কিশোর উপন্যাস ০ কিশোরদের মন – দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার

কিশোরদের মন

দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার

ভূমিকা

কিশোরদের উপন্যাসের অক্ষর লিখ্‌তে, ‘কালিটে নিতে হয় সব্‌জে’। সেই ছোট ছোট উজ্জ্বল মানুষদের মন, যেন নূতন পাখা ওঠা পক্ষিরাজ ঘোড়ার পিঠে সওয়ার; তরোয়াল ঝক্‌মকিয়ে সবটা রাস্তা চম্‌কিয়ে তারা চলেছে ! শিশুদের মনকে প্রথমেই ভুলিয়ে দেওয়া যায়, লাল একটুকু অমল হাসি দিয়ে। ঘটনার দোলায় দুলিয়ে, কি, কল্পনার উধাও মেঘে ছোটদের একেবারে উড়িয়ে নেওয়া যায়! কিন্তু বীর কিশোরেরা এক নিমিষে তরোয়াল দিয়ে কচ্‌ কচ্‌ করে এসব কেটে ফেলে দিতে পারে, তা-ই যদি তাদের ইচ্ছে হয়।
দিয়েই, হয় ত ভ্রূ কুঁচিয়ে আধ হাসি সঙ্গে রেখে, তারা জিজ্ঞেস করবে,
“কি –  এ?”
তখন সত্যিকারের রাজ্যের বাঁশী না বাজ্‌লে, তারা তাদের সদ্য ধারাল আলোর স্বর্ণপতাকা উড়িয়ে দিয়ে, সেইখেনে তাদের যুদ্ধের বিউগল্‌ বাজিয়ে দেয় । সজাগ কিশোরেরা এই রকমে তাদের চোখ আর মন এই দুটো অমূল্য হীরের আলোতে, জগতের কিছুকেই হারিয়ে দিতে পেরেছে। যা কিছু স্বপ্ন পৃথিবীতে আছে, আর যা কিছু স্বপ্ন রয়েছে কিশোরদের মনের ভিতর, সব তাদের কাছে হেরে গিয়ে, প্রতিদিন হয়ে উঠ্‌ছে, সত্য। এবং সেই সত্যকে সবখানেই হতে হয়েছে রঙিন্‌। তারই উপর দিয়ে জীবনের অমর পক্ষিরাজ ঘোড়া ছুটিয়ে চলে যাচ্ছে তারা!—সেই প্রফুল্ল, সুন্দর, অতুল, জীবন্ত কিশোরেরা!
তাদের জীবনের ইতিহাস আর উপন্যাস, এ দুই-ই মাখা তারি মধ্যে। তাজা সবুজে’ রঙে৷ কোন্‌টি তারা ভালোবাসে ? তাদের হার আর জিৎ, ওরি ভিতরে দুটিই। তা তারা কখনও বেছে নিতে পারে না! নিতে না পারাটাই যেন তাদের অসীম আনন্দ! বেছে নিতে না পেরে, গাছের পাতা যেমন গাঢ় আর হালকা দু’রঙেরই উপর দিয়ে, ফুল হয়ে ওঠে ফুটে, এরাও তেম্‌নি ফুটে ওঠে মানুষের ভুবনের আলোর ফুল হয়ে, সোণালি রঙে! সেই কথার একটি ফোঁটা এ বইয়ে।
বল্‌বার জন্যে, যে— খোলা পথে, নদীর ধারে, মাঠের বুকে, পাহাড় ডিঙিয়ে কিশোরদের ঘোড়া ছুটে চলেছে; হীরের আলো জ্বলে উঠ্‌ছে আঁধারের গায়ে গায়ে। বিমল আর সুবিনয় ফিরে দাঁড়িয়ে দেখ্‌ছে—তাদের সাথীদের কার কার ঘোড়া ছুটে আস্‌ছে!
শ্রীদক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার . সাহিত্যাশ্রম, লেক রোড

