গদ্য । ইব্রাহিমের নৌকা : মৌলীনাথ গোস্বামী

ইব্রাহিমের নৌকা

মৌলীনাথ গোস্বামী


নভেম্বর মাসের গোড়ার দিকে। দীপাবলি সবে শেষ। তখন বেলা সাড়ে তিনটে। চলেছি। বাইকের পিঠে। স্বচ্ছল জীবনের মতো মসৃণ পিচ রাস্তা দিয়ে।

রোদ পড়ে আসছে। তেজ নেই। নরম, মায়াবী, কিঞ্চিৎ ঠাণ্ডা। মরা রোদ, কিন্তু রঙের বাহারে ভরপুর। সেই মায়া-আলোয় রাস্তার দু’ধারে জিরোচ্ছে ধান, ধানের মড়াই, সবজির ক্ষেত। সবুজের বিভিন্ন আভার অবাক বৈচিত্র্য। হালকা, কচিকলাপাতা, গাঢ়, আরো গাঢ়….

ছুটে চলেছি। আমাদের পথ করে দিচ্ছে কোথাও হলুদ, বেগুনি, আবার লালচে রঙা মাঠ। মাঠেরও এতো রং হয়! চঞ্চল ফিঙে, ব্যস্ত বেনেবৌ, একমনা শামুকখোলের পরিবার। বেহুলা নদীর বাঁক, বাঁয়ে একলা তালগাছ, রাস্তার পাশে দাঁড়ানো লম্বা লম্বা পাট কাঠির আঁটি, ত‍্যাঁদোড় ছেলে ছোকরার হুল্লাট!- সব ছাড়িয়ে…

একসময় গ্রামের রাস্তা ধরলাম। খড়ের গাদা। আম পাতার সুবাস। হঠাৎ এক ঝলক বিড়ির গন্ধ। ভ্যান রিকশা। দু-চার জন সওয়ারি। ইস্টিশন ফেরত।

‘পথিক তুমি পথ হারাইয়াছ?’– হারাইয়াছিই তো! একে তাকে জিজ্ঞেস। রাস্তার মোড়ে থমকে দাঁড়িয়ে দিক ঠাওর। পাশ কাটিয়ে চলে যায় কৌতূহলী চাউনি। গ্রাম্য অলিগলির পরিপাটি নিকোনো পাকস্থলী বেয়ে, অবশেষে এসে থামলাম।

আকাশ ছোঁয়া বিশাল বাঁশ বাগান। রাস্তার পাশে বাইক রেখে গুটিগুটি পায়ে। বাইরে তখনও রোদের আভাস। ভেতরে আন্ধের নগরী। আমি চৌপট রাজা!-

‘হেথা দিনেতে অন্ধকার
হেথা নিঃঝুম চারিধার
হেথা ঊর্ধ্বে উঁচায়ে মাথা দিল ঘুম-
যত আদিম মহাদ্রুম!’–

দ্রুম আর কোথায়? শুধু ইয়য়া লম্বা লম্বা বাঁশগাছ গলাগলি ক’রে নিচের দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আকাশ দেখা যায় না। কিছু মালুম হয় না। বাঁশঝাড়ের মাথার ফাঁক দিয়ে চোরা রোদ ঢুকছে ভেতরে। ইতিউতি। আমিও ঢুকছি। ভোরের আলো ফোটার মত একটু একটু করে অন্ধকার কাটছে। আবছায়ে চোখ সয়ে গেলে দৃষ্টি ক্রমে পরিষ্কার হল। বাঁশ বাগানের ঘন ছাউনির ভেতর ভোজবাজির মতো জেগে উঠল বাদামি রঙের এক বিস্ময় জগৎ…… প্রাগৈতিহাসিক চতুষ্পদ সরীসৃপদের মতো ঝিম মেরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অজস্র নৌকা!!

এই গ্রামে নৌকা তৈরি হয়??


শুনশান অন্তঃস্থল। নিস্তব্ধ। মৃদু মচমচ শব্দে পায়ের তলায় গুঁড়িয়ে যাচ্ছে শুকনো বাঁশপাতা। গুঁড়ো গুঁড়ো চিলতে আলো।

পায়ে পায়ে এগিয়ে সামনে একটা নৌকা। নাঃ! নৌকার মতন। শুধু শিরদাঁড়া। প্রথম পরিচয়। একটু মজ্জা। বাঁশবাগানের গোল গর্ভে জন্ম নিচ্ছে নৌকার ভ্রূণ। দুটি অদৃশ্য হাত লালন করছে। আগলে রেখেছে। শৈশব না কী নিঃসঙ্গ বার্ধক্য? বাঁকা মেরুদণ্ড। ন্যুব্জ। ভগ্নপ্রায়। পড়ে আছে উদোম। অসহায় । কোনওমতে কয়েকটা ঠেকনা দিয়ে জিইয়ে রাখা…..

অজ্ঞানতার পর্দা সরে যাচ্ছে… উপলব্ধি… কী দেখলাম? কী দেখছি আমি? সিনেমার দৃশ্যের মতো চোখের সামনে ঘটে যাচ্ছে আমার অতীত। মনে পড়ছে আমার জন্ম বৃত্তান্ত। চোখের সামনে শুয়ে আছে আমার ভবিষ্যৎ। দেহ… শুধু মেরুদণ্ড…

তখন সুনামগঞ্জের বাঁশবাগানে হালকা হাওয়া। পাতায় পাতায় আব্দুল করিম শা গাইছে…

‘নাও বানাইলো রে নাও বানাইলো রে কোন মেস্তরি
কোন সন্ধানে বানাইলো রে নাও, বুঝিতে না পারি-
নাও বানাইলোরে কোন মেস্তরি!’

কে বানাচ্ছে? দেখা যায় না। কেউ নাই, অথচ সৃষ্টি আছে। আবছায়া ধ’রে আমার দিকে হেঁটে আসে পাতার মচমচ। একটি লোক। হেঁটো লুঙ্গি।

‘কে তুমি? ঈশ্বর পাটনী?’
আজ্ঞে আমি ইব্রাহিম।

‘কী করো?’
আজ্ঞা, নৌকা বানাই।

‘এগুলো তুমি বানাচ্ছ?’
হ কত্তা। আরো কারিগর আসে।

‘তারা সব কোথায়?’
পার্বণের সময় অহন। তাই ছুটি গেসে। এক আধ জন আসে। আইজকার মতো কাম শ্যাষ। বাইর হইসে।

‘কাজ শেষ কেনো? এখনো তো বাইরে আলো আছে!’
বাইরে আলো। ভিতরে তো অন্ধকার। কাল বেলার আগে কাম হইবো না। আলো ছাড়া কাজ করন যায় না।

‘তাহলে জঙ্গলে কেন? খোলা জায়গায় করলেই পারো!’
নাঃ! কত্তা! রোদে পিঠ পুড়ে। বেশীক্ষণ কাজ করন যায় না।

রোদ ইব্রাহিমদের কাছে আশীর্বাদ; রোদই এদের কাছে অভিশাপ!


‘চাইর রঙ্গে রঙ লাগাইয়া ঐ নাও দিয়াছে সুন্দর করিয়া
যে জন হয় সুজন নাইয়া রাখে যত্ন করি…
নাও বানাইলো রে কোন মেস্তরি!’

‘কতদিন লাগে একটা নৌকা বানাতে?’
দশ দিন !

চমকে গেলাম। সমাপতন– দশ ! বলে কী !! আস্ত একটা নৌকা! দশ দিন?.. যেন দশ মাস। নবজাতক। টলমল টলমল। প্রস্তুত। জীবন স্রোতের উজান বাইবে…

ইব্রাহিম কিঞ্চিত আনমনা। বিড়ি ধরায়। ধোঁয়া ছাড়ে। হাওয়ায় কুণ্ডুলি পাকিয়ে ধোঁয়ার কলোনি আক্ষেপের মতো ঘিরে থাকে তাকে। উদাস। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইব্রাহিম…

আমার আর কদ্দিন! কারিগর কমতাসে। ছেলেরা নৌকা বানাতি চায় না। শহরে যায় কাম করতি।”… জন্ম দাতার আকাল। আগুন, পানি, বাতাস, মাটি- সব আছে। রং লাগাবার মেস্তরি নাই। চুম্বকের-শহর উজাড় করে দিচ্ছে গাঁ-গঞ্জের কোল। আগুন আছে, হাপর ঠেলার লোক নাই। পুকুরে জল আছে, সেচ করার মানুষ নাই। মাটি আছে, লাঙ্গল দেয়ার মুনিষ নাই। বাতাস আছে, কুলো ঝাড়বার লোক নাই। শহুরে আলোর আলেয়া। মরীচিকা। অশনি সংকেত। গ্রাম রোজ ট্রেনে চেপে শহরে যায় যে!

সন্ধ্যা নামছে। আলো মরে যাচ্ছে। ইব্রাহিমের চকচকে নৌকোগুলো ঝাপসা হয়ে হয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে। জ্যান্ত জীবাশ্মের মুখোমুখি আমি। আলো চাই। পিঠে রোদ্দুরের ভালোবাসা মাখার কারিগর চাই। কাঠের টুকরো জুড়বার। কোষ থেকে কোষ। শিরদাঁড়া। অস্থি। মজ্জা। দেহ। বাঁশবাগানের জঠরে আমার চোখের সামনে ঘটে চলেছে একটি নৌকার মৃত্যু–

‘বলো হরি, হরি বোল!’

বাঁশপাতায় শুকনো ফিসফিস। হাহাকার। কারিগর নাই… কারিগর নাই

অহন বাজার পড়তাসে। খদ্দের নাই।…

ছটফট ক’রে ওঠে ইব্রাহিম !–

আবার ধাক্কা। নৌকা কেনার লোক নাই! জীবনের গতির সাথে পাল্লা দিতে পারছে না মনপবনের নাও। পিছিয়ে পড়ছে। সবাই চায় গতি, পিস্তলের গুলির মত! অষ্টমীর খ্যানের খাঁড়ার মতো- দ্রুত… আরো দ্রুত… মন্থরতার বিলাস আজ প্রান্তিক। শহরের গতি গ্রাস করছে গ্রামের ধ্রুপদী জীবনযাত্রা। অসম লড়াই। ইব্রাহিম বিরক্ত। শহর এসে বাঁশতলায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে তার সাথে। শহুরে মানুষ। আমি। এই সন্ধ্যায় আমিই জিন্স পরিহিত শহর!- যে শহর নৌকার পালের বাতাস কেড়ে নিচ্ছে!

হাঁটা দেয় ইব্রাহিম। ক্রমশ মিশে যায় ভারাক্রান্ত অন্ধকারের বুকে।
‘ভেসে যায় আদরের নৌকো ভেসে যায় সোহাগের সাম্পান’…

… একটা নদী
নদীতে কানায় কানায় জল
জলে ভাঁটির টান
টানে ভাসছে একলাটি নৌকা
ইব্রাহিমের নৌকা…
ভেসে যাচ্ছে ইব্রাহিম… ইব্রাহিমের নৌকা… ভেসে যাচ্ছে ইব্রাহিমরা!!

মৌলীনাথ গোস্বামী

জন্ম ১৯৭০

আজন্ম বসবাস আসানসোলে। স্কুলজীবন কেটেছে আইরিশ মিশনারিদের মাঝে। ম্যানেজমেন্ট নিয়ে স্নাতকোত্তর। বর্তমানে, রাজ্য সরকারের আধিকারিক।

দীর্ঘ সময় ধরে কবিতা ও গল্প, উপন্যাসের চর্চা করে চলেছেন। বিশ্বাস করেন, জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি বস্তু নিয়ে কবিতা রচনা করা সম্ভব। তাঁর লেখায় বারবার উঠে এসেছে প্রেম, বিচ্ছেদ, মানুষের সামাজিক অবস্থান এবং গভীর মৃত্যু-চেতনা। একাধিক পত্র-পত্রিকায়, তাঁর কবিতা, গল্প নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে।

কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ- দয়াল । প্রকাশকাল, বইমেলা, ২০২০, প্রতিভাস, কোলকাতা।

লিখবেন, যতদিন জীবন লেখাবে তাঁকে দিয়ে…

About S M Tuhin

দেখে আসুন

জন্মদিন : আমাদের নিবেদন

জ ন্ম দি ন  :  আ মা দে র নি বে দ ন কাকতাড়ুয়ার তাড়ায় …

4 কমেন্টস

  1. I have been trying to find a post about that forever.

  2. Cheers! Helpful information! courses online great college essays

  3. coursework resources
    cpa coursework
    coursework website

  1. Pingback: 1schemes

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *