‘আবদুল্লাহ আল-মামুনের নাটকে, আমরা লক্ষ্য করি, মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের নানা আলোড়ন-বিলোড়ন, মূল্যবোধহীনতা, রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচার, স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতি এবং উত্তরণে আহ্বান। শিল্পী আবদুল্লাহ আল-মামুনের স্বাতন্ত্র্য এখানে যে, নিখিল নিরাশার প্রান্তরে বাস করেও তিনি মানুষকে শোনান আশার সংলাপ, তাঁর সৃষ্টিসম্ভার হয়ে ওঠে অনিঃশেষ শান্তিকামী আলোর অপরূপ-উৎস।’
আবদুল্লাহ আল-মামুন : মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিষয়ক নাটক
অনুপম হাসান
বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আবদুল্লাহ আল-মামুনের নাটকে নানাভাবে, নানামাত্রায় উপস্থাপিত হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্বৈরাচারের উত্থান, ধর্মীয় মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িক শক্তি মাথা চাড়া দিয়ে ওঠায় আবদুল্লাহ আল-মামুন প্রচণ্ডভাবে আলোড়িত হয়েছেন। এসবের বিরুদ্ধে তিনি নাটকের মাধ্যমে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে প্রয়াসী হয়েছেন। তাঁর নাটকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং প্রগতিশীল সামাজিক উজ্জীবনের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত হয়েছে। তিনি নাটকে নানাভাবে ও নানা অনুষঙ্গে তুলে ধরেছেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং যুদ্ধোত্তর পরিবর্তিত রাজনৈতিক বাস্তবতা। নাটকে ক্ষয়িষ্ণু আদর্শবাদের বিরুদ্ধে তিনি সু-বোধ, সু-চেতনার কথা বলেছেন।
স্বাধীনতা-উত্তরকালে বাংলাদেশে নাট্যচর্চা শুরু হয়- নতুন আঙ্গিকে, নতুন উদ্যমে। যাঁরা একদিন দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন, স্বাধীন বাংলাদেশে নাটকের পথ চলা শুরু হয় মূলত তাঁদের হাতেই। পাকিস্তান শাসনামলে বিধি-নিষেধের বেড়াজালে যে নাটক মুখ থুবড়ে পড়েছিল তা স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তির দিশা খুঁজে পায়। বলাবাহুল্য, বাংলাদেশের নাট্যসাহিত্যকে মহান মুক্তিযুদ্ধ যথেষ্ট প্রভাবিত করেছে। বাংলাদেশের নাটকে মুক্তিযুদ্ধ, সমকালীন রাজনীতি ও সমাজ-বাস্তবতা বিশেষভাবে স্থান করে নিয়েছে।
বাংলাদেশের নাটকের বিকাশে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছে মুক্তিযুদ্ধ। বাংলাদেশের নাট্যচর্চায় যাঁরা নিবেদিত প্রাণ তাঁদের বিশ্বাসের মর্মমূলে প্রোথিত আছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বাঙালি জাতীয়তাবোধ, অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও বিশ্বমানবতাবোধ সৃষ্টির একান্ত অনুপ্রেরণা। স্বাধীনতা অর্জনের অল্প-সময়ের ব্যবধানে জাতীয় সংস্কৃতির দ্বিধা-বিভক্তি, অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান এবং অপসংস্কৃতির জোয়ারে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। সামরিক অপশক্তির দোর্দণ্ড প্রতাপে দেশ এবং জনগণ যখন দিশেহারা, দেশে সাহিত্যচর্চার বিরুদ্ধ-পরিবেশ বিদ্যমান, তখন নাট্যকারগণ অপশক্তির বিরুদ্ধে নাটকের মাধ্যমে দেশবাসীকে জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন। রাজনৈতিক অপশক্তির বিরুদ্ধে নাট্যকর্মীরাই প্রথম রুখে দাঁড়িয়েছে। ফলে নাটকে উঠে এসেছে স্বাধীন বাংলাদেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক বাস্তবতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, দেশপ্রেম, নৈতিক অবয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং প্রগতিশীল চেতনা। তবে বাংলাদেশের নাটকে বিশেষভাবে স্থান করে নিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। বাংলাদেশের নাটক প্রসঙ্গে এই মন্তব্য যথার্থ যে- মুক্তিযুদ্ধের সাক্ষাৎ ফসল বাংলাদেশের নাটক জন্মলগ্ন থেকেই আধুনিক, প্রগতিশীল, সুস্থশিল্প চেতনাকে শিরোধার্য করে নতুন সময় ও সমাজের উপযোগী বিষয় ও আঙ্গিকে নিজেকে নির্মাণ করে নিতে সক্ষম হয়েছিল।’
বাংলাদেশের নাটক প্রসঙ্গে এই মন্তব্য যথার্থ যে- মুক্তিযুদ্ধের সাক্ষাৎ ফসল বাংলাদেশের নাটক জন্মলগ্ন থেকেই আধুনিক, প্রগতিশীল, সুস্থশিল্প চেতনাকে শিরোধার্য করে নতুন সময় ও সমাজের উপযোগী বিষয় ও আঙ্গিকে নিজেকে নির্মাণ করে নিতে সক্ষম হয়েছিল।
বাংলাদেশের প্রগতিবাদী সুস্থ ধারার নাট্যকারগণের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক রচনায় যাঁরা বিশেষ কৃতিত্বের দাবীদার তাঁরা হচ্ছেন- নীলিমা ইব্রাহীম, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সৈয়দ শামসুল হক, মমতাজউদ্দীন আহমদ, আবদুল্লাহ আল-মামুন, আনিস চৌধুরী, কল্যাণ মিত্র, রশীদ হায়দার, মামুনুর রশীদ, সেলিম আল দীন, আল মনসুর, সাযযাদ কাদির, সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকি, এস এম সোলায়মান, রণেশ দাশগুপ্ত, মান্নান হীরা, আব্দুল্লাহেল মাহমুদ প্রমুখ। এঁদের সকলের নাটকেই মুক্তিযুদ্ধ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। তবে কারো কারো নাটকে অধিকতর গুরুত্বের সাথে এবং বিষয়-বৈচিত্র্যে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বহিঃপ্রকাশ লক্ষণীয়, এর মধ্যে আবদুল্লাহ আল-মামুনের নাটক উল্লেখযোগ্য।
আবদুল্লাহ আল-মামুন স্বাধীনতা-উত্তরকালে বাংলাদেশের সমকালীন সমাজ-বাস্তবতা থেকে নাট্যোপাদান সংগ্রহ করেছিলেন। তাঁর নাটকে মুক্তিযুদ্ধ গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তবে তিনি কোনো নাটকেই মুক্তিযুদ্ধকে সরাসরি উপস্থাপন করেন নি। মামুন নাটকের কেন্দ্রবিন্দুতে রাখেন মুক্তিযুদ্ধের শানিত চেতনা এবং তা সমকালীন বাস্তবতার নিরিখে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিচার-বিশ্লেষণ করেন। নাটক রচনার ক্ষেত্রে স্বভাবতই আবদুল্লাহ আল-মামুনের প্রিয় প্রসঙ্গ- রাজনীতি, মুক্তিযুদ্ধ ও সমকালীন সমাজ-জীবনের অবক্ষয়। তিনি নাটকের মাধ্যমে তাঁর দর্শকদের আত্ম-সচেতন করে তুলতে চেয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন- … মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাপ্রাপ্তি বাঙালির ইতিহাসের সবচেয়ে মূল্যবান অধ্যায়। একটা স্বাধীন জাতি আত্মপ্রকাশ করে তার স্বাধীন সত্তা নিয়ে। একটা স্বতন্ত্র সামাজিক বোধ তৈরি হয়। কিন্তু খুব একটা বেশি দিন স্থায়ী হতে পারে নি। মুক্তিযুদ্ধের উত্তেজনা সস্তা আবেগের মতই উবে যায় মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে। গতি শিথিল হয়ে পড়ে। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের বিচিত্র উপাখ্যানই তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের অল্প-দিনের মধ্যে স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্বাধীনতা-বিরোধী শক্তির হাতে সপরিবারে নিহত হন। এরপর বাংলাদেশে পাকিস্তানী আমলের মতোই পুনরায় সামরিক শাসন চেপে বসে। সামরিক শাসনামলে স্বাধীনতা-বিরোধী শক্তি নানাভাবে পুনর্বাসিত হয়। উপরন্তু সামরিক শাসকরা এ দেশে ধর্মীয় মৌলবাদী রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতা করায় বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হয়। ১৯৯০ সালে গণ-অভূত্থ্যানে সামরিক শাসনের অবসান ঘটলেও দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতালিপ্সার কারণে স্বাধীনতা-বিরোধী ধর্মীয় মৌলবাদী রাজনৈতিক শক্তি নানাভাবে আশ্রয়-প্রশ্রয় লাভ করে। আবদুল্লাহ আল-মামুন স্বাধীনতার প্রত্যাশিত স্বপ্ন-পূরণের আকাক্সক্ষা মনে-প্রাণে লালন করতেন, এজন্য তিনি তাঁর নাট্যকর্মে জানাতে চেয়েছেন- ভৌগোলিক স্বাধীনতা লাভ করলেও বাংলাদেশের জন-মানুষের জীবন পাকিস্তানী আমলের অন্ধকারেই রয়ে গেছে। আবদুল্লাহ আল-মামুন তাঁর নাট্যকর্মে এই অন্ধকার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজেছেন।
‘আবদুল্লাহ আল-মামুনের নাটকে, আমরা লক্ষ্য করি, মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের নানা আলোড়ন-বিলোড়ন, মূল্যবোধহীনতা, রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচার, স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতি এবং উত্তরণে আহ্বান। শিল্পী আবদুল্লাহ আল-মামুনের স্বাতন্ত্র্য এখানে যে, নিখিল নিরাশার প্রান্তরে বাস করেও তিনি মানুষকে শোনান আশার সংলাপ, তাঁর সৃষ্টিসম্ভার হয়ে ওঠে অনিঃশেষ শান্তিকামী আলোর অপরূপ-উৎস।’
আবদুল্লাহ আল-মামুন নাটকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সযত্নে লালন করেছেন। তাঁর রচিত প্রায় সব নাটকের ঘটনাই কমবেশি আবর্তিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ এবং তৎপরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক অবস্থাকে কেন্দ্র করে। তিনি বিশ্বাস করেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়; মনে-মননে লালন করেন অসাম্প্রদায়িক মানসিকতা। এজন্য তাঁর নাটকে মুক্তিযুদ্ধ এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উজ্জীবিত হওয়ার উদাত্ত আহ্বান শোনা যায়। নাটকে তাঁর প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক চেতনার উৎসারণ তীব্র আবেগ সংরাগী ও স্বতঃস্ফূর্ত। আবদুল্লাহ আল-মামুন রচিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-ভিত্তিক নাটকগুলো হচ্ছে : এবার ধরা দাও (১৯৭৭), আয়নায় বন্ধুর মুখ (১৯৮৩), এখনও ক্রীতদাস (১৯৮৩), তোমরাই (১৯৮৮), বিবিসাব (১৯৯১), মেহেরজান আরেকবার (১৯৯৮) ইত্যাদি।
আবদুল্লাহ আল-মামুন নাটকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সযত্নে লালন করেছেন। তাঁর রচিত প্রায় সব নাটকের ঘটনাই কমবেশি আবর্তিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ এবং তৎপরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক অবস্থাকে কেন্দ্র করে। তিনি বিশ্বাস করেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়; মনে-মননে লালন করেন অসাম্প্রদায়িক মানসিকতা। এজন্য তাঁর নাটকে মুক্তিযুদ্ধ এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উজ্জীবিত হওয়ার উদাত্ত আহ্বান শোনা যায়। নাটকে তাঁর প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক চেতনার উৎসারণ তীব্র আবেগ সংরাগী ও স্বতঃস্ফূর্ত।
আবদুল্লাহ আল-মামুন এবার ধরা দাও নাটকে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের দুর্বিসহ জীবনের চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। এসব পরিবারের কর্মক্ষম শিক্ষিত যুবকেরা কাজ না পেয়ে নষ্ট হচ্ছে। এর মাধ্যমে সমাজ ব্যবস্থার আর্থিক বৈষম্যের চিত্র আবিষ্কার করেছেন নাট্যকার। নাট্যকাহিনীতে পড়ালেখা শেখা যে যুবককে কাজের খোঁজ করতে দেখা যায় সে মূলত পুঁজিবাদী অর্থ-ব্যবস্থার সৃষ্ট সংকটের শিকার। সমকালীন সামাজিক বাস্তবতায় মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন যুবকের কাজ মানে- ছিনতাই করা, রাহাজানি করা অথবা ভাড়াটে খুনি হওয়া। অথচ একই সময় সমাজের কতিপয় মানুষের হাতে সম্পদের পাহাড়। শেষ পর্যন্ত যে মহিলা যুবককে চাকরি দিয়েছিল তার অর্থ-সম্পদের হিসাব নেই। মহিলা তার বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পদ উড়িয়ে (বাজে খরচ) দেওয়ার জন্য যুবককে নিয়োগ করে। বৈষম্যমূলক এই অর্থ-ব্যবস্থায় মুষ্টিমেয় লোকের হাতে সম্পদের পাহাড় গড়ে উঠলেও অধিকাংশ মানুষ হয়ে পড়ে নিঃস্ব, অসহায়। অধিকাংশ মানুষ যুবকের বাবার মতো বাড়িওয়ালার ভাড়ার টাকা পরিশোধ করার জন্য পড়ালেখা শেখা ছেলের চাকুরির প্রত্যাশায় বসে থাকে। যুবকের পিতার সংলাপে মু্িক্তযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত পরিবারের গ্লানিকর জীবন-বাস্তবতার স্বরূপ ফুটে ওঠে-
‘ভালো ছেলের গর্ব? কী হবে ঐ গর্ব দিয়ে? আমার পেটে ক্ষিদে, মাথা ভর্তি দুশ্চিন্তা। আমি পেট পুরে খেতে চাই। নিশ্চিন্তে ঘুমুতে চাই। সেজন্য আমার টাকার দরকার। সে টাকা দিবি তুই। সারাজীবন যা রোজগার করেছি সব আমি তোর পেছনে ঢেলেছি। টাকা ফেরত দে হারামজাদা।’- (এবার ধরা দাও )
বাবার বক্তব্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত পরিবারের সাংসারিক টানাপোড়েন এবং দৈন্যদশা। এবার ধরা দাও নাটকে স্বাধীনতা-উত্তরকালে সাধারণ মানুষের জীবনচিত্র উপস্থাপন করা নাট্যকারের মূল উদ্দেশ্য নয়। তিনি বরং একটি নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের আর্থিক সংকটকে উপজীব্য করে পুঁজিবাদী সমাজের ক্ষয়ে যাওয়া অভ্যন্তরীণ সংকট ও বাস্তবতায় মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে মানুষের প্রত্যাশিত আকাক্সক্ষার ব্যর্থতাকে ফুটিয়ে তুলেছেন।
ধনাঢ্য মহিলা চায়- টাকার বিনিময়ে তার ছোট ভাই পড়ালেখা শিখে মানুষ হোক। আর তরুণের পিতা চায়- ছেলের লেখাপড়া নয়, চাকরি। যুবক ছেলে উপার্জন করুক যাতে তাকে সংসারের জন্য চিন্তা করতে না হয়। পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক সমাজের দ্বিমুখী সংকট। একদিকে টাকার জন্য ‘জীবন হারিয়ে’ যায়। অন্যদিকে টাকার জন্য বাবার মানবিক চেতনার লোপ ঘটে। বাবার চৈতন্য বিলোপের মধ্য দিয়ে নাট্যকার স্বাধীনতা পরবর্তী দেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতার করুণ চিত্র ফুটিয়ে তোলেন- ‘যার বাড়ি ভাড়া দেবার মুরোদ নেই, বুড়ো বয়সে যে শান্তিমতো দু’মুঠো খেতে পায় না, যার ছেলে কাজ পেয়ে ঘরে টাকা আনতে পারে না, মেয়ের দালালকে ঘরে ডেকে আনা ছাড়া তার উপায় কী?’ এই নিষ্ঠুর সত্য উচ্চারণে একজন পিতাকে বিবেকহীন অমানুষের পর্যায়ে নামিয়ে দিয়েছে এবং জীবন বাস্তবতার নগ্নতা উন্মোচন করে দেখিয়েছেন নাট্যকার। মানুষ কতটা অসহায় হলে, অথবা কতটা আর্থিক সংকটে নিপতিত হলে এতটা হীন কাজ করতে পারে। অর্থাৎ পিতা হয়েও মেয়ের দালাল বাড়িতে ডেকে নিয়ে এসে তার হাতে নিজেরই মেয়েকে তুলে দিতে চায়।
এবার ধরা দাও নাটকে মানবিকতার চরম লাঞ্ছনার চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে এ দেশের মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষজন চরমভাবে অপমানিত-লাঞ্ছিত-অবমূল্যায়িত হয়েছে। কেননা বাবাকে যখন তার মেয়েকে বাজারে বিক্রি করে দিয়ে অর্থ রোজগারের কথা ভাবতে হয়, তখন নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের রুগ্ন জীবনের দৈন্যদশা সম্পর্কে নতুন কিছু ভাবার অবকাশ থাকে না। আর তাই নাটকের সমাপ্তিলগ্নে তরুণের কণ্ঠে করুণ আকুতি প্রেক্ষাগৃহ জুড়ে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়- ‘আমার সামনে দুটি পথ খোলা আছে। একদিকে নিশ্চিত প্রতিষ্ঠা অন্যদিকে নিশ্চিত ধ্বংস। আমি ভালো থাকতে চাই। আপনারা আমাকে বাঁচান।’ তরুণের এই আর্ত-আকুতি এবং ‘ভালো’ থাকার পরামর্শ চাওয়ার মধ্য দিয়ে নাট্যকাহিনীর পরিসমাপ্তি ঘটেছে। তবে নাট্যদর্শকবৃন্দ তরুণের করুণ আকুতির কোনো সদুত্তর দিতে পারবে কী? তাকে কী আমরা উদ্ধার করতে পারব নিমজ্জিত অন্ধকার থেকে? তরুণের আকুতির মধ্য দিয়ে নাট্যকার আবদুল্লাহ আল-মামুন মূলত ভবিষ্যৎ প্রজন্মের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব এবং অনিশ্চিত জীবন-বাস্তবতার ইঙ্গিত দিয়েছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মকে আমরা সত্যিই কী একটি সুন্দর সমাজ-জীবনের নিশ্চয়তা দিতে পারব?
আবদুল্লাহ আল-মামুন আয়নায় বন্ধুর মুখ নাটকে মূলত মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে দুই তরুণ মুক্তিযোদ্ধা রানা ও বাবুর রাজনৈতিক মতাদর্শগত ভিন্নতা আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে চিত্রিত করেছেন। বাবু শিক্ষকের ছেলে। সৎ পথে উপার্জন করে জীবন-জীবিকা নির্বাহের চেষ্টায় নিয়োজিত। কিন্তু একই সাথে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেও রানা যুদ্ধোত্তর অস্থির রাজনৈতিক বাস্তবতায় অসৎ পথে ন্যায়-নীতি বিসর্জন দিয়ে উপার্জন করে এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন করে। নাট্যকার মামুন রানা ও বাবুকে সমকালীন সমাজের ভিন্ন দুই প্রেক্ষাপটে স্থাপন করে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের সমাজ-বাস্তবতা ফুটিয়ে তুলেছেন। নাট্য-পরিণতিতে আবদুল্লাহ আল-মামুন সততার জয় ঘোষণার মাধ্যমে নীতিভ্রষ্ট মানুষকে সচেতন করে তুলতে চেয়েছেন।
সৎ স্কুল শিক্ষক অবসর গ্রহণের পর ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বসে আছেন। বাবুর চাকরি হবে; উপার্জন করবে। তাদের টানাটানির সংসারে ফিরে আসবে আর্থিক সচ্ছ্বলতা। কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক যে পরিবর্তনে ব্যক্তিমানুষ অনেকাংশে নীতিভ্রষ্ট ও অসৎ হয়ে পড়ে। বিশেষ করে রাজনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ীমহল এ সময় নীতিহীনভাবে বিত্ত-বৈভব গড়ে তুলতে চেষ্টা করে। এই নীতিহীনদের দলের একটি বিরাট অংশ ছিল মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি। যেহেতু তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে সহজভাবে গ্রহণ করতে পারে নি, তাই তারা আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে স্বাধীনতাকে ব্যর্থ করে দেয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। মোহাম্মদ হেদায়েতুল্লার কাছে চাকরির জন্য ধরণা দিয়ে বাবু চাকরি পায় নি। পারে নি সংসারের হাল ধরতে। অথচ বাবুর বন্ধু রানা পরিবর্তিত সমাজ-বাস্তবতার সাথে নিজেও বদলে যায়। অসৎ রাজনীতিবিদ আর ব্যবসায়ীদের সাথে গড়ে তোলে সুসম্পর্ক। তবে মুক্তিযোদ্ধা রানা সমাজের এই অসৎ মানুষগুলো সম্পর্কে মনে মনে ঘৃণা পোষণ করে। এজন্যই তাকে বলতে শোনা যায়, ‘হাত না মেলালে যে আমিই আগে ভাগে মরে যাই। আমি মরে গেলে ওদের মারবে কে? বুঝতে পারছিস না, ওরা হচ্ছে আমাদের এই লড়বড়ে পচা সমাজটার মাথা, বুক, পেট, কোমর। ওদেরকে আমি ঢালের মত ব্যবহার করি।’ অর্থাৎ রানা সময়ের সাথে সময়ের স্রোতে মিশে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বুকের সাহসকে পুঁজি করে অসৎ শিল্পপতি, কালোবাজারী ব্যবসায়ী ও ধূর্ত-ধান্দাবাজ রাজনীতিবিদদের ঘাড়ে পা দিয়ে অর্থোপার্জনের অসৎ পথ বেছে নিয়েছিল। এতে রানা বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়েছে ঠিকই কিন্তু মানসিক শান্তি পায় নি। রানার যন্ত্রণাদগ্ধ কাতর উচ্চারণ-
‘বুদ্ধি হবার পর থেকেই শুনে আসছি, সমাজে ঘুণ ধরেছে, এই সমাজ দিয়ে আমাদের চলবে না, এই সমাজকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিতে হবে কিন্তু বিল্লীর গলায় ঘণ্টা তো কেউ বাঁধে না।’ (আয়নায় বন্ধুর মুখ)
‘বুদ্ধি হবার পর থেকেই শুনে আসছি, সমাজে ঘুণ ধরেছে, এই সমাজ দিয়ে আমাদের চলবে না, এই সমাজকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিতে হবে কিন্তু বিল্লীর গলায় ঘণ্টা তো কেউ বাঁধে না।’ (আয়নায় বন্ধুর মুখ)
অতএব রানা ঘুণে ধরা সমাজের স্রোতেই গা ভাসিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু আদর্শবান পিতার আদর্শ পুত্র বাবু সময়ের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিতে পারে নি। পারে নি বাবুর স্ত্রী রাবেয়াও। তারা স্বামী-স্ত্রী মিলে চাকরি করে সৎ পথে থেকেই জীবিকা উপার্জন করতে চেয়েছে। অথচ রাবেয়া চাকরি করতে গিয়ে লম্পট কাশেম আলীর অফিসে অপমানিত হয়। তারা কাশেম আলীর অপমানের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে না। কারণ, কাশেম আলীরা সমাজের প্রভাবশালী বিত্তবান। কাশেম আলীর যৌন হয়রানির পরও রাবেয়ার কণ্ঠে শোনা যায় আদর্শের প্রতি অবিচল আস্থা। তাই স্বামীর বন্ধু রানাকে উদ্দেশ্য করে রাবেয়া উচ্চারণ করে-
‘তুমি এখন আমার স্বামীর একজন পয়সাওয়ালা বন্ধু, সে-খবর আমি পেয়েছি। ইচ্ছে করলে তুমি বাবুকে টাকার স্রোতে ভাসিয়ে দিতে পারো। কিন্তু তোমার কাছে আমার একটাই অনুরোধ, তুমি বাবুকে নষ্ট করো না। তুমি নিজে নষ্ট হয়ে গেছো, তুমি আরো নষ্ট হও, তুমি টাকার পাহাড় গড়ে তোলো- বাবু যা আছে ওকে তাই থাকতে দাও।’ (আয়নায় বন্ধুর মুখ)
বন্ধুর স্ত্রীর এই ঘৃণায় রানার হৃদয় রক্তাক্ত হয়। আত্ম-যন্ত্রণাদগ্ধ রানার হৃদয়ের এই গোপন ক্ষরণ দারুণতর হয়ে ওঠে রানা-মনির প্রেমের সম্পর্কে। ভালোবেসে বাবুর বোন মনিকে রানা বিয়ের কথা বললেও মনি নীরবে প্রস্থান করে রানার প্রতি তীব্র ঘৃণা ছুঁড়ে দেয়। মনির উপেক্ষা ও ঘৃণায় রানার বিত্ত-বৈভবের জাগতিক জীবন বিষিয়ে ওঠে। মনির উপেক্ষা, বন্ধু-স্ত্রীর করুণামিশ্রিত ঘৃণার আগুনে রানার হৃদয় জ্বলেপুড়ে ছাই হয়েছে। অথচ সে তার রক্তাক্ত হৃদয়ের মানসিক যন্ত্রণার কথা কাউকে বলতেও পারে নি। সম্ভবত এ কারণেই রাবেয়ার সামনে ব্রিফকেস ভর্তি অসৎ পথে উপার্জিত টাকায় আগুন জ্বালিয়ে রানা প্রমাণ করতে চেয়েছে টাকা কিংবা বিত্তের চেয়েও বড় কিছু তার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। বিত্ত-বৈভবের প্রাচুর্য একদিকে রানার জীবন তছনছ করে দেয়, অন্যদিকে বিত্তের অভাবে স্কুল শিক্ষকের সংসার নির্বাহ অসম্ভব হয়ে পড়ে। স্বাধীনতা-উত্তরকালের সমাজ-বাস্তবতায় সৎ-ভাবে বেঁচে থাকতে চাওয়া মধ্যবিত্ত পরিবারের করুণচিত্র অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষকের বক্তব্যে ফুটে উঠেছে-
মুক্তিযুদ্ধোত্তর সময়ে দেশের সামগ্রিক জীবন-বাস্তবতা বিবেচনা করে নীতি-নৈতিকতা, মূল্যাবোধ এবং আদর্শের নির্বাসনচিত্র সুবচন নির্বাসনে উপস্থাপন করেছিলেন। সুবচন তথা সততা, আদর্শ, ন্যায়-নীতির নির্বাসনে প্রকৃতার্থে এদেশের তরুণ সমাজ অধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। পরবতী সময়ে নাট্যকার শঙ্কিত হয়েছেন এই ভেবে যে, তরুণ সমাজ যদি স্বাধীনতা-বিরোধী শক্তির হাতে ব্যবহৃত হয়, তাহলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নস্যাৎ হবে, ঝিমিয়ে পড়বে দেশপ্রেম। সেই সুযোগ দেশে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান ঘটবে। এই তরুণ সমাজকে সঠিক পথের নির্দেশনা দেওয়া যায় নি বলে ইতোমধ্যে দেশে ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থান স্পষ্টতর হয়ে উঠেছে। নাট্যকার বাংলাদেশে মৌলবাদী স্বাধীনতা-বিরোধী শক্তির উত্থানে মইরাম বিবির সংগ্রাম দেখিয়েছেন। তাঁর সৃষ্ট মেরাজ ফকির, মেহেরজান স্বাধীনতার চেতনায় বলীয়ান হয়ে রুখে দাঁড়িয়েছে।
‘পিতার অস্তিত্ব নিয়ে দুরন্ত দুর্বৃত্ত সন্তানের দিকে তেড়ে যাবো, সে শক্তিই বা কোথায়, মর্যাদাই বা কোথায়? সব তো কেড়ে নিয়েছে। তুমি হয়ত প্রশ্ন করবে কারা, কারা কেড়ে নিয়েছে? উত্তরটা আমি জানি কিন্তু বলব না। ভয়ে বলব না। কারণ বাঁচার সাধ কি জীবিত মানুষের সহজে মেটে? অতএব টিউশনী খোঁজাই শ্রেয় বোধহয়।’ (আয়নায় বন্ধুর মুখ)
বেঁচে থাকার সাধ আছে বলে সৎ স্কুল শিক্ষক এখন সমাজের দুর্বৃত্তদের নাম মুখে উচ্চারণ করতে ভয় পান। দরিদ্র-নিরীহ স্কুল শিক্ষকের পক্ষে রাষ্ট্র-ক্ষমতার অধিকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহসটুকু পর্যন্ত নেই। কেননা সমাজের কর্তা ব্যক্তিরাই অসৎ, নীতিভ্রষ্ট এবং দুর্নীতিপরায়ণ। এরকম সমাজ-বাস্তবতায় সৎ স্কুল শিক্ষকের মতো ছা-পোষা মানুষের পক্ষে প্রতিবাদ অক্ষমের আর্ত-হাহাকার ছাড়া কিছুই নয়।
আবদুল্লাহ আল-মামুন রানার অন্তর্দহনকে অত্যন্ত মেধাবী দক্ষতায় পরিবর্তিত সমাজ-বাস্তবতার প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণে সংশ্লিষ্ট করে উপস্থাপন করেছেন। রানার অসৎ পথে গড়ে তোলা বিত্ত-বৈভবের প্রতি সকলের ঘৃণা তাকে প্রতিমুহূর্তে যন্ত্রণায় বিদ্ধ করেছে। আর তাই রানার কণ্ঠে শোনা যায়, ‘আমি কি বেঁচে আছি? তুই কি মনে করিস আমি বেঁচে আছি? সুখে আছি?’ রানার এই বেঁচে না-থাকা অর্থে নাট্যকার তার আদর্শচ্যুতিকে বুঝিয়েছেন। যে রানা মুক্তিযুদ্ধের সময় বাবুর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিল তার পরিবর্তিত বাস্তবতায় রানার সেই বন্ধু বাবু তাকে ‘স্বাধীনতার শত্রু’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ফলে রানা ভোগে আদর্শচ্যুতির যন্ত্রণায়। আদর্শবর্জিত রানা বিবেকের দংশনের ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে প্রতিক্ষণ; সম্ভবত এই বিবেকের তাড়নায়-ই রানা শেষ পর্যন্ত মনিকে ফিরিয়ে দিয়েছে। রানা স্বেচ্ছায় জাগতিক সকল সুখ-ঐশ্বর্য উপভোগ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করার মধ্য দিয়ে আত্মশুদ্ধির প্রয়াস পেয়েছে। অবশেষে বিবেকের কাছে পরাজিত রানা পুলিশের কাছে আত্ম-সমর্পণ করে অনুতাপের অনলে অন্তরের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি খুঁজেছে। নাট্য-পরিণতিতে রানার আত্ম-সমর্পণের মধ্য দিয়ে নাট্যকার সুবিধাবাদী রাজনীতিবিদ মল্লিক, অসৎ ব্যবসায়ী কাশেম আলী এবং হেদায়েতুল্লা’র পরাজয়ের প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছেন। পরিবর্তিত সমাজ প্রেক্ষাপটে রানা চরিত্রের অন্তর্দহন নাট্যকার শিল্পিত নৈপুণ্যে উপস্থাপন করেছেন।
আবদুল্লাহ আল-মামুন-এর এখনও ক্রীতদাস পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা বাক্কা মিয়ার করুণ জীবনগাথার বস্তুনিষ্ঠ চিত্র। রেলপথ লাগোয়া গলাচিপা বস্তিবাসীর সাথে পঙ্গু বাক্কা মিয়ার অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবন-প্রদীপ বিপন্ন অবস্থায় টিকে আছে মাত্র। নাট্যকাহিনীতে বাক্কা মিয়ার মর্মান্তিক জীবনযুদ্ধের পাশাপাশি গলাচিপা বস্তিবাসীদেরও করুণ জীবন-বাস্তবতা ও সংগ্রামের চিত্র উঠে এসেছে। বস্তিব সকলেই দরিদ্র। নাট্যকার বস্তিবাসীদের জীবনের সাথে দারিদ্র্যের সংগ্রাম দেখিয়েছেন। গলাচিপার বাসিন্দারা যেন দারিদ্র্যের ক্রীতদাস।
বাক্কা মিয়া সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে নি। তথাপি এক অর্থে সে মুক্তিযোদ্ধা। কারণ, মুক্তিযুদ্ধের সময় বাক্কা মিয়া ট্রাক চালাতে গিয়ে পাকিস্তানী সৈন্যদের হাতে ধরা পড়েছিল। তাকে হত্যার জন্য লাইনে দাঁড় করিয়ে সৈন্যরা গুলিও করেছিল। বাক্কা মিয়া সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলেও চিরতরে পঙ্গু হয়ে যায়। স্বাধীন বাংলাদেশে বাক্কা মিয়ার মতো মুক্তিযুদ্ধের ক্ষত নিয়ে এখনো অনেকেই বেঁচে আছেন। বাক্কা মিয়ারা মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি ক্ষয়-ক্ষতির শিকার হয়েছিল। এই বিবেচনায় এরাও এক অর্থে মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ ক্ষয়-ক্ষতির শিকার বাক্কা মিয়াদের জীবনকথা এখনও ক্রীতদাস নাটকে আবদুল্লাহ আল-মামুন উপস্থাপন করেছেন।
কর্মহীন পঙ্গু বাক্কা মিয়া স্বাধীনতার পর গলাচিপা বস্তিতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল। বাক্কা মিয়া এখন স্ত্রী এবং মেয়ের গলগ্রহ হয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। বাক্কা মিয়ার স্ত্রী কান্দুনি সাহেবদের বাসায় ঝিয়ের কাজ করে। মেয়ে মর্জিনা সিনেমায় এক্সট্রা মেয়ের কাজ করে। স্ত্রী-কন্যার উপার্জনে বাক্কা মিয়ার ক্ষুধা কখনো নিবৃত্ত হয় না। তার ক্ষুধা অনন্ত – ‘আমার ক্ষিধা লাগছে … খাওন দে …।’
পঙ্গু বাক্কা মিয়াকে কেন্দ্র করে নাট্যকার আবদুল্লাহ আল-মামুন গলাচিপা বস্তির নিম্নশ্রেণীর মানুষের অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবনের বহুবিচিত্র ক্লেদাক্ত স্বরূপ উদ্ঘাটন করেছেন। বস্তিবাসীর জীবন-সংগ্রামে ফুটে ওঠে- তারা (বস্তিবাসী ছিন্নমূল মানুষ) ‘মানুষ’ হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশে মর্যাদা পায় নি। নাট্যকার এই বস্তিবাসীদেরকে দারিদ্রের ‘ক্রীতদাস’ বা গোলাম হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কান্দুনির মতো গলাচিপা বস্তির অনেকেই বাসা-বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। বিত্তবানেরা অর্থের বিনিময়ে তাদের শ্রম কিনে নেয়। নাট্যকার এদের শ্রম-বিক্রির প্রতীকে যে জীবন-বাস্তবতা তুলে ধরেছেন তা এক অর্থে দাসত্বই। অন্যদিকে বাক্কা মিয়ার মেয়ে মর্জিনা সিনেমায় এক্সট্রা মেয়ের কাজ করতে গিয়ে স্বাধীনতা-বিরোধীদের হাতেই সম্ভ্রম হারায়। গলাচিপা বস্তির আরেক যুবতী তহুরুন জীবন-জীবিকার তাগিদে শরীর বিক্রি করে। প্রকৃতপক্ষে জীবনের অন্ধকার গলিতে বস্তিবাসীদের অবস্থান। এদের জীবন-বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে নাট্যকার প্রশ্ন তোলেন- প্রকৃতপক্ষে বস্তির এসব মানুষ কি স্বাধীনতা পেয়েছে? বাংলাদেশ রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করেছে তবে দেশের আশি ভাগ মানুষের আর্থিক মুক্তি (স্বাধীনতা) মেলে নি। বস্তুত দেশের আশি ভাগ মানুষ জীবন-জীবিকার প্রশ্নে দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পায় নি। ফলে এদের কাছে দেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতা মূল্যহীন।
এখনও ক্রীতদাস নাটকের ফাইটার এক উদ্ভ্রান্ত তরুণ। এই তরুণের মাধ্যমে নাট্যকার বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জীবন-বাস্তবতা নির্মাণ করেছেন। দারিদ্র্যের নিষ্পেষণে ফাইটারের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছে। ছিনতাই-রাহাজানি-গুণ্ডামি করাই ফাইটারের কাজ। অপরাধীচক্রের সদস্য ফাইটার মূর্খ-অজ্ঞ। তাই না বুঝে বস্তির পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধার মেয়ে মর্জিনাকে তুলে দিয়েছে নারী-পাচারকারীদের হাতে। ফাইটার ভুল বুঝতে পেরে মর্জিনাকে উদ্ধার করতে গিয়ে ক্ষয়ে যাওয়া রাষ্ট্রযন্ত্রের বিবেচনাহীন পুলিশ-বাহিনীর হাতে প্রাণ দিয়েছে। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধা বাক্কা মিয়ার প্রতিবাদের ভাষা চিরতরে কেড়ে নেয়, রাজাকার কাজী আবদুল মালেকের ভাড়াটে গুণ্ডার নির্মম বুলেট। মরণ যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে বাক্কা মিয়া স্মরণ করিয়ে দেয় তার অনন্ত ক্ষুধার কথা- ‘চা দে টোস বিস্কুট দে- আমি চায়ের মইদ্যে চুবাইয়া চুবাইয়া খামু ।’ নাট্যকাহিনীতে যুবক ফাইটারের মৃত্যু, মর্জিনার সম্ভ্রম হরণ, তহুরুনের শরীর বিক্রির মূলে ক্রিয়াশীল অনন্ত ক্ষুধা। মূলত এখনও ক্রীতদাস নাটকের কাহিনী ক্ষুধার জ্বালা আর দারিদ্র্যের নিষ্পেষণ নিয়ন্ত্রণ করেছে। নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র বাক্কা মিয়া তাই অনন্ত ক্ষুধার জ্বালা নিয়েই মৃত্যুবরণ করে। মৃত্যুর সময়ও ‘চা-বিস্কুট’ খেতে চেয়ে বাক্কা মিয়া দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে নীরব প্রতিবাদ করে গেছে। বাক্কা মিয়ার জীবন-বাস্তবতায় নাট্যকার প্রকৃত প্রস্তাবে যুদ্ধোত্তরকালে মুক্তিযোদ্ধাদের মূল্যায়নের স্বরূপ উদ্ঘাটন করেছেন। যাঁদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে, তাঁদের (বাক্কা মিয়াদের) জীবনে স্বাধীনতার সুফল আসে নি। স্বাধীনতার পর তাদের ভাগ্যেরও কোনো পরিবর্তন ঘটে নি। বাক্কা মিয়াদের দায়িত্ব রাষ্ট্র গ্রহণ করে নি। বাক্কা মিয়ার করুণ-ক্লেদাক্ত জীবনসত্য তুলে ধরে নাট্যকার আবদুল্লাহ আল-মামুন মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন-জীবিকার ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় বিবেচনার দাবী উত্থাপন করেছেন।
আবদুল্লাহ আল-মামুন এখনও ক্রীতদাস নাটকে বাক্কা মিয়ার পঙ্গুত্ব এবং তার স্ত্রীর কান্দুনি নামকে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছেন। বাক্কা মিয়ার পঙ্গুত্বে স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক পঙ্গুত্বের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। আর কান্দুনি নাম-প্রতীকে নাট্যকার ক্রন্দনরতা বেহাল বঙ্গমাতাকেই দ্যোতিত করেছেন। মর্জিনা নাম-প্রতীক আরো অনেক বেশি ধারাল এবং লক্ষ্যভেদী। নাট্যকার মর্জিনা নামটি বক্র-বক্তব্যে ব্যবহার করেছেন। রূপকথার মর্জিনা ভয়ানক ডাকাত দলের হাত থেকে পিতৃপ্রতিম মনিবকে সুকৌশলে উদ্ধার করতে পারলেও বাংলাদেশের মর্জিনা নিজের সম্ভ্রমটুকু রক্ষা করতে পারে নি। নাট্যকার দেখিয়েছেন- দস্যু-তস্কর পরিবেষ্টিত স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের সমাজ-বাস্তবতায় মর্জিনারা নিজেদের রক্ষা করতে পারে না, বরং পরাজিত ও ভগ্ন হয়ে ফিরে আসে।
রাজাকার কাজী আবদুল মালেক স্বাধীন দেশে নারীপাচারের ব্যবসা করে। গলাচিপা বস্তিবাসীদের দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে মর্জিনা, তহুরুনদের মতো যুবতী মেয়েদের সর্বনাশ করে আবদুল মালেক। বিভিন্ন দেশে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে বস্তির যুবতীদের পাচার করে দেয়। আবদুল মালেকের নারী পাচারের ঘটনায় প্রতীয়মান হয়- নাটকের ‘ক্রীতদাস’ নামকরণটি আক্ষরিক অর্থেই স্বার্থক হয়েছে।
আবদুল্লাহ আল-মামুনের নাটকে স্বাধীনতা-উত্তর সমাজ বাস্তবতার নিরিখে ঘুরেফিরে এসেছে তরুণ সমাজের কথা, বিশেষত তাদের বিপথগামী হওয়ার কথা। কেননা তিনি মনে করেন, তরুণ-প্রজন্মই দেশ-জাতির মূল চালিকাশক্তি এবং ভবিষ্যৎ কর্ণধার। সুবচন নির্বাসনে নাটকের মাধ্যমেই নাট্যকার আবদুল্লাহ আল-মামুন তরুণ সমাজের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধোত্তর সময়ে দেশের সামগ্রিক জীবন-বাস্তবতা বিবেচনা করে নীতি-নৈতিকতা, মূল্যাবোধ এবং আদর্শের নির্বাসনচিত্র সুবচন নির্বাসনে উপস্থাপন করেছিলেন। সুবচন তথা সততা, আদর্শ, ন্যায়-নীতির নির্বাসনে প্রকৃতার্থে এদেশের তরুণ সমাজ অধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। পরবতী সময়ে নাট্যকার শঙ্কিত হয়েছেন এই ভেবে যে, তরুণ সমাজ যদি স্বাধীনতা-বিরোধী শক্তির হাতে ব্যবহৃত হয়, তাহলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নস্যাৎ হবে, ঝিমিয়ে পড়বে দেশপ্রেম। সেই সুযোগ দেশে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান ঘটবে। এই তরুণ সমাজকে সঠিক পথের নির্দেশনা দেওয়া যায় নি বলে ইতোমধ্যে দেশে ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থান স্পষ্টতর হয়ে উঠেছে। নাট্যকার বাংলাদেশে মৌলবাদী স্বাধীনতা-বিরোধী শক্তির উত্থানে মইরাম বিবির সংগ্রাম দেখিয়েছেন। তাঁর সৃষ্ট মেরাজ ফকির, মেহেরজান স্বাধীনতার চেতনায় বলীয়ান হয়ে রুখে দাঁড়িয়েছে।
আবদুল্লাহ আল-মামুন তোমরাই নাটকে দেখিয়েছেন, বাংলাদেশের তরুণ-প্রজন্ম স্বাধীনতা-বিরোধী রাজাকারদের হাতে বর্তমানে ব্যবহৃত হচ্ছে। তরুণ-প্রজন্মের রঞ্জু এই ব্যবহৃতদের একজন। বিপথগামী এই যুবকদের হাতে তারা তুলে দিচ্ছে অস্ত্র। আর রাজাকারদের হুকুমে নীতিভ্রষ্ট এই যুবকেরা মুক্তিযোদ্ধার বুকে ছুরি চালিয়ে দিচ্ছে। স্বাধীনতার পর হায়দার আলীর মতো পুনর্বাসিত রাজাকাররা ‘দাবার গুটির মতো রঞ্জুকে নিয়ে খেলছে। রঞ্জুর বয়সী ছেলেগুলোর ‘ব্রেন ওয়াশ’ করে চলেছে, যেন এই জেনারেশানটা ভুলে যায় এদেশে একদিন মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। স্বাধীনতাকে অর্থহীন করে তোলার জন্য স্বাধীনতার এইসব পুনবার্সিত শত্রুরা এটাকেই লেটেস্ট স্ট্রাটিজি করেছে।’ রাষ্ট্র নিতে পারে নি রঞ্জুদের দায়িত্ব। শিক্ষা-দীক্ষা অর্জনের পরও রঞ্জুর মতো যুবকদের জীবনের নেমে আসে বেকারত্বের অভিশাপ। বিভ্রান্ত বেকার যুবকদের কিছু টাকার বিনিময়ে কিনে নিচ্ছে পুনর্বাসিত রাজাকার হায়দার আলীরা। বেকার যুব-সমাজের হতাশাকে পুঁজি করে এগিয়ে চলেছে হায়দার আলীরা। দেশের এই আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার চিত্র ননী ব্যানার্জির সংলাপে ফুটে ওঠে-
‘দেশের এখন ব্যবসা বাণিজ্য, শিল্প সংস্কৃতি, শিক্ষা দীক্ষা কোনোটাই ফ্লারিস করছে না। মানে এসবের বারোটা অনেক আগেই বেজে গেছে। এখন একমাত্র ভরসা পাগলা ঘোড়ার রাজনীতি।’ (তোমরাই)
মুক্তিযোদ্ধা ননী ব্যানার্জির এ কথায় পরিবর্তিত সমাজসত্য নিহিত রয়েছে। কারণ, তরুণ-সমাজ এখন খুন করা থেকে শুরু করে বোমাবাজি-ছিনতাই-রাহাজানি-ডাকাতি পেশায় নিয়োজিত হয়েছে। নাট্যকার এবার ধরা দাও নাটকে আরো স্পষ্ট করে দেখিয়েছেন- সৎভাবে জীবিকার্জনের উপায় খুঁজে বেড়ানো এক তরণের আর্ত-হাহাকারে- ‘এই বয়সটা কি শুধু হাইজ্যাকার হবার?’ অথবা, ‘এই বয়সটা কি শুধুই খুনি হবার?’ তাই পথচারীর বেশে স্বাধীনতার শত্রু ঐ তরুণের হাতে রিভলবার তুলে দিয়ে বলেছে- ‘এই বয়সে এটাই তো কাজ।’ এবার ধরা দাও নাটকের সংকটাপন্ন তরুণের নতুন সংস্করণ রঞ্জু। ঐ তরুণের মতো রঞ্জুও কাজ খুঁজেছে কিন্তু রাষ্ট্র বেকার রঞ্জুকে যেমন কাজ দিতে পারে নি তেমনি তার জীবন-জীবিকার দায়িত্বও নিতে পারে নি। চাকরি প্রার্থী তরুণ শেষ পর্যন্ত তাকে একটা সৎপরামর্শ দেয়ার কথা বলেছিল। কারণ, সে তার বাবা ও বোনকে নিয়ে সমাজে ভালোভাবে বেঁচে থাকতে চায়। কিন্তু সমাজ কিংবা রাষ্ট্র তরুণকে সৎ পরামর্শ দিতে পেরেছে কি? না, পারে নি। আর পারে নি বলেই আজ বেকার যুবকেরা বোমাবাজি, ছিনতাই, রাহাজানিকে কাজ হিসেবে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে। এজন্যই রঞ্জুর মুক্তিযোদ্ধা মা কান্তা অসহায়ভাবে উচ্চারণ করেছে- ‘আমাদের কমিটমেন্ট কি আমরা রাখতে পেরেছি? আমাদের ছেলেমেয়েদেরকে আমরা কি স্বাধীনতার মানে বোঝাতে পেরেছি?’ রঞ্জুর মায়ের বক্তব্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী শক্তির প্রধান ব্যর্থতা ফুটে উঠেছে। দেশের নির্মাতাগণ তাঁদের উত্তর-প্রজন্মকে স্বাধীনতার চেতনায় গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন। অর্থনৈতিক কারণেই তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন। স্বাধীনতার চেতনা-বিমুখ উত্তর-প্রজন্মের যুবক হারানের কথায় এই ব্যর্থতার চিত্র পাওয়া যায়- ‘স্বাধীনতার মানে যদি হয় সব হারিয়ে ক্র্যাচে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা, তাহলে সেই স্বাধীনতার মানে আমাদের না বুঝলেও চলবে।’
রঞ্জু, হারান, শমসের- এসব তরুণের এই নষ্ট হয়ে যাওয়ার মূলে রয়েছে পুঁজিবাদী অর্থনীতি, যে আর্থ-রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার দেশের উৎপাদনক্ষম যুব-সমাজ।
নাট্যকার আবদুল্লাহ আল-মামুন তোমরাই নাটকের ঘটনায় পারিবারিক সংকট, আর্থিক-দৈন্য, রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র প্রভৃতি বিষয়ানুষঙ্গের প্রয়োজনে আনলেও তাঁর মূল প্রেক্ষণ বিন্দু কখনো রঞ্জুর ওপর থেকে সরে যায় নি। তিনি স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে পুনর্বাসিত রাজাকারদের অভিনব কৌশলের বিষয়টিই রঞ্জু চরিত্রের মাধ্যমে নাট্যঘটনায় মুখ্য করে তুলেছেন। হায়দার আলীর মতো পুনর্বাসিত রাজাকার চায় যুব-সমাজ (স্বাধীনতা-উত্তর প্রজন্ম) তাদের পূর্ব-পুরুষের কথা, দেশের ইতিহাস কিংবা অতীতের মহান গৌরবের কথা ভুলে যাক; এরা কখনো যেন প্রকৃত সত্য জানতে না পারে। হায়দার আলীদের এই পরিকল্পনা সফল হলে একদিন রঞ্জুরাই তাদের কথামতো মুক্তিযুদ্ধের সৈনিক ননী ব্যানার্জির বিরুদ্ধে দাঁড়াবে-
‘কি দেখছেন ননীবাবু? নিউ জেনারেশান? দেখুন, ভালো করে দেখুন। এরা এখন আমাদের সৈন্য। প্রয়োজন পড়লে এরাই আপনাদের মোকাবেলা করবে।’ (তোমরাই)
নির্ভীক মুক্তিযোদ্ধা ননী ব্যানার্জি বিশ্বাস করে- তরুণ প্রজন্ম সাময়িকভাবে আত্ম-বিস্মৃত হলেও একদিন ঠিকই তারা প্রকৃত সত্য অনুধাবন করতে পারবে। কিন্তু কীভাবে? স্বাধীনতা-উত্তর প্রজন্মকে প্রকৃত সত্য জানাবার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয় নি। স্বাধীনতার চেতনা নতুন প্রজন্মের মধ্যে সঞ্চারিত করার জন্য সামাজিক বা রাষ্ট্রিক ন্যূনতম চেষ্টাও করা হয় নি। উপরন্তু দেশের অস্থির আর্থ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় তরুণ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করেছে পুনর্বাসিত রাজকার হায়দার আলীরা। তাই হায়দার আলীর কণ্ঠে সাফল্যের সুর শোনা যায়-
‘স্বাধীনতার পর যারাই ক্ষমতায় এসেছে তারাই একটার পর একটা ভুল করেছে। সবার অলক্ষ্যে সেই ফাঁকটা আরো বেড়েছে। … ক্রমশ ঐ ফাঁকে আমরা আমাদের জায়গা করে নিয়েছি। … রঞ্জুদের জেনারেশনটার কাছে এই স্বাধীনতাকে অর্থহীন করে তুলতেই হবে। এই লাইনে সাকসেসও আসতে শুরু করেছে। ওদের কাছে স্বাধীনতার কোন মানেই নেই। রঞ্জুরা স্বাধীনতার গপ্পোটা পর্যন্ত শুনতে চায় না।’ (তোমরাই)
‘স্বাধীনতার পর যারাই ক্ষমতায় এসেছে তারাই একটার পর একটা ভুল করেছে। সবার অলক্ষ্যে সেই ফাঁকটা আরো বেড়েছে। … ক্রমশ ঐ ফাঁকে আমরা আমাদের জায়গা করে নিয়েছি। … রঞ্জুদের জেনারেশনটার কাছে এই স্বাধীনতাকে অর্থহীন করে তুলতেই হবে। এই লাইনে সাকসেসও আসতে শুরু করেছে। ওদের কাছে স্বাধীনতার কোন মানেই নেই। রঞ্জুরা স্বাধীনতার গপ্পোটা পর্যন্ত শুনতে চায় না।’ (তোমরাই)
এজন্যই আজ রাজাকার হায়দার আলী স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে চূড়ান্ত চ্যালেঞ্জ করার কথাও বলতে পারে, ‘আমাদের ক্যালকুলেশান মোতাবেক সব কিছু ঠিক মতো চললে, একাত্তরের বাংলাদেশটাকে আমরা ঠিকই একদিন শূন্যে মিলিয়ে দিতে পারব।’ হায়দার আলীদের ক্যালকুলেশানটা হচ্ছে- ‘একটা সংগ্রাম। আর এই সংগ্রামে এখনকার ইয়ং জেনারেশনটাই হচ্ছে আমাদের প্রধান হাতিয়ার। এই জেনারেশনটাকে কিছুতেই পেছনের দিকে তাকাতে দেওয়া যাবে না।’ হায়দার আলীর ক্যালকুলেশান অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধার সন্তান রঞ্জু এবং তার সঙ্গী-সাথীরা মুক্তিযোদ্ধা ননী ব্যানার্জির দোকান উচ্ছেদ অভিযানে অংশ নিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের সংঘাত সৃষ্টি করাই নাট্যকারে মূল উদ্দেশ্য ছিল।
নাট্যকার রঞ্জুর নষ্ট হওয়া প্রসঙ্গে মা কান্তার নির্লিপ্ততায় যে নাট্য-সংকট সৃষ্টি করেছিলেন সেই সংকটের গ্রন্থি-মোচন করে জানিয়েছেন- হায়দার আলীই একাত্তরে রঞ্জুর বাবাকে পাকিস্তানী সৈন্যদের হাতে তুলে দিয়েছিল। আর কান্তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়েছিল হিংস্র পশুর মতো। সেই পরিবারের সন্তান রঞ্জু এখন পিতার হত্যাকারী রাজাকার হায়দার আলীর হুকুমের দাস। নির্দেশ তামিলকারী আজ্ঞাবহ ভাড়াটে গুণ্ডা। মায়ের নিকট থেকে রঞ্জু তার জীবনের অতীত-কথা জানার পর হায়দার আলীর মুখোমুখি হয়ে একাত্তরের প্রকৃত ঘটনা জানতে চায়। একাত্তরের সত্য প্রকাশের সাহস কোনোদিনই ছিল না হায়দার আলীর। অতঃপর হায়দারের সাথে রঞ্জুর সম্পর্ক বিছিন্ন হয়। তবে রঞ্জু ফিরে আসলেও মুক্তিযোদ্ধা ননী ব্যানার্জির দোকান রক্ষা করতে পারে না। হায়দার আলী তার সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে পুড়িয়ে দেয় ননীদার দোকান। আর পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা আকবর নিজের জীবন দিয়ে রক্ষা করে ননী ব্যানার্জিকে।
ননী ব্যানার্জির দোকান পুড়িয়ে এবং আকবরকে হত্যা করার পর হায়দার আলী পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। আকস্মিকভাবে তখন রঞ্জু সেখানে উপস্থিত হয়ে পুনরায় একাত্তরের প্রকৃত ঘটনা তার কাছে জানতে চায়। ইতোমধ্যে নাটকের অন্যান্যরাও (বাবা, মা, ননীদা, বাবলু, শমসের, হারান, টোকন) রঞ্জুর খোঁজে হায়দার আলীর বাড়িতে উপস্থিত হয়। হায়দার আলীকে হত্যার উদ্দেশ্যে রঞ্জু গুলি ছুঁড়তে যাবে এমন মা (কান্তা) তাকে বাঁধা দেয়। কারণ, একাত্তরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে কান্তার মনে দীর্ঘদিনের ক্ষোভ ছিল হায়দারের বিরুদ্ধে। এ সময় আকস্মিকভাবে পলায়নপর জীবন-ভয়ে ভীত রাজাকার কান্তার গালে চড় মেরে বসে। তখন রঞ্জুর প্রতিশোধ হিসেবে গুলি করে হত্যা করে হায়দার আলীকে।
আবদুল্লাহ আল-মামুন তোমরাই নাটকের সমাপ্তি অনেকাংশে সিনেমাটিক করে তুলেছেন। প্রথমত, সবগুলো চরিত্রের একত্রিত হওয়া; দ্বিতীয়ত, গুলি করতে উদ্যত রঞ্জুকে তার মায়ের বাধা প্রদান; তৃতীয়ত, জীবন-ভয়ে পলায়ন-প্রবণ হায়দার আলী কর্তৃক কান্তার গালে চড় দেয়া; এসব ঘটনা নাটকে বাস্তব সম্মত হয় নি। বরং মনে হয়, এসব ঘটনা নাট্যকার কর্তৃক আরোপিত ও পরিকল্পিত। আসলে নাট্যকার আবদুল্লাহ আল-মামুন পরিকল্পিতভাবেই চেয়েছিলেন, কাহিনীর শেষে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির জয়। এজন্য তিনি কাহিনীর সমাপ্তি দৃশ্য স্ব-কল্পনায় সৃজন করে নিয়েছেন। যা কাহিনীর অনিবার্যতা নয়, বরং আরোপিত। কাহিনীর অনিবার্য পরিণামকে নাট্যকার প্রভাবিত করে এর শিল্পগুণ ক্ষুণ্ন করেছেন। সমাপ্তি দৃশ্যে এতগুলো অসামঞ্জস্য থাকার পরও কান্তার সংলাপের আবেদন বাস্তবচেতনাপ্রসূত। কান্তা দেশবাসীর উদ্দেশে বলেছে-
‘যারা যেভাবে পারছে ওদেরকে ব্যবহার করছে। ক্ষমতায় যারা আছে, তারা একভাবে, যারা ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করছে তারা আরেকভাবে। রঞ্জুরা মুক্তিযুদ্ধ দেখে নি। এই ফাঁকটা লুফে নিচ্ছে স্বাধীনতার শত্রুরা, অদৃশ্য শক্তি যাদেরকে পুনর্বাসিত করছে একের পর এক। এই নতুন চক্রান্তকে অঙ্কুরেই বিনাশ করুন।’ (তোমরাই)
মা কান্তার এই বক্তব্যে সমাজসত্য উদ্ঘাটিত হয়েছে। রঞ্জুদের দায়-দায়িত্ব যদি রাষ্ট্র-সমাজ নিতে না পারে তাহলে হয়তো সত্যিই একদিন রঞ্জুদের গুলিতেই প্রাণ হারাবে আকবরের মতো পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা; নিজের জীবিকার্জনের ঠিকানা থেকে ননী ব্যানার্জির মতো নির্ভীক মুক্তিযোদ্ধাও উচ্ছেদ হবে। বিরোধী ও ক্ষমতাসীন দু’দলকেই রঞ্জুদের প্রজন্ম সম্বন্ধে সচেতন হতে হবে। অন্যথায় একদিন হয়তো সত্যিকার অর্থে আমাদের স্বাধীনতার গৌরব হায়দার আলীরা ‘শূন্যে মিলিয়ে’ দেবে। কারণ, যে হায়দার আলীরা স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে সাধারণ ক্ষমার আওতায় পুনর্বাসিত হয়েছিল তারা এখনো পাকিস্তানের স্বপ্ন বুকে নিয়েই রঞ্জুদের প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাস ভুলিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছে। অতএব স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস উত্তর-প্রজন্মের হাতে তুলে দিতে হবে। একই সাথে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের মাধ্যমে রঞ্জুদের মতো বেকার যুবকদের কর্ম-সংস্থান করে দিতে হবে।
বিবিসাব নাটকে আবদুল্লাহ আল-মামুন বিষয়বস্তু সংগ্রহ করেছেন স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘটনা থেকে। একাত্তরে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে, কিন্তু স্বাধীনতার জন্য যে ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে উঠতে পারে নি বাংলাদেশ। এখনো দেশময় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহ সব স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে কিছু মানুষ, কিছু জীবন বেঁচে আছে। মুক্তিযুদ্ধজনিত ক্ষয়-ক্ষতির শিকার এমনই এক নারী মরিয়ম ওরফে মইরাম বিবি। স্বাধীনতা যুদ্ধে মইরাম বিবি তার স্বামী এবং যুবক দুই সন্তান (আলা-ভোলা) হারিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধার মা হিসেবে স্বাধীন দেশে তার সম্মানিত হবার কথা ছিল, কিন্তু তার পরিবর্তে মইরাম বিবি স্বাধীনতা-শত্রুদের (বসিরুদ্দি মোল্লার) ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে। বসিরুদ্দির ষড়যন্ত্রে মুক্তিযোদ্ধা-মাতার জীবিকার্জনের ন্যূনতম সম্বলটুকু হারিয়েছে। মইরাম বিবির জীবিকা-নির্বাহের উপায় গোটা দশেক রিক্সা এবং একটি রিক্সা গ্যারেজ। রিক্সার ভাড়া তুলে বস্তিতে বাস করে মইরাম বিবির একাকী জীবন কোনোভাবে চলে যায়। তবে আপদমস্তক প্রতিবাদী ও সংগ্রামী মইরাম বিবি কারো অনুগ্রহ, দয়ার ওপর নির্ভরশীল হতে চায় না।
বসিরুদ্দি মোল্লাদের মতো স্বাধীনতাযুদ্ধের বিরোধী শক্তির উত্থান এতটাই ঘটেছে যে, তাদের বাড়ির সৌন্দর্য রক্ষার জন্য মুক্তিযোদ্ধার মা মইরাম বিবির বেঁচে থাকার এবং জীবিকা উপার্জনের অবলম্বন সরকারি সহায়তায় নস্যাৎ করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র চলছে। মইরাম বিবির সংগ্রামশীলতার মধ্যে বাংলাদেশের সমকালীন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থার একটি করুণ দশা ফুটে উঠেছে। সরকার এবং রাজনীতিবিদরা এদের (ছিন্নমূল বস্তিবাসী, রিক্সা চালক) থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারে না; কিন্তু নির্বাচনের সময় এদেরকে নানা রকম আশ্বাসের কথা শোনায়, ভোট নেয়। নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়ে গেলে নিম্নবিত্তের এসব মানুষের ভাগ্য যেমন ছিল তেমনি থাকে; কোনোই পরিবর্তন হয় না। অর্থাৎ এ দেশে এখন ক্ষমতা কেন্দ্রিক রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র চরম রূপ পরিগ্রহ করেছে। যার শিকার মইরাম বিবি, জমিরুদ্দিদের মতো অসহায় সাধারণ মানুষ।
‘কোনো কোনো সত্য, আমি বিশ্বাস করি, চিরসত্য : যেমন একবার রাজাকার চিরকাল রাজাকার। … যদিও প্রকাশ করতে ভয় পাচ্ছি, একবার মুক্তিযোদ্ধা কি চিরকাল মুক্তিযোদ্ধা? নাকি মুক্তিযোদ্ধারও ঘটতে পারে আন্তর বদল, এবং হয়ে উঠতে পারে তার-একদা-শত্রুর মতো অবিকল? … অনেক বদল দেখেছি আমি, দেখেছি অন্ধকারের পাত্রপাত্রীদের সাথে মিলে গেছে আলোর সৈনিকেরা, চ’লে গেছে বিপরীত দিকে, যেদিকে তাদের যাওয়ার কথা ছিলো না। যেদিকে যাওয়ার অর্থই হলো নিজের বিরুদ্ধে যাওয়া, বাঙলার বিরুদ্ধে যাওয়া।’ (বিবিসাব)
বসিরুদ্দি মোল্লার সাথে মইরাম বিবির শত্রুতা শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। বসিরুদ্দি-মইরামের শত্রুতা পুরনো দিনের শত্রুতা। স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের চিত্র সম্পূর্ণ বদলে গেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়েছে স্বাধীনতার পক্ষের মানুষ। বসিরুদ্দি মোল্লাদের মতো স্বাধীনতা-বিরোধীরা স্বাভাবিকভাবেই দরিদ্র মানুষগুলোর অত্যাচার-নির্যাতন করতে উদ্যত হয়েছে। নাট্যঘটনায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির সাথে বিপক্ষ শক্তির সংঘাতকে অনিবার্য করে তুলেছেন। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় যেভাবে রাজাকার-আলবদর বাহিনী মা-বোনের ইজ্জতের ওপর চড়াও হয়েছিল, একইভাবে স্বাধীন দেশের সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতা বিশ্লেষণ করে নাট্যকার দেখিয়েছেন- ছিন্নমূল বস্তিবাসী জমিরুদ্দির স্ত্রী রহিমার দিকে বসিরুদ্দির মোল্লার ছোট ছেলের কুনজর পড়েছে। এমনকি রহিমাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করারও দুঃসাহস দেখিয়েছে বসিরুদ্দি মোল্লার ছেলে। কিন্তু শহীদ জননী মইরাম বিবি নারীজাতির ওপর স্বাধীন দেশে পুনরায় রাজাকারদের এই অপমান-অত্যাচারকে সহ্য করে নি। মইরাম বিবি রাজাকার বসিরুদ্দি মোল্লার ওপর এবারে সংঘবদ্ধ আক্রমণ পরিচালনায় নিরীহ বস্তিবাসীদের উদ্বুদ্ধু করেছে। মইরাম বিবির নেতৃত্বে জেগে ওঠা বাংলার নিরীহ এবং সাধারণ বস্তিবাসীর হাতে বসিরুদ্দি নিহত হয় এবং বর্তমানের সুবিধাবাদী মেম্বার (মুক্তিযোদ্ধা) পালিয়ে যায়।
রাজাকার বসিরুদ্দি মোল্লার যায়-আসে না- দেশের গরীব মানুষ বাঁচুক কিংবা মরুক। মইরাম বিবির রিক্সা গ্যারেজ তার বাড়ির শোভা বর্ধনে অন্তরায়। সুতরাং যেভাবেই হোক ঐ রিক্সা গ্যারেজ তুলে দিতে সে বদ্ধপরিকর। বসিরুদ্দি মোল্লা ষড়যন্ত্র শুরু করে মইরাম বিবির রিক্সা গ্যারেজ উচ্ছেদের। রাজাকার বসিরুদ্দি মোল্লাকে সঙ্গ দেয়- বর্তমান মুক্তিযোদ্ধা মেম্বার। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের পরিবর্তনে মেম্বারদের মতো মুক্তিযোদ্ধাদের কথা ভেবেই সম্ভবত ভীত-সন্ত্রস্ত হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন-
‘কোনো কোনো সত্য, আমি বিশ্বাস করি, চিরসত্য : যেমন একবার রাজাকার চিরকাল রাজাকার। … যদিও প্রকাশ করতে ভয় পাচ্ছি, একবার মুক্তিযোদ্ধা কি চিরকাল মুক্তিযোদ্ধা? নাকি মুক্তিযোদ্ধারও ঘটতে পারে আন্তর বদল, এবং হয়ে উঠতে পারে তার-একদা-শত্রুর মতো অবিকল? … অনেক বদল দেখেছি আমি, দেখেছি অন্ধকারের পাত্রপাত্রীদের সাথে মিলে গেছে আলোর সৈনিকেরা, চ’লে গেছে বিপরীত দিকে, যেদিকে তাদের যাওয়ার কথা ছিলো না। যেদিকে যাওয়ার অর্থই হলো নিজের বিরুদ্ধে যাওয়া, বাঙলার বিরুদ্ধে যাওয়া।’ (বিবিসাব)
ড. হুমায়ুনের বিশ্বাসেরই হুবহু প্রতিফলন ঘটেছে যেন আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিবিসাব নাটকে। কেননা রাজাকার বসিরুদ্দি মোল্লার পরিবর্তন ঘটে নি; মনে-মননে সে এখনো দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধাচরণ করে। অথচ মুক্তিযোদ্ধা মেম্বার ঠিকই ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধা লাভের জন্য দেশের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে স্বাধীন দেশেই স্বাধীনতার শত্রু বসিরুদ্দি মোল্লার সাথে হাত মিলিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা-মাতা মইরাম বিবি ও মেম্বারের সংলাপ থেকে ড. আজাদের আশঙ্কা যে অমূলক নয় সে-কথাই প্রতীয়মান হয়। যথা-
মইরাম
স্বাধীনের পরে পরে আপনে ভাষণ দিছেন না, বসিরুদ্দি মোল্লা শান্তিকমিটির মেম্বর আছিলো অর দুই পোলা আছিলো বদর বাহিনী? স্বাধীন বাংলাদেশে অগো মাপ নাই … দিছেন না এই ভাষণ?
মেম্বার
তা দিছি।
মইরাম
তাইলে?
মেম্বার
অহনে দিনকাল অন্যরহম হইয়া গেছে বিবিসাব।
মইরাম
দিনকাল অন্যরহম হয় নাই। অন্যরহম হইছেন আপনেরা, ক্ষ্যামতার নিশায় পাইছে আপনেগো। ক্ষ্যামতায় যাওনের লিগা আপনেরা আইজকা এই পাট্টি করেন, কাইলকা ঐ পাট্টি। আপনেরা মনে করেন পাবলিক কিছু বুজে না। পাবলিক হইতাছে গরু ছাগল হেগো যেই দিকে খেদাইবেন হেরা সেই দিগেই যাইবো।- (বিবিসাব)
অবশ্য এই সুবিধাবাদী মুক্তিযোদ্ধা মেম্বারের পালিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে নাট্যকার তাদের মতো সুবিধাবাদী মু্িক্তযোদ্ধাদের হয়তো আরো একবার সুযোগ দিতে চান।
এ নাটকের মূল সংকট বসিরুদ্দি মোল্লা কর্তৃক মইরাম বিবির রিক্সা গ্যারেজ উচ্ছেদের পরিকল্পনায়। অথচ এই রিক্সা গ্যারেজটি মইরাম বিবি ও বস্তিবাসী ছিন্নমূল মানুষগুলোর জীবন-জীবিকা নির্বাহের উপায়। অন্যদিকে বসিরুদ্দি মোল্লার বাড়ির সৌন্দর্য নষ্টের অজুহাত। অতএব মইরাম বিবি ও বসিরুদ্দি মোল্লার মধ্যে সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠেছে। মুক্তিযোদ্ধা হয়েও মেম্বার স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে পুনবার্সিত রাজাকার বসিরুদ্দির পক্ষাবলম্বন করেছে। বসিরুদ্দি ও মইরাম বিবির সৃষ্ট সংঘাতকে নাট্যকার চরমতর করে তুলেছে- ছিন্নমূল জমিরের স্ত্রী রহিমার প্রতি রাজাকারের ছোট ছেলের কু-প্রস্তাব ও তার গায়ে হাত দেওয়ার মধ্য দিয়ে।
ড. হুমায়ুনের বিশ্বাসেরই হুবহু প্রতিফলন ঘটেছে যেন আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিবিসাব নাটকে। কেননা রাজাকার বসিরুদ্দি মোল্লার পরিবর্তন ঘটে নি; মনে-মননে সে এখনো দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধাচরণ করে। অথচ মুক্তিযোদ্ধা মেম্বার ঠিকই ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধা লাভের জন্য দেশের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে স্বাধীন দেশেই স্বাধীনতার শত্রু বসিরুদ্দি মোল্লার সাথে হাত মিলিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা-মাতা মইরাম বিবি ও মেম্বারের সংলাপ থেকে ড. আজাদের আশঙ্কা যে অমূলক নয় সে-কথাই প্রতীয়মান হয়।
আবদুল্লাহ আল-মামুন মেহেরজান আরেকবার নাটকে মূল বিষয়বস্তু ও উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন মুক্তিযুদ্ধের বীজ থেকে। স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে স্বাধীনতার শত্রুরা কীভাবে দেশে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে এবং তাদের হাতে বিশেষত ধর্মীয় মৌলবাদীদের হাতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষের দুর্দশা কতটা ভয়ানক আকার ধারণ করেছে তা তুলে ধরেছেন। নাট্যকারের মূল প্রেক্ষণবিন্দু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং এর বিরোধী-শক্তির সাথে সংঘাত-সংঘর্ষের ওপর নিবদ্ধ থেকেছে। নাট্যকার মেহেরজান আরেকবার-এ সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থান দৃশ্য অঙ্কন করেছেন।
এ নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র মেহেরজান। এই মহিয়সী নারী স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় সবকিছু হারিয়েছে এবং স্বাধীনতার পরে মৌলবাদীদের ফতোয়ার শিকার হয়েছে; পরন্তু নদী ভাঙনের কবলে পড়ে সর্বস্ব হারিয়ে ঢাকার শহরে এক নিম্নমানের হোটেলে (সোনার বাংলা হোটেল এ্যাণ্ড রেস্টুরেন্টে) মেয়ে পরী এবং বিধবা পুত্রবধূ সকিনাকে সঙ্গে রান্নার কাজ করে জীবিকা-নির্বাহ করতে বাধ্য হয়েছে। আবদুল্লাহ আল-মামুন মেহেরজান আরেকবার-এ হোটেলের নামটি প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছেন। হোটেল ‘সোনার বাংলা’র হতশ্রী অবস্থা এবং মালিক-কর্মচারীদের দৈন্য-দশার মাধ্যমে নাট্যকার যেন স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের দৈন্যদশাকেই মূর্ত করে তুলতে চান।
মেহেরজানের বিধবা পুত্রবধূ সকিনা; স্বামীর মৃত্যুর পরও এই জনম দুঃখী নারী ফিরে যেতে পারে নি বাবা-মা কিংবা ভাইদের কাছে। কেননা জোতদার তার পরিবারে সবকিছুই দখল করে নিয়েছিল। ফলে বিধবা হওয়া সত্ত্বেও শাশুড়ীর সাথেই থাকতে হয়েছিল সাকিনাকে। তাই সকিনার ভাগ্যও শাশুড়ী-ননদীনীর বিপর্যস্ত-বিপন্ন জীবন বাস্তবতার সাথে জড়িয়ে যায়। সেও ‘সোনার বাংলা’ হোটেলে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করত। তবে সকিনা বিধবা হলেও ভালোবেসেছিল প্রতিবাদী যুবক হিটলারকে। কিন্তু সমাজ-সংসার এবং শাশুড়ীর ভয়ও সকিনা একেবারে উপেক্ষা করতে পারে নি। তবে শাশুড়ী মেহেরজানকে ভয় করার কিছু ছিল না; কারণ এই মহিয়সী নারী অবলীলায় তার বিধবা পুত্রবধূর ভালোবাসাকে মেনে নিয়ে সকিনাকে প্রতিবাদী হিটলারের হাতে তুলে দিতে পেরেছে। অবশ্য এখানে নাট্যকার নাটকীয়তা সৃষ্টি করে জানিয়েছেন যে- রাজাকার হাজী সাহেবের অত্যাচার থেকে পুত্রবধূ সকিনার ইজ্জত রক্ষার স্বার্থেই সকিনাকে তুলে দিয়েছে হিটলারের হাতে। যে-কারণেই হোক-না কেন, হিটলারের হাতে সকিনা তুলে দিয়ে মেহেরজান নারীর যৌন-জীবনের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছে।
ট্রাক ড্রাইভার শিকদার মেহেরজান আরেকবার নাটকের মুক্তিযোদ্ধা। শিকদার বন্দুক হাতে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। একদিন যে হাতে শিকদার বন্দুক চালিয়েছিল আজ তার সেই হাতেই আলবদর বাহিনীর নেতার ট্রাক চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে বাধ্য হয়েছে। এবং শেষ পর্যন্ত হাজী সাহেবের অন্যায়-অত্যাচারের প্রতিবাদ করতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে আসতে পারলেও স্বাধীন দেশের শত্রুদের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে নি। স্বাধীনতা-বিরোধী শক্তির হাতে মুক্তিযোদ্ধা শিকদার ড্রাইভারকে প্রাণ দিতে হয়েছে স্বাধীন দেশের মাটিতে।
মেহেরজান আরেকবার নাটকে স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থানে এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনার পরাজয়ের চিত্র এঁকেছেন। বাংলাদেশে মৌলবাদ তথা সাম্প্রদায়িকতার ভিত তৈরি হয়েছিল ১৯৭২ সালের মূল সংবিধান পরিবর্তন করে ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে ২ক নং অনুচ্ছেদ পরিবর্তন করে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে।৬৩ যদিও অন্যান্য ধর্ম শান্তিতে পালনের বিধানও সংবিধানে রাখা হয়েছিল, তথাপি ইসলাম ধর্মাবলম্বী জনগণের সংখ্যাধিক্যে স্বার্থন্বেষী ধর্ম-ব্যবসায়ীগণ কর্তৃক ধর্মের অবাধ অপব্যবহার শুরু হয়। ফলে স্পষ্টতই দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবর্তে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ে। এজন্যই মেহেরজানকে ফতোয়ার শিকার হতে হয় এবং পুনর্বাসিত আলবদর বাহিনীর নেতা হাজীর হাতে নির্মম অত্যাচারে নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধা শিকদার এবং হোটেল সোনার বাংলার নিরীহ মালিকও আলবদর বাহিনীর নেতার হাতে মৃত্যু বরণ করে।
আবদুল্লাহ আল-মামুন তাঁর রচিত নাটকের মাধ্যমে সমাজ-জীবনে, ব্যক্তি-মানসে আশার আলো ছড়িয়ে দিতে চান- মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশবাসী উজ্জীবিত হোক এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধনের গড়ে তুলুক এক সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ; যে বাংলাদেশের সকল নাগরিকের জীবনে স্বাধীনতার সুফল বয়ে আসবে, আসবে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক মুক্তির প্রাণস্পন্দন।
আবদুল্লাহ আল-মামুনের নাট্য-সংলাপ বলিষ্ঠ, তীক্ষ্ণ-ক্ষুুরধার, তীব্র আবেগী এবং নাট্য-পরিণতি সংহত প্রায়শ ট্র্যাজিক, বহুক্ষেত্রে মিলনাত্মক। তিনি নাট্যমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে যেমন সমুন্নত করে তুলতে চান, তেমনি ধর্মনিরপেক্ষ অসম্প্রদায়িক চেতনা, স্বদেশপ্রেম এবং ব্যক্তিগত আশা-আকাক্সক্ষা, স্বপ্ন-বাসনার অকৃত্রিম ও সাবলীল উপস্থাপনে কুশলী। তাঁর নাটক সম্পর্কে বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেছেন-
‘আবদুল্লাহ আল-মামুনের নাটকে, আমরা লক্ষ্য করি, মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের নানা আলোড়ন-বিলোড়ন, মূল্যবোধহীনতা, রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচার, স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতি এবং উত্তরণে আহ্বান। শিল্পী আবদুল্লাহ আল-মামুনের স্বাতন্ত্র্য এখানে যে, নিখিল নিরাশার প্রান্তরে বাস করেও তিনি মানুষকে শোনান আশার সংলাপ, তাঁর সৃষ্টিসম্ভার হয়ে ওঠে অনিঃশেষ শান্তিকামী আলোর অপরূপ-উৎস।’ (মেহেরজান আরেকবার)
তিনি মৌলবাদী শক্তির উত্থান দেখিয়েছেন বিবিসাব, মেরাজ ফকিরের মা এবং মেহেরজান আরেকবার নাটকে। মেরাজ ফকির শেষ পর্যন্ত মায়ের ধর্ম এবং মানব ধর্মে প্রত্যাবর্তন করেছে এবং গ্রামের প্রগতিশীল মানুষ মাস্টারের সহায়তায় গেদা মুন্সির মোকাবিলা করে মা আলোবিবি ওরফে আলোরাণীকে, তার পরিবারকে মৌলবাদীদের হাত থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু মেহেরজান আরেকবার নাটকের মেহেরজান এবং মুক্তিযোদ্ধা শিকদার ড্রাইভারকে স্বাধীন দেশে স্বাধীনতা-বিরোধী মৌলবাদী শক্তির হাতেই জীবন হারাতে হয়েছে। অন্যদিকে বিবিসাব নাটকের মইরাম বিবিও রাজাকার বাহিনীর নেতা বসিরুদ্দি মোল্লাকে সাধারণ জনগণের সহায়তায় চরম শাস্তি প্রদান করে। কিন্তু এ প্রসঙ্গে এটাও মনে রাখা দরকার যে, নাট্যকার স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে নাট্যরচনায় ব্রতী হয়েছিলেন বলেই মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তিকে নাট্য-ঘটনায় নিজে উপস্থিত থেকে যেন পরাজিত করেছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিল্পসঙ্গতিহীন হলেও নাট্যকার মামুন স্বাধীনতার পক্ষের তথা প্রগতিশীল আধুনিক চিন্তাচেতনার জয় দেখিয়েছেন। আবদুল্লাহ আল-মামুন তাঁর রচিত নাটকের মাধ্যমে সমাজ-জীবনে, ব্যক্তি-মানসে আশার আলো ছড়িয়ে দিতে চান- মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশবাসী উজ্জীবিত হোক এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধনের গড়ে তুলুক এক সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ; যে বাংলাদেশের সকল নাগরিকের জীবনে স্বাধীনতার সুফল বয়ে আসবে, আসবে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক মুক্তির প্রাণস্পন্দন।
cheap cialis pills for sale tadalafil brands
lowest price cialis tadalafil daily online
tadalafil order online no prescription tadalafil generic
cialis without prescription tadalafil blood pressure
canada generic tadalafil buy cialis pills
cialis without prescription where to buy cialis without prescription
cost tadalafil generic where to buy tadalafil on line
tadalafil dosage cost tadalafil generic
lowest price cialis tadalafil daily online
buy tadalis tadalafil dosage
best price usa tadalafil cialis at canadian pharmacy
canada generic tadalafil best price usa tadalafil
cialis without prescription buy cialis pills
tadalafil price walmart tadalafil order online no prescription
https://cialisusdc.com/ generic cialis tadalafil
tadalafil cost in canada cheapest tadalafil cost
side effects of tadalafil where to buy cialis without prescription
cost tadalafil generic buy cialis pills
tadalafil online tadalafil without a doctor prescription
cost provigil 100mg
buy modafinil 200mg pill provigil 100mg brand
modafinil 200mg cost buy generic provigil order modafinil
why Is 40mg Of Cialis Harmful?
how Long Before Sex Can I Take Cialis?
when To Take Cialis?
provigil 100mg generic buy provigil pills
what Does Cialis Pill Look Like?
สุดยอดเกมสล็อตจากค่าย PGเป็นการเข้าร่วมกิจกรรมที่มีประโยชน์มากมายสำหรับผู้เล่นเกมทุกคน ซึ่งเหตุผลหลักที่ทำให้เราต้องเข้าร่วมค่ายนี้ ได้แก่ PG SLOT
how to buy cialis 5 g dL, increasing the Hb level up to 14 g dL with erythropoiesis stimulating agents ESAs progressively decreased left ventricular ejection fraction LVEF and cardiac output, 13 probably because a higher hematocrit value leads to increased blood viscosity and decreased nitric oxide availability, thereby raising systemic vascular resistance and afterload
cialis 10mg E PSD analysis shows that unlike iKO p q mice, a similar PSD distribution in the iKO p q g mouse at DP1i21 to that before tamoxifen induction Pre tamo