 

 

হাইস্কুল

ক্লাসের যেখানটাতে বস্‌ত সুবিনয়, বিমল বস্‌ত ঠিক তারি পেছনের বেঞ্চে। থার্ড ক্লাস্‌। এই ক্লাসে পড়াশুনার তেমন চাড়্‌ নেই। ছেলেরা, এই ক্লাসে একটু জিরিয়ে নেয়। ফার্ষ্ট ছেলে ছিল না বটে সুবিনয়, কিন্তু, মাষ্টার মহাশয়ের ডান দিকের ফার্ষ্ট সীটেই সে বস্‌ত। জজের ছেলে সে। পড়াশুনায় ইংরেজিটা সে খুব ভালো জান্‌ত।

সুবিনয়ে বিমলে বেশ্‌ ভাব এখন। একখানা বই আন্‌তে একদিন বিমল সুবিনয়ের বাসাতে গিয়েছে । বসে আছে বৈঠকখানাতে। এমন সময়, মুখখানা ভরা বড় বড় চোক আর জোড়া ভুরু, কুমোরদের-গড়া ছোট্ট প্রতিমার মুখের মত মুখ, একটি মেয়ে, ছবির বই একখানা হাতে করে’ ঘরে ঢুকেই, বিমলকে দেখে বল্‌লে— “এটাকে দয়েল পাখী বলে ? ইস্!—এটা শালিক !— মণ্টু সব জানে কি-না !”

সুবিনয় আর বিমলের মধ্যে এখন, মা অনেক সময় ভুলে যান, কে তাঁর ছেলে। আর মণ্টু আর তার দিদির মধ্যে ভাব যা হয়েছে এখন তা কখনো স্বপ্নেও হয় না। বিমল মুগুর ভাঁজত। তার শরীরটে ছিল যেন লোহার কাঠামোতে তয়েরি। দুই ভাইবোন্‌কে কাঁধে নিয়ে বিমল যখন তিনতলার সিঁড়ি ভেঙে ছাদে উঠ্‌ত, তখন তাদের সেই ঝগ্‌ড়ার ঘোড়াটার কথা একটুও মনে থাক্‌ত না!

গরমের ছুটিতে বিমল বাড়ী গিয়েছে। কথা ছিল সুবিনয়ও যাবে। কিন্তু বিমলদের বাড়ী যেখানে সেখানকার স্বাস্থ্য এ ক’মাস ধরে’ তেমন ভালো থাক্‌ত না। সুবিনয়ও ওরকম পাড়াগাঁয়ে আর কখনো যায় নি। বিমল বললে,—“বেশ্‌ হবে! মা ত গঙ্গাস্নানের যোগেই আস্‌ছেন,—ক’দিন ত এ সহরেই থাক্‌বেন, তখন সবারি সঙ্গে দেখা হবে। তুই শীতের সময় যাবি সুবিনয়!”

সুবিনয়ও দেখ্‌ল যে, বেশ হবে !

দু’জনের কথার যেন শেষ হল না!

আর আর বারে ছুটি ত কোথা দিয়ে পালিয়ে যায়, এবারে যেন ফুরুচ্ছেই না। আর মার গঙ্গাস্নানের যোগটাও আস্‌ছে না। যা হ’ক গ্রামে বারোয়ারি কালীপূজো নিয়ে বিমল মেতে রয়েছে কদিন খুব। শৈলেন্‌, নরেন্‌, চারু, ক্ষিতীশ পাড়ার সব ছেলেদের সঙ্গে সারাদিন উৎসাহে বেজায় সে খেটেছে। মোড়ল সে-ই। তা’পর সন্ধ্যেয় আরতি দেখ্‌তে গিয়েছে সকলে।

