উপন্যাসের পৃথিবী : অমর মিত্র । পর্ব-এক

This image has an empty alt attribute; its file name is 872.jpg

কথাসাহিত্যিক অমর মিত্র । বাংলাদেশের সাতক্ষীরায়, ১৯৫১ সালের ৩০ আগস্ট জন্ম । থাকেন ইন্দ্র বিশ্বাস রোড, কলকাতায় । অসংখ্য দ্যুতিময় ছোটোগল্প আর উপন্যাসের লেখক তিনি। মেলার দিকে ঘর নামক গল্প দিয়ে তার লেখক জীবনের শুরু। প্রথম গল্পের বিষয় ‘ক্ষুধা’ । ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত হয়।

সমাজের নিম্নবর্গীয় লোকেরা দিনে দিনে আরও পতনের দিকে যাচ্ছে, আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছে বিত্তশালী ব্যক্তিরা । এরকম সমাজ বাস্তবতা নিয়েই তিনি লিখতে শুরু করলেন। তাঁর মতে, ‘আমার মতো করে এই পৃথিবীটাকে দেখতে পাচ্ছে কে? আমি বরং লিখেই যাই। আমি বরং আমার ক্ষুদ্র ক্ষমতাটুকু ব্যবহার করে চাষিবাসী বিপন্ন মানুষের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করি।’ লিখেছেন দু’হাত ভরে। গল্প। উপন্যাস। প্রথম উপন্যাস নদীর মানুষ, রচনাকাল- ১৯৭৮। এই বছরই বের হয় মাঠ ভাঙে কালপুরুষ। প্রথম গল্প সংকলন। স্বদেশযাত্রা নামক ছোটগল্পের জন্য ১৯৯৮ সালে পেয়েছেন সর্বভারতীয় কথা পুরষ্কার। তাঁর অনেক গল্পই মঞ্চে অভিনীত হয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা হলো- পিঙ্কি বুলি, দামিনী হেপাসিং শো নামের আরও একটি প্রযোজনা মঞ্চস্থ হয় ২০১৫ সালের নভেম্বরে। ১৯৯৯ সালে লেখেন অশ্বচরিত। এই উপন্যাসখানি ২০০১ সালে বঙ্কিম পুরস্কার লাভ করে। ২০০৬ সালে পেয়েছেন সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার, ধ্রুবপুত্র উপন্যাসের জন্য। ২০১৪ সালে দেশভাগ আর কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবন নিয়ে লিখেছেন উপন্যাস দশমী দিবসে। লিখেছেন ছিটমহলের বেদনা নিয়ে উপন্যাস কুমারী মেঘের দেশ চাই

নদী, দেশভাগ, সীমান্ত আর ছিটমহলকে প্রধান বিষয় করে না-ফেনানো গদ্যে জীবন এঁকেছেন সাবলীল। সেই সাবলীল স্রোতে আমরা ভাসতে চাই, ভালোবাসতে চাই নিরন্তর–

উপন্যাসের পৃথিবী । পর্ব-এক
অমর মিত্র

আরম্ভে কেন এখনো আমি খাঁটি সাহিত্য পত্রের নিয়মিত লেখক। তার ভিতরে ছিল আর রয়েছে বারোমাস, পরিচয়, অনুষ্টুপ, অনীক। এখন শুধু অনুষ্টুপ পত্রিকায় লেখা হয়। বারোমাস বন্ধ হয়ে গেছে। পরিচয় বা অনীকে লেখা হয়ে ওঠে না। ক’বছর আগেও লিখেছি। হ্যাঁ, এর সঙ্গে আছে কিছু বাণিজ্যিক পত্রিকা। বর্তমান, আজকাল, প্রতিদিন সংবাদপত্রে আমি লিখি। যিনি সমাদর করে লিখতে বলেন , আমি লিখি। আমি একই সঙ্গে শারদীয় অনীক ও বর্তমান, আনন্দবাজারে লিখেছি। আমার কোনো অসুবিধে হয়নি। শারদীয় ‘এই সময়’ পত্রিকার গল্প পড়ে সম্পূর্ণ বামপন্থায় বিশ্বাসী অনীক সম্পাদক দীপঙ্কর চক্রবর্তী আমাকে ফোনে বলেছিলেন, গল্পটি তুমি অনীকে দিতে পারতে। অনীকের গল্প এইটি। আবার অনীকে লিখেছিলাম প্রাণবায়ু নামের যে গল্প, সেই গল্প পড়ে অনীকের পাঠকদের একটা অংশ খুব নিন্দা করেছিলেন যৌনতার ব্যবহারে। কেউ কেউ বলেছিলেন, আনন্দবাজারের গল্প ঐটি। আমি এখনো বলতে পারি আমি যে লেখা লিখতে পারি সেই লেখাই লিখতে চেষ্টা করি, কাগজ হিসেব করে লিখি না।

