‘ বাংলার প্রকৃতি ও মাটি গদ্যের চেয়ে পদ্যের মঞ্জরি ফোটাতেই হয়তো বেশি আগ্রহী, তাই হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির বিশ্লেষণে দেখা যায় গদ্যের চেয়ে কবিতাই এখানকার মানুষকে অনেক বেশি আলোড়িত ও আলোকিত করে। তা সত্ত্বেও গাজী আজিজুর রহমান গদ্যের প্রতিই অনুভব করলেন তীব্র আকর্ষণ।
গদ্যের, বিশেষ করে প্রবন্ধে জ্ঞান-বিজ্ঞান, ধর্ম-দর্শন, মনস্তত্ত্ব, সমালোচনা-তুলনা-প্রতিতুলনা, রাজনীতি-অর্থনীতি- বৈশ্বিক চেতনা ইত্যাদি চর্চা, বিচার বিশ্লেষণের যে অপার সম্ভাবনা তৈরি করা সম্ভব সেটি সাহিত্যের অন্য শাখায় সার্থকভাবে হয়ে ওঠে না। আবেগসর্বস্বতা ও ভাবুকতার চেয়ে যেহেতু যুক্তি ও দ্বান্দ্বিকতা গাজী আজিজুর রহমানের অধিক পছন্দের বিষয় তাই তিনি গদ্যচর্চায় সকল অশৈল্পিক ভার থেকে নিজের মুক্তি খুঁজেছেন ’
ম্যানগ্রোভ সাহিত্যে-র বিশেষ নিবেদন–

গাজী আজিজুর রহমানের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
গাজী আজিজুর রহমান-এর জন্ম ১৯৪৭ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ভারতের দার্জিলিংয়ে। পিতা কাসেম আলী গাজী, মা করিমন্নেসা। তিনি ১৯৬৪ সালে সাতক্ষীরা কালীগঞ্জের নলতা হাই স্কুল থেকে এসএসসি, ১৯৬৬ সালে সাতক্ষীরা কলেজ থেকে এইচএসসি, ১৯৬৯ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে বিএ এবং ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। কালীগঞ্জ মহাবিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন ১৯৭৫ সালে এবং অধ্যাপক পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন ২০১০ সালে।
প্রতিভার সপ্তপর্ণা মণি ধারণ করে বাংলা সাহিত্যের রস ভাণ্ডার পূর্ণ করে চলেছে দেশের অন্যতম এই লেখক ও প্রাবন্ধিক। খুব কম লিখলেও যা লেখেন ভেবেচিন্তে লেখেন। তার লেখার একটি ব্যতিক্রম বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বিশেষ করে মৃত্যু, আত্মহত্যা এবং কবিতাবিষয়ক তার লেখাগুলো পাঠককে বার বার ভাবিত করে, প্রশ্নমুখী করে তোলে। বিশ্বসাহিত্য, ইতিহাস, আধুনিকতা তার প্রিয় লেখালেখির বিষয়-আশয়। এছাড়া সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে তার দীর্ঘ আড়াই দশকের লেখা পাঠককে জুগিয়েছে নবভাবনার খোরাক। তার ভাষার বিরলতা, ভাবনার দুর্লভতা এবং সবকিছু নিয়ে সাহিত্য হয়ে ওঠার যে অন্যনতা তিনি তার অনাপ্য উদাহরণ।
তাঁর প্রথম লেখা ছাপা হয় ১৯৬৫ সালে সাতক্ষীর কলেজ বার্ষিকীতে। ১৯৬৭ সালে আজম খান কমার্স কলেজের বিকম পড়ার সময় খুলনা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক দেশ, সাপ্তহিক জনবার্তা, দৈনিক পাকিস্তানের শিশুদের পাতা সাতভাই চম্পা, ডেইলি অবজারভারের সাপ্তাহিক ফিচার পাতা ইয়াং অবজারভারসহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছাপা হতে থাকে শিশুতোষ গল্প, ছাড়া, কবিতা এবং নিজের আঁকা ছবি। ১৯৬৮ সালে বাংলাদেশ পুলিশের মুখপত্র ডিটেকটিভে গল্প লিখে প্রথম ১৫ টাকা লেখক সম্মানী পান। প্রথম সম্পাদিত পত্রিকা হরফ প্রকাশিত হয় ১৯৭৮ সালে। তাঁর সম্পাদনায় সাপ্তাহিক সুন্দরবন প্রকাশিত হয় ১৯৮৩ সালে। আর প্রথম বই প্রকাশিত হয় ১৯৯২ সালে।
দেশের সুদূর দক্ষিণ প্রান্তে সাতক্ষীরা জেলার কালীগঞ্জ কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছর কাজ করেছেন তিনি। ইত্যবসরে নিজেকে সম্পূর্ণ নিয়োজিত করেছেন গবেষণাকর্ম ও সংস্কৃতিসেবায়। সাতক্ষীরা কালীগঞ্জে বসে কাজ করলেও তার গবেষণাকর্ম ঢাকা-কোলকাতা পর্যন্ত বিস্তৃত এবং সমাদৃত। পরিশ্রমী কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ বেশ কয়েকটি সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : সাতক্ষীরা সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার (১৯৯৫); ম্যান অব দি ইয়ার, বায়োগ্রাফিক্যাল ইনস্টিটিউট, যুক্তরাষ্ট্র (১৯৯৮); কবি জসীমউদ্দীন সাহিত্য পুরস্কার (২০০১); শিমুল-পলাশ সাহিত্য পুরস্কার, কলকাতা (২০০৪); বাংলা ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চাকেন্দ্র পুরস্কার (২০০৭); লিনট পদক পুরস্কার (২০০৮); সিকানদার আবু জাফর পদক (২০১২); কবি সুকান্ত পুরস্কার (কলকাতা ২০১৫)।
তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ : প্রবন্ধ গবেষণা : সাহিত্যে সমাজবাস্তবতার ধারা (১৯৯২, পুনর্মুদ্রণ ২০১৪); স্বেচ্ছামৃত্যুর করতলে কবি (১৯৯৬, পুনর্মুদ্রণ ২০১৫); সাহিত্য ও সিংহাসন (১৯৯৯); নোবেল সাহিত্য পুরস্কারের শতবর্ষ (২০০১); সাতক্ষীরার ভাষা ও শব্দকোষ (২০০৪); আধুনিক বাংলা উপন্যাসের বিষয় ও শিল্পরূপ (২০০৯); কবিদের কবি (২০১০); কালীগঞ্জের ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধ (২০১৪)। সম্পাদনা : মরণরে তুহু মম (২০০৪) এবং খান আনসার উদ্দীন আহমেদ রচনাবলী (১৯৯৯)। অন্যান্য প্রকাশনা : বজ্রের বাঁশি (উপন্যাস), কালো সূর্যের নীচে (নাটক), সক্রেটিস (নাটক), যোদ্ধার জতুগৃহ (উপন্যাস)।
সম্পাদনার কাজেও তার মুন্সিয়ানা রয়েছে। ১৯৮৩ সাল থেকে সম্পাদনা করে যাচ্ছেন ‘নদী’ নামের একটি সাহিত্যপত্র। এছাড়াও রয়েছে প্রচুর অনিয়মিত সম্পাদনা।
গ্রন্থনা : ইমরুল ইউসুফ

স্মৃতি-বিস্মৃতির দিন : মাকিদ হায়দার
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় তার একটি কবিতায় স্মৃতি এবং মর্মবেদনার কথা আমাদেরকে জানিয়েছেন। কবিতা পাঠান্তে যে কোনো পাঠকই মুহূর্তের ভেতরেই ফিরে যেতে পারে যেন, তার সেই ফেলে আসা অতীতের কাছে।
‘চোখ বন্ধ করলে অবস্থাটা যেন সব কিছু স্পষ্ট দেখতে পাই’,
আমার বিশ্বাস, জীবিত মানুষেরা বর্তমানের চেয়ে অতীতকে নিয়ে ভাবতে ভালোবাসে, আমায় কেউ-ই সেই মোহ থেকে মুক্ত নই, মুক্ত নই বলেই চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই হাজার মানুষের মুখ। আরো দেখতে পাই মাত্র ৫০ বছর আগের সেই ১৯৬৭ সালের আমাদের জগন্নাথ কলেজ। দেখতে পাই ঢাকা শহরের উত্তর-দক্ষিণে চারদিকের সবুজাভ। জনবসতি, তখনকার দিনে ঘনবসতি হয়নি, হেঁটে হেঁটে সারা শহর ঘুরলেও কারো সঙ্গে কারো ধাক্কা খাবার সম্ভাবনা ছিল না বললেই চলে।
তখনকার দিনে ঢাকা শহরে যে সকল বাস চলাচল করতো সেগুলোকে বলা হতো মুড়ির টিন। সেই মুড়ির টিনের ভাড়া ছিলো ছাত্রদের জন্য অর্ধেক। মালিকেরা ছিলেন অধিকাংশই মোহাম্মদপুর-মিরপুরের বিহারীরা, গাড়ির ড্রাইভার-হেলপার তারাও ছিলেন উর্দুভাষী। তখনকার দিনে গুলিস্তান, রাণীমহল, নগরমহল, মুকুল, (আজাদ নাম পরে দেয়া হয়) সিনেমা হলগুলোতে বেশির ভাগ সময়ই পশ্চিম পাকিস্তানের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সিনেমাগুলো প্রদর্শিত হতো। অভিনেত্রী নিলু, সাবিহা, জেবা, সন্তোষ, কামাল, কৌতুকাভিনেতা শের-এ গুলসহ অজস্র উর্দু ছায়াছবি। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় ছায়াছবি প্রদর্শন বন্ধ করে দিয়েছিলো পাক সরকার। তবে লিও এবং দোসানীদের গুলিস্তানসহ আরো একটি প্রেক্ষাগৃহ ছিলো যার নাম ছিলো ‘নাজ’। নাজে শুধু প্রদর্শিত হতো পৃথিবীর বিখ্যাত ইংরেজি ছায়াছবিগুলো, ফ্রন্ট স্টলের টিকিটের মূল্য ছিলো ১২ আনা, সর্বশেষ বেলকনিতে ছিলো ৩ টাকা ৪ আনা। ছাত্রদের পরিচয়পত্র দেখালে নাজ কর্তৃপক্ষ টিকিটের মূল্য কম রাখতো বলেই এখনো মনে পড়ে। যেমন মনে পড়ে মালিবাগ থেকে সদরঘাটের ভাড়া ছিলো ২০ নয়া পয়সা। সেখানেও বাসের হেলপারকে বলতে হতো আমি জগন্নাথ কলেজের ছাত্র। ১০ পয়সাতেই মালিবাগ থেকে প্রেসক্লাব পর্যন্ত বাস যেতো। রমনা পার্কের পূর্ব পাশ হয়ে প্রেসক্লাব থেকে জেনারেল পোস্ট অফিসকে হাতের বামে ফেলে থামতো গিয়ে গুলিস্তান। সেখান থেকে সদরঘাট। সেই সময়ে বিজয়নগর রোড, শাহবাগ নর্থ-সাউথ রোড হয়নি, আমরা থাকতাম ১৪/২ মালিবাগের একটি ভাড়া বাসায় ১৯৬৪ সাল থেকে।
সমগ্র ঢাকা শহর ছিল আমার প্রিয় সাইকেলের অধীনে, নাম ‘এশিয়া বাইক,’ ১৮৫ টাকা দিয়ে মিতা কিনে দিয়েছিলেন নবাবপুরের এক উর্দুভাষীর দোকান থেকে। কলেজছাত্র শুনে ৫ টাকা কম নিয়েছিলেন সাইকেল বিক্রেতা। সাইকেলে চেপে প্রায়শই দেখতে যেতাম, সে কালের বিখ্যাত শাহবাগ হোটেলকে। আমার মতো বয়সে মফস্বল শহর থেকে যারা ঢাকায় আসতেন তাদের দেখবার তালিকায় ছিলো শাহবাগ হোটেল, মীর জুমলার কামান, গুলিস্তান সিনেমা হল এবং নিমতলির জাদুঘর, লালবাগ কেল্লা এবং তেজগাঁওয়ের এয়ারপোর্টের অ্যারোপ্লেনগুলোকে এবং প্লেনের ওঠানামা দেখতে আমি পিতার সঙ্গে ১৯৫৯ সালে পাবনা থেকে ঢাকায় এসেছিলাম ২ দিনে। বৃষ্টিভেজা আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে। সে যে কি আনন্দ-গৌরব লিখে বোঝানো সম্ভব নয়। তবে মনে আছে ময়মনসিংহের গফরগাঁও নামক ইস্টিশনে পৌঁছানোর আগেই আমাদের ইন্টার ক্লাসের সকল দরজা জানালা তাড়াহুড়ো করে বন্ধ করে দেয়া হলো, পিতার নিকট থেকে জানতে চাইলাম, হঠাৎ এইভাবে জানালা-দরজা বন্ধ করা হলো কেন? পিতা আমার প্রশ্নের উত্তর দেবার আগেই পাশের যাত্রী জানালেন গফরগাঁও হচ্ছে চোর ডাকাতের জায়গা, জোর করে টাকা-পয়সা মেয়েদের গলার হার এমনকি যাত্রীদের বাচ্চা, পোটরা, চোখের নিমিষে নামিয়ে নিয়ে যায় সঙ্গে থাকে আরো জনাকয়েক। তাই ট্রেন গফরগাঁওয়ের ইস্টিশনে প্রবেশ করবার অনেক আগেই দরজা-জানালা বন্ধ করে না দিলে ওরা চুরি-ডাকাতি করবেই।
আমরা যাত্রীরা ভয়ভীতি কাটিয়ে শ্রীপুর, জয়দেবপুর, তেজগাঁও পাড়ি দিয়ে যখন ফুলবাড়িয়া স্টেশনে এলাম তখন বিকেলে ৩টা থেকে ৪টা হবে, সেদিনও বৃষ্টি হয়েছিল থেমে থেমে। আমাদের বড় ভগ্নিপতি থাকতেন কমলাপুরের চারদিকের গাছপালাবেষ্টিত একটি করস্টেটেড স্টিলের ৩টি ঘরসহ একটি বাড়িতে। বাড়িটি বেশ বড়, ভাড়া ছিল, বিদ্যুৎ পানিসহ ৪০ টাকা। তবে রাস্তা কিছুই ছিলো না, ছিলো সামান্য হেরিং বোনের পায়ে চলার পথ, ফুলবাড়িয়া ইস্টিশন থেকে পিতা আর আমি রিকশায় চেপে গুলিস্তান সিনেমা হলের পূর্ব দিকের তিন রাস্তার মোড়ে মীর জুমলার কামান হাতের ডানে রেখে, সেকালের বড় আইটি (ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট স্কাউট) ভবনের সামনে দিয়ে কিছুটা এগিয়ে মতিঝিলে রিকশায় ঢুকতেই দেখতে পেলাম সমগ্র মতিঝিল এলাকা ফাঁকা। একটি মাত্র ভবন দাঁড়িয়ে আছে সেটি রেডক্রস ভবন। আরো কিছুটা এগিয়ে সামনে যেতেই দেখি- একটি দোতলা, নাকি তিন তলা বাড়ি। নাম বোধহয় সালভিউ ভিলা, অনেক পরে জেনেছিলাম ওই বাড়িটির মালিক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবদুল জব্বার। জব্বার সাহেবের মূল বাড়ি পাবনা জেলার সুজানগরে। সেই বাড়ি বামে রেখে রিকশা যখন ডানদিকের ছোট একটি কালভার্টের কাছাকাছি পৌঁছালো তখন দেখি বিশাল একটি বিল, পানি আর পানি। লোক সমাগম নেই বললেই চলে। কোনো রকমে কাকভেজা হয়ে সেই বাড়িতে যাবার আগে একখানে লেখা দেখলাম কমলাপুর। সেই কমলাপুরের চারদিকে আম জাম কাঁঠাল, বিশাল একটি বটের গাছ। অনেকগুলো তাল গাছ দাঁড়িয়ে আছে মাঠের ভেতরে। অনেক গরু ভিজছে সেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে।
পিতার সঙ্গে সেই ১৯৫৯ সালে জীবনে প্রথম ঢাকায় আসায় আনন্দে আমাদের বাড়ির পুকুরে নিজের হাতে লাল রঙের শার্ট, ২টি ঈদের প্যান্ট, লুঙ্গি ও আমার জমানো ২ টাকা নিয়ে ঢাকায় আসবার আগে মনে মনে ঠিক করেছিলাম ওই টাকা দিয়ে খুব দামি আইসক্রিম খাব। কিন্তু সেই আইসক্রিম যে কোথায় পাওয়া যায় সে খবর জানা না থাকলেও জানা ছিল রমনা পার্ক নামে একটি পার্ক আছে, সেটি দেখতে হবে আর গুলিস্তান সিনেমা নামে একটি হল আছে সেটি দেখতে হবে। আর গুলিস্তান সিনেমা হলের সামনে নাকি ২টি কামান আছে, সেটিকে নেড়ে চেড়ে দেখতে হবে। ওই পরিকল্পনা করেছিলাম পাবনার বাড়িতে বসেই।
ঢাকার কমলাপুর সেদিন কম বৃষ্টি থাকায় পিতা এবং বড় আপাকে কিছু না জানিয়ে মতিঝিল এবং কমলাপুরের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে থাকা নটেরডেম কলেজ দেখে মানুষকে জিজ্ঞেস করে চলে গিয়েছিলাম গুলিস্তানের মীর জুমলার কামান দেখতে। কমলাপুরে ফেরার পথে পথ হারিয়ে কিছুটা এগিয়ে যেতেই দেখি আমাদের বড় ভগ্নিপতি প্রকৌশলী আবুল মুনছুর। তিনি আমার হাত ধরে তার বাসায় ফিরেই পিতার কাছে অভিযোগ করলেন রোকন তো আরেকটু হলেই চলে যেতো শাহজাহানপুরের দিকে। পিতা সাবধান করলেন ঢাকা শহরের সব ছেলে ধরাদের বাড়ি শাহজাহানপুরে। আর কোথাও একা একা যাসনে। তখন আমার বয়স বারো। ভগ্নিপতি চাকরি করতেন সেকালের ইডেন বিল্ডিংয়ে। রাতে খাবার খেতে খেতে আব্বা ভগ্নিপতিকে জানালেন তিনি কিছু জমি কিনতে চান কমলাপুর, শাহজাহানপুর, মালিবাগ, শান্তিবাগে। যে কোনো এক জায়গায় হলেই হয়। পিতা ভগ্নিপতিকে জিজ্ঞাসা করলেন সবচেয়ে কম দামের জমি কোনদিকে পাওয়া যাবে। ভগ্নিপতি জানালেন তার এক সহকর্মী আছেন কমলাপুর, শাহজাহানপুরের আদি লোক, তাকে জিজ্ঞেস করলেই জানা যাবে সস্তায় কোথায় পাওয়া যাবে বিঘে দুই তিনেক জমি।
দিন দুয়েক পরে ভগ্নিপতি জানালেন, আগামীকাল রোববার আমার সেই সহকর্মী এই বাড়িতে আসবেন, তিনি আমাদেরকে জমি দেখাতে নিয়ে যাবে কমলাপুরে। কমলাপুরের জমি যদি পছন্দ না হয় তাহলে শাহজাহানপুর, মালিবাগে, গুলিস্তানে। ভগ্নিপতির সেই সহকর্মীর সঙ্গে আমিও গেলাম কমলাপুর থেকে কিছুটা দক্ষিণের দিকে যেতেই চোখে পড়লো বেশ কয়েকটি ক্যানেস তারা টিনের এবং করগেটেড টিনের বাড়ি। বাড়িতে খড়ের পালা হাঁস-মুরগি, গরু ছাগল এবং লাঙলও দেখলাম কয়েকটি বাড়িতে। একটি বড় বাড়ির ভেতর থেকে একজন বয়সী লোক বেরিয়ে এসে সাদরেই বসালেন তার বৈঠকখানায়। তিনিই জমি বিক্রি করবেন, পিতা জানতে চাইলেন, জমিটা কোনদিকে। বিক্রেতা জানালেন শাহজাহানপুরের গোরস্থানের পূর্বের সব জমিই আমার। দরদাম মিল না হওয়ায় বিক্রেতা বললেন, আমার জমি বাসাবোতেও আছে, বিঘা ১০০০ টাকা। শেষ অবধি ঢাকা শহরের কোনো জমিই পিতা কিনলেন না। তবে কমলাপুর-বাসাবো এবং শাহজাহানপুর অঞ্চলে সত্যিকার অর্থেই বসবাসের অযোগ্য। লোকজন প্রায় নেই বললেই চলে। পিতা-ভগ্নিপতি আর তার সহকর্মীকে বললেন কলকাতার পার্ক সার্কাসের বাড়ি কিনেছিলেন এবং দম দম এয়ারপোর্টের ডোবা জলাশয় কেনা অনেক খানি সেই জমির দামের তুলনায় এই পচা ডোবা ঢাকা শহরের জমির দাম অনেক বেশি। আমার পার্ক সার্কাসের বাড়িটি বোধহয়- পিতার কণ্ঠস্বর জড়িয়ে এসেছিলো।
সেই ১৯৫৯ সালেই আমাদের অগ্রজ জিয়া হায়দার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন আর ভগ্নিপতি কমলাপুরের সেই ৪০ টাকার বাসা ছেড়ে দিয়ে সরকারি কোয়ার্টার আজিমপুরে গিয়ে উঠেছিলেন ১৯৬০ সালে। আর আমি এ সময়ই এসেছিলাম পাবনা থেকে ঢাকা ১৯৬২ সালে। আরমানিটোলা সরকারি স্কুলে ক্লাস সেভেনে ভর্তির জন্য পরীক্ষা দিয়ে পাস না করে ফিরে গিয়েছিলাম পাবনায়। আমার জিয়া ভাই, রশিদ ভাই ওনারা দু’জন থাকতেন বেচারাম দেউরার সম্ভবত ৬৮ নম্বর বাড়িতে। ভাড়া কত ছিলো জানি না। তবে জিয়া ভাই নারায়ণগঞ্জের তুলারাম কলেজে শিক্ষকতা করতেন আর রশিদ পড়ালেখা করতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে।
১৯৬৫ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েই চলে এসেছিলাম দুই অগ্রজের ভাড়া করা ১৪০ টাকার মালিবাগের ১৪/২ নম্বরের সেই ৪ রুম বিশিষ্ট করগেটেডেট টিনের বাড়িতে। মাধ্যমিকের ফলাফল পেয়েই ভর্তি হলাম জগন্নাথ কলেজে ১৯৬৫ সালের জুলাই মাসে। ক্লাসে পেয়ে গেলাম আজকের দিনের বিশিষ্ট ঔপন্যাসিক বুলবুল চৌধুরী, হরিপদ দত্ত, তরুণ গল্পকার দেলোয়ার মোরশেদ, অভিনয় কুমার দাশসহ নামিদামি শিক্ষকদের অজিতগুহ, শওকত আলী, শামসুজ্জামান খাসহ আরো অনেক শিক্ষককে। অধ্যক্ষ ছিলেন বিখ্যাত সাইদুর রহমান।
১৯৬৭ সালে স্নাতকে ভর্তি হয়ে বন্ধুর সংখ্যা বাড়লেও বাড়েনি বান্ধবীর সংখ্যা, শাঁখারিবাজারের গীতা সাধনা ওষুধালয়ের বারখালের এক ভেষজ চিকিৎসকের কন্যা, সবিতা, মীরা এবং বাবুবাজারের সহপাঠিনী, মনোয়ারা হক, দুর্ভাগ্য তাদের সঙ্গে কয়েক বছর একত্রে লেখাপড়া করেও মন খুলে কথা বলতে পারিনি। তবে সবিতা তার বিয়েতে আমাকে আর আমাদের ক্লাসের গাজী আজিজুর রহমান নামের এক ছেলেকে নিমন্ত্রণ জানিয়ে ছিলেন। যদিও গাজী আজিজের সঙ্গে তখনো আমার সখ্যতা গড়ে ওঠেনি।
মালিবাগের চৌমাথায় ছিল একটি বিশাল আম গাছ। সঙ্গে পুলিশদের একটি পেট্রোল পাম্প। ওই পাম্পের সামনে এসে দাঁড়াতো সরদঘাটে যাবার জন্য বাস। যাকে মুড়ির টিন বলতো সকলেই। একদিন কলেজে যাবার জন্য সেই বাসে উঠতেই দেখা হলো গাজী আজিজের সঙ্গে। বাসগুলো চলতো রমনা পার্কের পূর্বদিক হয়ে। সোজা প্রেসক্লাব, গুলিস্তান, সদরঘাট, ইসলামপুর, লালবাগ, বোর্ড মার্কেট হয়ে মোহাম্মদপুরের বাস স্টপেজ। প্রেসক্লাবের সামনে গেলেই ইডেন বিল্ডিংয়ে যারা চাকরি করতেন তারা নেমে যেতেই দুটি বসবার সিট পেয়ে গেলাম আমি আর আজিজ। কলেজে পৌঁছানোর আগেই দুজনে দুজনের খবরাখবর, বাড়ি, জেলা এবং বর্তমান অবস্থান জেনে নিলাম। মালিবাগের বাসার ঠিকানায় আসতে বললাম, আজিজ জানালো সে শাহজাহানপুরের একটি বাসায় বড় ভাইয়ের সঙ্গে থাকেন।
ইতোমধ্যে ১৯৬৭-৬৮ সালের শিক্ষাবর্ষকালীন জগন্নাথ কলেজ থেকে একটি ম্যাগাজিন বের হলো। ছাত্রছাত্রীদের গল্প-কবিতা ছাড়াও শিক্ষকদের লেখাও ছিলো। ম্যাগাজিনে সম্পাদনায় ছিলেন শিক্ষকরা আর সম্পাদক ছিলেন অভিনয় কুমার দাশ। আমার সহপাঠী বুলবুল, হরিপদ, দেলোয়ার এবং গাজীর লেখা গল্প এবং পদ্য ছাপা হয়েছিলো। একদিন আমরা কয়েক বন্ধু মিলে ঠিক করলাম একটি মাসিক পত্রিকা, দেয়াল পত্রিকা বের করা হবে। নামও ঠিক হলো ‘সবাক’ বেশ কয়েক সংখ্যা বেরুনোর পর বুলবুল চৌধুরী বিএ ক্লাসের ছাত্র থাকাকালীন ২১০ টাকা দামের একটি চাকরি পেয়ে গেলেন তৎকালীন ওয়াপদায়। চাকরিটি জুটিয়ে দিয়েছিলেন বুলবুলের পিতা। তিনি ছিলেন ওয়াপদার ঊর্ধ্বতন নির্বাহী।
এক সন্ধ্যায় আজিজদের শাহজাহানপুরের বাসায় গিয়ে দেখি ও ভীষণ খুশি। একটি মেয়ের একটি চিঠি আমাকে দেখিয়ে বললো, লেখাপড়া করে, থাকে সাতক্ষীরায়। প্রায় নিয়মিত আমরা তিনজন সেকালের জগন্নাথ কলেজের ‘অবকাশ’ ক্যান্টিনে বসে এমনকি মাঝে মাঝে প্যারীদাস রোডের বিউটি বোর্ডিংয়ে গিয়ে আড্ডা দিতে গিয়ে সেকালের বিখ্যাত কবিদের প্রথম দেখতে পেয়েছিলাম শহীদ কাদরী, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক-সহ একজন চিত্রশিল্পী। জনা দুয়েক ছায়াছবির লেখকও আসতেন ওই বিউটি বোর্ডিংয়ে। সম্ভবত অভিনেতা গোলাম মুস্তফা এবং সুভাষ দত্তকেই প্রথম দেখি একদিন দুপুরে হরিপদ দত্ত, জীবন বড়াল, অভিনয় কুমার দাশ, জয়দেবপুরের আমাদের সহপাঠী অচিন্ত ঘোষালও যেতো মাঝে মধ্যে আমাদের সঙ্গে। লক্ষ্য সকলেই কবি, কথাশিল্পী, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক হবো। আজ থেকে ৫০ বছর আগের দিনলিপি আমাদের অতীত নিয়ে। তবে বুলবুল চৌধুরী বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ ছোট গল্পকার এবং হরিপদ দত্ত ঔপন্যাসিক, দুজনেই বাংলা একাডেমির পুরস্কারপ্রাপ্ত। অপর দিকে প্রাবন্ধিক হিসেবে উভয় বাংলা থেকে গাজী আজিজুর রহমান ইতোমধ্যে একাধিক পুরস্কার গ্রহণ করেছেন। একাধারে পেশায় অধ্যাপনা, সমালোচক, দেশি-বিদেশিদের শিল্প নিয়ে একাধিক লেখা পুস্তকারে প্রকাশিত হয়েছে। সর্বশেষ যে বইটি এ বছর (২০১৭) প্রকাশিত হয়েছে সেটি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য পাঠকদের জন্য ‘স্বদেশ ভাবনা ও বঙ্গবন্ধু’। বুলবুল, হরিপদ, গাজী, দেলোয়ার এখনো বেঁচে আছে আমাদের ৫০ বছরের আর্তি নিয়ে। তবে হরিপদ বছর কয়েক আগে পশ্চিমবঙ্গে পাড়ি দিলেও যোগাযোগ এখনো অক্ষুণœ আছে। শুধু যোগাযোগ অক্ষুন্ন নেই দেলোয়ারের সঙ্গে। অধ্যাপনা ছেড়ে দিয়ে ভ্রষ্ট রাজনীতিতে যুক্ত হয়েই হারিয়েছে শিল্প সাহিত্যের অঙ্গন। আসছে ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭ সাল, গাজীর হবে ৭০ বছর, আর আমার হবে ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭ সালে ওই ৭০ বছরই। হয়তো বা বুলবুলের, হরিপদের, দেলোয়ারের তাই হবে।
সাতক্ষীরার কালিগঞ্জে বেশ অনেকবার গাজীর বাড়িতে গিয়েছি, নিরিবিলি, শান্তশিষ্ট নিভৃত একটি গ্রাম। যদিও ওর জন্ম হয়েছিলো দার্জিলিংয়ে ১৯৪৭ সালের ২৯ সেপ্টেম্বও, জন্মের দিনটি কি বার ছিলো ওর মনে নেই, আমারও মনে নেই, শুধু মনে আছে আমাদের সখ্যতা বিগত ৫০ বছরের।
লেখক : কবি ও কলাম লেখক

গাজী আজিজুর রহমান সুজনেষু : হোসেন উদ্দীন হোসেন
অধ্যাপক গাজী আজিজুর রহমানের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় অনেক আগে। সম্ভবত নয় দশকের মাঝামাঝি। তখন ঢাকায় গেলেই ‘শৈলী’ পত্রিকার অফিসে গিয়ে সময় কাটাতাম। শৈলী সম্পাদক কায়সুল হকের টেবিল ঘিরেই ছিল আমাদের সাহিত্যের আড্ডা। এখানে অনেকেই এসে বসতেন। রাজধানী ছাড়াও মফঃস্বলের অনেককেই এখানে আসতে দেখেছি। এই শৈলী অফিসেই একদিন পরিচয় হলো গাজী আজিজুর রহমানের সঙ্গে। তিনিও আমার মতো মফঃস্বলের লেখক। এর আগেও তার লেখা আমি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় পাঠ করেছি। একজন মননশীল প্রাবন্ধিক হিসেবেই সবার নিকট পরিচিত হয়ে ওঠেন। তিনি শুধু মননশীল প্রাবন্ধিক নয়- সৃজনশীল সাহিত্যিকও। তার বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ পাঠ করে আমি মুগ্ধ হই।
একবার দৈনিক জনতা পত্রিকার কার্যালয়ে গিয়ে সাহিত্য সম্পাদক মফিজ ইমাম মিলনের টেবিলে আজিজুর রহমানের একটি প্রবন্ধ গ্রন্থ দেখলাম। গ্রন্থটি রচিত হয়েছে পৃথিবীর সেই সব স্মরণীয় ও বরণীয় রাষ্ট্রনায়কদের নিয়ে- যাঁরা সাহিত্যকর্মে বিশেষ অবদান রেখেছেন। এই গ্রন্থটি নিয়ে জনতার সাহিত্য পাতায় মনোজ্ঞ আলোচনা করা হয়। আলোচনা করেন কবি মাহবুব হাসান। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, গাজী আজিজুর রহমানের সঙ্গে তার পরিচয় আছে কিনা। মাহবুব হাসান বললেন, ‘এই বইটি দিতে একবার তিনি এই অফিসে এসেছিলেন, কিন্তু আমি না থাকায় তার সঙ্গে দেখা হয়নি। গ্রন্থটি প্রকাশ করা হয়েছে মফঃস্বল থেকে, মনে হয় সাতক্ষীরা জেলার কোনো এক মফঃস্বল কলেজে তিনি অধ্যাপনা করেন।’
সুদূর মফস্বলে অবস্থান করে গাজী সাহিত্য সাধনা করে বিদগ্ধজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন শুধু তাই নয়- নিজের সাহিত্যিক অবস্থানও তৈরি করে নিয়েছেন, এটাও তার জন্য একটা গৌরবের বিষয়।
‘শৈলী’ অফিসে এই ব্যক্তির সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন কুয়াত-ইল-ইসলাম। কুয়াত-ইল ইসলাম ছিলেন ‘শৈলী’ পত্রিকার সহ-সম্পাদক। তিনি গাজী আজিজুর রহমানকে বললেন, আপনি হোসেন উদ্দীন হোসেনকে চেনেন?
গাজী আজিজুর রহমান আমাকে দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন।
বললেন, বহুদিন থেকে খুঁজছি, এবার দেখা পেলাম।
এক মফস্বলের সাহিত্যিক আর এক মফঃস্বলের সাহিত্যিককে সাদর সম্ভাষণ জানালো।
গাজী আজিজুর রহমান বললেন, আমি কালিগঞ্জে সাহিত্য সম্মেলন করব, আপনাকে বিশেষভাবে আমন্ত্রণ জানাবো।
আমি যশোর জেলার লোক। গাজী আজিজুর রহমান হলেন আমার প্রতিবেশী জেলা সাতক্ষীরা জেলার লোক। গাজী আজিজুর রহমানের বসত দক্ষিণ অঞ্চলে, আমার অবস্থান হলো দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে। একদা আমরা একই জেলার অধিবাসী ছিলাম। আমার ‘যশোর’ জেলার নামকরণ হয় প্রতাপাদিত্যের রাজ্য ‘যশোর’র নামানুসারে। ১৭৮১ সালে কোম্পানি সরকার রাজস্ব আদায় এবং প্রশাসনের স্বার্থে প্রথম জেলা হিসেবে ঘোষণা দেন- ‘যশোহর’ জেলা সৃষ্টি করে। এই ‘যশোহর’ স্থানটি গাজী আজিজুর রহমানের উপজেলার পার্শ্ববর্তী উপজেলা শ্যামনগরের মধ্যে অবস্থিত। একেবারে সুন্দরবন ও বঙ্গোপসাগরের উপকূলে। অর্থাৎ আমরা দুজনেই আদি যশোরের বাসিন্দা। একই মাটি ও একই নদ-নদী বিধৌত অঞ্চলের লোক। ভাষার উচ্চারণ বৈশিষ্ট্য প্রায় একই রকম- তবে কোথাও কোথাও সামান্য পার্থক্য আছে।
‘শৈলী’ অফিসেই আমাদের দুজনের আত্মিক পরিচয় ঘটলো। তিনি আড্ডাপ্রিয় মানুষ। শুধু তাই নয়- অনবরত কথা বলায় পারদর্শী। আমি তার উল্টো। কান পেতে শোনা ছাড়া বিশেষ কথা বলিনে। এটা হচ্ছে আমার স্বভাব। প্রয়োজন ছাড়া মুখ খুলিনে। তিনি একটার পর একটা কথা বলতে লাগলেন। যারা উপস্থিত ছিলেন তারাও আড্ডাবাজ মানুষ। সমানতালে আড্ডা চলতে লাগলো।
আমি লক্ষ্য করলাম, গাজী আজিজুর রহমান অধ্যাপনা করেন বটে- কিন্তু তার মধ্যে পা-িত্যসুলভ আচরণ নেই। একেবারে মনখোলা মানুষ। চেহারাতেও পা-িত্যের ছাপ নেই। সাদাসিধে সরল বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। তবে একটু চঞ্চল প্রকৃতির। এটাই তার স্বভাবধর্ম। গাজীর সঙ্গে আলাপ করে মনটা বেশ প্রফুল্ল হয়ে উঠলো।
১৯৯৯ সাল। ডাকযোগে একটা আমন্ত্রণপত্র পেলাম। পাঠিয়েছেন গাজী আজিজুর রহমান কালিগঞ্জ থেকে। সেখানে সাহিত্য সম্মেলন। সেই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করার জন্য তিনি আমাকে বিশেষভাবে অনুরোধ জানিয়েছেন। পশ্চিম বাংলা থেকে আসবেন কবি কৃষ্ণধর, কবি কানাই সেন, কবি অমিতাভ চক্রবর্তীসহ আরো অনেকে।
পত্রটি পাঠ করে দারুণ খুশি হলাম। দক্ষিণ অঞ্চলের মতো একটা থানা শহরে সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করা একটা দুঃসাধ্য ব্যাপার। যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই যে ভালো- তা নয়। দক্ষিণ অঞ্চল মানে অবহেলিত অঞ্চল। আমার পার্শ্ববর্তী জেলা হলেও এই অঞ্চল সম্পর্কে আমার ধারণা ছিল যে, অর্থনৈতিক দিক থেকে অঞ্চলটা এখনো পশ্চাদবর্তী রয়েছে। ১৯৫০ সালে এই অঞ্চলে একবার দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। দলে দলে দরিদ্রশ্রেণীর লোক অভাবের তাড়নায় ভিটেমাটি ছেড়ে যশোরের মাটিতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। এটা তো আমি নিজের চোখেই দেখেছি। এখনো সেই লোকগুলো আমাদের অঞ্চলে অবস্থান করছে। সেহেতু ধারণাটা আমার মনে বদ্ধমূল হয়ে আছে।
চিঠিটা পাবার পর আমার গ্রামের এক যুবক রিজু এসে বললো, কাকা, কালিগঞ্জে আমি বিয়ে করেছি। ওখানে সাহিত্য সম্মেলন হচ্ছে। আমার ভাইরাভাইও একজন সংস্কৃতিমনা লোক। গাজী সাহেবের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক। তিনি আমার ওপর দায়িত্ব দিয়েছেন যে, সম্মেলনের একদিন আগে আপনাকে কালিগঞ্জে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আপনি নিশ্চিত থাকুন। আমিই আপনাকে নিয়ে যাব। তার কথা শুনে আশ্বস্ত হলাম। বললাম, ঠিক আছে। দুজনে এক সঙ্গে যাব। রিজুকে আমি ভালো করে চিনি। ওর বাবা একজন নামকরা মৎস্য ব্যবসায়ী। বাজারে পশ্চিম পার্শ্বে কপোতাক্ষ নদের গা ঘেঁষে ওদের বাড়ি।
নির্দিষ্ট দিনে আমি ওর সঙ্গে কালিগঞ্জের পথে রওয়ানা হলাম। প্রায় বিকেলের দিকে কালিগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে নামলাম। রিজু বললো, গাজী সাহেব কলেজে অবস্থান করছেন। আমরা দুজনে হেঁটে কলেজের দিকে রওয়ানা হলাম।
আমি এর আগে দু’বার কালিগঞ্জে এসেছি। কাঁকশিয়ালী নদীর ওপর তখন কোনো ব্রিজ ছিলো না। পারাপারের জন্য নৌকা ছিল। এবার দেখলাম দৃশ্যপট একেবারে বদলে গেছে। এপার থেকে ওপারে ব্রিজ পার হয়ে গেলাম। ফাঁকা জায়গাগুলোতে এখন দোকানঘর উঠেছে। লোকজনের কর্মব্যস্ততা বেড়েছে। কালিগঞ্জ থেকে মুন্সীগঞ্জ পর্যন্ত প্রশস্ত রাস্তা। নিয়মিত বাস চলাচল করছে। সেই ১৯৫০ সালের দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চলটি নতুন সাজে ঐশ্বর্যম-িত হয়ে উঠেছে। মুক্তিযুদ্ধের পর পরই ঘটেছে এর আশ্চর্য রকম পরিবর্তন। চারদিকে সুরম্য অট্টালিকা, দোকান-পাট। আমরা দুজনে হাঁটতে হাঁটতে কলেজের সীমানায় প্রবেশ করলাম। একজন বললেন, অধ্যক্ষ মহোদয়ের কক্ষে যান, সেখানে সকলেই আছেন। সেখানে গিয়ে দেখলাম, গাজীসহ আরো অনেকেই বসে আছেন।
গাজী আজিজুর রহমান আমার হাত টেনে ধরে বসতে বললেন। অন্যদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। এই কক্ষে বসেই পরিচিত হলাম অধ্যাপক ড. কানাই সেন এবং অধ্যাপক ড. অমিতাভ চক্রবর্তীর সঙ্গে। কলকাতা থেকে মাত্র এসেছেন ওরা দু’জন।
রিজু আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল।
সন্ধ্যার দিকে গাজী আজিজুর রহমান কানাই সেন, অমিতাভ চক্রবর্তী ও আমাকে নিয়ে আমাদের যেখানে রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা করা হয়েছে, সেদিকে নিয়ে চললেন। কলেজের সীমানা ছাড়িয়ে আমরা নদীর পাশ দিয়ে হাঁটতে লাগলাম। এবার ব্রিজের দিকে নয়। কিছু দূর হেঁটে এসে নদীর একটা ঘাটে এসে দাঁড়ালাম।
গাজী বললেন, নদীর ওপারে ওয়াপদার বাংলো। ওখানে আপনাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
একটা নৌকায় উঠে নদী পার হলাম আমরা। বাংলোটা বেশ পুরোনো। আইয়ুবের আমলের তৈরি। নির্জন। কোথাও কোনো লোকজনের সাড়া নেই। একজন কি দু’জন প্রহরী আছে মাত্র। ড. কানাই সেন এবং ড. অমিতাভ চক্রবর্তীর জন্য একটা কক্ষ। আমি আমার কক্ষে একাকী। পরিধানের কাপড় বদলে লুঙ্গি আর একটা হাফশার্ট গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়লাম। গাজী ওদের দুজনকে নিয়ে আড্ডায় মেতে উঠলেন।
চলতে লাগলো তর্কবিতর্ক। হাসি উল্লাস। আমি আমার শয্যায় শুয়ে ওদের গলার শব্দ শুনছি।
কিছুক্ষণ পরে গাজী আমাকে ওদের ঘরের মধ্যে নিয়ে গেলেন। শুরু হলো সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতি সম্পর্কে আলোচনা। রাত দুপুর অবধি চললো আড্ডা। তারপর গাজী তার ডেরায় চলে গেলেন। রাতটা বেশ ভালোই কেটে গেল। পরের দিন সকাল ১০টায় প্রথম অধিবেশন। স্থান উপজেলা পরিষদের হল। প্রধান অতিথি সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক সাইফুল আলম। তিনি আগেই এসে উপস্থিত হয়েছেন। সময় সম্পর্কে দারুণ সচেতন। তার সঙ্গে গাজী আজিজুর রহমান আমাদের পরিচয় করে দিলেন। তিনি আন্তরিকতার সঙ্গে উষ্ণ করমর্দন করলেন।
দেখতে দেখতে উপজেলা মিলনায়তনটি জনসমাগমে পরিপূর্ণ হয়ে উঠলো। প্রথম অধিবেশনটি শুরু হলো। উদ্বোধন করলেন জেলা প্রশাসক। সভাপতিত্ব করলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। গাজী আজিজুর রহমান সঞ্চালনা করলেন। কালিগঞ্জসহ সাতক্ষীরার সাহিত্যশিল্প ও সংস্কৃতির বিষয় নিয়ে অনেকেই আলোকপাত করলেন। দুপুর পর্যন্ত চললো এই প্রথম অধিবেশন। তারপর বিরতি ও মধ্যাহ্নভোজন।
অতিথিদের জন্য ভোজনের আয়োজন করেছিলেন উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা অনিন্দ্য আনিস। তিনিও একজন কবি। তার বাসায় গিয়ে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে ভোজন পর্ব শেষ করলাম। কত রকমের খাদ্য সম্ভার! নানা রকমের মাছ। সবজি, মাংস, মিষ্টি মিঠাই। জেলা প্রশাসক রসিকতা করে প্রশংসা করলেন। আমরা হো হো করে হাসলাম। মানসিক আনন্দে দুপুরটা অতিবাহিত হয়ে গেল। বিকাল বেলা শুরু হলো দ্বিতীয় অধিবেশন। কালিগঞ্জের লোক যে এত সংস্কৃতিপ্রিয় তা এই অধিবেশনে প্রমাণ পেলাম। মিলনায়তনে ঠাঁসাঠাঁসি লোক। বাইরেও প্রচুর লোক সমাগম। খবর পেলাম, সীমান্তের ওপার থেকেও চোরাই পথে প্রচুর দর্শক এসেছে। অনেকেই তারা মঞ্চে এসে বক্তৃতা দিলেন। এই অধিবেশনটা মনে হলো বাঙালির মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। সীমান্তের এপার ওপার একাকার হয়ে গেছে। ঠিক যেন বন্যার জলের মতো অবস্থা। বাঙালি আবেগপ্রবণ জাতি। ভাষা তার একমাত্র শিকড়। এই প্রাণচেতনা উপলব্ধি করে রবিঠাকুরের কথা মনে হলো। তিনি বাঙালিত্বের উপলব্ধি প্রকাশ করেছিলেন এইভাবে–
‘বাঙালি আপন প্রাণ দিয়ে একটি প্রাণবান সাহিত্যকে গড়ে তুলেছে! সেখানে বাঙলার শুধু ভৌগোলিক অধিকার সেখানে সে মানচিত্রের সীমা পরিধিকে ছাড়াতে পারেনা। সেখানে তার দেশ বিধাতার সৃষ্ট দেশ; সম্পূর্ণতার স্বদেশ নয়। কিন্তু ভাষা বসুন্ধরাকে আশ্রয় করে যে মানসদেশে তার চিন্তা বিরাজ করে সেই দেশ তার ভূ’সীমানার দ্বারা বাধাগ্রস্ত নয়, সেই দেশ তার স্বজাতির সৃষ্টদেশ। আজ বাঙালি সেই দেশটিকে নদী প্রান্তর পর্বত অতিক্রম করে সুদূর প্রসারিতরূপে দেখতে পাচ্ছে, তাই বাঙলার সীমার মধ্যে থেকে বাঙলার সীমার বাহির পর্যন্ত তার আনন্দ বিস্তীর্ণ হচ্ছে। খ- দেশকালের বাহিরে সে আপন চিত্তের অধিকারকে উপলব্ধি করছে।’
তিনি আরও বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে সৌভাগ্যক্রমে আমাদের একটা মিলনের ক্ষেত্র আছে! সে আমাদের ভাষা ও সাহিত্য। এইখানে আমাদের আদান প্রদানে জাতিভেদের কোনো ভাবনা নেই। সাহিত্য যদি সাম্প্রদায়িকতা ও জাতিভেদ থাকিত তবে গ্রিক সাহিত্য গ্রিকদেবতার লীলার কথা পড়িতে গেলেও আমাদের ধর্মহানি হইতে পারিত।… একদা নিষ্ঠাবান হিন্দুরাও মুসলমান আমলে আরবি ফারসি ভাষায় প-িত ছিলেন। তাহাতে তাঁহাদের ফোঁটা ক্ষীণ বা টিকি খাটো হইয়া যায় নাই। সাহিত্যপুরীর জগন্নাথ ক্ষেত্রের মতো, সেখানকার ভোজে কাহারও জাতি নষ্ট হয় না।’
কালিগঞ্জের এই সাহিত্য সম্মেলনে এসে রবীন্দ্রনাথের এই বাণীর সত্য উপলব্ধি করলাম। বাংলা ১৩৩৩ সালের বৈশাখ মাসে এই রকমই একটা সাহিত্য সম্মেলনে রবীন্দ্রনাথ উপরিউক্ত বক্তব্য ব্যক্ত করেছিলেন।
কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে এপারের এই সাহিত্য সম্মিলনে ওপার থেকে যারা মনের টানে এসেছিলেন তাদেরকে এপারের বাঙালিরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে হাততালি দিয়ে শুধু নয়- জয়ধ্বনি দিয়ে স্বাগতম জানিয়ে প্রাণের ঔদার্য প্রকাশ করে। এই সম্মিলনের মধ্যে আমি খুঁজে পেয়েছিলাম বাঙালির বাঙালিত্ব ও সাহিত্য সংস্কৃতির অকৃত্রিম প্রাণচেতনা।
গাজী আজিজুর রহমান সুদূর মফঃস্বলে বাস করে এরকম একটি প্রাণচেতনাময় বাঙালির সম্মিলনের স্বার্থক আয়োজন করেছিলেন, এটাই ছিল আমার কাছে একটা বিস্ময়। সেই থেকে তার সঙ্গে আমার একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। দু’জনের মত ও পথ প্রায় অভিন্ন। দু’জনেই একই পথের অভিযাত্রী। কিন্তু প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে তিনি যেমন সাহিত্য সৃষ্টি করেন না- তেমনি আমারও কোনো লোভ লালসা নেই। কর্মই হচ্ছে গাজী আজিজুর রহমানের দর্শন। এই দর্শনই তাকে কালের পাতায় জীবন্ত করে রাখবে- এই বিশ্বাস আমার আছে।
গাজী আজিজুর রহমানের সাহিত্য রচনায় সৃজনশীলতা ও মননশীলতার যে পরিচয় আমরা উপলব্ধি করি- এটাই হচ্ছে তার মুখ্য অবদান এবং এটাই হচ্ছে তার বড় প্রাপ্তি। এর মধ্যেই তার অমরত্ব- যা কালের পাতায় চিরকাল অক্ষয় হয়ে থাকবে।
গাজী আজিজুর রহমান সত্তর বছর বয়সেও এখনো কর্মে সচল এবং সাহিত্য নিবেদিতপ্রাণ। কামনা করি, তার কর্মধারা আরো প্রাণবন্ত ও সৃষ্টিমুখর হোক।
লেখক : কথাসাহিত্যিক

সুন্দরবন মানুষ : আবদুস সামাদ ফারুক
ইছামতি নদীর কলধ্বনি, কাঁকশিয়ালীর কুলু কুলু ধ্বনি, ভাড়াশিমলার সবুজ প্রকৃতি, খোলপেটুয়া নদীর উদ্দাম হাওয়া, খান বাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) এর জন্মভূমি নলতার মায়াবী নিসর্গে আর সুন্দরবনের বিশুদ্ধ হাওয়ায় বেড়ে ওঠেন একজন মানুষ। এখন তিনি ৭০ বছরের চিরসবুজ প্রাণ। যিনি আত্মনিবেদিত সাহিত্য চর্চায়, সুস্থ সংস্কৃতি গড়ে তোলার কাজে। দেশের নৈঋত কোণের নান্দনিক অনুভবের জনপদ সাতক্ষীরার কালীগঞ্জে তাঁর জীবনধারণ ও জীবনচারণ। কাফলগঞ্জের মতো মফস্বল জনপদের বেসরকারি ডিগ্রি কলেজের অধ্যাপক। এই মানুষটি গাজী আজিজুর রহমান। কবিতা দিয়েই যাত্রা শুরু তবে তাঁর সাফল্য গদ্যে। আর সে গদ্য হচ্ছে কাব্যময়।
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক হিসেবে কাজ করার সুবাধে গাজী আজিজুর রহমানের সাথে আমার পরিচয় ও আত্মিক যোগাযোগ। তাঁর যে কোনো লেখা আমি যখন পড়ি তখন আমাকে অন্তত দুই তিনবার পড়তে হয়। ভাষার মাধুর্য, বিষয়বস্তুর বিশ্লেষণে গভীরতা এবং বিশ্ব সাহিত্যের প্রাসঙ্গিকতা তার লেখায় এক ধরনের যাদুময় আকর্ষণ সৃষ্টি করে। তার গদ্য পাঠ মানে আমার কাছে কবিতা পাঠের স্বাদ। এতো চমৎকার শব্দশৈলীর মোহনীয় আবাহন কম গদ্য লেখকদের মাঝেই দেখা যায়। তাকে গদ্যের কবি হিসেবে বলতে আমি ভালোবাসি।
সাতক্ষীরা থাকতে বহু সাহিত্য সভায় আমরা দুই বাংলার কবি সাহিত্যিকদের নিয়ে এসেছি। ওপার বাংলার কবি কানাই সেন, অমিতাভ চক্রবর্তী, সাধন চন্দ্র ঘোষ, নৃপেন চক্রবর্তী, অভিজিৎ বিশ্বাস, গোপাল বিশ্বাস, স্বপ্না গাঙ্গুলী, শেফালী ঘোষ বার বার সাতক্ষীরায় এসেছেন। ঢাকা থেকে তাঁর কবিবন্ধু মাকিদ হায়দার, সাযযাদ কাদির বারবার এসেছেন সাতক্ষীরায়। অসাধারণ উদ্ধাত্ত উন্মুক্ত সময় আমরা অতিক্রম করেছি কপোতাক্ষ, বেত্রাবতী, লাবণ্যবতীর জনপদে।
বাংলা সাহিত্যের প্রখ্যাত কবি ও সমকাল সাহিত্য আন্দোলনের প্রবক্তা সিকান্দার আবু জাফর স্মরণে তাঁর আবাসভূমি সাতক্ষীরার তালার তেতুলিয়া গ্রামে “সিকান্দার উৎসব” শুরু করি ২০১১ সালে। এই উৎসবে সিকান্দার আবু জাফর সাহিত্য পদক দেয়ার জন্য সিলেক্ট কমিটির সভা করি। সভায় প্রথমবারের মতো এই পদক দেয়ার জন্য গাজী আজিজুর রহমানকে বাছাই করা হয়। আমার ঢাকা কলেজ জীবনের শিক্ষক অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারকে আমন্ত্রণ জানাই সাতক্ষীরায় আসার জন্য। তিনি অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে পদক প্রদান করেন এবং চমৎকার স্মৃতিচারণ করেন।
সাতক্ষীরা কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরি ভিজিট করে দেখতে পেলাম কয়েকজন পত্রিকা পড়ার পাঠক লাইব্রেরিতে। প্রতি দুই মাস অন্তর অন্তর একটি সাহিত্যসভা করার নির্দেশনা দেই। সাতক্ষীরার প্রয়াত সাহিত্যিক খান বাহাদুর আহছ্ানউল্লাহ (র.), মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, আনিস সিদ্দিকী, আবদুল ওহাব সিদ্দিকী, তবিবুর রহমান- তাঁদেরকে নিয়ে আমরা সাহিত্য সভা শুরু করলাম। ৪-৫ ঘণ্টা ধরে এই সভা চলে। প্রবন্ধ-উপস্থাপন, তার উপর আলোচনা-সমালোচনা এবং প্রত্যেক সাহিত্য ব্যক্তির উপর স্মরণিকা প্রকাশ এই কাজগুলি জোরেসোরে শুরু করলাম। তাঁদের পরিবারের সদস্যদেরকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে এবং ক্রেস্ট বা উপহার দেয়া হয়েছে। উৎসাহী দর্শক স্রোতার সংখ্যাও বাড়তে লাগল। প্রয়াতদের পর জীবিতদের সাহিত্য র্কীতি নিয়ে সভা চললো। যাথাক্রমে অধ্যাপক কাজী মুহাম্মদ ওলিউল্লাহ, আ. শ. ম. বাবর আলী, মোহাম্মদ আবদুল মজিদ, কাজী রোজী এবং এক পর্যায়ে গাজী আজিজুর রহমানকেও আমরা সংবর্ধনা দিলাম। তার সৃষ্টিশীল কাজ নিয়ে তারই জন্মভূমির মাটিতে সাহিত্য সভা হলো। চমৎকার নিবন্ধ পাঠ করলেন অধ্যাপক নিমাই ম-ল। কবি পল্টু বাসার, সালেহা আকতার আরো বিদগ্ধজন প্রাণবন্ত আলোচনা করলেন।
কলকাতা থেকে সাধন চন্দ্র ঘোষ সম্পাদিত “আত্মপ্রকাশ” সাহিত্য পত্রিকায় গাজী আজিজুর রহমানের একটি নিবন্ধ বেরুলো। শিরোনাম ‘আমার দেখা বাংলাদেশের দুর্গাপূজা’। কী চমৎকার ভাষার যাদুমন্ত্রে শরৎকালের বর্ণনার সাথে দেবী দুর্গাকে নিয়ে যে আবেগ উচ্ছ্বাস তা প্রকাশিত হয়েছে। ভাষা ও ছন্দের সুরে শরৎঋতু ও দেবী দুর্গার চিরন্তন রূপ যেন প্রভা ছড়াচ্ছে। আমি দুবার অন্তত পড়লাম। দুধের সরের স্বাদ দিয়ে নিবন্ধটির শরীর অনির্বচনীয় শব্দের খাস বুনানোতে ঠাসা। আমি পত্রিকা নিয়ে অফিসে গেলাম। প্রতিদিন সকাল নয়টায় আমার সকল সহকর্মী আমার রুমে আসেন। দিনের কাজ ও কর্মসূচি আমি বলে দেই। অগ্রাধিকার কোনটি, কি করণীয় সহকর্মীদের জানাই। তারপর চা খেয়ে সহকর্মীরা যার যার কক্ষে ফিরে যান। তবে ওই দিন আমার নির্ধারিত আলোচনার পূর্বে এই নিবন্ধটি পাঠ করার জন্য আমাদের কনিষ্ঠতম সহকর্মী সাদিয়া আফরিনকে অনুরোধ করি। সদ্য চাকরিতে ঢুকেছে। পাঠ করতে গিয়ে আনেক জায়গায় ও খেই হারিয়ে ফেলে। আবারো পাঠ করে। সবাই শুনলেন। আমি জিঞ্জাসা করলাম, তোমাদের কেমন লাগলো। উত্তর, ‘স্যার, এতো সুললিত ভাষা, সুর তাল লয়ের মূর্ছনায় লেখা, যেন এক নিমিষেই শেষ হয়ে গেল’। এ হচ্ছেন সুন্দরবন মানুষ গাজী আজিজুর রহমান, সুন্দরবনের মতো রূপবৈচিত্রে ভরা, নৈঃশব্দ্য সংগীতে স্রোতে ভাসা।
লেখক : কবি, ভারপ্রাপ্ত সচিব, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়

গাজী আজিজ ও বন্ধু আমার : আরেফিন বাদল
আজিজ আমার বন্ধু। গাজী আজিজুর রহমান আমার সহপাঠী। কবি গাজী আজিজুর রহমান এক সময়ে আমার প্রিয় কবি। কোথায় হারিয়ে গেলো আমার সেই প্রিয় কবি! ষাট দশকের শেষ প্রান্ত থেকে স্বাধীনতাউত্তর ক’টি বছর বেশ দাপটের সঙ্গেই ও কাব্যচর্চা করে যাচ্ছিল। আর, আমি ছিলাম তার একজন অনুরাগী পাঠক, যদিও আমার কাজের ক্ষেত্র ছিলো ‘কথা সাহিত্য’। আজকে জাতীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত ওর সমসাময়িক অনেক কবির থেকেই আজিজ ভালো লিখতো। ওর কবিতা পড়লে অন্তত একটা মেসেজ পাওয়া যেতো। সেই সব দিনগুলোতে বেশ কিছু ছোটগল্পও লিখেছিল আজিজ। এসব এখন অতীত। এখন ওর মুখ্য পরিচয় গবেষক, প্রবন্ধকার গাজী আজিজুর রহমান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এমএ পাস করার পর আমরা যারা সাহিত্য নিয়ে নাড়াচাড়া করতাম, তাদের অধিকাংশই ঢাকাতেই রুটি-রুজির ব্যবস্থা করে, এখানেই থিতু হলাম। মূল লক্ষ্য ছিল সাহিত্য নিয়ে কাজ করার সুযোগ হাতছাড়া না করা। পত্র-পত্রিকা-প্রকাশনা সবই তখনি রাজধানীকেন্দ্রিক। আজিজ পাস করার পর পরই ওর এলাকা সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ কলেজে শিক্ষকতার চাকরি পেয়ে যায়। ওর বাড়িও সুন্দরবনঘেঁষা কালীগঞ্জেই। পরবর্তী জীবনটা কাটিয়ে দিলো কালীগঞ্জ কলেজে অধ্যাপনা করেই। বিভাগীয় প্রধান হিসেবে অবসর নিয়েছে- তাও তো বেশ কয়েক বছর হলো। তারপরও এখনো আমরা সত্তরে পা রাখা তরুণ। এই বয়সেও মনে-প্রাণে তারুণ্যের ঘাটতি নেই কোনো আমাদের মাঝে।
সহপাঠী অন্তরঙ্গ বন্ধু থেকে ক্রমশ আমরা একান্ত পারিবারিক স্বজনও হতে পেরেছি। আজ থেকে ষোল কি সতের বছর আগে আমার অসুস্থ স্ত্রী ও পুত্রসহ সপরিবারে এক কোরবানির ঈদ করেছি ওর কালীগঞ্জের বাড়িতে। ছিলাম প্রায় সপ্তাহ খানেক। বেড়িয়েছি সুন্দরবনসহ আশপাশের ভারত সীমান্তঘেঁষা নানা ঐতিহাসিক ও নান্দনিক জায়গায়। সঙ্গে গাড়ি নিয়ে গিয়েছিলাম বলে দেদার ঘুরেছি, চুটিয়ে আড্ডা মেরেছি সব কিছু ভুলে। ওখানেও দেখেছি, সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি কী গভীর আকর্ষণ ওর মধ্যে। তরুণ-যুবা সাহিত্য-কর্মীদের নিয়ে গড়ে তুলেছে নানা সাংগঠনিক কর্মকা-। নিয়মিত সাহিত্যের আসর জমে ওঠে ওর নেতৃত্বে। কালীগঞ্জে একটি প্রিন্টিং প্রেসও স্থাপন করেছিল আজিজ। ঢাকা থেকে একটি প্রিন্টিং মেশিন কেনায় আমিও সহযোগিতা করেছিলাম। এই প্রেস থেকে সময়ে সময়ে ও প্রকাশ করতো, বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন ও বই। এই রকম একজন সাহিত্য পাগল মানুষের কবিসত্তার বিসর্জন সত্যি অবাকই বটে! তাই বলে, ওর গবেষণাকর্ম, প্রবন্ধ-নিবন্ধ চর্চাকে আমি তাচ্ছিল্য করছি বললে একদম বোকামি হবে। বরং এসব কর্মধারায় আজিজের পা-িত্য আমাকে মুগ্ধ করে তোলে। ওর প্রকাশিত প্রতিটি বই-ই আমাকে পাঠানো হয়। আমি পড়ি। ওর সর্বশেষ গ্রন্থ গত একুশে ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত- ‘স্বদেশ ভাবনা ও বঙ্গবন্ধু’ বইটির প্রথম দুটো অধ্যায়- ‘বঙ্গভঙ্গ : শতবর্ষের স্মরণাঞ্জলি’ এবং ‘বাংলা কবিতায় দেশপ্রেম ও জাতীয় সংহতি : ১৯০৫-১৯৩০’ আমি গভীর মনোযোগের সঙ্গে পড়েছি। দ্বিতীয়টি তো আমি দুবার পড়েছি। আর- এগুলো কী আমাদের আজিজেরই লেখা! কী অসাধারণ পা-িত্য, বিশ্ব সাহিত্য থেকে যেসব উপমা-উদাহরণ ওর দ্বিতীয় লেখায় ব্যবহার করেছে- তাতে লেখাপড়ার কতো গভীরেই না ওকে বিচরণ করতে হয়েছে। তারপরও আমার কথা, এসবের সঙ্গে কাব্যচর্চাটাও যদি আজিজ ধরে রাখতো বাংলা সাহিত্য লাভবান হতো নিশ্চিত। এখানে ওর লেখা একটি কবিতা থেকে ক’টি লাইন উল্লেখের লোভ সামলাতে পারলাম না- “…সেই সমস্ত দিনের একদিনে বিদ্রোহ জন্ম নিলো শরীরে। যেদিন পুলিশি জুলুমে যখন হয়ে ফিরলেন বড়দা’/তখন থেকেই এই পথের সঙ্গে হলো পরিচয়।/বাংলার একটা মানচিত্র রেখেছি বুকের কাছে। ইতিহাসের পথ ধরে গিয়েছি অনেক অনেক দূরে…”। কিংবা “…রাগ হলে ভালোবাসা দাঁত দিয়ে ছিঁড়ি এবং ইশ্বর/মাকেও আজকাল মাঝে মাঝে মনে হয় অন্য রকম/ঘরে ফেরার কথা মনে হলে যন্ত্রণা ফুলে ফেঁপে ওঠে…”। ‘শৈশবের পাঠশালা’ নামের এই কবিতাটি ছাপা হয়েছিলো- ‘সূর্যতপা’ নামে একুশের একটি স্মরণিকায়। ম্যাগাজিনটি প্রকাশ হয়েছিল পাকিস্তান তথা পূর্ব পাকিস্তানের সর্বশেষ একুশে ফেব্রুয়ারি (১৯৭১ খ্রি.) উপলক্ষে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে। বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ছিলেন এটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক। আর স্মরণিকাটির সম্পাদক হিসেবে আমার নাম ছাপা হলেও সম্পাদনা পরিষদের এক নম্বর সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল আজিজই। মুদ্রণ ও প্রকাশনার কাজে ফলপ্রসূ ভূমিকা পালন করেছিল আমাদেরই আরেক সহপাঠী বন্ধু গায়িকা শবনম মুশতারী। শবনম মুশতারীর নাম উল্লেখ করে আমি ওর বয়স বাড়িয়ে দিলাম নাকি! আসলে, আমাদের ক্লাসের ভেতর ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের নিয়ে আলাদা একটা গ্রুপ সৃষ্টি হয়েছিল- সেখানে দল-মতের বালাই ছিলো না; ছিলো শুধু মনের মিল। শবনম মুশতারীকে আমরা ‘রাকা’ বলেই ডাকতাম। রাকা হলো ওর ডাকনাম। কবি তালিম হোসেন ও দৈনিক বাংলার মহিলা পাতার সম্পাদক কথা সাহিত্যিক মাফরুহা চৌধুরীর বড় সন্তান ছিল রাকা। স্মরণিকাটির প্রচ্ছদ আঁকারও একটা ইতিহাস আছে। দেশে তখন স্বাধীকার আন্দোলনের উন্মাতাল অবস্থা। আমরাও কোনো না কোনোভাবে জড়িত। অতোটা সময় আমাদের হাতে ছিলো না। আমি ‘দিগদর্শন’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। এটির জন্য বেশ ক’সংখ্যার কভার আজিমপুরে থাকতো একটি ছেলে তখন ক্লাস নাইনে পড়ে। কিন্তু আঁকা-আঁকিতে চমৎকার হাত। নাম মেহেদী হাসান, আমার পরিচিত। তাকে দিয়ে কভারগুলো আঁকিয়েছিলাম। আমরা সবাই মিলে এগুলোর ভেতর থেকে একটি পছন্দ করি। শুধু ‘সূর্যতপা’ লেখাটির ডিজাইন দেয়- আমাদের আরেক সহপাঠী সত্যব্রত চৌধুরী। দু’জনের নামই প্রচ্ছদ ডিজাইনার হিসেবে ছাপা হয়। পরবর্তী সময়ে মেহেদী হাসান বিসিএস ক্যাডারে সহকারী চাকরিতে যোগ দেয় এবং ইতোমধ্যে সরকারের ‘সচিব’ হিসেবে অবসরও গ্রহণ করেছে। মেহেদী হাসান চাকরিরত অবস্থায় আমার দু’টি গ্রন্থের- ‘বাছাই গল্প’ (ছোট গল্প) এবং ‘ঐ আসে আমিরালী’ (উপন্যাস)-এর প্রচ্ছদও এঁকে দেয়।
আজিজের মাধ্যমেই আমার প্রথম পরিচয় হয়েছে কবি মাকিদ হায়দার ও কবি আবুল হাসানের (মরহুম) সঙ্গে। পরবর্তীতে অবশ্য আমাদের বন্ধুত্ব ‘তুই’-এ এসে ঠেকে। মাকিদের সঙ্গে ব্যতিক্রম ছাড়া প্রতিবছরই অন্তত একবার এখনো দেখা হয়, আড্ডা হয়- সে বাংলা একাডেমির বার্ষিক সাধারণসভা উপলক্ষে ডিসেম্বরে। আজিজের সঙ্গে আমার যোগাযোগ সেই সুদূর সুন্দরবন উপলকূলে কমপক্ষে চার-পাঁচ বার। একুশের বইমেলা, বাংলা একাডেমির বার্ষিক সাধারণ সভা ছাড়াও বিভিন্ন কাজে ওর ঢাকায় আসা-যাওয়া। ঢাকায় এলে প্রথম দিকে আমার বাসায়ই উঠতো- থাকতো। এখন ওর ছেলেরা লেখাপড়া শেষে চাকরিসূত্রে সপরিবারে ঢাকায় থাকার কারণে আমার বাসায় আর ওর থাকা হয় না। কিন্তু দেখা করে যায় ঠিকই। আজিজের ঢাকায় নিজস্ব একটি বাড়িও রয়েছে- সবগুলো ছেলে ঢাকায় থাকে, তবুও কালীগঞ্জের মায়া ও কাটিয়ে উঠতে পারেনি এখনো। স্ত্রীকে নিয়ে একাই পড়ে আছে ওখানে। ওর স্ত্রী অত্যন্ত ভালো মানুষ। আমার সঙ্গে সখ্যতাও প্রচুর। দু’জনেই পান খেতে পছন্দ করি আমরা। আমার অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে যখন কালীগঞ্জে আজিজের বাসায় গিয়েছিলাম, তখন ওর স্ত্রীও কিছুটা অসুস্থ ছিল। তারপরও আমার স্ত্রীর সিরিয়াস অসুখের কথা ভেবে এক মুহূর্তের জন্যও চোখের আড়াল করেনি। যখন সুন্দরবন দেখতে আমরা ভেতরে যাত্রা শুরু করি, তখন আজিজ-গিন্নিও আমাদের সঙ্গে অসুস্থ শরীর নিয়েই রওনা দেয়- শুধু আমার গিন্নির শারীরিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে।
প্রসঙ্গক্রমে কবি আবুল হাসানের কথা মনে পড়ে গেলো। শরীফ মিয়ার ক্যান্টিনে আমরা বন্ধুরা একত্রে চা খেলে বিল দেয়ার সময় ওর কাছ থেকে কখনো পয়সা আদায় করা সম্ভব হতো না। কেমন রসিকতার স্বরে- ‘বিষ খাওয়ার একটা পয়সা নেই, আবার চায়ের বিল’ বলেই কেটে পড়তো। সর্বশেষ হাসানের সঙ্গে আমার দেখা ও কথা বলা, হাসানের মৃত্যুর অল্প কিছুদিন আগে। আমি তখন থাকতাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেলে’র ১৩৪ নম্বর কক্ষে। উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আমার হলে (মুহসীন হল) পাকিস্তানি বাহিনী ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। অনেকগুলোর সঙ্গে আমার রুমটিও ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। স্বাধীনতার পর এসে কোথায় থাকবো- এটা বিরাট এক সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো। আপাতত ধানমন্ডিতে প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁর ‘দক্ষিণ হাওয়া’তে উঠলেও তা স্থায়ী কোনো সমাধান নয়। তখন ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেলে মুক্তিযুদ্ধের কারণে নিরাপত্তার অভাবে বিদেশি ছাত্র খুবই কমে গিয়েছিল। অনেক রুম খালি পড়ে ছিল। আমরা ক্ষতিগ্রস্ত একদল ছাত্র মিলে তৎকালীন ভিসি অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী (‘ম্যাক স্যার’ নামে খ্যাত)-এর কাছে গেলাম, আমাদের হল মেরামত না হওয়া পর্যন্ত ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেলে থাকার অনুমতির দরখাস্ত নিয়ে। উনি সানন্দে সম্মতি দিয়ে হোস্টেলের ওয়ার্ডেন ড. জিয়াউদ্দিন বরাবরে এক নির্দেশনা পাঠালেন। আমাদের বেশ ক’জনের ঠিকানা জুটে গেলো। হ্যাঁ- যা বলছিলাম, কবি আবুল হাসান এক রাতে, গভীর রাতে- বারোটা/একটা হবে, এসে হাজির আমার হোস্টেল কক্ষে। আমি ঘুম ভাঙা চোখে দরজা খুলে দেই- হাসানকে দেখে অবাক বনে যাই। কেমন উস্কো-খুস্কো মনে হচ্ছিল ওকে। ভেতরে ঢুকে চেয়ারে বসে, হাতল দুটোতে হাত রেখে দু’পা আমার বিছানার ওপর তুলে দিল। একটু আয়েসী ভঙ্গিতে একটা হাই তুলে বললো, ‘ভাইজান, আপনার রুমে আসলে মনটা কেমন ভইরা যায়- তাই চইলা আইলাম।’ এরপর প্রসঙ্গহীন কিছু এলোমেলো আলাপচারিতা হয় আমাদের মাঝে। অনেকক্ষণ। তারপর হঠাৎ সটাং করে ওঠে দাঁড়িয়ে বলে ওঠে, ‘চলিরে দোস্ত’- বলেই ঘট-ঘট করে বেরিয়ে গেল আমার রুম থেকে। এর কিছুদিন পরেই ওর অকাল মৃত্যু সংবাদ।
আজিজের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব সেই ষাট দশকের শেষ প্রান্ত থেকে অদ্যাবধি একই রকম একইভাবে চলমান নদীর মতোই এবং তা প্রজন্মান্তরে অর্থাৎ আজিজের তিন ছেলে, আর আমার দুই ছেলের মাঝেও একইভাবে প্রবাহমান। আমাদের দু’বন্ধুরই কোনো মেয়ে সন্তান নেই।
সর্বশেষ আজিজ ওর স্ত্রীসহ ঢাকায় এসেছিল সমগ্র পরিবার মিলে গত ঈদুল ফিতর উদযাপন করতে। ঈদের পরের দিন স্ত্রী, পুত্র, পুত্রবধূদের সঙ্গে দুই নাতনিসমেত (এখনও আজিজ নাতি পায়নি) আমার বাসায় বেড়াতে আসে। দুপুরের খাওয়ার পর্ব সেরে অলস আড্ডায় আমরা মেতে উঠি। এক পর্যায়ে আমি আজিজকে বললাম, তুই আবার কবিতা লেখা শুরু কর। ওর উত্তর, মফস্বলে থেকে কবি হওয়া যায় না। আমি বলি, অন্তত আগের পুরনো কবিতাগুলো একত্র করে একটা বই বের কর। প্রকাশক না পেলে আমিই না হয় প্রকাশনার দায়িত্ব নেবো। আমার প্রিয় কবি গাজী আজিজুর রহমান রহস্যজনক মৃদু হেসে অন্য প্রসঙ্গে চলে যায়।
এখানে, ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ আয়োজিত পিকনিকে ‘বাস’ থেকে মালামাল নামাতে আমাদের দু’বন্ধুর ছবি এবং ৭০-এ পা’ রেখে কয়েক যুগ পরে গত ঈদের পরের দিন (২৭.০৬.২০১৭) আমার বাসায় ওর বড় ছেলে বাংলা একাডেমির সহকারী পরিচালক ইমরুল ইউসুফের তোলা ছবিতে কী মনে হয় আমাদের বন্ধুত্বে এই বয়সেও কোনো ঘাটতি রয়েছে? বয়স হয়েছে আমাদের, কে আগে মরি ভবিষ্যতই জানে। যে বেঁচে থাকি, সে যেনো ভালো থাকি বা থাকে- এই কামনা এখনই আমার। কারণ, মৃত মানুষের সঙ্গে জীবিত মানুষের কোনোই কমিউনিকেশন নেই।
লেখক : উপন্যাসিক, প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক তারকালোক, কিশোর তারকালোক

আমার আত্মার আত্মীয়, ভালো লাগা ও ভালোবাসার মানুষ : নৃপেন চক্রবর্তী
ক্যালেন্ডারের পৃষ্ঠায় সঠিক দিনক্ষণের হিসেবটা আর মনের মণিকোঠায় বন্দি নেই। তবে যা প্রায় দু’দশকের বেশি সময় ধরে স্মৃতিসুন্দরে স্বচ্ছ হয়ে রয়েছে তা হলো আমার অন্যতম বন্ধু, আত্মার আত্মীয়, ভালো লাগা ও ভালোবাসার মানুষ আজিজুরের অফুরান ভালোবাসার ছোঁয়া। তবে বন্ধুর চাইতেও আমি ওকে আমার পিঠোপিঠি ভাই বলেই মনে করি।
কোনো এক রাতে আবছা আলো-অন্ধকারে কালীগঞ্জের নলতার (বাংলাদেশ) এক বারান্দায় দাঁড়িয়ে কয়েক মুহূর্তের আলাপ যে এইভাবে দু’দশকের বেশি সময় ধরে প্রগাঢ় ভালোবাসার সুদৃঢ় বন্ধনে আটকে রাখবে সে কথা প্রথম পরিচয়েই সামান্য হলেও কিছুটা আভাস পেয়েছিলাম। তখন তো শুধু প্রীতি বিনিময়ের দু’একটা হালকা কথাবার্তা হয়েছিল। তবে ওই হালকা কথার মধ্যেই কিভাবে যেন এক ভালো লাগা মনের মধ্যে অজান্তেই বীজ বপন করে দিয়েছিলো। ওটাই ছিলো মাহেন্দ্রক্ষণ। এইভাবেই দিন থেকে মাস, মাস থেকে বছর, আর বছর পেরিয়ে এই দুই যুগের বৃত্তবন্ধনে আমরা দু’জন। না, আমরা দু’জন বলাটা বোধ হয় এখন আর মানায় না বরং বলা ভালো আমরা দুটি পরিবার। একদিকে আমি ও আমার স্ত্রীপুত্র আর অন্যদিকে আজিজুর আর তার স্ত্রী, পুত্রসমেত গোটা পরিবার।
আমাদের দু’দেশের মাঝখানে কাঁটাতারের বেড়া। কিন্তু তাতে কী? সে বেড়া আমাদের প্রীতির সম্পর্ককে কখনোই দূরে সরিয়ে রাখতে পারেনি। কয়েকদিন কথা না হলেই মনে হয় যেন কতদিন কথা হয়নি। বুকের মধ্যে কেমন যেন এক শূন্যতা অনুভব করি, আর তখনই আঙুল চলে যায় মোবাইলের বোতামে। শুরু হয় কথার বিনিময়। মনের বিনিময়, ভালো লাগা ও ভালোবাসার বিনিময়। এ বিনিময় এখন শুধু আজিজুরের সঙ্গেই সীমাবদ্ধ নয়। এ বিনিময় এখন তার ছেলেদের সঙ্গেও হয়ে চলে।
আমি আজিজুরকে ভীষণ কাছের থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। মিলেছি আন্তরিকভাবে। লেখা পড়েছি ওর। লেখার অনুরাগী পাঠকও হয়ে উঠেছে। যতদিন গেছে ততই সে আমার কাছে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও মনের মানুষ হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ থেকে যখনই কোনো কারণে আমাকে ফোন করেছে তখনই আমি সেই ব্যাপারে এগিয়ে ওর সঙ্গে সহযোগিতা করার চেষ্টা করেছি। সে লেখালেখি হোক বা পারিবারিক কোনো ব্যাপারে হোক। আসলে ওর কণ্ঠস্বর শুনলেই আমি খুঁজে পাই এক সহৃদয়, বন্ধুবৎসল আর অকপট হাসি মাখানো অন্য এক মানুষ। যার বুকের গভীরে রয়েছ অনন্ত ফল্গুধারা। আমি দু’দশক ধরে একটু একটু করে এই প্রবাহমান ফল্গুধারায় স্নাত হয়েছি। আসলে তার সঙ্গে আমার এই সম্পর্কের গভীরতা কাব্যভাষা বা গদ্যভাষা দিয়ে জরিপ করতে পারবো না। সম্ভবও নয়, কেননা এ ভালোবাসা ও বন্ধুত্ব শুধুমাত্র অনুভবে উপলব্ধি করার বিষয়।
পেশায় একজন অধ্যাপক। বাংলা সাহিত্যের। সকলের কাছে অত্যন্ত প্রিয়। ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে তো বটেই, বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়জনের কাছেও সে সকলের মনের মানুষ হিসেবেই পরিচিত। আমি যতবার আমন্ত্রিত হয়ে কালীগঞ্জে তার শ্যামল ছায়ায় ঘেরা বাড়িতে গিয়েছি ততবারই পেয়েছি অফুরান ভালোবাসা ও আতিথেয়তা। বর্ডার থেকে কখনো কখনো পৌঁছাতে দেরি হয়ে গিয়েছে। গিয়ে দেখেছি সে কিন্তু বসে আছে ঠায়। আমাদের পৌঁছানোর পর সে এক সঙ্গে খেয়েছে। আপ্যায়নের কখনো কোনো ত্রুটি হয়নি। বাড়িতে হয়তো ওর স্ত্রী নেই। এমনো হয়েছে বাড়ির সকলেই ঢাকায় চলে গিয়েছে, কিন্তু তাতে কী? রান্না-বান্নার সমস্ত ব্যবস্থা করে আজিজুর আমাদের নিখুঁতভাবে খাইয়েছে। আসলে ওর রক্তে রয়েছে নিখাদ বন্ধুপ্রীতি। আর সেই কারণেই আমি যখন যাদের নিয়েই কালীগঞ্জে গিয়েছি তখন তাদের সকলকেই একান্ত কাছের করে নিতে সামান্যতমও দেরি হয়নি তার।
এ বছর (২০১৭) সেপ্টেম্বর মাসেই আজিজুর সত্তর পূর্তি করতে চলেছে। ওর ছেলেদের কাছ থেকে এই খবরটা পেয়ে আমারও একবার নিজের বয়সের দিকে ফিরে তাকাতেই দেখলাম আমিও তো সেই সংখ্যাটা কিছুদিন পরেই ছুঁয়ে ফেলবো। ভাবতে গিয়ে যে একটু কষ্ট হয়নি তা নয়। বুকের ভেতরে এক মুহূর্তে ফেলে আসা অতীতের স্মৃতিগুলো জ্বলে উঠেছিলো। ভাবতে ভাবতে কিছুটা আনমনাও হয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো- এটাই তো জীবন। মনে পড়লো বিখ্যাত সেই পঙ্ক্তি ‘ঞরসব ধহফ ঃরফব ধিরঃ ভড়ৎ হড়হব’. সময় বড় শৃঙ্খলপরায়ণ। সে থেমে থাকার কথা জানে না। সে এগিয়ে যায়। চরৈবেতী তার মন্ত্র! অতীত চলে যায়, ভীড় করে কঠোর কঠিন বাস্তব। আমাদের ভবিষ্যত।
আমরা যারা লেখালেখি করি, বিশেষ করে যারা কবিতা জগতের সঙ্গে যুক্ত তারা বোধহয় একটু বেশি পরিমাণেই কল্পনাপ্রবণ হই। কিন্তু আজিজুর প্রাবন্ধিক। কঠোর গদ্যের সঙ্গে তার নৈমিত্তিক বোঝাপড়া। কঠিনেরে ভালোবেসেই সে কঠিনের বারান্দায় শব্দের শরীর নির্মাণ করে। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি ওর লেখালেখি নিয়ে আমার বরাবরই মনে হয়েছে মূলত প্রবন্ধ লিখলেও ওর হাতেরও লেখার মুন্সিয়ানায় যে কোনো কঠিন বিষয়ও স্বচ্ছ জলের মতো হয়ে ওঠে। অসাধারণ গদ্য লেখে সে। অসাধারণ পা-িত্যও। ওপর থেকে বোঝা যায় না কিন্তু লেখার মধ্যে প্রবেশ করলে তা পরিপূর্ণভাবে টের পাওয়া যায়। একটা নিজস্ব গদ্যের স্টাইল আজিজুর ইতোমধ্যেই তৈরি করতে পেরেছে যা একান্তই ওর নিজের তৈরি। বাংলাদেশে এবং আমাদের পশ্চিমবঙ্গে অনেকেই প্রবন্ধ লেখেন। আমি কাউকেই ছোট করছি না। কিন্তু এই মুহূর্তে বাংলাদেশে যারা বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক হিসেবে অত্যন্ত সুপরিচিত তাদের মধ্যে অবশ্যই আজিজুর রহমানকে প্রথম সারিতে রাখতেই হয়। এমন কোনো বিষয় ভাবনা নেই যে, যা নিয়ে সে প্রবন্ধ লেখেনি। সে মৃত্যুভাবনাই হোক, আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে হোক, কিংবা রবীন্দ্র, নজরুল, সুকান্ত বা মানিক, বুদ্ধদেব হয়ে সাম্প্রতিককালের শক্তি, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় পর্যন্ত সকলেই। ওর লেখায় সমস্ত বিষয়ই হয়ে ওঠে অসাধারণ। একটা স্বতন্ত্র রচনাভঙ্গি ও শৈলী দিয়ে যখন সে লেখা শুরু করে তখন তা সুন্দর বিশেষণের সহজ সরল ব্যবহারের মধ্য দিয়ে একটা সাবলীল গতি নিয়ে এগিয়ে চলে। পাঠককে প্রথম থেকেই আকর্ষণ করে নেবার শক্তি আছে ওর মধ্যে। যে কোনো বিমূর্ত বিষয়কে মূর্ত করে নেবার এই দক্ষতা সকলের মধ্যে থাকে না। যাদের থাকে তারাই সত্যিকারের প্রাবন্ধিক হয়ে উঠতে পারে। আমি মনে করি বন্ধু আজিজুরের মধ্যে সেই ক্ষমতা রয়েছে। আর রয়েছে বলেই তার লেখা এক অন্য মাত্রা পায়।
ইতোমধ্যেই সে প্রায় কুড়িটির মতো বই লিখে ফেলেছে। বাংলাদেশের বাংলা একাডেমি থেকেও তার গবেষণামূলক বই বেরিয়েছে। এ ছাড়াও আরো অনেক নামিদামি প্রকাশন সংস্থা থেকেও বেরিয়েছে ওর নানা বিষয়ের ওপরে প্রবন্ধের বই। আমি অনেকগুলোই পড়েছি। পড়ে সমৃদ্ধ হয়েছি। আমি আশা রাখবো এবং যারপরনাই খুশিও হবো যদি বাংলাদেশের বাংলা একাডেমি তাকে সম্মানিত করে।
তাকে নিয়ে আরো অনেক কথাই অন্যভাবে বলার ইচ্ছে রইল। সময় ও সুযোগে অন্য জায়গায় অবশ্যই লিখবো।
সত্তর বছর পূর্তির প্রাক্কালে প্রার্থনা রইলো বন্ধু আজিজুর, তুমি লেখো। তোমার ক্ষুরধার লেখনীর ছোঁয়ায় বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্য নতুন দিগন্ত খুঁজে পাক। আর আমরা তোমার বন্ধু ও গুণমুগ্ধ পাঠকেরা সেই নতুন দিগন্তের খোলা হাওয়ায় দাঁড়িয়ে প্রতিক্ষণে তোমার ভাব ও ভাবনা, মন ও মনন, ভালো লাগা ও ভালোবাসার ছায়ায় থেকে আরো অনেকদিন ধরে গল্প, কবিতা ও আলোচনার স্বচ্ছ সরোবরে অবগাহন করে পরম প্রশান্তি অনুভব করি।
লেখক : কবি, কলকাতা