বিমল ফিরেছে। কিন্তু ইস্কুল খোলার মাসখানেকের পর,  ক্লাসে ভারি একটা ওলোট পালোট দেখা যাচ্ছে। First বেঞ্চের শেষ সিটে—সুবিনয়। আর ঝম্‌ঝম্‌ বৃষ্টিতে ভিজে এসে, বিমল, লাষ্ট্‌ বেঞ্চির শেষে বসে আছে। কতক্ষণ পরে সে ছুটি নিয়ে চলে গেল। ইস্কুলের ডিবেটিং ক্লাবের মিটিংএর শেষে, বক্তৃতার ইংরেজীর একটা গ্রামারের কোশ্চেন নিয়ে, ঘোর তর্কাতর্কি হয়। তাতে ইস্কুলে দুটাে দল হয়ে যায়। কিন্তু সে তর্কের মীমাংসা হল না।

ঘড়ির কাঁটা তবুও সব বাড়ীতেই প্রায় ঠিক ঠিক মতই চলছে। কিন্তু সুবিনয় মাঝে মাঝে তার টাইমপীস্‌টাতে চাবি দিতে তবুও ভুল করে ফেলে। বিমলের তো ঘড়ি নেই। তার কোনই বালাই নেই। কেবল, হয়ত, বেলাই অনেক তার বেড়ে যায়। একদিন ক্রিকেট ম্যাচে, বিমলের একটা hit হঠাৎ সুন্দর হয়ে যাওয়াতে, সুবিনয় “Gr-a-nd” বলতে গিয়েও,—নিজের মুখ রুমাল দিয়ে চেপে ধরে’—চলে এল।

সন্ধ্যে রাঙা হয়ে উঠেছে। দূর থেকেই বাড়ীর গেট, দাঁড়িয়ে আছে। ফুটবলের ফিল্ডে গোলপোষ্ট্‌টার কাছে কোন কোনদিন দেখা যেত, সুবিনয় সেখানে পায়চারি কর্‌ছে, যখন খেলা শেষ হয়ে গেছে। সেই পায়চারির পা দুটোই তাকে ধীরে ধীরে বাঁধের উপরে বড় রাস্তাতে নিয়ে যেত, গির্জ্জার বকুলতলায়, বাঁধ যেখানে শেষ হয়েছে। বাঁধানো চত্বরে সে উঠত। কিন্তু সদ্য ঝরে’ পড়া বকুলের সৌরভ দিয়ে সেখানে কি কথা যে লেখা ছিল, তা সে পড়ে’ উঠ্‌তে পারত না।

হাফ ইয়ার্লির কয়েকদিন আগে, সুবিনয় দেখ্‌লে, বিমল এসেছে। তার কাণে এ কথাটি এল। ক্রমে জান্‌তে পারলে সে, মার চিকিৎসা করাবার জন্যে, মাকে সঙ্গেই নিয়ে এসেছিল বিমল। একটি নিঃশ্বাস, আধখানা হতে হতে, আস্তে ভেঙে গেল। খুব তাড়াতাড়ি করে’ ছেলেদের সঙ্গে যেন যুদ্ধ করে, পূজোর আগেই হাফ ইয়ার্লি শেষ হল। ছুটির ক’দিনই বা আর? সে কটা দিন যেন ঠিক ছেঁড়াকাগজের নিশানের মত খসে’ খসে’ পড়্‌তে লাগ্‌ল। রং ফ্যাকাসে হয়ে।

 

কখন্‌ পূজোর ছুটি হয়ে গেছে। তার পরের দিনগুলো ‘ছুটি’ গায়ে মেখে বেড়ালেও, তাদের, ছুটি যেন একটুও নেই। নানা রকমের ভিড়। নানা কাজের ভিড়। পূজোর ধূমে সহর মাতিয়ে দিয়ে, অবশেষে পূজোর বাদ্য থেমে গেছে।

আজ বিজয়া। সহরের সদর পথে অনেক দূর ধরে’ নিরঞ্জনার প্রতিমার সঙ্গে বাজনার করুণ এলোমেলো সুর আর সহরের পাকা পথে আর চারধারের গ্রামের কাঁচা পথে আস্‌ছে যাচ্ছে লোকের পর লোক সুবিনয়দের বাসায়। মা ধানদূর্ব্বার আশীর্ব্বাদ দিচ্ছেন।

মা বল্‌লেন-“বিমল আজো, এখনো এল না রে?

“বোধ হয় আরো রাত্তিরে আস্‌বে?”

মণ্টুরা যখন সুবিনয়কে প্রণাম করেই বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল, সুবিনয় তখন শুধু তাদের হাতের ছোঁয়াটাই পেল, তাদের মুখ সে কি দেখতে পেল?

না! না!

মাকে, বাবাকে, সে প্রণাম করেছে।

গাছপালার ফুলে হাসা প্রণাম নিয়ে, শরতের জ্যোৎস্না মাখা মেঘেরা চলে গেল। সে তা-ও দেখ্‌তে পেল না।

ফার্ণের টব্‌টার কাছে সে শুধু দাঁড়িয়ে রইল।

তিনটে চাদর, ঝুল্‌ছিল আল্‌নাতে। একটা চাদর গলায় জড়িয়ে নিয়ে সে বারান্দায় ঘুর্‌তে লাগল।

কতক্ষণ পরে সে চাদরটা গলা থেকে খুলে’ একটা চেয়ারের ব্যাকে রেখে, তাতেই বসে পড়্‌ল।

বসে’ বসে’ কতকটা ঘুমের মতো আস্‌ছিল, কেউ দেখে বোধ হয় এই রকম মনে কর্‌ত।

হঠাৎ সে উঠে, খালি সাটটা গায়ে, মাঠের উপর দিয়ে চল্‌ল।

রাস্তার আলোর তল দিয়ে লোকজনেরা চল্‌ছে, শব্দ করে গাড়ী চল্‌ছে কাঁকর-পথের মাঝখান দিয়ে, ঘাসগুলোর উপর দিয়ে চোখ বুলিয়ে, সে, গাছের আড়াল ধরে আস্তে চল্‌ল। ষ্টেসানের পুকুরের ওপারের পথ বেয়ে থানা পেরিয়ে গিয়ে, সে বিমলদের বাসায় উঠেছে। ভিতরে ঢুকে, সিঁড়িতে উঠেই সে থেমে গেল।

পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে, কাম্‌ড়াতে লাগ্‌ল হাতের বুড়ো আঙুলের নখ্‌টা।

কোথাও সাড়া শব্দ নেই।

ভাব্‌ছিল ফিরে যাবে।

বিমলদের ঘরে, মা ঘুমিয়ে পড়েছেন।

বিমল মাথায় একটা পাগ্‌ড়ি জড়ালো।

তারপর সেটাকে খুলে রেখে কতক্ষণ মায়ের পায়ের কাছে বসে রইল।

তারপর আবার উঠে বেরিয়ে এল।

আস্‌তেই, দোর খুলেই,—সাম্‌নে—সুবিনয়!

শব্দ শুনে’ সুবিনয় ফিরেই,—দেখ্‌লে—বিমল!

একেবারে বিস্ময়ে, দুজনে কতক্ষণ দুজনের দিকে চেয়ে থাক্‌লে।

তারপর হেসে দিলে বিমল, সুবিনয়, দুজনেই

আর ক’ সেকেণ্ডের মধ্যে দুজন দুজনের বুকে—বিজয়ার আলিঙ্গনে বাঁধা পড়্‌ল।

হঠাৎ সুবিনয়ের হাত বিমলের পিঠের একটা পকেটে গেল বেধে!

চম্‌কে সুবিনয় বল্‌লে,—

“কি রে?”

বিমল বল্‌লে—

“সেই জামাটা, মাকে দিয়ে নিয়েছি সারিয়ে, পিছনে একটা পকেট করে’।

আজ ইস্তিরি করে পরেছি

তোদের ওখানে যাব বলে!”

 

* দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার

বাংলা শিশুসাহিত্যের ধারায় সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাম দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার। প্রধানত ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ শীর্ষক অবিস্মরণীয় গ্রন্থের জন্য বাঙালি পাঠকসমাজে তিনি সমধিক পরিচিত। লোক-সাহিত্যের সংগ্রাহক ছড়াকার, চিত্রশিল্পী, দারুশিল্পী এবং কিশোর কথাকার হিসেবেও দক্ষিণারঞ্জন বিশিষ্ট অবদান রেখে গেছেন। বস্তুত, তার হাত ধরেই বাঙালি কিশোর শিক্ষার্থীরা সর্বপ্রথম সাহিত্যের অভ্যন্তরলোকে প্রবেশ করেণ্ড প্রথম লাভ করে শব্দশিল্পের আস্বাদ। পশ্চিমে হ্যান্স এন্ডারস কিংবা গ্রীম ভ্রাতৃদ্বয় কিশোরদের সাহিত্যমুখী করার জন্য যে ভূমিকা পালন করেছেন, বাংলাদেশে তা পালন করেছেন দক্ষিণারঞ্জন। এই ভূমিকার কথা স্মরণ করে একথা আজ নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, হাজার বছরের বাংলাদেশ যেসব শ্রেষ্ঠ সন্তান বাঙালিকে উপহার দিয়েছে, দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার তাদের অন্যতম।

১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ এপ্রিল (১২৮৪ বঙ্গাব্দের ২ বৈশাখ) ঢাকা জেলার সাভারের অন্তর্গত উলাইল গ্রামের সম্ভ্রান্ত মিত্র মজুমদার বংশে দক্ষিণারঞ্জন জন্মগ্রহণ করেন। ১৯০২ সালে দক্ষিণারঞ্জনের পিতা রমদারঞ্জন মারা যান। পিতার মৃত্যুর পর তিনি মুর্শিদাবাদ ত্যাগ করে পিসিমা রাজলক্ষ্মীর কাছে টাঙ্গাইল চলে আসেন। এ কারণেই তার প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখায় সমাপ্তি ঘটে। টাঙ্গাইলে এসে দক্ষিণারঞ্জন কৃষিকাজে মনোযোগী হয়ে ওঠেন। ভাইপোর উৎসাহ দেখে রাজলক্ষ্মী দেবী তাকে জমিদারী দেখাশোনার দায়িত্ব দিলেন। এর ফলে পল্লিবাংলাকে জানার সুযোগ ঘটলো দক্ষিণারঞ্জনের। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে তিনি ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। রাখাল বালকের বাঁশির সুরে, মাঝিদের উদাসকরা ভাটিয়ালী গানে আর গ্রাম-বৃদ্ধাদের মুখে ‘পরণকথা’ শুনে তার রসপিপাসু মন ভরে উঠলো। দীর্ঘদিন ধরে তিনি এসব গ্রামীণ ব্রতকথা গীতিকথা-রূপকথা দিয়ে ভরে তুলেছেন তার খাতার পাতা। উত্তরকালে এসব উপাদানই তিনি উপহার দিয়েছেন বাঙালি পাঠককে। কাজেই পিসিমার আশ্রয় এবং তার জমিদারি দেখাশোনার ভার কেবল দক্ষিণারঞ্জনের জীবনের জন্যই নয় রসপিপাসু বাঙালি পাঠকের জন্য ছিল এক ঐতিহাসিক আশীর্বাদ।