আমি আমার জীবনের অনেকটা সময় জলে দিয়েছি সরকারী চাকরিতে। এদেশে লেখাকে বৃত্তি হিসেবে নিয়েছিলেন, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, সমরেশ বসু। এর ভিতরে মানিকের অবর্ণনীয় দারিদ্রের কথা আমরা জানি। তাঁর বেদনাদায়ক অকাল প্রয়াণের কথা আমি জানি। জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীও কম দারিদ্রের ভিতর দিয়ে জীবন অতিবাহিত করেননি। কেউ একজন লেখক আমাকে বলেছিলেন, খালি পেটে লেখা হয় না। তাই জীবিকার কথা ভাবতে হয়েছিল প্রথম থেকে। কিন্তু অনেক ক্ষমতাধরের চাকরি করিনি। হ্যাঁ, সে এলেমও ছিল না বলেই মনে হয়। জানতাম লিখে যদি আনন্দ পাই, তাহলে চাকরির ঝামেলায় গিয়ে লাভ কী? আমার স্ত্রী মিতালি আমার সব মেনে নিয়েছেন। সাধারণ জীবন যাপনে তাঁর কোনো ক্ষোভ দেখিনি। আমি যে চাকরি করেছি তা আমার লেখায় সাহায্য করেছে। আমি ক্ষমতাকে ভয় করি। ক্ষমতা অন্ধকার বিবরবাসী সাপের মতো বিষ ধারণ করে। তাতে লেখা নষ্ট হয়। কেন না সাহিত্য তো চিরকাল তাদের কথা বলেছে যারা ক্ষমতাহীন। সাহিত্য চিরকাল দুবর্লের নিরূপায়তার কথা বলেছে। ক্ষমতার অলিন্দে প্রবেশ করে দুবর্লের কথা অনুভব করা কঠিন। ঠিক এই কারণেই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ক্ষমতায় গিয়ে বদলে যান। ক্ষমতা সৃজনশীলতাকে নষ্ট করে। উপন্যাস ধ্রুবপুত্রতে এই কথাই চলে এসেছে।

