কবিতা : মকবুল মাহফুজ

মকবুল মাহ্ফুজ নব্বই দশকের নিভৃতচারী অথচ স্বাতন্ত্র‍্য, শক্তিমান কবি। প্রতীকধর্মী স্মার্ট কবিতা রচনায় তিনি সিদ্ধহস্ত। তাঁর কবিতা সহজ কিন্তু সেখানে রয়েছে অতলান্ত দীঘির মত নিবিড় গভীরতা। প্রতিটি কবিতায় আছে নিটোল গল্প, অসাধারণ মেটাফর। ছন্দকে মান‍্য করে কত হৃদয়গ্রাহী কবিতা লেখা সম্ভব, মাহ্ফুজের কবিতা পাঠ করলে তার প্রমাণ মেলে। আমাদের সময়ে তাঁর কবিতা অন‍্যদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। প্রচারবিমুখ স্বভাবের কারণে তাঁর পরিচিতি কম। কিন্তু প্রকৃত বিচারে মকবুল মাহ্ফুজ আমাদের সাহিত‍্যের একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি হিশেবে বিবেচিত হবেন, এটা আমার একান্ত বিশ্বাস।
সাহিত‍্যের জন‍্য রাজধানী নয়, নিজেকে তৈরি করতে পারলে সুদূর পল্লীতে বসেও জিউসের পদধ্বনি শোনা যায়; এই কবি তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ
খসরু পারভেজ
কবি ও গবেষক

 

কবিতা
মকবুল মাহফুজ

জীবনানন্দদুপুর

ট্রামলাইনে লেপ্টে আছে জীবনানন্দদুপুর।

জীবন বাবু সেই যে কবে ছাই হয়ে গেছে
মনে নেই।

টিনেজ কুমারী তুমি
আসা – যাওয়ার পথেই অমল-ধবল কুমারীত্বে
মেখে নাও শুচি-শুভ্র রোদ।

দারুণ তোমার রোদ-চর্চা; বনলতা বনলতা ইহকাল।

দেখে এসো

আমিও বলেছিলাম যাও
নদী মরে যাচ্ছে দেখে এসো।

নদীকে দেখেছি ঘনঘন কফিতে চুমুক দিতে
বারোমাস সিগারেট টানতে
বুকের বাপাশে ব্যথা নিয়ে হাসতে-খেলতে।

একা একা ঝড়বৃষ্টিতে ভিজতে, প্রচণ্ড কাশিতে ভুগতে।

নদী তাকাচ্ছে না, খাচ্ছেও না
তবু কিছু হাতে করে নিয়ে যাও
তবে দুপুরের আগে ফিরো কিন্তু!

আর আসার সময়
ওষুধঘর থেকে দুটো ওলমেসান এনো
প্রেসার দারুণ ওঠানামা করছে রোজ।

আমিও আসুস্থ।

বিকেলের গল্প

পায়েস পায়েস সেই দিনের কথাই ভাবি–

সুস্বাদু বিকেলে সোনামুখি সূঁচে
পাহাড়ি গোলাপ তুলছিলে তুমি কামিজে।

কী ধৈর্য তোমার!

গন্ধ নিতে কেবল প্রজাপতিই নয়
আকাশও অনেকটা নেমে এসেছিল নিচে।

এখনও অতীত পড়ে নিতে পারি
ছানি পড়া চোখে।

আহা! শিল্পের সেই বিকেল ; সেই শিল্পীত কামিজ।

কঙ্কাল

জলের গভীরে জল নেই ; থৈ থৈ হাহাকার।

প্রবীণ শিকারী বড়শিতে গেঁথেছে সুস্বাদু আধার
তবু মাছ নয়, উঠে আসছে মাছের কঙ্কাল।

হেমিংওয়ে আরেক সাগরে আজ
তাঁর বড়শিতেও কঙ্কাল আর কঙ্কাল।

জলের কঙ্কাল, হাঙর-কুমীরের কঙ্কাল
লৌকিক-অলৌকিক কঙ্কাল সব।

অসুখ

পাথরার ট্রেন লাইন বরাবর
দলে দলে উড়ে যাচ্ছে প্রজাপতি।

শেখপুরার জারুল গাছটা অসুস্থ খুব
রক্তে ধরা পড়েছে ক্যান্সার
সফেদার বিচির মতন কালো হয়ে আছে মুখ।

