কাজী নজরুল ইসলাম– কবি ও মানুষ
আমিনুল ইসলাম

[কবি হিসেবে তিনি কতো বড়ো, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা, তিনি তাঁর বিশিষ্টতায় সমুজ্জ্বল– তিনি একক ও অনন্য। সমসাময়িক কবিদের সঙ্গে তাঁর তুলনা তিনি অপ্রাসঙ্গিক করে দিয়েছেন, কারণ অন্যেরা যেখানে শুধুই কবি, তিনি সেখানে তাঁর সৃষ্টির চেয়েও মহত্তর এক ব্যক্তি, তিনি ইতিহাসের স্রষ্টা, এবং ইতিহাসের একপর্বের একজন নায়ক। সমকালকে এভাবে আলোড়িত অভিভূত আর কোনও কবি করেনি। (জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী)]
‘আমায় নহে গো ভালোবাসো শুধু ভালোবাসো মোর গান’ কাজী নজরুল ইসলামের এই বাণী তাঁর জীবদ্দশাতেই আংশিকভাবে ভুল প্রমাণিত হয়ে গিয়েছিল। তিনি তাঁর সৃষ্টি ব্যাপকভাবে সমাদৃত হওয়ার পাশাপাশি তরুণ বয়সেই বাঙালি জাতি কর্তৃক জাতীয় কবির সম্বর্ধনা লাভ করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি হয়েছেন বাঙালি জাতির একমাত্র স্বাধীন সার্বেভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের জাতীয় কবি। তিনি কোটি কোটি বাঙালির প্রিয় কবি-গীতিকার এবং ব্যক্তি। তাঁর কবিতা গান এবং অন্যান্য সৃষ্টি সমান জনপ্রিয়তার পঠিত ও উচ্চারিত হচ্ছে প্রতিদিন। বিবিসি পরিচালিত জরীপেও তিনি হাজার বছরের সকল বাঙালির মধ্যে ৩ নং স্থান অধিকার করেছেন।একশ্রেণীর উন্নাসিক বুদ্ধিজীবীর নজরুলবৈরিতা এবং মুখোশপরা নানাবিধ কায়েমী ষড়যন্ত্র নজরুলের জনপ্রিয়তাকে আটকিয়ে রাখতে পারেনি।
একজন সৃজনশীল ব্যক্তির প্রিয় হয়ে ওঠার পিছনে দুটি প্রধান কারণ কাজ করে থাকে। এক, তার সৃষ্টির সৌন্দর্য ও তাতে জীবনের নান্দনিক প্রতিচ্ছবির প্রতিফলন এবং সেসবের স্থায়িত্ব এবং দুই, ব্যক্তি হিসেবে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা । নজরুল যুগপৎভাবে দুটিরই অধিকারী।
কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাসাহিত্যে নবযুগের উদ্বোধক, নতুনবাণীর বার্তাবাহক, নতুন পথের সন্ধানদাতা, নতুন স্বাদ ও রুচির স্রষ্টা। তাঁর কলমেই বাংলা সাহিত্যে বিষয়-ভাবনায় আধুনিকতার সূত্রপাত, যৌবনের জয়গান রচনা, ভালোবাসার পূর্ণ মানবীয় রূপ উন্মোচন, যুদ্ধদৃশ্য-কবিতার প্রচলন, রাষ্ট্রীয় স্বাধীনাতা, নারী স্বাধীনতা, মানুষের অত্মিক স্বাধীনতা, গণমানুষের কল্যাণ ভাবনা, বিশ্বমানবতাবাদ, এবং সর্বধর্ম-সম্প্রীতির প্রবল পক্ষাবলম্ববন। তিনি কবিতায়-গানে নতুন যুগের সূচনা করেন। তিনি সাহিত্য-সংস্কৃতিতে যৌবন ও বীর্যবানতার প্রচলন করেন। তিনি চিরযৌবনের প্রতীক। তাঁর কলমে বাংলা ভাষা পেয়েছে (কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়)‘‘অরুগ্ণ-বলিষ্ঠ-হিংস্র-নগ্ন-বর্বরতায় অনবদ্য’’ প্রকাশক্ষমতা।
নজরুলের হাতে মানুষের ব্যক্তিত্বের ও অন্তর্নিহিত শক্তির পূর্ণ উদ্বোধন ঘটেছে সাহিত্যে। কবিতায়-প্রবন্ধে-সংগীতে তিনি যে-‘আমি’ কে উপস্থাপন করেন, সে হচ্ছে ‘বীর্যবান আমি’, ‘চিরবিজয়ী আমি’, ‘বিশাল আমি’। নজরুল তাঁর সৃষ্টিকর্মে মানুষের অপরিসীম শক্তিধর ও অশেষ সম্ভাবনাময় ব্যক্তিত্ব ও আমিত্বের শুভ উদ্বোধন ঘটান। নজরুলের ‘আমি’ শুধু ‘অসাম্প্রদায়িক’ নয়, তা হচ্ছে সর্বসাম্প্রদায়িক’, তাঁর আমি হচ্ছে ‘সর্বমানবিক’, ‘বিশ্বমানবিক’, ‘সর্বজাতীয়’, সর্বযুগীয়’ এবং ‘সর্বদেশীয়’। সে আমি ‘চিরউন্নতশির’। সে শির হিমালয় ছাড়িয়ে, খোদার আসন আরশ অতিক্রম করে বিশ্ববিধাতার চিরবিস্ময় হয়ে উঠেছে সবার ওপরে, সবকিছুর ঊর্ধ্বে। সে সর্বজয়ী। ঝড় ঝঞ্ঝা-খরা-সাইক্লোন-ঘূর্ণি-সাপ-হিংস্র পশু-মহামারী-বন্যা-দেবতা-অপদেবতা সবাইকে বশে আনার ক্ষমতা তার বাহুতে মেধাতে। সে পাতাল ফুঁড়ে নিচে নামতে পারে; তেমনি পারে আকাশ ফুটো করে আরশ পেরিয়ে যেত। তার ‘মুঠোয় পুরে’ বিশ্বলোক। সে ঘুমিয়ে থাকলেই রাত, সে জেগে উঠলেই প্রভাত। কোনো প্রাকৃতি বা অতিপ্রকৃতিক শক্তির ভয়ে সে ভীত নয়, সে কারো অধীন নয়। কারো চরণতলে সে মাথা নোয়ায় না; বরং তার মাথা দেখে মাথা নিচু করে প্রণতি জানায় হিমালয়। যে ভগবান বা কর্তৃপক্ষ অন্যায়কারী, তার বুকে তাৎক্ষণিক পদাঘাত করতে সে সুসক্ষম ও সুসাহসী। কোনো কায়েমী বিধিবিধান সে মানে না। সে কুর্নিশ করে শুধু তার মতো বলিষ্ঠ ও ঐশ্বর্যবান ‘আমি’-কেই, আর কাউকে নয়। ব্যক্তির সকল ভীরুতা দূর করে সে অকুতোভয়- অসীম সাহসী। সারা পৃথিবীতে আজকে যে আধুনিকতার জোয়ার এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের বিজয়–তার সর্বোত্তম কণ্ঠ নজরুলের কবিতা ও গান। আবার ‘‘নজরুলের আমি ইউরোপিয়ান ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের স্বার্থপর সংকীর্ণ আমি নয়; ব্যক্তিস্বাধীনতার নামে সে অবাধ আদিম জৈবিক প্রবৃত্তি, সীমাহীন ব্যক্তিগত ধনলিপ্সা কিংবা বিবেকহীন ক্ষমতালিপ্সার দাস নয়। তার যৌনক্ষুধা-খ্যাতির বাসনা-অর্থের প্রয়োজনবোধ সবই আছে বটে, কিন্তু সে এসবের কোনোটিরও সে গোলাম নয়। আবার সমাজতন্ত্রের শৃঙ্খলিতপ্রাণ বিকাশরুদ্ধপ্রাণীও নয় সে। সে সংসারবিমুখ প্রাচীন ভারতীয় সন্ন্যাসীর আমি নয়। তারও রয়েছে জৈবিক-মানসিক ক্ষুধা এবং উত্তম পন্থায় সে ক্ষুধা নিবারণে তার ইচ্ছা বা চেষ্টা। এই আমি ফ্রয়েডের জন্ম হতে মৃত্যু অবধি যৌনতার দাস আমিও নয়। তার যৌনক্ষুধা রয়েছে; তবে একই সাথে রয়েছে প্রেম-পিপাসাও। যৌনক্ষুধা তার সবকিছুর পরিচালন-শক্তি নয়। সামাজিক দায়বোধ এবং মানবিক বিবেচনা তার কর্মপ্রচেষ্টার পেছনে মূল চালিকা-শক্তি। সে অদৃষ্টবাদী আমি-এর বিপরীত আমি। অতিপ্রাকৃত শক্তির করণাভিখারী সে নয়; সে নয় প্রকৃতির খাময়োলীর হাতে পরাজিত অসহায় অস্তিত্ব। প্রকৃতির বহুবিধ শক্তিকে জয় করে সে মহাশক্তিধর। সে আপন-আলোকে আপনার সামনে উদ্ভাসিত মহাসম্ভাবনাময় এক আলোকিত সত্তা। সে নিজেকে চিনেই চিনে ফেলেছে কে তার প্রভু, কে তা নয়; কোন্ কোন্ শক্তিকে বশ মানিয়ে নিজের কাজে লাগানোর চাবি তার নিজের হাতে আর নিজবশে আনা যায় না এমন শক্তি প্রকৃতিতে কিংবা প্রকৃতির আড়ালে আদৌ আছে কি নেই। এই আমি সংকীর্ণ জাতীয়তাবোধে আক্রান্ত আমিও নয়- যে আমি