আমার চাকরি, বদলি, দূর গঞ্জে একা থাকা, নিঃসঙ্গতা—সব পেয়েছি আমার ওই জলে যাওয়া সময় থেকে। একবার দেবেশ রায়কে বলেছিলাম, সারাটাদিন কী ভাবে নষ্ট হয়ে যায়, যদি লিখতে পারতাম, জানলার ধারে বসে ভাবতে পারতাম ফেলে আসা সময়কে, যদি ইচ্ছে মতো বেরিয়ে পড়া যেত, জীবনটাকে অন্যভাবে দেখা যেত। তিনি বলেছিলেন, সত্যি, সারাটা দিন যদি ওতে যায়, লিখবে কী করে? কিন্তু একটা বড় সত্য আমি দেখতে পেরেছি তো দেশটাকে। ক্ষমতাহীন মানুষকে দেখেছি তো গ্রামে-গঞ্জে। দেখেছি অসামান্য প্রকৃতি,তার একটা চাপ ছিলই মনের ভিতরে। প্রকৃতিই লিখিয়ে নিয়েছে অনেক লেখা। নিঃসঙ্গবাস আমার কল্পনাকে বিস্তৃত করতে পেরেছে। মনে পড়ে সেই শালতোড়ার কথা। ছোট ছোট পাহাড়, বিলীয়মান শাল মহুয়া পিয়ালের বন, অভ্র চিকচিক দিগন্ত বিস্তৃত টাঁড় জমি, প্রায় অচ্ছুৎ বাউরি পাড়া, পাহাড়গোড়ায় নিঃঝুম জলাশয়, মাঠ পেরিয়ে দূরে কোথায় একটি মধ্যবয়সীর চলে যাওয়া। আমি একটি দৃশ্য থেকেই একটি গল্প লিখেছি কতবার। মনে পড়ে, ভাদ্র সংক্রান্তির আগের দিন সমস্তরাত ভাদুগান শোনা এমন এক ভাদু গায়িকার কন্ঠে, যাঁর বাবা ছিলেন এক অসামান্য লোকসঙ্গীত গায়ক, কিন্তু কালান্তক কুঠো রোগে সমাজ থেকে পরিত্যক্ত তখন। তাঁর কাছে গিয়েছিলাম আমি কৌতুহলে। ভাদু গায়িকা সেই যুবতীর গান শুনে আমি পূর্ণ হয়ে গিয়েছিলাম। ওই গান আমার উপন্যাস নয় পাহাড়ের উপাখ্যান-এ আছে। এই যে দেখা, এসব দুদিনের জন্য ঘুরে আসা নয়। আমি একাই থেকেছি বছরের পর বছর। শালতোড়ায় বিহারীনাথ পাহাড়। মাইল পনেরর ভিতরে শুশুনিয়া একদিকে, বেড়ো পাহাড় অন্যদিকে। অনেকদিন বাদে ২০০৯ সালে আমি গিয়েছিলাম শালতোড়ায় গড়ে ওঠা নেতাজি মহাবিদ্যালয়ের একটি অনুষ্ঠানে। স্তম্ভিত হয়েছিলাম। খুব হতাশ হয়েছিলাম সেই প্রকৃতির ধ্বংস যজ্ঞ দেখে। ক্রাশার ভাঙছে পাহাড়, স্পঞ্জ আয়রন ফ্যাক্টরি কালো করে দিয়েছে বনভূমি। ক্ষমতাবানেরা এইসব করেছেন। হাঁসপাহাড়ি উপন্যাসে ( ১৯৯০ ) এর ছায়া ছিল।

১৯৮৯ নাগাদ সাপ্তাহিক বর্তমানে আমি একটি ধারাবাহিক উপন্যাস লিখি আগুনের গাড়ি। বাঁকুড়া শহর থেকে বর্ধমানের রায়না পযর্ন্ত একটি ছোট লাইনের রেলপথ ছিল। ন্যারো গেজ সেই রেলপথের নাম ছিল, বাঁকুড়া দামোদর রিভার রেলওয়ে। লোকমুখে ছোট হয়ে, বি, ডি, আর—-বড় দুঃখের রেল। এই উপন্যাসটি ছিল সেই রেলপথ আর তার সংলগ্ন জনপদকে ঘিরে। আমি তখন বেলিয়াতোড়ে থাকি। বিচিত্র রেলগাড়ি আমার ভিতরে একই সঙ্গে বিস্ময় আর কৌতুকের জন্ম দিত। আমি সেই গাড়িতে করে রায়না অবধি পাড়ি দিয়েছি। সে হতো এক আনন্দময় যাত্রা। ফেরার সময়ে সেই ভাদ্রমাসের রাতে জানালা দিয়ে দেখেছিলাম লাইনের পাশের কাঁটা ঝোপ, ফনি মনসার জঙ্গলে কোটি কোটি জোনাকি। জ্বলছে নিভছে। সেই দৃশ্য এ জীবনে ভুলব না। ঈশ্বরের পৃথিবী কী সুন্দর ! আগুনের গাড়ির কথা এখনো শু্নি পাঠকের মুখে। সেই রেলপথ এখন আর নেই। ব্রড গেজে পরিবর্তিত হয়ে গেছে ন্যারো গেজ লাইন। উপন্যাসটি হারিয়ে যাওয়া সেই জগৎকে ধরে রেখেছে। সাহিত্য সব সময় যা অতীত হয়ে গেছে তার কথা বলে। স্মৃতির কথা বলে। আগুনের গাড়ি যখন লিখেছিলাম, তখন তা ছিল। এখন বিলুপ্ত। বাঁকুড়ার গ্রীষ্ম আমাকে অনেক দিয়েছে। থাকি কলকাতার টালা ট্যাঙ্কের কাছে। ২৪ ঘন্টা জল। বর্ষায় আমাদের এলাকা ভাসে। কলকাতাই ভাসে। বাঁকুড়ায় বৃষ্টিহীনতা, জলাভাব এমন জায়গায় পৌঁছয় যা আমি আগে কখনো দেখি নি। একটা লোকের কথা লিখেছিলাম একটি গল্প ‘তাল খেজুর’-এ। তাকে হয় তো দেখেছিলাম আমি। না দেখতেও পারি। তার কথা শুনেছিলাম হয় তো। সে দ্বিপ্রহরের আকাশের দিকে আঙুল তুলে বলেছিল, তাপে তাপে আকাশটা বেঁক্যে গিঁইছে, দ্যাখো দ্যাখো, ভাল করে দ্যাখো।

আসলে লেখা তো হয় অনুভব আর উপলব্ধি থেকে। আমার সেই প্রাক চল্লিশে বাঁকুড়ার নানা গঞ্জে বাস আমাকে সমৃদ্ধ করেছিল যে অভিজ্ঞতায়, তা আমার সমস্ত জীবনের অর্জন হয়ে গেছে যেন। মনে পড়ে, ঠিক দুপুরে তিলুড়ি নামের এক গ্রামের ধারের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি বাসের জন্য। আছে দুই বুড়ি, শালতোড়া নামবে বলে বেরিয়ে এখানে এসে পড়েছে। কখন আবার বাস আসবে। আমিও বাসের জন্য। তারা ভিক্ষে করবে বলে বেরিয়েছে। উপায় নেই তা ছাড়া। একজনের ঘাড়ে বিধবা ছেলের বউ, অন্য জনের ঘাড়ে বুড়ো অকেজো স্বামী। তাদের নিয়ে একটা গল্প লিখেছিলাম সেইদিন সন্ধ্যায় ফিরে। দুই নারী। আমার প্রিয় গল্প। গল্প কীভাবে আসে তা ধরা যায় না। গল্পের জন্য, উপন্যাসের জন্য উপাদান জোগাড় করি নি কখনো, তা হয়েছে আপনা-আপনি, যাপিত জীবনই তার উপাদান দিয়ে দেয় মনের ভিতর। যা দেখিনি তা নিয়ে লেখা যায় আবার যায়ও না। কল্পনা লেখার এক মস্ত জায়গা। যা দেখিনি তা কল্পনায় দেখি। ম্যাকক্লাক্সিগঞ্জ যাইনি। শুনেছিলাম অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের বসতি করে গড়ে তোলা হয়েছিল সেই জনপদ। তা পরিত্যক্ত হয়েছে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার অবসান হতে। গল্প শুনেছিলাম এক বন্ধুর কাছে। আমি একটি গল্প লিখেছিলাম ম্যাকক্লাস্কিগঞ্জ নামে। পরিত্যক্ত এক নগরের গল্প আমার কল্পনায় এসেছিল। আসলে যা দেখা, তা তো দেখাই, যা না দেখা তা যেন আন্দাজ করে দেখা। আমি জানি লেখক এক অলীক ভুবন নির্মাণ করেন আন্দাজে আন্দাজে। এ যেন অন্ধকার নিষ্প্রদীপ পথে একা কোথাও যাওয়া। এই যাত্রাটি আমার ভাল লাগে। যা হয় তো হয়নি, হতে পারত, তা আন্দাজ করাও লেখা। আমি সেই চেষ্টা করতে করতে লিখেছি।

লিখতে লিখতে বুঝেছিলাম, মনের সেই জোর আর কলমে বিশ্বাস না থাকলে লেখা কঠিন। কবে আমাকে মহাসম্পাদক লিখতে বলবেন, আমি গালে হাত দিয়ে সেই চিঠির জন্য অপেক্ষা করব, তাহলে আমার লেখা হবে না, অপেক্ষা হবে। ফলে আমি লিখেছি, পান্ডুলিপি থেকে বই হয়েছে। সেই বই সম্মানিত করেছে আমাকে। আমার কোনো দুঃখ নেই আমি বড় কাগজে ফরমায়েসি উপন্যাস ধারাবাহিক লিখতে পারি নি বলে। বরং না লিখে বেঁচে গেছি, আমি তাহলে ধ্রুবপুত্র, ধনপতির চর বা অশ্বচরিত, নিরুদ্দিষ্টের উপাখ্যান লিখতে পারতাম না নিজের ভিতরের তাগিদ থেকে। হ্যাঁ, যে লেখা একবার লিখেছি, সেই বিষয় আর লিখতে যাই না। খুঁজে যাই জীবনের নতুন ভাষ্য। ধ্রুবপুত্র দিয়েছিল সফলতা। প্রাচীন ভারতের দিকে পা বাড়াইনি। অনুরুদ্ধ হয়েও না। কিন্তু মিথ-প্রত্নপুরাণ অথবা কিম্বদন্তী আমাকে বারবার আকৃষ্ট করেছে। নিয়ে গেছে সেই লোককথার দিকে। অশ্বচরিত, ধনপতির চর, দশমী দিবসে বা অতি সাম্প্রতিক প্রকাশিত মোমেনশাহী উপাখ্যান–সেই পথেই যাত্রা। পুরাতন আর নতুনের ভিতরে সেতু বন্ধন। কিম্বদন্তী আর সাম্প্রতিকে মিলে গেছে মিশে গেছে।

‘দশমী দিবসে’ কয়েক বছর আগে প্রকাশিত। প্রকাশ করেছেন, ন্যাশানাল বুক ট্রাস্ট, ইন্ডিয়া। এই উপন্যাসটি বছর চার ধরে লিখেছিলাম। ২০০০ সালে বাংলাদেশ গিয়েছিলাম। গিয়েছিলাম সাগরদাড়ি, কপোতাক্ষ তীরে মধুকবির পিতৃভূমিতে। আমার এক আত্মীয়া ছিলেন মহাকবি মাইকেলের সম্পর্কিত নাতনি। তাঁর কাছে বাল্যকালে মেঘনাদ বধ কাব্যের অনেক চরণ শুনেছি। তাঁর মুখস্ত ছিল সেই কপোতাক্ষ প্রশস্তি। তিনি অবলীলায় মেঘনাদ বধ কাব্যের শেষ পংক্তি উচ্চারণ করতেন,

করি স্নান সিন্ধুনীরে, রক্ষেদল এবে
ফিরিলা লঙ্কার পানে, আর্দ্র অশ্রুনীরে—
বিসর্জি প্রতিমা যেন দশমী দিবসে
সপ্ত দিবানিশি লঙ্কা কাঁদিলা বিষাদে।।

সেই বৃদ্ধা দেশভাগের পর সব হারিয়ে এদেশে এসে পড়েছিলেন শুধু মাইকেলকে নিয়ে। আমি দেশভাগ, মাইকেল মধুসূদন, রেবেকা, হেনরিয়েটা, সব মিলিয়ে ওই দীর্ঘ উপন্যাসটি লিখেছিলাম। বাংলাদেশের মানুষ মধুকবির বাড়িটিকে সযত্নে রক্ষা করছেন। কপোতাক্ষ ছিল আমাদের ওপারের গ্রাম ধূলিহরেরও নদী। আমার মাতৃকূলও ছিল কপোতাক্ষতীরের। তো সাগরদাড়ির এক যুবক কপোতাক্ষ তীরের একটি জায়গা দেখিয়ে আমাকে বলেছিল, ওই জায়গাটি হল বিদায়ঘাট। মধুকবি বিলেত যাওয়ার আগে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। ওখানে তাঁবু ফেলে অপেক্ষা করেছিলেন মধু। ওখন থেকেই বিদায় নেন। ওই তাঁর শেষ আসা। আর আসেন নি। তথ্যগত ভুল আছে, তিনি যখন বিলেত যান, মা জাহ্নবী বেঁচে নেই। এমন হতে পারে মাদ্রাজ যাওয়ার আগে এসেছিলেন খ্রিস্টান মধুসূদন। কালাপানি পার হতে হয়েছিল মাদ্রাজ যেতে। আবার এই গল্প বানান হতে পারে। কল্পনা। মধুকে নিয়ে গর্বিত সাগরদাড়ির মানুষ ওই গল্প বানিয়েছে। আমি সেই বিদায়ঘাটের গল্পটি জুড়েছি দেশভাগে। পারটিশনে সমস্ত দেশ হয়ে উঠেছিল বিদায়ঘাট। দশমী দিবসে উপন্যাসে সাধারণ মানুষের জীবন, মধুকবির জীবনে জুড়েছে। মেঘনাদের মৃত্যু মাইকেলের মৃত্যু মিলেছে। লিখে তখন ভাল লেগেছিল। ভাল না লাগলে সেই লেখা লিখব কেন?

সাহিত্য সাধনার জায়গা। আর গদ্য সাহিত্য এমন এক সাধনা যেখানে পরিশ্রম আর আরটের প্রতি নিজেকে সমর্পণ না থাকলে লেখা হয় না। আর থাকবে নিরূপায় আর দুঃখের জীবনকে চেনার চেষ্টা। লেখকের এক দায়বদ্ধতা আছেই, তা তাঁর যাপিত জীবন আর এই পৃথিবীর প্রতি। পৃথিবী শব্দটি অনেক বড়। উপন্যাস যেন তার চেয়েও বড়, মহাপৃথিবীর কথা।

আমি আমার চারপাশ নিয়ে লিখতে স্বচ্ছন্দ। আমি যেমন দূর গোপীবল্লভপুরের গ্রাম, বনভূমি, হাঘরে চাষীদের কথা বুঝতে চেয়েছি সেখানে বাস করতে করতে, তেমনি আমার পাশের ফ্ল্যাটের সেই মেয়েটির কথাও লিখতে চেয়েছি যে কিনা এই শহর থেকে নিবার্সিত হয়েছিল নিষ্ঠুর পরিবারের লোভের বলি হয়ে। সে দূর উজ্জয়িনীতে গিয়ে বাড়ির সকলের জন্য, প্রতিবেশির মঙ্গল কামনায় মহাকাল মন্দিরে পুজো দিয়ে আসে। শিপ্রা নদীর ধারের মন্দিরে মন্দিরে যায় কলকাতা শহরে তার নিকটজনের মঙ্গলের জন্য। আসলে মানুষ দেখে দেখেই তো জীবন পার হয়ে যায়। মানুষের নিরূপায়তা, দুঃখ, মানুষের ভিতরের লুকোন অশ্রু আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নেয়। আমি আন্তন চেখভের অনুরাগী। রুশ সাহিত্য পড়েছি অনেক। এখনো রুশ উপন্যাস, গল্প শ্রেষ্ঠ মনে হয়। ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট থেকে রেজারেকশন, আনা কারেনিনা, ক্রয়েটজার সোনাটা, ইভান ইলিচের মৃত্যু আমাকে এখনো মুগ্ধ করে রেখেছে। মুগ্ধ করে রেখেছে আরো কত লেখা। যখন লেখা আসতে চায় না। বসেই থাকি, বসেই থাকি, তখন পড়তে হয়। কী পড়ব তা আমি নিজেই টের পাই। ভাল লেখা উদবুদ্ধ করে। ইদানীং হারুকি মুরাকামি পড়ে স্তম্ভিত। উপন্যাসে চরম বাস্তবতা কিছু হয় না। বাস্তবতা থেকে বেরিয়ে নতুন ভুবনে প্রবেশই আমার উপন্যাস লিখন। উপন্যাস লিখন যেন বাঘের পিঠে চাপা। ঝুঁকি লেখককেই নিতে হয়। কোথায় তিনি থামবেন, কোথায় গিয়ে পৌঁছবেন তা কি তিনি জানেন ? যে উপন্যাস লিখছি, শেষও করেছি সম্প্রতি, মোমেনশাহি উপাখ্যান, তার ভিতরে নতুন ভুবনকে আস্বাদ করে আনন্দ পেয়েছি। তিন পর্বে যদি ৩০০ বছর হয়, প্রবুদ্ধ, সুবুদ্ধ, দুই বন্ধু তিন পর্বেই ভ্রমণ করে। যা ঘটেনি, অথচ ঘটবে বলে খবর পেয়েছে তারা, তা ঘটিয়ে দিয়ে অদৃশ্য হয়। নিরুদ্দেশে যায়। তিনশো বছর ধরেই বারবার তারা আসে।

ধনপতির চর উপন্যাসেও বুড়ো ধনপতি, যে মনে করে পর্তুগিজ হার্মাদ পেদ্রোর বংশধর, যে মনে করে আসলে সে এক কাছিম, যার নামও ধনপতি, এসেছিল কয়েকশো বছর আগে কাছিমের পিঠে চেপে সেই দূর পশ্চিম থেকে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে, কোন কোন পথে যেন, এই দক্ষিণবঙ্গের উপসাগরের কুলে। তার স্মৃতিতে আছে কলম্বাসের আমেরিকার পূর্ব উপকুলে আটলান্টিকের তীরে পা রাখা। স্মৃতিতে নেটিভ আমেরিকানের ভয়। তার বয়সের গাছ পাথর নেই। মানুষ দেখলে আমার তাই মনে হয়, বয়সের গাছ পাথর নেই। শত শত বছরের স্মৃতি তার মস্তিষ্কে। মানুষ যেন পাখিরই জাত। ঘুরে ঘুরে কত কিছু দেখেছে সে। মৃত্যু, ধ্বংস আর জীবন। মানুষ তো একজন নয়, বহুজন। আমার ভিতরে কি আমার পিতৃপুরুষের স্মৃতি নেই ? তাঁরা যা দেখে গেছেন ? সেই পিতৃপুরুষ কি আপন রক্তেরই। আমার রক্তে কোন রক্ত আছে তা কে জানে ? আমি যে গারো পাহাড়ের হাজং উপজাতির স্মৃতিও বহন করি( মোমেনশাহি উপাখ্যান )। না হলে কলকাতা থেকে বাংলাদেশের উত্তর-পুবে নেত্রকোনায় ছুটব কেন, কেনই বা সেখান থেকে যাব গারো পাহাড়ের কোলে সুসঙ্গ দুর্গাপুর। সেখানে তখন ২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা। মেঘলা আর কুয়াশায় ভরা দিন। জায়গাটা মেঘালয় সীমান্তে। লিখতে আরম্ভ করেছিলাম ময়মনসিংহ গীতিকার কমলা সায়র খননের কাহিনি, তা চলে গেল কোথায়? পড়ে থাকল সায়র। পড়ে থাকল কমলার আত্মবিসর্জন। কুয়াশার ভিতর থেকে বেরিয়ে এল ব্রিটিশ দানব সিনিয়র ব্যাস্টিন। হাতি ধরা, হাতি খেদা আন্দোলন, জমির আন্দোলন, কমিউনিস্ট পার্টি, দেশ বিভাজন।

লেখক কেউ একদিনে হয় না। সমস্তজীবন লাগে। এমনও হয়, তারপরেও হয়তো দেখা গেল তাঁকে বিস্মৃত হলেন সুধী পাঠক। এ খুব নিষ্ঠুর জায়গা। পার্টি, মিশন, ধর্ম, প্রতিষ্ঠান, বিশ হাজার ফলোয়ার কেউ বাঁচাতে পারে না, যদি না অচেনা পাঠক তাঁকে খুঁজে বের করেন নিজের তাগিদ থেকে ।

This image has an empty alt attribute; its file name is MANGROVE.jpg

অমর মিত্র

About S M Tuhin

দেখে আসুন

ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব এবং প্রথম ভাষা শহিদ আনোয়ার হোসেন : অরবিন্দ মৃধা

ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব এবং প্রথম ভাষা শহিদ আনোয়ার হোসেন অরবিন্দ মৃধা   বাংলাভাষা আন্দোলন …

14 কমেন্টস

  1. Hi there it’s me, I am also visiting this web site regularly, this site is actually nice and the users are in fact sharing nice thoughts.

  2. Very well presented. Every quote was awesome and thanks for sharing the content. Keep sharing and keep motivating others.

  3. These are in fact wonderful ideas in about blogging. You have touched some good points here. Any way keep up wrinting.

  4. Modern equipment can be equipped with remote troubleshooting capabilities for rapid support. vidalista tadalafil 60 mg

  5. We are a group of volunteers and starting a new scheme in our community. Your site provided us with valuable information to work on. You have done an impressive job and our whole community will be grateful to you.

  6. Good post! We will be linking to this particularly great post on our site. Keep up the great writing

  7. Incredible quest there. What occurred after? Good luck!

  8. I like this web blog very much, Its a really nice spot to read and obtain information.

  9. You’ve made some good points there. I looked on the internet for more info about the issue and found most individuals will go along with your views on this site.

  10. Excellent post. I used to be checking continuously this blog and I am inspired! Very useful information particularly the final phase 🙂 I take care of such info a lot. I used to be seeking this particular info for a long timelong time. Thank you and good luck.

  11. Il CUG della Provincia di Pesaro e Urbino è stato istituito nel 2012 e rinnovato nel 2017 e nel 2022 (Determine dirigenziali n. 1471 2012, n.255 2017 e n. 409 2022). Il Comitato è composto in modo paritetico da dipendenti dell’Amministrazione e dalle organizzazioni sindacali più rappresentative dell’ Ente, e in modo da assicurare la presenza di entrambi i generi. Condividi le tue foto, suggerisci modifiche e segnalazioni. Tieni aggiornate le informazioni e aiuta migliaia di viaggiatori come te 🙂 Assicura la perfetta esecuzione degli standard richiesti nei punti vendita. C’è tempo fino al 30 settembre per candidarsi ai n. 2 posti nel Comune di Pesaro Utilizzata per un periodo di tempo costante, favorisce la durata delle prestazioni ed è un aiuto in caso di eiaculazione precoce. Viagra naturale peruviano: la maca Fra le alternative naturali al viagra arriva direttamente dal Perù la pianta di maca peruviana. Cresce sulle cime delle Ande ed ha conquistato da tempo la fama di pianta della fertilità.
    https://www.tzportfolio.com/help/forum/profile/comprarepriligy.html
    La civiltà indiana (3000-1500 a.C.) è forse la più antica del mondo e, secondo alcuni autori, risalirebbe addirittura al 7500 a.C. Di essa ci restano in particolare i Veda, testi sacri della religione vedica (poi brahmanesimo e induismo) che rivelano un’aspirazione perenne all’integrità e all’immortalità. L’Ayurveda (scienza della longevità da Ayur=longevità e Veda=conoscenza rivelata) è la medicina tradizionale indiana, ancora per certi versi attuale. Il suo principio è che il corpo fisico sia pervaso da tre Dosha (energie vitali) e che lo squilibrio fra queste energie causi la patologia. Revisione a cura del Dott. Roberto Gindro (fonti principali utilizzate per le analisi labtestsonline.org e Manual Of Laboratory And Diagnostic Tests, Ed. McGraw-Hill).

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *