অনিন্দিতার কাছে অর্ণবের চিঠি

অর্ণব আশিক

অনিন্দিতা,

গতকাল ফোনে বাংলা সাহিত্যে চিঠিপত্রের প্রভাব নিয়ে কথা হচ্ছিল তোমার সাথে। আজ ২৫শে বৈশাখ রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের দিন। তাঁর পত্রাবলি নিয়েই কিছু বলি।

রবীন্দ্রনাথের পত্রাবলি বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। তা বাংলা সাহিত্যকে দারুণভাবে প্রবাবিত করেছে। কবি তার জীবনের গভীরতম ভাষ্য ‘ছিন্নপত্রাবলী’তে উল্লেখ করেছেন। তিনি জীবনে যে পরিমাণ চিঠি লিখেছেন তা আর কোনো সাহিত্যিক লেখেননি। তার চিঠি কয়েকটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। প্রধান দু’টি শ্রেণী হচ্ছে আত্মউদঘাটনমূলক পত্র এবং প্রয়োজন নির্ভর পত্র।

চিঠির জন্য কবির ব্যাকুলতার তীব্রতা প্রকাশ পেয়েছে ‘মানসী’ কাব্যগ্রন্থের ‘পত্রের প্রত্যাশা’ কবিতায়। এই কবিতায় রবীন্দ্রনাথ বলছেন, চিঠি কই, কই চিঠি। ‘চিঠি’ নামে কবিতাটি আছে ‘পূরবী’তে। ‘পত্র’ শিরোনামেও তার কয়েকটি কবিতা আছে বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থে।

ইন্দিরা দেবীকে লেখা চিঠিসমূহে কবিজীবনের গভীরতম ভাষ্য ফুটে উঠেছে। এইসব চিঠিই ‘ছিন্নপত্রাবলী’ নামে বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ সর্বাধিক চিঠি লিখেছেন নির্মলকুমারী মহলানবিশকে। ১৯২৫ থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত চিঠি লিখেছিলেন প্রায় পাঁচশ। এই চিঠিগুলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য সৃষ্টির এক অসামান্য নিদর্শন। ব্যক্তি এখানে তুচ্ছ বা গৌণ- সৃষ্টিকর্মই উজ্জ্বল এখানে।

রবীন্দ্রনাথ বলেছেন : ‘তাঁর চিঠি হল ভিড়ের আড়ালে অন্তরঙ্গ মানুষের সঙ্গে আলাপ প্রতিলাপ তা সর্বসাধারণের সাহিত্য দরবারে উপস্থাপিত করবার নয়’।

ভিড়ের আড়ালে অন্তরঙ্গজনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পত্রালাপ যে সাহিত্য তার প্রমাণ কবির ভাইঝি ইন্দিরা দেবীকে লেখা ছিন্নপত্রাবলী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দের ১৬ মে ইন্দিরা দেবীকে চিঠি লিখেছিলেন শিলাইদহ থেকে। এই চিঠির প্রতিটি শব্দ এবং বাক্যে কবির সাহিত্য সৃষ্টির অসাধারণ দক্ষতা লক্ষ্য করা যায়।

‘আমি প্রায়ই মনে করি, এই তারাময় আকাশের নীচে আবার কি কখনও জন্মগ্রহণ করব? যদি করি, আর কি কখনও এমন প্রশান্ত সন্ধ্যাবেলায় এই নিস্তব্ধ গোরাই নদীটির উপর বাংলাদেশের এই সুন্দর একটি কোণে এমন নিশ্চিন্ত মুগ্ধ মনে জলিবোটের উপর বিছানা পেতে থাকতে পাব? হয়তো আর কোন জন্মে এমন একটি সন্ধ্যাবেলা আর কখনো ফিরে পাব না। তখন কোথায় দৃশ্যপরিবর্তন হবে। আর কিরকম মন নিয়েই বা জন্মাব। এমন সন্ধ্যা হয়তো অনেক পেতেও পারি, কিন্তু সে সন্ধ্যা এমন নিস্তব্ধভাবে তার সমস্ত কেশপাশ ছড়িয়ে দিয়ে আমার বুকের উপর এত সুগভীর ভালোবাসার সঙ্গে পড়ে থাকবে না। আমি কি এমন মানুষটি তখন থাকব? আশ্চর্য এই আমার সবচেয়ে বড় ভয় হয় পাছে আমি য়ুরোপ গিয়ে জন্মগ্রহণ করি।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৫ সালের ১৮ জুলাই শিলাইদহ থেকে পুত্র রথীন্দ্রনাথকে লিখেছেন : ‘রথী, শিলাইদহে এসেছি। … অনেকদিন পরে জলের ধারা ও সবুজ মাঠের সংশ্রব ও নির্জন পেয়ে আমি যেন নিজের সত্যকে আবার ফিরে পেয়েছি। এখানেই সুদীর্ঘকাল থাকতে ইচ্ছা করছে। নিভৃত প্রকৃতির হাতে সুশ্রুষা আমার পক্ষে একান্ত দরকার- সে জন্যই জীবনের ও সংসারের সমস্ত জঞ্জাল ছিন্ন করে ফেলে সুদূরে পালাবার জন্যে আমার মন এত ছটফট করছিল।’

রবীন্দ্রনাথ শেষ চিঠি লিখেছিলেন পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীকে। মৃত্যুর এক সপ্তাহ আগে ১৯৪১ সালের ৩০ জুলাই ৭টি বাক্যের ওই চিঠিতে তিনি লেখেন : ‘তোমাকে নিজের হাতে কিছু লিখতে পারিনে বলে কিছুতে লিখতে রুচি হয় না।’

আমার প্রিয় একটি পত্র কাব্যের আবৃত্তি দিলাম। বুদ্ধদেব গুহের কথপোকথনের চিঠিময় উপন্যাসের কাব্য রূপ।
এখানে দুটি মূখ্য চরিত্র। যারা চিঠি আদান প্রদান করেছে এবং যাদেরকে উপজিব্য করেই এ উপন্যাস শুরু ও সমাপ্তি।
একজন রাজর্ষী অন্যজন রীতি রায়। অনিন্দিতা’র মধ্যে আমিও একজন রীতি রায়কে খুঁজে ছিলাম।
সে যাক, আমি রাজর্ষির মত নই। ভালোলাগা ভালোবাসা এসব হলো নবীন জোয়ারের মত, তাতে ঘোলা জল না পরিস্কার জল তা বিচার করা যায় না।

এখন ভোর প্রায়, ভোরের নির্জনতা এই ভোরকে দারুণ নিঃসঙ্গ করছে, এই আমার মত। আর এর পেলবতা প্রকৃতিকে অপার স্নিগ্ধতায় জড়িয়ে আছে। মানুষ এরকম নির্জনতায় ও পেলবতায় আপন সুহৃদকে ভাবে, নিজের বুকের গভীরে, একান্ত করে।

আমিও ভাবছি যদিও জানি এ ভাবনা হলো ঘোলা জলে মাছ শিকার বা তীরে বসে নদীর ঢেউ গোনবার মতো।
আমার বুকের লম্বা সূতো ছড়ানোই থাকলো, কাউকে সে ভালোবাসার বাঁধনে বাঁধতে পারলো না সে তার ব্যর্থতা। আমি আগুন মুখে সাঁতরে চলা মানুষ, অনন্তকাল প্রহর গোনা আমার স্বভাব। তবুও বুকের ভিতর একফালি চাঁদ শত লন্ড ভন্ড করা ঝড়েও ঠিকই থাকে।
নিত্য দিনের যোগাযোগ থাকবে, থাকবেই।
ভালো থেকো।

অর্ণব

মোঃ হুমায়ূন কবীর । লেখক নাম অর্ণব আশিক

জন্ম : ১ জানুয়ারি ১৯৫৫ টবগী, বোরহানউদ্দীন, ভোলা । স্নাতক সম্মান ও স্নাতকোত্তর বাংলা সাহিত্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা।

কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধে নিরন্তর নিবেদিত প্রাণ । প্রকাশিত বই-র সংখ্যা ১০ (দশ)

কবিতা : অর্ণব আশিক