গল্প ?

রাহুল বিশ্বাস

চুপ ! শিকারি ওঁত পেতে আছে
জ্ঞাতস্বরে অজ্ঞাত
মধ্যরাতে হঠাৎ দরজায় ঠক্ ঠক্ শব্দ। বিরক্ত হয়ে ঘরের লোকটা দরজা খুলতে বাধ্য হলেন।
‘আমরা ডিবি পুলিশ। আপনি মাহতাব সাহেব?’
‘জ্বি, কিন্তু আপনারা এখন? কোনো সমস্যা?’
‘কিছু মনে করবেননা। আপনাকে আমাদের সাথে একটু থানা যেতে হবে।’ ওয়ারলেসের তীব্র শব্দ মাহতাবের স্ত্রীকে ইতোমধ্যে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলেছে। সাদা পোশাকধারী লোকগুলোকে দেখে তিনিআতঙ্কগ্রস্থহয়ে উঠলেন।
‘কী ব্যাপার, আপনারা?’
‘হাঁ আপনার স্বামীকে একটু যেতে হবে আমাদের সাথে।’
‘কেনো ? কি হয়েছে?’
‘কাল সকালে থানায় আসবেন। সব জানতে পারবেন।’
মাহতাবের স্ত্রী বাঁধা দিতে চাইলো। কিন্তু একপ্রকার জোর করে তাকে একটি সাদা মাইক্রোবাসে তুলে নেওয়া হলো। গাড়িটার পেছনে নেমপ্লেটে লেখা ‘ঢাকা মেট্রো-খ-৮২-৮৬১৮’, সামনের বডিটাতে নীলহরফে লেখা ‘বাংলাদেশ পুলিশ’। পরদিন সকালে থানায় গিয়ে জান্নাত তার স্বামীর খোঁজ পেলো না। দারোগাবাবুকে সব কথা খুলে বললে তিনি জানিয়ে দিলেন, গতরাত্রে থানা থেকে কেউ তার স্বামীকে আটক করতে যায়নি। থানার ডাইরিটা ঘেঁটেও এমন কোন নাম উদ্ধার করা গেলনা। সেনাদপ্তর ও গোয়েন্দা সংস্থা থেকেও তার স্বামীর আটকের কথা অস্বীকার করা হলো।
ঠিক দু’দিন পর রেলঘাটের পাশে মাহতাবের লাশ পাওয়া গেল।

যন্ত্র
‘স্যার,মানে বলছিলাম এই মহামারী অবস্থার ভেতর মানুষগুলো দিয়ে কাজ করানো কি ঠিক হবে?’
‘এই শ্রমিকের জাতটিকে আপনি মানুষ ভাবেন বুঝি! তেল মানে দুটো পয়সা একমুঠো চাল দিলেই এ যন্ত্র চলবে।’

মর্মন্তুদ
সকাল থেকে দিনের শেষপ্রহর পর্যন্ত কর্মবিরতি বলতে একমাত্র দুপুরের খাবারের জন্য যেটুকু সময় বরাদ্দ। এক একটা বোতাম বাঁধানো শেষ হলে এক একটা হাতের বদল। এর মধ্যে গত সপ্তাহে আয়েশা কয়েক মিনিটের জন্য বাইরে গিয়েছিলো। তাতে করে মেশিনের কাজ বন্ধ থাকবার দরুন ম্যানেজার তাকে ত্যক্ত কণ্ঠে হুশিয়ারি দিয়ে বললেন, ‘আর কখনো এমনটা হলে সরাসরি কাজ থেকে ছাটাই।’
দুপুরে আজ আয়েশা ও কানিজা পাশাপাশি খেতে বসল। কানিজার টিফিন বাটিতে শুধু দু’মুঠো মতো মুড়ি। আয়েশা সেটা দেখে নিজের খাবার থেকে অর্ধেক ভাত ও সবজির তরকারি তার বাটিতে তুলে দিল। কানিজা বলে উঠে, ‘বুবু খাওনের খুব কষ্ট। কর্তারও মরণের ঠাই অইছে।’
‘কী কও বইন, খাওনের কষ্ট থ্যাইকা বেবাক কষ্ট আছে। আচ্ছা কওতো তোমার কষ্ট অয়না। আমারতো মাঝে মধ্যে মুতের লগে সারা জানটা বের অয়ন যায়।’
‘কী কও বুবু। আমারও অয়। লজ্জায় কইতে পারিনা। রাতে বাসায় ফিরা দেহি পেচ্ছাব তো লয়, য্যানো লাল টকটকে রক্ত।’

মুশকিল
কি মুশকিল দ্যাখো। ঐ শালা চাকমার জাতও রাষ্ট্র ফোটায়। দাও হালারে সান্দাইয়া।

দুর্বৃত্ত
শহরের পচাগলা নদীটির বুকে একটা ছেলের লাশ পাওয়া গেল। একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় ছোট পরিসরে ছাপা হলো, দুর্বৃত্তরা টাকা, মানিব্যাগ, মুঠোফোন ছিনতাই করে ছেলেটাকে আঘাত করে হয়তোবা পালিয়েছিল। তার শরীরে কয়েকটি আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। আবার বলা হলো, ছেলেটার একটা রোগ ছিল প্রতিবেশী সূত্রে এমন তথ্যেরও আভাস মিলেছে। শেষ লাইনটা ছিল, ছাত্র আন্দোলনের প্রথম সারিতে তাকে প্রায়শই দেখা যেতো এমন খবরও পাওয়া গেছে। শেষ লাইনটা অবশ্য অন্য কোন জাতীয় পত্রিকায় ছাপা হয়নি।

বেকায়দা
‘কি? কোন সমস্যা?’
‘জ্বি হুজুর, মালটাতো মালাউন। জঙ্গি বলে চালায় দিমু ক্যামনে?’

জিজ্ঞাসা ও প্রাপ্তি
একজন বিদেশি ভদ্রমহিলা। যিনি ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলা বলতে জানেন। তিনি তার ভাঙ্গা ভাঙ্গা কণ্ঠে মি. আহমেদের কাছে জানতে চাইলেন, ‘আমি সন্ত্রাস নিয়ে স্টাডি করতে এখানে এসেছি। আপনি কি আমাকে সাহায্য করতে পারেন?’ মি. আহমেদ গুরুগম্ভীর ভাব নিয়ে একটা ইংরেজি পত্রিকা পড়ায় মনযোগী ছিলেন।
আহমেদ সাহেব মুখে কোন কথা বললেন না। তার হাতের উপর একটা মশা বসেছিল সেটাকে তিনি না মেরে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিলেন। তারপর জামাটার পকেট থেকে কলমটা হাতে নিয়ে তিনি হয়তো ভদ্রমহিলাকে দেখিয়ে নয়তো দেখানোর কোনরকম চেষ্টা না নিয়ে পত্রিকার একজোড়া শব্দ গোল করলেন। যেখানে লেখা ছিল ‘The Government.’ এমতাবস্থায় ভদ্রমহিলা মুখে কোন কথা বললেন না, তিনি অবাক হয়ে মি. আহমেদের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মশাটা আবার আহমেদ সাহেবের হাতের উপর বসল, আবারও তিনি মশাটাকে না মেরে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিলেন।

গুম
এরকম একটা জায়গায় বদলি হলো! লাশটাকে যে সেফটি ট্যাংকের ভেতর চালিয়ে দিবো সেরকম একটা জায়গা খুঁজে পাচ্ছিনা। এই রাতে কি তাহলে পিকআপটা বুড়িগঙ্গার পাড়ে ভিড়াতে হবে?
আমার থেকে এক রাঙ্ক উপরে অফিসারের বাচ্চাটা আমার বিবির দিকে সেদিন যেভাবে তাকাচ্ছিল, শালা মালটাকে যদি এভাবে গুম করে দিতে পারতাম।

চুপ
‘আমাদের চুপ থাকার অর্থ এই নয় আমরা থেমে গেছি।’
‘তাহলে?’
‘আমাদের চুপ থাকার অর্থ আমরা গুছিয়ে উঠছি।’
‘লাল সালাম।’


রাহুল বিশ্বাস
জন্ম : ৩০ ডিসেম্বর ১৯৯৩, খুলনা
স্নাতক ও স্নাতকোত্তর : ফরেস্ট্রি এন্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশিত গ্রন্থ : অষ্টক-তত্ত্ব