গাজী আজিজুর রহমানের লেখার চালিকাশক্তি : ড. জাহাঙ্গীর হাবীবউল্লাহ
মানুষ অমৃতের সন্তান, অমৃত পিয়াসী, দেবত্ব অভিলাষী। সে ধ্যানে জ্ঞানে বুদ্ধসত্ত্ব লাভ করতে চায়। হতে চায় অজেয়, অমর, ঈশ্বরিত। মানুষের এই মৃত্যুঞ্জয় বাসনাই সকল সংকটের মূলধারা। ব্যক্তির বিকাশ ঘটাতে গিয়েই ব্যক্তি হয় কুঞ্চিত। ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যে উজ্জীবিত হতে গিয়ে হয়ে পড়ে পরিপার্শ্বচ্যুত। আর ব্যক্তিত্বে বিশ্বজনীনতায় উদ্ভাসিত হতে গিয়ে হয়ে যায় বিশ্ববিচ্যুত। স্বর্গে সুখ নেই, আবার মর্ত্যওে শান্তি নেই। অতএব ত্রিশঙ্কু ঝুলে থাকা সিসিফাস যাতনা ভোগ করাই হয়ে দাঁড়ায় মানুষের কাছে নিয়তি। মোটকথা অস্তিত্বের সংকটই মানুষের জীবনযাপন প্রক্রিয়ার প্রধান সমস্যা। কবি জীবনানন্দ দাশ যাকে বলেছেন, ‘পৃথিবী বাঁধা এই দেহের ব্যাঘাতে’, ‘এই দেহ অপসারণের মধ্যেই কি তাহলে কি মুক্তি? ফলে স্বভাবতই এসে যায় জীবনের অসারতা, ঊষরতা আর নেতিবাচকতা। এই বোধ ও হৃদয় ক্ষত থেকেই ক্ষয় বৈকল্য এবং পরিশেষে মৃত্যু কামনায় উৎক্রান্ত হতে চান এলিয়ট। দি ওয়েস্টল্যান্ডে যার ভয়াবহ চিত্র ও মনশ্চেতনা আমরা বিস্ময় বিমূঢ় হয়ে অবলোকন করি’।
স্বেচ্ছামৃত্যুর করতলে কবি, শক্তিমান গদ্যশিল্পী, প্রবন্ধ লেখক ও গবেষক গাজী আজিজুর রহমানের প্রকাশিত (প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬, প্রথম পুনর্মুদ্রণ ২০১৫) গ্রন্থটিতে উপরোক্ত বক্তব্য সমৃদ্ধ বাক্যসমূহ ছাড়াও আরো অনেক বুদ্ধিদীপ্ত বিষয়ভিত্তিক কথামালা রয়েছে। ওই কথামালা শিল্পসম্মত গ্রন্থটির নাম, ‘স্বেচ্ছামৃত্যুর করতলে কবি।’ পুস্তকটি বাংলা সাহিত্য নতুন এক সংযোজন। ফলে ভিন্ন আর এক মাত্রা এদেশের সাহিত্য শিল্পে সন্নিবেশিত হলো।
আত্মহত্যা করে জীবনের জ্বালা-যন্ত্রণা যে সকল কবি জুড়াতে চেয়েছেন তাদের নিয়ে এ গ্রন্থ। সারা বিশ্বের যেসকল কবি আত্মহত্যা করেছেন তাদের কথাই বৃত্তাবদ্ধ মননশীল ভাষায় সাহিত্য রসে সিক্ত করে লেখক পাঠকবৃন্দের করকমলে উপস্থাপন করেছেন।
মানুষ কিন্তু মরতে চায় না। তবু অনেকে আত্মহত্যা করে। মৃত্যু যতো মহৎ বা শ্যামময় হোক না কেন। শত সংকটে, সংহরণে সন্তাপে, মস্বন্তরে, জরামারী মড়কেও তিনি বলেন, ‘মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে’ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) বলেন, ‘এ দু্যুলোক মধুময়, মধুময় পৃথিবীর ধূলি’, ‘এই নান্দনিক ধী ও ব্যাকুল আকুতি, ইতার্থ যখন মুহূর্তে বৈরী বাতাসে গিলোটিনের নিচে মাথা রেখে উচ্চারণ করে জীবন যাহারে বলে মরণ তাহারি নাম তখন কবি রবীন্দ্রনাথ সীমাহীন আত্ম ষ্টেই সে কথা বলেন। মানুষ এক নিষ্ঠুর আত্মপীড়নী।
নিজেকে দহনে পীড়নে-পেষণে প্রতিহিংসায় তার আনন্দ ও উদ্ধার। নইলে সাধ করে কে চায় এই নারকী যাতনা আত্মবলিদান, কে চায় আলোর বিলাস ছেড়ে কৃষ্ণ অভিসার?
তাই বলে ওসব অবস্থা ও জীবন কোনো চূড়ান্ত সমাধান নয়। মানুষের ইতিহাস দর্শন এক জায়গায় থেমে থাকবার নয়। বারবার শেষ থেকে সে শুরু করেছে। তাই, রিচার্ড বার্টনে পাই-‘আত্মহত্যা করলেই কি আত্মহত্যার কারণ থেকে অব্যাহতি পাওয়া যাবে? আসলে তা নয়। নেতি থেকে ইতি, ধ্বংস থেকে সৃষ্টি, বিলুপ্ত থেকে জাগরণ, পতন থেকে উত্থান, পরাজয় থেকে জয়ে পরাপ্রাপ্তির আশায় যে নিরাশাকে ভাসিয়ে দিয়ে আশায় বুক বেঁধেছে। হিতবাদী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইতার্থকভাবে বলেন, ‘তবু আশা জেগে রয় প্রাণের কন্দরে’। আর বিষ্ণু দে বলেন, ‘স্বপ্নে মুক্তির জাগা নবজন্ম’, এসব বাঁচার প্রয়াসের প্রকাশ। এমন কি সমাজবাদী বিপ্লবী লেলিন বস্তুবাসিত মানুষ হয়েও স্বপ্নের প্রয়োজনীয়তা মানতো।
তবু একথা সত্য মানুষ দেখছে তার ক্ষমতা অপেক্ষা অক্ষমতার পাল্লাই ভারী। নইলে- ‘ডব ঃড়ঁপয মড়ষফ ধহফ রঃ ঃঁৎহং রহঃড় ষবধফ, হড়ঃ ষবধফ রহঃড় মড়ষফ.’ মানুষ ইষ্ট অপেক্ষা অনিষ্ট, সৃষ্টি অপেক্ষা ধ্বংস, পূণ্য অপেক্ষা পাপেই পারঙ্গম বেশি। সত্য ও সুন্দরের পূজার যে যাতনা নিবেদিত, মিথ্যা ও অসুন্দরের আরাধনায় সে ততো বিনীত। জোনাথন সুইফট তাই দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘পরস্পরকে ঘৃণা করার ধর্ম আমাদের অনেক আছে, কিন্তু পরস্পরকে ভালোবাসার ধর্ম যথেষ্ট নেই’। এই বোধ কবিদের মাঝেই ঘুরপাক খায় প্রতিনিয়ত। গ্রিক ভাষায় কবি শব্দের অর্থ স্রষ্টা। ফরাসিরা বলে সুন্দরী অসতী। ভারতবর্ষে এক সময় জ্ঞানী মাত্রকেই কবি বলা হতো। এ যুগে কবি হচ্ছেন ‘সত্যদ্রষ্টা’। আর কবিতা ‘সশস্ত্র ও স্বাধীন’। কবিরা এখন আর শুধু অনুকারক নয়, ‘কবিরা কালের সাক্ষী, কালো শিক্ষক’। কবি এখন সমাজের চক্ষু-কর্ণ এবং হৃদয়। কবি এখন যোদ্ধা, বজ্র-বিষ, প্রীতি-ভালোবাসা, কবি এখন মানুষ। কবিতা এখন বাঁচবার ও বাঁচাবার হাতিয়ার, ‘অহিংস ঘাতক’।
আর ওই কবিতার রচয়িতা কবি বড় অভিমানী। তাই কবি হন কুঞ্চিত, কুণ্ঠিত, কল্পিত, মানুষের জ্বালা যন্ত্রণা দেখে সন্তাপ অনুভব করে হয় আবেগী কুরঙ্গ। আসলে কবি মাত্রেই আবেগের অনার্য দেবতা। তার থাকে এক বুনো বন্যতা, বন্য স্বপ্নের বল্লভা। কণ্ঠলগ্না কবি আকণ্ঠ পান করেন আত্মবল্লভা সুরা। হোক সে সুরা জীবন বা মৃত্যুর, প্রশ্ন নয়, উপদেশ, আদেশ নয় যেন স্রষ্টার জীবনার্থ স্রষ্টাই জানে। সে কারো নিয়ন্ত্রিত নয়, সে নিজেই নিজের নিয়ামক বা নিয়ন্তা। নিজের নিয়ামক বা নিয়ন্তা বলে কি কবি আত্মহত্যার মধ্যে জীবন অর্থের সমাধান পায়? আত্মহত্যাই কি চূড়ান্ত মুক্তির সোপান? কারণ সে যেমনই হোক না কেন, যত কষ্টে বা দুঃখের অথবা যতই মুক্তির সূর্যের, মীমাংসা কি হয় জীবন মৃত্যুর?
উপরোক্ত বিভিন্ন বক্তব্যে দেখা গেছে আত্মহত্যা বিরোধী একটা মনোভাব খুব সূক্ষ্মভাবে তুলে ধরা হয়েছে। বিশ্বে এ পর্যন্ত যে সকল কবি জীবনযন্ত্রণা জুড়াতে আত্মহননকারী উৎস যজ্ঞে আত্মহুতি দিয়েছেন তাদের বিভিন্ন অনুভূতি এই গবেষণা গ্রন্থে তুলে ধরা হয়েছে। তবে খুবই মোহগ্রস্ত করার মতো ভাষা অনেক দুর্বল চিত্তের আবেগপ্রবণ কবিকে বিব্রতকর অবস্থার সম্মুখীন করতে পারে। এখানে একটা কথা উল্লেখ্য, গাজী আজিজুর রহমান একজন সমাজবাদী ধ্যান-ধারণার মানুষ। তাই সে পরিম-ল থেকে সেই দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি এই গ্রন্থ রচনা করেছেন। এখানে বেশির ভাগ পশ্চিমা দ্বন্দ্ববাদে বিশ্বাসীদের অঃঃরঃঁফব প্রকাশ পেয়েছে। অথচ পৃথিবীর বৃহৎ একটি জনগোষ্ঠীর একজন হয়েও গাজী আজিজুর রহমান মুসলিম ধ্যান-ধারণার তেমন কোনো বক্তব্য এ গ্রন্থে তুলে ধরেনি কেন তা আমার বোধগম্য নয়। নিজের অবচেতন মনে নিজ গোত্র-গোষ্ঠীর এক ছবি অস্বচ্ছ হলেও প্রকাশ পাওয়ারই কথা। তাই, এদিকে একটু নজর দিলে তিনি অবশ্যই বলতেন, মানুষকে মানুষ হিসেবে মর্যাদাশীল হতে হলে নিজেকে পরিশীলিত ও কলুষমুক্ত ও সংশয়মুক্ত অবশ্যই করতে হবে। স্বার্থ সর্বস্বতা ও ঈর্ষা-বিদ্বেষ অবশ্যই পরিহার করে ‘সকলের তরে সকলে আমরা’ হতে হবে। এমন অঃঃরঃঁফব গ্রো করা সহজ, যা কিনা আত্মবিধ্বংসী আবেগকে সংহত করে নিজেকে নিয়ন্ত্রিত মানুষে রূপান্তরিত করা সম্ভব অবশ্যই। আর ওটা হতে পারলেই সত্যিকার সমাজবাদী হয়ে ওঠা যায়। ইসলাম যে সমাজবাদী চায়, তা হয়ে ওঠার মধ্যেই আসে জীবনের পূর্ণাঙ্গতা। যাদের মধ্যে তা আসবে সে অবশ্যই আত্মহত্যা করতে যাবে না। গাজী আজিজ অবশ্য আত্মহননের বিরোধিতা করেছেন। শিল্পিত মননে, কিন্তু ইসলামী মনীষা ও জ্ঞানী-গুণীদের নানা আলোচনা ও তথ্য, দর্শনে এদিকটি উপেক্ষা করে গেছেন অথবা তার অনিচ্ছাকৃত উপেক্ষাই রয়ে গেছে। তবে তার গ্রন্থে আছে, ঘৃণায় নয় ভালোবাসায় আমাদের ধুয়ে দিতে হবে মানুষের সব পাপ, পরাজয়, পরাভাবকে। বুদ্ধের মতো দুঃখ-শোক-যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে লাভ করতে হবে পরমাকে। আত্মবাদ থেকেই তার ফলে জন্ম নেবে ঊীরংঃবহঃরধষরংস-এর। এ গ্রন্থ ১৭টি অনুদিত কবিতাও সংকলিত হয়েছে। কবিতাগুলোতে রয়েছে মৃত্যু বিষয়ক ধ্যান-ধারণা। পাঠক ভিন্ন ধরনের রস আস্বাদন করতে পারবেন পুস্তকটি পাঠ করলে।
নানা গ্রন্থের রচয়িতা গাজী আজিজুর রহমান চিন্তা ও মননশীল প্রবন্ধই বেশি লিখে থাকেন। তার অনেক গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ এদেশের প্রথম শ্রেণীর পত্রিকাগুলোতে প্রকাশিত হয়েছে। তবে তার প্রথম গ্রন্থ প্রকাশিত হয় অক্টোবর ১৯৯২-তে (প্রথম পুনর্মুদ্রণ ২০১৪)। বইটির নাম ‘সাহিত্যে সমাজ বাস্তবতার ধারা’। সাহিত্যে সমাজ বাস্তবতার ধারা: এটি লেখকের প্রথম গ্রন্থ হলেও তা পাঠক হৃদয়কে আন্দোলতি করতে সক্ষম। এ গ্রন্থে সাহিত্য সমাজ বাস্তবতার কথা বলতে গিয়ে লেখক প্রসঙ্গক্রমে সংশ্লিষ্ট সূত্রসমূহকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। কিছু আপন মনন-চিন্তা চেতনায় সৃজিত এবং কিছু অন্যের প্রদত্ত সংজ্ঞাতে পুনরুপস্থাপিত করে। সংজ্ঞা দিয়েছেন সাহিত্যের, সমাজের। সংজ্ঞা দিয়েছেন ব্যক্তিবাদের, বস্তুবাদী চেতনার। অর্থনীতি ও সমাজনীতি রাজনীতি ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের। ইতিহাসে ছায়াপাত ঘটিয়েছেন বিশ্বের রাজতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনের। ওই উভয়ের সংজ্ঞা উপস্থাপনেও তার মনঃসংযোগের কিছুটা অভাব ঘটেছে। বিশ্ব মনীষীদের প্রদত্ত সংজ্ঞাসমূহকে বিশ্লেষিত করেছেন তিনি। তার নিজ চিন্তা-চেতনার অভিব্যক্তিতে। তবে এসব ক্ষেত্রে কোনো বিরোধ সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে মতানৈক্যের স্বাতন্ত্র্য পরিলক্ষিত। যেমন তার ধারণায় ধর্ম নিরপেক্ষতার আদর্শের সঙ্গে সবাই একমত নাও হতে পারেন। এক্ষেত্রে তিনি আদর্শ বিচ্যুতির অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন বিশ্বের অনেক মনীষীকেই। এমন কি রবীন্দ্রনাথ, কবি নজরুল এবং শেখ মুজিবকেও। কবি রবীন্দ্রনাথের অপরাধ, তিনি আধ্যাত্মবাদী। নজরুল গোঁড়া (আসলে কি তাই?) মুসলিম, আর শেখ মুজিব ইসলামিক সম্মেলনকে স্বীকৃতিদানকারী সদস্য। এ সকল মনীষীরা নাকি ধর্মনিরপেক্ষতাকে হত্যা করে চরম সাম্প্রদায়িক মানসিকতায় নিজেদেরকে বন্দি করেছেন। কিন্তু তার এই চেতনাকে লেখক নিজের বলে প্রচার করেছেন-সার্বজনীন চিন্তা চেতনা বলে দাবি করেননি। এটাই যা আশার কথা।
এ গ্রন্থ সম্পর্কে অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, ‘ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্যে সুস্থ, স্থিতধী, বিচারপ্রবণ, বিবেক ও যুক্তি-আশ্রয়ী প্রতিভাবান ব্যক্তিরা নিজ নিজ সৃষ্টি দিয়ে স্বজাতিকে এবং মানব জাতিকে ঋণী করে গিয়েছেন।’
অধ্যাপক গাজী আজিজুর রহমান এই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও টানাপড়েনের মাঝে অবস্থান করে সংগ্রামী চেতনাকে আত্মস্থ করে এগোতে চেয়েছেন। মার্কসীয় ভাবধারা ও জনগণের বৈপ্লবিক সংগ্রাম তাকে অনুপ্রাণিত করেছে। সাহিত্য ও শিল্পকলার আদর্শ উদ্দেশ্যও সৃষ্টি প্রক্রিয়াকে তিনি বুঝতে চেয়েছেন এবং নিজের উপলব্ধি ও জ্ঞানকে প্রকাশ করতে চেয়েছেন। যদিও সাহিত্যকে আশ্রয় করে তিনি চিন্তা করেছেন তবুও সঙ্গীত, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, চলচ্চিত্র এসবের কথাও এসেছে। প্রসারিত শিল্পদৃষ্টি ও সংস্কৃতি চেতনার পরিচয় এটা। প্রচলিত মতগুলোকে তিনি নিজের মতো করে বুঝতে চেয়েছেন। তার দৃষ্টিভঙ্গিতে স্বকীয়তা আছে।
গাজী আজিজ অবশ্য এক সময় ভালো কবিতাও রচনা করেছেন। কিন্তু কেন জানি এখন আর কবিতা লেখেন না। তিনি রাজধানী থেকে অনেক দূরে (সাতক্ষীরার কালীগঞ্জে) অবস্থান করেও চিন্তাচর্চা ও জ্ঞানানুশীলন অব্যাহত রেখেছেন, সর্বোপরি এই পরিশ্রম-বিমুখ চমক-সর্বস্বতার কালেও পরিশ্রম করে লিখছেন এবং গ্রন্থ প্রকাশের দায়িত্বও পালন করছেন। তা মোটেও সামান্য ব্যাপার নয়।
মানুষের জন্য সাহিত্য সৃষ্টি। সৃষ্টি মনুষ্য নির্ভর সমাজ। তাই সুসাহিত্যের অনুশীলনের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় কল্যাণময় সমাজের মৌলিক কাঠামো। সাহিত্যকে হতে হয় বাস্তবতা নির্ভর। অন্যদিকে কেবল কল্পনা নির্ভর সাহিত্য চর্চা মানুষ, তথা সমাজের জন্য কোনো রকম কল্যাণ সম্বলিত হতে পারে না। বরং তা সাহিত্য নির্মাতা ও ভোক্তা উভয়েরই শ্রম ও সময়ের অপচয়কারী হয়, অনেক উপকরণ সমৃদ্ধ উদাহরণের উপস্থাপনায় লেখক এ তথ্যাবলির প্রমাণ নির্দেশ করেছেন আলোচ্য গ্রন্থে।
উপরোক্ত গ্রন্থদ্বয়ের ভাষা অত্যন্ত আধুনিক। ‘তার লেখায় সাহিত্য শিল্পকলার প্রতি বিশেষ অনুরাগের প্রকাশ আছে, অনুসন্ধিৎসা ও চিন্তাশীলতার পরিচয় আছে, নিজস্ব বিশ্বাস এবং আবেগও আছে। জনগণের প্রতি ভালোবাসা এবং মুক্তিকামী মানুষের মুক্তিকামনা তার লেখার অন্তর্গত চালিকা শক্তি। এ-বই পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগাবে, পাঠকের চিন্তাকে উদ্রিক্ত করবে। (ভূমিকা : সাহিত্যে সমাজ বাস্তবতার ধারা)।
গাজী আজিজুর রহমান নিরলসভাবে শ্রমনির্ভর গবেষণালব্ধ যে সাহিত্য কর্ম এক এক করে সাহিত্যামোদি বাঙালিদের উপহার দিচ্ছেন তা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। তিনি রাজধানী থেকে বহু দূরে সাতক্ষীরার কালীগঞ্জের প্রত্যন্ত গ্রাম নারায়ণপুরে বসবাস করেও গবেষণা ও সাহিত্য চর্চা করে যাচ্ছেন। তার পরিশ্রম মুক্তিকামী মানুষকে মুক্তির দ্বার প্রান্তে একদিন পৌঁছে দেবেই।
সাহিত্য ও সিংহাসন: জন্মে কেউ কবি হয় না। কবি হওয়ার জন্য কোনো শর্ত বা অনুজ্ঞার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু প্রতিভা, অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, অনুশীলন, শিক্ষা, অধ্যয়ন এবং সংবেদন (ঝবহংধঃরড়হ) থাকলে যে কোনো মানুষ কবি সাহিত্যিক হয়ে উঠতে পারেন। আর কবি-সাহিত্যিকদের মনুষ্যত্ব প্রভাতবেলার সূর্যের মতো উজ্জ্বল। ওই মনুষ্যত্বের সঙ্গে ক্ষমতা আর প্রতিষ্ঠার নিরন্তর দ্বন্দ্ব রয়েছে। তাই কি সাহিত্য এবং সিংহাসনের দ্বন্দ্ব অনিবার্য নিয়তি? অনুরূপ বিষয় নিয়ে, ‘সাহিত্য ও সিংহাসন’ গ্রন্থটি গাজী আজিজুর রহমান ও অমিতাভ চক্রবর্তীর রচনা বাংলা রসসাহিত্যের ইতিহাসে সন্দেহাতীতভাবে একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন যা পাঠকদের প্রতি নিবেদিত হয়েছে। এটি অবশ্যই শ্রমসাধ্য একটি কাজ।
রাষ্ট্রনীতি সমাজবদ্ধ মানবজীবনের অনিবার্য অঙ্গ, তেমনি শিল্প-সাহিত্য ভাবনাও মানব হৃদয়ের চিরন্তন সত্য। সভ্য সংস্কৃতিমনস্ক মানুষের জীবনে দুটিই অপরিহার্য। ভাবজীবন ও বাস্তবজীবন অঙ্গাঙ্গি যুক্ত। বাস্তবজীবন আবার সাহিত্য দর্শন অর্থনীতি সমাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ওই প্রত্যেকটি বিষয় পৃথক কিন্তু যৌথভাবে জীবন সংলগ্ন পরস্পরের পরিপূরক। তবে ওই বিপরীত মতের যুক্তি-প্রতিযুক্তির মধ্য দিয়ে একটি সত্যি আবির্ভূত হয়, তা হলো সাহিত্য সৃষ্টির মাধ্যমে শিল্পী যেমন নিজেকে উপলব্ধি করেন, পাঠকও তেমন এর মধ্যে জীবনের মূল্য খুঁজে পায়। সাহিত্যের সাহায্য এই শর্তটি পূরণ করতে পারলে রাষ্ট্রনায়কের সাহিত্য স্রষ্টা হতে বাধা নিশ্চয়ই থাকে না। অমন একটা মীমাংসার সূত্রপাত ‘সাহিত্য ও সিংহাসন’ গ্রন্থে আমরা দেখতে পাই।
রাষ্ট্রনায়কের প্রকৃত প্রস্তাবে দু’টি সত্তা- একটি রাষ্ট্র চিন্তানির্ভর অন্যটি হচ্ছে ব্যক্তিকেন্দ্রিক। বৃত্তি প্রতিষ্ঠাগত অবস্থানের মাপকাঠিতে মানুষকে বিশ্লেষণ করলে সব মানুষের ভেতর দুটি সত্তা তো বটেই বরং তার অধিক সত্তার সমন্বয় লক্ষ্যযোগ্য। ওগুলো পরস্পর বিরোধী কখনো কখনো হলেও পরস্পরের পরিপূরক অবশ্যই হতে পারে। সে কারণেই একজন রাষ্ট্রনায়কও একজন বিশুদ্ধ সাহিত্য স্রষ্টা হতেই পারেন।
উল্লেখিত গ্রন্থে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, কবি ও রাজনীতিক উভয়ের কাজ মানুষকে প্রাণিত করা, সম্মোহিত করা। এই সম্মোহন শব্দের সানাই বাজিয়ে সমীকরণ করা মূল লক্ষ্য। কবি ও রাজনীতিবিদদের তাই দ্বন্দ্ব কোথায়? থাকলে ফিদেল ক্যাস্ট্রো আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে নিপীড়িত জনতার জন্য জবানবন্দি দিতে গিয়ে রবীন্দ্র ছন্দে উচ্চারণ করতেন না- ‘প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধে, বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতে কাঁদে’। সেই বিকল্প ক্যাস্ট্রোই আজ কিউবার মুক্তিদাতা, গণদেবতা। সঙ্গে সঙ্গে একজন সুলেখকও। কর্নেল গাদ্দাফিই কম যান কিসে।
একজন কবি অথবা সাহিত্যিক কি কখনোই সমাজ-রাষ্ট্র-রাজনীতি অসচেতন হন? বরং তাদেরকেই বলা হয় সমাজের সবচেয়ে সচেতন শ্রেণী। তাদের শিক্ষা জ্ঞান হৃদয় সংবেদনা, শৌর্য, সাহস যুগে যুগে মানুষ ও বিশ্বকে আলোড়িত করেছে। তাদের চিন্তা-চেতনা যেমন দূরদর্শী অন্তর্দশীও তেমন। কবি হৃদয়যোগের অন্যতম দূত। নেতা-নেত্রীর প্রথম কাজ মানুষের হৃদয়কে জয় করা। যার মুখ্য অস্ত্র শব্দ, অর্থবহ শব্দ। যে শব্দবানে থাকে ভালোবাসার অমৃত, বিপ্লবের আগুন, মুক্তির ঠিকানা, মাতৃভূমির মমতা। যা বহু কষ্টে অর্জন করেন একজন কবি, তাই অর্জন করতে হয় একজন রাষ্ট্রনায়ককে। গান্ধী, নেহেরু, মাও সে তুং, হোচি মিন, সেঙ্গর, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তা করতে পেরেছিলেন বলেই ইতিহাসে তারা সবচেয়ে বেশি অমরতা লাভ করেছেন। তাই সিংহাসনের দিকে তারা যতো না এগিয়েছেন সিংহাসন তার চেয়ে বেশি এগিয়েছে তাদের কাছে। বলা যায়, প্রতিভার শক্তির কাছে নতি স্বীকার করেছে রাষ্ট্র ও সিংহাসন।
কবি-সাহিত্যিকের অহংকার মানুষের ভালোবাসা। এই ভালোবাসার উৎস কবির সংবেদনশীল মন সত্য-সুন্দরের আরাধনা, কল্যাণেষু শুভ চেতনা, মানবতা এবং যাবতীয় অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে সংশপ্তকরূপে উন্নত শিরে দাঁড়িয়ে থাকা। যে গুণে তিনি সহজেই প্রবেশ করতে পারে জনযন্ত্রে, তারপর রাষ্ট্রযন্ত্রে। রাষ্ট্র এরকমই নেতৃত্ব প্রার্থনা করে। আর এ গুণগুলো যেহেতু বহন করেন মূলত একজন কবি-সাহিত্যিক তাহলে রাষ্ট্রের অংশীদারিত্বে তারাই তো হবেন বড় দাবিদার ইত্যাদি বিষয়কে নিয়ে রচিত ‘সাহিত্য ও সিংহাসন’ গ্রন্থটি।
নিত্যনতুন বৈচিত্র্য, নতুন পথের খোঁজে সাহিত্যের অপরিচিত পথে পাঠককে নিয়ে যাবার স্বেচ্ছা দায় ও অঙ্গীকার যে সব মুষ্টিমেয় সাহিত্যকর্মী স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কাঁধে নিয়েছে এই বাংলাদেশের প্রাবন্ধিক অধ্যাপক গাজী আজিজুর রহমান ও পশ্চিম বাংলার কবি অধ্যাপক অমিতাভ চক্রবর্তী তাদের অন্যতম।
সমগ্র পৃথিবীর দেশে দেশে যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন অথবা রাজনীতিবিদ হিসেবে খ্যাত হয়েছেন তাদের ভেতর যারাই সাহিত্য-শিল্পের স্রষ্টা এদের রাজনৈতিক জীবন সত্তার মাঝে শিল্পী-প্রাণের স্পন্দন কোনোভাবেই গোপন থাকেনি। সুপ্রাচীনকাল থেকে অতি আধুনিককাল পর্যন্ত (যেমন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা) অসংখ্য রাষ্ট্রনায়ক বা রাজনীতিবিদ কাব্য-সাহিত্য সৃষ্টির ভেতর দিয়ে অবিনশ্বর কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন।
বিশ্বের বহু খ্যাত রাষ্ট্রনায়কদের সাহিত্য সম্ভার নিঃসন্দেহে কৌতূহলের সামগ্রী। সেই সাহিত্য সম্ভার পাঠকের সামনে সর্বাঙ্গ সুন্দর করে উপস্থিত করার জন্য বিশ্বাস, নিষ্ঠা, আন্তরিকতার সঙ্গে যে দায়িত্বশীলতা, নিরপেক্ষতা ও হৃদয়তা প্রয়োজন তার যথার্থ দৃষ্টান্ত ‘সাহিত্য ও সিংহাসন’ গ্রন্থটি।
গ্রন্থটির রচনাশৈলী, রস সম্বলিত ভাষা প্রয়োগ ও গাম্ভীর্য পাঠক হৃদয়কে অবশ্যই আলোড়িত করবে। এ ধরনের গুরুত্ববহ গ্রন্থটির রচনায় অনুবাদের উপযোগী প্রাণস্পর্শী ভাষা নন্দিত না হয়ে পারে না। নতুন ধরনের সাহিত্য-রস এই বই থেকে আস্বাদনের সুযোগ লাভ করায় কবি অধ্যাপক অমিতাভ চক্রবর্তী ও প্রাবন্ধিক গাজী আজিজুরর হমানকে অবশ্যই ধন্যবাদ দিতে হয়।
লেখক : কবি, সাহিত্যিক, গবেষক, সাংবাদিক, সম্পাদক এবং সাবেক জাতীয় কমিশনার (প্রকাশনা), বাংলাদেশ স্কাউটস, সাবেক সম্পাদক ও প্রশাসক, প্রতিরোধ, মাসিক গণশিক্ষা, সম্পাদক ‘অগ্রদূত’, স্কাউটস মুখপত্র। বীর মুক্তিযোদ্ধা।

তবু চাই অগ্রযাত্রা : রফিকুর রশীদ
গাজী আজিজুর রহমান। দীর্ঘ তিন দশকেরও অধিক সময় ধরে কলেজ শিক্ষকতার সুবাদে নিজ এলাকায় অধ্যাপক আজিজুর রহমান নামে তিনি সমধিক পরিচিতি লাভ করেন। অত্যন্ত সফল শিক্ষক হিসেবে মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হতে শুনেছি ‘আজিজ স্যারে’র নাম, কিন্তু এসব পরিচয়ের অনেক ঊর্ধ্বে সাহিত্যব্রতী গাজী আজিজ নিজের অনন্য এক পরিচয় খুব নিভৃতে নির্মাণ করে চলেছেন, সে তাঁর কবিসত্তার পরিচয়। অসাধারণ দ্যুতিময় অসংখ্য কাব্যপঙ্ক্তি তাঁর হাতে রচিত হলেও আমি ব্যক্তিগতভাবে তাঁর লেখা গদ্যেরই ভক্ত। গদ্যপড়ায় আমার বাস বলেই যে এই পক্ষপাত তা কিন্তু মোটেই নয়। তাঁর হাতের পরিশীলিত আধুনিক এবং নির্মেদ গদ্য যে কোনো পাঠকেরই বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। গদ্যের গাঁথুনি, শব্দবিন্যাস, গঠনশৈলী-প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি নিরীক্ষাপ্রবণ, নতুন ভঙ্গিতে উপস্থাপনতেই তার অধিক আনন্দ, তাই বলে তিনি পাঠকের বোধগম্যতার পথকে কিছুতেই কণ্টকাকীর্ণ করতে চাননি, পাঠকের পাঠাভ্যাসের দেয়াল ভাঙতে চেয়েছেন গায়ের জোরে ধাক্কা দিয়ে নয়, খুব কাছে থেকে সেই দেয়ালকে পুরোপুরি বুঝে নিয়ে শৈল্পিক ভঙ্গি দিয়ে আঘাত করতে চান। খুব হুড়োহুড়ি না করে ধীরে ধীরে রয়ে সয়ে এই ভাঙাভাঙি করার ফলে তাঁর হাতে নির্মিত হয় ভিন্নমাত্রার গদ্যশৈলী। এইখানে তিনি স্বতন্ত্র এবং অনন্য। তাঁর লেখা সর্বশেষ গদ্যগ্রন্থ ‘স্বদেশ ভাবনা ও বঙ্গবন্ধু’ সেই প্রমাণই মেলে ধরে পাঠকের সামনে।
এই যে ‘স্বদেশ-ভাবনা’র ব্যাপারটা, এইখানে পাওয়া যাবে গাজী আজিজুর রহমানের প্রকৃত পরিচয়। জন্মমাত্রই তিনি দেখেছেন সাম্প্রদায়িকতার ছুরিতে ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত স্বদেশভূমি। দক্ষিণের সাগরঘেঁষা জনপদ সাতক্ষীরার এক অন্ত্যজ পাড়াগ্রাম তার পিতৃভূমি হলেও তিনি জন্মগ্রহণ করেন উত্তরের পাহাড় ছোঁয়া সৌন্দর্যশহর দার্জিলিংয়ে, ভারতমাতার রক্তাক্ত জঠর চিরে যখন স্বাধীন দুটি দেশের জন্ম হচ্ছে এ উপমহাদেশে, সময়টা ছিল সেই ঐতিহাসিক সাতচল্লিশে। পিতার কর্মসূত্রে সেই সাতচল্লিশের শেষাশেষি তার আগমন ঘটে ঢাকা নগরীতে। শৈশব-কৈশোর ঢাকায় কাটলেও পিতার কর্মজীবনের সমাপ্তিতে সবাই মিলে ফিরে আসেন সাতক্ষীরার কালীগঞ্জে। ইন্টারমিডিয়েট পাসের পর আবারও ঢাকাবাস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে লেখাপড়া সম্পন্ন করা, কবিতা লেখা, নাটক করা, সদ্য স্বাধীন দেশে রাজনীতির উত্তাপ ও ঘ্রাণ গ্রহণ করা- এইসব মিলিয়ে ছাত্রজীবনের অমল ধবল দিনযাপন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক আকাশে সবচেয়ে ঘন তমিস্রা বিস্তারের কালে গাজী আজিজুর রহমান শিক্ষা জীবনের পাট গুটিয়ে চলে আসেন নিজ এলাকায় সাতক্ষীরার কালীগঞ্জে। অনেকটা পারিবারিক দায়বোধ থেকেই তাকে ফিরে আসতে হয় স্বভূমে। যোগ দেন কলেজ শিক্ষকতায়, কালীগঞ্জ কলেজে। উন্নত রুচি ও সুস্থ সাংস্কৃতিক চেতনাসম্পন্ন এই ব্যক্তিত্বের আগমনে দক্ষিণের এই জনপদে প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়, তরুণ সমাজে সঞ্চারিত হয় নতুন উৎসাহ-উদ্দীপনা। গাজী আজিজুর রহমান প্রেরণার এই প্রেক্ষিতকে কাজে লাগাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। অথচ তখনকার বাস্তবতা ছিল ভিন্ন, বাঙালির মাথার ওপর থেকে পিতৃত্বের ছায়া সরিয়ে দেয়া হয়েছে, গোটা জাতি হতবিহ্বল, ভেতরে ভেতরে চক্রান্ত আর ষড়যন্ত্রের ছুরিতে শান দেয়ার কাজ চলছে পর্দার অন্তরালে; তবু তিনি মনে করেন- সারাদেশে ইতিবাচক পরিবর্তনের আশায় বসে না থেকে নিজের এলাকার সামাজিক-সাংস্কৃতিক (ক্ষেত্রবিশেষে রাজনৈতিকও) প্রেক্ষাপটে সদর্থক পরিবর্তন আনার কাজে তিনি দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে পারবেন। সুশীল অধ্যাপক হিসেবে ক্লাসঘরে পাঠদানের বাইরেও তিনি দিনে দিনে বিশাল কর্মক্ষেত্র রচনা করে নেন এবং এই স্বরচিত কর্মক্ষেত্রকে গ্রহণ করেন রণক্ষেত্রের চ্যালেঞ্জ হিসেবে। এ পথ মোটেই কুসুমাস্তীর্ণ ছিলো না, ছিলো দুস্তর বাধাসংকুল। পথে পথে পাথর ছড়ানো।
মসৃণ পথে নয় পাথর ছড়ানো পথে পা বাড়ানোতেই তাঁর অধিক আনন্দ। ক্লাসের শিক্ষার্থীকে পাঠ্যসূচির পাঠ দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেননি। তাদের সাংস্কৃতিক রুচি গঠন, রাজনৈতিক চেতনা শাণিত করা, সর্বোপরি মানবিক মূল্যবোধে উদ্দীপ্ত করা- এগুলোকে তিনি গ্রহণ করেন ব্রত হিসেবে।
সমাজ ভাবনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে গাজী আজিজুর রহমান এত সব কর্মকা-ের মাঝে নিজেকে ছড়িয়ে দিতে গিয়ে তবে কি সাহিত্যভাবনা থেকে সরে এসেছেন? প্রশ্ন জাগতে পারে- এতসব নানামুখী কর্মতৎপরতা কি তার সৃষ্টিশীলতাকে ব্যাহত করেছে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্যের মেধাবী ছাত্র এবং মননশীল পাঠক গাজী আজিজ ছাত্রজীবনেই ঢাকার বিভিন্ন কাগজে এবং সাহিত্য সাময়িকীতে নিয়মিত উপস্থিত থেকেছেন প্রবল প্রতাপের সঙ্গে, সেই মানুষের সাহিত্যচর্চা কি সহসা থমকে দাঁড়াতে পারে? না, বাস্তবে তেমনটি হয়নি। কবিতা অন্তঃপ্রাণ এই মানুষটি কবিতার সঙ্গেই পথ হেঁটেছেন দীর্ঘদিন। তবে পথ চলতে চলতে তাঁর বাঁকবদল ঘটেছে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই। কবিতার পাশাপাশি গদ্যচর্চাতেও মনোনিবেশ করেছেন আন্তরিক উপলব্ধি থেকেই। সত্যি বলতে কী, প্রথম প্রেমিকার প্রণয়স্মৃতির মতো কবিতার প্রতি ভালোবাসাকে বুকের গভীরে আগলে রেখেও পরিণত বয়সে এসে তিনি গদ্যের প্রতিই অধিক মাত্রায় ঝুঁকে পড়েছেন। একে পক্ষপাত না বলে সময়োচিত অবস্থান গ্রহণ বলা যেতে পারে। আত্মমূল্যায়নের মধ্য দিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছেন বলেই এ নাগাদ তার লেখা বেশ কয়েকটি মননশীল প্রবন্ধের বই প্রকাশিত হয়েছে এবং সেগুলো সুধীমহলে যথা সমাদরও লাভ করেছে। তবু মানতেই হবে দীর্ঘকাল ঢাকার বাইরে নিভৃত মফস্বলে জীবনযাপনের কারণে গাজী আজিজুর রহমানের সাহিত্য প্রতিভা জাতীয়ভাবে যথার্থ মূল্যায়িত হয়নি। সুখের কথা, তার কলম এখনো যথেষ্ট সচল এবং সৃষ্টিশীল, কারো স্বীকৃতি-অস্বীকৃতির তোয়াক্কা না করে তিনি এখনো চিন্তাশীল গদ্যচর্চার সঙ্গে আন্তরিকভাবে লেগে রয়েছেন। আমার বিশ্বাস এই পথ ধরেই একদিন তিনি সাফল্যের বরমাল্যও জয় করবেন।
গাজী আজিজুর রহমানের সঙ্গে কবে কীভাবে আমার প্রথম পরিচয়, সে কথা আজ আর ঠিকমতো মনেও পড়ে না। তবে এ কথা জোর দিয়েই বলতে পারি শুরু থেকেই আমার মতো অনুজকে তিনি গ্রহণ করেছেন বুকের কপাট হাট করে দিয়ে। সাতক্ষীরা-কালীগঞ্জে তো বটেই, সাহিত্যসভাকে কেন্দ্র করে তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে খুলনা, ঢাকা, কুষ্টিয়া-কুমারখালী, কলকাতা, মেদিনীপুর, হলদিয়াসহ বিভিন্ন জায়গায়। তার সূত্র ধরেই পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন কবি সাহিত্যিকের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে। আমার মতো সামান্য এক লেখককে অসামান্য গুরুত্ব দিয়ে সাতক্ষীরা সাহিত্য একাডেমির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা প্রদান করে অপরিমেয় কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ করেছেন, এ আমার পরম সৌভাগ্য বটে।
সামনে আমাদের প্রিয় আজিজ ভাইয়ের ৭০তম জন্মদিন। চমকে ওঠার কথা- মেঘে মেঘে এত বেলা! ভারি অবাক হই- গত দু’আড়াই দশক ধরে আমি তো প্রায় পরিবর্তনহীন এক গাজী আজিজুর রহমানকেই দেখে আসছি। অকৃত্রিম সেই চেহারা-ছবি, অমায়িক তার আচার-আচরণ, মেধাশাণিত বুদ্ধিদীপ্ত তার ব্যক্তিত্ব। অত্যন্ত ধীর পদবিক্ষেপে অথচ দৃঢ়তার সঙ্গে এগিয়ে চলেছেন সম্মুখে। সেই সমুখেটা কোথায়? মৃত্যু নয়, আমার তো মনে হয় এগিয়ে চলেছেন তিনি পরবর্তী জন্মদিনের দিকে। আমাদের ঐকান্তিক প্রত্যাশা সৃষ্টিশীল কর্ম দিয়ে ম-িত হোক তাঁর প্রতিটি জন্মদিন এবং তার এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকুক শতাব্দীর ওপার পর্যন্ত। না থাক বরমাল্য, তবু চাই অগ্রযাত্রা।
লেখক : কথাসাহিত্যিক