অন্যজাতিকে ঘৃণা করে কিংবা তাদের দাবিয়ে রাখার মানসে তাদের ওপর সাম্রাজ্যবাদী শোষণ কিংবা যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়। সে অন্যায় যুদ্ধবিরোধী, সকল প্রকার লোভী আগ্রাসনের প্রতিরোধশক্তি। কিন্তু সে দেবতাও নয়; তারও রয়েছে মাটির মানুষের মনোদৈহিক চাহিদা, ক্লান্তশ্রান্ত হওয়ার মানবীয় সীমাবদ্ধতা। নজরুলের এই আমি কোনো ক্ষুদ্র কালখন্ডে বা ভূগোলে, কোনো পার্টিকুলার নৃতাত্ত্বিক জাতিসত্তায় বা ধর্মীয় বৃত্তে সীমায়িত আমিও নয়। নজরুলের আমি নিজের মধ্যে আত্মস্থ করেছে আন্তঃভৌগলিক পরিসর, ত্রিকালীয় মহাগভীরতা, বহু ধর্ম-পুরাণ-কিংবদন্তীর সংস্কৃতির উত্তরাধিকার এবং সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধবাজদের কবল হতে মুক্ত (নিঃক্ষত্রিয়) করে শোষণ-নিপীড়ন-বঞ্চনামুক্ত বিশ্ব গড়ে তোলার মহামানবীয়-সর্বমানবীয় সর্বজনীন অঙ্গীকার:“আমি বিশ্ব-তোরণে বৈজয়ন্তী, মানব-বিজয়-কেতন।” নজরুলের হাতে উদ্বোধিত ও উন্মোচিত ‘আমি’ বিচারবুদ্ধিপ্রাপ্ত শ্রেষ্ঠতম মানবগোষ্ঠীর আলোক-উদ্ভাসিত প্রতিনিধি।’’ (নজরুলের আমি: সৃষ্টির চূড়ায় মানব-বিজয়-কেতন/আমিনুল ইসলাম)। এই রক্তমাংসে গড়া মৃন্ময়-চিন্ময় আলোকিত বিশাল ‘আমি’ আধুনিক মানুষের পছন্দের সত্তা।
একজন আধুনিক মানুষের প্রিয় বিষয় হতে পারে আধুনিক মানুষ ও আধুনিক সৃষ্টি। যারা নজরুলকে ছোট করে দেখতে ভালোবাসেন, তারা যা-ই বলুক, এটাই সত্য যে বাংলা সাহিত্যে নজরুল আধুনিকতার সূচনা করেছেন এবং সে আধুনিকতাকে অনেকখানি প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। তার দেখানো পথ ধরেই বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার উৎকর্ষ সাধন। আধুনিকতা শুধু প্রকরণের বিষয় নয়। এটি মূলতঃ কাব্যভাবনার বিষয়। আধুনিকতা হচ্ছে মন ও মানসিকতার ব্যাপার, চিন্তা ও চেতনার ব্যাপার, বোধ ও বিবেচনার ব্যাপার। আধুনিকতা হচ্ছে নতুনকে স্বাগত জানানোর মন, মিথ্যা প্রমাণিত অতীতের দৃঢ়মূল ধারণা ও বিগত-সত্যকে পরিত্যাগ করার সাহস। বোধে ও মননে আন্তর্জাতিকতাকে গ্রহণ, সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা, অন্যায়-যুদ্ধবিরোধিতা, রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার অধিকার, ব্যক্তির ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের অশৃঙ্খলিত উন্মোচন, জনগণের ক্ষমতায়ন, লৈঙ্গিক সমতা, বিজ্ঞান-মনস্কতা, অতিপ্রাকৃত শক্তিতে অবিশ্বাস, ধর্ম-বর্ণ-জাত-পাত-উপগোষ্ঠীগত কৃত্রিম ব্যবধানে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন, জন্মের বদলে কর্মে মূল্যায়ন, যৌনতাকে প্রাণীর স্বাভাবিক চাহিদা হিসেবে গ্রহণ এবং কোদালকে কোদাল জ্ঞান করা–ইত্যাদি হচ্ছে আধুনিক জীবনের প্রধান অনুষঙ্গসমূহ। রোমান্টিকতা হচ্ছে কল্পনাসর্বস্ব আকাশচারিতা; আধুনিকতা হচ্ছে ভূমিলগ্নতা; রোমান্টিকতা বা অনাধুনিকতা হচ্ছে প্রথাবদ্ধতার নিকট আত্মসমর্পণ; আধুনিকতা হচ্ছে প্রথার অচলায়তন ভেঙে বের হয়ে আসা। আধুনিক হচ্ছে ভালো-মন্দে মিশ্রিত জীবনকে তার সমগ্রে গ্রহণ করার মানসিক প্রস্তুতি। নজরুলই প্রথম রোমান্টিক শুচিবায়ুগ্রস্ততাকে পরিহারপূর্বক বাংলা কবিতা-গানে-কথা-সাহিত্যে-অভিভাষণে রক্ত-মাংসের মানুষের মানসিক এবং শারীরিক চাহিদা কামনা-বাসনাকে গভীর ইতিবাচকতায় উপস্থাপন করেছেন; তিনি নারী-পুরুষের সমতার গান গেয়েছেন; তিনি জাতিভেদ প্রথাসহ সকল কুসংস্কার ও মানবসৃষ্ট অসাম্যের বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন শক্তহাতে। তিনি বারাঙ্গনা নারীকে মহত্বের উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। তিনি কবিতায় ও অভিভাষণে মানুষের রাষ্ট্রিক ও আত্মিক স্বাধীনতার কথা প্রথম উচ্চারণ করেছেন। তিনি সকল প্রকার কুসংস্কার ও অন্ধত্বের বিরুদ্ধে কবিতা-গান-অভিভাষণ রচনা করেছেন। নিয়তিবাদী মানুষকে তিনি দিয়েছেন আত্মনির্ভর প্রেরণা, বিশ্বাস ও সাহস। গৃহবধু-বারাঙ্গনা, পাপ-পুণ্য, সতী-অসতী প্রভৃতি প্রচলিত ধারণগুলো তিনি আধুনিক বোধের পক্ষে আমূল পাল্টে দিয়েছেন। তিনি বারাঙ্গনাদের জননী বলে সম্বোধন করেছেন এবং তারা অসতী-অশুচি এমন যুগ-পুরাতন ধারণাকে আধুনিক জীবনের অনুকূলে পাল্টে দিয়েছেন। তিনি সবার উপরে স্থান দিয়েছেন মানুষকে। যুগস্বীকৃত প্রথা ছিল– পতিতা নারীরা খারাপ। নজরুল সে প্রথায় আঘাত করে লিখেছেন ‘বারাঙ্গনা’ নামক মহৎ কবিতা যেখানে তিনি বারাঙ্গনাকে মেরী, অহল্যা, গঙ্গার মতো মহৎ ও নিস্পাপ জননী বলে আখ্যায়িত করেছেন। শুধু নারী হবে অসৎ অথচ পুরুষ নয়– এ ধারণা ভেঙে দিতে বলেছেন–
শুন ধর্মের চাঁই–
জারজ কামজ সন্তানে দেখি কোনো সে প্রভেদ নাই!
অসতী মাতার পুত্র যদি সে জারজপুত্র হয়
অসৎ পিতার সন্তানও তবে জারজ সুনিশ্চয়।
যুগ যুগ ধরে প্রথা ছিল এবং এখনো অনেকটা রয়ে গেছে– নিম্নবর্গের মানুষ বিশেষত হিন্দুধর্মে যাদের ঘৃণাভরে শুদ্র বলে আখ্যায়িত করা হয়, তারা নিম্নজাত এবং অস্পৃশ্য। নজরুল এই প্রথা ভেঙে দিতে লিখেছেন ‘শুদ্রের মাঝে জাগিছে রুদ্র’। তিনি শুদ্রের মধ্যে ভগবানকে দেখেছেন এবং প্রতিষ্ঠা করেছেন। ডোম মেথর কুলি কৃষক মজুর তাঁতী জেলে নাপিত কামার কুমোর মাঝি কুলি– এসকল তথাকথিত নিম্নশ্রেণীর মানুষ যে মানুষ হিসেবে নিম্নশ্রেণীর নয়, নিম্নজাতের নয়, বরং তারা ভগবানতুল্য পূজনীয়, নজরুল তার কবিতার গানে তা প্রতিষ্ঠত করেছেন। যে গয়না-অলংকারকে নারীজাতির ভূষণ বলে যুগ যুগ ধরে প্রশংসিত করে আসা হয়েছে, তা যে নারীর জন্য শিকল, তার বন্দিত্বের নির্দশন, নজরুলই সর্বপ্রথম তা কবিতা-গানে চিহ্নিত করে সেসব পরিহার করার জন্য নারীজাতিকে পরামর্শ ও প্রণোদনা দান করেছেন।
স্বর্ণ-রৌপ্য অলংকারের যক্ষপুরীতে নারী
করিল তোমায় বন্দিনী, বল, কোন্ সে অত্যাচারী?
আপনারে আজ প্রকাশের তব নাই সেই ব্যাকুলতা,
আজ তুমি ভীরু আড়ালে থাকিয়া নেপথ্যে কও কথা!
চোখে চোখে আজ চাহিতে পারো না, হাতে রুলি পায়ে মল
মাথার ঘোমটা, ছিঁড়ে ফেল নারী, ভেঙে ফেল ও শিকল!
যে-ঘোমটা তোমা করিয়াছে ভীরু ওড়াও সে আবরণ!
দূর করে দাস দাসীর চিহ্ন ঐ যত আভরণ!
প্রেম করা ‘পাপ’ অথবা ‘ব্যভিচার’ ইত্যাদি ধারণার মূলে কুঠারাঘাত করে তিনি লিখেছেন ‘জীবনে যাহারা বাঁচিল না’ ‘পাপ’ প্রভৃতি কবিতা। ‘পাপ’ কবিতায় নজরুলের ভাবনা আধুনিকতার শিখর স্পর্শ করেছে। তিনি এ কবিতায় বলেছেন যে– পৃথিবী তথাকথিত পাপেরই জায়গা ‘পাপস্থান’। তিনি বলেছেন ‘‘সাম্যের গান গাই/ যত পাপী তাপী সব মোর বোন, সব হয় মোর ভাই।’’ তিনি বলেছেন ‘‘বিশ্ব পাপস্থান/ অর্ধেক এর ভগবান, আর অর্ধেক শয়তান।’’ অধিকন্তু ‘‘পাপের পঙ্কে পূণ্য-পদ্ম ফুলে ফুলে হেথা পাপ।’’ তিনি এতটাই আধুনিক যে বলেছেন– মানুষ আত্মা ও দেহ নিয়ে পূর্ণসত্তা আর ‘‘পুণ্যে দিলেন আত্মা ও প্রাণ, পাপেরে দিলেন দেহ।’’ দেহ বাদ দিয়ে তো মানুষ হতে পারে না। অতএব পাপ ছাড়া মানুষ চলতে পারে না। তাই ‘‘সুন্দর বসুমতী/ চিরযৌবনা, দেবতা ইহার শিব নয়, কামরতি’’। এই আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি বাংলাসাহিত্যে নজরুলের আমদানী এবং তাঁর হাতেই এর চূড়ান্ত রূপ লাভ। প্রকাশ প্রকরণে সহজিয়া বটে, কিন্তু বিষয়ভানায় ও জীবনদর্শনে গভীরভাবে চির-আধুনিক।
নজরুল বাংলা কবিতা ও গানকে সকল মানুষের কবিতা-গানে রূপান্তরিত করেছেন। বাংলাসাহিত্য হয়ে উঠেছে গণমানুষের সাহিত্য, বাংলা গান হয়ে উঠেছে গণমানুষের গান। ‘‘বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রোমান্টিক কবিতাগান বাংলাসাহিত্যকে বিশ্বের দরবারে পরিচিত করে তোলে। সেসব কবিতাগান মূলত শিক্ষিত ভদ্রলোক বা কথিত বিদগ্ধ শ্রেণীর মানুষের জন্য রচিত। সমাজে তারা ক্ষমতায়-প্রতিপত্তিতে-জ্ঞানে-সামাজিক মর্যাদায় ওপরে, তবে সংখ্যার দিক হতে একেবারেই সংখ্যলঘিষ্ঠ। অন্যদিকে ব্যাপকভাবে সাধারণ অনভিজাত মানুষই বাংলার সুখদুঃখ-রূপরসের মূল আধার। রবীন্দ্রনাথ জীবনের পড়ন্তবেলায় আক্ষেপ করে বলেছিলেন যে সমাজের উঁচুতলায় তার আসন হওয়ায প্রতিদিনের জীবনযাপননের বেড়াগুলি তাঁকে সাধারণ মানুষের সাথে মিশতে দেয়নি। ‘ওদের সাথে মিলাও যারা চরায় তোমার ধেনু/ তোমার নামে বাজায় যারা বেণু’ বলে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করলেও শেষপর্যন্ত তাঁর পক্ষে তাদের সাথে মেলামেশা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। হয়ত তাই তিনি একজন ( বা একাধিক) কবির আবির্ভাব কামনা করেছিলেন যিনি হবেন সাধারণ মানুষের আপনজন; যার কবিতাগানে সমাজের নিচুতলায় খেটে- খাওয়ার মানুষের সুখদুঃখ-আবেগ-অনুভূতির ছবি ফুটে উঠবে। যে তাঁতী বসে তাঁত বোনে, যে কৃষাণ হাল দিয়ে জমিতে ফসল ফলায়, যারা উদয়াস্ত মাঠে পরিশ্রম করে, যাদের সম্মিলিত কর্মভারের উপর পা দিয়ে চলছে সমস্ত সংসার, সেই অখ্যাতজনদের কবি আসুক–. তাদের নির্বাক মনের বেদনা উদ্ধার করে গান গানে ফুটিয়ে তুলুক–এই ছিল রবীন্দ্রনাথের কামনা।
কৃষাণের জীবনের শরীক যে জন
কর্মে ও কথায় সত্য আত্মীয়তা করেছে অর্জন
যে আছে মাটির কাছাকাছি
সে কবির বাণী লাগি কান পেতে আছি।
…
এসো কবি অখ্যাতজনের
নির্বাক মনের
মর্মের বেদনা যত করিয়া উদ্ধার
প্রাণহীন এ দেশেতে গানহীন যেথা চারিধার
অবজ্ঞার তাপে শুষ্ক নিরানন্দ সেই মরুভূমি
রসে পূর্ণ করে দাও তুমি।
রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই সেই অখ্যাতজনদের কবিগীতিকারের আর্বিভাব ঘটে। সেই কবিগীতিকারের নাম কাজী নজরুল ইসলাম। উপন্যাস-কবিতা-গান-নাটকে উপেক্ষিত কৃষাণ-জেলে-কুলি-মজুর-নারীশ্রমিক-বেদে-বাউল-সাঁওতাল-পতিতা-হরিজন প্রভৃতি শ্রেণীর অখ্যাত উপেক্ষিত মানুষের জন্য কাজী নজরুল ইসালাম কলম ধরেন এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাঁর হাতে সোনার ফসল ফলে। অবজ্ঞার তাপে শুল্ক নিরানন্দ সেই মুরুভূমিকে তিনি রসে-মাধুর্যে পূর্ণ করে তোলেন। বাংলার লোকায়ত আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে জীবনঘনিষ্ঠ গানের সুরে সুরে। কৃষকের লাঙল, জেলের জাল, কামারের হাঁপর, ছাদপেটা নারীশ্রমিকের হাতুড়ি, বেদের বাঁশি, সাঁওতালের মাদল, বাউলের একতারা, কৃষাণ-বধূর কলস, রাখালের বাঁশি, বেদেনীর কলার মান্দাস, আদিবাসী নারীর ঝুমরা নাচ প্রভৃতি রাতারাতি গৌরবের আসন পেয়ে যায় বাংলা গানের ভুবনে। নবাব-জমিদারের বিলাসী জলসাঘর আর পণ্ডিতদের ড্রয়িংরুম থেকে বাংলাগান নেমে আসে ফসলের মাঠে, নদীর জলে, শ্রমিকের কারখানায়-কয়লাখনিতে, সাঁওতালনীর তালপুকুরে, বেদেনীর শালপাহাড়ে, বাউলের বটতলায়। লোকায়ত জীবনে শুরু হয় উচ্ছ্বল প্রাণরস আর ভাররসের জোয়ার। অবশ্য সে-সুর শিক্ষিত ভদ্রলোদের নাগরিক মনেও আনন্দের ঝড় তোলে। নজরুল হয়ে ওঠেন সর্বশ্রেণীর মানুষের কবি, সর্বশ্রেণীর মানুষর প্রাণের সঙ্গীত রচয়িতা, সুরস্রষ্টা। তখন বাঙালি মসুলমান সমাজ গান শুনতে ও গাইতে ভুলে গিয়েছিল। তারা গানকে অধর্মের কাজ মনে করতো। নজরুলের গানের জোয়ার পৌঁছে যায় তাদের শয়নঘরে,বৈঠকখানায়। আত্মজাগরণের স্রোতে ভেসে যায় তাদের সংগীতবিমুখতা।’’ (নজরুলের গানে অখ্যাতজন/ আমিনুল ইসলাম)। এ প্রসঙ্গে কবি জীবনানন্দ দাশের মূল্যায়ন গুরুত্বপূর্ণ:
‘‘বাংলার এ মাটির থেকে জেগে, এ মৃত্তিকাকে সত্যিই ভালোবেসে আমাদের দেশে উনিশ শতকের ইতিহাস প্রান্তিক শেষ নিঃসংশয়তাবাদী কবি নজরুল ইসলাম। তাঁর জনপ্রেম, দেশপ্রেম পূর্বোক্ত শতাব্দীর বৃহৎ ধারার সঙ্গে সত্যিই একাত্ম। পরবর্তী কবিরা এ সৌভাগ্য থেকে অনেকটা বঞ্চিত বলে আজ পর্যন্ত নজরুলকেই সত্যিকারের দেশ ও দেশীয়দের বন্ধু কবি বলে জনসাধারণ মেনে নেবে। জন ও জনতার বন্ধু ও দেশপ্রেমিক কবি নজরুল। এ জিনিসের বিশেষ তাৎপর্যের দিকে লক্ষ্য রেখে বলতে পারা যায় যে, যে সময়ে ও যেখানে জনমানস তার প্রার্থিত জিনিস পেয়েছে বলে মনে করে, সেখানে বাস্তবিকই তা অদ্বিতীয় ।’’
নজরুল ছিলেন সাধারণ আমজনতার একজন। তিনি উঁচুতলার বাসিন্দা ছিলেন না কোনোদিনও। কৃষক-জেলে-মজুর-শ্রমিক-তাঁতী-জোলা-নাপিত-কামার-কুমার-ফেরিওয়ালা-মাঝি–এই গণমানুষের মাঝে তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা। তাদের সুখ-দুঃখ ও আবেগ-অনুভূতি তাঁকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল। সেজন্যই নজরুলের কবিতা-গানে তাঁদের মুক্তির দিশা রয়েছে। তিনি গণমানুষের কবি, তিনি সম্মিলিত মানবজাতির বলিষ্ঠ কণ্ঠধর। তাঁর কিছু কবিতার চরণ স্মরণ করা যায়:
১.নারী পুরুষের সমতা ও নারী স্বাধীনতার অগ্রদূত কবি
সাম্যের গান গাই
আমার চক্ষে পুরুষ রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই।
বিশ্বের যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
…
সেদিন সুদূর নয়-
যেদিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীরও জয়।
ক. নারীজাগরণের অগ্নিমন্ত্র রচয়িতা কবি
মেলি শতদিকে শত লেলিহান বসনা
জাগো বহ্নিশিখা স্বাহা দিগ্ বসনা।
খ. কুলি-মজুর সর্বহারা শ্রেণীর কবি
দেখিনু সেদিন রেলেকুলি বলে এক বাবুসাব তারে ঠেলে দিল নিচে ফেলে।
চোখ ফেটে এল জল
এমনি করে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল!
আসিতেছে শুভদিন
দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা শুধিতে হইবে ঋণ।
গ. কৃষকের মুক্তির কবি
ওঠ্ রে চাষী জগদ্বাসী র্ধ কষে রাঙল!
ঘ. জেলেদের মুক্তির কবি
আমরা নিচে পড়ে রইব না আর
শোন্ রে ও ভাই জেলে
এবার উঠব সব ঠেলে।
ঙ. গণ মানুষের মুক্তির কবি ও মুখপাত্র
গাহি তাহাদের গান-
ধরণীর হাতে দিল যারা আনি ফসলের ফরমান।
শ্রম-কিণাঙ্ক কঠিন যাদের নির্দয় মুঠিতলে
ত্রস্তা ধরণী নজরানা দেয় ডালি ভরে ফুলে ফুলে।
বন্য- শ্বাপদ-সঙ্কুল জরা-মৃত্যু-ভীষণা ধরা
যাদের শাসনে হল সুন্দর কুসুমিতা মনোহারা।
চ. জনগণের শক্তির পক্ষের অর্থাৎ গণতন্ত্রের কবি
এ আশা মোদের দুরশাও নয়, সেদিন সুদূর নয়–
সমবেত রাজ-কণ্ঠে যেদিন শুনিব প্রজার জয়।
কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্বমানবতাবাদের সবচেয়ে বলিষ্ঠ কবি। তিনি কবি-সংগীতকার হিসেবে শিল্পে-সাহিত্যে-গানে-প্রবন্ধে সমগ্র মানবজাতির ঐক্যের অগ্রদূত। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বনাগরিক এবং কবিতা-গানে বিশ্বমানবতাবাদী কবি। তিনি এক অভিভাষণে বলেছেন “এই দেশে এই সমাজে জন্মেছি বলে শুধু এই দেশেরই এই সমাজেরই নই। আমি সকল দেশের সকল সমাজের। সুন্দরের ধ্যান, তাঁর স্তবগানই আমার উপাসনা আমার সাধনা। যে কূলে, যে সমাজে, যে ধর্মে, যে দেশেই জন্মগ্রহণ করি, সে আমার দৈব।আমি তাকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছি বলেই আমি কবি’’। আপন দেশ জাতি এবং একই সাথে বিশ্বমানুষের প্রতি এমন দায়বদ্ধ কবি পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত আর জন্মগ্রহণ করেননি। তিনি কবিতায় উদার মানবিকতাবাদ ও সর্বমানবতাবাদের জয়গান রচেছেন। তিনি হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-খৃস্টান-পারসিক-অগ্নিউপাসক-ইহুদি-নৃতাত্ত্বিক উপজাতি সকল মানুষকে একই মানুষ হিসেবে দেখেছেন এবং সবার মহামিলনের অভিন্ন মোহনা রচেছেন।
গাহি সাম্যের গান
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান,
যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম খ্রীশ্চান।
কে তুমি?– পার্সি? জৈন ? ইহুদী? সাঁওতাল ভীল, গারো?
কনফুসিয়াস? চার্বাক-চেলা? বলে যাও, বল আরো!
বন্ধু, যা খুশি হও,
পেটে-পিঠে কাঁধে-মগজে যা-খুশি পুঁথি ও কেতাব বও,
কোরান-পুরাণ-বেদ-বেদান্ত-বাইবলে-ত্রিপিটক-
জেন্দাবেস্তা-গ্রন্থ-সাহেব পড়ে যাও যত সখ,–
কিন্তু কেন এ পণ্ড শ্রম, মগজে হানিছ শূল?
দোকানে কেন এ দর কষাকষি? পথে ফোটে তাজা ফুল!
মিথ্যা শুনিনি ভাই
এই হৃদয়ের চেয়ে বড়ো কোনো মন্দির-কাবা নাই।
কাজী নজরুল ইসলাম সকল মানুষের স্বাধীনতার কবি। রাষ্ট্রিক বা আত্মিক পরাধীনতা তাঁর নয়। কোনো প্রকারের ‘বদ্ধঘরে’ তনি থাকতে চাননি এবং কেউ তাঁকে আবদ্ধ রাখতেও পারেনি। পরাধীন বৃটিশ-ভারতেও তিনি স্বাধীন মানুষ ছিলেন। তিনি মুক্ত প্রাণের কবি, মুক্ত চিন্তার কবি, মুক্ত বিশ্বের কবি। নজরুল সারা বিশ্বের সকল মানুষের স্বাধীনতার পক্ষের কবি, মুক্তির মুখপাত্র। তিনি তাঁর কবিতা-গানে-অভিভাষণে সকল মানুষের স্বাধীনতা মুক্তির পক্ষে কথা বলেছেন। এ স্বাধীনতা রাষ্ট্রিক–এ মুক্তি আত্মিক। তিনি সকল প্রকার সাম্রাজ্যবাদ, শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে, কুসংস্কার ও কুপ্রথার বিরুদ্ধে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রবল কবিকণ্ঠ। তিনি সকল প্রকার অন্যায় যুদ্ধের বিরোধী এবং সেজন্যই বিশ্বকে ‘নিঃক্ষত্রিয়’ করতে চেয়েছেন। তিনি অন্যায়কারী ‘ভগবান’দের বুকে পদচিহ্ন এঁকে দেয়ার সক্ষমতা ও সংকল্প ব্যক্ত করেছেন। আর পৃথিবীর বুক থেকে অত্যাচার, অন্যায়, অবিচার, শোষণ, নিপীড়ন চিরতরে শেষ না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চলিয়ে যাওয়ার দৃঢ় সংকল্প ঘোষণা করেছেন।
মহাবিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেইদিন হব শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না,
বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেইদিন হব শান্ত।
এতটা তেজদীপ্ত, অগ্নিগর্ভ ও প্রত্যয়-উদ্দীপক প্রতিবাদ পাবলো নেরুদা, নাজিম হিকমত, লোরকা, মাহমুদ দারবিশ কিংবা অন্যকোনো কবির কবিতায় ফুঠে ওঠেনি। কবি হিসেবে এখানে নজরুল বিশ্বসাহিত্যে অনন্য, একক ও অতুলনীয়। সারা পৃথিবী এখন যুদ্ধ ও আগ্রাসনে উৎপীড়িত ও পীড়িত; প্রবলের অত্যাচারে জর্জরিত, অতিষ্ঠ ও অসহায় দুর্বল। অথচ অন্যায়ের বিরুদ্ধে তেমন প্রবল কণ্ঠস্বর নেই। আমরা নজরুলকেই প্রতিবাদের কণ্ঠ হিসেবে ব্যবহার করতে পারি। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় বলেছেন :‘‘আমরা আগামী সংগ্রামে কবি নজরুলের সঙ্গীত কণ্ঠে ধারণ করিয়া শ্রীমান সুভাষের মতো তরুণ নেতাদের অনুসরণ করব। ফরাসী বিপ্লবের সময়কার কথা একখানি বইতে সেদিন পড়েছিলাম। তাহাতে লেখা দেখিলাম সে সময় প্রত্যেক মানুষ অতি মানুষে পরিণত হইয়াছিলেন। আমার বিশ্বাস, নজরুল ইসলামের কবিতাপাঠে আমাদের ভাবী বংশধরেরা এক একটি অতি মানুষে পরিণত হইবে।’’ সে পথ ধরেই আমাদের স্বাধীনতা-সংগ্রামে ও মুক্তিযুদ্ধে নজরুলের গান ও কবিতা ছিল অগ্নিমন্ত্র। কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা যথার্থতই বলেছেন:
“ ‘বাংলার জয় হোক’– এই নজরুলীয় আশাবাদকে জনতা জাতীয় স্লোগানে রূপান্তরিত করে সমুদ্র-নিনাদে উচ্চারণ করেছিলো: ‘জয় বাংলা’। তাই তো একাত্তরের বাঙালি বিজয়ী বাঙালি। আর বিজয়ী বাঙালি মানেই নজরুলের মন্ত্রে দীক্ষিত বাঙালি। নজরুল বাংলার জাতীয় কবি এই কারণেই নয় যে, তিনি বাংলার বা বাংলা ভাষার সবচেয়ে বড় কবি। বরং এই কারণেই যে বাঙালিকে ব্যক্তি ও জাতিগত পর্যায়ে আত্মশক্তিতে উদ্ধুদ্ধ করে চিরবিজয়ী বীর বাঙালিতে পরিণত করার দীক্ষা দিয়েছিলেন একমাত্র তিনিই, যিনি পরাধীন ভূ-ভারতে স্বয়ংশাসিত স্বাধীন নাগরিক। মানবিক, ব্যক্তিক ও সামষ্টিক পর্যায়ৈ সারা বিশ্বে মানবিক স্বাধীনতার এক শ্রেষ্ঠ ঘোষক কাজী নজরুল এভাবেই তাঁর স্বজাতিকে জাতিসত্তায় উন্মোচিত করে তাকে স্বয়ংশাসিত হওয়ার পথ দেখিছিলেন। তিনি স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা ও স্বাধীনতা যুদ্ধের আদি নকশার স্রষ্টা।”
বাঙালি জাতির একমাত্র স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে স্বীকৃত। আন্দোলন সংগ্রাম নেতৃত্ব প্রভৃতিতে সবার সামনে থেকে তিনি হাজার বছরের লাখো বছরের বাঙালি জাতিকে প্রথমবারের মতো একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অধিকারী হতে সফল ভূমিকা পালন করেন। কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়ন এখানে সবচেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক ও তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেছেন:
“নজরুল বাংলার বিদ্রোহী আত্মা ও বাঙালির স্বাধীন ঐতিহাসিক সত্তার রূপকার। বাংলার শেষ রাতের ঘনান্ধকারে নিশীথ নিশ্চিত নিদ্রায় বিপ্লবের রক্তনালীর মধ্যে বাংলার তরুণরা শুনেছে বিধাতার অট্টহাসি, কালভৈরবের ভয়াল গর্জন—নজরুলের জীবনে, কাব্যে, কন্ঠে। প্রচণ্ড সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের মত, লেলিহান অগ্নিশিখার মত, পরাধীন জাতীর তিমির ঘন অন্ধকারে বিশ্ববিধাতা নজরুলকে এক স্বতন্ত্র ছাঁচে গড়ে পাঠিয়েছিলেন এই ধরার ধুলায়। … সাম্রাজ্যবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে নজরুলের অগ্নিমন্ত্র বাঙালি চিত্তে জাগিয়েছিল মরণজয়ী প্রেরণা—আত্মশক্তিতে উদ্ধুদ্ধ হওয়ার সুকঠিন সংকল্প।”
শুধু বাংলা নয়, একইভাবে তিনি ভারতবর্ষের স্বাধীনতারও কাব্যিক মুখপাত্র। তাঁর আগে কোনো কবি-লেখক ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা এমনভাবে প্রবল কণ্ঠে এমন পরিস্কার ভাষায় দাবি করেননি; রাজনীতিবিদদের কেউ করেছিলেন বলেও আদ্যাবধি জানা যায়নি। কিন্তু শুধু ভারত বা বাংলাদেশ নয়, প্রতীকী অর্থে নজরুল সারা বিশ্বের সকল পরাধীন মানুষের আত্মিক-রাষ্ট্রিক-মানবিক স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্র উচ্চারণকারী কবি। ধর্ম-বর্ণ-জাতি-ভূগোল-যুগ নির্বিশেষে নিরপেক্ষ মন নিয়ে যদি বিবেচনা করা হয়– তবে এটা পরিস্কার যে অন্যায়-অত্যাচার-অসত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামে পৃথিবীব্যাপী অসংখ্য স্বাধীনতাকামী বীরমানুষ গড়ে তুলতে হলে আমাদের নজরুলের কবিতা-গান ও জীবনকেই সেধরনের মানুষ গড়ে তোলার অস্ত্র হিসেবে বেছে নিতে হবে।
শুধু গণ-আবেগ আর গণমুক্তির কবি বলেই নয়, তিনি প্রেম ও সমাজভাবনার প্রাতিস্বিক অনভূতির রূপকার কবি ও সংগীত রচয়িতা। নজরুলের কবিতা-গান মানুষের নিভৃত ব্যক্তিসত্তাকেও নিবিড়ভাবে স্পর্শ করে, তাকে ভাবায় ও দোলায়। তাঁর দারিদ্র, প্রেম ও প্রকৃতি ভাবনার কবিতাগুলো সূক্ষ্ণ নিবিড়তায় ছুঁয়ে যায় মানুষের ব্যক্তিমন ও মনন। তিনি তাঁর ‘দারিদ্র’ কবিতায় দারিদ্রের যে ভয়ংকর রূপ অর্থনৈতিক সূক্ষ্ণতায়, কাব্যিক চারুতায় ও অনুভূতির নিবিড়তায় তুলে ধরেছেন, তা কোনো অর্থনীতিবিদ বা সমাজবিদের গবেষণা-গ্রন্থে পাওয়া যাবে না। তিনি যখন বলেন– “পারি নাই বাছা মোর হে প্রিয় আমার/ দুই বিন্দু দুগ্ধ দিতে/ মোর অধিকার/আনন্দের মোহে নাহি/ দারিদ্র অসহ/পুত্র হয়ে জায়া হয়ে কাঁদে অহরহ/আমার দুয়ার ধরি।’’, তখন দুর্ভিক্ষ নিয়ে গবেষণাকারী অমর্ত্য সেনরাও পিছে পড়ে যান। আর যখন দারিদ্র কর্র্তৃক একজন সৃজনশীল মানুষের সৃজনশীলতা ও সৃজনশীলতার স্বপ্নকে কুরে কুরে খাওয়ার (রাষ্ট্রবিদ-সমাজবিদ-অর্থনীতিবিদের সিলেবাসের বাইরে থাকা) আড়ালের অন্তরঙ্গ চিত্র তুলে ধরে বলেন–“বেদনা হলুদ বৃন্ত কামনা আমার/শেফালির মত শুভ্র সুরভি বিথার/ বিকশি উঠিতে চাহে/তুমি হে নির্মম/ দল বৃন্ত কাটো শাখা কাঠুরিয়া সম/ আশ্বিনের প্রভাতের মত ছলছল/করে উঠে সারা হিয়া শিশির সজল/টলটল ধরণীর মত করুণায়/তুমি রবি, তব তাপে শুকাইয়া যায়/করুণা নিহারবিন্দু।’’, তখন বেদনায় ও বিস্ময়ে থমকে যায় মন। অনেক সৃজনশীল ও শুভবাদী স্বপ্ন ভেস্তে গেছে অর্থাভাবে। আজও যাচ্ছে। আজও ‘‘ভালে বেদনার টিকা’’ নিয়ে ‘‘কাঁটাকুঞ্জে বসে’’ অন্তরঙ্গ বেদনার মালা গাঁথে আরও কত লক্ষজন । তারা যদি নজরুলের ‘দারিদ্র’ কবিতাটি পাঠ করেন, দেখবেন কি গভীর নিবিড় অনুভব ও অন্তরঙ্গ অবলোকনের অধিকারী ছিলেন কবি ও ব্যক্তি নজরুল! আর সেসবের প্রকাশ ঘটেছে কত নান্দনিক সফলতায়!
পৃথিবীর যাবতীয় অন্যায়-অসুন্দরের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ব্যস্ত এই কবি কোনো ফাঁকে আসন্ন বসন্তসন্ধ্যার, শিশিরস্নাত শারদপ্রভাতের, দগ্ধ গ্রীষ্মদুপুরের, চৈতালী চাঁদনীরাতের অন্তরঙ্গ রূপ ব্যক্তিমানুষের প্রাতিস্বিক আনন্দ-বেদনার সঙ্গে একীভূত করে উপস্থাপন করেন নিবিড় সূক্ষ্ণতায়, সে উপস্থাপনায় মিশে যায় মানুষের ব্যক্তি-আবেগ। নজরুলের কবিতা মানুষের অন্তরঙ্গ উপলব্ধি ও বেদনাকে আরও বেশি নিবিড় করে তুলতে চেয়েছে।
ধরণী দিয়াছে তার
গাঢ় বদেনার
রাঙা মাটি-রাঙা ম্লান ধূসর আঁচলখানি
দিগন্তের কোলে কোলে টানি।
পাখি উড়ে যায় যেন মেঘ-লোক হতে
সন্ধ্যা-দীপ জ্বালা গৃহ-পানে ঘর-ডাকা পথে।
আকাশের অস্ত-বাতায়নে
অনন্তদিনের কোন্ বিরহিণী কনে
জ্বালাইয়া কনক-প্রদীপখানি
উদয়-পথের পানে যায় তার অশ্রু-চোখ হানি।
নজরুলের প্রেমভাবনা আধুনিক মানুষকে গভীরভাবে স্পর্শ করে, আলোড়িত করে। বাংলাসাহিত্যের ভরা রোমান্টিক যুগে নজরুলের আবির্ভাব। কিন্তু রোমান্টিক শুচিবায়ুগ্রস্ততা ও কল্পনাসর্বস্ব আকাশচারিতাকে তিনি এড়িয়ে আধুনিক জীবন-দর্শনকে গ্রহণ করেছিলেন। রোমান্টিকদের প্রেম-ভাবনা ছিল এই যে– একজন নর ও একজন নারীর মধ্যে প্রেম সর্বদায় পবিত্রশুচিতায় শুভ্র; সেখানে কামের স্থান নেই বললেই চলে। একজন আরেকজনকে শুধু ‘হৃদয়ে’ পেলেই চলে; সে যদি বাস্তবে তাকে ছেড়ে চলে যায়, বা হারিয়ে যায়, তবু একা হয়ে যাওয়া নর বা নারী নতুন করে আর কোনো নর বা নারীর প্রেমে পড়বেন না। কারণ তাতে করে প্রেমের অমর্যাদা হবে। কিন্তু বাস্তবতা এই যে মানুষ জীবনে একাধিকবার কিংবা বারবার প্রেমে পড়তে পারে, পড়ে থাকে। আর প্রেমে দেহজ কামনাবাসনা থাকবেই। কখনো কখনো সেটাই থাকে আড়ালের চালিকাশক্তি। শুধু ‘হৃদয়-নির্ভর’ দর্শনের ওপর বাস্তবের প্রেম প্রতিষ্ঠিত নয়। শুচিবায়ু প্রেমসম্পর্কিত রোমান্টিক ভন্ডামিকে উড়িয়ে দিয়ে নজরুল বলেছেন–
তোমারে দেহের তীরে পাবার দুরাশা
গ্রহ হতে গ্রহান্তরে লয়ে যায় মোরে।
বাসনার বিপুল আগ্রহে
জন্ম লভি লোকে– লোকান্তরে
উদ্বেলিত বুকে মোর অতৃপ্ত যৌবন-ক্ষুধা
উদগ্র কামনা,
জন্ম তাই লভি বারে বারে
না-পাওয়ার করি আরাধনা।..
যা-কিছু সুন্দর হেরি’ করেছি চুম্বন
যা-কিছু চুম্বন দিয়া করেছি সুন্দর–
সে সবার মাঝে যেন তব হরষণ
অনুভব করিয়াছি! ছুঁয়েছি অধর
তিলোত্তমা, তিলে তিলে!
প্রেম সম্পর্কে নজরুলের এই সত্যাপলব্ধি বাস্তবতার প্রাতিস্বিক অভিজ্ঞান। এই যুগান্তকারী উচ্চারণ একবিংশ শতাব্দীর উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকা এই আমাদের মুগ্ধ করে, বিস্মিত করে। আধুনিক মানুষ হিসেবে নর-নারীর ভালোবাসার চির-আধুনিক গভীর-নিবিড় কাব্যিক পাঠে ঋদ্ধ হয়ে ওঠে আমাদের কাব্যপ্রেমী ও প্রেমানুরাগী মন।
এবার ব্যক্তি-নজরুলকে একটু দেখে নেয়া যায়। তিনি কেমন ছিলেন? ব্যক্তি হিসেবে তিনি কি তাঁর সৃষ্টির মতো অসাম্প্রদায়িক ও গণমুখি ছিলেন? তিনি কি তার কবিতা গানের মতো উদার ও সর্বমানবতাবাদী ছিলেন? নিজ কবিতার মহত্ত্ব কি তিনি নিজ চরিত্রে ধারণ করেছেন? এসকল প্রশ্নের সবকটিরই উত্তর হচ্ছে হাঁ। তিনি হিন্দু নারী বিয়ে করে হিন্দু নারীর সাথে ঘর করেছেন। তাকে মুসলিম বানাননি। তিনির সকল ধর্মের মানুষকে ব্যক্তিজীবনে শ্রদ্ধা করেছেন।
‘‘নজরুল ধর্মের চেয়ে মানুষকে বড় করে দেখেছেন সব সময়,– তাই ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে নজরুলের ভালোবাসতে কারো বাধেনি। কতদিন আমাদের বাড়িতে গানের মজলিস বসেছে, খাওয়া করেছি আমরা একসঙ্গে, গোঁড়া বামুনের ঘরের বিধবা মা, নজরুলকে নিজের হাতে খেতে দিয়েছেন– নিজের হাতে বাসন মেজে ঘরে তুলেছেন, বলেছেন—‘’ ও তো আমার ছেলে,– ছেলে বড় না আচার বড়। ‘’ এই যে নজরুল আপনাকে সকলের মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর প্রাণের প্রাবল্যে, হৃদয়ের মাধুর্যে- এই তো মানুষের সবচেয়ে বড় ধর্ম —বড় আদর্শের কথা।‘’ (সাবিত্রী প্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়) ।
তিনি জেলে কামার কুমার তাঁতী কৃষক মাঝি মেথর ডোম সাঁওতাল সবার সাথে প্রাণ খুলে মিশেছেন- সবার সাথে একাত্ম হয়ে জীবন কাটিয়েছেন। তাঁর নিজের কথা:
“আমি উঁচু বেদীর উপর সোনার সিংহাসনে বসে কবিতা লিখিনি। যাদের মুক মনের কথাকে আমি ছন্দ দিতে চেয়েছি, মালকোচা মেরে সেই তলার মানুষের কাছে নেমে গেছি। দাদারে বলে দুবাহু মেলে তারা আমায় আলিঙ্গন দিয়েছেন। আমি তাদের পেয়েছি—তারা আমায় পেয়েছে।’’
তিনি পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন। বারবার জেল খেটেছেন। কিন্তু আপোষ করেননি। নারীদের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন। তিনি কৃষকের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন। তিনি পরাধীনতাবিরোধী, শোষণ-নিপীড়নবিরোধী এবং নারী-মুক্তির লক্ষ্যে আয়োজিত বিভিন্ন সভা-সমিতিতে যোগদান করে নিজকণ্ঠে অগ্নিঝরা গান গেয়ে–বক্তৃতা দিয়ে মুক্তির অগ্নীবীণা বাজিয়েছেন। তিনি সাধারণ মানুষের সাথে মিশে সাধারণ মানুষের হয়ে অসাধারণ জীবন যাপন করেছেন।
লোভ, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও ভয়ের কাছে বিকিয়ে যান কত প্রতিভা: ‘‘মগজ বিকিয়ে দিয়ে পরিতৃপ্ত পন্ডিতসমাজ।’’ ( সোনালি কাবিন / আল মাহমুদ)। কিন্তু নজরুলকে কোনও আর্থিক লোভ, পুরস্কারের হাতছানি, পদমার্যাদার মোহ কিংবা জেল-জুলুমের ভয় আদর্শচ্যুত করতে পারেনি। গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংয়ের সময় যখন বড়বড় কবি সাহিত্যেকরা সুচতুরভাবে চুপ থেকে সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে মৌনতা অবলম্বন করেছেন, তখন তিনি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ফিরিয়ে অনতে মাঠে নেমে কাজ করেছেন। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামাবিরোধী গান গেয়েছেন মহল্লার মহল্লায়।‘‘দুর্গম গিরি কান্তার-মরু দুস্তর পারাবার’’ কবিতা বা গান সেভাবেই সৃষ্টি হয়েছে। তিনি কৃষক-সম্মেলন, নারী-সম্মেলন, ছাত্র-সম্মেলনে সশরীরে শরীক হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ‘‘জীবনে জীবন যোগ করা/ না হলে বৃথা পণ্যে ব্যর্থ হয় গানের পশরা।’’ নজরুল জীবনে জীবন যোগ করেছেন, ‘‘কর্মে ও কথায় সত্য আত্মীয়তা’’ অর্জন করেছেন। তাঁর কবিতা গান-গল্প-অভিভাষণ মহৎ মানবতাবাদী সৃষ্টিকর্মের উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত । তিনি ব্যক্তি হিসেবে তাঁর সৃষ্টির চেয়েও মহৎ। তাঁর সৃষ্টিকর্মে ভুলত্রুটি আবিস্কার করা অসম্ভব নয়; কিন্তু ব্যক্তি নজরুল সকল লোভ- লালসা, ভয়-ভীতি ও সাম্প্রদায়িকতা-সংকীর্ণতার উর্ধ্বে ছিলেন। নজরুল পূর্ণ মানবতার প্রতীক পূর্ণ বাঙালিত্বের প্রতীক। রবীন্দ্রনাথের কবিতা ধার করে বলা যায়: ‘‘তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহৎ/তাই তব জীবনের রথ/পশ্চাতে ফেলিয়া যায় কীর্তিরে তোমার/বারম্বার।’’ তাঁর সম্পর্কে বিভিন্ন গুণীজনের অভিমত আকাশছোঁয়া।
ক.
ভূল হয়ে গেছে বিলকুল
আর সব কিছ ভাগ হয়ে গেছে
ভাগ হয়নিকো নজরুল।
এই ভুলটুকু বেঁচে থাক,
বাঙালি বলতে একজন আছে
দুর্গতি তার ঘুচে যাক।
(অন্নদাশংকর রায়)
খ.
খুঁজি না রাস্তার নামে
জানি নেই মর্মর মূর্তিতে
তুমি থাকবে, তুমি আছো
আমাদের নিত্য দুঃখ জয়ের সংগ্রামে।
(সুভাষ মুখোপাধ্যায়)
গ.
স্বাধীনতা তুমি
কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো
মহান পুরুষ, সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কাঁপা।
(শামসুর রাহমান)
নজরুল তাঁর শেষ অভিভাষণে কবি হিসেবে তাঁর চাওয়া-পাওয়ার কথা বলতে গিয়ে বলেছেন:
“হিন্দু-মুসলমানে দিন রাত হানাহানি, জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, মানুষের জীবনে একদিকে কঠোর দারিদ্র, ঋণ, অভাব, অন্যদিকে লোভী অসুরের যক্ষের ব্যাঙ্কে কোটি কোটি টাকা পাষাণ-স্তুপের মতো জমা হয়ে আছে- এই অসাম্য, এই ভেদজ্ঞান দূর করতেই আমি এসেছিলাম। আমার কাব্যে, সঙ্গীতে, কর্মজীবেন অভেদ-সুন্দর সাম্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম–অসুন্দরকে ক্ষমা করতে, অসুরকে সংহার করতে এসেছিলাম–আপনারা সাক্ষী আর সাক্ষী আমার পরম-সুন্দর।’’
আমরা অতীতের প্রেক্ষাপটে থেকে যদি বর্তমান বিশ্বের দিকে তাকাই তো দেখি– সারা পৃথিবী এখন নতুন করে এবং আরও বেশি প্রকটভাবে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, সাম্প্রদায়িক হানাহানি, দখলদারী যুদ্ধ এবং ভেদাভেদজনিত অবিচারের কবলে পড়েছে। ভারত উপমহাদেশে, মধ্যপ্রাচ্যে– কোথাও শান্তি নেই এতটুকু। বিশ্বে অতীতের চেয়েও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে পুঁজিবাদী শাসন ও শোষণ। নারী জাতিকে নতুন কৌশলে একপক্ষে কালো বোরকায় বন্দি এবং অন্যপক্ষে নগ্ন সেক্সপণ্যে পরিণত করার সুচতুর চেষ্টা চলছে। একদিকে সম্পদের পাহাড় ও আকাশছোঁয়া বিলাসিতা, অন্যদিকে কোটি কোটি মানুষের অনাহার, অর্ধাহার, অশিক্ষা, চিকিৎসাহীনতা ও আশ্রয়হীনতার সীমাহীন কষ্ট। এই প্রেক্ষাপটে যদি পৃথিবীর কোনো কবির সৃষ্টি ও জীবনকে সমস্যা সমাধানের মডেল হিসেবে বেছে নিতে হয়, সেটি হবে নজরুলের সৃষ্টি ও ব্যক্তিজীবন। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সুস্বপ্ন, স্বাধীনতা, সর্বজনীন মানবপ্রেম, ধর্মীয় সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা, নারী-পুরুষের মাঝে সৃষ্ট কৃত্রিম বৈষম্য দূরীকরণ, এবং সকল মানুষের মধ্যে উদারনৈতিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার কবি হিসেবে কথায ও কাজে, সৃষ্টিতে ও সাধনায়, আদর্শের বহিঃপ্রকাশে ও ব্যক্তিজীবনে অনুশীলনে– নজরুল এক ও অদ্বিতীয় । আর সম্ভবত সেজন্যই নতুন সাম্রাজ্যবাদীরা , একচেটিয়া মুনাফালোভী অর্থনৈতিক বেনিয়ারা, শিক্ষিত রাষ্ট্রীয় মৌলবাদীরা, শিক্ষিত পুরুষতন্ত্রবাদীরা, নিরুঙ্কুশ ভোগবাদী প্রগতিশীলেরা, ধর্ম-বর্ণ-জাতপাতভেদকারী কায়েমী স্বার্থান্ধ গোষ্ঠী নজরুলকে নানাভাবে দাবিয়ে রাখার এবং উপেক্ষা করার নানামুখি তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। সেসব কায়েমী স্বার্থান্ধ গোষ্ঠীর বিপরীতে যাদের নৈতিক, আদর্শিক ও আত্মিক অবস্থান, নজরুল তাদের প্রিয় কবি ও মানুষ।


আমিনুল ইসলাম
জন্ম : ১৯৬৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার টিকলীচর গ্রামে।
তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় হতে সমাজকর্ম বিষয়ে অনার্সসহ এমএ এবং নর্দান ইউনিভার্সিটি থেকে গভর্নেন্স স্টাডিজ বিষয়ে এমএস ডিগ্রী অর্জন করেন। চাকরিজীবনে তিনি ভারত, মালেশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, মায়ানমার, অস্ট্রেলিয়া, তুরস্ক প্রভৃতি দেশ ভ্রমণ করেছেন।
প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ
কবিতা
তন্ত্র থেকে দূরে : ২০০২ । মহানন্দা এক সোনালি নদীর নাম : ২০০৪ । শেষ হেমন্তের জোছনা : ২০০৮ । কুয়াশার বর্ণমালা : ২০০৯ । পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি : ২০১০ । স্বপ্নের হালখাতা : ২০১১ । প্রেমসমগ্র : ২০১১ । জলচিঠি নীলস্বপ্নের দুয়ার : ২০১২ । শরতের ট্রেন শ্রাবণের লাগেজ : ২০১৩ । কবিতাসমগ্র : ২০১৩ । জোছনার রাত বেদনার বেহালা : ২০১৪ । তোমার ভালোবাসা আমার সেভিংস অ্যাকউন্ট : ২০১৫ । প্রণয়ী নদীর কাছে : ২০১৬ । ভালোবাসার ভূগোলে : ২০১৭ । অভিবাসী ভালোবাসা : ২০১৮ । বাছাই কবিতা : ২০১৯ ।
ছড়া
১.দাদুর বাড়ি : ২০০৮
২. ফাগুন এলো শহরে : ২০১২
৩. রেলের গাড়ি লিচুর দেশ : ২০১৫
প্রবন্ধ
বিশ্বায়ন বাংলা কবিতা ও অন্যান্য প্রবন্ধ : ২০১০
সম্মাননা/পুরস্কার
রাজশাহী সাহিত্য পরিষদ সাংগঠনিক সম্মাননা : ২০০৪
বগুড়া লেখক চক্র স্বীকৃতি পুরস্কার : ২০১০
শিশুকবি রকি সাহিত্য পুরস্কার : ২০১১
নজরুল সংগীত শিল্পী পরিষদ সম্মাননা : ২০১৩
এবং মানুষ সাহিত্য পুরস্কার : ২০১৭
দাগ সাহিত্য পুরস্কার : ২০১৮

লেখকের আরও লেখা :
বীররসের শিল্প-সাহিত্য এবং চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান : আমিনুল ইসলাম
I’m really impressed with your writing skills as well as with the layout on your
blog. Is this a paid theme or did you modify it yourself?
Either way keep up the nice quality writing, it is rare to see a nice blog like this
one nowadays.
We stumbled over here from a different web address and thought I may as well check things out.
I like what I see so i am just following you. Look forward
to looking into your web page again.
my web page: Glasses With Round Face
http://buydrugsonline.top/# on line pharmacy with no prescriptions
on line pharmacy with no perscriptions: order medication online – safe online canadian pharmacy
biaxin 0.625mg
Ꮋi! Ƭhis isѕ kind of off topic but I need slme guidance fгom an established blog.
Is it hard to set uսp your own bⅼog? I’m not very techincal but I can figure things
out pretty fast. I’m tthinking about maҝing my own but I’m
not sure where to begin. Do you have any points or suggestions?
Cheers
mexican online pharmacies prescription drugs mexican pharmacy online mexico pharmacy
indian pharmacy online are drugs from canada safe online pharmacy for sale
top online pharmacy india: world pharmacy india – best online pharmacy india
pharmacy website india: buy medicines online in india – buy medicines online in india
Very shortly this website will be famous among all blogging
people, due to it’s fastidious articles
http://buydrugsonline.top/# cheap canadian cialis
What i do not understood is іn truth how you’re not really a lⲟt more well-appreciated than you
might be right now. Yoᥙ’re very intelligent.
You realize thus significantly with гegards to this subject, proԀuced me personally consider
it from a lot of variеd аngles. Its like women and men aren’t fascinated unless іt’s one thing
to do with Lady gaga! Your own stuffs nice.
At all times maintain it uρ!
my page – MyPrivateProxy promotional codes 2023
india pharmacy: world pharmacy india – top online pharmacy india
reputable indian online pharmacy: online pharmacy india – online pharmacy india
I savor, result in I discovered exactly what I was having a look for.
You’ve ended my 4 day lengthy hunt! God Bless you man. Have
a nice day. Bye
I must thank you coupon codes for Shifter.io the еfforts you’ve ⲣut in penning this website.
I’m hߋping to view the same hiɡh-grade content by you in the futսre
as well. In truth, your creative writing abilities has encouraged
me to get my very own blog noѡ 😉
Its like you read my mind! You seem to know so much about
this, like you wrote the book in it or something.
I think that you can do with some pics to drive the message home a little bit, but instead of that, this is magnificent
blog. A great read. I’ll definitely be back.
http://ordermedicationonline.pro/# reputable online pharmacy
recommended canadian pharmacies buy medicine online canadian online pharmacies legitimate
I just could not leave your web site prior to suggesting that I
extremely enjoyed the usual info a person provide on your visitors?
Is going to be again often in order to check out new posts
alın kırışıklığı için botoks fiyatları
I used to be able to find good info from your content.
Hmm it looks like your blog ate my first comment (it was extremely long) so I guess I’ll just sum it up what I wrote
and say, I’m thoroughly enjoying your blog.
I as well am an aspiring blog writer but
I’m still new to everything. Do you have any recommendations for rookie blog writers?
I’d genuinely appreciate it.
This design is wicked! You definitely know how to keep a reader entertained.
Between your wit and your videos, I was almost moved to start my own blog (well, almost…HaHa!) Fantastic job.
I really loved what you had to say, and more than that, how you presented it.
Too cool!
Also visit my web site Puff Wow
http://wellbutrin.rest/# wellbutrin 450 mg cost
As the admin of this website is working, no question very shortly it will be renowned, due
to its feature contents.
Feel free to visit my blog; https://Www.Localgirlsonline.Com/Local-Girls-In-New-Zealand.Php
ventolin tablet 2 mg: ventolin tablets 4mg – ventolin tablet
Hi, I wish for to subscribe for this website to obtain newest
updates, thus where can i do it please help out.
Here is my web page – 2 single parents dating
Hi there! Would you mind if I share your blog with my
myspace group? There’s a lot of people that I think would
really enjoy your content. Please let me know. Thanks
I think this is one of the most significant info for me.
And i’m glad reading your article. But want to remark on few general things, The website style is perfect, the articles
is really nice : D. Good job, cheers
Also visit my blog post … telegram中文语言包下载 (telcgrnm.org)
Hello, I enjoy reading through your post. I wanted to write a little comment to support you.
I?m not that much of a online reader to be honest but your sites really nice, keep it up!
I’ll go ahead and bookmark your website to come back
later on. Cheers
my homepage; Manage Toothache Pain – Formasis.Com,
http://wellbutrin.rest/# average cost of wellbutrin
buy cheap ventolin: ventolin albuterol inhaler – how to get ventolin over the counter
It’s really a cool and useful piece of information.
I am happy that you simply shared this useful information with us.
Please keep us informed like this. Thank you for sharing.
Hello, Neat post. There’s an issue together with your web
site in internet explorer, may check this? IE nonetheless
is the market chief and a good section of other folks
will pass over your fantastic writing due to this problem.
I visited multiple web sites however the audio quality for audio songs present at this web site is truly fabulous.
my web site … 사설토토사이트
Hello friends, how is all, and what you wish for to say regarding this paragraph, in my
view its actually amazing designed for me.
Whoa! This blog looks exactly like my old one!
It’s on a completely different subject but it has pretty
much the same page layout and design. Great choice of colors!
Oh my goodness! Impressive article dude! Many thanks, However
I am experiencing troubles with your RSS. I don’t understand why
I can’t subscribe to it. Is there anybody having similar RSS problems?
Anyone that knows the answer can you kindly respond? Thanks!!
Feel free to surf to my website; Medical payments
An impressive share! I have just forwarded this onto a coworker who was conducting a little homework on this.
And he in fact bought me breakfast due to the fact that I found it for him…
lol. So allow me to reword this…. Thanks for the meal!!
But yeah, thanx for spending the time to discuss this topic here on your site.
https://paxlovid.club/# Paxlovid buy online
can i buy neurontin over the counter: buy gabapentin – neurontin capsule 400 mg
Excellent blog here! Additionally your website quite a bit up fast!
What web host are you the use of? Can I get your affiliate link for your host?
I wish my site loaded up as quickly as yours lol
I used to be suggested this website via my cousin. I’m not certain whether this submit is written by him as nobody else
recognise such targeted approximately my trouble. You’re amazing!
Thank you!
https://colon-dotson.mdwrite.net/degil-hakkinda-gercekler-bilinen-aksam-namazi-kac-rekat-hangi-sureler-okunur
You have made the point.
Heya fantastic blog! Does running a blog similar to this take a large amount of work?
I have virtually no knowledge of programming but I had been hoping to
start my own blog soon. Anyway, should you have any recommendations or tips for new blog owners
please share. I understand this is off subject however I just needed to ask.
Appreciate it!
https://claritin.icu/# ventolin online usa
can i buy ventolin over the counter singapore: ventolin discount coupon – cheap ventolin online
voit tarkistaa täältä
Hello there! This blog post couldn’t be written much better!
Looking at this post reminds me of my previous roommate!
He constantly kept preaching about this. I’ll send this post to him.
Pretty sure he’s going to have a good read. Thank you for sharing!
Greate post. Keep writing such kind of info on your blog.
Im really impressed by your blog.
Hi there, You’ve done an excellent job. I will certainly digg it and personally recommend to my friends.
I’m sure they’ll be benefited from this site.
https://clomid.club/# can you buy clomid prices
buying generic clomid without dr prescription: Buy Clomid Shipped From Canada – how can i get cheap clomid no prescription
If you are going for finest contents like I do,
just pay a quick visit this website all the time because it offers quality
contents, thanks
I’ve been exploring for a bit for any high-quality articles or weblog posts iin this sort of area .
Exploring in Yahoo I eventually stumbled upon this
web site. Reading this information So i’m happy to convey that I have an incredibly good uncanny
feeling I came upon exactly hat I needed. I so much definitely wil make
certain to don?t put oout of your mind this website and provides itt a glance on a continuing basis.
Herre is my homepage :: Sohna Road call girls
Haliyle ne özellikleri kullanabiliyorum, (video indirme, reklamsız izleme) ne de üyeliği iptal ed…
Hello There. I found your weblog the usage of msn. This is an extremely well
written article. I will make sure to bookmark it and return to learn more
of your helpful info. Thank you for the post.
I will certainly comeback.
It is actually a great and useful piece of info.
I am glad that you simply shared this helpful information with us.
Please keep us up to date like this. Thanks for sharing.
my site; Alcohol breathalyzer for sale
http://clomid.club/# generic clomid
My developer is trying to persuade me to move to .net from PHP.
I have always disliked the idea because of the expenses.
But he’s tryiong none the less. I’ve been using WordPress on numerous websites for
about a year and am concerned about switching to another platform.
I have heard excellent things about blogengine.net. Is there a way I can import all my wordpress posts into it?
Any kind of help would be really appreciated!
Currently it sounds like Movable Type is the best blogging
platform available right now. (from what I’ve read) Is that what you are using
on your blog?
paxlovid pill: Buy Paxlovid privately – paxlovid generic
I love your blog.. very nice colors & theme. Did you design this website yourself or did you hire someone to do it for you?
Plz respond as I’m looking to construct my own blog and would like to know where u got this from.
thanks
I’m very pleased to find this site. I want to to thank you for ones time just
for this fantastic read!! I definitely really
liked every bit of it and I have you book marked to check out
new stuff in your web site.
my blog post Luigi
I’ve been browsing online more than 4 hours
today, yet I never found any interesting article like yours.
It is pretty worth enough for me. In my opinion, if all website owners and bloggers made good content as you did, the
internet will be much more useful than ever before.
Also visit my website: Low Cost Breathalyzer
Write more, thats all I have to say. Literally, it seems as though you relied on the video to make your point.
You definitely know what youre talking about, why waste your intelligence on just posting
videos to your site when you could be giving us something informative to read?
http://clomid.club/# can i get cheap clomid online
can i buy cheap clomid no prescription: Buy Clomid Online – can i get cheap clomid without rx
Awesome blog! Is your theme custom made or did you download it from somewhere?
A design like yours with a few simple tweeks would really
make my blog stand out. Please let me know where you got your design. Cheers
farmacia online piГ№ conveniente comprare avanafil senza ricetta farmacia online
http://avanafilit.icu/# farmaci senza ricetta elenco
Greetings from Carolina! I’m bored at work so I decided
to check out your site on my iphone during lunch break. I really like the knowledge you present here and
can’t wait to take a look when I get home. I’m surprised at how quick
your blog loaded on my phone .. I’m not even using WIFI, just 3G ..
Anyhow, superb blog!
farmacie online sicure: kamagra – farmacia online senza ricetta
Hi, I do believe this is an excellent site. I stumbledupon it
😉 I’m going to revisit yet again since I bookmarked it.
Money and freedom is the greatest way to change, may you be rich and continue to guide other people.
my blog: 사설토토
Hello just wanted to give you a quick heads up.
The words in your content seem to be running off the screen in Internet explorer.
I’m not sure if this is a formatting issue or something
to do with internet browser compatibility but I figured I’d
post to let you know. The style and design look great though!
Hope you get the issue solved soon. Many thanks
I got this web page from my friend who told me on the topic of this site and at
the moment this time I am browsing this web site and reading very informative content
here.
viagra acquisto in contrassegno in italia: viagra generico – alternativa al viagra senza ricetta in farmacia
farmacia online: Farmacie a milano che vendono cialis senza ricetta – migliori farmacie online 2023
acquisto farmaci con ricetta: avanafil – farmacia online
comprare farmaci online con ricetta avanafil prezzo acquisto farmaci con ricetta
https://avanafilit.icu/# acquisto farmaci con ricetta
farmacia online miglior prezzo: farmacia online miglior prezzo – farmaci senza ricetta elenco
comprare farmaci online con ricetta: avanafil prezzo in farmacia – acquistare farmaci senza ricetta
Good post. I learn something totally new and challenging on blogs
I stumbleupon every day. It will always be helpful to read through articles from other authors and use
something from other sites.
Also visit my web-site; SEO Services
comprare farmaci online con ricetta: avanafil spedra – farmaci senza ricetta elenco
many thanks lots this amazing site is actually official in addition to casual
farmaci senza ricetta elenco: farmacia online miglior prezzo – farmacie online affidabili
Hello, just wanted to tell you, I enjoyed this post.
It was inspiring. Keep on posting!
I just like the helpful information you provide to your articles.
I’ll bookmark your weblog and test once more right here frequently.
I am somewhat certain I will be told many new stuff right here!
Best of luck for the following!
farmacie online affidabili: farmacia online miglior prezzo – farmacia online senza ricetta
migliori farmacie online 2023 kamagra oral jelly п»їfarmacia online migliore
comprare farmaci online con ricetta: Avanafil farmaco – top farmacia online
https://tadalafilit.store/# migliori farmacie online 2023
Hmm is anyone else encountering problems with the images on this blog loading?
I’m trying to find out if its a problem on my end or if it’s the
blog. Any suggestions would be greatly appreciated.
comprare farmaci online con ricetta: farmacia online più conveniente – acquisto farmaci con ricetta
This is really interesting, You are a very skilled blogger.
I’ve joined your feed and look forward to seeking more of your excellent
post. Also, I’ve shared your site in my social networks!
https://bowen-toft.thoughtlanes.net/yaralanmali-trafik-kazasi-tazminat-zamanasimi-icin-adim-haritaya-gore-yeni-adim
Amazing lots of terrific advice.
Hurrah, that’s what I was looking for, what a material! existing here at this web site, thanks
admin of this web page.
pillole per erezione in farmacia senza ricetta: viagra generico – viagra generico prezzo più basso
viagra online in 2 giorni: viagra senza ricetta – viagra generico prezzo più basso
comprare farmaci online con ricetta: farmacia online miglior prezzo – farmaci senza ricetta elenco
さらにヒント
farmacie online affidabili avanafil generico farmacia online
farmacia online migliore: Farmacie a milano che vendono cialis senza ricetta – acquistare farmaci senza ricetta
farmacie online autorizzate elenco: Farmacie che vendono Cialis senza ricetta – comprare farmaci online con ricetta
I’m excited to find this great site. I want to to thank
you for your time for this wonderful read!! I definitely loved every little bit of it and i also have you saved to fav to check out new information on your web site.
farmacie online affidabili: avanafil generico – farmaci senza ricetta elenco
https://tadalafilit.store/# farmacie on line spedizione gratuita
Keep working ,terrific job!
farmacia online migliore: farmacia online spedizione gratuita – farmaci senza ricetta elenco
farmacia online senza ricetta: Farmacie a roma che vendono cialis senza ricetta – comprare farmaci online con ricetta