ইতিমধ্যে দক্ষিণারঞ্জনের লেখা ও সংগৃহীত রূপকথা কলকাতার বিখ্যাত সব পত্রিকায় ছাপা হতে আরম্ভ করে। ক্রমে তিনি উৎসাহী হয়ে ওঠেন। এভাবে এক সময় প্রস্তুত হয়ে যায় ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র পান্ডুলিপি। প্রকাশক না পেয়ে নিজের অর্থেই পান্ডুলিপি প্রকাশে উদ্যোগী হন দক্ষিণারঞ্জন। এ সময়ই আকস্মিকভাবে রূপকথা-লোকগীতি সংগ্রহের আরেক কিংবদন্তী দীনেশচন্দ্র সেনের নজরে আসে ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র প্রুফ কপি। অবশেষে দীনেশচন্দ্র সেনের উদ্যোগেই সেকালের বিখ্যাত প্রকাশক ভট্টাচার্য অ্যান্ড সন্স থেকে ১৯০৭ সালে আত্মপ্রকাশ করে ‘ঠাকুরমার ঝুলি’। বাংলাসাহিত্যে সৃষ্টি হয় অভূতপূর্ব আলোড়ন। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে ইয়োরোপেও লাগে সে আলোড়নের ঢেউ।

‘ঠাকুরমার ঝুলি’ প্রকাশের পর একে একে দক্ষিণারঞ্জনের অনেক বই প্রকাশিত হতে থাকে। তার প্রতিটি বই-ই বাংলা সাহিত্যের অক্ষয় সম্পদ হিসেবে স্বীকৃত। উত্থান এবং ঠাকুরমার ঝুলি ছাড়া তার যেসব বই বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, সেগুলো নিম্নরূপ- মা বা আহুতি (১৯০৮), ঠাকুরমার ঝুলি (১৯০৯), আর্যনারী (প্রথম ভাগ ১৯০৮, দ্বিতীয় ভাগ ১৯১০), চারু ও হারু (১৯১২), দাদামশায়ের থলে (১৯১৩), খোকাখুকুর খেলা (১৯০৯), আমাল বই (১৯১২), সরল চন্ডী (১৯১৭), পুবার কথা (১৯১৮), ফার্স্ট বয় (১৯২৭), উৎপল ও রবি (১৯২৮), কিশোরদের মন (১৯৩৩), কর্মের মূর্তি (১৯৩৩), বাংলার সোনার ছেলে (১৯৩৫), সবুজ লেখা (১৯৩৮), চিরদিনের রূপকথা (১৯৪৭), আশীর্বাদ ও আশীর্বাণী (১৯৪৮) ইত্যাদি। ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র মতো চারু ও হারুও সেকালে বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করে। এ বই-ই বাংলা ভাষার প্রথম কিশোর উপন্যাস। রূপকথাধর্মী নিজের মৌলিক সাহিত্যকর্ম সবুজ লেখা (১৯৩৮) দক্ষিণারঞ্জনের আর একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। বঙ্গীয় সাহিত্য মন্দির (১৯৩৯) শীর্ষক তার একটি মৌলিক কবিতা সংকলন ও সেকালের বাঙালী পাঠকের কাছে বিশেষভাবে সমাদৃত হয়েছিল। দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের কর্মজীবন ও সাহিত্যজীবন অভিন্ন। সাহিত্যজীবনই মূলতঃ তার কর্মজীবন। সারাজীবনই তিনি লোকসাহিত্য সংগ্রহ ও সম্পাদনা করেছেন। তবে পিসীমার বাড়িতে কৃষিকাজ তদারকি তার কর্মজীবনের এক উজ্জ্বল অধ্যায়। দক্ষিণারঞ্জনের প্রতিভার আর দুটো উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি খুব ভালো ছবি আঁকতে পারতেন। নিজের বইয়ের ছবিগুলো তিনি সব সময় নিজেই আঁকতেন। বইয়ের প্রচ্ছদও করতেন তিনি নিজের হাতে। দক্ষিণারঞ্জন ছিলেন একজন অসাধারণ দারুশিল্পী। কলকাতা পূর্ণদাস রোডে তার যে বাসভবন, সেখানকার দরজা-জানালা কাঠের শিল্পকর্ম তিনি নিজের হাতে করেছেন।

১৩৬৩ বঙ্গাব্দের ১৬ চৈত্র (১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৩০ মার্চ) দক্ষিণারঞ্জন মিত্র-মজুমদার আশি বছর বয়সে কলকাতার নিজ বাসভবন ‘সাহিত্যাশ্রম’ এ চিরনিদ্রায় শায়িত হন। দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার বাংলা সাহিত্যের এক কিংবদন্তী পুরুষ। এ দেশের কিশোর-কিশোরীদের স্বপ্নমুখী, সাহিত্যমুখী এবং জীবনমুখী করার ক্ষেত্রে তিনি পালন করেছেন অবিস্মরণীয় ভূমিকা।

* উপন্যাস নির্বাচন ও পরিশিষ্ট কথন সংগ্রহ : অতলান্ত অঝর

 

About S M Tuhin

দেখে আসুন

মুকুল শাহরিয়ারের ছড়া

ছড়া মুকুল শাহরিয়ার মিল-অমিল মায়ের সাথে চেহারাতেআমার অনেক মিল ছিলোআমার মতো মার গালেওএকটা ছোট তিল …

23 কমেন্টস

  1. What i don’t realize is if truth be told how you are no longer actually a lot more smartly-preferred than you
    might be right now. You’re so intelligent.
    You already know therefore considerably relating to this topic,
    made me for my part consider it from so many varied angles.
    Its like men and women don’t seem to be involved unless it is one thing
    to do with Lady gaga! Your individual stuffs outstanding.

    All the time take care of it up!

  2. Thankfulness to my father who shared with me regarding this website, this weblog
    is in fact awesome.

  3. I am regular reader, how are you everybody? This piece of writing posted at this website is really pleasant.

  4. Pretty! This was a really wonderful post. Thank you for providing this info.

  5. I enjoy what you guys are up too. Such clever work and exposure!
    Keep up the superb works guys I’ve incorporated you guys to my blogroll.

  6. If i waѕ to put bad fuеl or ᧐iⅼ in our car, may we expect of its peгformance along
    with the way long should we expect the auto to survive, do we cross our fіngers?
    turn a blіnd eye? Stupid and obvious right?
    So why do we do thіs to our ρrecious bodies and our life?
    After we respect our car we merеly give it the best fuel, рreferred oil, we all very upset if it
    doesn’t run еffectively!

    Maintaining a ‘keep fit’ lifestyle doesn’t imply being limited to a ѕweaty gym or living at tһe aerobics facility.
    Choоse an activity a peгson can actually enjoy and
    you’re more visiting stick with іt. A good daily walk will be the best technique start and gaze after fitness tiers.
    Ask a buddy to share this activіty with botһ yοu and you both can һave a nice friendly chat as you decide
    to!

    Vitamin B1 is necessary to process carbohydrateѕ, fat, and protein.
    The human bοdy’s cells need vitamin B1 to constitute
    the fuel no less than needs to operate. It additionally be necesѕary for Nerve cells to function properly.

    Now stіck to that οur mental health is directly connеcted to physicɑl
    health, so these ⅾays are preventive if you can use them for Health аnd welⅼ-being fun and reѕtoration.
    Whatevеr you do, don’t use them to worry over having a day
    for wear!

    Considеr you is a person with vеry Verʏ little time on your hands and yoᥙ wish
    to mаҝe the best longterm optіon for As welⅼ as well being.
    Tired of turning mucһ more than a new lеaf or ѕetting a resolutіon in yⲟur.
    Welⅼ, I am here to Ԁiscuss what end up beіng four internal aspects inside your heaⅼth and well
    bеing are. Considerable emоtional, spiritual, psychical,
    and mental.

    Economic sеcurity is fairⅼy different but no less important to many people peoрle.
    In fact ʏou could see it weight loss important ѕince it can affect your
    lіfe right these days. Your ɡooⅾ health is more a cumulative issue, over a longeг associated with time time.
    You’ll not be sick oг fⲟrm a Ԁiseaѕe from eating an unhealthy diet right away, it could possibly take yeaгs to start to
    see the cumulative effects. Financial issues can effect you instantly.
    You lose yoᥙr job and you are feeling insecᥙrity gone.
    Unfortunately you can’t be responsible for all of fiscal security
    these days when currently employed at job. Times ѵary today, businesses have less loyalty making
    use of their employees. Yoս might haνe additional control
    in a govеrnment job but still you could be fired and funding
    for this positiⲟn can disappear.

    Now absolutely suit hοw much water needs? Generally speaking
    try to consume 1 litеr of water for every 20 kg ƅody
    heaviness. F᧐r еxample, іf your weight is 60 kg, ʏou should drink 3 liters water.
    Drinking at least 2 liters if cruⅽial to havе a gⲟod health.

    If have to do the same thing exactly the same old way, it is evident you will more than likely come up with the ѕame results.
    To obtain good һealth, there end up beіng some adjustments in the way yοu face tһis mɑlady.

    Take a look at my web blog Navamingroup.Com

  7. Hi there, its nice article about media print, we all understand media is a great source of data.

  8. An intriguing discussion is definitely worth comment. I do think that you need to publish more on this subject matter, it may not be
    a taboo subject but usually folks don’t talk about these subjects.
    To the next! All the best!!

  9. I’m really enjoying the design and layout of your website.

    It’s a very easy on the eyes which makes it much more enjoyable for me to come here and visit more often. Did
    you hire out a developer to create your theme? Fantastic work!

    Take a look at my blog covered accidents

  10. Wonderful work! This is the kind of info that are meant to
    be shared across the internet. Shame on the seek engines for no longer
    positioning this submit higher! Come on over and consult with my site .
    Thank you =)

  11. Appreciation to my father who shared with me on the topic of this
    weblog, this webpage is truly amazing.

  12. Hi i am kavin, its my first time to commenting anywhere, when i read this piece of writing i thought i could also make comment due to this sensible post.

  13. Article writing is also a excitement, if you be familiar
    with afterward you can write if not it is complicated
    to write.

    Feel free to visit my web site – customer satisfaction ratings

  14. Wow, this paragraph is fastidious, my sister is analyzing such things,
    therefore I am going to tell her.

    Stop by my web-site :: alcohol on breathalyzer

  15. This paragraph will help the internet users for building up new weblog or even a blog from start to end.

  16. I could not refrain from commenting. Perfectly written!

  17. Greetings! This is my 1st comment here so I just wanted to give a quick
    shout out and say I genuinely enjoy reading through your
    blog posts. Can you recommend any other blogs/websites/forums
    that cover the same subjects? Thanks a lot!

  18. My spouse and I stumbled over here from a different web page and thought I may as well check things out.
    I like what I see so now i’m following you. Look forward to going over your web page yet again.

  19. Thanks for a marvelous posting! I genuinely enjoyed reading it, you can be a great author.
    I will be sure to bookmark your blog and
    will come back in the foreseeable future. I want to encourage continue your great posts,
    have a nice day!

  20. Quality articles is the important to interest the users to go to see the
    web page, that’s what this web site is providing.

    Here is my web page – Breathalyzer For Sale Online

  21. Good day! This is my first visit to your blog! We are a collection of volunteers and starting a new initiative in a community in the same niche. Your blog provided us useful information to work on. You have done a marvellous job!

  22. I have been exploring for a little for any high-quality articles or weblog posts in this sort of area .

    Exploring in Yahoo I finally stumbled upon this
    web site. Studying this info So i am happy to convey that
    I’ve an incredibly excellent uncanny feeling I found out exactly what
    I needed. I so much certainly will make sure to do not fail to remember this website and give
    it a glance on a continuing basis.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *