
গল্পগুলো যখন খুলে দেয় বোধের কপাট
শুভ্র আহমেদ

এক
গল্পলেখক-গল্প-গল্পপাঠক, এই তিনটিকে যদি স্বতন্ত্র বিন্দু ভাবি কোনো সরলরেখায় তাহলে গল্পটাই থাকে মাঝখানে কিন্তু যদি এদের বসাই কোনো বৃত্তে, কোনো ত্রিভূজে অথবা অন্য কোথাও অর্থাৎ সাহিত্য সমালোচনার ইতিহাসে এই ত্রিত্বের তুলনামূলক অবস্থানের রকমফের হলে অবস্থাটা কেমন দাঁড়ায়? আরো জটিল নাকি সহজ থেকে সহজতর।
গল্পকে গল্পকারের জীবন থেকে সরিয়ে এনে ‘বাইরের সব হাতিয়ার’ বিশেষ করে সমাজতত্ত্ব, অর্থনীতি, মনস্তত্ত্ব, পুরাতত্ব, ইতিহাস ও ঐতিহ্য ইত্যাদিকে নিয়ে এসে এরই আলোকে গল্পের বিচার বিশ্লেষণ তথা চরিত্র হরণের শুরু গত শতকের সাতের দশকে। এই সময় গল্প হয়ে উঠতে থাকে কবিতার মতোই জটিল নির্বান্ধব। কেউ কেউ পুরাতনের সাথে জড়িয়ে থেকে ছিটকে যান গল্পের আধুনিক ক্যারাভান থেকে। যারা একটু বুদ্ধিমান ও অবাণিজ্যিক, কিন্তু ছোটকাগজের একেবারেই পেটের মানুষ নয় তারা এ দুয়ের সমন্বয়ের মাধ্যমে নতুন পথের সহযাত্রী হয়ে গল্পকে পৌঁছে দেন কখনো কবিতা কখনো কথনের দরজায়। মনিরুজ্জামান ছট্টু এই শেষোক্ত ধারার গল্প লেখক।
গল্পকার হিসেবে মনিরুজ্জামান ছট্টুর আবির্ভাব গত শতকের আটের দশকে। গল্প বয়ানের ক্ষমতা অনন্য সাধারণ, প্রায় ঐশ্বরিক। আপাতত গুরুত্বহীন ঘটনাগুলোকে তিনি যখন ছড়িয়ে দেন সাদা কাগজের শরীরময় তখন তা হয়ে ওঠে অনন্য উচ্চতায় রামধনুর মতো বর্ণিল। তার গল্পের শরীর সাধারণ মানুষের যাপিত জীবনের আলো আঁধারিত ঘটনাবলীর স্বর্ণকণায় খচিত। তার গল্পের ভূবন মানবিক আবেদনে ঋদ্ধ এবং সমাজমনস্ক শিল্পরীতির কাছে দায়বদ্ধ। তবে এই দায়বদ্ধতা তাকে কখনোই কোনো তত্ত্ব বা গোষ্ঠীর জালে অহেতুক জড়িয়ে ফেলতে পারেনি।
মনিরুজ্জামান ছট্টু গল্প লেখার আগে সুস্থির কোনো গল্পের কাঠামো নির্মাণ করেন বলে মনে হয় না। তার গল্পের সচেতন পাঠক যেটি সহজেই অনুধাবন করতে পারবেন তা হচ্ছে তিনি গল্পের প্রয়োজনে কতকগুলো চরিত্রকে তার ভাবনায় নিয়ে আসেন তারপর সেই চরিত্রগুলোকে ছেড়ে দেন, ছড়িয়ে দেন কাগজের সাদা জায়গায়। চরিত্রগুলো একটু একটু করে বেড়ে ওঠে তাতেই নির্মিত হয় গল্পের কাঠামো, এক পূর্ণাঙ্গ গল্প।
তার গল্পের চরিত্রগুলো বৈরী সময়েও নিজস্ব বিশ্বাসে অটল, স্থির থাকতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। কিন্তু গত শতকের ছয়ের দশকে সৃষ্ট আমিত্ববাদী চেতনায় ছট্টুর চরিত্রগুলো স্নাত নয় বরং উৎকর্ষ দর্শনের অন্ত:গুঢ় সত্তায় অনুভূত তাগিদ থেকে তার গল্পগুলো সৃজিত, গল্পের চরিত্রগুলো নির্মিত বলে আপাতদেখা ঘটনাবলীর অন্তরালে পাঠক একটু সচেতন হলেই গল্পগুলোতে অনুভব করতে পারবেন ভিন্ন আরেক মনস্তাত্ত্বিক বাসনার স্তর।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গী দ্য মপাস্যাঁ, অন্তম চেকভ মনিরুজ্জামান ছট্টুর প্রিয় গল্পকার। ঐতিহ্যের পাশাপাশি আধুনিকতাকেও তিনি সমান স্পর্শ করতে চান। লৌকিক বিশ্বাসগুলোও তাই তার গল্পে অনেক সময় যাদুবাস্তবের সীমানায় কুহক সৃষ্টি করতে চায়।
দুই
‘ফিরিঙ্গির চরের সে এবং চণ্ডিপুরের তারা’ মনিরুজ্জামান ছট্টুর প্রথম গল্পের বই। বইটির পৃষ্ঠা সংখ্যা আশি অন্যদিকে সংকলিত গল্পের পরিসংখ্যানিক সংখ্যাতথ্য কুড়ি। সুতরাং সিদ্ধান্ত এই যে, গল্পগুলো নাতিদীর্ঘ।
‘এক স্লিপ গল্প’ দিয়েই ছট্টুর গল্পের ভূবন শুরু। গল্পটি মূলত নিু মধ্যবিত্ত এক পরিবারের দৈনন্দিন জীবন যাত্রায় পাঁচালী নিয়ে লেখা। সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ বাপী বাবা-মার দৈনন্দিন ঝগড়া ও শারীরিক প্রেমকে নিস্পৃহভাবে গ্রহণ করে। কারণ, তার কাছে এসবের চেয়ে ক্ষুধা ও ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্যে বাবার লেখা চাল-ডালের স্লিপ অনেক বেশি আকর্ষণীয়। বাপী এতদিনে বুঝে গেছে বাবা-মায়ের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি ছাড়া বাবা কখনো চাল-ডালের স্লিপ লিখবেন না। ছট্টু এসবের বি¯তৃত বর্ণনা করেন না বরং পরিবর্তে অসাধারণ একটি চিত্রকল্প আঁকেন। ‘…এইসব অসম্ভব মনোহর আকর্ষণধর্মী শব্দে ভরপুর ঝড়টা হঠাৎ থেমে যায়। বাপির কিন্তু খারাপ লাগে না। … বাবা ভদ্রলোক এবং মা ভদ্র মহিলার আপাতত সন্ধি।’ (পৃষ্ঠা-১০) অবশেষে বাপী দূরন্তবাস্তবের পাশবিকতা থেকে পালাতে চায়, ভেসে চলা নিু মধ্যবিত্তের অনাগত দিনগুলোর মতো চাল ডালের কাক্সিক্ষত স্লিপের ভেসে যাওয়ায় পরাবাস্তব দৃশ্যের মধ্য দিয়ে গল্পটি শেষ হয়। ‘বাপীর হঠাৎ মনে হল, দীঘিটা যেন এক সাগর হয়ে গেল মুহূর্তে। আর নৌকাটা এক ছোট্ট জাহাজ।’ (পৃষ্ঠা-১৩)
‘সুতো কাটা বিষয়ক চলচ্চিত্র’ নামক গল্পের প্রধান চরিত্র কাসেম। কাসেম ছাড়া গল্পের অন্য দুটি চরিত্র ‘মিলি’ কাসেমের স্ত্রী অন্যজন’ নামহীন কাসেমের মা। মনিরুজ্জামান ছট্টু গল্পটিতে কাসেম নামক একজন আপাত অসফল দর্জির মনোজাগতিক রূপান্তর বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে দেখাতে সচেষ্ট হয়েছেন। গল্পকার অবশ্য এই মনোরূপান্তরের কোনো কারণ অনুসন্ধানে ব্রতী হননি। স্ত্রীর গৃহত্যাগ যদি এর অন্যতম কারণ এবং গল্পের চরম পরিণতি ধরি তাহলেও আমরা দেখতে পাব সেই ঘটনা জানার পূর্বেই কাসেমের পরিবর্তন ঘটেছিলো। গল্পকার কি টেলিপ্যাথিক বা চিৎপ্রকর্ষ রীতির প্রয়োগ ঘটাতে চেয়েছেন গল্পের এই জায়গাটিতে। আমরা অবশ্য জটিলতাকে বাদ দিয়ে তার এই রূপান্তর বরং তার অস্থির চিত্তের আরেকটি ভিন্ন মাত্রার প্রকাশ মনে করতে পারি। তবে গল্পের প্রেক্ষিত তৈরী না করেই অনেক সময় চিত্রকল্প নির্মিত হয়েছে। যা গল্প পাঠককে এক ধরনের ধোঁয়াশায় নিক্ষেপ করে কখনো। ‘তার মনে হয় মিলির কোন উজ্জ্বল অংশকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেওয়া বা ইচ্ছাকৃতভাবে তা প্রতিহত না করা তার অপরাধ। উঠোনে তারের ওপর মেলে দেওয়া মিলির একটি শাড়ির খানিকটা ধুলোয় গড়াগড়ি খাচ্ছিল।’ (পৃষ্ঠা-৫৪) আলোচ্য অংশে আমরা ‘কনফেকশনাল সাহিত্য তত্ত্বেরও’ ইঙ্গিত পাই। এর একটি চূড়ান্ত ও পূর্ণাঙ্গ প্রকাশ দেখি ‘তদন্ত প্রতিবেদন’ নামক গল্পে। এটি একটি চমৎকার গল্প। দুটি দৃশ্যপটে গল্পটি রচিত। দৃশ্যপট ২ এ আমরা দেখতে পাই গল্পকথক রাকিবউদ্দিন এক শীতের সকালে বিছানায় অলস সময় কাটাচ্ছেন। আধো ঘুমের মধ্যে তার তিন বছর আগের একটি ঘটনা হঠাৎ মস্তিষ্কের দরজায় হানা দেয়। সে ঘটনার কথা, সকলে এমনকি গল্পের ভিকটিম তার স্ত্রীও ভুলে গেছে। কিন্তু ভোলেননি তিনি। অবচেতন মনের এক পাপবোধ হয়তো তুলতে না পারার কারণ। দৃশ্যপট -১ এ বর্ণিত হয়েছে সেই ঘটনা। পাহাড়ী অঞ্চলের স্পর্শিক বিবরণের পাশাপাশি রাকিব উদ্দীন আমাদের জানাচ্ছেন পাহাড়ি পথে চলতে চলতে হঠাৎ সামনে পাওয়া ছড়ায় øানরতা কয়েকজন মারমা সুন্দরীর দিকে তিনি মনোযোগী হন। একই সময়ে তার স্ত্রী পা পিছলে ছড়ায় পড়ে যান। চূড়ান্ত কোনো বিপদ ঘটার আগেই তিনি রেসকিউড হন, অবশ্য সেই কর্মকান্ডে রাকিব উদ্দীনের কোনো ভূমিকাই ছিল না। অবচেতন মনের গহীনে অপরাধ বোধের এটাই কারণ। যেটি তার অবচেতন মনে সাজিয়ে রাখা অন্য একজন তদন্ত কর্মকর্তার মুখোমুখি, তার সাথে কথোপকথনের শেষ পর্যায়ে তিনি স্বীকার করেন।
গল্পটি সংক্ষেপে এ রকম। কিন্তু এক বড় প্রেক্ষাপটে এটি আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয়। রাকিবউদ্দিনের মারমা স্নানরতা রমনী দর্শন কী অবৈধ যৌনতায় দুষ্ট। যে কোনো মনস্তাত্বিক সম্পর্কও কি শারীরিক সম্পর্কতুল্য? স্বীকারোক্তির পরে রাকিবউিদ্দন কি অপরাধ বোধ থেকে নিজে নিস্কৃতি নিতে পারলেন?
গল্পের শেষে আমরা অবশ্য দেখি তদন্ত কর্মকর্তা, যিনি একমাত্র প্রকৃত সত্য ছুঁতে পেরেছিলেন তিনিও রাকিবউদ্দিনের মনের গহীনে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়লেন। তাহলে কী গোপন পাপ থেকে কেউ কোনোদিন নিস্কৃতি পায় না? নাকি এ ধরনের কাজ করার পর ব্যক্তির মনের পাপবোধ চিরকাল অন্ধকারেই থেকে যায় এক ধরনের প্যাশনের ছায়ায়?
মনিরুজ্জামান ছট্টু তার গল্পে বার বার গার্হস্থ্য জীবনের টক-মিষ্টি ছবি আঁকেন। সম্পূর্ণ আঞ্চলিক ভাষায় লেখা ‘ধ্যানাচির ব্যায়রাম’ এমনই একটি গল্প। ‘দাফন-কাফন’ ও হতে পারত আরিফুল মঞ্জিলার গার্হস্থ্য জীবনের গল্প। হতে পারত বন্যা কবলিত একটি গাঁয়ের এক গৃহস্থ্য দম্পত্তির নিত্য দিনের জীবনালেখ্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অবশ্য গল্পটি হয়ে ওঠে মানবিক আবেদন সমৃদ্ধ সামাজিক দায়বদ্ধতার গল্প। লাশ দাফনের পূর্বে মুসলিম রীতি অনুসারে গোসল অপরিহার্য। এই কাজটি সকলে পারে না। কেউ কেউ পারে। আরিফুল তাদের অন্যতম। লাশ গোসলের অনুপুঙ্খ বর্ণনার পাশাপাশি একেবারেই বিপরীত মনস্তাত্ত্বিক আর একটি দিক গল্পকার ছট্টু ফুটিয়ে তোলেন অসম্ভব প্রয়োজনীয় কুশলতায়। গল্পের টেক্সট অনুধাবনে পাঠক এক ধরনের গোলক ধাঁধায় ঘুরতে থাকেন যখন আমরা দেখি, আরিফুল তার ব্যক্তিগত সুবিধা/অসুবিধা এমনকি ক্ষুধা নিবৃত্তির মতো একটি জরুরি বাস্তব প্রয়োজনকেও উপেক্ষা করছেন কাজের তাগিদে। কিন্তু তাকে কে বাধ্য করছেন? নাকি অন্ত:গূঢ় সত্তার অনুভূত তাগিদেই তিনি কাজ করেন, সকল কিন্তুকে উপেক্ষা করেন, সকল কিছুর উর্দ্ধে কাজের স্থান এই বিশ্বাসে বৈরী সময়েও অটল থাকেন? মূলত ছট্টু তার গল্পে এভাবে বারবার একাধিক প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করান তার পাঠককে। কারণ আমাদের ভারসাম্যহীন সমাজ জীবনের বিপরীতেই সর্বদা তার গল্পগুলোর অবস্থান, তার অবস্থান।
‘খুলে যায় বোধের বদ্ধ কপাট’ এবং ‘খুন’ গল্প দুটি এ প্রসঙ্গে বিশেষ আলোচনায় আসতে পারে।
প্রথম গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র হাসমত সাহেব একজন অবসরপ্রাপ্ত, স্বচ্ছল, ধার্মিক সুখী ব্যক্তি। বই পড়ার অভ্যাস হাসমত সাহেবের পূর্বে ছিল না, বস্তুত দুইজন বৌমার আগ্রহে এবং কিছুটা অবসর কাটানোর চেষ্টায় তিনি বই পড়তে শুরু করেন। বড় বৌমা মূলত ধর্মীয় বই পুস্তক পড়তে তাকে উৎসাহ যোগাতেন। অন্যদিকে ছোট বৌমা তাকে রবীন্দ্রনাথ পড়তে শিখিয়েছিলেন। ক্রমশ তিনি অনুধাবন করতে শিখলেন, ‘ধর্ম মানুষকে কখনো বিপদগামী হতে বলে না। আর সাহিত্য তো মানুষের সুকুমার বৃত্তিগুলো জাগিয়ে তোলে। মানুষকে মানুষই হতে বলে।’ (পৃষ্ঠা-৪৭)
গল্পের শেষাংশে দেখি জামাতে নামাজ পড়ার তাড়নায় একদা তিনি মৃত্যুপথযাত্রী একটি গরুকে রক্ষা করেননি, অথচ সামান্য একটু সাহায্যের হাত বাড়ালে গরুটি নিশ্চিত বেঁচে যেতো। নামাজের অজুহাতে একটি জীবন রক্ষা না করায় তিনি ঘটনার চার বছর পর এক ধরনের মনোকষ্টে ভুগছেন। হাসমত সাহেবের এই যে ধর্মের বাহ্যিক আচার সর্বস্বতাকে ছাড়িয়ে আরো মানবিক হয়ে ওঠা গল্পকার এটাকেই বোধের বদ্ধ কপাট খুলে যাওয়া হিসাবে চিত্রিত করেছেন।
‘খুন’ গল্পে মারুফের আরেক ধরনের রূপান্তর দেখি আমরা। মারুফ তার স্ত্রীকে খুন করতে উদ্যত। নিখুত পরিকল্পনা। কিন্তু যন্ত্রণাকাতর স্ত্রীর আর্তস্বর সবকিছু তছনছ করে দেয়। মারুফের ভিতরে প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসা-মানবিকতার বদ্ধ কপাটটি খুলে যায় মুহূর্তে। ‘তার কেবল মনে হতে থাকল তার নিজের ভেতরেরই কোনো এক মহাশক্তি তার সকল পরিকল্পনাকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছে। সে আর কিছু ভাবতে পারে না।’ (পৃষ্ঠা-৫৮)
পূর্বেই উল্লেখ করেছি মনিরুজ্জামান ছট্টুর গল্প বলার অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে। গল্পের আঙ্গিক নিয়ে তিনি নিরন্তর পরীক্ষা নিরীক্ষা করতেও উৎসাহী নন। এদিক দিয়ে ব্যতিক্রম ‘সাপ’ গল্পটি।
গল্পের শুরুতে গল্পকার মনিরুজ্জামান ছট্টু গল্পের কল্পিত অনুলেখক আব্দুল খালেকের বয়ানে তার (ছট্টুর) মৃত্যু সংবাদ ঘোষণা করেন। আমরা জানতে পারি বিষাক্ত সাপের কামড়ে ২০ আগস্ট ১৯৯১ মঙ্গলবার ভোর ৪টা ৪৯ মিনিটে তিনি মারা গেছেন। গল্পটি মূলত তার মৃত্যুকালীন বয়ান। গল্পে ছট্টু তার একান্ত পরিচিত কয়েকজন মানুষের চরিত্র চিত্রনের পাশাপাশি তাদের সাথে তার সম্পর্কের কতিপয় বিশেষ মুহূর্তগুলোকেও মূর্ত করেছেন।
মৃত্যু অমোঘ। মৃত্যু অবধারিত। হয়তো তাই মৃত্যুকে নিয়ে আমাদের এতো ভাবনা। মৃত্যু এবং তৎপরবর্তী সময়ের কল্পিত সিংহাসন আমাদের ইহজাগতিকতাকে অনেক সময়ই ধ্বংস করে দিচ্ছে। লেখক কি নিরন্তর অষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরা এইসব স্বর্ণলতার বাঁধন থেকে মুক্তি খুঁজেছেন আলোচ্য গল্পে? নাকি মৃত্যু অবধারিত, মৃত্যু অনিবার্য বলে মৃত্যুভয়কে উপেক্ষা করার সাহসে তাকে তাচ্ছিল্য করেছেন, উপহাস করেছেন। পাঠক এ রকম একাধিক ভাবনায় পেখম মেলতে পারেন। সাদা চোখে আমরা যেটি দেখি তা হচ্ছে প্রায় শেষ মুমূর্ষু অবস্থায়, সৈয়দ মৌলভি সাহেব যখন পরম মমতা ও নির্ভরতায় গল্পকার ছট্টুকে তওবা পড়াচ্ছেন তখন ছট্টুর কাছে মৃত্যু, তওবা, পরকাল ইত্যাদির চেয়ে নিতান্তই এক তুচ্ছ ঘটনা তার বন্ধু আবুল বাসার পল্টু কেনো তার দীর্ঘদিনের সযতেœ লালিত দাঁড়ি কেটে ফেললেন তাই জানা জরুরি হয়ে উঠল। ‘এই রকম একটা জমকালো পরিবেশে হঠাৎ আমার একটা বিষয় মনে পড়ে গেলো, আমার মনে হল তওবা পড়ার চেয়েও এই বিষয়টি যে আরো জরুরী। … হায় পল্টু! তুমি কোথায়? তুমি কি বলবে কেন তুমি হঠাৎ দাড়িগুলো কেটে ফেললে? (পৃষ্ঠা-৩৮)
গল্পের শুরুটি চিৎপ্রকর্ষ রীতির ছায়ায় নির্মিত হলেও যাদু-বাস্তবতায় তিনি এমনই এক মৃত্যুকালীন দৃশ্যের সৃষ্টি করেন যেখানে মৃত্যুও উৎসবে রূপান্তরিত হয়।
‘উৎসব’ গল্পে দেখি মৃত্যুপথযাত্রী আলিমকে ঘিরে তার চারপাশের মানুষগুলোর অবিবেচক আচরণ যখন ক্রমশ হৃদয়হীন গন্তব্যে ধাবমান তখন আলিম বেশ পরিতৃপ্তির সাথে পরম নির্ভরতায় অচেনা-অজানা এক জগতে প্রবেশ করে ক্রমশ হারিয়ে যেতে থাকে। জানে না সে কোথায় যাচ্ছে কিন্তু যেতেই থাকে, যেতেই থাকে। মৃত্যু মূলত ছট্টুর কাছে এমনই এক নতুন গন্তব্যে যাত্রা মাত্র।
‘ফিরিঙ্গির চরের সে এবং চণ্ডিপুরের তারা’ নামক গল্পটি দিয়েই ছট্টু তার গল্পগ্রন্থের সমাপ্তি টেনেছেন।’
‘ফিরিঙ্গির চর’ সুন্দরবনের এক গহীন অংশের নাম। অন্যদিকে ‘চণ্ডিপুর হচ্ছে সুন্দরবন সংলগ্ন এক গ্রাম। ‘ফিরিঙ্গির চরের সে’ অর্থাৎ আট দিনের উপোসী ক্ষুধার্ত এক বাঘ যে খাদ্যের অন্বেষণে সুন্দরবন সংলগ্ন গ্রাম চন্ডিপুরে চলে এসেছিল। ‘চন্ডিপুরের তারা’ অর্থাৎ বাঘের চেয়ে হিংস্র, বনভূমি ধ্বংস ও বনজসম্পদ উজাড়কারী একদল মানুষ যারা বাঘটিকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছিল। সংক্ষেপে এই হচ্ছে কাহিনী।
গল্পকার অসম্ভব নিপুনতায় সুন্দরবনের ভূগোল-পরিবেশ-প্রতিবেশ চিত্রিত করেন তার গল্পে এবং ক্ষুধার্ত বাঘটির চরিত্রে চাপান মানবিকতার পলেস্তারা। ক্ষুধা নামক ভয়ংকর দানবের কাছে অতি ক্ষুদ্র মানব শিশুই হোক অথবা বনরক্ষক খ্যাত, অতি শক্তিশালী হিংস্র দাপুটে বাঘ হোক সকলেই যে নিতান্ত অসহায় সেই সত্যকেই গল্পকার পূনর্বার আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। এভাবে ছট্টু কখনও কখনও আফ্রো-এশীয় সাহিত্যের মূল স্রোতে বিলীন হতে চান।
মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে বাঘ তার অভয়াশ্রম ফিরিঙ্গির চরে ফিরে যেতে চেয়েছে। এ যেনো ঠিক বিলাসের মোহে নিজ বাসভূমি ছেড়ে বহি অভিগমনের পর অস্থির মানুষের নিজ বাসভূমে ফিরে আসার চিরন্তন প্রচেষ্টা, হাহাকার।
মনিরুজ্জামান ছট্টু এভাবে বিপন্ন মানবতার পাশে তার গল্পের চরিত্রসমূহকে বারবার দাঁড় করিয়ে তার দার্শনিক ভাবনাগুলোকে তার পাঠকের মধ্যে সঞ্চারিত করার চেষ্টা করেন।
কে বেশি হিংস্র? পশুত্বের স্বভাবী মানুষ যে কখনও কখনও খোদ বন্য পশুকেও হিংস্রতায় হার মানাতে পারে তেমনই চিত্র অংকিত হতে দেখি আলোচ্য গল্পের শেষাংশে।
সশস্ত্র মানুষের উল্লাস তার সাহসিকতাকেও কখনও কখনও ম্লান করে। নিরস্ত্র বাঘটিকে হত্যা করার জন্য ক্রমাগত নতুন কৌশল আবিষ্কার, বাঘটিকে হত্যার পরে জান্তব উল্লাস ইত্যাদি আমাদের চারপাশের চেনা জানা মানুষগুলোকেও অচেনা করে তোলে। মানুষ ও পশুর পার্থক্য যখন একেবারেই লুপ্ত হয়, মানুষ হারিয়ে ফেলে তার বিবেক। মনুষত্বই হয়ে ওঠে ধর্ষক, হত্যাকারীর সিনথেসিস। তখন অনেক যতেœ তৈরি ভয়ংকর মনুষ্য সমাজের চেয়ে শ্বাপদ সংকুল নির্জনতায় মোড়া বনভূমিও হয়ে ওঠে সুন্দর-সুস্থ্য, এমনই একটি টেক্সস্টের বয়ানে গল্পকার গল্পের ইতি টানেন। ফলে গল্পটি আর নিছক শিকার কাহিনী থাকে না বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনায় এটি বাংলা তথা বিশ্ব সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছোটগল্পে রূপান্তরিত হয়।
ইষৎ সুনীলে বিশ্বাস এবং কিছুটা পরিবর্তনের পর মনে করি গল্পের কিছুটা অতিরিক্ত দায় রয়েছে, যা শিল্পের অন্য মাধ্যমে উপস্থিত অপরিহার্য নয়। গল্পকে শিল্প সম্মত হতে হবে একই সাথে জীবন্ত এবং বিশ্বাসযোগ্যও। মানুষে-মানুষে বিশ্বাসে-অবিশ্বাসে বহুমুখী দৃষ্টি ও সৃষ্টিতে কল্প ও অধিকল্পে, তত্ত্বে এবং বাস্তবে এতই ভিন্নমত প্রতিষ্ঠিত যে বিশ্বাস যোগ্যতার মাপকাঠি বিশেষ কোনো বিন্দুতে স্থির নেই। একথা মান্যতা করেও বলবো যে শিল্প সকলের বা অধিকাংশের কাছে আংশিক বা সম্পূর্ণ গ্রহণযোগ্য তাই হচ্ছে বিশ্বাসযোগ্যতা। মনিরুজ্জামান ছট্টুর ‘একটি অনুকষ্টের আখ্যান’ ‘নাইট কুইন বিষয়ক ক্ষুদে ভাবনা’ ‘দুই নিমাই’ প্রভৃতি গল্প উপরোক্ত শিল্প ভাবনায় যেমন উত্তীর্ণ তেমনি পদ্যের সীমানায় হামাগুড়ি দিয়েও গল্পগুলো গল্পের চৌহদ্দি না ভেঙে জীবন্ত ও বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছে। চিত্রকল্পকে যদি কবিতার নিজস্ব কিছু বলে ধরে নিই তাহলেও পাঠক লক্ষ করবেন কবিতার চিত্রকল্প যেখানে পাঠকের মনে শরতের নির্মলতা কিংবা গ্রীষ্মের ঝিমধরা দুপুরের এক পশলা বাতাসের সাথে ক্লান্ত পথিকের আত্মীয়তা সৃষ্টি করতে উদগ্রীব যেখানে মনিরুজ্জামান ছট্টুর গল্পে তৈরি করা চিত্রকল্পগুলো পাঠকের মনে প্রেম অথবা প্রেম থেকে উৎপাদিত হর্ষ-ভয় ইত্যাদিকে কিংবা হিংসা-মৈত্রীর সম্পর্ক ইত্যাদি অথবা কিছুই নয় এমন বোধকেই জাগ্রত করতে সচেষ্ট। চিত্রকল্পের দু’টি উদাহরণ : এক. ‘অত:পর সত্যিই আমি একটি কবিতা আবিষ্কার করলাম। স্বয়ং কবিই আমার চোখের সামনে একটি মূর্ত কবিতা হয়ে উঠলেন। আর সেই কবিতাটি আমি কি অনায়াসেই না পড়তে পারলাম।’ (পৃষ্ঠা-৭৫)
তিন
‘সহসা তার সামনে থেকে অরণ্য উধাও হয়ে যায়। কিন্তু অরণ্য উধাও হয়ে অন্যকিছু দৃশ্যমান হয় না।’ (পৃষ্ঠা-৭৭)
অবশ্য এদিক দিয়ে ‘একটি গ্রেনেড ও একজন জনাব আলী’ গল্পটি অনুজ্জ্বল। মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক এই গল্পটি অতি নাটকীয়তায় ঠাসা এবং ইতিহাস বিকৃতির দায়ে একে কিছুটা অভিযুক্তও করা যেতে পারে। জনাব আলী নামক একজন প্রায় শিশুকে মুক্তিযুদ্ধে সম্পৃক্ত করতে যেয়ে গল্পকার অনেকটাই অপ্রাসঙ্গিকভাবে নিয়ে এসেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে জনাব আলীর বৈঠক, জনাব আলীকে গ্রেনেড ছোড়ায় তথাকথিত প্রশিক্ষণ প্রদান এবং শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হাসিব উদ্দীনকে হত্যা করার জন্য ‘শহীদ রাজ্জাক পার্ক’ অপারেশনের দায়িত্ব প্রদান ইত্যাদি প্রসঙ্গ।
অবশ্য গল্পকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আজো দৃঢ় আস্থাশীল। আর তার বোধের জামিনটুকু এমনই শক্ত যে, একাত্তরের শিশু জনাব আলী বার্ধক্যে পৌছলেও প্রয়োজনীয় মুহূর্তে ’৭১ এর অগ্নিচেতনায় পূনর্বার জেগে উঠতে চায় তার গল্পে। বিষয়টিকে চিৎপ্রবাহ রীতির আশ্রয়ে চমৎকার নির্মিতও হতে দেখি গল্পের শেষাংশে। ‘জনাব আলীর যে ছেলে কোনোদিন রাজনীতি করেনি, কোনোদিন মারামারি করেনি, সেই ছেলের কানের কাছে যেয়ে চিৎকার করে বলে আমার কাছে গ্রেনেড আছে খোকা, হাসিবউদ্দিনরা আবার আসছে। হাসিবউদ্দিনরা আবার আমার মাকে হুমকি দিচ্ছে। জনাব আলীর ছেলে উঠে দাঁড়ায়, বাবার বুকে হাত বুলায়, যন্ত্রণাক্লিষ্ট মাথায় হাত রাখে এবং কোনোদিকে না তাকিয়ে নেমে আসে রাস্তায়।’ (পৃষ্ঠা ১৮)
চিৎপ্রবাহ রীতির অনবদ্য প্রকাশ ‘ডায়েরি’ গল্পটি। গল্পটি রচিত হয়েছে ২০০৮-২০১০ সালের কোনো এক সময়ে। গল্পটি অবশ্য পাঠক পড়তে-জানতে পারছেন এর প্রায় ৫০০ বছর পরে। অতীত ও বর্তমানের যোগাযোগে গল্পটিতে ছট্টু এমন একটি সমাজ/রাষ্ট্রের কথা বলেন যেটি উপনিবেশ শাসন থেকে মুক্তির পরও সমস্ত ঔপনিবেশিক শাসনযন্ত্র দ্বারা চালিত এবং সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়তই এই অশুভ শক্তির দ্বারা নিগৃহীত ও নিপীড়িত হচ্ছে। সাধারণ মানুষের মৌলিক বা মানবাধিকার বলতে প্রায় কিছুই আর অবশিষ্ট থাকছে না, তবুও মানুষ এই প্রশাসন যন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী না হয়ে তাদেরকেই স্বস্তি ও নিরাপত্তার সিপাহসালার ভাবছে। গল্পের কেন্দ্রে রয়েছে একটি চুরির ঘটনা। অনিবার্যভাবেই জড়িয়েছে সিদ্দিক সাহেব, তার স্ত্রী, কয়েকজন প্রতিবেশি এবং পুলিশসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন। পাঁচশত বছর পরের চরিত্র কবির আহমেদ অবশ্য আমাদের ঘটনার শেষটি জানান না- কেননা সাধারণ মানুষ শেষ পর্যন্ত জয়ী হতে না পারলেও পরাজিতও হয় না এমনটাই গল্পকার মনিরুজ্জামান ছট্টু সম্ভবত বিশ্বাস করেন। গল্পকার ছট্টু নৈরাশ্যবাদী নয়। তিনি আশা করেন একদিন সাধারণ মানুষের পারিবারিক ও সামাজিক মুক্তি ঘটবেই। যে কারণে তার গল্পে তিনি সাধারণ মানুষের গল্প বলেন, তাদের সুখ দুঃখকে, তাদের খুব ছোট ছোট চাওয়া-পাওয়ায় কথা বলেন, সে সমস্ত না পাওয়ার যন্ত্রণাকে চিত্রিত করেন কিন্তু দীর্ঘশ্বাস ফেলে না তার কোনো চরিত্র। ‘একটি মৃত্যু সংবাদ’ ‘চোখ’ ‘যেভাবে গল্পগুলো হারিয়ে যায়’ প্রভৃতি গল্পে ছট্টু বারবার এভাবেই তার ভাবনাকে তার পাঠকের মনে সঞ্চারিত করতে চান তার ছোটগল্পের ছোট ছোট কিন্তু অনন্য উচ্চতার চরিত্রগুলোর মাধ্যমে।
চার
সাবলীল গদ্যে ছট্টু গল্প লেখেন। তার গল্পগুলো পাঠককে যেমন চিন্তার নদী সাতরে কুলে ওঠার আনন্দ দেয় তেমনি গল্পগুলো নিজের শক্তিতে পাঠককে ক্রমাগত গল্পটি পড়ে শেষ করতেও প্রাণিত করে। এখানেই ছট্টু সমসাময়িক গদ্য লেখকদের মধ্যে অনন্য, ধ্রুবতারার সমান।


শুভ্র আহমেদ
জন্ম : ০৩ অক্টোবর ১৯৬৬
প্রকাশিত বই
কার্নিশে শাল্মলী তরু : কবিতা : ১৯৯৯, আড্ডা
বিচিত পাঠ : প্রবন্ধ : ২০১৪, ম্যানগ্রোভ
বলা যাবে ভালোবেসেছি : কবিতা : ২০১৫, ম্যানগ্রোভ
দুই ফর্মায় প্রেম ও অন্যান্য কবিতা : কবিতা : ২০১৬, ম্যানগ্রোভ
রবীন্দ্রনাথ যেভাবে বাঁশি বাজিয়েছেন এবং অন্যান্য : প্রবন্ধ : ২০১৯, ম্যানগ্রোভ
পুরস্কার / সম্মাননা
কবিতাকুঞ্জ সম্ম্ননা (১৪০৮ ব)
বিজয় সাহিত্য পুরস্কার (২০০৯)
কবি শামসুর রাহমান পদক (২০১০)
দৈনিক কালের কণ্ঠ শিক্ষক সম্মাননা (২০১২)
কবি সিকানদার আবু জাফর স্বর্পদক (২০১৪)

লেখকের আরও লেখা :
সাবদার সিদ্দিকি : একজন ক্রুশকাঠহীন যিশু – শুভ্র আহমেদ
কবিতা । অভিসার পর্ব : শুভ্র আহমেদ
canadian compounding pharmacy: canada drugs – the canadian drugstore
http://canadiandrugs.store/# canadian pharmacy 24 com
canadadrugpharmacy com: safe online pharmacy – is canadian pharmacy legit
canadian pharmacy prices international online pharmacy best canadian pharmacy to buy from
This article is in fact a pleasant one it helps new net viewers, who are wishing for blogging.
aarp recommended canadian online pharmacies: cheapest online pharmacy – online pharmacy usa
http://ordermedicationonline.pro/# canadian pharmacy cialis cheap
canadian pharmacy without prescription: buy drugs online safely – express pharmacy
An interesting discussion is worth comment. I do think that you should write more on this subject, it might not be a taboo subject but generally people don’t discuss such subjects. To the next! Kind regards!!
the canadian pharmacy: certified canadian pharmacy – canada pharmacy reviews
universal canadian pharmacy Top mail order pharmacies best rated canadian online pharmacy
https://buydrugsonline.top/# fda approved canadian online pharmacies
ordering drugs from canada: certified canada pharmacy online – canadian drugs online
wellbutrin 300 mg no prescription online: Buy bupropion online Europe – price of wellbutrin xl
http://wellbutrin.rest/# best generic wellbutrin 2017
This is my first time visit at here and i am in fact happy to read all at one place.
neurontin price: cheap gabapentin – neurontin 1000 mg
http://paxlovid.club/# Paxlovid over the counter
http://gabapentin.life/# neurontin cost in canada
paxlovid india https://paxlovid.club/# paxlovid generic
buy wellbutrin without prescription: Buy Wellbutrin XL online – wellbutrin prescription uk
https://gabapentin.life/# prescription price for neurontin
paxlovid cost without insurance: buy paxlovid – paxlovid buy
http://paxlovid.club/# paxlovid generic
https://clomid.club/# can i order cheap clomid
medicine neurontin 300 mg: generic gabapentin – 2000 mg neurontin
We are a group of volunteers and starting a new scheme in our community. Your site provided us with valuable information to work on. You have done an impressive job and our whole community will be grateful to you.
https://paxlovid.club/# paxlovid price
best generic wellbutrin: Buy Wellbutrin XL online – cost of wellbutrin in south africa
http://tadalafilit.store/# farmaci senza ricetta elenco
migliori farmacie online 2023: farmacia online miglior prezzo – farmacie online affidabili
farmacia online migliore kamagra farmacia online senza ricetta
acquisto farmaci con ricetta: farmacia online migliore – comprare farmaci online con ricetta
farmacie online autorizzate elenco: Cialis senza ricetta – migliori farmacie online 2023
viagra originale in 24 ore contrassegno: viagra online spedizione gratuita – viagra generico sandoz
farmacia online senza ricetta: kamagra oral jelly – acquisto farmaci con ricetta
https://tadalafilit.store/# farmacia online piГ№ conveniente
viagra generico sandoz viagra prezzo farmacia viagra ordine telefonico
migliori farmacie online 2023: farmacia online spedizione gratuita – farmacia online migliore
farmacia online migliore: farmacia online più conveniente – farmacia online migliore
viagra generico sandoz: viagra generico – viagra naturale in farmacia senza ricetta
farmacie online autorizzate elenco: Farmacie a milano che vendono cialis senza ricetta – acquisto farmaci con ricetta
farmacia senza ricetta recensioni: viagra prezzo – cialis farmacia senza ricetta
farmacie online sicure: farmacia online – acquistare farmaci senza ricetta
http://tadalafilit.store/# farmacie on line spedizione gratuita
comprare farmaci online con ricetta: kamagra oral jelly – comprare farmaci online all’estero
farmacie online sicure: farmacia online spedizione gratuita – farmacie online autorizzate elenco
acquisto farmaci con ricetta: farmacia online miglior prezzo – farmacie online affidabili
If you are going for best contents like I do, simply pay a visit this website everyday since it gives quality contents, thanks
farmaci senza ricetta elenco: avanafil spedra – top farmacia online
siti sicuri per comprare viagra online: viagra prezzo farmacia – cialis farmacia senza ricetta
alternativa al viagra senza ricetta in farmacia: viagra consegna in 24 ore pagamento alla consegna – viagra consegna in 24 ore pagamento alla consegna
farmaci senza ricetta elenco dove acquistare cialis online sicuro comprare farmaci online con ricetta
farmaci senza ricetta elenco: dove acquistare cialis online sicuro – farmacie on line spedizione gratuita
http://tadalafilit.store/# farmacie on line spedizione gratuita
farmacia online miglior prezzo: kamagra – farmaci senza ricetta elenco
viagra online consegna rapida: viagra senza ricetta – viagra generico prezzo più basso
viagra online in 2 giorni: sildenafil 100mg prezzo – viagra pfizer 25mg prezzo
viagra naturale in farmacia senza ricetta: viagra consegna in 24 ore pagamento alla consegna – pillole per erezioni fortissime