কবিতা : গৌতম গুহরায়

গৌতম গুহরায়

বসন্ত

চৈত্র কি শেষ হয়ে এলো, আঙুলে আঙুলে তেঁতে ওঠা বাতাস
একজন ফস করে বলেই ফেললেন, ‘বসন্ত’
ব্যাস, মুখর মুখে ফাগ ও ফাগুনের সেই পুরোনো গল্প !
একটা দেওয়ালের এদিক ওদিক, রঙ মাখা জলের খেলা

সেই কি হাসি আমাদের, হাতে হাতে ডানা মেলা দুপুরের আলো,
একজন বললেন : ‘কাল সকালে খাসির মাংস ও এক পাইট
আরো একজন বলেন, : বিকালে রবীন্দ্রসঙ্গীত ও কাজু সরবত’ ।

ধুর, এসব কিছুই নয়, আসলে গরম ধুলোয়
সর্বনাশের ভাইরাস ভেসে আসে, মাথা চুলকায়, এই সময়
ক্ষুধা খুব সংক্রামক, আত্মহন্তারক হয় ।
একটাই রঙ শুষে নেয় রোদ, বসন্ত আবীর

কালবৈশাখীর তীব্র ভাঙ্গনেও ঋজু ছিলো যে বটবৃক্ষ
উপড়ে নিয়েছে তাকে যে প্রশস্থ সড়ক, ছায়াহীন
ক্রমশঃ তীব্র তাপে জেগে ওঠে আদি ও অকৃত্রিম
হত্যাপ্রবণ, সেলেব্রেটি রক্তের রঙ, বসন্ত নীল

This image has an empty alt attribute; its file name is ttttt888-1024x200.jpg

ছায়া ছবি

পাতা ঝরার শব্দের ভেতর একটা আলাদা গন্ধ থাকে, যেমন
পান্তা ভাত বা বাতাবি লেবু মেখে তাতে কাচা লঙ্কা ডলে দিলে হয় ।
শব্দ বা গন্ধ দেখা যায় না, কিন্তু পাতাদের ঝরে পরা দেখি
চোখ ও চোখের গভীরে ঝরতে থাকে
নানা আকারের ও রঙের পাতা ।
লক্ষ করে দেখেছি এরা কেউ সবুজ নয়,
যেমন আঁকা ছিলো বটতলা বা কুঞ্জবিহারির ছবিতে ।
বাবুই পাখির ঝুলে থাকা বাসার চারদিকে নেমে আসা দীর্ঘ ও সবুজ পাতা,
এ তো ঘরেরই আশ্রয় ।
অথচ, আমার মনে ও স্মৃতিতে যে পাতাগুলো ঝরছে
তাদের কোনো রঙ নাই । শুধু শব্দ এবং গন্ধ

মৃত পাতাদের ঝরে যাওয়া ক্ষত নিয়ে আভূমি বিস্তৃত বৃক্ষনাথ,
অন্ধকার ঘন হয়ে এলে স্ফুলিঙ্গে দাঊ দাঊ জ্বলে ওঠে অরন্যও,
সবশেষে দু একটি ভেজা পাতা আর ভষ্ম পরে থাকে
সর্বাংগে তার পোড়া ক্ষত, সর্বাংগ জুড়ে তীব্র আঁশটে গন্ধ
রণরক্ত প্রতিহিংসা পুড়তে থাকে পাতাদের কালো দীর্ঘশ্বাসে ।

পাথরের নক্ষত্রসভায় সবুজ আলোয় ঘন হয়ে বসে
গাছের আভূমি বিস্তৃত ছায়া ও মৃত পাতার অখণ্ড ছবি

This image has an empty alt attribute; its file name is ttttt888-1024x200.jpg

হাততালি

ঐ তালি দিতে দিতে নেমে আসছে একটি হাত
ঐ তো, সাদা হাত, রক্তশূন্য,
নিবিড় আলিঙ্গনে জড়াতে চাইছে ঊষ্ণ কপাল
নখের গভীরে লুকিয়ে থাকা ঘাম ও রক্ত, ধাপে ধাপে নামছে সে
দোতরার ছেড়া তারের থেকে, ইজেলের ছেঁড়া ক্যানভাস থেকে
ডাংগুলি ছক্কার উল্লাসে নেচে ওঠা ঐ হাত ।

কিশোরীর মেহেন্দি আঁকা হাত নেমে আসছে
এক অলৌকিক পিয়ানোর দিকে,
মাংস রিড তার টিং টং করে বেজে ওঠে, কেঁপে ওঠে দেওয়াল
ঝম ঝম করে ভেঙে পরে জমে থেকে দীর্ঘকালের নৈঃশব্দ ।
আমার সাদা হাত, রক্তশূন্য, আঙুল
নীলনবঘন স্বরলিপির দিকে চলে যায়

ঐ হাত জানালা দিয়ে ডেকে আনে বন্ধুর ভয়, শত্রুর হিংসা,
দু-হাতে খেলতে থাকে জিঘাংসার নীল বল ।
নির্দেশ অমান্য করার দায়ে
সদর দরজা দিয়ে ছুড়ে ফেলে সে প্রভুভক্ত মাছিদের ।
বুড়ো আঙ্গুলের দাপুটে ছাপ ধাপে ধাপে নেমে আসে,
দখল করে গল্পডাইনির রাত, সিঙ্ঘাসনের ছায়া

একটি হাত আর একটি হাতের দিকে এগিয়ে দেয় মুঠোভর্তি নুন
একটি মুষ্টিবদ্ধ হাত ভয়ানক ভাবে গুড়িয়ে দেয় অন্যজনের চেয়ালের হাড়,
একটি কলম ধরা হাত তখন সহস্র মুখে কথা বলে
একটি তর্জনি লংমার্চ হয়ে ওঠে,
অজস্র হাতের দাপটে ভেঙ্গে পরে নিখুঁত আকাশ

This image has an empty alt attribute; its file name is ttttt888-1024x200.jpg

বন্দরের কবিতা

এই রহস্য বন্দরে ব্রহ্মভোরে কাচের বোতল ভেসে আসে, ভেতরে থাকে সাদা চিরকূট ।
নাবিকেরা গোটা রাত, সেই চিরকূটের জন্য ওৎ পেতে বসে থাকে
তাদের চার পাসে জমে থাকা অন্ধকার ।
লোকশিক্ষা বলে ঐ চিরকূটেই রয়েছে নাবিকদের প্রাণ ভোমরা,
সেখানে লেখা থাকে কবে জ্যোৎস্না উঠবে, জোয়ার আসবে কবে ।
এই রহস্যময় ধাতব জেটিতে বসে থাকতে থাকতেই
ফুরিয়ে যায় এক পক্ষ আয়ুষ্কাল । এরা জানতো না
বন্দরের বাইরেও গ্রাম ও শহর আছে, মাটি বা নদী

এই কুয়াশাচ্ছন্ন বন্দরে পিতৃপক্ষের আজানের তৃতীয় প্রহরে
ডুবেছিলো তাদের ময়ুরপঙ্খি নাও । আদতে সেটি নিছকই ভ্রান্তি বিলাস,
প্রকৃতই কি এই বন্দরে কোনো জ্যোৎস্না রাত এসেছিলো ?
জোয়ার এসেছিলো কোন রাতে

নীতিকথার সেই তিনটি বাঁদরের মতো
চোখ বন্ধ করে, মুখ বন্ধ করে, কান বন্ধ করে
নাবিকেরা প্রতিক্ষায় বসে থাকে, কখন আদি অনন্তের নোনা জলে আসবে
সেই অলৌকিক বোতল । তার বুকের চিরকূটে লেখা থাকবে
একদিন জ্যোৎস্নার আলোতে জোয়ারের ঢেউ তাদের নিয়ে যাবে
সেই স্বপ্নের দ্বীপে । ছুঁয়ে ফে্লবে দীর্ঘ আলো মিশ্রিত জ্যোৎস্নার বন্দর,
এই ভাবেই বোতলে বোতলে ভেসে যায় মন্ত্রপূত ভোর

This image has an empty alt attribute; its file name is ttttt888-1024x200.jpg

কান্না

শরীর ছড়াতে ছড়াতে গাছেরাও মা হয়ে যায়
মায়েরা ক্রমগত ঝুরি নামাতে নামাতে একদিন প্রকৃতি হয়ে গেলে
ধূপ জ্বালিয়ে, শাঁখ বাজিয়ে বরণ করিনি সেই মহেন্দ্রক্ষণে ।
আজীবন ব্যাথতুর শেকড়ের কাছে মাটির প্রদীপ, টোটেম পুতুল রেখেছি
নামে নামে রেখে দিয়েছি কৃষি ক্ষেত্র, ফন্দিফিকির করে
গন্ডি এঁকেছি ঘরে ও বাইরে, কখনও
রূপালী শিশির দুহাতে মেখে তোমাকে স্পর্শ করিনি আগে

আদি-অন্ত দাড়িয়ে যাওয়া ওই মহাবৃক্ষ,
সহজাত প্রকৃত মূল নিখোজ
পোড়া মাটির বাদামী খোলস ছেড়ে এসে দাঁড়ায় বিষাদগ্রস্ত শোক,
এক জোড়া সবুজ চোখ, গোল চাঁদের মত কপালের টিপ
পিঠ জুড়ে কালো মেঘের মতো চুল ।

কোথাও বেজে ওঠে শঙ্খ ধ্বনি
যেন এই সন্ধ্যায় দুহাতে শাঁখ তুলে নিয়েছে, মা আমার
এই বৃষ্টি মায়াময়, উন্মাদ মাদলের দ্রিমি দ্রিমি
মরালের মতো পেঁচিয়ে ধরেছে,
মর্মর করে ভাঙছে মাটির দেওয়াল, ফেলে রাখা খোলশ
গুঁড়ো গুঁড়ো স্নেহ এসে জলেভেজা শীতল দেহ ঢেকে দিচ্ছে ।
চারদিকে ক্রমশ আরো আরো ঘন হয়ে আসছে এই মহাবৃক্ষের ঝুরি ।
মাতৃ স্নেহের মায়াপথে দাঁড়িয়ে এক আবহমান প্রদীপ
ছড়িয়ে দেয় আলো ও তাপ ।

This image has an empty alt attribute; its file name is ttttt888-1024x200.jpg

মেয়েকে লেখা কবিতা

সকালের হাল্কা আলোর মধ্যে, চায়ের গন্ধ লাগা ধোঁয়ায়, কলিংবেল বেজে ওঠার
পরের নিস্তব্ধতা বা বাথরুমে শাওয়ারের ঝমঝম শব্দের মধ্যে
গান গেয়ে ওঠে আমাদের মেয়ে, এভাবে যেখানেই ক্ষণিক ফাঁক দেখে
গান ভরে দেয় তাতে । গানে গানে ভরে যায় আমাদের দু-কামরার ঘর,
বাতাসে কেঁপে ওঠা পর্দা, সমুদ্র শঙ্খের ফুটো, বাসনকোসনের ঝমঝম
সবকিছুতেই তার গানের বিক্রমী রাগ

আমাদের মেয়ের গলার সাতটি সুরে কেঁপে ওঠে শো-কেসের কাঁচ
দাদাঠাকুরের ছবি, তটস্থ আমাদের সাত দরজার বাসা

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, সোফার কোনে, রুদ্ধদ্বার স্নানঘরে, ছাঁদের ঈশান কোণে
সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি তে মাখামখি বাতাস
আমাদের কোনো কথাই পাত্তা দেয় না আর

গান আর কথার মাঝে, ঘুম আর জাগরণের মাঝে
অনেকটা ফাঁক থাকে, আমাদের একমাত্র মেয়ে সেখানে
চুপ করে বসে আরো এক গানের তালিম নেয়

আমি বুঝি, নৈঃশব্দের ভেতর ক্রমশঃ ফুটতে থাকে এক অলৌকিক ফুল,
তার সৌরভে রহস্যমধুর কাঁপতে থাকে তার ভ্রু-পল্লব
একটা অলৌকিক জাহাজের বিউগলে সে শুনতে পায়
আরো এক সুর ডানা মেলে ভেসে আসহে, স্বপ্নের ঢেউ
মাথা ছুঁয়ে উঠে যায়, আবার ভেঙে পরে পায়ে আসে তার

তিন কামরার এই বাসাটাকে মেয়ে আমাদের
একটা সামুদ্রিক ঢেউয়ের মাথায় ভাসিয়ে দেয়,
সূর্যোদয়ের আলো মিশে যায় সূর্যাস্তের কোলে ।

This image has an empty alt attribute; its file name is ttttt888-1024x200.jpg

ট্রাডিশান -১

প্রত্যেকের মনেই একটা লুকোনো ট্রাডিশান থাকে,
মনে মনে সে যখন বুলবুলি, ময়না বা হরিদাশের বুলবুল ভাজার কথা ভাবে,
তখন সেই ট্রাডিশান তাকে জানায় :
তার বংশের পুরুষেরা ঋতবান হলেই ছাঁদে গিয়ে পায়রা ওড়ায়,
মেয়েরা পাখিদের উড়ে যাওয়া কক্ষপথে শুনতে পায় সম্মোহিত শঙ্খধ্বনি
এবং এই বাড়িতে কোনোদিন আর এস্রাজ বাজবে না ।
পাঁচ পুরুষ আগে গানে গানে আত্মঘাতী হয়েছিলো এ বাড়ির ছোটকুমার ।
সাপের ছোবলে মৃত বা মহল্লার বাইরে,
ঈশান কোনের নিমগাছটা ঝুলে থাকা পূর্বপুরুষের মৃত্যু কথা বহন করে ।
ক্রমশঃ যে গল্প ট্রাডিশান হয়ে যায় প্রত্যেকেই,
প্রতিটি ট্রাডিশনের ভেতর থাকে চাপা হরিধ্বনি ।

ট্রাডিশান- ২

মরে যাওয়ার পরের কোনো কথা হয় না,
তারা সবাই মৃত্যু আগের কথা বলে,
বলে কিট দংশন বা পথ দূর্ঘটনার কথা, সবাই মেনে নেন
ট্রাডিশানে জড়িয়ে মরাটাই অহংকারের ।
অভিজাত মৃত্যুর মধ্যেই সেই সুগন্ধ, পাখির মাংসের ভোজ,
ফিনফিনে পাঞ্জাবি ও হেতাল দণ্ডের গর্বিত মুষ্ঠি,
এই সবকিছুই মৃত্যুর আগের ছবি ।

আমার ঝুলকালি মাখা চোখ মুখ ক্রমশঃ হারিয়ে ফেলে
মনের ভেতর জমিয়ে রাখা ট্রাডিশানের বহুবিধ স্কেচ
অথচ, যেদিন তোমরা পেন্সিল হাতে দিলে :
সেইদিন আমি শুধু শূন্যটাই আঁকতে পারছি ।

শূন্যই ভূত ও ভবিষ্যতের প্রকৃত ও একমাত্র ট্রাডিশান ।

কবিতা নির্বাচন : সাকিরা পারভীন সুমা

This image has an empty alt attribute; its file name is MANGROVE.jpg

গৌতম গুহরায়

২৩ জানুয়ারি ১৯৬৪, জলপাইগুড়ি, উত্তর পশ্চিমবঙ্গ, ভারত ।
আদি ভূমি, বিক্রমপুর, মালখানগর

কবিতা
সাপ স্বপ্ন সহবাস
দাহ্য বৃষ্টির কবিতা
রেখা তামাংএর ঝর্ণা
কুয়াশা উড়ন্ত ঝাপি
নির্বাচিত কবিতা
৫আংগুলে উড়ন্ত মেঘ

প্রবন্ধ৷ / গদ্য
আশা স্বপ্নের ছাই ভষ্ম
স্বপ্ন পরিব্রাজকেরা
ভাষা : তর্ক বিতর্ক
ভাষা : সংবেদন নির্মান
গিরীশ কার্নাড

অনুবাদ
রাবো
গুন্টারগ্রাস
মায়াকোভস্কি

সম্পাদিত লিটল ম্যাগাজিন
দ্যোতনা

About S M Tuhin

দেখে আসুন

কবিতা । শিশির আজম

কবিতা শিশির আজম মুক্ত মানুষের কেচ্ছা বসে থাকা ছাড়া কোন কাজ নেই দেখছি গনগনে দুধের …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *