মরণ রে
সিরাজুল ইসলাম

১
সকালে পত্রিকা অফিসের গেট খুলতে গিয়ে মাওলা দেখলেন বুড়িটা মরে পড়ে আছে দরজা বরাবর। মাওলা হলো শোকরে মাওলা। সম্পাদকের ছোট ভাই। সাপ্তাহিক দখিনায়নের ব্যবস্থাপক হিসেবে পত্রিকার যাবতীয় কাজকর্ম দেখাশুনো করেন।
বেশ কয়েকদিন হলো একটা বুড়ি ‘দখিনায়ন’ এর দরজার সামনে জায়গা করে নেয়। খেয়ে না-খেয়ে বসে থাকে। গায়ে কোনো মাংস নেই। পাতলা চামড়ার একটি পর্দা হাড়ের গায়ে লেপটে আছে। অনেকটা মাটির দেয়ালের মতো। এঁটেল মাটি ও গোবর একসাথে গুলে দেয়াল লেপন দিলে যেমন দেখা যায়, বুড়ির শরীরের চামড়া দেখতে ঠিক তেমনই। কেউ কিছু দিলে সেটুকুই খাওয়া, নইলে শুধুই পড়ে থাকা। শেষের কয়েকটা দিন খাবার দিলেও খাওয়ার জো ছিল না মানুষটার। ডাক দিলেও কোনো উত্তর দিত না। চোখ বুজেই পড়ে ছিল এক-দুদিন। তারপর কখন যে প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেছে কেউ জানে না।
পত্রিকা সম্পাদক মাওলাকে বলেছিলেন হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে। মানুষটার খাবার দরকার চিকিৎসা দরকার- নইলে মারা যাবে যে! সত্যিই মারা গেল বিনা চিকিৎসায়, খেতে না পেয়ে। কয়েকদিন যাবৎ একটা নিউজও রেডি হয়ে আছে বার্তা সম্পাদকের টেবিলে। কম্পোজিটর সেটা কম্পোজও করে রেখেছেন। বক্স নিউজ। আঠারোতে হেডিং। মফস্বল শহরের সাপ্তাহিক পত্রিকা। লেটার প্রেস। আজ ছাপা হবে। কাল বেরুনোর কথা- ‘দখিনায়নের দরজায় একজন মৃত্যুপথযাত্রী।’ মার খেল নিউজটা। এখন অন্য নিউজ হবে। অন্য কাহিনি।
দেখতে দেখতে প্রায় অর্ধশত মানুষের ভিড়। অথচ এতদিন একটা লোক খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেননি কেউ। মৃত মানুষের মধ্যে এমন কি থাকে যা দেখার জন্য মানুষের এত ঔৎসুক্য!
লাশ ডিঙিয়ে অফিসের তালা খুলে মাওলা প্রথমে সম্পাদককে বিষয়টা জানিয়ে দ্বিতীয় ফোনটা করলেন থানায়। সব শুনে ‘আচ্ছা লোক পাঠাচ্ছি’ বলে থানার দারোগা সাহেব ফোন রেখে দিলেন।
বেশ খানিক পরে সদর থানার একজন সহকারী দারোগা দুজন সেপাই নিয়ে পথ চিনে এলেন পত্রিকা অফিসের সামনে। সপ্তাহখানিক হয়েছে তিনি প্রশিক্ষণশেষে থানায় যোগদান করেছেন। জামার পকেটের ওপরে সেপটিপিন দিয়ে লাগানো নেমপ্লেট থেকে বোঝা গেল নামটা– আকমল হোসেন। পুলিশ দেখে সরে যাওয়া লোকজন আবার জড়ো হতে শুরু করে। লাশ পেয়ে পুলিশ কী করে তাই দেখবার অদম্য ইচ্ছে লোকগুলোর। সত্যি তাই, লাশ পেলে পুলিশকে অনেককিছু দেখতে হয়, ছবি তুলতে হয়, সুরতহাল লিখে রাখতে হয়।
ছবি তুলতে হবে লাশের। ফটোগ্রাফার প্রয়োজন। বকুলতলার মোড় থেকে একজন রিকশাওয়ালাকে ডেকে তাকে পাঠানো হলো স্টুডিয়ো থেকে একজন ফটোগ্রাফার ডেকে আনতে। কিছুক্ষণ পর সে এস জানালো এখনও কোনো স্টুডিয়ো খোলেনি, সব বন্ধ। বন্ধ থাকবারই কথা। এত সকালে কোনো স্টুডিয়ো খোলে না।
কিছুক্ষণ পর তাকে আবার পাঠানো হলো। এবার খুলেছে– ‘পদ্মা স্টুডিয়ো’। পুলিশের কথা বলতেই লাশের প্রসঙ্গ এল। তখনই পদ্মা-র মালিকের জরুরি কাজ গজিয়ে উঠল ভূই ফুঁড়ে বটের চারা গজাবার ন্যায়। তাড়াতাড়ি দোকান
বন্ধ করে মালিক চলে গেলেন বাড়িতে। ‘বাঘে ছুঁলে আঠরো ঘা, আর পুলিশে ছত্রিশ’ প্রবাদটি মনে গেল তার। তারপর বেওয়ারিশ লাশের ছবি তোলার ব্যাপার। বলবে, চারদিক থেকে দশ অ্যাঙ্গেলে ছবি তুলতে হবে।
তারপরের নির্দেশ– এক্ষুণি চাই। ফিল্ম ওয়াশ হবে, নেগেটিভ হবে, তারপর তো ছবি। সময় দেবে না, টাকা-পয়সা দেওয়া তো দূরের কথা। তারচেয়ে অর্ধদিবস দোকান বন্ধ করে না হয় বাড়িতেই বসে থাকা যাক।
রিকশাওয়ালা মারফত ঘটনাটা জেনে একেবারে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন দারোগা আকমল হোসেন। তিনি একজন সেপাইকে পাঠিয়ে দিলেন স্টুডিয়োর মালিককে বুঝিয়ে আনতে। যেন দেরি না হয়। তাড়াতাড়ি।
ঘটনাস্থল থেকে স্টুডিয়োপাড়া বেশ খানিকটা দূরে। পাশাপাশি তিনটি স্টুডিয়ো– পদ্মা, এলিট ও গাজী। তিনটিই বন্ধ। রিকশাওয়ালা পদ্মা স্টুডিয়োর মালিকের বাড়ি চেনে। পুলিশের সেপাইকে নিয়ে সোজা চলে গেল সেখানে। অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তাকে রিকশায় করে আনা হলো ঘটনাস্থলে। বিভিন্ন্ অ্যাঙ্গেল থেকে বেশ কয়েকটা স্ন্যাপ নেওয়া হলো। বেঁচে থাকতে যে মহিলা কোনোদিন ছবি তোলেনি, স্টুডিয়োর মধ্যে ঢোকেনি, ক্যামেরাম্যান এসে সযত্নে তার ছবি তুলে নিল। এরে বলে ভাগ্যি। মরণ রে, তুঁহুঁ মম শ্যামসমান।
এরপর আর-এক ঝক্কি। এবার নিতে হবে হাত-পা ও আঙুলের ছাপ। একটা স্ট্যাম্প প্যাড জোগাড় হলো। এবার মাওলার পালা। তাকেই পুলিশের সাথে থেকে লাশের হাত ও পায়ের আঙুলের ছাপ নিতে হলো দারোগা আকমল হোসেনের নিয়ে আসা কাগজগুলোতে। মনে মনে ভাবে সে, অজানা অচেনা এক বুড়ির মৃত্যু তার সারাদিনের কাজের রুটিনটাই পাল্টে দিল। কাল সোমবার, ডেটলাইন। পত্রিকা বেরুবার দিন। অনেক কাজ বাকি। তা বাদ দিয়ে লাশ নিয়ে ঘাটাঘাটি। দারোগা আকমল হোসেনও পড়েছেন বেকায়দায়। নতুন চাকরি। প্রথম কেস। প্রতি পদক্ষেপে তাকে সদ্য প্রশিক্ষণ থেকে শিখে আসা আইন-কানুন অনুসরণ করতে হচ্ছে। মনে করতে হচ্ছে বাংলাদেশ পেনাল কোড বা ফৌজদারি কার্যবিধি-র ধারা উপধারাগুলো। পুলিশ রিপোর্টটাও লিখতে হচ্ছে সন্তর্পনে। মুশকিল হচ্ছে সাক্ষী জোগাড়ে। কারও স্বাক্ষর নিতে ডাকলেই কেটে পড়ছে কাজের অজুহাত তুলে। অথচ সকাল থেকে ঘন্টার পর ঘন্টা ঠায় দাঁড়িয়ে সরকার ও পুলিশের পিন্ডি চটকাচ্ছে, থেকে থেকে চা খাচ্ছে আর জনপ্রতিনিধিদেরও গালি দিয়ে ধুয়ে দিচ্ছে।
লাশের পাশে বেশকিছু টাকা জমা হয়েছে। ছড়িয়েছিটিয়ে আছে টাকাগুলো। মাওলা একবার বলেছিল, লাশটার দাফনকাফন করতে হলে খরচ আছে; যে যা পারেন সাহায্য করেন। তাতেই কিছু টাকা পড়েছে। মাওলা সেগুলো কুড়িয়ে নিজের কাছে রেখেছে। কাফনের কাপড় কেনা, লাশ ধোয়ানো, কবর খোড়া, বাঁশ কেনা। খরচ আছে।
লাশের সুরতহাল হলো। এবার ময়নাতদন্ত। উপস্থিত লোকজন পুলিশের দারোগাকে ময়নাতদন্ত না করার জন্য অনুরোধ করেন। তবে তিনি বলেন-‘আইনে আছে। মৃত্যুর কারণ জানতে ময়নাতদন্ত করতেই হবে। নতুবা লাশ দাফন করা যাবে না।’
কেউ একজন ভিড়ের মধ্য থেকে বলে উঠল, ‘আইনে তো কতকিছুই আছে। তারপরওতো মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি নেই। স্রেফ না খেয়ে চিকিৎসা না পেয়ে সবার চোখের সামনে একটা মানুষ মরে গেল, আর সবাই চেয়ে চেয়ে দেখলাম। কিছুই করলাম না। মানবতার জন্য এটা খুবই লজ্জার।’
২
দেখতে দেখতে দুপুর হয়ে গেল। এলাকার মেম্বর জগমোহন মন্ডলকে ডেকে আনা হয়েছে। তিনি পুলিশের কাজে সহযোগিতা করছেন। ‘দখিনায়ন’ এর সম্পাদক মহোদয় এসেছেন। সকলের দাবি পোস্টমর্টেমের নামে শবদেহ কাটাছেঁড়া করে আর কী লাভ! তারচেয়ে শবদেহ দিয়ে দিন, দাফনকাফনের ব্যবস্থা করি। মাওলা তার সাথে যোগ করে বলল, আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামকে জানানো হলে তারাই ব্যবস্থা নেবে, জানিয়ে দিয়েছে।
কিন্তু দারোগা সাহেবের একটাই কথা ফৌজদারি কার্যবিধি মোতাবেক ময়নাতদন্ত ছাড়া লাশ হস্তান্তর করা যাবে না। তবে তা করতে হলে মহকুমা হাকিম অর্থাৎ মহকুমা প্রশাসকের অনুমতি প্রয়োজন।
যেমন বলা তেমন কাজ। দারোগা আকমল হোসেন তার সঙ্গে থাকা দুজন সেপাইয়ের সহযোগিতা নিয়ে লাশ ভ্যানে তুললেন। ঘটনাস্থল থেকে ঢিলছোড়া দূরত্বে সদর থানা। সেখানকার কাজ সেরে লাশ যাবে হাসপাতালের মর্গে। উপস্থিত লোকজনের মধ্যে গুঞ্জরণ উঠল। নানাজন নানাকথায় পরিবেশ উত্তপ্ত করার চেষ্টা করছে। কেউ একজন চেঁচিয়ে উঠল– ‘কোথাকার এক বুড়ি যাকে কেউ চেনে না জানে না, পত্রিকা অফিসের সামনে বসে খেয়ে না খেয়ে মারা গেল। জীবন থাকতে হাসপাতালের বারান্দায় ঠাঁই হলো না, মরণের পরে যাবে মর্গে। হাসপাতালের হিমঘরে।’