তিন কুড়ি দশ নয় কুড়ি রস : আলম তালুকদার
তিনি গাজী পদবীর আজিজুর রহমান। প্রথমত: তিনি অধ্যাপক তারপর প্রাবন্ধিক ও গবেষক। দেখা যাচ্ছে তাঁর মেলা মেলা শখ। হাজী, কাজি এবং গাজী এরা সব সময়ে থাকেন রাজী। কাজি বিয়ে করানোর ওস্তাদ, হাজী হাদিস কালাম বয়ানে ওস্তাদ আর গাজী গায়ে গতরে জী জী করতে করতে জীবন দিতে রাজি কিন্তু কপাল গুণে শহিদ নেহি, তখন সে গাজী মহা গাজী পদবিতে ভূষিত হয়ে যায়। এই রকম গাজীরা অনেক আগে শহিদ হওয়া থেকে বঞ্চিত হয়ে অবশেষে গাজীতে রূপান্তরিত হয়েছে বলে বিদুৎবাণীতে জানা গেছে।
যাহোক প্যাঁচাল বাদে একটু আলাপ-আলাপন করা দরকার। প্রথম কথা হলো গিয়ে তা এতদিন পরে কেন তাকে নিয়ে লেখা হচ্ছে। তাঁর সাথে দেখা হলেই তো ছড়ায় ছড়ায় কয়টা লাইন মিলিয়ে বললেই হতো। কষ্ট করে সময় নষ্ট, আর পাঠকদের অত্যাচার করার কী দরকার? আছে আছে দরকারও আছে প্রয়োজনও আছে। সবাই জানতি পারে না।
বয়স বেশি না, মাত্র তিনকুড়ি দশ
তাঁর চলায় বলায় আছে নান্দনিত রস।
৭০ উল্টালে লাকি ০৭
যার অনেকগুলো হাত
ধরতে পারে রবীন্দ্রনাথ
করেন সাহিত্য মাৎ
সিংহাসন? গুদাম জাত!
আমি আমার বক্তৃতায় মাঝে মাঝে বলি, আপনি কোন ফুল ভালোবাসেন? কেউ বলে, গোলাপফুল, আবার কেউ বলে কদম। আসলে ভুল। লাইক করেন বা ভালোবাসেন ‘পাওয়ারফুল’। তো পৃথিবীর সব প্রাণীর প্রধান যুদ্ধ হলো নিজেকে পাওয়ারফুল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। পাওয়ার প্রধানত দুই রকমের। একটা হলো সিংহাসনে বসে পাওয়া যায়, আরেকটা হলো ‘নলেজ’। মানে ‘নলেজ ইজ পাওয়ার’। গদি আর গতি এই নিয়ে মতিগতি চির চলমান। তো সেই চির চলমান শক্তিটাকে কে কিভাবে এস্তেমাল করেছে তার একটা খতিয়ান জনাব গাজী আজিজুর রহমান ও অভিতাভ চক্রবর্তী তাদের লেখা ‘সাহিত্য ও সিংহাসন’ নামক বইটিতে বিধৃত করেছেন খুব সহজ সরলভাবে। সেই সামন্তকাল থেকে হালের রাজাগোজারা শুধু রাজ্যশাসন করেই ক্ষান্ত হননি তারা কাব্যচর্চাও করেছেন। সাহিত্যরস ভা-ারে অবগাহন করেছেন সন্তরণও করেছেন। সিংহাসন মানেই রাজার কথা চলে আসে। খাইছে আমারে! আইসা পড়লো যে। মানে জোকস ধাক্কাচ্ছে। আচ্ছা বাইর করে দেই।
এক ছিল রাজা। তার ছিল বিশাল রাজ্য। বেশ আমুদে রাজা। তার প্রধান নেশা কবিতাচর্চা। তিনি দৈনিক কবিদের দরবারে ডাকেন আর কবিতা শুনে পুরস্কার প্রদান করেন। তো এইভাবে চলছে তো চলছে। তার রাজ্যে কবিদের মহাসুখ। চার লাইন মিলিয়ে দিলেই বখশিস। তো ওই রাজ্যে ছিল এক গরিব ব্রাক্ষণ। অং বং চং ছাড়া সে তেমন কিছু জানে না। তার বউ তাকে ঠেলে ঠুুলে রাজার দরবারে পাঠিয়ে দিলো। কবিতা বললেই নগদ বখশিস! তো ওই ফাঁকিবাজ লাইনে দাঁড়িয়ে গেলো। একসময় তার পালা আসে। তাকে রাজা কবিতা শুনাতে বললেন, তো সে কবিতা বলছে, ‘বিড়াল ক্ষীর খায়’। তারপর চুপ। রাজা বলেন, ‘তারপরের লাইন?’ সে বলে ‘আমার কবিতা হুজুর ওইটুকুই।’ রাজা অবাক হয়ে বলেন, ‘সেকি? কবিতায় কমপক্ষে চারটি চরণ থাকবে।’ ‘আছেতো হুজুর, ওই যে বিড়াল, বিড়ালের চারটা চরণ আছেতো!’ রাজা মশায় চমকে যান। ‘হ্যাঁ তাইতো ওটাও তো চরণই বটে। আচ্ছাতো গোজামিল। বেশ ধরলাম চরণ। তা কবিতায় একটু রস থাকবে না?’ ‘কেন? ওই ক্ষীরের মধ্যে রস আছে না?’ রাজা এবার গাজারু হয়ে তবদা মেরে যান। ‘আরে উল্লুক কাহা ওই রস আর কবিতার রস এক হলো?’ তো ওই বেটা বলে কী! ‘কেন হুজুর রস তো নাকি?’ রাজা তার বুদ্ধির গুণে পুরস্কার দিয়ে বিদায় করতে বাধ্য হলেন।
তো গাজী-চক্রবর্তীরা ‘সাহিত্য ও সিংহাসন’ নামক বইটিতে ক্ষমতার গদিতে মানে সিংহাসনে বসে যারা সাহিত্য বা কবিতা রচনা করে রাজা এবং কবি নামে তার সময়ে বা পরেও খ্যাত ছিলেন বা এখনও আছেন তাদের নিয়ে বইটি সমৃদ্ধ করা হয়েছে। বিশ্বের বহুখ্যাত রাষ্ট্রনায়কদের সাহিত্য সম্ভার উপহারের এই নাতিদীর্ঘ পুস্তক। একবার শুরু করলে শেষ করার আগ্রহ প্রবলতরভাবে বজায় থাকে। এই দিক দিয়ে গাজীরা সফল।
সেই প্লেটো হতে শুরু করে আমাদের দেশের লে. জে হু. এু. এরশাদের নামও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিভিন্ন মহাদেশভিত্তিক দেশ নায়ক ও কবিদের কর্ম ও কবিতা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
বিভিন্ন মহাদেশভিত্তিক সাহিত্যিক নামের তালিকা দেয়া আছে এবং সবার সম্বন্ধে তথ্যাদি দেয়া আছে। এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, উত্তর আমেরিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার কবি ও সাহিত্যিকদের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এক নজরে বিশ্ব সাহিত্য জগতে ভ্রমণ ইচ্ছা থাকলে বইটি সহায়ক হবে। এই দিক হতে বইটি একটি উপকারী জন্তু। জন্তু ইচ্ছা করেই দিলাম। যাতে মানুষেরা কোনোদিন জন্তু হতে না পারে! প্লেটো তাঁর রাজ্যে কবিতাকে ম্রিয়মান করার জন্য অনেক বাণী দিলেও তাঁর শিষ্য অ্যারিস্টটল আবার কবিতা এবং কবিদের জয়গান গেয়েছেন। নানান তথ্যে ঠাসা এই বইটি পাঠ করলে নিজেকে সমৃদ্ধ করার এক অপার সুযোগ পাওয়া যায়। তা পাঠক পাঠ করলে করুন না করলে আরো ভালো। কারণ বইটি বাজারে কিনতে পাওয়া যায় না।
শেষ করার পর্যায়ে এসে গেছি। বেশি প্যাঁচাপ্যাঁচিতে না যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। সিংহ চিহ্নিত যে আসন তাকে সিংহাসন বলা হয়। তাই না? তো সিংহ কেন? বাঘ নয় ছাগল বা কুকুর বা বানর বা সাপ নয়, সিংহ কেন? কারণ সিংহ হলো বনের এবং পশুদের রাজা। মানুষও সিংহের মতো নাদুস নুদুস শক্তিমান রাজা হতে চায়। এই চাওয়া হতেই এই কারবার। তো একদিন এক দেশের এক সিংহ সকালবেলা মনে করলো, আচ্ছা আজকাল আমাকে তেমনটা কেউ ভ্যাট দিচ্ছে না কেন? সে তার ভাব নিয়ে গুহা হতে বহিষ্কার হয়ে হাঁটা শুরু করলো। যার সাথে দেখা হয় তাকেই জিজ্ঞেস করে, এই বনের রাজা কে? কেন? আপনি। ও। আচ্ছা যা। এইভাবে ছোট বড় যার সাথে দেখা হয় তাকেই জিজ্ঞাস করে। জবাবে সবাই বলে, আপনিই তো আমাদের রাজা। তো দুপুরের দিকে এক পাগলা হাতির সাথে দেখা। তাকে জিজ্ঞেস করছে, এই হাতি বলতো এই বনের রাজা কে? হাতির কোনো চেৎবেৎ নাই। আবার প্রশ্ন করে। আবারও নীরব। আবার প্রশ্ন করলে, হাতিটা হঠাৎ ফোঁস করে শব্দ করে তার শুঁড় দিয়ে সিংহটাকে পেঁচিয়ে ধরে উপরে তুলে মারছে এক আছাড়! সিংহতো হতভম্ব! যাক- নিজেকে সামলিয়ে একটু রাগ দেখিয়ে বলল, এই ব্যাটা হাতির পো হাতি রাগারাগি করবা না। অনেকে অনেক কিছু নাই জানতে পারে নাকি? তুমি জানো না বনের রাজা কে? সেটা বললেই পারো। রাজার সাথে ইয়ার্কি করবা না কইলাম। আমি আবার জিজ্ঞাস করমু। ঠিক জবাব দিবা। বলো, বনের রাজা কে? এবারও হাতি ফোঁস ফোঁস আওয়াজ তুলে শুঁড় দিয়ে প্যাঁচ দিয়ে আরও জোরে মারছে এক মহা আছাড়। তাতে সিংহের কোমরের অবস্থা কাহিল হয়ে গেলো। কোহায়ে কোহায়ে উঠে বলে, দেখো হাতি, আমি কিন্তু ইয়ার্কি ফাইজলামি পছন্দ করি না। তুমি অমন ব্যবহার কেন করছো। অত রাগ দেখাও কেন? পৃথিবীর সবাইকে সব জানতে হবে এটার কেনো মানে নাই। তুমি জানতে নাও পারো যে বনের রাজা কে? কিন্তু রাগারাগির কী আছে? না জানাটা সমস্যা নয়। সমস্যা হচ্ছে গিয়ে তোমার রাগারাগি। এইটা বাদ না দিলে তোমার ভবিষ্যৎ অন্ধকার। সাবধান!
তো গাজী আজিজুর রহমানের বয়স ৭০ পার হতে যাচ্ছে। রাগারাগি মারামারি বাড়াবাড়ি তাড়াতাড়ি করতে করতে ৭০ বসন্ত পার। তার অভিজ্ঞতার ভা-ার অপার। তিনি জীবনকে আনন্দের সাথে উপভোগ করে যাচ্ছেন। তিনি আরো ৫/৬ কুড়ি বছর তার ঝুড়ি নিয়ে সুস্থভাবে চলমান বেগবান অবস্থায় বেঁচে থাকুন এই কামনায় বিরতি দিচ্ছি।
লেখক : ছড়াকার, শিশুসাহিত্যিক, মুক্তিযোদ্ধা

অভিনন্দন : কাজী মুহম্মদ অলিউল্লাহ
যুক্তি, তর্ক, তত্ত্ব ও তথ্যের সমাবেশের একটি সমন্বিত শিল্পরসসম্মত রূপকল্প হলো প্রবন্ধ। সেখানে আবেগ, অতিশয়োক্তি বা রোমান্টিকতার উপস্থিতি মূলত অপ্রবেশ্য বলা যেতে পারে। তবে শব্দের সৌন্দর্যময় লালিত্য ও উচ্ছ্বল আবেগের সাথে উপলব্ধি ও মননের সম্পৃক্তি রসায়নের যে জারণ সৃষ্টি হয়, প্রবন্ধ বা নিবন্ধের জগতে রোমান্টিক গদ্যের তা এক অনুপম আবহ সৃষ্টি করে নতুন মাত্রা দেয়। ইমোশন ও ইনটেলেক্টের যেনো রীতিমতো হরিহর আত্মকথায় অবস্থান। এমন শিল্পীরা সাহিত্য ক্ষেত্রে ভিন্ন স্বাদের সওদা ও ব্যতিক্রম স্বাতন্ত্র নিয়ে আবির্ভূত হন। এ জাতীয় শিল্পীদেরকে রোমান্টিক গদ্যশিল্পী বলাই মনে হয় শ্রেয়। এ ক্ষেত্রে রচনা অনেক সময় বক্তব্যকে ছাপিয়ে, যুক্তিকে পেরিয়ে শিল্পিত আবেগের এক বিশেষ পরিম-লের অবতারণা করে পাঠকদেরকে না কবিতা না গদ্যের রহস্যের ইন্দ্রজালে সম্বোহিত করে। এটাই এ জাতীয় শিল্পির স্বভাব-সুন্দর স্বধর্ম।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক তথা সাহিত্যিক অধ্যাপক গাজী আজিজুর রহমানকে বার বার এ রকম অভিধায় অভিহিত করতে ইচ্ছে হয়। সাহিত্যক্ষেত্রে বাঙালি সন্তানদের মতো মনে হয় কবিতা দিয়েই তার আবির্ভাব। ছোটোগল্প, উপন্যাস, নাটক প্রভৃতি অবশ্য তাঁর হার্দিক অনুষঙ্গ, যা থেকে বেরিয়ে আসাও সম্ভব হয়নি। এগুলো দিয়েও সিদ্ধিলাভের ক্ষেত্রে পদচারণা অযথার্থও ছিলো না। কবিতা রচনার বিষয়ে তাঁর অভিজ্ঞান, “কবিতা কি, এ বিষয়টি বুঝতে পারার পরপরই অনুভব করি কবিতা লেখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।” কথাটায় হয়তো আংশিক সত্যি আছে, তবে মনে হয় বিনয় বহুলাংশে। কথাসাহিত্যের বিষয়েও এ ধরনের ভাবনার সাযুজ্যও বিদ্যমান। কারণ এসব থেকে তিনি প্রায়শ মুক্ত হতে পারেননি।
তবে অব্যাহত পঠন-পাঠন, বিশ^সাহিত্যের নাড়ি-নক্ষত্র অধ্যয়ন, মার্কসবাদী দর্শনের সাথে রাজনীতি, অর্থনীতি, মনস্তত্ব প্রভৃতির বহুমাত্রিক ধারণা ও সংখ্যা তাঁর বোধ ও বোধিকে এক গভীর তাৎপর্যমুখী করে তুলেছে। তাঁর অজস্র প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও গ্রন্থসমূহ এসবের সাক্ষ্য বহন করে।
সাহিত্যে সমাজবাস্তবতার ধারা তাঁর নিরীক্ষাধর্মী আলোচনা গ্রন্থে যুক্তি ও আবেগের কারুকার্যে সমাজ বাস্তবতার স্বরূপটা বোঝাতে চেষ্টা করা হয়েছে। এ ধারণা ধীরে ধীরে যে একটা লক্ষে উন্নীত হবার চেষ্টায় প্রাগ্রসর, পরবর্তী গ্রন্থসমূহ বিশেষ করে স্বেচ্ছামৃত্যুর করতলে কবি (১৯৯৬), সাহিত্য ও সিংহাসন (১৯৯৯), নোবেল সাহিত্য পুরস্কারের শতবর্ষ (২০০১), আধুনিক বাংলা উপন্যাসের বিষয় ও শিল্পরূপ (২০০৯), এবং কবিদের কবি (২০১০)- তে পরিণতি অভিমুখী।
বলাবাহুল্য লেখকের সব কথা, সব যুক্তি, সব অভিমতে সব পাঠক এসবে একমত হবেন এমন মনে করার কোনো কারণ নেই, তবে লেখকের উপস্থাপন সৌকর্য ও শব্দ চয়নের সৌন্দর্যে পাঠককুল নান্দনিক মহিমায় মোহিত না হয়ে পারবেন না, এই স্বভাব বৈশিষ্ট্যই গাজী আজিজুর রহমানকে মজবুত পায়ে দাঁড়াবার শক্তি যুগিয়েছে বলে মনে করি।
সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনে লক্ষ্য করেছি গাজী আজিজ সর্বদাই সতত সঞ্চরণশীল, সহাস্য, স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বেচ্ছাগ্রহী। সামনে যে সময় পড়ে আছে, লক্ষ্যণীয় যে, জীবনের সতেজতা সেখানে একটুও স্বাভাবিকতা অতিক্রম করেনি। এটা খুবই সুখের কথা। আমরা আরো সজীবতা, আরো সৌন্দর্যচ্ছটা প্রত্যাশা করি।
সত্তরতম জন্মদিন উপলক্ষে স্মারক সংকলন প্রকাশ তাঁর প্রতি পাঠক-পাঠিকা, ভক্তবৃন্দ, গুণীজন ও গণমানুষের শ্রদ্ধা নিবেদন ও তাঁর অবদানের প্রতি সকৃতজ্ঞ ঋণস্বীকার।
এই সদিচ্ছাপ্রসূত আয়োজনের সাথে সম্পৃক্ত হতে পেরে আনন্দ প্রকাশ করছি। তাঁর নিরোগ দীর্ঘ জীবন কামনা করছি ও আয়োজকদের এই শুভ উদ্যোগটাকে অভিনন্দিত করছি।
লেখক : প্রাক্তন অধ্যাপক, সাহিত্যিক, গবেষক

আমাদের প্রবন্ধ সাহিত্যের শক্তিশালী সাধক : আ. শ. ম. বাবর আলী
অধ্যাপক গাজী আজিজুর রহমান আমাদের প্রবন্ধসাহিত্যে আপন ঔজ্জ্বল্যে একটি পরিচিত নাম। সাহিত্যের অন্যান্য শাখায় তাঁর কৃতিত্বপূর্ণ বিচরণ থাকলেও সে সেব ক্ষেত্রে তাঁর অনুশীলন কম। তিনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন প্রবন্ধচর্চায়। তাই স্বেচ্ছায় প্রবন্ধর জগৎ বেছে নিয়েছেন গবেষণামূলক প্রবন্ধ রচনার মাধ্যমে আপন সৃষ্টিকে বিকশিত করতে।
সাহিত্য জগতে তাঁর সৃষ্টি শুরু বিগত শতকের সত্তরের দশকে। সেই থেকে দীপ্ত পদচারণায় তিনি লিখে চলেছেন অদ্যাবধি। একনিষ্ঠতায় লিখছেন নিরলসভাবে। তবে সময়ের তুলনায় তাঁর লেখার সংখ্যা অনেকটা সীমিত। তা হলেও এ পর্যন্ত যা লিখেছেন, মানের দিক দিয়ে প্রতিটি লেখাই অতি উন্নত। মনের ভাবনাকে প্রসারিত করে অনেক মনন চিন্তার ফসল তাঁর প্রতিটি লেখা। অনেক গবেষণার ফসল প্রতিটি রচনা।
তার ওপর সবচেয়ে বড় কথা, তাঁর লেখার উপকরণের বিষয়বৈচিত্র্য। যে সমস্ত বিষয় নিয়ে তিনি লিখেছেন এবং লেখেন, সাহিত্য জগতে আর কাউকে তেমন করে বিষয় নির্বাচন করতে আমরা দেখিনি। বর্তমান কালে তো নয়-ই। বলা যেতে পারে, বৈচিত্র্যময় এমন বিষয়বস্তু গ্রহণ তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত ভাবনারই ফসল। তা তাঁর ব্যক্তিগত ভাবনা হলেও শুধু সাহিত্যের নয়, সকল শ্রেণীর পাঠককে মজাদার স্বাদে মুগ্ধ করে। সমৃদ্ধ করে অনেক বেহিসেবি ঘটনার মনোরম প্রজ্ঞাকে।
অধ্যাপক গাজী আজিজুর রহমানের অনেক প্রবন্ধ আমি পাঠ করেছি। অনেক সম্মেলন-সেমিনারে শুনেছি তাঁর সুলিখিত নিবন্ধ পাঠ। আমাকে অতি আত্মনিমগ্নতায় মুগ্ধ করেছে তাঁর প্রতিটি লেখার গভীরতা, বিষয়বস্তু বিন্যাসের প্রাজ্ঞতা, গবেষণার দক্ষতা, ভাষার পাণ্ডিত্য, শব্দ চয়নের নিজস্ব সৃষ্টিশীল পারঙ্গমতা- ইত্যাদি আরও অনেক কিছুর শক্তিময়তার কৃতিত্ব।
তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘সাহিত্যে ও সমাজবাস্তবতার ধারা’ গ্রন্থটি পাঠ করে তাঁর সাহিত্যপ্রজ্ঞা সম্পর্কে আমার ধারণাকে আরও উচ্চস্তরে নিয়ে যায়। সাহিত্যের সাথে সমাজের সম্পর্ক এবং সাহিত্য একটি সমাজকে কীভাবে প্রভাবিত করতে পারে, এ বিষয়ে তাঁর চিন্তাধারা তাঁকে একজন বড় মাপের সাহিত্য গবেষক বলে আমার মননে তাঁকে সুদৃঢ়ভাবে অধিষ্ঠিত করে।
এরপর একে একে তাঁর কতগুলো গ্রন্থ পাঠ করলাম। নতুন নতুন আনন্দময় বিষয়বৈচিত্র্যে রচিত। যেমন- ‘মরণরে তুঁহু মম’। এ গ্রন্থটিতে বিশ্বসাহিত্যের বেশ কিছু কবির মৃত্যু উপলব্ধিমূলক কিছু কবিতার উদ্ধৃতি দিয়েছেন তিনি প্রথমে। তারপর দিয়েছেন ওইসব কবিদের পরিচিতি। ‘স্বেচ্ছামৃত্যুর করতলে কবি’ গ্রন্থের বিষয়বস্তু আরও আগ্রহোদ্দীপক। জীবনের প্রতি বিতশ্রদ্ধ হয়ে আত্মহত্যায় জীবন বিসর্জন দিয়েছেন, বিশ্বসাহিত্যের এমন পনেরজন কবি-সাহিত্যিকের আত্মহত্যার কাহিনি এবং রচনাশৈলী বর্ণনা করেছেন তিনি এ গ্রন্থে।
আর একটি মজাদার তথ্য সমৃদ্ধ গ্রন্থ ‘সাহিত্য ও সিংহাসন’। রাষ্ট্রশাসক হয়েও সাহিত্যচর্চায় নিজকে নিয়োজিত রেখেছিলেন, বিশ্বের এমন কয়েকজন খ্যাতিমান ব্যক্তির সাহিত্যচর্চার বিবরণ দিয়ে তিনি রচনা করেছেন এ গ্রন্থটি। এ তালিকায় এসেছে আমাদের দেশের একজন প্রাক্তন রাষ্ট্রনায়কের নামও।
জীবনানন্দ দাশ, শামসুর রাহমান এবং আবুল হাসান- এই তিনজন শক্তিশালী কবির কাব্যপরিচিতি দিয়ে রচিত ‘কবিদের কবি’ গ্রন্থটি তাঁর স্বকীয় গবেষণা চিন্তাশীল কৃতিত্বের দাবি রাখে।
সম্প্রতি বাতিঘর প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত তাঁর লেখা ‘আধুনিক বাংলা উপন্যাসের বিষয় ও স্বরূপ’ গ্রন্থটিতে বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান কয়েকজন ঔপন্যাসিকের সাহিত্যকর্মকে বিশ্লেষণ করেছেন। এসব ঔপন্যাসিকদের মধ্যে অন্যতম- সমরেশ বসু, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, মহাশ্বেতা দেবী, হুমায়ূন আহমেদ, জহির রায়হান, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ প্রমুখ। অনেক অনুশীলন ও গবেষণার ফসল তাঁর এ গ্রন্থটি।
সাহিত্যের অনুশীলন তাঁর সর্বক্ষণের সাধনা- একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। তাঁর যে কোনো লেখা পাঠে এটা বুঝতে পারা যায়, বিশ্বসাহিত্যের একজন একনিষ্ঠ পাঠক তিনি। পাঠক বিশ্বসাহিত্যকে অনুকরণের জন্য নয়, শুধুমাত্র অনুশীলনের জন্য। সহজ ভাষায় বলা যেতে পারে, বিশ্বসাহিত্য সম্পর্কে প্রাজ্ঞতা অর্জন করে নিজের সাহিত্যপ্রজ্ঞাকে সমৃদ্ধ করা। আর এ ব্যাপারে তিনি একজন সফল সাহিত্যসাধক। সাহিত্য ও সংস্কৃতিবিষয়ক সাতক্ষীরার ভাষা ও শব্দকোষ গ্রন্থটি তাঁর নিজস্ব ঐতিহ্যপ্রেমেরই প্রতিফলন।
সফল সাহিত্যিক, সফল সাহিত্য গবেষক হিসেবে তিনি লিখে যাচ্ছেন আপন মনন সাধনায়। এতে করে শুধু তিনি নিজেই সমৃদ্ধ হচ্ছেন না, সমৃদ্ধ হচ্ছে আমাদের সাহিত্যের সৃষ্টিঅঙ্গন।
দোয়া করি, আশির্বাদ করি- অধ্যাপক গাজী আজিজুর রহমানের এ মননশীল সাহিত্যচর্চা অব্যাহত থাকুক আমাদের ভাষার কল্যাণে, জাতির কল্যাণে, জাতীয় সাহিত্য ও সংস্কৃতির কল্যাণে।
লেখক : কবি, ছড়াকার, কনসালট্যন্ট (প্রকাশনা), ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন

গাজী আজিজুর রহমান : সাহিত্য ও শিল্প মানস : শুভ্র আহমেদ
এডওয়ার্ড সাঈদ তার ‘অরিয়েন্টালিজম’ বইয়ে জ্ঞানের সাথে ক্ষমতার সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন জ্ঞান কিভাবে বৈধ সম্প্রসারণের জন্ম দেয়। কিন্তু ড. নিহার রঞ্জন রায় বলেন, ‘অরিয়েন্টালিজম বিশুদ্ধ জ্ঞান প্রকল্প নয়, এটি প্রাচ্যের দুর্বলতা চিহ্নিত করে প্রাচ্যকে নিয়ন্ত্রণের কৌশলও। অধ্যাপক গাজী আজিজুর রহমান সম্পর্কিত আলোচনার সূত্রপাত করার পূর্বেই আরো একটি বিষয়, সেটি অরিয়েন্টালিজমের সাথে জড়িত ‘কেন্দ্র প্রান্তের’ সম্পর্কটাকেও সামান্য বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।
সুপ্রাচীনকাল থেকে পশ্চিমারা নিজেদের প্রবল ও প্রধান এবং প্রাচ্যকে দুর্বল নিষ্ক্রিয় ও অধস্তন ভাবতে আগ্রহী। সে কারণে তারা নিজেদেরকে কেন্দ্র এবং সমগ্র প্রাচ্যকে প্রান্ত বলেই মনে করেন। এডওয়ার্ড সাঈদ অবশ্য মনে করেন এই অরিয়েন্ট বা কেন্দ্রিক মনোভাবের কারণে পশ্চিমা শিল্প, সাহিত্য-রাজনীতি ইত্যাদি সম্ভাবনাহীন হয়ে পড়বে অন্যদিকে প্রান্ত বা অক্সিডেন্ট অপূর্ণ তাই সম্ভাবনাময় এবং সেই কারণেই প্রাচ্যের শিল্প-সাহিত্য-রাজনীতির অস্থিরতা সত্ত্বেও তার বিকাশ অপরিহার্য।
‘কেন্দ্র প্রান্তের’ এই সম্পর্কটিকে ঢাকা, কলকাতাকেন্দ্রিক সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রেও প্রবল ও প্রধান হয়ে উঠতে দেখি, এমনকি স্বাধীনতা অর্জিত হওয়ার পরও।
‘কেন্দ্র প্রান্তের’ এই সম্পর্কটিকে উল্টিয়ে দিয়ে, সাহিত্যের বিচিত্র বর্ণালীতে সজ্জিত হয়ে, মুক্তিযুদ্ধ, ভাষাকেন্দ্রিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের সাথে মার্কসীয় মানবিকতার দ্বান্দ্বিক সমন্বয় সাধন করে বহুভাষিক সমাজ সাংস্কৃতিক ইতিহাস ও রাজনীতির পাঠ গ্রহণের পর আন্তঃসাংস্কৃতিক সম্পর্ক স্থাপন এবং জ্ঞানকেন্দ্রিক ক্ষমতার নিপুণ প্রয়োগে মফস্বলে চিরন্তন বসবাসী হয়েও নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিম-ল গড়ে তোলেন গাজী আজিজুর রহমান। গাজী আজিজুর রহমান পেশায় অধ্যাপক, বিষয় বাংলা। কালিগঞ্জ মহাবিদ্যালয়ে দীর্ঘ অধ্যাপনার পর এখন অবসরে। তারপরও দেখি তার অঞ্চলের প্রাগ্রসর চিন্তার মানুষ বিশেষত তরুণেরা সর্বক্ষণ তাকে ঘিরে থাকে। এইসব ঘিরে থাকা মানুষের দলে ছাত্র-ছাত্রী এবং অছাত্র-অছাত্রীর প্রভেদ জটিল।
গাজী আজিজুর রহমানের জন্ম ১৯৪৭ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর। ভারতের দার্জিলিংয়ে। কৈশোরিক পড়াশোনা ঢাকায়। মাঝখানে কিছুদিন সাতক্ষীরা ও খুলনার স্কুল-কলেজে কাটিয়েছেন বিদ্যায়তনিক শিক্ষার অন্বেষায়। এরপর জগন্নাথ কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে পড়া ও লেখার সার্বক্ষণিক প্রতিবেশী হয়ে উঠেছিলেন কবি আবুল হাসান, কবি মাকিদ হায়দার, কবি জাহাঙ্গীর হাবিবউল্লাহ, কবি নির্মলেন্দু গুণ, আব্দুল মান্নান সৈয়দ, বুলবুল চৌধুরী, শাহরিয়ার কবির প্রমুখ।
অধিকাংশ বাঙালি যুবক/তরুণের মতো কবিতা দিয়ে লেখালেখির ডুব সমুদ্রে গাজী আজিজুর রহমানের আবির্ভাব হলেও বিশুদ্ধ জ্ঞান ও দর্শনের অসহ্য অভিঘাতে তিনি বেশিদিন কবিতাচর্চায় নিমগ্ন থাকেননি। মাঝখানে কিছুদিন উপন্যাস ও নাটক রচনায় সার্থকতা অর্জনের প্রচেষ্টার মধ্যে শক্ত, কঠিন, বস্তুবাসিত, মনন-মেধা-জ্ঞান-মস্তিষ্ক নির্ভর গদ্যের হিরোকোজ্জ্বল আলোকছটায় আত্মাহুতি দিয়ে প্রায় সার্বক্ষণিক গদ্য বিশেষ করে প্রবন্ধচর্চায় নিমগ্ন হতে দেখি তাঁকে।
বাংলার প্রকৃতি ও মাটি গদ্যের চেয়ে পদ্যের মঞ্জরি ফোটাতেই হয়তো বেশি আগ্রহী, তাই হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির বিশ্লেষণে দেখা যায় গদ্যের চেয়ে কবিতাই এখানকার মানুষকে অনেক বেশি আলোড়িত ও আলোকিত করে। তা সত্ত্বেও গাজী আজিজ গদ্যের প্রতিই অনুভব করলেন তীব্র আকর্ষণ। গদ্যের প্রতি গাজী আজিজুর রহমানের এই আকর্ষণের দুটি কারণ সনাক্ত সহজযোগ্য:
এক. সাতক্ষীরার সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য চিত্রিত করতে গিয়ে তিনি দেখতে পেয়েছেন, সাতক্ষীরায় প্রকৃত পদ্য/কবিতার চেয়ে গদ্যের চর্চা বেশি হয়েছে। তার কাছে এটি বাংলাদেশের অন্য যে কোনো অঞ্চলের চেয়ে ব্যতিক্রম বলেই মনে হয়েছে। আর এজন্যই তিনি গদ্যচর্চায় মনোনিবেশী হতে চেয়েছেন।
দুই. গদ্যের বিশেষ করে প্রবন্ধে জ্ঞান-বিজ্ঞান, ধর্ম-দর্শন, মনস্তত্ত্ব, সমালোচনা-তুলনা-প্রতিতুলনা, রাজনীতি-অর্থনীতি- বৈশ্বিক চেতনা ইত্যাদি চর্চা, বিচার বিশ্লেষণের যে অপার সম্ভাবনা তৈরি করা সম্ভব সেটি সাহিত্যের অন্য শাখায় সার্থকভাবে হয়ে ওঠে না। আবেগসর্বস্বতা ও ভাবুকতার চেয়ে যেহেতু যুক্তি ও দ্বান্দ্বিকতা গাজী আজিজের অধিক পছন্দের বিষয় তাই তিনি গদ্যচর্চায় সকল অশৈল্পিক ভার থেকে নিজের মুক্তি খুঁজেছেন। উপরোক্ত সত্যের দায় এড়াতে চান না বলেই তার প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে প্রবন্ধ সাহিত্যের প্রাধান্য সুস্পষ্ট পরিলক্ষিত হয়। তাঁর অধিকাংশ প্রবন্ধই গবেষণাধর্মী ও সাহিত্যনির্ভর।
তার প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ
উপন্যাস : বজ্রের বাঁশি (১৯৮৯), যোদ্ধার যতুগৃহ (১৯৯০),
নাটক : কালো সূর্যের নীচে (১৯৯১), সক্রেটিস (১৯৯৩), চন্দ্রাবতী (রেডিওতে প্রচার ২ ডিসেম্বর ১৯৯৫)
প্রবন্ধ : সাহিত্যে সমাজ বাস্তবতার ধারা (১৯৯২), স্বেচ্ছামৃত্যুর করতলে কবি (১৯৯৬), সাহিত্য ও সিংহাসন (১৯৯৯), নোবেল সাহিত্য পুরস্কারের শতবর্ষ (২০০১), আধুনিক বাংলা উপন্যাসের বিষয় ও শিল্পরূপ (২০০৯), কবিদের কবি (২০১০), স্বদেশ ভাবন ও বঙ্গবন্ধু (২০১৬)।
গবেষণা গ্রন্থ : কালীগঞ্জের ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধ (২০১৪), সাতক্ষীরার ভাষা ও শব্দকোষ (২০০৪), এস এম হারুন-উর-রশিদ-এর সাথে যৌথভাবে লিখিত।
সম্পাদনা : মরণ রে তুঁহুঁ মম (১৯৯৮), খান আনসারু-উদ্-দীন আহমেদ রচনাবলী ১ম খ-।
পত্র-পত্রিকা : হরফ (১৯৭৮), উদিত দুঃখের দেশ (১৯৯০), একুশের সংলাপ (১৯৯১), নদী (১৯৯২), জল পড়ে পাতা নড়ে (১৯৯৮) প্রভৃতি।
গাজী আজিজুর রহমানের প্রকাশিত ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা ১৬টি। তবে লক্ষণীয়, এর মধ্যে মাত্র ১টি (সম্পাদিত) গ্রন্থ কবিতার। এ থেকে কবিতার চেয়ে গদ্যের প্রতি তার অনুরাগ যে বেশি সেটি বোঝা যায়। যদিও তার লেখালেখির হাতেখড়ি কবিতায় এবং ইতস্ততঃ তার ছড়িয়ে থাকা কবিতার সংখ্যাও একেবারে কম নয়। কবিতায় তিনি তার কবিবন্ধু আবুল হাসান, মাকিদ হায়দার, জাহাঙ্গীর হাবিবউল্লাহ প্রমুখের সগোত্রীয় ও সমকক্ষ না হলেও মফস্বলের হাটে কবিতার সওদাগরী অনেকের চেয়ে তার কবিতা ভাবের ব্যঞ্জনায়, বিষয়বস্তুর বিচিত্রতায়, শব্দের কুশলী প্রয়োগে উজ্জ্বল। কবিতাচর্চায় অধিকতর মনোনিবেশ না করা এবং শিল্পোত্তীর্ণ কবিতা রচনার অক্ষমতায় বিব্রত কবি গাজী আজিজুর রহমানের স্বীকারোক্তি, ‘কবিতা কি, এ বিষয়টি বুঝতে পারার পরপরই অনুভব করি কবিতা লেখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়’। তবু গাজী আজিজুর রহমানের ছড়ানো ছিটানো কবিতায় তার প্রিয় কবি ব্যক্তিত্ব কবি এসেনিন, র্যাবো, ডিলান টমাস, কিংবা শক্তি চট্টোপাধ্যায়, নির্মলেন্দু গুণ এমনকি তার কবিবন্ধু জয়শ্রী জীবনের সন্তু কবি আবুল হাসানের মতোই দ্রুতিময় পংক্তি কখনো কখনো আমাদের চমকিত করে।
‘তবু ট্রয়লাস পেয়েছিল পেন্ডারার একান্ত সহানুভূতি
আমরা কি পেয়েছি তাও আমার বিরূপ জন্মে
তবু প্রেম ছিল নোরার ক্রন্দসী বক্ষ জুড়ে
ওফেলিয়ার নিঃশব্দ ক্রন্দন শব্দমান কান্নাকে ছাপিয়ে
পদ্ম গোখরার মতো এড়িয়ে চলি। পিঞ্জিরার পাখি
রক্তমাখা ঠোঁটে খুঁটে খায় শহুরে ক্লেদ।১
তবে কবিতা শিল্পের জটিলতা নিরসনে তার অব্যাহত প্রচেষ্টা পরবর্তীকালের সাহিত্যকর্মীদের প্রাণিত করবে বলেই মনে করি।
শিল্পের প্রতি প্লেটোর বিরূপ ধারণাকে অগ্রাহ্য করে ধ্রুপদী আদর্শের অনুসরণের মাধ্যমে অ্যারিস্টটলই (২৫৭-১৮০ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দ আনুমানিক) প্রথম সাহিত্যচিন্তার যুক্তিগ্রাহী ও সুস্পষ্ট বিশ্লেষণ দাঁড় করান। ‘তিনিই সমালোচনা পদ্ধতির জনক।’২ অন্যদিকে সমাজ উপলদ্ধির মাধ্যমে সাহিত্য নির্মাণের বিষয়টি প্রথম গুরুত্বের সাথে বিবেচনা শুরু করেন ভিক্টোরীয় সমালোচকবৃন্দ। এই সময়ের একজন প্রখ্যাত সমালোচক ম্যাথু আর্নন্ডের কাছে সৌন্দর্য ও শিল্পকলা হলো অধিবিদ্যা এবং ধর্মের বিকল্প।
চর্যাপদ, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, মঙ্গলকাব্য, রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান, পুথি ইত্যাদিতে বাঙালির সাহিত্য কৃতী ও সাহিত্যচিন্তার উল্লেখযোগ্য অনেক বিষয় লিপিবদ্ধ থাকলেও ‘যথাবিহিত সাহিত্যচিন্তার শুরু মূলত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের এতদসম্পর্কিত আলোচনা থেকে’৩। ‘সৌন্দর্য ও মনুষ্যত্ব’ ছিল বঙ্কিমের আদর্শ। সুন্দর-আনন্দ-কল্যাণেই সাহিত্যের সিদ্ধি এই সত্যকে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলা সাহিত্যের সিদ্ধিদাতা গণেশ বিশ্বজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মোহিতলাল ও নজরুল রবীন্দ্রবলয়ের বাইরে কল্যাণ ও সমাজবাদী সাহিত্যচিন্তার পৃথক একটি ধারা গড়ে তোলেন। বিবিধ শিল্প দর্শন উপভোগে পারঙ্গম আবু সয়ীদ আইয়ুব কল্যাণমুখী সৌন্দর্র্যই চিরন্তন বলে মনে করেন। মার্কসবাদী সাহিত্যচিন্তায় আস্থাশীল হলেও গাজী আজিজুর রহমানের সাহিত্যচিন্তার সাথে ম্যাথু আর্নন্ড, মোহিতলাল, কাজী নজরুল প্রমুখের সাহিত্য ভাবনার সুস্পষ্ট মিল পরিলক্ষিত হয়। তাঁর ভাবনার বিস্তার ও দৃষ্টিভঙ্গির সাথে শিখা গোষ্ঠীর মিল লক্ষ্যণীয়। তবে এসব এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে তিনি পুরাতনকে অতিক্রম করে নতুনের সন্ধানে ব্রতী হন। জীবন ও ধর্ম বিষয়ে তার ভাবনা কুসংস্কার ও গোঁড়ামিমুক্ত এবং নাস্তিকতার সীমায় করাঘাত করলেও সীমানা অতিক্রম করে না। ‘ধর্মের প্রতিষ্ঠা দেখি অসির ডগায়, রক্তপ্রপাতের গাঢ় রঙে। আর জীবনের প্রতিষ্ঠা দেখি হৃদয়ের প্রফুল্ল বিন্যাসে, আরক্ত প্রেমানুভবে। জীবন সত্য হয়ে ওঠে সৌন্দর্যে ভালোবাসায় প্রেমে। আর ধর্মসত্য ওঠে অন্তঃগূঢ় মানসলোকে আত্মবিলোপে। জীবনের আবেদন সার্বজনীন। ধর্মের আবেদন গোষ্ঠী, গোত্র কিংবা সম্প্রদায় বা শ্রেণীর মানচিত্রে’৪।
গাজী আজিজুর রহমানের লেখার মধ্যে প্রসারিত শিল্পদৃষ্টি ও সংস্কৃতি চেতনার উন্মেষ ও বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। সাহিত্য বিষয়ক আলোচনাও তাই অনেক সময় শুধু সাহিত্যে সীমাবদ্ধ না থেকে শিল্পের সকল শাখায় তা প্রসারিত হয়। এই প্রসারণ ঘটে সঙ্গীত, চিত্রকলা, নাটক থেকে চলচ্চিত্র পর্যন্ত। গাজী আজিজুর রহমান ভাষা ও মননে আধুনিক। এ সম্পর্কে আবুল কাসেম ফজলুল হকের অভিমত, ‘অধ্যাপক গাজী আজিজুর রহমানের ভাষা অত্যন্ত আধুনিক। তার লেখার সাহিত্য ও শিল্পকলার প্রতি অনুরাগের প্রকাশ আছে, অনুসন্ধিৎসা ও চিন্তাশীলতার পরিচয় আছে, বিশ্বাস এবং আবেগ আছে। জনগণের প্রতি ভালোবাসা এবং যুক্তিকামী মানুষের মুক্তিচেতনা তার লেখার অন্তর্গত চালিকাশক্তি।’৫ গাজী আজিজুর রহমানের প্রথম প্রবন্ধের বই সাহিত্যে সমাজবাস্তবতার ধারা। মার্কসবাদী শিল্পতাত্ত্বিক প্লেখানভ, কডওয়েল, লুকাচ প্রমুখ শিল্পতাত্ত্বিক শিল্পের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে যে সমস্ত সংজ্ঞা ও প্রস্তাবনা পেশ করেছেন সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা, নাটক বা চলচ্চিত্রে সে সবের উদ্বোধন সমাজবাস্তবতা ধারার সাহিত্য বলে চিত্রিত করার চেষ্টা লক্ষিত হয় গ্রন্থটিতে। প্রায় শতাধিক বছরের মানুষের ইতিহাস ও মানুষের রচিত ইতিহাসের আলোকদীঘি মন্থন করে বিশ্বসাহিত্য ও শিল্প থেকে কুড়িয়ে এনেছেন তার দরকারি নির্মাণ সামগ্রী। আর এভাবে সমাজবাস্তবতা ধারায় সাহিত্যের বিশাল ইমারতটি নির্মাণের পথে আক্রান্ত হয়েছেন স্ববিরোধিতা ও আংশিক যুক্তিহীনতায়। ফরাসি বিপ্লব, বলশেভিকদের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব-প্রতিবিপ্লব, রামায়ণ-মহাভারত-ইলিয়ড-অডিসি ইত্যাদি গ্রন্থের আলোচনা, আইনস্টাইন-বেগর্স, কার্লমার্কস-মাওসেতুং-রবীন্দ্রনাথ-রমা রঁল্যা প্রমুখের চিন্তাজগৎ এবং রুশ, মার্কিন, ফ্রেন্স, জার্মান, ইংল্যান্ড, বাংলা প্রভৃতি সাহিত্যের প্রায় সকল প্রধান পুরুষদের মার্কসবাদী বিশ্লেষণের সবিশেষ চেষ্টার পরও সাহিত্যে সমাজবাস্তবতার ধারা গ্রন্থটি গাজী আজিজের মননবিশ্বের চূড়ান্ত সঠিক অথবা সম্পূর্ণ শক্তির প্রকাশ নয়।
গ্রন্থটিতে দাসভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা থেকে সাম্যের পথে উত্তরণের সামাজিক অভিঘাতটিকে অগ্রাহ্য করে কার্ল মার্কসের মধ্যে মুক্তির সীমানাটিকে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। আর এ কারণে গ্রন্থটিতে রবীন্দ্রনাথও দোষী সাব্যস্ত হন প্রলেতারিয়েত সাহিত্য বা সমাজবাস্তবতা সাহিত্যের ধ্বংসকারী হিসেবে। ‘শিল্পের জন্য শিল্প এই প্রস্তাবের স্বপক্ষে ক্রোচে, ফিশার, রবীন্দ্রনাথ, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় ইত্যাদি বিশ্ববিখ্যাত নন্দনতাত্ত্বিকেরা যুগ যুগ এই তত্ত্বের সপক্ষে বিস্তর প্রচারণা চালিয়ে বুর্জোয়া স্বার্থের স্বার্থরক্ষা করে চলেছে এবং সমাজবাস্তবতার সাহিত্যিকদের অন্তরে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের বীজ বপন করে চলেছেন। প্রলেতারিয়েত সাহিত্য এভাবেই মার খাচ্ছে বুর্জোয়া সাহিত্যের হাতে’।৬ অথচ উচ্চবিত্ত ও অভিজাত সম্প্রদায়ের ছবি আঁকার পর কিংবা স্বৈরাচার ও সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে লেখনী পরিচালনার পরও ফরস্টার, জয়েস, ওস্কার ওয়াইল্ড, পাউন্ড, এলিয়টের প্রতি তিনি সহানুভূতিশীল। ‘ফরস্টার, জয়েস, অস্কার ওয়াইল্ড, পাউন্ড, এলিয়টকে একেবারে সমাজ উদাসীন ও জীবন বিমুখ বলা যাবে না। বরং বলা যায় শিল্পের প্রতি অত্যাধিক দুর্বলতাবশত সমাজ সভ্যতার প্রতি পরিপূর্ণ ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনে তারা ব্যর্থ হয়েছেন।৭ গ্রন্থটিতে সমাজ ও সাহিত্য বিকশিত হওয়ার যে সম্ভাবনা তৈরি করে তা শেষ পর্যন্ত অধরাই থেকে যায়। সাহিত্যে সমাজ বাস্তবতার ধারা গ্রন্থটি শেষ পর্যন্ত তাই টেরি ঈগলটনের ‘মার্কসবাদ ও সাহিত্য সমালোচনা’৮ কিংবা জর্জ টমসনের ‘মার্কসবাদ ও কবিতা’র৯ মতো মার্কসবাদী সাহিত্যের প্রচার পুস্তিকায় রূপ নেয়।
বিষয়বস্তুর অভিনবত্বে, স্বতন্ত্র গদ্যভাষার সুদক্ষ প্রয়োগে, বিপুল পঠনের সমারোহে এবং সিনথেসিস ক্ষেত্রের আত্মীকরণে গাজী আজিজুর রহমানের ২য় প্রবন্ধের বই স্বেচ্ছামৃত্যুর করতলে কবি একই সাথে লেখককে দিয়েছে প্রবন্ধ সাম্রাজ্যে এক টুকরো পবিত্রভূমি ও অমরত্বের হাতছানি। পরবর্তী প্রবন্ধের বই সাহিত্য ও সিংহাসন (সহ লেখক অমিতাভ চক্রবর্তী) এই প্রত্যয়কে প্রতিষ্ঠিত করতেই রচিত।
মৃত্যুর বহু রকমফেরের মধ্যে আত্মহনন/আত্মহত্যা আমাদের নিত্য পরিচিত। আত্মহত্যা অপরাধ হলেও এর সুষ্ঠু সংঘটনের মধ্যেই রোপিত আছে এই অপরাধ থেকে নিষ্কৃতির একমাত্র পথ। বিষয়টি পার্থিব সকল বিষয়ের মধ্যে ব্যতিক্রম।
জীবনের প্রতি দুর্জেয় ভালোবাসা মানুষের সহজাত। মানুষ শত সংকটেও বাঁচতে চায়। তবু কেউ কেউ স্বেচ্ছামৃত্যুর মায়াবী হাতছানি উপেক্ষা করতে পারে না। চলে যায়, না ফেরার এক রহস্যময় দেশে। প্রাবন্ধিক একে বলেছেন সোনালি ফাঁসে সোনার মাছি। আর এই ফাঁস নির্মাণকারী কবি তার চোখে ট্রাজেডির রাজা। তবে তাদের সংখ্যা শেষ পর্যন্ত স্বল্পই থেকে যায়। এই স্বল্প ক’জন ‘কোন অমৃত পিয়াসী দেবত্ব অভিলাষী’ তারই সন্ধান করেছেন লেখক স্বেচ্ছামৃত্যুর করতলে কবি নামক গ্রন্থে। তবে শেষ পর্যন্ত তার দৃষ্টির তীর নিবদ্ধ হয়েছে আত্মঘাতী কয়েকজন কবির জটিল মনোলোক ও তাদের স্বেচ্ছামৃত্যুর নান্দনিক আয়োজনের পরাবাস্তব চিত্রে। কবিদের এই নাতিদীর্ঘ তালিকাটির আয়োজন প্রাচ্য-প্রতীচ্যের মেলবন্ধে মহাদেশ মহাকাল নির্বিশেষে। নির্মোহতার উদাহরণ সৃজনে তাই টমাস চ্যাটারটন (১৭৫২-১৭৭০) থেকে এ কে এম আহমদ উল্লাহ পর্যন্ত সকলে বেড় পড়েন গাজী আজিজের মনন ছাকনির অদৃশ্য কাঠামোয়। যাদের নিয়ে গাজী আজিজের আয়োজন তারা হলেন উপরোক্ত দু’জন ছাড়াও সের্গেই এসেনিন (১৮৮৫-১৯২৫), ভøাদিমির মায়াকভস্কি (১৮৯৩-১৯৩০) মারিনা ৎসভেতায়েভা (১৮৯২-১৯৪১), হার্ট ক্রেন (১৮৯৯-১৯৩২), সিলভিয়া প্লাথ (১৯৩২-১৯৬৩), অ্যান সেক্সটন (১৯২৮-১৯৭৪) জেরার দ্য নের্ভাল (১৮০৮-১৮৮৫) গেঅর্ক ট্রাকল (১৮৮৭-১৯১৪) জেন জোসেফ র্যাবিয়েবিভেলা (১৯০১-১৯৩৭), আশরাফ আলী খান (১৯০১-১৯৩৯), ফজল মাহমুদ (১৯৫৫-১৯৭৮), সুনীল সাইফুল্লাহ (১৯৫৭-১৯৮২) প্রমুখ। গাজী আজিজ তাঁর কলমের তীক্ষ্ম আঁচড়ে উপরোক্ত কবিগণের জীবন জটিলতার সংক্ষিপ্ত বয়ান উপস্থিত করেছেন যেখানে আমরা সন্ধান পাই কবির সময়, মনন, ব্যথা, বিরহ, হতাশা থেকে আরো অনেক কিছু। আত্মহত্যার সুনির্দিষ্ট কারণ এর ফলে শনাক্ত হয় না বটে তবে কবি হয়ে ওঠেন আমাদের পড়শি এবং তাঁদের মৃত্যুতে আমরাও হয়ে পড়ি শোকাতুর এবং একাত্ম হই প্রাবন্ধিকের সত্য উপলদ্ধির সাথে, ‘আমাদের করতলের ফাঁক গলে অনেক জল গড়িয়ে পড়েছে ঊষর ভূমিতে। আর না। আর একটিও স্বেচ্ছা বলিদান চাই না। আবেগই সত্যি। যুক্তি আর তর্কেই সব মীমাংসা নয়। সত্য হচ্ছে মিলে মিশে থাকা। আমৃত্যু সত্য ও সুন্দরের জন্য সংগ্রাম করা। ঈশ্বরিত হওয়া’১০।
গ্রন্থের প্রথম তিনটি অধ্যায় যথাক্রমে ক. জীবনের চেয়ে সুস্থ্য মানুষের নিভৃত মরণ, খ. যে উৎসে আমার উৎসার গ. ফিরে আসতে চাই, ফেরার পথ নেই। এই তিনটি অধ্যায়ে গাজী আজিজের বক্তব্য ক্লাসিকধর্মী, সমাজতত্ত্বের পটভূমিতে, দার্শনিক বিতর্কের শীর্ষে, চিকিৎসা ও মনোবিজ্ঞানের সামান্য ছোঁয়ায় প্রজ্ঞাপিত। তবে সবকিছুর মধ্যে সবকিছুকে ছাড়িয়ে রয়েছে সাহিত্য এবং সাহিত্যের মধ্যে বেঁচে থাকা ইতিহাস-ঐতিহ্য-পুরাণ-ধর্ম। ইউরোপীয় রেঁনেসার অগ্নি উত্তাপে ফিনিক্স পাখিটির মৃত্যু হলে নবজন্ম লাভকারী নব্য ফিনিক্সটির ডানায় যে নব ঝড় উঠলো সেই প্রবল ঝড়ে ভূ আলোড়িত হলো যেমন বিশ্ব চৈতন্য তেমনি ব্যক্তি বিশ্বের চিৎ চৈতন্য। কবি ভেঙে ফেললেন তার আত্ম অচলায়তনের দুর্গ, ভাঙলেন সমাজ অচলায়তনের দুর্গকেও ছুটি পাওয়া নটীর মতো মুক্ত হলেন কবি।১১ অসম্ভব নিপুণতায় গাজী আজিজ একাধিক কবির মৃত্যু মুহূর্তকে বিমূর্ত করে তুলেছেন। নাটকীয়তার হাতছানি সত্ত্বেও সেটি যেমন বিশ্বাসযোগ্য একটি উপস্থাপন শেষ পর্যন্ত তেমনি তা আমাদের সক্রেটিসের মৃত্যু দৃশ্যকেও স্মরণ করিয়ে দেয়।
সাধারণের বিজ্ঞান অমনস্কতা বা বিজ্ঞানের জটিল সূত্র না বোঝার দায় সাধারণের নয়। কিন্তু কবিতার ক্ষেত্রে পাঠকের যাবতীয় অক্ষমতা আর বস্তুবিশ্বের চেয়ে কল্পনার ভাবজগতে কবিদের বিচরণ এমন দুটি অনার্য দায় মাথায় নিয়ে কবিদের পথ চলা।
প্রতিভা ও জ্ঞান কবিদের দুই প্রধান শক্তি হওয়ার পরও প্লেটোর সময় থেকেই কবিদের রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে সরিয়ে রাখার প্রচেষ্টা লক্ষণীয়। কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলেও আজও অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। ‘সাহিত্য ও সিংহাসন’ গ্রন্থে কবিদের দেখা হয়েছে মানুষের জয়গানে মুখর, স্বপ্নবিলাসী, স্বাধীনচেতা ‘ঈশ্বরিত প্রায় স্বয়ম্ভু শক্তি’১২ হিসেবে। প্রায় ৭০ জন কবি/গদ্য শিল্পীর সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত রূপরেখা, তাদের জীবন ও মনোজগতের অজ্ঞাত ধূসর অধ্যায়ের উন্মোচন, রাষ্ট্র, রাষ্ট্রনেতা, ধর্মব্যবসায়ী, সামন্ত, সৈনিক, আমলা, প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সাথে তাদের সম্পর্ক, সংঘাত, সংঘাতের পরিণতি এবং ক্ষেত্র বিশেষে রাষ্ট্র/শক্তির শীর্ষে আরোহণ ও তার অনুশীলন ১০৩ পৃষ্ঠায় ক্ষুদ্রকার গ্রন্থটির মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। বিশ্বসাহিত্য সম্পর্কে অগাধ জানাশোনা না থাকলে এমন গ্রন্থের রচনাতো দূরের কথা পরিকল্পনাও সম্ভব নয়। গ্রন্থটির নিবিড় পর্যবেক্ষণের পর গাজী আজিজুর রহমান যে এ বিষয়ে প্রকৃতই পারদর্শী একজন ঋদ্ধ ব্যক্তি সে বিষয়ে সন্দেহ থাকে না।
নোবেল সাহিত্য পুরস্কারের শতবর্ষ শীর্ষক গ্রন্থে গাজী আজিজুর রহমান ১০০ বছরের নোবেল সাহিত্য পুরস্কারের বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করেছেন। গ্রন্থটি দুটি পর্বে বিভক্ত। গ্রন্থটির ১ম পর্ব গ্রন্থটির ভূমিকায় উল্লেখিত লক্ষ্য উদ্দেশ্যের সাথে অধিক সঙ্গতিপূর্ণ। নোবেল সাহিত্য পুরস্কার ও একটি পর্যালোচনা শিরোনামের আলোচ্য অংশটি ৮টি স্বতন্ত্র উপশিরোনামে বিভক্ত। বিশ্ব বিজ্ঞান ও মানব সভ্যতার ইতিহাসে স্যার আলফ্রেড নোবেল (১৮৩৩-১৮৯৬)-এর অবদান চিরস্মরণযোগ্য হলেও নোবেল পুরস্কার নামক কীর্তিস্তম্ভের আড়ালে তিনি সাধারণে হারিয়ে গেছেন। মানবজাতির কল্যাণে তার চিন্তা-কর্মের প্রকৃত স্বরূপটি কেমন ছিল, সে সম্পর্কে যেমন লেখক আমাদের জানাতে প্রাণিত হয়েছেন তেমনি তাঁর (নোবেলের) চিন্তা কর্মের সাথে বর্তমানের নোবেল পুরস্কার প্রদান কমিটির চিন্তা-কর্মের অসঙ্গতির দিকটি বেশ জোর দিয়ে দেখিয়েছেন। তিনি তার আলোচনা, মতামত, চিন্তা-কর্মের অসঙ্গতির বিষয় প্রধানত সাহিত্য পুরস্কার বিষয়ে সীমাবদ্ধ করেছেন এ বিষয়ে পুরস্কার নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কারের একটি সাহসী রূপরেখা তুলে ধরেছেন।১৩ তার প্রস্তাবিত সংস্কারসমূহের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, প্রতি মহাদেশ থেকে ২ জন করে মোট ১২ জন (এন্টার্কটিকাকে বাদ দেয়া হয়েছে যেহেতু সেখানে মানুষের স্থায়ী বসতি নেই) এবং নোবেল একাডেমির ৬ জন-সহ মোট ১৮ জনকে নিয়ে গঠিত কমিটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পুরস্কারের বিষয়টি চূড়ান্ত করবেন। বিশ্লেষণের একাধিক পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে নোবেল পুরস্কার, পুরস্কার প্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ তাদের ভাষা ও ভাষিক অঞ্চল ইত্যাদি সম্পর্কে খুঁটিনাটি অনেক কিছুর সন্ধানে সমৃদ্ধ আলোচ্য গ্রন্থটি।
গাজী আজিজুর রহমানের শিল্পমানস আধুনিক এবং সংগ্রামী মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল। বৃত্তকে অতিক্রমের চেষ্টা তার প্রতিটি লেখায় সহজে শনাক্তযোগ্য। রাষ্ট্রযন্ত্র, শক্তিকেন্দ্র এমনকি শিল্পের শাসনও তিনি বিনা বিচারে মেনে নিতে রাজি নন। তিনি সবসময় সত্যের মধ্যে থাকতে চান। সত্যের কাছাকাছি হতে চান। তুলনা-প্রতিতুলনার মাধ্যমে চিন্তার বীজটি রোপণ করে তা থেকেই আহরণ করতে চান ডালাভরা সোনালি শস্য। সেজন্যে তার লেখায় বারবার ঘুরে ফিরে আসে কিছু নাম, ইতিহাসের কিছু বিচিত্র-বিনিদ্র ঘটনা। পুনরাবৃত্তির দোষে তার লেখা মাঝে মধ্যে দূষিত হলেও অভূতপূর্ব বাকবিন্যাসে তা অবশ্য শেষ পর্যন্ত পাঠককে ক্লান্ত করে না। আধুনিক বাংলা উপন্যাসের বিষয় ও শিল্পরূপ গাজী আজিজুর রহমানের সৃজনশীলতার অনন্য উদাহরণ। আধুনিক কথাটি এখানে কিছুটা বিস্ময়ের উদ্রেক করে। মূলত গ্রন্থটি একটি বিশেষ সময়াধারে রচিত ১০ জন ঔপন্যাসিকের নির্বাচিত ১০টি উপন্যাসের শিল্পিত আলোচনা। আলোচ্য ১০টি উপন্যাস বাংলা উপন্যাসের প্রতিনিধিত্ব না করলেও সেগুলো বাংলা উপন্যাসের ঐতিহ্যকে দায়বদ্ধভাবে ধারণ করে। শাস্ত্রশাসিত সমালোচনার পদ্ধতি অনুসরণ না করেও সে সৃজনশীল সমালোচনা সম্ভব সেটি গাজী আজিজুর রহমানের আলোচ্য গ্রন্থ পাঠে অনুধাবন করা যায়।
‘উপন্যাস হলো মানুষকে এনলাইটেড করা, আবিষ্কার করা, আমাদের জানার পেছনে অজানাকে জানা, দেখার পেছনে অদেখাকে দেখা, বাস্তবতার অতিরিক্ত বাস্তবকে অবলোকন করা’।১৪ স্বোপার্জিত এই শিল্প সূত্রে গাজী আজিজুর রহমান আলোচ্য উপন্যাসগুলো দেখার চেষ্টা করেছেন। আর এই কারণে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘কাঁদো নদী কাঁদো’, অতীন বন্দোপাধ্যায়ের ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’, মহাশ্বেতা দেবীর ‘অরণ্যের অধিকার’, আবুল বাশারের ‘ফুলবউ’, হোসেনউদ্দীন হোসেনের ‘সাধুহাটির লোকজন’ প্রভৃতি সম্পর্কে লেখকের মতামত নতুনত্বে লালিত।
‘উপন্যাসসমূহের ভাষাশৈলীর বিশ্লেষণ গ্রন্থটির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। উপন্যাসগুলোর শব্দ সম্পদের বৈচিত্র্য, চেতনাপ্রবাহ রীতির ব্যবহার, উপমা উৎপ্রেক্ষা, ছন্দ, অলংকার, প্রবাদ-প্রবচন, প্রভৃতি আলাদাভাবে বিশ্লেষণ করার ফলে পাঠক সহজেই উপন্যাসগুলোর ভাষাশৈলীর ঐক্য/অনৈক্য এবং বিবর্তনের বিষয় সম্পর্কে জানতে সক্ষম হন। একই সাথে তরুণ উপন্যাসের স্বতন্ত্র ভাষা নির্মাণ কতটা জরুরি সে বিষয়েও সচেতন হয়ে ওঠেন।
বাঙালির প্রাত্যাহিক জীবনের সব সংকট, সংগ্রাম, আনন্দ-বেদনায় রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য আমাদের অনুপ্রাণিত ও উজ্জীবিত করলেও আমরা আমাদের সাহিত্য রচনায় রবীন্দ্রভাষা ব্যবহার করি না। অন্যদিকে আমাদের মানস গঠন ও জাতীয় জীবনে জীবনানন্দ দাশের প্রভাব ততোখানি না হলেও গত সত্তর বছর জীবনানন্দের ভাষাই আমাদের সাহিত্যের প্রধান শকট। আন্দোলন সংগ্রামে জেগে ওঠা সাহসী মানুষের আত্মাকে ধারণ করেই শামসুর রাহমানের সাহিত্যিক সাফল্য। আবুল হাসান অসামান্য প্রতিভাধর, সাহসী, সময়ের চেয়ে অগ্রসর ঝিনুকে মুক্তা ফলাতে আগ্রহী। প্রথমত তিনজন পরিণত বয়স পেলেও আবুল হাসান অকাল প্রয়াত। গাজী আজিজুর রহমানের কবিতা বিষয়ক সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্থ কবিদের কবি সেখানে জীবনানন্দ দাশ, শামসুর রহমান ও আবুল হাসানের কবিতা ও কবিত্রয়ের মননবিশ্ব অসামান্য দক্ষতায় আলোচিত হয়েছে গাজী আজিজুর রহমানের আধুনিক, প্রাঞ্জল, তুলনামূলক বিশ্লেষণী ভাষায়। ‘কবি’ এবং ‘কবিদের কবি’ এই শব্দ দুটির সীমানা নির্ধারণ গ্রন্থটির সবচেয়ে বড় সংকট। সেই সংকট নিরসনে গাজী আজিজুর রহমান স্বীকার করলেন, ‘বাংলা ভাষায় প্রথম কবিদের কবি রবীন্দ্রনাথ। তাঁর বিশ্বলোকে, স্বপ্নালোকে, কল্পলোকে, কাম্যালোকে আবর্তিত হলো অসংখ্য গ্রহ-নক্ষত্র কবি।’১৫ অন্যদিকে রবীন্দ্রবৃত্ত ভেঙে আপন আলোয় পথ দেখলেন ও দেখালেন জীবনানন্দ দাশ। ‘বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে তার উৎপাদিত শস্য খুঁটে খুঁটে খেয়ে সব কবিই হয়েছেন গর্ভবতী। তাঁর হৃদয় নিংড়ানো রক্তকণা, বিষকণা, দীর্ঘশ্বাস, দুঃস্বপ্ন ও শিল্পের আশ্রয়ন্তে হননি এমন কবি অর্ধ শতকেই বিরল।’১৬ গত ৭০ বছর জীবনানন্দের শিকলে বাঁধা এইসব কবিদের কবিতায় তাই ইতিহাস-ঐতিহ্য-পুরাণ-কিংবদন্তি, প্রেম-প্রকৃতি, বাস্তব-পরাবাস্তব, চেতন-অবচেতন-নিশ্চেতন, প্রতীক উপমা সবই জীবনানন্দকেই ক্রমাগত স্মরণ করিয়ে দেয়। জীবনানন্দের প্রতিবিশ্ব রবীন্দ্র বিশ্ব থেকে আলাদা। আর এই দুই বিশ্বে বসবাসকারী কবিদের সংখ্যাও কম নয়। তাই এই দুজন কবিদের কবি।
যে কোনো তুচ্ছ ঘটনাকে অসামান্য কবিতায় রূপদানের প্রলয় সমান কবিত্ব শক্তি শামসুর রাহমানের অনায়াস আয়ত্তে থাকলেও তাকে ঘিরে গড়ে ওঠেনি কবিদের মিছিল। সাহসী মানুষের পথ চলার শব্দে তিনি আলোড়িত হয়েছেন, আপন আলোয় পথও চলেছেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে অনুকরণ, অনুসরণ ছিল অসম্ভব। কারণ তার অসম্ভব সফল কবিতাগুলোর সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের জাতীয় জীবনের সামাজিক রাজনৈতিক আলোড়িত আলোচিত ঘটনাবলীর প্রগাঢ় সম্পর্ক।
‘সব ভাল কবিতাই আমার কবিতা’১৭ এরকমই শিল্পবিশ্বাস নিয়ে আবুল হাসান এগোতে চেয়েছিলেন। আবুল হাসানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কে গাজী আজিজুর রহমানের অভিমত, ‘প্রথম কাব্যের কবিতায় কবি খুব আবেগতাড়িত, রোমান্টিক, অভিমানী, স্মৃতি সংরক্ত… ভাষা ও কর্মের দিক থেকে আবুল হাসান যেমন পূর্বজের বৃত্তকে ভেঙেছিলেন তেমনি আবার জীবনানন্দসহ উত্তর তিরিশের অনেক কবির কল্পনা চেতনা ও ভাষাকে জোড়াতালি দিয়ে কিউবিস্টদের মতো নির্মাণ করেছিলেন সার্থক এক চিত্রকর্ম।’১৮ পৃথক পালঙ্কের কবিতা যদিও গাজী আজিজের মতে ‘খুব স্পষ্ট নগ্ন এবং বিষয় শিল্পে জটিল, তবু তার পরিণতি সার্থকতা খুঁজে পেয়েছে এমনটি তিনি দেখাতে চাননি। আবুল হাসানের কবিতাকে তাই নির্মাণ প্রতিনির্মাণ সম্ভব নয়। আর এজন্য ১০টি অধ্যায়ে বিভক্ত হাসানের কবিতার পক্ষে জোরালো অভিশংসনের পরও পাঠক হয়তো দ্বিধাগ্রস্তই থেকে যাবেন কবিদের কবি এই অভিধা আবুল হাসান এবং শামসুর রাহমান বহনে পারঙ্গম কিনা?
তবে আলোচ্য গ্রন্থটিতে শামুসর রাহমান ও আবুল হাসানের কবিতার অনেকগুলো নতুন দিক উন্মোচিত হয়েছে। কবি ও পাঠকের সেতুবন্ধনে গ্রন্থটি পুরোহিতের ভূমিকা পালনে সক্ষম। জীবনানন্দ বিষয়ে তার বিশ্লেষণ আধুনিক তবে ঐতিহ্যের অনুসারী ও প্রথাসিদ্ধ।
গাজী আজিজুর রহমান নাটক রচনা ছাড়াও নাট্যদল গঠন ও নির্দেশনা দান করেছেন। তাঁর নাট্যদল নিয়ে তিনি একদিকে যেমন অস্থায়ী মঞ্চ নির্মাণ করে মফস্বল শহরে নাটক মঞ্চস্থ করেছেন তেমনি নাটকের দল নিয়ে ছুটে গেছেন রেডিওর মতো প্রচার মাধ্যমেও। তাঁর হাতেই কবর নাটকের সার্থক মঞ্চায়নের মাধ্যমে প্রান্তিক মানুষেরা প্রথম অনুধাবন করতে শেখে যাত্রা ও মঞ্চ নাটকের পার্থক্য। গাজী আজিজুর রহমান নাটকের ক্ষেত্রে স্তানিস্লাভস্কির এবং নাট্য সংলাপের স্বর প্রক্ষেপণে শম্ভু মিত্রের নাট্যরীতির অনুসারী তবে তিনি সফদর হাসমির মতোই বিশ্বাস করেন সব নাটকই রাজনৈতিক এবং তা কতকগুলো উদ্দেশ্যেই রচিত, নির্দেশিত ও প্রদর্শিত হতে হবে। নাট্য পরিচালনার ধারায় অমল বোস তাকে প্রভাবিত করেছিল বলে তিনি স্বীকার করেছেন।
গাজী আজিজুর রহমানের লেখালেখির বিষয় বিচিত্র এবং ক্ষেত্রবিশেষে গবেষণাধর্মী। কলকাতা, ঢাকা, সাতক্ষীরা থেকে প্রকাশিত লিটল ম্যাগাজিন এবং জাতীয় পত্র-পত্রিকায় তাঁর প্রকাশিত লেখার সংখ্যা প্রায় তিন শতাধিক। এর বেশির ভাগই প্রবন্ধ, সেগুলো মূল্যবান কিন্তু অগ্রন্থিত।
প্রকাশিত লেখার অসম্পূর্ণ ও সংক্ষিপ্ত একটি তালিকা তুলে ধরা হলো:
ক. দৈনিক পত্রিকা
১. হিমেনেথের কবিতায় গোলাপ, দৈনিক মিল্লাত, ৭ জুলাই ১৯৮৮
২. কালো কবিতা, দৈনিক সংবাদ, অক্টোবর ১৯৮৮
৩. ফরাসি কাব্যের পালাবদলে ১৯ শতকের ভূমিকা, দৈনিক জনকণ্ঠ, মে ১৯৯৩
৪. সাহিত্যে চেতনা প্রবাহ রীতির উদ্ভব ও বিকাশ, দৈনিক জনকণ্ঠ, ১ অক্টোবর
৫. এপিটাফ সাহিত্য, দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকা, ২৩ জুন ১৯৯৪
৬. চিত্রকলা ও সাহিত্য : একটি সাধারণ পাঠ, দৈনিক আজকের কাগজ, ডিসেম্বর ২০০০
৭. সুন্দরবনাঞ্চলের বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর ভাষা সং¯ৃ‹তি, দৈনিক কালের কণ্ঠ, ১২ মার্চ ২০১০
খ. লিটল ম্যাগাজিন
৮. মুক্তির জন্য বিদ্রোহ নিগ্রহ মৃত্যু, শৈলী, ১ সেপ্টেম্বর ২০০১
৯. বঙ্গভঙ্গের শতবর্ষ, কালি ও কলম, আগস্ট ২০০৫
১০. কবি চন্দ্রাবতী : জীবন ও কাব্য, বাংলা একাডেমী পত্রিকা ১৯৯৯-২০০০
১১. রবীন্দ্রনাথ জলতরঙ্গের সত্তা, উত্তরাধিকার বৈশাখ -২০১০
১২. আমাদের চিন্তাশীল ধারার ভূমিকা, সাম্প্রতিক, ফেব্রুয়ারি ২০১০
১৩. সাতক্ষীরার সাহিত্য শতবর্ষের ক্যানভাস, প্রাণসায়ের, নভেম্বর ১৯৯৬
১৪. সাতক্ষীরার সংস্কৃতি কলা পর্ব, উন্মেষ, ২০০১
১৫. সাতক্ষীরার কবি ও কবিতা : আলোকে নিরালোকে, কবিতা উৎসব প্রবন্ধ ২০০৫
১৬. সাতক্ষীরার লোকাতীত সংস্কৃতি, সৌম্য ২০১০
১৭. বাংলাদেশের প্রবন্ধ ও গবেষণা সাহিত্য, প্রগলভ, ২০১০
গ. স্মারক গ্রন্থ
১৮. ছোট বড় বিপন্ন মানুষের বিক্রমের গল্প, মানিক বন্দোপাধ্যায় জন্ম শতবর্ষ সংখ্যা, উত্তরাধিকার, বাংলা একাডেমী ঢাকা, ২০০৮
১৯. যিনি কখনো কলম ও কণ্ঠ ভাড়া দেননি, আহমদ শরীফ স্মারক গ্রন্থ, অনন্যা, বাংলাবাজার ঢাকা -২০০১
পুরস্কার :
গাজী আজিজুর রহমানের কাজ সাতক্ষীরা, ঢাকা ও কলকাতায় সমাদৃত। পরিশ্রমী কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন পুরস্কার ও সম্মাননা। সাতক্ষীরা সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার (১৯৯৫), ম্যান অব দি ইয়ার, বায়োগ্রাফিক্যাল ইনস্টিটিউট যুক্তরাষ্ট্র (১৯৯৮), কবি জসীমউদ্দীন সাহিত্য পুরস্কার (২০০১), শিমুল-পলাশ সাহিত্য পুরস্কার, কলকাতা (২০০৪), খান জাহান আলী পুরস্কার (২০০৬), বাংলা ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতিচর্চা কেন্দ্র, ঢাকা সম্মাননা (২০০৭), কবি শামসুর রাহমান পদক (২০০৮), লিনেট সাহিত্য পুরস্কার (২০০৮), বিজয় সাহিত্য পুরস্কার (২০০৯), সাতক্ষীরা সাংস্কৃতিক ফোরাম সম্মাননা (২০০৯), কবিতা পরিষদ পুরস্কার (২০১০), সিকানদার আবু জাফর পদক (২০১২); কবি সুকান্ত পুরস্কার (কলকাতা ২০১৫)।
প্রভৃতি।
গাজী আজিজুর রহমান এখনো পর্যন্ত তাঁর কাজের কোনো সরকারি বা সরকারি প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি পাননি। আংশিক প্রথা ও প্রতিষ্ঠান বিরোধী এই লেখকের পক্ষে সেটি অবশ্য অগৌরবের নয় বরং গৌরবের। গাজী আজিজুর রহমানের সাহিত্য ও শিল্পমানস আজও সম্পূর্ণভাবে আবিষ্কৃত হয়নি। আমি সেই মল্লিনাথের অপেক্ষায় আছি যার লেখায় গাজী আজিজুর রহমান স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে নতুন স্বয়ংবরায় হাজির হবে।
তথ্যসূত্র
১. গাজী আজিজুর রহমান, শর্তহীন কবিতা, স্রোত, ফেব্রুয়ারি ২০১০
২. আফজালুল বাসার, বিশ শতকের সাহিত্য তত্ত্ব, বাংলা একাডেমী, ১৯৯২
৩. প্রাগুক্ত।
৪. গাজী আজিজুর রহমান, জীবন ও ধর্ম, ঈক্ষণ, ১ম বর্ষ ৩য় সংখ্যা ১৯৯৩
৫. আবুল কাসেম ফজলুল হক, ভূমিকা, সাহিত্যে সমাজ বাস্তবতার ধারা, ১৯৯২
৬. গাজী আজিজুর রহমান, সাহিত্যে সমাজ বাস্তবতার ধারা ১৯৯২, পৃষ্ঠা-৪৭
৭. প্রাগুক্ত পৃষ্ঠা-২১
৮. টেরী ঈগলটন, মার্কসবাদ ও সাহিত্য সমালোচনা, দীপায়ন কলকাতা, ১৩৯৮
৯. জর্জ টমসন মার্কসবাদ ও কবিতা, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী ঢাকা, ১৯৮৬
১০. গাজী আজিজুর রহমান, স্বেচ্ছামৃত্যুর করতলে কবি, ১৯৯৬, পৃষ্ঠা-৮৪
১১. প্রাগুক্ত পৃষ্ঠা-৩৫
১২. গাজী আজিজুর রহমান, সাহিত্য ও সিংহাসন, ১৯৯৯, পৃষ্ঠা-১৪
১৩. এ সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানা যাবে ‘নোবেল সাহিত্য পুরস্কার নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কার চাই’ শীর্ষক উপশিরোনামে লিখিত অংশ থেকে। প্রাগুক্ত গ্রন্থের ১৯ ও ২০ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।
১৪. গাজী আজিজুর রহমান, আধুনিক বাংলা উপন্যাসের বিষয় ও শিল্পরূপ, ২০০৯, পৃষ্ঠা-২৩
১৫. গাজী আজিজুর রহমান, কবিদের কবি : জীবনানন্দ দাশ, শামসুর রাহমান, আবুল হাসান, পৃষ্ঠা-১৮
১৬. প্রাগুক্ত
১৭. নির্মলেন্দু গুণ, আমার কন্ঠস্বর, কাকলী প্রকাশনী, ১৯৯৫, পৃষ্ঠা-১৩
১৮. গাজী আজিজুর রহমান, কবিদের কবি : জীবনানন্দ দাশ, শামসুর রাহমান, আবুল হাসান, পৃষ্ঠা-১৭৭

শুভ সত্তর : পিয়াস মজিদ
গাজী আজিজুর রহমানের জন্ম দেশভাগের বছর আর স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে তাঁর সাহিত্যিকসত্তার পরিণত প্রকাশ। দেশের সুদূর দক্ষিণপ্রান্তস্থ সাতক্ষীরায় বসত করলেও তিনি অনন্য সাহিত্যকর্মের মধ্য দিয়ে কেন্দ্রপ্রান্তের সীমানা ভেঙে দিয়েছেন। আমি তাঁর কথা প্রথম শুনি তাঁর সুহৃদ কথাসাহিত্যিক বন্ধু বুলবুল চৌধুরীর কাছে। গাজী আজিজুর রহমানের প্রজ্ঞার প্রতি তাঁর আস্থার কথা শুনেছি, আগ্রহী হয়েছি তাঁর বিচিত্রবিধ বইপত্রের প্রতি। তাঁর প্রবন্ধ গবেষণাগ্রন্থের মধ্যে আছে- সাহিত্যে সমাজবাস্তবতার ধারা (১৯৯২), স্বেচ্ছামৃত্যুর করতলে কবি (১৯৯৬), সাহিত্য ও সিংহাসন (১৯৯৯), নোবেল সাহিত্য পুরস্কারের শতবর্ষ (২০০১), সাতক্ষীরার ভাষা ও শব্দকোষ (২০০৪), আধুনিক বাংলা উপন্যাসের বিষয় ও শিল্পরূপ (২০০৯), কবিদের কবি (২০১০), কালীগঞ্জের ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধ (২০১৪)। সম্পাদনা : মরণরে তুহু মম (২০০৪) এবং খান আনসার উদ্-দীন আহমেদ রচনাবলী (১৯৯৯)। অন্যান্য প্রকাশনা : বজ্রের বাঁশি (উপন্যাস), কালো সূর্যের নীচে (নাটক), সক্রেটিস (নাটক), যোদ্ধার জতুগৃহ (উপন্যাস)।
গাজী আজিজুর রহমান সমগ্রতাবাদী সাহিত্যিক। তাই বাংলাদেশের প্রান্তবর্তী অঞ্চল সাতক্ষীরার ভাষা ও শব্দ নিয়ে যেমন তিনি ভাবনাশীল তেমনি আন্তর্জাতিক সাহিত্যপুরস্কারের শতবর্ষও তাঁর কাছে ভীষণ উদ্যাপনীয়। তিনি সাহিত্য ও তখতের সম্পর্ক নিয়ে যেমন নাড়াচাড়া করেন তেমনি স্বেচ্ছামৃত্যুর রক্তিম ছোবলে কবির জখমি অবস্থা নিয়েও সমান সন্ধিৎসু। উপন্যাসের কারুকাঠামোর মতো সাহিত্যে উপস্থাপিত সমাজকাঠামোও তাঁর যুগপৎ গবেষণাবস্তু।
বছর সত্তরের এই জীবনের চৌত্রিশ বসন্ত তিনি সাহিত্য বিষয়ের শিক্ষকতা করেছেন। তবে নিজের সৃষ্টিশীল সমালোচকসত্তাকে এতটুকু বিসর্জন দেননি। বলা হয়, অধ্যাপকেরা সাহিত্য নিয়ে অযথা কাটাছেঁড়া করেন কিন্তু গাজী আজিজুরের অন্তত কবিদের কবি- জীবনানন্দ দাশ ॥ শামসুর রাহমান ॥ আবুল হাসান বইটির নিবিষ্ট পাঠ প্রমাণ করে তাঁর সাহিত্যবিশ্লেষণের সৃজনতরঙ্গময় অভিমুখ। এই অনন্য গদ্যগ্রন্থে তিনি তিন ভুবনের তিন কবি-বাঙালিকে দেখেছেন, বুঝেছেন অভিনতুন প্রেক্ষণীতে, নিজস্ব অনুধ্যানী অনুধাবনের দর্পণে আমাদের সামনে স্বচ্ছ করেছেন আলোচ্য কবি-মহানদের না-বোঝা গিঁটগুলো।
ভাষা-লাবণ্যহীনের এই নিদারুণ দুষ্কালে যখন প্রবন্ধ-নিবন্ধ নেহায়েত বক্তব্য প্রকাশের গুদামঘর হয়ে দাঁড়ায় তখন গাজী আজিজুর রহমানের নম্রদৃঢ় কথামালা, যুক্তিপরম্পরা, ব্যাখ্যাপদ্ধতি জুড়ে জ্বলতে থাকে সুনির্বাচিত শব্দ, স্বনির্মিত বাক্যবন্ধ, সুমিত ভাষার বর্ণিল বিচ্ছুরণ। জীবনানন্দ নিয়ে ‘ভিন্ন এক কবির প্রমিতি’, ‘শামসুর রাহমানের কবিতায় মাতৃচেতনা’, কিংবা আবুল হাসান নিয়ে ‘ব্যক্তিবাসিত বিশ্ব’, ‘যে ঝিনুক মুক্তা ফলায়’, ‘রুগ্ন, ঋতুমতী বসুন্ধরা’, ‘রেডিয়ামের তলায় ইউরেনিয়াম’ শীর্ষক গদ্যগুচ্ছ বাংলাদেশের প্রবন্ধসাহিত্যে মহিমময় সংযোজন। এই বইয়ের শেষভাগের উদ্ধৃতিতে স্পষ্ট হবে তাঁর ব্যতিক্রমী গদ্যের শ্রীময় শক্তিসামর্থ্য-
সে নাই। সে সানাই আজো বেজে যায় কালের মন্দিরায় হৃদয়ের একতারায়। তিনি আমৃত্যু বহন করেছিলেন প্রৌঢ়ের প্রাজ্ঞতা। অথচ ওষ্ঠলগ্ন ছিল সকালের হাসি, হৃদয়লগ্ন ছিল অপরাহ্নের আলো, আর আত্মলগ্ন ছিল সাধু-সন্তের দীর্ঘশ্বাস। কেউ বিকেলে ভোরের ফুল হয়ে ফোটে, কেউ ভোরে বিকেলের কলি হয়ে ফোটে। আবুল হাসান ছিলেন দ্বিতীয় দলে। অপরাহ্নের সূর্য যদি পূর্বাহ্নে ডুবে যায়, ফুরিয়ে যায় আলোর বসন্ত, ঘটে অকাল বোধন- তাহলে যেমন বিপ্রতীপ ‘দ্বিষত শোনিত নদে’ ভেসে যেতে হয় তেমনি আবুল হাসানের চলে যাওয়া আমাদের ক্লান্ত করে, বিষণœ করে, নিরালা মানুষের বেদনার ভূগোলে নিমজ্জিত করে। আমাদের কালে আবুল হাসান পূর্বাহ্নে সায়াহ্নের সেই সাহানা সানাই যার মূর্ছনায় আছে ‘বৃত্তাবদ্ধ গোঙনির’ শোকাবহ বিরল উত্থান ॥ (কবিদের কবি : পৃষ্ঠা ২৩৩)
শুভ সত্তর গাজী আজিজুর রহমান; আপনার জন্মদিনের আনন্দগানে আমাকেও অংশী জানবেন।
লেখক : কবি, গবেষক

কালীগঞ্জে আধুনিক কালচারের জনক : অনিন্দ্য আনিস
আর মাত্র বারোটি জন্মদিন পালন করতে পারলেই আমার সাহিত্যগুরু অধ্যাপক গাজী আজিজুর রহমান বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে অতিক্রম করবেন। ২৯ সেপ্টেম্বর ১৪ আশ্বিন তার ৭০তম শুভ জন্মদিন। এই শুভ জন্মদিনে আমার প্রার্থনা হাজার বছর বেঁচে থাক আমাদের হৃদয়ে।
গাজী আজিজুর রহমান রক্তের বন্ধনে আবদ্ধ কেউ নয় আমার। অথচ তিনি আমার আত্মার আত্মীয়। চাকরিসূত্রে ১৯৯৩ সালে পরিচয়। তখন আমার কর্মস্থল ছিল সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা। যোগদান করেই ওখানে গঠন করি ‘প্রত্যয়ন সাহিত্য মঞ্চ’। পাবলিক লাইব্রেরির একদল তরুণ ও অভিজ্ঞ জনদের নিয়ে শুরু হয় সাহিত্যচর্চা, নাটক। উল্লেযোগ্য অনুষ্ঠান ছিল শারদীয় সাহিত্য সম্মেলন। দাওয়াত দিয়েছিলাম তাকে। তিনি নিয়ে এলেন কালীগঞ্জসহ সাতক্ষীরা জেলার সাহিত্য সাংস্কৃতিক কর্মে নিয়োজিত নিবেদিত প্রাণ, সকল গুণিজনকে। সেই থেকে তাঁর সাথে পথ চলা এবং বর্তমান সময় পর্যন্ত একান্তজন হিসেবে আছি।
গাজী আজিজুর রহমানের কাজের শাখা-প্রশাখা ব্যাপক বিস্তৃত। স্বল্প পরিসরে বলা কঠিন। যথাক্রমে তার সৃষ্টিকর্মের বিষয় ছড়া, কবিতা, গান, ছোটগল্প, নাটক, নিবন্ধ, প্রবন্ধ, উপন্যাস ও জীবনী সাহিত্য এবং ভ্রমণ কাহিনি। সম্পাদনা করেছেন একাধিক সাহিত্য পত্রিকা ও সৃষ্টি করেছেন একাধিক সংগঠন। তার সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সংখ্যা ২১ এর ঊর্ধ্বে।
আমি আলোচনা করবো কালীগঞ্জসহ সাতক্ষীরার সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিস্তারে সৃষ্ট সংগঠনের মাধ্যমে আধুনিকতার বিকাশ। সেই ধারাবাহিকতার কর্মধারা যেভাবে রূপায়িত হলো :
তার জন্ম ও অবস্থান : ১৯৪৭, ২৯ সেপ্টেম্বর, দার্জিলিংয়ে। পিতা মরহুম মৌলভী কাশেম আলী গাজী, মা মরহুম করিমন নেছার তিন ছেলে ও চার মেয়ের মধ্যে তিনি সকলের ছোট। বাবা বন বিভাগের কর্মকর্তা পদে চাকরি করতেন। বাবার চাকরি বদলির সুবাদে তিনি দেখার সুযোগ পেয়েছেন বিচিত্র অঞ্চলের বিচিত্ররূপ ও তার প্রকৃতি। দেখেছেন মানুষের বিচিত্র স্বভাব ও চরিত্র। সেই প্রকৃতি ও মানুষভাবনা থেকে তার সাহিত্যভাবনার সূত্রপাত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার মতো “জলপড়ে পাতা নড়ে” সেই শৈশব কাল থেকে তার মনের ভিতর জল পড়ে ছিল আর তা সাহিত্য সৃষ্টির জন্য নড়ে ছিল।
শিক্ষাজীবন ও সাহিত্যচর্চা : মতিঝিল প্রাথমিক বিদ্যালয় টু সিদ্বেশ্বরী গার্লস স্কুলে ৩য় শ্রেণি পর্যন্ত। পরবর্তীতে ৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত সিদ্বেশ্বরী বয়েজ স্কুলে। ফিরে এলেন নিজ উপজেলায় কালীগঞ্জ। নলতা হাই স্কুলে পুনরায় ভর্তি হলেন ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে।
নলতা স্কুল থেকেই মানবিক বিভাগে ১৯৬৪ সালে এসএসসি পাস। তার ফুফাতো ভাই অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আব্দুল মজিদ জানান এসএসসি পরীক্ষার পর পরই আজিজ লিখে ফেললেন রোমান্টিক উপন্যাস। বন্ধুমহলে হইচই পড়ে গেলো। তিনি আরো জানান শৈশব থেকে ছবি আঁকা, ছড়া, কবিতা লেখা, আর অভিনয়ের প্রতি আগ্রহ ছিল, হাতের লেখা সুন্দর ছিল, ছাত্র হিসেবে সুনামও ছিল বেশ।
পরবর্তীতে এইচএসসি সাতক্ষীরা কলেজ। কলেজে পড়াকালীন পরিচয় বামপন্থী নেতা সাইফুল্লা লস্কর সাহেবের সাথে। তিনি তাকে গোপনে মার্কসবাদ শিক্ষা দিতেন। তার সান্নিধ্য পেয়ে জীবনের স্বাভাবিক ভাবধারা পরিবর্তন হতে লাগলো। ছাত্র অবস্থায় ছড়া, কবিতার পাশাপাশি নাটকের প্রতি ঝুঁকে পড়লেন। ওই সময়ে সাতক্ষীরা লাবনী সিনেমা হলের পাশে মঞ্চ নাটক হতো। তিনি মঞ্চ নাটকে অভিনয় করার জন্য অডিশন দিলেন, চান্স পেলেন এবং পরবর্তীতে নিয়মিত নাটক করতেন।
এইচএসসি পাস করার পর ভর্তি হলেন খুলনা আযম খান কমার্স কলেজে। এবার আর্টিস হবার জন্য শুরু করলেন চর্চা, পরবর্তীতে বাড়ির চাপের কারণে আর আর্ট শেখা হয়নি। তিনি জানান ঢাকা প্রাইমারিতে পড়াকালীন একসঙ্গে আর্ট শিখতেন যে শৈশব বন্ধুর সাথে তিনি এখন দেশের খ্যাতিমান আর্টিস কালাম মাহমুদ। খুলনা পড়াকালীন সাপ্তাহিক দেশ, জনবার্তায় তার ছড়া/ছবি ও কবিতা ছাপা হতো।
হঠাৎ করেই খুলনা থেকে পালিয়ে চলে এলেন ঢাকা। বিএ ভর্তি হলে জগন্নাথ কলেজ। ঢাকায় শিক্ষাজীবন ১৯৬৮-১৯৭৪। এই দীর্ঘ সময়ের শুরুতে তিনি সান্নিধ্য পেয়ে যান রণেশ দাশগুপ্তের।
রণেশ দাশগুপ্ত ছিলেন একাধারে সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনীতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। তার বাড়ি ছিলো গাউরদিয়া, উপজেলা- লৌহজং, জেলা- মুন্সীগঞ্জ। এই মহান ব্যক্তি তাকে শিখিয়ে ছিলেন বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাস, কবিতা, গল্প, নাটক, উপন্যাস, অনুবাদ, ইতিহাস, শিখিয়েছিলেন সংগঠন সৃষ্টি ও সাংগঠনিক দক্ষতা কিভাবে অর্জন করতে হয়, সাংগঠনিক কার্যক্রমের মাধ্যমে কিভাবে অন্যাকে প্রভাবিত করা যায়। তাছাড়া জগন্নাথ কলেজ পড়াকালীন উৎসাহ পেয়েছেন কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, রাহাত খান, অজিত কুমার গুহর মতো সাহিত্যিক, শিক্ষকদের।
রণেশ দাশগুপ্তের সাথে একাত্ম হাওয়ার পর তিনি প্রবন্ধ ও অনুবাদ বিষয়ের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। কবিতাচর্চার পাশাপাশি তিনি প্রবন্ধ লেখাও শুরু করেন। ১৯৬৮-১৯৭৪ পর্যন্ত ঢাকায় সাহিত্য আড্ডায় বিখ্যাত স্থানগুলিতে তার ছিল নিয়মিত যাতায়াত। বিউটি বোর্ডিং-এর মতো বিখ্যাত সাহিত্যআড্ডার স্থানে পদচিহ্ন রেখে গেছেন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, মহান স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিউটি বোর্ডিং-এর অবস্থান ছিল তার জগন্নাথ কলেজ সংলগ্ল এজন্য সেখানেই বেশি যাওয়া হতো। এছাড়া আড্ডা দিতেন সংবাদপত্রের অফিস সূত্রাপুর, শরীফ মিয়ার ক্যান্টিন, নিউ মার্কেটের মনিকো রেস্টুরেন্টে। এখান থেকে বের হয়ে এসেছেন কবিদের কবি আমাদের কবি শামসুর রাহমানসহ রফিক আজাদ, আসাদ চৌধুরী, নির্মলেন্দু গুণ, আল মাহমুদ প্রমুখ। সেই আড্ডা থেকে বের হয়ে আসা আরেকজন লেখক ও প্রাবন্ধিক গাজী আজিজুর রহমান।
ঢাকা অবস্থানের ১৯৭৪ পর্যন্ত তিনি লিখেছেন কবি শামসুর রাহমান, রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণের সাথে, দৈনিক সংবাদ, ইত্তেফাক, আজাদ ও ইয়াং অবজারভারে। একই সাহিত্য পাতায় তাদের সাথে তার লেখা ছাপা হতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন প্রবন্ধকার মনসুর মুসা, ড. আহমদ শরীফ, ড. সানজিদা খাতুন, অধ্যাপক রবীন্দ্র গবেষক, সৈয়দ আকরাম হোসেন বরেণ্য এই ব্যক্তিদের সান্নিধ্য পেয়েছেন।
১৯৭৪ সাল লেখাপাড়া শেষে তিনি চাকরি পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পা-ুলিপি শাখায়। মঞ্জুরি কমিশনের অনুমোদন না থাকায় তিনি সে চাকরি তিন মাসের বেশি করেননি। ১৯৭৫ সালে বাংলা প্রভাষক হিসেবে নিজ উপজেলার কালীগঞ্জ কলেজে যোগদান করেন।
ঢাকা বিচ্ছিন্ন হলেন এই প্রথম, রেখে এলেন দীর্ঘদিনের সঙ্গীদের মধ্যে প্রয়াত কবি আবুল হাসান, কবি মাকিদ হায়দার, গল্পকার বুলবুল চৌধুরী, লেখক সাংবাদিক আরেফিন বাদল, কবি সমুদ্র গুপ্ত উল্লেখযোগ্য।
কালীগঞ্জ তার নিজ উপজেলা। উপজেলাটি কাঁকশিয়ালি নদী দ্বারা বিভক্ত। নদীর দক্ষিণ পাড় উপজেলা প্রশাসনের সব ভবন এবং উত্তর পাড় নদী সংলগ্ন একটু ভিতরে সবুজ বৃক্ষরাজির মধ্যে দ্বিতলা ভবন, এখানেই তিনি বসবাস করেন।
কালীগঞ্জ কলেজে যোগদানের পর ভাবলেন আমার কালীগঞ্জের কবিতার কি হবে, সাতক্ষীরার কবিতার কি হবে- আবার পরক্ষণেই ভাবলেন কালীগঞ্জ বা সাতক্ষীরার কবিতা বলে তো কিছু নেই, কবিতা তো দেশের, বিশ্বের, কবিতা তো দৈনন্দিন ভাবনার বিষয় যা তাৎক্ষণিক লিখতে হয়। ডাকযোগে ঢাকা, খুলনার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় পাঠানো লেখা ছাপা হতে থাকে। কিন্তু এভাবে কবিতা ছাপানো এবং ধীরগতিতে চলা তিনি পছন্দ করলেন না। ফলে সব বাদ দিয়ে একটানা পাঁচ বছর প্রবন্ধ সাহিত্যের ওপর পড়াশোনা করলেন।
প্রবন্ধ চর্চার পাশাপাশি কালীগঞ্জ সাতক্ষীরায় সাহিত্যচর্চার ব্যাপকতার জন্য কাজ শুরু করেন। সৃষ্টি করতে থাকলেন জেলা/ উপজেলা পর্যায় একাধিক সাহিত্য সাংস্কৃতিক সংগঠন। তখনকার চলমান গুণীজন এবং একঝাঁক তরুণদের নিয়ে সৃষ্টি করলেন একাধিক সংগঠন। কালীগঞ্জের ধ্যানধারণা পরিবর্তনের জন্য অধ্যাপক আবুল কাসেমকে সঙ্গে নিয়ে শুরু করলেন গণসংগীত, গণনাটক, বিপ্লবী নাটক, যাত্রা, মঞ্চনাটক, ছবি প্রদর্শনী ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। যা করতে তাদের পদে পদে বিপদের মুখে পড়তে হয়েছে কিন্তু পিছপা হননি।
তার গড়ে তোলা এবং সরাসরি দায়িত্ব পালন করা উল্লেখযোগ্য সংগঠন হলো- সাতক্ষীরা সাহিত্য একাডেমি, কালীগঞ্জ সাহিত্য একাডেমি, সুশীলন এনজিও, কবি তীর্থ, বর্ণমালা প্রেস, মুক্তিযুদ্ধের শহীদ স্মৃতি পাঠাগার, কালীগঞ্জ নাট্যসংস্থা, কালীগঞ্জ পাবলিক লাইব্রেরি, কালীগঞ্জ ডিবেট ক্লাব অন্যতম। এছাড়া তিনি মুক্তিযুদ্ধের শহীদ স্মৃতি পাঠাগার ও জাতীয় কবিতা পরিষদের সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন।
তার স্নেহধন্য কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, লেখক, গবেষক, নাট্যকর্মী, এনজিও কর্মীর সংখ্যা কম নয়। তারা নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রেও কৃতিত্বের সাথে কাজ করছেন। তারা হলেন, মোস্তফা নুরুজ্জামান, প্রয়াত হাসানুজ্জামান, কবি পল্টু বাসার, স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয় নাট্যকর্মী ও আবৃত্তিশিল্পী মো. ফজলুর রহমান ফজলু, প্রয়াত কবি সৈয়দ হাফিজ, কবি সংগঠক ও অ্যাডভোকেট জাফরুল্লাহ ইব্রাহিম, ছড়াকার আবুল হুসেন আজাদ, কবি ও শিশু সাহিত্যিক ইমরুল ইউসুফ, সাংবাদিক আসিফ আজিজ, ছড়াকার নাজমুল হুসেন, কবি গাজী শাহজাহান সিরাজ, কবি বেদুঈন মোস্তফা, সাংবাদিক ও নাট্যকর্মী শুকুমার দাস বাচ্চু, কবি ও শিক্ষক প্রাণকৃষ্ণ সরকার, সাইদ মেহেদী, আশিক মেহেদী, বাবলু ভঞ্জ চৌধুরী, কবি আবৃত্তিকার একেএম আমিনুর রহমান, মানিক ঘোষ, তরুণ আকাশ, বাবর আলী, আলী সোহরাব, কবি ফরহাদ খান চৌধুরী, শিল্পী মুন্নাহার মুন্না, তারা সবাই আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ে পরিচিত।
সমবয়স্ক ও সমকক্ষ শুভাকাক্সক্ষীর সংখ্যাও অনুজদের চেয়ে কম নয়। তাদের মধ্যে অন্যতম অধ্যাপক আবুল কাশেম, অধ্যাপক মো. তমিজ উদ্দিন, অধ্যক্ষ আব্দুল মজিদ খান, অধ্যাপক কাজী ওয়ালিউল্লাহ, অধ্যাপক আব্দুল্লাহেল বারী, আব্দুল বারী আল বাকী, অধ্যক্ষ আশেক এলাহী, অধ্যাপক আব্দুল খালেক, অধ্যাপক শ্যামাপদ দাস, অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মতিউর রহমান খান, মো. আসাদুর রহমান খান, নাট্যকার খায়রুল বাসার, ডা. আব্দুন নুর, মনছুর আলী, মো. বাবর আলী ও মৃত কবি সৈয়দ আলী খান, সোহরাব হোসেন, কবি লুৎফর রহমান, কবি সওদাগর নুরুল ইসলাম উল্লেখযোগ্য।
সহযোগিতা ও উৎসাহ পেয়েছেন স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ ও কর্মীদের কাছ থেকে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- শেখ ওয়াহিদুজ্জামান, শেখ মো. আকবর হোসেন, শেখ নাসির উদ্দিন, শেখ আনোয়ার হোসেন, মো. বারেক আলী মাস্টার, মোজাহার হোসেন কান্টু, শেখ সাইফুল বারী সফু, গাজী সাইদুর রহমান, সাইদ মেহেদী প্রমুখ।
উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে যারা সার্বিক সহযোগিতায় নিবেদিত ছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ইউএনও ছালেক সাহেব, কবির বিন আনোয়ার, আতিয়ার রহমান, শহীদুল ইসলাম, সিরাজুর রহমান, নজরুল ইসলাম, অনিন্দ্য আনিস প্রমুখ। যারা বর্তমানে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
তার উদ্যোগে আয়োজিত অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য আর্থিক সহযোগিতায় বরাবর যারা উদার ছিলেন, তাদের মধ্যে নজমুল উল্লা, মোস্তফা নুরুজ্জামান, নরিম আলী মাস্টার, প্রাণকৃষ্ণ সরকার উল্লেখযোগ্য।
তার রয়েছে অনেক মূল্যবান প্রবন্ধগ্রন্থ। সম্পাদনা করেছেন ‘নদী’ নামে অনিয়মিত সাহিত্য পত্রিকা, সম্পাদনা করেছেন সাপ্তাহিক সুন্দরবন। এছাড়া তিনি খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লাহ (র.) এর বাৎসরিক ওরছ মাহফিল উপলক্ষ্যে প্রকাশিত স্মরণিকায় আহ্ছানউল্লাহ (র.) জীবন ও কর্ম বিষয়ে মূল প্রবন্ধ রচনা করে আসছেন বর্তমান সময় পর্যন্ত। ‘নদী’ ও ‘সুন্দরবন’ পত্রিকা দু’টি কালীগঞ্জের ইতিহাস, সাহিত্য, সংস্কৃতি বিকাশে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। এছাড়া তিনি কালীগঞ্জ সাতক্ষীরায় অনিয়মিত অসংখ্য লিটল ম্যাগ সম্পাদনা করেছেন ও করতে প্রেরণা যুগিয়েছেন। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা বারো। আগামীতে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে বাংলার দ্বিতীয় রেনেসাঁ, ভ্রামণিক রবীন্দ্রনাথ, বাংলা ও বাঙালিপনা শিরোনামের বই। আর দেশ বিদেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধের সংখ্যা শতাধিক।
সাহিত্যের একনিষ্ঠ গবেষক হিসেবে তার সততা সুচারু অনুশীলন ও পরিশ্রমী সৃষ্টিশীল কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ বেশ কয়েকটা পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। এর মধ্যে সাতক্ষীরা সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার (১৯৯৫), ম্যান অব দ্যা ইয়ার, বায়োগ্রাফিক্যাল ইনস্টিটিউট, যুক্তরাষ্ট্র (১৯৯৯), কবি জসীম উদ্দীন সাহিত্য পুরস্কার (২০০১), শিমুল-পলাশ সাহিত্য পুরস্কার, কলকাতা (২০০৪), খান জাহান আলী পুরস্কার (২০০৬), বাংলা ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র, ঢাকা সম্মাননা (২০০৮), গাঙচিল সাহিত্য পুরস্কার, খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লাহ সাহিত্য সম্মাননা (২০০৮), শামসুর রাহমান পদক (২০০৮), লিনেট সাহিত্য পুরস্কার (২০০৮), বিজয় সাহিত্য পুরস্কার (২০০৯) সাতক্ষীরা সাংস্কৃতিক ফোরাম সম্মাননা (২০০৯), সিকান্দার আবু জাফর পদক (২০১১), স্বপ্নসিঁড়ি সাহিত্য সাংস্কৃতিক পরিষদ সম্মাননা পদক, জকিগঞ্জ, সিলেট (২০১৬) উল্লেখযোগ্য। মোটা দাগে এই হলো গাজী আজিজুর রহমান, যিনি এপার বাংলা ও ওপার বাংলায় সমকালীন সময়ে আলোচিত। তার সাহিত্যচর্চা, আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি কালীগঞ্জ, সাতক্ষীরা ঢাকা হয়ে কলকাতা পর্যন্ত সমাদৃত।
আমার জানা মতে তার ও কবি পল্টু বাসারের আমন্ত্রণে সাতক্ষীরার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে এসে উজ্জ্বল হয়ে আছেন কবি সৈয়দ শামসুল হক, কবি নির্মলেন্দু গুণ, কবি আসাদ চৌধুরী, কবি মাকিদ হায়দার, কবি সমুদ্র গুপ্ত, কবি কাজী রোজী, কবি জুলফিকার মতিন, ছড়াকার আলম তালুকদার, কবি জাহাঙ্গীর হাবিবউল্লাহ, কবি ব্রাত্য রাইসু, গল্পকার হাসান আজিজুল হক, প্রবন্ধকার হোসেন উদ্দিন হোসেন, ওপার বাংলার ড. কানাই সেন, ড. অমিতাভ চক্রবর্তী, চন্দন ভট্টাচার্য, গৌরাঙ্গ নন্দী, নৃপেন চক্রবর্তী, গোপাল বিশ্বাস অন্যতম।
এই হলো আমার সাহিত্যগুরু গাজী আজিজুর রহমান, যার সাথে ১৯৯৩-২০০১ সাল পর্যন্ত চলার সৌভাগ্য হয়েছিল। কত মজার মজার আড্ডার গল্প আছে, আমরা সাহিত্য আড্ডা দিতাম কাঁকশিয়ালী নদীর উত্তরপাড় নিমাই ও রাজ্জাকের চায়ের দোকানে, কালীগঞ্জ সাহিত্য একাডেমিতে, পাবলিক লাইব্রেরিতে, তার নিজস্ব প্রতিষ্ঠান বর্ণমালা প্রেসে, নরিম আলী মাস্টারের ডিপোতে। এছাড়া সাতক্ষীরার সাহিত্য একাডেমির দুইশততম আসর বসেছিল কালীগঞ্জ সাহিত্য একাডেমিতে। সেই আসরে সাতক্ষীরা থেকে কবি পল্টু বাসারের নেতৃত্বে এসেছিলেন অনেক কবি সাহিত্যিক।
এপার বাংলা-ওপার বাংলার মধ্যখানে ইছামতি ও কালিন্দী নদীর স্বচ্ছ জলের ওপর ভাসা নৌকায় চলছে আমাদের সাহিত্য আসর। দুই বাংলাকে যুক্ত করেছিল স্মরণযোগ্য সেই সাহিত্য আসর। আমরা চিৎকার করে জানিয়ে দিয়েছিলাম ড. কানাই সেন, ড. অমিতাভ চক্রবর্তীকে এসো বন্ধু দেখে যাও এই মিলনমেলা। উক্ত অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন সাইফুল আলম (তখনকার সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক) এমনিভাবে তিনি উপজেলা পর্যায়ে ১৯৯৯ সালে তারই সৃষ্ট প্রতিষ্ঠান কালীগঞ্জ সাহিত্য একাডেমির ব্যানারে এই এলাকায় সর্ববৃহৎ সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করলেন। সম্মেলন সফল করার জন্য তিনি পরিচালনা কমিটি-সহ উপ কমিটি গঠন করলেন। সেসময় একাডেমির সভাপতি ছিলাম আমি এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন অ্যাডভোকেট জাফরুল্লাহ ইব্রাহিম, উপদেষ্টা গাজী আজিজুর রহমান। আমাদের ত্রিযুগোল নেতৃত্বে একদিকে প্রশাসনের পক্ষে সার্বিক সহযোগিতা করেছিলেন শিল্পী ও সাহিত্যিক মুন্সী শফিউল হক, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, কালীগঞ্জ। কবি ও আবৃত্তিকার মো. শহিদুল ইসলাম, সহকারী কমিশনার ভূমি। একাডেমির পক্ষে আমরা তিনজন এবং রাজনৈতিক জননেতা শেখ ওয়াহিদুজ্জামানের পূর্ণ সহযোগিতায় আমরা আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম দুই বাংলার কবি সাহিত্যিকদের। ওপার বাংলা থেকে এসেছিলেন ড. কানাই সেন, ড. অমিতাভ চক্রবর্তী, চন্দন ভট্টাচার্য, গৌরাঙ্গ নন্দী, নৃপেন চক্রবর্তী, গোপাল বিশ্বাস আর আমাদের ছিলেন আ.শ.ম বাবর আলী, জাহাঙ্গীর হাবিবউল্লাহ, হোসেন উদ্দিন হোসেন, আব্দুল্লাহেল বাকী, কাজী ওয়ালিউল্লাহ, কবি পল্টু বাসার, নিমাই মন্ডল-সহ আরো অনেকে। তিন দিনব্যাপি ওই অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেছিলেন সাবেক জেলা প্রশাসক সায়ফুল আলম, তার অনাবদ্ধ উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা সাতক্ষীরা কালীগঞ্জের সাহিত্য চর্চার ভূমি আরও উর্বর হয়েছিল।
পরিশেষে বলা যায়, সাবেক ও বর্তমান মিলে তিনি একুশটি সংগঠনের যুক্ত ছিলেন এবং বর্তমানে আছেন। ফলে সংগঠন সৃষ্টি, সফল কর্মী সৃষ্টি, প্রশাসনিক সহযোগিতা সৃষ্টি, রাজনৈতিক সহানুভূতি সৃষ্টি, পাঠক ও দর্শকদের সমর্থন সৃষ্টি এবং তার প্রজ্ঞা, শক্তি, সাহস, সততা, দক্ষতা ও একনিষ্ঠ সুচারু অনুশীলন দিয়ে সৃজন করেছেন কালীগঞ্জ সাতক্ষীরার সাহিত্য সাংস্কৃতিক কালচার জোন। ফলশ্রুতিতে অত্র অঞ্চল থেকে আঞ্চলিক ও জাতীয়ভাবে বের হয়ে এসেছেন একঝাঁক লেখক, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও নাট্যকর্মী। আমার দৃষ্টিতে তাই প্রবন্ধকার গাজী আজিজুর রহমান সাহিত্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কালীগঞ্জ সাতক্ষীরার উজ্জ্বল নক্ষত্র এবং তিনিই কালীগঞ্জের সংস্কৃতি চর্চার জনক।
লেখক : কবি, সহকারী মৎস্য কর্মকর্তা

না গৃহী না বোহেমিয়ান : নিমাই মণ্ডল
সত্তরতম জন্মদিনে গাজী আজিজুর রহমান- আমাদের আজিজ ভাইকে প্রাণিত শুভেচ্ছা এবং অভিনন্দন। অবাক হবার কথা। সত্তর বছর বয়স! তবে আজিজ ভাইয়ের জন্য সত্তর/আশি কোনো বিষয় না। প্রাণচাঞ্চল্য, মননে এবং স্ফূর্ততৎপরতায় তিনি যৌবনকে ধরে রেখেছেন। যৌবন তো সৃষ্টিশীলতার উর্বর সময়। যেখানেই সৃষ্টি সেখানেই যৌবনের স্বাক্ষর। আজিজ ভাই সত্তরে পা রাখা দুরন্ত যৌবন।
আজিজ ভাইয়ের জনসম্পৃক্তি (হতে পারে সেটা সিলেকটিভ) এতই দৃষ্টিগ্রাহ্য যে তিনি কোথাও কখনো একা বসে আছেন এমন দৃশ্য বিরল- কদাচিৎ দেখা যায়। কালীগঞ্জ, সাতক্ষীরা এমনকি ঢাকায়ও- যেখানেই তাকে দেখা যায় সেখানেই কিছু মানুষ তার সঙ্গে জম্পেশ আড্ডা দিয়েই চলেছেন। আড্ডা তার খুব প্রিয়। বুদ্ধদেব বসু আড্ডাকে শিক্ষিত বাঙালি ইনটেলেকচুওয়ালের জীবনবোধের অনুপম অনুশীলন হিসেবে বিবেচনা করেছেন। পক্ষান্তরে নীরোদ চৌধুরী আড্ডাকে সময় হন্তারক বিবেচনাহীন কর্মবিমুখতার সঙ্গে তুল্য জ্ঞান করেছেন। আধুনিকতা তথা প্রগতিশীলতা এবং প্রতিক্রিয়াশীলতার দ্বন্দ্বে আজিজ ভাই আজ পর্যন্ত বুদ্ধদেব বসুর ‘আড্ডা’ ধারণার সমার্থক। বুদ্ধদেব বসু আজিজ ভাইয়ের শীর্ষ পছন্দজনের একজন।
ঢাকার সাহিত্যিক মহলে বিখ্যাতজনদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আমাকে ভীষণভাবে ঈর্ষান্বিত করে। কবি মাকিদ হায়দারের সঙ্গে তার সখ্যতা নিয়ে জনৈক ব্যক্তির মন্তব্য আমাকে যুগপৎ আমোদিত ও বিস্মিত করেছিল। মাকিদ হায়দার তার অসাধারণ সাধারণ্য নিয়ে একবার সাতক্ষীরায় নিশিকান্ত ব্যানার্জী সম্পাদিত একটি সাহিত্যপত্রের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ অতিথি হিসেবে এসেছিলেন। পাবলিক লাইব্রেরির সামনে রাজ্জাক পার্কের এক কোণে শিশুদের জন্য কয়েকটি দোলনা ঝুলানো ছিল। মাকিদ হায়দার এবং আজিজ ভাই দুজনে দুটি দোলনায় বসে দোল খেতে খেতে শিশুআনন্দে বিভোর হয়ে গিয়েছিলেন। এই দুর্লভ দৃশ্য অনেককে মুগ্ধ করেছিল।
‘প্রিয় রোকনালী’-র কবি মাকিদ হায়দার তার মুগ্ধ করা সমৃদ্ধ আলোচনা শেষ করে পুনরায় রোদ পোহাতে মাঠে এসে দাঁড়ালেন। মাঠে দাঁড়ান আমার সামনে আরেক ব্যক্তি তার বন্ধুকে বললেন: ‘মাকিদ হায়দার যার বন্ধু; তার আর অতটা লম্বা হওয়ার প্রয়োজন ছিল না।’ আমি আজ পর্যন্ত এই মন্তব্যের ‘কুল কিনারা’ খুঁজে পাইনি। চেষ্টাও খুব বেশি করিনি।
দীর্ঘদেহী আজিজ ভাই। রোমান্টিক মুখম-ল। ঘন কেশ দাম। বিশ^স্ত। বিন্যাস্ত। পাঞ্জাবি-ট্রাউজারে একেবারে মানিক বন্দোপাধ্যায়। বেশ কিছুদিন তার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ নেই। সত্তরতম জন্মদিনে নিশ্চয়ই তাকে অক্ষুণœ অবয়বে দেখতে পাবো।
আজিজ ভাই কখনো উচ্ছন্নে যাওয়া মানুষ নন। কিছুটা চাপা স্বভাবের বটে। বাইরে যতটা তাড়াহুড়ো থাক না কেন ভেতর সজাগ সতর্কতা। নিজেকে গ্রহণযোগ্যতায় প্রতিষ্ঠিত করার এক অসাধারণ ক্ষমতা তার আছে। সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আয়োজনে তিনি নিঃসন্দেহে প্রভাববিস্তারী সংগঠক। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি স্নাতকোত্তর পাঠ শেষ করেন। এই বিশ^বিদ্যালয়ের কাছে তার ঋণ অনেক। এই বিশ্ববিদ্যালয়ই তাকে প্রগতির পথে হাঁটতে শিখিয়েছে। অনেকের মতো তিনি আপদমস্তক হিপোক্রাট হয়ে যাননি। ক্রুরতা নয়- কঠোরতা তাকে অনেক সময় অপ্রিয় করে তুললেও সময়ের প্রয়োজনে তিনি তা প্রয়োগ করতে দ্বিধান্বিত হননি। কিন্তু এটা তার মৌলিক মনস্কতা নয়- জাতি, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষকেই তিনি ভালোবাসেন। তার মানব সংলগ্নতা আমাদেরকে মুগ্ধ করে। আঞ্চলিকতা ও গোষ্ঠীগত ক্ষুদ্রত্ব তার মধ্যে জেঁকে বসা কঠিন। তার বুকের ভেতর নিশিদিন বাস করে লালন-হাছন ; সে কি কখনও মানুষের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হীরক আঙিনায় তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন কিছু সাহিত্যপাগল, কবিতাপাগল, নন্দনপাগল সতীর্থ ও বন্ধু। আরও ছিল ঋদ্ধতায় টগবগে কিছু উজ্জ্বল শিক্ষক। আর কী প্রয়োজন? গাজী আজিজুর রহমান বটবৃক্ষের দীঘল ছায়ায় নিজেকে নির্মাণ করেছেন অনবদ্য আনন্দময়তায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহুবর্ণিল চত্বরে তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন কবি আবুল হাসানকে। বন্ধুত্ব আর সৌহার্দ্যরে জানালা খুলে গেলো। দুই মানবিক যৌবন মাটি, খুঁড়ে নন্দনতত্বের নৃ-তাত্ত্বিক গোপনীয়তা সন্ধানে ব্যাপৃত হলেন। নির্মলেন্দু গুণসহ আরো অনেকেই। যে যার পথে হাঁটতে লাগলেন। এই হাঁটা আমৃত্যু। একেকজনের কাছে একেক রকমের।
‘রাজা যায় রাজা আসে’ এবং ‘পৃথক পালঙ্ক’-এর কবি আবুল হাসান তার অকাল মৃত্যুর পূর্বে যখন হসপিটালে রোগ শয্যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতেন, সেই আড্ডাকে বলা যেতে পারে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আড্ডাগুলির একটি (পাঠক অতিশয় উক্তির জন্য ক্ষমা করবেন)। এই আড্ডায় যারা নিয়মিত আসতেন তার মধ্যে গাজী আজিজুর রহমান অন্যতম। মৃত্যুপথযাত্রী কবি বন্ধুকে ভালোবাসা ও সান্ত¦নায় বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখাতেন। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জীবন ও জগৎ সংসারের উচ্চমার্গীয় নান্দনিকতায় ডুবে যেতেন কবি আবুল হাসান এবং তরুণ বিদগ্ধ দর্শনার্থীরা। কবির একজন বিদুষী বান্ধবী গাম্ভীর্য ও দার্শনিকতায় এই আড্ডায় নতুন মাত্রা নির্মাণ করতেন।
একদিন, হ্যাঁ, একদিন থেমে গেল জীবনের এই জলসা। সবাইকে বেদনার আবীর মাখিয়ে ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যগগনের সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিময় বাংলা কবিতার নতুন নির্মাতা কবি আবুল হাসান মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়লেন। ভেঙে গেল চাঁদের হাঁট-বাজার। কিন্তু ইতোমধ্যে আবুল হাসান এক আশ্চর্য সুন্দর সত্যকে স্পর্শ করেছিলেন। কোনো অলৌলিক কিছু নয়-জীবনঘষা অনুধাবনের অপূর্ব নান্দীপাঠ। তিনি ‘এফিটাফ’-এ উৎকীর্ণ করেছিলেন দু’টি শব্দ- ‘মিলনই মৌলিক’। গাজী আজিজুর রহমান এবং অন্যান্যরা এই দুটি শব্দের মধ্যে হারিয়ে গেলেন। গাজী আজিজুর রহমানের বুকের মধ্যে তৃতীয় অলিন্দটি হচ্ছে কবি আবুল হাসান। খুব বিশাল ব্যাপার না হলেও খুব ছোট খাটো বিষয় এটি নয়।
আজিজ ভাই একসময় ঢাকা ছেড়ে চলে আসলেন সাতক্ষীরার কালীগঞ্জে। এখানেই তার পৈত্রিক বাড়িঘর, জমি-জিরেত, আত্মীয়-স্বজন সবই আছে। কাীলগঞ্জ কলেজে বাংলা বিভাগে শিক্ষকতা শুরু করলেন। সেই সঙ্গে সাহিত্যচর্চা, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন। সমাজ উন্নয়নে এবং মানবিক প্রয়োজনে তিনি সাতক্ষীরা জেলার সর্বত্র ছুটে বেড়িয়েছেন। পিছিয়ে পড়া মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের আকাক্সক্ষায় আহ্ছানিয়া মিশন এবং সুশীলন-এর মতো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করেছেন দেশ-বিদেশে (বিশেষ করে পশ্চিম বাংলায়) সাহিত্য সম্মেলন, সেমিনার, সাহিত্য আলোচনা কিংবা নিছক সাহিত্যের আড্ডায় যোগ দেওয়ার জন্য আজিজ ভাই ক্লান্তিহীন পরিব্রাজকের মতো ঘুরে বেড়ান। তিনি না গৃহী-না-বোহেমিয়ান।
বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলার কালীগঞ্জের গাজী আজিজুর রহমানের জন্ম ভারতের দার্জিলিং-এ। তার পিতা ব্রিটিশ সরকারের বনবিভাগে চাকরি করতেন। তিনি আশৈশব এক ধরনের বৈচিত্র্যময়তার মধ্যে গড়ে উঠেছেন। তার পিতার সঙ্গে নজরুলের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। যা গড়পরতা বাঙালির জীবনে ঘটে না। অধ্যাপক গাজী আজিজুর রহমান একজন সফল শিক্ষক ছিলেন। তার প্রভাব সৃষ্টিকারী ব্যক্তিত্ব, শ্রবণইন্দ্রিয়রঞ্জন উচ্চারণ ভঙ্গি এবং নাটকীয় পাঠদান অনুসরণযোগ্য। শিক্ষার্থী এবং তার গুণমুদ্ধদের নিয়ে কালিগঞ্জে গড়ে তুলেছিলেন সাড়া জাগান নাট্য আন্দোলন। নিজের রচিত নাটক স্বনির্দেশনায় মঞ্চস্থ করেছেন। নিজে অভিনয়ও করতেন। বলা যায় এক সময় তিনি কালীগঞ্জের ‘নায়ক’ ছিলেন।
বড় ভাবীর ছোট বোনকে নবঃঃবৎ যধষভ হিসেবে পাওয়া ভিন্ন ধরনের রোমান্টিকতা। তিন তিনটে সুযোগ্য চাকরিজীবী পুত্র সন্তান এবং পুত্রবধূ ও নাতি-নাতনি নিয়ে ভাবিসহ আজিজ ভাইয়ের যে সংসার জীবন সেখানে কোনো উল্লেখযোগ্য তরঙ্গ বিক্ষোভ ঘটেনি।
আমাদের বাঙালি মধ্যবিত্তের জীবন কাহিনি অনেকটা ব্যাগ ভরা মিথ্যাচার। কিন্তু জানা মতে আমাদের আজিজ ভাই ভীষণভাবে এক ভিন্ন মানুষ। একবার ঈদের ছুটিতে আজিজ ভাইয়ের কালীগঞ্জের হাফ বিল্ডিং-এর বাসভবনে সপ্তাহ খানেকের অনাহুত অতিথি হিসেবে অকাস্মাৎ উপস্থিত হলাম। সে অনেক দিন আগের কথা। আমি তখন কলারোয়া কলেজে। আজিজ ভাই উঠোনে দাঁড়িয়ে ছিলেন কোথাও যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে। আমাকে দেখেই সহাস্যে জড়িয়ে ধরে কিছু আন্তরিক অভিবাদন শব্দ আওড়িয়ে বললেন, খবর কী?
আমি নিঃসঙ্কোচে বললাম, ঈদের ছুটি কাটাব বলে এসেছি। বাসায় কেউ কিছু জানে না। আপনার সঙ্গে ঘুরবো, আড্ডা দেবো আর বাংলা কবিতার ছন্দ সম্পর্কে আলোচনা করবো। ঠিক ঈদের দিন সেমাই খেয়ে চলে যাব।
এভাবেই আমি আমার ভ্রমণ পরিকল্পনাটি বলে ফেললাম।
আজিজ ভাইয়ের চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে আছি। কোনো বিরক্তি কিংবা অস্বস্তি দেখছি না। বরং হাস্যোজ্জ্বল আজিজ ভাই হাত বাড়িয়ে করমর্দন করতে করতে সাবলীল উচ্চারণে বললেন, ঈদের সাত দিন আগে এ রকম অতিথি পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার। ইতোমধ্যে ভাবি দরজা খুলে ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমাদের দেখছেন, আজিজ ভাই উচ্চৈঃস্বরে বললেন, আরে দেখছো কী? এই সেই নিমাই ম-ল। যার কথা বলি। আমরা এখন ঘুরে আসি পরে কথা বলবো। ভাবি ক্ষীণকণ্ঠে বললেন, চা দিচ্ছি।
আমার কাছে ছিল ছোট খাটো একটা ট্রাভেল ব্যাগ। সেটি বারান্দায় নামিয়ে আজিজ ভাই আর আমি চেয়ারে বসলাম। ভাবি দু’ কাপ চা এবং বিস্কিট টেবিলে রেখে আজিজ ভাইকে কিছু বাজার করার কথা বললেন।
আমরা চা আর বিস্কিট দিয়ে আপ্যায়িত হচ্ছি। হঠাৎ দেখি ইমরুল এসে সামনে দাঁড়িয়েছে। অমলিন শ্যামল রঙে কী চমৎকার নিষ্পাপ সৌন্দর্যের প্রতিকৃতি। আসলে বাঙালির শ্যামল রঙের অপূর্ব দীপ্তময়তা অবর্ণনীয়।
তারপরে দেখি আরও দু’জন।
আরও আছে কিনা একটু উঁকি দিয়ে ঘরের মধ্যে তাকিয়ে দেখলাম। আজিজ ভাই দ্রুত চা পান শেষ করে দাঁড়িয়ে পড়লেন। আমাকেও তাড়াতাড়ি চা শেষ করার জন্য তাগিদ দিলেন। কিন্তু আমার জিভ সুস্বাদু চা ছাড়তে চাচ্ছে না; অন্যদিকে আজিজ ভাইয়েরও তর সইছে না।
যা হোক, ইমরুলের সঙ্গে কিছু কথা বলে তিন ভাইকে আদর করে আজিজ ভাইয়ের সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম।
সন্ধ্যা হবো হবো। ব্রিজের ওপরে দাঁড়িয়ে কাঁকশিয়ালী নদী দেখছি। অসাধারণ। কলারোয়া থেকে বাসে চড়ে কালীগঞ্জ পর্যন্ত আসার ক্লান্তিটা ক্রমশ দূরীভূত হলো।
আজিজ ভাই এক সময় বললেন, চলেন, যাওয়া যাক। আরেকটু চা খাই। ব্রিজ থেকে নেমে পাকা রাস্তার ধারে একটি চায়ের দোকানে বসলাম। বেশকিছু দোকান-পাট রাস্তার এ ধারে-ওধারে। একটা বাজারের মতো। কিছুটা শহুরে শহুরে ভাব।
আমরা যখন চায়ের দোকানে বসলাম, তখন দোকানদার বেশ সমীহ করে টেবিল পরিষ্কার করে দিলো। চায়ের দোকানটায় পাঁচ-ছয় জন লোক- কেউ কেউ চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিল, কেউবা গল্প-গুজবে মশগুল। আজিজ ভাই আসার কারণে কয়েকজন সংকোচে জড়সড় হয়ে স্থান ত্যাগ করলো; আবার আজিজ ভাইকে চায়ের দোকানে দেখে কয়েকজন সোৎসাহে ভিতরে ঢুকে আজিজ ভাইয়ের সঙ্গে হাতে হাত দিয়ে- কেউবা সালাম ঠুকে শুভেচ্ছা বিনিময় করে যে যার মতো করে বসে পড়লো। ঘটনাটি খুব সাধারণ হলেও আমার কাছে খুব তাৎপর্যপূর্ণ মনে হলো।
শুরু হলো চা পান। সঙ্গে বিস্কিট-মুড়ি। ক্ষুধার কারণে আমি অন্তত অমৃতের মতো আস্বাদন করলাম।
ইতোমধ্যে আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। নানা ধরনের-নানা স্বাদের। আজিজ ভাই মধ্যমণি। আমাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো খুব গুরুত্বের সঙ্গে। মাঝে মাঝে আমাকে কিছু বলার জন্য তাগিদ আসল। আমি অতীব বিনয় প্রকাশ করে কোনো রকমে রেহাই পেলাম। ক্রমশ আলোচনা গতি পাচ্ছে। সংগীতের উচ্চ-নিনাদের মতো জমে উঠেছে। এখন মনে হচ্ছে আমরা একটি ক্লাবের মধ্যে আছি।
অবশেষে আরেক দফা চা। সেদিনের মতো শেষ হলো আড্ডা। আড্ডাটির মধ্যে যে খুব বেশি শৃঙ্খলা ছিল তা নয়- বলা যায় বিশৃঙ্খলার মধ্যে শৃঙ্খলা এবং এক ধরনের কাব্যিক, সাহিত্যিক, সাংগীতিক, আধুনিক, নাগরিক, সামাজিক, লৌকিক এবং নাটকীয় পরিম-লের মধ্যে কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে দেওয়া গেলো। এই যে বললাম ‘বিশৃঙ্খলার মধ্যে শৃঙ্খলা’- এটিই বুঝি আধুনিক কবিতার শৈলী এবং সুষমার গোপন সত্য। যেমন প্রাণী, উদ্ভিদ এবং পরিবেশের মধ্যে Unity in diversity.
রাত প্রায় দশটা অতিক্রম করেছে। আজিজ ভাই উতলা হয়ে উঠেছেন। এদিকে বাজার করা হয়নি। আমাকে দায়ী করেই যেন বললেন, আপনার ভাবি তো বাজার করতে বলেছিল, আপনি তো মনে করিয়ে দেবেন।
আমার প্রতি বেশ অখুশীই মনে হলো। কিন্তু আমার তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না। আজিজ ভাই দ্রুত হেঁটে চলেছেন। আমি পেছনে হাঁটছি। বাজার করতে পারেননি বলে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন কয়েকবার। আমি আবিষ্কার করে ফেললাম- আজিজ ভাই যতক্ষণ চায়ের দোকানে ছিলেন ততক্ষণ বোহেমিয়ান; আর এখন গৃহী। সত্যি সত্যি আজিজ ভাই না গৃহী না বোহেমিয়ান। তবে পিথাগোরাসের মতো ‘ইউরেকা’ ‘ইউরেকা’ বলে চেঁচিয়ে উঠিনি। বিষয়টি নিয়ে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়াও আমার মধ্যে সৃষ্টি হলো না। কারণ নিদারুণভাবে ক্ষুধাক্রান্ত এবং আমরা প্রায় সবাই বিশেষ করে আমিও অনেকটা না গৃহী না বোহেমিয়ান টাইপের।
বিশ-পঁচিশ মিনিটের মধ্যে আমরা পৌঁছে গেলাম। ভাবি জেগে আছেন। তেমন কিছু বললেন না। সয়ে গেছে। শুধু আমাকে বললেন, আপনার তো খুব কষ্ট হয়েছে। আমি যে কতটা মিথ্যা কথা বলতে পারি তা ঐদিন বুঝলাম। নির্দ্বিধায় বললাম, না ভাবি, কোনো কষ্ট হয়নি। অনেক কিছু খেয়েছি। রাতে না খেলেও চলবে।
রাত্রে খাওয়া-দাওয়া করে বিছানায় গেলাম। চমৎকার-পরিপাটি। বেশ কিছু বই বিছানার দু’পাশে সুন্দর করে সাজানো। ঘুমিয়ে পড়লাম দ্রুত। সকালে যথারীতি ঘুম ভেঙে গেলো। উঠে বসলাম। দেখি শয্যাশীর্ষে কাঁচের গ্লাস দিয়ে ঢাকা একজগ জল। বালিশের পাশে একটি ছোট টর্চ লাইট। সবই ঠিক আছে। কিন্তু সাজানো বই! অপূর্ব।
হঠাৎ আজিজ ভাই ডাকলেন। আমি দ্রুত ফ্রেশ হয়ে আজিজ ভাইয়ের সাথে নাস্তা করতে বসলাম। আজিজ ভাই বললেন, ঘণ্টাখানেক আগে দু’জন এসে আপনাকে নিমন্ত্রণ করে গেছে। আমি জানতে চাইলাম, কোথায়? কালকের রাতের মতো কোনো আড্ডায়- আজিজ ভাই বললেন। এভাবেই এক সপ্তাহ কেটেছিল। আড্ডা, আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক, চা-পান, আন্তরিক আপ্যায়ন, আজিজ ভাইয়ের সঙ্গে আমার ছন্দ নিয়ে দু’দিনের একান্ত আলোচনা, আরো অনেক কিছু। আমি ঠিকই ঈদের দিন সেমাই খেয়ে কলারোয়ায় চলে এসেছিলাম।
এই কয়দিনে আজিজ ভাইয়ের সাংগঠনিক ও নেতৃত্বদানকারী কৌশল এবং যোগ্যতা সম্পর্কে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম। তিনি একজন সফল নির্দেশকও ছিলেন। তার নির্দেশনায় যে আয়োজন ও অনুষ্ঠানগুলো হতো সেখানে তার মানুষগুলো ভীষণ আন্তরিকভাবে অংশগ্রহণ করতেন। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে এসে সময়মতো দায়িত্ব পালন করে নিজেদেরকে ধন্য মনে করতেন। কয়েকটি অনুষ্ঠানে তার পাশাপাশি থেকে কাজ করতে যেয়ে দেখেছি মানুষ খুব চধংংরড়হ নিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করছে।
আজিজ ভাই যেমন গম্ভীর তেমনই খোলামেলা; যেমন হাসিখুশি তেমনই কিছুটা রগচটা। কাজ করতে যেয়ে সমস্যা হলে তিনি মাঝে মধ্যে ক্ষেপে যেতেন। আবার সেই মুহূর্তেই প্রাণ খোলা হাসির ঝলক সবাইকে মুগ্ধ করতো। তার অসাধারণ আন্তরিকতা সবার ক্ষোভ-দুঃখ ভুলিয়ে দিতো। আজিজ ভাইয়ের প্রতি রাগ করা যায়। কিন্তু তাকে ত্যাগ করা যায় না।
সাতক্ষীরার সাহিত্যঅঙ্গনকে সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে আজিজ ভাইয়ের নেতৃত্বস্থানীয় অবদান সর্বজনবিদিত। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কবি, লেখক, সংগীত শিল্পী এবং বিদগ্ধ শিক্ষাবিদদের সাতক্ষীরার সাহিত্য আয়োজনে অংশগ্রহণ যতদূর জানি আজিজ ভাইয়েরই অবদান। ড. অমিতাভ চক্রবর্তী, ড. কানাই সেন, নৃপেন চক্রবর্তী, স্বপ্না গঙ্গোপাধ্যায়, প্রণব মুখোপাধ্যায়, অশোক রায় চৌধুরী, গোপাল বিশ্বাস, সুকুমার সিং প্রমুখদের প্রথমদিকে আজিজ ভাইয়ের আমন্ত্রণে এবং ব্যবস্থাপনায় সাতক্ষীরার প্রত্যন্ত অঞ্চলেও সাহিত্য আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে দেখেছি। পরবর্তী অনেকেই আজিজ ভাইকে অনুসরণ করে অথবা তার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে এই ধারা আরও বেগবান রেখেছেন।
আজিজ ভাই এক সময় কালীগঞ্জে প্রেসের ব্যবসা শুরু করেছিলেন। উদ্দেশ্যটি ঠিক বাণিজ্যিক ছিল না। নিয়মিত সাহিত্যপত্র প্রকাশনা এবং সাহিত্য বিষয়ক বই-পত্র স্বল্প ব্যয়ে মুদ্রিত করা। আরও কোনো বড় মাপের পরিকল্পনা ছিল কিনা জানা নেই। কিন্তু ব্যবসা কখনও আজিজ ভাইকে বশ করতে পারেনি; আর আজিজ ভাইও কখনও ব্যবসার বশ্যতা স্বীকার করেননি। ফলে যা হবার তাই হয়েছিল।
‘নদী’ তার সৃজনশীলতার দর্পণ।
গত আশির দশকের শেষের দিকে যশোরের সাহিত্যজনদের একটি সাহিত্য উদ্যোগে কবি শামসুর রাহমান এসেছিলেন। তার সঙ্গে সস্ত্রীক রফিক আজাদ এবং পশ্চিম বাংলা থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও প্রণতি ঠাকুর (রবীন্দ্র পরিবারের সদস্য) সহ আরো অনেকে। সবার কথা মনে নেই। তখন যশোরে কবিতার বান ডাকতো। আমরা কয়েকজন বন্ধু টগবগে আবেগের তাড়নায় সেখানে উপস্থিত হলাম। খুবই উপভোগ্য-হৃদয় দোলানো-বোধ ভাসানো আয়োজন ছিল এটি। শামসুর রাহমানের স্বকণ্ঠে ‘ইলেকট্রার গান’ আবৃত্তি অনেকের চোখ ভিজিয়ে দিয়েছিল।
মধ্যাহ্নভোজের বিরতির পর আমি যে সোফায় বসেছিলাম সেই সোফায় এসে বসলেন কবিতার রাজপুত্র শামসুর রাহমান। আমি কবিতার দিনমজুর করি কী তখন? ভীষণ অস্বস্তি। এক সময়ে হাত ইশারায় আমাকে ডাকলেন।
কী করা হয়?
শিক্ষকতা
কোথায়?
সাতক্ষীরায় (কলারোয়ার কথা বলতেই ভুলে গিয়েছিলাম)
সাতক্ষীরার গাজী আজিজুর রহমানকে চেনেন?
সাতক্ষীরায় হাজার হাজার গাজী আজিজুর রহমান থাকলেও স্বাধীনতার কবি শামসুর রাহমান উচ্চারিত ‘গাজী আজিজুর রহমান’ আমাদের আজিজ ভাই হবেন নিঃসন্দেহে।
আমি বললাম,
চিনি
উনি এসেছেন?
না, দেখিনি।
উত্তরগুলো কেমন কাট কাট দ্রুত হয়ে যাচ্ছে।
চোখে আইড্রপ দিয়ে দিতে পারেন?
পারি
এর আগে কাউকে দিয়েছেন?
হ্যাঁ
পাশে রাখা চটের সুন্দর নক্সা করা থলে থেকে আইড্রপের শিশি আর ড্রপার বের করে আমাকে ইন্সট্রাকশন দিলেন।
আমি দুরু দুরু বুকে চোখে ড্রপ দিয়ে দিলাম।
ডবষষ ফড়হব, ঞযধহশ ুড়ঁ.
আমি ‘নবেল লরিয়েট’ হয়ে গেলাম।
খুব সহজেই বোঝা যায়, আজিজ ভাই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের মনোযোগী পাঠক এবং বোদ্ধাজন। রবীন্দ্র অনুরাগী কিন্তু তিরিশের কবিদের প্রতি আগ্রহ প্রবল। সমকালীন অগ্রজ, সতীর্থ ও অনুজদের লেখালেখি তার দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়া কঠিন। কালীগঞ্জে অবস্থানকালে ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল নিয়মিত এবং ঘনিষ্ঠ। আর এখন তো কালীগঞ্জ-ঢাকা, ঢাকা-কালীগঞ্জ। এবং এ কারণেই আজিজ ভাই তার লেখক সত্তা জীবন্ত রেখে তারুণ্যের উষ্ণতা ছড়িয়ে দেন সবার মাঝে।
বিশ্ব সাহিত্যের মহাসাগরীয় বিশালতায় তিনি ডুব দিয়েছেন রাজহংসের মতো। সক্রেটিস তার ভেতরে রাখা আরদ্ধ মানিক। হোমার, দান্তে, অভিদ, এরিস্টটল, সফোক্লিস, চসার, সেকস্পিওর, মিলটন, পোপ, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কোলরিজ শেলি, কীটস, বায়রন, টিএস এলিয়ট, সিলভিয়া প্লাথ, ডিকেন্স, টলস্টয়, বোদলেয়ার, বেকেট, ব্রেশট, মার্ক টোয়েন, ইমারসন, হুইটম্যানসহ আরও অনেককে বুঝবার চেষ্টা করেছেন আন্তরিকভাবে। ‘সাহিত্যে সমাজ বাস্তবতা’ বা অন্য কোনো প্রবন্ধ-নিবন্ধে কিংবা বক্তৃতায় তার বিশ্ব সাহিত্যের বারান্দায় চলাচলের শব্দ শোনা যায়।
আজিজ ভাই মূলত কবি। কিন্তু কবিতা তেমন লিখলেন না। তিনি আমাকে অথবা বোধ করি অনেকক্ইে বলেছেন- ‘আমাকে কবিতা নিয়েই কাজ করতে হবে। কবিতাই আমার আসল জায়গা।’ গভীর অনুধাবনে আমাদের উপলদ্ধিতে ধরা পড়ে আজিজ ভাইয়ের গাদ্যিক বিন্যাস কাব্যিক হাওয়ায় দোল খায়।
সিকান্দার আবু জাফর সম্মাননা পদক সর্বপ্রথম প্রদান করা হয় আজিজ ভাইকে। ওই অনুষ্ঠানে আজিজ ভাইকে যে সম্মাননা পত্র দেওয়া হয়েছিল সেটি লেখার দায়িত্ব ছিল আমার। সেই সূত্রে আজিজ ভাইয়ের সঙ্গে আমার কিছু কথা হয়। কথাচ্ছলে আজিজ ভাই এক প্রকার ক্ষোভ প্রকাশ করেই বললেন, রবীন্দ্রনাথ সুন্দরবন সম্পর্কে কিছু লেখেননি। এমনকি সুন্দরবন ভ্রমণে কখনো এসেছিলেন কীনা তাও জানা যায় না।
আমার তো চক্ষু চড়ক গাছ। আমিও অল্প বিস্তর খোঁজ-খবর নিয়ে যা দেখলাম- তা আজিজ ভাইয়ের ধারণা এবং ক্ষোভ সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্তে আসা গেলো না। অবশ্য আজিজ ভাইয়ের এই ক্ষোভ সুন্দরবনের প্রতি গভীর ভালোবাসার অন্য প্রকাশ। যে রবীন্দ্রনাথ প্রায় সারা পৃথিবী ভ্রমণ করেছেন, নবেল পাওয়ার পর অনেক দেশ তাকে নিমন্ত্রণ করে এবং একমাত্র অস্ট্রেলিয়া ছাড়া প্রায় সবদেশেই তিনি ভ্রমণ করেছেন। সেই রবীন্দ্রনাথ আমাদের সুন্দরবন ভ্রমণ করবেন না- সুন্দরবন নিয়ে কিছু লিখবেন না- এটা সত্যি ভাবা যায় না।
পরবর্তীতে ইন্টারনেটে ভাসা ভাসা একটা তথ্য পাওয়া গেলো। জানা গেলো রবীন্দ্রনাথ ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ২৯ ও ৩০ ডিসেম্বর এই দু’দিন ভ্রমণ উপলক্ষে সুন্দরবনে অবস্থান করেন।
আজিজ ভাই বহুলপ্রজ লেখক নন। ১০/১২টি বই তার প্রকাশ পেয়েছে। এটি আমি কমও বলবো না আবার বেশিও বলবো না। প্রকাশনার সংখ্যা নিয়ে লেখক বিবেচনা কখনও সুবিবেচনা হবে না। আমরা চাই আজিজ ভাই আরও লিখুন। কবিতা ও উপন্যাস লিখুন। তিনি লিখতে চান অথচ লেখেন না। আজ সাহিত্য-সংস্কৃতি-শিল্পের মানবিক পাটাতন খুব বিস্তৃত করা দরকার। মানুষ খুব সংকটে আছে। শুধু বাংলাদেশের মানুষ না- পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ আজ অরক্ষিত। জীবন আজ নানাভাবে-নানা পরীক্ষায়-নানা ফাঁদে আটকে গেছে। এই জীবনকে রক্ষা করতে হবে- এই জীবনকে পথ দেখাতে হবে- এই জীবনকে অন্য জীবনের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে।
আজিজ ভাইয়ের জীবন অন্বেষা দিশা খুঁজে পেয়েছে কিছু নির্বাচিত গ্রন্থের পাতায়। তার জীবনবোধও গড়ে উঠেছে একাগ্র পঠন-পাঠনের অভিঘাতে। সম্প্রতি কালীগঞ্জে একটি শিক্ষার্থী সমাবেশে আলোচনাচ্ছলে তিনি বলেছেন, তার বিছানায় মাথার কাছে সবসময থাকতো গীতবিতান আর কার্ল মার্কস্। কার্ল মার্কস্ও বুকের উপর হোমার-দান্তে রেখে ঘুমাতেন।
গাজী আজিজুর রহমান, আপনি সত্তরে পা রাখা এক দুরন্ত যৌবন। নজরুল বলেছেন যৌবনকে বয়সের ফ্রেমে ঢেকে রাখা যায় না। নজরুলের এই যৌবনবোধ-যৌবন ধারণা পৃথিবীকে পাল্টে দিতে পারে। যৌবন সম্পর্কে এত বড় সত্য খুব কম মানুষ বুঝতে পারে। আজ যৌবন শক্তি নানাভাবে আক্রান্ত ও বিভ্রান্ত। এই আক্রান্ত ও বিভ্রান্ত যুবশক্তি মানব সংস্কৃতির সংস্পর্শে নবজীবনের সন্ধান খুঁজে পাক। কবি আবুল হাসানের ‘এপিটাফ’-এ উৎকীর্ণ ‘মিলনই মৌলিক’-এই বোধ আমাদের সকলের বার্ধক্য, জরা, জীর্ণতা ধুয়ে মুছে ছাপ করে দেবে। আর এ সকল শুভবোধ আপনি আপনার করোটিতে ধারণ করেন। মুক্তিযুদ্ধ আপনার জীবনাদর্শের স্বর্ণকমল। যে মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক আদর্শে বিশ্বাস করে তার মৃত্যু নেই- নেই বার্ধক্য, জরা, জীর্ণতা। সে চির নতুন-চির সবুজ-চির উদ্যম।
আজিজ ভাই, আপনার জন্ম সার্থক হোক- বর্ণাঢ্য হোক জন্মদিনের আয়োজন- শুভ জন্মদিন।
লেখক : কবি, প্রাক্তন উপাধাক্ষ্য সরকারি কলেজ

সাতক্ষীরার সাহিত্যাঙ্গনে গাজী আজিজুর রহমান : পল্টু বাসার
গাজী আজিজুর রহমান। প্রাবন্ধিক, কবি, সাহিত্য সমালোচক, সাহিত্য সংগঠক। সাতক্ষীরার সাহিত্য অঙ্গনের এক শ্রদ্ধাভাজন নাম। তাঁর সত্তর বছরের জীবন, অধ্যাপনা ও সাহিত্যচর্চা আমাদের উদ্দীপ্ত করে। নিজের সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি সাতক্ষীরার সাহিত্যাঙ্গনকে উজ্জীবিত করতে তিনি সব সময় আগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। সাহিত্যাঙ্গনের যেকোনো আহ্বান তাঁকে সাতক্ষীরামুখি করে তোলে। তিনি সাতক্ষীরার সাহিত্যাঙ্গনকে সমৃদ্ধ করেছেন নানাভাবে। বিশেষ করে সাতক্ষীরার সাহিত্যকর্মীদের সাহিত্যকর্মের সাথে যখন এদেশের প্রখ্যাত সাহিত্যিক কিম্বা পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিকদের এমন কি পাশ্চাত্যের সাহিত্যিকদের অনায়াসে তুলনা করে দেন তখন মনে হয় আমরা বোধহয় বৃত্ত ভাঙার কাজে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছি।
‘বৃত্ত থেকে মুক্তি’ শ্লোগান নিয়ে গড়ে তুলেছিলাম সাতক্ষীরা সাহিত্য একাডেমি। নব্বইয়ের দশকে জেলাভিত্তিক একমাত্র সাহিত্য সংগঠন। ১৯৯০ সালে প্রথম সাহিত্য সম্মেলন। সাহিত্যিক বেদুঈন সামাদ প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়েছিলেন। দেবহাটার একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন কবিতা আবৃত্তি করেছিল ওই সম্মেলনে। সাহিত্য একাডেমি প্রতিষ্ঠা করে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করতে থাকি। প্রথম সম্মেলনে সভাপতি হন অধ্যক্ষ মতিউর রহমান। প্রতি উপজেলা থেকে একজন করে সহসভাপতি ও দুজন করে সদস্য এর অন্তর্ভুক্ত হন। এভাবে জেলা ব্যাপি সাহিত্যের কাজ শুরু করি। গাজী আজিজুর রহমান হন সিনিয়র সহসভাপতি। সাতক্ষীরা সাহিত্য একাডেমি আয়োজিত ১৯৯৫ সালের সাহিত্য সম্মেলন সাতক্ষীরার সাহিত্যাঙ্গনের জন্য বিশেষ দিন। এই দিনটি বিশেষ হয়ে উঠেছিল গাজী আজিজুর রহমানের কারণে। তাঁরই সংযোগ ও সহযোগিতায় সম্মেলনে উপস্থিত হয়েছিলেন কবি নির্মলেন্দু গুণ, কবি আসাদ চৌধুরী, কবি সমুদ্র গুপ্ত, কবি জাহাঙ্গীর হাবীবউল্লাহ ও কবি ব্রাত্য রাইসু। জাতীয় পর্যায়ের এতোজন সাহিত্যিকের সান্নিধ্য একসাথে এর আগে আর সাতক্ষীরার সাহিত্যাঙ্গনে ঘটেনি। ৯০ থেকে ৯৫ এই পাঁচ বছরে অনুভব করেছিলাম সাতক্ষীরা সাহিত্য একাডেমির জন্য একজন আরও সক্রিয় সভাপতি প্রয়োজন। একদিন কালীগঞ্জে আজিজ ভাইয়ের বাড়ির ছাদে বসে দুজনে কথা বলছি। অনেকটা ঝুঁকি নিয়েই প্রস্তাব দিলাম। ‘এবার আপনি সভাপতি হবেন’। বিস্ময় চোখে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন, তারপর বললেন- কি বলছো তুমি? তোমার সাতক্ষীরা শহরে কতজন আছেন। তাদের বাদ দিয়ে আমাকে সভাপতি করলে তোমার জন্য সমস্যা হবে। আমি বললাম, সে জেনেই আমি প্রস্তাব করেছি। ওনাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বলছি- আমি আরও কাজ চাই, আরও অনেক দূর পৌঁছে যেতে চাই সাতক্ষীরার সাহিত্যাঙ্গনকে নিয়ে। আপনাকে পেলে সাতক্ষীরার সাহিত্যাঙ্গনের ‘বৃত্ত থেকে মুক্তি’ ঘটাতে পারবো। ঢাকা ও কলকাতার সাহিত্যিকদের সাথে আপনারই যোগাযোগ বেশি। আপনি চুপ থাকবেন, বাকিটা আমার ওপর। ১৯৯৫ সালের সম্মেলনের আয়োজন চলতে থাকলো। সাড়া পড়ে যাওয়া সম্মেলন হলো। কবি সাহিত্যিকরা ঢাকায় ফিরে গেলেন। তাঁদের সাথে সংযুক্ত বিভিন্ন সংবাদপত্রে সাতক্ষীরার লেখকদের লেখা প্রকাশ হতে থাকলো। ১৯৯৫ এর সাহিত্য সম্মেলনেই গাজী আজিজুর রহমান সাতক্ষীরা সাহিত্য একাডেমির সভাপতি হলেন। আর পিছনে ফেরা লাগেনি। ’৯৭ এর সম্মেলনে দু’বাংলার কবি সাহিত্যিকদের মিলনমেলা হলো সাতক্ষীরায়। এপার বাংলার সৈয়দ শামসুল হক, হাসান আজিজুল হক, জুলফিকার মতিন, ড. হাবিব রহমান, খায়রুল বাসার প্রমুখ আর ওপার বাংলার ড. কানাই সেন ও ড. অমিতাভ চক্রবর্তী, নৃপেন চক্রবর্তী, স্বপ্না গাঙ্গুলি, সাধন ঘোষ, প্রণব চট্টোপাধ্যায়কে সম্মেলনে আমন্ত্রণ করে আনা হলো। কলকাতার সাথে সাতক্ষীরার এই যে সেতুবন্ধন হলো এখনও তা অব্যাহত আছে। সাতক্ষীরা সাহিত্য একাডেমি যে কাজটার সূচনা করেছিল এখন তা আরও সমৃদ্ধ হয়েছে। এখন ইচ্ছা করলেই সাতক্ষীরার কবি সাহিত্যিকদের লেখা কলকাতার সাহিত্য পত্রিকায় ছাপা হয়। আবার সাতক্ষীরার লিটল ম্যাগাজিনে সেখানকার লেখা নিয়মিত ছাপা হয়ে চলেছে। এখানের কবি-সাহিত্যিকরা সেখানে যাচ্ছেন যেমন, সেখান থেকেও আসছেন তেমন। এই যে, পশ্চিমবাংলার সাথে আমাদের সাহিত্যের এবং সাহিত্যিকের আদান প্রদান তার পিছনে বড় অবদান সাতক্ষীরা সাহিত্য একাডেমি আর গাজী আজিজুর রহমানের। বৃত্ত থেকে মুক্ত হয়ে সাতক্ষীরার সাহিত্য ও সাহিত্যিক এখন জাতীয় পরিম-লে এবং দেশের বাইরে বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের নানা জায়গার সাথে যুক্ত হতে পেরেছে।
এবার সাতক্ষীরার আদলে কালীগঞ্জে কালীগঞ্জ সাহিত্য একাডেমি প্রতিষ্ঠা করলেন আজিজ ভাই। সেখানেও ঢাকা সাতক্ষীরা আর কলকাতার সাহিত্য-সাহিত্যিকের সম্মেলন করলেন বেশ কয়েক বছর। এভাবে সাতক্ষীরার সাহিত্যাঙ্গনের সমৃদ্ধিতে তিনি অবদান রাখলেন। সাতক্ষীরা সাহিত্য একাডেমির ‘বৃত্ত থেকে মুক্তি’ শ্লোগানকে বাস্তবায়িত করলেন। নিজের সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি সাতক্ষীরার আর সাহিত্যকর্মীদের সহায়তায় তিনি সব সময় আন্তরিক। সাতক্ষীরার কোনো অনুষ্ঠানে উনি উপস্থিত হলে সে সাহিত্যানুষ্ঠান বা আড্ডা বিশেষ মর্যাদা পায়। গাজী আজিজুর রহমান মফস্বলে বসবাস করছেন আর সেখান থেকেই কেন্দ্রে নিজকে স্থাপন করেছেন। তাঁর প্রবন্ধ পাওয়ার জন্য কেন্দ্রের অনেক কাগজ প্রতীক্ষায় থাকে।
তাঁর জীবনের এই সত্তরতম বছরে সাতক্ষীরার সকল সাহিত্য ব্যক্তির পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানাই। তিনি দীর্ঘজীবী হোন। প্রাচ্য-পাশ্চাত্য’র সাহিত্য বিশ্লেষণে আরও আমাদের সমৃদ্ধ করুন। আমরা আলোকিত হই।
লেখক : কবি, শিক্ষক, সাধারণ সম্পাদক সাতক্ষীরা সাহিত্য একাডেমি, সভাপতি ঈক্ষণ সাংস্কৃতিক সংসদ

গাজী আজিজুর রহমান : কবির রায়হান
বাংলা দেশ কবিতার দেশ। সুতরাং কবিতার লেখক যে বেশি হবে- এটাই স্বাভাবিক। সেই স্ব^াভাবিকতার সাথে মিশে আছে সাতক্ষীরা নামের জেলাটিও। মোটা দাগে বাংলা সাহিত্যকে গদ্য সাহিত্য ও পদ্য সাহিত্য দুইভাগে বিন্যাস্ত করলে ক্ষতি কি? গদ্য সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ, নাটক, সমালোচনা, গবেষণা প্রভৃতি। পদ্য সাহিত্যের অন্তর্র্ভুক্ত কবিতা, শুধুই কবিতা। তবে সাতক্ষীরায় গদ্যচর্চা যে হচ্ছে না তা নয়। যে দেশে যত বেশি শহরায়ন, নগরায়ন ও শিল্পায়ন হয়েছে, সেই দেশে গদ্যচর্চা বেশি হয় ইউরোপ ও আমেরিকার শিল্পায়িত দেশগুলিই তার সবচেয়ে বড় গদ্যচর্চায় এগিয়ে এসেছেন। এদের কেউ কেউ ভালো গদ্য লিখছেন। প্রবন্ধ, সমালোচনা ও গবেষণা সাহিত্যে যে দুচারজন লেখক নিবেদিত প্রাণ তাঁদের মধ্যে গাজী আজিজুর রহমান অন্যতম।
লেখক গাজী আজিজুর রহমানকে বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন মাধ্যমে লেখালেখি করতে দেখা গেছে। কখনো তিনি উপন্যাসিক, কখনো নাট্যকার, কখনো প্রবন্ধকার, কখনো সমালোচক, কখনো গবেষক। কিন্তু আমার ধারণা, তিনি সাহিত্যের সমালোচক হিসেবেই বেশি সিদ্ধি লাভ করেছেন। অবশ্য সমালোচক ও গবেষক মাত্রই প্রবন্ধকার। কিন্তু প্রবন্ধকার মাত্রই সমালোচক ও গবেষক নন। আমি গাজী আজিজুর রহমানকে একজন সমালোচক হিসেবেই অভিহিত করতে চাই। বাংলা সাহিত্যের অনাগতকালে তিনি প্রবন্ধকার নন, একজন পাকা সমালোচক হিসেবে পরিচিত হবেন।
প্রবন্ধকার শুভ্র আহমেদ সাহিত্যে সমাজ বাস্তবতার ধারা, স্বেচ্ছামৃত্যুর করতলে কবি, সাহিত্য ও সিংহাসন, নোবেল সাহিত্য পুরস্কারের শতবর্ষ, আধুনিক বাংলা উপন্যাসের বিষয় ও শিল্পরূপ এবং কবিদের কবি এই ছয়খানা বইকে প্রবন্ধের বই বলেছেন। আমি তাঁর কথায় একমত নই। এই ছয়খানা বই আসলে সমালোচনামূলক বই, প্রবন্ধের বই নয়। সমাজ-সংস্কৃতি-ইতিহাস-দর্শন-রাজনীতি-ধর্ম-অর্থনীতি প্রভৃতি বিষয়ে সমস্যামূলক চিন্তাভিত্তিক প্রবন্ধ লেখার দিকে তাঁর ঝোঁক কম। তিনি বিমুগ্ধ সাহিত্যভিত্তিক সমালোচনামূলক লেখালেখিতেই প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন বেশি। সম্ভবত কলেজে সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন বলেই তিনি সাহিত্য সমালোচনায় আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। কখনো কখনো প্রবন্ধ, সমালোচনা ও গবেষক একে অন্যের পরিপূরক হয়ে দাঁড়ায়। গাজী আজিজুর রহমানের ক্ষেত্রে এটা হবে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
গাজী আজিজুর রহমান একজন প-িত মানুষ। বাংলাদেশের সাহিত্য সম্পর্কে তো বটেই, বিদেশি সাহিত্য নিয়ে তার ব্যাপক পড়াশোনা আমাকে মুগ্ধ করেছে। তিনি বেশ কিছু সাহিত্যভিত্তিক সমালোচনামূলক প্রবন্ধ লিখেছেন। এই ধরনের কয়েকটি প্রবন্ধ সম্পর্কে আমি আমার সমালোচনা সীমাবদ্ধ রাখতে চাই। কাজী আব্দুল ওদুদ, কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল ফজল, আহমদ শরীফ, আব্দুল হক, আনিসুজ্জামান, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আহমদ ছফা, আবুল কাসেম ফজলুল হক, শিবনারায়ণ রায়, অমøান দত্ত, অশোক মিত্র প্রমুখ যে অর্থে প্রবন্ধকার, গাজী আজিজুর রহমান সেই অর্থে কিন্তু প্রবন্ধকার নন। বরং তিনি একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠ সাহিত্য সমালোচক।
আমি প্রথমেই বাংলাদেশের প্রবাদপ্রতীম প্রবন্ধকার আহমদ শরীফ সম্পর্কে লিখিত ‘যিনি কখনো কলম ও কণ্ঠ ভাড়া দেননি’ নামের প্রবন্ধটি নিয়ে আলোচনা করতে চাই। বাংলাদেশে আহমদ শরীফ যে ধারার, যে ধরনের ও যে বৈশিষ্ট্যম-িত প্রবন্ধ লিখেছিলেন, সেই রকম চিন্তামূলক সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক-ধর্মীয়-ঐতিহাসিক প্রবন্ধ খুব কম রচিত হয়েছে। কারণ তিনি (আহমদ শরীফ) একজন জীবনজয়ী সাহিত্যকার অর্থে একজন বুদ্ধিজীবী ছিলেন। গাজী আজিজুর রহমান যখন ‘আহমদ শরীফ এক স্বতন্ত্র মানববৃক্ষ। সূর্যরশ্মিতে যার বিকাশ ও ব্যাপ্তি। রূপে রঙে আচারে আচরণে, বাগ্মিতায় ভাষণে বিশ্বাসে-নিঃশ্বাসে, আত্মবান আদর্শে যিনি অনির্বাণ উজ্জ্বল।’ প্রকৃতপক্ষে আহমদ শরীফ উন্নত, অটল, ঋজু ও দৃঢ় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন দেবদারু বৃক্ষ ও বটবৃক্ষই ছিলেন। আহমদ শরীফের ব্যক্তিত্ব ও পা-িত্য ছিল হিমালয় সদৃশ। গাজী আজিজ আমার মনের কথাগুলোই যেন প্রকাশ করেছেন। ওই একই প্রবন্ধে গাজী লিখেছেন ‘একান্ত আত্মবিশ্বাসী, প্রখর যুক্তিবাদী, ইতিহাস সচেতন, সমকালের জাগ্রত বিবেক, বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, কালের ভাবুক ও চিন্তক, সময়ের সাহসী সিন্দাবাদ, আমাদের চেতনার হিরন্ময় হেমকুট আদর্শ শিক্ষা গুরু ড. আহমদ শরীফ ছিলেন এদেশের প্রগতিশীল প্রতিটি মানুষের প্রেরণার উৎস।’ এই সুদীর্ঘ বাক্যটির প্রতিটি শব্দ অক্ষরে অক্ষরে সত্য। ড. আহমদ শরীফ শতাব্দীতে একজন তৈরি হয়, দুইজন নয়। মানব জীবনের সকল বাধা, বিপত্তি ও অন্ধকারের অপশক্তির বিরুদ্ধে জনাব শরীফ ছিলেন বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর ও আপোষহীন লড়াকু কলমসৈনিক। এরকম সাহসী শক্ত মেরুদ-সম্পন্ন সংগ্রামী চেতানসমৃদ্ধ কলমযোদ্ধা বাংলাদেশে খুব কমই দেখা গেছে। গাজী আরও লিখেছেন ‘যে সমাজে সৎ ও সত্যানিষ্ঠ মানুষের নিতান্ত অভাব, যে দেশে যৌক্তিক ও আদর্শনিষ্ঠ মানুষের আকাল, যে জাতির মুকুরে বীর ও সাহসী মানুষের চিহ্ন মেলে না, সেখানে আহমদ শরীফের মতো মানুষের বড় প্রয়োজন ছিল।’ অবশ্যই আহমদ শরীফের কোনো বিকল্প নেই। আহমদ শরীফের প্রবন্ধে যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ প্রতিফলিত হয় এবং তাঁর প্রবন্ধ প্রতিবাদের, প্রতিকারের ও প্রতিরোধের এটোম বোম।
এবারে আমি বাংলা সাহিত্যের চেতনা প্রবাহরীতির বিখ্যাত উপন্যাসিক মানিক বন্দোপাধ্যায় সম্পর্কে লিখিত ‘ছোট বড় : বিপন্ন মানুষের বিক্রমের গল্প’ নামের প্রবন্ধটি নিয়ে আলোচনা করবো। আমি নিজে যদিও গল্প ও উপন্যাস সাহিত্যের নিবিষ্ঠ পাঠক নই। তারপরও আমার মনে হয়, মানিক বন্দোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যে চেতনা প্রবাহ রীতির শ্রেষ্ঠ উপন্যাসিক। উক্ত প্রবন্ধে গাজী আজিজ আলোচনা করেছেন মানিকের গল্পগুলো নিয়ে। বারো পৃষ্ঠার প্রবন্ধটিতে গল্পকার মানিক বন্দোপাধ্যায় চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন। মানিকের গল্পে উঠে এসেছে অতি সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের দ্বন্দ্বময় জীবন কাহিনি। গাজী লিখেছেন- ‘তিনি (মানিক) সহজ, সরল বা প্রথাগত নন। তিনি বিশ শতকের আধুনিক মতবাদের অগ্রসর লেখক। তাঁকে যথার্থ বুঝতে হলে যেমন ফ্রয়েড ও ইয়ংকে বুঝতে হয়, তেমনি বুঝতে হয় মার্কসবাদকে, আধুনিক বিজ্ঞান ও সমাজতত্ত্বকে, তিরিশোত্তর যুগ, কল্লোল যুগ ও যুদ্ধোত্তর যুগকে। বুঝতে হবে গোর্কি, এলিয়ট, এলুয়ার, আরাগঁ, বারবুসে, নেরুদা ও ব্রেখটকেও।’ আসলে আধুনিক চেতনাপ্রবাহ রীতি ও মনোস্তত্ত্বমূলক গল্প ও উপন্যাস বুঝতে হলে উপরোক্ত লেখকদের রচনার সঙ্গে অবশ্যই পরিচিত হওয়া অনস্বীকার্য। এ প্রসঙ্গে একজন সমালোচক লিখেছেন- ‘ফুকো, বার্ত, দেরিদা, লাকাঁ/না জানলে জীবন ফাঁকা।’ একালের পাঠকদের উচ্চ শিক্ষিত না হয়ে উপায় নেই। মনোবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস ও পাশ্চাত্য সাহিত্য সম্পর্কে মোটামুটি পঠন-পাঠন না থাকলে উচ্চস্তরের কথাসাহিত্য উপলব্ধি করা সহজ নয়। উক্ত প্রবন্ধে গাজী আরো লিখেছেন- ‘মানুষে মানুষে বিভেদ ও বিবাদের মূল চালিকাশক্তি ধর্মীয় উন্মাদনা, ধর্মীয় রাজনীতি ও ধর্মীয় ভাবাবেগ। মানুষে মানুষে সম্প্রীতি-সৌহার্দকে ধর্মবোধ কীভাবে মুহূর্তে কলুষিত করে তোলে, সন্দেহ সংকটে বিষাক্ত করে তোলে, তারই এক রসালো গল্প ‘ছেলে মানুষি’।’ ধর্ম ভালো, কিন্তু ধর্মীয় উন্মোত্ততা ভালো নয়। ধর্ম কিন্তু ভালোবাসার কথা বলে পরমতসহিষ্ণুতার কথা বলে, সেবার কথা বলে, শৃঙ্খলার কথা বলে, সংযমের কথা বলে, সৌহার্দ ও সম্প্রীতির কথা বলে, ঘৃণা, বিদ্বেষ ও হানাহানির কথা বলে না। ধর্ম পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ও পবিত্রতার কথা বলে। ধর্ম মানুষে মানুষে মিলন ও মৈত্রীর কথা বলে। ধর্ম তো প্রগতির সহায়ক। তাই যদি হয়, তাহলে তো ধর্ম মানবতার ও মনুষ্যত্বের পতাকাবাহী। ধর্ম আমাদের ধৈর্য, সংযম ও সহিষ্ণুতার শিক্ষা দেয়। ধর্ম নিয়ে হানাহানি, ধ্বংসযজ্ঞ ও হত্যাকা- হবে কোনো? আমরা ধর্মের বিরুদ্ধে নই, আমরা ধর্মীয় সহিংসার ও উন্মাদনার বিরুদ্ধে। আমরা হিংসার বিরুদ্ধে।
গাজী আজিজুর রহমানের নজরুল-মূল্যায়ন ইতিবাচক নয়। তিনি তাঁর ‘সাহিত্যে সমাজ বাস্তবতার ধারা’ বইতে নজরুলকে রক্ষণশীল হিসেবে অভিহিত করেছেন। যা নাকি অনৈতিহাসিক, অযৌক্তিক ও অনভিপ্রেত। নজরুল যখন বাংলা সাহিত্য অঙ্গনে আবির্ভূত হন, তখন বাঙালি মসুলমান আধুনিক শিক্ষা-দীক্ষায় অনেক পিছিয়ে ছিল। বাঙালি মুসলমান সমাজের জাগরণে নজরুল অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখেছিলেন। তাই তিনি ধর্ম নিয়েও লেখালেখি করেছিলেন। বলতে গেলে চারণের বেশে নজরুল তৎকালীন বঙ্গদেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে গান ও কবিতা নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন। এতে তিনি অনেকখানি সফলও হয়েছিলেন। তিনি ইসলামী গান লিখেছিলেন, কাব্যে আমপারা লিখেছিলেন এবং হজরত মুহাম্মদ (সা) এর জীবনী বিষয়ক ‘মরুভাস্কর’ কাব্যাকারে লিখেছিলেন। সবই লিখেছিলেন বঙ্গীয় মুসলমানদের জাগরণের জন্য। ধর্ম বিষয়ে লিখলেই যে তিনি রক্ষণশীল হবেন, এমন তো হতে পারে না। বরং নজরুল ছিলেন আপাদমস্তক অসাম্প্রদায়িক, মৌলবাদ বিরোধী ও মানবতার পূজারি।
রবীন্দ্র সাহিত্য ও রবীন্দ্রনাথের উপর লিখতে চাওয়া অপরিসীম সাহস, ব্যাপক পড়াশোনা ও ঐকান্তিক আগ্রহ থাকা দরকার। কারণ রবীন্দ্রসাহিত্য মহাসাগরের মতো। গাজীর সেই সাহস ও পা-িত্য দুটোই আছে। রবীন্দ্রসাহিত্যে নদী বিষয়ক তাঁর লিখিত বিখ্যাত প্রবন্ধটির নাম ‘রবীন্দ্রনাথ: জলতরঙ্গের সত্তা’। এই প্রবন্ধটি সম্পর্কে ব্যাপকভাবে আলোচনা হওয়া উচিত। বিপুল রবীন্দ্রসাহিত্য যে গাজী আজিজ অত্যন্ত ধৈর্য্যরে সঙ্গে মনোযোগ সহকারে পড়েছেন, তার প্রতিফলন উক্ত প্রবন্ধটির ছত্রে ছত্রে বিরাজমান। রবীন্দ্রসাহিত্য নদী বিশেষ করে পদ্মা নদীর প্রভাব প্রবলতম। উক্ত প্রবন্ধে গাজী লিখেছেন-‘পদ্মার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ খুঁজে পেয়েছিলেন মানুষের চিরন্তন স্বাভাবিক স্বভাব। পদ্মার প্রবাহ, সৌন্দর্য, মুখরতা, আক্রমণ, দু’পাড়ের লোকায়ত জীবনের নূতনতা আমূল পালটে দিয়েছিল তাঁর নিকট অতীতের ভাব, ভাষা, দর্শন ও কর্মের গতি-প্রকৃতিতে। পদ্মাকে তিনি পেয়েছিলেন নবসৃষ্টির সোনার খনিরূপে।’ সত্যিই তো, পদ্মা তীরে এসে তিনি আমূল পরিবর্তিত হয়েছিলেন। সাহিত্য, জীবন ও কর্ম-সকল ক্ষেত্রেই রবীন্দ্র-দর্শন নব নব রূপে বিকশিত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ তখন এক নতুন জগতের সন্ধান পেয়েছিলেন। রবীন্দ্রসাহিত্যে পদ্মানদীর জন্যই নতুন রীতি, নতুন দর্শন ও নতুন ভাব-ভাষা-ভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছে, একথা সর্বজন বিদিত। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যে যে গতিবাদের কথা আমরা শুনি, সেই দর্শন তো তিনি পদ্মানদী থেকেই অনুভব করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের জীবনে ও সাহিত্যে পদ্মানদী এক অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখেছিল। এই প্রবন্ধটিই প্রমাণ করে যে গাজী আজিজ একজন দক্ষ সাহিত্য সমালোচক।
আমি গাজী আজিজুর রহমানের সমালোচনামূলক প্রবন্ধের একজন গুণমুগ্ধ পাঠক। আমার পঠিত তাঁর সব প্রবন্ধ সম্পর্কে আলোচনা করতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু তা সম্ভব নয়। এবারে আমি বিখ্যাত প্রবন্ধকার প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত ‘সবুজপত্র’ পত্রিকার উপর গাজীর লিখিত ‘সবুজপত্র’র শতবর্ষ’ প্রবন্ধটি নিয়ে আলোচনা করতে চাই। গাজী উক্ত প্রবন্ধের প্রথম অনুচ্ছেদেই লিখেছেন এভাবে- ‘আজকের বাংলা ভাষার যে গতি, সংহতি, অনাড়ষ্টতা, স্বচ্ছন্দতা, সাবলীলতা এবং সর্বজনীনতা তার পনের আনা কৃতিত্ব প্রমথ চৌধুরীর। তিনিই বাংলা ভাষাকে প্রথম রঙের ব্যাভিচার থেকে, জবরজঙের দুর্ভর থেকে, হেঁয়ালি কূটাভাষ-জটিলতার জাল থেকে উদ্ধার করে একটা আদর্শবাদী, অসংশয়িত, বুদ্ধিদীপ্ত, সৃজনধর্মী ভাষার প্রবর্তন করেন।’ প্রমথ চৌধুরী সম্পর্কে গাজী আজিজুরের এ অভিমতের সঙ্গে আমি সর্বাংশে একমত। আসলে ভাষার প্রাচীনতা, জীর্ণতা, পুনরুক্তি দোষ, ভাবালুতা ও অস্পষ্টতা থেকে প্রমথ চৌধুরী ভাষাকে মুক্ত করেছিলেন বাংলা সাহিত্যে চলতিরীতি প্রবর্তন করে। রবীন্দ্রনাথ ও প্রমথ রীতি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। প্রথম দিকে রবীন্দ্রনাথ দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগলেও পরিশেষে প্রমথ রীতিতে আত্মসমর্পণ করেছিলেন।
এই রচনাটি শেষ করার আগে আমার একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলতে চাই। আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে একবার ঢাকায় গিয়েছিলাম বাসে আমি ও গাজী ভাই পাশাপাশি বসে। আমরা প্রায় দশ ঘণ্টার মতো সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। বেশি কথা তিনিই বলেছিলেন, আমি বলেছিলাম কম। আমাদের আলোচনায় ছিল তত্ত্ব, তথ্য ও অভিজ্ঞতার কথা। তবে আমার চেয়ে গাজী ভাইয়ের পড়াশোনা ও পা-িত্য অনেক অনেক বেশি। আমি সেই অনুপাতে কিছুই না। তাঁর আলোচনায় আমি ঋদ্ধ হয়েছিলাম, সমৃদ্ধ হয়েছিলাম। তিনি আরো লিখুন। বিশেষ করে বাংলা সমালোচনা সাহিত্য সাহিত্যকে আরো সমৃদ্ধ করুন। আপনি সবসময় সুস্থ থাকুন, সবর থাকুন, নীরোগ থাকুন, দীর্ঘায়ু হোন, এই কামনা করি।
লেখক : প্রাবন্ধিক, প্রাক্তন ব্যাংকার

আমি বোধহয় অনেকটা কমিয়েই বলেছি : স ম তুহিন
একটু অন্যরকম গদ্যের লেখক হিসেবে উল্লেখ করার মতো কিছু কাজ (লেখালেখি) আছে গাজী আজিজুর রহমানের। সে কাজের যে উজ্জ্বল আলো তা তাঁর দীর্ঘদিন বাংলা পড়ানো কলেজ শিক্ষক সত্তাকে প্রায় আড়াল করে দেয়। নিজেকে প্রকাশ করার খুব বেশি তাড়া ছিল না বলেই মনে হয়। সব রকমের সুযোগ থাকার পরও ঢাকায় থাকার ইচ্ছেটাকে পাশ কাটিয়ে এখনও পর্যন্ত জেলা শহর সাতক্ষীরা থেকে প্রায় পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার দূরে কালীগঞ্জে আধা-গ্রাম আধা-শহরের আবহে কাটিয়ে দিলেন কোনো খেদ না রেখে- এটা একেবারে আমার নিজের ভাবনা। অবশ্য তাঁর স্বেচ্ছামৃত্যুর করতলে কবি বইয়ের ভূমিকার আদলে বলা ‘পূর্বিতা’য় বলেছেন ‘…অনিচ্ছাকৃতভাবে নির্বাসিত গ্রামে।’
শুরুতে বলেছি, একটু অন্যরকম গদ্যের লেখক। অন্যরকমটা কী রকম? ধারণা পাওয়া যাবে অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের কথায়- ‘রাজধানী থেকে দূরে অবস্থান করেও অধ্যাপক গাজী আজিজুর রহমান চিন্তাচর্চা ও জ্ঞানানুশীলন অব্যাহত রেখেছেন, সর্বোপরি এই পরিশ্রম বিমুখ চমকসর্বস্বতার কালে পরিশ্রম করে লিখছেন। …তার ভাষা অত্যন্ত আধুনিক। তার লেখায় সাহিত্য ও শিল্পকলার প্রতি অনুরাগের প্রকাশ আছে, অনুসন্ধিৎসা ও চিন্তাশীলতার পরিচয় আছে, বিশ^াস এবং আবেগও আছে’ (ভূমিকা : সাহিত্যে সমাজবাস্তবতার ধারা, গাজী আজিজুর রহমান)।
বই পড়া আর সংগ্রহ করা একজন মানুষের বয়স সত্তর বছর। তা থেকে কিছু বছর বাদ দিলে পঞ্চান্ন থেকে ষাট বছর ধরে জমানো বইয়ের সংগ্রহটা অনেক বড় হবে- সেটা অনুমান করে নিতে খুব বেশি কষ্ট হবার কথা না। অনেকের কাছে শুনেছি- কষ্ট করে সারাজীবন সংগ্রহ করা বইগুলো গুছিয়ে বাড়িতে রাখাটাও আরও কষ্ট। সবচেয়ে দামি সম্পদ বাড়ির অন্যদের কাছে জঞ্জাল! সংগ্রহের নেশাটা এক সময় না হারালেও ভাটা পড়ে। দু’একটা বই তখন অন্যরা চাইলেও খুব মন খারাপ হয় না। একটা সময় যে বইটার জন্যে ইনিয়ে-বিনিয়ে সত্যটাকে পাশ কাটিয়ে কিংবা সরাসরি মিথ্যে বলে নিজের কাছে রাখার প্রবল ইচ্ছে, সে ইচ্ছেরও মৃত্যু হয়। ‘কত বই কতজনকে দিয়ে দিলাম’, স্যার বলছিলেন। পুরনো আর নতুন সাময়িকপত্রে সাজানো র্যাকের দিকে তাকিয়ে দেখে আর টেনে টেনে চোখ বুলিয়ে, উল্টে-পাল্টে দেখতে দেখতে অনেকটা সময় পার করেছিলাম। গাজী আজিজুর রহমান স্যারের সাথে তার বাড়িতে বসে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেছি। অনেকক্ষণ কথা বললে অনেক কথাই এসে যায়, ভালো লাগা-না লাগার কিছু বিষয়ও থাকে। কখনও সেটা নিজের সাথে মিলে যায়, কখনও মেলে না।
কথা হচ্ছিল সম্পাদনা আর সংকলন বিষয়ে। উঠেছিল আবদুল মান্নান সৈয়দের কথা। গাজী আজিজুর রহমান স্যার বিচ্ছিন্ন যে কথাগুলো বলছিলেন, সে কথাগুলো আমার মতো করে একটু সাজিয়ে নিলে এমনটি হয় আবদুল মান্নান সৈয়দ মননশীলতা আর সম্পাদনায় যে মেধাবীর ছাপ রেখেছেন তা বুদ্ধদেব বসুর পর এক উল্লেখযোগ্য আর নিজস্ব ঘরানার কথাই বলবে। কী পরিশ্রমের ছাপটাই না রেখেছেন কাজে, অনবদ্য কিছু ভূমিকা লিখেছেন! অনেক ভূমিকায় যে সব কথা বলেছেন, বিশেষ করে ডকুমেন্টস্-এর প্রেজেনটেশন বিস্মিত হওয়ার মতো। অনেক প্রসঙ্গে এখনো তার বলা কথার চেয়ে নতুন কথা আমরা বের করতে পারিনি। কিন্তু শেষের দিকটার কাজে, মানে বেঁচে থাকার শেষের দিকটার প্রতিটি কাজে তাড়াহুড়োর একটা চিহ্ন রয়ে গেছে। সব মিলিয়ে দায়সারা গোছের কিছু কাজ করেছেন। সামর্থ্য যার আছে তার কাছে সামর্থ্যরে পুরোটা আশা করে সবাই…।
বন্ধু, কবি মাকিদ হায়দারের নির্বাচিত কবিতার বইয়ের কবিতা নির্বাচন আর ভূমিকার দায়িত্ব চেপেছে অধ্যাপকের কাঁধে। তাই প্রকাশনা আর ভূমিকা নিয়ে কথা বলতে বলতে কথা হয়েছিল বইমেলা, আধুনিক প্রকাশনার নানা দিক আর প্রচার-প্রচারণা বিষয়েও। ঠিক ঠিক প্রচারে মানুষের কাছে বেঁচে থাকে অনন্য সৃষ্টিগুলো। আবার কৌশলগত প্রচারেও অন্যায্য কিছু পাওনা জুটে যায় কারো কারো বা কোনো কোনো বিষয়ের।
গাজী আজিজুর রহমান আমার প্রিয়দের একজন। তার মতোই প্রিয় আমার তার স্বেচ্ছামৃত্যুর করতলে কবি’ বইটি। বইটিতে চলতি ভাবনা থেকে সরে লেখক আলাদা করে ভেবেছেন, সমবেদনা জানিয়েছেন, বিস্মিত হয়েছেন, জিজ্ঞাসা ছুঁড়েছেন আর পরাজিতদের সাথে থাকতে চেয়েছেন বরাবর। এ বইয়ের প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬। ২০১৫ সালে প্রকাশিত দ্বিতীয় সংস্করণে সবই অপরিবর্তিত, শুধু জুড়ে দিয়েছেন জার্মান কবি পাউল সেলান-এর অধ্যায়টি। কবিদের স্বেচ্ছামৃত্যু নিয়ে চমৎকার উপস্থাপন। বইটি নিয়ে লেখকের কথা- ‘১৯৭৩ সাল। আমি তখন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের জহুরুল হক হলে (প্রাক্তন ইকবাল হল) থাকি। প্রয়াত বন্ধু কবি আবুল হাসান এক রাতে আমার কক্ষে এসে আমার অজান্তে আমার ডায়রিতে দুটো লাইন লেখে ‘একজন মানুষকে হত্যা করতে গিয়ে আমি ফিরে আসি। এক গাছি দড়ি হাতে আত্মঘাতী হতে যেয়ে আমি হয়ে যাই আত্মবাদী’। লাইন দুটো আমাকে প্রবলভাবে আলোড়িত করে। বিশেষ করে শেষ লাইনটির দ্বারা তাড়িত হয়ে এ সময় কয়েকটি লিটিল ম্যাগাজিনে আত্মহত্যা বিষয়ে কয়েকটি কবিতাও লিখে ফেলি। আবুল হাসান রহস্যময় হাসি হাসে। প্রবাসী বন্ধু কবি রবিউল হাসান আমাকে নিত্য উত্তপ্ত করে। আমি মনে মনে পুলকিত হই।
আবুল হাসান আজ নেই। রবিউল প্রবাসে। আমি অনিচ্ছাকৃতভাবে নির্বাসিত গ্রামে। এর মধ্যে সময় ও কালের অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে। ভুলে গেছি অনেক আবেগের উৎকণ্ঠার স্মৃতি। আমার পৃথিবী হয়েছে অনেক ধূসর। অনেক আশা-আকাক্সক্ষার মুখ চাপা পড়ে গেছে বিদিশার অন্ধকারে।
১৯৮২ সাল। আমার এলাকার খুব কাছের ছেলে তরুণ কবি সুনীল সাইফুল্লাহ আত্মহত্যা করলো। অমনি জেগে উঠলো একটা পুরনো উৎকণ্ঠা। যে বীজ ভূমিতে চাপা ছিলো, শুরু হলো তার অঙ্কুরোদ্গম। আমি বেরিয়ে পড়ি অনুসন্ধানে। ঢাকা-কলকাতা। কিন্তু কেউ আমাকে বিশেষ সাহায্য করতে পারে না। অনেকটা লন্ডন যাবার আগের দিন ঘরে না শুয়ে বারান্দায় শুয়ে পথ এগোনোর মতো তারা আমাকে সাহায্য করে। আমি তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে হাফিয়ে উঠি, হতাশ হই। কারণ সবাই আমাকে এ পথ না মাড়ানোর উপদেশই দেন বেশি। তাদের ভয় হয় আমাকে নিয়ে।
‘…আমি আজও বুঝে উঠতে পারি না সমাজে-রাষ্ট্রে-ব্যক্তিতে-ব্যক্তিতে আত্মহত্যার বিষয়টি এত ঘৃণ্য বা অবাঞ্ছিত কেন! গিনেজ বুক ’৯৫ অনুযায়ী যেখানে প্রতিদিন গড়ে ২৭০০ লোক আত্মহত্যা করে, বাংলাদেশে যার হার আরো তেজী, সেখানে এটি যে একটি বিরাট সামাজিক সমস্যা বা ব্যাধি তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই সমস্যা কি অবহেলা যোগ্য? পাপ বা অন্যায় বলে অন্ধ সেজে সেই প্রলয়কে বন্ধ করা যাবে? আজ বড় প্রয়োজন এই সমস্যার দরজা জানালা খুলে দিয়ে তাকে মোকাবিলার চেষ্টা। নইলে এর পুনরাবৃত্তি ঘটতেই থাকবে। … হ্যামলেট, ম্যাকবেথ, ওফেলিয়া যা ভক্ষণ করে, তাই পান করেন চ্যাটারটন, নের্ভাল, প্লাথ। আমাদের করুণা, অনুকম্পা, ভালোবাসা পাবার যোগ্যও কি তারা নয়? মৃত্যু কি এতই অস্পৃশ্য বা অস্মরণীয়? তাহলে আল-হাদিস ? ‘মৃত্যু মানুষের নিকট উপঢৌকন সদৃশ-মৃত ব্যক্তিদিগকে সর্বদা স্মরণ করো, তাদের গুণকীর্তন করো এবং তদের সম্বন্ধে মন্দ বাক্য বলো না।’ আমি সেই সমবেদনাটুকুই কেবল জানাতে চেয়েছি এই গ্রন্থে। আমরা কি কেবল জয়ীকেই চিরকাল প্রথাগতভাবে অভিনন্দন জানাবো? তাহলে পরাজিতরা দাঁড়াবে কোথায়! আমি তাই অনেকটা ভ্যান গগের মতো পরাজিতদের দলে।’ (পূর্বিতা : স্বেচ্ছামৃত্যুর করতলে)।
গাজী আজিজুর রহমান গদ্যের মোড়কে আটকে থাকা একজন মানুষ। তাঁর কাছঘেঁষা মানুষেরা জানে কবিতার প্রতি তার টান কিংবা পক্ষপাতিত্বের কথা। কবিতা বুঝতে পারা, কবিতা নিয়ে বলা মানুষের একটা তালিকা করলে তালিকাটা টেনেহিঁচড়েও অনেক লম্বা করা যাবে না। আমার মনে হয়, অধ্যাপক গাজী আজিজুর রহমান শুধুমাত্র কবিতা বিষয়ে লিখলে বাংলা কবিতায় আমাদের বুঝতে না পারা অনেক বিষয়, বিষয়াবলী নিয়ে পরিষ্কার একটা ধারণার খসড়া তৈরি হতে পারতো। বাংলাদেশে, বাংলা সাহিত্যে কবিদের নিয়ে অথবা কবিতা বিষয়ে তার মতো বলতে পারা জন খুব বেশি পাওয়া যাবে না। কিছু মানুষ আছেন তাদের নিয়ে বলতে গেলে কমিয়ে বলার সুযোগ থাকে না। আমি বোধহয় অনেকটা কমিয়েই বলেছি।
লেখক : কবি

প্রিয়জনের কথা : আব্দুল বারী আল-বাকী
অধ্যাপক গাজী আজিজুর রহমান বয়সে আমার চেয়ে অনেক বড়। কিন্তু আমাদের সম্পর্ক সহপাঠী বন্ধুর মতো। আমরা একসাথে মিলেমিশে সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সমাজ উন্নয়নমূলক অনেক কর্মকা- করেছি, যা আনন্দের স্মৃতি হিসেবে মনকে দোলা দেয়। ১৯৭৮ সালে ‘মিতালী’ নামে আমার সম্পাদনায় একটি ‘লিটিলম্যাগ’ নলতা থেকে বের করি। প্রথম সংখ্যায় আজিজ ভাইয়ের লেখা ছিল না। কিন্তু পরবর্তী দুটি সংখ্যায় তাঁর দুটি ছোটগল্প ছাপা হয়। শুধু তাই না, লেখার পাণ্ডুলিপিগুলো প্রেসে যাওয়ার আগে তাঁর সাথে আমি আলাপ করে নিতাম। বিশেষ করে আমার প্রতিটি লেখা তিনি দেখে দিতেন।
‘ছাত্রবন্ধু গ্রন্থালয়’ নামে নলতায় আমার বইয়ের দোকান ছিল। ’৭৮ সালে আমি ঢাকা থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার এজেন্সি নিয়ে দেবহাটা, পারুলিয়া কালীগঞ্জ এবং শ্যামনগরের বিভিন্ন স্থানে পত্রিকা সরবরাহ করতাম। কালীগঞ্জ এবং শ্যামনগরের জন্য সাব-এজেন্ট হিসেবে আজিজ ভাই এবং কাশেম ভাই (কালীগঞ্জ কলেজের ইংরেজি অধ্যাপক), কালীগঞ্জ কলেজের অফিস সহকারী ফজলুকে ঠিক করে দেন এ কাজের জন্য। এ কাজটি ছিল পত্রিকার ব্যবসা হিসেবে নয়, এলাকার মানুষদের মধ্যে পত্রিকার পাঠক তৈরি করার একটা শুভ উদ্যোগী প্রচেষ্টা।
এরপর আজিজ ভাই আর কাশেম ভাইদের ‘সুমন সাহিত্য গোষ্ঠী’ গঠন এবং এ সংগঠনের মাধ্যমে সর্বপ্রথম বাবর ভাইকে (আ. শ. ম. বাবর আলী) সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
১৯৭৯ সালে আমি ‘নলতা মিতালী কচি-কাঁচার মেলা’ গঠন করি। আজিজ ভাইয়ের সাথে মিলেমিশে এই মেলাকে কেন্দ্র করে একদা আমরা আনন্দঘন সময় পার করেছি।
এরপর ‘কালীগঞ্জ প্রেসক্লাব’ গঠিত হয়। কিন্তু আজিজ ভাই কোনো পত্রিকার রিপোর্টার না হওয়ায় তাঁকে ক্লাবের সদস্য করা যাচ্ছিল না। তখন আজিজ ভাইয়ের সহযোগী হয়ে যতদূর মনে পড়ে ’৮৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে ‘সুন্দরবন বার্তা’ নামে একটা সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করা হয়। এভাবে অজিজ ভাইয়ের সাথে আমার পথচলা।
১৯৮৩ সালে কালীগঞ্জ থানাকে উপজেলায় উন্নীত করা করা হয়। আজিজ ভাইসহ আমরা ছিলাম উপজেলা বাস্তবায়ন কমিটির অন্যতম সদস্য। এম. এ. শুকুর সাহেব মহাকুমা প্রশাসক হিসেবে সবকিছু তদারকি করতেন। বলা যায়, সে সময় দিনের পর দিন আমরা একসাথে কালীগঞ্জে অনেক সময় কাটিয়েছি।
আজিজ ভাইয়ের অনেক গুণের মধ্যে একটা বড় গুণ হলো, কালীগঞ্জ সাতক্ষীরার যে কোনো জায়গায় যে কোনো প্রকার, তা সে যত ক্ষুদ্র পরিসরেই হোক আর কোনো ব্যানারে কারা করলো, তার কোনো খোঁজ-খবর না নিয়ে আমন্ত্রণ পেলেই চলে যেতেন। এখনও যান। এক সময় এ ব্যাপারে তাঁর সাথে আমি রাগ করতাম। তিনি মৃদু হেসে বলতেন, ‘যা হোক, একটা কিছু হলো তো।’
আজিজ ভাই আজ উপজেলা, জেলার গ-ি পেরিয়ে জাতীয় পর্যায়ে। অর্থাৎ রাজধানী শহর ঢাকাতে একটা অবস্থান করে নিতে পেরেছেন। অনেক নামি-দামি খ্যাতিমান মানুষের সাথে তাঁর সখ্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সাহিত্যের অঙ্গনে সবার মাঝে তিনি একটা উচ্চ আসন করে নিয়েছেন।
অনেক উচ্চমানের শব্দ গাঁথুনির মাধ্যমে তিনি যে সাহিত্য রচনা করছেন, তা যেমন আমার ভালো লাগে, তেমনি অন্যদেরও ভালো লাগে। তাঁর লেখার একটা নিজস্ব স্টাইল আছে, যা যে কোনো পাঠককে আকৃষ্ট করে।
আজিজ ভাই শুধু একজন ভালো লেখক নন, একজন ভালো বক্তাও তিনি। যে কোনো সাহিত্য অনুষ্ঠানে তথ্য সমৃদ্ধ সুললিত বক্তব্য উপস্থাপন করে সর্বশ্রেণীর শ্রোতদেরকে আকৃষ্ট ও মুগ্ধ করার যাদুকরী দক্ষতা ও ক্ষমতা তাঁর আছে।
’৮৫ সালের কথা। জুলাই মাসের ১৪ তারিখে আজিজ ভাই আমার কাছে একটা হাতচিঠি লিখে পাঠালেন-
‘বারী, আগামীকাল শিল্পকলার উদ্বোধন হচ্ছে। আগামী ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার বিকেল চারটায় উদ্বোধন হবে। তুমিসহ নিমাই ও রাজ্জাককে অবশ্যই নিয়ে আসবে। নিমন্ত্রণপত্র পেয়ে যাবে। শুভেচ্ছা। গাজী আজিজুর রহমান, সম্পাদক, শিল্পকলা পরিষদ, কালীগঞ্জ উপজেলা।
কালীগঞ্জ উপজেলার প্রথম নির্বাহী কর্মকর্তা ছিলেন আব্দুস সালেক সাহেব। উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন শাহজাহান সাহেব। দু’জনাই ছিলেন সং¯ৃ‹তিমনা আর অমায়িক ও মিশুক মানুষ। ইউএনও সাহেব তাঁর বাসার কাছে পার্কের মতো একটা জায়গা করেছিলেন। বিকালে অফিস শেষে আমরা সেখানে যেতাম। থাকতেন আজিজ ভাই, তমিজ স্যার, খোদা বক্স স্যার, বারেক স্যারসহ আরও অনেকে। অনেক রাত্রি পর্যন্ত আমরা ওখানে বসে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সময় কাটাতাম।
কালীগঞ্জ উপজেলায় যা কিছু হতো, যত কর্মক- হতো তার সবখানে আমরা থাকতাম। ক্রীড়া কমিটি, সাংস্কৃতিক কমিটি, শিশু পুরস্কার বিতরণ কমিটি সব রকম আয়োজনের সাথে আমরা অনেক মধুর সময় পার করে এসেছি। কালীগঞ্জ উপজেলার প্রশাসনিক উদ্বোধনের সময় একটা পরিচিতিপত্র ছাপাবার দায়িত্ব আজিজ ভাইকে দেওয়া হয়। এ কাজে আমি আজিজ ভাইয়ের সাথে প্রাণপণ সহযোগিতা করেছি। সেই পরিচিতির মধ্যে ‘সুন্দরবন বার্তা’ এবং ‘নলতা কচি-কাঁচার মেলা’র কথাও ছিল।
সাতক্ষীরার ‘তটিনী সাহিত্য সংসদ’, ‘অধ্যাপক তবিবুর রহমান স্মৃতি সংসদ’সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদি ও সংগঠনে আজিজ ভাইয়ের সাথে থেকেছি। বেশি দিনের কথা নয়। জসিমউদ্দিন সাহেব তখন কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। উপজেলা পরিষদ এবং স্থানীয় বিভিন্ন সংগঠনের যৌথ উদ্যোগে পহেলা বৈশাখ পালিত হচ্ছে। ক’দিন আগে আজিজ ভাইয়ের সাথে ফোনে কথা হলো, আমি বাড়িতে যাচ্ছি কিনা। বললাম, ‘যাবো। ‘কচি-কাঁচার মেলা’র অনুষ্ঠান আছে।’ আজিজ ভাই বললেন, ‘সকালে নলতায় অনুষ্ঠান করে সন্ধ্যায় কালীগঞ্জ এসো। মোজাহার মেমোরিয়াল হাইস্কুলে অনুষ্ঠান হবে। তোমার মেলার সদস্যদের নিয়ে এসো।’
যথারীতি হাজির। অনুষ্ঠানসূচিতে আমার উপবেশন স্থান হয়েছে বিশাল ডায়াসে, উপজেলা পরিষদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং স্থানীয় গণ্যমান্য সুধীজনদের সারিতে। অনুষ্ঠানে উপজেলার সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং সমাজ উন্নয়নে অবদানের জন্য কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে সম্মাননা দেওয়া হচ্ছে। সেখানে আমাকেও একটা পদক দেওয়া হয়। আমি অবাক হলাম! কারণ, বিষয়টি সম্পর্কে আগে আমি কিছুই জানতাম না।
কথাটা এখানে এভাবে উল্লেখ করলাম এ জন্য যে, আজিজ ভাই না থাকলে হয়তো আমার নামটা এখানে আসতো না।
আজিজ ভাইকে নিয়ে কিছু অতীত স্মৃতিকথা লিখলাম। গুণী মানুষকে নিয়ে বর্তমানের কথা অনেকে অনেক কিছু লিখবেন। এমন প্রত্যাশা করতেই পারি।
আজিজ ভাইরা এখনও আছেন। আর আমি ঢাকা প্রবাসী হওয়ায় অনেক কিছুতে এখন আর থাকতে পারি না।
পরিশেষে বলবো, আজিজ ভাই অনেক কিছুই করেছেন। অনেক কিছুর সাথে থেকেছেন। কিন্তু কোনো ব্যানার তৈরি করতে পারেননি। জানি না, হয়তো তেমন কিছু করতে চাননি। চাইলে পারতেন।
আজিজ ভাই আরও দীর্ঘদিন আমাদের সাথে, আমাদের মাঝে অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবেন- এই কামনা করি।
লেখক : শিশু সংগঠক

গাজী আজিজুর রহমানের সত্তরতম জন্মদিনে ইমরুল ইউসুফের সম্পাদনায় দূরন্ত সত্তর প্রকাশনাটি থেকে লেখাগুলি নেওয়া।