!
I am regular reader, how are you everybody? This paragraph posted at this website is in fact good.
Awesome! Its genuinely remarkable piece of writing, I have got much clear idea about from
this post.
wonderful issues altogether, you just received a new reader.
What may you suggest in regards to your put up that you simply made a feew
days in the past? Any positive?
1인샵
Great weblog here! Additionally your website lots up fast!
What web host are you using? Can I get your associate hyperlink to your host?
I want my site loaded up as fast as yours lol
Feel free to surf to my blog post: A片
Pretty nice post. I just stumbled upon your blog and wished to
say that I have really enjoyed surfing around your weblog posts.
In any case I will be subscribing for your feed and I hope you write again soon!
hi!,I really lime your writing very a lot! percentage we keep
upp a correspondence more about you article on AOL? I need an expert in thiis space to
unravel my problem. May be that’s you! Taking a look ahead too look you.
건마
What a stuff of un-ambiguity and preserveness of precious know-how regarding unexpected emotions.
I have been exploring for a little bit for any high quality articles or blog posts in this
sort of area . Exploring in Yahoo I ultimately stumbled upon this website.
Studying this info So i’m glad to show that I have a very excellent uncanny feeling I came upon exactly what I needed.
I most for sure will make certain to don?t fail to remember this website and
give it a look regularly.
If some one wishes expert view regarding running a blog afterward i propose him/her to visit this website, Keep up the nice job.
Hi there colleagues, how is everything, and what you want to say on the topic of
this post, in my view its really remarkable in support
of me.
Hey there this is somewhat of off topic but I was wondering if
blogs use WYSIWYG editors or if you have
to manually code with HTML. I’m starting a blog soon but have no coding know-how so I wanted to get guidance from someone with experience.
Any help would be greatly appreciated!
I was suggested this website by my cousin. I am not sure whether this post is written by him as nobody
else know such detailed about my trouble. You’re wonderful!
Thanks!
It’s perfect time to make some plans for the future and it’s time to be happy.
I have read this post and if I could I want to suggest you few interesting things or suggestions.
Maybe you could write next articles referring to this article.
I wish to read more things about it!
Whats up are using WordPress for your site platform?
I’m new to the blog world but I’m trying to get started and set up my own. Do you require any html coding
knowledge to make your own blog? Any help would be really appreciated!
Unquestionably consider that which you said. Your favorite reason seemed to be on the web the simplest factor to take note of.
I say to you, I certainly get irked at the
same time as folks consider concerns that they plainly do not recognize about.
You managed to hit the nail upon the highest as neatly
as defined out the whole thing with no need side-effects , people can take a signal.
Will probably be back to get more. Thanks
Stop by my web blog; m88
Greetings! I know this is kinda off topic but I was wondering if you knew where I could locate a captcha plugin for my comment form?
I’m using the same blog platform as yours and I’m having difficulty finding one?
Thanks a lot!
Hey fantastic blog! Does running a blog similar to this require a large amount of work?
I have very little understanding of programming but I was hoping to start my own blog in the near
future. Anyhow, should you have any ideas
or tips for new blog owners please share. I understand this is off topic
but I simply wanted to ask. Thanks a lot!
Here is my web page: CryptoTab NFT rewards
Drugs information sheet. Effects of Drug Abuse.
gabapentin otc
Best information about medicines. Get information now.