এটাই হয়। একবার এক আলোকচিত্রশিল্পীর চিত্র প্রদর্শনীতে একটা ছবি দেখানো হয়েছিল। ঝা চকচকে আলো ঝলমল মার্কেটের এক দোকানের সামনে প্লাস্টিকের তৈরি মানুষের (ম্যানিকিন) গায়ে কেতাদুরস্ত পোশাক, আর ঠিক তার পাশে দাঁড়ানো রক্ত মাংশের এক ন্যাংলা পথশিশুর গায়ে কিচ্ছু নেই। দিগম্বর। ছবির ক্যাপশন– প্রাণ আছে প্রাণ নেই। আসলে প্রাণের মূল্য কম। প্রাণহীন জড় পদার্থ অনেকসময় প্রাণের চেয়েও মূল্যবান হয়ে ওঠে। প্রাণ থাকতে কোনো গুণিজনকে সম্মান দেওয়া হয় খুব কম ক্ষেত্রে। অথচ মরণের পরে তার ছবিতে বা ভাস্কর্যে ফুল বা মালা দেওয়ার প্রতিযোগিতা হয়।
আবার কবির এ-রকম একটি উক্তিও আছে– ‘নেই বলে খাচ্ছো, থাকলে কোথা পেতে? কবি কালিদাস কহেন পথে যেতে যেতে।’ গো-ভাগাড়ে একদল শকুরের মরা গরুর মাংশ খাওয়ার দৃশ্য দেখে কবি কালিদাস কথাটি বলেছিলেন। যার মর্মার্থ হলো গরুটার প্রাণ থাকলে শকুনগুলো আর ওটাকে খেতে পরত না। পাখিতে পিঁপড়ে খায়, আবার প্রাণহীন হয়ে পড়লে পিঁপড়েরা দলবেধে সেই পাখিকে ভক্ষণ করে। সেক্ষেত্রেও ওই একই ক্যাপশন– প্রাণ আছে প্রাণ নেই। জন্ম ও মৃত্যুর মধ্যবর্তী সময়ইতো জীবন। কারও সেকেন্ডের, কারও মিনিটের, কারও ঘন্টার, কারও দিনের, কারও মাসের, কারও বছরের, কারও কারও শত বছরের জীবন।
অবশেষে সম্পাদক মহোদয়ের হস্তক্ষেপে পোস্টমর্টেম অর্থাৎ শবদেহের কাটাছেঁড়ার হাত থেকে রেহাই পেল বুড়িটা। মহকুমা প্রশাসক সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে বলে দিলেন ময়নাতদন্ত ছাড়াই উপযুক্ত কারও কাছে লাশ হস্তান্তর করতে।
থানার কাগজপত্রে সই করে লাশ বুঝে নিলেন শোকরে মাওলা, সাপ্তাহিক দখিনায়নের ব্যবস্থাপক। একটা ভ্যানে করে মরদেহ নিয়ে এলেন পত্রিকা অফিসের সামনে। তিনি আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামকে খবর দিয়ে তাদের হাতে লাশ তুলে দিতে চাইলেন। যা করার তারাই করুক। ঝামেলা থাকবে না। কিন্তু তারপরেই বাধলো গন্ডগোল। মেম্বর জগমোহন মন্ডলের নেতৃত্বে একদল লোক এসে জানালেন, বুড়িটা হিন্দু ছিল। নাম তার প্রতিমা বিশ্বাস। বাড়ি আশাশুনির কাদাকাটি গ্রামে। জগমোহন মন্ডলের দূরসম্পর্কের আত্মীয়। হারিয়ে গিয়েছিল বছর দশেক আগে বলাবাড়িয়ার বাঁধ ভেঙে গিয়ে গ্রামের পর গ্রাম ডুবে যাওয়ার সময়। সবাই ভেবেছিল নদীতে ভেসে চলে গেছে। মাথার দোষ ছিল। কাউকে চিনতে পারত না। নিজের মনে বিড়বিড় করে কথা বলত। এখন বোঝা যাচ্ছে প্রতিমা বেঁচে ছিল। কথায় বলে, ‘মরণ যেখানে থাকবে পায়ে হেঁটে হলেও সে সেখানে যাবে।’ এখানেই বসে ছিল যমরাজ। তাই ছুটে এসেছে। সুতরাং তারাই সৎকার করবে হিন্দুধর্মমতে।
পত্রিকা অফিসের সামনে লন্ড্রি-র দোকান, নাম ব্রাইট হাউজ। মালিক খ্রিষ্টধর্মের বসন্ত সরদার। শহরের খ্রিষ্টান মিশনারি থেকে দুজন লোক এসে তাকে জানিয়েছেন, বুড়িটা না-কি তাদের খ্রিষ্টান পল্লির বাসিন্দা। নাম আশালতা গোমেজ। একসময় তার মাথা খারাপ হয়ে। মিশনারির মধ্যে ঘুরত আর আবোলতাবোল বকতো। বছর পাঁচেক আগে হঠাৎ সে নিখোঁজ হয়ে যায়। বহু খোঁজাখুঁজি করেও পাওয়া যায় না। বসন্ত সরদার তাদের কথার সাথে
সহমত পোষণ করে জানান, ‘পত্রিকা অফিসের সামনে যেদিন প্রথম আসে সেদিন থেকেই তাকে চেনার চেষ্টা করি। কিন্তু বুঝে ওঠার আগেইতো সব শেষ হয়ে গেল। সুতরাং আশালতাকে আমাদের হাতে তুলে দেওয়া হোক। আমরা খ্রিষ্টান ধর্মমতে তার সৎকারের ব্যবস্থা করি।’
মহাফাঁপরে পড়ে যান শোকরে মাওলা। কী করবেন তিনি। এখন তার মনে হচ্ছে লাশ মর্গে রাখাই ভালো ছিল। ময়নাতদন্ত হতো। তারপর বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে হাসপাতাল ও পুলিশের নিয়ম-নীতিতে যা হওয়ার তাই হতো। নিদেনপক্ষে তাকে তো আর এত সমস্যায় পড়তে হতো না।
এরই মধ্যে পাঁচ-সাতজনের একটা জটলা তৈরি হয়। দুজনের হাতে ধরা একটা বড় কাগজ। তাতে লেখা– ‘প্রতিমার লাশ চাই, নইলে…।’ কাগজটা ভাঁজ হয়ে থাকায় বাকিটা পড়া গেল না। তবে তাদের চাওয়া পরিষ্কার, প্রতিমা নামধারী মানুষের মরদেহ হিন্দুমতে দাহ করতে চান তারা। তাদের পরিচয় তারা ‘দরদি’ সঙ্ঘের লোকজন। পরক্ষণেই একটা ছোট মিছিলের মতো আওয়াজ। পাঁচ-সাতজন মানুষের মিছিল। মিছিলের একটাই আওয়াজ– ‘ধর্ম নয় কারও দান, আশালতা খ্রিষ্টান।’ তারা খ্রিষ্টান ধর্মমতে সৎকারের ব্যবস্থা করতে চান। তারা ‘সেবক’ নামক একটি সংগঠনের সদস্য। দু দলের লোকজন লাশের পাশে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়েই যাচ্ছে। লাশ তাদের কাছে দিতেই হবে।
এরই মধ্যে দল ভারী করে আর-একটি মিছিল কালো পতাকা হাতে বেশ হইচই করেই এল লাশের পাশে। ‘কল্যাণ’ নামক একটি সমিতির লোকজন তারা। তাদের দাবি মৃত বুড়ির নাম প্রতিমা বা আশালতা কোনোটাই নয়। বুড়ির নাম মাজু বিবি। কে এই মাজু? ভোটার লিস্ট, ইউনিয়ন পরিষদের নাগরিকত্ব সনদে মাজুর পুরো নাম মাজেদা বেগম। মা-র নাম বেদানা বিবি, বাবার নাম বাহারাম ঢালি, গ্রাম মজগুরখালি, ডাকঘর বদরতলা, থানা আশাশুনি, মহকুমা সাতক্ষীরা। পুরাতন একটি নাগরিকত্বের সার্টিফিকেট দেখিয়ে কল্যাণ সমিতির লোকজন লাশ দাবি করল। তাদের কথা মাজু বিবির যেখানে বাস সেখানকার হাতেগোনা কয়েকজনকে বাদ দিলে অধিকাংশ মানুষই গরিবগুর্বো ধরনের। তার মধ্যে মাজু বিবি একেবারে হতকুৎসিত রকমের গরিব। ত্রিভূবনে আপন বলতে তার কেউ নেই। থাকার মধ্যে ছিল পোড়ো পোড়ো বাড়ির মাটির দেওয়াল আর নাড়ার ছাউনি একখানা ঘর। তবে গত বর্ষায় ঘরটা পড়ে গেলে মাজু বিবিকে ঘরছাড়া হতে হয়। সহায় সম্বলহীন মাজু শুধু তার চিমটেমারা পেটটার জন্য এখান-সেখান ঘুরে আর না পেরে অগত্য এখানটায় এসে দেহ রেখেছে।
মাওলা পড়ে গেছে ভীষণ ফাঁপরে, যাকে বলে মহা খ্যাঁচাকলে। তার বাঁশবনে ডোমকানা দশা। কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। সমস্যা জোয়ারের পানির মতো আস্তে আস্তে বাড়ছে বই কমছে না। এসব দেখেশুনে যারা আশেপাশে ছিল তারা কেউ কাউকে না জানিয়ে কেটে পড়ল। তবে অতি উৎসাহী কিছু মানুষ নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে উটমুখো হয়ে আকাশ দেখতে লাগলো।
শেষ পর্যন্ত মাওলাকে উদ্ধার করলো পুলিশ। কে বা কারা থানায় খবর দিয়েছে যে পত্রিকা অফিসের সামনে সকালে যে বুড়িটা মারা গেছে তাকে তিন ধর্মের তিনটি সংগঠনের পক্ষ থেকে সৎকারের জন্য লাশ ঘিরে রেখেছে। লাশটা নেওয়ার একটাই উদ্দেশ্য– সরকারকে বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে ফেলা। স্রেফ না খেয়ে একটা মানুষ পত্রিকা অফিসের বারান্দায় মরে গেছে এটাকে ইস্যু করে আন্দোলন উস্কে দেওয়া। রাজনীতির মাঠ গরম করা। কারণ যে তিনটি সংগঠনের পক্ষ থেকে লাশ দাবি করা হচ্ছে সবগুলিই রাজনীতিঘেঁষা। আর লাশ নিয়ে রাজনীতি করাটা বর্তমানে বেশ প্রচলিত।
ঘটনাটা বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াতে পারে ভেবে পুলিশ এসে বুড়ির লাশটাকে থানায় নিয়ে গেল। তাতে মিছিল থামেনি। চিৎকার করে গলা ফাটাচ্ছে, চোঙাও ফুঁকছে। তবে পুলিশ বলে গেছে সাক্ষী-সাবুদসহ উপযুক্ত প্রমাণপত্র দাখিল সাপেক্ষে থানা থেকে লাশ হস্তান্তর করা হবে। ভিড়ের মধ্য থেকে কেউ একজন বলে উঠল– মড়ার আবার জাত কিরে, মড়ার জাত আছে নাকি!
হঠাৎ করেই তিনদলের মধ্যে কথাকাটাকাটি, তারপর মারামারি শুরু হয়ে যায়। আর যায় কোথায়। লাঠিসোটা, দা- রামদা নিয়ে হাজির হয় সবদলের লোকজন। একপর্যায়ে বোমাবাজিতে অন্ধকার হয়ে গেল এলাকা। প্রচন্ণ্ড ধোঁয়ার মধ্যে লাশ পড়লো একজনের। মুহূর্তেই বন্ধ হয়ে গেল শহরের দোকানপাট ও ব্যবসা-বাণিজ্য। পুলিশের ছোটাছুটি আর ফাঁকা গুলিবর্ষণে ছাইছুট হয়ে গেল সব। গ্রেপ্তার হলো কয়েকজন। লাশ গেল থানায়।
পুলিশের তাড়া খেয়ে সন্ত্রস্ত লোকজন দূর থেকে দেখতে পেল থানার বারান্দায় দুটো মৃতদেহ শোয়ানো। দুজনের দেহ মলিন সাদা কাপড়ে আপাদমস্তক ঢাকা। একটা লাশ বুড়ি-র, অপরটা কার এখনও কেউ জানে না।
পুলিশ ভাবছে অপর লাশটার পরিচয় জানাজানি হলে আর-এক দফা গন্ডগোল হবে। মামলা হবে। থানা সরগরম তুলে তুলবে।
পরদিন পত্রিকা বেরুলো খুব কষ্টেসৃষ্টে। তিন কলামে বড় বড় টাইপে হেডিং লেখা হলো ‘মরণ রে …’। থানার বারান্দায় বুড়ির লাশের পাশে রাখা অপর লাশেরও কোনো পরিচয় পুলিশ দিতে পারেনি। তবে কি সে-ও বুড়িটার মতো বেওয়ারিশ লাশের তকমা পাবে?
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ও ২০ মে ২০১৯


সিরাজুল ইসলাম
কবি, গল্পকার ও প্রাবন্ধিক
১৯৮৬ তে আবছা আপেক্ষিক নামে একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। তারপর প্রকাশ পায় যৌথ গল্পগ্রন্থ দুজনে (১৯৯৪), দৌড় ও দোলা (১৯৯৮)। প্রথম একক গল্পগ্রন্থ বামাবর্ত ও অন্যান্য গল্প (২০১৭)
১৯৮৮ তে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় (গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর) আয়োজিত উদীয়মান সাহিত্যিকদের দেশব্যাপী সাহিত্য প্রতিযোগিতায় কবিতা ও গল্প উভয় বিষয়ে বিভাগীয় পর্যায়ে ‘একুশে সাহিত্য পুরস্কার’ লাভ করেন। এছাড়া ১৯৮৬, ১৯৮৭, ১৯৮৯ ও ১৯৯২ তে কবিতা ও গল্পে জেলা পর্যায়ে একই মন্ত্রণালয় থেকে পুরস্কার পান।
জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র থেকে ১৯৯২ তে পুস্তক রচনা, অনুবাদ ও সম্পাদনা পদ্ধতি এবং ১৯৯৩ তে গ্রন্থ রূপায়ণ ও চিত্রণ বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সিরাজুল ইসলাম লিখছেন তার ছাত্রজীবন থেকেই। তিনি বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি-র গবেষণা সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন। তাঁর গবেষণামূলক রচনা বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট পত্রিকা ‘মাতৃভাষা’ ছাড়াও বাংলাদেশের অনেক প্রতিনিধিত্বশীল পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৯৩ তে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র বাংলাদেশ আয়োজিত বাংলা চতুর্দশ শতাব্দী পূর্তি উপলক্ষে ‘গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানের পূর্বশর্ত গণগ্রন্থাগার’ শীর্ষক প্রবন্ধ রচনায় জাতীয় পর্যায়ে শীর্ষস্থান অধিকার করেন এবং পুরস্কৃত হন।
জন্ম : ১৯৬০ পারুলিয়া, সাতক্ষীরা
বিপরীত । উচ্চারণ । নৈর্ঋত । স্রোত । চিত্রণ । সঙ্কলন । নবনূর । কবিতাপত্র— নামে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে প্রতিটি নামের বিপরীতে আছে একাধীক সংখ্যা, কয়েক হাজার পাতার অনবদ্য সম্পাদনা