বছর দুয়েক আগে ভুগেছিল সে যক্ষায়।

রান্নাঘরের ধোঁয়ার মতো উড়ে যাচ্ছে তার মুখের দুর্গন্ধ
তবু সে বাঁচতে চায়; ফুলকথা-ফুলভোর চায়
ছেলে-মেয়েদের সাথে হৈচৈ চায় সারাদিন।

বিষাক্ত ব্যাধি নিয়ে আমিও বসে আছি জানালায়
আমার বিষাদ বেয়ে বেয়ে নামছে নীল জল।

চুমু

সাদা-কালো সন্ধের মৌসুমে
বয়সী ইচ্ছেয় তাকে তুমি চুমু দিয়েছিলে।

দারুচিনিগন্ধীচুমু অনুবাদও করেছিলে
জন্মান্ধ অমাবস্যায়।

সেই থেকে বিশ্বের নানান দেশে, নানান ভাষায়
অনূদিত হচ্ছে চুমু।

ভাষান্তরিত সবুজ চুমু
হাত ধরাধরি করে পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছে প্রতিদিন।

সময়ের গোপন চুমুই এখন অনন্য অনুবাদ অনুষঙ্গ।

ইত্তেফাক

সকালের ইত্তেফাক হাঁটতে হাঁটতে
সন্ধেয় এসে পৌঁছোয় প্রত্যন্ত পাড়ার পাঠাগারে।

এলে তাকে পাশে বসতে দিই
তার পছন্দের চিনিছাড়া লাল চা খাওয়াই
চা-কফির ইতিহাস শুনি।

পায়ের জবজবে অবসাদ ঝরে গেলে তাকে খুলি
খবরের অনেক পেছনের খবরে ডুবে যাই।

আহা! ইত্তেফাক ইত্তেফাক ঘ্রাণে ম ম করে
আমাদের চর্যাঘর,সময়ের সবুজ অক্ষরবাগান।

ভিখেরি

দুপুরে ভিখেরি আসে দরজায়
ভিখেরি মানেই ক্রাচে ভর দিয়ে চলা হলুদ বয়সী
ছেলে এক।

উঠোনের রোদে শুয়ে আছে লক্ষ্মীলতা ধান
ধানের দিকেই হাভাতের চোখ
চোখের লোনায় ছুরির মতন চকচকে লোভ।

অতঃপর
একঝলক হাওয়া এসে
ধানকুমারীদের কানে কানে কী যেন বলে পালায়।

কী আশ্চর্য!
উঠোনে শুকোতেে দেয়া সিদ্ধ ধান
ভিখেরির হাঁ-করা থলের দিকে পায়ে পায়ে হেঁটে যায়।

সাপসংবাদ

সাপ্তাহিক বাজারের থলে থেকে বেরিয়ে পড়েছে
নীল সাপ।

অন্ধকারে বিজোড় চোখের অদ্ভুত সাপে খেয়েছে
সংসারের আলু – পটল – আনাজ
তেল – নুন – সুগন্ধী সাবান ; দাদিমার পানসুপারি সব।

চোখ বড়ো বড়ো করে তাকাচ্ছে
জিহ্বা বের করছে ঘন ঘন।

কেউটে নয়, ঢোঁড়া নয় ; ঘরচিতিও নয়
ওঝাবাড়ির মেয়ে তুমি তো
আপাদমস্তক এ হারামজাদাকে চিনবে নিশ্চয়।

ধারাপাত

চোখের কোটরে অন্ধ অমাবস্যা
রেললাইনের মতন দীর্ঘ রাত্রি।

আলোর দিকে পিঠ ফিরিয়ে হাতের আঙুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে
আমি ব্রেইল অক্ষরে নিই জীবনের পাঠ।

পাঠ করি দুঃখের দ্বিতীয় ভাগ ; বিষাদের ধারাপাত।

আমি আকাশ দেখিনি, চন্দ্র দেখিনি– সূর্য দেখিনি
নিজের ছায়া দেখিনি
ভেজা পায়ে হেঁটে যাওয়া কোনো রমণীর
সৌন্দর্য দেখিনি কোনোদিন।

আমি দেখিনি আমার সন্তানের ফর্সা মুখ
অন্য কেউ বেঁধে দেয় আমার শার্টের ছিঁড়ে যাওয়া
রঙিন বোতাম।

সকাল-বিকেল চিলেকোঠার কার্নিশে বসে
কাক ডাকে জোড়ায় জোড়ায়
আর আমি অন্ধত্বের কাছে ঋণী হতে থাকি।

মাঝে মাঝে ভাবি– অক্ষরে অক্ষর ঠুঁকি
সময়ের আরাধ্য আগুনে ছাই হয়ে যাক অন্ধত্ব অধ্যায়
বিষাক্ত সাদাছড়ি দিবস।

ছড়িতে ছড়িতে লেপ্টে থাকা পাপ।

This image has an empty alt attribute; its file name is 23579pppp-Copy.jpg

মকবুল মাহ্ফুজ

জন্ম ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দের ০১ অক্টোবর যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার কাঁকবান্ধাল গ্রামে। পিতা: মৃত এরশাদ আলী খান, মাতা: মৃত নূরজাহান বেগম।
দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর কবিতা, গল্প ও গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ।
শিক্ষকতা পেশায় তিনি জড়িত। যশোর-কেশবপুরের কানাইডাঙ্গা মাধ‍্যমিক বিদ‍্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক হিশেবে তিনি কর্মরত।
প্রকাশিত গ্রন্থ
কাব‍্য
দুঃসময়ের কাছাকাছি, মর্মপোড়া গন্ধ, আক্রান্ত আত্মার গান, দ্বিতীয় দহন, মধুময় মধুনাম হে, বেহুলাবৃত্তান্ত, কুকুরকাব‍্য, কলাপাতায় লেখা কবিতা।
গদ‍্য ও গবেষণা
বরেণ‍্য বিদ‍্যাসাগর, বাঙালির কবি শামসুর রাহমান, অপ্রতিদ্বন্দ্বী মাইকেল মধুসূদন দত্ত, তিষ্ঠ ক্ষণকাল, হাজী মুহম্মদ মহসীন।
শিশুতোষ রচনা
ছোটোদের জীবনানন্দ, ছড়ায় ছড়ায় মনোজ বসু।
সম্পাদনা গ্রন্থ: মধুসূদন পরিচয়, ফুটি যেন স্মৃতিজলে ( যৌথ )।
তাঁর সম্পাদিত পত্রিকা
সড়ক, কপোতাক্ষ, সাধিতে মনের সাধ ও আরণ‍্যক। মধুসূদন স্মরণবার্ষিকী ‘মধুকর’ স্মরণিকার সম্পাদনা পরিষদের সঙ্গে যুক্ত।
তাঁর প্রাপ্ত পুরস্কার ও সম্মাননার মধ‍্যে ধীরাজ ভট্টাচার্য স্মৃতি পুরস্কার, বিবেকানন্দ পদক, মাইকেল মধুসূদন পদক, কাদামাটি সাহিত‍্য পদক উল্লেখযোগ্য।
মকবুল মাহফুজ কবি সংগঠন ‘পোয়েট ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ’ এর প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারি, মধুসূদন স্মারক সংস্থা ‘মধুসূদন একাডেমী’ এর উপরিচালক। নিজ গ্রামে গড়ে তুলেছেন ‘জীবনানন্দ গ্রন্থাগার’ এবং ‘কেশবপুর লেখক-সৃষ্টি সংগ্রহ-কেন্দ্র’।

 

About Mangrove Sahitya

দেখে আসুন

কবিতা । শিশির আজম

কবিতা শিশির আজম মুক্ত মানুষের কেচ্ছা বসে থাকা ছাড়া কোন কাজ নেই দেখছি গনগনে দুধের …

7 কমেন্টস

  1. Yesterday, while I was at work, my sister stole my iphone and tested to see if it can survive a thirty foot drop, just so she can be a youtube sensation. My iPad is now broken and she has 83 views. I know this is completely off topic but I had to share it with someone!

  2. I do not even know how I ended up here, but I thought this post was great. I don’t know who you are, but definitely you’re going to be a famous blogger if you aren’t already 😉 Cheers!

  3. Somebody essentially lend a hand to make significantly articles I’d state. That is the very first time I frequented your website page and up to now? I surprised with the research you made to make this actual submit amazing. Wonderful task!

  4. My spouse and I absolutely love your blog and find a lot of your post’s to be exactly what I’m looking for. Do you offer guest writers to write content to suit your needs? I wouldn’t mind composing a post or elaborating on some of the subjects you write about here. Again, awesome web log!

  5. I want to to thank you for this wonderful read!! I certainly enjoyed every little bit of it. I’ve got you book marked to check out new stuff you post

  6. What’s up, always i used to check website posts here early in the dawn, since i like to gain knowledge of more and more.

  7. Good day very nice web site!! Guy .. Beautiful .. Superb .. I will bookmark your blog and take the feeds also? I am satisfied to seek out so many useful information here in the publish, we need develop more strategies in this regard, thank you for sharing. . . . . .

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *