শিরোনাম হোক সাতক্ষীরা : জ্যোতি পোদ্দার

২৪ নভেম্বর ২০২৩

। কবি নুরুজ্জামান সাহেবের শুভম পঞ্চপঞ্চাশত্তম।

শিরোনাম হোক সাতক্ষীরা

জ্যোতি পোদ্দার

এক

তখন তো আর ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি ছিল না। ছিল— নিখাদ ফিজিক্যাল রিয়্যালিটি। গায়ে গা ঘেঁসে, গায়ে চিমটি কেটে পায়ের ওপর পা রেখে দেয়ালে হেলান দিয়ে গল্পে মশগুল হবার সত্যিকারের রিয়্যালিটি। তেমনই এক এ্যাকচুয়াল রিয়্যালিটির আড্ডায় সাহেবের নাম উঁকি দিলো একদিন। শুধু কি সাহেবের নাম? কখনো শুভ্র আহমেদ কখনো সৌহার্দ্য সিরাজ কখনো শিল্পী রাশেদ বা অগ্রজ কবি লিখিয়েদের নাম। আমার আর ফারহাদের অন্তহীন রাতের আড্ডায় নানা কথার ছলে একে একে উঠে আসত আস্ত সাতক্ষীরা!

দুই

সাতক্ষীরা দেখবার আমার জানালা ছিল ফরহাদ খান চৌধুরী। পরিমিত বোধের কবি ফরহাদ। ছোট ছোট বাক্যের ঠিক ঠিক উপাত্ত দিয়ে সাজানো বাক্যই ফরহাদ বলেন। হাল্কা-পাতলা-স্লিম বাক্যের ভেতর দিয়ে সাতক্ষীরা নিয়ে আমার জানাজানি। ফরহাদ শুধু পরিমিত বাক্যই বলেন না, চমৎকার হাসিও পরিমিত বোধে বেঁধে শব্দহীন হাসি হাসেন ফরহাদ। তা হাসুক, আমাদের আপত্তি নেই।

আমাদের সান্ধ্য আড্ডায় সাতক্ষীরার কবি ও কবিতা একটা জায়গা করে নিয়েছিল। ঈদের পর ছুটি শেষে ফরহাদ ঢাকায় ফিরলেই আমাদের সান্ধ্য আড্ডায় সাতক্ষীরা উছলে উঠত। ফরহাদের কাছে পেতাম সাতক্ষীরার গল্প যেমন তেমনি নানা কাগজ পত্র। সাহেবকে পড়া সেই আড্ডার সূত্রে নানা আলাপের বরাতে।

কখনো ক্ষীণকায় ‘প্রাণসায়র’, নদী, কিংবা ফরহাদ সম্পাদিত ‘লাবণ্যবতী’ অথবা ‘ব্যাঘ্রতট পরিক্রমণ’  বা পল্টু বাশারের কেয়ার অফে বের হওয়া ‘মৌয়াল’ এইসব কাগজ ফরহাদের বরাতে আমার পাওয়া। এখনো সময়ের দাপটে কী জানি কী কারণে রয়ে গেছে। ফরহাদ সেই সময়ে ফিজিক্যাল রিয়্যালিটির যুগে সাতক্ষীরা দেখতাম ফরহাদের আলাপের ভেতর দিয়ে।

তিন

আর আজকাল ভার্চুয়াল রিয়্যালিটিতে ‘অবারিত বাংলা’ জানালার ভেতর দিয়ে দেখছি কখনো বাঁকাল, বাবুলিয়া, দেবনগর, খেজুরডাঙী— সাতক্ষীরার নানা প্রান্ত নুরুজ্জামান সাহেবের ক্যামারার চোখ দিয়ে। পুঁজির দাপটে এই প্রান্ত একদিন হারিয়ে যাবে হয়তো। থেকে যাবে উকিলের দেখার চোখের ফটোগ্রাফগুলো।

২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে বইকন্ঠ থেকে বের হওয়া নুরুজ্জামান সাহেবের ‘তুমি ঘুড়ি তুমিই লাটাই’ ছড়ার বই আর আমার ‘দুই পৃথিবীর গ্যালারি’ কবিতার বই দুটি একসাথে উন্মোচিত হলো একটি পাঠাগারে— জাগ্রত সাতক্ষীরা সংগঠনের ব্যানারে। মাত্র ঘণ্টা খানেকের জন্য সাতক্ষীরায় ছিলাম। মন ভরেনি! শুধু সাহেবের সাথে নয়— আলাপ হলো ছড়াকার আহমেদ সাব্বির, কবি স ম  তুহিন, বাবলু ভঞ্জ চৌধুরী, কবি তনুশ্রী নাগসহ আরো কারো কারো সাথে। সবার নাম মনে নেই। মনে থাকার কথাও না। ঘন্টা খানেকের মধ্যে সাহেব আর ফরহাদ টিকেট সমেত ঢাকাগামী গাড়িতে তুলে দিলেন।

সাতক্ষীরা পাবলিক লাইব্রেরির সামনে আকাশ ছোঁয়া শহিদ মিনার। বাংলাদেশে খুব কম পাঠাগারই আছে যার সামনে এমন সুউচ্চ মিনার। শিল্পকলার সামনের দিকে বিশাল মাঠ। যদিও ঘাস নেই। পাশে বেশ বড়ো একটা শান বাঁধানো দীঘি। কালো জলে টলমল করছে। একপাশে মসজিদ। অন্য পাশে শিল্পকলা ভবন। সারিসারি গাছের ফাঁকে শিশুদের দোলনা, স্লিপার। বসার জায়গা। রেলিং বেয়ে ওঠা বেগুনি রঙের বাগান বিলাস। এখনো চোখ লেগে আছে। সেই পাঠাগারে বিকেলে বসেছিল যৌথতার আড্ডা দুই প্রকাশনের আলাপ নিয়ে।

দুই হাজার দুইয়ে প্রথম আসি সাতক্ষীরায় বিনেরপোতায় সুফিয়ান সজলের বাসায়। সজল আর আমি তখন বিবর্তনে নাট্য গোষ্ঠীর কর্মী। পথনাটক করে বেড়াই। আলাপের গিট্টুও বেশ শক্ত। সে বছর কোলকাতা বইমেলায় যাবার জন্য কাকডাঙ্গা বর্ডার রোডটি সজলই বাতলে দিয়েছিল। পাসপোর্ট ছাড়া দালাল আশুতোষ বল্লভের সাহ্যয্যে সীমান্ত পাড়ি দিয়েছিলাম। সে বছর আমাদের কাফেলার নাম দিয়েছিলাম— ‘কবিতার জন্য সীমান্ত পাড়ি’।

বিনেরপোতায় নেমেই খোঁজ করেছিলাম প্রাণসায়র আর লাবণ্যবতীকে। দুই নদীর নামপ দুই ছোট্ট কাগজ। ফরহাদের বরাতে পাওয়া। এমন ভারি সুন্দর প্রাণসায়রের ক্ষীণ সরলরেখার মতো ময়লা বোঝাই রেখা দেখে খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। আর যখন কুলিয়ায় যাই তখন লাবণ্যবতীর ব্রিজের ওপর অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি।

আর শহরের বুকচিরে প্রাণসায়র খালও ঘুরে ঘুরে দেখলাম। উনিশ শতকে জমিদার প্রাণনাথ খনন করেছিলেন জমিদার-প্রজা যুগে। প্রজা কল্যানার্থে। জমিদারি ইতিহাসের পাতায় আর প্রজা এখন নাগরিক। জলের নাব্যতা নেই। হেজে মজে গেছে। আর জলাশয় সংরক্ষণ ও তাকে কেন্দ্র করে জীবন জীবিকার বিস্তার নেই। এমন দৃশ্য প্রায় যে কোন পুরাতন শহরে দেখা যায়। সাতক্ষীরা তার ব্যতিক্রম নয়।

চার

যে কোনও উকিল সাবই মামলা-মকোদ্দমায় ঘটনার সুরতহাল খুঁজেন নিজের গরজে। মক্কেলের পক্ষ লড়াইয়ের জন্য নানা ধারায় নানা উপধারায় অথবা, উচ্চ আদালতের নানা পর্যবেক্ষণে। নুরুজ্জামান উকিলের ‘চোখ’ শুধু আইন ও তার  সাওয়ালের ভেতর  নয়— ‘চোখ’ আছে সমাজ, রাষ্ট্রের অথবা, নানা ব্যক্তি সম্পর্কের টানাপোড়েনের ভেতর। এই চোখ সাহেবের নিজস্ব চোখ। দেখাবার ও দেখানোর চোখ। নানা অসঙ্গতিকে উদোম করে দেবার চোখ। গোটা দুই বা, চার লাইনের ছড়া। আমি বলি— বুলেট ছড়া। যদিও বিস্তার নেই কিংবা সাহেব বিস্তারিত করতে চান না; বুলেটেই ছুঁড়ে দেন দাঁড়ি-চিহ্নের চেয়ে প্রশ্নবোধক অথবা আশ্চর্যবোধক চিহ্ন দিয়ে।
প্যাচাল-ক্যাচালের চেয়ে বরং পটাপট পড়ে ফেলি উকিল নুরুজ্জামান সাহেবের বুলেট ছড়া।

ক.
বলেছিল সে
‘দেখেছিস ফ্রেম’!
বুঝিনি আজও সেটা
হুমকি না প্রেম?

খ.
বৃথাই তুমি ভুগছো আরোগ্যে!
স্বাভাবিক মৃত্যু কি আছে ভাগ্যে?

গ.
পুর হস্তিনা! কারো দোস্তি না
মুনি-ঋষি গো টু দ্য হেল!
জীবিকার জলে উধাও মিনারেল!

ঘ.
দেশ ছেয়ে গেছে চামচায়!
বারে বারে কী যে খামচায়!

ঙ.
কি রে scene?
কে রো সি ন!!

চ.
ডাউন-আপে জোশ!
ব্রেক-আপে দোষ!!

কোথাও একটি কখনো দু’টি আশ্চর্যবোধক চিহ্ন নিয়েই ঘটিত তার ছড়া। এটা সাহেবের নিজস্বতা, সাহেবের অনন্যতা। তবে আফসোস এই যে, বুলেট বার্তা দিচ্ছে, ফটাস করে ফুটছে বটে তবে ডাঙ্গর হবার আগেই অকালে ঝরিয়া পড়িল— ঝরিয়া ঝরিয়া মরিয়া গেল। হয়তো এইটুকু যত্ন করিলে এই বুলেট ছড়া কী না হইতে পারিত! উকিল সা’ব সাওয়াল বেশিক্ষণ করেন না। করতে জানেন না তা নয়। উকিল সাহেব করতে চান না বলেই বন্দুকের ট্রিগার টিপে দেন বিচারকের উদ্দেশ্য। মানে পাঠকের দরবারে। পাঠকই ভাবুক পাঠকই রায় দিক। উকিল সা’ব যা করার করিয়া দিয়াছে।

পাঁচ

উকিল নুরুজ্জামান সাহেব শুধু গাউন গায়ে চড়ান না— তিনি ছড়াকার; তিনি শিক্ষক মহাশয়দের পরিচালক। ‘লাল সবুজের পাঠশালা’। কী চমৎকার তার বিদ্যাপীঠ। দেয়ালে লাল-সাদায় কতকিছু লেখা। সেই সাহেবের আজ পঞ্চান্ন। হাফ সেঞ্চুরি করে শতরানের দিকে এগুচ্ছে…। শতরান করে বল বাউণ্ডারির বাইরে ছুঁড়ে দিক এই প্রত্যাশাই করি।

শুভ জন্মদিন বন্ধু, শুভায়ণ হোক।

 

 

 

 

About Mangrove Sahitya

দেখে আসুন

প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায় : আমার বই পড়া

প্রণবকুমার  মুখোপাধ্যায় (২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৩৭- ২২ মে ২০২০) পঞ্চাশ দশকের যে কজন সাহিত্যিক বাংলা সাহিত্যকে …